ইস্ট ইজ ইস্ট অ্যানড–
ইজরাএল (ইসরাইল) নিমিত্ত মাত্র। অর-রইস জমাল আবদুন নাসিরও নিমিত্ত মাত্র। দুজনের পিছনে রয়েছে দ্বিধা বসুন্ধরা–যাকে আমরা এতদিন প্রাচী তথা প্রতীচী নামে চিনেছি। ইংরেজ-ফরাসি গয়রহ বলেছে, অরিএনট এবং অকসিডেন্ট। জরমনরা এ দুটো শব্দ ব্যবহার করে বটে, কিন্তু খাঁটি জরমনে বলা হয় মরগেলান্ট (উদয়াচল) ও আবেনট্রলান্ট (অস্তাচল অবশ্য লানট = ভূমি, দেশ); আরবরা হুবহু ওইরকমই মশরি ও মগরিব (মগরিব(১) বলতে আবার দক্ষিণ আফরিকাকেও বোঝায়) বলে থাকে।
এই দুই ভূখণ্ড নিজেদের ভিতর প্রায় সম্মিলিত হয়ে একে অন্যের সম্মুখীন হয়েছে– যুদ্ধং দেহি।
এ লেখা বেরুবার পূর্বেই হয়তো উভয়পক্ষ অস্ত্রসংবরণ করে নেবেন। কিন্তু এর শেষ অতি অবশ্যই এখানে নয়। এ শুধু আরম্ভ মাত্র।
প্রতীচীর শক্তিশালী যুযুধান বলতে উপস্থিত বুঝি জনসন, উইলসন(২) ও দ্য গল। প্রাচীর ভীষ্ম-কর্ণ বলতে বুঝি কসিগিন-মাও।
ইজরাএলের পিছনে দাঁড়িয়েছেন মারকিন ও ইংরেজ। আরব রাষ্ট্রপুঞ্জের পশ্চাতে রুশ ও চীন।
দ্য গল ব্যত্যয়। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের মতো। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণেরই মতো তিনি একটা শান্তিসভার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন এবং সে প্রস্তাবের পশ্চাতে তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু কূট কসিগিন সঙ্গে সঙ্গেই অনুমান করে নিলেন যে ধড়িবাজ মারকিন ইংরেজ এই সভাটাকেই মুষলে পরিবর্তিত করে আরব বংশ ধ্বংস করতে চাইবে। তাই কসিগিন যা বললেন, যার ব্যঞ্জনা দিলেন, এবং যা বললেন না কিন্তু মিন করলেন তার সবকটা একুনে দাঁড়ায় : শান্তির প্রস্তাব তো উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু প্রশ্ন, তুমি জনসন, এবং উনি উইলসন যে দুটি আপন আপন খাসা নৌবহর ভূমধ্যসাগরে রোদ মারিয়ে ফেরাচ্ছ, দুনিয়ার সর্বত্র ছড়ানো বাদবাকিগুলোকে নোঙর ভেঙে ফেলে ফুল ইস্টিমে ওদিক-বাগে ধাওয়া করতে হুকুম দিচ্ছ (মুখে যদিও বলছ, ওরা তো চলাফেরা করছে কবেকার সেই ইস্যু করা প্রাচীন দিনের টাইম-টেবিল অনুযায়ী) তারা কি ওখানে আসছে ফেরেস্তাদের প্যাটারনে পিঠে ড্যানা গজিয়ে, হাতে হারপ যন্ত্র নিয়ে হাল্লেলুইয়া কীর্তনসহ যিশুদত্ত আপ্ত আপ্ত শান্তিসঙ্গীত গাইতে :
অগ্রসর হও আজি খ্রিস্টসেনাগণ।
সবে মিলি আইস–
থাক না, বাছারা, ওসব সন্-ডে ইস্কুলের মোলায়েম মোলায়েম মধুরসের মোরব্বা! আর সেই যদি কইছ, ভূমধ্যসাগরে, ইজরাএলের ধারে ধারে, মিশরের বন্দরে বন্দরে মানওয়ারিদের কোনওপ্রকারের ভালোমন্দ মতলব নেই তবে একটা সরল কর্ম করলেই তো হয়। বেচারি খালাসিমাল্লারাও লক্ষ-হস্ত তুলে তোমাদের আশীর্বাদ করবে আপন আপন দেশের বন্দরে দারাপুত্ৰপরিবারসহ সম্মিলিত হয়ে যাক না এরা ফিরে আন্ক স্যামের সোনার দেশে, ডিফেন্ডার-অব-ফেত-রুল-ব্রিটানিয়ার অক্ষয় স্বর্গে আহা! ন ইয়রক সাউত্যামটনে ফুল কত না অজস্র, আসব কত না সুলভ, আর ললনারা কতই না উন্মুক্ত হৃদয় (পাঠক, আমি শব্দার্থে বলছি না!– খেয়াল থাকে যেন লেখক)। শান্তি সম্মেলনে তো যাব, ওদিকে যারা তোমাদের দলে নয়, তাদের প্রত্যেকের পিছনে থাকবে ছোরা-হাতে একটি একটি করে মানওয়ারি গুণ্ডা (হিটলার রাইষটাগে এই ব্যবস্থা করাতেন গোড়ার দিকে, বিপক্ষ দল নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত)। ওই আনন্দেই থাক।
সরল পাঠক হয়তো এই বলে প্রশ্ন শুধোবেন, আমরা তো জানি, রুশরাও ইউরোপীয়, অকসিডেন্টাল, প্রতীচ্য জাত। আদৌ নয়। রুশ কেন, চেক-পোল ইত্যাদিকেও অনেকে ইয়োরোপীয় ইসটারন বলে থাকে। এই তো সেদিন জরমনির কষ্টাস্ শহরে এক সাহিত্য সম্মেলন হয় তাতে ইসটের প্রতিভূ হয়ে আসেন এক চেক, অন্যজনা পোল বা রাশান। আর হিটলার তো যুদ্ধ লড়তে লড়তে বরাবর চিৎকার করে গেছেন, এ সংগ্রামে এক পক্ষে সভ্য ঐতিহ্যশীল ইউরোপীয়, অন্যপক্ষে বর্বর ইসটারন– রুশ। মৃত্যুবরণের পূর্বে বলেন, আমি ছিলুম ইউরোপের শেষ আশা। কিন্তু সপ্রমাণ হল, প্রাচী আমার চেয়ে শক্তিশালী।
সরল পাঠককে বোঝাই, তারই মতো সরল–অবশ্য এদেশে বিরল-ইয়োরোপীয় মাত্রই একটি অতি বাস্তব, ধরা-ছোঁওয়ার জিনিস দিয়ে প্রতীচী-প্রাচীর তফাত করে। জামার সামনের দিকটা পাতলুনের ভিতর যে গুঁজে দেয় সে ইয়োরোপীয়, যে বাইরে ঝুলিয়ে রাখে সে প্রাচ্যদেশীয়। রুশরা যখন তাদের খাঁটি দিশি পোশাক–বাতুশকা, স্তালিন যা পরতেন–গায়ে চড়ায় তখন তাদের কারুকার্য করা শারটটি (ব্লাউজও বলা হয়) পাতলুনের উপরে ঝুলিয়ে দেয়, আমরা যেরকম পাঞ্জাবির সামনের দিকটা (দামন, অঞ্চল) ধুতির উপর ঝুলিয়ে রাখি। এখানে বুশ-শারটের রেজে দেত্র নিয়ে আলোচনা করাটা সমীচীন, কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে চলে যাব; তবে পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, উত্তম বুশ-শারটের দামন ভিতরে খুঁজে টাই পরা যায়, আবার বাইরে ঝুলিয়ে মি-টাই হওয়াও যায়।
মধ্যপ্রাচ্য উপলক্ষ মাত্র।
একদিকে জনসন-উইলসন চালিত ইয়োরোপ– লক্ষ করেছেন চ্যাংড়া ডেনমারক তক বাঁদরনাচ নেচে রুশের কাছে ধমক খেয়েছে?– অন্যদিকে রুশ-চীন চালিত এশিয়া, এবং আফরিকাও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে সাদা, অন্যদিকে কালো বা রঙিন বলতে পারেন। সাদার পাল এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে, ইউরোপের বাইরের সবাইকে কলরড় নাম দিয়ে কী থানডারিং ব্লানডারই না সে করছে! পিলা চীন, কালা নিগ্রো, তাঁবাটে আরব, আধা-পিলা রুশ (ইংরেজাদির দৃঢ় সংস্কার, রুশের গায়ে প্রধানত মনগোল-তাতার রক্ত) হয়েছে এক-জোট ওদিকে মার্কিন নিগ্রো মুহম্মদ আলী (কেসিয়াস ক্লে) বলছে, মারকিনের হয়ে লড়তে তার বিবেক-জাত ঘোরতর অধর্মবোধ রয়েছে–পিছনে রঙ-বেরঙের ভারতীয়-পাকিস্তানিও সায় দিয়ে মাথা নাড়ছে; এস্তেক যে, লেবানন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কারণ সে আধা ক্রিশ্চান আধা মুসলমান– যে কি না এতদিন সর্বসংঘাতে গা বাঁচিয়ে দেহ রক্ষা করেছে, সে-ও আব্দুন নাসিরের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু লক্ষ করার মতো দেশ, জাপান। পশ্চিমের দ্য গলের মতো ইনিও এতাবৎ নিরপেক্ষ। তা, এরকম দু-একটা ব্যত্যয় না থাকলে মাথাভরা চুলের প্রকৃত বাহার মালুম হয় না।
হাজার চার-পাঁচেক বছর পূর্বে ঠিক এই প্যাটারটিই ভারতবর্ষে রূপ নিয়েছিল যার প্রতি ইঙ্গিত, যার সঙ্গে বর্তমান সমস্যা– প্যাটারূনের তুলনা আমি এই ক্ষুদ্র লেখায় এতক্ষণ দিলুম : বিরাট দেশ ভারতবর্ষ, নানা বর্ণ(৪)–বিশুদ্ধ সংমিশ্রিত– নানা জাতি, নানা সভ্যতার লোক একদা কুরুক্ষেত্রে সমবেত হয়েছিল। একদিকে দুর্যোধনের পশুবল; অন্যদিকে ধর্মরাজের ধর্মবল।
আজ সেই প্যাটারনই বোনা হচ্ছে গোটা বিশ্বের নানারঙের সুতো নিয়ে।
হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ লাগবে না। কিন্তু সে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
তেইশ বছর পূর্বে তখন স্বরাজ হয়নি– আনন্দবাজারে আমি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করি– মারকিন-ইংরেজের এই বে-আদপি বেতমিজিকে ধবলদম্ভ নাম দিয়ে। ইংরেজ যেরকম একটা চীনকে পীতাতঙ্ক (ইয়েলো পেরিল) নামে ডাকত, আজ বিশ্বজুড়ে তারই পুনরাবির্ভাব।
হাজার পাঁচেক বছর পূর্বে হয় মহাভারত; আজ না হোক, দু-দিন বাদে হবে বিশ্বভারত।
———–
১. বাঙলা গরিব শব্দ ও মগরিব মূলে একই ধাতু থেকে। গরিব আরবিতে বিচিত্র অদ্ভুত অর্থ ধরে।
২. একদা এদেশে বলা হতো বাঙালির জাত মারছে তিন সেন-এর মিলে। উইলসেন-এর হোটেলে বাঙালি খেত নিষিদ্ধ মাংস, কেশব সেন তাদের করে ফেলত বেম্মজ্ঞেনী, আর ইস্টিসেনে বাহান্ন জাত-বেজাতের সঙ্গে মেলামেশা এড়ানো যেত না। এখন পৃথিবীর জাত মারার জন্য এসেছেন অন্য তিন সেন। মার্কিন জনসেন, ইংরেজ উইলসেন এবং কানাডার পিয়ারসেন। তৃতীয়োক্ত ব্যক্তিটি নিতান্তই চুনোপুঁটি। কিন্তু স্বয়ং জনসেন মুক্তকচ্ছ হয়ে এঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এঁকে বেজাতে তুলেছেন, কিংবা বলব এর জাত মেরেছেন।
৩. মধ্য বা পশ্চিম ইয়োরোপে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেরুলে একাধিক সজ্জন আপনার কানে কানে ফিসফিস করে বলবে, স্যার! শার্টটা খুঁজতে ভুলে গিয়েছেন। তার মনে হয়েছে, আপনি শৌচাগারে প্রয়োজনীয় কর্মটি করার পর দামনটি খুঁজতে ভুলে গেছেন– বুড়া অধ্যাপকরা যেরকম ক্ষুদ্রতর কর্মের পর পাতলুনের বোতাম লাগাতে ভুলে যান।
৪. অনেকের বিশ্বাস, কৃষ্ণের যদুবংশ ছিল কালো, কৌরবেরা ছিলেন গোরা, আর পাণ্ডবরা ছিলেন পাণ্ডু, অর্থাৎ পিলা, হলদে। পাণ্ডবরা নাকি আসলে তিব্বতের মঙ্গোলীয়ান। (Winternitz পশ্য। এ বাদ বা বিবাদে যোগ দেবার শাস্ত্রাধিকার আমার নেই।) মহাভারতের যুদ্ধ নাকি কৃষ্ণ-পাণ্ডু বনাম গোরা-কৌরব।