ঈর্ষা

ঈর্ষা

বিনয়েন্দ্র বললেন . সব ঠিক হয়ে গেল। আজ অ্যাডভান্স জমা দিয়ে এলুম। বুঝলে!

অনিমা ড্রেসিং টেবিলের আয়না মুছছিলেন, বললেন জানালাগুলো রং করে দেবে তো? বারান্দার কোলাপসিবল গেটটাও ঢকঢক করে নড়ছিল।

সব ঠিক করে দেবে। বাড়িওয়ালা লোকটি ভালো। একতিরিশ তারিখ রোববার আছে, সেদিনই সিফট করব। যতীনকে বলেছি দুটো লরি পাঠাতে।

বাবলু আর অদিতি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওরা কৌতূহলে ছটফট করছে।

বাবলু বললো . বাবা, ওখানে ফুটবল খেলার মাঠ আছে?

বিনয়েন্দ্র হাসলেন। বললেন . অত বড়ো মাঠ নেই—তবে ছোটো একটা লন আছে। ইচ্ছে করলে ব্যাডমিন্টনের নেট ফেলতে পারবি।

রাস্তার নাম কী বাবা?

রত্নাকর সেন রোড। সিক্স রত্নাকর সেন রোড, মুখস্থ করে রাখো। পোস্ট অফিসে একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।

বাবলু তাড়াতাড়ি ছুটে গেল পাশের ফ্ল্যাটে ওর বন্ধু সুজিতকে খবরটা জানাতে। অদিতি এসে দাঁড়াল মায়ের পাশ ঘেঁষে। অনিমা বললেন . হ্যাঁ গো, ভাড়া সেই সাড়ে পাঁচশোই রইল? এত টাকা ভাড়া দিয়ে কুলোতে পারবে তো? কমালে না?

নাঃ! ভাড়া কি আজকাল কেউ কমায়? তবে পাড়াটা ভালো, ওদের ইস্কুল কাছে হল। সামনের বছর অদিতি পাস করলে ওকে বেব্রোনে ভরতি করব— তাও খুব দূরে হবে না।

যাক ভালোই হল। এ বাড়িটা আর আমার একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। আশেপাশে যা হই-হট্টগোল দিনরাত!

অদিতি অনুযোগের সুরে বলল . বাড়ি ঠিক হয়ে গেল, আমরা এখনও দেখলুম না। যদি এর থেকে ভালো না হয়!

এর চেয়ে ঢের ভালো। বাইরে থেকেও কত সুন্দর দেখতে, গোলাপি গোলাপি রং, সামনের লনে একটা ছোটো ইউক্যালিপটাস গাছ আছে—কলকাতা শহরের কোন বাড়িতে তুই ইউক্যালিপটাস গাছ পাবি? ওটা একেবারে ঠিক আমাদের জানালার পাশে। একটা ছোটো ঘর আছে—ওটা আমি ভেবে রেখেছি তোর জন্য একেবারে আলাদা। পড়াশুনোর সুবিধে হবে—সঙ্গে ছোটো ব্যালকনি, অ্যাটাচড বাথরুম।

বাথরুমে শাওয়ার আছে?

হ্যাঁ, খুব মোটা জল পড়ে দেখে এলুম।

কলিং বেল আছে?

কলিং বেল কি বাড়িওলা দেয়। ওটা আমাদেরই গিয়ে লাগিয়ে নিতে হবে। আজ বা কাল তোরা গিয়ে বাড়িটা দেখে আয় না। দেখিস, তোদের ঠিক পছন্দ হবে।

বাবলু গিয়ে সুজিতকে বলল . জানিস, আমরা সামনের মাস থেকে চলে যাচ্ছি। সব ঠিক হয়ে গেছে।

কোথায় রে? অনেক দূরে?

হুঁ, বহুৎ দূর, বালিগঞ্জে যাচ্ছি।

বালিগঞ্জ আবার দূর নাকি? এই তো পরশুদিন টুবলুমামার গাড়িতে ঘুরে এলুম বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ—একটা দোকানে আইসক্রিম খাওয়ালেন, দোকানটা কী ঠান্ডা। তোরা বেশ রোজ রোজ ওই দোকানে আইসক্রিম খেতে পারবি।

বাবা বলেছেন, আমাদের নতুন বাড়ির ঠিক পাশেই একটা আইসক্রিমের দোকান আছে। জানিস, আমি এই ইস্কুল ছেড়ে দেবো।

ইস্কুল ছেড়ে দিবি? তারপর কী করবি?

ওখানে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ব। সেই ইস্কুলের বাস আছে। রোজ আমাদের বাড়ির সামনে বাস থামবে।

সুজিত একটুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল . যাবার সময় তোরা ছাদ থেকে রেডিয়োর এরিয়ালটা খুলে নিয়ে যাবি?

হ্যাঁ। এরিয়াল নিয়ে যাবো, জানালার পর্দা, নিয়ন লাইট সব নিয়ে যাবো।

সুজিত বলল . ভালোই হল। তোদের এরিয়ালটার জন্য ছাদে ভালো করে ঘুড়ি ওড়াতে পারতুম না। এখন পুরো ছাদটা ফাঁকা পাবো। তোদের ফ্ল্যাটে যতদিন না অন্য ভাড়াটে আসে ততদিন তো দোতলাটাই আমাদের—কী মজা হবে তখন! শানু, পিন্টু, শুভাদের ডেকে রোজ চোর চোর খেলব।

বাবলু গম্ভীরভাবে জানাল . আমাদের নতুন বাড়িতে ব্যাডমিন্টন খেলা হবে।

সুজিতের দাদা ইন্দ্রজিৎ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। সদ্য কলেজে ভরতি হয়েছে ইন্দ্রজিৎ, এই কিছুদিন আগেও সে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়াত—এখন উলটে আঁচড়ায় বলে মুখখানা একটু বদলে গেছে। স্বভাবও একটু বদলেছে তার—আগে সে যখন তখন বাবলুদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে বসত—এখন আর খেলতে চায় না। সে গম্ভীরভাবে বলল . তোমাদের বাড়ি বদলানো ঠিক হয়ে গেল বাবলু?

হ্যাঁ ইন্দ্রদা, খুব চমৎকার বাড়ি। বাবা বলেছেন…

তোমাদের তো বদলানো দরকারই। তোমার বাবার কাছে কত লোক আসেন, কিন্তু এখানে তোমাদের ভালো বসবার ঘর নেই…

ওখানে আমাদের ছ-খানা ঘর, তার মধ্যে দুটো বসবার ঘর, বাবার একটা মা-র একটা।

কবে যাচ্ছো তোমরা?

এই তো একত্রিশ তারিখ রোববার—বাবা বলেছেন সকালবেলায় চলে যেতে হবে—চারখানা লরি আসবে—

চারখানা লরি কীসে লাগবে?

বাঃ, অ্যাত্ত জিনিস, আমি প্রথম লরিটায় ড্রাইভারের পাশে বসব।

অনিমা বললেন . বাড়িটা তো ভালোই ঠিক হয়েছে। কিন্তু আপনাদের ছেড়ে চলে যাবো, ভাবতে এত খারাপ লাগছে—

সুজিতের মা রত্নপ্রভা বললেন . এমন কিছু তো দূর নয়। বাসে চড়লেই দশ মিনিট। যাওয়া-আসা তো থাকবেই।

আচ্ছা তা তো থাকবেই। তবু এখানে যেমন আপনজনের মতন পাশাপাশি ছিলুম শান্তিতে—কোনো ঝঞ্ঝাট ছিল না, এসব ছেড়ে নতুন জায়গায়—অবশ্য পাড়াটা ভালো—আশেপাশে কোনো বস্তি নেই, সবই নতুন বাড়ি।

আমার এক মাসতুতো ভাই ওই সি. আই. টি. রোডে বাড়ি করেছে। বলছিল যে, সবই ভালো, শুধু বর্ষাকালে বড্ড জল জমে। আর মশা খুব। আমাদের এদিকটায় কিন্তু মশা নেই। তোমাদের ভাড়া কত পড়বে?

ভাড়া? ইয়ে, সাড়ে ছ-শো ঠিক হয়েছে, গ্যারেজ নিলে পুরো সাতশোই পড়বে। ভাবছি আপিসের গাড়িটা এখন থেকে বাড়িতেই রাখব।

আমরাও ভাবছি যাদবপুরের জমিটায় এইবার একটা বাড়ি তোলা শুরু করবো। এখন ব্রিজ হয়ে গেছে তো—ওদিকটা এমন সুন্দর হয়েছে—ভাড়া বাড়িতে আর ভালো লাগে না। অজিত এবার কানপুরের ট্রেনিং শেষ করে ফিরবে—তখন আর কি এইসব বাড়িতে থাকতে চাইবে?

তা ঠিক। নিজের বাড়ির তুলনায় কী আর ভাড়া বাড়ি! আমাকেও তো মা আর দাদারা বলছেন বাড়ি করো, বাড়ি করো। বাড়ি তো করাই যায়—কিন্তু ওর আপিস থেকে যে এতগুলো টাকা বাড়িভাড়া দেয়—নিজের বাড়ি হলে তো তা আর দেবে না। শুধু শুধু এতগুলো টাকা ছাড়ি কেন বলুন!

তোমার কী ইয়ে অদিতির বাবার আর ক-বছর চাকরি আছে?

এখনো সাত বছর। যাই, প্রেসার কুকারে মাংস চাপিয়ে এসেছি। দূরে চলে যাচ্ছি বলে ভুলে যাবেন না আমাদের রত্নাদি। বিপদে আপদে আপনাদের কাছে কত রকম সাহায্য পেয়েছি!

আহা সাহায্য আবার কী? পাশাপাশি ছিলুম দু-বোনের মতন—দূরে চলে গেলেও তুমিও কি আমাদের ভুলতে পারবে?

ছাদে একটা ছোট্ট ঘর, সেটা ইন্দ্রজিতের দখলে। একটা চেয়ার, একটা টেবিল আর একটা ছোট বুকশেলফ—এখানেই সে জানালার ধারে বসে পড়াশুনো করে, আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখে পায়রাদের ওড়াউড়ি। আর তার নতুন শেখা সিগারেট খাওয়ার জন্যই সারা বাড়িতে এই একটি মাত্র জায়গা। যখনই তার মন খারাপ হয়—আজকাল প্রায়ই হয়—সে এসে সেই ছাদের ঘরে জানালার পাশে বসে। এখান থেকে সে বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখতে পারে—তার আস্তে আস্তে মন ভালো হয়ে যায়। ইন্দ্রজিৎ সেই ঘরে বসেছিল, পিছন দিক দিয়ে অদিতি এসে টপ করে টেবিলের ওপর একটা বাটি রেখে বলল . এই নাও।

ইন্দ্রজিৎ মনোযোগ দিয়ে উপন্যাস পড়ছে, ঘাড় না ফিরিয়ে বলল . কী?

আচার। যা ঝাল হয়েছে না, আমরা কেউ খেতে পারছি না—তোমার খুব পছন্দ হবে।

উঁহু, আমি এখন আচার খাবো না।

কেন?

আমি এইমাত্র সিগারেট খেয়েছি। এখন আচার খেলে স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে।

ইস, এর মধ্যেই পাকা নেশাখোরের মতন কথা! রঞ্জিতদাকে বলে দেবো একদিন, তখন বুঝবে।

বলতে হয় তো এখুনি বলো, পরে তো আর সুযোগ পাবে না!

অদিতির কিশোরী মুখখানি এমন ঝকঝকে স্পষ্ট যে সমস্ত মনোভাবের তৎক্ষণাৎ ছায়া পড়ে। ছাদের সিঁড়িতে ওঠার সময় তার মুখ ছিল ঝাল লেগে বিব্রত, ঘরে ঢোকার পর কৌতুকের, এইমাত্র সে মুখে ম্লান ছায়া পড়ল। সে ইন্দ্রজিতের কাছে সরে এসে বললে. আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তুমি শুনেছো?

হুঁ।

তোমার বইটা এখন রাখো তো! আমার এখন মন খারাপ লাগছে—আর উনি বসে বসে বই পড়ছেন!

কেন, মন খারাপ লাগছে কেন?

নতুন বাড়িতে যাবো শুনে বেশ আনন্দও হচ্ছে, আবার মন খারাপও লাগছে।

মন খারাপ লাগছে কীজন্য?

তুমি জানো না বুঝি?

না তো। আমি কেমন করে জানবো—কীজন্য তোমার মন খারাপ!

ঠিক আছে জানতেও হবে না। জানি তো, আমার কথা কেউ ভাবে না।

অদিতি সত্যিই রাগ করে চলে যাচ্ছিল, ইন্দ্রজিৎ দ্রুত উঠে গিয়ে তার হাত ধরলো। বলল. এই, রাগ করো না। শোনো, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

না, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না—আমার সময় নেই।

ইন্দ্রজিৎ জোর করে ওকে টেনে চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসাল। নিজেও বসল পাশে। অদিতির কচি হাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলল . জানো অদিতি, তোমরা চলে যাবে শুনে প্রথমটায় আমারও মন খারাপ লাগছিল—এখন কিন্তু বেশ ভালো লাগছে।

কেন, ভালো লাগছে কেন?

আমি বিকেলবেলা কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রত্যেকদিন তোমাদের বাড়িতে যাবো—

সত্যি যাবে? না, মিথ্যে কথা, বিকেলবেলা তোমার কত বন্ধু-বান্ধব।

না, না, সত্যিই। শোনো, বিকেলবেলা তো এ বাড়িতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় না—মায়েরা তখন ছাদে আসেন, তা ছাড়া, দাদা তো আমাকে দেখলেই একটা না একটা কাজে পাঠাবে—তোমাদের বাড়িতে তো আর কোনো কাজ থাকবে না, আমরা তখন…

আমরা বিকেলে ওখানে ব্যাডমিন্টন খেলব।

হ্যাঁ খেলবো, আর বাগানে বসে গল্প করব। আমার প্রত্যেকটি বিকেলবেলা কেমন যেন মন খারাপ মন খারাপ লাগে, কলেজ থেকে বাড়ি আসতে ইচ্ছা করে না—এখন থেকে আমাদের নতুন বাড়িতে…

অদিতি আলতোভাবে ইন্দ্রজিতের আঙুলে চাপ দেয়। সে মনোভাব লুকোতে জানে না, খুশি ঝলমল চোখে বলল . বাড়ি বদলে তাহলে খুব ভালো হল, না? ভালো কি খারাপ, আমি এতক্ষণ বুঝতে পারছিলুম না।

খুব ভালো হল। মাঝে মাঝে আমরা আলাদা বেড়াতে যাবো। কী করে যাবো জানো? তোমার মাকে বলব . মাসিমা, অদিতিকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি! আসলে কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসব না। আমরা আলাদা বেড়াব।

মা জানতে পারবেন না?

উহুঃ! এমন কায়দা করে ম্যানেজ করব—আমরা কখনো একসঙ্গে বেড়াইনি, দেখো কী ভালো লাগবে! তুমি লেকে গেছ কখনও? আমি তোমাকে লেক দেখাতে নিয়ে যাবো—

যদি আমাদের কেউ রাস্তায় দেখে ফেলে?

কেউ দেখবে না, আমি অনেক অচেনা অচেনা রাস্তা জানি।

আর পাঁচদিন বাদেই একতিরিশের রোববার। জিনিসপত্র গুছোনো, বাঁধাছাদা শুরু হয়ে গেছে। ইন্দ্রজিতের দাদা রঞ্জিত এসব কাজে খুব পাকা, সে ওদের সাহায্য করছে খুব। একটা পায়া ভাঙা টেবিল অনিমা রঞ্জিতকে দানই করে দিলেন। বাবলুর খুব ইচ্ছে আগে একবার গিয়ে নতুন বাড়িটা দেখে আসে। রোজই তাই নিয়ে বায়না ধরছে। বিনয়েন্দ্রের সময় নেই, অনিমা তাই বললেন . আচ্ছা তুই আর দিদি আজ বিকেলবেলা ঘুরে আয়। ইন্দ্রজিৎকে বল না তোদের সঙ্গে নিয়ে যাবে।

বাইরে বেরুবার সময় অদিতি আজকাল ফ্রক পরে না, একটা কালো রঙের সিল্কের শাড়িতে ওকে একটা ফুরফুরে দোয়েল পাখির মতন দেখাচ্ছে। বাবলু কিছুতেই মোজা পরতে চায় না, অদিতি ওকে জোর করে সু এবং মোজা পরিয়েছে। ইন্দ্রজিৎ পরেছে পায়জামা আর মুগার পাঞ্জাবি, তার চটি পরা পা দুখানি তার মুখের মতনই ঝকঝকে পরিষ্কার। পথে বেরিয়ে অত্যন্ত দায়িত্বসম্পন্ন মানুষের মতন সে বাবলুর হাত ধরে রইল, বাসে ওঠবার সময় সে সাবধানে বলল . লেডিজ, একদম রোখকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে গম্ভীরভাবে টিকিট কাটল। মাঝে মাঝে অদিতির সঙ্গে চোখাচোখি হতে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইল, বাবলু সঙ্গে আছে—তাই যে-সব কথা বলতে ইচ্ছে করছে তা সে বলতে পারছে না। একবার সে শুধু একটু ফিসফিস করে বলেছিল . তোমাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে অদিতি, সত্যি।

অদিতি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, যাঃ।

ইন্দ্রজিৎকে কেউ বলে দেয়নি, তবু যেন সে মনে মনে কল্পনা করে রেখেছিল—

অদিতিদের নতুন বাড়ি হবে একটা সুন্দর বাংলো ধরনের একতলা, আলাদা বাড়ি, সামনে থাকবে চমৎকার একটা বাগান, কেন জানি না সে ভেবেছিল, বাড়িটার রং হবে ধবধবে সাদা। বাগান পেরিয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, তার কাছেই থাকবে বৈঠকখানা।

ঠিকানা মিলিয়ে এসে দেখলো, একটা লালচে রঙের দোতলা বাড়ি, সামনে একটুখানি জমি আছে বটে, তাতে কয়েকটা এলোমেলো গাছ—কোনো বাগান নেই। বাড়ির দোতলায় বাড়িওলা থাকে, একতলাটা শুধু অদিতিদের। দরজায় অন্যলোকের নাম লেখা পাথরের ট্যাবলেট লাগানো। গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা বিশাল কুকুর ঘেউঘেউ করে ছুটে এল। ইন্দ্রজিৎ কুকুরকে বিষম ভয় পায়, সে সঙ্কুচিত হয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল।

একটু পরেই ভেতর থেকে একুশ-বাইশ বছরের একটি সুন্দর মতন ছেলে বেরিয়ে এল, তার পরনে প্যান্ট ও তোয়ালে জামা, মাথায় ঝাঁকড়া—কোঁকড়া চুল। ছেলেটি বলল . কী চাই? ওরা কেউ কিছু বলার আগেই বাবলু বলে উঠল . আমরা এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি। আমরা বাড়ি দেখতে এসেছি! ছেলেটি বলল . ও আপানরা মি. সেনগুপ্তর ফ্যামিলি থেকে? আসুন!

ছেলেটি শক্ত হাতে কুকুরটার বগলস চেপে ধরে গেট খুলল। মাঠটা পেরুবার সময় বললো . আপনারা তিন ভাই বোন?

ইন্দ্রজিৎ বলল . না, না…

অদিতি বলল . উনি আমার দাদা নন।

ইন্দ্রজিৎ বলল . ওদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি! সঙ্গে এসেছি!

ছেলেটি বলল . ও, নমস্কার। আমার নাম সিদ্ধার্থ মজুমদার।

ইন্দ্রজিৎ বলল . নমস্কার। আমার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়চৌধুরী। ওর নাম অদিতি, আর এর নাম বাবলু, ভালো নাম দেবকুমার।

একতলায় সাড়ে তিনখানা ঘর অদিতিদের, নতুন বাড়ি—তাই ঘরগুলো বেশ পরিষ্কার, বাথরুমটা বেশ বড়োসড়ো, রান্নাঘরে গ্যাসের কানেকশান আছে। সিদ্ধার্থ ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সিঁড়ির পাশের ঘরটাও ওরা ভেবেছিল অদিতিদের, কিন্তু সেই ঘরের দরজা খুলে সিদ্ধার্থ বলল . এইটে আমার পড়ার ঘর। আসুন, একটু বসবেন। চা খাবেন তো, আপনি নিশ্চয়ই খাবেন? আর আপনি? দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হল অদিতিকে, সে উত্তর দেবার আগেই বাবলু বলল . আমিও চা খাবো।

অদিতিকে এর আগে কোনো ছেলে আপনি বলে কথা বলেনি, সে লাজুকভাবে ঘাড় হেলালো শুধু। সিদ্ধার্থ বলল . বসুন, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।

বেশ ছিমছাম সাজানো ঘর। রেক্সিন মোড়া বড়ো টেবিল, বইয়ের র‌্যাকে অনেক বই—বেশির ভাগই ইংরেজি। দেয়ালে ব্র্যাডম্যান, ফ্রাঙ্ক ওরেল, ডব্লু. জি. গ্রেস ইত্যাদির বাঁধানো ছবি। চাকর এসে চা দিয়ে গেল। ইন্দ্রজিৎ ছবিগুলো দেখছিল, তাই সিদ্ধার্থ বলল . আমি কলেজের ক্রিকেট টিমের স্কিপার। আপনার কোন কলেজ? আমার সেন্ট জেভিয়ার্স। থার্ড ইয়ার।

ইন্দ্রজিৎ বলল . আমি আশুতোষে পড়ি।

ও। কোন ইয়ার?

ফার্স্ট ইয়ার?

দুনিয়ার সমস্ত থার্ড ইয়ারের ছেলে সমস্ত ফার্স্ট ইয়ারের বালকদের দিকে যে রকম কৃপার দৃষ্টিতে তাকায়, সিদ্ধার্থ সেইরকম সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে বলল . আপনাদের আশুতোষে স্পোর্টসের ব্যাপারে বোধ হয় তেমন এনকারেজমেন্ট নেই। ওখানে তো ইউনিয়ন নিয়েই সবসময় গণ্ডগোল লেগে আছে—

ইন্দ্রজিৎ বিব্রতভাবে বলল . আমি ওসবের মধ্যে থাকি না। বাড়ির কাছে বলেই আমি আশুতোষে ভরতি হয়েছি, ইচ্ছে করলে প্রেসিডেন্সিতেও আমি ভরতি হতে পারতুম। আমিও ফার্স্ট ডিভিশান পেয়েছিলুম।

কথাটা বলেই ইন্দ্রজিৎ লজ্জা পেল। ছি, ছি, ফার্স্ট ডিভিশনের কথাটা নিজের মুখে বলা তার উচিত হয়নি। অদিতি চকিতে একবার ওর দিকে তাকাল। সিদ্ধার্থ খুব ভদ্র, সে ওর লজ্জা ঢাকা দেবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল . না, সব কলেজেই পড়াশুনো প্রায় এক। বাড়ির কাছে কলেজই ভালো। আননেসেসারিলি বাস জার্নির অরডিয়েল ভোগ করতে হয় না। আর, আপনি কোন কলেজে?

এবার অদিতির লজ্জা পাবার পালা, সে টেবিলে আঙুল নিয়ে আঁচড় কাটতে কাটতে বললো . আমি কলেজে পড়ি না। আমার ক্লাস ইলেভেন।

বাবলু বলল . আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আচ্ছা এ বাড়ির ছাদ আছে?

হ্যাঁ আছে, ওই সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে যাও। যাও না, কোনো ভয় নেই, আমি কুকুর বেঁধে রেখেছি।

অদিতি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল . কুকুরটার নাম কী?

জুলি। আপনি কুকুর খুব ভালোবাসেন?

হ্যাঁ।

ওই কুকুরটাকে নিয়েই আমার বেশি সময় কাটে। বাড়ি তো ফাঁকা—মা, বাবা আর আমি। আমার বাবা টেনান্ট নেবার ব্যাপারে খুব সিলেকটিভ। পছন্দ না হলে নেন না, তিনমাস আমাদের ওই অ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে আছে। আপনারা এলে আবার বাড়িটা বেশ জমজমাট হবে।

বেশি দেরি করলে বাড়িতে চিন্তা করবে, তাই ইন্দ্রজিৎ একবার ওঠার কথা বলল। বাবলুকে ডেকে আনা হল। ঢোকার সময় নজর করেনি, এবার ওরা লক্ষ করল সামনের জমিটায় একটা ছিপছিপে সাদা রঙের গাছ। ইন্দ্রজিৎ জিজ্ঞেস করল . এইটা ইউক্যালিপটাস, না?

হ্যাঁ। আমাদের মধুপুরের বাড়িতে অনেক ইউক্যালিপটাস আছে। এখানে তিনটে লাগানো হয়েছিল, মাত্র ওই একটাই বেঁচেছে।

এর পাতাগুলোর গন্ধ এমন সুন্দর হয়!

বাবলু বলল . ইন্দ্রদা, আমায় দুটো পাতা পেড়ে দাও না।

ইন্দ্রজিৎ বলল . না, এখন না, এ বাড়িতে তো থাকবেই, মাটিতে অনেক শুকনো পাতা পাবে—শুকনো পাতাতেও গন্ধ হয়।

না, এখন দাও।

নীচে একটাও শুকনো পাতা পড়ে নেই। ইন্দ্রজিৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিল। সিঁড়িতে দাঁড়ানো সিদ্ধার্থ বলল . হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিন না কয়েকটা পাতা। গন্ধটা ভালো লাগবে।

হাতের নাগালে একটাও পাতা নেই। সাদা রঙের গুঁড়িটা সোজা উঠে গেছে। একটু উঁচুতে কচি কচি চিকন পাতা। ইন্দ্রজিৎ গোড়ালির ওপর ভর দিয়েও পাতা ছুঁতে পারল না। তখন একটু ছোটো লাফ দিয়ে ধরার চেষ্টা করল, তাও হাত যায় না! বাবলু সোৎসাহে বলছে . ইন্দ্রদা, আরও জোরে লাফাও, আর একটু। ইন্দ্রজিৎ আরও জোরে লাফালো, তবু হাত যায় না, আরও জোরে লাফাতেই পকেট থেকে মানিব্যাগ, কলম ছিটকে পড়ে গেল। সে সেগুলো নীচু হয়ে তুলতে যেতেই সিদ্ধার্থ বলল . দাঁড়ান, আমি পেড়ে দিচ্ছি।

সিদ্ধার্থ সাবলীলভাবে একটি মাত্র লাফ দিয়ে একটা ছোটো ডাল ধরে ফেলল। কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে এনে, দুটো দিল বাবলুকে, বাকিগুলো হাতের তালুতে মুড়ে কচলাবার পর বলল. এবার দেখুন কী সুন্দর গন্ধ! অদিতি মুখ নীচু করে বড়ো শ্বাস টেনে বলল . আঃ, কী সুন্দর কচি কচি গন্ধ! আঃ—অদিতি নিজের থেকেই নাকটা কাছে এনে সিদ্ধার্থের হাতে ছুঁইয়ে বলল . কী চমৎকার লাগছে না গন্ধটা, ইন্দ্রদা, দেখুন!

ইন্দ্রজিৎ নিজের নাকটা নিয়ে এলো সিদ্ধার্থর হাতের দিকে। কিন্তু দমবন্ধ করে রইলো। নিশ্বাসে সে ঘ্রাণ নিল না।

বাইরে বেরিয়ে বাবলু অবিরাম বকবক করছিল, আর অদিতি একবার জিজ্ঞেস করল . ইন্দ্রদা অ্যাপার্টমেন্ট মানে কী?

ভাড়া দেয়ার ফ্ল্যাটকেই কায়দা করে অ্যাপার্টমেন্ট বলছিল।

ওঁর ইংরেজি উচ্চারণ ভারি চমৎকার না? কী রকম সুন্দরভাবে বলছিলেন!

কথা ছিল ইন্দ্রজিৎ আর রঞ্জিত মালপত্র নিয়ে ওদের সঙ্গেই যাবে। কিন্তু শনিবার দিন বেশি রাত্রে বাড়ি ফিরে ইন্দ্রজিৎ মাকে বলল . মা, কাল আমায় খুব ভোরে ডেকে দেবে। আমাদের কলেজের পিকনিক আছে।

রত্নপ্রভা বললেন . সে কি রে? কাল ওরা বাড়ি পাল্টাচ্ছে, তুই ওদের সঙ্গে যাবি না?

না, উপায় নেই। কলেজের প্রফেসাররা সব যাচ্ছেন—আমাকে যেতেই হবে। ডেকে দিও, ঠিক।

ইন্দ্রজিৎ পাশের ঘরে যেতেই রত্নপ্রভা স্বামীকে বললেন . ও পাশের গিন্নি মিষ্টি কথা বলে ছেলে দুটোকে একেবারে চাকরের মতন খাটাচ্ছে। আমি পরের ছেলেকে ওরকমভাবে খাটাতে পারতুম না।

ইন্দ্রজিৎকে ডাকতেও হয়নি, সারারাত বুঝি সে জেগেই ছিল। খুব ভোরে, তখন আলো ফোটেনি, কারুকে কিছু না বলে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে সে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে শুনল ফার্স্ট ট্রেন ছাড়ছে ক্যানিং-এর দিকে। ক্যানিং-এর টিকিট কেটে সে উঠে পড়ল। এই প্রথম সে একা একা ট্রেনে যাচ্ছে, কিন্তু তার একটুও ভয় করছে না। জানালার ধারে মাথা রেখে সে ভোরের টাটকা হাওয়া বুক ভরে নিতে লাগল।

খানিকটা বাদেই দেখল একটা স্টেশনের নাম চম্পাহাটি। হঠাৎ সেখানেই নেমে পড়ল ইন্দ্রজিৎ। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চা আর এস বিস্কুট খেল। তারপর স্টেশন ছেড়ে, পুকুরপাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে পৌঁছোলো। বাজার পেরিয়েও সোজা রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল একটা কচুরিপানা ভরতি খাল। খালের উঁচু পাড় ধরে ইন্দ্রজিৎ আপন মনে হাঁটতে লাগল। পাশে দু-একখানা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে—তারপর ফাঁকা মাঠ। একটা ফণীমনসার গাছে দুটো প্রজাপতি ছুঁই ছুঁই খেলার মতন একবার করে বসছে আর উড়ে যাচ্ছে, বসছে আর উড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ আপন মনে বললো . সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়লেই ভালো ইংরেজি জানা হয় না। আমিও ইংরেজিতে সিক্সটি সিক্স পারসেন্ট নম্বর পেয়েছিলুম। অমন কথায় কথায় কায়দা করে ইংরেজি বলা পছন্দ করি না! বুঝলে?

খালের পাড় ধরেই ইন্দ্রজিৎ হাঁটতে লাগল। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় তার এত ভালো লাগছিল যে সে ঠিক করল সারাদিন ওই মাঠের মধ্যেই থাকবে। একটু বাদে সে আপন খেয়ালে দৌড়তে লাগল। যেন সে ছুটতে ছুটতে গিয়ে ওই খালটা কোথায় শেষ হয়েছে তাই দেখবে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়বার পর সে হাঁপিয়ে গিয়ে এক জায়গায় বসল। তখন ও বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিচ্ছে। খালের জলে অল্প স্রোতে কচুরিপানাগুলো ভেসে যাচ্ছে। কয়েকটা মাটির ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে টুপটুপ করে জলে ছুঁড়তে লাগল। এবার আমি ওই ফুলটায় লাগাবো, ওই যে ওইটা।

ঠিক টিপ মতন এক জায়গায় ঢিল লাগাবার পর ইন্দ্রজিৎ মনে মনে বলল . সবাই উঁচু দিকে লাফাতে পারে না। আমি হাইজাম্পে পারবো না। কিন্তু আমার সঙ্গে রানে রেস দিয়ে কেউ পারবে? আসুক দেখি! আমি সামনে ছুটে যাবার প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হবো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *