ঈদ ভয়ংকর!
ভাবতে অবাক লাগে, একসময় আমার ঈদও আনন্দময় ছিল। তখন আমাকে ঈদসংখ্যায় উপন্যাস লিখতে হতো না। কারণ ‘ঈদসংখ্যা’ নামক কোনো বস্তু ছিল না। বিটিভিতে ঈদের হাসির নাটক লিখতে হতো না, এই দায়িত্ব জনাব আমজাদ হোসেন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। বিটিভির কর্মকর্তা মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের কাছে শুনেছি, আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে ঈদের নাটক আদায় করা কঠিন ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে কাগজ-কলম দিয়ে বিটিভির একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। নাটক শেষ হলে মুক্তি, তার আগে না।
মানুষের কোনো সুখই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমারও ঈদসুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের ফাঁদে পড়ে এক ঈদে হাসির নাটক লিখতে রাজি হলাম। সবাই খাল কেটে কুমির আনে, আমি খাল কেটে অক্টোপাস নিয়ে এলাম। এই অক্টোপাস আমাকে আট পায়ে আঁকড়ে ধরল। বাংলাদেশের মানুষদের ঈদের দিনে হাসানো আমার পবিত্র এবং মহান দায়িত্ব হয়ে গেল।
যে-কোনো দায়িত্বের সঙ্গে টেনশন থাকে, সেই দায়িত্ব যদি মহান হয় টেনশন মহা হয়ে যায়। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি রোজার শুরুতেই। স্ক্রিপ্ট লিখি, স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয় না। আবার লিখি, আবার লিখি।
বিটিভির রিহার্সেল রুমে রিহার্সেল হয়। প্রতিবারই আমি উপস্থিত থাকি। রিহার্সেল শুনে নাটক কাটাকুটি করি। প্রযোজক বিরক্ত হয়ে বলেন, এত কাটাকুটি করলে কীভাবে হবে? প্রতিদিন নতুন সংলাপ দিলে আর্টিস্ট কীভাবে মুখস্থ করবে?
বিখ্যাত সব আর্টিস্ট, প্রায়ই তাদের অভিনয়ের প্যাটার্ন আমার পছন্দ হতো না। মুখ ফুটে বলতে পারতাম না। যেহেতু হাসির নাটক, সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই ভাবতেন দর্শক হাসানোর দায়িত্ব তাদের। অভিনয়ে স্থূলভাব চলে আসত। স্বাভাবিক সংলাপ তাদের অভিনয়ের গুণে অস্বাভাবিক শোনাত।
দৃশ্যগ্ৰহণও আমার মনের মতো হতো না। বড় অভিনেতাদের মুখের ওপর সবসময় ক্যামেরা ব্রা থাকত। ছোট অভিনেতারা বলতে গেলে ক্যামেরার আড়ালেই থাকতেন।
ইনডোরের শুটিং হতো দুদিন। দ্বিতীয় দিনেই শুরু হতো তাড়াহুড়া। শেষ ঘণ্টা বাজার আগে দেখা যেত আট-নটি দৃশ্য ধারণ করা হয় নি। পরিচালক মাথায় হাত দিতেন।
বিটিভি জমানায় (অন্য কোনো চ্যানেল যে জমানায় আসে নি, সেই জমানা) ঈদের দিন ঘুম ভাঙার পর থেকেই আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতাম। রাতে নাটক আছে। না জানি কেমন হবে? যাদের জন্যে নাটক বানানো হয়েছে, তারা পছন্দ করবে তো? প্রাণ খুলে হাসবে তো? আনন্দ পাবে তো? অসহনীয় টেনশনে ঈদ হয়ে যেত ভয়ঙ্কর।
এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক নোংরা এবং বিষাক্ত পানি প্রবাহিত হয়েছে, আমার জন্যে ঈদ ভয়ংকরই থেকে গেছে।
আগে একটা নাটক লিখতাম। টেনশন এক নাটকে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন এক ঈদে পাঁচটা-ছ’টা করে নাটক লিখতে হয়। আমি নিজে প্রচারের দিন কোনো নাটকই দেখতে পারি না। কোনটা দেখব? দর্শকরাও নাটক দেখেন না। তারা দেখেন বিজ্ঞাপন। ‘লেড়কা সে লেড়কাকা গু ভারী’র মতো নাটকের চেয়ে বিজ্ঞাপন ভারী হয়ে গেছে।
আমি কঠিন প্যাঁচে পড়েছি। গোদের উপর ক্যান্সারের মতো ঈদের নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঈদসংখ্যায় লেখা। আমি রক্তের মধ্যে ক্লান্তি অনুভব করছি।
ক্লান্ত চোখ ও ক্লান্ত চোখের পাতা
তাহার চেয়েও ক্লান্ত আমার পা।
মাঝ উঠোনে সাধের আসন পাতা
একটু বসি?
জবাব আসে, ‘না’।