ইলেভেন মিনিটস – ২৫

পঁচিশ 

মিনিটগুলো পরিণত হলো ঘণ্টায়। র‍্যালফ হার্টের বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল মারিয়া। জেগে দেখে এখনও রাত। ও একটা ঘরে শুয়ে আছে। ঘরের এক কোণে একটি টিভি। এ ছাড়া কিছু নেই। সাদা ধবধবে দেয়াল। 

গরম চকোলেটের কাপ হাতে উদয় হলো র‍্যালফ। 

‘তোমার যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছ,’ বলল সে। 

‘আমি চকোলেট খাবো না,’ বলল মারিয়া। ‘আমার দরকার মদ। আমি নিচে গিয়ে ফায়ার প্লেসের সামনে বসব। আমাদের চারপাশে থাকবে শুধু বই।’ 

পায়ের দিকে তাকাল মারিয়া। সামান্য কেটে গেছে পা, এছাড়া কয়েক জায়গায় চামড়া উঠে লাল হয়ে আছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিচে নামল মারিয়া। অগ্নিকুণ্ডের সামনে কার্পেটে বসল। এখানে বসতে ভালো লাগে ওর। নিজের বাড়ি বলে মনে হয়। 

র‍্যালফ হাতে বড়সড় একটা ফাইল নিয়ে এগিয়ে এল মারিয়ার দিকে। ভেতরে অনেক ছবি। 

‘বেশ্যাবৃত্তির ইতিহাস তুমি জানতে চেয়েছিলে।’ 

হ্যাঁ, জানতে চেয়েছিল মারিয়া। কিন্তু তখন তো স্রেফ আলাপচারিতা চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এ ইতিহাস জানতে চেয়েছে সে। এখন আর এটা ওর কাছে কোনও গুরুত্ব বহন করছে না। 

‘লোকে বলে পতিতাবৃত্তি হলো বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা। তবে এর একটা ইতিহাস অবশ্যই আছে,’ বলল র‍্যালফ। 

‘এ ছবিগুলো কীসের?’ 

র‍্যালফের কথায় মনোযোগ নেই মারিয়ার। ব্যাপারটা হতাশ করে তুলল তাকে। তবে হতাশ ভাবটা গোপন করল সে। 

‘এগুলো আমি গবেষণা করার সময় সংগ্রহ করেছি।’ 

‘এ ব্যাপারটা আজ থাক। এ নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে। আমার বেদনা কী তা বোঝা দরকার।’ 

‘গতকাল বেদনার অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমার এবং আবিষ্কার করেছ এর মধ্যে মিশে আছে আনন্দ। আজও এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় তোমাকে দিয়েছে শান্তি। তাই তো তোমাকে বলি : এ ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না। কারণ এই নেশায় জড়িয়ে পড়া খুব সহজ; এ অত্যন্ত শক্তিশালী মাদক। যন্ত্রণা বা বেদনা যখন তার আসল চেহারা দেখায় তখন তা রীতিমত ভীতিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু উৎসর্গের ছদ্মবেশে এলে যন্ত্রণা হয়ে ওঠে মনোহর। আমরা একে যতই অগ্রাহ্য করি না কেন মানুষ সবসময়ই যন্ত্রণা পেতে ভালোবাসে, একে জীবনের অংশ করে নেয়। 

‘আমি এ কথা বিশ্বাস করি না। কেউ সেধে কষ্ট পেতে চায় না।’ 

‘তুমি যদি মনে কর দুঃখ-কষ্ট ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে, সেটা তো বিরাট ব্যাপার। তবে ভেবো না অন্য মানুষ তোমাকে বুঝতে পারবে। এ কথা সত্যি সেধে কেউ কষ্ট বা যন্ত্রণা পেতে চায় না, তবু প্রায় প্রত্যেকেই বেদনা খুঁজে বেড়ায়, তারপর মনে করে তাদের সঙ্গে ন্যায় বিচার করা হয়েছে। গড়, এ নিয়ে এখনই মাথা ঘামাতে যেয়ো না। তোমার জানা উচিত পৃথিবী কেবল আনন্দের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় না, আত্মত্যাগ বা আত্মোৎসর্গই হলো আসল বিষয়। 

‘সৈনিক কি শত্রু হত্যা করার জন্য যুদ্ধে যায়? না, সে তার দেশের জন্য জান কোরবান করতে যুদ্ধে যায়। স্ত্রী কি স্বামীকে দেখাতে চায় সে কতটা সুখী? না, সে দেখাতে চায় সে কতটা পতি-অন্ত প্রাণ, স্বামীকে সুখী করতে নিজে কত কষ্ট সহ্য করছে। স্বামী কি কাজে যায় ব্যক্তিগত পছন্দগুলো মিটানোর আশায়? না, সে পরিবারের মঙ্গলের জন্য শরীরের ঘাম ছোটায়। এভাবেই চলছে সব কিছু; পুত্র তার বাবা-মাকে সুখী করতে নিজের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয়, বাবা মা সন্তানকে খুশি নিজেদের জীবন দিয়ে দেন; বেদনা এবং শুধু একটি জিনিসের যথার্থতা প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হয় : প্রেম। 

‘চুপ করো।’ 

চুপ করে গেল র‍্যালফ। বিষয় পরিবর্তন করার মোক্ষম সময় এটা। সে মারিয়াকে একের পর এক ছবি দেখাতে লাগল। সেই সঙ্গে কথা বলে গেল : 

‘পতিতাবৃত্তির ইতিহাস একটি নয়, দুটো। প্রথমটির কথা সবাই জানে, তোমার মতই এর গল্প; সুন্দরী কোনও তরুণী বিশেষ কারণে এ পেশা বেছে নেয়, মনে করে শুধু শরীর বিক্রি করেই সে টিকে থাকতে পারবে। কেউ দেশ শাসন করে, যেমনটি মেসালিনা করতেন রোমে, কেউ কিংবদন্তীতে পরিণত হন, যেমন মাদাম দু ব্যারী, কেউ স্রেফ রোমাঞ্চের নেশায় এ কাজ করতে গিয়ে ডেকে আনেন দুর্ভাগ্য, যেমন মাতাহারি। তবে বেশিরভাগের জীবনে কোনও উজ্জ্বল অধ্যায় থাকে না, তারা কখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হয় না। তারা খোঁজে খ্যাতি, স্বামী, রোমাঞ্চ কিন্তু ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তারা এ জীবনে একসময় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তারা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আছে ভাবলেও শেষতক কিছুই করতে পারে না। 

‘শিল্পীরা তিন হাজারেরও বেশি বছর ধরে তৈরি করছেন স্থাপত্য, আঁকছেন ছবি, লিখছেন বই। পতিতারাও প্রায় একই সময় ধরে পতিতাবৃত্তি করে আসছে। কিন্তু তাদের কোনও কিছুর তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। তুমি বিস্তারিত জানতে চাও?’ 

মাথা ঝাঁকাল মারিয়া। বেদনার স্বরূপ বুঝতে তার কিছু সময়ের দরকার। যদিও তার শরীর ব্যথায় বিষ হয়ে আছে। 

‘পতিতাবৃত্তির কথা ক্ল্যাসিকাল কিছু টেক্সটে আছে, মিশরীয় হিয়ারোগ্লিফসে আছে, সুমেরিয়ান লেখায় তাদের বর্ণনা পাওয়া যায়, রয়েছে ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টে। তবে পেশাটি সংগঠিত হতে শুরু করে মাত্র খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে, গ্রীক শাসক সোলন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেশ্যালয় স্থাপন করেন এবং ‘চামড়ার ব্যবসা’র ওপরে কর ধার্য করতে থাকেন। এথেনীয় ব্যবসায়ীরা এতে খুশি হয়। কারণ পতিতাবৃত্তি এক সময় নিষিদ্ধ ছিল, পরে এটা বৈধতা পায়। কাকে কত কর দিতে হবে এ নিয়ে পতিতাদের মধ্যেও শ্রেণী বিন্যাস ঘটে। 

‘সবচে’ সস্তা পতিতা ছিল পোরনাই, এরা ছিল বাড়ির মালিকদের ক্রীতদাস। এরপরে পেরিপাটেটিকা, রাস্তা থেকে খদ্দের তুলে নিত এরা। আর সবশেষ ছিল হেটারিয়া, এরা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের এবং দামী পতিতা। ব্যবসায়ীদের সফরসঙ্গী হতো তারা, দামী রেস্টুরেন্টে খেত, প্রয়োজনে তার খদ্দেরকে পরামর্শও দিত, তারা নগরীর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গেও জড়িত ছিল। এরকম ঘটনা এখনও ঘটছে। 

‘মধ্য যুগে, যৌন রোগের কারণে…’ থেমে গেল র‍্যালফ। 

‘আমার কথা তুমি শুনছ না মনে হচ্ছে।’ 

‘আমি এসব কথা জানি,’ বলল মারিয়া। ‘তাই শুনতে ইচ্ছা করছে না। শুনলে মন খারাপ হয়। তুমি বলেছিলে আরেক ধরনের পতিতাবৃত্তির ইতিহাস আছে।’ 

‘এ ইতিহাস পুরো এর বিপরীত : পবিত্র পতিতাবৃত্তি।’ 

হঠাৎ যেন ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠল মারিয়া। পবিত্র পতিতাবৃত্তি? শরীর বিক্রি করে অর্থ উপার্জন, তার মধ্যেও পবিত্ৰতা? 

‘গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডটাস, বেবিলোনিয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ‘এখানে অদ্ভুত একটি প্রথা রয়েছে, যা সুমেরিয়ায় জন্ম নেয়া প্রতিটি নারী মেনে চলে, অন্তত জীবনে একবারের জন্য হলেও। তাহলো তারা দেবী ইশতার-এর মন্দিরে যায় এবং অচেনা কোনও মানুষকে দেহদান করে। এ হলো আতিথেয়তার প্রতীক এবং প্রতীকী মূল্য। 

‘গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছিল দেবী ইশতার এর প্রভাব। সুদূর সার্ডিনিয়া সিসিলি এবং ভূ-মধ্যসাগরের বন্দরে পরবর্তীতে, রোমান সাম্রাজ্যের সময় আরেক দেবী, ভাস্তা, সম্পূর্ণ কুমরীত্ব অথবা আত্মসমর্পণ দাবি করেন। পবিত্র আগুন জ্বালিযে রাখার জন্য নারীরা কাজ করত মন্দিরে। তারা তরুণ এবং রাজাদের যৌনতার পথে নিয়ে আসে। তারা যৌন উদ্দীপক স্তোত্ৰ গাইত। 

র‍্যালফ মারিয়াকে প্রাচীন একটি কবিতা দেখাল। জার্মান ভাষায় লেখা। তবে মারিয়াকে সে প্রতিটি লাইন ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনাল : 

When I am sitting at the door of a tavern 
I, Ishtar, the godes. 
Am Prostitute, mother, wife, divinits. 
I am what People call life
Although you call it death. 
I am what people call Law.
Although you call it Deliuehcy 
I am what you seck 
And what you find 
I am what you Scattered 
And the Pieces you now gather up. 

মারিয়া কাঁদতে শুরু করল। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হেসে উঠল র‍্যালফ হার্ট। তার শক্তি আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। জ্বলতে শুরু করেছে ‘আলো’। গল্পটা বলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল সে। 

‘কেউ জানে না পবিত্র পতিতাবৃত্তি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল কেন। কারণ এর বয়স খুব বেশিদিন ছিল না। বড় জোর দুই শতক। হয়তো রোগের কারণে অথবা সমাজ পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী। সমাজের সঙ্গে ধর্মেরও তো পরিবর্তন ঘটে। যা হোক, এর এখন আর অস্তিত্ব নেই, কখনও এর আবির্ভাবও ঘটবে না। এখন পুরুষ শাসন করে বিশ্ব, পতিতাবৃত্তি এখন কলঙ্ক বলে বিবেচিত।’ 

‘কাল একবার কোপাকাবানায় আসতে পারবে?’ 

মারিয়ার এ প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারল না র‍্যালফ। তবে সে যাবে বলল। 

.

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, জেনেভার জার্ডিন অ্যাংগলেইস এ নগ্ন পদে হাঁটার রাতের পরে লেখা : 

আমাকে এটা পবিত্র করে তুলছে কী করছে না তা আমি গ্রাহ্য করি না। আমি যা করছি তা আমি ঘৃণা করি এটা আমার আত্মা ধ্বংস করে দিচ্ছে, নিজেকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, শেখাচ্ছে কষ্ট একটা পুরস্কার, টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায়। 

আমার চারপাশে যারা আছে তাদের কেউই সুখী নয়। ক্লায়েন্টরা পয়সা দিয়ে বিনোদন কেনে, তবে তাদেরকে আমি সুখী দেখি না। নারীরা জানে তাদেরকে কিছু বিক্রি করতে হবে। তারা তৃপ্তি বিক্রি করে। আমি অত্যন্ত অসুখী এবং অতৃপ্ত একজন মানুষ। 

কিন্তু আমার কিছু করার নেই। শুধু ভান করতে পারি সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু এটা আমি ভুলে যেতে চাই। আমি ভালোবাসতে চাই – ব্যস, এই-ই। আমি ভালোবাসতে চাই। 

ছাব্বিশ 

এটা পুরুষটির বাড়ি নয়। এটা মেয়েটির বাড়ি নয়। এটা ব্রাজিল কিংবা সুইটজারল্যান্ড নয়। এটা একটা হোটেল। আর এ হোটেল পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় থাকতে পারে। সুসজ্জিত, আর দশটা হোটেল রুমের মতোই। পারিবারিক একটা আবহ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এতে। 

তবে এ হোটেল দিয়ে লেকের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায় না, এ হোটেল বেদনা, কষ্ট এবং উল্লাসের স্মৃতির অনুরণন তোলে না মনে। এ হোটেল দিয়ে সান্তিয়াগো যাবার রাস্তা দেখা যায়। যে রাস্তার পাশের ক্যাফেতে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, একে অপরের ‘আলো’ আবিষ্কার করে, কথা বলে, বন্ধু হয়, প্রেমে পড়ে। 

এখন বৃষ্টি হচ্ছে। রাতের এ সময়টাতে কেউ ওখানে হাঁটছে না, ওই রাস্তায়। এখন আলো বন্ধ করে দাও। টেনে দাও ঘরের দরজা। 

মেয়েটি পুরুষটিকে বলল কাপড় খুলতে। সে নিজেও নগ্ন হলো। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিল নারী, সে কোথাও থেকে ভেসে আসা আলোয় পুরুষটির কাঠামো দেখতে পাচ্ছে, শেষ বার যখন তারা এই উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছিল মেয়েটি তখন আংশিক নগ্ন হয়েছিল। 

মেয়েটি একজোড়া ভাঁজ করা রুমাল নিল। ধোয়া রুমাল দুটো, এতে সাবান বা পারফিউমের গন্ধ লেগে নেই। সে পুরুষটির কাছে এগিয়ে গেল। তাকে বলল চোখে রুমাল বেঁধে নিতে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল পুরুষ। মেয়েটি বলল সে নিকষ আঁধার চায়। এখন তার পালা পুরুষটিকে কিছু শেখাবে, যেভাবে গতকাল সে বেদনা নিয়ে শিখিয়েছে। পুরুষটি চোখে বেঁধে নিল রুমাল। মেয়েটিও একই কাজ করল। এখন বিন্দুমাত্র আলোর চিহ্ন নেই; কালিগোলা আঁধারে ডুবে গেছে তারা, হাতে হাত ধরে বিছানার দিকে এগোল দু’জনে। 

‘না, আমরা বিছানায় শোব না। মুখোমুখি বসে কথা বলব। তবে এবারে একটু কাছাকাছি হয়ে বসব যাতে আমার হাঁটু স্পর্শ করে তোমার হাঁটু।’ 

নারীটি সবসময় এ কাজটি করতে চেয়েছে, কিন্তু সবচে’ যে জিনিসটি দরকার তা-ই তার ছিল না; সময়। প্রথম বয়ফ্রেন্ড কিংবা প্রথম পুরুষ যে তার শরীরে প্রবেশ করেছিল, কারও জন্যই এই সময়টা ছিল না। এমনকী সময় ছিল না সেই আরবের জন্য যিনি তাকে এক হাজার ফ্রাঁ দিয়েছিলেন। সময় ছিল না অসংখ্য সেই পুরুষদের জন্য যারা তারা শরীরটাকে ইচ্ছে মত ছানাছানি করেছে, তারা কখনও নিজেদের কথা ভেবেছে, কখনও মেয়েটির কথা চিন্তা করেছে, কখনও রোমান্টিক স্বপ্ন দেখেছে। 

মেয়েটি তার ডায়েরির কথা ভাবে। সে চাইছে দিনগুলো দ্রুত পার হয়ে যাক, এজন্য সে নিজেকে তুলে দিচ্ছে পুরুষটির কাছে, কারণ তার প্রেমের আলো লুকিয়ে আছে এখানে। 

মেয়েটি ভাবছে : আমার সামনে যে পুরুষটি বসে আছে তাকে আমি ভালোবাসি। কারণ তার ওপর আমি অধিকার ফলাতে যাই না সে-ও আমার ওপর কর্তৃত্ব করতে আসে না। আমরা যে যার কাছে মুক্ত। 

মেয়েটি অন্যান্য পতিতাদের কথা ভাবে যারা তার সঙ্গে কাজ করে। সে তার মা এবং বন্ধুদের কথা ভাবে। তাদের সবার বিশ্বাস পুরুষ একদিনে শুধু এগারো মিনিটের জন্য কামনা করে, এবং এই এগারো মিনিটের জন্য তারা পয়সা খরচ করে। তবে তাদের এই বিশ্বাস বা ধারণা সঠিক নয়; পুরুষ একই সঙ্গে নারীও, সে-ও কাউকে খোঁজে, তার জীবন অর্থবহ করে তুলতে চায়। 

তার মাও কি বাবার সঙ্গে সঙ্গমকালে তৃপ্ত হবার ভান করেন? নাকি ব্রাজিলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেক্সে তৃপ্ত হওয়া এখনও নিষিদ্ধ? সে জীবন এবং প্রেম সম্পর্কে এত কম জানে! তবে চোখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় সে যেন এই মুহূর্তে জগতের সবকিছুর উৎপত্তি আবিষ্কার করছে এবং সে যেভাবে শুরু করতে চেয়েছে সেভাবেই যেন শুরু হচ্ছে সবকিছু। 

পতিতা, ক্লায়েন্ট, মা এবং বাবার কথা ভুলে যাও। সে এখন গাঢ় আঁধারে। সে সারা বিকেল ভেবেছে এ লোককে সে কী দেবে যে তার সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছে এবং বুঝতে শিখিয়েছে যন্ত্রণার চেয়ে সুখের সন্ধান অনেক বেশি জরুরি। 

নারী ভাবছে : আমাকে স্পর্শ করার সুখ তাকে আমি দেব। আমি লক্ষ করেছি আমাকে কিছু শেখাতে পারলে সে অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করে। কাজেই ওকে আমি শেখাতে দেব, আমাকে গাইড করতে দেব। আমি জানতে চাই আত্মা, পেনিট্রেশন, অর্গাজম ইত্যাদি ছাড়াই কীভাবে একজনের শরীরের কাছে যাওয়া যায়। 

নারী তার হাত বাড়িয়ে দিল। পুরুষকেও বলল একই কাজ করতে। ফিসফিস করে কিছু বলল, সে। বলল আজ রাতে, এই নো-ম্যানস-ল্যান্ডে সে চায় পুরুষ তার ত্বক আবিষ্কার করুক, আবিষ্কার করুক তার মাঝের সীমানা এবং পৃথিবী। সে তাকে স্পর্শ করতে বলে, হাত দিয়ে তাকে অনুভব করতে বলে, কারণ আত্মা যখন ব্যর্থ হয় তখনও শরীর পরস্পরকে বুঝতে পারে। সে তাকে স্পর্শ করতে শুরু করল। পুরুষটিও স্পর্শ করছে তাকে। তবে যেন আগেই চুক্তি হয়েছে এভাবে তারা পরস্পরের শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকবে। 

পুরুষটির হাত স্পর্শ করল নারীর মুখ। নারী তার হাতে কালির গন্ধ পেল, যে গন্ধ থাকবে সারা জীবন এমনকী সে যদি হাজারবার তার হাত ধোয়, তবুও। এ গন্ধটা ছিল যখন সে জন্মগ্রহণ করেছে তখন থেকে, যখন সে প্রথম বৃক্ষ দেখে, দেখে তার বাড়ি এবং স্বপ্নে ওগুলো আঁকার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরুষও হয়তো নারীটির হাত থেকে কোনও গন্ধ নিচ্ছে। তবে নারীটি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, কারণ এ মুহূর্তে শরীরটাই সবচে’ প্রধান হয়ে উঠেছে, বাকি সব নীরবতা। 

নারীটি ক্রমাগত আদর করে যেতে লাগল। সারারাত সে কাটিয়ে দিতে পারে এভাবেই, কারণ এটা এমন আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা যার জন্য সেক্স করার প্রয়োজন হয় না, আর যেহেতু সেক্স করতে কোনও বিধিনিষেধ নেই, নারী তার দু’পায়ের মাঝে উত্তাপ অনুভব করতে শুরু করে। এবং সে জানে তার যোনির ভেতরটা রসে সিক্ত হয়ে উঠেছে। পুরুষ যখন ওখানটাতে স্পর্শ করবে, সে এটা আবিষ্কার করবে এবং নারী জানে না এটা খারাপ হবে না ভালো, তার শরীর তো এভাবেই সাড়া দিচ্ছে, তার ইচ্ছে নেই পুরুষকে বলে এখানে বা ওখানে আস্তে বা দ্রুত হাত দিতে। 

পুরুষটির হাত এখন নারীটির বগল স্পর্শ করছে। নারীর হাতের রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে, তার ইচ্ছে করল পুরুষটির হাত সরিয়ে দেয়। কিন্তু স্পর্শটা ভালো লাগছে তার। যদিও সে এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছে। নারী একই জিনিস করল পুরুষটির ক্ষেত্রে। তার বগলে হাত চালিয়ে দিল। 

পুরুষের আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছে নারীর বক্ষযুগলে। নারী চাইছে দ্রুততর হোক আঙুল চালনা, স্পর্শ করুক তার স্তনবৃন্ত, কারণ তার চিন্তা চেতনা পুরুষের হাতের চেয়েও দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। সম্ভবত এটা জানে পুরুষ তাই ওখানে হাত নিয়ে যেতে সময় নিচ্ছে। 

নারীর স্তনের বোঁটা এখন পাথরের মতো শক্ত। পুরুষ স্তন নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করল, সুড়সুড়ি লাগল নারীর, আরও বেশি উত্তেজনা বোধ করল সে, আরও বেশি ভিজে গেল যোনি। পুরুষের হাত এখন তার মসৃণ পেটে, তারপর নেমে এল পায়ে, পায়ের পাতায়, ঘোরাঘুরি করতে লাগল ঊরু এবং হাঁটুর নিচে। নারীর শরীরের উত্তাপ টের পাচ্ছে পুরুষ, বুঝতে পারছে কতটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে নারী। পুরুষটির হাতের ছোঁয়া নরম, হালকা 

একই কাজ করছে নারীও। তার হাত যেন ভেসে বেড়াচ্ছে পুরুষটির অঙ্গে, তার পায়ের লোম স্পর্শ করছে, যৌনাঙ্গের এলাকায় পৌঁছে সে টের পেল কতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পুরুষটি। তারপর হঠাৎ, যেন হঠাৎ করেই নারীটি ফিরে পেয়েছে তার কুমারীত্ব, যেন এই প্রথম স্পর্শ করছে কোনও পুরুষ শরীর, সে ছুঁয়ে ফেলল তার পুরুষাঙ্গ। সে যা কল্পনা করেছিল এখনও অতটা শক্ত হয়ে ওঠে নি লিঙ্গ, হতে পারে পুরুষের উদ্রিত হতে আরও সময়ের প্রয়োজন। 

পুরুষাঙ্গ ধরে আদর শুরু করল নারী। যেন কুমারী কোনও মেয়ে এই প্রথম ওটা আবিষ্কার করছে। সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানাল পুরুষ। নারীর নরম হাতের মধ্যে ওটা ফুঁসতে লাগল, আকারে ক্রমে বড় হচ্ছে, ওটাকে জোরে চাপ দিল নারী, এখন জানে কোথায় কোথায় স্পর্শ করতে হবে। ওপরের থেকে নিচে বেশি। হস্তমৈথুনের ভঙ্গিতে সে হাত ওপর নিচ করছে। এখন পুরুষ উত্তেজিত, ভয়ানক উত্তেজিত। সে নারীর যোনি ঠোঁট স্পর্শ করল, খুব আস্তে। নারীর ইচ্ছে করল বলে পুরুষ যেন আরও জোরে ঘষতে থাকে, তার যোনির ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় আঙুল। কিন্তু পুরুষ তা করল না। সে ঘষতে থাকল ভগাঙ্কুর। যোনির রাগ রসে ভিজে সপসপ করছে ওটা। তাকে এমনভাবে স্পর্শ করছে যেভাবে নারী স্বমেহনের সময় তার যোনি নিয়ে করে। 

পুরুষের একটি হাত ফিরে এল নারীর বুকে; দারুণ লাগছে। চাইল পুরুষ এখন তাকে জড়িয়ে ধরুক। কিন্তু না, তারা এখন শরীর আবিষ্কার করছে, তাদের হাতে সময়, তাদের প্রচুর সময়ের দরকার। তারা ইচ্ছে করলে এখন প্রেম করতে পারে; বরং এটাই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ, কিন্তু নারী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। সে সব কিছু নষ্ট করে দিতে চায় না। প্রথম রাতে কীভাবে তারা মদ পান করেছিল, স্মরণ করল নারী, কেমন ধীরে ধীরে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। 

সে পুরুষটিকে মদের মতো আস্তে আস্তে পান করতে চায়। তারপর সে সস্তা মদের কথা ভুলে যাবে যে মদ আপনাকে মাতাল করে এবং আপনাকে ছেড়ে চলে যায় মাথাব্যথা এবং হৃদয়ে শূন্যতা রেখে। 

থেমে গেল নারী। গোঙাচ্ছে পুরুষ, তারও গোঙানি আসছিল। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। তার শরীর ফুটে তাপ বেরুচ্ছে। একই জিনিস নিশ্চয় পুরুষের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। নারী রাগমোচন হতে দিল না। কিন্তু এভাবেই সে চেয়েছে, মাঝপথে থেমে যেতে। 

সে আস্তে আস্তে নিজের চোখ থেকে খুলে ফেলল রুমাল, পুরুষের চিত্ত খুলল। জ্বেলে দিল বেডসাইড ল্যাম্প। ওরা দুজনেই নগ্ন : তারা হাসছে না, স্রেফ তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। আমি ভালোবাসা, আমি সঙ্গীত, ভাবল নারী। চলো নাচি। 

.

কিন্তু নারী কিছু বলল না। ছুতোনাতা বিষয় নিয়ে কথা বলছে তারা। যেমন কবে আবার সাক্ষাৎ হবে তাদের। নারী দিন দুই পরের একটা তারিখ দিল। পুরুষ বলল সে নারীকে তার চিত্র প্রদর্শনীতে নিয়ে যেতে চায়। ইতস্তত করল নারী। এর মানে তার পৃথিবী, বন্ধু-বান্ধবদের জানা হবে, তারা কী বলে, কী ভাবছে শোনা হবে। 

নারী ‘না’ বলল। কিন্তু পুরুষ বুঝতে পারল আসলে সে ‘হ্যাঁ’ বলতে চেয়েছিল। তাই সে ইতস্তত করল, তর্ক করল খানিক বেহুদাই, শেষ পর্যন্ত রাজি হলো নারী, আসলে তো সে রাজি হতেই চেয়েছে। কোথায় সাক্ষাৎ হবে সিদ্ধান্ত নিল ওরা- প্রথম দিন যে ক্যাফেতে ওদের পরিচয় সেখানে গেলে হয় না? 

‘না’ বলে নারী। ব্রাজিলীয়রা খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন। যেখানে একবার সাক্ষাৎ হয়েছে সেখানে দ্বিতীয়বার কখনও সাক্ষাৎ করতে নেই, কারণ এতে সম্পর্কের অবসান ঘটতে পারে। 

তারা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় তারা চার্চে দেখা করবে যেখান থেকে গোটা শহর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যে গির্জার অবস্থান সান্তিয়াগো যাবার রাস্তায়। 

.

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, ব্রাজিলের টিকেট কেনার প্রাক্কালে! 

একদা একটি পাখি ছিল। পাখিটির ছিল চমৎকার এক জোড়া ডানা, ঝলমলে পালক তাতে। মুক্তভাবে আকাশে ওড়ার জন্য সৃষ্টি করা হয় তাকে। তাকে যে-ই দেখে তারই জীবনে নেমে আসে আনন্দ। 

একদিন এক নারী দেখল এই পাখিটিকে এবং সে তার প্রেমে পড়ে গেল। নারী পাখিটিকে উড়তে দেখল, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় সে, তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, উত্তেজনায় ঝিকমিক করতে থাকে চোখ, সে পাখিটিকে তার সঙ্গে ওড়ার আমন্ত্রণ জানায় এবং দু’জনে মিলে উড়তে থাকে আকাশে। 

নারীর মনে হঠাৎ একটি চিন্তার উদয় হয় : পাখিটি হয়তো দূরের পাহাড় দেখতে যেতে চাইবে। নারীটি ভয় পেয়ে যায়, ভয় পায় এই ভেবে যে সে হয়তো আর কোনওদিন অন্য কোনও পাখির মতো এরকম অনুভব করবে না। পাখিটিকে সে ঈর্ষা করে, হিংসা করে তার উড়তে পারার ক্ষমতার জন্য। 

নিজেকে তার একা মনে হতে থাকে। 

এবং সে ভাবে : আমি একটা ফাঁদ পাতব। আবার যখন আসবে পাখি, আমাকে ছেড়ে আর যেতে পারবে না। পাখিটি, সে-ও প্রেমে পড়েছে নারীর, পরদিন ফিরে আসে, আটকা পড়ে ফাঁদে এবং তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়। 

নারী পাখিটিকে দেখে প্রতিদিন। এই তো সে, তার আবেগ-অনুভূতির বস্তু, সে পাখিটিকে তার বন্ধুদেরকে দেখায়। তারা বলে : ‘তুমি তো এখন যা চেয়েছ সবই পেয়ে গেলে। 

হঠাৎ একটি অদ্ভুত রূপান্তর ঘটতে শুরু করে : নারীটি এখন পাখিটি পেয়ে গেছে, এখন আর তাকে প্রলুব্ধ করার প্রয়োজন নেই, সে পাখির ব্যাপারে হারিয়ে ফেলতে থাকে আগ্রহ। পাখি, যে এখন উড়তে পারে না, যে নিজের জীবনের সত্যিকারের অর্থ প্রকাশে অসমর্থ, সে ক্রমে বুড়ো হতে থাকে, তার পালক থেকে চকমকে ভাব উধাও হয়ে যায়, সে হয়ে ওঠে কুৎসিত; এবং নারীটি তার প্রতি মোটেই মনোযোগ দেয় না, শুধু তাকে খাওয়ানো এবং খাঁচা পরীক্ষা করা ছাড়া। 

একদিন মারা যায় পাখিটি। নারীর মন ভয়ানক খারাপ হয়ে যায়, সে পাখির কথা ভেবে কাটায় সারা দিন। তবে খাঁচার কথা মনে করে না সে, ভাবে সেইদিনটির কথা যেদিন প্রথম দেখেছিল তাকে। পাখিটি মেঘের আড়ালে উড়ে বেড়াচ্ছিল সন্তুষ্টচিত্তে। 

নিজের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে নারী বুঝতে পারত তাকে পাখিটির যে বিষয়টি সবচে’ রোমাঞ্চিত করে তুলত তা হলো তার স্বাধীনতা, তার ডানার শক্তি, শরীর নয়। 

পাখি ছাড়া নারীর কাছেও জীবন হয়ে ওঠে অর্থহীন এবং মৃত্যু এসে কড়া নাড়তে থাকে দরজায়। তুমি কেন এসেছ?’ জিজ্ঞেস করে সে মৃত্যুকে। ‘যাতে তুমি আরেকবার তার সঙ্গে উড়তে পার আকাশে।’ জবাব দেয় মৃত্যু। তুমি তাকে আসতে এবং যেতে দিতে, তুমি তাকে ভালোবাসবে। কিন্তু হায়, তাকে আবার দেখার জন্য এখন আমাকে দরকার হয়ে পড়েছে তোমার। 

সাতাশ 

মাসের পর মাস রিহার্সাল দিয়েছিল যে বিষয়টি নিয়ে আজ সে কাজ দিয়ে দিন শুরু করল সে; ট্রাভেল ও এজেন্টের কাছে গেল। কিনল ব্রাজিলের টিকেট, দুই সপ্তা পরের তারিখে। 

এখন থেকে জেনেভা হবে সেই লোকাটির মুখ যাকে সে ভালোবাসত এবং যে তাকে ভালোবাসত। রু ডি বার্নে হবে স্রেফ একটা নাম। সে স্মরণ করবে তার ঘর, লেক, ফরাসী ভাষার কথা 

সে পাখিটিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখবে না, তার সঙ্গে পাখিকে ব্রাজিলে যেতেও বলবে না। তার মতো একটি পাখির মুক্তভাবে উড়ে বেড়ানোই উচিত। আর সে নিজেও তো একটি পাখি : পাশে পেয়েছে র‍্যালফ হার্টকে যাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে কাটিয়ে দেয়া যাবে বাকিটা জীবন। তবে এটা তার অতীত, ভবিষ্যৎ নয়। 

সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুধু একবারই ‘বিদায়’ কথাটা উচ্চারণ করলে যখন যাবার সময় হবে, কারণ এখানে থেকে এত কষ্ট সহ্য করার মানে হয় না। 

সে লাইব্রেরিতে গেল ফার্ম ম্যানেজমেন্টের ওপরে লেখা বইটি ফেরত দিতে। এ বইয়ের একটা শব্দও বুঝতে পারে নি সে। তবে বইটি ছিল তার নীরব সঙ্গী। এ যেন অন্ধকার রাতগুলোর বাতিঘর। 

সে ভাবে, আমি যতবার ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করেছি ততবার বিস্ময়কর কোনও ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে। 

সে অনুভব করে নিজেকে সে আবিষ্কার করেছে স্বাধীনতা, হতাশ, প্ৰেম, যন্ত্রণা দিয়ে। 

তার কলিগরা নির্দিষ্ট বা ধরাবাঁধা কিছু খদ্দেরের সঙ্গে বিছানায় যায় মহাউল্লাসে। কিন্তু সেক্সের মধ্যে ভালো বা মন্দ কিছুই আবিষ্কার করতে পারে নি সে, সে নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারে নি, সে এখন পর্যন্ত যৌন মিলনে রাগ মোচন করতে পারেনি, সে সেক্সুয়াল কাণ্ডকারখানাগুলো অত্যন্ত অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করেছে মাত্র। 

.

সিরিয়াস সেই লাইব্রেরিয়ান (এবং মারিয়ার একমাত্র বন্ধু, যদিও কথাটা তাকে কখনও বলেনি মারিয়া) বেশ ভালো মুডে ছিল। স্যান্ডউইচ খাচ্ছিল সে। মারিয়াকে অংশীদার হতে আহ্বান জানাল। মারিয়া ধন্যবাদ দিয়ে বলল সে খাবে না। এইমাত্র খেয়ে এসেছে। 

‘বইটা পড়তে অনেক সময় নিলে।’

‘আমি একটা শব্দও বুঝতে পারিনি।’ 

‘তোমার মনে আছে একবার আমার কাছে কি চেয়েছিলে?’ 

না, মনে নেই মারিয়ার। তবে মহিলার চেহারায় দুষ্টু একটা ভাব ফুটে উঠতে দেখে ব্যাপারটা অনুমান করতে পারল সে, সেক্স। 

‘তুমি ওই বিষয়ের ওপরে বই খুঁজতে এলে। আমি ঠিক করলাম সেক্সের ওপরে কী কী বই আছে তার একটা তালিকা করব। তবে খুব বেশি বই ছিল না। কিশোর-কিশোরীদের যেহেতু এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন, আমি কিছু বইয়ের অর্ডার দিলাম। অন্তত একটা দিক থেকে এদের রক্ষা করা যাবে- সেক্স কী জিনিস তা জানার জন্য পতিতাদের কাছে যেতে হবে না।’

ঘরের এক কিনারে, বাদামী কাগজে মোড়ানো কতগুলো বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করল লাইব্রেরিয়ান। 

‘ওগুলোর ক্যাটালগ করার সময় এখনও পাইনি। তবে চট জলদি একবার চোখ বুলিয়েছি। পড়ে যা জানলাম তাতে রীতিমত আতঙ্ক বোধ করেছি।’ 

মারিয়া কল্পনা করল মহিলা কী বলবে : বিব্রতকর ভঙ্গি, স্যাডো- ম্যাসেকিজম, ইত্যাদি। 

লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মারিয়ার। বলল ও এখন যাবে। লাইব্রেরিয়ান বলল : 

‘তুমিও আতঙ্ক বোধ করবে ওসব বই পড়লে। যেমন ধরো, তুমি কি জানো, ভগাঙ্কুর সাম্প্রতিক আবিষ্কার? 

আবিষ্কার? সাম্প্রতিক? 

‘রিয়াল্ডো কোলাম্বো নামে এক ডাক্তার ১৫৫৯ সালে একটি বই লেখেন ‘De re anatonial’ নামে। এতে তিনি ভগাঙ্কুরের কথা উল্লেখ করেন। খ্রিস্টান যুগে, পনেরোশো বছর ধরে অফিশিয়ালভাবে এ বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কোলাম্বো তাঁর বইতে ভগাঙ্কুর এর বর্ণনা দিয়েছেন ‘সুন্দর এবং দরকারি জিনিস’ বলে। বিশ্বাস হয়?’ হেসে উঠল দু’জনেই। 

‘এর দুই বছর পরে, ১৫৬১ সালে, জ্যাব্রিয়েল্লো ফাল্লোপিন্ড নামে আরেক ডাক্তার দাবি করেন তিনি এটা ‘আবিষ্কার’ করেছেন। ভাবতে পারো! দু’জন মানুষ— ইতালীয়, তাঁরা তর্ক করছেন কে আগে ইতিহাস বইতে ভগাঙ্কুর শব্দটি অফিশিয়াল ভাবে যুক্ত করেছেন, তা নিয়ে। 

আড্ডাটা বেশ মজার। তবে মারিয়া এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইছে না কারণ ইতিমধ্যে সে অনুভব করছে তার যোনিতে রসের ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছে— র‍্যালফ তার ভগাঙ্কুর স্পর্শ করেছে, এ কথা মনে পড়তেই। মনে পড়ছে রুমালে বাঁধা চোখ, র‍্যালফের হাত তার সারা শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। 

কিন্তু মহিলার বিরতি দেয়ার কোনও লক্ষণ নেই। সে যেন ইতিমধ্যে ভগাঙ্কুর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে। সে বকবক করেই যেতে লাগল, ‘আফ্রিকান উপজাতিদের মধ্যে অঙ্গছেদের ব্যাপারটি প্রচলিত। তারা নারীকে যৌন আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছে এ কথা সবাই জানে। উনিশ শতকে খোদ এই ইউরোপে ভগাঙ্কুর ছেদন চলত।’ 

মারিয়া হাত তুলল বিদায় বলার জন্য কিন্তু লাইব্রেরিয়ানের কথা বলায় কোনও ক্লান্তি নেই। 

‘এমনকী ড. ফ্রড, মনোবিজ্ঞানের জনক, তিনিও বলেছেন নারীদের যোনি থেকে ভগাঙ্কুর অপসারণ করা উচিত। তার বিশ্বস্ত অনুসারীরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছে নারীর যৌন আনন্দের কেন্দ্রস্থল যদি ভগাঙ্কুর হয় তাহলে তা সমকামের দিকে মোড় নিতে পারে। 

‘অথচ আমরা জানি, স্রেফ পুরুষাঙ্গ দিয়ে গুঁতোগুঁতি করলেই তৃপ্তি হয় না নারীর। আসল আনন্দ লুকিয়ে আছে ছোট্ট ওই মাংসপিণ্ডটিতে যার আবিষ্কারক একজন ইটালিয়ান।’ 

এ মহিলা সহজে থামবে না বুঝতে পেরে একরকম ওখান থেকে পালিয়েই এল মারিয়া। লাইব্রেরিয়ান হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকল পলায়নপর মারিয়ার দিকে। 

.

কোপাকাবানায় যেতে ইচ্ছে করছে না মারিয়ার। তবু কাজে ফেরার একটা তাগিদ অনুভব করল। যদিও বুঝতে পারছে না কেন- কারণ ও তো টাকা কম আয় করেনি। বিকেলটা কেনাকাটা করে কাটিয়ে দিতে পারে মারিয়া। 

মারিয়া জানে না কেন, হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। আর দুই সপ্তা পরে বাড়ি ফিরবে ও। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল চৌরাস্তার মোড়ে। এখানে হাজারও বার এসেছে মারিয়া, এখান থেকে দেখা যায় লেক। 

হঠাৎ যেন মূর্তির মত জমে গেল মারিয়া। আকস্মিক মন খারাপ হবার কারণটা বুঝতে পারছে 

ও আসলে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। 

বাড়ি ফিরতে চাইছে না র‍্যালফ হার্ট, সুইটজারল্যান্ড কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নয়। কারণটা অতি সহজ : টাকা। 

টাকা! কাগজের একটা নোট, চমৎকার রঙে রাঙানো। এর জন্য লালায়িত সবাই। সে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে সবাই, একগাদা নোট নিয়ে যদি কোনও সুইস ব্যাংকে যায়, জিজ্ঞেস করে। আমি কি টাকা দিয়ে আমার জীবনের কয়েকটা ঘণ্টা কিনতে পারি?’ 

জবাব আসবে : ‘না, ম্যাডাম আমরা বিক্রি করি না, আমরা শুধু কিনি।’ 

গাড়ির ব্রেকের শব্দে যেন একটা ঘোর থেকে জেগে ওঠে মারিয়া। এক মোটর সাইকেল আরোহী চেঁচাচ্ছে, এক বৃদ্ধ হাসি মুখে মারিয়াকে ইংরেজিতে বলছেন ফুটপাতে উঠে দাঁড়াতে। কারণ ট্রাফিক সিগনালে পথচারীদের জন্য লাল বাতি জ্বলছে। 

চারপাশে চোখ বুলাল মারিয়া। লোকজন মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে, কেউ দ্রুত পা চালাচ্ছে কর্মস্থলের উদ্দেশে, কেউ যাচ্ছে স্কুলে। মারিয়া যেন তাদেরকে, রু ডি বার্নেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারব। আমার একটা স্বপ্ন আছে। তাছাড়া আমি কিছু টাকা রোজগার করতে চাই।’ 

এ কথা সত্য মারিয়ার পেশা নিয়ে অনেকেই কটূ কথা বলে। কিন্তু ও তো আসলে আর সবার মত সময় বিক্রি করছে। ওর সামনে এখনও বিরাট সুযোগ অপেক্ষা করছে। বিখ্যাত ক্লায়েন্টরা অপেক্ষা করছে ওর জন্য, যারা একবারের সেশনে মারিয়ার জন্য তিনশ থেকে হাজার ফ্রাঁ খরচ করতে দ্বিধা করে না। 

মারিয়া সিদ্ধান্ত নিল সে আরেকটা বছর থেকে যাবে এখানে। কাজ করবে। 

সবুজ আলো জ্বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করল মারিয়া। তারপর রাস্তা পার হয়ে ঘড়িটার সামনে দাঁড়াল। রাস্তার এপারে মস্ত একটা ঘড়ি আছে। র‍্যালফের কথা ভাবল মারিয়া। মনে পড়ল সেই রাতের কথা যেদিন অর্ধনগ্ন শরীর দেখিয়ে ছিল সে র‍্যালফকে। র‍্যালফের চোখে জ্বলজ্বল করছিল কামনা। তার হাত ঘুরে বেড়াচ্ছিল মারিয়ার নগ্ন বক্ষে, যোনিতে, মুখে, মারিয়া ভিজে উঠছিল। দূরে পানির দিকে তাকাল মারিয়া। আর ঠিক তখন, শরীরের কোনও অঙ্গ স্পর্শ করা ছাড়াই, সবার সামনে রেতঃপাত হয়ে গেল মারিয়ার।

তবে কেউ তাকে লক্ষ করল না। কারণ সবাই যে যার কাজে অতি ব্যস্ত। 

আঠাশ 

মারিয়া তার সহকর্মীদের মধ্যে ফিলিপিনো মেয়ে নিয়ার সঙ্গেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। মারিয়া ক্লাবে ঢুকতেই ওকে ডাকল সে। নিয়া প্রাচ্যদেশীয় এবং লোকের সঙ্গে বসে আছে। দু’জনেই হাসাহাসি করছে খুব। ‘দ্যাখো,’ নিয়া বলল মারিয়াকে। ‘এ লোক আমাকে দিয়ে কী করাতে চাইছে!’ 

প্রাচ্যদেশীয় ভদ্রলোক মারিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, হাসতে হাসতে একটা সিগার বক্সের ঢাকনা খুলল। মিলান দূর থেকে লক্ষ করছে ওদেরকে। দেখছে বক্সের মধ্যে ড্রাগস আছে কিনা। নেই। তবে জিনিসটা কী দূর থেকে দেখেও বুঝতে পারল না মিলান। 

‘দেখে মনে হচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন জিনিস,’ মন্তব্য করল মারিয়া। 

‘ঠিক তাই,’ বলল ভদ্রলোক। ‘এর বয়স একশ বছরেরও বেশি। প্রচুর টাকা দিয়ে কিনেছি আমি এ জিনিস।’ 

বক্সের মধ্যে কতগুলো ভালব, একটি হাতল, ইলেকট্রিক সার্কিট, খুদে মেটাল কনট্যাক্ট এবং ব্যাটারি। যেন পুরানো কোনও রেডিওর ভেতরের অংশ দেখছে মারিয়া, এক জোড়া তার বেরিয়ে আছে ছোট গ্লাস রঙের শেষ মাথা থেকে, আঙুলের মত মোটা। দেখে মনে হচ্ছে না অনেক দামী জিনিস। 

‘এটা কীভাবে কাজ করে?’ 

মারিয়ার প্রশ্ন পছন্দ হলো না নিয়ার। মারিয়াকে সে বিশ্বাস করলেও মানুষ বদলে যেতে কতক্ষণ। মারিয়া হয়তো তার ক্লায়েন্টের ওপর নজরও দিয়ে দিতে পারে। 

‘কীভাবে কাজ করে উনি আগেই ব্যাখ্যা করেছেন। এটা ভায়োলেট রড।’

প্রাচ্যদেশীয় ভদ্রলোকের দিকে ফিরল নিয়া। বলল ওরা এখন উঠতে পারে। কারণ সে ভদ্রলোকের দাওয়াত কবুল করেছে। লোকটা খুশি হলো মারিয়া তার খেলনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে। 

‘১৯৮০ সালের দিকে, যখন বাজারে প্রথম এল ব্যাটারি, ট্রাডিশনাল মেডিসিন বিদ্যুতের সাহায্যে এক্সপেরিমেন্ট চালাতে থাকে দেখার জন্য এটা মানসিক অসুস্থতা বা মৃগী রোগ সারাতে পারে কিনা। এটা শরীরের দাগ তুলতে এবং ত্বক উত্তেজিত করে তোলার কাজে ব্যবহার করা হতো। এ দুটো প্রান্ত দেখতে পাচ্ছেন? এখানে এগুলো রাখা হতো।’ নিজের কপালে ইংগিত করল লোকটা। 

‘ব্যাটারি এক ধরনের স্থির বিদ্যুত উৎপাদন করত। এদেশে এটা কমন ব্যাপার, বিশেষ করে শুকনো আবহাওয়ার সময়।’ 

ব্রাজিলে স্থির বিদ্যুৎ নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি মারিয়ার, হয়েছে সুইটজারল্যান্ডে এসে। সে একবার ট্যাক্সির দরজা খুলতে গিয়ে বিদ্যুতের শক খেয়েছিল। তবে ওই একবারই নয়, আরও কয়েকবার এ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে মারিয়ার, পরে জেনেছে শুকনো আবহাওয়ার কারণে এমন হয়। এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল মারিয়া, ধাতব কিছু ধরতেও ডরাত। পরে সুপার মার্কেট থেকে একটি ব্রেসলেট কিনে নেয় সে। ব্রেসলেট বিদ্যুৎ টেনে নিত। আর শক খেতে হয়নি মারিয়াকে। 

লোকটার দিকে ঘুরল মারিয়া! 

‘কিন্তু ওটা খুব বাজে একটা জিনিস।’ 

মারিয়ার মন্তব্যে রাগ হচ্ছিল নিয়ার। বান্ধবীর সঙ্গে সংঘাত এড়াতে সে লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরল হাত দিয়ে। এখন সবাই বুঝতে পারবে এ লোকটি তার। 

‘ব্যাপারটা নির্ভর করছে ওটা আপনি কোথায় রেখেছেন তার ওপর,’ হা হা করে হেসে উঠল লোকটা। 

সে ছোট হাতলটা ঘুরিয়ে দিল। রড দুটো বেগুনি রঙ ধরল। রড জোড়া সে দুই নারীর গায়ে ছোঁয়াল। ওরা বিদ্যুতের শক খেল, তবে ব্যথার চেয়ে সুড়সুড়িই লাগল যেন। কাউন্টার ছেড়ে এগিয়ে এল মিলান 

‘এসব এখানে ব্যবহার না করলেই খুশি হবো, প্লিজ। 

লোকটা রড জোড়া ঢুকিয়ে রাখল বাক্সে। সুযোগটা কাজে লাগাল নিয়া। বলল হোটেলে যেতে। লোকটাকে কিঞ্চিৎ হতাশ মনে হলো। নতুন মেয়েটি তার যন্ত্রের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছিল। অথচ সঙ্গের মেয়েটা কিনা তাকে হোটেলে যাবার তাগাদা দিচ্ছে। সে গায়ে জ্যাকে চৈড়াল। বাক্সটা চামড়ার ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে বলল : 

‘ওরা এখন এ জিনিস তৈরি শুরু করেছে; বিশেষ আনন্দ যারা পেতে চায় তাদের জন্য এগুলো তৈরি করা হয়। এগুলো বড় জোর দুষ্প্রাপ্য মেডিকেল কালেকশন, জাদুঘর এবং অ্যান্টিকশপ-এ দেখতে পাবেন।’ 

 মিলান এবং মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

‘এরকম জিনিস আগে কখনও দেখেছেন?’ 

‘না ঠিক এরকম জিনিস দেখিনি। তবে এটার দাম বোধহয় অনেক বেশি।’ অবশ্য এ লোক এক তেল কোম্পানির উচ্চ পদস্থ নির্বাহী। ‘আমি এর আধুনিক সংস্করণ দেখেছি।’ 

‘এ দিয়ে কী করে?’ 

‘লোকটা তার শরীরে ঢোকায় এটা… তারপর সঙ্গিনীকে বলে হাতল ঘোরাতে। শররের ভেতরে ইলেকট্রিক শক খায় সে।’ 

‘কাজটা তো সে নিজেই করতে পারে, পারে না?’ 

‘অনেক সেক্সুয়াল কাণ্ডই তুমি একাই করতে পার, আর এরা যদি ভাবতে থাকে নিজেরাই আনন্দ লুটবে তাহলে তো আমার বার-এর চাট্টিবাট্টি গুটিয়ে বাড়ি নিয়ে বসে থাকতে হবে। যাকগে, তোমার স্পেশাল ক্লায়েন্ট বলেছিল আজ রাতে সে আসছে। কাজেই অন্য কাউকে আজ নিয়ো না। 

‘আমি এসেছিলাম বিদায় জানাতে। আমি চলে যাচ্ছি।’ 

‘পেইন্টারকে ছেড়ে দিচ্ছ?’ 

‘না। কোপাকাবানা। সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্রাজিলে ফিরে যাব। ওখানে খামার করব। আমি জানি আমি আরও টাকা বানাতে পারব যদি আরেকটা বছর কাজ করি- কিন্তু কী লাভ? কারণ আরেকটা বছর থাকতে গেলে ফাঁদে পড়ে যাব আমি। আরেকটা দিন যদি থাকি তো আরও একটা বছর থাকতে হবে আমাকে এখানে। আরেকটা বছর থাকা মানে এখান থেকে আর বেরুতেই পারব না।’ 

মাথা ঝাঁকাল মিলান, যেন বুঝতে পেরেছে সব কিছু। মারিয়া যা বলল তার সঙ্গে একমত হলো সে। যদিও মুখে বলল না কিছুই। মারিয়া ভুল করছে, এ কথা বলে ওকে পটানোর চেষ্টাও করল না। 

মারিয়া ধন্যবাদ জানাল মিলানকে। তার কাছে ড্রিঙ্ক চাইল— এক গ্লাস শ্যাম্পেন। ফ্রুট জুস ককটেল খেতে আর ভাল্লাগে না। সে এখন মদ পান করতে পারে কারণ সে আর কাজ করছে না। মিলান বলল মারিয়ার যখনই প্রয়োজন হবে তাকে যেন ফোন করে সে। তার দরজা মারিয়ার জন্য সব সময় খোলা। 

ড্রিঙ্কের দাম দিতে চাইল মারিয়া। নিল না মিলান। 

.

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, বাড়ি ফেরার পরে : 

আমার ঠিক মনে পড়ছে না কবে, তবে সাম্প্রতিক এক রোববার আমি চার্চে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারি আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি— এটা প্রোটেস্টান্ট চার্চ। 

আমি চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পাদ্রী ততক্ষণে প্রার্থনা অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছেন। ভাবলাম এখন চলে যাওয়াটা খারাপ দেখাবে। তাছাড়া ধর্মযাজক যা বলছিলেন শুনতে খুব ভালো লাগছিল আমার। তিনি বলছিলেন : পৃথিবীর সকল ভাষায় রয়েছে এই প্রবাদ বাক্যটি : ‘চোখ যা দেখতে পায় না হৃদয় তার জন্য শোক করে না।’ তবে আমি মনে করি এর মধ্যে সত্যি নেই এক রত্তি। দু’জনের মধ্যে যত দূরত্ব সৃষ্টি হবে হৃদয় তত বেশি করে অনুভব করবে সেইসব কথা যা আমরা ভুলে যেতে চাই। যখন নির্বাসনে থাকি আমরা, আমরা নিজেদের মূলের প্রতিটি ক্ষুদ্র স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। আমরা যাকে ভালোবাসি, তার কাছ থেকে যদি দূরে থাকি, রাস্তার প্রতিটি মানুষকে দেখলে তার কথাই আমাদের মনে পড়ে বেশি। 

‘সকল ধর্মেও পবিত্র শ্লোক এবং ধর্মগ্রন্থ রচনা করা হয়েছে নির্বাসনে থাকাকালীন, ঈশ্বরকে জানার চেষ্টায়, আমাদের পূর্ব পুরুষরা জানতেন না, আমরাও জানি না দেবতারা আমাদের কাছে কী চান যে সব বই লেখা হয়েছে, আঁকা হয়েছে ছবি, এসব আঁকা ও লেখার উদ্দেশ্য একটাই— আমরা নিজেদের ভুলে যেতে চাই না— পারিও না।’ প্রার্থনা সভা শেষে আমি ধর্মযাজকের কাছে গিয়ে বলি আমি এক অদ্ভুত দেশের অচেনা বাসিন্দা। তাকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে চোখ যা দেখতে পায় না, হৃদয় তার জন্য শোক করে। আমার হৃদয় আজ এত বেশি শোকাকুল যে চলে যাচ্ছি আমি।’ 

ঊনত্রিশ 

মারিয়া দুটো সুটকেস নিয়ে বিছানায় রাখল। সে ভাবত এ সুটকেস ভরে ফেলবে উপহার, নতুন কাপড়, বরফের ছবি, সুখি সময়ের স্যুভেনির দিয়ে। সে অল্প কিছু নতুন জামা কাপড় কিনেছে বটে এবং জেনেভায় তুষারপাতের সময় কয়েকটি ছবিও তুলেছে, তবে এ ছাড়া কল্পনার সঙ্গে মেলে এমন কিছু নেই তার কাছে। 

সে প্রচুর টাকা কামাই করার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল এ দেশে। স্বপ্ন দেখেছে একটা খামার কিনে দেবে তার বাবা-মাকে, খুঁজে নেবে বর, তার পরিবারকে নিয়ে আসবে দেখাতে কোথায় সে বাস করে। সে মাত্র একটি স্বপ্ন পূরণ করার মত টাকা-পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সে পাহাড় দেখেনি, নিজের কাছে নিজেকে অচেনা মনে হয়। তবু সুখি মারিয়া। সে জানে এবারে বিরতি দেয়ার সময় এসেছে। 

অনেকেই এভাবে থামতে জানে না। 

মারিয়ার জীবনে চারটে অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনা ঘটেছে— ক্যাবারের ডান্সার হয়েছে, ফরাসী ভাষা শিখেছে, কাজ করেছে পতিতা হিসেবে এবং নির্বোধের মত প্রেমে পড়েছে। এক বছরে এত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার মত গর্ব করতে পারে ক’জনা? সে সুখি, তবু মনের ভেতরে একটা দুঃখ আছে ওর। এ দুঃখের একটা নাম আছে— র‍্যালফ হার্ট। যদিও কোনওদিন স্বীকার করেনি নিজের কাছে, কিন্তু মনের গভীর থেকে জানে র‍্যালফকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। যে মানুষটি তার জন্য এখন চার্চে অপেক্ষা করছে, তাকে তার বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাবে, তার ছবি দেখাবে, তার পৃথিবী দেখাবে। 

মারিয়া বিমান বন্দরের কাছে হোটেল ভাড়া করতে বলেছে র‍্যালফকে। যদিও ওর ফ্লাইট কাল সকালে। মারিয়া একটা সুটকেস খুলে ইলেকট্রিক ট্রেনের ক্যারিজ বের করল। এটা র‍্যালফ তাকে দিয়েছে। কিছুক্ষণ খেলনাটার দিকে তাকিয়ে থাকল মারিয়া। তারপর ওটা আবর্জনার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে দিল। এটাকে নিয়ে ব্রাজিলে যাবার কোনও মানে নেই। 

না, মারিয়া চার্চে যাবে না : আগামীকালের কথা জিজ্ঞেস করতে পারে র‍্যালফ। মারিয়া যদি বলে দেয় সে চলে যাচ্ছে, র‍্যালফ তাকে থাকার জন্য অনুনয় করতে পারে, প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারে মারিয়ার প্রতি তার ভালোবাসার কথা। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে- সম্ভবত এই একটা মাত্র কারণেই ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে, কারণ ওরা জানে ওদের একে অপরকে দরকার নেই। পুরুষ ভীত হয় যখন নারী বলে : ‘আমি তোমাকে চাই।’ আর মারিয়া র‍্যালফ হার্টের ছবিটা শুধু তার মনের মাঝে গেঁথে রাখবে যে তার প্রেমে ছিল মাতোয়ারা এবং একান্তভাবেই ছিল মারিয়ার। যে কিনা মারিয়ার জন্য যে কোনও কিছু করতে প্রস্তুত। 

মারিয়ার হাতে এখনও সময় আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার সে র‍্যালফের কাছে যাবে কী যাবে না। কিছু প্রাকটিকাল বিষয়ে মনোসংযোগ করা দরকার মারিয়ার। যেসব জিনিস বাঁধাছাদা করতে পারেনি ওগুলোর ওপর চোখ বুলাল মারিয়া। বুঝতে পারছে না এগুলো দিয়ে কী করবে। ভাবল বাড়ির মালিক এসেই যা করার করবে’খন। সে ঘরে এসে দেখবে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মারিয়ার ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র। সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা কয়েকটি ছবি, তোয়ালে, বিছানার চাদর। এসব ব্রাজিলে নিয়ে যাবে না মারিয়া। যদিও সুইস ভিক্ষুকের চেয়েও তার বাবা মা’র এগুলো বেশি দরকার। 

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মারিয়া। গেল ব্যাংকে। বলল সব টাকা তুলে নেবে। ব্যাংক ম্যানেজার- যে মারিয়ার সঙ্গে এর আগে বিছানায় গেছে—বলল কাজটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না, কারণ ব্যাংক থেকে সুদ পাচ্ছে মারিয়া এবং এ সুদ সে ব্রাজিলে বসেও পাবে। তাছাড়া বলা যায় না, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সমস্ত টাকা খুইয়ে বসতে পারে মারিয়া। তারমানে এতদিনের পরিশ্রমই জলে যাবে। একমুহূর্ত ইতস্তত করল মারিয়া- যেভাবে সে সবসময়ই করে- বুঝতে পারল লোকটা তাকে সত্যি সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু শেষে সিদ্ধান্ত নিল সুদের দরকার নেই তার, সে এ টাকা দিয়ে খামার করবে, বাবা-মাকে বাড়ি কিনে দেবে, কয়েকটা গরু কিনবে, এ ছাড়াও কিছুকাজ করবে। 

মারিয়া তার জমাকৃত অর্থের প্রতিটি পাই পয়সা পর্যন্ত তুলে নিল। টাকাটা রাখল ছোট একটি ব্যাগে। টাকা রাখার জন্যই ব্যাগটা কেনা। ওর জামার নিচের বেল্টের সঙ্গে ব্যাগটার ফিতে আটকানো। 

এরপর ট্রাভেল এজেন্সিতে গেল মারিয়া। মনে মনে প্রার্থনা করল সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে। বলল সে আলাদা একটি ফ্লাইটে যেতে চায়। তাকে বলা হলো আগামীকালের ফ্লাইটে গেলে তাকে প্যারিসে বিমান বদলাতে হবে। এটা কোনও ব্যাপারই না— দ্বিতীয়বার কোনও চিন্তা মনে আসার আগেই সে যত দূরে সম্ভব চলে যেতে চায়। 

একটা ব্রিজে চলে এল মারিয়া। আইসক্রিম কিনল। জেনেভা শহরটার দিকে তাকাল। সবকিছু কেমন অন্য রকম লাগছে। যেন এই মাত্র সে এই শহরে এসে পৌঁছেছে। সে জাদুঘর দেখতে যাবে, যাবে ঐতিহাসিক মনুমেন্ট দর্শনে, ফ্যাশনের বার এবং রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখবে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, যখন আপনি একটি শহরে বাস করেন তখন ওই শহর কখনোই ঘুরে দেখেন না ফলে ওই শহর সম্পর্কে জানাও হয়ে ওঠে না। 

মারিয়া ভেবেছিল বাড়ি যাচ্ছে বলে ভালো লাগবে মন। কই, তেমন তো লাগছে না। ভেবেছিল যে শহরে এতদিন থেকেছে সে শহর ছেড়ে যেতে খারাপ লাগবে। কিন্তু তাও লাগছে না। এখন অবশ্য একটা কাজ করতে পারে মারিয়া খানিকটা অশ্রু ঝরাতে পারে। ঝরাতে পারে এ জন্য যে তার মতো বুদ্ধিমতী একটি নারী, যার সব ছিল, সে কিনা একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। 

মারিয়া আশা করল এবারের সিদ্ধান্তটি সঠিক হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *