ইশক কা আন্দাজ
এবারে ‘মুলিমালোঁয়ার ছোটো মসজিদের চুড়োটা চোখে পড়ল। অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। গলার কাঠের ঘণ্টা দোলানো কতগুলো গোরু আমাদের আগে আগে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল একটি ওরাওঁ ছেলে। ধুলো উড়ছিল খুব। কিন্তু শীতের আসন্ন সন্ধ্যায় জঙ্গলের গন্ধমাখা ধুলো খুব ভালো লাগে।
আর বেশি দূর নেই।
চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা, জব্বরদের জমিদারি মুলিমালোঁয়া। একদিন জব্বরদের বাপ-দাদারা এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, গ্রাম, মাদ্রাসার গোড়াপত্তন হয়েছিল। একদিন ছিল, যখন এই গাঁয়ের কাঁড়াবয়েল থেকে শুরু করে, শম্বর-চিতল, গেঁহুবজরা, কিতারি-সরগুজা এমনকী বস্তির হর-উমরের তামাম ছোকরি সবই জব্বরদের বাপ-দাদাদের ভোগের সামগ্রী ছিল। এখনো সেইদিনের কিছু জের রয়ে গেছে। এখানে বেশিদিন থাকলে আমরাও যে কোনো দিন জব্বরদের মতো হয়ে যেতে পারি। সন্ধের পর একসারি শাড়ি-খোলা দেহাতি রুখু মেয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে বেছে নিতে পারি প্রতিরাতের সঙ্গিনী।
মনে মনে জব্বর মিঞাকে আমরা সকলে বোধহয় ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। এবং হয়তো নিজেদের অবচেতনে সেই ভয়টাই আমাদের এখান থেকে আগামীকাল ভোরে পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। শিকার অবশ্য খুবই জব্বরদস্ত হয়েছিল এ তিনদিনে। সে-বাবদে জব্বর কারো মনে কোনো ক্ষোভ রাখেনি।
মসজিদের কাছে পৌঁছেই আবার সেই পাগলটির সঙ্গে দেখা হল।
সাধারণত পাগলরা একটু খ্যাপাটে হয়। ইট-পাটকেল ছোড়ে, যা-তা মন্তব্য করে; এককথায় অস্বস্তির উদ্রেক করে। কিন্তু একে আমরা এ ক-দিন হল দেখছি, অথচ, ভাব দেখে মনে হয়েছে, এ যেন এই বাড়ি সংলগ্ন মসজিদেরই মৌলবি। একটা গোটানো কালো ছিন্নভিন্ন গরম প্যান্ট। গায়ে কোনো শিকারির দান করা হাত-ছেঁড়া আমেরিকান ডিজপোজালের জার্কিন। মাথার চুল অদ্ভুতভাবে হাঁড়ি-বসিয়ে কাটার মতো করে কাটা। গায়ের রং কালো। মাঝারি গড়ন। মুখটা সুন্দর নয়, তবে দুঃখে-শীতে-গ্রীষ্মে তাতে এত রেখা জমেছে, যে আসল মুখ কি ও কেমন ছিল তা বোঝার উপায় নেই। একটি চোখ ছিল না লোকটির। আর সারামুখে এমন একটি নির্বিকার সমর্পণের ভাব ছিল, যে লোকটিকে আমি যতবার দেখছিলাম ততবারই অবাক হচ্ছিলাম। ওর হাঁটায়, চলায়, ওকে কুকুরের চেয়েও বিনত ও নম্র দেখাচ্ছিল। জব্বর ওকে খাওয়াতও কুকুরগুলোর সঙ্গে। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার পরে। ওই ঠাণ্ডায়, খোলা উঠোনে, কুয়োতলার পাশে পেয়ারাগাছের নীচে বসে ও নি:শব্দে খেত। কখনো কিছু চাইত না; এমনকী জলও না। খেতে খেতে কখনো মাথাও তুলত না।
এখানে আসা অবধি ভাবছি ওর কথা জব্বরকে জিগগেস করব কিন্তু শিকারের নেশায় আর হুল্লোড়ে তা আর হয়ে ওঠেনি।
পাথরে তৈরি মুলিমালোঁয়ার জমিদারের ভান্ডারে ঢুকে, গানর্যাকে পরপর সকলের বন্দুক-রাইফেল রেখে কুয়োতলায় হাত-পা ধুয়ে নিলাম। চোখে-মুখে জল দিলাম। খিদমদগাররা চা ও কাবাব নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল, তারা একেবারে তৈরিই ছিল।
চা খেতে খেতে দেখলাম, উঠোনের পাশের ঢাকা লম্বা বারান্দায় একটি বিরাট কাঠের চৌকি পাতা হয়েছে এবং তার উপর একটি মির্জাপুরী গালচে। উঠোনের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত টাঙানো যে দড়িগুলোতে সকালেও মকাই শুকোতে দেখেছি, সেখানে গোটা-চারেক হ্যাজাক ঝুলছে। অর্ডার হলেই জ্বালিয়ে ফেলা হবে।
চ্যাটার্জি, বড়ো বিলিতি কোম্পানির সেলস সাইডের নাম্বার টু। ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না। ওর সাহেবিখানায় আমরা উত্যক্ত। পাইপটা পরিষ্কার করতে করতে ও বলল— What this bloody Jabbar is up to?
আমি বললাম, যা ঘটেছে, তাকে ঘটতে দাও। নাচনা-গানা হবে, বোঝাই যাচ্ছে। ভালো না লাগলে কম্বলের তলায় গিয়ে ঢুকতে তো কেউ বাধা দেবে না?
ও বলল, That’s right.
ইতিমধ্যে জব্বর ভোল পালটে ফেলেছে।
শিকারের পোশাক ছেড়ে ফেলে— একেবারে শেরওয়ানি-কামিজ পরে মেহমানদের ঠিকমতো দেখভাল করে বেড়াচ্ছে।
এই জঙ্গলের বাড়িতে এমনিতে তো কেউ থাকে না। বন্ধুবান্ধব, চেনা-পরিচিত কেউ এলে তবেই এ বাড়ি কাজে লাগে। তাই জব্বরের কাজও কম নেই।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। ঠাণ্ডাটা বেশ জানান দিয়ে পড়েছে। অনেকেই হুইস্কি-টুইস্কি খেল। চ্যাটার্জি ত বিলক্ষণ খেল। তারপর খানায় বসা গেল। সারাদিনের হাঁপওঠা হাঁকোয়ার পর সে অনির্বচনীয় খানা। বেশি নয়, সিরিফ তিন পদ। কিন্তু কী যে খেয়েছিলাম; মুখে লেগে আছে।
বিরিয়ানি পোলাও, হরিয়ালের কলিয়া ভাজা, আর দহিকোটরা। সঙ্গে টম্যাটো-পেঁয়াজ-ধনেপাতা এবং কাঁচালঙ্কার সংমিশ্রণে কাফী চাটনি।
কারো মুখে সাড়াশব্দ নেই। হায়নার মতো মুখ নীচু করে সবাই খাচ্ছে। কারো মুখ দিয়ে জবজবে আওয়াজ বেরোচ্ছে, কারো কষ দিয়ে দহি-কোটরার দই গড়াচ্ছে, কারো দাঁতে হাড় লেগে কটাং করে আওআজ হল। খাওয়াটা এমন জমল যে, মায় চ্যাটার্জির মতো সাহেবও সাহেবত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে— ঢুক-ঢুক-ঢুক-ঢুক আওয়াজ করে এক লোটা জল বাঁ-হাত দিয়ে তুলে মেরে দিল। কচুবনে ঢোকা শুয়োরের দলের মতো সশব্দ কদর্যতার সঙ্গে আমরা খেয়ে চললাম।
ঠিক এমন সময় বাড়ির বাইরে একটি ঝড়ঝড়ে অ্যাম্বাসাডর এসে দাঁড়াবার আওয়াজ পেলাম। এবং জব্বর আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল—আ পৌঁছা।
আমরা সমস্বরে বললাম, কে?
জব্বর বুক ফুলিয়ে বলল, পালামুঁকা জঙ্গল পাহাড়োঁকো গা-তে-হুয়ে দিল ঔর মুলিমালোঁয়াকো রোতে হুয়ে—বুলবুল—মুনতজির বিবি।
বললাম—মুনতজির মানেতো—ইন্তেজারে অধীর; অপেক্ষায় অধীর?
চ্যাটার্জির চোখ দুটো কিছুর একটা প্রত্যাশায় দপ করে জ্বলে উঠেই আবার দহি কোটরায় ফিরে গেল।
খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল।
আমরা সবাই ফরাসের উপর বসলাম।
পুরু গালিচা পেতে তার উপর ফরাস পাতা সত্ত্বেও ভীষণ ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। প্রত্যেকের পাশে পাশে মাটির মালশায় কাঠকয়লার আগুন দেওয়া হল। তবুও ঠাণ্ডা গেল না। তখন উঠোনে মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি এনে আগুন জ্বালানো হল।
আমি বললাম, মেহফিল তাহলে এই আগুনের আলোতেই হোক। ঝুটোবাতি জ্বালিয়ে লাভ কী?
জব্বর বলল, আচ্ছা বোলা ইয়ার। অ্যায়সাহি করুঙ্গা।
আগুনটা দেখতে দেখতে বেশ চনমনে হল। দু-একটা মশা কানের কাছে গুনগুন করছিল। আগুনের তাপ বাড়তে, পালাল।
আমরা ততক্ষণে মুনতজির বিবির অপেক্ষায় নিজেরাই মুনতজির।
এমন সময় জব্বর সারেয়াওঙ্গিলা ও তবলচিকে সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে গেল। তারা এসে জাঁকিয়ে বসে তাকু-টাকু, ট্যাঁ-ফোঁ শুরু করল। তারপর মুনতজির নিজে এল।
মুনতজিরকে সুন্দরী বলব না।
যাকে সহজলভ্যা বলে জানি, যে মেহফিলে ম্যায়ফিলে জঙ্গল পাহাড়ে মুজরা নিয়ে এসে কতগুলো কামার্ত বদখত পুরুষের নিশানা হয়, তাকে আর যাই বলি সুন্দরী বলতে বাধে। কারণ, সৌন্দর্যের মধ্যে একটা সারল্য থাকে, যা এসব মেয়ের মুখ থেকে উবে যায়।
কিন্তু মুনতজিরের চেহারায় ও চোখে এমন কিছু ছিল যে, এমন শীতের রাতে অনেক পুরুষই নি:সন্দেহে তার সুতনুকা নগ্নতার মসৃণ উষ্ণতায় নিজেদের শীতল অণু-পরমাণু ও বর্তমান ভবিষ্যৎ সব তাতিয়ে নিতে চাইত।
বেশ লম্বা চেহারা। নিতম্ব অপেক্ষাকৃত ভারি; কিন্তু মানানসই। একটা লাল-হলদে বুটি-তোলা জরিপাড়ের বেনারসী শাড়ি পরনে। আগুনের আভায় পাড়ের জরি ঝিকমিক করছিল।
বড়ো করে খোঁপা বাঁধা— খোঁপায় একটি মাত্র বড়ো জংলা ঝুমকো ফুল। সারা শরীরে কেমন ঝাঁকুনি তুলে যেন হাঁটছিল সে। প্রতি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল তার শরীরের ভিতরে একটা কাচের কিছু বুঝি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল— তারপর সেই কাচ-ভাঙা আওয়াজ কানের দুল, নাকের নথ থেকে শুরু করে পায়ের পায়জোড়েও ঝুনঝন করে বাজছিল।
মুনতজির বিবি এসে বসে, আমাদের হাত তুলে কুর্নিশ করল বার বার।
তার শরীরের যতটুকু অনাবৃত ছিল, তা জ্বালাময়ী লাল বলে মনে হল আগুনের আভায়। কামনার রং বোধ হয় ওরকমই হয়।
সারেঙ্গিওয়ালার বড়ো মিঠে হাত। একেবারে কায়েমি সুরে ছড় উঠছিল-নামছিল। ছড়ের এক-এক ঝটকায় রাশ রাশ সুরের চড়াই উড়ছিল, বসছিল, কিচমিচ করছিল।
মুনতজির শুরু করল—
দিলকে আয়িনেমে
হ্যায় তসবির ইয়ার,
যব গর্দান ঝুঁকায়ি
দেখলি…
মাত্র এই চারটি লাইন। মুনতজিরের গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা, কিন্তু গলায় একটা জাদু ছিল। এমন গলায় যারা গান গায়, তাদের গলায় চুমু খেতে ইচ্ছে করে।
ওই চারটি লাইন, এতবার করে, এত করুণ করে, বারে বারে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে লাগল যে কী বলব।
গানের কথাগুলো যদি সত্যি হত? সত্যিই যদি হৃদয়ের আয়নায় তার ছবি থাকত, যদি ঘাড় নীচু করলেই তাকে দেখতে পেতাম? সত্যিই যদি তাই হত!
ইস, সত্যিই যদি তাই হত?
না জানি, মুনতজির তোমার দিলের আয়নায় কার ছবি ছিল। না জানি সে কত খাপসুরত ছিল। না জানি সে তোমাকে কত ব্যথা দিয়েছিল। মুজরা নিয়ে মেহফিলে গেয়ে বেড়াও আর যাই করো, তুমি মেয়ে তো বটেই।
সারেঙ্গির ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলে দুলে তবু গাইতে লাগল মুনতজির— ‘দিলকে আয়িনেমে হ্যায় তসবির ইয়ার, যব গর্দান ঝুঁকায়ি দেখলি’।
এমন সময় হঠাৎ, অতর্কিতে আমাদের পিছন থেকে হো: হো: হো: করে উৎসারিত ফোয়ারার মতো একটি হাসি শোনা গেল।
সেই পাথরের বাড়ির মহলায় মহলায় সে হাসি ছড়িয়ে গেল। গা ছমছম করে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে মুনতজির ও জব্বরের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম যে, সেই পাগল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একচক্ষু অসহায়তার মূর্ত প্রতীক হয়ে। সমস্ত মেহফিলে এক নিথর নিরুপদ্রব নিস্তব্ধতা নেমে এল। মুনতজির চোখ নীচু করে নিল।
ভেবেছিলাম, এইবার জব্বর বেচারা পাগলটিকে মারধোর করবে।
কিন্তু আশ্চর্য! জব্বর কিছুই না করে মিষ্টি গলায় পাগলকে বলল, ক্যা ফৈজু? তুমভি কুছ শুনাওগে?
পাগল, যার নাম এইমাত্র ফৈজু বলে জানলাম, পাগলের মতোই মাথা নাড়ল।
তারপর সে মুনতজিরের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল, কাছে পৌঁছে বারান্দার চওড়া একটা থামের পাশে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল; যেন খুব অন্যায় করেছে।
পরক্ষণেই, সেই রকম মাথা নীচু-করা অবস্থায়ই ফৈজু অভাবনীয় সুললিত গলায় গান শুরু করে দিল, প্রথমে গুনগুন করে, পরে ধীরে ধীরে শীতের রোদ্দুর যেমন কুয়াশা ছাপিয়ে কোয়েল নদীর চড়ার বালিকে রাঙিয়ে তোলে, উষ্ণ করে তোলে, তেমনি করে গাইতে লাগল।
সেই পাথরের বাড়ির খিলানে খিলানে, গম্বুজে-গম্বুজে সারেঙ্গির সুরের চড়াইগুলো একরাশ পায়রা হয়ে যেন ডানা-ঝটপটিয়ে উড়তে লাগল। ফৈজু গাইতে লাগল :
‘অ্যায় হুসন, জি খোলকর
আজ সতাঁলে মুঝকো
কাল মেরি ঈশককো
আন্দাজ বদল যায়েগা…’
অর্থাৎ, ওহে সুন্দরী, ব্যথায় ব্যথায় আমায় নীল করে দাও। তোমার যত সাধ আছে সব সাধ আজ আমায় যন্ত্রণা দিয়ে মিটিয়ে নাও, কারণ সুন্দরী; আগামীকাল আমার প্রেমের প্রকৃতি ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আজও তুমি আমার সম্রাজ্ঞী—তোমার প্রজাকে তুমি যেভাবে পারো আজ পীড়ন করে নাও। আগামীকাল আমার প্রেম, আজকের প্রেম নাও থাকতে পারে। তুমি আমার প্রেমিকা নাও থাকতে পারো।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কলিগুলো বলছিল ফৈজু—।
ওর যে একটিমাত্র চোখ দিয়ে ও দেখতে পায়, তা দিয়ে জল গড়াচ্ছিল।
এমন সময় মুনতজির দৌড়ে এসে ফৈজুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর সে এক দৃশ্য। দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
চ্যাটার্জি বলল, শালা, হচ্ছিল মেহফিল আর এ কী যাত্রা শুরু হল?
আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, যা হচ্ছে সেটাই দেখো না।
জব্বর এমন সময় ওদের প্রায় ঘাড়ে পড়ে কর্কশ গলায় বলল, ঈ কৌনসা রিস্তেদারি বা? দোনো দোনোকে কান পাকাড়কে রোনে লাগা মেহমানোঁকো সামনে? গানা গাও মুনতজির, নেহি তো ফৈজুকো গানে দেও।
ফৈজু খুব অপ্রতিভের মতো হাত দুটো মাথার উপর তুলে নেতিবাচক ভঙ্গিতে নাড়তে লাগল। মুনতজির ওকে নিয়ে এসে খাটের উপরের ফরাসে বসাল এবং জব্বরকে ফিসফিস করে কী বলল। ফৈজুর ঠোঁট দুটো ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছিল। জব্বর গ্লাসে একটু ব্রাণ্ডি এনে আমাদের সামনেই ফৈজুকে দিল।
অতি-বিনয়ের সঙ্গে ফৈজু আমাদের সামনে সেইটুকু খেল— তারপর জার্কিনের হাতা দিয়ে কৃতজ্ঞতা মাখা তৃপ্তির সঙ্গে মুখ মুছল।
এবার সারেঙ্গিওয়ালা ছড়ে বেশ খুশির ঝিলিক আনল, তবলচি ঠেকা দিতে শুরু করল, আর ফৈজু গাইতে শুরু করল, আড়ে আড়ে, বুকের মধ্যেটা মুচড়ে মুচড়ে—
‘মস্ত কর দেও মুঝে সাকি
মগর এক শর্ত পর—
হোঁস ইতনা রহে
কি তুঝে ইয়াদ করে…।’
দু-জন দু-জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
সাকি তুমি আমায় মস্ত করে দাও, বিলকুল বেহুঁশ করে দাও— কিন্তু আমার অন্তত ততটুকু হুঁশ যেন থাকে, যাতে তোমায় মনে রাখতে পারি, মনে করতে পারি।
‘হোঁস ইতনা রহে কি তুঝে ইয়াদ করে।’
বড়ো ভালো গলা ফৈজুর, মেঘগর্জনের মতো গম্ভীর, হরিণের মতো ক্ষিপ্র পাতাবাহারের ডাল থেকে শিশির ঝরার শব্দের মতো মিষ্টি।
পাগল বলেই হোক, অথবা করুণ বিষণ্ণ ক্লিষ্ট চেহারা ও একচোখ কানা বলেই হোক— সেই আগুনের দপদপানো আভায়, সেই আদিগন্ত জঙ্গল পাহাড় ঘেরা নির্জন মুলিমালোঁয়ায় সেই মোহময় শীতার্ত রাতে যে গান শুনেছিলাম, তা বহুদিন মনে ছিল।
ফৈজুর গানের পর আগুনে ফুটফাট করে কাঠ পুড়তে লাগল। সাদা হালকা ছাই সারেঙ্গির ছড়ের’ টানে টানে, আগুনের মুখে ফোয়ারার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল।
একটির পর একটি গান গেয়ে চলল মুনতজির।
ফৈজুর সঙ্গে আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইলাম।
পরদিন রওয়ানা হবার আগে জব্বরকে শুধোলাম, গত রাতের ব্যাপারটা কী? ওটা কি পাগলের নিছক পাগলামি? না আরো গভীর?
জব্বর বলল, ব্যাপার অনেক, সংক্ষেপে বলি শোনো। তারপর জব্বর কবির মতো আমাদের সেই ব্যাপার শোনাল :
আমার গুণধর কাকা মুনতজিরের মাকে এখানেই রেখে দিয়েছিলেন— সঙ্গে মুনতজিরকেও। তার বয়স তখন সবে সতেরো-আঠারো। ফৈজু তখন এই গ্রামেই থাকত। কাঠের ঠিকাদারের চাকরি করত। তখন ওর বয়স বড়ো জোর চব্বিশ-পঁচিশ। এ বাড়িতে ফৈজুর অবাধ গতি ছিল। বিশেষ করে আমার কাকা যখন থাকতেন না। মুনতজিরের মা ফৈজুকে খুব ভালোবাসত এবং ওকে দিয়ে নানা রকম ফাইফরমাশ, যথা ডালটনগঞ্জ থেকে ঈতরসুর্মা কিনে আনা; ইত্যাদি করিয়ে নিত।
ফৈজু আর মুনতজির দু-জনে দু-জনের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু তখন দু-জনে এত লাজুক ছিল যে, সে ভালোবাসা তাদের চোখের ভালোবাসাতে এসেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। আর এগোতে পায়নি।
একদিন সকালে রোদ উঠেছিল। বসন্তের সকাল। আকাশটা সমুদ্রের মতো নীল। হাওয়াতে জঙ্গলের হুরীদের রেহেতরীন খুশবু বনটিয়ার ঝাঁককে ধাওয়া করে ফিরছিল। পেয়ারাডালে বসে একটি হলুদ-বসন্ত পাখি নিজের মনে কত কী বলছিল— আর উনিশ বছরের মুনতজির প্রথম ফোটা বেগনে বসরাই গোলাপের মতো শরীরে কিছুই না পরে, কুঁয়োতলার রোদ্দুরে একটি শিষ দেওয়া হাঁসীর মতো চান করছিল। আর ওই দরজার ফাটলে চোখ লাগিয়ে চোরের মতো, ভিখিরির মতো, বেশরম ফৈজু, স্বপ্নে দেখা মুনতজিরের নিক্কণিত নগ্নতাকে চোখ দিয়ে চুমু খাচ্ছিল। মুনতজির চান করছিল— আর হয়তো মনে মনে কারো কথা ভাবছিল— হাওয়া লাগা শিশুগাছের পাতার মতো তার আলো পিছলানো ভিজে বুক দুটি থরথরিয়ে কেঁপে উঠছিল।
হঠাৎ মুনতজিরের চোখ গেল দরজার দিকে, ফাটলের দিকে, তারপর ফাটলের আড়ালে একটি চোখের দিকে।
চমকে উঠে একপাশে সরে গেল সে। সেই চোখের দৃষ্টির বাইরে তারপর কাঁপা-কাঁপা গলায় গান গাইতে গাইতে, যেন জলে ঈতর মেশাচ্ছে, কী, যেন রোদ্দুরে চুল ঝাড়ছে, এইভাবে পেয়ারাগাছ থেকে একটি সরু ডাল ভেঙে নিয়ে পা-টিপে-টিপে পাশ দিয়ে গিয়ে সোজা সেই চোখ লক্ষ করে ঢুকিয়ে দিল।
ফৈজুর একটি চোখের কালো মণিতে যে স্নানরতা হাঁসের ছায়াটা কাঁপছিল এতক্ষণ— তা, এক আঁজলা রক্ত হয়ে গলে গেল।
পরে নাকি মুনতজির অনেকই কেঁদেছিল।
বেশরম ফৈজু…মুনতজিরের নিক্কণিত নগ্নতাকে চোখ দিয়ে চুমু খাচ্ছিল ।
ফৈজুর মাথা, নিজের বুকে রেখে, অনেক করে বলেছিল; যে আমার কী এমন ছিল যা তুমি চাইলে পেতে না? কী এমন দর্শনের, স্পর্শনের, ঘ্রাণের ছিল, আমার কাছে যা তোমার নিজের হাতের নাগালের বাইরে ছিল? যে ছবির অনুপ্রেরণা তুমি, সে ছবি তুমি লুকিয়ে চুরি করে দেখতে গেলে কেন? এ তুমি কী করলে ফৈজু, এ তুমি কী করলে?
অথচ ফৈজু কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ হারানোর শারীরিক যন্ত্রণায় ও অভাবনীয়তায় পাগল হয়ে গেল। সেই থেকে সে খালি কবিতা আওড়ায় আর টি-টি পাখির মতো চমকে চমকে বেড়ায়।
মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ ফৈজুর সঙ্গে দেখা।
মসজিদের সিঁড়িতে বসে রোদ পোয়াচ্ছে। একা একা। কোনো অভিমান নেই, অভিযোগ নেই, দুঃখ নেই। এক চরম ও পরম নির্লিপ্ত প্রশান্তি নিয়ে সে বসে আছে।
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে একটি দশ টাকার নোট ওর হাতে দিলাম।
ফৈজু ফিক করে হেসে উঠল।
তারপর নোটটা ফসস করে ছিঁড়ে দু-টুকরো করে দিল।
বিড়বিড় করতে করতে দুহাতের তেলো উলটে বলল, ‘কাল মেরি ঈশককা আন্দাজ বদল যায়ে গা…।’