ইসলামাবাদের পথে
সোমবার, ৮ অক্টোবর। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল। গোসল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। গোসলখানার অবস্থা দেখে প্রাণ উড়ে যায় যায় অবস্থা। নোংরা অপরিষ্কার টয়লেট। দুর্গন্ধে বমি বমি লাগছিল। মনে মনে ঠিক করলাম, ভবিষ্যতে যেকোনো জায়গায় থাকার আগে টয়লেটের অবস্থা যাচাই করে নেব।
গোসলের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে দ্রুত প্রয়োজন সেরে বেরিয়ে এলাম। রুমেই দাঁত ব্রাশ করতে করতে ছয়টা বেজে গেল। আমাকে খুব সকালেই প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই উত্তেজনা অনুভব করলাম। হয়তো মুক্তির পয়গাম এসে হাজির। কিন্তু না, এক টুকরা রুটি আর সবুজ চা।
কালকের বোমা হামলার পর মেয়েগুলো কেমন আছে, কে জানে। আমি ওদের বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি। যতই ভয়ংকর শব্দ হোক না কেন, আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কারণ, হামলার লক্ষ্যবস্তু আমরা নই। সন্ত্রাসী ঘাঁটি লক্ষ্য করেই বোমারু বিমান আঘাত হানবে। মনে আছে, হিথারকে একদিন অভয় দিয়ে বলেছিলাম আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের নির্ভুল নিশানার দক্ষতার কথা। এমনকি যদি সামনের বাগানের একটা গাছ লক্ষ্য করেও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়, তাহলেও আমাদের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। নির্ভুলভাবেই লক্ষ্যে আঘাত হানা হবে।
যে বিষয়টা নিয়ে আমরা সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতাম, তা হচ্ছে কাবুলের জনগণের প্রতিক্রিয়া। এই বোমা হামলার প্রতিশোধ নিতে যদি আমেরিকান ও ব্রিটিশদের হত্যা করতে হয়, সে ক্ষেত্রে গর্দান যাবে আমাদেরই। ওরা ভালোভাবেই জানে, কোন কয়েদখানায় পশ্চিমা নাগরিকদের বন্দী করে রাখা হয়েছে। তবে সেদিন রাতে এমন কিছু ঘটেনি।
পরক্ষণেই নিজের চিন্তা ফিরে এল মাথায়। চত্বরে খানিক হাঁটাহাঁটি করার জন্য বেরিয়ে এলাম। কারা পরিচালক ও কয়েকজন তালেবান কথা বলছিলেন। তাঁকে দেখেই আমি হাত নেড়ে চিৎকার করতে থাকি, কোথায় আমার গাড়ি? তার চালকই-বা কোথায়? বানোয়াট কথা শুনিয়েছ আমায়। তোমরা যুদ্ধ চাইলে আমিও কম যাই না। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী। শ্লোভাদান মিলোশোচিভের কথা একবার ভেবে দেখো। হতচ্ছাড়া এখন চৌদ্দ শিকের ভেতর দিন গুনছে। তোমাদেরও একই দশা হবে। আমি তোমাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করব এবং তোমাদের খুঁজে খুঁজে বের করা হবে।
কথা শেষ করেই আর কোনো দিকে তাকালাম না। এক দৌড়ে রুমে ফিরে এসে দরজাটা দড়াম করে আটকে দিলাম ভেতর থেকে। হিংস্র হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম আবার আমাকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। তালেবানরা নিশ্চয়ই আবার মানসিক খেলা খেলতে বসেছে।
পেছনে ফিরে তাকালে এখন মনে হয়, তখন আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ, কোনো কিছু দিয়েই ওদের হুমকি দেওয়ার অবস্থায় ছিলাম না নিশ্চয়। আগের দিন রাতেই আমি তির-ধনুকের কথা বলে ওদের ব্যঙ্গ করেছি, কিন্তু বাস্তবে কিছু হলে একটা বাদাম ছুড়ে মারার ক্ষমতাও ছিল না আমার।
মনে পড়ে, ভাঙা খাটে শুয়ে ছিলাম। নিচে তাকাতেই তূপ করে রাখা আরপিজি চোখে পড়ল। এটা নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ। বিশেষ বাহিনীর সদস্য অথবা নারী গোয়েন্দা হিসেবে সন্দেহ হলে নিশ্চয় এত মারাত্মক মারণাস্ত্র আমার হাতের নাগালে ফেলে রাখা হতো না। বন্দুক ধরতেই আমার হাত কাঁপাকাঁপি শুরু হতো। একটা আরপিজি হাতে নিলে বোধ হয় হামলার বদলে নিজের হাত-পাই উড়িয়ে দিতাম।
মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া বইটাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। গল্পটা সত্যিই নেশা ধরানোর মতো। তবে আগের দিন এত দ্রুত পড়েছি যে, শেঃ অধ্যায়ে এসে মনে হতে লাগল, বইটা শেষ হয়ে গেলে কীভাবে সময় কাটার? এখানে আমাকে এখনো অনেক দিন থাকতে হবে।
একটা সিগারেট ধরালাম। মেয়েগুলো আমাকে এক কার্টন ভর্তি ২০০ সিগারেট উপহার দিয়েছে। ওদের কারোরই ধূমপানের অভ্যাস নেই। ভাগ্য ভালো বলতেই হয় আমার, আগুন জ্বালাতে গিয়ে লক্ষ করি, দেশলাইয়ের কাঠি প্রায় শেষের দিকে। হায় এখন যে আবার ফিরে গিয়ে পাহারাদার তালেবানের কাছে দেশলাই চাইব, সে অবস্থাও অবশিষ্ট নেই।
করার ছিল একটাই। একের পর এক সিগারেট জ্বালিয়েই যাব, যতক্ষণ পর্যন্ত না অসুস্থ লাগছে। সেদিন বইটা সমাপ্ত হওয়ার আগে আমি টানা সাতটি সিগারেটের ধোঁয়া টেনেছি। উঠে রুমের চারপাশেই পায়চারি করতে লাগলাম। গলা ছেড়ে পুনরায় রুল ব্রিটানিয়া গাইতে শুরু করি। মনে পড়ল, গত বছর স্কুলের অনুষ্ঠানে কত মজাই না করেছি, আর এ বছর চার দেয়ালে বন্দী হয়ে আছে আমার সব আনন্দের পসরা।
এরপর ভাঙা রুক্ষ কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করলাম। এর আগে কোনো দিন গান গাওয়ার চেষ্টাও করিনি। শুধু কর্কশ নয়, গাওয়ার সময় আমার কণ্ঠস্বর রীতিমতো কাঁপছিল। আমার হেঁড়ে গলার গান শুনে নিশ্চয়ই বাইরে দাঁড়ানো সৈন্যরা মনে মনে ভাবছিল, কেন গান-বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সন্দেহ নেই, তারা ধরতে পেরেছিল গানের সুর-তাল-লয় কিছুই ঠিক নেই। জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলে দেখি একজন সৈন্য ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমাকে দেখেই সৈন্যটা একটা ধুলোয় ঢাকা গাড়ির সামনে থেকে সরে গেল। কাচে জমে থাকা ধুলোর ওপর লেখা, তুমি কাবুল থেকে মুক্তি পাচ্ছ। আমি সৈন্যটার সঙ্গে এক দফা হাসি বিনিময় করলাম। তবে বিশ্বাস করার কোননা কারণ নেই।
একটু পরে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ততক্ষণে সৈন্যটার গাড়ির কাচের চিঠিতে আরও অনেক কিছু লেখা হয়ে গেছে। তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ। তোমার কথা আমার সব সময় মনে পড়বে। বিদায় হে প্রিয়। কিছুটা অবাক হলাম। মনে পড়ছে না কখন এই দূরপ্রেমিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ও হ্যা, আমার ইয়োগা অনুশীলনের দ্বারা যেসব সৈন্য বিনোদিত হয়েছিল, এ নিশ্চয় তাদের একজন। অথবা কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কথা শুনেই দিওয়ানা হয়ে গেছে বোধ করি।
একটা সিগারেটের খালি প্যাকেট ও কলম নিয়ে লিখতে থাকি, ধন্যবাদ তোমার সহানুভূতির জন্য। যদি সত্যিই আমি বাড়ি পর্যন্ত পৌছাতে পারি, তাহলে আমি প্রার্থনা করছি তোমার বাকি জীবনটা যেন সুখে-শান্তিতে কাটে। গরাদের ফাঁক দিয়ে কাগজটা ছুড়ে মারি। লোকটা দ্রুত তা কুড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
মোল্লা ওমর কি এসব গোপন যোগাযোগ নিষিদ্ধ করেছেন? সে ক্ষেত্রে আমার কী হবে? আমার বন্দিতের মাঝেই হয়তো সে আবার উদ্ভট কোনো আইন জারি করেছে। নারীরা বাইরে খেতে বা বনভোজনে যেতে পারবে না এবং খেতে পারবে না। যদি না তাদের জন্য কোনো তাঁবু টাঙানো হয়, যেখানে তারা পুরুষের চোখের আড়ালে থেকে খাওয়াদাওয়া করতে পারবে। যত্ত সব অনর্থক বকোয়াজ।
সকাল সোয়া নয়টার দিকে দূতাবাসের সেই হাস্যময় লোকটা দরজায় আঘাত করে ভেতরে আসতে চাইল। দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানালাম। চলে যেতে বললাম লোকটাকে। ব্যাটা জাহান্নামে যাও। তোমরা সবাই মিথ্যাবাদী। যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের মিথ্যা কথার ফাঁদে আর পড়ছি না আমি। ক্ষোভে ফেটে পড়লাম আমি। লোকটা প্রায় জোর করেই বলতে লাগল, গাড়ি হাজির এবং আমি যেতে পারি। কিন্তু আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না।
একসময় দরজায় জোরে জোরে কড়াঘাত হতে লাগল। বাধ্য হয়েই দরজাটা খুলে দিলাম। ছিটকিনিটা খুলতেই দরজাটা সজোরে হাঁ হয়ে যেতেই পাঁচজন লোক হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়ল। আমাকে বসতে বলে তারা জানাল, একটা গাড়ি আমাকে সীমান্তে নিয়ে যেতে বাইরে অপেক্ষা করছে।
কারা পরিচালক আমার জন্য সুন্দর একটা উপহার নিয়ে এসেছেন। ভারী, কালো রঙের খুব সুন্দর একটা পোশাক। সঙ্গে লাল ও সোনালি রঙের একটা পর্দা। ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক। উপহারটা পেয়েই আমার মনটা বিগলিত হয়ে এল। এই সেই কারা পরিচালক, যার জীবনটা আমি একরকম দুঃসহ করে রেখেছিলাম এই কদিনে। তিনি আমাকে পোশাকটা পরিধান করতে বললেন। আমি অস্বীকার করলাম। এত সুন্দর পোশাকটা ছয় ঘণ্টার ভ্রমণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
হাস্যময় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বললেন, ‘কাল রাতে বোমা হামলা শেষ হওয়ার পর আপনাকে নিশ্চিন্ত করতে এসেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন বলে আর জাগাইনি।’
কিসের বোমা হামলা? ও আচ্ছা আমি তো ভেবেছিলাম, তালেবানদের পক্ষ থেকে আতশবাজি পুড়িয়ে আমাকে বিদায় জানানো হচ্ছিল। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিল। রিডলি, তুমি একটা মানুষই। অতিশয় চালাক ব্যক্তি। এখন চলে, যাওয়ার সময় হয়েছে।
অবশেষে আমি প্রথমবারের মতো লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা উষ্ণ হাসি দিলাম। এত দিনের খারাপ ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। এরপর কারা পরিচালকের দিকে তাকিয়ে সুন্দর পোশাকটার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। তাঁকেও বলি, আমি যতই রুক্ষ ও কঠোর আচরণ করে থাকি না কেন, এটাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি অভয় দিলাম, সব ইংরেজ নারীই আমার মতো এত ঝগড়াটে নয়। লোকটা একটু
অবাক হয়ে আমাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত অবলোকন করলেন। তাঁর কঠিন পাথরের মতো নিষ্প্রাণ মুখে একটা সুন্দর হাসি দেখতে পেলাম প্রথমবারের মতো। কুঁচকে থাকা প্রু জোড়াও সোজা হয়ে এল।
চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। তালেবান সৈন্যরা হতবিহ্বল হয়ে দেখতে লাগল কঠিন হৃদয়ের রিডলি একটা মহাকাশযান-সদৃশ গাড়িতে উঠছে। আমি আর কিছু দেখতে পাইনি। প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই, যেখানে একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা আমাকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌছে দিতে অপেক্ষা করছিলেন।
হাসিমুখের খুনি লোকটা দেখা করতে এল। এতক্ষণ পর্যন্ত সবার সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করলেও এই ব্যাটার প্রতি কোনো মায়া অনুভূত হলো না। আমি নিরুত্তাপ চেহারা নিয়ে বসে রইলাম। সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে লোকটা বলতে থাকে, আশা করব ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তুমি আমাদের বিরুদ্ধে খারাপ কিছু লিখবে না। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন তোমাকে জ্বালাতন করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়। আমি তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছি না দেখে তার মুখের হাসিটা মলিন হয়ে এল। এটা ছিল আমার জন্য একধরনের নৈতিক বিজয়।
কূটনৈতিক কর্মকর্তা ভালো ইংরেজি জানেন না। দীর্ঘ পথ আমাকে চুপ হয়ে থাকতে হবে। রওনা দেওয়ার সময় দেখা গেল লোকটা পাসপোর্ট নিয়ে আসতে ভুলে গেছেন। অগত্যা আবার তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যেতে হলো। যোগাযোগের মাধ্যম না থাকলেও তাঁর সঙ্গে ভ্রমণটা হয়তো মন্দ হবে না।
কাবুল শহরের এক অভিজাত এলাকায় সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে তিনি থাকেন। এলাকাটায় উচচপদস্থ কর্মকর্তাদের বসবাস। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কয়েকটা বাড়ির ছাদে নিষিদ্ধ টিভির অ্যানটেনা বা ডিশ স্যাটেলাইট দেখা যাচ্ছে। আমাকে জানানো হলো, শাসকগোষ্ঠীর সন্তান, এমনকি মেয়েরাও পাকিস্তানের নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য।
দিনের বেলায় কাবুলে পথে চলতে চলতে শহরটাকে দুই ভাগ মনে হলো। এক পাশে বোমা হামলায় ক্ষস্তি সব স্থাপনা। বহু বছর ধরে চলা যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা। অন্য প্রান্তে প্রশস্ত সড়কের দুই পাশে গাছগাছালিতে ঘেরা মনোরম সব দালানকোঠা। এখানেই সব দূতাবাস অবস্থিত। উঁচু একটা দালানের ওপর চীনের পতাকা উড়তেও দেখা গেল।
চারপাশে ধোঁয়া উড়ছে। গতকালের বোমা হামলায় অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক। কাবুল শহরে এতবার বিদেশি শক্তি বোমা হামলা করেছে যে, এখানকার অধিবাসীদের কাছে এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঠিক যেন, ইংল্যান্ডের বৃষ্টিবহুল শহর ম্যানচেস্টার, যেখানে বৃষ্টিপাত হলো নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। কাবুল যেন একটা ভুতুড়ে নগরী। যারা চলে যাওয়ার, তারা বোমা হামলা শুরু হওয়ার অনেক আগেই চলে গিয়েছে।
শহরের ধ্বংসলীলা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। শহরের গিরিখাতের দৃশ্য দেখে যেন দম আটকে যাচ্ছে। খাইবার পাস এই ভয়ানক দৃশ্যের কাছে কিছুই নয়। সংকীর্ণ ঢালু পথ দিয়ে যখন গাড়ি চলছিল, স্বীকার করি, একেকবার ভয়ে নীল হয়ে যাচ্ছিলাম। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। সরু পাহাড়ি পথ ও খাড়া ঢালগুলো গাড়ি চলাচলের জন্য এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে।
গিরি সংকট ও সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে যেতে যেতে সামনের ছয় ঘণ্টা ভ্রমণের কথা ভাবতে থাকি। সুড়ঙ্গগুলো পাথর খোদাই করে বানানো। সমগ্র পথজুড়েই পাথর আর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। প্রতিটা চেক পয়েন্টেই কূটনৈতিক কর্মকর্তা একটা কাগজ দেখাতেই আমাদের গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। কাগজে স্বয়ং মোল্লা ওমর স্বাক্ষর করেছেন। এতে লেখা, ইভন রিডলিকে মানবতার দিক বিবেচনা করে মুক্তি দেওয়া হবে।
তবে তালেবানদের একটা দল আমাদের সহজে ছেড়ে দিচ্ছিল না। বিশেষ করে, গতকাল রাতের ভয়াবহ বোমা হামলার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল। কোথাও কোথাও তাদের সঙ্গে ছোটখাটো ঝগড়া লেগে যাচ্ছিল।
কিন্তু গাড়িচালক কথা না বাড়িয়ে সব জায়গাতেই মোল্লা ওমরের স্বাক্ষরিত কাগজ দেখিয়ে দ্রুত সটকে পড়ছিল। আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তবে চালক নিজ উদ্যোগে এসব জায়গা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মাঝপথে এসে যাত্রাবিরতি করতে হলো। একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেল। একটা দরজা দেখিয়ে আমাকে ভেতরে যেতে বলা হলো। সঙ্গের পুরুষ লোকজন অন্য দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। ভেবেছিলাম, টয়লেট আছে এখানে নিশ্চয়ই। ভেতরে যেতেই দেখি কয়েকজন নারী ও বাচ্চাকাচ্চা একত্রে মাটিতে বসে খাবার গ্রহণ করছে। আমি মরিয়া হয়ে জানতে চাইলাম, টয়লেট কোথায়? আমার ভাষা বুঝতে না পারলেও ওরা একটা পর্দার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।
দ্রুত ভেতরে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। বিশাল একটা হলঘর। দুটি সারিতে প্রায় ২০ জন লোক বসে খাচ্ছে। খোদার প্রতি অশেষ ধন্যবাদ, টয়লেট মনে করে পর্দার ভেতরে গিয়েই আমি কাপড় খুলে ফেলিনি। তাহলে আগেরবারের মতো এবারও দ্রুতই রুমটা খালি হয়ে যেত। আমার সঙ্গে আসা লোকেরাও ভেতরে বসা ছিলেন। তাঁরা আমাকে তাঁদের সঙ্গে বসে খেতে অনুরোধ করলেন।
দেশটাতে আসার পরে এটাই ছিল আমার প্রথম স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ। মাছি ভনভন করতে থাকলেও খাবারটা ছিল খেতে দারুণ সুস্বাদু। বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর বন্ধুবান্ধবের কাছে গল্প করতে গিয়ে জায়গাটাকে আমি ‘হাজার মাছির রেস্তোরাঁ’ বলে সম্বোধন করতাম। এখন হয়তো কোথাও মাছি বসলেও সারা বাড়ি দৌড়ে তাকে তাড়িয়ে দেব। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওখানে হাজারখানেক মাছি উড়তে থাকলেও আমি একবারও ভ্রু কুঁচকে তাকাইনি। কূটনৈতিক কর্মকর্তা, গাড়িচালক ও দুজন সশস্ত্র গার্ডসমেত আমরা সবাই প্রায় নিঃশব্দে বসে খেয়ে নিলাম। আমরা চলে যাওয়ার পর তাঁরা সবাই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তখনো আমার টয়লেটের প্রয়োজন সারেনি। মনে আছে, এক পাশে আদিম ধরনের একটা টয়লেট চোখে পড়েছিল, যেখানে গোসল করার ব্যবস্থাও ছিল। কানাডা সরকারের উদ্যোগে এটা তৈরি করা হয়েছিল। জানি ঠিক কী কারণে, কিন্তু নিরাপদ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। নারীদের টয়লেটে যেতে দেখে স্থানীয় ব্যবস্থাপক উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু দরজা ছিল আটকানো।
গোছা থেকে চাবি বের করে লোকটা দরজা খুলে দিল। মনে হচ্ছিল, নতুন টয়েলেটে আমাকে যাওয়ার সুযোগ দিতে পেরে সে যারপরনাই খুশি। প্রয়োজন শেষে বের হয়ে লোকটাকে ধন্যবাদ দিলাম। ইংরেজ সাংবাদিক? আমি হা-সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। কীভাবে বুঝল জানি না। সঙ্গের সৈন্য দুজন তাদের বলে থাকতে পারে।
যেতে যেতে অসংখ্য উটের কাফেলা ও ভেড়ার পাল চোখে পড়ল। এত মানুষ উটের পিঠে করে কোথায় যাচেছ? কাফেলার লোকগুলো দেখতে খুব সুন্দর ও চমকপ্রদ। চোখ ফেরানো দায়। চেহারায় হাজার রকম বৈচিত্র্য। কঠিন চেহার। ঘাড় অবধি লম্বা চুল। কারও কারও চোখ পান্নার মতো জ্বলছে। গাঢ় বাদামি বর্ণের চোখ, গাঢ় সবুজ চোখ।
দেশটার এই স্থানগুলো একদম ফাঁকা, ধূসর ও প্রাণহীন; যেন পৃথিবীর সর্বশেষ স্থান। প্রকৃতি এখানে বড় নির্মম। কাবুলে যাওয়ার পথেও একই রকম দৃশ্য চোখে পড়েছিল। তবে শহরের বাইরে আর কোথাও বোমা হামলায় ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য চোখে পড়েনি।
জালালাবাদ অতিক্রমের সময় আমাদের গাড়ির সামনে ভিড় জমে যায়। লোকজন ইংরেজ সাংবাদিক বলে সোল্লাসে শ্লোগান দিচ্ছিল। এই শহরেই মাত্র এক সপ্তাহ আগে আমাকে বন্দীর মতো করে যোরানো হয়েছিল। আর আজ নিজেকে গণ্যমান্য ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে।
কূটনৈতিক কর্মকর্তা এসব দেখে হেসে দিলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, এখানে সবাই তোমাকে চেনে। তুমি মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেছ সমগ্র আফগানিস্তানে। তোরখামের দিকে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। পথিমধ্যে আমরা একটা পিকআপকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। দুজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি অলস ভঙ্গিতে পেছনে বসে ছিল। পা দুটো আয়েশ করে ছড়িয়ে কালাশনিকভ বুকে জড়িয়ে সূর্যাস্তের সর্বশেষ দৃশ্য দেখছিল ওরা।
ওদের একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি আবার ভালো করে লক্ষ করলাম। পৃথিবীটা এত ছোট যে মাঝেমধ্যে তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়ায়। সেই সবুজ চোখের লোকটা পিকআপের পেছনে বসা। এই লোকটার জন্যই আমার আফগানিস্তান ভ্রমণ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। একটা গাধার পিঠে চড়তে গিয়ে কী দুর্ভোগেই না পড়লাম।
লোকটাও আমাকে মুহূর্তের মধ্যে চিনে ফেলে। তার চোখে ভয় আর অবিশ্বাস। এর মধ্যেই তারা পিকআপ নিয়ে বেশ কয়েকবার অতিক্রম করে আগে যাওয়ার চেষ্টা করে। সবুজ চোখের লোকটা বারবার আমাদের গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করছিল আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আতঙ্কে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। আবার কি আমাকে বন্দী করা হবে? এই নরক যন্ত্রণা আরও একবার সইতে হবে? কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। বরং, আমি বাড়ি যাচ্ছি শুনে লোকটাকে খুশি খুশি আর ভারমুক্ত দেখাল।
আরও কয়েক মাইল আমাদের গাড়ি ওদের পিকআপের পাশাপাশি ছুটে চলল। পিকআপের লোকগুলো অতীব উৎসাহের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় যাত্রী ও পথচারীদের আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছিল। মানুষগুলো চমৎকার। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ইঙ্গ মার্কিন বাহিনী দেশজুড়ে বোমা হামলা করেছে। অথচ এদের মাঝে কোনো আক্রোশ অথবা ক্ষোভ নেই।
সীমান্তে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা নেমে এল। আমরা প্রকাণ্ড লোহার গেটটার সামনে বসে পড়লাম। এই গেটের ওপারেই আমার বন্দিত্বের অবসান হবে। মুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাসের অপেক্ষা। এপারে চারদিকে কেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। আমাদের সঙ্গের গার্ড দুজন উৎসাহী জনতাকে দূরে সরিয়ে রাখছিল।
আমি নীরবে প্রার্থনা করছিলাম গেট খুলে দেওয়ার জন্য। ৩৮ মিনিট আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই ৩৮ মিনিট ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম অপেক্ষা। সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও সংঘর্ষে তিনজন মানুষ মারা যাওয়ার সংবাদ পাই। ভয় ছিল, আমার মুক্তির খবর পেলে কেউ কেউ হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। আমেরিকার বোমা হামলার পর ২৪ ঘন্টা সময়ও পেরোয়নি। সঙ্গের সৈন্য দুজন নিরাপত্তার আশঙ্কা করছিল। তাই গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে স্থানীয় সৈন্যদের কাছে নিরাপত্তা জোরদার করতে অনুরোধ জানাল। আবার কি নতুন কোনো খেলা শুরু হলো? আমাকে জানানো হলো, আমাকে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ওপারে ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে কেউ আমাকে নিতে আসেনি। আবার মাথায় চেপে বসতে শুরু করল হতাশা আর বিরক্তি। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ওরা আবার কোনো প্রতারণাপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করছে।
তবে যে তরুণ কূটনৈতিক কর্মকর্তা আমার সঙ্গে এসেছেন, তিনি আমার চোখে-মুখে হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ ধরতে পারলেন। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তার হাতে আমাকে তুলে দেওয়ার। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি আমাকে আগেই মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন। এই লোকটার নিকট আমি চিরদিন ঋণী হয়ে রইব। ভারী লোহার গেটটা ম্যাচম্যাচ শব্দ করে আস্তে আস্তে খুলে গেল। আমাদের গাড়ি সামনের দিকে আরও পাঁচ গজ অতিক্রম করার পর শুনতে পেলাম, তুমি এখন যেতে পারো। হৃৎস্পন্দন থেমে গেল বুঝি!
গাড়ি থেকে নামতেই চোখে এসে লাগল টেলিভিশন ক্যামেরার আলোর তীব্র ঝলকানি। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু কানে এল, অসংখ্য কণ্ঠস্বর। তালেবানরা তোমার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছে? বিগত ১০ দিনের স্মৃতি আর মানসিক খেলার সবকিছু যেন এক মুহূর্তে জ্বলজ্বল করে উঠল চোখের সামনে। আমি উত্তর দিলাম, সম্মান ও সৌজন্যের সহিত।
আমি জোরে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম। পরক্ষণেই মনে হলো মা ও ডেইজি নিশ্চয় টেলিভিশনে সরাসরি আমাকে দেখছেন। আমার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সবাই নিশ্চয় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সহকর্মীরাও নিশ্চয়ই দম বন্ধ করে টেলিভিশন সেটের সামনে বসা। থাক আর কাউকে কষ্ট আর যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
ইচ্ছে হচ্ছিল আনন্দের আতিশয্যে সজোরে শূন্যে ঘুষি মারি। কিন্তু পারলাম না। আমার সঙ্গের সেই দুজন নারী, বাচ্চা মেয়েটা ও জার্মান দাতব্য সংস্থার সাহায্যকর্মীদের দলটা এখনো কাবুলে বন্দী। আমি অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সীমান্তের দুঃসহ অপেক্ষার চাইতেও বেশি কষ্ট লাগল, যখন সীমান্তের ওপারে এসে কোনো ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে দেখতে পেলাম না।
হাজার হাজার লোক চারদিকে গিজগিজ করছে। আমাকে একটা ভবনে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একটা বিশাল ঘরে সামরিক কর্মকর্তা, কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও অসংখ্য সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন কিছু খেতে চাই কি না। ইচ্ছে করছিল এক বোতল স্কচ চেয়ে বসি। কিন্তু, আমি সদ্য একটা মুসলমান দেশ থেকে আরেকটা মুসলমান দেশে প্রবেশ করেছি।
ক্যামেরার ফ্লাশলাইট পুনরায় জ্বলে উঠল। স্বীকার করতে হবে, ওই সময়ে এসে আমার সাংবাদিক সত্ত্বা জেগে উঠল। আমার ঝুলিতে থাকা অসংখ্য অভিজ্ঞতা ছাপাতে আমার পত্রিকা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নিশ্চয়।
আমি পেশোয়ারের নিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম প্রধানের দিকে ফিরে ক্যামেরা বন্ধ করতে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের অনুরোধ করতে বলি। দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের পরে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত। এই মুহুর্তে কারও সঙ্গেই কথা বলার ইচ্ছা নেই। বলার সঙ্গে সঙ্গেই টিভি কর্মীরা কোনো অভিযোগ ছাড়াই ক্যামেরা বন্ধ করে দিলেন। এমনকি আমার পাশে বসা সাংবাদিকটাও আমার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে নতুন কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত রইলেন।
চা ও বিস্কুট। সবকিছুতেই সভ্য জগতের ছোঁয়া, যেন ব্রিটিশদের আদব কায়দা। কিন্তু এখানে শুধু আমি একাই ইংরেজ। তালেবান কূটনৈতিক কর্মকর্তা আমার বিপরীত দিকেই বসা ছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলেন।
তিনি বোধ হয় মনে মনে বেশ খুশি হয়েছেন যে এখন পর্যন্ত আমি তার দেশ ও তাদের নিয়ে কোনো গালাগাল দিইনি। অথচ বন্দী থাকা অবস্থায় আমি সর্বদা এই ভয়ই দেখিয়েছি ওদের। এখন তিনি গুলি খাওয়ার ভয় অথবা পাথরের আঘাতে মৃত্যুর ভয় কাটিয়ে নিশ্চিন্তে কাবুল ফিরে যেতে পারবেন।
অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, তালেবানরা তাদের কুখ্যাতির বদলে বরং আমার সঙ্গে সম্মান ও সৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। লোকগুলো চাইলেই নিষ্ঠুর ও বর্বর হতে পারত। অথচ আমার সঙ্গে তারা অমায়িক ব্যবহারই করেছে। সাংবাদিক সহকর্মীরা হয়তো এখনই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার গল্প কেঁদে বসবে।
সশস্ত্র পাহারায় খাইবার পাস অতিক্রম করে রাজনৈতিক এজেন্টের অফিসে উপস্থিত হলাম। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন সহকারী রাজনৈতিক কর্মকর্তা শাহজাদা জিয়াউদ্দিন আলী। আমাকে দেখেই বলতে লাগলেন, আমাকে চিনতে পারছ? আমিই তোমাকে আগের বার খাইবার পাস যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলাম। যদি জানতাম তুমি এভাবে আফগান যাবে, তাহলে আমি নিজ দায়িত্বেই তোমাকে নিয়ে যেতাম। তোমাকে নিষেধ করেছিলাম ক্যামেরা নিয়ে যেয়ো না।’
অফিসটার প্রবেশপথে কয়েকজন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের গাড়িটা তাদের কোনো রকম সুযোগ না দিয়েই সোজা ভেতরে প্রবেশ করেছিল। ভেতরে প্রবেশ করলে আমাকে মূল্যবান সেগুন কাঠের তৈরি একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানে ঝামেলাবাজ রিডলির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ফিদা মোহাম্মদ ওয়াজির। ভদ্রলোকের পেছনে একটা কাঠে খোদাই করে খাইবার পাসে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সব রাজনৈতিক কর্মকর্তার নাম লিখে রাখা। সবার শেষে খোদাই করে ওয়াজির সাহেবের নাম লেখা। দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি আমি আটক হওয়ার কয়েক দিন পরেই সদ্য দায়িত্ব পেয়েছেন বলে জানান।
এবার সামনের দিকে ঝুঁকে তিনি জানতে চাইলেন, কাদের সহায়তায় আমি আফগানিস্তান গিয়েছি? ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত কারা আমাকে সাহায্য করেছে? প্রশ্ন শুনে আমি একটু হেসে উত্তর দিই, যথাবিহীত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক জানাচ্ছি, ১০ দিনের বন্দিজীবনে আমি খোদ তালেবানদেরও এই প্রশ্নের উত্তর দিইনি। এখনো দিচ্ছি না। তিনি শুধু একবার মাথা নাড়লেন। আমার উত্তর মেনে নিয়েছেন কি নেননি, তা বোঝা গেল না।
এবার আমি জানতে চাইলাম, আমি আটক হওয়ার পরে তাদের কোনো লোক আফগানিস্তানে নিখোঁজ হয়েছে কি না। তিনি শুধুই মাথা নাড়লেন। আমার দুই গাইড ও ছোট মেয়েটার জন্য কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু এদের তথ্য আমি যার-তার কাছে ফাঁস করে দিতে পারি না। অন্যথায় মুক্তি পাওয়ার পরে তারা বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হবে।
আমি বলতে থাকি, শাহজাদার কাছ থেকে শুনেছি, প্রেসিডেন্ট মোশাররফ আমার মুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এ জন্য তাঁকে কৃতিত্ব ও ধন্যবাদ দিতেই হবে। দ্রলোক মাথা ঝাকিয়ে বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনার মুক্তির জন্য তালেবানদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টের কাছে আমার আন্তরিক অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা পৌছে দিতে অনুরোধ করলাম।
ঠিক এমন সময়ে ডেইলি এক্সপ্রেস-এর ডেভিড স্মিথ দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে উঁকি দিল। আমাকে দেখেই ও মুখ টিপে হাসতে লাগল। হঠাৎ মনে পড়ল হায় আমাকে দ্ভূিতকিমাকার লাগছে দেখতে। উস্কখুষ্ক চুলের ওপর দিয়ে মাথায় স্কার্ফ জড়ানো। চেহারায় কোনো মেকআপ নেই। পরনের সালোয়ার-কামিজটা ধুলোবালিতে ময়লা হয়ে আছে। যা-ই হোক, আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে না নিশ্চয়ই।
পরে জানলাম, ডেভিডের হাসির রহস্য। মিনিট দুয়েক আগেই ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে ওকে ফোন করে জানানো হয়, আমার মুক্তির ব্যাপারে যেসব সন্দেহ দেখা দিয়েছে, তা নিতান্তই অমূলক। দূতাবাসের কর্মকর্তার কণ্ঠস্বর নকল করে দেখায় ডেভিড। ওকে বলা হয়েছিল, সীমান্তের কাছেই দূতাবাসের লোকজন অপেক্ষায় থাকবে। আমি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডেভিডকে জানানো হবে।
অনেকক্ষণ ডেভিড আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। এক্সপ্রেস-এর ভাড়া করা চিত্রগ্রাহককে ডাকতে ছুটে গেল সে। একদম পুরোদস্তুর সংবাদসন্ধানী সাংবাদিক। কয়েক সেকেন্ড পরই মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে ফিরে এল সে। চিত্রগ্রাহক ইতিমধ্যেই আমার ছবি তুলতে শুরু করেছে। মুঠোফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। ডেইলি এক্সপ্রেস-এর প্রধান সম্পাদক ক্রি উইলিয়ামস প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, স্বাগত। ওপাশে তখন মুহুর্মুহু করতালি আর চিল্কারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সবাই আনন্দিত। কেমন আছ?
আমি আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ক্রিসের সঙ্গে কথা বলতে পেরে চমৎকার একটা অনুভূতি হচ্ছে। ক্রিসকে বলি, স্ট্যামির এক টুকরা পিম কেকের জন্য মারা যাচ্ছি আমি। ডেভিডকে জানালাম দারুণ শ্বাসরুদ্ধকর একটা গল্প অপেক্ষা করছে ওর জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে আমার একটা সংবাদ সম্মেলনও করা উচিত। এরপর ডেভিডকে আমার অভিজ্ঞতার একটা সারসংক্ষেপ বলে ফেললাম। নিজেও একজন প্রতিবেদক হওয়ায় আমি জানি কী কী বলতে হবে।
আমি রাজনৈতিক এজেন্টের সঙ্গে বসে আরও এক কাপ চায়ে চুমুক দিলাম। তিনি আমাকে কিছু খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। খাবারগুলো ছিল দারুণ সুস্বাদু। জানতে চাইলাম, উনি আরও লোকের জন্য অপেক্ষা করছেন কি না। জবাবে তিনি জানালেন, তাঁকে বলা হয়েছিল ব্রিটিশ হাইকমিশনের কোনো একজন কর্মকর্তা আমাকে সীমান্ত থেকে গ্রহণ করবেন।
আমার খুব অসহায় ও ব্ৰিত বোধ হতে লাগল। আমি কি এমন কোনো অপরাধ করে ফেলেছি যে দূতাবাস আমার জন্য কিছুই করতে চাচ্ছে না। শাহজাদা আমাকে হতাশ হতে নিষেধ করল। আমাকে বরণ করে নিতে তাঁর বাড়িতে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানায় সে। পরে জানতে পারি হাইকমিশনের অনুপস্থিতির কারণ। আমাকে আরও আগেভাগেই মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি যখন ভারী লোহার গেটটা
অতিক্রম করছিলাম, ততক্ষণে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। ঘন অন্ধকারে রাজকীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টারের পক্ষে উড্ডয়ন সম্ভব ছিল না।
মাকে ফোন করে তাঁর মুঠোফোনটা ব্যস্ত পেলাম। সম্ভবত তিনি ভিভের সঙ্গে কথা বলছিলেন। একটু আগেই আমার মুক্তির সংবাদ মাকে জানিয়েছে ডেভিড। এ-ও বলেছে, পরে আমার সঙ্গে কথা হবে মায়ের। সান ফ্রন্টিয়ার এর এক চিত্রগ্রাহক গ্যারি ট্রটার মনে হয় শ খানেক ছবি তুলল। ওর ক্যামেরাটাকে বিশ্রাম দিতেই এই ফাঁকে আমি ও ডেভিড একটা গাড়িতে উঠে পড়ি। গাড়িতে আমাদের সঙ্গী হলো আরেকজন চিত্রগ্রাহক অ্যারল সেদাত। শাহজাদার গাড়ির পিছু পিছু আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। শাহজাদার অফিসে পৌছামাত্রই জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক ও ক্যামেরাম্যান আমাদের একদম ছেকে ধরল। মাথা নিচু রাখো। মুখ ঢেকে ফেলে। কাউকে কিছুই বলবে না। ডেভিড প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। আমি চমকে উঠি। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল একই রকম আরেকটা দৃশ্য। তালেবানদের ভূমিতে পা রাখার পর থেকে আমাকে একই কথা শুনতে হয়েছিল বারবার।
ড্রাইভার ঝাকি খেতে খেতে গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এমন সময় হঠাৎ করেই একজন সাংবাদিক এক হ্যাচকা টানে চালকের দরজা খুলে গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, যাতে আমরা আর এগোতে পারি। চালক ব্যাটা বিমূঢ় হয়ে গেল। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকলে ও হয়তো এসব বদমাশকে তোয়াক্কা না করেই জোরে গাড়ি ছুটিয়ে দিত। কিন্তু ও ভুল করে গাড়িটা থামিয়ে দিল।
অপর দিক থেকে কেউ একজন আমার পাশের দরজা খুলে দিয়ে আমাকে বাইরে বের করার চেষ্টা করতেই অ্যারল আমাকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে এল। চেষ্টা করল আমার চারপাশে হাত দিয়ে প্রতিরক্ষাবেষ্টনী দেওয়ার। এবার ডেভিডের গলা শুনতে পেলাম। সবাইকে উদ্দেশ করে ও। বলতে থাকে, অনেক হয়েছে। হতভাগা মেয়েটাকে একটু শান্তি দাও। ১০ দিন ধরে ও বন্দিশালায় আটক ছিল। আমরা এখনো ওর স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানি না।
সহানুভূতি, শব্দকোষে থাকা বহুল প্রচলিত একটা শব্দ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে সিমপ্যাথি। অভিধানে শিট (মলমূত্র) ও সিফিলিস (একধরনের রোগ) শব্দদ্বয়ের মাঝেই এর অবস্থান। পেশোয়ারে সেদিন রাতে এই শব্দটার টিকিটিরও অস্তিত্ব ছিল না। এক চিত্রগ্রাহক চিৎকার করে উঠল,ওই পাপিষ্ঠাকে বের করো। এর সবই ধান্দাবাজি। আরেকজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সে একজন ইতর সাংবাদিক। সব গুমর তার জানা। আরও অনেক গালিগালাজ ও ঘৃণাসূচক শব্দ শুনতে পেলাম।
এমনকি যখন আমাকে আমেরিকান গোয়েন্দা হিসেবে জালালাবাদে প্রদর্শন করা হয়েছিল, তখনো আফগান বা তালেবানদের কেউই এ ধরনের হিংস্রতা বা গালি দেয়নি। তারা হয়তো আকাশে গুলি ছুড়েছে কিন্তু সেদিনের জমায়েতটা আরও কুৎসিত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল। আমার সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি কী শুনছি। এমনকি অত্যাচারী তালেবানরাও এ রকম বাক্য ব্যবহার করেনি। উল্টো আমি তাদের কাছে যথেষ্ট সম্মান পেয়েছি। ব্যাপারটা সত্যিই বিভ্রান্তিকর। কেন এমন হচ্ছে?
শাহজাদা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে একরকম ধাক্কা দিয়েই সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। ওর অফিসে পৌছে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ডেভিড আমার অবস্থা জানতে চাইলে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ও এরপর তৃতীয়বারের মতো আমাদের হাইকমিশনের কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল। অবশেষে কূটনৈতিক কর্মকর্তা কলিন মুল্কের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হই আমরা। ততক্ষণে আমার মুক্তির সংবাদ হাইকমিশনে পৌঁছে গেছে। তিনি আমাকে ব্রিটিশ হাইকমিশনে নিয়ে যেতে আসছেন বলে জানান।
ডেভিড জানায়, এক্সপ্রেস-এর এক পরিচালক পল অ্যাশফোর্ড ও সালেহ হুসনুদ্দিন, একজন উর্দুভাষী আইনজীবীও ইসলামাবাদে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি লাফিয়ে উঠলাম। কী? অ্যাশফোর্ড? উনি ইসলামাবাদে এসেছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না। হায় খোদা! আমাকে তালেবানরা বলেছিল এক্সপ্রেস-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার মুক্তির জন্য তদবির করছেন। আমি ভেবেছিলাম হয়তো উনি লন্ডন থেকেই ফোনে কথা বলছিলেন। কিন্তু খোদ ইসলামাবাদেই তিনি চলে এসেছেন, তা কে জানত?
ডেভিড জানায়, আমি আটক হওয়ার পরমুহূর্তেই ও কোয়েটা থেকে সরাসরি ইসলামাবাদে চলে আসে। পল আসার আগ পর্যন্ত ওকে একাই প্রতিবেদক-কূটনীতিক-তদবিরকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর পরের খবর আরও চমকপ্রদ ছিল।
সাংস্কৃতিক দূরত্ব কাটাতে সালেহ হুসনুদ্দিন সব জায়গায় তাকে সঙ্গ দেয়। ২০০০ সালের নভেম্বরে রিচার্ড ডেসমভের ঘটনার পর থেকে আমি আর ওর মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কর্মস্থলে আমার টেবিলের কাছেই আইনগত প্রক্রিয়া সারার জন্য আলাদা দপ্তর খোলা হয়। পল অ্যাশফোর্ড ঠিক আমার বিপরীত দিকেই বসতেন অফিসে। আমরা তিনজন প্রায়ই একত্রে বসে চা-কফি পান করতাম।
ডেভিডের কাছে আমার পরিবারের খবর জানতে চাইলাম। কারণ, আমি জানতাম, আমার মা ইসলামাবাদের কোথাও অবস্থান করছেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা মাকে নিয়ে এতটাই উফুল্ল ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন, যেন তারা সবাই সশরীরে মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে, এই ১০ দিনে মা রাতারাতি ব্রিটিশ তারকা বনে গেছেন। সামনের দিনগুলোতে গার্ডেন গেটে মা গণমাধ্যমের সামনে যে চমকার ভূমিকা রাখতে যাচ্ছিলেন,
তা তখনো আমার ধারণার বাইরে ছিল।
এক কোনায় শান্ত চুপচাপ একজন তরুণ বসে ছিল। ডেভিড পরিচয় করিয়ে দিল। আকবর শিনবারি। এই কয়েকটা দিন ডেভিডের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। গাড়ি ঠিক করা, নিরাপত্তা বজায় রাখা, কাগজপত্র জোগাড় করা-আমার মুক্তির জন্য যা যা করণীয় ডেভিড আর ও মিলে রাজ্যের কাজ সমাধা করেছে। এমনকি বের হওয়ার সময় গন্ডগোল করতে থাকা নাছোড়বান্দা গণমাধ্যমের চোখ ফাঁকি দিতে ও একটা বোরকাও কিনে নিয়ে এল। বুদ্ধিটা দারুণ কাজে দেয়। গুটি কয়েকজন মাত্র বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে গাড়ির পেছনে বোরকা পরিহিত নারীই আমি।
কলিন মুষ্ক একটা রেঞ্জ রোভারে করে এলেন। অবশেষে ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমরা। আমার শরীরে আর কুলাচ্ছিল না তখন। তবে কলিন খুব স্নেহপ্রবণ আর ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। এ জন্যই বোধ করি তিনি কূটনীতির চাকরি বেছে নিয়েছেন। রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে যেতে যেতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সম্ভবত, আটক অবস্থায় তুমি খুব কঠিন সময় পার করে এসেছ। আগে কখনো বিদেশি জেলে ছিলে?’ কিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে কোথাও গ্রেপ্তার বা আটকের পর কী করতে হয়, তা শেখানো হয়।
আমি আগে কোনো দিন কোনো জেলেই বন্দী ছিলাম না। অবাক হলাম উনি কেন এসব প্রশ্ন করেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার এমন অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। আমি বলতে থাকলাম, ইরাক বা ইরানে আটক হলে হয়তো আমি ওদের পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতাম কিন্তু এ মানুষগুলো ভিন্ন ধাতুতে গড়া। আমি তালেবানদের সর্বোচ্চ চাপে রাখার চেষ্টা করেছি। ওদের বুঝিয়েছি, আমি তোমাদের শান্ত নিরীহ নারীদের চেয়ে অন্য কিছু। এটা দারুণ কার্যকর ছিল এবং ফলাফল আমি এখানে বসে আছি। আশা করছি, আমাকে ইসলামাবাদে আর কটা দিন থেকে অসমাপ্ত কাজগুলো সমাধা করতে দেওয়া হবে।
তিনি বললেন, কোনোভাবেই আমাকে থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে সবাই এখন আমাকে চেনে। ফলে নিরাপত্তাঝুঁকিও বেড়ে গেছে। তখন আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হতে থাকে গত কয়েক দিন আমিবিহীন পৃথিবীতে কী কী ঘটেছে। আমাকে নিয়ে গণমাধ্যমে দুর্দান্ত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। শোরগোল পড়ে গিয়েছিল চারদিকে।
এমন সময় কলিনের ফোন বেজে উঠলে তিনি মুঠোফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দেন। ওপ্রান্তে পলের কণ্ঠস্বর শুনেই আমার হাত-পা অবশ হয়ে এল। তাঁকে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ও একই সঙ্গে খুশি মনে হচ্ছিল। আমি এ রকম উটকো ঝামেলা করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। এরপর আমাদের পত্রিকার কাটতি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ইভন, এটা পত্রিকার কাটতি নিয়ে কথা বলার সময় নয়। আমরা জানতে চাই তুমি কেমন আছ। তুমি জানো না আমাদের ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে গেছে। তবে তোমাকে ফিরে পেয়ে আমরা যারপরনাই আনন্দিত।
সেদিন মুঠোফোনের ফাঁক গলে যে উষ্ণতা আর সৌহার্দ্য ভেসে আসছিল, তা আমি নিজ কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারিনি। সবার ধারণা, অ্যাশফোর্ড কাঠখোটা আর ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। বরং মোটেই তা নয়। অ্যাশফোর্ড লম্বা গড়নের হ্যাংলা ধরনের মানুষ। অফিসে যখন গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে উনি হেঁটে বেড়ান, তখন মনে হয় বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। আমাদের চেয়ারম্যান রিচার্ড ডেসমভের একরকম ডান হাত হিসেবে কাজ করেন উনি। এ জন্য বোধ হয় উনি অনেকের চক্ষুশূল।
ঘড়ির কাঁটা তখন ১১টার ঘর অতিক্রম করেছে। তাই পরদিন ভোরে হাইকমিশন অফিসে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পৌছানোর পর একজন চিত্রগ্রাহক আমার চিত্র ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চত্বরের ভেতর রাষ্ট্রদূত হিলারি সিট ও তাঁর স্ত্রী অ্যানি আমাকে অভিবাদন জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কী খাব জানতে চাইলে জবাব দিই, বড় এক পেয়ালা স্কচ ও বেকন স্যান্ডউইচ। পরমুহূর্তেই বলি, স্যান্ডউইচটা মজা করে বলেছি। বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।
যা-ই হোক, অ্যানি তখনই অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সুস্বাদু বেকন স্যার্নি নিয়ে হাজির হলেন। ইতিমধ্যেই বাড়ির ফোনে সংযোগ করতে সক্ষম হই। ফোনটা রিসিভ হলে ও পাশ থেকে একটা অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কে? জানতে চাইলাম। মার্ক ব্ল্যাকলক, নিউক্যাসলভিত্তিক একজন এক্সপ্রেস সাংবাদিক। তার দায়িত্ব হচ্ছে আমার মাকে পাহারা দিয়ে রাখা, যাতে করে সংবাদ সংগ্রাহকেরা তাঁকে হেঁকে ধরতে না পারে। ঘোলাটে একটা পরিস্থিতি।
অবশেষে টেলিফোনের ওপাশে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তাঁকে খুবই উৎফুল্ল ও খুশি মনে হচ্ছিল। মাকে জানাই, পরদিন সকালে বিস্তারিত কথা বলব। আমার মুক্তির সংবাদে ডেইজি এতটাই উত্তেজিত হয়ে আছে যে ফোনে কথা বলার সময় পায়নি। নানির কাছে সংবাদ শোনার পরই লাফাতে লাফাতে বন্ধুদের এই খবর পৌঁছে দিতে বাইরে চলে গেছে।
এদিকে হিলারির আতিথেয়তা ছিল দেখার মতো। উনি আমাকে যাবতীয় সংবাদ জানাতে লাগলেন। কয়েদখানার ভেতরে আমি যে সাহসী ও উদ্ধত বন্দীর মতো আচরণ করেছি, সে খবরও তার কানে পৌঁছেছে বলে জানান তিনি। তালেবান রাষ্ট্রদূত জায়িফ জানিয়েছেন এ কথা।
উপরন্তু জায়িফই তাকে সীমান্তে লোক পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। তাঁর মতে, আমি তালেবানদের বিরুদ্ধে খুব বাজে কথা বলছিলাম। হাইকমিশনের কর্মকর্তারা যেন আমাকে থামাতে সেখানে উপস্থিত থাকেন। যাক, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্ধর্ষ রাজত্ব নিজেদের ভেতরের খবর প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। পাছে আমি না আবার সব প্রকাশ করে দিই, এ ভয় ওদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এত দিন। হিলারিও ব্যাপারটিতে মজা পেয়েছেন। জায়িফের কথার প্রত্যুত্তরে তিনি জানিয়েছেন, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের ওপর তাঁর কোনো অধিকার নেই। চাইলেই তিনি সাংবাদিকদের কণ্ঠস্বর রোধ করতে পারবেন না। আমি ভাবলাম, মুক্তি পাওয়ার আগে এসব কথা হিলারি না বললেই পারতেন। ভাগ্য ভালো, হিতে বিপরীত হয়ে যায়নি।
আমার বোঁচকাটা নিয়ে ওপরের তলায় গেলাম। ক্রাউন প্লাজায় আমার ভাড়া করা রুম থেকে সব জিনিস গুছিয়ে ডেভিড একটা পোটলা বানিয়েছে। ছেলেরা কখনোই ঠিকমতো কিছু গোছাতে পারে না। যা-ই হোক, উল্টেপাল্টে দেখলাম, কিছু জিনিস বাদ পড়েছে। গ্রেনেডসমেত কৌটায় পোভাকেটিয়ারের একটা বেশ দামি সুগন্ধি ছিল। ওটা পাওয়া গেল না। জানি না কে নিয়েছে কিন্তু কী ভেবেছে কে জানে আমাকে তো অনুচর উপাধি দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয় তারা আমার রুম তল্লাশি করে এই গ্রেনেডটা খুঁজে পেয়েছিল।
এরপর নাইতে নেমে গেলাম। না, এবার আর কোনো জিঙ্কের বালতি বা ঠান্ডা পানি নয়। আহ কী আনন্দ! সবকিছু কেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও গোছানো। চারপাশ গন্ধে ম-ম করছে। রাতের পোশাকটা খুঁজে না পেয়ে উসামা বিন লাদেন টি-শার্টটাই গায়ে চাপিয়ে নিই। এরপর সোজা লেপের নিচে, যেন স্বর্গে এসে পড়েছি।
পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল। হাইকমিশনের বাগানে পায়চারি করতে বেরিয়ে পড়ি। বাগানে হরেক রকম ফুলের গাছ। এক পাশে একটা কৃত্রিম ঝরনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাড়ির এক কোণে আরও একটা সংরক্ষিত বাগান দেখতে পেলাম। তবে এই গাছগুলো স্থাপত্যকলার দৃষ্টিতে দেখলে বেমানান লাগে। সিনটের দুটি প
োষা কুকুর। আমার কুকুরের প্রতি নাক সিঁটকানোর কথা সবাই জানে। একটাকে দেখলাম একটা বিড়ালকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিড়ালটা নির্বিকার ভঙ্গিতে নিরাপদ দূরত্বে একটা দেয়ালের ওপর বসে জিরিয়ে নিচ্ছিল। আমি কুকুরটাকে একটু ধমক দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ওর কাছে আমাকে কেন পছন্দ হলো কে জানে, আমার পিছু পিছু বাগানের সিঁড়ি পর্যন্ত চলে এল।
অ্যানি সুপ্রভাত জানাতে এগিয়ে এলেন। বাগানের এক পাশে নাশতার টেবিলে বসার জন্য আহ্বান জানান তিনি। কী সুন্দর ও সভ্য নিয়মে একটা নতুন দিন শুরু করতে যাচ্ছি। ডেভিড স্মিথ একটু পরে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। ও আমার বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতার পরবর্তী কিস্তি লেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
ওকে আমার গোপন ডায়েরিটার কথা জানিয়েছিলাম আগেই। এবার ও সেই ডায়েরিটাতে একনজর চোখ বোলাতে চাইল। কিন্তু এটা তো লিখেছি সানডে এক্সপ্রেস-এর জন্য। ওর কাছে আমার সুগন্ধি বোতলটার কথা জানতে চাইলাম। আমার রুমে এমন কিছু ওর চোখে পড়েনি বলে জানায়। ও বলতে থাকে, তোমার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানতাম না প্রথমে। তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ, এ রকম পরিস্থিতিতে তোমার ব্যবহৃত হোটেল রুমে প্রবেশ করা ছিল একটা ভীতিকর অভিজ্ঞতা। কক্ষটা ছিল অগোছালো। মনে হচ্ছিল, সদ্য কেউ বিছানা থেকে উঠে বাইরে গেছে। তখনো টেলিভিশন চলছিল। রুমের সব লাইট আমি জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। দরজার বাইরে তখনো ‘বিরক্ত করবেন না’ লেখা চিহ্নটা ঝুলছিল।’ ডেভিড বলতে থাকে, ত
োমার কক্ষে রাখা ব্যাগে পাসপোর্ট জায়গামতোই ছিল। কিন্তু কোথাও তোমার বিখ্যাত কার্টিয়ার হাতঘড়িটা খুঁজে পাইনি। অথচ ওটা খুঁজে বের করতে আমাকে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল। পরে অবশ্য হোটেলের নিচতলার সেফ থেকে ওটা খুঁজে পাই। আর হ্যা, তোমার কক্ষের সেটা কিন্তু খোলা ছিল।’
ওর কথা শুনে আমি খুব অবাক হই। ডেভিডকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই, কিন্তু না। বেরোনোর আগে আমি সবকিছু বন্ধ করে বের হয়েছিলাম। কেউ নিশ্চয় প্রবেশ করেছিল আমার কক্ষে। তালেবানরা কি কাউকে পাঠিয়েছিল? জেরার সময় আমি ওদের আমার কক্ষ নং ও পাসপোর্ট কোথায় রেখেছিলাম বলে দিয়েছিলাম।
একটা অমলক সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল মনের ভেতর। পরে জানতে পারলাম, ইতালির একজন সাংবাদিক ঘুষ দিয়ে আমার কক্ষের ভেতরটা ভিডিও করেছিল। এক্সপ্রেস-এর চিত্রগ্রাহকেরাও আমার ২০৯ নং কক্ষে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ওদের তোলা ছবিগুলোর সঙ্গে যে অবস্থায় কক্ষ ত্যাগ করেছিলাম, তার কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। আমার যোগাযোগের খাতাটা পড়ে ছিল খোলা অবস্থায়। বিছানা ছিল অগোছালো। সুগন্ধির বোতলটা পাওয়া যাচ্ছিল না। এবং অবশ্যই আমি দরজায় বিরক্ত করবেন না চিহ্ন ঝুলিয়ে যাইনি। তখন বিষয়টা নিয়ে অত ভাবার সময় ছিল না। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রয়োজনীয় আরও অনেক চিন্তা। তবে একটা সুযোগ ও পরবর্তী কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমাকে আবার ২০৯ নং কক্ষেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।