ইস্কাপন-বিবির কাঁটা

ইস্কাপন-বিবির কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

রচনাকাল : প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি 2001

প্রচ্ছদশিল্পী : বিজন কর্মকার

উৎসর্গ : শ্রীমতী পাপড়ি কুণ্ডু ও শ্রীবাসব নারায়ণ কুণ্ডু

এক

তিন দিন টানা বৃষ্টিতে কলকাতা ভেসে যাবার উপক্রম। আজও মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা থামবে না। বাড়ি ছেড়ে কেউ বের হতে পারবে না। আজও ভোর রাত থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বাসু-সাহেবের প্রাতভ্রমণ তাই আজ বন্ধ। বিশে বাজার যেতে পারেনি। গেলেও লাভ ছিল না কিছু। বাজার বসেইনি। ফুট্‌কি তাই আজ খিচুড়ির আয়োজন করেছে। আলুভাজা, পাঁপরভাজা আর অমলেট।

ওঁদের প্রাতরাশ সদ্য সমাপ্ত। কাগজগুলোও নাড়াচাড়া করা শেষ হয়েছে। রানুদেবী আসন্ন শীতের জন্য এখনি একটা প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাঁর হাতে নিটিং-কাঁটা। নাতনির জন্য একটা উলের সোয়েটার বুনে চলেছেন। বাসু-সাহেবের হাতে একটা ইংরেজি থ্রিলার। কৌশিক কাগজে খেলার পাতাটা শেষ করে বলে ওঠে, এমন বর্ষার দিনে একটা জমাটি গল্প শোনান মামু। রাখুন তো আপনার বইটা।

বাসু একটা পেজ-মার্ক দিয়ে বইটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। বলেন, কিসের গল্প এমন বর্ষার দিনে জমবে তা আগে বল? প্রেমের না ভূতের?

সুজাতা বলে, না না। ও দুটোর একটাও নয়। আপনার কোনো পুরানো কেস হিস্ট্রি। অনেক-অনেক দিন আগেকার একটা সত্য ঘটনা। যা এই বৃষ্টিভেজা দিনে স্মৃতির উজানপথে আপনাকে একবারে প্র্যাকটিসের প্রথম যুগে নিয়ে যাবে। আমরাও সেই হারিয়ে যাওয়া অতীতটা আস্বাদন করতে পারব। এমন একটা ‘কেস’ যা আমাদের অজানা। আর আপনার নিজস্ব স্টাইলে হঠাৎ গল্প থামিয়ে একসময় বলে বসবেন : বল এবার, কে—কেন খুনটা করেছে?

কৌশিক বলে ওঠে, আমার একটা সাজেশান আছে। মানে, সুজাতার প্রস্তাবটার একটা সামান্য মডিফিকেশন।

বাসু জানতে চান, সেটা কী জাতীয়?

—হাইকোর্ট পাড়ায় একটা গুজব চালু আছে শুনেছি যে, আপনি কখনো কোনো খুনের মামলায় হারেননি। এ কথাটা কি সত্যি?

বাসুর হাত পকেটে চলে গেল—তামাক-পাউচের খোঁজে। পাউচ থেকে তামাক বার করতে করতে বললেন, না, সত্যি নয়। একটি মাত্র কেসের কথা মনে পড়ছে যেখানে আমার টেক্‌নিকাল ডিফীট হয়নি, মর‍্যাল ডিফীট হয়েছিল।

কৌশিক বলে, অত প্যাঁচালো ভাষা বুঝি না। সোজা কথায় বলুন, আপনি যে আসামীটার কেস নিয়ে লড়েছিলেন সে আদৌ ‘গিটি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল কি? ফাঁসির দড়ি থেকেই ঝুলুক অথবা জেল-জরিমানা?

—না, তা অবশ্য মনে পড়ে না। আমি এ পর্যন্ত যেসব মক্কেলের কেস নিয়ে লড়েছি—আই মীন খুনের মামলায়, তারা কেউই সাজা পায়নি। সবাই বেকসুর খালাস হয়েছিল।

—তাহলে আপনার মর‍্যাল ডিফীট হলো কী করে?

—সেটাই তো বোঝাতে চাইছিলাম। তুমি রাজি হলে না। বললে, তুমি নাকি প্যাঁচালো- ভাষা বোঝ না!

সুজাতা আগ বাড়িয়ে বলে, ও-কেসটা আমাদের জানা! আপনি একদিন বলেছিলেন সবিস্তারে।

বাসু-সাহেব একটু অবাক হয়ে বলেন, আমি বলেছিলাম? কই মনে পড়ছে না তো?

—হ্যাঁ, একেবারে প্রথম দিনই।

—প্রথম দিন! মানে? কিসের প্রথম দিন?

—আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়ের। মনে পড়ছে?

বাসু পাঁচ-সেকেন্ড চোখ বুজে স্মৃতিচারণ করলেন। তারপর বলে ওঠেন, ও ইয়েস! এতক্ষণে মনে পড়েছে। বিপুলের ড্রইংরুমে। সেই তোমরা বসে রিহার্সাল দিচ্ছিলে—

কৌশিক বলে, আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না নিশ্চয়। আমার আদৌ সে কেসটা মনে পড়ছে না। আমাকে অন্তত শোনান। মামীও নিশ্চয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

রানু এতক্ষণে আলোচনায় যোগ দেন। বলেন, না, আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম না ঠিকই, তবে কেসটা আমার জানা। তোমাদের মামা কেস জিতে এমন মনমরা কখনো হয়নি। আর তোমারও তো তা অজানা থাকার কথা নয়, কৌশিক। সে-ঘটনার কথা তো তুমি তোমার কাঁটা-সিরিজের ‘ট্রায়াল’ বলে লিখেওছো—নাগচম্পায়।

কৌশিক বলে, এটা হতেই পারে না। লিখলে আমার নিশ্চয় মনে থাকত। বিপুলবাবুর বৈঠকখানায় যখন রিহার্সাল চলছে, আমি তখন বাইরে বসেছিলাম। আমি তো তখন সুজাতার ড্রাইভার। সুতরাং আমি কেসটা শুনিনি। লিখিওনি।

রানু বলেন, তখন শোননি, পরে নিশ্চয় শুনেছিলে। কারণ নাগচম্পা যখন সিনেমা হয় তখন আমি তা দেখেছিলাম। কী নাম হয়েছিল মনে নেই।

সুজাতা বলে, আমার মনে আছে। রূপালী পর্দায় নাগচম্পা হয়ে যায় যদি জানতেম।

—হ্যাঁ, যদি জানতেম। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘটনাটা।

কৌশিক বলে, তাহলে সেটা আমার লেখা নয়, যিনি ক্রিপ্ট লিখেছেন তিনি ঢুকিয়েছেন মোট কথা সে কেস-হিস্ট্রিটা আমার মনে নেই। বলুন, মামু, কেস জিতেও কেন আপনি মনমরা হয়ে পড়লেন?

বাসু বললেন, বিস্তারিত বলব না। কারণ তোমার পাঠক-পাঠিকার স্মরণক্ষমতা তোমার স্মৃতিশক্তির চেয়ে বেশি। তাই সংক্ষেপে বলছি :

একবার এক সদ্যবিধবা তাঁর ভাই এবং পুত্রবধূকে সঙ্গে করে আমার চেম্বারে এসে হাজির। বিরাট জামিদারের বিধবা। স্বামী খুন হয়েছেন সপ্তাহ-খানেক আগে। তখনো শ্রাদ্ধশান্তি মেটেনি! আর পুলিসে অশৌচ অবস্থায় ধরে নিয়ে গেছে তাঁর একমাত্র পুত্রকেই—বাপ্‌কে খুন করার চার্জে। মৃত ভদ্রলোকের একটি বন্দুকের লাইসেন্স ছিল। তাতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। ঘটনাচক্রে ওঁর ছেলেটি জড়িয়ে পড়েছে। কারণ বৃদ্ধ খুন হয়েছিলেন দ্বিতলে তাঁর শয়নকক্ষে। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ ছাড়া ছিল কিছু চাকর-বাকর শ্রেণীর লোক। রাত তখন এগারোটা। বন্দুকের শব্দ শুনে সবাই দ্বিতলে ছুটে আসে। সে সময় ঘরে পিতাপুত্র ছাড়া আর কেউ ছিল বলে প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ঠাকুর-চাকরেরা তাদের জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে, কর্তাবাবুর সঙ্গে ছোটকর্তার কী নিয়ে যেন কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। বিধবার বক্তব্য : তাঁর পুত্র এমন কাজ করতেই পারে না। করার কোনও হেতুও সত্যই নেই। ওঁদের একমাত্র পুত্রটিই তাঁর মৃত স্বামীর ওয়ারিশ। সে কেন বাপকে খুন করবে?

কৌশিক জানতে চায়, আসামীর কী বক্তব্য? তার কোনো অ্যালেবাঈ ছিল?

—না, ছিল না। সে স্বীকার করেছিল যে, দুর্ঘটনার সময় সে ঘরের ভিতর ছিল। কিন্তু তার জবানবন্দি অনুসারে সে তার বাবার ঘরে ঢোকার আগেই কেউ একজন অচেনা লোক তাঁর শয়নকক্ষে উপস্থিত ছিল। ও নিজে ঘরে ঢোকার আগেই লোকটা আলমারির পিছনে আত্মগোপন করে। ও কথাও সে স্বীকার করেছে যে, বাপের সঙ্গে তার একটা কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। মনোমালিন্যের হেতুটা কী, তা সে সবিস্তারে জানিয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট, মৃতের স্ত্রী এবং পুত্রবধূর জবানবন্দি থেকেও তথ্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাপারটা সামান্য : ছেলেটি সস্ত্রীক দেশ দেখার অছিলায় বিলাত বেড়াতে যেতে চাইছিল—তার বাবা তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। ওদের অর্থের অভাব নেই। জমিদারের একমাত্র পুত্র যদি সস্ত্রীক বিদেশভ্রমণে কয়েক লক্ষ টাকা ওড়ায় তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু জমিদারমশাই এই অহৈতুকী অর্থব্যয়ে স্বীকৃত হচ্ছিলেন না। হঠাৎ আলমারির ওপাশ থেকে কেউ ফায়ার করে। বৃদ্ধ বুকে গুলির আঘাত খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। ছেলে বাপের দিকেই ছুটে আসে। কিন্তু সে টের পায় আলমারির ওপাশ থেকে আত্মগোপনকারী আততায়ী বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে যায়। লোকটাকে সে দেখেছে। মাঝবয়সী একজন পুরুষ। খেটো ধুতি পরা, গায়ে তার কালো আলোয়ান জড়ানো ছিল। যেহেতু পিছন থেকে দেখেছে, তাই তার দৈহিক বর্ণনা সে প্রায় কিছুই দিতে পারেনি। লোকটার পিছনে ধাওয়া না করে সে বাপের দিকে এগিয়ে আসে।

কৌশিক জানতে চায়, আর কেউ তাকে দেখেনি?

–দেখেছে। বাড়ির দারোয়ান। রাত এগারোটার সময় সে বাগানের গেটে বল্লম হাতে পাহারা দিচ্ছিল। জমিদারমশায়ের শোবার ঘর থেকে বন্দুকের শব্দ শুনে সে ছুটে আসে। সদর দরজা খোলাই ছিল। সিঁড়ি দিয়ে সে উপরে উঠে আসে। বড়কর্তার ঘরে ঢুকে দেখে গৃহস্বামী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। মেজের অনেকটা অংশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ছোট- সাহেব ঝুঁকে পড়ে বড়কর্তার নাড়িটা দেখছেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে কাউকে দেখতে পায়নি। বাড়ির আর সবাই তখন একতলায়। দারোয়ানের চিৎকারে সবাই হুড়মুড়িয়ে দ্বিতলে উঠে আসে। দারোয়ানের লক্ষ্য হয় যে, সাহেবের বাথরুমের দরজাটা খোলা। সে চট করে সে ঘরে ঢুকে দেখে যে, বাথরুমের পিছন দিকে যে ম্যাথর-খাটার স্পাইরাল সিঁড়িটা আছে সেটা বেয়ে একজন বেগানা লোক খুব তাড়াতাড়ি নেমে পালাচ্ছে। দারোয়ান চিৎকার করে ওঠে, ‘রুখ যাও!’ লোকটা শোনে না। স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নামতে থাকে। লোকটার মুখ সে দেখতে পায়নি; কিন্তু তার পরনে ছিল ধুতি, গায়ে কালো চাদর জড়ানো। দারোয়ান ছুটে চলে আসে ঘরের ভিতরে। বন্দুকটা তুলে নেয়। আবার স্নানঘরে ফিরে এসে পিছনের দরজা দিয়ে দেখে লোকটা ততক্ষণে বাগানটা পার হয়ে গেছে। বাগানের পিছন দিকের পাঁচিল টপকাচ্ছে। বন্দুকটা ছিল ড-ব্যারেল থ্রি-নট-থ্রি—শিকারের বন্দুক। তাতে দ্বিতীয় একটা টোটা ভরাই ছিল। দারোয়ান তৎক্ষণাৎ ফায়ার করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। খুনীটা পাঁচিল টপকিয়ে ওদিকের রাস্তায় লাফিয়ে নামে। এই হলো মোটামুটি কেস। তা বিধবার সনির্বন্ধ অনুরোধে আমি কেসটা নিয়েছিলাম। হাজতে গিয়ে আসামীর সঙ্গে দেখা করি। সে ওই একই কথা বলে যায়। তার মা যে-কথা বলেছিল। প্রসিকিউশান জমিদারপুত্রকে অ্যারেস্ট করেছিল বটে কিন্তু হত্যার কোনো মোটিভ দেখাতে পারেনি।

কৌশিক আবার প্রশ্ন করে, দ্বিতীয়বার ফায়ারিঙের শব্দ বাড়ির অন্য কেউ শুনেছিল?

—হ্যাঁ, সদ্যবিধবা এবং পুত্রবধূ দুজনেই তাঁদের সাক্ষ্যে সেকথা স্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, বিধবা তাঁর এজাহারে বলেন যে, তিনি যখন একতলা থেকে উঠে এসে ঘরে ঢুকছেন, তখন দেখতে পান দারোয়ান মোহন থাপা বন্দুকটা উঁচিয়ে নিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তখনো তিনি জানেন না, ঘরের ভিতরে কী কাণ্ড হয়েছে। হঠাৎ দেখতে পেয়ে, তিনি তাঁর মৃতস্বামীর দিকেই ছুটে আসেন—কিন্তু বাথরুমের ভিতর দ্বিতীয়বার একটা ফায়ারিঙের শব্দ তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলেন। আসামীর স্ত্রী অকুস্থলে পৌঁছেছিল আরও মিনিট খানেক পরে। সে নিচে রান্নাঘর থেকে প্রথমবারের ফায়ারিঙের শব্দ শোনে। দারোয়ানের চিৎকারও শোনে। শাশুড়িকে ছুটে দোতলায় উঠতে দেখে। তারপর কোনো কিছু বুঝতে না পেরে সেও ছুটে যায়। সে যখন সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এ তখন দ্বিতীয়বার একটা ফায়ারিঙের শব্দ শোনে। অথচ বাড়ির ঠাকুর-চাকর এবং ঝি ঠিকমতো বলতে পারেনি যে, তারা পর পর দুটো ফায়ারিঙের শব্দ শুনেছে।…পুলিস এসে পৌঁছায় ঘণ্টাখানেক পরে। জমিদারমশাই তার অনেক আগেই মারা গেছেন। পুলিস সকলের জবানবন্দি নেয়। পুলিশী তদন্তে দেখা যায়—বন্দুকে শুধু দারোয়ানের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে, আসামীর নেই। দ্বিতীয় কোনও আঙুলের ছাপ—অর্থাৎ আততায়ীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। তবে দারোয়ান-নির্দিষ্ট স্থানে পাঁচিলে একটা গুলি আবিষ্কৃত হয়। নিঃসন্দেহে সেটা ওই বন্দুক থেকে নিক্ষিপ্ত বুলেট!

কৌশিক আবার জানতে চায়, পুলিশ অন্য কোনও সম্ভাব্য খুনীকে চিহ্নিত করতে পারেনি?

—না। তবে জমিদারমশাই ছিলেন অত্যাচারী। অনেকের ভিটে-মাটি উচ্ছেদ করেছেন। তাঁর অসংখ্য শত্রু ছিল। পাশের জমিদারের সঙ্গে জমিজমা সংক্রান্ত তাঁর একটা বিরাট মামলা বহুদিন ধরেই চলছিল। লোয়ার কোর্টে হেরে সে মামলা তখন হাইকোর্টে। ওই প্রতিবেশী জমিদারটি ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। তাঁর কুকীর্তিও পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু তিনি কোনো প্রফেশনাল মার্ডারারকে নিযুক্ত করেছেন এমন তথ্যও প্রমাণ করা যায়নি। নিহত জমিদারমশাই- এর চরিত্র ভালো ছিল না, একথা আগেই বলেছি। তাঁর একটি বাগানবাড়ি ছিল। তাতে একজন রক্ষিতাও থাকত। মাঝে মাঝে জমিদারমশাই সেই বাগানবাড়িতে রাত কাটাতে যেতেন। প্রত্যহ সন্ধ্যায় প্রচুর মদ্যপানও করতেন। বাড়িতে এবং বাগানবাড়িতে। বেশ কিছু সন্দেহজনক চরিত্রের ইয়ারদোস্তও ছিল তাঁর।

—শেষ পর্যন্ত আসামী বেকসুর খালাস হয়ে গেল?

—তা গেল।

—তাহলে আপনার ‘মরাল-ডিফীট টা হলো কীভাবে?

কেস ডিমিস্ হবার পরে। মামলা-জিতে, ছেলেটি এক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে আমার ফী মেটাতে এল। কিন্তু আমার নায্য ফী-টা আমি নিতে পারলাম না, কৌশিক!

—কেন?

—আনন্দের উচ্ছ্বাসে সে আমার কাছে রুদ্ধদ্বার কক্ষে আদ্যোপান্ত স্বীকার করে বসল : খুনটা সে নিজে হাতেই করেছে। বাপকে! দারোয়ান মোহন থাপাকে সে মোটা বক্‌শিশ দিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বাধ্য করেছিল। ওর মা এবং স্ত্রীও সজ্ঞানে আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে গেছেন!

—কিন্তু কেন? হত্যার উদ্দেশ্যটা কী?

—ওর বাবা মত্তাবস্থায় পুত্রবধূর শ্লীলতাহানি করেছিলেন। ওর মায়ের সামনেই। সেই ব্যাপারেই বাপের সঙ্গে একটা ফয়শালা করতে গিয়েছিল সে। ‘উত্তেজনার মুহূর্তে সে বন্দুকটা তুলে নিয়ে নিজের হাতে বাপকে গুলি করে!

মিনিট-খানেক কেউ কথা বলতে পারে না। বাসুই বলেন, আমি তিন-চার দিন এমন অশান্তির ভিতর কাটিয়েছি যে, বলার নয়। আসামী আমার ক্লায়েন্ট। সে আমার কাছে যে স্বীকারোক্তি করেছে তা “প্রিভিলেজড্-কমুনিকেশান’। যদিও সেটা আমি জানতে পারি কেস জিতে যাবার পরে। শেষ পর্যন্ত আমি আমার সিনিয়ারের কাছে সবটা খুলে বলি—

—আপনার ‘সিনিয়ার’ মানে ব্যারিস্টার এ. কে. রে?

—হ্যাঁ, তখনো তিনি রিটায়ার করেননি। তাঁর কাছে পরামর্শ চাই—এখন আমার কী করা উচিত। তিনি সংক্ষেপে বলেছিলেন, নাথিং। হোয়াট কান্ট বি কিওর্ড মাস্ট বি এন্ডিয়োর্ড!

রানী বলেন, মনে আছে আমার, সে দিনগুলোর কথা। তোমাদের মামুর প্রায় সাতদিন লেগেছিল ধাক্কাটা সামলে উঠতে।

সুজাতা বলে, এত বিস্তারিত নয়, তবে এ গল্পটা আপনি সেদিন বলেছিলেন—সেই আমাদের রিহার্সালের ঘরে। সেটা তুমি ‘নাগচম্পায়’ লিখেও ছিলে, কৌশিক।

কৌশিক দৃঢ় প্রতিবাদ করে, হতেই পারে না। বই খুলে দেখাও।

সুজাতা বলে, তা সে যাই হোক। এটা আমাদের জানা গল্প। আর তাছাড়া আমি তো এ জাতীয় কেস শুনতে চাইনি। আমি শুনতে চাইছিলাম—আপনার জীবনে এমন কোনো কেস হয়েছে কি না, যেখানে আপনি জ্ঞাতসারে প্রকৃত অপরাধীকে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়েছেন। খুনীকে চিহ্নিত করেও পুলিশে জানাননি।

—এ কেসটা তো তাই।

—না! টেক্‌নিক্যালি নয়। এ কেসে আপনি অপরাধীকে শনাক্ত করেছেন মামলা শেষ হয়ে যাবার পর। সে বেকসুর খালাস হয়ে যাবার পরে। দ্বিতীয়ত এ-কেসটা তো আপনি নিজে ডিটেক্ট করেননি। কেস মিটে যাবার পর আসামী আপনাকে নিজেই জানিয়েছিল। আমি জানতে চাই, এমন কেস কি কখনো হয়েছে যে, মামলা মিটে যাবার আগেই আপনি খুনীকে শনাক্ত করেছেন, অথচ তাকে ধরিয়ে দেননি।

—না! সেটা এথিক্যালি সম্ভবপর নয়। অ্যাজ অ্যান অফিসার অব দ্য হাইকোর্ট সেটা আমি পারি না।

রানী বলেন, এথিক্স-টেথিক্স বুঝি না; কিন্তু অমন কাণ্ডও তুমি একাধিকবার করেছ।

—একাধিকবার? কী বলছ রানু?

রানু নিটিং-কাঁটা তাঁর কোলে নামিয়ে রাখেন। বলেন, একটু আগে তুমিই বলেছিলে না যে, কাঁটা-সিরিজের পাঠক-পাঠিকার স্মৃতিশক্তি কৌশিকের চেয়ে বেশি। তা আমি বাপু ওই পাঠক-পাঠিকার দলে। আমি অনেক কিছু পারি না। তার মধ্যে একটা হচ্ছে : অতীতকে ভুলতেও পারি না। তুমি রবিকে অপরাধী জেনেও পুলিশে ধরিয়ে দাওনি। মনে পড়ে?

—রবি? কোন রবি?

—ঘড়ির কাঁটার রবি। লটারি-জেতা ইন্সপেক্টার রবি। যে-কেসের শেষে তুমি বলেছিলে, “কারণ রবি জানে যে, আমি জানি যে, রবি জানে যে, আমি জানি।” কী স্যার? মনে পড়েছে?

বাসু লজ্জা পেয়ে বলেন, ওটা একটা একসেপশান!

কৌশিক বলে, কিন্তু মামী যে বললেন, একাধিক কেস?

রানী বলেন, হ্যাঁ। আরও একটা কেস-এর কথা আমার মনে আছে। সেটা অনেক- অনেকদিন আগেকার কথা। ইন ফ্যাক্ট তখনো আমাদের বিয়েই হয়নি। কেসটা সে হিসেবে আমার কাছে ‘হেয়ার-সে’। তোমাদের মামার কাছেই শোনা। এমনি এক বাদলা দিনে।

বাসু অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, নো, আই ডোন্ট রিমেম্বার!

—বাট আই ডু!— নিটিং-এর কাঁটা দুটো তুলে নিয়ে বললেন রানু।

–কোন কেস? একটু ব্লু দাও?

—সেই ইস্কাপনের বিবির নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া?

আস্তে আস্তে যেন বিস্মৃতির একটা যবনিকা সরে গেল ওঁর চোখের সামনে থেকে। হেসে বললেন, আ-ইয়েস! নাউ আই রিমেম্বার! ইস্কাপনের বিবির কাঁটা!

সুজাতা, কৌশিক দুজনে একযোগে আক্রমণ করে বসে, তাহলে সেই গল্পটাই বলুন, মামু!

বাসুর পাইপটা নিভে গিয়েছিল। আবার সেটা ধরিয়ে নেন।

এদিকে বৃষ্টিটাও ঝেঁপে নামল আবার।

দুই

সেটা সম্ভবত প্রাক-স্বাধীনতা যুগের কথা। না, ভুল হলো—ভারত তখন সদ্য স্বাধীন। মহাত্মাজি যেবার শহিদ হয়ে যান! বাসু সবে ফিরে এসেছেন বিলেত থেকে। ব্যারিস্টারি পাশ করে। রে-সাহেবের জুনিয়ার হিসাবে সবে কাজ শুরু করেছেন। রানী দেবীর সঙ্গে তখনো তাঁর আলাপই হয়নি।

রে-সাহেবের চেম্বারটা ছিল ধর্মতলায়। তিনি সে-আমলে কলকাতা ‘বার’-এর সবচেয়ে পশার-ওয়ালা ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার। রে-সাহেবের চেম্বারে চারখানি ঘর। গর্ভগৃহে রে- সাহেবের চেম্বার। তার সংলগ্ন ল-লাইব্রেরি। সামনের দিকে ল-অফিস। চার-পাঁচজন জুনিয়ার সেখানে কাজ করেন। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছেন ওই তরুণ বয়ষ্ক ব্যারিস্টার : প্রসন্নকুমার। একপাশে স্টেনো-টাইপিস্ট ক্রমাগত টাইপ করে চলে। ডাক পড়লে ভিতরে যায় ডিকটেশন নিতে। একেবারে সামনের দিকে রিসেপশন রুম’ বা প্রতীক্ষাগার। মক্কেলরা সেখানে অপেক্ষা করে। একে একে তাদের ডাক পড়ে ভিতরে।

রে-সাহেব কেস-হিস্ট্রি শোনেন। মক্কেলের ভিড় দেখলে কখনো বা জুনিয়ারদের মধ্যে মক্কেলদের বন্টন করে দেন। তারাই জবানবন্দি নেয়। সুবিধামতো রে-সাহেবের কাছে খাতাপত্র দাখিল করে।

একদিন সকালে রে-সাহেবের সঙ্গে রে-সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন একজন সুদর্শন যুবাপুরুষ।দেখলেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। পরনে থ্রি-পিস্ গ্রে রঙের স্যুট। বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্রিশ। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। গোঁফদাড়ি কামানো।

মুহুরিবাবুকে একটা আইভরি-ফিনিশড ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, তিনি ব্যারিস্টার- সাহেবের সাক্ষাৎপ্রার্থী। মুহুরিবাবু তাঁকে বসিয়ে রেখে ভিতরে খবর দিতে গেল। একটু পরেই রে-সাহেবের খাস-বেয়ারা এসে তাঁকে ভিতরে ডেকে নিয়ে যায়। প্রসন্নকুমার দেখলেন, ভদ্রলোক খুবই বিচলিত। তাঁর হাতে একটা পোর্টম্যান্টো ব্যাগ।

একটু পরেই রে-সাহেবের পিয়ন এসে ওঁকে ডেকে নিয়ে গেল। উনি ভিতরে যেতেই রে- সাহেব বললেন, বস। এঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এঁর নাম মিস্টার সুরেশচন্দ্র চৌধুরী। ইনি একটা মার্ডার-কেস-এ আমাকে এনগেজ করতে চান।

কথা বলতে বলতে রে-সাহেব সেই আইভরি-ফিনিশ ভিজিটিং কার্ডখানা বাড়িয়ে ধরেন বাসু-সাহেবের দিকে। বাসু একনজর দেখে নিয়ে সেটা টেবিলে নামিয়ে রেখে দিলেন।

রে-সাহেব তাঁর চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, মিস্টার চৌধুরী, এ আমার জুনিয়ার, পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল। নাউ স্টার্ট টকিং। বলুন কেস-হিস্ট্রিটা।

সুরেশচন্দ্র নড়ে-চড়ে বসলেন। ইতস্তত করে বললেন, স্যার, কেসটা আমার তরফে নিতান্ত কনফিডেন্‌শিয়াল। আমি শুধু আপনাকেই তা জানাতে এসেছি।

রে-সাহেব তাঁর পাইপটা ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনার এ প্রশ্নের জবাব তো আগেই দিয়েছি, মিস্টার চৌধুরী। ইনি আমার জুনিয়ার, আমার অ্যাসিস্টেন্ট। আমাকে যা বলবেন, তা আমি ওকে বলতে বাধ্য হব। আমার হয়ে সে নিজেই কেসটার প্রাথমিক তদন্ত করবে। আমাকে যা বলবেন, তা ওর সামনেই বলতে হবে।

তবু আগন্তুক নীরব হয়ে নখ খুঁটতে থাকেন।

রে-সাহেব ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেন, আমাকে এনগেজ করলে আমার শর্তেই তা করতে হবে। আপনার তাতে আপত্তি থাকলে, আয়াম সরি। অন্য কোনো লীগ্যাল অ্যাডভাইসারের সন্ধানে আপনাকে উদ্যোগী হতে হবে।

সুরেশচন্দ্র মনস্থির করে বললেন, না স্যার। পারলে আপনিই আমাকে বাঁচাতে পারবেন। বেশ, আমি আপনাদের দুজনের সামনেই সব কথা খুলে বলব। কিন্তু কথা দিন, আমার সব কথা শোনার পর যদি আপনি কেসটা না নেন, তাহলে আমার এসব কথা গোপন থাকবে? রে-সাহেব একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আপনার বোধহয় ইতিপূর্বে কোনো ল-ইয়ারের সঙ্গে কারবার করার দুর্ভাগ্য হয়নি। তাই নয়?

—আজ্ঞে।

—আপনি যে-কথা বললেন তা তো রুডিমেন্টারি লীগ্যাল এথিক্স। আপনার কেস আমি নিই বা নিই, কেস-হিস্ট্রি যদি আমি শুনি তবে সেটা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। এ বিষয়ে নতুন করে প্রতিশ্রুতি দেবার কী আছে? আইদার স্টেট য়োর কেস অর কুইট!

রে-সাহেবের ছিল এই রকম কাটা-কাটা কথা। শুনলে প্রথমে মনে হতো ভদ্রলোক খুব রূঢ়। বাস্তবে তিনি ফালতু কথা একদম বরদাস্ত করতেন না। ক্ষুরধার বুদ্ধির মাটির মানুষ তিনি।

সুরেশচন্দ্র বোধহয় সেটা প্রণিধান করলেন। তাঁর কেসটা সবিস্তারে বলতে শুরু করেন :

খুন হয়েছেন একজন প্রৌঢ় জমিদার : জনার্দন জানা। বর্ধমানের জমিদার। হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছে দিন-দুয়েক আগে। জনার্দনের নিজের বাগানবাড়িতে। সন্ধারাত্রে। ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন শশিমুখী দেবী নামে এক ভদ্রমহিলা,—যাঁর তরফে সুরেশচন্দ্র রে-সাহেবকে অগ্রিম- রিটেইন করতে চান।

রে-সাহেব বিবৃতিতে বাধা দিয়ে বলেন, ওই শশিমুখী দেবীটি আপনার কে হন?

সুরেশচন্দ্র একটু রাঙিয়ে উঠে বললেন, আজ্ঞে না, আমার কেউ হন না। জাস্ট পরিচিত…

—অ! তাহলে তাঁর তরফে হঠাৎ এভাবে পড়ি-তো-মরি করে আমার কাছে ছুটে এসেছেন কেন?

—বাঃ! একটি অসহায় যুবতী —

—যুবতী? অবিবাহিতা?

—আজ্ঞে।

—বয়স কত হবে? ষোলো থেকে আঠারো?

—আজ্ঞে না। আমার চেয়ে বছর-পাঁচেকের ছোট হতে পারে। তার একজ্যাক্ট বয়সটা আমার জানা নেই। আন্দাজে বলছি।

—আপনার একজ্যাক্ট বয়সও আমার জানা নেই। আন্দাজে বলছি, বছর ত্রিশেক? আন্দাজটা মোটামুটি সঠিক হলে শশিমুখীর বয়স বর্তমানে পঁচিশ! কেমন?

—তাই হবে মনে হয়

রে-সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। বলেন, দেখুন মশাই। ঝেড়ে কাশতে যে অসমর্থ তার ‘কেস’ আমি নিই না। আপনি মনস্থির করুন : আমাকেই রিটেইন করতে চান তো?

—না হলে এই বিপদে এভাবে আপনার কাছে ছুটে আসব কেন?

—আরে মশাই, সেটাই তো আমার জিজ্ঞাস্য! যেভাবে আপনি আমার কাছে ছুটে এসেছেন তা থেকে ডিডিয়ুস করছি যে, শশিমুখী দেবী একটি সুন্দরী মহিলা, আপনি তাকে ভালোবাসেন এবং সে রাজি হলে তাকে বিবাহ করতেও সম্মত। তা সে-কথা যদি আমার কাছে খোলাখুলি স্বীকার করতে না পারেন তা হলে আমি কীভাবে কেসটা হাতে নিই?

সুরেশচন্দ্র অধোবদন হলেন। আবার দু-একটি মুহূর্ত চিন্তা করে নিয়ে বললেন, আমি কি সেসব কথা অস্বীকার করেছি?

—করেননি। কিন্তু আপনি তো ‘উইটেহস্ ফর দ্য প্রসিকিউশন’ নন যে, ক্রমাগত আপনার পেটে খোঁচা মেরে মেরে আমাকে প্রকৃত তথ্যটা জেনে নিতে হবে। তা বেশ, ওই শশিমুখীর সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ? সে কি আপনার ‘প্রপোজাল’ অ্যাকসেপ্ট করছে না? না করলে কেন করছে না? আপত্তিটা কার? শশিমুখী না তার অভিভাবকের?

আবার বিহ্বল হয়ে সুরেশচন্দ্র বলে ওঠেন, মার্ডার কেসের সঙ্গে এসব প্রশ্ন কি রেলিভেন্ট? রে-সাহেব স্পষ্টই বিরক্ত। বললেন, কিছু মনে করবেন না সুরেশবাবু। আপনি কাইন্ডলি আমার এই তরুণ বয়স্ক শাগরেদটির সঙ্গে পাশের লাইব্রেরিরুমে চলে যান। আমি লোকটা বড়ই অধৈর্য। এভাবে খোঁচা মেরে মেরে ক্লায়েন্টের বক্তব্য শোনা আমার ধাতে নেই। তার চেয়ে এই ভালো। ও আপনার কাছে কেস-হিস্ট্রিটা প্রথমে শুনবে। তারপর ওর মুখ থেকে আমি বরং সেটা শুনে নেব। যথেষ্ট আকর্ষণীয় মনে হলে কেসটা আমি নেব, শশিমুখীকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করব। সে-ক্ষেত্রে আমি আপনার রিটেইনার গ্রহণ করব, তবে শশিমুখীর তরফে।

সুরেশ বলেন, সে তো একই কথা।

—আজ্ঞে না। মোটেই এক কথা নয়। আমি টাকাটা নিচ্ছি আপনার কাছে থেকে— শশিমুখীর তরফে। অর্থাৎ আমার ক্লায়েন্ট হবে শশিমুখী, আপনি নন। বুঝেছেন? আর সবটা ইতিহাস শুনে যদি আমার মনে হয় শশিমুখীই বাস্তবে অপরাধী, অথবা যদি মনে হয় কেসটা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং নয়, তাহলে আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করব না। সেক্ষেত্রে হান্ড্রেড নয়, টু-হান্ড্রেড-পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে রাখছি যে, আপনার প্রেমকাহিনী এই চার-দেয়ালের বাইরে যাবে না। অ্যাম আই ক্লিয়ার?

সুরেশচন্দ্র বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তাতেই রাজি। আমি শশির তরফে আপনাকে এমপ্লয় করব।

—অর্থাৎ কেসটা যদি আপনার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে আমি শশিমুখীকেই রক্ষা করব। আপনাকে নয়, কেমন তো?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! আমি ওই খুন-জখমের ধারে-কাছে নেই!

—ভেরি গুড। এবার তাহলে ওর সঙ্গে পাশের ঘরে চলে যান। প্রসন্ন তুমি ওঁকে লাইব্রেরি-রুমে নিয়ে যাও। চা-টা খাওয়াও। কেস-হিস্ট্রিটা বিস্তারিত শোন। কাল সকালে না- হয় আমাকে সবটা জানিও।

বাসু অবাক হয়ে বলে ওঠেন, কাল সকালে, স্যার?

—আমার তাই অনুমান। একটা দিন আর একটা রাত তোমার কেটে যাবে মিস্টার চৌধুরীর পেটে ক্রমাগত বোমা মেরে গোটা কেসটা উদ্ধার করতে। তুমি তো জানই, ক্লায়েন্টের বিষয়ে সব কথা না জেনে আমি কোনো কেস হাতে নিই না। সো প্লিজ এক্সকিউজ মি, মিস্টার চৌধুরী। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে ওঁকে জবানবন্দিটা দিয়ে ফেলুন। আমি বরং দেখি, নেক্সট ক্লায়েন্ট কে আছে—

তিন

সুরেশচন্দ্র নিজে না হলেও তাঁর পিতৃদেব আচার্য জগদানন্দ চৌধুরী একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন একনিষ্ঠ নেতা। তাঁর পিতামহ ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন নামী স্টিভাডোর। জাহাজের ব্যবসায়ে অগাধ সম্পত্তি সঞ্চয় করে যান। সে সম্পত্তির পরিমাণ এত বেশি যে, তাঁর অধস্তন তিন পুরুষ ঘোড়ার খুরে খুরে অথবা ‘ম’-কারান্ত মালের বেসাতি করে তা শেষ করতে পারতেন না। জগদানন্দের পিতৃদেব সে চেষ্টা করেওছিলেন। অশ্বখুরে এবং মকারান্ত অন্যান্য দ্রব্যের নিত্য ব্যবহারে অল্পবয়সেই লিভারটি পচিয়ে ফেলেন। তাঁর বিধবা স্ত্রী—জগদানন্দের জননী কিন্তু ছিলেন অদ্ভুত দৃঢ়চেতা মহিলা। ব্রাহ্মসমাজের আলোকপ্রাপ্তা। সে আমলের বেথুনে-পড়া গ্র্যাজুয়েট। অকালবৈধব্যে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েননি। দুই পক্ষপুটে একমাত্র সন্তানটিকে ব্রাহ্মসমাজের কঠোরতার মধ্যে মানুষ করে তোলেন। জগদানন্দ ইতিহাস এবং দর্শনে দু’-দুবার ফার্স্ট-ক্লাস পেয়ে এম.এ পাশ করেন। স্যার আশুতোষের স্নেহধন্য হয়ে পড়েন। প্রথম জীবনে অধ্যাপনা করতেন। শেষ জীবনে কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে ওঠেন। তাঁরও একটিমাত্র সন্তান, ওই সুরেশচন্দ্র। সে কিন্তু পিতামহের রক্তের প্রভাবেই পড়ে যায়। উচ্ছন্নে যায়নি অবশ্য; কিন্তু পড়াশুনায় তার মন ছিল না। কোনোক্রমে পাস কোর্সে বি.এ. ডিগ্রিটা নিয়ে সে ব্যবসার দিকে ঝুঁকল। জগদানন্দের ঘোরতর আপত্তি ছিল। ব্যবসায়ি-বৃত্তিটার জন্য নয়, তার প্রকারভেদে। সুরেশচন্দ্র ছায়াছবির জগতে নাক গলালেন।

সে আমলে নিউ-থিয়েটার্স-এর দারুণ রমরমা। প্রমথেশ, সাইগল তখন বাজার গরম করে আছেন। সঙ্গীতজগতে এইচ. এম. ভি একচ্ছত্র অধিপতি। সেখানেও পঙ্কজ মল্লিক, সাইগল, লালচাঁদ বড়াল, কানাকেষ্টর কদর। সুরেশচন্দ্র অবশ্য অভিনেতা বা সঙ্গীতকেশরী হতে চাননি। চেয়েছিলেন প্রডিউসার হতে। পরিচালনাও নয়। প্রযোজনা।

জগদানন্দের ঘোরতর আপত্তি ধোপে টিকল না। তার মূল হেতু : জগদানন্দের জননী তাঁর একমাত্র নাতিটির জন্য একগোছা কোম্পানির কাগজ রেখে সাধনোচিত ধামে প্রয়াতা হয়েছিলেন। সুরেশ তারই জোরে নামল সিনেমার ব্যবসায়।

পিতাপূত্রে মতান্তর হলো। ক্রমে মনান্তর। সুরেশচন্দ্র টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় একটা বাসাবাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছিলেন। জগদানন্দ তাঁকে ত্যাজ্যপত্র করেননি স্ত্রীর মুখ চেয়ে—কিন্তু সেদিন থেকে তাঁর একমাত্র পুত্রটির আর মুখদর্শনও করতেন না।

এ-হেন সুরেশচন্দ্র একদিন পঙ্কের মাঝখানে আবিষ্কার করে বসলেন একটি শতদল পদ্ম : শশিমুখী!

সে তখন এক বাইজির হেপাজতে কন্যার মতো পালিত হচ্ছিল। বাগবাজারে এক ধনীবঙ্কুর বাড়িতে গানের জলসায় চারচক্ষুর প্রথম মিলন। সে আজ আট বছর আগেকার কথা। শশিমুখী তখন সপ্তদশী। সুরেশচন্দ্রের বয়স বাইশ। কলেজ থেকে সদ্য-পাশ। তখনো সে ব্যবসায় নামেনি। শশিমুখীর গান শুনে একেবারে বাওরা হয়ে গেল সুরেশ। তার যাতায়াত শুরু হলো বাইজির আস্তানায়। একান্ত নিষ্ঠায় কী না হয়? ক্রমে একদিন আলাপ হলো মেয়েটির সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ আলাপ নয়। বাইজি এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক।

মাস ছয়েকের ঘোরাঘুরি করার পর সুরেশচন্দ্র বাইজির কাছে প্রস্তাব রাখল : সে শশিমুখীর একটি লঙ-প্লেইং রেকর্ড বানাতে চায়। এইচ. এম. ভি. থেকেই। যাবতীয় খরচ-খরচা সে মিটাবে। বাইজি কস্তুরীবাঈ প্রৌঢ়া। লক্ষ্ণৌ ঘরানার। তবে এখন কলকাতারই পাকাপাকি বাসিন্দা। অনেক ঘাটে জল খেয়েছে সে। বড়লোকের বাড়ির এইসব কাপ্তেনবাবুদের চিনতে তার বাকি নেই। বছর ঘুরে গেল কস্তুরীবাঈয়ের বিশ্বাস উৎপাদন করতে। বাইজি সমঝে নিল—বাবুটির কোনো বেলেল্লাপনা নেই, কোনো কুমতলবও নেই। সত্যিই সে ওর পালিতা কন্যার কিছু গান রেকর্ড করতে চায়। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল বাইজি।

ওরা দুজনেই যে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, এটা অভিজ্ঞ বাইজির নজর এড়ায়নি, কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারেনি যে, বাবুজি তার পালিতা কন্যাকে বিবাহ করতে উদ্‌গ্রীব! রক্ষিতা হিসাবে পুষতে নয়। বাইজিবাড়ি বিবাহ করা সে যুগে ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

শশিমুখীর রেকর্ড বার হলো। কিন্তু বাজারে কাটল না। খালি-গলায় তার স্বর যতটা সুমিষ্ট লাগে, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাকে বন্দী করলে সে মিষ্টতা আর থাকে না। কী আশ্চর্যের কথা! সে আমলে আঙুরবালা, কাননদেবীকে ছাপিয়ে শশিমুখী বাজার দখল করতে পারল না।

ইতিমধ্যে পিতাপুত্রে বিচ্ছেদ হয়েছে। সুরেশচন্দ্র বাসাবাড়ি ভাড়া করে টালিগঞ্জে উঠে এসেছে।

এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা বছর। সুরেশ সিনেমাপাড়ায় ঘোরাঘুরি করে। অনেক শিল্পী, ক্যামেরাম্যান, টেকনিশিয়ানের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। দোস্তি হয়েছে। কিন্তু জুতসই একটা ফিল্ম বানাবার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারছিল না। অর্থের অভাবে নয়। কাহিনীও সে চয়ন করেছে। কিন্তু জুতসই একটি নায়িকা যোগাড় করতে পারছে না। কাননবালা, চন্দ্রমুখী আর উমাশশী পুরোপুরি নিউ থিয়েটার্সের কব্জায়। সুরেশ নতুন মুখ খুঁজছিল। এই সময়ে ওর বঙ্কু বিশু প্রামাণিক একদিন বৃদ্ধি যোগাল। বললে, শশিমুখীকে দিয়ে হয় না?

সুরেশ চমকে ওঠে। বলে, শশী? কিন্তু তার গান তো ভালো রেকর্ডিং হলো না?

–গান নিয়ে কি ধুয়ে খাবি, সুরেশ? চন্দ্রমুখী কি গান গায়? আমি তো সিনেমায় অভিনয়ের কথা বলছি। ছবিতে গান থাকলে কাউকে দিয়ে প্লেব্যাকও করানো যাবে।

—কিন্তু ক্যামেরাতেও যদি ওর ছবি ভালো না আসে? রেকর্ডিং যন্ত্রের মতো?

–আরে বাবা, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর মুখটা ফটোজিনিক। হাতে-পাঁজি-মঙ্গলবার। তুই চেষ্টা করে দেখ না একবার।

বিশু প্রামাণিক ক্যামেরাম্যান। তার নিজস্ব একটা ছোট ষোলো-এম. এম ক্যামেরাও আছে। কথাটা মনে ধরল সুরেশের। প্রস্তাবটা সে প্রথমে তুলল শশীর কাছে। শশী দারুণ উৎসাহিত হলো, কিন্তু তার আশঙ্কা হলো : দিদি হয়তো রাজি হবে না।

দিদি বলতে কস্তুরীবাঈ—বাঈজি—যার কাছে ও মানুষ।

সুরেশ বঙ্কুবর বিশ্বনাথের বয়ানটাই শুনিয়ে দিল শশীকে, আরে বাপু, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

চেষ্টা করা হলো। কস্তুরীবাঈ রাজি হলো না। বললে, নেহি বাবুজি! ম্যায়নে শুনি হায়, পিক্‌চারলাইন বহুত খতরনাখ্

সুরেশ সকাল-সন্ধ্যে কস্তুরীকে তোয়াজ করতে থাকে : . আজকাল ভদ্রঘরের ছেলেমেয়েরাও সিনেমায় নামছে। তাদের প্রচুর উপার্জন। তাদের গ্ল্যামারও ঈর্ষার যোগ্য। শশিমুখীর ছবি যদি একবার ‘হিট করে যায়, তাহলে তার আর চিন্তার কিছু থাকবে না। বাকি জীবনের মতো হিল্লে হয়ে যাবে।

শেষমেশ রাজি হয়ে গেল বাইজি। সুরেশ বললে, তাহলে আমার বঙ্কু বিশু প্রামাণিককে নিয়ে আসব। প্রথমে পাঁচ-সাতটা ফটো তুলতে হবে, ফটো দেখে অভিজ্ঞ ব্যক্তি বলতে পারবেন সিনেমায় শশীর মুখখানা কেমন দেখাবে।

কস্তুরী আপত্তি করল না; কিন্তু আপত্তি করল বিশু। বলে, অনেক সময় ফটো দেখে ঠিক বোঝা যায় না রে। ফটো দেখে তুই ওকে হযতো নায়িকার পার্ট দিলি, তারপর সেলুলয়েডে দেখা গেল মুখের সে মাধুর্য আর নেই। কিন্তু ততদিনে তোর তো বেশ কয়েক হাজার টাকা গলে গেছে। এ ধাষ্টামো করিস না, সুরো।

সুরেশ প্রতিবাদ করে, ধাষ্টামো মানে? তুইই তো প্রথম প্রস্তাবটা তুলেছিলে। বলেছিলি, ফটো দেখে বোঝা যাবে ওর চেহারা ‘ফটোজিনিক’ কি না।

বিশু বলে, তুই আমার কথাটা বুঝতে পারছিস না। শোন, আমার তো একটা ছোট সিক্সটিন এম. এম ক্যামেরা আছে। তুই শশীমুখীকে আউট-ডোরে নিয়ে আয়। আমি বিশ পঞ্চাশ ফুট ‘মুভি’ তুলি। সামনে থেকে, পাশ থেকে, বসে, দাঁড়িয়ে, চলন্ত অবস্থায়। তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে ওর ফিল্ম উত্তাবে কি না। সেই ফিল্ম দেখিয়ে তোর পার্টনারকে কনভিন্স করা সহজ হবে।

সুরেশ রাজি হলো। ইতিমধ্যে সে আর এক ধনীর দুলালকে তাতিয়ে একটা যৌথ- প্রযোজনার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

এবার বিশুকে নিয়ে সুরেশ এল কস্তুরীর কাছে। সব কথা খুলে বলল। শশীও তার দিদিকে খুব পীড়াপাড়ি শুরু করল। কস্তুরী বলে, ঠিক হ্যায়। আপনারা ছাদে গিয়ে পিকটার তুলুন।

বিশু বলে, ছাদে সুবিধা হবে না। আশেপাশের বাড়ি থেকে ডিসটার্ব করবে। এত ঘিঞ্জি এলাকায় ওসব হয় না। আমরা ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে ছবি তুলব। সকালে যাব, সন্ধ্যায় ফিরে আসব।

কস্তুরী জানতে চায়, কিসে যাবেন?

—সুরেশের একটা মরিস্ মাইনার গাড়ি আছে। তাতেই যাব আমরা তিনজনে। সুরেশ আর আমি, আমরা দুজনেই ড্রাইভ করতে জানি। একটি দিনের তো মামলা, সকালে যাব, সন্ধ্যায় ফিরে আসব।

—গ্যাসবাতি জ্বলে ওঠার আগেই তো?

— গ্যাসবাতি? ও হ্যাঁ, রাস্তায় বাতি জ্বলে ওঠার আগেই।

—ঠিক আছে। কিন্তু তিনজনে নয়, আপনারা চারজন যাবেন। রুক্‌মনীকেও আমি সঙ্গে পাঠাব। সে বেচারিও তো বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ পায় না। যাক, একটু হাওয়া খেয়ে আসুক।

সুরেশ বুঝতে পারে ভিতরের কথাটা। রুকমিনীর জন্য বাইজির প্রাণ কাঁদছে না। সে শশিমুখীকে একলা-একলা ওদের দুজনের সঙ্গে পাঠাতে সাহস পাচ্ছে না। রুক্‌মিনী মধ্যবয়সী, যদিও দেখলে মনে হয় তরুণী। সে সঙ্গে থাকলে বাইজি কিছু ভরসা পায়। দুজন পুরুষের সঙ্গে একা শশীকে পাঠানো ঠিক নয়।

পরের সপ্তাহেই ওরা চারজন রওনা হলো ক্যামেরা নিয়ে। ডায়মন্ডহারবারের দূরত্ব বেশি নয়। মাইল পঞ্চাশ। তবে সেখানে দোকানপাট কী আছে জানা নেই। তাই বড় টিফিনক্যারিয়ারে পরোটা-গোস্-সবজি আর মিঠাই দিয়ে দিল কস্তুরী।

মুক্ত-প্রকৃতির একটা আলাদা মোহ-বিস্তারের ক্ষমতা আছে। বেহালা-অঞ্চল ছাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়েই গাড়ির গতিবৃদ্ধি করে দিল সুরেশ। দু-ধারে ধানক্ষেত। রাস্তার পাশে পাশে বড় গাছ। শিরিষ, পাকুড়, অশ্বথ, আর রেন-ট্রী। মাঝে মাঝে দু-পাশের গাছ রাস্তা টপকিয়ে যেন পরস্পরকে ছুঁতে চায়। সেখানে, দূর থেকে মনে হয়, কে যেন ওদের বরণ করতে গাছ- গাছালির তোরণ বানিয়ে রেখেছে।

শশী খালি গলায় গান ধরল। রুক্মিনীও যোগ দিল তার সঙ্গে। বাইজির কাছে মানুষ, গান-না-জানা অপরাধ।

বিশু অ্যাটাচি-কেসটা টেনে নিয়ে সানন্দে সঙ্গত করতে শুরু করল।

রুক্‌মিনী বললে, বাবুজি! আপ্‌কো ঠেকা বঙ্কু কিজিয়ে। বহু বিলকুল গল‍ হ্যয়।

সুরেশ অট্টহাসে ফেটে পড়ে।

বিশু থেমে যায়। অস্ফুটে বলে, আয়াম সরি!

ডায়মন্ডহারবারে ছোট-ক্যামেরায় শশিমুখীর নানান নড়াচড়া, শোয়া-বসার ছবি ওঠানো হলো—দূর থেকে, সেমি-ক্লোজআপ, ক্লোজআপ। স্থির ক্যামেরাতেও অনেক ছবি নেওয়া হলো। রুক্মিনীর ফটো তোলার প্রয়োজন ছিল না, তবে সে বেচারির ফটো তো কেউ তোলে না। তাই বিশু তারও কিছু স্টিল ফটো তুলে নিল। রুক্‌মিনী কৃতজ্ঞ হলো বিশুর প্রতি।

সন্ধ্যায় ওরা ফিরে এল ডায়মন্ডহারবার থেকে।

সেদিনই নির্জনতার সুযোগে সুরেশ শশিমুখী সম্বন্ধে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে ফেলে। তার বালিকা জীবনের কথা, কৈশোরের ইতিকথা—

এইখানে সুরেশের জবাবন্দিতে বাধা দিয়ে প্রসন্নকুমার প্রশ্ন করেছিলেন, নির্জনতার সুযোগ মানে? আপনারা তো ছিলেন চারজন। শশিমুখী তার বাল্যকৈশোরের কথা হড় হড় করে বিশুবাবুর সামনে বলে গেল?

—না, না! ছবি ওঠানোর পরও আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল। রুক্মিনী আর বিশু নদীর ধার ধরে-ধরে অনেকটা দূরে চলে গেছিল। আমরা দুজন তখন গঙ্গার ধারে একেবারে নির্জনে বসেছিলাম।

বাসু-সাহেব বললেন, এই জায়গাটা আর একটু বিস্তারিত করে বলুন তো সুরেশবাবু। আপনি হঠাতই ওকে জিজ্ঞেস করে বসলেন : তোমার ছেলেবেলার গল্প বল?

—না! মানে….ঠিক হঠাৎ নয়। একেবারে নির্জন মুহূর্তে মানুষের মনের দরজা তো খুলে যায়। সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমি। ও একটু অভিভূতও হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে। ওর মানসিক বিহ্বলতাটা কাটাতে আমি ওর বাল্য-কৈশোরের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম।

—জাস্ট আ মিনিট। আপনি প্রথমে বললেন, ‘একেবারে নির্জন মুহূর্তে মানুষের মনের দরজা খুলে যায়।’ তারপর নাকি আপনি একটা ‘সুযোগ’ নিয়েছিলেন। এবং তারপর বললেন, ‘মেয়েটি অভিভূত হয়ে পড়ে, নেতিয়ে পড়ে—’ তাই নয়?

—আজ্ঞে হাঁ, তাই তো বলেছি।

—কিন্তু কার্য-কারণ সম্পর্কটা খুলে বলছেন না কেন?

—কার্য-কারণ সম্পর্ক মানে?

—কী আশ্চর্য! শশী হঠাৎ কেন ‘নেতিয়ে’ পড়ল? আপনি নির্জনতার কী ‘সুযোগ’ নিয়েছিলেন? শশিমুখী কেন অভিভূত হয়ে পড়ে?—এইসব কার্য-কারণ সম্পর্ক? সুরেশচন্দ্র রুখে ওঠে; আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন বলুন তো মশাই?

—বলছি। আমি জানতে চাইছি একেবারে নির্জন মুহূর্তের সুযোগে আপনি কি শশীমুখীর মুখচুম্বন করেছিলেন? জীবনে প্রথম? আর তাতেই কি সে অভিভূত হয়ে নেতিয়ে পড়ে?

কোথাও কিছু নেই সুরেশ উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনার কৌতূহলের একটা সীমা থাকবে তো মিস্টার বাসু? এর সঙ্গে মার্ডার-কেস-এর কী সম্পর্ক?

বাসু বলেন, গুরুর মতো আমারও ধৈর্যটা কম। আমার যা জিজ্ঞাস্য আছে তা আমাকে জেনে নিতে হবে। আপনার আপত্তি থাকলে আমি বরং চলে যাই। আমাদের স্টেনোগ্রাফারকে পাঠিয়ে দিই। সে কোনো প্রশ্ন করবে না। তার অসীম ধৈর্য। কৌতূহল বিন্দুমাত্র নেই। না হয় হপ্তাখানেক ধরে ধীরে ধীরে আপনি আপনার জবানবন্দিটা দেবেন! স্যার বলেছিলেন, ‘একদিন’, আমার মনে হচ্ছে পুরো এক হপ্তা লাগবে!

সুরেশ স্থিরদৃষ্টিতে বাসু-সাহেবের দিকে সেকেন্ড-বিশেক তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলে বসে, অলরাইট স্যার! আই কনফেস! আই কিড হার। অ্যান্ড ইয়েস, ফর দ্য ফার্স্ট টাইম ইন আওয়ার লাইভস্!

—থ্যাঙ্কু স্যার। প্লীজ প্রসীড। শশীদেবী তার বাল্য-শৈশবের কথা কী জানালো?

শশীমুখীর জন্ম রেঙুনে। বর্মা মুলুকে। যুদ্ধের হাঙ্গামায় বর্মার প্রবাসী ভারতীয়রা— বাঙালীই বেশি—হাঁটাপথে বর্মা থেকে কলকাতা ফিরে আসেন। শশী তার বাবা আর মায়ের সঙ্গে—ও ছিল তাদের একমাত্র সন্তান—সেই দুর্গম অরণ্যপথে রেঙুন থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসে। পথে নানান কষ্ট, নানান বিপর্যয়। তার মধ্যে একরাত্রে ওদের উদ্‌বাস্তু শিবিরে বর্মী-ডাকাতের দল হানা দেয়। টাকা-পয়সা, হাতঘড়ি, মেয়েদের অলঙ্কার সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। সে রাত্রেই ওর বাবা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, আর মা—তখন তাঁর বয়স হবে ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ—ডাকাতেরা তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। শশী তখন নিতান্ত বালিকা—ফ্রক পরে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে দেখে সে শুয়ে আছে একটা আশ্রয় শিবিরে। হাতফিরি হতে হতে ওই অনাথা মেয়েটি তারপর কস্তুরী বাঈয়ের ছত্রছায়ার আশ্রয় পায়। কস্তুরীও রেঙন থেকে পালিয়ে আসছিল। শশীকে সে মানুষ করে তোলে। গান শেখায়। শশী গায়িকা হয়ে ওঠে। প্রথমে ওরা ছিল লক্ষ্ণৌতে। তারপর উত্তর কলকাতার এক সঙ্গীতপ্রিয় ধনী ব্যক্তির বাঁধা বাইজি হিসাবে কস্তুরী পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসে। রুক্মিনী আর শশিমুখীও আসে তার সঙ্গে। সে আজ বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। ইতিমধ্যে কস্তুরী বাইজি কলকাতার ঠুংরি আর গজলের বাজারে বেশ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে।

এই হলো ওর বাল্য-কৈশোরের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

সে-যাই হোক, ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে ছবি তোলার ঘটনা বেশি দিন আগেকার নয়। ইতিমধ্যে বিশু প্রামাণিক পরীক্ষা করে দেখেছে যে, শশীমুখীর চেহারা ‘ফটোজিনিক’। নায়িকার চরিত্রে তার সাফল্য কামনা করা যেতে পারে। সুরেশের পার্টনার রাজি। সব ব্যবস্থাপনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন সুরেশচন্দ্র একদিন বেমক্কা শশিমুখীকে বিবাহ করার প্রস্তাব তুলে বসে।

আবারও বাধা দিয়ে বাসু বলেন, কার কাছে? প্রথমে কে? শশিমুখী না কস্তুরী?

আবার রুখে ওঠে সুরেশ : আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! আপনি মার্ডার কেস শুনতে চান, না কি ‘সুরেশ-শশী’ প্রেমকাহিনী নিয়ে একটা বাঙলা-ফিল্ম বানাতে চান?

পি. কে. বাসু জবাব দিলেন না। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ক্লায়েন্টের দিকে। সুরেশচন্দ্রই শেষমেষ অধৈর্য হয়ে বলে ওঠে, অলরাইট, অলরাইট স্যার! আমি প্রথমে শশীকেই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, সে রাজি থাকলে ফিল্মে নামার আগেই আমি তাকে রেজিস্ট্রি মতে বিবাহ করতে চাই। বাড়িতে না জানিয়ে, গোপনে। আর ও হ্যাঁ, ইতিমধ্যে আমি হয়তো বার পঞ্চাশ তার মুখচুম্বন করেছি। তবে একসঙ্গে কখনো রাত কাটাইনি, এক বিছানায় শুইনি। আর য়ু স্যাটিসফায়েড?

—থ্যাঙ্কু সার। এবার আপনি জানা-মশায়ের প্রসঙ্গে আসতে পারেন।

—জানা! জানা-মশাইটা কে?

—কী আশ্চর্য! জানাকে অজানা মনে হচ্ছে? জনার্দন জানার মার্ডার কেস-এই তো আপনি স্যারের কাছে এসেছেন?

—ও হ্যাঁ। জনার্দন জানা! দ্যাট বাস্টার্ড অব আ জমিন্দার!

চার

সমস্ত বৃত্তান্তটা শুনে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল বাইজি।

বলে, সচ বাৎ? শশীকে সাদি করে নিয়ে যাবেন আপনি? রখেলি নয়?

সুরেশ অবাক হয়ে বলেছিল, ‘রখেলি’! রখেলি কাকে বলে?

—ওই যাকে বাঙ্গালিবাবুরা বলে কি ‘রক্ষিতা’। বড়লোকের পোষা ময়না সোনার দাঁড়ে শিকল পরিয়ে যাকে বাগানবাড়িতে রাখা হয়, শুনেননি?

সুরেশ দৃঢ় প্রতিবাদ করেছিল, এসব কী বলছেন আপনি? আমি ওকে প্রথমে রেজিস্ট্রি মতে বিবাহ করব। তারপর আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব কালীঘাটের মন্দিরে। আপনার সমুখেই আমি ওর সিঁথিতে সিঁদুর দেব, হাতে নোয়া-শাঁখা পরাব। শশী রাজি আছে, আপনি অনুমতি দিলেই—

আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল প্রৌঢ়া বাইজি। সুরেশের হাত দুটি ধরে বলেছিল, শিউজি আপনার ভালো করবেন বাবুজি। লেকিন, আপনি খানদানি ঘরের ছেলে। আপনার পিতাজি- মাতাজি ওকে ঘরে নিবেন তো?

—তা আমি জানি না, দিদি।

—”দিদি’! দিদি ডাকলেন আমাকে?

—আপনি অনুমতি দিলে তাই বলেই তো ডাকতে হবে বাকি জীবন। শশী আপনাকে ‘দিদি’ বলে না?.

বাইজি চোখে আঁচল দিল। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলে, আপনি ওর বদনসিবীর সব কথা জানেন? ও হতভাগী কি আপনাকে সব কথা বলতে পেরেছে?

—সব কথা নয়। তবে অনেক কিছুই বলেছে। ওর জন্ম রেঙুনে। বার্মা ইভ্যাকুয়েশনের সময় ওদের ছাউনিতে বর্মী ডাকাত হানা দেয়। ওর পিতাজি মারা যান, মাতাজিও…

—জী হ্যাঁ, সচ বাৎ! আমি ছিলাম সেখানেই। ডাকাত পড়েছে শুনে জঙ্গলের ভিতর সারারাত সিঁটিয়ে বসেছিলাম। সকালবেলা আজাদ-হিন্দ ফৌজদের পুকার শুনে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসি। শশী তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

—কত বয়স হবে তখন ওর?

—কত আর হবে? দশ-বারা! তখন সে ফ্রক পরে। সেই তখন থেকেই ও আমার কাছে মানুষ। ওকে লক্ষ্ণৌ নিয়ে গেলাম। গানা শিখালাম। তারপর আমরা চলে এলাম কলকাত্তায়।

—ওর বাপের নাম, বা পরিচয় শশী আমাকে বলেনি। আপনি জানেন?

—জানতাম ভাইসাব। লেকিন এতদিন পরে তা আর য়্যাদ নেই। সে-কথা তো ওকে বারবার জিজ্ঞাসা করা যায় না। সে কিস্সার কথা উঠলেই ও কান্না শুরু করে দেয়। সেই বদনসিবীর দিনগুলো তো ও ভুলে থাকতে চায়, না? তবে ওর পিতাজির নাম ছিল ‘মুখার্জি- সাব’। পুরো নামটা আমার ইয়াদ নেই; রেঙুনে একটা কাঠ-চেরাই কারখানার ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ঘবওয়ালী আর ওই চুন্নিমুন্নি লেড়কি ছাড়া তাঁর আর কেউ ছিল না।

—শশী তাহলে বামুনের মেয়ে? ধর্মে হিন্দু?

—হ্যাঁ, ভাইসাব। বিলকুল হিন্দু! মুখার্জি-সার বরামভন ছিলেন বৈকি।

—তাহলে আপনি অনুমতি দিচ্ছেন তো, দিদি?

—না হলে তোমাকে ‘ভাইসাব’ বলে ডাকব কেন সুরেশ? এতদিন তো ‘বাবুজি’ বলে ডেকেছি, সুরেশবাবু বলে বাৎচিৎ করেছি।

—তাহলে কবে বিয়ের এন্তাজাম করব আপনিই বলুন?

—শুন ভাইসাব! সাত রোজ তোমাকে রুখে যেতে হবে। সাদির আগে শশীকে একটা জবর কাম করতে হবে। ওই যাকে তোমরা ‘প্রায়শ্চিত্ত’ বল। ওকে একবার ‘বরধোমান’ যেতে হবে।

—বর্ধমান! কেন বর্ধমানে যেতে হবে কেন?

—এটা ওর বদনসিবীর খোয়াড়! তোমাকে সব কথাই খুলে বলব সুরেশভাই। ও তোমার ঘরওয়ালী হতে চলেছে। তাই এত কথা বলছি। না হলে বলতাম না। এই সাত রোজ তুমি শশীর সঙ্গে দেখা করবে না। ও ‘বরধোমান’ থেকে ওয়াপস্ এলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের সাদি দেব।

—বেশ, আমি তাতেই রাজি। ওকে কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমাকে খুলে বলুন। কস্তুরীবাঈ সব কথা ওকে খুলে বলেছিল।

প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। ওরা তখন লক্ষ্ণৌতে থাকত। শশিমুখী তখন পঞ্চদশী। লক্ষ্ণৌয়ে বিভিন্ন মুজরোয় কস্তুরীবাঈ শশীকে নিয়ে যেত। ওই বয়সেই দারুণ সুনাম হয়েছিল শশীর। কৈশোর অতিক্রমণে সে তখন সদ্য প্রস্ফুটিতা পঞ্চদশী। ওই সময় এক আসরে শশীকে দেখে এক বাঙালী রহিস্ আদমী একেবারে মোহিত হয়ে যান। তিনি ওকে ‘রখেল’ করার প্রস্তাব দেন। সেই বাবুজি বরধোমানের একজন জমিন্দার। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর দু- দুটি বিবি। অনেকগুলি বাল-বাচ্চা। তবু উনি শশীকে কিনে নিতে চাইলেন। সে সময় কস্তুরীবাঈয়ের একটা অর্থনৈতিক দুর্যোগ চলছিল। কস্তুরীবাঈ জনান্তিকে সব কথা খুলে বলেছিল শশিমুখীকে। শশী অনেক কেঁদেছিল; কিন্তু সে বুঝমান মেয়ে। বলেছিল, দিদি, আমাকে তুমি খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করেছ। তুমি শুধু আমার দিদি নও, তুমি আমার মা। কিন্তু এতদিনে আমি দুনিয়াদারির অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছি। কোনো খানদানি ঘর তো দূরের কথা—কোনো সংশের গৃহস্থও তাঁর লেড়কার সঙ্গে আমার সাদি দিতে রাজি হবেন না। এটাই আমার নিয়তি। সর্বজনভোগ্যা বাজারের বেশ্যা হয়ে বাকি জীবন কাটানোর চেয়ে ওই বাবুজির ‘রখেল’ হয়ে থাকাই তো আমার পক্ষে ভাল! অন্তত প্রতি রাত্রে অজানা অচেনা কামার্ত রাক্ষসকে তো শান্ত করার বদনসিবী থেকে রক্ষা পেলাম। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি রাজি হয়ে যাও!

নগদ পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে জমিদারমশাই লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। বলে এসেছিলেন, একটা বাসাবাড়ি বা বাগানবাড়ির এন্তাজাম করে উনি এসে শশিমুখীকে নিয়ে যাবেন। মাসখানেকের মধ্যে। কোথায় মাসখানেক? বছর ঘুরে গেল। বাবুজির পাত্তা নেই। তারপর এল তাঁর পূর্জা। কী একটা জমিদারী সংক্রান্ত মামলায় জানামশাই কেঁসে গিয়েছিলেন। সেজন্যই এতদিন তত্ত্বতালাস নিতে পারেননি। তা হোক, অগ্রিম তো তিনি দিয়েই রেখেছেন। শশিমুখীর উপর দখলীসত্ত্ব! পঞ্চদশী যদি সপ্তদশী বা অষ্টাদশী হয়ে যায় জনার্দন জানা আপত্তি করবেন না। তিনি সুযোগ মতো এসে ময়নাটিকে নিয়ে যাবেন। বাগানবাড়ি কেনা হয়ে গেছে। সোনার খাঁচাও তৈরি হয়েছে। সময় মতো তিনি লক্ষ্ণৌ আসবেন।

ইতিমধ্যে ঘটনাচক্রে বাইজির ভাগ্য ফিরে গেল। উত্তর কলকাতার এক সঙ্গীতপ্রিয় ধনী ব্যক্তির নজরে পড়ে গেল সে। তাঁরই ব্যবস্থাপনায়, তাঁর বাঁধা বাইজি—রক্ষিতা নয়, বাইজির পরিচয়ে ও পাকাপাকি কলকাতা চলে আসে। বর্ধমানের জমিদারমশাইকে সে সুদ সমেত তাঁর দেয় অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা প্রত্যর্পণ করতে চায়। কিন্তু জমিদারমশাই তা গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলেন না। মাঝে-মাঝে তিনি হুকি দিয়ে পাঠান। কস্তুরীবাঈ কী করবে স্থির করে উঠতে পারে না। এবার সেই জমিদারবাবু তাঁর পাঁচ হাজার টাকা ফেরত নিতে স্বীকৃত হয়েছেন কিন্তু একটি কঠিন শর্তে।

টাকাটা তিনি কস্তুরীবাঈয়ের কাছ থেকে ফেরত নেবেন না। নেবেন শশিমুখীর হাত থেকে। শুধু তাই নয়, টাকাটা শশিমুখী স্বহস্তে তাঁকে প্রত্যপর্ণ করবে। তিনি শশিমুখীর জন্যে যে বাগানবাড়িটা সাজিয়েছেন সেখানে গিয়ে। নির্দিষ্ট দিনে শশীকে যেতে হবে। জনার্দন জানা একটা মুজরোর ব্যবস্থা করবেন। সান্ধ্য-আসরে ওঁর কিছু ইয়ার-দোস্ত আসবে। তাদের সবাইকে শশিমুখী গান শোনাবে। তবচি-সারেঙ্গীকে নিয়ে যেতে হবে না। সেসব এন্তাজাম জমিদার- মশাই নিজেই করবেন।

সুরেশ বজ্রাহত হয়ে যায়। বলে, এসব কী বলছেন দিদি? শশী একা যাবে সেই বাগানবাড়িতে?

—না, একেবারে একা নয়। সে কি একা-একা ট্রেনে চেপে বরধোমান যেতে পারে? আমি ওর সঙ্গে একজন পুরুষমানুষকে রক্ষী হিসেবে পাঠাব। সেই টিকিট-মিকিট কাটবে। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে শশীকে বাগানবাড়িতে পৌঁছে দেবে। পাহারায় থাকবে। আবার মুজরো শেষ হলে ফিরিয়েও নিয়ে আসবে।

—কিন্তু শশী গিয়ে যদি দেখে ‘মুজরো-টুজরো’ সব ফাঁকা বুলি? সেই বদমাইশটা ওই ফাঁকা বাড়িতে একা আছে। এই সুযোগে সে যদি শশীর ধর্মনাশ করতে চায়?

—না, তা সে পারবে না।

—কেন পারবে না? কে তাকে রক্ষা করবে?

–যে তার রক্ষক হয়ে যাচ্ছে। সে আমার খুব বিশ্বস্ত লোক। দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া আর ইমানদার!

—সে কে? কী নাম তার?

—নামধাম জানতে চেও না ভাই। তবে এটুকু জেনে রাখ, সে দুর্ধর্ষ ডাকাত। পাঁচ-সাতটা মানুষকে ইতিপূর্বেই খুন করেছে! পুলিশের খাতায় তার নাম আছে ঠিকই। মামলাও ঝুলছে তার নামে। সে জামিনে খালাস আছে। তা হোক আমাকে সে ‘মা’ ডাকে। আমার সঙ্গে সে তঞ্চকতা করবে না।

সুরেশ নতনেত্রে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললে, তাহলে আমাকেও সঙ্গে যেতে দিন, দিদিভাই। বাগানবাড়ি-তক আমি যাব না, কিন্তু কাছে-পিঠে কোথাও লুকিয়ে থাকব। শশীর চিৎকার শুনলেই ছুটে চলে যাব ওই শয়তানটার গুহায়।

—না, ভাইসাব, তা হয় না। কেন হয় না, তাও আমি তোমাকে বলতে পারব না।

—তাহলে আমাকে আর একটা কাজ করতে দিন?

—কী কাজ?

—আমার বড়ি-আব্বার একটা ছোট্ট শৌখিন পিস্তল ছিল। খুব ছোট্ট। মুঠোর মধ্যে ধরা যায়। কিন্তু মারাত্বক মরণাস্ত্র। সেটা এখন আমার হেপাজতে। আমিই তার লাইসেন্স-হোল্ডার। সেটা আমি শশীকে দেব। ও সেটা সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। এমন হতে পারে যে, গানের জলসা মিটে গেলে জমিদারবাবু নির্জন ঘরে শশীকে আক্রমণ করে বসতে পারে। হয়তো ওর রক্ষক তখন অন্যত্র। সেই নিতান্ত প্রয়োজনে শশী ওটা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে।

বাইজি বলে, ভাইসাব! ও বদনসিব জীবনে কি কখনো পিস্তল দেখেছে? ও কি পিস্তল চালাতে জানে?

—না, জানে না। আমি তাকে দু-ঘন্টার ভিতর সেটা শিখিয়ে দেব। কই, ডাকুন তো শশীকে।

কস্তুরীবাঈ রাজি হলো। তার আহ্বান শুনে শশী ঘরে এল। সুরেশ তাকে বলল, শোন শশী, দিদি রাজি হয়েছে। আমাকে বলেছে যে, তোমাকে একবার বর্ধমান যেতে হবে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে, যদিও আপাতদৃষ্টিতে তুমি গানের জলসায় ‘মুজরো’ নিয়ে যাচ্ছ। আমি কাল তোমাকে একটা পিস্তল এনে দেব, শশী। ঘণ্টা-খানেক নাড়াচাড়া করলেই তুমি বুঝে ফেলবে কী করে পিস্তল চালাতে হয়। আসলে পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া কোনও ব্যাপারই নয়। বন্দুক, রিভলভার পুরুষমানুষের অস্ত্র; কিন্তু পিস্তল মেয়েদের। ওটা চালাতে একটা জিনিসেরই প্রয়োজন : সাহস! হিম্মৎ! শোন, দিদি তোমার জন্যে একজন দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করেছে। সে বিশ্বস্ত লোক। তার হেপাজতেই যন্ত্রটা থাকবে ট্রেনে করে যাবার সময়। থাকবে একটা থলেতে। তাতে দিদির দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার নোটের বান্ডিলটাও থাকবে। হয়তো জলসাঘরে সেই পুরুষ দেহরক্ষীকে ঢুকতেই দেওয়া হবে না। তাই জলসাঘরের ভিতরে, মানে ওই শয়তানের বাগানবাড়িতে ঢোকার আগেই তুমি থলিটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিজের কাছে রাখবে। প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় কুকুরটাকে গুলি করে মেরে ফেল। তুমি জান কি জান না, জানি না—শুনে রাখ, কোনো স্ত্রীলোক নিজের ইজ্জৎ বা নারীধর্ম রক্ষা করার প্রয়োজনে কাউকে গুলি করে মারলে সেটা তার অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না।

শশী এতক্ষণ নিশ্চুপ শুনেছে। এবার বলল, আর আমি যদি গিয়ে দেখি—জলসা-টলসা বাজে কথা। বাগানবাড়িটা ভোঁ-ভাঁ?

—সেটাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেখবে যে, ওই পিশাচটা তোমার প্রতীক্ষায় একাই বসে আছে। হয়তো ওর দারোয়ান তোমার সঙ্গের লোককে রুখে দেবে—তোমাকে পৌঁছে দেবে ওর জলসাঘরে। সেক্ষেত্রে ওই থলিটা নিয়েই তুমি জলসাঘরে ঢুকে যাবে। দারোয়ান যদি জানতে চায় থলিতে কী আছে, তাহলে টাকার বান্ডিলটা বার করে দেখিয়ে দেবে। খুব সম্ভব যেই তুমি সেই নির্জন ঘরে ঢুকবে অমনি বদমায়েশটা দরজা ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দেবে। তাতে ভয় পেও না। তখন তুমি র‍্যাশন-ব্যাগ থেকে ওই দুটো জিনিস চট্ করে একই সঙ্গে বার করে নেবে—বাঁ হাতে টাকার ব্যান্ডিল, আর ডান হাতে পিস্তলটা। বুঝলে? সোজাসুজি জোর গলায় বলবে, ‘এই নিন আপনার পাঁচ হাজার টাকা’ বলেই বাঁ হাতে সেটা ছুঁড়ে মারবে ওর মুখে। আর একই সঙ্গে ডান হাতে পিস্তলটা উঁচিয়ে বলবে, আপনি নিজে হাতে দরজার ছিটকিনিটা খুলে দিন, মিস্টার জানা। আমার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করবেন না, তাহলে আমি কিন্তু আপনার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!—কী পারবে না বলতে?

শশী সংক্ষেপে শুধু বলে, পারব!

—পিশাচটা তখন হয়তো অনেক কথা বলবে। হয়তো বলবে, ‘তোমার হাতটা কাঁপছে শশী। ওটা সরিয়ে নাও।’ হয়তো বলবে, ‘মানুষ খুন করলে তোমার ফাঁসি হয়ে যাবে।’

শশী জোর গলায় বলে, তখন আমি তাকে বলব, ‘কিন্তু তুমি তো মানুষ নও, বাবুজি। কুকুর মারলে ফাঁসি হয় না। আমি তিন গুনব। তারমধ্যে যদি…’

সুরেশ আর নিজেকে সামলাতে পারে না। স্থান-কাল ভুলে কস্তুরীর সামনেই শশীকে বাহু পাশে আবদ্ধ করে বলে, সাবাস!

.

এর পরের ঘটনা, অর্থাৎ বাস্তবে ঠিক কী ঘটেছিল তা আর জানে না সুরেশ। গত সোমবার, মানে তিন দিন আগে কস্তুরীর সরবরাহ করা সেই দেহরক্ষীকে নিয়ে শশিমুখী বর্ধমান চলে যায়। সকালের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে। দুটো দিন দারুণ অশান্তিতে কেটেছে সুরেশ আর কস্তুরীর। কারণ ওদের দুজনের একজনও ফিরে আসেনি। কাল রাত্রে বর্ধমান থেকে সুরেশ একটা ট্রাঙ্ককল পায়। ফোনটা করেছিলেন বর্ধমানের একজন নামকরা অর্থোপেডিক সার্জেন। ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ মৈত্র। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে বলেন যে, মিস্ শশিমুখী মুখার্জির অনুরোধে তিনি ফোনটা করছেন। মিস্ মুখার্জি সুরেশবাবুকে জানাতে চায় যে, সে একটা ছোটাখাটো দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শয্যাশায়ী। এজন্যই সে কলকাতায় ফিরে যেতে পারেনি।

সুরেশ আকুল হয়ে জানতে চায়, অ্যাসিডেন্ট! কী জাতীয়?

—উনি পা পিছলে পড়ে যান। আমি এক্স-রে করে দেখেছি, পেলভিখ-গার্ডেলে একটা সামান্য হেয়ার-ক্র্যাক হয়েছে। এজন্যই সে শয্যাশায়ী। আমার বাড়িতেই আছে। চিন্তার কিছু নেই। তবে দিন-সাতেক সে বিছানা থেকে নামতে পারবে না।

সুরেশ আকুল হয়ে বলে, আপনার অ্যাড্রেস কী? টেলিফোন নম্বর কত?

—না মিস্টার চৌধুরী। সে-কথা জানাতে আমাকে স্পষ্ট নিষেধ করেছেন মিস্ মুখার্জি তিনি চান না আপনি বর্ধমানে আসেন। কী কারণে তাঁর আপত্তি তাও তিনি আমাকে বলেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন যে, আপনি বা তাঁর দিদি যেন কোনোক্রমেই বর্ধমানে না আসেন। চিন্তার কিছু নেই। আমার নাম তো শুনেছেন। টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার আপনি অনায়াসে পেয়ে যাবেন। কারণ বর্ধমানে আর কোনো অর্থোপেডিক ডাক্তার নেই। কিন্তু প্লিজ, আপনারা আসবেন না। মিস্ মুখার্জির সনির্বন্ধ অনুরোধ। আমি কাল সন্ধ্যার পর আবার আপনাকে একটা ফোন করে জানাব উনি কেমন আছেন। গুড নাইট!

বলেই তিনি টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিলেন।

বাসু জানতে চান, তাহলে আপনি কোন সূত্রে জানলেন যে বর্ধমানের জমিদার জনার্দন জানা খুন হয়েছেন।

সুরেশচন্দ্র তাঁর পোর্টম্যান্টো-ব্যাগ খুলে তা থেকে একটা খবরের কাগজের কার্টিং বার করে দেখালেন। সেদিনেরই সংবাদপত্র। তাতে জর্নাদনের রহস্যময় মৃত্যু সম্বন্ধে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় সংবাদদাতা মৃত্যুর রহস্যময়তার বিষয়ে সংযতবাক, অথচ মৃত ব্যক্তির কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে মুখর :

“বর্ধমান; ২৫শে জুলাই : গতকাল বৈকালে তারামাতলায় বর্ধমান পৌরসভার মাননীয় কাউন্সেলার প্রখ্যাত সমাজসেবী জনার্দন জানা মশায়ের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হইয়াছে। ঘটনার সময় ওই বাড়িতে গৃহস্বামী ভিন্ন শুধুমাত্র দারোয়ান উপস্থিত ছিল। দ্বিপ্রহরে মধ্যাহ্ন-আহারান্তে গৃহস্বামী তাঁর শয্যায় শয়ন করেন। অপরাহ্ণে দারোয়ান চা পরিবেশন করিতে আসিয়া তাঁহাকে মৃতাবস্থায় আবিষ্কার করে। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে তাঁহার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি তাঁহার দুই সহধর্মিণী, তিন পুত্র এবং চারজন কন্যাকে শোকসাগরে ভাসাইয়া যান। জনার্দন জানা এ অঞ্চলের এক স্বনামধন্য সমাজসেবী। উপর্যুপরি দুইবার পৌরসভার নির্বাচনে…” ইত্যাদি।

বাসু বললেন, জনার্দন জানা যে খুন হয়েছেন এমন কথা কিন্তু সংবাদপত্রে আদৌ ছাপা হয়নি। আপনার বান্ধবীর নামোচ্চারণ পর্যন্ত করা হয়নি। এক্ষেত্রে আপনি এতটা ঘাবড়ে গেলেন কেন বলুন তো?

—আমি একটা অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাচ্ছি, বাসু-সাহেব। শশী গেল পাঁচ হাজার টাকার খেসারত দিতে। ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সন্ধ্যাতেই বুড়োটা রহস্যজনকভাবে মারা গেল। এদিকে শশী দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। দুর্ঘটনাই যদি হয় তাহলে টেলিফোন করে সে আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে বারণ করছে কেন? টাকা আর পিস্তলের সম্বন্ধে কোনো খবর নেই। এই ঘটনাচক্রের মধ্যে একটা বিচিত্র যোগসূত্র কি আপনার নজরে পড়ছে না?

–পড়ছে। আলবাৎ পড়ছে। কিন্তু এখানে বসে আমাদের যুগল লাঙ্গুল আন্দোলনে সে রহস্যের সমাধানে কিছুমাত্র সাহায্য করবে না। যদিও মিস্ মুখার্জি বারণ করেছেন তবু আমাদের দুজনকেই সরেজমিন তদন্ত করে দেখতে হবে। আপনি বরং প্রথমে পর্যায়ে আড়ালে থাকবেন। নেক্সট ট্রেনেই আমাদের দুজনকে বর্ধমানে যেতে হবে। দাঁড়ান। টাইমটেবল্‌ল্টা আনাই।

—ট্রেনে কেন স্যার? আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি। গাড়িতে পুরো ট্যাঙ্ক পেট্রোল ভরে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। গাড়িতে ওভারনাইট ব্যাগে যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এসেছি। যথেষ্ট টাকাও সঙ্গে এনেছি। আপনি সিনিয়ার ব্যারিস্টার-সাহেবকে জানিয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে আসুন। আমরা বিকেলের মধ্যেই বর্ধমানে পৌঁছে যাব। কিন্তু আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থলটা কোথায়? যেখানে খুনটা হয়েছে, সেই তারামাতলা? নাকি ডক্টর মৈত্রের বাড়ি?

—দুটোর একটাও নয়। আমাদের প্রথমে যেতে হবে পুলিশ-স্টেশনে। খবর নিয়ে জানতে হবে পুলিশ এটা কী: চোখে দেখছে। মস্তিস্কের রক্তক্ষরণটা কি কোনও সেরিব্র্যাল স্ট্রোকের হেমারেজ, নাকি সেটা আপনার নামে লাইসেন্স-করা একটা পিস্তলের গুলির অবদান?

—পুলিশ তা আপনাকে জানাবে?

—জানাবে। যদি আমরা ঠিকমতো কৌশল করতে পারি।

—যতই কৌশল করুন, স্যার। আপনি তো ডিফেন্স কাউন্সেল। পুলিশের বিপক্ষের লোক। আপনাকে আগ্নাড়িয়ে পুলিশ কিছু জানাবে কেন?

—দেখা যাক।

পাঁচ

পুলিশ তা জানাল কিন্তু। অকপটে। বিশেষ কারণ ছিল।

বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ থানা-ইনচার্জ, আবদুল জব্বর-সাহেব বাসু- সাহেবকে সবান্ধবে অত্যন্ত সমাদর করে আপ্যায়ন করলেন। একাধিক হত্যা মামলায় তিনি রে-সাহেবের কেরামতি দেখেছেন। ফলে সেই রে- সাহেবের সাগরেদকে— বিশেষ, ইনিও বিলাতী ডিগ্রিধারী ব্যারিস্টার—ওঁর মনে হলো, আল্লাতালা প্রেরিত এক বেহেস্তি মুবারকী! বাস্তবে এই খুনের কেসটা নিয়ে জব্বরের রাতের ঘুম ছুটে যাবার যোগাড়। বিভাগীয় বড়কর্তার নির্দেশ : অবিলম্বে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে, খুনীকে চিহ্নিত এবং পাকড়াও করতে হবে; ওদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ মন্ত্রিমশায়ের কফিডেনশিয়াল সেক্রেটারি সরাসরি থানায় টেলিফোন করে জব্বরকে জানিয়েছেন কেঁচো খুঁড়তে কোনোক্রমেই যেন সাপটা না বার হয়ে পড়ে। জানামশাই পার্টির এক হোমরা-চোমরা—তাঁর অত্যাচার আর ব্যভিচার সর্বজনবিদিত।

বাসু বললেন, দেখুন মিস্টার জব্বর, খবরের কাগজে যেটুকু ছাপা হয়েছে তাতে কোথাও বলা হয়নি যে, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের হেতু একটি সীসার গোলক!

—না স্যার। খবরের কাগজ কেন ও-কথা ছাপবে? কারণ বাস্তবেও তা হয়নি। এটা বুলেট-উন্ডের কেসই নয়।

—সেরিব্র্যাল থম্বোসিস?

—আজ্ঞে না, তাও নয়। মিস্টার জানা আদৌ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফৌত হননি। তাঁর লাশটা পাওয়া গেছে ঘরের মেঝেতে। পোস্ট-মর্টেম হয়নি, হবেও না—রাজনৈতিক কারণে—কিন্তু মৃত্যুর হেতু একটি লোহার ডাণ্ডা!

–লোহার ডাণ্ডা! মাথায়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! সামনে কপালের দিকে নয়—পিছন দিকে— ওঁর সেরিবেল্লাম সে আঘাতে ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। দেখুন স্যার—যতদুর আন্দাজ করা যাচ্ছে, ঘরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না—

—তৃতীয়? তা দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে? জনার্দন জানা ছাড়া?

—ওই যাঁর জন্যে আপনি বর্ধমানে হন্যে হয়ে ছুটে এসেছেন! আপনার ক্লায়েন্ট!

—বলেন কী! কী করে জানলেন?

—বলছি! কিন্তু তার আগে বলি : মিস্ মুখার্জির হাইট পাঁচ-দুই, আর জনার্দন পাঁচ-নয়। ত্রিসীমানায় কোনো লাঠি, ডাণ্ডা, হাতুড়ি জাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি। গেলেও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিস্ মুখার্জি ওঁর সেরিবেল্লাম চৌচির করতে পারতেন না। সুদূর কল্পনাতেও তেমন পরিস্থিতির কথা ভাবা যায় না।

—মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?

—সেটাই কি স্বাভাবিক নয়, স্যার? নির্জন ঘরে একটি পুরুষ যদি একটি মহিলার শ্লীলতাহানি করতে চায়, তাহলে সে কি পিছন ফিরে দাঁড়াবে? পিছন ফিরে আদর করে বলবে, ‘আয় সোনামণি, আমার মাথায় ডাণ্ডা মার!’ বিশেষ সে যদি দেখে মেয়েটির হাতে রয়েছে একটা স্লেজ-হ্যামার?

সুরেশ আঁৎকে ওঠে, স্লেজ-হ্যামার?

—আরে মশাই ওটা কথার কথা। ধরুন যদি সেটা মশারির লোহার ছত্রিই হয়, তাহলেও? বাসু জানতে চান, আমার ক্লায়েন্ট এখন শয্যাশায়িনী। সে কি নজরবন্দি হয়ে আছে? উঠে দাঁড়াতে পারলেই কি আপনি তাকে অ্যারেস্ট করবেন? তাহলে অ্যান্টিসিপেটারি বেইল …

—না স্যার! আমি নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা মতো তাঁকে আদৌ অ্যারেস্ট করব না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছি। আমি স্থির নিশ্চয় যে, ওই বাইজি নিজে হাতে খুনটা করেনি। কারণ সেটা বাস্তবে সম্ভবপর নয়। কিন্তু আমার অনেক উপর- ওয়ালা আছেন। তাঁরা যদি হুকুমজারি করেন তাহলে মেয়েটাকে গ্রেপ্তার করতেই হবে।

বাসু বলেন, দেখুন মিস্টার জব্বর। যতক্ষণ না আপনি আমার মক্কেলকে আসামীরূপে চিহ্নিত করতে চাইছেন ততক্ষণ আপনি-আমি একই পক্ষে। আমাদের একটাই উদ্দেশ্য— রহস্যের জাল ভেদ করে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা। সেক্ষেত্রে আপনি কি গোটা কেসটা—আপনি যতদূর জেনেছেন—তা আমাকে জানাবেন? তাহলে আমরা যৌথভাবে প্রকৃত অপরাধীকে….

জব্বর বাধা দিয়ে বলেন, আর বলতে হবে না, স্যার—আপনার এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবকে আমি আল্লাহ্র ‘দোয়া’ হিসাবে মনে করছি। আমি গোটা কেসটাই আপনার সামনে তুলে ধরছি। দেখুন, আপনি কোনও হিল্লে করতে পারেন কি না। অর্থাৎ কে, কীভাবে, কেন নির্জন ঘরে জনার্দন জানার মাথার খুলি এভাবে স্টোন-চিপ্‌স্ বানিয়ে দুনিয়ার ভার কিছুটা লাঘব করে দিল। আগেই বলেছি—মিস্ মুখার্জি নন, তাঁর পক্ষে সেটা অসম্ভব; কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডটা তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছে। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। অবধারিত ভাবে। স্টার উইটনেস!

—মিস্ মুখার্জি কি এ কথা অস্বীকার করেছেন?

—আজ্ঞে না। অস্বীকার করেননি। আবার স্বীকারও করেননি। বস্তুত আমি এখনো পর্যন্ত তাঁর ভালরকম একটা জবানবন্দিই নিতে পারিনি। আন্ডার মেডিক্যাল অ্যাডভাইস! শুধু ঠ্যাঙের হাড় ভাঙাই নয়, মিস্ মুখার্জি একটা প্রচণ্ড মেন্টাল শক্ও পেয়েছেন। ডাক্তার মৈত্র ওঁকে জেরা করতে দিচ্ছেন না! ক্রমাগত ঝুলিয়ে রাখছেন। বলছেন, ‘মেডিক্যাল-অ্যাডভাইস্ অগ্রাহ্য করে আপনি যদি ওকে জেরা করেন এবং আমার পেশেন্টের তাতে যদি ভালমন্দ কিছু হয়ে যায় তাহলে আপনি ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী থাকবেন।

বাসু বললেন, আই সী!

জব্বর তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেন, নো, য়ু ডোন্ট স্যার। আই মীন আমার সসেমিরা অবস্থাটা। এস.পি.-সাহেব বলছেন, ‘আপনি যদি ওই মেয়েটিকে অবিলম্বে জেরা না করেন তাহলে বুঝব আপনি প্রেজুডিসড্!’ তার মানে সাদা বাঙলায় : পার্টির কাছে টাকা খেয়েছেন। ওদিকে সিবিল-সার্জেন বলছেন, তিনি কোনও দায়িত্ব নিতে পারবেন না। আর রাজনৈতিক পার্টি বলছেন, আপনি ওই বাইজিকে জেরায় জেরবার করে দিন, আমরা আপত্তি করব না, কিন্তু খবর্দার ‘জনসেবক’ জানার কোঁচার পত্তনটা যেন ঠিক থাকে। ছুঁচোর কেত্তনটা যেন না জানাজানি হয়ে যায়।

বাসু বলেন, আপনি আদ্যোপান্ত খুলে বলুন তো কেসটা?

.

থানায় টেলিফোনটা আসে সন্ধ্যা পাঁচটা বত্রিশে। জব্বর-সাহেব নিজেই টেলিফোনে সাড়া দেন। ও-প্রান্তে ছিলেন ডঃ রবিন মৈত্র। সে আমালে বর্ধমানের বস্তুত একমাত্র অর্থোপেডিক সার্জেন। বিলাতী ডিগ্রিধারী। জব্বর-সাহেবের বিশেষ পরিচিত, কারণ তাঁর বড়ি-আব্বা যখন বছরখানেক আগে স্নানঘরে পা-পিছলে পড়ে পায়ের হাড় ভাঙেন তখন ডাক্তার মৈত্রই তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন। সে যাই হোক, ডাক্তার মৈত্র টেলিফোনে জানালেন যে, তাঁর পাড়ায়, বস্তুত সামনের বাড়িতেই এক ভদ্রলোকের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে। জব্বর-সাহেব যেন অবিলম্বে তদন্তের ব্যবস্থা করেন।

ডাক্তার-সাহেবের বাড়ি তারামাতলায়। এলাকাটার সম্বন্ধে জব্বর-সাহেব বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি জানতে চান, কার বাড়ি? লোকটি কে?

ডাক্তার মৈত্র বলেন, আমার বাড়ির উল্টোদিকে জনার্দন জানা-মশায়ের যে বাড়িটা আছে—মানে ‘জলসাঘর’—সেখানেই ঘটেছে দুর্ঘটনাটা।

জব্বর জানতে চান, কে মারা গেছেন? আপনি চেনেন?

ডাক্তারবাবু বলেন, মৃতদেহ আমি দেখিনি, যিনি দেখেছেন তিনি এখন আমার বাড়িতেই আছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী মনে হচ্ছে মৃতদেহটা জনার্দন জানা মশায়েরই।

জব্বর সোজা হয়ে উঠে বসেন। বলেন, এ কী বলছেন মশাই! সেই প্রত্যক্ষদর্শীকে টেলিফোনটা একবার দিন তো, ডাক্তার-সাব।

—সরি! তিনি মারাত্বকভাবে অসুস্থ। মেন্টাল শক্! আমার চিকিৎসাধীনে আছেন। আপনি দেরি না করে এখনি চলে আসুন।

থানায় সবেধন একটিই নীলমণি-জিপ। সেটা নিয়ে জব্বরের অধীনস্থ ইন্সপেক্টার রোঁদে গেছেন। যেকোনো সময়ে ফিরে আসতে পারেন। জব্বর অতঃপর জনার্দন জানার বাড়িতে ফোন করেন—জলসাঘরে’ নয়, তাঁর ভদ্রাসনে। দেখা যায় ওঁরা ইতিপূর্বেই খবর পেয়েছেন। জনার্দনের বড় ছেলে নির্মল আর তার বড় মামা কেশববাবু সংবাদপ্রাপ্তিমাত্র ‘জলসাঘর’-মুখো রওনা হয়ে গেছেন।

জব্বর অকুস্থলে এসে পৌঁছান সন্ধ্যে সওয়া ছয়টায়। জলসাঘরের সামনে তখন রীতিমতো একটা জটলা। কেশবচন্দ্র পেশায় উকিল। বর্ধমান আদালতের। গেট খুলে তিনিই এগিয়ে এলেন জব্বর-সাহেবের দিকে।

জানা গেল, কেশববাবুকে খবর দিয়েছিল জলসাঘরের বেয়ারা-কাম-দারোয়ান কানাই। মৃতদেহটা নাকি সেই আবিষ্কার করে। বিকেলবেলা জানামশাইকে বৈকালিক জলখাবার আর চা পরিবেশন করতে গিয়ে। জলসাঘরে টেলিফোন আছে। কানাই তৎক্ষণাৎ বাড়িতে ফোন করে দেয়। তখন ঠিক কয়টা তা কেশববাবু বলতে পারলেন না, তবে তিনি অকুস্থলে এসে পৌঁছান মিনিট পনের আগে ছয়টা নাগাদ। কানাইয়ের নির্দেশ মতো দ্বিতলে উঠে গিয়ে মৃতদেহটি স্বচক্ষে দেখেন। এবং তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন করেন। সেখান থেকে জানতে পারেন যে, পুলিশ ইতিপূর্বেই খবর পেয়েছে এবং তদন্ত করতে রওনা হয়ে গেছে। থানা কীভাবে এত শীঘ্র খবরটা পেল—মানে কেশবচন্দ্র মৃতদেহ আবিষ্কার করার পূর্বেই—এটা নিয়ে তিনি তখনো চিন্তিত। তিনি জানতে চান, থানায় খবরটা কে দিয়েছে? জব্বর সে কথার জবাব না দিয়ে প্রথমেই দ্বিতলে উঠে গিয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করেন। মৃত্যু সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই—কারণ জানামশায়ের মাথার পিছন দিকটা একেবারে থেঁৎলে গেছে। জব্বর ঘরটা, বারান্দাটা, জানলা দিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে যতদূর সম্ভব সেই দূরত্ব পর্যন্ত সন্ধান করে দেখলেন। জানার মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো কোন ডাণ্ডা, মুগুর, লাঠি জাতীয় কিছু আবিষ্কার করতে পারেন না। নিঃসন্দেহে খুনী তার অস্ত্রটা সঙ্গে নিয়েই পালিয়েছে। কিন্তু কেন? রক্তমাখা অমন একটা অস্ত্র নিয়ে সে কেন পথে বার হলো? জব্বর এ প্রশ্নের কোনও সমাধানে আসতে পারেন না। জিপটা পাঠিয়ে তিনি অটপ্সি-সার্জেনকে ডেকে আনেন।

জলসাঘরটি দ্বিতল। একতলায় বড়-হল কামরা। পঞ্চাশ-ষাটজন বসতে পারে। ঝাড়-লণ্ঠন- ফরাস সবই সাবেকি ধরনের; তবে খাশগেলাসের বদলে টিউব-লাইট। তারামাতলায় বছর দুই হলো বিজলি এসেছে। দ্বিতলে একটিমাত্র কক্ষ শয়নকক্ষই বলা চলে। সে ঘরে একটি ডবল- বেড পালঙ্ক, বড় একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, খান চারেক ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত গদিমোড়া চেয়ার, একটি বেতের আরাম-কেদারা। সে ঘরের সংলগ্ন একটি টয়লেট ও আছে। তার বাহিরের দিকে জমাদারের যাতয়াতের জন্য ঢালাই-লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি।

সরেজমিন তদন্ত সেরে জব্বর-সাহেব কেশবচন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন, বাথরুম থেকে ওই লোহার সিঁড়িতে যাবার যে দরজাটা আছে তা তো এখন দেখছি ভিতর থেকে বন্ধ করা। আপনারা যখন আসেন—ছয়টা নাগাদ, তখনো কি ওই দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল?

কেশব বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি সেটা পরীক্ষা করে দেখেছিলাম। ছিটকানি বন্ধ করা ছিল।

জব্বর এবার কানাইকে প্রশ্ন করেন, তুমি যখন বিকেলে জানা-সাহেবকে চা-খাবার দিতে এসেছিলে, তখনো কি ওই দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল?

—আজ্ঞে আমি তা যাচাই করে দেখিনি, হুজুর। আমার কি তখন মাথার ঠিক ছিল? তবে ও দরজাটা দিন-রাত তো বন্ধই থাকে। শুধু জমাদার যখন আসে তখনই আমি খুলে দিই। সে সাফ-সুতরো করে চলে গেলেই ভিতর থেকে বন্ধ করে দিই। ওটা নিশ্চয় বন্ধই ছিল।

জব্বর এরপর একে-একে জনান্তিকে সকলের জবানবন্দি নিতে থাকেন। প্রথমেই কানাই—যে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিল।

কানাই তার এজাহারে বলে যে, সে সওয়া পাঁচটা নাগাদ—তার হাতঘড়ি নেই, সে সঠিক সময়টা বলতে পারছে না—সাহেবের জন্য চা-জলখাবার নিয়ে উপরে আসে।

চা-জলখাবার অস্পর্শিতভাবে শ্বেতপাথরের টেবিলটার উপরেই পড়ে আছে। সেদিকে এক নজর দেখে নিয়ে জব্বর জানতে চান, দুই প্লেট খাবার আর দু-কাপ চা রয়েছে দেখছি। তোমার সাহেব কি ঘরে একা ছিলেন না?

কানাই আমতা-আমতা করে বলে, আজ্ঞে না, হুজুর। সাহেবের কাছে বিকালের দিকে একজন মেহমান এসেছিলেন। তাই দু-কাপ …

—মেহমান! কে তিনি? তুমি চেন তাঁকে? কখন এসেছিলেন?

—আজ্ঞে চিনি না, হুজুর! তিনি সাড়ে চারটে নাগাদ এসেছিলেন। একটা ট্যাক্সি নিয়ে। আমি আগে কখনো তাঁকে দেখিনি।

—আগে তাকে কখনো দেখনি? বয়স কত হবে?

—আজ্ঞে বিশ-পঁচিশ হবে, আমি ঠিক আন্দাজ পাইনি।

–চোখে চশমা ছিল? গোঁফ-দাড়ি কামানো?

কানাই আরও কুণ্ঠিত হয়ে বলে, আজ্ঞে তিনি পুরুষমানুষ নন, হুজুর, আর চশমাও চোখে ছিল না।

—পুরুষ নয়! বিশ-পঁচিষ বছরের যুবতী? ট্যাক্সি করে একা এসেছিল?

—আজ্ঞে, একা এসেছিলেন একথা তো আমি বলিনি হুজুর। ট্যাক্সিতে আর একজন ষণ্ডামার্কা লোক ছিল। সে লোকটারও চোখে চশমা ছিল না। তার দাড়ি-গোঁফ দুইই কামানো। ঈ-য়া দশাসই চেহারা। সে ছিল ট্যাক্সি-ড্রাইভারের পাশের সিটে। তার হাতে ধরা ছিল একটা র‍্যাশন ব্যাগ। লোকটা ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগটা ওই বাইজির হাতে—

—বাইজি! এই যে বলছিলে মেহমান?

—আজ্ঞে বাইজি কি মেহমান হতে পারে না, হুজুর?

—তা সে বাইজি কোথায় গেল?

—আমি তা জানি না হুজুর। তাঁকে সাহেবের কাছে দোতলায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। তারপর আমি আউট-হাউসে চলে যাই। ওখানে সাহেবের জন্য মাছের চপ গড়ে রেখেছিলাম। বিকালের জলখাবার। সেগুলোই ভাজতে বসি। বাইজি যে চা-খাবারের জন্য অপেক্ষা না করে সুট করে সরে পড়তে পারে তা আমি আজাদই করতে পারিনি হুজুর!

—আজ সন্ধ্যায় কি এখানে গান-বাজনার আসর বসানোর কথা ছিল? বাইজি একা একা এল, তার সঙ্গে তবচি বা সারেঙ্গী এল না? তাছাড়া তোমার সাহেব কি একা-একাই জলসা বসাতে চেয়েছিলেন নাকি?

—আজ্ঞে, এ সব কথা উকিলবাবু জানেন। আমি জানি না।

‘উকিলবাবু’ বলতে কেশবচন্দ্র। জনার্দন জানার বড়বিবির সহোদর।

—ঠিক আছে, সেকথা না হয় কেশববাবুর কাছেই জানতে চাইব। তুমি বরং বল, ট্যাক্সিটা কি বাইজিকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল? আর সেই ষণ্ডামার্কা লোকটা কোন দিকে গেল? ব্যাগটা বাইজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে? আবার কি ট্যাক্সিতেই উঠে বসল?

—আজ্ঞে, সেসব আমি নজর করে দেখিনি, হুজুর

—কেন দেখনি? সেই ষণ্ডামার্কা লোকটাই তো সবচেয়ে সন্দেহজনক। বাইরের বেগানা লোক— তুমি বলছ দশাসই চেহারা—

—তা আমি কি তখন জানি যে, কত্তামশাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খুন হয়ে যাবেন?

—বুঝেছি! তুমি তখন বিশ-বাইশ বছরের বাইজির দিকেই লক্ষ্যভেদী অর্জুনের মতো নিবদ্ধদৃষ্টি। তা হোক, মেয়েটির হাতে যে ঝোলা ব্যাগটা ছিল, তার ভিতরে কি ছিল?

—তা আমি কেমন করে জানব হুজুর? আমি তা দেখতে চাইনি। ট্যাক্সিটা বিকেলবেলা গেটের সমুখে এসে দাঁড়াল, আমি তখন বাগানে গাছের গোড়া নিড়িয়ে দিচ্ছি। ট্যাক্সিতে বসা ওই ষণ্ডামার্কা লোকটা জানতে চাইল—এ বাড়িটার নাম ‘জলসাঘর’ কি না? আমি বললাম, হ্যাঁ। ও তখন জানতে চাইল মালিক জানামশাই আছেন কি না। আমি তা স্বীকার করায় সে ট্যাক্সি থেকে নেমে এল, পিছনের দরজা খুলে বাইজিকে নামতে সাহায্য করল, তার হাতে র‍্যাশন ব্যাগটা ধরিয়ে দিল আর আমাকে বলল, এঁকে তোমার সাহেবের কাছে নিয়ে যাও। আমি তাই নিয়ে এলাম। সাহেব তখন দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বাইজিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখে নিজেও উঠে দাঁড়ালেন, ভিতর নিয়ে গিয়ে বসালেন। বাইজি বোধহয় বাথরুমে যেতে চাইল। সাহেব আমাকে বললেন, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চা-টা নিয়ে আসিস। দুজনের জন্যই। আমি নিচে এসে দেখি ট্যাক্সিটা চলে গেছে। সেই যণ্ডামার্কা লোকটকেও আর দেখতে পাইনি। সেও ওই ট্যাক্সিতেই নিশ্চয় ফিরে গেছিল বোধহয়।

—জানামশায়ের মৃতদেহটা আমি যেখানে পড়ে থাকতে দেখেছি সেখানেই পড়েছিল? ওই ভাবেই?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! আমি ওঁকে ছুঁইনি। চা-খাবারের ট্রে-টাটেবিলে চট করে নামিয়ে রেখেই আমি নিচে নেমে আসি বাড়িতে টেলিফোন করতে। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না, হুজুর।

–মেয়েটি যে বাইজি তা তুমি কেমন করে জানলে?

—আজ্ঞে সেরেফ আজাদে। তা নাও হতে পারে।

–সে কি শাড়ি পরে ছিল?

—আজ্ঞে না। মুসলমানী ঢঙের শেরওয়ানি-চুস্ত, ওড়না। তাতেই আজাদ করেছিলাম ও নির্ঘাৎ বাইজি—ঘরানা-ঘরের ঔরৎ নয়।

এরপর জবানবন্দি দেন কেশবচন্দ্র। তিনি স্বীকার করেন যে, ওই স্ত্রীলোকটি বাইজিই। কী নাম তা ওঁর মনে নেই। তবে ঘটনার সন্ধ্যায় তার মুজরো ছিল। বর্ধমানের তিন-চারজন সঙ্গীতরসিকের নিমন্ত্রণও ছিল। কেশবচন্দ্রকেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন জনার্দন। কিন্তু ঘটনাচক্রে দিন-চারেক আগে কাশী থেকে একটি পত্র আসে যে, সেখানে জর্নাদনের জ্যাঠতুতো বড়ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী মারা গেছেন। তাই অশৌচ পড়ে যাওয়ায় জলসাটা বাতিল করতে হয়। বর্ধমানের অন্যান্য সবাইকে খবর দেওয়া হয়; কিন্তু বাইজিকে খবর দেওয়া যায়নি। জনার্দন যাকে সংবাদ দিতে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন সে হতভাগা বাইজির ঠিকানাই খুঁজে পায়নি। তাই নাকি কেশবচন্দ্রের জামাইবাবু দুপুরবেলাতেই ‘জলসাঘরে’ চলে আসেন। বাড়ির গাড়িতেই। ড্রাইভার ওঁকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। কথা ছিল, রাত সাতটা নাগাদ ড্রাইভার ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। বাইজি যদি আসে তাহলে সন্ধ্যার আগেই আসবে। তাকে কিছু আপ্যায়ন করে এবং নগদ বিদায় দিয়ে কলকাতায় ফেরত পাঠানো হবে।

জব্বর জানতে চান, আপনাদের অশৌচ হলে তো শেভিং করা গুনাহ্ বলে ধরা হয়। তিন- চার দিন জানামশায়েক অশৌচ চলছে অথচ ডেড-বডি দেখে তো মনে হলো উনি ক্লীন- শেভড অবস্থায় বেহেস্তে চলে গেছেন।

কেশব একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, জামাইবাবু সাজপোশাক বিষয়ে একটু বেশি শৌখিন ছিলেন। প্রতিদিন ক্ষৌরি না করলে রাতে তাঁর ঘুম হতো না, অসোয়াস্তি হতো।

—তাই বুঝি? বিশেষ সন্ধ্যেবেলা এক সুন্দরী বাইজির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে যখন। কিন্তু কানাই বলল, সে বিকালে তার সাহেবের জন্য মাছের চপ বানিয়ে এনেছিল। অশৌচ অবস্থাতেও দৈনিক মাছ-মাংসের খাদ্য না পেলে কি ওঁর ঘুমের ব্যাঘাত হতো?

কেশববাবু একটু হেসে বললেন, এই সওয়ালের জবাব পেতে হলে আপনাকে কষ্ট করে একবার বেহেস্তে যেতে হবে পুলিশ-সাহেব। এটা আমি প্রত্যক্ষ জ্ঞানে জানি না, জানাই জানাতেন।

জব্বর গম্ভীর হয়ে বলেন, জলসাতে বর্ধমানের আর কোন কোন সঙ্গীতপ্রিয়র নিমন্ত্ৰণ ছিল?

—সেটাও আমার জানা নেই স্যার, জানাই জানতেন।

—বাইজির নামটা কী?

—আগেই বলেছি, আমি জানি না। নির্মল হয়তো জানে, কারণ সেই বাইজিকে কলকাতায় খবর পাঠিয়েছিল। যদিও খবরটা পৌঁছায়নি।

এরপর এজাহার দিতে এল মৃতের বড় ছেলে নির্মল। সেও কেশববাবুর কথা করোবরেট করে। অর্থাৎ সেদিন সন্ধ্যায় জলসার আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু বড় জেঠিমার মৃত্যুসংবাদ আসায় সেটা বাতিল করতে হয়। নির্মলের বাবা মধ্যাহ্ন আহারান্তে জলসাঘরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য : বাইজি যদি সন্ধ্যার আগে এসে পড়ে, তবে তাকে কিছু নগদ-বিদায় দিয়ে ফেরত পাঠানো।

জব্বর জানতে চাইলেন, শহরের আর কার কার নিমন্ত্রণ ছিল? যাঁদের আপনি খবর পাঠান যে, জলসার প্রোগাম ক্যানসেল হয়ে গেছে।

নির্মল বলে, আমার ঠিক মনে পড়ছে না স্যার, খাতাপত্র দেখে বলতে পারব।

জব্বর অবাক হয়ে বলে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাঁরা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি। আপনার বাবার বঙ্কু। তাঁদের আপনি একদফা নেমতন্ন করলেন বাপজানের আদেশে; আবার একদফা সে নিমন্ত্রণ ক্যানসেলও করলেন। অথচ খাতাপত্র না দেখে একটা নামও বলতে পারছেন না?

—পারছি না! সে অপরাধে কি আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করতে চান? আমার মনের অবস্থাটা আপনি বুঝতে পারছেন না?

ছয়

মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে জব্বর যখন ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের বাড়িতে আসেন তখন রাত সাড়ে সাত। তারামাতলায় এ-পাড়াটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তবে ডঃ মৈত্রের বাড়িটা ‘জলসাঘরে’র প্রায় বিপরীতেই বলা চলে। জমিদারেরই বাড়ি ছিল এটা। জমিদারের এক অকৃতদার নায়েব এই দ্বিতল বাড়িতে বাস করতেন। তাঁর প্রয়াণের পর ডক্টর মৈত্রের পিতৃদেব গগনচন্দ্র মৈত্র বাড়িটা কিনে নিয়েছিলেন। একতলায় তিনটি ঘর, দ্বিতলে একটি। তবে বর্তমানে বাড়িতে ওঁরা লোকও বেশি নন। ডাক্তারবাবুর বিধমা মা, স্ত্রী আর একটি ছোট বোন : তারাসুন্দরী। স্ত্রী মেমসাহেব। বিলেতে বিদ্যাজর্নের সময় এটি রবিনবাবুর ‘কঞ্জুমার্স সারপ্লাস’, অর্থাৎ সাদা বাঙলায় ডিগ্রির সঙ্গে : ফাউ। মুৎ! যদিও বছর তিনেক বিবাহ হয়েছে তবু ওঁদের এখনো কোনও সন্তানাদি হয়নি। ছোট বোনটি স্থানীয় কলেজে পড়ে।

কলবেল বাজানোতে দরজা খুলে দিলেন মিসেস সুজান মৈত্র। বৈঠকখানায় বসালেন জব্বর আর তাঁর শাগরেদকে। ভিতরে চলে গেলেন ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে। জব্বর লক্ষ্য করে দেখলেন, বৈঠকখানা ঘরটা আকারে বেশ বড়। সদর দরজার সামনেই, ঘরের মাঝামাঝি একটা কার্ড-টেবিল। তার চারপাশে চারখানি চেয়ার। বেশ বোঝা যায়, একটু আগে এখানে তাসের আসর বসেছিল। তিনদিকে তিনটি তের-তাসের হাত উপুর করে রাখা। চতুর্থ হাতটা—দরজার বিপরীতের হাতটা—নিশ্চয় ছিল ‘ড্যামি’-র। সেখানে তাস চিৎ করে বিছানো রয়েছে। কিন্তু প্রথম ডিল পেড়ে খেলা শুরু হয়নি। যে-কোনো কারণেই হোক, এই সময় হঠাৎ খেলা বন্ধ হয়ে যায়। তাসগুলো আর গুছিয়ে প্যাকেটে ভরার সময় অথবা মেজাজ কারও ছিল না।

একটু পরেই ডাক্তার মৈত্র এলেন। দীর্ঘদেহী। সুঠাম চেহারা। চোখে রিমলেস চশমা। পরনে পায়জামা। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি সিল্কের গাউন। তিনি তাঁর জবানবন্দি দিলেন—

শরীরটা ভাল না থাকায় ডাক্তারবাবু সেদিন চেম্বারে যাননি। দিবানিদ্রা দিয়েছিলেন। বিকালে এক-এক কাপ চা নিয়ে ওঁরা চারজনে বৈঠকখানায় তাস খেলতে বসেন। অশান ব্রিজ। বেলা তখন তিনটে বা চারটে। খেলছিলেন ওঁরা বাড়ির কজনই—ডাক্তারবাবু আর তাঁর মা খেঁড়ি হয়েছিলেন। তারাসুন্দরী আর তার বৌদি ওঁদের বিপরীতে। ঘণ্টাখানেক তাস খেলার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বাইরে তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। বস্তুত সকাল থেকেই বর্ষা লেগে আছে। ডাক্তারবাবু বসেছিলেন দরজার বিপরীতে। সদর দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎ ডাক্তারবাবুর নজর হলো—সামনের ওই জলসাঘর থেকে একজন মহিলা পড়ি-তো-মরি করে ছুটে আসছেন। তাঁর পরনে সালোয়ার-চু—ওড়নাটা কাদায় সসপ্,ে হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। ডাক্তার মৈত্র সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালেন। মেয়েটি— মহিলাটিই বলা উচিত—ছুটতে ছুটতে আসছিলেন। এ বাড়ির সদর দরজার কাছাকাছি এসে জলকাদায় তাঁর পা পিছলে গেল। উনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন চৌকাঠের উপর। ওঁরা ধরাধরি করে মহিলাটিকে ঘরে নিয়ে এলেন। ডাক্তার-জননী বাসন্তী দেবী ঝুঁকে পড়ে বলেন, কী হয়েছে মা! তুমি অমন করে …

মহিলাটি জলসাঘরের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে শুধু বললে : খুন!

বলেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।

একটু পরেই অবশ্য সে জ্ঞান ফিরে পায়। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো তাকে ধরাধরি করে দ্বিতলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারাসুন্দরী তার ভিজে জামা-কাপড় ছাড়িয়ে নিজের এক সেট শাড়ি-ব্লাউজ পরিয়ে দেয়। এক গ্লাস হর্লিক্স খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই মেয়েটি বলে জলসাঘরে জনার্দন জানা খুন হয়ে গেছেন। সে নাকি স্বচক্ষে তাঁকে মৃতাবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে। ডাক্তারবাবু মেয়েটিকে প্রশ্ন করে যেটুকু জানতে পেরেছেন তা এই :

ওর নাম মিস শশী মুখার্জি। থাকে কলকাতায়। ও পেশাদার বাইজি। আজ সন্ধ্যায় তার মুজরো ছিল ওই জলসাঘরে। সে কলকাতা থেকে সকাল দশটা তিনের লোকালে রওনা হয়ে বর্ধমানে আসে। স্টেশান থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা তারামাতলায় চলে আসে। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই লোকজন চিনিয়ে দেয় জনার্দন জানার জলসাঘরটা। তারপর সেই বাড়ির দারোয়ান ওকে জলসাঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। দোতলায় একটা ইজি-চেয়ারে বসেছিলেন মালিক। শশী ইতিপুর্বে তাঁকে কখনো দেখেনি, ফটোও দেখেনি। ভদ্রলোক কিন্তু ওকে চিনতে পারেন। অনেকদিন আগে কোন জলসায় বুঝি তিনি ওর ঠুংরি শুনেছিলেন। জনার্দনবাবু ওকে আপ্যায়ন করে বসালেন; কিন্তু জানালেন তাঁর হঠাৎ একটা মৃতাশৌচ পড়ে যাওয়ায় জলসার অনুষ্ঠানটা বাতিল করতে হয়েছে। তিনি ওর যাতায়াত খরচ ও খেসারত বাবদ কিছু টাকা দিতে চান। শশী তখন তাঁকে বলে, তাহলে সে তখনি কলকাতা ফিরে যেতে চায়। জমিদারবাবু বলেন, বেশ তো, তাহলে কিছু চা-জলখাবার খেয়ে যাও। শুধুমুখে তো আমি তোমাকে বিদায় দিতে পারি না। এই বলে, যে দারোয়ানটি ওকে দোতলায় পৌঁছে দিয়েছিল তাকে বলেন চা-টা নিয়ে আসতে। মিনিট পনের আলাপের পর জনার্দন বলেন, তুমি খালি গলাতেই একখানা গান শোনও বরং। মেয়েটি রাজি হয় না। বলে, আপনি বরং চাকরকে চা-খাবারের বন্দোবস্ত করতে বারণ করুন। আমি একা-একা ফিরব তো—বেশি রাত হয়ে গেলে অসুবিধা হবে। তাতে জনার্দন বলেন, আজ রাতে তো তোমার ফেরার কথা ছিল না শশী। গান-বাজনা হলে রাতটা তো তোমাকে থেকে যেতেই হতো। বাইজি রুখে ওঠে, তা আমি থাকব কোথায়? ওই খাটে? আপনি আর আমি? জনার্দন হেসে বলেন, তা কেন? তুমি একাই থাকবে। ভিতর থেকে ছিটকানি দিয়ে। আমার তো অশৌচ চলছে! আমি আমার বাড়িতেই ফিরে যাব। এইসব কথাবার্তা হতে হতে আরও অনেকটা সময় কেটে যায়। তারপর মেয়েটি বলে, ওই দরজাটা কি বাথরুমের? জনার্দন বলেন, হ্যাঁ, তুমি যাবে? যাও না। মেয়েটি দরজা খুলে বাথরুমে যায়। লোকাল ট্রেনে বাথরুম থাকে না। বর্ধমান স্টেশনেও সে তাড়াহুড়ো করে ট্যাক্সি ধরেছিল। এখন বাথরুমে ঢুকে দেখে স্নানঘরের ওদিকে আরও একটা দরজা আছে। তাতে অবশ্য ছিটকানি লাগানো। ও বাথরুমে থাকতে থাকতেই টের পায় ও-ঘরে জমিদারমশাই কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। পুরুষকণ্ঠ; কিন্তু কথাবার্তা কী হচ্ছে ও বুঝতে পারে না। ও ইচ্ছে করেই দেরি করে বেরিয়ে আসতে। আশা করে, জমিদারবাবু ওই উটকো লোকটাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দেবেন। তখনি ওর মনে হয়, পাশের ঘরে একটা বচসা চলছে। দু- চারটি উষ্ণ বাক্যবিনিময়ের পরেই পর পর দুটি অপ্রত্যাশিত শব্দ—প্রথমটি যেন আঘাতজনিত, দ্বিতীয়টি পতনজনিত। তারপরেও সে পুরো এক মিনিট অপেক্ষা করে—এইসময় সে একটি পদশব্দ শুনতে পায়। দ্রুতগতিতে বারান্দা দিয়ে এবং সিঁড়ি দিয়ে কে যেন হেঁটে নেমে গেল। তারপর চরাচর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সাহসে ভর করে মেয়েটি দরজা খুলে ঘরে ফিরে আসে। দেখে, জনার্দন জানা মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার পিছন দিকটা থেঁৎতে গেছে; আর তা থেকে ঝলকে ঝলকে রক্ত বার হয়ে আসছে। এই অদ্ভুত এবং বীভৎস দৃশ্যটা দেখে মেয়েটি বজ্রাহত হয়ে যায়। তার প্রচণ্ড ভয় করে এবং গা গুলিয়ে ওঠে। খুব তাড়াতাড়ি হাতব্যাগটা তুলে নিয়ে মেয়েটি বারান্দায় বার হয়ে আসে। কাউকে দেখতে পায় না। নিচে নেমে এসে দেখে বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আবার সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে। জনমানবের সাড়াশব্দ পায় না। জমিদারমশায়ের সেই দারোয়ানটা বোধকরি আউট-হাউসে তার ঘরের ভিতর। মেয়েটি ভেবেচিন্তে কিছু করেনি। প্রাণধারণের তাগিদে কাজ। ওই বীভৎস মৃতদেহটার কাছ থেকে সে দূরে চলে যেতে চেয়েছিল। সুরকির রাস্তাটা পার হয়ে গেট খুলেই তার নজরে পড়ে সামনের একটি বাড়িতে সদর দরজা খোলা। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনো ঘনায়নি। ও দেখতে পায়, চারজন লোক একটা টেবিলকে ঘিরে বসে আছেন। কিছু না ভেবেই সে ওইদিকে ছুটতে শুরু করে। সিঁড়ি বেয়ে সে বাড়ির দাওয়ায় উঠে আসতে গিয়ে পা-পিছলে পড়ে যায়। তারপর আর কিছু সে জানে না। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যায়।

জব্বর সেই মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে চান; কিন্তু ডাক্তারবাবু বলেন, তাকে কড়া ঘুমের ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে—ঘণ্টা আট-দশ সে অঘোরে ঘুমাবে। তারপরেও তাকে এ বিষয়ে জেরা করা ঠিক হবে কিনা তা পরদিন সকালে পরীক্ষা করে বোঝা যাবে।

জব্বর বলেন, আপনি তো বুঝতেই পারছেন, স্যার, এই জনার্দন জানার বীভৎস মৃত্যুটা জানাজানি হলেই বর্ধমানে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। পুলিশের বড়কর্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। রাজনৈতিক নেতার দলও! আপনি আজ সন্ধ্যায় ডাক্তার হিসেবে বাধা দিলে আমি নাচার। কিন্তু কাল সকালেই আমি ফিরে আসব। তখন আর বাধা দেবেন না। দিলে, আমি সিভিল সার্জেনকে কল দিতে বাধ্য হব। আর কিছু মনে করবেন না স্যার, আজ রাত্রে আপনার বাড়ির বাইরে আমি কিছু আমর্ড গার্ড-এর ব্যবস্থা করব। ওই স্টার-উইটনেস্ যদি রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায় তাহলে ওই সঙ্গে আমার সাতাশ বছরের চাকরিটাও হাওয়া হয়ে যাবে।

—কিন্তু ওই মহিলাটি প্রত্যক্ষজ্ঞানে যেটুকু জানে, যেটুকু সে স্বচক্ষে দেখেছে, তা তো আমাকে বলেইছে। আপনি নতুন করে ওর কাছে আর কী জানতে চান?

—অনেক-অনেক প্রশ্ন, স্যার। প্রথম প্রশ্ন : হাওড়া থেকে কর্ড লাইনে বর্ধমান পর্যন্ত ভাড়াটা কত?

—এই প্রশ্নের অর্থ?

—আমার ধারণা, বাইজি সেটা জানে না। বলতে পারবে না। ও একা আসেনি। যে লোকটা ওকে নিয়ে এসেছিল সেই টিকিট-মিকিট কাটে। ট্যাক্সি ভাড়া মেটায়। সে লোকটা কে, কখন সে পালিয়ে গেল জানা দরকার।

—ও যে একা-একা আসেনি এটা মনে করছেন কেন?

—ডাক্তারসাব! আমার বড়ি-আব্বা যখন ঠ্যাঙ ভেঙেছিলেন তখন আপনিই একতরফা সাওয়াল করতেন, আমি জবাব দিতাম। এখন আমাদের অবস্থানটা বদলে গেছে। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন : আজ বেলা সাড়ে বারোটা থেকে বিকাল চারটে পর্যন্ত মেয়েটি কোথায় ছিল? হিসাব জুড়ে নিন ডাক্তারসাব—দশটার লোকাল বর্ধমানে পৌঁচেছে সাড়ে বারোটায়। স্টেশনেও সে টয়লেটে যাবার সময় পায়নি। কেমন? তড়িঘড়ি ট্যাক্সি ধরে তারামাতলার দিকে রওনা হয়। তাহলে ট্যাক্সিতে এই চার মাইল রাস্তা—স্টেশান টু জলসাঘর—আসতে তার কেন চার ঘন্টা সময় লাগল?

—হয়তো সে দুপুরে কোনো হোটেলে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে খেয়ে নিয়েছে।

—চার ঘন্টা ধরে? খুব ধীরেসুস্থে খেয়েছে বলতে হবে। বেশ, তা খাক। সেক্ষেত্রে কোন হোটেলে? কী কী খেয়েছে তা তাকে বলতে হবে। যাতে আমি হোটেলে গিয়ে তদন্ত করে দেখতে পারি।

—আপনি কি সন্দেহ করছেন মিস্ মুখার্জিই খুনটা করেছেন।

—আজ্ঞে না। সেটা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় ওই জাতীয় বাইজি কক্ষণো অরক্ষিতা অবস্থায় বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় না। ট্রেনে চাপা তো অসম্ভব। অথবা একা-একা ট্যাক্সি ভাড়া করা। আমার খবর বাইজির সঙ্গে একজন ষণ্ডামার্কা দেহরক্ষী এসেছিল। কীভাবে তা জেনেছি তা জানতে চাইবেন না। সে লোকটাই টিকিট-মিকিট কাটে, ট্যাক্সি ভাড়া করে। লোকটা ওকে জলসাঘরে পৌঁছে দিয়েই ঘাপটি মারে। সচরাচর এইসব বাইজি বা দেহব্যবসায়ীর যারা রক্ষক হয় তারা সমাজবিরোধী। খুন-জখম-ডাকাতির মেয়াদ- খাটা গুণ্ডা! সুতরাং জানা দরকার :লোকটা কে, সে কখন জলসাঘর ছেড়ে চলে যায়; এবং কেন সে ওই অরক্ষিতা মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি। একা-একা এভাবে কেটে পড়ল?

—আপনি নিশ্চিত যে, মিস্ মুখার্জি একা আসেননি? তাঁর সঙ্গে একজন সঙ্গী ছিল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, নিশ্চিত। লোকটার হাতে একটা র‍্যাশান ব্যাগের থলিও ছিল। তার ভিতর কোনও পাথর-ভাঙা হাতুড়ি ছিল কিনা এটা অবশ্য এখনো প্রমাণিত হয়নি। আপনার পেশেন্টকে কবুল করতেই হবে যে, সে একা আসেনি। তাহলে কার সঙ্গে এসেছিল? সে লোকটা কখন পালিয়ে গেল? তার সঙ্গে ওর কী বন্দোবস্ত ছিল? জলসা শেষ হতে রাত বারোটা বেজে যেত নিশ্চয়—সেক্ষেত্রে বর্ধমানে ও কোথায় রাত্রিবাস করত? ওই বাইজি আর তার এস্কট্?

—এসব প্রশ্ন কি প্রাসঙ্গিক?

—আলবাৎ রেলিভেন্ট। মিস্ মুখার্জি তাঁর জবানবন্দিতে বেশ কিছু মিছে কথা বলেছেন। আমার জানা দরকার কতটা। আমার বিশ্বাস—ওর সেই যণ্ডামার্কা এস্কটাই আসল খুনী। হয়তো সে বর্ধমানেরই লোক, জনার্দন জানার পূর্বপরিচিত। হয়তো সে ওই অত্যাচারী জমিদারের দ্বারা নিগৃহীত। প্রতিশোধ নেবার সুযোগ নিতেই সে শশী-বাইজির রক্ষক হিসেবে এসেছিল। দারোয়ানটা যখন আউট-হাউসে মাছের চপ ভাজতে চলে যায় এবং ঝেঁপে বৃষ্টি নামায় পথঘাটে মানুষজনও বিরল হয়ে পড়ে, তখন সে একটা পাথর-ভাঙা হাতুড়ি-হাতে নিঃসাড়ে দোতলায় উঠে আসে। বাইজি তখন টয়লেটে। এই সমাধানটা সত্য কিনা আমাকে যাচাই করে দেখতে হবে। গুড নাইট স্যার! কাল সকালেই আমি আবার আসব

পরদিন প্রতিশ্রুতি মতো সে ডাক্তার-সাহেবের বাড়ি ফিরে আসে। ডাক্তার সাহেব জানান, ইতিমধ্যে ওঁর পোর্টবেল এক্সরে যন্ত্রে দেখা গেছে মেয়েটি ফিমার বোনে একটা হেয়ার-ক্র্যাক হয়েছে। তাকে পনের দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া সে প্রচণ্ড মেন্টাল শক্‌ও পেয়েছে। সে যাই হোক, ডাক্তার সাহেবের অনুমতি নিয়ে জব্বর বাইজিকে কিছু প্রশ্ন করেন। মেয়েটি এবার স্বীকার করে যে, সে একা আসেনি। তার সঙ্গে একজন পুরুষ সঙ্গী ছিল। তার প্রকৃত নাম, পরিচয় বা ঠিকানা সে জানে না। যিনি ওই বাইজির অভিভাবক তিনিই তার ব্যবস্থা করে দেন। অভিভাবকের নাম-ঠিকানা সে জানাতে অস্বীকার করে। কলকাতার ঠিকানাও সে জানায় না। জব্বর এ বিষয়ে পীড়াপীড়ি করেননি, কারণ তিনি জানতেন, নির্মল জানার কাছ থেকে সে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে শশী-বাইজি বলে তার বাদবাকি এজাহারে কোনও মিছে কথা নেই। লোকটি ওকে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। লোকটা কখন জলসাঘর ছেড়ে যায় তা শশী জানে না। বর্ধমান স্টেশান থেকে তারামাতলায় আসতে তার কেন চার ঘন্টা সময় লাগল সে প্রশ্নের জবাবও মেয়েটি দেয়নি। এ প্রশ্নের জবাবে বলে যে, সে একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে জবাব দেবে।

সমস্ত বিবরণটা শুনে, বাসু-সাহেব বললেন, আমিই তার সলিসিটার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি। ওর কাজিন-ব্রাদার আমার সঙ্গী এই সুরেশচন্দ্রই আমাকে এনগেজ করেছেন। আমি একবার মেয়েটির সঙ্গে এখন দেখা করতে চাই। আপনি টেলিফোনে ডাক্তার মৈত্রকে একটা খবর দিন।

সেই মতোই ব্যবস্থা হলো। টেলিফোনে সাড়া দিল ডাক্তারবাবুর ছোট বোন। দুর্ভাগ্যবশত ডক্টর মৈত্র বাড়ি নেই। গাড়ি নিয়ে আসানসোল চলে গেছেন। বার্নপুরে একজন অফিসারের মা পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। উনি সেখানেই গেছেন। কখন ফিরবেন বলা যাচ্ছে না। তবে ব্যারিস্টার-সাহেবের পরিচয় পেয়ে এবং তিনি মিস্ মুখার্জির কাজিন-ব্রাদার সুরেশচন্দ্র কর্তৃক সলিসিটার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন শুনে মেয়েটি তাঁকে তারামাতলায় আসতে বলল।

সুরেশচন্দ্র একটা হোটেলে উঠলেন। প্রথমেই তাঁর পক্ষে মিস্ মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়—বিশেষ যখন সে ইতিপূবইে এ বিষয়ে বারণ করেছে।

স্থির হলো, বাসু একটা ট্যাক্সি নিয়ে তারামাতলায় ডাক্তার-সাহেবের ডেরায় যাবেন। সুরেশের গাড়িতে নয়। সেটা শশী-বাইজির পরিচিত গাড়ি। তাতে শশী সন্দেহ করতে পারে যে, তার নিষেধ অগ্রাহ্য করে সুরেশচন্দ্র বর্ধমানে এসেছে। অসুস্থ মেয়েটির তাতে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

সাত

‘জলসাঘরের’ বিপরীতে রাস্তার ওদিকেই রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ভদ্রাসন। নেমপ্লেটে পরিচয় ঘোষিত। তাছাড়া ট্যাক্সি-ওয়ালা বাড়িটা চেনে! ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে বাসু-সাহেব এগিয়ে এসে ডোরবেল বাজালেন। একটু পরেই দরজা খুলে দিল বিশ-বাইশ বছরের একটি সুশ্রী মেয়ে। বাসু অনায়াসে তাকে চিনতে পারেন—ডাক্তারবাবুর কলেজে পড়া ছোট বোন। মেয়েটিও চিনতে পারে ওঁকে। একটু আগেই সে নিজেই টেলিফোনটা ধরেছিল। ওঁর আগমন-প্রতীক্ষাতেই ছিল। বললও সে-কথা, আপনি নিশ্চয় ব্যারিস্টার বাসু? মিস্ মুখার্জির সলিসিটার?

বাসু মাথা থেকে টুপিটা খুলে ‘বাও’ করে বলেন, আপনি নিশ্চয় মিস্ তারাসুন্দরী মৈত্র। এখানকার কলেজের ছাত্রী।

মেয়েটি হেসে বলে, ওব্বাবা! আপনি আমাকে চোখে দেখেননি, তবু নাম-ধাম জেনে ফেলেছেন?

বাসু বললেন, এ কথাটা তো আমিও বলতে পারতাম আপনাকে। কী জানেন? পরিবেশ অনেক সময় মানুষের পরিচয় বহন করে। জীবনে যাঁকে চোখে দেখেননি তাঁকে মধ্য-অফ্রিকায় একপাল নিকষকালো কাফ্রির মধ্যে একমাত্র শ্বেতাঙ্গরূপে আবিষ্কার করে স্ট্যালি-সাহেব তো অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন, ‘ডক্টর লিভিংস্টোন, আই প্রিজিয়ুম?’

তারা হেসে ফেলে। একঝাঁক কুন্দশুভ্র দাঁতের সারি।

ইতিমধ্যে বাসন্তী দেবীও এগিয়ে এসেছেন। বলেন, দাঁড়িয়ে কেন বাবা, বস।

মেয়েটির দিকে ফিরে তাকে একটা মৃদু ধমক দেন, আগে তো বসতে বলবি।

তারা বললে, সরি! বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে, আইয়ে সাব, পাধারিয়ে।

বাসু সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলেন, বেশ বোঝা যায়, বাংলাদেশ পার হয়ে এখনো বিহারে ঢুকিনি। আমি ঘরের ভিতরে এসে গেছি, ‘পাধারিয়ে’ মানে ‘পদার্পণ করুন’ বা ‘ভিতরে আসুন’–’বসুন’ নয়। তারপর বাসন্তী দেবীর দিকে ফিরে বলেন, আমি কেন এসেছি নিশ্চয় জানেন? আপনাদের বাড়িতে যে মেয়েটি পায়ের হাড় ভেঙে বাধ্যতামূলকভাবে অতিথি…

—হ্যাঁ, বাবা জানি। বস তুমি ওই সোফাটায়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, রবি তো বাড়িতে নেই, বউমাও গেছে তার সঙ্গে। অথচ…

—অথচ কী?

—রবি বারণ করে গেছে, পুলিশ, সংবাদপত্রের রিপোর্টার বা জনার্দনের আত্মীয়-বঙ্কু কেউ এসে যদি ওই মেয়েটির …

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, কিন্তু আমি তো ও-তিনের বার। আমি মিস্ মুখার্জির তরফেরই সলিসিটার। কাগজপত্র সব দেখাচ্ছি।

বৃদ্ধা কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, সবই বুঝছি বাবা, কিন্তু রবি কিংবা বৌমা ফিরে আসার আগে আমরা ওটা পারব না। সে পইপই করে নিষেধ করে গেছে। তুমি পরে একবার বরং খোঁজ নিও। রাত আটটার মধ্যে ওরা এসে যাবে নিশ্চয়।

বাসু বলেন, তাহলে ঘণ্টা দুই পরেই না হয় এসে খোঁজ করব। অথবা টেলিফোন করব। দেখি, ট্যাক্সিটা কাছাকাছিই আছে কিনা।

তারাসুন্দরী বলে, হোটেলে গিয়ে তো বইপত্র বা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাবেন। মূল লক্ষ্য তো দু’ঘণ্টা সময় অপব্যয় করা? খেয়াল-খুশিতে? তা সেই সময়ের অপচয়টা এখানেও করতে পারেন। ঘণ্টা দুইয়ের তো মামলা। আমি বরং দু-কাপ চা বানিয়ে আনি। চা না কফি?

বাসু বলেন, আমার জন্য কফি। র। শুধু কফি কিন্তু।

লক্ষ্য করে দেখলেন ঘরের মাঝখানে জব্বরবর্ণিত সেই তাসের টেবিলে তাসগুলো এখনো সেভাবেই ছড়ানো রয়েছে। তেরজন চিৎ, বাদবাকি উবুর। কেউ গুছিয়ে তা প্যাকেটে তোলেনি। বাসু জানলার ধারে একটা সোফায় বসতে বসতে সে কথাই বললেন, তাসগুলো এখনো সেদিনের মতোই টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখছি।

তারাসুন্দরী কফি বানাতে ভিতর বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, সেদিনের মতোই মানে? আপনি কী করে জানলেন?

—জব্বর সাহেব বলেছিলেন তিনি যখন তদন্তে আসেন তখনো তাসগুলো কার্ড-টেলে ওইভাবেই পড়ে ছিল। তারপর তো প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে—

বাসন্তী কৈফিয়ত দেন, এ দু’দিন কি আমাদের মাথার ঠিক ছিল, বাবা? একের-পর-এক পুলিশ, সংবাদপত্রের রিপোর্টার, পার্টির লোক, মিউনিসিপ্যালিটির হোমড়া-চোমড়া—

বাসু মেয়েটিকে বলেন, আপনারা তো অশান-ব্রিজ খেলছিলেন? কে কোথায় বসেছিলেন বলুন তো?

বাসন্তী বললেন, ওকে আবার ‘আপনি’ কেন? ও তো অনেক ছোট তোমার চেয়ে। মেয়েটি বললে, শুধু বয়সে নয়, অভিজ্ঞতাতেও। কিন্তু আমরা কে কেথায় বসেছিলাম শুনতে আপনি এত আগ্রহী কেন?

—না, মানে, খোলা দরজার বিপরীতে কে বসেছিলেন? অর্থাৎ কে প্রথম মিস্ মুখার্জিকে জলকাদার মধ্যে ছুটতে ছুটতে আসতে দেখেন?

—ওই চেয়ারটায় বসেছিলেন দাদা। তিনিই প্রথমে দেখতে পান। আপনাকে কি কিছু ম্যাগাজিন দিয়ে যাব? কারণ মা তো এখন যাবে পুজো-ঘরে, আর আমি কফি বানাতে—

বাসু বললেন, না। আমি বরং ততক্ষণ একা-একা পেশেন্স খেলি। দেখি, চারটে সিরিজ বানাতে পারি কিনা।

বাসন্তী পুজো-ঘরে চলে গেলেন, মিস মৈত্র গেল কফি বানাতে। বাসু সোফা থেকে উঠে এসে কার্ড-চেবিলে বসলেন। তাসগুলো গুছিয়ে নিয়ে শাফ্ল করলেন; তারপর টেবিলে একা- একাই পেশেন্স খেলতে বসলেন। একটু পরেই তাঁর খেয়াল হলো টেবিলে তাসের সংখ্যা বাহান্ন নয়, একান্ন। উনি গুনে-গুনে হিসাব করে দেখলেন ইস্কাবনের বিবিটা নেই। টেবিলের এপাশ-ওপাশ খুঁজলেন কিন্তু না পেলেন হারানো স্পেডের বিবিকে, না তাসের শূন্যগর্ভ প্যাকেটটা। একটু পরেই দু-পেয়ালা কফি হাতে ফিরে এল মেয়েটি। বাসু তাঁর র-কফির কাপটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে সে-কথাই বললেন, কী ব্যাপার? টেবিলে সর্বসমেত একান্নখানা তাস দেখছি যে, ইস্কাপনের বিবিটা কোথায় গেল?

মিস্ মৈত্র বললে, সে কী? কই দেখি?

সেও গুনে দেখল। না ইস্কাপনের বিবি গা-ঢাকা দিয়েছে। সে উঠে গেল। ওপাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে টেনে বার করল তাস প্যাকেটের খোলটা। তাতে দু-খানা জোকারের সঙ্গে ইস্কাপনের বিবিও লুকিয়ে ছিল। বাসু বাকি তাসগুলো ওর হাতে দিয়ে বললেন, আর পেশেন্স খেলার দরকার নেই। এস, তোমার সঙ্গে বসে গল্পই করা যাক। ওপাশে একটা ঢাকা দেওয়া তানপুরা দেখছি। গানবাজনার শখটা কার? তোমার, না, তোমার দাদা? বৌদি তো মেমসাহেব, তানপুরা বাজান না নিশ্চয়।

তারাসুন্দরী বলল, গানবাজনার শখ আমারও আছে দাদারও আছে, কিন্তু তানপুরাটা ছিল বাবার। ওটা এ বাড়িতে দু-পুরুষের বাসিন্দা। বাবা খুব ভালো ক্লাসিকাল গাইতেন। তোমার বাবা? মানে গগনবিহারীবাবু? কত দিন মারা গেছেন তিনি?

—বছর পাঁচেক। দাদা তখন বিলেতে।

—এ বাড়িটা তো তিনিই কিনেছিলেন, তাই না? বছর সাতেক আগে? তার আগে তোমরা কোথায় থাকতে?

—বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। যখন সেখানে বদলি হয়েছেন তখন সেখানেই থাকতাম। রিটায়ারমেন্ট নেবার পরেই বাবা এই বাড়িটা কিনে নেন।

বাসু সদর দরজার উপর টাঙানো একটা গ্রুপ ফটো দেখিয়ে বলেন, ওই মাঝখানে যিনি বসে আছেন, উনিই তো তোমার বাবা, তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। তাঁর ঠিক বাঁ-পাশে যিনি বসে আছেন তিনি অভিয়াসলি মা। তার পাশে আমি, তখন ফ্রক পরতাম, আর পিছনে দাদা, স্কুলের ছাত্র।

—আর তোমার বাবার ডাইনে?

—ও ছিল আমার বড় বোন, দিদি।

—ছিল?

—হ্যাঁ, মারা গেছে। টাউফয়েডে। ষোল বছর বয়সে। তা প্রায় বছর দশেক আগে।

একটু পরেই ফিরে এলেন ডঃ মৈত্র। তাঁর স্ত্রী নার্সিং পাস। তিনিও গিয়েছিলেন ডাক্তার মৈত্রের সঙ্গে বার্নপুরে। দুজনে ভাগাভাগি করে ড্রাইভিং করে।

সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, আমার মনে হয় পুলিশ মিস্ মুখার্জিকে আসামী করে কাঠগোড়ায় আদৌ তুলবে না। ফলে তার তরফে কোনো সলিসিটারের কোনো প্রয়োজন হবে কি?

বাসু বললেন, মিস্ মুখার্জিকে আসামী না করলেও, খুনীকে ধরতে পারলে শশীদেবীকে কাঠগোড়াতে নির্ঘাৎ তুলবে প্রসিকিউশান। স্টার উইটন্সে হিসাবে। ফলে, তাঁর সলিসিটারের নিশ্চয় প্রয়োজন আছে।

—কেন? যা সত্য, যেটুকু সে দেখেছে, জানে, তাই বলে যাবে।

—উনি কি কলকাতা থেকে একা এসেছিলেন?

—না। সে কথা তো মিস্ মুখার্জি পুলিশকে জানিয়েছেন।

—তা থেকে প্রশ্ন হবে, কে তাঁর অভিভাবিকা? কে ওই এস্ককে ওঁর সঙ্গে পাঠিয়েছিল? কী তার কলকাতার ঠিকানা? সে সব কথা কি মিস্ মুখার্জি পুলিশকে জানিয়েছেন?

—না জানায়নি; কিন্তু পুলিশ তা এতক্ষণে জেনেছে। নির্মল জানার কাছ থেকে। নির্মলবাবু কলকাতায় ওই ঠিকানায় লোক পাঠিয়েছিল মিস্ মুখার্জিকে এখানে আসতে বারণ করার জন্য।

–আর ওই তথ্যটা? দশটা-দুইয়ের লোকাল ঘটনার দিন বেলা বারোটা-সাতে বর্ধমান স্টেশন ইন্ করেছিল—রেলওয়ে রেকর্ড অনুসারে। আর মিস্ মুখার্জি তারামাতলায় ট্যাক্সি নিয়ে এসে পৌঁছান বেলা পৌনে চারটেয়। ফলে, প্রায় চার ঘন্টার ‘অ্যালেবাইটার হিসেব তো পুলিশ জানে না, নির্মল জানাও জানে না—আপনি জানেন? আমাকে জানাতে পারবেন?

—আমি? কী আশ্চর্য! আমি তা কেমন করে জানব?

—বটেই তো। কিন্তু মিস্ মুখার্জি নিশ্চয় সেটা জানেন। কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে পাবলিক প্রসিকিউটারের এই সঙ্গত প্রশ্নটির জবাব তাঁকে দিতে হবে। কী জবাব দেওয়া তাঁর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ তা তিনিও জানেন না, আপনিও না। জানি আমি। ফলে তাঁর কাজিন আমাকে তাঁর তরফে নিযুক্ত করে কোনও বোকামি করেননি।

–কী কৈফিয়ত দেবে শশী?

—সরি ডক্টর মৈত্র, সেটা আমি জনান্তিকে আমার ক্লায়েন্টকেই জানাতে চাই। তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?

—হ্যাঁ নিশ্চয়। যখন তাঁর কাজিন-ব্রাদার আপনাকে এনগেজ করেছেন। মিস্ মুখার্জি তাঁর সেই কাজিন-ব্রাদার সুরেশবাবুকে চিনতে পারছেন, বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন। কিন্তু একটা শর্ত। আপনি আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলবেন তা আমার উপস্থিতিতে।

—এটা আপনার ছেলেমানুষের মতো কথা হয়ে গেল ডক্টর মৈত্র। আমি তাঁকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করব—হত্যাকারীকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন? জবাবে উনি আমাকে— তাঁর সলিসিটারকে— যা বলবেন, সেটা ‘প্রিভিলেজড্ কমুনিকেশন’। প্রসিকিউশন আমাকে কাঠগড়ায় তুলে তা জিজ্ঞেস করতে পারবে না। কিন্তু আপনার উপস্থিতিতে যদি প্রশ্নোত্তরটা ঘটে, আপনি কী করবেন ডক্টর মৈত্র? সত্যি কথা বলে মিস্ মুখার্জিকে ফাঁসাবেন? না কি মিছে কথা বলে নিজে পার্জারি কেসে মেয়াদ খাটতে যাবেন? হ্যাফপ্যান্ট পরে, গলায় তক্তি ঝুলিয়ে?

ডক্টর মৈত্র গুম খেয়ে গেলেন। অধোবদনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, অলরাইট স্যার। য়ু উইন। চলুন, আপনাকে দোতলায় পৌঁছে দিই—

বাসু বললেন, তার আগে আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করার আছে। আপনি তো এই চেয়ারটায় বসে তাস খেলছিলেন, তাই প্রথমেই মিস্ মুখার্জিকে দেখতে পান। কিন্তু কখন? তিনি কি তখন জলসাঘরের ভিতরে, সুরকি-বিছানো রাস্তায়?

—আজ্ঞে না, তিনি তখন জলসাঘরের গেট খুলে সরকারি রাস্তায় নেমে পড়েছেন।

—অলরাইট। সে সময় তাঁর হাতে একটা র‍্যাশেনের ব্যাগ ছিল। সেটা কি ছিটকে পড়ল যখন তিনি পড়ে গেলেন?

ডক্টর মৈত্র অবাক হলেন, র‍্যাশনের ব্যাগ? কই না তো?

—উনি খালি হাতে ছিলেন?

—না। ওঁর বাঁ-হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ছিল। সেটা ছিটকে পড়ে। আমার স্ত্রী সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আসেন। আমরা সেটা তুলে রেখেছি।

—তার ভিতরে কী ছিল, তা কি আপনাদের চারজনের কেউ নজর করে দেখেছিলেন?

চারজনেই জানালেন : না।

বাসু-সাহেবের অনুরোধে মিসেস মৈত্র ওঁদের শোবার ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এলেন। বাসু সর্বসমক্ষে সেটা খুলে ভিতরটা দেখলেন। ফেরত দিলেন।

ডক্টর মৈত্র বলেন, র‍্যাশন-ব্যাগের কথা তখন কেন বললেন?

—আমার ইনফরমেশন :মিস মৈত্র কলকাতা থেকে একটা র‍্যাশন-ব্যাগে ভরে দুটি জিনিস নিয়ে আসেন—ওই ভ্যানিটি ব্যাগটি ছাড়া। সেই র‍্যাশন-ব্যাগের ভিতর ছিল নগদে পাঁচ হাজার টাকা এবং একটি লোডেড পিস্তল। এ বিষয়ে আপনাদের চারজনের ভিতর কেউ কিছু জানেন কি?

ডক্টর মৈত্র আবার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, লোডেড পিস্তল? ও সেটা কোথায় পাবে?

বাসু প্রতিপ্রশ্ন করেন, ওর সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন ডক্টর মৈত্র, যে, আমি রাম- শ্যাম-যদু কারও নাম বললেই আপনি বুঝে নেবেন?

মৈত্র থতমত খেয়ে বলেন, তা বটে। আজ্ঞে না, নগদ পাঁচ হাজার টাকা, পিস্তল বা র‍্যাশন- ব্যাগ সম্বন্ধে আমরা কেউ কিছুই জানি না।

—আপনারা এই টেবিলে বসে চা-পান করতে করতে তাস খেলছিলেন। তাসের বান্ডিলটা তো সময়ের অভাবে গুছিয়ে তোলা যায়নি; কিন্তু চায়ের কাপগুলো কোথায় গেল?

—কী আশ্চর্য! এটা কি একটা প্রশ্ন হলো? এ দু-দিন আমাদের তাস খেলার অবকাশ হয়নি তাই তাসের বান্ডিলটা গুছিয়ে তোলা হয়নি; কিন্তু এ দু-দিন আমরা চা তো খেয়েছি। সুতরাং…

কথার মাঝখানেই বাসু বলে ওঠেন, কতক্ষণ তাস খেলেছিলেন? কটা ‘রাবার’?

মৈত্র বিরক্ত হয়ে বলেন, কটা ‘বাবার’ তা মনেনেই। তবে ঘণ্টা দেড়েক খেলেছিলাম, কি বল সুজান?

সুজান হ্যাঁ-না কিছুই বলে না।

বাসু বলেন, আর একটা প্রশ্ন ডক্টর মৈত্র। আপনাদের এই এলাকাটা বেশ নির্জন—শহরের একান্তে। শহরবাসী জানে, আপনি বিলাতফেরত ডাক্তার, প্রচুর পশার। আপনি বাড়িতে একটা ফায়ার-আর্ম রেখেছেন তো? বন্দুক?

—না বন্দুক নেই, একটা রিভলভার লাইসেন্স নেওয়া আছে।

–সেটা কাইন্ডলি একবার দেখাবেন?

–কেন বলুন তো?

—আপত্তি আছে?

—না, না, আপত্তি কিসের?

এবার আর স্ত্রীকে বললেন না। নিজেই শয়নকক্ষে থেকে নিয়ে এসে যন্ত্রটা দেখালেন। সিক্সচেম্বার ভারী রিভলভার। চেম্বারে ছয়টি গুলি ভরা আছে। বাসু-সাহেব চেম্বার খুলে দেখলেন। তারপর সেটা বন্ধ করে ডাক্তার সাহেবের হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, চলুন এবার দোতলায় যাওয়া যাক।

বাসন্তী দেবী আর সুজান নিচেই রয়ে গেলেন। বাকি তিনজন সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন দ্বিতলে। মিস্‌ মুখার্জি শুয়ে ছিল ঘরের খাটে। তার বাঁ-পায়ে প্লাস্টার করা। দরজাটা হাট করে খোলা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন বাসু-সাহেব। তর্জনীসঙ্কেতে একজোড়া সাদা সোয়েডের লেডিজ-শ্য দেখিয়ে মিস্ মৈত্রকে প্রশ্ন করেন, এ জুতো-জোড়া কি তোমার, না মিস্ মুখার্জির?

তারাসুন্দরী জবাব দেয় না। তার দাদার দিকে তাকায়। ডক্টর মৈত্র বলেন, এটা মিস্‌ মুখার্জিরই। কেন?

—সাদা সোয়েডের জুতোটায় জলকাদা লাগেনি তো?

মিস্ মৈত্র বলে, আজ্ঞে না, লেগেছিল। আমিই ধুয়ে সাফ করে রেখেছি। দামী জুতো- জোড়া তো?

—তা বটে। তাহলে এখান থেকেই আপনারা বিদায় হন। আমি আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিজেই আলাপ-পরিচয় করে নেব। কেমন?

আট

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে নেমে এলেন বাসু-সাহেব। দেখলেন চারজন আতঙ্কিত গৃহস্থ তাস-টেবিলের চারপাশে ঘন হয়ে বসে আছেন। নিচু গলায় কী যেন পরামর্শ করছেন। বাসু-সাহেবকে দেখেই সবাই সচকিত হয়ে পড়েন। বাসু বলেন, থ্যাঙ্কু লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। আমার কাজ সারা হয়েছে। মিশন সাসেসফুল। এবার চলি আমি।

বাসন্তী বললেন, ওর…মানে ওই মেয়েটির কোনো বিপদ নেই তো?

বাসু ইতিমধ্যে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছেন। বললেন, না, মাসিমা। আপনার বাড়ির ওই অনিমন্ত্রিত ক্ষণিক অতিথির আর কোনো বিপদ নেই। শুধু তাই নয়, আপনাদের চারজনেরও আর ভয়ের কিছু নেই। আমি আপনাকে নিশ্চিন্ত করে যাচ্ছি। জনার্দন জানার প্রকৃত খুনীকে পুলিশ কোনোদিনই খুঁজে পাবে না।

ডক্টর মৈত্র বলেন, কিন্তু পুলিশ তো কলকাতায় ওর ঠিকানায় গিয়ে সেই গুণ্ডাপ্রকৃতির লোকটার নামধাম সব জানতে পারবে।

বাসু বলেন, তাতে কী? সে তো বর্তমানে গৌহাটি থেকে গুজরাট, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীরের ভিতর যেকোনো একজন অচিহ্নিত ভারতবাসী!

—কিন্তু পুলিশ যদি কোনো ভুল লোককেই আসামীর কাঠগোড়ায় তোলে? আর মিস্ মুখার্জিকে সাক্ষীর কাঠগোড়ায় ওঠায়? স্টার উইটনেস ফর দ্য প্রসিকিউশান হিসাবে? ওর এই চার ঘণ্টা বেহিসারী সময়টার কী কৈফিয়ত সে দেবে?

—চার ঘণ্টা বেহিসাবী সময়! মানে? কোন চার ঘণ্টা?

—বাঃ! দশটা দুইয়ের বর্ধমান লোকালে হাওড়া থেকে রওনা হলে…

বাধা দিয়ে বাসু বলেন, তার কোনো এভিডেন্স আছে? ও আদৌ দশটা-দুই বলেনি। ট্রেনটা তো হাওড়া ছাড়ে একটা পঞ্চাশে। প্রসিকিউশনের ক্ষমতা হবে সেটা অপ্রমাণ করার?

—কিন্তু পুলিশের কাছে প্রথম এজাহারে-

—ওঃ পুলিশের কাছে! কোনো ফার্স্টক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্ট্যাম্পকাগজে দেওয়া জবানবন্দি তো নয়। পুলিশ তো ওকে ফাঁসাবর জন্য, অথবা ভুল করে ট্রেনের সময়টা গড়বড় করেছে। প্রয়োজন হলে দেখবেন, একাধিক সাক্ষীর সন্ধান পাওয়া যাবে, যারা হলফ্ নিয়ে বলবে, ওকে হাওড়া স্টেশনে একটা পঞ্চাশের মেনলাইন বর্ধমান লোকালে উঠিয়ে দিয়ে গেছিল।

বাসন্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দু-চোখে জল টলটল করছে। ধরা গলায় বললেন, তোমাকে একটা কথা বলব, বাবা?

—বলুন, মাসিমা।

—অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি আমাদের সঙ্গে যাহোক দুটি খেয়ে নাও। রবি তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বাসু হাসলেন। বললেন, তা হয় না, মাসিমা। মিস্ শশী মুখার্জি আপনার বাড়িতে অনিমন্ত্রিত এসে পাত পেড়ে যাহোক দুটি খেতে পারেন। সে অধিকার তাঁর আছে। কী অধিকার তা আপনি জানেন। আমি তা পারি না।

বাসন্তী ম্লান হয়ে গেলেন।

বাসু বলেন, এবার আমি আপনাকে একটা কথা বলব, মাসিমা?

—বল বাবা?

ওয়ালেট খুলে একটা নামাঙ্কিত কার্ড বার করে বৃদ্ধার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এই হাঙ্গামার দিন কটা কেটে যাক। মাসখানেক পরে আপনার সুবিধামতো আমরা তিনজনেই এসে চর্বচূষ্য নিমন্ত্রণ খেয়ে যাব। রবিবাবুকে বলবেন ট্রাঙ্ককলে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে।

বাসন্তী বিহ্বলের মতো বলেন, তিনজনে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার মেয়ে-জামাইয়ের সাথে একসঙ্গেই পাত পেড়ে খেয়ে যাব আমি।

তারাসুন্দরী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বলে, ও ব্বাবা! সেটা মাসখানেকের মধ্যেই হবে কী করে? আমার বিয়ে কি এ মাসেই হবে নাকি? কার সাথে?

বাসু ধমকে ওঠেন, বোকার মতো হেসো না তারা। আমি কথাটা তোমাকে বলিনি। বলেছি তোমার মাকে!

চোখের সেই দু-ফোঁটা জলকে আর ধরে রাখা গেল না। এতক্ষণে মাটিতে ঝরে পড়ল।

.

বাসু-সাহেব থামতেই সুজাতা বলে, তারপর? গল্পটা শেষ করুন।

বাসু বলেন, ওমা! আবার কী শেষ করব গো? গল্প তো আমার শেষ হয়ে গেছে।

—বাঃ শর্ত ছিল, আপনি এমন একটা গল্প বলবেন, যেখানে আসামীকে চিহ্নিত করেও আপনি তাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে শশীর এস্কটের নামই তো আপনি জানতেন না।

বাসু বলেন, কী রানু, তুমি কী বল?

রানু বলেন, আমি কী বলব? গল্পটা তো আমার জানা। আমিই তো ধরতাইটা তোমাকে প্রথমে ধরিয়ে দিলাম, ইস্কাপনের কাঁটা!

বাসু এবার এ-পাশ ফিরে বলেন, ভাগ্নে, তুমি কী বলছ?

কৌশিক বলে, হ্যাঁ শর্তানুসারে খুনীকে আপনি চিহ্নিত করেছেন, তাকে পালিয়ে যাবার সুযোগও দিয়েছেন। কিন্তু কী করে আপনি কেসটা সল্ভ করলেন বুঝে উঠতে পারছি না

–কেন? অ্যানোম্যালিগুলো নজরে পড়ছে না?

—তা কেন পড়বে না! প্রথম কথা, চারজন দেড়-দু’ঘন্টা ধরে তাস খেলতে পারে না, যেখানে তাসের সংখ্যা বাহান্ন নয় একান্ন। স্পেডের বিবি জোকারদের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছে। দ্বিতীয়, টাইম ফ্যাকটারেও একটা বিরাট গণ্ডগোল। ঘটনা আটচল্লিশের তখন শশিমুখীর বয়স পঁচিশ। বর্মা থেকে বাঙালিদের ইভ্যাকুয়েশান হয় একচল্লিশে-বেয়াল্লিশে। হিসাব মতো তখন শশীর বয়স আঠার-উনিশ হবার কথা। সে তখন ফ্রক পরা নাবালিকা হতে পারে না। জনার্দন জানাই নাকি পঞ্চদশী অবস্থায় তাকে লক্ষ্ণৌতে দেখেছেন খুন হবার বছর দশেক আগে। সুতরাং শশীর বাল্য-কৈশোরের কাহিনীটা আদ্যন্ত বানানো। কিন্তু তা থেকে আপনি কী করে আন্দাজ করলেন…

বাসু বললেন, দুটো ক্লু অবশ্য আমার আস্তিনের তলায় রয়ে গেছে। অর্থাৎ যা আমি জানতে পেরেছি, তোমরা জান না। সে দুটির কথা বলার আগে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি নামের ব্লু-টা নজরে পড়েছিল তোমাদের?

কৌশিক বলে, হ্যাঁ, সেটাও খেয়াল হয়েছিল। গগনবাবুর তিনটি সন্তান। বড়টি রবি—’গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা’। ছোটটি ‘তারা’। এর মাঝে যদি একটি মেয়ে হারিয়ে যায়—টাইফয়েডেই হোক অথবা কুলত্যাগিনী হওয়ায়, তার নাম কী হতে পারে? তাই ‘রবি-শশী-তারা’র সূত্রটা নজরে পড়েছিল। গগনবাবুর ক্লাসিকাল গানের পারদর্শিতা—যা ‘জীন’ সূত্রে রবি-তারা পেয়েছে, তা শশীরও পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আরও একটা সূক্ষ সূত্র : ডাক্তার মৈত্র বারে বারে বাইজির প্রসঙ্গে ‘আপনি-তুমি’ গুলিয়ে ফেলেছিলেন। একটু আতঙ্কগ্রস্ত হলেই তাঁর অবচেতনে অপরিচিতা বাইজি হয়ে যাচ্ছিল ছোট বোন। কিন্তু খুনটা করল কে? কীভাবে?

বাসু বললেন, যে দুটো ব্লু আমার আস্তিনের তলায় লুকানো আছে তার একটা হচ্ছে ওই গ্রুপ ফটোটা। দশ বছরে চেহারার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু তবু শশীকে চিনতে পেরেছিলাম আমি। এই ব্লুটা ‘ভিশুয়াল’–তোমাদের জানাতে পারিনি। আর দ্বীতিয়টা শশীর ‘আনরিজার্ভড কনফেশান’। লীগ্যাল ‘প্রিভিলেজড কমুনিকেশন’ বস্তুটা কী তা ঠিকমতো সমঝে নেবার পর শশী তার সব কথাই আমাকে খুলে বলেছিল। তাকে আমি বলেছিলাম, আদালতে সাক্ষীর কাঠগোড়ায় এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে সে বলবে ‘আমার লীগ্যাল- কাউন্সেলারকে এ-প্রশ্নের জবাব আমি দিয়েছি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন। আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে এ প্রশ্নের জবাব দিলে আমি নিজেই নিজেকে ‘ইন্‌ক্রিমিনেট’ করব।’

সুজাতা প্রশ্ন করে, শশী নিশ্চয় দশটা দুইয়ের ট্রেনেই এসেছিল। সে কি তার দাদার বাড়ির ঠিকানা জানত?

—জানত। গগনবাবুর খুব ন্যাওটা মেয়ে ছিল শশী। কুলত্যাগিনী কন্যাকে যে তিনি ক্ষমা করেছিলেন, তার সঙ্গে যে গোপন পত্রালাপ করতেন, তা তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকেও গোপন রেখেছিলেন। তাই বাসন্তী দেবী, রবি বা তারাসুন্দরী শশীর ঠিকানা জানত না; কিন্তু শশী জানত তারামাতলার বাড়ির ঠিকানাটা। বর্ধমান স্টেশান থেকে সে সরাসরি চলে আসে তার মায়ের কাছে। চার ঘণ্টা বেহিসাবী সময়ের প্রথম ঘণ্টা তিনেকের অশ্রুপ্লাবিত ইতিহাসটা শশী আমাকে বলেনি; কিন্তু শেষ এক ঘণ্টার কথা বলেছিল। রবিই পরিকল্পনাটা ছকে। সে লোডেড রিভলভারটা নিয়ে জলসাঘরের পিছনের বাগানে লুকিয়ে পড়ে। আমি সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। তাই তার আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। শশীকে যখন কানাই দোতলায় পৌঁছে দেয় তখন শশীর হাতে ছিল র‍্যাশন-ব্যাগ। তাতে পাঁচ হাজার টাকা নগদে, আর সুরেশের পিস্তলটা। পরিকল্পনা মতো দ্বিতলে উঠে গিয়ে শশী প্রথম সাক্ষাতেই জনার্দনকে ওই প্রশ্নটা করে—’ওইটা কি বাথরুম’। ইনফ্যাক্ট তখনো কানাই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়নি। জনার্দন তাকে বাথরুমের রাস্তাটা দেখিয়ে দেন। শশী সে ঘরে ঠুকেই ম্যাথরখাটা-দরজাটা খুলে দেয়। রবি এসে বাথরুমে লুকায়। তারপর শশী দরজা খুলে শয়নকক্ষে ফিরে এসে দেখে, জনার্দন ইতিমধ্যে দরজায় ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর আর তর সইছিল না। শশী টাকা বা পিস্তলটা ব্যাগ থেকে বার করার সুযোগই পায়নি। জনার্দন ব্যাঘ্রঝম্পনে শশীকে আক্রমণ করেন। পালঙ্কের উপর চিৎ করে পেড়ে ফেলেন। শশীর পরনে শাড়ি-ব্লাউজ ছিল না। ছিল সালোয়ার কামিজ। জনার্দন তাই সহজে ওকে বিবস্ত্র করতে পারেননি। শশী মৰ্মান্তিক চিৎকার করে ওঠে।…ঘটনার বাকি অংশ বলবার অপেক্ষা রাখে না। রবি রিভলভার নিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো তা থেকে ফায়ার করেনি। সে হত্যা করতে চায়নি। জনার্দনের হাত থেকে নিজের বোনের ইজ্জৎ বাঁচাতে চেয়েছিল। তাই রিভলভারের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে জর্নাদনের মাথার পিছন দিকে আঘাত করে। উত্তেজনার জন্যই হোক বা প্ৰচণ্ড ক্রোধে অথবা হিতাহিত জ্ঞান হারানোতে আঘাতটা আসুরিক হয়ে যায়। জনার্দনের সেরিবেল্লাম চৌচির হয়ে যায়। রবি কামুক লোকটার ঠ্যাঙ ধরে দরজার দিকে কিছুটা টেনে আনে। তারপর র‍্যাশনের থলিটা উঠিয়ে নিয়ে স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে নিচে বাগানে নেমে যায়। তখন জোর বৃষ্টি নেমেছে। চরাচর শূন্য। শশী বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি দিয়ে, মৃতদেহ ডিঙিয়ে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে আসে। কানাই তখন চপ ভাজতে ব্যস্ত। ত্রিসীমানায় কেউ নেই।

নিজের বাড়িতে ফিরে আসার পর ওর সত্যিই একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। তাকে অন্যত্র পাচার করা সম্ভবপর ছিল না। কানাই তাকে দেখেছে, শনাক্ত করতে পারবে। কোনোক্রমে ধরা পড়লে পলাতকার কেসটা নিদারুণ খারাপ হয়ে যেত। তাই ওই তাসখেলার গল্পটা ফাঁদা হয়। তাড়াহুড়োয় ইস্কাপনের বিবিটা জোকারের সঙ্গে ‘ইলোপ’ করার সুযোগ পেয়ে যায়। তাস খেলার এভিডেন্সটা জোরদার করতে দু’দিন ধরে তাসের টেবিলে হাত দেওয়া হয়নি। না হলে মিস মৈত্র শশীর জুতোর কাদা ছাড়িয়ে জুতো সাফ করার সময় পেল আর তাসগুলো গুছিয়ে প্যাকেটে ভরতে পারল না? সর্বোপরি ‘দিদি’ না হলে অচেনা বাইজির জুতো ওই কলেজের ছাত্রীটি সাফ করত থোড়াই!

আশা করি সব সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। আমার গল্পের আর কিছু বুঝিয়ে বলার আছে?

রানু বললেন, আছে বইকি। উপসংহার। বাসন্তী দেবী মাসখানেক পরে মেয়ে-জামাই আর তাদের সলিসিটারকে কী কী পদ রেঁধে খাওয়ালেন?

—না, খাওয়াননি। শশী রাজি হয়নি দ্বিতীয়বার বর্ধমানে যেতে। তারাসুন্দরীর বিয়ের কথা ভেবে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেকার সমাজ তো! দুনিয়ার দৃষ্টিতে গগন থেকে শশী অস্ত গেছে। টাইফয়েডে নয়, স্বেচ্ছায় কুলত্যাগিনী মেয়েটা পরিবারের নিরিখে চলে গেছে চিরকৃষ্ণপক্ষে। কিন্তু বাসন্তী বা রবিরা তা মানতে চাইতো না। তাই প্রতিবছর পূজাবকাশে ওরা একসাথে ভারতভ্রমণে বেরিয়ে পড়ত। রবি-শশী-তারা, তাদের মা এবং সুজান আর সুরেশ। সেটা শশীর শুক্লপক্ষ। আমি যেহেতু আদালতে সওয়াল করতে উঠিনি তাই কোনও ‘ফী’ নিইনি। তবে একবার ওদের সঙ্গে, ওদেরই খরচে, রাজস্থান ইত্যাদি বেড়াতে গিয়েছিলাম। মাণ্ডুর সেই বাজবাহাদুরের ভাঙা রাজপ্রাসাদে ‘রূপমতী’ শশিমুখী আমাকে গেয়ে শুনিয়েছিল একখানা দরবারী কানাড়া—মেজাজী রাগ, সুর ফাঁকতালে : ‘বাজত ‘ঝাঁঝ-মৃদঙ্গ’!

তারপর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। তবু আজও কানে : ‘বাজত ঝাঁঝ-মৃদঙ্গ!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *