ইহুদীর কবচ – আর্থার কনান ডয়েল
॥ ১ ॥
প্রাচ্যের পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আমার বিশিষ্ট বন্ধু ওয়র্ড মর্টিমারের জ্ঞান ছিল অসামান্য। সে এ বিষয়ে বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছিল, মিশরের ভ্যালি অফ দ্য কিংসএ খনন কার্য তদারকের সময় একটানা দু’বছর থীবিসের একটি সমাধি গ্হে বাস করেছিল, আর যে কাজটা করে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছিল, সেটা হল ফাইলীতে হোরাসের মন্দিরের একটি ভিতরের ঘরে ক্লিওপ্যাট্রার মামি আবিষ্কার। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে যে লোক এত কিছু করতে পেরেছে তার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল হতে বাধ্য সেটা প্রায় সকলেই বিশ্বাস করত। তাই মর্টিমার যখন বেলমোর স্ট্রীট মিউজিয়মের তত্ত্বাবধায়কের কাজটা পেল, তখন কেউই বিশেষ অবাক হয়নি। এই পদ যিনি পাবেন, তিনি সেই সঙ্গে ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যাপকের পদেও অধিষ্ঠিত হবেন, এবং তার ফলে তাঁর মাসিক রোজগার যা হবে তাতে সচ্ছল জীবনযাত্রার সঙ্গে গবেষণার কাজও চালানো যায়।
শুধু একটা কারণেই ওয়র্ড মর্টিমার কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছিল। সেটা হল, যে-তত্ত্বাবধায়কের স্থান সে দখল করেছিল তাঁর অতুল খ্যাতি। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ, এবং খ্যাতি সারা ইউরোপ জোড়া। দেশবিদেশ থেকে তরুণ ছাত্ররা আসত তাঁর বক্তৃতা শুনতে। তাছাড়া মিউজিয়মের মহামূল্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য তিনি যে ব্যবস্থা করেছিলেন, সকলেই একবাক্যে তার প্রশংসা করত। ফলে পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি হঠাৎ এমন একটি চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে সকলেই বেশ অবাক হয়েছিল। ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্ড্রিয়াস স্বভাবতই তাঁর মেয়েকে নিয়ে মিউজিয়ম-সংলগ্ন তাঁর বাসস্থান ত্যাগ করে চলে যান, আর তাঁর ঘরগুলি দখল করে আমার অকৃতদার বন্ধু ওয়র্ড মর্টিমার। চাকরিটা পাবার কয়েকদিনের মধ্যেই মর্টিমারকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানালেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। যেদিন প্রথম এই দুজনের পরিচয় হয় পরস্পরের সঙ্গে সেদিন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। অ্যান্ড্রিয়াস সেদিন তাঁর সংগ্রহশালার আশ্চর্য জিনিসগুলি আমাদের দেখালেন। প্রোফেসরের সুন্দরী মেয়ে এবং উইলসন নামে একটি যুবক (বোঝাই যাচ্ছিল ইনি অধ্যাপক-দুহিতার পাণিপ্রার্থী) আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সংগ্রহশালায় সবশুদ্ধ পনেরটি ঘর; তার মধ্যে ব্যাবিলন ও সিরীয়ার সভ্যতা সংক্রান্ত দুটি, আর সংগ্রহশালার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত প্রাচীন মিশরীয় ও ইহুদী সভ্যতা সংক্রান্ত একটি ঘরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস এমনিতে চুপচাপ মানুষ, কিন্তু তাঁর সংগ্রহের প্রিয় জিনিসগুলি দেখাবার সময় তাঁর শ্মশ্রুগুম্ফহীন শুকনো মুখখানা উৎসাহে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পুরাতত্ত্বের এই মহামূল্য নিদর্শনগুলির উপর থেকে তাঁর হাত যেন আর সরতে চায় না। বেশ বোঝা যায় সেগুলি তাঁর গর্বের বস্তু, এবং সেগুলি অন্যের আওতায় চলে যাওয়াটা যেন তাঁর পক্ষে এক মর্মান্তিক ঘটনা।
তাঁর সংগ্রহশালার মামিগুলি, তাঁর প্রাচীন পুঁথির সম্ভার, তাঁর স্ক্যারাবের সংগ্রহ, ইহুদী সভ্যতার যাবতীয় নিদর্শন, আর টাইটাস কর্তৃক রোমশহরে আনা বিখ্যাত সপ্তপ্রদীপের অবিকল প্রতিরূপ (আসলটি টাইবার নদীগর্ভে নিমজ্জিত)-এ সবই একের পর এক আমাদের দেখালেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। তারপর তিনি হলঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা একটি শো-কেসের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে গভীর সম্ভ্রমের সঙ্গে তার উপর ঝুঁকে পড়লেন।
‘আপনার মতো বিশেষজ্ঞের পক্ষে এ জিনিসটা হয়তো তেমন বিস্ময়কর কিছু নয়,’ মর্টিমারকে উদ্দেশ করে বললেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, ‘কিন্তু আপনার বন্ধু মিঃ জ্যাকসনের পক্ষে হওয়া উচিত।’
এবার আমিও কাঁচের আবরণের উপর ঝুঁকে পড়ে দেখলাম কেসের ভিতর রাখা রয়েছে হাতের তেলোর মতো বড় সূক্ষ্ম কারুকার্য করা একটি চতুষ্কোণ সোনার পাত, যার উপর তিন সারিতে চারটি চারটি করে পাথর বসানো। পাতটির একদিকে দুই কোণে দুটি সোনার আংটা। সমান আয়তনের পাথরগুলো প্রত্যেকটি আলাদা জাতের এবং রঙের। রঙের বাক্সে পাশাপাশি খোপে খোপে যেমন বিভিন্ন রঙ সাজানো থাকে, এ যেন কতকটা সেইরকম। এও দেখলাম যে প্রত্যেকটি পাথরের উপর একটি করে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন খোদাই করা আছে।
‘মিঃ জ্যাকসন, আপনি কি উরিম ও থুমিমের কথা জানেন?’
‘নামগুলো আমার চেনা, কিন্তু তাদের মানে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না।’
প্রোফেসর বললেন, ‘ইহুদীদের প্রধান পুরোহিতের বুকে যে কবচটা ঝুলত তাকেই বলা হত উরিম ও থুমিম। ইহুদীরা এই কবচের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করত, যেমন রোমানরা করত ক্যাপিটলে রাখা সিবিলাইন পুঁথিগুলির প্রতি। সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা বারোটি মহামূল্য রত্ন দেখতে পাচ্ছেন। উপরে বাঁ-দিক থেকে শুরু করে পাথরগুলি হল কার্নেলিয়ান, পেরিডট, এমারেন্ড, রুবি, ল্যাপিস, ল্যাজুলি, অনিক্স, অ্যাগেট, অ্যামেথিস্ট, টোপ্যাজ, বেরিল আর জ্যাসপার।’
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম মণিমুক্তোখচিত মহামূল্য কবচটার দিকে। শেষে প্রশ্ন করলাম, ‘এই কবচের সঙ্গে কি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত আছে?’
‘জিনিসটা যে অতি প্রাচীন এবং অতি মূল্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নাই,’ বললেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও আমরা নানা কারণে বিশ্বাস করি যে এটা সেই সলোমনের মন্দিরের আদি ও অকৃত্রিম উরিম ও থুমিম। এ জিনিস ইউরোপের কোনো মিউজিয়মে নেই। আমার তরুণ বন্ধু ক্যাপ্টেন উইলসন মণিমুক্তো সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। উনিই বলবেন এই পাথরগুলো কত খাঁটি।’
তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্যাপ্টেন উইলসন দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ভাবী পত্নীর পাশেই। অল্প কথায় তিনি তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করলেন।
‘সত্যি কথা। আমি এর চেয়ে ভালো পাথর আর দেখিনি।’
‘স্বর্ণকারের কাজও দেখার মতো,’ বললেন অ্যান্ড্রিয়াস। ‘অতীতে স্বর্ণকারেরা—’
প্রোফেসরের কথার উপর কথা চাপিয়ে উইলসন বললেন, ‘ওর চেয়ে ভালো সোনার কাজের নিদর্শন দেখা যাবে এই মোমবাতিদানে।’ তাঁর দৃষ্টি এখন অন্য একটি টেবিলের দিকে। আমরা সকলেই শাখা-প্রশাখা-বিশিষ্ট সোনার বাতিদানটার আশ্চর্য কারুকার্যের প্রশংসায় উইলসনের সঙ্গে গলা মেলালাম।
অ্যান্ড্রিয়াসের মতো বিশেষজ্ঞের চোখ দিয়ে এই সব আশ্চর্য জিনিস দেখা পরম সৌভাগ্যের কথা। সত্যি বলতে কি, সব কিছু দেখা শেষ হলে পর প্রোফেসর যখন আমার বন্ধুকে জানালেন যে এখন থেকে এ সবই তার জিম্মায় চলে যাচ্ছে তখন ভদ্রলোকের জন্য বেশ কষ্টই হচ্ছিল, আর সেই সঙ্গে আমার বন্ধুর সৌভাগ্যকে খানিকটা ঈর্ষার চোখে না দেখে পারছিলাম না। এক সপ্তাহের মধ্যেই ওয়র্ড মর্টিমার বেলমোর স্ট্রীট মিউজিয়মের অধিকর্তা হিসাবে তার নতুন বাসস্থানে উঠে গেল।
এর দিন পনের পর মর্টিমার তার জনা-ছয়েক অকৃতদার বন্ধুদের সঙ্গে তার নতুন বাড়িতে একটা ভোজের আয়োজন করল। শেষে যখন সবাই যাবার জন্য উঠে পড়েছে, তখন মর্টিমার আমার কোটের আস্তিন ধরে একটা ছোট্ট টান দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে সে চায় আমি আর একটুক্ষণ থাকি।
‘তোমার বাড়ি তো এখান থেকে দশ-পা’, বলল মর্টিমার (আমি তখন অ্যালব্যানিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি)—‘তুমি একটু থেকে যাও। চুরুট সহযোগে দুজনে নিরিবিলি কথা হবে। একটা ব্যাপারে তোমার পরামর্শের দরকার।’
অগত্যা আমি একটি আরাম কেদারায় বসে মর্টিমারের একটি উৎকৃষ্ট ম্যাট্রোনাস চুরুট ধারালাম। সবাই চলে যাবার পরে সে পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে আমার সামনে বসল।
‘এই নামবিহীন চিঠিটা আজই সকালে এসেছে,’ বলল মর্টিমার। ‘আমি পড়ে শোনাচ্ছি, তারপর তুমি বল এ ব্যাপারে আমার কী কর্তব্য।’
‘বেশ তো—আমার সাধ্যমতো পরামর্শ দিতে আমি প্রস্তুত।’
‘চিঠিটা হচ্ছে এই—“মহাশয়, আপনার জিম্মায় যে সমস্ত মহামূল্য সম্পদ রয়েছে সেগুলি সম্পর্কে আপনাকে বিশেষ সাবধান হতে বলি। বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী একটিমাত্র পাহারাদারে কাজ হবে বলে আমি মনে করি না। আপনি এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে অপূরণীয় ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে।”
‘এই পুরো চিঠি?’
‘হ্যাঁ।’
‘অন্তত এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে তোমাদের ওখানে রাত্রে যে একটিমাত্র পাহারাদার থাকে সে খবরটা মুষ্টিমেয় যে কজন জানে তাদেরই একজন লিখেছে এ চিঠি।’
মর্টিমার এবার একটা রহস্যজনক হাসি হেসে চিঠিটা আমার হাতে দিল।
‘হস্তলিপি ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কোনো চর্চা করেছ?’ প্রশ্নটা করে মর্টিমার আরেকটা চিঠি আমার সামনে রেখে বলল, ‘এটার “কনগ্র্যাচুলেটের” “সি-র” সঙ্গে ওটার “কমিটেডের” “সি” মিলিয়ে দেখ। ক্যাপিটাল “আই”টাও লক্ষ্য কর, আর ফুলস্টপের জায়গায় ড্যাশ-চিহ্ন ব্যবহার করাটা।’ আমি বললাম, ‘দুটো চিঠি নিঃসন্দেহে একই লোকের লেখা, যদিও প্রথমটায় হাতের লেখা গোপন করার একটা প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে।’
‘দ্বিতীয় চিঠিটা হচ্ছে আমার এই নতুন চাকরিটা পাবার খবর পেয়ে প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের অভিনন্দন পত্র।’
আমি অবাক হয়ে চাইলাম মর্টিমারের দিকে, তারপর দ্বিতীয় চিঠিটা ওলটাতেই ‘মার্টিন অ্যান্ড্রিয়াস’ সইটা চোখে পড়ল। যে লোক হাতের লেখা নিয়ে সামান্যতম চর্চাও করেছে তার মনে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসই মিউজিয়মের সদ্য-ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ককে চুরির ব্যাপারে সাবধান হতে বলে এই নামহীন চিঠিটা লিখেছেন। ঘটনাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
‘কিন্তু ভদ্রলোক এমন চিঠি লিখবেন কেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘ঠিক এই প্রশ্নই আমি করতে চাই তোমাকে। তাঁর মনে যদি এ-ধরনের আশঙ্কা থেকেই থাকে তাহলে ত তিনি নিজে এসে আমাকে বলতে পারতেন।
‘তুমি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাও?’
‘সেখানেও ত গণ্ডগোল। উনি ত সোজাসুজি অস্বীকার করতে পারেন যে চিঠিটা উনি লিখেছেন।’
‘যাই হোক—এ চিঠির উদ্দেশ্য যে সৎ তাতে ত কোনো সন্দেহ নেই। উনি যে পরামর্শ দিয়েছেন সেটা মানতে কোনো বাধা আছে কি? এখন যে ব্যবস্থা চালু আছে সেটা কি সতর্কতার দিক দিয়ে যথেষ্ট?’
‘আমার ত তাই বিশ্বাস। দর্শকদের জন্য মিউজিয়ম খোলা থাকে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময়টা পাশাপাশি দুটো ঘরের জন্য একটি করে গার্ড মোতায়েন থাকে। দুটো ঘরের মাঝখানে যে দরজা সেখানে দাঁড়ায় গার্ড, ফলে একসঙ্গে দুটো ঘরেই সে চোখ রাখতে পারে।’
‘কিন্তু রাত্রে?’
‘পাঁচটার পর লোহার গেটগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে গেট খোলার সাধ্যি কোনো চোরের নেই। যে পাহারা দেয় সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। সে তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারা মিউজিয়মটা টহল দেয়। প্রত্যেকটি ঘরে একটি করে বিজলিবাতি সারারাত জ্বলে।’
‘তাহলে একমাত্র উপায় হচ্ছে দিনের গার্ডগুলিকে রাত্রেও রেখে দেওয়া।’
‘সেটা খরচে পোষাবে না।’
‘অন্ততঃ পুলিশে খবর দিয়ে বল যে বেলমোর স্ট্রীটে তারা যেন একটি বিশেষ কনস্টেবলের ব্যবস্থা করে। এই চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি যদি তাঁর পরিচয় গোপন করতে চান তাহলে কিছু বলার নেই। কেন তিনি এটা চাইছেন সেটা আশা করি এর পর কী ঘটে তার থেকেই বোঝা যাবে।’
এরপর অবিশ্যি এ বিষয়ে আলোচনা করার আর কিছু রইল না। আমি বাড়ি ফেরার পর সারারাত মাথা ঘামিয়েও প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের চিঠির পিছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা বুঝতে পারলাম না। এ চিঠি যে তাঁরই লেখা সে বিষয় বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মিউজিয়মে যে চোরের উপদ্রব হতে পারে সেটা তিনি আঁচ করেছিলেন; সেই কারণেই কি তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন? কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে সরাসরি মর্টিমারকে সতর্ক করলেন না কেন? আমি অনেক ভেবেও রহস্যের কিনারা করতে না পেরে শেষরাত্রে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, ফলে আমার উঠতেও দেরি হয়ে গেল।
ঘুমটা ভাঙ্গলও আশ্চর্যভাবে। নটা নাগাদ মর্টিমার হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকল। তার চাহনিতে গভীর উদ্বেগ। এমনিতে পোষাক-আষাকের ব্যাপারে মর্টিমার খুব পরিপাটি। কিন্তু আজ দেখি তার শার্টের কলার প্রায় খুলে এসেছে, গলার টাই আর মাথার টুপিরও প্রায় সেই দশা। তার সন্ত্রস্ত দৃষ্টি থেকে মোটামুটি বোঝা যায় কী ঘটেছে।
আমি তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বললাম, ‘মিউজিয়মে চোর এসেছিল বুঝি?’
‘ঠিকই ধরেছ। সেই পাথরগুলো—উরিম আর থুমিমের সেই অমূল্য পাথরগুলো!’ দৌড়ে আসার ফলে মর্টিমার হাঁফাচ্ছে। ‘আমি চললাম থানায়। তুমি যত শিগগির পার চলে এস জ্যাকসন—গুড বাই!’
উদ্ভ্রান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মর্টিমার আর পরক্ষণেই শুনলাম তার দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ।
আমি ওর কথামতো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিউজিয়মে পৌঁছে দেখি মর্টিমার এর মধ্যেই একটি ইন্স্পেক্টর ও আরেকটি ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে। ভদ্রলোকটি হলেন মিঃ পার্ভিস—বিখ্যাত হীরক ব্যবসায়ী মবসন এণ্ড কোং-এর একজন অংশীদার। নামকরা জহুরী হিসাবে ইনি পাথর চুরির ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত। ইহুদির কবচটা যে শো-কেসের মধ্যে ছিল সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন। কবচটা এখন বাইরে বার করে কাঁচের আচ্ছাদনটার উপর রাখা হয়েছে আর তিনজনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেটাকে পরীক্ষা করছে।
‘কবচটার উপর যে মানুষের হাত পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই’, বলল মর্টিমার। ‘আজ সকালে এটার দিকে চোখ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সন্দেহ হয়। কাল রাত্রেও আমি এটা দেখেছি, তখন ঠিকই ছিল। অর্থাৎ কুকীর্তিটা হয়েছে মাঝরাত্রে।’
মর্টিমার ঠিকই বলেছে; কবচটা নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। প্রথম সারির চারটে পাথরকে ঘিরে সোনার উপর ক্ষতচিহ্ন। পাথরগুলো তাদের জায়গাতেই রয়েছে; ক্ষতি যা হয়েছে সেটা সোনার সূক্ষ্ম কারুকার্যে—যার সৌন্দর্যের তারিফ আমরা এই কদিন আগেই করেছি।
ইন্স্পেক্টর সাহেব বললেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন পাথরগুলোকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল।’
মর্টিমার বলল, ‘আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে শুধু চেষ্টাই করেনি, কৃতকার্যও হয়েছিল। আমার ধারণা প্রথম সারির চারটে পাথরই নকল, যদিও চোখে দেখে ধরার উপায় নেই।’
জহুরী মশাইয়েরও মনে হয়ত একই সন্দেহের উদয় হয়েছিল, কারণ তিনি এখন আতস কাঁচের সাহায্যে অতি মনোযোগের সঙ্গে পাথরগুলো যাচাই করছেন। কাঁচের সাহায্য ছাড়াও নানাভাবে সেগুলোকে পরীক্ষা করে অবশেষে মর্টিমারের দিকে চেয়ে একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার কপাল ভালো। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে প্রথম সারির চারটে পাথরই খাঁটি। এত নিঁখুত পাথর সচরাচর দেখা যায় না।’
আমার বন্ধুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাবটা চলে গেল। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাক, বাবা!—কিন্তু তাহলে চোরের উদ্দেশ্যটা ছিল কী?’
‘হয়ত পাথরগুলো নেওয়ার মতলবেই এসেছিল, কিন্তু সে কাজে বাধা পড়ে।’
‘কিন্তু নেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে ত একটা একটা করে খুলে নেওয়া উচিত। এখানে দেখছি চারটে পাথরকেই আলগা করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু একটাকেও নেওয়া হয়নি।’
‘ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক’, বললেন ইনস্পেক্টর সাহেব। ‘ঠিক এরকম ঘটনা আর একটাও মনে পড়ছে না। চলুন, একবার পাহারাদারের সঙ্গে কথা বলা যাক।’
প্রহরীকে ডেকে আনানো হল। মজবুত, মিলিটারি গড়ন, চেহারায় সততার ছাপ, গতরাত্রের ঘটনায় সে তার মনিবের মতোই বিচলিত।
‘না স্যর, আমি কোনো আওয়াজ পাইনি।’ ইনস্পেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল। ‘আমি যেমন রোজ করি, তেমনি কাল রাত্রেও তিনবার টহল দিয়েছি, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। আমি গত দশ বছর এই কাজ করছি; এমন ঘটনা আমার আমলে এর আগে কখনো ঘটেনি।’
‘কোনো জানালা দিয়ে চোর ঢুকতে পারে কি?’
‘অসম্ভব স্যর!’
‘তোমার ঘরের সামনে দিয়ে কেউ গিয়ে থাকতে পারে?’
‘না স্যর। টহল দেবার সময়টুকু ছাড়া আমি সারাক্ষণ আমার ঘরের বাইরে বসে থাকি।’
‘মিউজিয়মে ঢোকার আর কী পথ আছে?’
‘মিঃ মর্টিমারের কোয়ার্টাসের একটা প্রাইভেট দরজা দিয়ে মিউজিয়মে ঢোকা যায়।’
‘সে দরজা রাত্রে চাবি দিয়ে বন্ধ থাকে, বলল মর্টিমার। আর সেটায় পৌঁছতে হলে আগে মিউজিয়মের সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়।’
‘আপনার চাকর বাকর?’
‘তাদের থাকবার জায়গা একেবারে আলাদা।’
‘ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে তাতে সন্দেহ নেই’—বললেন ইনস্পেক্টর। ‘অবিশ্যি মিঃ পার্ভিসের মতে আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।’
‘আমি শপথ করে বলতে পারি প্রথম সারির চারটে পাথর একেবারে খাঁটি’, আবার বললেন মিঃ পার্ভিস।
‘তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে চোরের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কবচটাকে জখম করা’, বললেন, ইনস্পেক্টর সাহেব, ‘তা সত্ত্বেও একবার দালানটা ঘুরে দেখায় কোনো ক্ষতি আছে বলে মনে করি না। হয়ত তার ফলে কে এই রহস্যময় চোর তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।’
সারা সকাল পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানেও কোনো ফল হল না। মিউজিয়মে ঢোকার যে আরো দুটো সম্ভাব্য পথ আছে সেটা ইনস্পেক্টর সাহেব আমাদের দেখালেন। একটা হল মাটির নিচে সেলারের মাথায় একটা চোরা দরজা, আর দ্বিতীয় হল মাথার উপরে একটি অকেজো জিনিসপত্র রাখার ঘর বা লাম্বার রুমের স্কাইলাইট। এই ঘরের একটা বিশেষ স্কাইলাইট দিয়ে নিচে মিশরীয় ও ইহুদী জিনিসের ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। তবে এই দুটো প্রবেশপথের যে কোনো একটা ব্যবহার করতে গেলেই চোরকে আগে ঢুকতে হবে দালানের মধ্যে। কিন্তু সে পথ যেহেতু বন্ধ, আর সেলারে এবং লাম্বার রুম দুটোতেই যে পরিমাণ ধুলো জমে রয়েছে, এই দুটো প্রবেশপথের কথাই ওঠে না। শেষ পর্যন্ত কে, কখন, কেন কুকীর্তিটা করেছে সে রহস্যের কোনো কিনারা হল না।
আর একটিমাত্র পথ মর্টিমারের সামনে খোলা আছে, এবং শেষ পর্যন্ত সে সেটাই নিল। পুলিশদের তাদের কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে আমাকে অনুরোধ করল সেদিনই বিকেলে তার সঙ্গে প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের ওখানে যেতে। যাবার সময় সে সঙ্গে চিঠি দুটো দিয়ে নিল, উদ্দেশ্য প্রোফেসরকে সরাসরি জিগ্যেস করা তিনি কেন নামবিহীন চিঠিটা লিখেছিলেন এবং কী করে তিনি অনুমান করলেন যে মিউজিয়মে এইরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আপার নরউডে একটা ছোট বাড়িতে প্রোফেসর থাকেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বাড়ির এক পরিচারিকার কাছ থেকে জানলাম যে প্রোফেসর শহরে নেই। এই খবরে আমরা দুজনেই খুব হতাশ হয়েছি দেখে পরিচারিকা বললেন আমরা যদি বৈঠকখানায় গিয়ে বসি তাহলে তিনি প্রোফেসরের মেয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা করিয়ে দেবেন।
আগেই বলেছি যে অ্যান্ড্রিয়াসের কন্যাটি সুন্দরী। দীর্ঘ ছিমছাম তার গড়ন, মাথার চুল সোনালী, গায়ের রঙ ও মসৃণতা গোলাপের পাপড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সে যখন ঘরে ঢুকল তখন এই দু-সপ্তাহে তার কত পরিবর্তন হয়েছে দেখে আমি প্রায় চমকে উঠলাম। তার চাহনিতে গভীর সংশয়ের ছাপ।
‘বাবা গেছেন স্কটল্যাণ্ডে’, বললেন মহিলা। ‘উনি বড় ক্লান্ত বোধ করছিলেন, তার উপর দুশ্চিন্তারও কারণ ছিল। উনি কালই চলে গেছেন।’
‘আপনাকেও যেন ক্লান্ত দেখছি, মিস অ্যান্ড্রিয়াস’, বলল আমার বন্ধু।
‘সেটা হয়েছে বাবার সম্বন্ধে চিন্তা করেই।’
‘ওঁর স্কটল্যাণ্ডের ঠিকানা আপনার কাছে আছে কি?’
‘হ্যাঁ। উনি রয়েছেন ওঁর ভাই রেভারেণ্ড ডেভিড অ্যান্ড্রিয়াসের বাড়িতে। ঠিকানা, এক নম্বর অ্যারাম ভিলা, আরড্রোস্যান।’
মর্টিমার ঠিকানাটা লিখে নেবার পর আমরা আমাদের আসার উদ্দেশ্যটা না জানিয়েই বিদায় নিলাম। সন্ধ্যায় আমরা দুজনে ঠিক সকালের মতোই আবার বেলমোর স্ট্রীটে মিলিত হলাম। প্রোফেসরের চিঠিই আমাদের একমাত্র ক্লু। মর্টিমার স্থির করেছিল পরদিনই আরড্রোস্যানে গিয়ে প্রোফেসরকে চিঠিটা দেখিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবে, এমন সময় একটা ঘটনার ফলে তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল।
পরদিন ভোরে আমার দরজায় টোকার শব্দে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখি একটি লোকের হাতে মর্টিমারের একটা চিঠি। সে লিখছে, ‘অবিলম্বে চলে এস। রহস্য আরো জটিল হয়ে উঠেছে।’
আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই মিউজিয়মে পৌঁছে দেখলাম মর্টিমার মাঝের ঘরটায় উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করছে, আর ঘরের এক পাশে পল্টনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন প্রহরীমশাই।
‘ওঃ জ্যাকসন! তোমায় আমার বিশেষ প্রয়োজন। এ-রহস্যের কূলকিনারা করা আমার কম্ম নয়।’
‘আবার কী হল?’
মর্টিমার কাঁচের শোকেসটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ‘যাও, নিজেই দেখ গিয়ে।’
আমি যা দেখলাম তাতে আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। এবার মাঝের সারির পাথরগুলোর অবস্থাও হুবহু উপরের সারির মতো। বারোটার মধ্যে আটটা পাথরের উপর দুর্বৃত্তের হাত পড়েছে। শেষের সারির পাথরগুলো যেমন ছিল তেমনিই আছে।
‘পাথরগুলো কি বদলানো হয়েছে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘না। মাঝের চারটের মধ্যে এমারেন্ডের রঙে সামান্য একটু বৈষম্য ছিল। এখনও সেটা রয়েছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে উপরের সারির মতো এগুলোও বদলানো হয়নি। আচ্ছা সিম্পসন, তুমি ত বলছ সন্দেহজনক কোনো শব্দ পাওনি।’
‘না স্যর’, প্রহরী জবাব দিল, ‘কিন্তু সকাল হলে পর আমি এই ঘরে এসে কবচটা দেখেই বুঝলাম যে ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে খবর দিই। কিন্তু আমি যতক্ষণ পাহারা দিয়েছি ততক্ষণ কাউকে দেখিনি, কোনো শব্দও পাইনি।’
মর্টিমার আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এস আমার সঙ্গে, একট ব্রেকফাস্ট করা যাক।’ তার ঘরে পৌঁছতেই সে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করল, ‘এসব কী ঘটছে বল ত জ্যাকসন?’
সত্যি বলতে কি, এমন অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আমার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে। আমি বললাম, ‘আমার মতে এ কোনো উন্মাদের কীর্তি।’
‘এর মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছ না তুমি?’
আমি একটু ভেবে বললাম, ‘এই প্রাচীন কবচটা ইহুদীদের কাছে একটি অতি পবিত্র জিনিস। ধরো যদি ইহুদী-বিরোধী কোনো দলের কেউ কবচটাকে নষ্ট—’
‘না, না, না!’ চেঁচিয়ে বলে উঠল মর্টিমার। ‘ওটা কোনো কথাই হল না। এমন লোক হয়ত আছে যে কবচটাকে নষ্ট করতে চাইতে পারে, কিন্তু পাথরের চারধারে কুরে কুরে সেগুলোকে আলগা করার চেষ্টা করবে কেন? এর কারণ খুঁজতে হবে অন্য কোথাও। এখন বল ত, টহলদার সিম্পসন সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা।’
‘ওকে সন্দেহ করার কোনো কারণ আছে কি?’
‘কারণ একমাত্র এই যে রাত্রে এক সিম্পসন ছাড়া কেউ এ তল্লাটে থাকে না।’
‘কিন্তু এমন অর্থহীন ধ্বংসের কাজ সে করবে কেন? কোনো জিনিস ত চুরি যায়নি।’
‘ধর যদি তার মাথা খারাপ হয়ে থাকে।’
‘উঁহু। সিম্পসনের মাথায় কোনো গণ্ডগোল নেই এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।’
‘তুমি নিজে অন্য কাউকে সন্দেহ কর?’
‘তুমিই ত রয়েছো!’ আমি হালকা হেসে বললাম। ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করার ব্যারামট্যারাম আছে নাকি তোমার?’
‘মোটেই না।’
‘তাহলে এ রহস্য সমাধানের কাজে আমি ইস্তফা দিলাম।’
‘কিন্তু আমি দিচ্ছি না। একটা পন্থা আছে যার সাহায্যে আমরা এর কিনারা করতে পারব।’
‘প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের সঙ্গে দেখা করে?’
‘না। স্কটল্যাণ্ড যাবার দরকার নেই। কী করব সেটা বলছি তোমাকে। ওপরের লাম্বার রুমের একটা স্কাইলাইট দিয়ে মাঝের হলঘরটা দেখা যায় সেটা ত দেখলে। আমরা হলঘরে বাতি জ্বালিয়ে রেখে ওপরের স্কাইলাইটে চোখ লাগিয়ে বসে থাকব। তুমি আর আমি। দুজনে একজোটে রহস্যের সমাধান করব। যদি এই রহস্যময় ব্যক্তিটি একেক দিনে চারটে করে পাথরের উপর কাজ করে, তাহলে সে নিশ্চয়ই আজ রাত্রে আবার এসে শেষ সারির চারটে পাথর নিয়ে পড়বে।’
‘উত্তম প্রস্তাব।’
‘আমরা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখব। পুলিশ বা সিম্পসন, কাউকেই কিছু বলব না। রাজি?’
‘অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে রাজি।’
॥ ২ ॥
রাত দশটা নাগাদ আমি মর্টিমারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তাকে দেখেই বুঝলাম সে একটা চাপা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। হাতে সময় আছে, তাই আমরা দুজনে মর্টিমারের ঘরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম। অবশেষে একটা সময় এল যখন রাস্তায় গাড়িঘোড়া পথচারী ইত্যাদির শব্দ কমে গিয়ে পাড়াটা নিস্তব্ধ হয়ে এল। প্রায় বারোটার সময় মর্টিমার আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অকেজো জিনিসপত্র রাখার ঘরটাতে।
ইতিমধ্যে দিনের বেলায় একবার ঘরটাতে এসে মর্টিমার আমাদের বসার সুবিধার জন্য মেঝেতে চট বিছিয়ে রেখেছে। স্কাইলাইটের শার্সিগুলো স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি হলেও তার উপর ধুলো পড়ে এমন দশা হয়েছে যে আমরা নিচের ঘরটা মোটামুটি দেখতে পেলেও, নিচ থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। কাঁচের উপর দুটো ছোট্ট অংশ থেকে ধুলো মুছে ফেলে সেইখানে আমাদের চোখ লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। বিজলি বাতির উজ্জ্বল আলোতে হলঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এমন কি শো-কেসের ভিতরের জিনিসগুলো পর্যন্ত। ঘরে এক পাশে দরজার ধারে দাঁড়করানো মিশরীয় মামি-কেস থেকে শুরু করে কাঁচের শো-কেসে রাখা ইহুদীর কবচের প্রত্যেকটি ঝলমলে পাথর—সব কিছুই আমরা দেখছি সমান আগ্রহের সঙ্গে। ঘরে মণিমুক্তার ছড়াছড়ি। কিন্তু কবচের উরিম ও থুমিমের বারোটা পাথরের জেল্লা অন্য সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। সিকারার সমাধি মন্দিরের ছবি, কার্ণাকের প্রাচীরচিত্র, মেমফিসের ভাস্কর্য, থীবিসের প্রস্তরলিপি—সবই তন্ময় হয়ে দেখার জিনিস; কিন্তু তা সত্ত্বেও চোখ বারবার চলে যায় কাঁচের নিচে কবচটার দিকে, আর মন উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে ওর রহস্য ভেদ করার জন্য। আমি এই রহস্যের কথাই ভাবছি, এমন সময় আমার বন্ধুটি হঠাৎ নিঃশ্বাস টেনে আমার কোটের আস্তিনটা সজোরে খামচে ধরল। পরমুহুর্তেই বুঝতে পারলাম এর কারণ।
হলঘরের দরজার পাশে রাখা মামি-কেসটার কথা আগেই বলেছি। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম দাঁড়করানো মামি-কেসটার ডালাটা খুলতে শুরু করেছে। খোলার ফলে যে সরু কালো ফাঁকটার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অতি ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে। এই খোলার ব্যাপারটা এত সন্তর্পণে ঘটছে যে ভালো করে না দেখলে চোখে ধরাই পড়ে না। একটুপরেই দেখলাম যে ফাঁক দিয়ে একটা শীর্ণ হাত বেরিয়ে এসে নকশাদার ডালাটাকে ধরে সেটা আরো সামনে এগিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে এল অন্য হাতটা, আর তার পরেই—একটা মুখ। এ-মুখ আমাদের দুজনেরই খুব চেনা। ইনি হলেন স্বয়ং প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। এবার তাঁর পুরো শরীরটা শবাধার থেকে বেরিয়ে এল, শেয়াল যেমন বেরিয়ে আসে তার গর্ত থেকে। ভদ্রলোকের দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, পা-দুটো একবার সামনে এগোচ্ছে, পরমুহূর্তেই থামছে, আবার দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, আবার এগোচ্ছে পা। একবার রাস্তা থেকে আসা একটা অস্ফুট শব্দে তিনি থেমে গেলেন, কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন, ভাবটা এই যেন দরকার হলে তৎক্ষণাৎ আবার ফিরে যাবেন তাঁর লুকোনর জায়গায়। কিন্তু সেটার প্রয়োজন হল না। প্রোফেসর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে শো-কেসটার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বার করলেন। তারই একটা চাবি দিয়ে খোলা হল শো-কেসের ঢাকনা, বাইরে বেরিয়ে এল ইহুদীর কবচ, আর সেটাকে ঢাকনার উপর রেখে একটি ছোট ধাতব যন্ত্র দিয়ে তার উপর কাজ শুরু করলেন প্রোফেসর। আমাদের একেবারে সরাসরি নিচে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর ঝুঁকে-পড়া পিঠটা কবচটাকে ঢেকে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাত যেভাবে চলছিল তাতে বুঝতেই পারছিলাম যে, যে-নষ্টামির পরিচয় আমরা পেয়েছি, সেই একই কাজে তিনি মগ্ন।
আমার বন্ধুর দ্রুত নিশ্বাসের আর আমার হাতের উপর তার হাতের চাপ থেকেই বুঝতে পারছি প্রোফেসরের এই কুকীর্তিতে তার মনে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অপকর্মের জন্য যে ইনিই দায়ী সেটা যে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই সেদিনই ইনি আমাদের কাছে ওই কবচের গুণগান করেছেন, আর আজ ইনিই সেই আশ্চর্য বস্তুটির সর্বনাশ করে চলেছেন। রাত দুপুরে এই কুকীর্তি যে কী অমানুষিক ভণ্ডামির পরিচয় বহন করে এবং তাঁর উত্তরাধিকারীর প্রতি কী পরিমাণ আক্রোশ যে এতে প্রকাশ পাচ্ছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কাজটা ভাবতেও যেমন, দেখতেও ঠিক তেমনি পীড়াদায়ক। আমি নিজে এ ব্যাপারে মোটেই বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু তাও এই আশ্চর্য কবচের এহেন দুর্গতি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গীটি আমার হাতে একটা টান দিয়ে নিঃশব্দে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। নিজের ঘরে ফিরে আসার পর মর্টিমার মুখ খুলল।
‘লোকটা কত বড় শয়তান! এ জিনিস কি স্বপ্নেও ভাবা যায়?’
‘ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।’
‘হয় শয়তান, না হয় পাগল। এই দুটোর একটা হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা শিগগিরই জানা যাবে। এস আমার সঙ্গে; এখনই একটা এস্পার ওস্পার করা দরকার।’
একটা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা দরজা দিয়ে সোজা মিউজিয়মে ঢোকা যায়। এটা একমাত্র তত্ত্বাবধায়কের ব্যবহারের জন্যই তৈরি। মর্টিমারের দেখাদেখি আমিও আগে পায়ের জুতো-জোড়া খুলে ফেললাম। তারপর নিঃশব্দে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মিউজিয়মে ঢুকে ঘরের পর ঘর পেরিয়ে অবশেষে আসল ঘরে পৌঁছলাম। ভদ্রলোক এখনও তাঁর দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা নিঃশব্দে তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছানর আগেই তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ঘুরে একটা চাপা চীৎকার দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
‘সিম্পসন!’ ‘সিম্পসন!’ মর্টিমার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলি দরজা পেরিয়ে শেষ দরজার মুখে বৃদ্ধ প্রহরীমশাইকে আবির্ভূত হতে দেখা গেল। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসও একই সঙ্গে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পরমুহুর্তেই তাঁর পিঠে দুদিক থেকে আমাদের দুজনের হাত পড়ল।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি যাচ্ছি আপনাদের সঙ্গে। আপনার ঘরেই চলুন মিঃ মর্টিমার। জবাবদিহির ব্যাপারটা ওখানেই সারা যাবে।’
মর্টিমার ক্রোধে এত অধীর যে তার মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না। প্রোফেসরকে মাঝখানে রেখে আমরা তিনজন প্রথমে হলঘরে ফিরে এলাম, সিম্পসন আমাদের পিছনে। শোকেসের উপর ঝুঁকে পড়ে মর্টিমার কাঁচটা পরীক্ষা করে দেখল। নিচের সারির প্রথম পাথরটা এর মধ্যেই খানিকটা আলগা হয়ে এসেছে। কবচটা হাতে নিয়ে মর্টিমার প্রোফেসরের দিকে ফিরল—তার দৃষ্টি যেন অগ্নিবর্ষণ করছে।
‘কী করে পারলেন আপনি, কী করে পারলেন।’
‘কাজটা অত্যন্ত ঘৃণ্য আমি জানি’, বললেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। ‘আপনার মনের ভাব আমি বুঝতে পারছি। আমি অনুরোধ করছি আপনার ঘরে নিয়ে চলুন আমাকে।’
‘কিন্তু এটাকে ত এভাবে ফেলে রাখা যায় না’, বলল মর্টিমার। তারপর গভীর দরদের সঙ্গে সে কবচটাকে হাতে তুলে নিল। আমরা রওনা দিলাম। প্রোফেসরের পাশে আমি হাঁটছি যেন পুলিশ চলেছে হাতেনাতে ধরা-পড়া চোরের পাশে। আমরা সোজা মর্টিমারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। হতভম্ব সিম্পসন বাইরে রয়ে গেল তার নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঘটনাটা অনুধাবন করবার জন্য; প্রোফেসর একটা সোফায় বসলেন। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে রাগের পরিবর্তে আমরা দুজনেই তাঁর সম্বন্ধে সংশয়ান্বিত বোধ করছিলাম। ব্র্যাণ্ডি খাবার পর তিনি খানিকটা প্রকৃতিস্থ হলেন।
‘এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘গত কদিনের ধকল আমাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। আমার পক্ষে এ এক চরম বিভীষিকা। একদিন যে মিউজিয়ম আমারই জিম্মায় ছিল, সেই মিউজিয়মের ঘরেই আমাকে ধরা দিতে হল চোরের মতো। অথচ আপনাকেই বা দোষ দেব কি করে? আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন আমি শুধু এটাই চেয়েছিলাম যে কেউ টের পাবার আগে আমি যেন আমার কাজটা শেষ করতে পারি। সেটা আজ রাত্রেই হয়ে যেত, কিন্তু…’
‘আপনি ভিতরে ঢুকলেন কি করে?’ প্রশ্ন করল মর্টিমার।
‘আপনি যে দরজা ব্যবহার করেন, সেই দরজা দিয়ে’, বললেন প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস। ‘কাজটা অত্যন্ত গর্হিত, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ সৎ। সেখানে কোনো দোষ ধরতে পারবে না কেউ। আসল ঘটনাটা জানলে আপনিও আমাকে আর গাল দেবেন না। আপনার বাসস্থানের দরজার একটা চাবি আর মিউজিয়মে ঢোকার একটা চাবি আমার কাছে ছিল। চাকরি ছাড়ার সময় সেগুলি ফেরত দিইনি। মিউজিয়ম থেকে দর্শকের দল বাইরে বেরোনমাত্র আমি হলঘরে ঢুকে মামি কেসটার ভিতর লুকিয়ে পড়তাম। তারপর নিরাপদ বুঝে বেরিয়ে এসে যা করার তা করতাম। যতবার সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেতাম, ততবারই আমাকে মামিকেসের ভিতর আশ্রয় নিতে হত। তারপর কাজ শেষ হলে, যেভাবে ঢুকেছি সেই পথেই বেরিয়ে আসতাম।’
‘তার মানে আপনি একটা মস্ত ঝুঁকি নিয়েছিলেন?’
‘নিতেই হয়েছিল।’
‘কিন্তু কেন? কোন উদ্দেশ্যে আপনাকে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে হল?’ পাশেই টেবিলের উপর রাখা কবচটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল মর্টিমার।
‘এ-ছাড়া কোনো রাস্তা ছিল না। অনেক ভেবেও আর কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। এ না করলে লোকমুখে আমার বদনাম ছড়িয়ে পড়ত আর সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনেও আমাকে গভীর শোক ভোগ করতে হত। আমি যা করেছি তা মঙ্গলের জন্যই, যদিও আপনার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আমি চাই আমার কথা সত্য প্রমাণ করার সুযোগ আপনি দেন।’
‘আপনার কী বলার আছে শোনার পর আমি আমার কর্তব্য স্থির করব’, দৃঢ়স্বরে বলল মর্টিমার।
‘আমি কিছুই গোপন রাখব না, সব কথা অকপটে আপনাকে বলব। তারপর আপনি কী করেন সেটা আপনার মর্জি।’
‘আসল ব্যাপারটা ত আর আমাদের জানতে বাকি নেই।’
‘আসল ব্যাপার আপনি কিছুই জানেন না। প্রথমে কয়েক সপ্তাহ আগের একটা ঘটনায় ফিরে যেতে দিন, তারপর আমি সব বুঝিয়ে বলব। এটুকু বিশ্বাস করুন যে আমি যা বলছি তার মধ্যে এক বর্ণ মিথ্যে নেই।
‘যে ব্যক্তি ক্যাপ্টেন উইলসন বলে নিজের পরিচয় দেন তার সঙ্গে আপনাদের আলাপ হয়েছে। আমি এইভাবে বলছি কারণ আমি এখন জানতে পেরেছি যে এটা তার আসল পরিচয় নয়। ওর সঙ্গে আমার কী করে আলাপ হল, কী করে সে আমার বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠল, এবং কী করে সে আমার মেয়ের ভালবাসা আদায় করল, এ সব বুঝিয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। সে এখানে আসার সময় বিদেশের অনেক জ্ঞানীগুণীর কাছ থেকে প্রশংসাপত্র নিয়ে এসেছিল; তাই তাকে আমার আমল দিতে হয়। তাছাড়া তার নিজেরও যে গুণ নেই তা নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমি খুশি হয়েই তাকে নিয়মিত আমার বাড়িতে আসতে দিই। যখন জানলাম যে আমার মেয়ে এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট, তখন মনে হয়েছিল যে ঘটনাটা যেন একটু বেশি দ্রুত ঘটে গেল। কিন্তু আমি অবাক হইনি, কারণ উইলসনের স্বভাব আর কথাবার্তায় এমন একটা মাধুর্য ছিল যে সমাজের উঁচু স্তরে নিজের জন্য একটা জায়গা করে নেওয়া তার পক্ষে ছিল সহজ ব্যাপার।
‘প্রাচ্যের প্রাচীন শিল্পবস্তু সম্পর্কে তার উৎসাহ ছিল, এবং এ বিষয়ে জ্ঞানও ছিল যথেষ্ট। অনেক সময় সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে সময় কাটাতে এসে সে আমার অনুমতি নিয়ে মিউজিয়মে গিয়ে একা ঘুরে ঘুরে সব দেখত। বুঝতেই পারছেন এ ব্যাপারে আমি নিজে উৎসাহী হওয়াতে তার অনুরোধে খুশি হয়েই সম্মত হতাম, আর আমার বাড়িতে তার ঘনঘন আগমনে কোনো বিস্ময় বোধ করতাম না। এলীজের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ পাকাপাকি হয়ে যাবার পর প্রায় প্রতি সন্ধ্যাই ছেলেটি আমার বাড়িতে কাটাত, এবং তার মধ্যে ঘণ্টাখানেক কাটাত মিউজিয়মে। সেখানে সে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। এমন কি আমি যেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থাকতাম না, সেদিনও সে এসে মিউজিয়মে কিছুটা সময় কাটিয়েছে। এই অবস্থার অবসান হয় তখনই যখন আমি চাকরি ছেড়ে নরউডে চলে যাই, এবং নানা বিষয় নিয়ে বই লেখার তোড়জোড় শুরু করি।
‘চাকরি ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি যে লোককে নির্দ্বিধায় আপন করে নিয়েছিলাম তার আসল চেহারাটা বুঝতে পারি। আমার বিদেশী বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটা চিঠি থেকে আমি জানতে পারি যে যেসব পরিচয়পত্র উইলসন আমাকে দেখিয়েছিল তার অধিকাংশই জাল। অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি এই ধাপ্পাবাজীর পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সে যদি অর্থলোভী হয়ে থাকে তাহলে আমাকে দিয়ে তার কোনো কাজ হবে না, কারণ আমি ধনী নই। তাহলে সে এল কেন? তখন আমার খেয়াল হল যে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পাথরের বেশ কিছু রয়েছে আমার জিম্মায়, এবং নানান অজুহাতে একা মিউজিয়ামে গিয়ে সে-সব পাথরের কোনটা কোথায় আছে সেটা উইলসন দেখে এসেছে। অর্থাৎ সে হচ্ছে এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি যে আমার মিউজিয়মে চুরির সুযোগ খুঁজছে। এই অবস্থায়, তাকে অন্ধের মত ভালোবাসে আমার যে মেয়ে, তাকে কষ্ট না দিয়ে কি করে আমি উইলসনকে জব্দ করব? আমি অনেক ভেবে যে পন্থা স্থির করলাম সেটা বেয়াড়া তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কার্যকরী কোনো পন্থা আমার মাথায় এল না। আমি যদি আপনাকে নিজের নামে চিঠি লিখতাম তখন আপনি নিশ্চয়ই আমাকে নানা খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতেন যার উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হত না। তাই আমি নাম ছাড়াই চিঠি লিখে আপনাকে সতর্ক করে দিই।
‘আমি বেলমোর স্ট্রীট থেকে নরউড চলে আসার পরেও এই যুবকের আমার বাড়িতে আসা একটুও কমেনি। হয়ত সে সত্যিই আমার মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিল। আর আমার মেয়ের কথা যদি বলেন, তাহলে আমি এটুকু বলব যে কোনো মেয়ে একজন পুরুষের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হতে পারে এটা আমি কল্পনা করতে পারিনি। উইলসনের ব্যক্তিত্ব যেন এলীজকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছিল। এটা যে কতদূর সত্যি এবং ওদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা যে কত গভীর সেটা আমি বুঝতে পারি এক সন্ধ্যায়, আর তখনই উইলসনের আসল রূপটা ধরা পড়ে। সেদিন আমি আগে থেকে হুকুম দিয়ে রেখেছিলাম যে উইলসন এলে যেন সোজা আমার কাজের ঘরে চলে আসে—বৈঠকখানায় যেন তাকে বসানো না হয়। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি সোজাসুজি বলে দিলাম যে তার স্বরূপ জানতে আর আমার বাকি নেই, আর সেটা জেনেই তার দুরভিসন্ধির পথ আমি বন্ধ করেছি, এবং আমি আর আমার মেয়ে তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। সেই সঙ্গে এও বললাম যে আমার পরম সৌভাগ্য সে মিউজিয়মের মহামূল্য জিনিসগুলোর কোনো ক্ষতি করার আগেই আমি তার আসল পরিচয়টা পেয়ে গেছি।
‘ছেলেটির বুকের পাটা যে অসামান্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার কথা সে শেষ পর্যন্ত শুনে কোনো বিস্ময় বা বিরুদ্ধভাব প্রকাশ না করে ঘরের উল্টোদিকে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে চাকরকে ডেকে পাঠাল। চাকর এলে পর তাকে বলল, ‘মিস্ অ্যান্ড্রিয়াসকে গিয়ে বল তিনি যেন অনুগ্রহ করে এখানে আসেন।’
‘আমার মেয়ে এল। উইলসন এগিয়ে গিয়ে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘এলীজ, তোমার বাবা এইমাত্র আবিষ্কার করেছেন যে আমি একটি দুশ্চরিত্র ব্যক্তি—যেটা তুমি আগেই জানতে।’
‘এলীজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।’
“উনি বলছেন যে আমাদের পরস্পরকে ত্যাগ করতে হবে, চিরকালের জন্য।”
‘এলীজ কিন্তু এখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।’
“তোমার উপর কি আমি ভরসা রাখতে পারি, না কি একমাত্র যে আমাকে সৎপথে চালাতে পারে সেও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
“জন!” আমার মেয়ে গভীর আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, “আমি কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না। দুনিয়ার সব লোক যদি তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলেও না।”
‘আমি আমার মেয়েকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো ফল হল না। সে যেন এই যুবকটির সঙ্গে তার জীবন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। আমার মেয়ে আমার চোখের মণি; যখন দেখলাম যে তাকে সর্বনাশের হাত থেকে উদ্ধার করার কোনো উপায় নেই তখন আমার যে কী অবস্থা হল তা বলতে পারি না। আমার অসহায় ভাব দেখে মনে হল উইলসনের কিছুটা দয়া হল। সে বলল, ‘আপনি যতটা ভাবছেন, অবস্থা ততটা খারাপ নয়। এলীজের প্রতি আমার ভালবাসা এতই গভীর যে হয়ত সেটাই আমাকে কলঙ্কের হাত থেকে উদ্ধার করবে। আমি কালই ওকে প্রতিজ্ঞা করেছি যে জীবনে আর কখনো এমন কোনো কাজ করব না যাতে সে কষ্ট পাবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার লোক আমি নই।”
‘উইলসনের কথায় মনে হল সে যা বলছে সেটা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কথাটা বলে সে পকেট থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স বার করে বলল, “আমি যা বলছি তা যে সত্যি তার প্রমাণ আমি দিতে চাই। এলীজ, আমার উপর তোমার প্রভাব যে মঙ্গলকর সেটা এবার বুঝতে পারবে। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন যে আপনার সংগ্রহশালার অমূল্য সম্পদ আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল। যে কাজে লাভের সম্ভাবনার সঙ্গে বিপদের আশঙ্কা জড়িয়ে থাকে সে কাজের প্রতি চিরকালই আমি একটা আকর্ষণ বোধ করি, তাই ইহুদীর কবচের পাথরগুলোকে হাত করার জন্যে আমি বদ্ধপরিকর হই।”
“সেটা আমি অনুমান করেছিলাম।”
“কিন্তু একটা ব্যাপার আপনি অনুমান করতে পারেন নি।”
“যে সেগুলো হাত করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। এই বাক্সের মধ্যে রয়েছে সেই পাথরগুলো।”
‘এই বলে সে বাক্সটা খুলে আমার ডেস্কের উপর উপুড় করে ধরল। দৃশ্য দেখে আমার হাত পা হিম হয়ে এল। সংকেত চিহ্ন আঁকা বারোটা মহামূল্য পাথর বেরিয়ে পড়েছে আমার টেবিলের উপর। এগুলোই যে উরিম ও থুমিমের পাথর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
“সর্বনাশ!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “তুমি ধরা না পড়ে এ কুকীর্তি করলে কী করে?”
“আসলের জায়গায় নকল পাথর বসিয়ে”, বলল উইলসন, “নকলগুলো এতই নিখুঁত যে দুইয়ের মধ্যে তফাৎ করা অসম্ভব।”
“এখন যে পাথরগুলো কবচে লাগানো রয়েছে সেগুলো নকল?”
“হ্যাঁ, এবং বেশ কিছুকাল আগেই ঘটেছে এই ঘটনা।”
‘আমরা তিনজন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মেয়ের মুখ বিবর্ণ হলেও সে তখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।
‘উইলসন এলীজের দিকে ফিরে বলল, “আমার সাধ্যের মাত্রা কতদূর সেটা ত এবার বুঝলে?”
‘এলীজ বলল, “এটাও বুঝলাম যে দুষ্কর্ম করে তার জন্য অনুতপ্ত হওয়াটাও তোমার অসাধ্য নয়।”
“সেটা তোমার প্রভাবের ফল” বলল উইলসন, “আমি পাথরগুলো আপনাকেই দিচ্ছি, প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, আপনি এ ব্যাপারে যা করা উচিত মনে করবেন তাই করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন আমার বিরুদ্ধে কিছু করা মানেই আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ স্বামীর বিরুদ্ধে করা। এলীজ, কিছুদিন পরেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এর পরে আর কোনোদিন আমার জন্য তোমাকে কষ্টভোগ করতে হবে না।” এই বলে উইলসন প্রস্থান করল।
‘আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অমূল্য পাথরগুলো এখন আমার হাতে, কিন্তু ধরা না পড়ে কী করে সেগুলো যথাস্থানে ফেরত দিই? এটা বুঝতে পারছি যে আমার মেয়ে যেরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাকে উইলসন-এর হাত থেকে কোনমতেই রক্ষা করতে পারব না। আর উইলসন-এর প্রভাব যদি তার উপর সত্যিই মঙ্গলকর হয়, তাহলে তাকে রক্ষা করার প্রশ্নই বা আসবে কেন? উইলসন-এর মুখোশ খুলে দিলেই বা কী ফল হবে, বিশেষ করে সে যখন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?
‘আমি অনেক ভেবে একটা রাস্তা বার করলাম যেটা হয়ত আপনাদের কাছে খুব অর্বাচীন বলে মনে হবে, কিন্তু আমার মতে এ-ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না। আমি স্থির করলাম, কাউকে জানতে না দিয়ে আমি নিজেই গিয়ে পাথরগুলো যথাস্থানে বসিয়ে দেব। আমার চাবির সাহায্যে আমি যে-কোনো সময় মিউজিয়মে ঢুকতে পারি, আর সিম্পসনের গতিবিধি যখন জানা আছে তখন ধরা পড়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। যা করতে যাচ্ছি সে সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলব না—আমার মেয়েকেও না—এটাও স্থির করলাম। মেয়েকে বললাম আমি স্কটল্যাণ্ডে আমার ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি। কটা রাত কারুর সন্দেহ উদ্রেক না করে আমি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারি এটাই ছিল আমার লক্ষ্য। সেই রাত্রেই হার্ডিং স্ট্রীটে একটা ঘর ভাড়া করলাম। বাড়িওয়ালাকে বললাম আমি খবরের কাগজে কাজ করি, আমাকে রাত্রেও কাজে বাইরে যেতে হতে পারে।
‘সেই রাত্রে মিউজিয়মে গিয়ে আমি প্রথম সারির চারটে নকল পাথর খুলে ফেলে আসল পাথর বসিয়ে দিলাম। কাজটা সহজ নয়, এবং সেটা করতে আমার সারা রাত লেগে গেল। সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেলেই আমি মামি-কেসের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। স্বর্ণকারের কাজ সম্বন্ধে আমার কিছু জ্ঞান আছে, কিন্তু উইলসন ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। সে যেভাবে মেকি পাথরগুলো বসিয়েছিল তাতে সোনার কারুকার্য একটুও রদবদল হয়নি। কিন্তু আমার ছিল কাঁচা এবং বুড়ো হাতের কাজ। আমি চাইছিলাম যে যে-কদিন আমি কাজটা করব সে-কদিন যেন কেউ বেশি মনোযোগ দিয়ে কবচটাকে না দেখে। যাই হোক, একইভাবে দ্বিতীয়রাত্রে দ্বিতীয় সারির পাথরগুলো বসিয়ে ফেললাম। আজ কাজটা শেষ হয়ে যেত, কিন্তু অদৃষ্টের ফেরে সেটা হল না, এবং সেই সঙ্গে আমাকে এমন সব কথা বলে ফেলতে হল যেগুলো একান্তই গোপনীয়। এখন আপনারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে স্থির করুন এখানেই ঘটনার পরিসমাপ্তি হবে, না এটাকে আরো কিছুদূর টেনে নেবেন। আমার নিজের শান্তি, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এবং তার ভাবী পতির সংস্কার—সবই নির্ভর করছে আপনাদের সিদ্ধান্তের উপর।’
মর্টিমার বলল, ‘সিদ্ধান্ত হল এই যে, যেহেতু সব ভালো যার শেষ ভালো, এই মুহূর্তে সমস্ত ঘটনাটির উপর চিরকালের মতো যবনিকা ফেলে দেওয়া হোক। কালই একজন পাকা স্বর্ণকারকে দিয়ে পাথরগুলো ঠিক করে বসিয়ে কবচটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। এবারে আপনার হাতটা দিন, প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, আর আশীর্বাদ করুন যেন এরকম অবস্থায় যদি কোনোদিন পড়তে হয় আমাকে, আমিও যেন আপনার মতো নিঃস্বার্থ আচরণ করতে পারি।’
কাহিনী শেষ করার আগে একটা কথা বলা দরকার। এক মাসের মধ্যেই এলীজের বিয়ে হয়ে গেল তার সঙ্গে যার আসল নামটা বললে পাঠক বুঝতে পারতেন যে তিনি এখন সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সত্যি কথাটা হল এই যে, সম্মান তার চেয়েও বেশি প্রাপ্য সেই শান্তস্বভাবা তরুণীর, যিনি তাঁর স্বামীকে পাপের পঙ্কিল পথ থেকে উদ্ধার করে ভদ্রসমাজে তার স্থান করে দিয়েছিলেন।