গঙ্গার ইলিশ – প্রনাবি
পণ্ডিতেরা বলেন কাজই নাকি মানবজীবনের লক্ষ্য। হয়তো তাই! কিন্তু এ সব অকাজের কথা ভাবিবার অবসরটুকু অন্তত পণ্ডিতদের আছে। আমার তা-ও নাই। আমার কর্মতালিকা দেখিলে পণ্ডিতদেরও স্বীকার করিতে হইত—কিছু বাড়াবাড়ি হইতেছে।
সকালে পাড়ায় দুটি ছেলে পড়াই। ছাত্র দুটির পিতা সত্যই পুত্রের শুভানুধ্যায়ী—পাঠের সময়ে তাঁরা কাছেই বসিয়া থাকেন—একটাও বাজে কথা বলিবার সময় পাই না। একজনের মাছ কিনিয়া দিবার ভার আমার উপরে আসিয়া পড়িয়াছে। উক্ত পিতা মৃদু হাসিয়া বলেন—মাস্টারমশায়, একবার বাজার থেকে, ওরে রামা সঙ্গে যা। আচ্ছা আপনি এগোন—রামা যাচ্ছে।
বলা বাহুল্য রামা যায় না—আমি একাই যাই এবং মাছ কিনিয়া আনি।
চাকরের হাতে মাছ কিনিবার ভার দিলে চুরির আশঙ্কা; আমাকে দিয়া সে ভয় নাই, হাজার হোক নোব্ল প্রফেশানের লোক তো। বাঙালি পিতাদের প্রাইভেট টিউটারদের উপরে অগাধ বিশ্বাস।
আহারান্তে সাড়ে দশটায় আসল কর্মস্থলে যাই। আমি জুট মিল বিদ্যাকেন্দ্রের অধ্যাপক। দশটা হইতে ছাত্ররা আসিতে থাকে; এগারটার মধ্যে বাড়ি ভরিয়া যায়; আড়াই হাজার গাঁট ছাত্র-সংখ্যা আমাদের। বছরে বছরে দেড় হাজার গাঁট শক্ত করিয়া বাঁধিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য পাঠাইয়া দিই; সেখানে ভালমন্দ মাঝারি দর কষা হইয়া থাকে। আমাদের কাজকে প্রায় নিষ্কাম বলা যাইতে পারে; বেতন এতই অকিঞ্চিৎকর মাসের প্রথম দিনের পরে হাতে আর কিছু থাকে না। তবে নোব্ল প্রফেশানের লোক বলিয়া দোকানে বাকি পাওয়া যায়। হায় হায়, তোক ঠকাইবার মরাল কারেজও আমাদের নাই—একথা সবাই জানিয়া ফেলিয়াছে। জুট মিল বিদ্যাকেন্দ্রের মালিক সুবিধাজনক পোষমানা একটা মৃগী ব্যারাম অর্জন করিয়াছেন, বেতন বৃদ্ধির কথা তুলিলেই তিনি মূর্ছা যান।
সন্ধ্যাবেলাতেও ছুটি নাই, রাত্রে জুট মিলে বাণিজ্য শিক্ষা দিই। ব্ল্যাক আউটের রাত্রি বাণিজ্য শিক্ষার উপযুক্ত সময় বটে। রাত্রি ন’টায় ছুটি। কলিকাতা শহরে নিতান্তই চৌকিদারি প্রথা নাই—নতুবা রাত্রিটা চৌকিদারি করিয়া কাটাইয়া দিতাম। কাজের জন্যই যখন মানুষের জন্ম তখন আর এটুকু ফাঁক থাকে কেন?
সেদিন রাত্রি ন’টার সময়ে জুট মিল হইতে বাহির হইতেছি, সহকর্মী বলিলেন, চলুন, বৈঠকখানা বাজার থেকে মাছ নিয়ে যাওয়া যাক। তার পরে একটা ঢোক গিলিয়া বলিলেন, রাত্রে ইলিশ মাছ সস্তা হয়।
আমি বলিলাম—চলুন।
মনে মনে ভাবিলাম, পরের জন্যই তো মাছ কিনিয়া আসিতেছি, নিজের জন্য তো কিনিবার কখনো অবসর হয় না।
সহকর্মী বাজারে ঢুকিয়া পড়িলেন, বুঝিলাম তিনি মাঝে মাঝে আসেন। ঝুড়ির মধ্যে স্নিগ্ধ চিক্কণ গঙ্গার ইলিশগুলি চক্রাকারে সজ্জিত, ছোট, বড়, মাঝারি; কোনটা বা তৃতীয়ার চন্দ্রকলা, কোনটা বা চতুর্থীর, কোনটা পঞ্চমীর, কোনটা ষষ্ঠীর।
সের নয় সিকে। সহকর্মী বলিলেন, কাল যে দেড় টাকা ছিল। ওহে গণেশ—
গণেশ মৎস্যবিক্রেতা। সে যেন কি একটা বলিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে অন্য একজন খদ্দের আসিতেই তার প্রতি মনোনিবেশ করিল। সহকর্মী আগামীকল্যের আশায় রহিলেন—আমার এই প্রথম (এবং শেষও বটে) তাই এক সেরের একটা মাছ কিনিয়া ফেলিলাম। সঙ্গে একটা কাগজের থলে ছিল—মাছটা তাতে ভরিলাম। কেবল শুভ্র পুচ্ছটি বৃদ্ধের পাকা গোঁফের মতো বাহির হইয়া রহিল।
সহকর্মী বলিলেন, আপনি এগোন। বুঝিলাম গণেশ ও তাঁহার মধ্যে এখন ধৈর্য পরীক্ষার দড়ি-টানাটানি চলিতে থাকিবে।
হ্যারিসন রোডের মোড়ে ট্রামে উঠিতে চেষ্টা করিতেছি। প্রত্যেকখানা গাড়িতেই সূচীভেদ্য ভিড়। সাতখানা ট্রাম ছাড়িয়া দিয়া রবার্ট ব্রূসের কীর্তিকে খর্ব করিয়া অষ্টম ট্রামে উঠিয়া পড়িলাম। ভিড়ের জন্য সরলভাবে দাঁড়ানো সম্ভব হয় নাই; দেহখানা তিন চার দফা বাঁকিয়া গিয়াছে, কিন্তু হাতে সেই খামখানা ঠিক আছে—তার ফাঁক দিয়া মৎস্য-পুচ্ছ দৃশ্যমান।
গাড়ি ছাড়িয়া দিল। তারপরে যা ঘটিয়া গেল একটি মুহূর্তের মধ্যে। একজন পুছিল—কোথায় কিনলেন মাছটা?
—আজ্ঞে বৈঠকখানা বাজারে।
তিনজন সমস্বরে পুছিল—কত নিলে?
নোব্ল প্রফেশানের লোকেরা চেষ্টা করিলেও মিথ্যা কথা মুখে টানিয়া আনিতে পারে না। কিন্তু কে যেন আমায় মুখ দিয়া বলিয়া ফেলিল—আজ্ঞে পাঁচ সিকে।
ট্রামের সেই সূচীভেদ্য জনতা ঐকতানে চিৎকার করিয়া উঠিল—পাঁচ সিকে!
ট্রামখানা ঘুরিয়া যেমনি শিয়ালদ স্টেশনের মুখে থামিয়াছে, অমনি সেই জনতা মুহূর্ত মধ্যে একজনবৎ ট্রাম হইতে নামিয়া পড়িল—এবং পরক্ষণেই মিলিটারি লরি অগ্রাহ্য করিয়া বৈঠকখানা বাজারের মুখে ছুটিয়া চলিল। কে বলিল বাঙালির মধ্যে একতার অভাব! তবে তেমন তেমন উপলক্ষ্য তো চাই।
ট্রাম খালি হইয়া গেল। নিতান্ত কর্তব্যবোধে না বাধিলে বোধ করি কন্ডাক্টারও যাইত। আরামে বসিয়া পড়িলাম। বাঙালির মৎস্যপ্রীতি ও যুদ্ধের বাজার সম্বন্ধে অনেক কথা চিন্তা করিতে লাগিলাম, কেবল ভয় ছিল হতাশ জনতা দ্রুততর বেগে ফিরিয়া আসিবার আগে ট্রামখানা এ অঞ্চল ছাড়িয়া গেলে হয়। ব্যাপারখানা হাস্যকর, মনে মনে একটু হাসিলামও বটে। কিন্তু তখনও কি জানিতাম এই মৎস্যক্ৰয় কী মাৎস্যন্যায়ে পরিণত হইবে!
নির্বিঘ্নে বাসায় পৌঁছিলাম। গৃহিণীর হাতে মাছটি দিলাম।
—কত নিলে?
—পাঁচ সিকে।
বারংবার আবৃত্তির ফলে মিথ্যাও নাকি সত্য হইয়া উঠে—
—পাঁচ সিকে।
গৃহিণীর মুখে এই প্রথম আমার বুদ্ধির প্রতি প্রশংসার আভা দেখিলাম।
তারপরে আমাকে ছাড়িয়া মাছটি লইয়া পড়িলেন এবং অবশেষে মাছটি ছাড়িয়া চাকরকে লইয়া পড়িলেন।
—হাঁ, হরি, তুমি মাছ কিনতে গেলে তিন টাকা সের লাগে—আর দেখ তো বাবু কেমন পাঁচ সিকের মাছ কিনে এনেছে।
হরি কি যেন বলিতে গেল কিন্তু গৃহিণীর ব্লিৎসক্ৰিগের সম্মুখে সে দাঁড়াইতে পারিল না।
পরদিন প্রাতে হরিকে আর দেখা গেল না। হরি খদ্দর পরে, মেদিনীপুরের লোক, তার আত্মসম্মান কিছু উগ্র। সে যে চৌরাপবাদে পালাইবে—কিছু বিস্ময়ের নয়।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপারও ছিল। খবরের কাগজ খুলিতেই চোখে পড়িল, বৈঠকখানার বাজারে দাঙ্গা। মৎস্যক্রেতা ও জেলেদের মধ্যে মাছের দর লইয়া ছোটখাটো এক দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে। বুঝিতে বিলম্ব হইল না—এ আমার সেই মৎস্যপ্রিয় জনতার কীর্তি।
বিকাল বেলা বেড়াইতে বাহির হইব, এমন সময়ে গৃহিণী আমার হাতে পাঁচ সিকে পয়সা দিয়া বলিলেন—আসবার সময়ে কালকার মতো একটা মাছ নিয়ে এসো।
কি সর্বনাশ! এজন্য তো প্রস্তুত ছিলাম না। বলিলাম—আজ তো জুট মিল ছুটি। রবিবার যে।
গৃহিণী বলিলেন—কিন্তু বাজার তো ছুটি নয়। ওবেলা আবার বাজার হয়নি, চাকর পালিয়েছে।
তারপরে আরো তিন দফা পাঁচ সিকে হাতে দিয়া বলিলেন—ওই তিন বাড়ির গিন্নীরা দিয়েছে—তাদের জন্যেও তিনটা।
পাড়াতে তিনটি বাড়ির সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আছে। আমার গৃহিণী দুপুর বেলা সে-সব বাড়িতে গিয়া স্বামীর অসাধারণ সাফল্যের বার্তা ঘোষণা করিয়াছেন এবং আসিবার সময়ে মাছের সুলভ মূল্য লইয়া আসিয়াছেন।
অগত্যা গৃহিণীর স্বামীর মর্যাদা রক্ষার জন্য চার দফা পাঁচ সিকে পয়সা লইয়া যাত্রা করিলাম। বাজারে পৌঁছিয়া ভাবিলাম যা করেন সিদ্ধিদাতা গণেশ।
সিদ্ধিদাতা গণেশই বটে! পূর্বোক্ত গণেশ তখন দুই ঘটি সিদ্ধি ঘুটিয়া পার্শ্ববর্তীর হাতে এক ঘটি দিতেছিল। সে আমাকে দেখিয়াই চিনিল। নোব্ল প্রফেশানের লোক দেখিলেই চেনা যায়।
—কত করে হে?
—আজ্ঞে বাবু আজ খুব সস্তা। তিন টাকা।
—সে কি হে?
—আজ মাছের আমদানি কম!
মাছেরাও সুযোগ বুঝিয়া ধর্মঘট করিয়া বসিয়াছে। চারটি মাছ কিনিয়া বাড়ি ফিরিলাম। জুতা কিনিবার জন্য একখানা দশ টাকার নোট রাখিয়াছিলাম—সেখানা ঘাটতির পথে গঙ্গার ইলিশের পিছনে গঙ্গাজলে গিয়া পড়িল। সবটা গঙ্গাজলে পড়িলেও সান্ত্বনা ছিল—অধিকাংশই সিদ্ধিদাতা গণেশের ফাঁকে আটকাইয়া রহিল।
নিজের ও পরের গৃহিণীরা আমার বিস্ময়কর চাতুর্যে খুশি হইলেন।
পরদিন শুনিলাম তাঁদের চাকর তিনটিও পলাতক। সকলেই মেদিনীপুরের লোক—খদ্দর পরে।
তারপর হইতে এখন সন্ধ্যাবেলা নিয়মিতভাবে ঘাটতি দিয়া গঙ্গার ইলিশ আমদানি করিয়া পাড়ার গৃহিণীদের বিস্ময় উদ্রেক করিতেছি। কিন্তু এমন করিয়া আর কয়দিন চলিবে? জুট মিল হইতে বেতনের মধ্যে কিছু অগ্রিম লইয়াছিলাম তাহাও নিঃশেষ। এখন কি করিব?
সত্য কথা বলিব কি? না মাছ খাওয়া ছাড়িব? না মাছ কন্ট্রোল হইয়াছে বলিব? কন্ট্রোল হইলেই যে দাম বাড়ে—একথা গৃহিণীরাও জানেন।
সত্য বলিলে কেহ বিশ্বাস করিবে না—বিনয় বলিয়া উড়াইয়া দিবে। মাছ খাওয়া ছাড়িলেও সকলকে তো ছাড়াইতে পারিব না, কাজেই ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই। কন্ট্রোল? ওকথা চলিবে না—গৃহিণীরা নিয়মিত কাগজ পড়া উপলক্ষে ঘুমাইয়া থাকেন।
মিথ্যা বলাতে যে এমন ক্ষতি তাহা জানিলে কে না সত্য বলিবে!
ইলিশ মাছের সময়টা গেলেও বাঁচা যায়, কিন্তু তার অনেক আগেই যে আমার তিন মাসের অগ্রিম বেতনও যাইবে।
কি করিব ভাবিতেছি—এমন সময়ে পূজাসংখ্যার লেখার জন্য তাগিদ আসিল! লক্ষ্মীর টানাটানিতে যে সরস্বতী এমন সাহায্যার্থ আসিতে পারেন, শাস্ত্রকারেরা কি তা ভাবিতে পারিয়াছিলেন? স্থির করিলাম দেশের উপকারের জন্য ঘটনাটা লিখিয়া ফেলি না কেন? ঘাটতির কিয়দংশ যদি উঠিয়া আসে নিজের উপকারও হইতে পারে। নিজের ও পাড়ার গৃহিণীরা অবশ্যই পড়িবেন—চাই কি আমার প্রতি দয়া হইলেও হইতে পারে।
নাঃ, সে ভরসা বড় নাই। একবার রসিক বলিয়া খ্যাতি রটিয়া গেলে তার দুঃখে আর কেহ বিশ্বাস করে না—না জুট মিল বিদ্যাকেন্দ্রে, না বাড়িতে!
১৩৫১ (১৯৪৪)