ঈদ
মহবুব, শমশের, মাহতাব, গুলশন, বিদৌরা।
(মাহতাব গাহিতেছিল)
(গান)
বিদায়-বেলায় সালাম লহো মাহে রমজান রোজা।
(তোমার)
ফজিলতে হালকা হল গুণাহের বোঝা॥
ক্ষুধার বদলে বেহেশ্তি ঈদের সুধা তুমি দিলে,
খোদার সাধনার দুঃখে কী সুখ তুমি শিখাইলে,
(তুমি)
ইশারাতে খোদার পাওয়ার পথ দেখালে সোজা॥
ভোগ-বিলাসী মনকে আনলে পরহেজগারীর পথে,
দুনিয়াদারি করেও মানুষ যেতে পারে জান্নাতে;
কিয়ামতে তোমার গুণে ত্রাণ করবেন বদরুদ্দোজা।
মহবুব॥
মাহতাব। আজ ঈদের ভোরে আবার রোজার গান কেন?
মাহতাব॥
মহবুব! মহ্বুবের রোজা ফুরায়, মাহতাবের রোজা ফুরায় না। রোজার তৃষ্ণা তার যায় না; রোজা ফুরালে যে ঈদ ফুরিয়ে যাবে! তুমি মহবুব, তোমার হয়তো রোজা শেষ হয়ে গেছে।
বিদৌরা :
মহবুব ভাই এত সকালে?
মহবুব :
বিদৌরা! আজ ভোরে কীসের খুশিতে মন যেন শিউলি-ঝরা আঙিনার মতো রেঙে উঠেছে। এই নাও – আমার রুমালের ঝরা শিউলি তোমার আঁচলে উঠে বেঁচে উঠুক।
বিদৌরা :
দাদাভাই, মহবুব ভাই, তোমরা কোথাও যেয়ো না। আমি খোর্মা, সেমাই, আর আতরদানি এনে দিই।
শমশের :
(ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে) শমশের ঘরে এল–বিদৌরা! আমার জন্য গোলাপ-পানি আর সূর্মা!
বিদৌরা :
শমসেরকে আমার ভয়ানক ভয়, ও কেবল গলায় পড়বার জন্য ছটপট করে বেড়ায়।
(দূরে গুলশনের হাসি)
শমশের :
ও নিশ্চয় গুলশনের হাসি।
মাহতাব :
গুলশনের বুকেই যত বুলবুলের ভিড় কিনা। আচ্ছা শমশের, এই ঈদের মানে কী জান?
মহবুব :
মাহতাব! দোহাই, আজ রসের ঈদ, আনন্দের ঈদ, আজ আর তত্ত্ব নয়। তত্ত্বের কথা শুনব বকরীদে। এক মাসের উপোসি রসনা আজ রসের তৃষ্ণায় অধীর হয়ে উঠেছে।
শমশের :
মাহতাব যে সেই রসের পিয়ালা, সেই খুশির পিয়ালা, মহবুব!
মহবুব :
হাঁ,তা বটে। তবে ওর খুশির কথায় আমার কিন্তু মাঝে মাঝে গলা খুশখুশ করে।
মাহতাব :
সেমাই খোর্মা চা আসছে মহবুব – তোমার গলা খুশখুশানি বন্ধ হবে।
শমশের :
মাহতাবের অর্থাৎ চাঁদের জ্যোৎস্না পান করে চকোর-চকোরী আর শাপলা ফুল। মাহতাব সকলের জন্য নয়। বলো মাহতাব কী বলছিলে? সত্যি এই এক মাস উপোস করে কী লাভ হয়।
মাহতাব :
শমশের! আমরা যে ক্ষীর-সন্দেশ, বা পোলাও-কোর্মা মসজিদে পাঠাই, তা কি আল্লাহ্ খান? ওই ক্ষীর-সন্দেশ, ফিরনিই শিরনি হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে। আমাদের অশুদ্ধ দেহ-মনের দান আল্লাহ্র নামে নিবেদিত হয়ে শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। এ আল্লাহ্র পরীক্ষা। তাঁর রহম ও রহমত, কৃপা ও কল্যাণ পেতে হলে আমাদের দেহ-মনকে মাঝে মাঝে উপবাসী রাখতে হয়। এই উপবাসে দেহ-মনের ভোগের তৃষ্ণা যখন চলে যায়, তখনই ঈদের অর্থাৎ নিত্য-আনন্দের চাঁদ, পরমোৎসবের চাঁদ ওঠে।
শমশের :
সত্যি, এক মাস রোজা রেখে ঈদের যে অপূর্ব আনন্দ পাই–তা বৎসরের আর কোনোদিন পাওয়া যায় না।
মাহতাব :
হ্যাঁ, এ তো দেহের রোজা, মনের রোজা রাখলে অর্থাৎ তাকে ভোগের থেকে ফিরিয়ে রাখলে দুর্ভোগ কমে যায় – শান্তি আনন্দ আল্লাহ্র কাছ থেকে নেমে আসে।
গুলশন :
চা সেমাই সব যে ঠান্ডা হয়ে গেল। এর মধ্যে মহবুব ভাই-ই সব চেয়ে চালাক। ও রসও পান করছে, তত্ত্বও শুনছে। তোমরা তত্ত্ব-বিলাসী, তোমাদের রসের খোরাক জুড়িয়ে গেল।
মহবুব :
গুলশনই বুলবুলকে চেনে। এইবার ওরা রস গিলুক, আমি গিলে ফেলেছি। তুমি গানের রস পরিবেশন করো।
গুলশন :
আমার আবার গান। শমশের হয়তো রাগে ঝলমলিয়ে উঠবে।
শমশের :
ভয় নাই গুলশন, কাছে মাহতাব আছে –প্রেমে গলিয়ে দেবে।
(গুলশনের গান)
নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।
আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার॥
নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি
ওতেই আমায় মানায় ভারী,
কলমা আমার কপালে টিপ
নাই তুলনা তার॥
হেরা গুহার হিরার তাবিজ
কোরান বুকে দোলে,
হাদিস ফেকাহ্ বাজুবন্দ,
দেখে পরান ভোলে।
হাতে সোনার চুড়ি যে মা
হাসান হোসেন মা ফাতেমা,
(মোর) অঙ্গুলিতে অঙ্গুরি,মা,
নবির চার ইয়ার॥
শমশের :
সাবাস গুলশন। ঈদ মোবারক হো! ঈদ মোবারক – গুলশন মোবারক!
গুলশন :
বিদৌরা, মোবারক বলো! নইলে পর্দার আড়ালে তার রাগ তিন পর্দা চড়ে যাবে।
বিদৌরা :
শমশের ভাই! ভয়ে আসিনি, যা ঝলমল করছ।
শমশের :
বিদৌরা, মোবারক! মহবুব মোবারক! না বিদৌরা, গুলশন এসে শমশেরের ঝলমলকে মলমল করে তুলেছে।
মহবুব :
সব মোবারক হল– মাহতাব মোবারক হো, বললে না যে কেউ। মাহতাব মানে চাঁদ, এই মাহতাব, এই চাঁদই আমাদের নিরাশার আঁধার রাতে ঈদের চাঁদ এনেছে।
শমশের :
নিশ্চয়ই! আমি তো ওরই হাতের শমশের, তলোয়ার!
মহবুব :
আমি তো ওরই প্রেমে মহবুব।
গুলশন :
আমি ওরই রচিত গুলশন–শীর্ণ প্রান্তরকে ওরই আদর, ওরই যত্ন গুলশনের ফুলবনে পরিণত করেছে। বিদৌরা, চুপ করে রইলি যে।
বিদৌরা :
আল্লাহ্ জানেন, ওই মাহতাবের মহিমাই আমায় বিদৌরা করেছে।
মহবুব :
এসো, আমরা সকলে মিলে ওই আল্লাহ্র দান মাহাতবকে মোবারকবাদ দিই।
সকলে :
ঈদ মোবারক হো! মাহতাব মোবারক হো! মাহতাব মোবারক।
শমশের :
আজকার ঈদগাহে তুমিই তো আমাদের ইমাম।
মাহতাব :
আল্লাহু আকবর! আমি ইমাম নই, আমি মুয়াজ্জিন। আমি আজান দিয়ে তোমাদের আনন্দের ঈদগাহে ডেকে এনেছি। মুয়াজ্জিন যে কেউ হতে পারে, ইমাম হয় আল্লাহ্র ইচ্ছায়।
মহবুব :
আমরা যদি বলি, আল্লাহ্র সেই ইচ্ছা তোমাতে অবতরণ করেছে।
মাহতাব :
আল্লাহ্ আমায় সব অহংকার, সব প্রলোভন থেকে রক্ষা করুন। ইমাম তোমাদের মাঝেই লুকিয়ে আছেন। তিনিই এই নবযুগের সর্বভ্রাতৃত্বের ঈদগাহে আত্মপ্রকাশ করবেন আল্লাহ্র ইচ্ছায়। জমায়েত সেদিন সার্থক হবে। সেই দিন আমরা এই মহামিলনের ঈদগাহে সর্ব জাতিধর্ম, হানাহানি ঈর্ষা ভেদ ভুলে সর্বধর্মের পূর্ণ সমন্বয় – সেই পরম নিত্য পরম পূর্ণ সনাতন আল্লাহ্কে একসাথে সিজদা করব – নামাজের শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে পরস্পরকে আলিঙ্গন করব । কোথায় সেই সর্বত্যাগী ফকির, কোথায় সেই মহাভিক্ষু? এক আল্লাহ্ জানেন। আমি তাঁর বান্দা, হুকুম-বরদার! যেদিন তাঁর হুকুম আসবে – সেদিন এই বান্দা তাঁর সিংহাসনের দিকে শির উঁচু করে ক্রন্দন করে উঠবে – আল্লাহ্, তোমার নিত্য দান তোমার হুকুম-বরদার বান্দা হাজির।
মহবুব :
ইনশাআল্লাহ্ !মা শা আল্লাহ্। জাজা কাল্লাহ্! আল্লাহ্র হুকুম-বরদারই অন্যকে হুকুম করতে পারে। সেই সর্বত্যাগী ফকিরই সামান্য জীবকে ইমাম করে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন। তিনি যে সকলের, তাই সকলকে ছেড়ে, জামাতকে ছেড়ে আগে গিয়ে দাঁড়ান না। আল্লাহ্র ইচ্ছায় ইমাম হয়, আল্লাহ্ তো ইমাম হন না। আপনি যে আল্লাহ্র ইচ্ছায় আপনার সকল ইচ্ছা সেই পূর্ণ পরম ইচ্ছাময়কে সমর্পণ করেছেন। এক আল্লাহ্র ইচ্ছাই সকল ইমামকে পরিচালিত করে। মাহতাব ভাই, ক্ষমা করো, তুমি কি আল্লাহ্র সেই গোপন ইচ্ছা ?
মাহতাব :
(হাসিয়া) আল্লাহ্ জানেন। তোমরা যখন আমাকে এইসব কথা বলছিলে, আমার প্রতি অণু-পরমাণু কেঁপে আল্লাহ্র উদ্দেশে বলছিল, ‘আল্লাহ্তুমি জান, আমাদের ব্যক্ত-অব্যক্ত সর্ব-অস্তিত্ব তোমার ইচ্ছায় সৃষ্ট হয়, পরিবর্তিত হয়। আমরা যদি সুন্দর হই, সে যে তোমার সাধ, তোমার ইচ্ছা, তোমার লীলা, তোমার বিলাস। তাই তোমরা যে ভালোবাসা প্রেম শ্রদ্ধা আমায় দাও, তা আমি আল্লাহ্কে নিবেদন করে দিই। আমার সর্ব-অস্তিত্বের যে তিনি একমাত্র অধিকারী।”
বিদৌরা :
আচ্ছা মাহতাব ভাই, এই যে এত ছেলেমেয়ে কী যেন অজানা আকর্ষণে তোমায় জড়িয়ে ধরতে চায়, প্রেম দেয়, মালা দেয় – তুমি তার কিছুই গ্রহণ কর না?
মাহতাব :
চাঁদকে দেখে ফুল ফোটে, চকোর-চকোরী কাঁদে। চাঁদ ফুল ফুটায়, চকোরীকে কাঁদায় – কিন্তু সে ফুলের গন্ধ কি সে চকোরীর কাঁদন দেখে বিচলিত হয়? ওই ফুলের গন্ধ চকোরীর ক্রন্দন, চাঁদকে ছুঁয়ে আল্লাহ্র কাছে চলে যায়। চাঁদ যদি ওই দান নিত, তাহলে চাঁদ শুকিয়ে মরা তারার মতো ঘুরে বেড়াত আঁধারের প্রেতলোকে। নদীতে যে ফুল ঝরে, নদী কি তা নেয়? সেই ফুল নদী তার প্রিয়তম মহাসাগরকে দেয়। উপনদী নদীতে পড়ে, সেই উপনদীর জল কি নদী নেয়? সেই উপনদীর জলকে সমুদ্রের জলে পৌঁছে দেয়।
গুলশন :
এ কী করুণ বৈরাগ্য তোমার। কেন, কেন তুমি নিজেকে এত বেদনা দাও? কেন এমন নিষ্ঠুরেরর মতো তুমি নিজেকে অবহেলা কর, বঞ্চিত কর? তোমার এই নিজেকে এই অবহেলাই আমাদের এমন করে কাঁদায়!
মাহতাব :
(হাসিয়া) আমি খুলে বলি। তোমরা যে প্রেম আমায় দাও, তা যদি আমার কামনার অগ্নিতে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যেত, তাহলে তোমরাও আমাকে হারাতে, আমিও তোমাদের হারাতাম। আল্লাহ্কে দিয়েছি বলেই তোমাদের প্রেম আজ এত বিপুল প্রবাহের আকার ধারণ করেছে। তোমাদের দেওয়া প্রেম আল্লাহ্কে দিয়েছি বলে সেই প্রেম আজ সকলে পাচ্ছে। আল্লাহ্ যে সর্বময়। যেখানে আল্লাহ্ নাই, তাঁর অস্তিত্বও নাই; যেখানে অস্তিত্ব সেইখানেই আল্লাহ্। কাজেই আল্লাহ্র দেওয়া তোমাদের এই প্রেম তাঁকে দিলে তাঁর সকল অস্তিত্ব অর্থাৎ সমস্ত জড় জীব ফেরেশতা মানুষ সেই প্রেমের স্বাদ পায়। সেই প্রেমে তারা গলে যায় – তাদের সমস্ত মন্দ ভালো হয়ে যায়।
গুলশন :
বুঝলাম। কিন্তু তুমি কী পেলে?
মাহতাব :
আমি আল্লাহকে পেলাম। অর্থাৎ তাঁরই অস্তিত্ব তাঁর ইচ্ছার সৃষ্টি তোমাদের সকলকে পেলাম। তাই আমার ঈদ ফুরায় না। আমার ঈদ ফুরায় আবার আসে। নদী যেমন সাগরকে নিত্য পেয়ে আবার নিত্য তার পানে ‘পাইনি পাইনি’বলে কেঁদে কেঁদে ধায়, আমার মিলন-বিরহ তাঁর সাথে তেমনি নিত্য। এ বোঝাবার ভাষা নাই; নদী হও, তখন বুঝবে। বিরহের রোজা না রাখলে কি প্রেমের চাঁদ দেখতে?
মহবুব :
ভাগ্যিস তুমি স্নিগ্ধ চাঁদ, প্রখর সূর্য নও, তা হলে এতক্ষণ গলে মোম হয়ে যেতাম। বিদৌরা! একী! তুমি কাঁদছ কেন? চাঁদের এত স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাও এমন করে গলায়!গোসলের সময় হয়ে গেল, আল্লাহ্র লীলা-সাগরে অবগাহন করলাম তবু গোসল করতেই হবে, এও তাঁরই ইচ্ছা। এখন তাঁরই ইচ্ছায় ‘এল ঈদ ঈদ’ গানটা গাও তো।
(বিদৌরার গান)
এল ঈদল-ফেতর এল ঈদ ঈদ ঈদ।
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল নাকো নিঁদ॥
রোজা রাখার ফল ফলেছে দেখ রে ঈদের চাঁদ,
সেহরী খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ।
ওরে বাঁধ আমামা বাঁধ।
প্রেমাশ্রুতে ওজু করে চল ঈদগাহ মসজিদ॥
(আজ)
ছিটায় মনের গোলাব-পাশে খুশির গোলাব-পানি
(আজ)
খোদার ইস্কের খশবু-ভরা প্রাণের আতর-দানি।
ভরল হৃদয়-তশতরিতে শিরনি তৌহিদ॥
(দেখ)
হজরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে,
সেই চাঁদেরই রং যেন আজ সবার বুকে লাগে।
(এই)
দুনিয়াতেই মিটল ঈদে বেহেশ্তি উমিদ॥