ইশারায়

ইশারায়

ইশারাতেই কথা হয় মেয়েটার সঙ্গে৷ আমি রোজ অফিসে বেরোবার সময় ও দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ায়৷ আমিও একটু থমকে দাঁড়িয়ে হাসি৷ হাত তুলে ওকে টা টা করি৷ ও না হেসেই হাত নামিয়ে নেয়৷ কোনও কোনও দিন হাত না নাড়িয়ে শুধু মাথা নাড়ায়৷ দিন দুয়েক হল দেখছি বিশেষ কিছু অঙ্গভঙ্গি করা শুরু করেছে ও৷ সেটাও দেখতে বেশ মজা লাগে আমার৷ মেয়েটার বয়স বছর আটেকের বেশি হবে না৷ বেশির ভাগ দিনই একটা নীল রঙের ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে থাকে৷

আজ বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই আটকে দিল সুমনা, ‘টেস্টগুলো করাতে ভুলো না৷’

‘কীসের টেস্ট?’ আমি মৌরি চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করলাম৷ কটমট করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সে জবাব দিল, ‘মাথাটা, আগে মাথারটাই করিও না হয়৷ তারপর সেটা উতরে গেলে ইউএসজি-টা করিও৷’

‘হ্যাঁ ইউএসজি৷ ভালো কথা মনে করিয়েছ৷ খালি ভুলে যাই,’ আমি জিব কাটলাম৷

‘আর বেশি ব্যথা হলে ফোন কোরো৷’

‘কাকে?’

কটমটে ভাবটা সুমনার মুখ থেকে মুছতে গিয়েও মুছল না, ‘দমকলে৷ নম্বর জানো তো?’

আমি ব্রিফকেসটা বগলদাবা করতে করতে বললাম, ‘হ্যাঁ তা থাকবে না কেন? তোমার মাথা গরম হলে কখন দরকারে লেগে যায়৷’

‘যাও তো৷ দূর হও৷’

প্রায় মুখের উপরেই দরজাটা বন্ধ করে দিল সুমনা৷ আমি আবার মৌরিতে মন দিয়ে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলাম৷ তিনতলা থেকে নামতে আজকাল হাঁপিয়ে যাই৷ কবে থেকে অরুণবাবুকে বলছি একটা লিফটের ব্যবস্থা করতে তা কে শুনেছে কার কথা৷ ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েই উধাও হয়েছেন ভদ্রলোক৷ মেনটেনেন্সের কথা বলতে গেলে ভাওয়াল রাজার মতো মুখ করে বলেন, ‘আপনাদেরই তো জিনিস, নিজেরাই বুঝেশুনে নিন৷’

হাঁপাতে হাঁপাতে নীচে নামতেই পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দাটা চোখে পড়ল৷ আজও দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা৷ রোজকার মতো রেলিং-এ দুটো হাত রেখে৷ সকালের ঝকঝকে রোদ তার ফোলা-ফোলা কচি মুখে এসে পড়েছে৷ নাকের ছায়া একদিকের গাল ঢেকে রেখেছে৷ মৃদু হাওয়ায় নীল ফ্রকের নীচের দিকটা একটু একটু উড়ছে৷ আমি রোজকার মতো হাত তুলে ওকে টা টা করলাম৷ ও কিন্তু করল না, উলটে একটা হাত প্রথমে কপালের কাছে এনে তালুর উলটোদিকটা কপালে ঠেকিয়ে আবার কোমরের কাছে নিয়ে গেল হাতটা৷ তারপর আচমকাই বাঁ হাতের একটা আঙুল উলটোদিকের ফ্ল্যাটের ছাদের উপর দিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে দিল৷ কপালে হাত ঠেকানোর মানে না বুঝলেও মনে হল, আকাশের গায়ে আমাকে কিছু দেখাতে চাইছে সে৷ আঙুল লক্ষ্য করে সেদিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ একটা ভাঙা অ্যাডভার্টাইজমেন্ট বোর্ডের ফাঁক দিয়ে অনেকখানি আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না সেখানে৷ খামোখা খোলা আকাশ দেখাচ্ছে কেন আমাকে? আমি খুব একটা গা করলাম না৷ বাচ্চা মানুষের নানারকম আজগুবি খেয়াল হতেই পারে৷ অত মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই৷ ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি আবার একবার হাত তুলে টা টা করে সামনের পথ ধরলাম৷

মোড়ের মাথাতেই জগন্নাথের ম্যাগাজিনের স্টল৷ রোজই অফিস যাবার সময় ওর দোকানে ঢুঁ দিই একবার৷ আজও পাশ ফিরে বিছানো ম্যাগাজিনের স্তূপে উঁকি দিয়ে বললাম, ‘কিছু বেরোল নাকি রে জগা?’

জগন্নাথ এতক্ষণ আনন্দবাজারের আড়ালে মুখ ঢেকে ছিল৷ এবার সেটা রেখে একটা ইংরেজি কাগজ খুলতে খুলতে বলল, ‘ও আর বেরোবে না৷’

‘বেরোবে না কী করে? কষ্ট করে কলম পিষে লিখলুম আর ছাপার বেলা বেমালুম মেরে দেবে?’

‘ওরকম অনেকে লেখে, সবার কি আর বের হয়?’

আমার মৌরি এতক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে৷ মুখের আনাচকানাচে দু-এক টুকরো জিব দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে বললাম, ‘ক্লাস এইটে আড়াই বার ফেল করা ছেলে যদি ইংরেজি কাগজ পড়তে পারে তাহলে আমার লেখাও ম্যাগাজিনে ছাপা হতে পারে৷’

জগন্নাথ আড়াইবার ফেল করেছিল, সে কথা এ পাড়ায় সবাই জানে৷ দু-বার ডাহা, আর একবার ইংরেজিতে গাড্ডা-খাওয়া সত্ত্বেও স্রেফ আপদ বিদায় করতে পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন হেডস্যার৷ সে কাগজটা পাশে রেখে বলল, ‘খেলার ছবিগুলো বড়ো ভালো দেয়৷ যা-ই বলো৷’

আমি মোক্ষম একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু মনে পড়ল জগুকে আমার দরকার৷ ছেলেবেলায় লেখালেখির শখ ছিল আমার৷ কিন্তু পড়াশোনার চাপে আর সেসব নিয়ে বেশি দূর এগোনো হয়নি৷ এখন অফিস থেকে ফিরে একটু খাতা-কলম নিয়ে বসি৷ ভালো কিছু লিখতে পারলে ম্যাগাজিনে দেগেও দিই৷ তবে এখনও অবধি ছাপা হয়নি একখানাও৷ জগু পাহারায় আছে৷ ছাপা হলেই আমাকে জানাবার কথা৷ সঙ্গে একখানা গোটা চিকেন রোলও পাওনা হয় ওর৷ বলা বাহুল্য, আমার মন আর ওর পেট কোনওটাই ভরে ওঠেনি আজ অবধি৷ জগুর দোকান ছেড়ে একটু এগোতেই কেন জানি না বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল আমার৷ ভারী অদ্ভুত মেয়েটা৷ রোজ শুধু ওই একটা সময়েই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ও৷

ফ্ল্যাটখানা এতদিন ফাঁকাই পড়ে ছিল৷ মাসখানেক হল নতুন ভাড়াটে এসেছে৷ তাদেরই মেয়ে হয়তো৷ এক মাস যাবৎ আমাকে দেখলে শুধু হাতই নাড়িয়ে এসেছে ও৷ ইদানীং অন্যকিছুও যেন বোঝাতে চায়৷ আকাশের দিকে আঙুল তোলে কেন কে জানে?

ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিলাম৷ আচমকা তীব্র গাড়ির হর্নে পিছিয়ে এলাম৷ একটা দ্রুতগামী বাইক আমার পেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল৷ আর-একটু হলে ধাক্কা লেগেছিল আর কী৷ ব্রিফকেসটা বাগিয়ে ধরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম আমি৷

আমার অফিসটা একেবারেই ছোটোখাটো৷ গাড়ি সারাইয়ের অফিস৷ আমার অবশ্য কালিঝুলির কাজ নেই৷ সারাদিন ডেস্কে বসে চিঠি-চাপাটি লেখা, ক্লায়েন্ট অর্ডার নেওয়া, সেগুলো জায়গামতো পাঠিয়ে দেওয়া, এইসব নিয়েই ব্যস্ত থাকি৷ কাজকর্ম বেশি না থাকলেও মাথাব্যথার অন্ত নেই৷ তার উপর আজ একগাদা ক্লায়েন্ট ভিড় করেছে৷ তাদের কাজ মিটতে মিটতে বিকেল গড়িয়ে গেল৷ আমিও ঝাঁপ বন্ধ করে বাড়ির পথ ধরলাম৷ ফেরার পথে তিনতলার বারান্দাটা আবার চোখে পড়ল৷ এখন সেটা খালি, লাগোয়া দরজাটা বন্ধ৷ জানলা দিয়ে একফালি আলো রেলিং-এর উপর এসে পড়েছে৷

সন্ধের অন্ধকারের মাঝে সেই অল্প আলোর রেখা বিষণ্ণতায় ঘিরে রেখেছে বারান্দাটাকে৷ মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল আমার৷ মাথা নামিয়ে একটু এগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম৷ দরজায় বেল বাজাতে বিনতা দরজা খুলে দিল৷ হাতে ন্যাতা দেখে বুঝলাম, এতক্ষণ ঘর মুছছিল ও৷ চারপাশে তাকিয়ে সুমনাকে দেখতে পেলাম না৷ ঘরে ঢুকে হাতের ব্রিফকেসটা টেবিলের উপরে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাদময়জেল কোথায়?’

‘কোথায় যেন বেরোলেন৷’ বিনতা বালতিতে ফিনাইল ঢালতে ঢালতে বলল৷

আমি বিছানার উপর বসে মোজা খুলতে লাগলাম, ‘তাই ভাবি পাড়াটা এত চুপচাপ লাগছে কেন…’

সে আর কিছু উত্তর দিল না৷ ডান পায়েরটা খুলে বাঁ পায়েরটা রোল করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, একটা কথা বলো তো?’

‘কী?’

‘পাশের ফ্ল্যাটের তিনতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে?’

‘দত্তরা?’

‘তা জানি না৷ তবে ছোটো একটা মেয়ে আছে৷’

বিনতা উপরে-নীচে অল্প মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ ওরাই৷ স্বামী-স্ত্রী আর ওই একটা বাচ্চা মেয়ে৷ মেয়েটা ভারী অদ্ভুত৷’

‘অদ্ভুত কেন?’ আমি ওর দিকে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করি৷

‘ওইটুকুনি বয়স অথচ সারাদিন একটা আওয়াজ করে না৷ লোকজনের সামনেও আসতে চায় না৷’

‘বলিস কী রে? লুকিয়ে থাকে? স্কুল পাঠশাল?’

‘কী যে বলো, বাড়ি থেকেই বের হয় না তো স্কুল৷’

কেমন যেন সন্দেহ হল আমার৷ একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ রে, বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করে আনেনি তো?’

বিনতা কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিল৷ দরজার কাছে পায়ের শব্দ শুনে থেমে গেল৷ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুমনা বলল, ‘অ্যাঁ? তুমি আবার কাকে কিডন্যাপ করবে?’

আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, ‘পাশের ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটেদের কথা বলছি৷’

‘ওঃ৷ তা কিডন্যাপ করবে কেন? মেয়েটা বোবা৷’

‘বোবা! দেখে কিন্তু মনে হয় না৷’ আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম৷

‘তোমাকে দেখে মনে হয়, মাথায় ছিট আছে?’ সবজির থলে হাতে রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে সুমনা৷ তারপর উঁচু গলায় বলে, ‘তবে কথা বললে বুঝতে পারে; ঠোঁট দেখে৷’

‘লিপরিডিং,’ আমি মনে মনে বললাম৷

সে চায়ের ছাঁকনি হাতে রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘কিন্তু তোমার এত আগ্রহ কেন বলো তো?’

‘তেমন কিছু না৷ রোজ বারান্দা থেকে হাত নাড়াত আমাকে দেখে৷ ইদানীং মনে হয় ইশারায় কিছু বলতে চায়৷’

‘কী বলতে চায়?’ মেঝের উপর ন্যাতা বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে বিনতা৷

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না৷’

মেয়েটার কথা মাথা থেকে সরিয়ে স্নান করে জামাকাপড় পালটে আমি লেখার টেবিলে গিয়ে বসি৷ মাঝে মাঝে নিজের খাতাপত্রের দিকে তাকিয়ে নিজেরই করুণা হয় আমার৷ পাতার পর পাতা লিখে চলেছি অথচ ছাপা আর হয় না৷

বেগার খাটাটাই সার৷ অফিসের ঘানি টেনেই হয়তো কাটিয়ে দিতে হবে জীবনটা৷ একচিলতে ঘরের গতানুগতিক জীবনে আছেটাই বা কী?

‘টেস্ট করিয়েছ?’ সুমনা কখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারিনি৷ চমকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম, চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ও৷

‘হ্যাঁ৷’

‘কী বলল?’

‘কী আবার বলবে? পরশু রিপোর্ট দেবে বলেছে৷’

‘ও৷’

কাপটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও৷ আমি চায়ে বড়োসড়ো একটা চুমুক দিয়ে কলম বাগিয়ে ধরে লেখার খাতাটা টেনে নিলাম৷

পরদিন একটু আগেভাগেই বাড়ি থেকে বেরোলাম৷ কাল সারারাত থেকে থেকে মেয়েটার কথা মনে পড়েছে আমার৷ হাতের ইশারায় আকাশের দিকে কী দেখাতে চায় ও? এক-একবার ভেবেছি, হয়তো গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে কিছু জানাতে চায়৷ কিন্তু বছর আটেকের মেয়ে লোক ডেকে অ্যাষ্ট্রোনমি বোঝাতে চাইবে, সেটাও বিশ্বাস করা যায় না৷

বেরোতেই দোতলাটার বারান্দায় চোখ রাখলাম আমি৷ অথচ মেয়েটাকে চোখে পড়ল না৷ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি৷ এই ক-দিন হাত নাড়ানোটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ খানিকটা দুশ্চিন্তাই হল আমার৷ মেয়েটার কি শরীর খারাপ হল? রোজ এই সময় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়৷ আজ আসেনি কেন? সাত-পাঁচ ভেবে আমি মনস্থির করে নিলাম৷ দু-পা এগোলেই ফ্ল্যাটের দরজা৷ হাতেও বেশ সময় আছে আজ৷ ফ্ল্যাটের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে এলাম আমি৷ দরজার উপর নেমপ্লেটে দুটো নাম খোদাই করা আছে৷ শচীকান্ত দত্ত, অরুণিমা দত্ত৷ লোকগুলো কেমন আমি জানি না৷ অকারণে বেল বাজিয়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে যদি বিরক্ত হয়? একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম আমি৷ দরজার পাশের বেলটায় চাপ দিতেই ভিতর থেকে হিন্দি ফিল্মের গান বেজে উঠল, মিনিট দুয়েক পরে দরজা খুলে গেল৷ ইনি সম্ভবত অরুণিমা দত্ত৷ আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘বলুন৷’

আমি একটু হেসে বললাম, ‘আসলে আমি এই পাশের ফ্ল্যাটে থাকি৷’ এবার মহিলার মুখে অমায়িক হাসি ফুটে উঠল, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ… আপনার ফ্ল্যাটেও তো গিয়েছি আমি৷’

‘তা-ই নাকি! কবে?’ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷

‘সুমনাই তো ডেকে নিয়ে গেল৷ আপনি মনে হয় অফিসে ছিলেন৷’

ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না৷ অবশ্য মেয়েটা ভিতরের ঘরেও থাকতে পারে৷ লোকজনের সামনে যে ও বেরোতে চায় না, সে কথা তো আগেই শুনেছি৷

‘আপনার মেয়ে রোজ আমাকে দেখে হাত নাড়ায়৷ আজ দেখতে পেলাম না, শরীর ঠিক আছে তো?’

‘কে রিমি?’ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন অরুণিমা দত্ত, ‘সকাল থেকেই একটু জ্বর-জ্বর এসছে৷ শুয়ে আছে ভিতরের ঘরে৷ আপনি ভিতরে আসুন-না৷’

আমি ধীরপায়ে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ ঘরটা ছোটো হলেও সাজানো-গোছানো৷ একদিকের দেওয়ালে তিনজনের পুরোনো একটা ছবি ঝুলছে৷ টেবিলের উপরে ফুলদানি রাখা৷ সদ্য-ফোটা দুটো লাল গোলাপ রাখা হয়েছে তাতে৷ পাশের চেয়ারটাতেই বসে পড়লাম আমি৷ কাল ভদ্রমহিলাকে কিডন্যাপার ভেবেছিলাম বলে খারাপই লাগল খানিকটা৷

‘আমার মেয়ে বড্ড খামখেয়ালি, জানেন তো? লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে চায় না৷ তা-ও আপনাকে দেখে হাত নাড়িয়েছে৷’ ভিতরের ঘরের দরজা বন্ধ৷ আমি সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম, ‘এইটুকু মেয়ে সারাক্ষণ একা একা থাকে?’

মিসেস দত্তকে এবার বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখল৷ মাথা নাড়িয়ে তিনি বললেন, ‘সেইজন্যেই চিন্তা হয়৷ আসলে শরীরটা তো ভালো নয় ওর৷ সবার সঙ্গে মিশতে দিতেও ভয় লাগে৷’

‘শরীর ভালো নয় বলতে?’

‘নার্ভের রোগ ছোট থেকে৷ এই তো পরশুই একটা অপারেশন হওয়ার কথা আছে৷ এর মধ্যে আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসেছে৷’

‘কীসের অপারেশন?’ আমি মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলাম৷

‘ওই নার্ভের৷’ আমার সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন মহিলা৷

‘এইটুকু মেয়ের ব্রেন সার্জারি৷ সাংঘাতিক ব্যাপার৷’ আমি আঁতকে উঠলাম৷

‘স্পাইনাল কর্ডে একটা টিউমার ধরা পড়েছে৷ মারাত্মক কিছু না; তবে ফেলে রাখলে মুশকিল বলে আমরা আর রিস্ক নিতে চাইনি৷’

আমি আর কিছু বললাম না৷ মনটা ভারী খারাপ লাগছে৷ কে জানে, হয়তো মাসখানেক বারান্দায় এসে দাঁড়াতে পারবে না ও৷ আমি উঠতে যাচ্ছিলাম, মিসেস দত্ত থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এসেছেন যখন, একবার দেখাই করে যান রিমির সঙ্গে৷ জেগে আছে মনে হয়৷ এ ঘরে আসুন৷’

তার পিছন পিছন আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম৷ এখনও মিনিট দশেক সময় আছে হাতে৷ সত্যি কথা বলতে কী, রিমিকে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা আমারও অনেকক্ষণ থেকে হচ্ছিল৷

মিসেস দত্ত দরজাটা একটু খুলে আমাকে ভিতরে ডাকলেন৷ আমি দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ ছোটোখাটো একটা বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা৷ আমাদের ভিতরে ঢুকতে দেখে মাথা তুলে বসল৷

‘থাক থাক, উঠতে হবে না৷’ রিমির পায়ের উপর একটা হাত রেখে বললেন মিসেস দত্ত, ‘এঁকে চিনিস তো?’

আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে হ্যাঁ জানাল রিমি৷ শুয়ে পড়ল না কিন্তু৷ মেয়েটার মুখখানা বেশ গোলগাল৷ সকালে চুল আঁচড়ানো হয়নি বলে অবিন্যস্ত চুল মুখের উপর ছড়িয়ে আছে৷ তার ফাঁক দিয়ে বড়োসড়ো ক্লান্ত চোখ দু-খানা উঁকি দিচ্ছে৷ আমি ঝুঁকে পড়ে দু-আঙুলে ওর নাকটা ধরে একটু নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘কী? আজ বারান্দায় যাওনি কেন?’

সে মাথা নাড়িয়ে আমার আঙুলের মাঝখান থেকে নাকটা সরিয়ে নিল৷ মিসেস দত্ত একটু হেসে বললেন, ‘মুখে হাত দেওয়া ও একদম পছন্দ করে না৷’

সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়তে আমি আটকে গেলাম৷ মেয়েটার মাথার পাশেই একটা রংচঙে বই পড়ে আছে৷ নামটা লক্ষ করলাম, ‘Unmute a handbook of sign language.

ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম৷ মিসেস দত্ত রিমির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘রোজ যে টা টা করো ওঁকে, আজ করলে না তো৷’

মনে মনে ভেবেছিলাম, মায়ের কথা শুনে রোজকার মতো হাত নাড়াবে রিমি৷ কিন্তু সেসব কিছুই করল না সে৷ উলটে দুটো হাত জড়ো করে আমার দিকে সেকেন্ডকয়েকের জন্য তুলে ধরে আবার নামিয়ে নিল৷ আমি অবাক হয়ে নিজেও হাত জড়ো করে বললাম, ‘বাবা! নমস্কার করছ যে৷’

আমার কথাটা সে বুঝতে পেরেছে কি না বুঝলাম না৷ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে মিসেস দত্ত বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না৷ আমার মেয়ে অতটা সাবলীল না৷’

‘আরে না না, এইটুকু বয়সে ও যে এত ঝড়ঝাপটা সামলাচ্ছে, সেটাই বড়ো কথা৷’

‘না সামলে আর উপায় কী বলুন?’

আমি বাইরের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললাম, ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বই পড়ছে দেখলাম৷ আপনারা বোঝেন?’

‘চেষ্টা করছি আর কী, সময় পেলে চোখ বুলোই৷’

ভেবেছিলাম, কপালে হাত ঠেকানো আর আকাশের দিকে দেখানোর অর্থ জিজ্ঞেস করব৷ কিন্তু কেন জানি না মন সায় দিল না৷ আমি জুতো পরতে পরতে বললাম, ‘অপারেশনের পর আমি আর সুমনা না হয় দেখে আসব একবার৷’

‘নিশ্চয়ই৷ আবার আসবেন৷’

আমি নমস্কার করে নীচে নেমে এলাম৷ হাঁটতে হাঁটতে মনটা ক্রমাগত খচখচ করতে লাগল৷ কিছু যেন বলতে চাইছে মেয়েটা অথচ বলতে পারছে না৷ ওর ক্লান্ত অবসন্ন চোখ দুটো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে৷ খানিক ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ জগুর দোকানের সামনে এসে ভালো করে ম্যাগাজিনগুলো দেখতে দেখতে বললাম, ‘তুই খালি এইসবই বেচিস না বইপত্রও থাকে?’

জগু রোজকার মতো আজও আনন্দবাজার মুখে দিয়ে বসে ছিল৷ সেটা না সরিয়েই বলল, ‘দোকানে নেই৷ বললে কাল এনে দিতে পারি৷’

‘যে-কোনও বই?’

‘বলেই দ্যাখো না৷ খালি ডিসকাউন্ট দিতে পারব না, আগে থেকে বলে দিলাম৷’

আমি পুরোনো কাগজ থেকে একটা ফাঁকা জায়গা ছিঁড়ে নিয়ে তার উপর ইংরেজিতে বইয়ের নাম লিখে জিব কেটে বললাম, ‘যাঃ, ইংরেজিতে লিখে ফেললাম৷ তুই তো আবার…’

সে প্রায় টান মেরে আমার হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘ভেবেছিলাম, টেন পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দেব৷’ তারপর বইয়ের নামের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘বাংলা লিখে তো লাভ হচ্ছে না, এবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে লিখে দ্যাখো বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে কি না৷’ কথাটা বলে মুখের উপর সগর্বে টেলিগ্রাফ খুলে ধরল জগু৷ আমি ওর দিকে একবার হিংস্র বাঘের মতো দৃষ্টি হেনে অফিসের পথ ধরলাম৷

সারাটা দিন আমার কাজে মন বসল না৷ রিমির চোখ দুটো বারবার ভেসে উঠছে৷ মিসেস দত্তর মধ্যেও তো অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না৷ কাল জগা যদি সত্যি বইটা জোগাড় করে আনতে পারে তাহলে হয়তো সুবিধা হবে খানিকটা৷ দুপুরে লাঞ্চ করে এসে দেখলাম বেশ কয়েকবার ফোন করেছে সুমনা৷ সাইলেন্ট ছিল বলে দেখতে পাইনি৷ ডেস্কে বসে পড়ে রিংব্যাক করলাম৷ বার তিনেক রিং হবার পরে ওপাশ থেকে ওর গলা শোনা গেল…. ‘তুমি নাকি দত্তদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে৷’

‘হ্যাঁ৷ কে বলল?’

‘মিসেস দত্ত৷ এইমাত্র এসেছিল৷’

‘ও৷’

‘তোমার কী হয়েছে বলোতো? এত সামাজিক হলে কবে থেকে?’ আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘ঠিক জানি না সুমো, তবে আমার মনে হচ্ছে এর পিছনে কিছু একটা গন্ডগোল আছে৷’

‘আরে বাবা, কাল বললাম তো ওরা কিডন্যাপার নয়৷’

‘সে না হোক৷ অন্য কিছু একটা৷ এতদিন রোজ আমাকে টা টা করত মেয়েটা৷ অথচ এখন আর করে না৷ যা-ই হোক, তুমি কি এই কারণে ফোন করেছিলে?’

‘না না৷’ একটা অচেনা খুশির রেশ ফুটে উঠল সুমনার গলায়৷

‘তাহলে?’

‘জগন্নাথ এসেছিল৷ তোমার নম্বর চাইছিল৷’

‘কেন?’

‘তা জানি না৷ তবে বলে গেল যে তোমার নাকি ওকে চিকেন রোল খাওয়ানোর কথা৷’

‘চিকেন রোল… কিন্তু আমি…’

‘তুমি কী?’

‘কিছু না৷ রাখছি৷’

ফোনটা রেখে আমি চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লাম৷ মনের ভিতরে চাপা উত্তেজনার ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ আনন্দের চোটে ভুলেই গিয়েছিলাম রিমির কথা৷ অফিস থেকে বেরোনোর পথে সিগারেট কিনতে গিয়ে চকোলেট চোখে পড়তেই মনে পড়ল৷ কালই হসপিটালে চলে যাবে মেয়েটা৷ তার আগে কিছু একটা দেওয়া উচিত ওকে৷ ফাঁকা হাতেই দেখা করতে গিয়েছিলাম আজ৷ তার উপর নাক নাড়িয়ে দেওয়াটা একেবারেই পছন্দ হয়নি ওর৷ বড়ো দেখে একখানা ডেয়ারি মিল্ক সিল্ক কিনে নিলাম৷ ফ্রুট অ্যান্ড নাট৷ বাচ্চারা এটা পছন্দ করে কি না কে জানে৷ চকোলেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আমি বাড়ির পথ ধরলাম৷

বাড়ির দরজায় পৌঁছোলাম, তখন রাত প্রায় ন-টা বেজেছে৷ রাস্তায় জ্যাম ছিল বলে বেশ দেরি হয়েছে আজ৷ এতক্ষণে ঘরের কাজ সেরে চলে গেছে বিনতা৷ সুমনাই দরজা খুলে দিল, আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘মিষ্টি আনলে না যে৷’

‘তোমার মায়ের শুগার ছিল, মনে নেই? মিষ্টির কথা বলো কোন মুখে?’

সে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘মায়ের ছিল বলে আমার হবে, তার কী মানে আছে?’

‘এই ধরনের রোগ জেনেটিক৷’

‘তা বটে, তোমার বাবা কিপটে ছিল, তুমিও কিপটে৷’

আমি ওর কথায় কান না দিয়ে ঘরের কয়েকটা জায়গায় উঁকি দিয়ে বললাম,

‘ম্যাগাজিনটা রেখে যায়নি?’

‘নাঃ, বলেছে চিকেন রোল না-খাওয়া অবধি দেবে না৷’

‘যাঃ, ফাঁকা হাতে এসেছিল৷’ আমি হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম৷

‘না, ফাঁকা হাতে না, কী একটা বই দিয়ে গেল যেন৷’

‘বই!’ আমি সোজা হয়ে বসলাম৷

সুমনা টেবিলের ড্রয়ার খুলে বইটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এইটা৷’

‘Unmute a handbook of sign language’, সকালে যে বইটা মেয়েটার মাথার কাছে দেখেছিলাম, সেটাই৷ তবে সকালে যতটা মনে হয়েছিল, তার থেকে বেশ মোটাসোটা বইটা৷ সেটা উলটে-পালটে দেখে আবার টেবিলের উপরে রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলাম আমি৷

রাতে শুতে শুতে দেরি হয়ে গেল৷ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, বইটা পড়ব৷ কিন্তু বারোটা বাজতেই সারাদিনের পরিশ্রম আর উত্তেজনা চেপে ধরল আমাকে৷ ধীরে ধীরে বইয়ের ছবিগুলো কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে এল৷ একসময় হতাশ হয়ে বইটা রেখে দিলাম আমি৷ কাল সকালেই মন দিয়ে পড়া যাবে না হয়৷ আলো নিবিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম৷

সকালে ঘুম থেকে উঠে আর মনেই ছিল না বইটার কথা৷ মনে যখন পড়ল তখন স্নানের জল গরম হয়ে গেছে৷ সুমনাও তাড়া লাগাতে শুরু করেছে৷ ব্যাগের ভিতর টিফিন ঢোকাতে গিয়েই চকোলেটটা চোখে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল রিমির কথা৷ আজই দুপুরে হসপিটালে চলে যাবে ও৷ চকোলেটটা ফ্রিজের ভিতর ঢুকিয়ে আমি শোবার ঘরে এসে বিছানায় বসে পড়লাম৷ বালিশের পাশ থেকে বইটা নিয়ে মেলে ধরলাম চোখের সামনে৷ ছবি দিয়ে হাজার পাঁচেক সংকেত বোঝানো আছে সেখানে৷ তার মাঝখানে রিমি আমাকে যেগুলো দেখিয়েছে, সেগুলো খুঁজে বের করা কঠিন না হলেও সময়সাপেক্ষ৷ দ্রুত চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম৷

‘তুমি কি যাবে না অফিস? চানের জল যে ঠান্ডা হয়ে গেল৷’ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তাড়া দিল সুমনা৷

আমি পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললাম, ‘আসলে এটা থেকে একটা জিনিস খোঁজার ছিল৷’

‘কী জিনিস?’

আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নিয়ে বললাম, ‘তুমি আর কী করে জানবে? পাঁচ মিনিট দাঁড়াও৷ আজ না হয় ঠান্ডা জলেই চান করব৷’

‘কিছু জানার থাকলে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো৷ আমি পড়েছি বইটা৷’

‘তুমি পড়েছ!’ আমি অবাক হয়ে গেলাম, ‘কখন?’

‘কাল দুপুরে৷ কাজ ছিল না, কী করব?’

আমি বইটা পাশে রেখে বললাম, ‘আমি যদি হাতের তালুর উলটোদিকটা এইভাবে কপালে ঠেকাই তাহলে মানে কী দাঁড়ায়?’

সুমনা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘দুর্ঘটনা৷’

‘দুর্ঘটনা… কিন্তু হঠাৎ…’ মনে মনে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়েও আমি থমকে গেলাম৷ সেদিন রাস্তা পার হবার সময় আর-একটু হলে বাইকে ধাক্কা খাচ্ছিলাম৷ কিন্তু সে তো রিমির সঙ্গে দেখা হবার পরে৷ একটা অসম্ভব ভাবনা আমার মাথায় উঁকি দিচ্ছিল৷ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘বই কীভাবে দেখায়?’

‘বই…’ আবার ভাবনায় ডুবে গেল সুমনা৷ একটু পরেই তার মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠল, ‘বইটা ভারী মজার৷ এইভাবে নমস্কার করার মতো হাত জড়ো করে…’

বিছানার উপরে বসে পড়লাম আমি৷ এসব ঘটনা যে আমার জীবনে ঘটবে তা রিমির পক্ষে আগে থেকে জানা সম্ভব নয়৷ অন্তত কোনও স্বাভাবিক উপায়ে তো নয়৷ তাহলে?

দু-হাতে মাথা চেপে ধরলাম আমি৷ রিমি কথা বলতে পারে না, মিশতে পারে না কারও সঙ্গে, কিন্তু অমানুষিক এক ক্ষমতার অধিকারিণী সে৷ ওর ক্লান্ত, রুগন চোখ দিয়ে সে অনাগত সময়কে দেখতে পায়৷

‘আমি আবার জল বসাচ্ছি, এবার দেরি কোরো না অন্তত৷’ কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুমনা৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ পড়ল বইয়ের পাতায়৷ প্রত্যেকটা সংকেতের পাশে ছবি দিয়ে সংকেতের অর্থ বোঝানো আছে৷ একটা বিশেষ সংকেতে চোখ আটকে গেল আমার৷ মুষ্টিবদ্ধ একটা ডান হাত৷ শুধু তর্জনীটা আকাশের দিকে নির্দেশ করছে৷ পাশের শব্দটায় চোখ রাখতেই আমার মাথা থেকে পা অবধি একটা ঠান্ডা স্রোত খেলে গেল৷ বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমি৷

দৌড়ে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে তুলে নিলাম মোবাইলটা৷ কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা নাম্বার ডায়াল করতেই ওপাশে রিং-এর শব্দ শোনা গেল৷

‘হ্যালো৷ গুডউইল ক্লিনিক৷’

‘আমি সপ্তর্ষি গুপ্ত বলছি৷ আজ একটা ইউএসজি রিপোর্ট আসার কথা ছিল৷’

‘হ্যাঁ এসে গিয়েছে তো৷’

‘একটু বলতে পারবেন?’

‘শিয়োর৷ হোল্ড করুন৷’

মনে হল আমার হাত থেকে খসে পড়ে যাবে ফোনটা৷ মৃত্যু আমার দরজায় টোকা দিচ্ছে৷ সারা শরীর জুড়ে উত্তপ্ত ঘাম যেন পুড়িয়ে মারতে চাইছে আমাকে৷

‘মিস্টার গুপ্ত, মাইনর কিছু সিস্ট আছে আপনার, তবে ক্ষতিকর কিছু না৷ আজকাল রাস্তাঘাটে থার্টি পারসেন্ট লোক এই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়৷

‘বিপদ কিছু নেই?’

‘নট আ চান্স৷ নিশ্চিন্তে রিপোর্ট নিয়ে যান৷’

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি৷ সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে৷ আকাশের দিকে তর্জনী দেখানোর সাংকেতিক অর্থ মৃত্যু৷ তাহলে কি রিমির মিলে যাওয়া সংকেতগুলো কোইনসিডেন্স? নাকি…

আচমকা একটা ভয়ানক আশঙ্কা এসে চেপে ধরল আমাকে৷ মৃত্যুর সংকেত কি তবে নিজের জন্য দেখিয়েছিল রিমি? আজই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে৷

কথাটা মাথায় আসতেই ফ্রিজ থেকে চকোলেটটা বের করে জামাটা গায়ে গলিয়ে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ কোনওদিকে না তাকিয়ে দ্রুত পাশের ফ্ল্যাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম৷ মিসেস দত্তর ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল, আমি প্রায় দৌড়ে ভিতরে ঢুকে এলাম৷

সোফার উপর শুয়ে ছিল রিমি৷ আমাকে দেখে ভাবলেশহীন মুখে একবার তাকিয়ে আবার মাথা ঘুরিয়ে নিল ও৷ আমাকে দৌড়ে ঢুকতে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয়েছিলেন অরুণিমা দত্ত৷ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো, এভাবে…’

‘ওকে নিয়ে যাবেন না৷’ আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম৷

‘কোথায় নিয়ে যাব না?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস দত্ত৷

‘হসপিটালে৷’

‘নিয়ে যাব না মানে? সব ঠিক হয়ে আছে৷ ওর বাবা গাড়ি নিয়ে আসতে গিয়েছে৷’

আমি ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালাম রিমির সামনে৷ সে ফিরেও তাকাল না আমার দিকে৷ অসহ্য যন্ত্রণার ঢেউ আমার বুকের কাছে এসে আটকে গেছে৷ ভবিষ্যৎকে পলাটানো যায় না৷ হসপিটালে না নিয়ে গেলেও যে সে বেঁচে যাবে, সে নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না৷ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম আমি৷ দুটো চোখের কোনা ভিজে উঠেছিল জলে৷ সেটা মুছে নিয়ে চকোলেটটা এগিয়ে দিলাম রিমির দিকে৷ সে মাথা নাড়িয়ে না বলল৷

‘ওই ফ্লেভারটা খায় না ও৷’

চকোলেটটা টেবিলের উপর রেখে আমি ধরা গলায় বললাম, ‘আমি তো জানতাম না৷ হসপিটাল থেকে ফিরলে অন্য ফ্লেভার এনে দেব তাহলে৷’

‘কী যেন নাম৷ আমারও মনে পড়ছে না৷ ওটা ছাড়া খেতে চায় না৷’

‘আচ্ছা, পরে বললেও চলবে৷’

কথাটা বলে আমি উঠে পড়লাম৷ রিমিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে দরজার দিকে দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বারান্দার দিকের দরজাটায় চোখ পড়ল৷ খোলা দরজা৷ অল্প অল্প হাওয়া এসে পর্দাটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে বারবার৷ তার ফাঁক দিয়ে কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে যেন৷ ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম আমি৷

এতদিন এখানে দাঁড়িয়েই আঙুল তুলে আকাশের দিকটা দেখাত রিমি৷ আজ কিন্তু সেদিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ এতদিন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট বোর্ডটা ফাঁকা ছিল বলে আকাশ দেখা যেত৷ এখন আর ফাঁকা নেই সেটা৷ কাল রাতেই হয়তো নতুন অ্যাড লাগানো হয়েছে সেখানে৷ সেটা ভালো করে লক্ষ করতেই আমার হাত কেঁপে উঠল, ডেয়ারি মিল্ক সিল্ক, অরেঞ্জ পিল৷

পিছন ঘুরে আবার ঘরে ফিরে এলাম আমি৷ এখনও রিমি আগের মতোই শুয়ে আছে৷ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস দত্ত বললেন, ‘আমরাও রীতিমতো টেনশনে আছি৷ এইটুকু মেয়ে…’

আমি রিমির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর মাথায় একটা হাত রেখে বললাম, ‘টেনশনের কিছু নেই৷ কিচ্ছু হবে না রিমির৷’

রিমি ওর উজ্জ্বল চোখে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল৷ ধীরে ধীরে ডান হাতটা উঠে এল৷ দুটো আঙুলে আমার নাকটা ধরে আলতো করে নাড়িয়ে দিল ও…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *