ইলেভেন মিনিটস – ৫

পাঁচ 

পরদিন দোভাষী-কাম-নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেলসন, যে এখন নিজেকে মারিয়ার এজেন্ট বলেও দাবি করে, তাকে মারিয়া জানাল সে সুইস লোকটির প্রস্তাব গ্রহণ করবে এবং সেটা সুইস কনস্যুলেট থেকে জারিকৃত ডকুমেন্ট হাতে পাবার পরেই। এ ধরনের শর্তে অভ্যস্ত বিদেশী মানুষটি জানাল সে-ও এরকম কিছু একটা চাইছে কারণ মারিয়া যদি তার দেশে কাজ করে তাহলে তার একখণ্ড কাগজের দরকার হবে যাতে লেখা থাকবে মারিয়া যে কাজ করছে সেটা অন্য কেউ করতে পারবে না। অবশ্য এরকম কাগজ পেতে মারিয়ার সমস্যা হবে না কারণ সুইস নারীরা সাম্বা নৃত্য জানে না। তারা সবাই মিলে শহরে এল। সিকিউরিটি অফিসার-কাম-ইন্টারপ্রেটার-কাম- এজেন্ট মেলসন চুক্তি সই হওয়া মাত্র নগদ অর্থ চেয়ে বসল। মারিয়া যে পাঁচশ ডলার পেয়েছে তার শতকরা ত্রিশ ভাগ কমিশন। 

‘এটা এক সপ্তাহের অ্যাডভান্স পেমেন্ট। এক সপ্তাহ, বুঝতে পেরেছেন? আপনি এখন থেকে সপ্তাহে পাঁচশ ডলার আয় করবেন।’ 

যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল মারিয়া তা হঠাৎ করেই এসে গেল। তবে ভেতরে ভেতরে শঙ্কাবোধ করল ও। এই চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি, যা সম্পর্কে সে জানে না তা কীভাবে গ্রহণ করবে? যে জীবনের সঙ্গে ও অভ্যস্ত তাকে কীভাবে পেছনে ফেলে যাবে? ভার্জিন মেরী ওকে এত দূরে পাঠাচ্ছেন কেন? 

মারিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিল এই ভেবে যে সে যে কোনও মুহূর্তে মত বদলাতে পারবে। ওর কাছে এখন সাড়ে তিনশ ডলার আছে। সে ইচ্ছে করলেই কাল ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে কেটে পড়তে পারে। কেউ ওর খোঁজ পাবে না। 

কনস্যুলেটে যাবার দিন বিকেলে মারিয়া একা একা হাঁটতে বেরুল সাগর- সৈকতে। হাঁটতে হাঁটতে দেখল শিশুদের, ভলিবল খেলোয়াড়, ভিখিরী, মাতাল, ব্রাজিলীয় ঐতিহ্যের আর্টিফ্যাক্টস (এগুলো আসলে চীনের তৈরি), বুড়োদের জগিং ও ব্যায়াম, বিদেশী পর্যটক, মা ও সন্তান, অবসর ভোগীদের তাস খেলা ইত্যাদি কোনও কিছুই তার নজর এড়িয়ে গেল না। সে রিও ডি জেনিরোতে এসেছে, পাঁচ তারা রেস্টুরেন্টে খেয়েছে, গিয়েছে কনস্যুলেট অফিসে, সাক্ষাৎ হয়েছে এক বিদেশীর সঙ্গে, তার একজন এজেন্ট হয়েছে, তাকে একটি পোশাক এবং এক জোড়া অত্যন্ত দামী জুতো উপহার দেয়া হয়েছে যা তার বাড়ির কেউ কস্মিনকালে চোখেও দেখেনি। 

এরপরে কী? 

সাগরের দিকে তাকাল মারিয়া : ভৌগোলিক শিক্ষা তাকে বলছে সে যদি উপকূল রেখা বরাবর এগিয়ে যায়, পৌঁছে যাবে আফ্রিকায়, গরিলা আর সিংহে পূর্ণ অরণ্যে। আর যদি উত্তরে এগোয়, যাত্রা শেষ হবে ইউরোপে ওখানে আছে আইফেল টাওয়ার, ইউরো ডিজনি এবং পিসার হেলানো টাওয়ার। মারিয়ার হারাবার কী আছে? প্রতিটি ব্রাজিলিয়ান মেয়ের মত ‘মা’ ডাকার আগে সে শিখে নিয়েছে সাম্বা নাচ; কাজটা পছন্দ না হলে ফিরে আসতে তো সে পারছেই। সে জানে কাজটা করলে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে। 

মারিয়া জীবনে অনেক ক্ষেত্রে ‘না’ বলেছে আসলে যেখানে সে ‘হ্যাঁ’ বলতে চেয়েছিল। সে এখন অজানা এক সাগর পাড়ি দিতে চলেছে। সে এ সমুদ্র পাড়ি নাও দিতে পারে ‘না’ বলে দিতে পারে। কিন্তু সারা জীবন তারপর আফসোস থেকে যাবে, সেই ছেলেটিকে নিয়ে যে আফসোসটা এখনও করছে, যে ছেলেটি ওর কাছে পেন্সিল ধার নিতে এসেছিল–ওর প্রথম প্রেম? মারিয়া সবসময়ই ‘না’ বলতে পারে, অন্তত এবার ‘হ্যাঁ’ বলতে দোষ কোথায়? 

‘হ্যাঁ’ বলতে না পারার কারণ খুব সাধারণ। সে এসেছে ব্রাজিলের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল থেকে, ভালো একটি স্কুলে পড়া, টিভি নাটক দেখা ছাড়া তার অন্য কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আর সে জানে সে সুন্দরী। এটুকু অভিজ্ঞতা নিয়ে পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়া যায় না। 

মারিয়া লক্ষ করল একদল লোক সাগরের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে কিন্তু জলে নামতে সাহস পাচ্ছে না। দিন দুই আগে ওরও একই রকম অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু মারিয়ার এখন কোনও ভয়ডর নেই। সে চাইলেই স্বচ্ছন্দে জলে নেমে যেতে পারে, যেন জল কুমারী। 

নীরবে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করল মারিয়া, ভার্জিন মেরীর কাছে পরামর্শ চাইল। একটু বাদে শক্তি ফিরে পেল সে। সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে মারিয়া কারণ নিজেকে মনে হচ্ছে সুরক্ষিত। সে ইচ্ছে করলেই ফিরে আসতে পারবে, কিন্তু এ ধরনের সুযোগ হয়তো আর মিলবে না। এ ঝুঁকি নেয়ায় লাভ আছে। 

মনটা খুশিতে ভরে আছে মারিয়ার। সুইস পর্যটক আবার যখন সাপারে নিমন্ত্রণ করল ওকে, লোকটাকে প্রলোভিত করে তুলতে চাইল সে। লোকটার হাত ধরল। কিন্তু লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে নিল হাত। ভয় এবং স্বস্তি নিয়ে মারিয়া উপলব্ধি করল এ লোক যা বলেছে সে ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস 

‘সাম্বা তারকা!’ বলল লোকটা। ‘সুন্দরী ব্রাজিলিয়ান সাম্বা তারকা! সামনের সপ্তাহে যাব!’ 

সবই ঠিক আছে কিন্তু ‘সামনের সপ্তাহে’ই যাওয়া সম্ভব নয়। মারিয়া ব্যাখ্যা করল পরিবারের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনও সিদ্ধান্তে সে আসতে পারবে না। রেগে গেল সুইস, মারিয়াকে দস্তখত করা চুক্তিপত্র দেখাল। প্রথমবারের মত ভয় পেল মারিয়া। 

‘চুক্তি!’ বলল সুইচ। 

বাড়ি ফেরার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেও মারিয়া ঠিক করল আগে এজেন্ট মেলসনের সঙ্গে কথা বলবে। শত হলেও তাকে মারিয়া টাকা দিয়েছে পরামর্শ নেয়ার জন্য। 

মেলসন এক জার্মান ট্যুরিস্টকে পটাতে ব্যস্ত। মহিলা মাত্র হোটেলে এসে পৌঁছেছে, ন্যাংটো হয়ে সূর্য-স্নান করছে সৈকতে। মহিলার মতে বিশ্বের সবচেয়ে উদার দেশ হলো ব্রাজিল (মহিলা লক্ষ করেনি সৈকতে সে-ই একমাত্র নগ্ন বক্ষা যার খাড়াখাড়া বুকের দিকে অন্যরা আড়চোখে, অস্বস্তি নিয়ে তাকাচ্ছে)। মেলসনের মনোযোগ নিজের দিকে ফেরাতে রীতিমত বেগ পেতে হলো মারিয়াকে। 

‘আমি যদি আমার মত বদলে ফেলি?’ জিজ্ঞেস করল ও। 

‘চুক্তিতে কী লেখা আছে জানি না আমি। তবে আমার ধারণা ওই লোক আপনাকে পুলিশের হাতে দিতে পারে।’ 

‘আমার খোঁজই তো সে পাবে না!’ 

‘ঠিকই তো! তাহলে খামোকা দুশ্চিন্তা করছেন কেন?’ 

সুইস লোকটা এদিকে মারিয়ার পেছনে পাঁচশ ডলার জুতো ও ড্রেস কেনা, রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো সহ আনুষঙ্গিক খরচ করে উৎকণ্ঠায় আছে উৎকণ্ঠার কারণ মারিয়া বার বার বাড়ি ফিরতে চাইছে, তার বাবা মা’র সঙ্গে কথা বলার অজুহাতে। সুইস ঠিক করল সে দুটো প্লেনের টিকেট কাটবে, মারিয়ার সঙ্গে যাবে তার শহরে- দু’দিনের মধ্যে কাজ সেরে ওই সপ্তাহের মধ্যেই ইউরোপে ফেরা যাবে যদি কথামত কাজ হয়। মারিয়া অবশ্য বুঝতে পেরেছে এ লোককে ফাঁকি দেয়া যাবে না। চুক্তি অনুযায়ীই তাকে কাজ করতে হবে। 

.

মারিয়াদের ছোট্ট শহরের সবাই অবাক হলো এবং গর্ব অনুভব করল ওর সঙ্গে এক বিদেশীকে দেখে। এ বিদেশী মারিয়াকে ইউরোপে নিয়ে গিয়ে বড় তারকা বানাবে বলে কথা দিয়েছে। মারিয়াদের প্রতিবেশীরা খুব দ্রুত জেনে গেল ঘটনা, তার পুরানো স্কুল বান্ধবীরা প্রশ্ন করল : 

‘কীভাবে ঘটল এটা?’ 

‘স্রেফ ভাগ্য,’ মারিয়ার জবাব। 

ওরা জানতে চাইল রিও ডি জেনিরোতে এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটে কিনা, কারণ টিভিতে তারা এরকম নাটক বহু দেখেছে। 

মারিয়ার সঙ্গে সুইস লোকটি ওদের বাসায় গেল। মারিয়ার বাবা মাকে ‘L’ অক্ষরে লেখা ব্রাজিল নামাঙ্কিত একটি লিফলেট দিল। মারিয়া জানাল তার এখন একজন এজেন্ট আছে এবং সে অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চায়। মারিয়ার মা সুইস লোকটার দেয়া বিকিনি পরিহিতা মেয়েগুলোর ছবি একপলক দেখেই ফেরত দিলেন। তিনি এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করা সমীচীন মনে করলেন না। আসল কথা হলো তাঁর মেয়ে সুখী এবং ধনী হলেই হলো। অসুখী হলেও আপত্তি নেই যদি ওর অঢেল টাকা থাকে। 

‘লোকটার নাম কী? ‘ 

‘রজার।’ 

‘রজারিও! আমার এক কাজিন আছে রজারিও নাম!’ 

লোকটা হেসে উঠে হাততালি দিল। ওরা বুঝতে পারল এ লোক ওদের কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারে নি। মারিয়ার বাবা বললেন : 

‘এ লোক তো আমার বয়সী!’ 

মারিয়ার মা স্বামীকে নিষেধ করলেন মেয়ের সুখের মধ্যে যেন নাক না গলায়। তিনি মারিয়াকে কিছু উপদেশ দিলেন : 

‘সোনা, গরীব স্বামী নিয়ে সুখী হবার চেয়ে পয়সাঅলা লোককে নিয়ে অসুখী জীবন যাপন অনেক ভালো। ওখানে হয়তো ধনী হবার সুযোগ হবে তোমার। যদি হতে না পারো সোজা বাসে উঠে ফিরে এসো বাড়ি।’ 

গাঁয়ের মেয়ে হতে পারে মারিয়া তবে সে তার মা’র চেয়ে ঘটে বেশি বুদ্ধি রাখে। সে পরিষ্কার বলল : 

‘মা, ইউরোপ থেকে ব্রাজিলে বাসে চড়ে আসা যায় না। তা ছাড়া, আমি সংস্কৃত শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চাই, বিয়ে করতে চাই না। 

মারিয়ার মা হতাশ হয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। 

‘তুমি ওখানে গেলে ফিরেও আসতে পারবে। অভিনেত্রী হতে পারাটা একজন তরুণীর জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। তবে যতদিন রূপ থাকবে, থাকবে যৌবন ততদিন এ লাইনে কদর পাবে। ত্রিশের পরে তোমার যৌবনে ভাটা পড়া শুরু হবে। কাজেই সুযোগের সদ্ব্যবহার এখনই করে নাও। সৎ, তোমাকে ভালোবাসে এমন কাউকে বেছে নিয়ে বিয়ে করে ফ্যালো তাকে। প্রেম তেমন জরুরি বিষয় নয়। তোমার বাবাকে দেখে আমি তো প্রথমে প্রেমে পড়ে যাই নি। তবে টাকা সব কিছু কিনতে পারে। তোমার বাবাকে দ্যাখো উনি এমনকী ধনীও নন।’ 

মারিয়ার দোকানের বস বলল : 

‘হ্যাঁ, শুনেছি একটি বড় ফরাসী কোম্পানি তোমাকে প্যারিসে নিয়ে যেতে চাইছে। সুখের সন্ধানে যাচ্ছ তুমি। তোমাকে আমি বাধা দিতে পারি না। তবে যাবার আগে তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।’ 

পকেট থেকে চেইনে বাঁধা একটা মেডেল বের করল সে। 

‘এ হলো আমাদের লেডি অব দা গ্রেস-এর মিরাকুলাস মেডেল। প্যারিসে এর নামে গির্জা আছে। ওখানে গিয়ে নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করো। দ্যাখো, ভার্জিন মেরীর ছবির পাশে কিছু কথা লেখা আছে।’ 

মারিয়া পড়ল : ‘Hail mary conceived without sin, Pray for us who turn to you, Amen. ‘ 

‘প্রতিদিন অন্তত একবার প্রার্থনা কোরো। আর…’ 

ইতস্তত করল সে। 

‘…আর কোনওদিন যদি ফিরে আসো, তোমার জন্য অপেক্ষা করব আমি। তোমাকে খুব সহজ একটা কথা বলার সুযোগ কখনোই পাইনি। এখন বলছি : আমি তোমাকে ভালোবাসি। হয়তো দেরি হয়ে গেল অনেক, তবু কথাটা তোমাকে জানানো দরকার ছিল।’ 

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই তিনটে শব্দ তার বাইশ বছর বয়সে বহুবার শুনেছে মারিয়া। তার কাছে এ কথা এখন কোনও অর্থ বহন করে না, অসাড় মনে হয়। কারণ এ শব্দগুলো তার জীবনে গভীর কোনও সম্পর্কে মোড় নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মারিয়া তার বসকে ধন্যবাদ দিল, তাকে নিজের গালে চুমু খাওয়ার সুযোগ দিল এবং পেছনে একবারও ফিরে না তাকিয়ে চলে এল। 

.

রিও ডি জেনিরোতে ফিরে এল ওরা। একদিনের মধ্যে পাসপোর্টের ব্যবস্থা হয়ে গেল। মেলসনের সাহায্যে জরুরি জিনিসপত্রগুলো (জামা, জুতো, মেকআপসহ একটি মেয়ের যা যা দরকার সব কিছু) কিনে ফেলল। ইউরোপ যাত্রার আগে আগে ওরা একটি নাইটক্লাবে গেল, রজার সেখানে নাচতে দেখল মারিয়াকে। সঠিক মেয়েটিকেই পছন্দ করেছে ভেবে সন্তুষ্ট হলো সে। মানস চক্ষে দেখতে পেল এ মেয়ে ক্যাবারে কলোনি’র ভবিষ্যত তারকা হতে চলেছে। সুইস কনস্যুলেটে ওয়ার্ক পারমিট রেডিই ছিল। ওরা ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে পরদিন বিমানে চড়ে উড়াল দিল চকোলেট, ঘড়ি আর পনিরের দেশে। মারিয়া মনে মনে ভাবছে এ লোকটিকে তার প্রেমে ফেলবে। এ লোক বুড়ো, কুৎসিত কিংবা গরীব নয়। কাজেই মারিয়ার আর কী চাই? 

ছয় 

বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বিমান বন্দরে নামল মারিয়া। তার বুক ঢিপঢিপ করছে ভয়ে : কারণ বুঝতে পারছে পাশের মানুষটার ওপর এখন থেকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে তাকে। এ দেশ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, জানে না এ দেশের ভাষা, এখানে কেমন ঠাণ্ডা পড়ে তাও জানা নেই তার। রজারের আচরণও অনেকটা বদলে গেছে। হাসি হাসি ভাবটা চেহারা থেকে উধাও, সে যদিও মারিয়াকে চুমু খেতে চেষ্টা করেনি কিংবা তার বুকের দিকে হাত বাড়ায় নি, কিন্তু তার চাউনি যেন ক্রমাগত দূরাগত হয়ে পড়ছে। সে মারিয়াকে নিয়ে একটি ছোট হোটেলে উঠল। ভিভিয়ান নামে মলিন চেহারার আরেক ব্রাজিলীয় তরুণীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। এ মেয়ে বুঝিয়ে দেবে মারিয়ার কাজ। 

ভিভিয়ান শীতল দৃষ্টিতে মারিয়ার আপাদমস্তক দেখল। তার চেহারায় সহানুভূতির ছিটে ফোঁটাও নেই। মারিয়া কেমন আছে জিজ্ঞেস করার ধার না ধেরে সরাসরি কাজের কথায় চলে এল সে। 

‘নিজের সঙ্গে প্রতারণা করবে না। রজারের কোনও নর্তকী বিয়ে করে ফেললেই সে ব্রাজিল চলে যায় আরেক নর্তকীর সন্ধানে। আর বিয়ে করার ব্যাপারটা হামেশাই ঘটছে। সে জানে তুমি কী চাও, এবং আমার ধারণা তুমিও জান। তুমি সম্ভবত অ্যাডভেঞ্চার, টাকা অথবা স্বামী এই তিনটির যে কোনও একটি পাবার জন্য এখানে এসেছ, না?’ 

এ মেয়ে এ কথা জানল কী করে? তাহলে কী সবাই একই জিনিস চাইছে? নাকি ভিভিয়ান মানুষের মনের কথা পড়তে পারে? 

‘এখানকার সব মেয়েই এ তিনটি জিনিসের যে কোনও একটির খোঁজে এখানে আসে,’ বলে চলল ভিভিয়ান। মারিয়া নিশ্চিত হলো মেয়েটা সত্যি মানুষের মনের কথা পড়তে পারে। ‘অ্যাডভেঞ্চার করার যদি ইচ্ছে থাকে, পারবে না। কারণ এ দেশে ভয়ানক ঠাণ্ডা পড়ে। তাছাড়া ভ্রমণ করার মতো টাকা-পয়সাও জোগাড় হবে না। আর টাকা; ঘরভাড়া এবং বোর্ডের প্রাপ্য টাকা দেয়ার পরে, প্রায় এক বছর তোমাকে কাজ করতে হবে বাড়ি ফেরার টিকেটের টাকা জোগাড় করার জন্য। 

‘কিন্তু…’ 

‘আমি জানি, তোমার চুক্তিতে এসব কথা লেখা ছিল না। কিন্তু সত্য হলো এই, অনেকের মতো তুমিও এ নিয়ে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলে। যদি আরেকটু সতর্ক হতে, ভালো করে চুক্তিপত্র পড়ে নিতে, বুঝতে পারতে তুমি আসলে ঠিক কীসের মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছ। কারণ সুইসরা মিথ্যা কথা বলে না, তারা চুপ করে থাকে। আর নীরবতাই তাদেরকে সাহায্য করে।’ 

মারিয়ার মনে হলো তার পায়ের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। 

‘আর স্বামী চাইলে বলি, কোনও মেয়ের বিয়ে করা মানে রজারের বিরাট আর্থিক ক্ষতি হওয়া। এজন্য কাস্টমারদের সঙ্গে আমাদের কথা বলা নিষেধ। তবু তোমার মনোযোগ যদি ওদিকে থাকে, তোমাকে দারুণ ঝুঁকি নিতে হবে। এটা রু-ডি বার্নের মতো নয় যে চাইলেই কাউকে পছন্দ করে ফেলতে পারবে।’ 

রু ডি বার্ন? 

‘পুরুষরা এখানে আসে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে, তবে পারিবারিকভাবে অশান্তিতে থাকা কিছু ট্যুরিস্ট নারী সঙ্গ খুঁজে বেড়ায়। ধরে নিচ্ছি তুমি ভালো নাচতে জান, গানটাও যদি ভালো গাইতে পার, তোমার বেতন বেড়ে যাবে। তবে অন্য মেয়েরা তোমাকে ঈর্ষা করবে। কাজেই ব্রাজিলের সেরা গায়িকা হলেও সে কথা ভুলে যাও। গান গাইবার চেষ্টাও কোরো না। আর একটা কথা, ফোন ব্যবহার কোরো না। ফোন করতে গেলে যা আয় করবে তার পুরোটাই খরচ হয়ে যাবে। তাছাড়া উপার্জনও বিরাট কিছু হবে না।’ 

‘কিন্তু রজার আমাকে বলেছে সপ্তায় পাঁচশ ডলার দেবে।’ 

‘ও, আচ্ছা!’ 

.

সুইজারল্যান্ডে মারিয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহ থাকাকালীন ডায়েরি থেকে উদ্ধৃতি : 

আমি নাইটক্লাবে গিয়েছিলাম। নৃত্য পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। সে মরক্কো নামে একটা দেশ থেকে এসেছে। সে জীবনেও ব্রাজিলে যায়নি, সাম্বা সম্পর্কে কিছু জানে না। অথচ সে নাচের যে মুদ্রা দেখিয়ে দেবে সেভাবেই নাচতে হবে আমাকে। লম্বা যাত্রার ধকল সামলে না উঠতেই প্রথম রাতেই আমাকে মঞ্চে নাচতে হলো মুখে হাসি ধরে। আমরা মোট ছ’জন, কেউই সুখী নই, জানি না এখানে কী করছি। খদ্দেররা মদের গ্লাসে চুমুক দেয়, হাততালি দেয়, চুমু ছুঁড়ে দেয় এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। 

গতকাল বেতন পেলাম, চুক্তির দশভাগের এক ভাগ টাকা, বাকিটা, চুক্তি অনুযায়ী আমার প্লেন ও এখানকার বাড়ি ভাড়া হিসেবে কেটে রেখে দেয়া হয়েছে। ভিভিয়ানের হিসেব অনুযায়ী এক বছর লাগবে পুরোটা শোধ হতে। তার মানে এই সময়ের মধ্যে পালাবার উপায় নেই। 

অবশ্য পালিয়ে যাবটাই বা কোথায়? মাত্র তো এলাম। এখনও কিছু দেখিনি। এক সপ্তায় সাতদিন নাচার মধ্যে তেমন কোনও অসুবিধা দেখতে পাচ্ছি না। আগে আনন্দ পেতে নাচতাম এখন টাকা এবং খ্যাতির জন্য কাজটা করছি; আমার পা ব্যথায় টনটন করে না, শুধু সমস্যা হলো মুখে মেকি হাসিটা ধরে রাখা। 

আমি এ পৃথিবীর ভিক্টিম হতে পারি অথবা দৌলতের অনুসন্ধানকারীও হতে পারি। পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করছে জীবনটাকে আমি কীভাবে দেখব তার ওপর। 

সাত 

দৌলতের সন্ধানে নেমেছে মারিয়া— সে তার সমস্ত আবেগ অনুভূতি জোর করে দূরে ঠেলে রাখল, প্রতি রাতের কান্না বাদ দিল, চেনা জানা সকল মানুষের কথা ভুলে গেল; আবিষ্কার করল সে খুব সহজে ভান করতে পারে যেন সে সদ্য জন্ম নিয়েছে। কাজেই কারও জন্য মন খারাপ করার তার দরকার নেই। আবেগ অনুভূতি আপাতত দূরে থাকুক, মারিয়ার এখন কিছু টাকা-পয়সা কামাই করা দরকার, দেশটাকে সে জানতে চায়, তারপর বাড়ি ফিরবে বিজয়ীর বেশে। 

আশপাশের সবকিছুই বড্ড চেনা মনে হতে থাকে মারিয়ার, যেন নিজের ছোট শহরটিতেই আছে। মহিলারা পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলে, পুরুষদের বিরুদ্ধে তাদের অনুযোগের শেষ নেই, তারা চিৎকার না করে কথা বলতে পারে না, কর্মঘণ্টা নিয়ে অভিযোগ তাদের, বসদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, নিজেদেরকে তারা মনে করে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী, স্বপ্নের রাজপুত্রদের গল্প বলে। এই রাজপুত্রদের বাস অনেক দূরে, তারা কেউ কেউ বিবাহিত, কেউ বা হতদরিদ্র। এ কারণে তাদেরকে ত্যাগ করেছে এরা। 

মারিয়াদের ক্লাবের মেয়েরা ‘সাম্বা নৃত্য শিল্পী’ হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছে। ক্লাবে কোনও কাস্টমারকে আমন্ত্রণ করা বা কারও সঙ্গে বাইরে যাওয়া নিষেধ। কারও কাছে কোনও কাস্টমারের ফোন নাম্বার পাওয়া গেলে তাকে দু’সপ্তাহর জন্য কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। মারিয়া যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে এখানে এসেছিল, ধীরে ধীরে এখানকার ক্লান্তিকর, একঘেয়ে জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে লাগল। 

প্রথম দুই সপ্তাহ বোর্ডিং হাউজ থেকে প্রায় বেরুলই না মারিয়া। এখানেই সে থাকে। বেরুল না কারণ সে লক্ষ করেছে বাইরের কেউ তার ভাষায় কথা বলে না। অবাক হয়েছে দেখে যে শহরে সে বাস করছে এ শহরটির দু’টি নাম। স্থানীয়রা বলে জেনেভা, ব্রাজিলিয়ানরা বলে জেনেব্রা। 

মারিয়ার ঘরে টিভি পর্যন্ত নেই। অসহ্য সময়গুলো নীরবে পার করে দেয় সে। কয়েকদিন পরে এ সিদ্ধান্তে এল মারিয়া : 

১. নিজেকে মেলে ধরতে না পারলে সে যা চাইছে তা কোনওদিনই পাবে না। এজন্য স্থানীয় ভাষা তাকে শিখতে হবে। 

২. যেহেতু তার সহকর্মীদের সবার প্রত্যাশা একই রকম কাজেই মারিয়াকে ভিন্ন কিছু চাইতে হবে। তবে সেটা কী এখনও জানে না সে। 

জেনেভা/জেনেব্রায় আসার চার সপ্তাহ পরে মারিয়ার ডায়েরি থেকে উদ্ধৃত : 

আমি এক শূন্যতার মাঝে এসে পড়েছি। আমি এখানকার ভাষায় কথা বলতে পারি না। সারাটা দিন কাটে আমার রেডিওতে গান শুনে, ঘরের চারপাশে পায়চারি করে, ভাবি ব্রাজিলের কথা, কাজ শুরু করার জন্য মুখিয়ে থাকি আমি কিন্তু কাজ করার সময় মুখিয়ে থাকি কখন বোর্ডিং হাউজে ফিরব। এক হিসেবে বলা যায়, আমি ভবিষ্যতে বাস করছি, বর্তমানে নয়। 

একদিন, অদূর ভবিষ্যতে, আমি বাড়ি ফেরার টিকেট পাব, ফিরে যেতে পারব ব্রাজিলে, কাপড় ব্যবসায়ীকে বিয়ে করব এবং ঈর্ষাকাতর বান্ধবীদের গা জ্বলা মন্তব্য শুনতে হবে বার। নিজেরা কখনও ঝুঁকি নিতে সাহস করে না, শুধু অন্যদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। না, আমি এভাবে ফিরে যেতে পারি না। তারচে’ প্লেন থেকে লাফ মেরে সাগরে পড়া ঢের ভালো। 

কিন্তু যেহেতু প্লেনের জানালা খোলার উপায় নেই, কাজেই আমাকে এখানেই মরতে হবে। তবে মৃত্যুর আগে লড়াই করব জীবনের জন্য। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে যেখানে খুশি যেতে পারব। 

আট 

পরদিন ফরাসী ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হলো মারিয়া। সকালে ক্লাস হয়। নানা বিশ্বাস ও বয়সের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো ওর। ঝলমলে রঙিন পোশাক পরে এসেছে তারা, মহিলাদের হাতে সোনার ব্রেসলেট, মাথায় স্কার্ফ, শিশুরা বড়দের চেয়ে দ্রুত শিখছে। মারিয়া গর্ব অনুভব করল দেখে সবাই তার দেশের নাম জানে- কার্নিভাল, সাম্বা, ফুটবল, এবং বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ পেলে’র খবর ওরা রাখে। 

বিকেলে, ভাষাটা প্রাকটিস করার জন্য দুই নামের এ শহরে বেরিয়ে পড়ে মারিয়া। সে স্বাদ নিল চমৎকার চকোলেট এবং পনিরের। এমন স্বাদের জিনিস জীবনে খায়নি ও। একটা লেক দেখতে পেল ও, মাঝখানে প্রকাণ্ড একটি ঝর্ণা, এখানে বরফ পড়ে, এখানকার রেস্টুরেন্টে ফায়ার প্লেস আছে (যদিও কোনও রেস্টুরেন্টে ঢোকেনি মারিয়া, শুধু বাইরে থেকে দেখেছে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে)। ও দেখে বিস্মিত সব দোকানেই ঘড়ির সাইনবোর্ড লাগানো নেই; কিছু ব্যাংকও আছে। যদিও ওর মাথায় ঢোকে না এত অল্প মানুষের শহরে এতগুলো ব্যাংকের কী দরকার। ব্যাংকের ভেতরেও খুব কম মানুষই ঢুকতে দেখেছে মারিয়া। তবে এ ব্যাপারে কাউকে প্রশ্ন করতে সাহস হয় না ওর। 

তিন মাস কঠোর পরিশ্রম করল মারিয়া। সবার চোখে সে সেক্সি এবং সংবেদনশীল। সে এক আরবের প্রেমে পড়ল। যুবক তার সঙ্গেই ফরাসী ভাষা শিখেছে। তবে সম্পর্ক টিকল মাত্র তিন সপ্তাহ। সে এক রাতে সিদ্ধান্ত নিল ছুটি নেবে। সে জেনেভার বাইরে এক পাহাড়ে গেল ঘুরতে। খবর চলে গেল রজারের কাছে। পরদিন কাজে যেতেই তোপের মুখে পড়তে হলো ওকে। 

সে মাত্র দরজা খুলেছে, উন্মাদ রজার তার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। মৃগীরোগীর মত চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, সে আবার ভুল করেছে, বুঝতে পেরেছে ব্রাজিলের মেয়েদের আসলে বিশ্বাস করতে নেই। মারিয়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করল হঠাৎ জ্বর আসার কারণে সে গতকাল আসতে পারে নি কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করল না সুইস। বলল সে আবার ব্রাজিলে যাবে, মারিয়ার বদলে নিয়ে আসবে আরেকজনকে। সে ব্রাজিলের মেয়েদের বদলে যুগোশ্লাভের মেয়েদের দিয়ে শো করবে। কারণ যুগোশ্লাভ সঙ্গীত এবং মেয়েরা অনেক সুন্দরী এবং তাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। 

মারিয়ার বয়স কম হলেও সে বোকা নয়। তার আরব প্রেমিক বলেছে সুইস এমপ্লয়েমেন্ট আইন নাকি খুব কড়া এবং যেহেতু নাইটক্লাবে তার বেতনের বড় একটা অংশ কেটে রাখে কাজেই সে সহজেই নালিশ করতে পারে যে তাকে এখানে ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করা হচ্ছে। 

রজারের অফিসে গেল মারিয়া। এবারে সে ফরাসী ভাষায় কথা বলল। সে ‘আইনজীবী’ শব্দটি বার কয়েক ব্যবহার করল। তাকে অপমানসূচক কয়েকটি কথা শুনিয়ে পাঁচ হাজার ডলার দেয়া হলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এত টাকা পাবে, স্বপ্নেও ভাবেনি মারিয়া। স্রেফ ‘আইনজীবী’ নামের জাদুর শব্দটা উচ্চারণ করতেই এতগুলো টাকা পাওয়া গেল! এখন সে তার আরব প্রেমিকের সঙ্গে ইচ্ছে মত সময় কাটাতে পারবে। কিছু উপহার কিনে, বরফের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে, বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরবে মারিয়া। মারিয়া প্রথমেই মা’র প্রতিবেশীর বাসায় ফোন করে বলল সে ভালো আছে। খুব ভালো কাজ করছে সে। তাকে নিয়ে বাবা-মাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। রজারের ভাড়া করা বোর্ডিং হাউজ ছেড়ে দিতে হবে মারিয়াকে। কাজেই তার আরব প্রেমিকের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে এবং ওকে বিয়ে করবে। মাথায় রুমাল পেঁচাতে হলেও তাতে আপত্তি নেই মারিয়ার। কারণ সবাই জানে আরবরা অত্যন্ত ধনী মানুষ। আর এটাই মারিয়ার জন্য যথেষ্ট। 

কিন্তু পাখি খাঁচা ছেড়ে ইতিমধ্যে উড়ে গেছে। সম্ভবত আরবে চলে গেছে মারিয়ার প্রেমিক। আরব দেশটির নামও মারিয়া কখনও শোনেনি। মনে মনে ভার্জিন মেরীকে ধন্যবাদ দিল ও। কারণ আরব প্রেমিক চলে যাবার কারণে ওকে স্বধর্ম ত্যাগ করতে হলো না। এখন সে ফরাসী ভাষা মোটামুটি বলতে পারে, রিটার্ন টিকেট কেনার মত টাকাও যথেষ্ট আছে, রয়েছে ‘সাম্বা নর্তকী’র ওয়ার্ক পারমিট এবং সাম্প্রতিক ভিসা; কাজেই যখন ইচ্ছা দেশে ফিরে সাবেক বসকে বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে বলে মারিয়া সিদ্ধান্ত নিল নিজের চেহারা পুঁজি করে আরও কিছু অর্থ কামাই করবে। 

ব্রাজিলে, স্কুলে একটা বইতে এক মেষ পালকের গল্প পড়েছিল মারিয়া। লোকটা গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। এসব বাধার বেড়াজাল তাকে তার প্রাপ্য জিনিস পেতে সাহায্য করে। মারিয়াও এখন ঠিক একই অবস্থায় আছে। কী করবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাকে মডেল হতে হবে। এতে যত বাধাই আসুক, পরোয়া করবে না মারিয়া। 

একটি ছোট ঘর ভাড়া করল সে (তার কোনও টিভি নেই, অবশ্য যথেচ্ছ আয় করার আগে একটু কষ্ট করে চলতে হবে ওকে) এবং পরদিনই এজেন্সিগুলোতে ফুঁ দিতে লাগল। 

সবাই বলল মারিয়ার কিছু পেশাদার ছবি দরকার। ক্যারিয়ারে এ টাকাটা তাকে বিনিয়োগ করতেই হবে- কারণ স্বপ্ন সহজে পূরণ হয় না। এক চমৎকার ফটোগ্রাফারের পেছনে বেশ বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করল মারিয়া। স্বল্পভাষী এ লোকের ফটোগ্রাফার হিসেবে বাজারে দারুণ চাহিদা। নিজের স্টুডিওতে জামাকাপড়ের বিরাট সংগ্রহ রয়েছে। মারিয়া নানান পোশাকে সেজে ক্যামেরার সামনে পোজ দিল। এমনকী বিকিনি পরেও। 

মারিয়া বেশ কিছু এক্সট্রা কপি চাইল ফটোগ্রাফারের কাছে। এগুলো তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে চিঠি লিখল সে সুইটজারল্যান্ডে খুব সুখে আছে। ওরা ভাববে বড়লোক হয়ে গেছে মারিয়া, তাকে নিয়ে শহরের সবাই আলোচনা করবে। যদি সব পরিকল্পনা মাফিক ঘটে (মারিয়া ইতিবাচক চিন্তা’র ওপরে প্রচুর বই পড়েছে এবং সে নিশ্চিত বিজয় তার হবেই), বাড়ি ফেরার পরে তাকে ব্যান্ড বাজিয়ে স্বাগত জানানো হবে এবং মেয়রকে বলা হবে মারিয়ার নামে যেন একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়। 

স্থায়ী কোনও ঠিকানা নেই বলে মারিয়া একটি মোবাইল ফোন কিনল, এতে প্রি-পেইড ফোন কার্ড ব্যবহার করা হয়। সে চাকরির অপেক্ষা করতে লাগল। মারিয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খায় (এখানে সবচে’ সস্তায় খাবার মেলে), সময় কাটাতে পড়াশোনা করতে লাগল সে। 

সময় বয়ে যায় কিন্তু ফোন আর বাজে না। অবাক হয়ে লক্ষ করে মারিয়া সে যখন লেকের ধার দিয়ে হাঁটে, মাদক বিক্রেতারা ছাড়া কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মাদক বিক্রেতারা সব সময় ব্রিজের নিচে ভিড় করে। ব্রিজটি সংযুক্ত করেছে শহরের নতুন অংশের পুরানো পাবলিক বাগানগুলো। নিজের চেহারা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ল মারিয়া। একদিন এক কাফেতে তার এক সাবেক কলিগের সঙ্গে দেখা, সে বলল এটা মারিয়ার দোষ নয়, সুইসদের দোষ। কারণ তারা সেধে কারও সঙ্গে কথা বলে না। আর বিদেশী পর্যটকরা কথা বলার সাহস পায় না যদি তাদের বিরুদ্ধে ‘যৌন নির্যাতনের’ অভিযোগ আনা হয়! 

মারিয়ার ডায়েরি থেকে : 

আজ একটা মেলায় গিয়েছিলাম। টাকা পয়সা উল্টোপাল্টা খরচ করা যাবে না বলে আমি এখন শুধু মানুষ দেখি। আমি রোলার কোস্টারের পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেখলাম মানুষ প্রবল উত্তেজনা নিয়ে এতে চাপলেও কোস্টার চালু হওয়া মাত্র আতঙ্কিত হয়ে উঠছে এবং গাড়ি থামাতে বলছে। 

এরা আসলে চায় কী? অ্যাডভেঞ্চার চাইলে তার জন্য প্রস্তুতির দরকার আছে না? নাকি তারা ভাবে উত্থান-পতন এড়িয়ে ক্যারুজেলের পিঠে চড়ে শুধু ঘুরবে আর ঘুরবে। আমি এখন ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা করি না। তবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় এটা ঘটবে। বিশ্বাস করতে মন চায় আমি একটা চাকরি পাব এবং এখানে আমি এখানে এসেছি কারণ এ নিয়তি আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। আমার জীবন হলো রোলার কোস্টারের মতো : জীবন একটি দ্রুত, মাথা ঝিমঝিম করা খেলা; জীবন হলো প্যারাসুট জাম্প; এতে ঝুঁকি আছে, এ সাঁ সাঁ করে নিচে নামে, আবার উঠে পড়ে। এ চায় আপনাকে শীর্ষে তুলতে। তবে না পারলে আপনাকে ক্রুদ্ধ ও হতাশ করে তোলে। 

পরিবার থেকে অনেক দূরে আমি, সেই ভাষা থেকে বহুদূরে যে ভাষায় আমি আমার সমস্ত আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি। এখন থেকে যখনই হতাশ বোধ করব, মেলাটির কথা মনে করব। আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি এব হঠাৎ জেগে উঠে দেখি রোলার কোস্টারে আছি, কেমন বোধ হবে আমার? 

মনে হবে অসুস্থ আমি একজন ফাঁদে পড়েছি, প্রতিটি বাঁক ঘোরার সময় আতঙ্কিত হয়ে উঠছি, নেমে পড়তে চাইছি। তবে যদি ধরে নিই রাস্তাটা আমার নিয়তি এবং ঈশ্বর যন্ত্রটা চালাচ্ছেন, দুঃস্বপ্নটা কিছুটা রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে। জীবন তো রোলার কোস্টারের মত, একটি খেলনা, এক সময় যা থেমে যাবে, তবে যখন ভ্রমণ চলবে আমি চারপাশের নিসর্গ উপভোগ করব প্রবল উত্তেজনা নিয়ে। 

নয় 

ডায়েরিতে খুব ভালো ভালো কথা লিখলেও সেগুলো অনুসরণ করার ক্ষমতা মারিয়ার নেই। ওর ভেতরে হতাশা দিন দিন বাড়ছে, ফোন এখনও বাজছে না। শূন্য ঘণ্টাগুলো থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে এবং ফরাসী ভাষা প্রাকটিসের জন্য সে সেলেব্রিটিদের ওপর লেখা পত্রিকা কিনতে শুরু করল। তবে একই সঙ্গে বুঝতে পারল খুব বেশি টাকা সে খরচ করে ফেলছে। তাই কাছের লাইব্রেরিতে গেল মারিয়া। এখানে বই ভাড়া দেয়া হয়। তবে লাইব্রেরিয়ান জানাল পত্রিকা ভাড়া দেয়া হয় না। সে কিছু বইয়ের নাম বলল, মারিয়ার ফরাসী ভাষা শেখায় কাজ দেবে। 

‘বই পড়ার সময় আমার নেই।’ 

‘সময় নেই মানে কী? কী কর তুমি?’ 

‘অনেক কিছু : ফরাসী শিখেছি, ডায়েরি লিখছি, এবং…’ ‘এবং কী?’ 

মারিয়া বলতে যাচ্ছিল ‘ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি,’ তবে কথাটা বলা ঠিক হবে না ভেবে শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। 

‘মাই ডিয়ার, তোমার বয়স খুবই কম। সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। পড়ো। বই সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে সব ভুলে গিয়ে পড়তে থাকো।’ 

‘আমি অনেক বই পড়েছি। তবে আরও পড়তে চাই। আপনি কিছু বই পছন্দ করে দেবেন?’ 

লাইব্রেরিয়ান মহিলাকে মারিয়ার ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে এ তার বন্ধু হতে পারবে। তাই সে মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। 

মহিলা তাকে ‘দ্য লিটল প্রিন্সেস’ বইটি দিল। ওই রাতেই পড়া ধরল মারিয়া। বেশ মজা পেয়ে গেল। এমনই মজে গেল বইয়ের মধ্যে যে মোবাইল ফোনের ব্যাটারিতে ফুল চার্জ আছে কিনা, পাঁচ মিনিট পরপর তা পরীক্ষা করে দেখার কথাও ভুলে গেল। 

মারিয়া লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠল। লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে সে আড্ডা দেয়। মহিলাকে নিজের মতোই একাকী মনে হয়, তার কাছে পরামর্শ চায় কী বই পড়বে, আলোচনা করে লেখকদের নিয়ে। এদিকে জমানো টাকা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে মারিয়ার। আর দুই সপ্তাহ পরে ব্রাজিলে ফিরে যাবার টিকেট কেনার টাকাও থাকবে না। 

এবং তখন, দুঃসময়ের পরে সুসময় আসার মতো, অবশেষে বেজে উঠল মারিয়ার ফোন। 

দীর্ঘ পাঁচ মাস বাদে একটি মডেল এজেন্সি জানতে চাইল সিনোরা মারিয়া এ নাম্বারে আছেন কিনা। দীর্ঘ দিনের রিহার্সাল করা শীতল জবাব দিল মারিয়া ‘হ্যাঁ,’ নিজের আগ্রহ দমিয়ে রেখে। শুনল এক আরব ভদ্রলোক, নিজের দেশে ফ্যাশন শিল্প নিয়ে কাজ করেন, মারিয়ার ছবি দেখে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে এবং মারিয়াকে তিনি ফ্যাশন শোতে নিতে চাইছেন। মারিয়ার মনে পড়ে গেল তার সাম্প্রতিক হতাশা এবং টাকার প্রচণ্ড প্রয়োজনীয়তার কথা। 

অত্যন্ত ফ্যাশন দুরস্ত একটি রেস্টুরেন্টে ওদের সাক্ষাত হলো। অভিজাত চেহারার এক আরব, রজারের চেয়ে বয়সে বড় এবং সুদর্শন, মারিয়াকে বললেন: 

‘ওই ছবিগুলো কে এঁকেছেন জানো? মাইরো। তুমি জোন মাইরোর নাম শুনেছ?’ 

মারিয়া কিছু বলল না। সে খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। এখানকার খাবার চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবারের চেয়ে একদম আলাদা। খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিল লাইব্রেরিতে আবার যখন যাবে মারিয়া, মাইরোর ওপরে বই চাইবে। 

আরব ভদ্রলোক বলে চললেন : 

‘এ টেবিলে একসময় ফেলিনি বসে খেতেন। তুমি ফেলিনির ছবি দেখেছ?’ 

মারিয়া মাথা ঝাঁকাল। দেখেছে। বলল ফেলিনির ছবি সে পছন্দ করে। লোকটি এসব নিয়ে আরও প্রশ্ন করছেন, মারিয়া জানে সে পরীক্ষায় ফেল করবে, সে সরাসরি বলল : 

‘আমি সব জানি এরকম ভান করে সন্ধ্যাটা কাটাতে চাই না। আমি শুধু আপনাকে কোকাকোলা এবং পেপসীর মধ্যে পার্থক্য কী তা বলতে পারব, এর বেশি কিছু নয়। আমরা কিন্তু এখানে এসেছি ফ্যাশন শো নিয়ে কথা বলতে।’ 

মারিয়ার খোলামেলা আচরণে খুশি হলেন আরব। 

‘সাপার শেষে এ নিয়ে কথা বলব আমরা।’ 

বিরতি। ওরা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। ভাবার চেষ্টা করছে অপরজন কী চিন্তা করছে। 

‘তুমি খুব সুন্দর,’ বললেন আরব। ‘আমার হোটেল রুমে এসে আমার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করলে তোমাকে আমি এক হাজার ফ্রাঁ দেব।’ 

লোকটার ইঙ্গিত তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল মারিয়া। দোষটা কি মডেল এজেন্সির নাকি তার? অথবা লোকটার? আসলে দোষ কারও নয়। এভাবেই ঘটনা ঘটে। অকস্মাৎ বাড়ির কথা খুব মনে পড়তে লাগল মারিয়ার। মাকে খুব মিস করছে ও। মনে পড়ল মেলসনের কথা। সে একরাতের পারিশ্রমিক বলেছিল তিনশ ডলার। তখন ওর কথাটা হাস্যকর মনে হয়েছিল মারিয়ার কাছে, মনে হয়েছিল কোনও পুরুষের সঙ্গে রাত কাটালে এর চেয়ে বেশি টাকা কামাই করার যোগ্যতা রাখে সে। এ মুহূর্তে মারিয়ার মনে হচ্ছে এ জগতে তার আপন বলে কেউ নেই, এমন কেউ নেই যার সঙ্গে সে নিজের সুখ-দুঃখগুলো ভাগ করে নিতে পারে, সে এক অদ্ভুত নগরীতে একা, বাইশ বসন্তের একটি মেয়ে যে বুঝতে পারছে না সে কী করবে। 

‘আমাকে আরেকটু ওয়াইন দেবেন, প্লিজ?’ 

আরব মারিয়ার গ্লাস ভরে দিলেন। দ্রুত চিন্তা করছে মারিয়া। সে এসেছে অ্যাডভেঞ্চার, টাকা এবং সম্ভব হলে একজন স্বামী খুঁজে পাবার আশায়। সে জানে পুরুষদের কাছ থেকে এরকম প্রস্তাব আসতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবু কেন যে তার কান্না পাচ্ছে! লোকটাকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে শুরু করল মারিয়া। আরব বুঝতে পারলেন না কী করবেন। ভয় পেলেন শেষে না একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যায়। তিনি ওয়েটারকে ডাক দিলেন বিল দিয়ে যেতে, মারিয়া বাধা দিল তাঁকে। 

না, ওয়েটার ডাকবেন না। আমাকে আরেকটু মদ ঢেলে দিন আর কিছুক্ষণ কাঁদতে দিন। 

মারিয়ার মনে পড়ছে সেই ছোট ছেলেটির কথা যে ওর কাছে পেন্সিল ধার চেয়েছিল, মনে পড়ল সেই তরুণকে যে ওকে চুমু খেয়েছিল, মনে পড়ল সেইসব লোকদের যারা মারিয়াকে ব্যবহার করেছে কিন্তু বিনিময়ে দেয়নি কিছুই। মারিয়া স্বাধীন। কিন্তু সে অপেক্ষা করে আছে অলৌকিক কোনও ঘটনা ঘটার জন্য, সে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে কবে প্রকৃত ভালোবাসা আসবে জীবনে, তার প্রেমের সুখময় পরিণতি ঘটবে সিনেমা এবং টিভিতে দেখা গল্পের মতো। 

মারিয়া এখন কী করবে? লোকটার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে? সে ফিরে যেতে পারে ব্রাজিলে, ফরাসী ভাষার শিক্ষকতার পেশা বেছে নিতে পারে, বিয়ে করতে পারে তার সাবেক বসকে। নাকি ছোট্ট এক কদম এগোবে মারিয়া? মাত্র একটা রাতের ব্যাপার। এ শহরে কেউ তাকে চেনে না, জানে না। কিন্তু একটা রাত কি তাকে রাস্তার এমন একটা প্রান্তে নিয়ে যাবে যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় থাকবে না? এখানে যা ঘটছে এটা কী বিরাট কোনও সুযোগ নাকি ভার্জিন মেরী ওর পরীক্ষা নিচ্ছেন? 

আরব তাকিয়ে আছেন জোন মেরীর চিত্রকলার দিকে, দেখছেন যেখানে ফেলিনি বসতেন, লক্ষ করছেন যে মেয়েটি খদ্দেরদের গা থেকে কোট খুলে নিয়ে সাজিয়ে রাখছে, দেখছেন অন্যান্য কাস্টোমারদের যারা রেস্টুরেন্টে ঢুকছে এবং বেরুচ্ছে। 

‘তুমি বুঝতে পার নি?’ 

‘আরেকটু ওয়াইন, প্লিজ,’ চোখে জল নিয়ে বলল মারিয়া। 

মনে মনে প্রার্থনা করল মারিয়া ওয়েটারটা যেন এখন এদিকে না আসে এবং বুঝতে না পারে কী ঘটছে। দূরে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ করছে সবকিছু, আড়চোখে তাকাচ্ছে। ওয়েটার প্রার্থনা করছে লোকটা এবং মেয়েটা যেন তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে চলে যায়। কারণ রেস্টুরেন্টে খালি জায়গা নেই এবং অনেক লোক অপেক্ষা করছে। 

অবশেষে, মারিয়ার মনে হলো অনন্তকাল, বলল : 

‘একটি ড্রিঙ্কের জন্য এক হাজার ফ্রাঁ?’ 

নিজের গলার স্বর শুনে নিজেই অবাক মারিয়া 1 

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন আরব, আফসোস করছেন প্রস্তাবটা সরাসরি দেয়া ঠিক হয়নি ভেবে। ‘তবে আমি সত্যি চাই না…’ 

‘বিল দিন। তারপর চলুন। আপনার হোটেলে বসে ড্রিংক করব।’ 

আবার নিজেকে অচেনা মনে হলো মারিয়ার। একটু আগেও নিজেকে তার চমৎকার হাসি-খুশি একটি মেয়ে মনে হচ্ছিল যে কিনা অচেনা লোকের সঙ্গে ওভাবে কখনও কথা বলে নি। কিন্তু ওই মেয়েটি, মারিয়ার মনে হচ্ছে, মারা গেছে। চিরতরে। তার সামনে আরেকটি মেয়ে যে কিনা এক হাজার ফ্রাঁ’র বিনিময়ে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। 

যেমনটি ভাবা হয়েছিল, ঘটল তেমনই। মারিয়া আরবের হোটেলে গেল, আকণ্ঠ শ্যাম্পেন পান করে মাতাল হল, তারপর দুই পা ফাঁক করে ধরল আরব লোকটার জন্য। আরব তার শরীরে প্রবেশ করলেন। মারিয়া অপেক্ষা করল তাঁর বীর্যঙ্খলনের জন্য। কাজটা শেষ হয়ে গেলে সে মার্বেল বাথরুমে ঢুকল সাফ হতে। তারপর টাকা নিয়ে ট্যাক্সি চড়ে বাড়ি ফিরল। 

বিছানায় শুয়ে পড়ল মারিয়া এবং সারারাত একটানা ঘুমাল। ঘুমের মধ্যে সে কোনও স্বপ্ন দেখল না। 

পরদিন, মারিয়ার ডায়েরি থেকে : 

আমার সবকিছু মনে আছে যখন আমি সিদ্ধান্তটা নিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার, কোনও অপরাধবোধ নেই আমার মধ্যে। আমি আগে ভাবতাম যেসব মেয়ে টাকার বিনিময়ে পুরুষদের সঙ্গে বিছানায় যায়, তাদেরকে নিয়ে। আমি ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলতে পারতাম। কেউ তো আমাকে এ কাজ করতে জোর করেনি। 

আমি রাস্তায় হাঁটি আর মানুষ দেখে বেড়াই। ভাবি ওরা ওদের জীবন নিয়ে কি সন্তুষ্ট? নাকি আমার মতো নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? যে মেয়ে মডেল হবার স্বপ্ন দেখত, সে করছে ঘর কন্না, যে সঙ্গীত পরিচালক হতে চেয়েছিল, তাকে ব্যাংকে কেরানীর কাজ করতে হচ্ছে, ডাক্তার হয়তো লেখক হতে চেয়েছে, ওই মেয়েটির হয়তো স্বপ্ন ছিল টিভি তারকা হবে, বদলে সুপার মার্কেটে কাজ করতে হচ্ছে তাকে। 

নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র দুঃখ বোধ হচ্ছে না আমার। আমি নিজেকে ভিক্টিমও মনে করছি না। কারণ আমি সম্মানের সাথে, শূন্য পার্স নিয়ে ওই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। আমার বিপরীতে বসা ওই লোকটাকে নৈতিকতা নিয়ে কড়া ভাষায় দু’একটা কথাও শুনিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু অনেকের মতো আমিও মেনে নিয়েছি নিয়তি। আসলে সুখের খোঁজে আমরা সবাই সমান, আমরা কেউ সুখী নই – ব্যাংকের কেরানী/মিউজিশিয়ান/ডাক্তার/লেখক/সুপার মার্কেটের মেয়ে/ অভিনেত্রী কিংবা গৃহবধূ/মডেল, কেউ নই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *