ইহুদি বিতর্ক : সত্য না কল্পকাহিনি

ইহুদি বিতর্ক : সত্য না কল্পকাহিনি

জ্যান্টাইলদের অনেকেই ‘হিব্রু’ ও ‘সেমাইট’ শব্দ দুটি দ্বারা ইহুদি জাতিকে সম্বোধন করে থাকে। ইহুদি শব্দটি মুখে এনে তারা কোনো বিপদে পড়তে চায় না।

একটা সময় ছিল যখন রাস্তাঘাটে তাদের নিয়ে হরদম আলোচনা হতো। যে পরিবারটির কারণে আজ তারা এতটা ক্ষমতাধর, তার প্রতিষ্ঠাতা মেয়র এমসেল রথসচাইল্ডের বাড়িতে পুলিশ নিয়মিত হানা দিত। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর পত্র-পত্রিকায় বড়ো অক্ষরে ছাপানো হতো। তাহলে কী এমন ঘটেছিল, যার দরুন বিংশ শতাব্দীতে মানুষ ইহুদিদের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে!

১৯১৩ সালে Anti-Defamation League প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক এ সংগঠনটির সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বত্রিশটি শাখা অফিস। ইহুদিদের প্রতি সাধারণ মানুষের যত ক্ষোভ, তা মোকাবিলা করাই এই সংগঠনটির মুখ্য উদ্দেশ্য। একে ইহুদিদের প্রতিরক্ষা বাহিনী বললেও ভুল হবে না।

তারা ইউরোপ-আমেরিকার সেই সব দেশকে টার্গেট করে, যেখানকার প্রশাসনিক পদগুলোতে যথেষ্ট ইহুদি রয়েছে। শিক্ষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিভাগগুলোতে তারা পর্যায়ক্রমে আঘাত হানতে শুরু করে। ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে সেক্যুলারিজম। সেন্সর বোর্ড এমন সব নাটক ও চলচ্চিত্র অনুমোদন দিতে শুরু করে, যা যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুকৌশলে তারা খ্রিষ্টান নারী সমাজের পর্দাপ্রথা উঠিয়ে দেয়। অতীতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে—এমন প্রতিটি বই তারা লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলতে শুরু করে। যেমন : : শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস। পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাধ্য করে, যেন তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ না করে। মানুষের মনে অদৃশ্য ভয় ঢুকিয়ে দিতে তারা জন্ম দেয় অসংখ্য উদ্ভট মতবাদ। যেমন : ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’

তারা চায় বিশ্ববাসী তাদের সমীহ করুক। তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করুক। যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর যত নিপীড়ন চালিয়েছে, এবার তার দায় মিটাক। তবে তাদের সাথে যে কেউ-ই সন্ধি করতে চায়নি—এমনটা নয়। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ইহুদিদের অনুরোধ করেছে, যেন তারা পৃথক জাতীয়তাবাদ নীতি থেকে সরে আসে এবং একত্রিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পৃথক জাতীয়তাবাদ নীতিতে তারা কতটা ঐক্যবদ্ধ—তার একটি নমুনা দেওয়া যাক।

একতাবদ্ধ জাতি মানে এই নয়, তাদের মধ্যে হানাহানি-মারামারি কিছুই ঘটে না। ক্রোধ-ঘৃণা-মারামারি সব সমাজেই বিদ্যমান। অন্যদের মতো তাদের সমাজেও এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটতে দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে—রেষারেষি শুরু হলে আমরা তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দিই, কিন্তু তারা দেয় না। যত যা-ই হোক না কেন, তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মেটায়। আবার জাতীয় ইস্যুতে তারা এক হয়ে যায়। আজ যারা মারামারি করছে, কাল তারা বন্ধুও হয়ে যেতে পারে; যদি জাতীয় স্বার্থে কোনো আঘাত আসে। এই গুণগুলো জ্যান্টাইলদের মাঝে কখনো দেখা যায় না।

জ্যান্টাইলদের মাঝে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাদের রয়েছে বহু জাত, ধর্ম ও বিভাজন। ফলে তারা এক হতে চাইলেও সূক্ষ্ম কোনো ইস্যুতে তাদের মাঝে সংঘাত উসকে দেওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। এ কারণে ঐক্য বজায়ের ক্ষেত্রে ইহুদিরা সব সময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।

তবে সস্তা সহানুভূতি দিয়ে তো আর ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়; এজন্য প্রয়োজন যুদ্ধ। যতদিন না পৃথিবীর অন্য সব রাজত্বের পতন ঘটবে, ততদিন এই ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া সম্ভব নয়। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রথম জায়োনিস্ট সম্মেলনের পূর্বে তারা একটি নীলনকশা তৈরি করে। কীভাবে অন্যান্য সাম্রাজ্যে আঘাত হানবে, কীভাবে জনমত তৈরি করবে, কারা এর পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সেই নকশায় স্থান পায়। এরপর থেকে তারা কতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে, তা বিংশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া যুদ্ধগুলোর দিকে তাকালেই উপলব্ধি করা সম্ভব।

সবাই বলে—দুষ্ট লোকের কোনো ধর্ম নেই। তারা যে দুষ্ট, এটাই তাদের পরিচয়। তাই তাদের পরিচয় প্রকাশে ধর্মকে না জড়ানোই উচিত। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে থাকে সমাজের বহু মানুষের আবেগ-অনুভূতি। কিন্তু যদি কোনো সম্প্রদায় নিজ ধর্মকে পুঁজি করে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করে এবং ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তখন কি তাদের ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখার আর কোনো উপায় থাকে?

পৃথিবীতে এখনও যে বহু সৎ ও আদর্শবান ইহুদি বেঁচে আছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিছু নৈতিকতা সব ধর্মেই পাওয়া যায়। এমন যদি হতো, বিশ্ববাসী সকল সমস্যার সমাধান শুধু এই ধর্মটিতে খুঁজে পাচ্ছে, তাহলে বিষয়টি ভিন্ন হতে পারত; কিন্তু সেখানেও তারা ব্যর্থ

ইহুদিরা নিজেদের ধার্মিক বলে দাবি করলেও তাদের সম্পদশালীদের ধর্মীয় অনুশাসনের ধারে কাছেও দেখা যায় না। তাদের মধ্যে ওল্ড টেস্টামেন্টের ছিটেফোঁটাও নেই। যারা কঠিন দরিদ্রতায় দিন পার করছে, কেবল তাদেরই প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে দেখা যায়। বেচা-বিক্রি কম হবে তা জেনেও সাব্বাতের[১৬] দিনে দোকান বন্ধ রাখে এবং ইওম কিপুর[১৭] দিনটিতে রোজা রাখে। ধর্মীয় চেতনা এই গরিবদের কখনো ক্ষমতার গদি এনে দিতে পারেনি। মূলত সঠিকভাবে নিজ ধর্ম পালন, আর ধর্মকে পুঁজি করে ব্যাবসা ও সন্ত্রাসবাদ কায়েম কখনো এক বিষয় নয়।

প্রাকৃতিকভাবেই তাদের প্রতিটি প্রজন্ম এমন কিছু গুণ পেয়ে থাকে, যা জ্যান্টাইলদের মাঝে সাধারণত দেখা যায় না। তাদের সবার মাঝেই কমবেশি এই গুণগুলো উপস্থিত থাকে। এ জাতীয় কিছু বৈশিষ্ট্য পাঠকদের জানা উচিত বলে মনে করি। যেমন :

১. ব্যাবসা-বাণিজ্যে ইহুদিদের মতো প্রতিভাধর জাতি আর দ্বিতীয়টি নেই। এর রহস্য কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন, কেন তিনি তাদের এভাবে সৃষ্টি করেছেন।

২. ইহুদিদের মতো সূক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই এসেছে। ব্যাবসা- বাণিজ্যে অসামান্য দক্ষতা অন্যদের চক্ষুশূলে পরিণত করেছে। অনেক সম্প্রদায় তো তাদের সাথে বাণিজ্য করতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এমনকী বহুবার তাদের একঘরে করে রাখা হয়েছিল। তবে ইহুদিদের রাজনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এতটাই বিস্ময়কর ছিল, বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহরা পর্যন্ত তাদের অভ্যর্থনা না জানিয়ে পারত না।

৩. ইহুদিরা অসংখ্য মতবাদের জন্মদাতা। একটি সমাজকে বহু অংশে বিভক্ত করার সহজ উপায় হচ্ছে—তাদের মাথায় নতুন নতুন মতবাদ ঢুকিয়ে দেওয়া। ধরুন, একটি মাঠে ১৬টি বিড়াল আছে। এখন যদি একটি বড়ো গামলায় বিড়ালগুলোকে দুধ পান করতে দেন, তবে তারা একত্রিত হয়ে দুধ পান করবে। কিন্তু এই দুধ যদি চারটি আলাদা পাত্রে ভাগ করে মাঠের চার কোনায় রেখে দেওয়া হয়, তবে খুব সম্ভাবনা আছে বিড়ালগুলো চারটি দলে বিভক্ত হয়ে দুধ পান করবে; দলগুলোতে যদিও সদস্য সংখ্যায় পার্থক্য থাকতে পারে। নতুন নতুন মতবাদ ঠিক একই রূপে কাজ করে, যার জন্য আমাদের সমাজ আজ বহু ভাগে বিভক্ত।

প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা নিজেদের লেখক, কলামিস্ট ও চিত্রকর নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিছুদিন পরপর পরিকল্পিত উপায়ে নতুন সব তত্ত্ব ও মতবাদ বাজারে নিয়ে আসে। এসব পড়ে পাঠকদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়, তা সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় তো আর সবার থাকে না। ফলে পত্রিকা পড়ে মানুষ যা বোঝে, তা নিয়েই অন্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেয়। আর আলোচনায় যদি সমর্থন না পায়, তবে অনেক সময় তা মারামারি পর্যন্ত গড়ায়।

ইহুদিরা আজ পর্যন্ত এত নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে কেন? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়তো অনেকেই দিতে পারবে না। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা যাক। প্রাচীন ইংল্যান্ডে ব্যবসায়ী ও বণিক দলগুলোর মাঝে বেশ কিছু নিয়মকানুনের প্রচলন ছিল, যা মেনে চলা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। এগুলোকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অনুশাসনও বলা হতো।

যেমন : একজন প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত ঠিকাদারকে কখনো পরবর্তী কাজের জন্য দরপত্র (টেন্ডার) জমা দিতে হবে না; বরং কাজ নিজ থেকেই তার নিকট চলে আসবে। নিজ দোকানের বিক্রয় বাড়াতে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা অন্যান্য ব্যবসায়ী ভাইদের প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেয়। একই সঙ্গে একাধিক পণ্যের বাণিজ্যে ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। যেমন : যদি কোনো ব্যক্তি চা-পাতা বিক্রি করে, তবে সে কখনো চা-চামচ বিক্রি করতে পারবে না। যদি কোনো বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে জনগণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং বিজ্ঞাপিত পণ্য ক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানকে কঠিন অপমানের মুখোমুখি হতে হতো; এমনকী ব্যাবসাও বন্ধ হয়ে যেত।

সে সময় সামাজিক অনুশাসনগুলোকে মানুষ স্বর্গীয় আইনের মতো শ্রদ্ধা করত। যারা এই আইন লঙ্ঘন করত, তাদের ওপর নেমে আসত কঠিন শাস্তি। আইন অমান্যকারীর জন্য কোনো ক্ষমার বিধান ছিল না। কিন্তু ইহুদিরা ইংল্যান্ডে আসার কিছুদিন পর সকল ব্যবসায়িক অনুশাসন ভেঙে দেয়। পণ্য বিক্রয়ে তারা এতটাই অধৈর্যশীল ছিল, একসঙ্গে অনেক পণ্য বিক্রি করতে শুরু করে। সামাজিক প্রথা ভেঙে এক দোকানে একাধিক পণ্য সাজিয়ে রাখতে শুরু করে, যা থেকে জন্ম নেয় বিভাগীয় বিপণিবিতান (Departmental Store)।

স্বল্প মুনাফা অধিক বিক্রয়—এ ধারণাটি প্রথম ইহুদিদের মগজ থেকেই বের হয়। উৎপাদন ব্যয় কম রাখতে তারা পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো শুরু করে। জ্যান্টাইলরা গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে পণ্য উৎপাদন করত, কিন্তু ইহুদিদের দৌরাত্ম্যে সেই সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে। তা ছাড়া কিস্তিতে ধার পরিশোধের বিষয়টি প্রথম তাদের মাথা থেকেই বের হয়। মোটকথা ব্যবসায়ে অচলাবস্থা তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। যেকোনো মূল্যেই হোক বাজারে পণ্য বিক্রয় সচল রাখতেই হবে।

ইহুদিরাই প্রথম ব্যবসায়িক কাজে বিজ্ঞাপন প্রথা সংযোজন করে। দোকানের অবস্থান, পণ্যের বিবরণ, মূল্যের পরিমাণ ইত্যাদি কাগজে লিখে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারিং-এর ধারণা তারাই বাজারে নিয়ে আসে। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করত, যেন প্রয়োজনের সময় অর্থ-সাহায্য পাওয়া যায়। অসাধু ও অনৈতিক উপায়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া তাদের কাছে ছেলেখেলার মতো। অথচ জ্যান্টাইলরা কাউকে ঠকিয়ে বাণিজ্য করাকে আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দেওয়া মনে করত। কারণ ধরা পড়লে তার জন্য অসহনীয় অপমান অপেক্ষা করত।

আশা করি এবার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের অসংখ্যবার নির্বাসিত করা হয়েছে। ১১০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের নির্বাসনের একটি সংক্ষিপ্ত ছক নিচে উপস্থাপন করা হলো—

রাষ্ট্র/দেশ — সাল/ নির্বাসনের বছর

ইংল্যান্ড — ১২৯০

পর্তুগাল — ১৪৯৭

স্পেন — ১৪৯২

ফ্রান্স — ১১৮২, ১৩০৬, ১৩২১, ১৩৯৪

জার্মানি — ১৩৪৮, ১৫১০, ১৫৫১

সার্ডিনিয়া — ১৪৯২

লিথুনিয়া — ১৪৪৫, ১৪৯৫

ডসলিসিয়া — ১১৫৯, ১৪৯৪

অস্ট্রিয়া — ১৪২১

হাঙ্গেরি — ১৩৪৯, ১৩৬০

নেপোলিস — ১৫৪১

ক্রিমিয়া — ১০১৬, ১৩৫০

তবে একবিংশ শতাব্দীর এ যুগে তাদের নতুন করে নির্বাসিত করবে—এমন ক্ষমতা কোনো রাষ্ট্রের নেই। মূলত তারা এ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আজ তারা ঠিক ততটাই ক্ষমতাধর, যতটা বাইবেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম তথা বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা পৃথিবীর সব সম্পদ শুষে খাচ্ছে। মানুষ যদি জানত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে কাজ করে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের নামে তারা কী করছে, তাহলে আগামীকাল সকালেই মহাসড়কে গণজোয়ার বয়ে যেত।

যে সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থাকে পৃথিবীর পয়গম্বর মোজেস নিষিদ্ধ করে গেছেন, তা-ই আজ ইহুদিরা পৃথিবীর সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। এখন দেখার বিষয়, এই রাজকীয় ক্ষমতা কখন নিউইয়র্ক থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়; যেমনটা ওল্ড টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে। আর তখনই বুঝতে হবে—পৃথিবীর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।

অ্যান্টি-সেমিটিজম কী

কোনো অপরাধী কখনোই চায় না, তার অন্ধকার জীবনের ইতিহাস সাধারণ মানুষের সামনে ফাঁস হয়ে যাক। তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় নেতিবাচক কিছু লেখা হোক এবং আইন বিভাগ তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করুক।

সে চায় পৃথিবীর সব সম্পদ একাই ভোগ করবে, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে যেন কেউ নেতিবাচক কিছু লিখতে না পারে, সেজন্য পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ের কিনে নেয়। আবার সম্পদের লোভ দেখিয়ে পুরো প্রশাসনকে নিজের পকেটে পুরে রাখে। এভাবে সে সমাজে ভিআইপির মর্যাদা পেতে শুরু করে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যেন আইন বিভাগের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই জন্ম নেয় নতুন সব গডফাদার, যারা সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে একসময় শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। তারা এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে, যে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে অন্তত কয়েকবার ভাবতে হয়।

আর যখন কোনো সাহসী ব্যক্তি তথ্য-প্রমাণসহ এই অপরাধীদের অন্ধকার জীবনের ইতিহাস ফাঁস করার প্রচেষ্টা করে, তখন সমাজের চতুর্দিক থেকে একের পর এক বিদ্রুপাত্মক সমালোচনা আসা শুরু করে। যেহেতু সংবাদ সংস্থাগুলো আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, তাই মনিবের সম্মান রক্ষায় তারা উঠেপড়ে লেগে যায়। তারা সেই সাহসী ব্যক্তিকে একের পর এক মনগড়া অভিযোগে ফাঁসাতে শুরু করে। মূলত কিছু পূর্বপরিকল্পিত কৌশল প্রতিটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে রাখে, যেন উদ্ভূত প্রতিটি পরিস্থিতি তৎক্ষণাৎ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।

সাহসী সেই ব্যক্তিটি যে তথ্যই উপস্থাপন করুক না কেন, বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো তার সকল প্রচেষ্টাকে পণ্ড করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে একসময় সাধারণ মানুষ গডফাদারদের বিরুদ্ধে কথা বলার ন্যূনতম সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলে। জরাজীর্ণতা ও বিভিন্ন কুসংস্কার সাধারণ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সবাই ভাবে, এদের নিয়ে কথা না বলাই ভালো। কথা বলতে গেলে না জানি কোন মিথ্যা অপবাদে দোষী হতে হয়। ফলে গডফাদাররা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সাংবাদিকতা শিল্পের ওপর Noam Chomsky তার বই Manufacturing Consent-এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

ওপরের উদাহরণ আজকের সাম্রাজ্যবাদী ইহুদিদের সাথে মিলে যায়। মানুষ যেন তাদের বিরুদ্ধে এক হতে না পারে, সেজন্য তারা স্বাধীন তথ্য প্রবাহের ওপর আঘাত হেনেছে। ভয় ও কুসংস্কারের রাজত্ব কায়েম করতে তারা অ্যান্টি-সেমিটিজম ধারণার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি যে নতুন কিছু—তা নয়; আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা শিল্পে এটি বহুল ব্যবহৃত ও আলোচিত একটি বিষয়। ইজরাইল সম্পর্কিত অনেক ইস্যুতে আজ এই শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে; যদিও এর প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৮৭৯ সালে জার্মানিতে। তবে অধিকাংশের কাছে এই শব্দকে নতুন বলে মনে হতে পারে।

ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের নেতিবাচক ধারণা পোষণ করাকে অ্যান্টি-সেমিটিজম বলা হয়। আর যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে এই ধারণা পোষণ করে, তাকে বলা হয় অ্যান্টি- সেমাইট। আপনি সত্য না মিথ্যা বলছেন, তা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

-প্যালেস্টাইনে আরবদের অধিকার নিয়ে কথা বলুন

-বলশেভিক বিপ্লবে তাদের গণহত্যার কথা বলুন

-ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলুন

-চলচ্চিত্রশিল্পে তাদের অশ্লীলতার কথা বলুন

-বিশ্বযুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলুন

-শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলুন

-ধর্ম প্রচারের নামে রাবাইদের বিভ্রান্তি ছড়ানোর কথা বলুন

-অনুসন্ধানী কোনো রিপোর্টে তাদের জড়িত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করুন

তবে মনে রাখুন, এ জাতীয় কোনো একটি কাজ করেছেন—তো আপনার ওপর অ্যান্টি- সেমাইট লেবেল চাপিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে।

এশিয়া বা আফ্রিকায় এ বিষয়টির খুব একটা প্রচলন না থাকলেও ইউরোপ-আমেরিকায় এটি রীতিমতো হইচই-এর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনিক দপ্তরের সবচেয়ে উচ্চপদ থেকে নিম্নপদ পর্যন্ত সবাই এ সম্পর্কে অবগত। প্রতিটি দেশে কিছু রাজনৈতিক আঁতুড়ঘর থাকে, যেখানে নতুন নতুন রাজনীতিবিদদের জন্ম হয়।

শুনে অবাক হবেন, বিশ্বের অধিকাংশ রাজনৈতিক আঁতুড়ঘরগুলোকে তারা একটি চেইন প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কেউ-ই কথা বলবে না। তাদের মূল লক্ষ্য জেরুজালেম। তারা জানে—হাজার বছরের পুরোনো এই ভূমিকে পুনরায় ইজরাইলের রাজধানী করা অতটা সহজ নয়। যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কা তাদের সব সময় বিচলিত করে রাখে। তারা ভৌগোলিক সীমারেখায় ফাটল সৃষ্টি করে অসংখ্য নতুন রাষ্ট্র তৈরির ইন্ধন জুগিয়েছে। জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার নামে এক দেশের সাথে অপর দেশের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দিয়েছে।

ধরুন, গাজায় ইজরাইলি বিমান হামলার প্রতিবাদে ইউরোপের কয়েকটি দেশ তাদের পার্লামেন্টে ইজরাইলবিরোধী আইন পাস করল। এবার জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তারা নিজেদের অতীত নির্যাতনের ইতিহাস এমনভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করবে, যেন মানুষের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

কবে কোন হলোকাস্টে ১৫ বছরের এক কিশোরী শত্রুবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে, তা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় কলাম ছাপানো শুরু হবে। ব্যাবিলন সেনাপতি নেবুচাদনেজারের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত তারা যত নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তা নিয়ে একের পর এক প্রামাণ্যচিত্র তুলে ধরা হবে। সবশেষে সমাপ্তি টানবে এই বলে—যে জাতি হাজার বছরের নির্যাতন সহ্য করে একবিংশ শতাব্দীতে পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস ফিরে পেয়েছে, তাদের প্রতি ইউরোপিয়ান দেশগুলোর এমন অ্যান্টি- সেমেটিক মনোভাব বিশ্ববাসীকে হতাশ করেছে!

এ নিয়ে ইহুদিরা টকশোর আয়োজন করবে, যেখানে তাদেরই নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা প্রতিনিধিত্ব করবে। এমন সব যুক্তি উপস্থাপন করবে, যা শ্রোতা সমাজের মগজধোলাই করে ছাড়বে। তারা বুঝিয়ে ছাড়বে, তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনগুলো-ই ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ও হৃদয়বিদারক। তাদের প্রতিটি জীবন খুবই মূল্যবান। কেবল আত্মরক্ষা করতেই তারা গাজার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা করেছে। যারা এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত এবং যারা তাদের পক্ষ নিয়ে পার্লামেন্টে আইন পাশ করেছে, তারা উভয়েই অ্যান্টি-সেমাইট। এমনকী সেই ফেরাউন, যার হাতে বনি ইজরাইলের হাজারও শিশুপুত্র নিহত হয়েছে, সেও ছিল অ্যান্টি-সেমাইট।

তাদের প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে সফলও হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক মহলগুলোতে ইহুদিদের নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না। সবাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলার পথ অবলম্বন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানিতে তারা যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তা আজ পুরো বিশ্বে কায়েম হয়ে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে একটি বা দুটি মহল ইহুদিদের নিয়ে আলোচনা করলেও সামগ্রিকভাবে বড়ো কোনো মহল তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করে না।

পৃথিবীর বড়ো বড়ো শহরগুলোতে আজ ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চারদিকে বারুদের গন্ধ। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ যেন পৃথিবীর দরজার টোকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কবে, কখন, কোথা থেকে এই যুদ্ধ শুরু হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তারা চায় না চূড়ান্ত মঞ্চ তৈরির পূর্বে বিশ্ববাসীর নিকট তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হোক। কারণ, এটাই একমাত্র ইস্যু, যা পুরো জ্যান্টাইল বাহিনীকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে এক করে তুলতে পারে। অ্যান্টি-সেমিটিজমকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—

১. কোনো রকম বাছ-বিচার ছাড়াই ইহুদিদের অপছন্দ করা প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাদের ব্যাপারে খুব সীমিত জ্ঞান রয়েছে—এমন মানুষদের মনেই কেবল এ জাতীয় মনোভাব লক্ষ করা যায়। এমন অনেকে আছে, যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—আপনি কেন তাদের ঘৃণা করেন? তবে সেই ব্যাক্তি এর গঠনমূলক কোনো উত্তর দিতে পারবে না।

২. ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। অপছন্দ করা আর শত্রুতা পোষণ কখনো এক বিষয় নয়। যেমন : চায়ের সাথে দুধ মেশানোকে অপছন্দ করতে পারেন; কিন্তু তার মানে এই নয়, আপনি দুধ ঘৃণা করেন।

৩. ইহুদিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সংঘাতমূলক মনোভাব তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়ের মানুষ প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে, যার দরুন তাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার নেমে আসে।

অভ্যাসগত কারণে অ্যান্টি-সেমিটিজম আজ পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ পুনরায় তাদের বিরুদ্ধে এক হতে শুরু করেছে। তবে ভৌগোলিক সীমারেখার ভিত্তিতে পুরো পৃথিবীকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বলে এই একতা চূড়ান্ত রূপ লাভ করতে পারছে না। তারা জানে, সংখ্যায় অল্প হয়েও বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র সূত্র হলো- ‘ Divide and Rule’ (ভাগ করো, শাসন করো)।

তারা যে কেবল আলাদা আলাদা ভূ-রাষ্ট্রই তৈরি করেছে তা নয়; বরং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন মতবাদের বীজ ছড়িয়ে প্রতিটি দেশে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রাজনৈতিক দল। এরা প্রতিনিয়ত ক্ষমতার লোভে একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যে চাকার ওপর ভর করে আপনি গন্তব্যে পৌঁছাবেন, সে চাকাতেই যদি ঘৃণা থাকে, তবে আর গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে না।

জার্মানদের অবস্থান ইহুদিদের বিরুদ্ধে কেন

জার্মানিকে বলা হয় কবি ও চিন্তাবিদদের দেশ। এ দেশের মাটিতে বহু প্রতিভাধর কবি, লেখক ও দার্শনিকের জন্ম হয়েছে। সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের রয়েছে অসামান্য অবদান। শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির মতো প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে তারা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু কে বলবে, মাত্র তিন দশক পূর্বেও তারা দুই ভূখণ্ডে (পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি) বিভক্ত ছিল, যা পরিচালিত হতো দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা! আধুনিক জার্মানির উত্থান ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের ইতিহাসে রয়েছে অনেক জটিলতা। পথ চলতে গিয়ে তারা যত ধাক্কা খেয়েছে, তাদের ইতিহাস ততই সমৃদ্ধ হয়েছে।

যে দেশটিকে নিয়ে এত আলোচনা, তারা মাত্র একশো বছর পূর্বেও কী পরিমাণ ভয়ংকর কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল, তা কি কখনো কল্পনা করা সম্ভব? একটি জাতি তাদের ওপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিষাক্ত অণুজীব হয়ে প্রবেশ করে জার্মানদের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ধসিয়ে দেয় তাদের সমাজব্যবস্থার প্রতিটি কাঠামো। অভাব ও দারিদ্র্যতার দরুন নেমে আসে ভয়াভহ দুর্ভিক্ষ।

১৯২৩ সালে তাদের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় নেমে আসে, তা আজও বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে অন্যতম বড়ো বিপর্যয়। ঠিক তখন এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে, যার কথা পুরো পৃথিবী আজও স্মরণ করে; যদিও তা নেতিবাচক অর্থে। তিনি হলেন এডলফ হিটলার। তার হাতেই নাৎসি বাহিনী প্রতিষ্ঠা পায়। প্রচলিত আছে, তার এই বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করে; যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত।

হিটলারের হলোকাস্ট বিষয়টি যেমন সত্য, তেমনি তার ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা-ও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ১৯৩৪ সালের জুন মাসে Les Annales পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে জার্মান ইহুদি লেখক Emil Ludwig Cohn বলেছিলেন—

,

‘হিটলার কোনো যুদ্ধে যাবে না। এমনকী সে কোনো যুদ্ধে জড়াতেও চায় না। কিন্তু আমরা তার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেবো। হয়তো এ বছর, নয়তো পরের কোনো বছর।

এ প্রসঙ্গে My Political Testament-এ হিটলার উল্লেখ করেন—

‘এটা পুরোপুরি অসত্য, আমি বা জার্মানির কেউ ১৯৩৯ সালে যুদ্ধে জড়াতে চেয়েছি। এর নেপথ্যে ছিল আন্তর্জাতিক ইহুদি সংগঠনগুলোর ষড়যন্ত্রময় পরিকল্পনা। তারাই আমাদের যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য করেছে। ধ্বংসাত্মক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি যুদ্ধের কথা আমি কখনো কল্পনাও করিনি; হোক তা আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।’

এই সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল ইহুদিদের অসংখ্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, যা আজও পুরো বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে। জেরুজালেম থেকে নির্বাসিত হয়ে নিজেদের একতা ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা ‘আল-জুদান’[১৮] নামে নতুন এক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়; কিন্তু এ রাষ্ট্রকে চোখে দেখা যেত না। কারণ, এর নিজস্ব কোনো ভূমি ছিল না। তাদের সদস্যরা পৃথিবীর যে প্রান্ত অবধি ছড়িয়েছে, রাষ্ট্রের সীমানা ছিল ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

তারা ‘কাহাল’[১৯] নামে নতুন এক সমাজব্যবস্থার জন্ম দেয়, যা মেনে চলা সকল ইহুদিদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। আধুনিক রাষ্ট্রের ন্যায় তাদেরও ছিল পার্লামেন্ট। সেখানে নিয়মিত অধিবেশন বসত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিদের অঞ্চলভিত্তিক প্রতিনিধিরা (বিশেষত রাবাইগণ) এই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করত। পরবর্তী বছরের অধিবেশনে কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা চলতি বছরে কাজের গুণাগুণ দেখে নির্ধারণ করা হতো। সে অধিবেশনে নতুন বছরের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং বাজেট পাশ করানো হতো। সেই পার্লামেন্টের নাম ‘সেনহাড্রিন’।[২০] পার্লামান্টের পাশাপাশি এটা ছিল তাদের ধর্মীয় আদালত।

প্যারিস, ওয়ারসো, হ্যানয়, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে তাদের অধিবেশন বসত। গোপনীয়তা ছিল তাদের সকল কাজের প্রথম শর্ত, যেন সাধারণ মানুষ এসবের ব্যাপারে কিছুই আঁচ করতে না পারে। আল-জুদানের প্রথম সদর দপ্তর ছিল প্যারিসে। পরে তা লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ওয়ারসোর মতো আরও অনেক শহরে স্থানান্তরিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠে এর শাখা সংগঠন। গুপ্তচরের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে পুরো পৃথিবীতে। ইজরাইল পুনরুদ্ধার এবং জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের সকল কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য।

ছোট্ট এই শহরটিকে নিয়ে মানুষের হানাহানি-রক্তারক্তির যেন শেষ নেই। অনেকে ছন্দ করে বলে— -পৃথিবীর আদি শিকড় হয়তো এই ভূমিতেই গজিয়েছে, যার জন্য সবাই এখানে ফিরে আসে। আর এখান থেকে সকল হানাহানির সূত্রপাত। তারা বিশ্বাস করে—যখন বহু প্রতীক্ষিত মসিহ[২১] পৃথিবীতে আসবেন, তখন তাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। তবে তাঁর আগমন নিশ্চিত করতে এই ভূমিকে অবশ্যই ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ পথে কোনো কাঁটা সহ্য করা হবে না। তাই আজ অবধি যারাই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কালের পরিক্রমায় তাদের সীমাহীন দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে; যেমনটা ঘটেছে জার্মান ও রাশিয়ানদের ভাগ্যে।

১৯২২ সালে পূর্ব ইউরোপে যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের সূচনা ঘটে, তা ছিল ইহুদিদের কাহাল ব্যবস্থার অনুরূপ। সোভিয়েত নিয়ে তাদের ছিল সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। তবে ১৯০৫ সালে সেই পরিকল্পনা ফাঁস হলে, রাশিয়ান সম্রাট নিকোলাস ইহুদিদের নাগরিকত্ব বাতিল করেন। ফলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী উদ্‌বাস্তু হয়ে পড়ে।

সেকালে জার্মানির ৫০ শতাংশ পত্রিকা ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পত্রিকায় কী ছাপানো হবে আর কী বাদ যাবে, তা কেবল তারাই নির্ধারণ করত। খুবই করুণ ভঙ্গিতে তারা এই উদ্‌বাস্তু জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন চিত্র চারদিকে প্রচার শুরু করে। কিন্তু সম্রাট নিকোলাস কেন তাদের নাগরিকত্ব হরণ করলেন এবং কেনই-বা তাদের বের করে দিলেন, তা নিয়ে কোনো কিছুই প্রকাশ করা হলো না। ফলে সাধারণ মানুষ মূল ঘটনা সম্পর্কে অজ্ঞই রয়ে গেল। তাদের সামনে যা উপস্থান করা হলো, তা-ই গিলে খেল। উদ্‌বাস্তু এই জনগোষ্ঠীটির জন্য চারদিকে মায়া ও ভালোবাসার রোল পড়ে গেল। জনগণের আকুল আবেদনে জার্মান সম্রাট তার দেশের সীমানা খুলে দিলেন। কিন্তু এত অভ্যর্থনা জানিয়ে জার্মানরা যাদের আশ্রয় দিলো, কিছুদিন পর তারাই যে জোঁক হয়ে তাদের ওপর জেঁকে বসবে, তা কি জার্মানরা ভুলেও কল্পনা করেছিল!

আশ্রয় লাভের কিছুদিন পর থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, উপমন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা সুকৌশলে প্রবেশ করতে শুরু করে। জনসংখ্যায় মাত্র দুই শতাংশ হয়েও পুরো জার্মান প্রশাসনের হর্তাকর্তা বনে যায়। ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক হয়ে ইহুদিদের হাতে আসত মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ; যা দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তারা তুড়ি মেরে কিনে নিত। ইহুদিদের এক দল ব্যাংকারের কাছে পুরো দেশ আটকা পড়ে। শুরু হয় অর্থনৈতিক অধঃপতন, যার চূড়ান্ত রূপ দেখা দেয় ১৯২৩ সালে।

Frederick Taylor-এর লেখা The Downfall of Money বই থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯২২ সালে তাদের বাজারে ১৬৩ মার্ক‍[২২] দিয়ে একটি পাউরুটি পাওয়া যেত। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তার মূল্য হয় ১.৫ মিলিয়ন মার্ক এবং নভেম্বর শেষ হতে না হতেই তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই বিলিয়ন মার্কে। দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্দ্ধগতির দরুন জনজীবনে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। ঋণের দায় মেটাতে না পেরে প্রচুর প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। বেকার ও গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৬০ লাখেরও অধিক মানুষ।

৮ নভেম্বর, ১৯২৩ হিটলার প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র সৈনিক নিয়ে মিউনিখ আক্রমণ করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালায়। সেদিন মিউনিখের Bürgerbräukeller Beer Hall-এ এক প্রশাসনিক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রায় তিন হাজারের অধিক সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিল। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ লাভের উপায় নিয়েই এ আলোচনা চলছিল।

হিটলার তার বাহিনীসমেত আচমকা হলে প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুড়তে শুরু করে। সবাইকে বলে, এই অচলাবস্থা থকে মুক্তির পথ সে খুব ভালো করে জানে। সবাই যেন তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় বিপ্লবে অংশ নেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাকে মিউনিখ মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের সাথে বন্দুকযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়। এই যুদ্ধ দুই দিন ধরে চলে। এতে তার বহু সৈনিক নিহত এবং অনেককে গ্রেফতার করা হয়। হিটলার জীবিত পালালেও ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪ সালে হিটলারকে বিচারের মুখোমুখি করা হলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই পুরো ঘটনা ইতিহাসে Beer Hall Putsch নামে পরিচিত। ১৯২২ সালে মুসোলিনি যেভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইটালির ক্ষমতা দখল করে, হিটলারও ভেবেছিল ঠিক একই উপায়ে জার্মানির ক্ষমতা দখল করতে পারবে। কিন্তু এই ঘটনার পর সে বুঝতে পারে, পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দল গঠন ব্যতীত এ দেশের ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়।

এই ঘটনার পর পুরো জার্মানিতে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আদালত কক্ষে বিচারকের সামনে সে যে বক্তব্য দিয়েছিল, পত্রিকাগুলো তা গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। তার বক্তব্য যেন সাধারণ মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছিল। এরপর হিটলারকে পাঁচ বছরের জায়গায় এক বছরও জেল খাটতে হয়নি। ২০ ডিসেম্বর, ১৯২৪ সালে হিটলার জেল থেকে মুক্তি পায়। এর আগে জেলে বসে সে রচনা করে Mein Kampf-এর প্রথমাংশ, যা সমাপ্ত হওয়ার পর ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়; শুরু হয় তার রাজনৈতিক দল গঠন পর্ব।

১৯৩৩ সালে তার রাজনৈতিক দল নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই পুরোনো অর্থব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা এবং নতুন মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। যে ব্যাংকারদের হাতে এতদিন দেশ জিম্মি ছিল, তাদের সে দেশছাড়া করে। রাতারাতি পুরো দেশের চিত্র পালটে যায়। পুরো বেকার সমাজকে সে একাই কাজে ফিরিয়ে আনে এবং সবার জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে শুরু করে। মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তারা হয়ে উঠে সুপারপাওয়ার জাতি। তাদের পরিবর্তন দেখে অস্ট্রিয়াও একই নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। কোনো বাধা ছাড়াই হিটলারকে তাদের দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।

ইহুদিরা জানত, তাদের চেহারা অবশ্যই একদিন জনসম্মুখে প্রকাশ পাবে। তখন রাশিয়ার মতো জার্মানি থেকেও তাদের বের করে দেওয়া হবে। আজ পর্যন্ত তারা যতগুলো দেশে গিয়েছে, সেখানেই নিজেদের কৃতকর্মের জন্য বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছে। তাই নিজেদের সুরক্ষা বলয় শক্তিশালী করতে প্রথম থেকেই জার্মানির বিভিন্ন মন্ত্রলায়কে নিজেদের কবজায় নিতে থাকে। বিষয়টি হিটলারের ক্ষমতায় আসার অনেক বছর আগের কথা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর Hugo Haase এবং Otto Landsberg-এর তত্ত্বাবধানে ছয় সদস্যের জার্মান মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হন Mr. Haase, যার প্রধান সহকারী ছিলেন Karl Kautsky। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হন Eguen Schiffer, যার প্রধান সহকারী ছিলেন Eduard Bernstein। শিক্ষা বিভাগের প্রধান হন Mr. Arndt, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার প্রধান হন Mr. Meyer-Gerhard, শিল্পকলা বিভাগের প্রধান Mr. Kastenberg, আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান হন Mr. Wurm । কোপেনহেগেনে অবস্থিত ডেনমার্ক পত্রিকা প্রতিষ্ঠান ‘Frankfurter Zeitung’-এর প্রধান হন Fritz Max Cohen; উল্লিখিত সবাই ছিলেন ইহুদি।

একই উপায়ে তারা প্রুশিয়ার প্রশাসনও দখল করে নেয়। সেখানকার মন্ত্রীসভা যে দুইজন ব্যক্তির নেতৃত্বে গঠিত হয়, তারা হলেন Paul Hirsch ও Kurt Samuel Rosenfeld। বিচার বিভাগের প্রধান হন Mr. Hirsch। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হন Mr. Rosenfeld। রাজস্ব বিভাগের প্রধান হন Mr. Simon এবং তার প্রধান সহকারী হন Mr. Furtran । যুদ্ধকালীন সময়ে খাদ্যবিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন Prof. Dr. Hirsch Ges Geheimrat, Dr. Stadthagen। এ ছাড়াও Cohen, Stern, Herz, Lowenberg, Frankel, Israelowicz, Laubenheim, Seligsohn, Katzenstein, Laufenberg, Heimann, Schlesinger, Merz এবং Weyl-এর মতো আরও অনেকে প্রশাসনিক বিভাগে নিযুক্ত হন।

বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুট, মিউনিখ ও এসেনে পুলিশ বিভাগের প্রধান হন যথাক্রমে Mr. Ernst, Mr. SinZheimer, Mr. Steiner এবং Mr. Levy। বাভারিয়ার প্রেসিডেন্ট Kurt Eisner-এর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হন Mr. Jaffe। শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের প্রধান হন Mr. Brentano। একই উপায়ে স্যাক্সনি ও ওয়ারটেমবার্গ রাজ্যের প্রধান হন Lipsinsky- Schwarz Ges Brentano। ইতিহাস অধ্যয়ন করলে আরও অনেকের পরিচয় পাওয়া যাবে, যাদের উপস্থিতি সেখানকার প্রশাসনিক পদগুলোতে ছিল। যেমন : Max Warburg, Dr. Von Strauss, Merton, Oskar Oppenheimer, Dr. Jaffe, Deutsch, Brentano, Brenstein, Struck, Rathenau, Wassermann R Mendelsohn-Bartholdi ।

The Berliner Tageblatt ও Muncher Neuester Nachrichten ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে জার্মান সরকারের প্রধান দুটি পত্রিকা। মজার বিষয় হলে—এই দুটি প্রতিষ্ঠানও তারা পরিচালনা করত। Frankfurter Zeitung প্রতিষ্ঠানটিকে তারা জার্মানবাসীর নৈতিক, আধ্যাত্মিক, মানবিক চরিত্র গঠন ও পরিবর্তনের কাজে বিশেষভাবে ব্যবহার করত।

সেকালে জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন Bethmann Hollweg। এবার তার উপদেষ্টাদের পরিচয় তুলে ধরা যাক। যেমন : Ballin ছিলেন প্রসিদ্ধ জাহাজ ব্যবসায়ী, Theodor Wolff ছিলেন Berliner Tageblatt এবং Pan-Jewish পত্রিকা দুটির প্রভাশালী সদস্য; Von Gwinner ছিলেন জার্মান ব্যাংকের মহাপরিচালক এবং Rathenau ছিলেন শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা। এরা সবাই ছিলেন সরকারের সকল তথ্য ও পরামর্শের একমাত্র উৎস। তারা সাধারণ জনগণের মতো সেখানকার সরকারকেও প্রতারিত করত।

মূলত তিনটি কৌশলে তারা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করত—

১. সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বলশেভিক চেতনা উসকে দেওয়া।

২. প্রকাশনীশিল্পে নিজেদের কর্তৃত্ব জোরদার করা।

৩. খাদ্য উৎপাদন ও কল-কারখানায় ব্যবহৃত কাঁচামাল সরবরাহে নিজেদের একচেটিয়া অধিপত্য নিশ্চিত করা।

১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে The London Globe পত্রিকার সাংবাদিক George Pitter- Wilson একটি কলামে উল্লেখ করেন—

‘বলশেভিজম মূলত খ্রিষ্টান ধর্মচ্যুত একটি সমাজব্যবস্থা, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য পৃথিবীতে ইহুদিদের রাজত্ব কায়েম।’

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর তারা প্রচার করতে শুরু করে—জার্মানদের পরাজয় ব্যতীত প্রলেতারিয়েতদের[২৩] প্রকৃত বিজয় অর্জন অসম্ভব।

Mr. Strobel ঘোষণা করেন—

‘জার্মানির সামগ্রিক বিজয় কখনোই গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য সুফল বয়ে আনবে না। এটা প্রলেতারিয়েটদের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে দেবে।’

তারা জাতি হিসেবে যে কতটা বিশ্বাসঘাতক, তা এই কয়েকটি উদাহরণ থেকেই বোঝা সম্ভব।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করতে ইহুদিরা খাদ্য সরবরাহ লাইনে আঘাত হানে। প্রতিটি দেশপ্রেমিক সৈন্যের ন্যায় তারাও জানত, যুদ্ধ মানে কঠোর আত্মত্যাগ এবং দীর্ঘকালীন কষ্ট ভোগ।

সে বছর ফসলের উৎপাদন বেশ ভালোই হয়েছিল, কিন্তু বাজারে পণ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য সবাইকে অবাক করে দেয়। মানুষ ভাবতে শুরু করে—এত ফসল তাহলে গেল কোথায়? যুদ্ধ শুরুর পূর্বে ফসলের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন অঞ্চলে ডিলার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। বিনিয়োগের অভাব ছিল না বলে ইহুদি ব্যবসায়ীরা ছদ্মবেশে সেসব ডিলারশিপ কিনে নেয়। তা ছাড়া মাঠ পর্যায়ে তাদের আরেকটি দল কাজ করত, যারা বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে বাজারমূল্যে সব পণ্য কিনে নিত। ফলে অল্প দিনে পুরো বাজার ফাঁকা হয়ে যায়। পরে তারাই কৃত্রিম সংকটের অজুহাতে বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।

এত পরিকল্পনার পরও কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে হার মানতে হবে, তা জার্মান সরকার কখনো ভাবতেও পারেনি। যুদ্ধের পর দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। আদালতে মামলা করা হয়। অবাক কাণ্ড! দেখা গেল যিনি মামলা করেছেন, আর যিনি বিচার করছেন, তারা উভয়েই ইহুদি! ফলে মামলা করেও প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অথচ এর বিপরীতে সাধারণ কোনো ব্যক্তিকে আদালতে তোলা হলে চারদিকে হইচই পড়ে যেত, তার ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে সাংবাদিকরা উঠেপড়ে লাগত।

সামাজিক স্বীকৃতি ও পদমর্যাদার প্রতি তাদের সব সময়ই মোহ কাজ করত। সম্পদশালীরা প্রতিপত্তির বিনিময়ে সমাজের উঁচু পদগুলো (যা থেকে শাসন করা সম্ভব) নিজেদের করে নিত; অনেকটা অর্থ দিয়ে সম্মান কিনে নেওয়ার মতো। কিন্তু তাদের গরিব ভাইয়েরা কী করত? তাদের তো আর সেই পরিমাণ সম্পদ নেই, যা দিয়ে ক্ষমতা কিনতে পারে! এক্ষেত্রে তারা একটি সূক্ষ্ম খেলা খেলত। গরিব গোষ্ঠীটি ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেত। ফলে কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হতো না—কে জ্যান্টাইল আর কে ইহুদি। বিভিন্ন অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়ে তারা মানুষের হৃদয়ে আন্দোলনের বীজ বুনে দিত। যেমন : শ্রমিক বিপ্লব। পেছন থেকে তাদের সম্পদশালী ভাইয়েরা প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিত। রাতারাতি জন্ম নিত কিছু শ্রমিকনেতা। আড়ালে কী ঘটছে, সাধারণ মানুষ কিছুই বুঝত না। তারা শুধু এতটুকুই দেখত—তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মহান এক নেতা, যিনি তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। আর নেতাদের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য পত্রিকা প্রতিষ্ঠানগুলো তো রয়েছেই।

এভাবে দল ভারী হওয়ার সাথে সাথে তারা মহা বিপ্লবের ডাক দেয়। তখন সরকার, প্রশাসন ও আইন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এক হয়েও এই আন্দোলন হটাতে পারে না। কারণ, ততক্ষণে জনগণ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। জন্ম নেওয়া নতুন শ্রমিকনেতা চলে আসে রাষ্ট্রের রাজকীয় ক্ষমতায়। সুবিধা ভোগের জন্য তিনি সেই সকল ব্যক্তিদের পথ করে দেন, যারা বিপ্লবের সময় তার পেছনে অর্থের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। জার্মান, ফরাসি ও বলশেভিক বিপ্লব এমন-ই কিছু উদাহরণের সমষ্টি।

প্রলেতারিয়েটদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তারা যখন রাশিয়াকে ভেঙে দিলো, তখন কে ক্ষমতায় আসে? ক্রান্সস্কি। তবে তার পরিকল্পনা যথেষ্ট ছিল না বলে ক্ষমতায় আসে ট্রটস্কি। এরপর আসে লেনিন। তারা সবাই ছিল বলশেভিক বিপ্লবের একেকজন মহানায়ক এবং একই গোষ্ঠীর সদস্য।

বেলফোর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে বহু আগেই ইজরাইল পুনঃপ্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়েছে। শক্তি, সামর্থ্য ও প্রতিপত্তির দিক দিয়ে তারা আজ পৃথিবীর যেকোনো পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের সমকক্ষ, কিন্তু একশো বছর আগেও তারা ছিল যাযাবর জাতি। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তাদের ছিল না নিজস্ব কোনো সৈন্যবাহিনী। তারপরও সামরিক শক্তির কোনো অভাব ছিল না। ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী তো পরোক্ষভাবে তাদেরই সামরিক শক্তি ছিল।

সমুদ্রের যেখানে ইহুদিদের সুরক্ষার প্রয়োজন হতো, সেখানেই তারা এই বাহিনীকে ব্যবহার করত। ইংল্যান্ডকে ব্যবহার করে তারা বিশ্বজুড়ে যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে, তার পেছনেও ছিল এ বাহিনীর বিশাল ভূমিকা।

১৯১৯ সালে অটোমানদের পরাজিত করে ব্রিটিশ জেনারেল অ্যাল্যানবি যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করে, এই সৈন্যবাহিনীর বিশাল একটি অংশ তখনও তার সাথে উপস্থিত ছিল। শুধু ব্রিটেন কেন, প্রয়োজন হলে তারা আরও অনেক দেশের সৈন্যবাহিনীকে মাঠে নামাতে সক্ষম। ইউরোপ-আমেরিকার এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নেই, যিনি তাদের অদৃশ্য ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত নন।

কয়েকশত বছর পূর্বে স্পেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও ইতালি পৃথিবীজুড়ে যে অসংখ্য ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল, তার সূর্যাস্ত বহু আগেই হয়েছে। আজ তারা নিজেরাই অন্তঃকোন্দলে ব্যস্ত। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খুব গোপনে এক নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। অতি সূক্ষ্ম উপায়ে এর কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ইজরাইলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এই অনুমানকে আরও প্রখর করে তুলছে। কারণ, বহু প্রতীক্ষিত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার[২৪] হয়তো সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠা পাবে।

‘ইহুদিরা যে পৃথিবীর সবচেয়ে বিতর্কিত জাতি, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে আজ পর্যন্ত আমরা নতুন অনেক স্থানে গিয়ে হাজির হয়েছি, যেখানে আমাদের নিয়ে পূর্বে কোনো বিতর্ক ছিল না। কিন্তু আমরা এতটাই অভাগা, সাধারণ মানুষের আক্রোশ কখনোই আমাদের পিছু ছাড়েনি। … ইংল্যান্ডে আজ যে অ্যান্টি- সেমিটিজম ছড়িয়ে পড়ছে, ইতোমধ্যে তা আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের উপস্থিতিই যেন সব বিতর্কের মূল কারণ।’ Theodore Herzl, ‘A Jewish State’ p. 4

*

১৬. প্রতি সপ্তাহের শনিবার হলো সাব্বাত। ইহুদিদের নিকট তা হলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

১৭. ইওম কিপুর-এটি ইহুদিদের নিকট বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন। দিন-রাত মিলিয়ে ২৫ ঘণ্টা রোজা রেখে তারা এই দিনটিকে পালন করে থাকে এবং সব পাপ কর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।

১৮. আল জুদান (Al Judan)— ইহুদিদের অদৃশ্য রাষ্ট্রের নাম। ধারণা করা হয়, Judah থেকে Judan শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে।

১৯. কাহাল (Qahal)— ইহুদিদের বিশেষ এক সমাজব্যবস্থা।

২০. সেনহাড্রিন (Sanhedrin) – আল জুদান রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট।

২১. মসিহ- ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মে তিনি ঈসা বা যীশুখ্রিষ্ট, কিন্তু ইহুদিরা যার জন্য অপেক্ষা করছে, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী সে হলো একচোখওয়ালা দাজ্জাল।

২২. মার্ক (Mark)- জার্মান মুদ্রার নাম

২৩. প্রলেতারিয়েট— কার্ল মার্ক্সের সংজ্ঞা অনুযায়ী নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে যারা শিল্প-কারখানাগুলোতে তাদের পরিশ্রম বিক্রি করে এবং নিম্ন আয়ের গোষ্ঠী হওয়ায় সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরে অবস্থান করে, তাদের প্রলেতারিয়েট বলে।

২৪. নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার (New World Order) – নতুন এক সমাজব্যবস্থা। এর বৈশিষ্ট্য হলো সকল ভৌগোলিক সীমারেখা উঠে গিয়ে পুরো পৃথিবী হবে একটি মাত্র দেশ এবং তাতে একটি মাত্র সরকার ও একক মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে। ল্যাটিন ভাষায় একে বলা হয় Novues Ordo Seclorun ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *