ক. ঈশান নাগর : অদ্বৈত প্রকাশ
গৌড়ীয় বৈষ্ণবসাহিত্যে মহাপ্রভুর জীবনসংক্রান্ত অমূল্য গ্রন্থাবলি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগকে আলোকদীপ্ত করেছে। মধ্যযুগের প্রায়ান্ধকার তামসিকতার বুক চিরে যে অনির্বাণ দীপশিখা বঙ্গভূম সহ সারা দেশকে আলোকিত করে তাঁর নাম শ্রীচৈতন্য। একটি প্রদীপের আলো থেকে একটি দুটি করে প্রদীপ আলোকিত হয়। তারপর শতশত লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বলে ওঠে। বৈষ্ণবভাবাদর্শ প্রকাশে পঞ্চতত্ত্ব যদি রূপকার হয়, গোস্বামী তবে প্রকাশক। শ্ৰীশ্ৰী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রকাশিত নবম পরিচ্ছেদ-৭, চরিতশাখা অংশে (শ্রীচৈতন্য যুগ ১৪০৭-১৫০০ শকাব্দ) চরিতকথাগুলি নিম্নরূপ : মুরারী গুপ্তের কড়চা (১৪২৫), প্রদ্যুম্ন মিশ্রের শ্রীকৃষ্ণচৈতনোদয়াবলী, স্বরপদামোদরের কড়চা, কবিকর্ণপুরের শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় (১৪৯৪ শক), বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত (১৪৯৭ শক) ১৪৯৫ (প্রেমবিলাস মতে), অদ্বৈতপ্রকাশ (১৪৯০), কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (১৫৩৭ বা ১৫৩৪ শক ইত্যাদি।
অদ্বৈতকে যেমন শিব-অবতার বলা হয়ে থাকে, তেমনই তাঁকে চৈতন্যলীলার ভূমি-প্রস্তুতকারক হিসাবে দেখা হয়। বিভিন্ন চরিতগ্রন্থ বিচারে দেখা যায় গৌরাঙ্গের আবির্ভাব কালে অদ্বৈতের বয়স ছিল বাহান্ন বছর। আবার মহাপ্রভুর অপ্রকটের পরেও আরও প্রায় কুড়ি বছর ধরাধামে ছিলেন অদ্বৈত। অদ্বৈত গৌরাঙ্গের ‘শিক্ষাগুরু’ আবার চৈতন্যের ‘শিষ্য’ বা ‘দাস’। অপার অনন্ত এই লীলা মাধুর্য। প্রায় সব চরিতকথায় অদ্বৈতপ্রসঙ্গ এসেছে অনুপম সৌকর্যে। কিন্তু অদ্বৈত সংক্রান্ত সম্পূর্ণ কোন জীবনচরিত ছিল না। কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা অদ্বৈতের জন্ম বাল্য ও কৈশোরের বিবরণের চুম্বকমাত্র। বনস্পতিপ্রতিম এই মহাত্মার প্রায় সম্পূর্ণ জীবনের রূপরেখা পাওয়া গেল ঈশাননাগরের অদ্বৈতপ্রকাশে। শুধু অদ্বৈত পরিবার, ভক্ত ও অনুরাগী নন, সমগ্র বঙ্গজীবনে অদ্বৈতপ্রকাশ- এর একটি বিশেষ স্থান।
ঈশাননাগরের পরিচিতি ও অদ্বৈতপ্রকাশ দীর্ঘদিন অগোচরে ছিল। ‘শ্রীযুক্ত অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি মহাশয় ১৩০৩ সালের মাঘ মাসের সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকায় সর্বপ্রথমে এই গ্রন্থের পরিচয় প্রদান করেন।’ বিমানবিহারী, পৃ. ৪৩৩। গ্রন্থের ভূমিকায় অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি যে ভাষায় গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট ও বিবরণ প্রকাশ করেছেন, হুবহু তাই তুলে দিলাম :
অদ্বৈতের দেহত্যাগে ঈশান তাঁহার আজ্ঞানুসারে পুনর্ব্বার পূর্ব্ববঙ্গে আগমন করিতে উদ্যত হইলেন। ঈশানকে পূর্ব্ববঙ্গে ধর্ম্মপ্রচারার্থ যাইতে দেখিয়া, সীতাদেবী তাঁহাকে দুইটি আদেশ করেন—১) অদ্বৈতচরিত্র বর্ণন করিতে, ২) শ্রীহট্টে গিয়া বিবাহ করিতে।
ঈশান তখন বৃদ্ধ, তাই তিনি সবিনয়ে এই বিবাহরূপ অদ্ভুত আদেশের প্রতিবাদ করেন, কিন্তু তাঁহাকে সীতাদেবীর আদেশ পালন করিতেই হইয়াছিল। শ্রীহট্টে ঈশানকে পুনর্ব্বার বাড়ী করিতে হইয়াছিল। শ্রীহট্টে ধর্ম্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ঈশান অদ্বৈতপ্রভুর লীলাঘটিত যে গ্রন্থখানি প্ৰণয়ন করেন, তাঁহারই নাম “অদ্বৈত-প্রকাশ”। এই অদ্বৈতপ্রকাশ প্রণয়নকালে ঈশান পূর্ব্বোক্ত “বাল্যলীলাসূত্র” হইতেও অনেক সাহায্য প্রাপ্ত হন। কেননা, অদ্বৈতের বাল্যলীলা তিনি স্বয়ং দেখেন নাই। ঈশান একথা স্বয়ং স্বীকার করিয়াছেন। অদ্বৈতের আবাল্য সঙ্গী পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তী ও শ্যামদাস আচার্য্যের মুখেও তিনি অনেক ঘটনা শুনিয়াছিলেন।
এই অদ্বৈতপ্রকাশ শ্রীহট্টবাসী ঈশানদাস কর্তৃক শ্রীহট্টে (নবগ্রামে) বিরচিত হয়। অদ্বৈত-প্রকাশে অদ্বৈতপ্রভুর জীবনী সম্বন্ধে প্রধান প্রধান ঘটনার অনেকেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ ঘটনাবলী বর্ণনার নাম “কড়চা” বা ‘সূত্র”। অতএব অদ্বৈত-প্রকাশের নামান্তর ঈশানদাসের কড়চা। ঈশান বলেন—
“সাধু মুখে শুনি আর হে কিছু দেখিনু।
তার সূত্র বিন্দুমাত্র প্রকাশ করি।”
এই “সাধু মুখে” অর্থ পূৰ্ব্বকথিত পদ্মনাভ ও শ্যামদাসের মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন। বস্তুতঃ এই গ্রন্থে গ্রন্থকারের প্রত্যক্ষীভূত ঘটনাই অধিক লিখিত হইয়াছে। যথা অদ্বৈতপ্রকাশে—
“যাহা দেখি তাহা লিখি না বুঝিনু মৰ্ম্ম।
যৈছে শুক গীত গায় শিক্ষণের ধৰ্ম্ম।।
অদ্বৈতপ্রকাশ যখন প্রণীত হন, গ্রন্থকার তখন বৃদ্ধ—বয়স ৭০ বর্ষের ঊর্দ্ধ। গ্রন্থখানি ১৪৯০ শকে বিরচিত হয়। যথা-অদ্বৈতপ্রকাশ–
“চৌদ্দশত নবতি শকাব্দ পরিমাণে।
লীলাগ্রন্থ সাঙ্গ কৈনু শ্রীলাউড় ধামে।।”
এই ঈশানের বংশধরগণ এখনও আছেন, কিন্তু আর তাঁহারা লাউড়ের অধিবাসী নহেন। অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি।। ভূমিকা।। অদ্বৈতপ্রকাশ।। পৃ.২৩
ঈশান সম্পর্কে বিশেষ জানার উপায় নাই। তার কারণ তিনটি—ঈশাননাগর যে কালে অদ্বৈতপ্রকাশ লিখছেন তার আগে ও পরে শ্রীচৈতন্য সংক্রান্ত অমর চরিতকথাগুলি প্রকাশিত হয়েছে। আকরগ্রন্থগুলি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে বিপুলভাবে আদৃত। এই সময় অদ্বৈতপ্রকাশের মত অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ কলেবর একটি গ্রন্থ অগোচরে থাকারই কথা। দ্বিতীয়ত, ঈশাননাগরের গ্রন্থটি প্রকাশিত হচ্ছে পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট থেকে। সমকালীন বিদ্যাচর্চার পীঠস্থান নবদ্বীপ বা তৎসংলগ্ন কোন ক্ষেত্র থেকে নয়। যদিও মহাপ্রভু, অদ্বৈতাচার্য এবং ঈশান—তিন জনেরই আদিভূম শ্রীহট্ট (অধুনা সিলেট)—পূর্বে ঢাকা দক্ষিণ। মহাপ্রভুর পিতা জগন্নাথ মিশ্র, অদ্বৈত এবং ঈশানের জন্ম শ্রীহট্টে। তৃতীয়ত, যে স্থানে অদ্বৈতপ্রকাশ রচিত হয়, শ্রীহট্টের লাউড়ের ধ্বংসপ্রাপ্তি। গ্রন্থটির ভাষাশৈলি, রচনার প্রসাদগুণ, সরল ব্যাখ্যা, মেদবর্জিত বিবরণ পাঠককে আকৃষ্ট করে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই গ্রন্থের একবিংশতিতম অধ্যায়টি এক অমূল্য সম্পদ। প্রত্যক্ষদর্শী ঈশানের চোখে বিষ্ণুপ্রিয়ার যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে তা পদকর্তা, বৈষ্ণবসমাজে ও পাঠকের কাছে অমূল্য সম্পদ। বস্তুত মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগ্রহণের পর থেকে শচীদেবী ও বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর জীবনযাপন সম্পর্কে সাধারণ্যে বিপুল জিজ্ঞাসা অদ্যাপি বিরাজিত। সেই কৌতূহলের অনেকখানি নিবারণ করেছেন ঈশান। যদিও জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে এবং প্রেমবিলাসে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর সাধনপ্রণালীর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়, সে বর্ণনা ঈশানের বর্ণনার মত মর্মস্পর্শী নয়।
ঈশাননাগরের জন্মস্থান শ্রীহট্টে এ উল্লেখ আগেই করেছি। গ্রামের নাম নবগ্রাম। লাউড় পরগণা। জন্ম আনুমানিক ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর এবং অদ্বৈতাচার্যের পুত্র অচ্যুতের জন্মকাল প্রায় সমসাময়িক ‘চৌদ্দ শত চৌদ্দ শকের বৈশাখি পূর্ণিমা।’ ঈশানের বিবরণ মত অচ্যুতের বিদ্যারম্ভের দিন তাঁকে নিয়ে তাঁর জননী অদ্বৈতগৃহে আসেন :
ক্রমে শ্রীঅচ্যুত পাঁচ বৎসরের হৈলা।
শুভক্ষণে প্রভু তার হাতে খড়ি দিলা।।
যেই দিন শ্রীঅচ্যুত বিদ্যারম্ভ কৈলা।
সেই দিন মোর মাতা শান্তিপুরে আইলা।।
শ্রীঅদ্বৈত পদে আসি লইলা শরণ।
পঞ্চম বৎসর মোর বয়স তখন।। অ.প্র. ৪৫
দিনক্ষণে বোঝা যায় ঈশান ও অচ্যুত সমবয়সী। সেদিক দিয়ে দেখলে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) থেকে ছ’বছরের ছোট। গবেষক বিমানবিহারী মজুমদার বলছেন : ‘অদ্বৈতপুত্র অচ্যুতের পাঁচ বৎসর বয়সে যেদিন হাতে খড়ি হয়, সেইদিন পঞ্চবর্ষ বয়স্ক ঈশানকে লইয়া তাঁহার মা আসিয়া অদ্বৈতগৃহে উপস্থিত হয়েন। (একাদশ অধ্যায়, পৃ. ৪৫, তৃতীয় সং)। তাঁহার গ্রন্থে পাওয়া যায় যে ১৪১৪ শকে বৈশাখী পূর্ণিমায় অচ্যুতের জন্ম। তাহা হইলে অচ্যুত ও ঈশান শ্রীচৈতন্য অপেক্ষা মাত্র ছয় বৎসর দুই মাসের ছোট।’ শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান, বিমানবিহারী মজুমদার, পৃ. ৪৪০।
কীভাবে অদ্বৈত-পরিবারে মাতাসহ ঈশানের আশ্রয় হল তার বিবরণ :
প্রভু দয়া করি মায়ে দিলা কৃষ্ণ-মন্ত্র।
মোরে হরিনাম দিয়া করিলা পবিত্র।।
মোরে পাঞা সীতাদেবী স্নেহ প্রকাশিলা।
আপন তনয় সম পোষণ করিলা।।
শ্রীগুরুর আজ্ঞাবহা ছিলা মোর মাতা।
কিছু কিছু মোর মনে পড়ে সেই কথা।।
প্রভু কহে ঈশানের মাতা পুণ্যবতী।
পরকালে হৈবে ইহার বৈকুন্ঠে বসতী।।
ঈশান বা ঈশানজননী ঠিক কোন স্থান থেকে শান্তিপুরে আসেন এবিষয়ে নির্দিষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না। লাউড় থেকে তাঁর আগমন ও বংশ পরিচয়ের অন্যদিক গুলি অপরিচিত থেকে যায়। এবিষয়ে অদ্বৈতপ্রকাশের ভূমিকায় শ্রী অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি (ঢাকা উথলী নিবাসী শ্রীঅদ্বৈতের উত্তরপুরুষ শ্রীল শ্রীনাথ গোস্বামী প্রদত্ত হস্তলিখিত পুঁথির পরিপ্রেক্ষিতে) বলছেন :
শ্রীঅদ্বৈতপ্রকাশ প্রকাশিত হইল, ইহা মহাজনের মৌলিক কীর্তি, রচয়িতার নাম শ্রীলঈশান নাগর। ঈশান শ্রীমদদ্বৈত প্রভুর শিষ্য ও অনুচর ছিলেন। ঈশানের পিতা ছিলেন দরিদ্র ব্যক্তি—আত্মীয়-বন্ধু বিহীন। ঈশানের যখন পিতৃবিয়োগ ঘটে, তখন তাঁহার বয়ঃক্রম পাঁচ বৎসর মাত্র; পাঁচ বৎসরের অপোগণ্ড শিশু লইয়া দু:খিনী ঈশান-জননী ভীষণ সংসারসাগরে ভাসিলেন। ঘরে যৎসামান্য তৈজসপত্র ছিল, প্রতিবাসিগণের পরামর্শ ও আদেশে তাহা বিক্রয় করিলেন, এবং তদ্দারা কোন প্রকারে পতির ঔর্দ্ধদৈহিক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হইল। ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষা হইল বটে, কিন্তু ঈশানের প্রাণরক্ষার উপায় থাকিল না। ঘরে থাকিলে না খাইয়া সপুত্রে মরেন, কাজেই অনাথা বিধবা গৃহের বাহির হইলেন। কিন্তু কোথায় যাইবেন, কে তাঁহার শিশুর মুখে দুটি অন্ন তুলিয়া দিবে? এ বিপদে, হে শঙ্কর! হে বিশ্বেশ্বর! তুমি ব্যতীত বিধাতার আশ্রয়দাতা আর কে আছে? অচ্যুতচরণ/ভূমিকা / পৃ. ১১০
দেখা যাচ্ছে, এখানেও শ্রীঅচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি ঈশানের জন্মস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ তথ্য দিতে পারছেন না। তবে ঈশান যে ব্রাহ্মণসন্তান এবিষয়ে ঈশান নিজেই তথ্য দিয়েছেন,
এত ভাবি যজ্ঞসুত্র ছিণ্ডিনু তখনে
… এত কহি প্ৰভু পুন পৈতা দিলা মোরে।’ অপ্ৰ, ৮১
অদ্বৈতের কথা কেন মনে পড়ল? তবে কি লাউড়-নবগ্রামে ঈশানের মা অদ্বৈতের কথা শুনেছিলেন? তাই কি লাউড় থেকে ‘দীর্ঘ পৰ্যটনে বহু ক্লেশে’ ঈশান-জননী লাউড় থেকে এসেছিলেন? যাঁরা অদ্বৈতের বাল্যলীলা (যা পঞ্চবর্ষে লাউড়-ছাড়া ঈশানের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না) ঈশানের কাছে প্রকাশ করেছেন, সেই কৃষ্ণদাস (দিব্যসিংহ), পদ্মনাভ, শ্যামদাস ঈশান-পরিবারের পূর্বপরিচিত মনে হওয়ার সঙ্গত কারণ থাকতে পারে।
লাউরিয়া কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা সূত্র।
যে গ্রন্থ পড়িলে হয় ভুবন পবিত্র।।
যে পড়িনু যে শুনিনু কৃষ্ণদাস মুখে।
পদ্মনাভ শ্যামাদাস যে কহিলা মোকে।। অপ্ৰ. ১০৪
অচ্যুতচরণের তথ্যের কিছু সূত্র এখান থেকে পাওয়া সম্ভব। ভূমিকায় আরও বলছেন:
হঠাৎ অদ্বৈত প্রভুর কথা বিধবার মনে পড়িল; অদ্বৈতের নাম ও প্রস্তাব তখন সমস্ত বঙ্গদেশে ব্যাপ্ত হইয়াছিল। জীবের প্রতি অদ্বৈতের করুণা, অনাথ নিরাশ্রয়ের প্রতি অসীম দয়া প্রভৃতি স্মরণ হওয়ায় হৃদয়ে ভরসা হইল, মনে বল আসিল। বিধবা ক্ষণবিলম্ব না করিয়া গঙ্গাস্নানের যাত্রীর সহিত শান্তিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলেন। ঈশানের দু:খিনী জননী যে দিন অদ্বৈতের ভবনে উপস্থিত হইবেন, সে দিন অদ্বৈত গৃহে আনন্দোৎসব, সেই দিন অদ্বৈত প্রভুর জ্যেষ্ঠ তনয় অচ্যুতানন্দের শুভ বিদ্যারম্ভ ছিল। দীর্ঘ পৰ্যটনে বহুক্লেশে বিধবা সেই উৎসব-দিনে উপস্থিত হইলেন। অদ্বৈতগৃহিণী সীতাদেবী আদর করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন, তাঁহার দুঃখের কাহিনীগুলি সেই আনন্দবাসরেই শুনিয়া সীতা বিষাদিতা হইলেন ও দুঃখিনীর একমাত্র ধন পুত্রটিকে অতি স্নেহের সহিত কোলে লইলেন। এরূপ দিগন্ত-প্রসারিণী দয়া, এরূপ অপার কৃপার চিত্রদর্শনে বিধবার ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতার উপহার মুক্তাবিন্দুর ন্যায় ঝরিতে লাগিল।
দু:খিনীর ভাবনা শঙ্করই দূর করিলেন; অদ্বৈতপ্রভুই বিধবাকে আশ্রয় দিলেন! সে ১৪১৯ শকাব্দার কথা। বলিয়াছি, ঈশান তখন পঞ্চমবর্ষীয় বালক, অতএব ঈশানের জন্মাব্দ ১৪১৪ শক জানা যাইতেছে। বলিয়াছি অচ্যুতের বিদ্যারম্ভ দিবসে অর্থাৎ পাঁচ বৎসর বয়সের সময় ঈশান-জননী শান্তিপুরে আগমন করেন, অতএব ঈশান অচ্যুতানন্দের সমবয়স্ক ছিলেন, ইহাও জানা যাইতেছে। যাহাহউক অদ্বৈত প্রভু ঈশানকে সেই শুভদিনেই মন্ত্র-দান করিলেন, তাঁহার জননীও সে সৌভাগ্য বঞ্চিতা হইলেন না। এইরূপে আশ্রয় পাইয়া ঈশান জননী যথাসাধ্য গুরুর সেবা করিতে লাগিলেন; ঈশানও অচ্যুতের সহিত বিদ্যাশিক্ষা করিয়া ক্রমে পণ্ডিত হইয়া উঠিলেন। অচ্যুতচরণ।। পৃ. ১১০
ঈশানের জন্মতারিখ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল। জন্মস্থান নিয়েও সংশয়ের নিরসন হল। শ্রীহট্ট জিলার নবগ্রাম। নির্দিষ্ট স্থানটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেল। যোগনাথ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বঙ্গ অভিধানে ঈশানের পরিচয় সুনিশ্চিত করে বলছেন, ‘জাতিতে ব্রাহ্মণ কিন্তু ভৃত্যরূপে প্রভুর সেবা করতেন। জন্ম ১৪৯২ খৃ. শ্রীহট্ট জেলার নবগ্রামে। শ্রীচৈতন্যদেবের গৃহত্যাগের পর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর সেবক হন। তিনি অদ্বৈতাচার্যের শিষ্য ও অদ্বৈতপ্রকাশ গ্রন্থের লেখক বলে পরিচিত। …..গ্রন্থটি সুরচিত ও তাতে সমকালীন বৈষ্ণবসমাজ ও শ্রীচৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষদের বসবাসকালের নানা তথ্য মেলে।’ যোগনাথ মুখোপাধ্যায়।। পৃ. ৮৪-৮৫। অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানে উল্লেখ, ঈশানের ‘জন্মস্থান নবগ্রাম-শ্রীহট্ট। অদ্বৈত প্রভুর জীবনী অবলম্বনে ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’ গ্রন্থ রচনা করেন (১৫৬৮)। চৈতন্যভাগবতে নিমাই পণ্ডিতের গৃহভৃত্য হিসাবে তাঁর উল্লেখ আছে। চৈতন্যদেবের গৃহত্যাগের পর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সেবা করতেন।’
শ্রীশ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব সাহিত্যে উল্লেখিত আছে :
‘শ্রীমদদ্বৈত প্রভুর শিষ্য ঈশাননাগর কর্তৃক অদ্বৈতপ্রকাশ রচিত। ঈশান পাঁচ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হইলে তদীয় অনাথা জননী শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মাতা-পুত্র উভয়েই দীক্ষিত হন। অচ্যুতানন্দের সহিত ঈশান লেখাপড়ায় ক্রমশ: বুৎপন্ন হন। শ্রীগৌর-বিরহে শ্রীঅদ্বৈত আত্মসংগোপন করিতে ইচ্ছা করত ঈশানকে স্বজন্মভূমি শ্রীহট্টে গৌরনামপ্রেম প্রচার করিতে আদেশ করেন। অদ্বৈতের অপ্রকটে ঈশানকে বঙ্গদেশে গমনোদ্যোত দেখিয়া সীতাদেবী তাঁহাকে বিবাহ করিতে ও শ্রীঅদ্বৈত চরিত্র বর্ণনা করিতে আদেশ করেন। এই অদ্বৈতপ্রকাশ শ্রীহট্টে নবগ্রামে রচিত হয়। …১৪৯০ শকে গ্রন্থকারের ৭০ বর্ষ বয়সে এই গ্রন্থ শেষ হয় বলিয়া প্রকাশ।’ শ্রীশ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণবসাহিত্য, পৃ. ৮১
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের বিশ্লেষণে—
‘প্রকৃতনাম : ঈশানদাস। জন্ম ১৪৯২ খ্রীঃ শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ মহকুমার লাউড় পরগণার নবগ্রামে ব্রাহ্মণবংশে। পিতৃবিয়োগের পর মাতার সঙ্গে শান্তিপুরে অদ্বৈতআচার্যের গৃহে আশ্রয়প্রাপ্ত। অদ্বৈত আচার্যের পালিত ও শিষ্য। শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শচীদেবী ও বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর সেবা ও তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত। অদ্বৈত আচার্যের তিরোধানের আদেশে ৭০ বছর বয়সে বিবাহিত। ৭৬ বছর বয়সে পদ্যে অদ্বৈতের জীবনী রচয়িতা।’ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য।। ১৫৮
উপরি উক্ত সংগ্রাহকদ্বয় (সম্পাদক) একটি বিষয়ে একমত যে ঈশান চৈতন্যের গৃহভৃত্য ছিলেন এবং শচী-বিষ্ণুপ্রিয়ার সেবা করেন। বিমানবিহারী অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করছেন। ঈশান নিজে লিখছেন :
‘তুঞি মোর প্রিয় শিষ্য আত্মজ সমানে।’ অর্থাৎ শিষ্য ও পুত্রসম। অদ্বৈতপ্রকাশ পড়লে তাঁকে পালিতপুত্র বলেই মনে হয়। অচ্যুতচরণ চৌধুরী শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে যা লিখছেন প্রায় সবটুকু অদ্বৈতপ্রকাশের ভূমিকার অনুরূপ। পুনরাবৃত্ত হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখ্য :
ঈশাননাগর অদ্বৈতাচার্যের শিষ্য ও অনুচর ছিলেন। ঈশানের জন্মস্থান লাউড়। ঈশানের পিতা দরিদ্র ব্যক্তি—আত্মীয় বন্ধু বিহীন। ঈশানের যখন পিতৃ বিয়োগ ঘটে, তখন তাঁহার বয়ক্রম পাঁচ বৎসর মাত্র; পাঁচ বৎসরের অপোগণ্ড শিশু লইয়া দুঃখিনী ঈশানজননী ভীষণ সংসার-সাগরে ভাসিলেন। ঘরে যৎসামান্য তৈজস পত্র ছিল, প্রতিবাসীদের পরামর্শ ও আদেশে তাহা বিক্রয় করিলেন এবং তদ্বারা পতির ঊর্দ্ধদেহিক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হইল। ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষা হইল বটে, কিন্তু ঈশানের প্রাণরক্ষার উপায় থাকিল না। ঘরে থাকিলে না খাইয়া সপুত্রে মরেন, কাজেই অনাথা বিধবা গৃহের বাহির হইলেন। কিন্তু কোথায় যাইবেন? কে তাঁহার শিশুর মুখে দুটি অন্ন দিবে?
হঠাৎ অদ্বৈতপ্রভুর কথা বিধবার মনে পড়িল। অদ্বৈতের প্রভাব তখন সমস্ত বঙ্গে পরিব্যাপ্ত। সৰ্ব্বজীবে দয়া, অনাথ নিরাশ্রয়ের প্রতি তাঁহার অসীম সমবেদনা প্রভৃতি স্মরণ হওয়ায় বিধবার হৃদয়ে ভরসা হইল, মনে বল আসিল। বিধবা ক্ষণ বিলম্ব না করিয়া শান্তি পুরাভিমুখে ধাবিত হইলেন। ঈশানের দুঃখিনী জননী যেদিন অদ্বৈতের শান্তিপুর ভবনে উপস্থিত হইলেন, সেদিন অদ্বৈতগৃহে আনন্দোৎসব, সেইদিন অদ্বৈতের জ্যেষ্ঠ তনয় অচ্যুতানন্দের শুভ বিদ্যারম্ভ ছিল। দীর্ঘ পৰ্যটনে বহুকেশে বিধবা সেই উৎসব দিনে উপস্থিত হলেন। অদ্বৈতগৃহিনী সীতাদেবী আদর করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন; তাহার দু:খের কাহিনী শ্রবণে সেই আনন্দবাসরেই সীতা দরদরিত ধারায় রোদন করতে লাগিলেন। দুঃখিনীর নিরাশ্রয় তনয়কে সীতা কোলে লইলেন, তাহার মুখচুম্বন করিলেন। এরূপ দিগন্ত প্রসারিত দয়া, এরূপ অপার কৃপার চিত্রদর্শনে বিধবার নেত্রে কৃতজ্ঞতার উপহার, মুক্তাবিন্দুর ন্যায় ঝরিতে লাগিল।
অদ্বৈত বিধবাকে আশ্রয় দিলেন। সে ১৪৯৭ খৃষ্টাব্দের কথা। ঈশান তখন পঞ্চম বর্ষীয় বালক মাত্র। অদ্বৈত প্রভু ঈশানকে সে শুভদিনেই দীক্ষামন্ত্ৰ দান করিলেন। ঈশান অদ্বৈতের শিষ্য মধ্যে পরিগণিত হইলেন।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।।২য় ভাগ।। ৩৯৪
ঈশান গুরুগৃহে কী পরিচয়ে বাস করতেন এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। অচ্যুতচরণ উল্লেখ করেছেন, ‘অদ্বৈতাচার্যের যত্নে ঈশান কালক্রমে পণ্ডিত হইয়া উঠিলেন। কিন্তু তিনি মন্ত্রচর্চা না করিয়া সর্বদা তাঁহার পরিচর্য্যা করিয়াই পরিতৃপ্ত হইতেন। তদেব, ৩৮২।
১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে অদ্বৈতপ্রভু মানবলীলা সংবরণ করেন। ঈশানের চিত্ত শোকসাগরে নিমজ্জিত হয়। বিষাদ-বিষন্নতার মধ্যেই তাঁকে তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। প্রথমত, তাঁর উদ্ধারকর্তা ও পিতৃপ্রতিম অদ্বৈতের জীবনচরিত রচনা করা (চৈতন্যবিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ ইতোপূর্বে রচিত হয়েছিল)। দ্বিতীয়ত, সীতাদেবীর নির্দেশে দারপরিগ্রহ করা। তৃতীয়ত, শান্তিপুর ছেড়ে লাউড়ে প্রত্যাবর্তন। এই তৃতীয় সিদ্ধান্তটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শান্তিপুরে গৌড়ীয় বৈষ্ণবসমাজ অদ্বৈতপুত্র অচ্যুতানন্দ এবং কৃষ্ণদাস দেখভাল করতেন। শ্রীহট্টীয় বৈষ্ণবসমাজের মধ্যে থেকে যদি ধর্মচর্চা, অনুশীলন ও প্রচার করা যায়—বিশেষত: গুরুর জন্মস্থানে বসে যদি গুরু-চরিত লেখা যায় তার ব্যপ্তি অনেক বেশি। তাই লাউড়ের নবগ্রামেই গেলেন, ‘বঙ্গদেশ শ্রীহট্ট নিকট নবগ্রাম।/সর্বারাধ্য অদ্বৈতচন্দ্রের প্রিয়ধাম।’ ভক্তিরত্নাকরগ্রন্থ।
ঈশানের পরিচিতির আর একটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। গৌরাঙ্গ কীভাবে ঈশানকে দেখতেন, তা উল্লেখ্য। গৌরাঙ্গ ঈশানকে যে ভাষায় বলছেন, ‘সহাস্য মধুরভাবে গৌরাঙ্গ কহিলা।/শুনহ ঈশান শাস্ত্র যাহা প্রকাশিলা।। নিজ ভৃত্যকে শাস্ত্রজ্ঞান দিচ্ছেন গৌরাঙ্গ—কোথায় যেন প্রশ্ন জাগে। তাছাড়া, বিশেষ করে লক্ষ্যণীয় ঈশান বারবার অদ্বৈতকে ‘মোর প্রভু’ বলছেন আর গৌরসুন্দরকে বলছেন ‘মহাপ্রভু’। চৈতন্যের ‘গৃহভৃত্য’ হলে অদ্বৈতকে ‘মোর প্রভু’ বলার যৌক্তিকতা টেকে না। অদ্বৈতের অপ্রকটের পর অদ্বৈতজায়া সীতাদেবী ঈশানকে বলছেন :
তবে প্রভুর অন্তর্দ্ধানে সীতাঠাকুরাণী।
কি ভাবে এই আদেশিলা কিছু নাহি জানি।।
আরে ঈশানদাস তোরে করি বড় স্নেহ।
মোর তুষ্টি হয় তুই করিলে বিবাহ।। অ.প্র. ১০৪
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে ঈশান উপসংহার টানলেন এমনভাবে যা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। অদ্বৈতের অপ্রকটের আগে চৈতন্যদেব দেহ ছেড়েছেন, নিত্যানন্দ নিত্যধামে প্রস্থান করেছেন। বাকি ছিলেন অদ্বৈত। তাঁর প্রয়াণে :
গৌর-প্রেম বৃক্ষের এক স্কন্ধ ছিল।
তাহে গৌরের অপ্রকট সম্পূর্ণ নহিল।।
আজি সে গৌরাঙ্গলীলা হৈল সমাধান।’ অ.প্র. ১০৩
বৃন্দাবনদাস মহাপ্রভুর অপ্রকট হওয়ার কথা বলেননি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ সেই পথেই হাঁটছেন, ‘বৃন্দাবনদাস প্রথম যে লীলা বর্ণিল।/সেইসব লীলার আমি সুত্রমাত্র কৈল।’ চ.চ./৬৩২
অর্থাৎ লীলা বর্ণনা করেছেন, কিন্তু লীলাবসানের বিবরণ থেকে নিবৃত হয়েছেন। কৃষ্ণদাস সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার কথা বলে আবার জালিয়ার জালে ওঠার কথা জানিয়ে দিলেন। বৃন্দাবনদাস মহাপ্রভুর কূপমধ্যে পতনের ‘পড়িলা যে কূপে প্রভু তাহো নাহি জানে’ কথা বলেও অন্তর্ধান প্রসঙ্গে নীরব থাকলেন। দুটি মূল কারণ থাকতে পারে নীরবতার। এক, প্রমাণের অপ্রতুলতা। দুই, বৈষ্ণবীয় অনুভবে লীলাবসান গর্হিত। তবু মনে রাখা যায়, পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের লীলাবসান শ্রীমদ্ভাগবতে ব্যাখ্যাত। যথা-
‘মুষলাবশেষায় : খণ্ডকৃতেষুলুব্ধকো জরা।
মৃগাস্যাকারং তচ্চরণং বিব্যাধ মৃগশঙ্কয়া।’ শ্রীমদ্ভাগবত/একাদশস্কন্ধ।।বিংশ অধ্যায়। ঈশান কিন্তু কল্পবৃক্ষের তিন স্কন্ধের লীলাবসান প্রকাশ করেছেন। বিশেষত অদ্বৈতের লীলাবসানের অন্যতম কারণ (তৎকালে অদ্বৈতের বয়স ১২৫ বৎসর!) হিসাবে বলা হচ্ছে:
প্রভু বলে মোর দুঃখ শুন বৎসগণ।
মোর দুষ্টগণে করে গৌরাঙ্গ নিন্দন।।
গৌরাঙ্গের নিন্দা অদ্বৈতের সহ্য হয় না প্রাণে। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত :
ইহা মোর পরাণে নাহিক সহ্য হয়।
তার প্রায়শ্চিত্তে দেহ ত্যজিমু নিশ্চয়।। অ.প্র. ১০২
পূর্বাপর সকল বিবরণ একটি যুক্তির আনুকূল্য করে, ঈশান অদ্বৈতের শিষ্য তথা পালিতপুত্র। চৈতন্যের গৃহভৃত্য নন। তবে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়াকে যে খুব কাছে থেকে দেখেছেন তার বিবরণ পশ্চাতে দেওয়া যাবে। এখন দেখার, অদ্বৈতগৃহে ঈশান কী ধরণের কাজকর্ম করতেন। বিমানবিহারী মজুমদার লিখছেন :
১৪১৪ শক হইতে ১৪৮০ শক, অর্থাৎ অদ্বৈতের তিরোভাব-কাল পর্যন্ত, তিনি অদ্বৈতপ্রভুর সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন। তিনি কি কাজ করিতেন, কত দূর পড়াশুনা করিয়াছিলেন তাহা স্পষ্ট করিয়া কিছু বলেন নাই; তবে কয়েক স্থলের ইঙ্গিত হইতে অনুমান করা যাইতে পারে যে টহলদারী, অর্থাৎ ভোগ রান্নার জোগান দেওয়ার কাজ, তাঁহাকে করিতে হইত। অদ্বৈত, তাঁহার পত্নী সীতাদেবী ও অচ্যূত তাঁহাকে খুবই স্নেহ করিতেন। তিনি শ্রীচৈতন্যের জীবনের যে যে ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন তাহার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করিয়াছেন। অদ্বৈতজ্ঞান-ব্যাখ্যা করিতেছিলেন বলিয়া বিশ্বন্তর ও নিত্যানন্দ যে দিন শান্তিপুরে তাঁহার সহিত বুঝাপড়া করিতে আসেন সে দিন সীতাদেবী অনেক জিনিস রান্না করিয়াছিলেন।
ঈশান বলেন—
মুঞি অধম কৈলা তাঁর জলের টহল। —১৪ অ. পৃ. ৬০
আবার নীলাচলে যে দিন অদ্বৈত শ্রীচৈতন্যকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন, সেই দিন “গৌরের পদ ধৌত লাগি মুঞি কীট গেনু” (১৮, অ, পৃ. ৮০)। শ্রীচৈতন্যের আহারের পর অদ্বৈত তাঁহাকে শ্রীচৈতন্যের পদসেবা করিতে বলিলেন। শ্রীচৈতন্য তাঁহাকে উপদেশও দিয়াছিলেন। বিমানবিহারী মজুমদার।। শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান।।৪৩৪
এই স্থলে ঈশানকে খুবই যুক্তিনিষ্ঠ মনে হয়। ‘গৌরাঙ্গ-নিন্দন’ নিয়ে সমকালের চরিতকারদের রচনায় বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায় না। প্রাক্পর্বে নিন্দন যা হয়েছে (যথা জগাই-মাধাই উদ্ধার, চাঁককাজি উদ্ধার ইত্যাদি) পরে ‘উদ্ধারের’ মধ্য দিয়ে তার উপসংহার ঘটেছে। অদ্বৈতের অপ্রকটের কালে (১৫৫৮) কী এমন চৈতন্য-নিন্দনের ঘটনা ঘটে যাতে তাঁকে দেহ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এবিষয়ে জগন্নাথ মিশ্রের বংশের উত্তরপুরুষ বাণীপ্রসন্ন মিশ্র লিখছেন :
গৌর-পারম্যবাদ দূরে থাকুক, স্বীকৃত দেব-দেবীর বাইরে গৌরাঙ্গ পুজোর জন্য সামান্য স্থান ছেড়ে দিতেও স্মৃতিশাস্ত্র-শাসিত ব্রাহ্মণ্যসমাজ ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষক, স্থিতাবস্থার সুবিধাভোগী, অভিজাতবর্গ দীর্ঘদিন এসময়েই রাজি ছিলেন না। এমতাবস্থায়, গৌরাঙ্গের সাধারণ গুণগ্রাহীরা হিন্দুসমাজের প্রান্তবর্তী ভূমিতে ‘আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ’ ইত্যাদি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখেন। চৈতন্যদেবের ধর্মান্দোলন সম্পর্কে ক্ষমতাশালী লোকেরা একসময় কতটা বিরূপ ছিলেন তার দৃষ্টান্ত হিসাবে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের কিছুকাল পরে নবদ্বীপে বিরহ-বিধুরা বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী কর্তৃক মহাপ্রভুর স্বগৃহে ব্যক্তিগতভাবে সেবিত মূর্তিটির পরবর্তী ইতিহাস স্মরণ করা যেতে পারে। ….নদিয়া-নবদ্বীপের রাজারা প্রকাশ্যে চৈতন্যমূর্তি পূজনের বিরোধী ছিলেন, তাই মালঞ্চপাড়ার এই বিগ্রহটিকে মাটির নীচে লুকিয়ে রেখে পুজো করা হত। উন্মোচিত ঢাকা দক্ষিণ।। বাণীপ্রসন্ন মিশ্র (৮৬-৮৭) (মণ্ডল, মৃত্যুঞ্জয় : ২১)
প্রসঙ্গত, ঈশান-পরিচিতি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চৈতন্যভাগবতের ঈশান, চৈতন্যচরিতামৃতের ঈশান, গোবিন্দদাস কর্মকারের ঈশান এবং অদ্বৈতপ্রকাশের ঈশান কি একই ব্যক্তি? চৈতন্যভাগবতে পাই :
ঈশান দিলেন জল-ধুইতে চরণ।
নিত্যানন্দ সঙ্গে গেলা করিতে ভোজন।।
…………………………………….
ঈশান করিল সব-গৃহ উপস্কার।
যত ছিল অবশেষে সকল তাহার।।
সেবিলেন সৰ্ব্বকাল তাঁহারে ঈশান।
চতুর্দশ লোক মধ্যে মহা ভাগ্যবান।।’ চৈতন্যভাগবত।।১৩৮
কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখায় সনাতনের সঙ্গে ঈশানকে পাই স্বতন্ত্র রূপে :
এই ভূঞা কেন মোরে সম্মান করিল।
এত চিন্তি সনাতন ঈশানে পুছিল।।
তোমার ঠাঞি জানি কিছু দ্রব্য আছয়।
ঈশান কহে মোর ঠাঞি সাত মোহর হয়।
……………………………………….
পার হঞা গোঁসাঞি তবে পুছিল ঈশানে।
জানি শেষ দ্রব্য কিছু আছে তোমা স্থানে।।
ঈশান কহে এক মোহর আছে অবশেষ।
গোঁসাঞি কহে মোহর লঞা যাহ তুমি দেশ।’ চৈতন্যচরিতামৃত।।৩৭৫
কোন দেশে যাওয়ার কথা বললেন, সনাতন ঈশানকে? পুরুষোত্তম? সেখানে রূপ-সনাতনের মহাপ্রভু দর্শনের বিবরণ ঈশানকে দেওয়া হয়েছে। অদ্বৈতপ্রকাশে আছে :
গৌরাঙ্গ দেখিতে যাঙ শ্রীপুরুষোত্তমে।।
এত কহি সনাতনে দণ্ডবৎ করি।
শুভযাত্রা কৈলা তিহ স্মরি গৌরহরি।। অপ্ৰ.।।৮৩-৮৪
গৌরাঙ্গসুন্দর যখন সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে ‘ভারতীকে লয়ে চলিলেন নানা রঙ্গে’, তখন—
লক্ষ লক্ষ লোক চলে প্রভুর পিছনে।
বিস্তর পণ্ডিত চলে প্রভু দরশনে।।
রুদ্রদেব রামরত্ব জগাই পণ্ডিত।
গঙ্গাদাস শম্ভুচন্দ্র ভুবনে বিদিত।।
ঈশান শঙ্কর বলরাম গদাধর।
পণ্ডিতের শিরোমণি চণ্ডচণ্ডেশ্বর।। গোবিন্দদাসের কড়চা।। পৃ. ২৬
চৈতন্য অনুগামী ‘ পণ্ডিত’’পণ্ডিত শিরোমণি’দের মাঝে এই ঈশানই বা কে? তন্নিষ্ঠ পাঠক কি একটা নিবিড় অথবা প্রচ্ছন্ন সাযুজ্য খুঁজে পান? শ্রীশ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সাহিত্যে ‘শ্রীশ্রীগৌরগণ’ পর্বে (পরিশিষ্ট) শ্রীগৌরগণ, দশম অনুক্রমে বলা হয়েছে :
‘১০। ঈশান আচার্য। মৌনমঞ্জরী, ১৯৫, ২০৫- ,
(১। শচীমার সেবক, ২। শ্রীরূপ সঙ্গী, ৩। শ্রী সনাতন ভৃত্য,
৪। অদ্বৈতগণ, গৌড়ীয়বৈষ্ণবসাহিত্য। পরিশিষ্ট (২৮)
অদ্বৈতের গৃহে দীর্ঘদিন থাকেন ঈশান। প্রায় পঁয়ষট্টি বছর। অদ্বৈতের নানাবিধ লীলা তিনি প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ ভাগ্য তিনি লাভ করেন। মহাপ্রভুরও বেশ কিছু লীলা প্রত্যক্ষ করার জন্মজন্মান্তরের সৌভাগ্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হন নি। সে সব লীলা মূল গ্রন্থে এবং প্রস্তাবনা পর্বে পরে বর্ণিত হবে। তবে ঈশান যে কাজের জন্য বৈষ্ণবসমাজে চিরদিন আদৃত হবেন তা হল সাল-তারিখের মধ্য দিয়ে সুক্ষ্মবিচারে প্রবেশের অধিকার দিয়েছেন ভক্ত ও পাঠককে। এর আগে অদ্বৈত সংক্রান্ত একটিমাত্র বই পাঠকের দৃষ্টিগোচর ছিল। ‘লাউরিয়া কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা।’ হিমালয়প্রতিম মহাপ্রভুর অভ্রংলিহ ব্যক্তিত্বের কাছে পঞ্চতত্ত্বের বাকি চারজনের তেমন আলো মধ্যযুগে চোখে পড়ে নাই। অদ্বৈতপ্রকাশের সরল ভাষা সহজ বিবরণ সেই আলো প্রক্ষেপণের কাজ অংশত করতে সক্ষম হয়। মহাপ্রভুর নবদ্বীপলীলা, শ্রীহট্টে গমন, বৃন্দাবনলীলা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি যখন যেখানে থেকেছেন, তাঁর চারিপাশে যাঁরা থেকেছেন, তাঁদের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে পূর্বাপর গ্রন্থাবলিতে। সেটাই স্বাভাবিক। ঈশান কিন্তু সন্তর্পণে স্বতন্ত্র থেকে প্রত্যক্ষ বিবরণকেই আলোকিত করেছেন। সীতাদেবী এবং সীতানাথ সম্ভবত হিসাবপত্রের বিষয়ে বিশেষ সচেতন থাকতেন না। আমাদের মনে হয়েছে এই কাজটি ঈশানকেই করতে হত। পাঁচ বছরের যে শিশু অদ্বৈতগৃহে প্রবেশ করেন, তাঁর পক্ষে দিনক্ষণের আঙ্কিক জটিলতায় প্রবেশ করা দুষ্কর। মনে হয়, কালে ঈশানের শিক্ষা, বিদ্যাচর্চা ও শুভঙ্করী আদি চর্চা তাঁকে সমৃদ্ধ করে। অদ্বৈতের পুত্রগণ, বিশেষত অচ্যুত অকৃতদার ও সংসারবিমুখ। চৈতন্যে নিবেদিত প্রাণ। অদ্বৈত জীবদ্দশায় কৃষ্ণদাসকে যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করেন। অচ্যুত ও ঈশান সমবয়স্ক। সমবয়স্কদের মধ্যে, বিশেষত আশ্রিত অনুগ্রহভাজনের ক্ষেত্রে, কোথাও কোথাও স্বাভাবিক অসূয়া সঞ্জাত হয়। সমবয়স্ক অচ্যুতের প্রতি ঈশান অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। যখন ‘গোরা টোল করি পঢ়াইল ছাত্র’ তখন অচ্যুত সেখানে পড়তে আসেন। কেমন ছাত্র ছিলেন অচ্যুত :
‘বুদ্ধ্যে বৃহস্পতি শাস্ত্রে অতি পটুতর।’ ঈশান আরও খুশি হন যখন বস্তুবিচার করতে গিয়ে গৌরকে অচ্যুত বলেন, ‘বস্তু শক্তিতে প্রকাশ’ তখন ছ’বছরের বড়ো অধ্যাপক ছাত্রকে সমাদর করেন,
শুনি মহাপ্রভু গূঢ় প্রেমে আর্দ্র হঞা।
অচ্যুতর শিরে চুম্বে নিজ কোলে লঞা।। অপ্ৰ., ৫২
এ যেন বিদ্যালয়ে অকৃতকার্য রবীন্দ্রনাথের গৃহ প্রত্যাবনান্তে সোল্লাস উক্তি ‘সত্য ফার্স্ট হইয়াছে!’ মহাজনচরিতের মাধুর্যের এই রীতিই স্বাভাবিক।
ঈশান অদ্বৈতের প্রতি পুত্রের জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ করে এক ঐতিহাসিক দিক নির্ধারণ করেছেন। জন্মতারিখগুলি নিম্নরূপ :
১। অচ্যুত।। ১৪১৪ শক।। বৈশাখি পূর্ণিমা।
‘চৌদ্দ শত চৌদ্দের বৈশাখি পূর্ণিমা।
যেই দিন সীতাদেবী পুত্র প্রসবিলা।।’
২। কৃষ্ণদাস।। ১৪১৮ শক।। চৈত্র কৃষ্ণা ত্রয়োদশী।
‘চৌদ্দশত অষ্টাদশ শক অবশেষে।
………………………………..
প্রসাবিলা সীতাদেবী অপূর্ব কুমার।
অলৌকিক রূপ যৈছে দেব অবতার।।’
৩। গোপাল।। ১৪২২ শক কার্তিক শুক্লা দ্বাদশী।
‘চৌদ্দশত বাইশ শকের কার্তিকেতে।
সীতা প্রসবিলা শুক্লা দ্বাদশীতে।।
৪। বলরাম।। ১৪২৬ শক, পৌষ
‘চৌদ্দশত ছাব্বিশ শকের পৌষ মাসে।
সীতার চতুর্থ পুত্র তাহে পরকাশে।’
৫। স্বরূপ ও জগদীশ।। ১৪৩০ শক, জ্যৈষ্ঠ মাস।
‘তবে চৌদ্দশত ত্রিশ শকে জ্যৈষ্ঠ মাসে।
সীতার যমজ পুত্র তাহে পরকাশে।।’ অ.প্র. ৪৬, ৪৭, ৬০, ৬১
এই স্থলে শ্রদ্ধেয় বিমানবিহারী মজুমদারের এক দীর্ঘ উক্তি সবিনয়ে প্রকাশ করছি :
সীতাদেবীর চার বছরের আঁজা ছিল, দেখা যাইতেছে। ঈশান যদি তিথির সঙ্গে বারটিও উল্লেখ করিতেন তবে জ্যোতিষিক গণনা করিয়া তাঁহার স্মৃতিশক্তি কতদুর প্রবল ছিল তাহার পরিচয় দেওয়া যাইত। কিন্তু ঈশান নিজে যে সব তারিখ দিয়াছেন ও ঘটনা লিখিয়াছেন তাহার মধ্যে কোথাও পরস্পর বিরোধ নাই। নিত্যানন্দের জন্মের ও অদ্বৈতের তিরোভাবের তারিখ ছাড়া আর সব তারিখ সত্য কি না যাচাই করিয়া লওয়ারও উপায় নাই, কেননা অন্য কোন বৈষ্ণব গ্রন্থকার তারিখ উল্লেখ করেন নাই। দাক্ষিণাত্য-দেশভ্রমণের পর শ্রীচৈতন্য যখন পুরীতে ফিরিয়া আসিলেন, তখন কৃষ্ণ মিশ্র তাঁহাকে দর্শন করিতে যাইতে চাহিলেন। সীতাদেবী কৃষ্ণকে বলিলেন, “তোর ভার্য্যা শ্রীবিজয়া সহ মন্ত্ৰ লহ” (১৫ অ)। সন্দেহ হয় যে কৃষ্ণদাসের তখনও বিবাহের বয়স হয় নাই। কিন্তু শ্রীচৈতন্য ১৫১২ খৃষ্টাব্দে পুরীতে ফিরিয়াছিলেন; এই জ্ঞাত তারিখের সহিত মিলাইয়া দেখিলে, তাঁহার বয়স তখন ১৬ বৎসর, সুতরাং বিবাহ হওয়া অসম্ভব নহে। শ্রীচৈতন্য অদ্বৈতকে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য যখন বুঝাপড়া করিতে আসিলেন, তখন সীতাদেবী অনেক প্রকার জিনিষ রাঁধিয়া তাঁহাকে খাওয়াইলেন। আমার সন্দেহ হয়, সীতাদেবী তখন পূর্ণগর্ভা বা সদ্য:প্রসূতা নহেন ত। গয়া হইতে আসার পর এক বৎসর কাল বিশ্বম্ভর গৃহে ছিলেন। সুতরাং এই ঘটনা ১৪৩১ শকের জ্যৈষ্ঠ মাসের পর হইয়াছিল, কেননা জ্যৈষ্ঠ মাসেই তিনি ভাবাধিক্যবশত: অধ্যাপনা বন্ধ করেন এবং ১৪৩১ শকের ২৯ মাঘ সন্ন্যাস লয়েন। ১৪৩১ শকের জ্যৈষ্ঠ মাসে সীতাদেবীর কোলের যমজ ছেলে দুইটির বয়স এক বৎসর। এইরূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম ঈশানের গণনা নির্ভুল। তিনি কোথাও পরস্পর-বিরোধী উক্তি করেন নাই। ঈশাননাগরের বর্ণনা সূক্ষ্ম গণনা করিয়া লেখা, তাই বোধহয় গ্রন্থের ভূমিকায় শ্রীযুক্ত অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি মহাশয় বলিয়াছেন, “অদ্বৈত-প্রকাশে কিছুমাত্র অসঙ্গত উক্তি নাই। স্থূল দৃষ্টিতে যাহা অসঙ্গত বোধ হয় তাহাতে বিচিত্র ঐতিহাসিক তত্ত্বই নিহিত আছে।” উক্ত ভূমিকা-লেখক মহাশয় আরও জানাইয়াছেন যে অদ্বৈত-প্ৰকাশে “শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলা-ঘটিত অনেক অভিনব আখ্যান আছে বলিয়া সম্মানিত।” যে সমস্ত ঘটনা মুরারি, কবিকর্ণপূর, বৃন্দাবনদাস, লোচন, জয়ানন্দ, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীরূপ, রঘুনাথদাস গোস্বামী, প্রবোধানন্দ, গোপাল ভট্ট, শ্রীজীব, বাসু ঘোষ, নরহরি সরকার প্রভৃতি চরিতকার এবং স্তব ও পদকর্তারা বলেন নাই বা জানিতেন না, এরূপ অনেক ঘটনা অদ্বৈত-প্রকাশে আছে।
শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদান।। বিমানবিহারী।। ৪৩৯-৪০
উদ্ধৃতিটি দীর্ঘ হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গে সন-তারিখের ‘গণনা নির্ভুল’ হওয়ায় বিমানবিহারীর সংশয় তৈরি করেছে। এই সংশয় বলবতী হয় না। বঙ্গদেশে সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে বকতিয়ার খিলজির কাল (১২০৩-০৪) সংস্কৃতির জীবন কিছুটা বিপর্যস্ত হলেও বিদ্যা-শিক্ষার প্রসারে তারতম্য ঘটে না। সুলতানি ফরমানে শকাব্দ-বিক্রমাব্দ থাকলেও চাপাচাপি ছিল না। সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব পড়লেও সাহিত্যচর্চা এগিয়ে চলেছিল স্বকীয় গতিতে। গীতগোবিন্দ-তে জয়দেব গোস্বামী দশাবতার বর্ণনার কল্কি অবতারে ‘ম্লেচ্ছনিবহনিধনে’র কথা বললেন। বলাবাহুল্য, শ্রীমদভাগবতে কল্কি-অবতারের ‘ম্লেচ্ছনিধনের’ সামাজিক-রাজনৈতিক দায় ছিল না। যথা-
অথাসৌ যুগসংখ্যায়াং দস্যুপ্রায়েসু রাজসু।
জনিতা বিষ্ণুযশসো নাম্মা কল্কির্জগৎপতি।। শ্রীমদভাগবত।। ১/৩/২৫
রুকনুদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৯-৭৬) ভাষা-সাহিত্যের প্রভূত পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যথা বৃহস্পতিমিশ্রের (পণ্ডিত সার্বভৌম) পদচন্দ্রিকা, মালাধর বসুর কৃষ্ণবিজয়, রামায়ণের কৃত্তিবাস-কৃত পদ্যানুবাদ। সাল-তারিখের বাড়াবাড়ি না থাকলেও অপ্রতুলতা ছিল না। যা সংকট ছিল তা হল হাতে লেখা পুঁথির এবং তার কপির যথাযথ পুণরুদ্ধার। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ‘কড়চা’ লেখায় অনেককে মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। কড়চা একপ্রকার দিনলিপি সহ নিত্যকৃত্ব বিবরণ। অধুনা যাকে ডায়েরি বলা যায় বা ডায়েরির মত। অন্যান্য চৈতন্যজীবনী গ্রন্থগুলি যেখানে ভক্তিপ্রধান, রসপ্রধান, তত্ত্বপ্রধান, অদ্বৈতপ্রকাশে সেখানে তথ্যের প্রাধান্য বেশি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাপ্রভুর লীলা স্বয়ং দর্শন করেন নি। মুরারী, কবি কর্ণপুর, জয়ানন্দ মহাপ্রভুকে স্বচক্ষে দেখেছেন। জয়ানন্দ ও কবিকর্ণপুর ছোটবেলাতেই চৈতন্য-দর্শনের সৌভাগ্য লাভ করেন।
‘জয়ানন্দের অনুসন্ধিৎসা একেবারেই ছিল না, তিনি কতকগুলি প্রবাদমাত্র লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। কবিকর্ণপুর খুব অনুসন্ধিৎসু ও সদ্বিবেচক ছিলেন; কিন্তু শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ-লীলা-সম্বন্ধে তাঁহার কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল না। মুরারি নীলাচল-লীলা-সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহার অধিকাংশই কবিকর্ণপুর, বৃন্দাবনদাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রামাণিক বলিয়া স্বীকার করেন নাই; কিন্তু ঈশান নাগর নিজে যে বিবরণ মহাপ্রভুকে প্রত্যক্ষ করে তাঁর প্রাকৃত রূপ বর্ণনা এক কথা, আর তাঁর কথা শুনে অপ্রাকৃত রূপবর্ণনা, অলৌকিকত্বের প্রকাশ আর এক কথা। চৈতন্যচরিতামৃত লেখার প্রধান প্রধান উপকরণ ‘বাংলা চৈতন্যভাগবতটি ছাড়াও পূর্বসুরী মহান বৈষ্ণবদের লেখা চৈতন্যজীবনী সম্পর্কিত প্রায় ষাটখানি গ্রন্থের পূর্ণ সাহায্য নিয়েছিলেন।’ দিলীপ মুখোপাধ্যায়।। চৈতন্যচরিতামৃতের ভূমিকা
স্বাভাবিক, নানা গ্রন্থের সকল মতকে সমান ভাবে গ্রহণ করা যায় না। তিনি (কৃষ্ণদাস কবিরাজ) নিজে লিখছেন, কবি বৃন্দাবন দাসের ‘লীলার সূত্র মাত্র’ করেছেন। আরও বলছেন :
নিত্যানন্দ-কৃপামাত্র বৃন্দাবন দাস।
চৈতন্যলীলার তিঁহ হয় আদি ব্যাস।।
এরপর পূর্ববর্তী অপরাপর লেখার তীর্যক সমালোচনা করছেন :
তাঁর আগে যদ্যপি সব লীলার ভাণ্ডার।
তথাপি অল্প বর্ণিয়া ছাড়িলেন আর।।
যে কিছু বর্ণিল সেহ সংক্ষেপ করিয়া।
লিখিতে না পারে তবু রাখিয়াছে লিখিয়া। চৈ. চ./৬৩৩
এই যাঁরা ‘লিখিতে না পারে তবু’ লিখেছেন, তাঁরা কারা পূর্বাপর চৈতন্যজীবনীকার?
জয়ানন্দ নন সেটা বোঝা যায় কারণ কৃষ্ণদাস তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছেন :
চৈতন্যমঙ্গলে তিঁহ লিখিয়াছে স্থানে স্থানে। চৈ.চ. ৬৩৩
তাহলে যে ‘ষাটখানি গ্রন্থের পূর্ণ সাহায্য’ লিখেছিলেন কৃষ্ণদাস, সেগুলির রচয়িতা কারা? উত্তরকালের সমালোচকগণ যতই প্রশ্ন ও বিতর্ক উত্থাপন করুণ, মহাপ্রভুর লীলার ক্ষুদ্র, খণ্ড, প্রক্ষিপ্ত বহু লীলা সমকালে পাওয়া যায়। যত দিন অতিক্রান্ত হয়েছে, চৈতন্য ও তাঁর লীলামাধুর্য ঈশ্বরীয় ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে। জীবদ্দশায় যে বিতর্ক ছিল, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর (‘গোকুলচাঁদ নবদ্বীপে উদয় হইল।’ অ.প্র. ৪৩) অথবা ‘ভক্ত’ (নীলাচলে জগন্নাথ সমীপে), ক্রমে তার নিরসন হয়েছে। চৈতন্যদেব যে বঙ্গজীবনের প্রকৃত নবজাগরণের দিকদিশারী সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।
এই প্রসঙ্গে একটি আলোচনার উপসংহার তুলে ধরছি। কোলকাতার এক সভাগৃহে আলোচনার বিষয় ছিল, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। প্রচুর নাম উঠে আসে—রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেন এমন কী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শেষাবধি ‘সমগ্র বুধমণ্ডলি একবাক্যে স্বীকার করে নেন, সর্বকালের সেরা বাঙালির নাম শ্রীচৈতন্য। যতদিন যাবে, এই নামটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এ বিষয়ে অন্তত বাঙালি সারস্বত সমাজ স্থিরপ্রজ্ঞ।
ঈশাননাগরের মত চরিতকার অপেক্ষাকৃত কম আলোকিত যে মহাত্মার জীবন ও চর্চা নিয়ে লিখে রাখলেন, তার মূল্য সমধিক না হলেও উপেক্ষা করার জায়গায় থাকতে পারে না। বৈষ্ণবজীবন চর্যায় অদ্বৈতের সঙ্গে ঈশানের নামও অবিকৃত থাকা উচিৎ। সত্যি বলতে কী, নিত্যানন্দ-অদ্বৈতের অপ্রকটের পর বৈষ্ণবগণ বহুধা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। মন্ত্ৰ, মতবাদ, আচার, সাধনপদ্ধতি, পূজার্চনা সহ জীবনযাপনের অজস্র খুঁটিনাটিতে পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠে বৈষ্ণবসমাজ। সুকুমার সেনের বিশ্লেষণে, ‘জীব গোস্বামীর তিরোধানের পরে বৃন্দাবনের বৈষ্ণবমণ্ডিলতে কেহ একজন নেতা রহিল না। ….যেখানে ধন ও ক্ষমতা সেখানেই বিরোধ।’ সুকুমার সেন।। ২য় খণ্ড।। ৪৯।
‘স্বকীয়া-বৈধী’ বনাম ‘পরকীয়া-রাগানুগা’–দুই মতাদর্শকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণপুরোহিত ও গুরু-মহান্তদের বিরোধ চরমে ওঠে। অন্যকে স্বীকার করার থেকে অস্বীকার করার বিপুল আয়োজন দেখা যায়। ‘তৃণাদপি সুনিচেন’’তরোরিব সহিষ্ণুনা’ পরিবর্তে বৈষ্ণবসমাজে অহং ও প্রত্যাঘাতের পরিণতি :
‘সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজের ইতিহাস অজ্ঞাত। এমন কী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র (১৭২৮-৮২) ও মহারাজ গিরীশচন্দ্রের আমলে (১৭৮২-১৮৪২) নবদ্বীপে চৈতন্য উপাসনা কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’ যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী।। ১৮৪-৮৫
তোতারাম দাস বাবাজী নামে এক দক্ষিণী সাধকের নামে প্রচারিত একটি গান প্রসঙ্গত উল্লেখ্য :
‘আউল বাউল কর্তাভজা নেড়া দরবেশ সাঁই।
সহজিয়া সখীভাবুকী স্মার্ত জাতগোঁসাই।।
অতিবড়ী চূড়াধারী গৌরাঙ্গ নাগরী।
তোতা কহে এই তেরোর সঙ্গ নাহি করি।।’ বাণীপ্রসন্ন।। ৮৭
আউল-বাউলের নির্দিষ্ট ধর্মমত ও পালন-আচার নিয়ে অনেক বিতর্ক বর্তমান। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সন্দেহ, সেকালে কাপালিক ও বাউল অভিন্নার্থক ছিল কিনা ‘মহাবাউল’ ও ‘নাম ধরি’ নিয়ে চৈতন্যচরিতামৃতের উল্লেখ বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু সম্প্রদায় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যথা
কাপালিকা: পাশুপতা: শৈবাশ্চ সহ কারুকৈ:।
দৃষ্টাশ্চেদ্ রবিমীক্ষেত পৃষ্ঠাশ্চেৎ স্নানমাচরেত।। যাজ্ঞবল্ক সংহিতা, পৃ. ১৮
অথচ দেখা যায় বাউল বা মহাবাউল শব্দগুলি অন্য ভাবে প্রকাশিত যখন অন্ত্যলীলার প্রহেলিকায় অদ্বৈতাচার্য মহাপ্রভুকে ‘বাউল’ বলে অভিহিত করছেন। অদ্বৈতকে কোথাও ‘আগমশাস্ত্রের বিধি-বিধানেতে কুশল’ বা ‘মহাযোগেশ্বর আচার্য তরজাতে সমর্থ।’ (অন্ত্যলীলা, ১৯ পরিচ্ছেদ) ‘আগমশাস্ত্র অর্থে তন্ত্রশাস্ত্র। …অদ্বৈতাচার্য-যোগমার্গ অবলম্বনে শিব-শক্তির সামরস্যের উপাসক ছিলেন বলিয়া মনে হয়, না হইলে একজন ভক্তি-পথাবলম্বী পরমবৈষ্ণবকে ‘মহাযোগেশ্বর’ বা ‘আগমশাস্ত্রের বিধি বিধানেতে কুশল’ প্রভৃতি বলার কোন অর্থ নাই। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পর তিনি যোগ-ক্রিয়ার সহিত প্রেমের অবতারণা করিয়াছিলেন এবং শিব-শক্তির স্থলে রাধাকৃষ্ণ স্থাপন করিয়াছিলেন।’ বাংলার বাউল, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পৃ। ৪১।
অপরদিকে নিত্যানন্দ প্রভু ‘অদ্ভূত আচরণ বিশিষ্ট, যোগমার্গাবলম্বী একপ্রকার বৈষ্ণব বলিয়া প্রতীয়মান হন। …এখন জিজ্ঞাস্য ‘অবধূত’ বলিয়া নিত্যানন্দ বা ‘মহাযোগেশ্বর’ বলিয়া বর্ণিত অদ্বৈতাচার্য কি বৌদ্ধ-সিদ্ধাচার্য-সম্মত যোগক্রিয়ার অনুষ্ঠান করিতেন? বাউলদের সহিত কি অবধূতদের সম্পর্ক আছে? …তবে বাউলরা ইহা বিশ্বাস করে যে অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রকৃতি-পুরুষ মিলন ঘটিত ধর্মসাধনার পৃষ্টপোষক ছিলেন।’ তদেব, পৃ. ৪৪। উপেন্দ্রনাথ আরও উল্লেখ করেছেন, ‘নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র হইতেই সম্প্রদায় হিসাবে প্রকাশ্যভাবে এই প্রকৃতি-পুরুষ-মিলন-ঘটিত ধর্ম-সাধনা বা বাউল ভজন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুরু পরম্পরার মধ্য দিয়া সারা বাংলায় ইহা ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। তদেব।
এই দলাদলি, উপদলের স্ব স্ব প্রাধান্যের কারণে বহু সত্যকে আনৃত করার প্রয়াস দেখা যায়। বহু গ্রন্থও অস্বীকৃত হয়।
এই সংঘাত সংকটের নামে ঈশানের অদ্বৈতপ্রকাশ যখন অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির আনুকূল্যে প্রকাশিত হল ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে, তাকে বরণ করে নিলেন বৈষ্ণবসমাজের একাংশ। প্রশ্নও রেখে দিলেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রেবেকা জে. ম্যানরিঙ-এ বিষয়ে সূত্র দিলেন :
Acyuta Caudhuri provides some data on Isana Nagara, the author of Advaita Prakasa, which he has apparently gleaned from the next itself. Isana reveals his identity bit by bit as the text unfolds. He tells us that Advaita’s eldest son Acyuta asked him to write his father’s life story. Isana himself met Advaita st the age of five, when his widowed mother, an impoverished brahman, approached the very wealthy Advaita for help. The two happened to turn up on Advaita’s doorstep on the very festive occasion of his eldest son Acyuta’s beginning his education. Sita Devi received them warmly, heard the mother’s sad story, took the title boy Isana on her lap, and gave them both places in the household. Acyutacarana tells us this was the year 1497. From that day on the boy and his mother served their guru to the best of their abilities. Manring, 154.
এখানে দৃঢ়ভাবে ঈশানের আগমনের দিনক্ষণ বিশদভাবে তুলে ধরায় কিছু সংশয় দানা বেঁধেছে। সে সংশয় স্থায়ী হয় না যখন নিপুনভাবে অদ্বৈতপ্রকাশের খুঁটিনাটি রচনার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরা হয়।
As a member of the household, Isana was thus well- positioned to observe, and later to comment upon, the doings of the various members of the family. He reports that, after Advaita’s death, Sita asked Isana to return to both families, home region of Lauda, in what is now Sylhet, in northeastern Bangladesh, to marry and start a family of his own. Isana expresses skepticism over the wisdom of her suggestion, as he is now over seventy years of age, but Sita reassures him that one of the other Vaisnavas will see to it that he finds a suitable bride, and, indeed, that is what he tells us happens. Finally, Isana reports that he finished composing the Advaita Pradasa in the east, in Navagrama, in the year 1568. Manring, 154.
প্রশ্ন ওঠে, অদ্বৈতপ্রকাশ কি তবে অন্যান্য জীবনী-গ্রন্থের পূর্বাপর?
That date, 1568, would make the Advaita Prakasa in earlier composition than Krsnadasa Kaviraja’s monumental Caitanya Caritamrta, the “final word” on the lfie of Krsna Caitanya. Given the mutual referentiality so typical of the Bengali Vaisnava authors, one would expect citations from such an early text to appear in later works, but none of the other hagiographics (outside the Advaita corpus) or theological treatises mention Isana’s work or even his name. Further, one would expect to find manuscripts of such an early text throughout the important libraries of the region, and yet the only extant manuscript is a very recent one in the possession of Dhaka University. Caudhuri mentions that the book remained unknown until Srinatha Gosvami, from Dhaka, carefully brought the manuscript down from Lauda to save it. Ibil.
এই সকল ‘তথ্য’ বেশ কয়েকজন গবেষক ও লেখক মানতে চাননি। মূল যুক্তি, এতদিন অপরিজ্ঞাত ছিল কেন? শ্রীনাথ গোস্বামী যে পাণ্ডুলিপি পেলেন ঢাকার মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তা অন্যদের চোখে পড়েনি তিন শতকের মধ্যে? কারও মতে, চৈতন্যচরিতামৃতের মত নির্ভরযোগ্য, যুক্তি-ভক্তি মিশ্রিত এই জীবনী গ্রন্থের প্রকাশের আগে কোনভাবেই অদ্বৈতপ্রকাশ স্থান পেতে পারে না।
সতীশচন্দ্র মিত্র (খুলনা, দৌলতপুর) জানিয়েছেন, তাঁর বিশ্বাস ঈশানের পরিবার কর্ণাটক থেকে আগত সান্ডিল্য গোত্রধারী ব্রাহ্মণ। ঈশানের পিতা মাতা পদ্মনাভ ও পদ্মিনীদেবী। রেবেকা জে. ম্যানরিঙ আরও জানাচ্ছেন :
Mitra goes on to detail Isana’s life after Advaita ‘s death, when he traveled east to Gopalpur, got married, and began his family. During this time many disciples came to him, and he initiated them. The local nawab was so impressed with his devotion that he gave him a large piece of land in Jhakpal, near Dhaka. But Isana knew he could not die until he had fulfilled Sita’s request that he start a family, so he went to Lauda and, in 1568, at the age of seventy- six, finally completed the AP. He died shortly thereafter. Mitra provides a great deal of detail about Isana’s descendants, which he says he learned from Bhuvana Mohan Majumdara of Daulatpur College. For example, Isana’s eldest son Purusottama eventually acquired quite a few followers himself, and the family came to be known as the Nagara-Advaitas and were considered part of Sita and Advaita’s family.
Mitra says that since the Caitanya Bhagavata, Caitanya Mangala, and the Caitanya Caritamrta were all written sometime after Advaita Prakasa, Isana could not have consulted them and, since he was writing in distant Lauda, the authors of those works did not have access to his text. His volunteering this information makes one wonder what straw man had asked for it.