বিশ
মাঝে মাঝে জীবন একেবারে নীরস এবং অর্থহীন লাগে : দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর কেটে যায় একেঘেয়ে ভাবে, কোনওরকম বৈচিত্র্য ছাড়াই। তারপর হঠাৎ করেই খুলে যায় একটি দরজা যেমনটি মারিয়ার ক্ষেত্রে ঘটেছে র্যালফ হার্টের সঙ্গে পরিচয় হবার পরে- যেন ঘটে যায় বিস্ফোরণ, আবেগের হিমবাহ হুড়মুড়িয়ে নেমে আসতে থাকে। এই মুহূর্তে আপনার কিছু নেই, কিন্তু পরমুহূর্তে এত কিছু পেয়ে গেলেন যে সামাল দেয়াই কষ্টকর হয়ে ওঠে।
ডায়েরি লেখার ঘণ্টা দুই বাদে কাজে ফিরেছে মারিয়া, মালিক মিলান তাকাল ওর দিকে :
‘তুমি তাহলে পেইন্টারের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলে, না?’
এ ক্লাবের সবাই র্যালফকে চেনে- ব্যাপারটা মারিয়া বুঝতে পেরেছে যেদিন সে তিনজন কাস্টমারের সমান টাকা দিল মিলানকে, এমনকী দরদস্তুর পর্যন্ত করেনি। মারিয়া আবছা মাথা ঝাঁকাল, মিলান অবশ্য ব্যাপারটা লক্ষ করল না বা লক্ষ করলেও পাত্তা দিল না। সে মারিয়ার চেয়ে এ জীবন ঢের বেশি চেনে।
‘তুমি বোধহয় পরবর্তী স্টেজের জন্য তৈরি। আমাদের একজন স্পেশাল ক্লায়েন্ট আছেন, প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন তোমার কথা। আমি তাঁকে বলেছি তুমি এখনও তেমন অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে পারনি। আমার কথা বিশ্বাস করেছেন তিনি। তবে আমার মনে হয় এবারে চেষ্টা করে দেখতে পার।’
স্পেশাল ক্লায়েন্ট?
‘পেইন্টারের কী হবে?’
‘উনিও স্পেশাল ক্লায়েন্ট।’
ঠোঁট কামড়াল মারিয়া। বলল না কিছুই। একটি চমৎকার সপ্তাহ কাটিয়েছে সে র্যালফ হার্টের সঙ্গে। ও ডায়েরিতে যা লিখেছে তা ভুলতে চায় না।
‘ওর সঙ্গে যা করেছি স্পেশাল ক্লায়েন্টের সঙ্গে তাই করতে হবে?’
‘তুমি কী করেছ জানি না আমি তবে আজ রাতে কেউ যদি তোমাকে ড্রিঙ্কের অফার দেয়, সরাসরি না বলে দেবে। বিশেষ ক্লায়েন্টরা বেশি পয়সা দেন। তোমার কোনও আফশোস থাকবে না।’
গতানুগতিকভাবে শুরু হলো কাজ। ক্লাবে আছে থাই, কলাম্বিয়ান এবং তিনজন ব্রাজিলিয়ান তরুণী। এ ছাড়া একজন অস্ট্রিয়, দু’জন জার্মান। বাকিরা লম্বা এবং সুন্দরী, বিষণ্ন চোখ, এরা এসেছে প্রাচ্যের দেশ থেকে। এরা অন্যদের চেয়ে দ্রুত স্বামী খুঁজে পেতে আগ্রহী।
খদ্দেরদের আগমন শুরু হলো- রুশ, সুইস, জার্মান, সবাই ব্যস্ত নির্বাহী কর্মকর্তা, বিশ্বের অন্যতম দামী শহরের সবচেয়ে দামী পতিতাদের কাছ থেকে বিনোদন কিনে নিতে যাদের পয়সার অভাব নেই। কয়েকজন এল মারিয়ার টেবিলে। মারিয়া তাকিয়ে ছিল মিলানের দিকে। সে মাথা নেড়ে মানা করল। মনে মনে খুশি হলো মারিয়া। আজ রাতে তাকে পা ফাঁক করতে হবে না, ঠাণ্ডা বাথরুমে গোসলও করতে হবে না। তাকে আজ শুধু সেক্স নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা একজনকে শিখিয়ে দিতে হবে কীভাবে প্রেম করতে হয়।
এক যুবক এল, বয়সে র্যালফ হার্টের কমই হবে। সুদর্শন, কালো চুল, সুবিন্যস্ত দাঁতের সারি, পরনে মাও জ্যাকেট, কোন টাই নেই, হাই কলার, নিচে ধবধবে সাদা শার্ট, সে সোজা বার-এ গেল। সে এবং মিলান দু’জনেই তাকাল মারিয়ার দিকে। যুবক এল মারিয়ার কাছে।
‘আপনাকে একটা ড্রিঙ্ক কিনে দিই?’
মারিয়া দেখল মাথা দোলাচ্ছে মিলান। সে যুবককে টেবিলে বসতে আমন্ত্রণ জানাল। ফ্রুট জুস ককটেলের অর্ডার দিল। অপেক্ষা করছে যুবক কখন তাকে নাচার আহ্বান জানায়।
যুবক নিজের পরিচয় দিল :
‘আমার নাম টেরেন্স। ইংল্যান্ডে একটি রেকর্ড কোম্পানিতে কাজ করি আশা করি এখানে আমার প্রাইভেসি নষ্ট হবে না। ব্যাপারটা শুধু তোমার এবং আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’
মারিয়া ব্রাজিল নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিল যুবক :
‘মিলান বলেছে আমি যা চাই তুমি তা বুঝতে পারবে।’
‘আমি জানি না আপনি কী চাইছেন তবে আমি আমার কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।’
রুটিন অনুসরণ করল না ওরা; যুবক বিল মিটিয়ে দিল, মারিয়ার হাত ধরে উঠে পড়ল একটি ট্যাক্সিতে। গাড়িতে বসে এক হাজার ফ্রাঁ দিল ওকে। এক মুহূর্তের জন্য সেই আরবের কথা মনে পড়ে গেল মারিয়ার যে তাকে একই পরিমাণের অর্থ দিয়েছিল। আনন্দিত হবার বদলে নার্ভাস বোধ করল মারিয়া।
শহরের অন্যতম অভিজাত একটি হোটেলের সামনে থামল ট্যাক্সি। পোর্টারকে নাম ধরে ডাকল যুবক, অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ তার চলাফেরা। সোজা নিজের রুমে চলে এল টেরেন্স, বিলাস বহুল স্যুইট, জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়। ওয়াইনের বোতল খুলল সে- সম্ভবত দুষ্প্ৰাপ্য মদ- মারিয়াকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিল।
টেরেন্স মদ পান করছে, মারিয়া তাকে লক্ষ করতে লাগল। এই ধনী, সুদর্শন যুবকটি তার মত পতিতার কাছে কী চায়? যুবক স্বল্পভাষী বলে মারিয়াও নিশ্চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল, ভাবছে এই বিশেষ ক্লায়েন্টকে কীভাবে সুখী করা যায়। ও জানে শুরুটা ওর করা উচিত হবে না, তবে কাজ শুরু হয়ে গেল যত দ্রুত সম্ভব যুবকের নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে ওকে। কারণ প্রতিরাতে তো আর হাজার ফ্রাঁ আয় করা যাবে না।
‘আমাদের হাতে সময় আছে প্রচুর,’ বলল টেরেন্স। ‘তুমি ইচ্ছে করলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পার।’
নিরাপত্তা বোধের অভাব আবার ফিরে এল মারিয়ার মাঝে। তার অন্যান্য কাস্টমারদের মত মোটেই ভীতিকর মনে হচ্ছে না এ লোকটিকে। যুবক খুব শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে। সে জানে সে কী চাইছে। চালিয়ে দিয়েছে চমৎকার মিউজিক। তার ঘরটি চমৎকার। ঘরের এক কোণে খুব ছোট একটি সুটকেস দেখতে পাচ্ছে মারিয়া। মনে হচ্ছে হালকা জিনিস বহন করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এ লোক। অথবা জেনেভায় এসেছে মাত্র একটি রাত কাটাতে।
‘আমি বাড়ি গিয়ে ঘুমাব,’ বলল মারিয়া।
হঠাৎ যেন পরিবর্তন ঘটল ওর সামনে বসা লোকটির চেহারায়, বরফ শীতল চাউনি ফুটল চোখে।
‘ওখানে বসো,’ ডেস্কের পাশে একটা চেয়ার দেখাল সে।
হুকুম! আক্ষরিক অর্থেই আদেশ। হুকুম পালন করল মারিয়া, আশ্চর্য ব্যাপার, সে উত্তেজনা বোধ করছে।
‘সুন্দরভাবে বসো। শিরদাঁড়া টানটান, নারীদের মত। ঠিক মত না বসলে আমি তোমাকে শাস্তি দেব।’
শাস্তি দেবে! স্পেশাল ক্লায়েন্ট! মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় মারিয়ার কাছে। সে ব্যাগ থেকে হাজার ফ্রাঁর নোটগুলো বের করে ডেস্কে রাখল।
‘আমি জানি আপনি কী চাইছেন,’ লোকটার ঠাণ্ডা, নীল চোখে তাকাল মারিয়া। ‘কিন্তু আমি তা করতে পারব না।’
যুবক যেন হঠাৎ আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে মারিয়া যা বলছে তাই করবে।
‘ওয়াইন নাও,’ বলল সে। ‘তোমাকে কোনও কিছু করতে জোর করব না আমি। তোমার ইচ্ছে হলে থাকবে না হলে চলে যেয়ো।’
একটু স্বস্তিবোধ করল মারিয়া।
‘আমি চাকরি করি। আমার একজন বস আছে। সেই আমার সব দেখভাল করে। সে আমাকে বিশ্বাসও করে। আপনি যদি তাকে কিছু না বলেন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।’
মারিয়া স্বাভাবিক গলায় কথাগুলো বলল। কোনও অনুনয় ফুটল না কণ্ঠে।
টেরেন্সকে আবার আগের চেহারায় দেখতে পেল মারিয়া— ভদ্রও নয়, কর্কশও নয়। সে জানে সে কী চায়। যুবক যেন একটা ঘোর থেকে জেগে উঠল।
মারিয়া কী এখন চলে যাবে এই ‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’-এর রহস্য না জেনে?
‘আপনি আসলে আমার কাছে কী চাইছেন?’
‘তুমি জান আমি কী চাইছি। ব্যথা। যন্ত্রণা। আর প্রচুর আনন্দ।’
.
‘ব্যথা এবং যন্ত্রণার সঙ্গে আনন্দ যায় না,’ ভাবে মারিয়া। তবু মরিয়া হয়ে ভাবতে চায় এগুলো একসঙ্গে যায়। এভাবে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে সে ইতিবাচক কিছু তুলে আনতে চায়।
টেরেন্স মারিয়ার হাত ধরে ওকে নিয়ে এল জানালার পাশে : লেকের অপরপাশে গির্জার চুড়ো চোখে পড়ল। সান্তিয়াগোর রাস্তায় র্যালফ হার্টের সঙ্গে হাঁটার সময় এ গির্জাটি দেখেছে মারিয়া।
‘তুমি নদী, লেক, বাড়িঘর এবং চার্চ দেখতে পাচ্ছ? পাঁচশ বছর আগেও এগুলো এরকমই সুন্দর ছিল। শুধু শহরটি ছিল পরিত্যক্ত। একটি অদ্ভুত রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ইউরোপ জুড়ে, কেউ বুঝতে পারছিল না কেন এত মানুষ মারা যাচ্ছে। তারা রোগটির নাম দেয় ব্ল্যাক ডেথ— ঈশ্বর মানুষের পাপের শাস্তি হিসেবে এ রোগ পাঠিয়েছেন বলে তাদের বিশ্বাস ছিল।
‘তখন একদল লোক সিদ্ধান্ত নেয় মানবতার স্বার্থে নিজেদেরকে উৎসর্গ করবে। তারা যে জিনিসটি সবচেয়ে ভয় পেত সেটা উৎসর্গ করবে বলে ঠিক করবে : শারীরিক যন্ত্রণা। তারা রাত-দিন কাটাতে থাকে সেতু, এবং রাস্তায়, নিজেদেরকে চাবকাতে থাকে, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। তারা ঈশ্বরের নামে নিজেদেরকে কষ্ট দিচ্ছিল এবং যন্ত্রণার সময় ঈশ্বর বন্দনা করত। তারা শীঘ্রি উপলব্ধি করতে পারে রুটি তৈরি কিংবা মাঠে কাজ করা অথবা পশু পালনের চেয়ে এ কাজটি তাদেরকে অধিকতর সুখ দিচ্ছে। শারীরিক যন্ত্রণা তাদেরকে কষ্ট তো দিচ্ছিলই না বরং এতে তারা আনন্দের উৎস পেয়ে যায়। ব্যথা বেদনা হয়ে ওঠে সুখ, জীবনের মানে, আনন্দ।’
যুবকের চোখের দৃষ্টি আবার শীতল দেখাচ্ছে। সে টেবিল থেকে মারিয়ার টাকাগুলো তুলে নিল, একটি একশ এবং পঞ্চাশ ফ্রাঁর নোট আলাদা করে রেখে দিল ওর ব্যাগে।
‘তোমার বসকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এটা তার কমিশন। কথা দিচ্ছি, তাকে আমি কিছুই বলব না।
‘তুমি এখন যেতে পার।
টাকাগুলো খপ করে ধরল মারিয়া।
‘না! আমি এখন কিছুই ভয় করি না। আপনি যা করতে চাইছেন করুন। আপনার কথা অমান্য করতে চেয়েছি বলে যা খুশি শাস্তি আমাকে দিতে পারেন।’ মারিয়া হঠাৎ করেই যেন বদলে গেছে। সে একটা খেলা খেলছে। এ খেলার শেষটা সে দেখতে চায়।
‘হাঁটু মুড়ে বসো!’ নিচু, শীতল গলায় আদেশ এল।
হুকুম তামিল করল মারিয়া। এর আগে তার সঙ্গে কেউ এ রকম আচরণ করেনি। সে বুঝতে পারছে না এটা ভালো হচ্ছে নাকি খারাপ। সে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। যেন সে যা করেছে তার জন্য শাস্তি পেতে চাইছে। একটা ভূমিকায় প্রবেশ করছে মারিয়া, ভিন্ন একজন মানুষ হয়ে উঠছে, এমন একজন নারী যাকে সে চেনে না মোটেই।
‘তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে কারণ তুমি কোনও কম্পের নয়, কারণ তুমি আইন-কানুন কিছুই জানো না এবং কারণ সেক্স, জীবন অথবা প্রেম সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণাই নেই।’
কথা বলছে টেরেন্স, যেন আলাদা দুটি মানুষে রূপান্তর ঘটল তার। একজন শান্তভাবে আইন-কানুন ব্যাখ্যা করছে মারিয়াকে, অপরজন তার মত অপদার্থ কেউ নেই।
‘আমি কেন এসব করছি জানো? কারণ অজানা পৃথিবীর কাউকে দিয়ে শুরু করার চেয়ে আনন্দ অন্য কিছু নেই। আর এই শুরু করাটা হলো কুমারীত্ব হরণ। শরীরের কৌমার্য নয়, আত্মার কৌমার্য। বুঝতে পেরেছ?’
বুঝতে পেরেছে মারিয়া।
‘আমি যদি ব্যথা সহ্য করতে না পারি?’
‘ব্যথা বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো আনন্দ এবং রহস্যে রূপান্তর। মাথা নিচু করো। আমার দিকে তাকিয়ো না!
মারিয়া হাঁটু মুড়ে বসেছে মেঝেতে, মাথা নামিয়ে তাকাল মেঝেতে।
‘আমরা একটা খেলা খেলছি। এ খেলায় দুটো কোড ওয়ার্ড আছে। আমাদের কেউ যদি বলে ‘হলুদ’ এর মানে, ভায়োলেন্সের মাত্রা কমাতে হবে। আর আমাদের কেউ যদি বলে ‘লাল’ তাহলে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিতে হবে খেলা।
‘আপনি বললেন, ‘আমাদের কেউ?…’
‘একজন ছাড়া অপরজনের অস্তিত্ব নেই। কেউ জানে না অপরজনকে কীভাবে নির্যাতন করতে হবে যদি তাদের নিজেদের নির্যাতনের অভিজ্ঞতা না থাকে।’
কথা বা শব্দগুলো ভয়ঙ্কর লাগছে মারিয়ার কাছে, এ যেন এমন এক পৃথিবী থেকে আসছে যে পৃথিবীকে চেনে না মারিয়া। ছায়া ঢাকা, নোংরা এক পৃথিবী। তবু সে খেলাটা চালিয়ে যেতে চাইছে— উত্তেজনা ও ভয়ে তার শরীর কাঁপছে থরথর করে।
টেরেন্স হাত রাখল মারিয়ার মাথায় অপ্রত্যাশিত কোমলভাবে।
‘ব্যস, এই-ই সব।’
মারিয়াকে সিধে হতে বলল সে। তবে আগের মত কর্কশ গলায় নয়। এখনও কাঁপছে মারিয়া, গায়ে চড়াল জ্যাকেট। টেরেন্স তার কাঁপুনি লক্ষ করল।
‘যাবার আগে একটা সিগারেট খেয়ে যাও।’
‘কিন্তু ঘটল না তো কিছুই।’
‘দরকার নেই। তোমার আত্মার মধ্যে যা ঘটার ঘটতে শুরু করবে। আবার যখন সাক্ষাৎ হবে আমাদের, প্রস্তুত থাকবে তুমি।’
‘এটুকুর জন্য হাজার ফ্রাঁ দিচ্ছেন?’
জবাব দিল না টেরেন্স। সে-ও একটা সিগারেট ধরাল। তারপর দু’জনে মিলে পান করল মদ। গান শুনল। উপভোগ করল নীরবতা। তারপর কথা বলল মারিয়া।
‘আমি বুঝতে পারছি না কেন এর মধ্যে পা দিলাম।’
‘এক হাজার ফ্রাঁ।’
‘না, কারণ সেটা নয়।’
মারিয়ার এ জবাবে টেরেন্স খুশি হলো।
সে বলল!
‘আমিও এ প্রশ্নটি নিজেকে করি। মার্কুইস ডি সাদে বলেছেন একজন মানুষ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে সেসব থেকে যা তাকে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেয় : এভাবেই আমরা শিখি। কারণ এতে আমাদের সমস্ত সাহসের প্রয়োজন হয়। একজন বস যখন তার কর্মচারীকে অপমান করে কিংবা স্বামী নির্যাতন করে তার স্ত্রীকে, তারা আসলে কাপুরুষের মত জীবনের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, এরা কখনোই নিজেদের আত্মার গভীরে তাকাবার সাহস পায় না, তারা যৌনতা, যন্ত্রণা, প্রেম ইত্যাদি বোঝার চেষ্টাও করে না।
‘যারা এসব জানে তারা জীবনকে চিনতে পারে। জীবন হলো সময় পার করে দেয়া, একই কাজের পুনরাবৃত্তি, বৃদ্ধ হওয়া এবং আমরা কী করছি তা না জেনেই মৃত্যু বরণ।
.
ঠাণ্ডার মধ্যে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল মারিয়া। শীতের মধ্যে হাঁটাহাঁটির সেই উদগ্র বাসনা আবার। যুবক ঠিক কথা বলেনি। ঈশ্বরকে পেতে হলে নিজের মন্দ সত্তা জানার কোনও প্রয়োজন নেই। বার থেকে একদল ছাত্ৰ হৈ হৈ করে বেরিয়ে এল। তাদেরকে পাশ কাটায় মারিয়া। এদেরকে বেশ সুখী মনে হচ্ছে, খানিকটা মাতাল। প্রত্যেকেই সুদর্শন, স্বাস্থ্য যেন ফেটে পড়ছে গা থেকে। শীঘ্রি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়ে যাবে এদের, লোকের ভাষায় ‘সত্যিকারের জীবন’ শুরু করবে তারা। চাকরি করবে, বিয়ে করবে, সন্তানের বাবা হবে, টিভি দেখবে, নানান তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে, বুড়ো হবে, অনেক কিছু হারানোর বেদনা থাকবে, হতাশা, অসুস্থতা, অন্যের ওপরে নির্ভরশীলতা, তারপর একদিন মরে যাবে টুপ করে।
টেরেন্সের সঙ্গে সাক্ষাতের রাতে লেখা মারিয়ার ডায়েরি থেকে :
সে মার্কুইস ডি সাদে’র কথা বলেছে যার কথা আমি জানি না কিছুই, ‘স্যাডিজম’ শব্দের অর্থ ছাড়া। এ কথা সত্যি আমরা পরস্পরকে তখনই জানতে পারি যখন নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারি। তবে এটাও ভুল একটা কথা। আমাদের সব কথা জানার প্রয়োজনটাই বা কীসের? মানুষকে তো শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, তাকে মাঠে যেতে হবে জমি চাষের জন্য, সে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করবে, শস্য ফলাবে, রুটি বানাবে।
আমার ভেতরে দু’টি নারীর অস্তিত্ব রয়েছে :
একজন সবরকমের আনন্দ পেতে চায়, চায় প্যাশন এবং অ্যাডভেঞ্চার। অপরজন রুটিনের ক্রীতদাস হয়ে পারিবারিক জীবন কামনা করে, চায় পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু ঘটুক। আমি একজন গৃহবধূ এবং পতিতা, দু’জনেরই বাস একটি শরীরের মধ্যে এবং দু’জন প্রতিনিয়ত পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। দুই নারীর সাক্ষাৎ হবে প্রচণ্ড ঝুঁকি। আমরা যখন সাক্ষাৎ করি আমরা হয়ে উঠি দুটি স্বর্গীয় শক্তি, দুটি ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যেন সংঘর্ষ ঘটে। সতর্কতার সঙ্গে যদি এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে একটি পৃথিবী অপরটিকে ধ্বংস করে দেবে।
একুশ
র্যালফ হার্টসের বাসায় এসেছে মারিয়া। বসেছে লিভিংরুমে। ফায়ার প্লেসে জ্বলছে আগুন, সামনে মদের বোতল নিয়ে দু’জনে বসেছে মেঝেতে।
র্যালফের দিকে তাকাল মারিয়া। এই লোকটির কাছে নিজেকে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। র্যালফকে এখন অনেকটাই সহজ লাগছে। হাসছে সে। গল্প বলছে মিউনিখের। সম্প্রতি এ শহর থেকে ঘুরে এসেছে র্যালফ। ওখানকার নামী একটি জাদুঘরের পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বয়ান করছে।
‘লোকটা আমার কাছে জানতে চাইল ‘ফেসেস অব জেনেভা’র ছবি রেডি হয়েছে কিনা। বললাম যাদের ছবি আঁকতে চাই তাদের একজনের সঙ্গে মাত্র পরিচয় হয়েছে। সে এক মহিলা, আলোয় ভরা এক নারী। তবে নিজের কথা বলতে চাই না আমি। তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই আমি। তোমাকে প্রবলভাবে কামনা করছি আমি।’
কামনা। কামনা? এ বিষয়টি সম্পর্কে মারিয়া বেশ ভালো জানে।
‘ঠিক আছে। তাহলে কামনা করো আমায়। আমরা তো এ মুহূর্তে তা-ই করছি। আমার কাছ থেকে দু’হাত দূরেও তুমি নেই, তুমি নাইটক্লাবে গিয়েছ, আমার সেবা কেনার জন্য টাকা দিয়েছ, এবং তুমি জান আমাকে স্পর্শ করার অধিকার তোমার আছে। কিন্তু তুমি সাহস পাচ্ছ না। আমার দিকে তাকাও। আমার দিকে তাকিয়ে কল্পনা করো আমার পোশাকের নিচে কী আছে।’
কাজে যাবার সময় মারিয়া সবসময় কালো পোশাক পরে। তার মাথায় ঢোকে না কোপাকাবানার মেয়েগুলো নিজেদেরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কেন ভয়ঙ্কর রঙের লো কাট ড্রেস পরে। মারিয়ার মনে হয় পুরুষরা বরং সেইসব মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি যাদেরকে সে সাধারণ পোশাকে দেখে। যে রকম পোশাকে মেয়েরা অফিসে যায়, ট্রেনে চড়ে কিংবা বাড়িতে থাকে।
র্যালফ তাকাল মারিয়ার দিকে। মারিয়া কল্পনায় দেখল র্যালফ তার গা থেকে একেএকে পোশাক খুলে ফেলছে। ভাবতে ভালোই লাগছে।
‘ধরো,’ বলে চলল মারিয়া, ‘আমরা একটা ট্রেন স্টেশনে এসেছি। আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমার পাশে, অপেক্ষা করছি ট্রেনের জন্য। কিন্তু তুমি আমাকে চেনো না। আমার সঙ্গে চোখাচুখি হলো হঠাৎ করেই। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম না। তুমি জান না আমি তোমাকে কী বলতে চাইছি, যদিও তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, অন্য মানুষের মাঝে ‘আলো’ দেখতে পাও। তবে আলোটা কতটা জ্বলছে তা দেখার মত যথেষ্ট সংবেদনশীল তুমি নও।’
মারিয়ার মনে পড়ছে সেই ইংরেজ নির্বাহীর কথা। তার কথা দ্রুত ভুলে যেতে চাইল সে। কিন্তু পারছে না। লোকটা যেন তার কল্পনাশক্তি উস্কে দিচ্ছে।
‘আমার দৃষ্টি তোমার চোখে, আমি হয়তো মনে মনে ভাবছি :
‘একে কি কোথাও আগে দেখেছি?’ অথবা আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি। অথবা ভয় পেতে পারি তুমি হয়তো মারমুখি আচরণ করবে ভেবে। হয়তো তুমি আমাকে চেন, হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে সত্যি তুমি আমাকে চেন। আমি হয়তো তোমার জন্য একরাতের প্রমোদ সঙ্গিনী হবো, আমার একঘেয়ে জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য ভিন্নরকম কিছু একটা করব।’ বিরতি দিল মারিয়া। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তবে যা ঘটবে তা হলো আমি তোমার ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিচ্ছি না। এবং তুমি বুঝতে পারছ না কী করবে। তুমি কি সেধে এগিয়ে আসবে? তুমি কি প্রত্যাখিত হবে? আমি কি গার্ড ডাকব? নাকি তোমাকে এক কাপ কফি পানের আমন্ত্রণ জানাব?’
‘আমি মিউনিখের কথা বলি,’ বলল র্যালফ হার্ট। তার কণ্ঠ অন্য রকম শোনাল যেন সত্যি প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়েছে ওদের। ‘আমি কয়েকটি ছবির কথা ভাবছি। বিখ্যাত কিছু মানুষের নগ্ন ছবি এঁকেছি আমি। আমাকে জাদুঘরের পরিচালক জিজ্ঞেস করেছিল আমি কীসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করি। জবাব দিয়েছি সেই সব মহিলার ওপরে আমি কাজ করি যারা প্রেম, করে অর্থ উপার্জন করে। পরিচালক বলে : আমরা এদেরকে ‘পতিতা’ বলি। আমি বললাম : বেশ। ওরা তবে পতিতাই। তবে আমি তাদের ওপর পড়াশোনা করব, তাদের নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু সৃষ্টি করব, যারা আপনাদের জাদুঘর ঘুরতে আসে সেইসব পরিবারের জন্য।
‘পরিচালক বলে : সেক্স এখন কোনও নিষিদ্ধ বস্তু নয়। সেক্স নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যে বিষয়টির ওপর নতুন কিছু সৃষ্টি করা সত্যি কঠিন। আমি জিজ্ঞেস করি : আপনি জানেন যৌন আকাঙ্ক্ষা কোত্থেকে আসে? আমাদের ইন্সটিক্ট থেকে, জবাব দেয় পরিচালক। হ্যাঁ, বলি আমি, ইন্সটিক্ট থেকে, সবাই তা জানে। সবাই যদি বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা শুরু করে তাহলে সুন্দর একটি প্রদর্শনী করবেন কীভাবে আপনি? আমি বলতে চাই লোকে কীভাবে এই আকর্ষণের কথা ব্যাখ্যা করে। ধরুন, একজন দার্শনিক বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারবে। পরিচালক আমাকে একটা উদাহরণ দিতে বলে। আমি বলি, ধরুন আমি ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরছি, এক মহিলা তাকাল আমার দিকে। আমি তখন তার কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব। আমি বলব যেহেতু আমরা কেউ কারও চেনা নই, আমাদের যা খুশি করার স্বাধীনতা রয়েছে, আমরা আমাদের ফ্যান্টাসির জগতে বাস করি, আমরা বাড়ি ফিরে যাব যে যার স্ত্রী এবং স্বামীর কাছে এবং আর কখনও আমাদের সাক্ষাৎ হবে না। তারপর, ট্রেন স্টেশনে দেখতে পাই।’
‘তোমার গল্পটা এত ইন্টারেস্টিং যে এটা কামনা-বাসনাকে হত্যা করে ফেলবে।’
র্যালফ হেসে উঠে সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। এক বোতল ওয়াইন সাবাড় করে ফেলেছে ওরা। র্যালফ কিচেনে গেল আরেকটি বোতল নিয়ে আসতে, অগ্নিকুণ্ডের সামনে বসে রইল মারিয়া, জানে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। এই পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ও, ভুলে যাচ্ছে ইংরেজ নির্বাহীর কথা, আত্মসমর্পণের উপলব্ধি ফিরে পাচ্ছে।
দুটো গ্লাস ভরে দিল র্যালফ। মারিয়া বলল :
‘স্রেফ কৌতূহল থেকে জানতে চাইছি, জাদুঘরের পরিচালকের গল্পটা তুমি শেষ করবে কীভাবে?
‘আমি প্লেটো থেকে একটা উদ্ধৃতি দিই। তাঁর মতে, সৃষ্টির শুরুতে, নারী-
‘পুরুষ এখনকার মত ছিল না; তারা দু’জনে মিলে একজন ছিল। বেঁটে খাটো, শরীর, এবং ঘাড় ছিল, তবে দুটো মুখ ছিল। দু’দিকে তাকাতে পারত। যেন দুটো প্রাণীকে আঠা দিয়ে পিঠোপিঠি জোড়া লাগানো হয়েছে, দু’জোড়া যৌনাঙ্গ, চারটে পা, চারট হাত।
‘গ্রীক দেবতারা তখন ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা ভাবলেন এই প্রাণীটি চারটে হাত দিয়ে বেশি বেশি কাজ করতে পারবে। দুটো মুখ দিয়ে সবসময় সতর্ক থাকবে, চারটে পা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিংবা হাঁটতে পারবে, ক্লান্ত হবে না। এবং সবচে’ বিপজ্জনক হলো প্রাণীটার দুটি আলাদা যৌনাঙ্গ থাকার কারণে সন্তান উৎপাদনও করতে পারবে।
‘দেবরাজ জিউস বললেন; ‘এই মরণশীল প্রাণীদের শক্তি হ্রাস করার একটি বুদ্ধি এঁটেছি আমি।’
‘তিনি বজ্রের আঘাত হেনে প্রাণীটিকে দু’খণ্ড করে ফেললেন। এভাবে নারী ও পুরুষের সৃষ্টি হলো। তারা পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা দারুণভাবে বৃদ্ধি করে তুলল এবং একই সঙ্গে তারা বিচ্ছিন্ন এবং দুর্বল হয়ে পড়ল। কারণ এখন তাদেরকে হারানো অর্ধাংশ খুঁজে বের করে তাকে আলিঙ্গন করতে হবে। আর দু’টি শরীরের পারস্পরিক আলিঙ্গনই হলো সেক্স।’
‘এটা কি সত্যি ঘটনা?’
‘গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর মতে, হ্যাঁ।’
মারিয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে র্যালফের দিকে। গতরাতের অভিজ্ঞতার কথা তার স্মৃতি থেকে পুরোপুরি দূর হয়ে গেল। সে দেখল তার সামনে যে মানুষটি বসে আছে তার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে ‘আলো’, যে আলো সে মারিয়ার মধ্যে দেখেছিল। তার চোখ এখন ঝিকঝিক করছে কামনা বা লালসায় নয়, আনন্দে।
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
র্যালফ বলল মারিয়ার যা খুশি প্রশ্ন করতে পারে।
‘তোমার কাছে কী কখনও মনে হয়নি পতিতারাও ভালোবাসতে পারে?’ ‘হ্যাঁ। পারে। এটা আমার প্রথম দিনই মনে হয়েছে যখন আমি ক্যাফেতে বসে ছিলাম এবং তোমার ভেতরে দেখছিলাম আলো।’
এবার আর পেছনে ফিরে তাকাবার অবকাশ নেই। মারিয়ার এখন তীব্রভাবে কামনা করছে র্যালফকে, তাকে ও চুমু খাবে, আলিঙ্গন করবে, অনুনয় করবে র্যালফ যেন ওকে ছেড়ে চলে না যায়।
সে কাঁধ থেকে ড্রেসের স্ট্র্যাপ খসে পড়তে দিল। তার গোলাপি স্তনের খানিকটা উদ্ভাসিত হলো।
‘তুমি যা দেখছ তা কামনা নয়, কামনা হলো তুমি যা কল্পনা করছ।’
.
র্যালফ হার্ট তাকিয়ে আছে ঘন কৃষ্ণ কেশী নারীটির দিকে, তার পরনে কালো পোশাক, সে তার লিভিংরুমের মেঝেতে বসে আছে, প্রচণ্ড কামনায় ব্যাকুল, জ্বলছে ফায়ার প্লেসের আগুনের মতো। হ্যাঁ, র্যালফ কল্পনায় দেখতে চায় ওই পোশাকের নিচে কী লুকিয়ে আছে; সে অনুমান করতে পারে মারিয়ার বুকের মাপ, সে জানে মারিয়ার ব্রা পরার কোনই প্রয়োজন নেই। কারণ ব্রা শাসন মানতে চাইছে না উদ্ধত বক্ষ জোড়ার। তবে কাজের প্রয়োজনেই হয়তো বক্ষ বন্ধনী পরতে হয় ওকে। মারিয়ার বুক খুব বড় নয়, আবার ছোটও নয়। ডাসা ডাসা।
র্যালফ ভাবছে এই নারী এখানে কী করছে? সে-ই বা কেন এই বিপজ্জনক সম্পর্কে জড়াতে গেল যখন নারী সঙ্গ পাওয়া তার জন্য কোনও সমস্যা নয়। সে ধনী, যুবক, বিখ্যাত, সুদর্শন। সে নিজের কাজ ভালোবাসে; সে যে মেয়েদেরকে ভালোবাসত তাদেরকে বিয়ে করেছে। সে ভালোবাসা পেয়েছে। সে এমন একজন যে চিৎকার করে ঘোষণা দিতে পারে ‘আমি সুখী।’
.
কিন্তু সুখী নয় র্যালফ। সে সব পেয়েও তার মধ্যে কাজ করে হতাশা। সে সারাজীবন কিছু একটা প্রমাণ করতে চেয়েছে কিন্তু জানে না কী এবং কার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে।
র্যালফ তাকিয়ে আছে তার সামনে বসা অপূর্ব সুন্দরী নারীটির দিকে। কালো পোশাকে দারুণ লাগছে তাকে। এর সঙ্গে ক্যাফেতে হঠাৎ করেই পরিচয় তার। যদিও একে আগে নাইটক্লাবে দেখেছে সে। ওকে তখনই আলাদা কেউ মনে হয়েছিল। এই নারী তাকে কামনা করতে বলেছে। র্যালফ তাকে এতটা তীব্র ভাবে কামনা করছে যা নারীটির কল্পনাতেও নেই। কিন্তু তার বক্ষ কিংবা শরীরের জন্য সে লালায়িত নয়, সে ওর সঙ্গ কামনা করছে। ইচ্ছা করছে ওকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে থাকে, তাকিয়ে থাকে অগ্নিকুণ্ডের দিকে, মাঝে মাঝে সিগারেটের ধোঁয়া গিলবে; ব্যস, ওটুকুই যথেষ্ট।
কিন্তু র্যালফের মনে হচ্ছে ওকে স্পর্শ করা মাত্র সবকিছু হারিয়ে ফেলবে। সে নিশ্চিত নয় মারিয়া জানে কিনা তার পাশে বসে থাকতে র্যালফের কত ভালো লাগছে। ওকে কি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে র্যালফ? হ্যাঁ, সে টাকা দিয়ে যাবে যতদিন না ওকে জয় করা যায়, ওকে নিয়ে লেকের ধারে বসবে, বলবে ভালোবাসার কথা, ওর কাছ থেকেও শুনবে একই কথা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
.
র্যালফ হার্ট নিজেকে আর যন্ত্রণা দিতে চাইল না। সে খেলাটায় মনোনিবেশ করল যে খেলা ওরা শুরু করেছে একসঙ্গে।
মারিয়া শোল্ডার স্ট্র্যাপ লাগানো একটি কালো পোশাক পরেছে। এক কাঁধ থেকে খসে পড়েছে ফিতে, উন্মোচিত হয়ে আছে বক্ষ। ওর ত্বক দেখতে পাচ্ছে র্যালফ। গাঢ় রঙের চামড়া। ওকে পেতে ইচ্ছে করল র্যালফের সাংঘাতিকভাবে কামনা করছে।
র্যালফের চাউনির পরিবর্তন লক্ষ করল মারিয়া। বুঝতে পারছে ওকে সাংঘাতিকভাবে চাইছে র্যালফ। সেই একই অটোমেটিক ফর্মূলা- আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করতে চাই, আমি বিয়ে করতে চাই, আমি স্খলন চাই, আমি তোমার পেটে আমার সন্তান চাই, আমি প্রতিশ্রুতি চাই।
কামনা আসলে সেনসেশন মুক্ত একটি জিনিস। কামনা সব কিছুর উৎস- এর জন্য মারিয়া দেশ ছেড়েছে, নতুন একটি বিশ্ব আবিষ্কার করছে, শিখেছে ফরাসি ভাষা, তারা কুসংস্কার দূর করেছে, খামার করার স্বপ্ন দেখছে, নিজেকে সে নারী বলে ভাবছে কারণ একজন পুরুষ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
মারিয়া অপর কাঁধ থেকেও পোশাকের বাকি ফিতেটি পিছলে পড়তে দিল। পুরো পোশাকটি খসে গেল গা থেকে। ব্রা মুক্ত করল বক্ষ। তার শরীরের উর্ধ্বাংশ এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত। ভাবছে র্যালফ এখন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কিনা, তাকে স্পর্শ করবে, প্রেমময় কথা বলবে। নাকি কামনার কথা ভেবেই সে যৌন আনন্দ পেতে পারে?
র্যালফ প্রথমে নড়ল না। তার চোখে লাজুক একটা ভাব ফুটে উঠতে দেখল মারিয়া। তবে অল্পক্ষণের জন্য। র্যালফ তাকিয়ে আছে মারিয়ার দিকে। কল্পনায় দেখল আদর করছে মারিয়াকে। আদর করার মাধ্যম নিজের জিভ। ওরা প্রেম করছে, ঘামে ভিজে জবজবে গা, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে শক্ত বন্ধনে, গোঙাচ্ছে, শীৎকার করছে।
তবে বাস্তব পৃথিবীতে এসব ঘটল না কিছুই। ওরা কিছু বলছে না। নড়ছে ও না কেউ। এটা আরও বেশি উত্তেজিত করে তুলল মারিয়াকে। কারণ ও-ও যা খুশি ভাবতে পারছে। ভাবছে র্যালফকে সে বলছে ওকে স্পর্শ করার জন্য।
দু’পা মেলে ধরেছে মারিয়া, র্যালফের সামনে হস্তমৈথুন করছে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে দারুণ রোমান্টিক সব বুলি আর অশ্লীল যত কথা, যেন ওরা দু’জনে এক এবং একত্রিত; বেশ কয়েকবার রেতঃপাত হলো মারিয়ার। তার শীৎকার আর গোঙানির চোটে ঘুম ভেঙে গেল প্রতিবেশীদের, জেগে গেল গোটা পৃথিবী। এই তো তার পুরুষ যে তাকে সুখ এবং আনন্দ দিচ্ছে, এর সঙ্গে সে আগের মানুষটি হতে পারে, তাকে বলতে পারে তার সঙ্গে বাকি রাতটুকু কাটাতে পারলে সে কতটা খুশি হবে। কত খুশি হবে যদি সপ্তাহ’র বাকি ক’টা দিন এবং সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
কপাল দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরতে শুরু করল মারিয়ার। আগুনের উত্তাপে ঘাম হয়েছে শরীরে
একজন মনে মনে বলল অপরজনকে। পুরুষ এবং নারী উভয়েই তাদের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে, কল্পনা করে তারা বিধ্বস্ত। এখন তাদের বিরতির প্রয়োজন, যদি আরেকটু এগোতে যায়, বাস্তবতার কষাঘাতে এই জাদুটা অদৃশ্য হয়ে যাবে।
খুব ধীরে ধীরে, যেহেতু শুরুর চেয়ে শেষটা সবসময় হয় কঠিন, ব্রা পরল মারিয়া, ঢাকল বুক। পৃথিবী ফিরে এল তার স্বাভাবিক জায়গায়, কোমরের কাছে খসে থাকা পোশাক গায়ে চড়াল মারিয়া, হাসল। খুব আস্তে স্পর্শ করল র্যালফের মুখ। র্যালফ মারিয়ার হাত চেপে ধরে রাখল গালে। জানে না কতক্ষণ ধরে রাখবে বা কতটা শক্তভাবে।
মারিয়া বলতে চাইল ওকে সে ভালোবাসে। কিন্তু বললে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। কথাটা র্যালফকে ভীত করে তুলতে পারে, তারচে’ও খারাপ ব্যাপার ও-ও বলতে পারে সে-ও মারিয়াকে ভালোবাসে। মারিয়া তা চায় না। ওর ভালোবাসার স্বাধীনতা নির্ভর করছে কিছু জিজ্ঞেস না করা বা কিছু প্রত্যাশা না করার ওপরে।
‘ট্রেন এসে গেছে,’ বলল মারিয়া। ‘আমাদের এখন ভিন্ন রাস্তায় যেতে হবে। আমি হয়তো তোমার এই ভ্রমণে সঙ্গী হতে পারব…কোথায়?
‘জেনেভায়,’ জবাব দিল র্যালফ।
মারিয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘একটা কথা বলি?’
‘কী?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি।’
‘দুঃখিত, আমি জানি না আমি কী বলছি।’
‘আমিও না।’
উঠে পড়ল মারিয়া। চুমু খেল র্যালফকে। এবারে নিজেই দরজা খুলল। যদিও ব্রাজিলীয় কুসংস্কার অনুযায়ী বাড়ির মালিক তার অতিথির জন্য খুলে দেবে দরজা।
.
পরদিন সকালে লেখা মারিয়ার ডায়েরি থেকে :
কাল রাতে র্যালফ হার্ট যখন আমার দিকে তাকাল, সে একটা দরজা খুলে দিয়েছে চুপিচুপি, যেন সে একটা চোর; কিন্তু ও যখন চলে গেল আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল না কিছুই, রেখে গেল গোলাপের গন্ধ— ও চোর নয়, ও বিয়ের বর, আমাকে দেখতে এসেছে।
প্রতিটি মানুষই তার নিজের কামনা-বাসনা-লালসা নিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করে। এ আমাদের ব্যক্তিগত আবেগের একটা অংশ, এবং যদিও এটা একটা আবেগ, এটা মানুষকে দূরে ঠেলে দিতে পারে এবং কাছেও টেনে আনতে পারে এ আবেগ এত তীব্র যে আমার সবকিছুকে প্রভাবিত করে।
প্রতিদিন যে সত্য আমার সামনে আসে তাকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। আমি বাস্তববাদী, দক্ষ এবং পেশাদার হবার চেষ্টা করি। তবে আমি কামনাকে আমার সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে চাই। কোনও বিধিনিষেধ থেকে নয়, আমার একাকীত্ব কমাতেও নয়, আমি চাই কারণ কামনা ভালো জিনিস। হ্যাঁ, খুব ভালো জিনিস।
বাইশ
কোপাকাবানায় রেগুলার ভিত্তিতে গড়ে আটত্রিশটি মেয়ে কাজ করে, এদের মধ্যে একমাত্র ফিলিপিনো নিয়াকে মারিয়া তার বন্ধু মনে করে। মেয়েরা ওখানে গড়ে বড়জোর ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত থাকে। এর মধ্যে হয় তারা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে যায়, কারও রক্ষিতা হয়ে থাকে, অথবা আর ক্লায়েন্ট টানতে পারে না। সেক্ষেত্রে মিলান তাদেরকে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিতে বলে।
এ জন্য মেয়েরা প্রত্যেকের ক্লায়েন্টকে সম্মানের চোখে দেখে এবং কোনও ক্লায়েন্ট কোনও মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে বারবার তার কাছে আসতে থাকলে ওই লোককে অন্যরা প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে না। অসৎ হলে তার কপালে খারাবী আছে। সপ্তাখানেক আগে এক কলম্বিয়ান নারী পকেট থেকে ধারাল একটি ব্লেড বের করে যুগোশ্লাভ একটি মেয়ের গ্লাসে ফেলে দিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল একজন ব্যাংক ম্যানেজার তার নিয়মিত খদ্দের। ওই লোককে যদি যুগোশ্লাভ মেয়েটি প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে তাহলে সে ব্লেড দিয়ে মেয়েটির মুখ চিরে দেবে। যুগোশ্লাভ মেয়েটি বলেছিল ব্যাংক ম্যানেজার যদি স্বইচ্ছায় তার কাছে আসে তাহলে সে না বলতে পারবে না।
সেই রাতে ব্যাংক ম্যানেজার ক্লাবে এলে কলাম্বিয়ান নারী তাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু লোকটি তার আহ্বান উপেক্ষা করে চলে যায় যুগোশ্লাভ মেয়েটির টেবিলে। তারা পান করে এবং নাচতে শুরু করে। যুগোশ্লাভ মেয়েটি নাচতে নাচতে চোখ টেপে কলাম্বিয়ান মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে। যেন বলতে চাইছিল : দেখলে? ও আমাকে পছন্দ করে!’
তবে ওই চোখ মারার অর্থ নানারকম হতে পারে : সে আমাকে পছন্দ করেছে কারণ আমি তোমার চেয়ে সুন্দরী, কারণ গত সপ্তায় তার সঙ্গে আমি বিছানায় গেছি এবং সে খুব মজা পেয়েছে আমার বয়স কম বলে। কলাম্বিয়ান মেয়েটি কিছুই বলে না। ঘণ্টা দুই পরে যুগোশ্লাভ মেয়েটি যখন ফিরে আসে, তারপাশে বসে কলাম্বিয়ান। সে পকেট থেকে ব্লেড বের করে যুগোশ্লাভ মেয়েটির কানের নিচে একটা পোচ দেয়। খুব গভীর ছিল না ক্ষত। তবে ওই ছোট্ট দাগটির কথা সারাজীবন মনে থাকবে মেয়েটির। এরপরে দু’জনে শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি, রক্তাক্ত হয়ে ওঠে দুই নারী। খদ্দেররা ছুটে পালায় ভয়ে।
পুলিশ এসে কী ঘটেছে জানতে চাইলে যুগোশ্লাভ মেয়েটি বলে সে শেলফ থেকে (কোপাকাবানায় কোনও শেলফ নেই। গ্লাস নামাতে গিয়ে গালে আঘাত পেয়েছে। গ্লাস ভেঙে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল গালে। এ হলো নীরবতার আইন। ইতালীয় পতিতারা যাকে বলে ওমের্তা)।
রু ডি বার্নেতে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই মিটিয়ে ফেলতে হয়, সেখানে আইনের অনুপ্রবেশ চলবে না।
ওমের্তা’র কথা পুলিশ জানে। জানত মেয়েটি মিথ্যা কথা বলছে। তবে তারা এ নিয়ে আর চাপাচাপি করেনি। কারণ কাউকে গ্রেফতার করার পরে তার বিচার করা, তাকে জেলে পোরা, প্রচুর অর্থকড়ি খরচের ব্যাপার। মিলান পুলিশদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলে স্রেফ ভুল বোঝাবুঝির কারণে এমনটি ঘটেছে। অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও নাইটক্লাব মালিকও ঝামেলার সৃষ্টি করে থাকতে পারে।
পুলিশ চলে যাবার পরপর সে মেয়ে দুটিকে বলে তারা যেন আর কোনওদিন তার ক্লাবের ছায়াও না মারায়। শত হলেও, কোপাকাবানা ফ্যামিলি প্লেস (এ কথাটি হজম করতে কষ্ট হয় মারিয়ার), এর সুনাম সে নষ্ট হতে দেবে না। এখানে কোনও মারামারি চলবে না, কারণ এখানকার প্রথম নিয়মই হলো একজন অপরজনের ক্লায়েন্টকে সম্মান করবে।
ক্লাবে কাকে ঢুকতে দেয়া উচিত আর উচিত নয় সে ব্যাপারে মিলানের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। মানুষ চিনতে তার ভুল হয় না। মেয়েরা দেখেছে ভদ্র কাপড় চোপড় পরা মানুষজনকেও মিলান এই বলে ফিরিয়ে দিয়েছে যে ক্লাব আজ রাতে খালি নেই (যদিও খালি ছিল) এবং পরের রাতেও খালি থাকবে না (এর মানে তোমরা এদিকে আর এসো না।) আবার তারা এও দেখছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখের, সস্তা পোশাক পরা মানুষজনকে মিলান শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে স্বাগত জানাচ্ছে। মেয়েরা বুঝতে পারে না মিলানের মানুষ পছন্দ করার ধরণ বা ক্রাইটিরিয়া। তবে মিলান চেহারা দেখে মানুষ বাছাই করে না। সে বুঝতে পারে কে ভালো কে মন্দ। এবং তার ধারণা সবসময় সঠিক বলে প্রমাণ হয়েছে।
এখানে আসা ক্লায়েন্টদের বেশিরভাগ বিবাহিত, তাদের অনেকেই বড় বড় কোম্পানিতে শীর্ষস্থানীয় পদ দখল করে আছে। কোপাকাবানায় কর্মরত কিছু মহিলা বিবাহিত, তাদের সন্তানও আছে। তারা তাদের সন্তানদের স্কুলের প্যারেন্টস ইভনিং-এ যোগ দেয়, জানে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ হবার ঝুঁকি নেই। বাবাদের কেউ যদি কোপাকাবানায় আসেও, তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যায়; এখানে এভাবেই কাজ করে ওমের্তা।
নেতৃত্ব কাজ করে এখানকার মেয়েদের মধ্যে, বন্ধুত্ব নয়। কেউই নিজের সম্পর্কে মুখ খুলতে চায় না। মারিয়ার সঙ্গে তার কলিগদের কথা হয় অল্পই। তবে তাদের মধ্যে কোনও অপরাধবোধ কিংবা দুঃখবোধ লক্ষ করেনি সে। বরং তারা যেন গর্বিত এভাবে লড়াই করে বেঁচে আছে বলে। তারা স্বাধীন এবং আত্মবিশ্বাসী।
এখানে নতুন যারা আসে তাদেরকে বলা হয় কর্মঘণ্টার বাইরে যেন কারও আমন্ত্রণ গ্রহণ করা না হয়, খদ্দেরের সব কথা তারা শুনলে তবে নিজেরা কোনও মতামত চাপিয়ে দেবে না, চূড়ান্ত মুহূর্তে শীৎকার এবং গোঙানি দিতে হবে (মারিয়া শুনেছে সবাই এটা করে তবে প্রথম দিনে তাকে কেউ বলে দেয়নি কী করতে হবে। কারণ এটা তাদের ব্যবসার কৌশল), রাস্তায় পুলিশ দেখলে হ্যালো বলতে হবে, ওয়ার্ক পারমিটের তারিখ যেন অতিক্রান্ত হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং সে যা করছে তার নৈতিকতা খুঁজতে যাওয়া চলবে না; তারা যা তা-ই মেনে নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মারিয়ার হাতে একখানা বই থাকে। শীঘ্রি সে ‘আঁতেল’ বলে পরিচিতি পেয়ে যায় দলের মধ্যে। ওরা প্রথমে জানতে চেয়েছিল মারিয়া প্রেমের গল্প পড়ছে কিনা, কিন্তু যখন দেখে মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং খামার গঠনের মত রসকষহীন জিনিস, তারা মারিয়ার ব্যাপারে হারিয়ে ফেলে আগ্রহ।
।
মারিয়ার যেহেতু নিয়মিত খদ্দের জুটে যায় এবং যেহেতু সে প্রতিরাতে যায় কোপাকাবানায়, এমনকী ক্লাবে ব্যস্ততা না থাকলেও, মারিয়া মিলানের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়ে ওঠে, একই সঙ্গে সহকর্মীরা তাকে ঈর্ষা করতে থাকে।
ওরা বলাবলি করে মারিয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী, দুবির্নীত এবং টাকা উপার্জন ছাড়া তার অন্য কোনও চিন্তা নেই— শেষ কথাটা সত্যি। তবে মারিয়ার ইচ্ছে করে ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে তারাও কী একই কারণে এখানে আসেনি?
তবে এসব মন্তব্যে খুনোখুনি হবার সম্ভাবনা নেই- সফল একজন ব্যক্তির জন্য এসব মন্তব্য জীবনের অংশ মাত্র। মারিয়ার কাছে এসব গা সওয়া হয়ে গেছে।
মারিয়ার সকাল-সন্ধ্যা জুড়ে মনের মাঝে একটি নামই শুধু গুঞ্জন তোলে- র্যালফ হার্ট। নিজেকে তার সুখী মনে হয় অদৃশ্য এক ভালোবাসার ছোঁয়ায়। যদিও ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য তার খানিক আফসোস ও হচ্ছে। কারণ সবকিছু হাবাবার একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে এতে। কিন্তু বিনিময়ে যদি কিছু পাবার আশা না করে মারিয়া তাহলে হারাবেই বা কেন? তার মনে পড়ে মিলান যখন বলেছিল র্যালফ বিশেষ ক্লায়েন্ট, তার বুক কেমন ধুকপুক করছিল। এর মানে কী?
কোপাকাবানায় বসে লেখা মারিয়ার ডায়েরি :
এখানে আসা নানান কিসিমের মানুষের সঙ্গে মিলিত হবার পরে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। তা হলো সেক্স আসলে মাদকের মতো : এর মাধ্যমে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়, ভুলে থাকা যায় সমস্যা, রিল্যাক্স হওয়া যায়। আর সকল মাদকের মতো সেক্স ও ক্ষতিকর এবং ধ্বংসাত্মক প্রাকটিস।
কেউ যদি সেক্সের চেহারায় মাদক গ্রহণ করতে চায় সেটা তাদের সমস্যা; ফলাফল কী হবে তা নির্ভর করবে তাদের পছন্দের ওপর।
আমার ক্লায়েন্টরা যাই চিন্তা করুক, আমি মনে করি সেক্স সবসময় প্রাকটিস করার জিনিস নয়। আমাদের সবার মধ্যে একটি ঘড়ি আছে এবং প্রেম করতে চাইলে ঘড়ির দুটো কাঁটাই একই সময়, একই ঘণ্টার দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে। তবে এমনটা প্রতিদিন ঘটে না। আপনি যদি কাউকে ভালোবাসেন, তৃপ্তি পাবার জন্য যৌন সঙ্গমের ওপর আপনাকে নির্ভর করতে হবে না। যারা একত্রে বসবাস করে এবং পরস্পরকে ভালোবাসে তাদের ঘড়ির হাত অ্যাডজাস্ট করতে হয় ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে। পৃথিবীতে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ঐকান্তিকভাবে যাপন করেন আপনার জীবন, আপনার অভিজ্ঞতা সবসময় আপনাকে তৃপ্তি দেবে, এজন্য সেক্সের প্রয়োজন হবে না। আপনি যখন সেক্স করেন, এটা হলো এক ধরনের প্রাচুর্যতার অনুভূতি, কারণ গ্লাসের মদ পূর্ণ থাকলে তা গ্লাস উপচে পড়বেই, কারণ এটা অনিবার্য, কারণ আপনি জীবনের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন, কারণ ওই মুহূর্তে, শুধুমাত্র ওই মুহূর্তটিতে আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন হবার সুযোগ দিচ্ছেন।
বি:দ্র: আমি যা লিখেছি তা আবার পড়লাম। সর্বনাশ! আমি দেখছি সত্যি আঁতেল হয়ে যাচ্ছি!
তেইশ
ডায়েরি লেখার কিছুক্ষণ পরের ঘটনা।
আরেকটি রাতে খদ্দেরের মনোরঞ্জনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মারিয়া, খুলে গেল কোপাকাবানার দরজা। ভেতরে ঢুকল টেরেন্স, রেকর্ড কোম্পানির এক্সিকিউটিভ, স্পেশাল ক্লায়েন্টদের একজন
বার-এর পেছনে, মিলানের চেহারা দেখে মনে হলো মিলানের আগমনে খুশি হয়েছে সে। মারিয়া তাকে হতাশ করেনি। ওর মনে পড়ে গেল টেরেন্সের কথাগুলো : যন্ত্রণা, বেদনা এবং প্রচুর সুখ।
‘লন্ডন থেকে উড়ে এসেছি আমি শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্য।’ বলল টেরেন্স, ‘তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছিল।’
হাসল মারিয়া, উৎসাহের ভাব গোপন করে রাখল চেহারায়, নিয়মকানুনের এবারও ধার ধারল না টেরেন্স, মারিয়াকে ড্রিঙ্ক পানের প্রস্তাব দিল না, ধপ বসে পড়ল ওর টেবিলে।
‘শিক্ষক যখন কাউকে কিছু আবিষ্কার করতে সাহায্য করেন, শিক্ষক ও নতুন কিছু শিখতে পারেন।’
‘আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি আমি,’ বলল মারিয়া, মনে পড়ল র্যালফ হার্টের কথা। এসময় র্যালফের কথা মনে পড়ায় বিব্রতবোধ করল।
সে এখন আরেকজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে আছে, যাকে সে সম্মান করবে এবং ক্লায়েন্টকে খুশি করার জন্য যা যা প্রয়োজন সব করবে মারিয়া।
‘যাবে আমার সঙ্গে?’
আবার এক হাজার ফ্রাঁ’র আহ্বান। এক লুকানো বিশ্ব, মারিয়ার বস্ লক্ষ্য করছে ওকে। মারিয়া ইচ্ছে করলেই অগ্রাহ্য করতে পারে যে কাউকে। ব্রাজিলে ফিরে যাবার দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।
‘আপনার কি তাড়া আছে?’ জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
টেরেন্স জবাব দিল ‘না,’ জানতে চাইল মারিয়া কী করবে?
‘আমি আমার পছন্দের ড্রিঙ্কটা পান করব, নাচব।’
এক মুহূর্ত ইতস্তত করল টেরেন্স। তারপর শেষে মারিয়াকে একটি ড্রিঙ্ক কিনে দিল। নাচল ওর সঙ্গে, তারপর ডাকল ট্যাক্সি। নগরীর একই হোটেলে যাওয়ার পথে পুরো টাকা শোধ করে দিল টেরেন্স। ভেতরে ঢুকল ওরা। ইটালিয়ান পটারকে ডাক দিল আগের দিনের মত। তারপর সেই একই স্যুইটে প্রবেশ করল যেখানে থেকে নদী দেখা যায় পরিষ্কার।
.
উঠে পড়ল টেরেন্স, পকেট থেকে বের করল লাইটার। মারিয়া লক্ষ করল ঘরে ডজনখানেক মোম জ্বলছে। টেরেন্স মোমবাতিগুলো জ্বালাতে লাগল।
‘তুমি কী জানতে চাও বলো? আমি কেন এরকম? যদি ভুল না হয় তাহলে বলব সেদিন সন্ধ্যাটা দু’জনে বেশ উপভোগ করেছিলাম। তুমি কি জানতে চাও তুমিও এসব পছন্দ করো কেন?’
‘আমি ব্রাজিলের একটা কুসংস্কার নিয়ে ভাবছিলাম। ওখানকার লোকে বলে একই দেশলাই’র কাঠি দিয়ে তিনটের বেশি জিনিস জ্বালাতে নেই। আপনি এই কুসংস্কারকে পাত্তা দিচ্ছেন না।’
মারিয়ার মন্তব্য অগ্রাহ্য করল টেরেন্স।
‘তুমি আমার মতো। তুমি এখানে হাজার ফ্রাঁ’র লোভে আসনি, এসেছ অপরাধবোধ এবং নির্ভরশীলতার বোধ থেকে, এসেছ কারণ তোমার মধ্যে নানান কমপ্লেক্স কাজ করে এবং তুমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছ। এটা ভালো বা মন্দ কিছুই নয়, এ হলো মানব-প্রকৃতি।’
টেরেন্স রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে একের পর এক টিভি চ্যানেল বদলাতে লাগল। থামল টিভির খবরে এসে। উদ্বাস্তুদের ছবি দেখাচ্ছে। যুদ্ধ এড়াতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে তারা।
‘দেখলে তো? তুমি ওই অনুষ্ঠানগুলো কখনও দেখেছ যেখানে মানুষজন সবার সামনে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলে? তুমি কখনও সংবাদপত্র অফিসে গিয়ে হেডলাইন দেখেছ? বিশ্ব কষ্ট এবং যন্ত্রণা উপভোগ করে। আমরা যেভাবে এসব দেখি তার মধ্যে লুকিয়ে আছে নিষ্ঠুরতা বা স্যাডিজম, আর উপসংহারে আছে ম্যাসোকিজম। তবু আমরা মানুষের ট্রাজেডি দেখি এবং কখনও কখনও তাদের দুঃখে সমব্যথী হই।’
টেরেন্স দুটি গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালল। বন্ধ করে দিল টেলিভিশন এবং জ্বালাতে লাগল মোমবাতি
‘যা বললাম আমি। এ হলো মানুষের অবস্থা। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার পর থেকে আমরা হয় কষ্ট সয়ে আসছি অথবা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছি কিংবা অন্যের কষ্ট দেখছি। এ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
বাইরে থেকে ভেসে এল বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুতের ঝিলিক সহ; প্রচণ্ড ঝড় আসছে।
‘কিন্তু আমি এটা পারব না,’ বলল মারিয়া। ‘আপনি আমার প্রভু আর আমি আপনার ক্রীতদাসী, এমন ভান আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। কষ্ট দেখার জন্য আমাদের ‘নাটক’ করার দরকার নেই।’
মোমবাতি জ্বালানো শেষ। একটা মোম নিয়ে টেবিলের মাঝখানে রাখল টেরেন্স। তারপর আরও শ্যাম্পেনে ভরে দিল গ্লাস। পরিবেশন করল ক্যাভিয়ার। মারিয়া দ্রুত মদ গিলছে, ভাবছে ব্যাগে রাখা হাজার ফ্রাঁ’র কথা, ভাবছে এই অচেনা মানুষটার কথা যে একই সঙ্গে তাকে মোহিত এবং ভীত করে তুলেছে এবং ভাবছে কীভাবে নিজের ভয় নিয়ন্ত্রণ করবে। মারিয়ার মনে হচ্ছে এ লোকের সঙ্গে রাতগুলো কখনও একরকম হবে না।
‘বসো।’
কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠ ভেসে এল। আদেশ পালন করল মারিয়া, তার শরীরে উত্তাপের একটা ঢেউ উঠল।
‘এটা নাটক। আমি এ নাটকে অংশ নেব।’
মারিয়া আরও শ্যাম্পেন চাইল। টেরেন্স ভদকা নিয়ে এল। সেই সঙ্গে ক্যাভিয়ার।
বোতল খুলল টেরেন্স। মারিয়া একাই অল্প বিস্তর পান করছে। শুনছে বজ্রপাতের শব্দ। সবকিছু যেন মুহূর্তটিকে যথার্থ করে তুলতে পাকাচ্ছে ষড়যন্ত্র; যেন আকাশ এবং পৃথিবীর শক্তিও তাদের ভয়ঙ্কর দিকটির প্রদর্শনী করছে।
একটু বাদে ওয়ার্ডরোব খুলে ছোট একটি সুটকেস বের করল টেরেন্স। রাখল বিছানায়।
‘নোড়ো না।’
নিশ্চল বসে রইল মারিয়া। সুটকেস খুলল টেরেন্স। বের করল এক জোড়া ধাতব হ্যান্ডকাফ।
‘পা ফাঁক করে বসো।’
হুকুম তামিল করল মারিয়া। টেরেন্স ওর দুই পায়ের ফাঁকে তাকাল। দেখছে কালো প্যান্টি, লম্বা মোজা, ছাল ছাড়ানো কলা গাছের মত মসৃণ ঊরু। কল্পনায় হয়তো মারিয়ার যোনিদেশের লোমও দেখতে পাচ্ছে।
‘উঠে দাঁড়াও!’
লাফ মেরে চেয়ার ছেড়ে সিধে হলো মারিয়া। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। পান করা বেশিই হয়ে গেছে। টলছে মাথা।
‘আমার দিকে তাকিয়ো না। মাথা নামাও, তোমার প্রভুর প্রতি সম্মান দেখাও!’
মাথা নিচু করার আগে মারিয়া দেখতে পেল সুটকেস থেকে একটি চাবুক বের করেছে টেরেন্স। বাতাসে একবার চাবুক কষাল সে। সাঁই করে শব্দ হলো।
‘পান করো। মাথা নিচু করে পান করো।’
আরেক গ্লাস মদ খেল মারিয়া। এক, দুই, তিন গ্লাস ভদকা। এটা নাটক নয়, বাস্তবতা; নিয়ন্ত্রণ মারিয়ার হাতের বাইরে চলে গেছে। নিজেকে স্রেফ একটা বস্তু বলে মনে হচ্ছে ওর, তবু নিজেকে স্বাধীন লাগছে মারিয়ার। সে আর শিক্ষক নয়, সে শিক্ষক নয় বলে উপদেশ দিচ্ছে না, সান্ত্বনা দিচ্ছে না, স্বীকারোক্তি শুনছে না; এই লোকটির আশ্চর্য শক্তির সামনে সে ব্রাজিলের প্রত্যন্ত মফস্বলের একটি অসহায় মেয়ে মাত্র।
‘কাপড় খোলো।’
ঝট্ করে এল আদেশ। মাথা নিচু রেখে পোশাকের বোতাম খুলতে লাগল মারিয়া। পোশাকটা ঝপ্ করে পড়ে গেল মাটিতে।
‘তুমি ঠিকমত আচরণ করছ না, নিশ্চয় জানো।
শূন্যে আবার সাঁই করে বাতাস কাটল চাবুক।
মারিয়া হাঁটু গেড়ে বসতে যাচ্ছিল, চাবুকের বাড়ি খেয়ে ককিয়ে উঠল ওর নগ্ন নিতম্বে বাড়ি মেরেছে চাবুক। জ্বলছে। তবে আশা করা যায় কোনও দাগ পড়েনি।
‘তোমাকে আমি হাঁটু মুড়ে বসতে বলেছি?’
‘না।’
চাবুক আবার আছড়ে পড়ল নিতম্বে
‘বলো, ‘না, স্যার।
আবার দংশনের জ্বালা। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য মারিয়ার মনে হলো হয় ওকে এটা এখন থামাতে হবে কিংবা চালিয়ে যেতে দিতে হবে। তবে টাকার জন্য নয়, বরং প্রথমবার সে যা বলেছিল তার ওপর ভিত্তি করে। ও বলেছিল যখন সীমানা ছাড়িয়ে যাবে তুমি শুধু তখনই জানতে পারবে নিজেকে।’
আর এটা নতুন একটা বিষয়, একটা অ্যাডভেঞ্চার। সে চালিয়ে যাবে কিনা তা পরে ঠিক করা যাবে। তবে এ মুহূর্তে তাকে সেই মেয়েটি হতে হবে যার জীবনের লক্ষ্য তিনটিঃ যে শরীর বেচে পেট চালায়, যার সঙ্গে এমন এক লোকের পরিচয় হয়েছে যে ফায়ার প্লেসের সামনে মজার মজার গল্প বলতে পারে। এখানে মারিয়া কিছু না, আর কিছু না বা কেউ না মানে সে যা কল্পনাও করেনি তা হতে পারা।
‘বাকি পোশাকগুলোও খুলে ফেলো। ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটে যাও। আমি তোমাকে দেখব।’
আবার নির্দেশ পালন করল মারিয়া, মাথা নিচু করে, একটিও বাক্য বিনিময় না করে। টেরেন্স ওকে দেখছে, তার গায়ে এখনও পুরো পোশাক। এ যেন সে লোক নয় যে ক্লাব থেকে হোটেলে ফেরার পথে বকবক করেছে মারিয়ার সঙ্গে। এ যেন ইউলিসিস, যে এসেছে লন্ডন থেকে, একজন থেসিয়াস, আগমন ঘটেছে স্বর্গ হতে, একজন কিডন্যাপার যে বিশ্বের সবচে’ নিরাপদ নগরীর ওপর হামলা চালিয়েছে, এবং যার হৃদয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শীতল।
মারিয়া তার আদেশ পালন করল। একে একে খুলে ফেলল প্যান্টি ও ব্রা। আবার সাঁই শব্দ উঠল বাতাসে। তবে এবারে চাবুক স্পর্শ করল না মারিয়ার গা।
‘মাথা নিচু করে রাখো! তুমি এখানে অপমান ও নির্যাতন সইতে এসেছ, আমার প্রতিটি কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে এসেছ, বুঝতে পেরেছ আমার কথা?’
‘জ্বী, স্যার।’
টেরেন্স খামচে ধরল মারিয়ার হাত, কব্জিতে পরিয়ে দিল হ্যান্ডকাফ।
‘তোমাকে আচ্ছা একটা ধোলাই দেয়া হবে। তাহলে শিখতে পারবে কীভাবে আচরণ করতে হয়।’
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মারিয়ার নিতম্বে চড় মারল টেরেন্স। মারিয়া ককিয়ে উঠল ব্যথায়।
‘আচ্ছা, নালিশ জানাচ্ছ? আমি তো এখন পর্যন্ত শুরুই করিনি।’
মারিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেরেন্স ওর মুখে চামড়ার একটা পট্টি ঢুকিয়ে দিল। তবে কথা বলতে পারবে মারিয়া। অন্তত ‘হলুদ’ এবং ‘লাল’ বলতে পারবে। তবে ও বুঝতে পারছে এ লোকটার হাতেই এখন তার নিয়তি নির্ভর করছে। এ ওকে নিয়ে যা খুশি করতে পারবে, পালাবার পথ নেই। সম্পূর্ণ নগ্ন মারিয়া, মুখে চামড়ার পট্টি, হাতে হাতকড়া, তার শিরায় রক্তের বদলে যেন প্রবাহিত হচ্ছে ভদকা।
আবার থাপ্পর পড়ল পাছায়।
‘হাঁটো।’
হাঁটা ধরল মারিয়া। সেই সঙ্গে মান্য করে গেল নির্দেশ : ‘থামো; ‘ডানে ঘোরো,’ ‘বসো,’ ‘পা ফাঁক করো।’ বারবার ওকে চড় কষাতে লাগল টেরেন্স, থাপ্পর খাওয়ার মতো অপরাধ মারিয়া করুক বা না-ই করুক। প্রতিটি থাপ্পরে জ্বালা ধরল গায়ে, অপমানও লাগছে— অপমানটা শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও বেশি— মনে হচ্ছে ও যেন এ জগতে নেই, চলে গেছে অন্য দুনিয়ায়, যেখানে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই, এ যেন এক ধর্মীয় অনুভূতি; সেলফ- অ্যানাইহিলেশন, সাবজেকশন, এবং ইগো বা আত্ম-অহমিকার সম্পূর্ণ ধ্বংস, যেখানে নেই কামনা-বাসনা কিংবা কোনও ইচ্ছা শক্তি। ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে মারিয়া, একই সঙ্গে প্রবল যৌন ক্ষুধা জাগছে ওর, কিন্তু বুঝতে পারছে না কী করবে।
‘আবার হাঁটু গেড়ে বসো!’
সারাক্ষণ মাথা নিচু করে আছে মারিয়া নির্দেশ মান্য করতে গিয়ে তা-ই বুঝতে পারছে না ঠিক কী ঘটছে। তবে অপর ব্রহ্মাণ্ডে, অপর গ্রহে সে দেখতে পাচ্ছে লোকটা ঘনঘন শ্বাস ফেলছে, তাকে সপাং সপাং মেরে চলেছে বেত, ওদিকে বল ও শক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠছে মারিয়া। তার লাজ-লজ্জা সব চলে গেছে, নিজের তৃপ্তি প্রদর্শনে দ্বিধা করছে না; সে এবার গোঙাতে শুরু করল, আকুতি জানাচ্ছে টেরেন্স যেন ওকে স্পর্শ করে, বদলে লোকটা ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল বিছানায়।
জোর করে মারিয়ার দু’পা ফাঁক করল টেরেন্স- বেঁধে ফেলল খাটের সঙ্গে। হাতকড়া বাঁধা হাত জোড়া শরীরের পেছনে, পা ছড়ানো, মুখে পট্টি গোঁজা, টেরেন্স কখন ওর শরীরে প্রবেশ করবে? ও কি দেখতে পাচ্ছে না প্রস্তুত হয়ে আছে মারিয়া, টেরেন্সের সেবা করতে চায় সে, মারিয়া তো টেরেন্সের ক্রীতদাসী, সে তাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারে।
মারিয়ার যোনিতে চাবুকের হাতল রাখল টেরেন্স। তারপর ওপরে-নিচে ঘষতে লাগল। ওর ভগাঙ্কুর স্পর্শ করা মাত্র নিজের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্ৰণ হারিয়ে ফেলল মারিয়া। ডজন ডজন পুরুষ এতদিন যা করতে পারেনি, আজ চাবুকের হাতলের ঘষায় তা ঘটল। রেতঃপাত হলো মারিয়ার। যোনির ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট দিয়ে ভলভল করে বেরিয়ে আসতে লাগল আঠালো, সাদা রস। আলোর একটা বিস্ফোরণ ঘটল মারিয়ার চোখের সামনে, মনে হলো আত্মার কালো গহ্বরে ঢুকে পড়েছে সে, যেখানে তীব্র যন্ত্রণা এবং ভয় প্রচণ্ড যৌনতৃপ্তির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে, তাকে চেনা সমস্ত সীমারেখা থেকে ঠেলে বের করে নিয়ে আসছে, শীৎকার দিল মারিয়া, চিৎকার করল, তবে মুখে চামড়ার পট্টি ঢোকানো বলে বেরুল না শব্দ। সুখে আকুল হয়ে মোচড় খেতে লাগল বিছানায়, হাতকড়ায় টান খেয়ে ছিলে গেল হাতের চামড়া। ওর যোনিতে যেন রাগরসের বান ডেকেছে। প্রচণ্ড সুখে মূর্ছা যাবার দশা হলো মারিয়ার, বারবার ঝাঁকি খাচ্ছে শরীর। টেরেন্সের হাত চালনা আরও দ্রুত হয়ে উঠল ঠাঁটিয়ে শক্ত হয়ে ওঠা লাল টকটকে ভগাঙ্কুরে। শুধু যোনি থেকে নয়, রেতঃপাত যেন হলো মারিয়ার মুখ, প্রতিটি লোম কূপ, চোখ এবং ত্বক থেকেও।
একটা ঘোরের মধ্যে যেন প্রবেশ ঘটেছিল মারিয়ার। আস্তে আস্তে, খুব ধীরে ধীরে ফিরে এল সে নিজের মধ্যে। দুই পায়ের ফাঁকে কোনও চাবুক এখন নেই। তার যোনির লোম রসে ভেজা, মাথার চুল ঘামে ভেজা, টের পেল নরম হাতে ওর কব্জি থেকে খুলে ফেলা হচ্ছে হ্যান্ডকাফ, চামড়ার রশি বাঁধা গোড়ালিও হলো মুক্ত।
বিছানায় শুয়ে রইল মারিয়া। নিজেকে কেমন বিভ্রান্ত লাগছে। সামনের লোকটার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগছে রেতঃপাতের জন্য, চিৎকার করার জন্য। টেরেন্স মারিয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, সেও নিশ্বাস ফেলছে ঘনঘন, তবে মূল তৃপ্তিটা পেয়েছে মারিয়া, উল্লাসের মুহূর্তগুলো বিন্দুমাত্র উপভোগ করার সুযোগ হয়নি টেরেন্সের।
টেরেন্সের গায়ে পুরো পোশাক। সে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মারিয়াকে। চিৎকার করে, নির্দেশ দিয়ে দিয়ে বিধ্বস্ত। মারিয়া বুঝতে পারছে না কী বলবে, তবে নিজেকে নিরাপদ এবং প্রোটেক্টেড মনে হচ্ছে, কারণ টেরেন্স মারিয়াকে তার শরীরের ভেতরে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যার কথা আগে জানা ছিল না মারিয়ার। টেরেন্স এখন তার রক্ষা কর্তা এবং প্রভু।
কাঁদতে শুরু করল মারিয়া। ওর কান্না থামা পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে থাকল টেরেন্স।
‘তুমি আমার কী করেছ?’ অশ্রু সজল কণ্ঠে প্রশ্ন করল মারিয়া।
‘আমাকে যা করতে বলেছ।’
মারিয়া টেরেন্সের দিকে তাকাল। ওকে সাংঘাতিকভাবে কামনা করছে সে।
‘আমি তোমাকে কোনওরকম জোর করিনি কিংবা কিছু করতে বাধ্যও করিনি, তুমি ‘হলুদ’ শব্দটিও উচ্চারণ করনি। তুমি শুধু আমাকে শক্তিটা দিয়েছ। আমার তরফ থেকে কোনও বিধিনিষেধ কিংবা ব্ল্যাকমেইল ছিল না, ছিল শুধু তোমার ইচ্ছা; তুমি হয়তো আমার দাসী হয়েছ আর আমি তোমার প্রভু, তবে আমার একমাত্র শক্তি ছিল তোমাকে তোমার স্বাধীনতার রাস্তায় ঠেলে দেয়া।’
মারিয়া নিজের মধ্যে পূর্ণ শক্তির একটা ফল্গুধারা টের পাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হয়নি?
‘না,’ জবাব দিল টেরেন্স। ‘প্রভু এখানে এসেছে দাসীকে চালাতে। দাসীর তৃপ্তিই প্রভুর আনন্দ।’ একটু থেমে সে যোগ করল, ‘তোমার যখন ইচ্ছা চলে যেতে পার।’
‘আমি চলে যেতে চাই না, আমি বুঝতে চাই।’
‘বোঝাবুঝির কিছু নেই।’
বিছানা ছাড়ল মারিয়া। তার নগ্ন দেহে ফুটে আছে অপূর্ব এক সৌন্দৰ্য্য। সে দুটো গ্লাসে মদ ঢালল। ধরাল একজোড়া সিগারেট। একটা দিল টেরেন্সকে— এখন যেন পাল্টে গেছে দৃশ্যপট- সে এখন কর্ত্রী হয়েও সেবা করছে ক্রীতদাসের, দাস তাকে যে তৃপ্তি দিয়েছে সে জন্য পুরস্কৃত করছে।
‘আমি জামাকাপড় পরেই চলে যাব। তার আগে একটু কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।’
‘কথা বলার কিছু নেই। আমি এটাই চেয়েছিলাম। তুমি দারুণ দেখিয়েছ। আমার এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। কাল লন্ডন ফিরব।’
বিছানায় শুয়ে পরল টেরেন্স। বুজল চোখ। মারিয়া বুঝতে পারছে না যুবক ঘুমের ভান করছে কিনা। তবে গ্রাহ্য করল না ও। চুপচাপ, অলস ভঙ্গিতে টেনে চলল সিগারেট, মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে মদের গ্লাসে। জানালার ধারে গেল মারিয়া। কাঁচে চেপে ধরল মুখ। তাকাল লেকের অপর প্রান্তে। মনে মনে আশা করল কেউ যেন লেকের তীর থেকে ওকে দেখতে পায়— নগ্ন, পরিপূর্ণ, তৃপ্ত, আত্মবিশ্বাসী।
কাপড় পরে নিল মারিয়া। বিদায়ও জানাল না। সে দরজা খুলবে নাকি টেরেন্স তা নিয়েও ভাবিত হলো না। কারণ ও ঠিক জানে না আবার এখানে ফিরবে কিনা।
দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনল টেরেন্স। অপেক্ষা করল দেখতে মারিয়া ফিরে আসে কিনা। কিছু একটা ফেলে গেছে হয়তো ফিরবে এই অজুহাতে। কিন্তু ফিরল না মারিয়া। কিছুক্ষণ পরে বিছানায় উঠে বসল টেরেন্স। আরেকটা সিগারেট ধরাল।
মেয়েটার একটা স্টাইল আছে, ভাবল সে। ওকে ইচ্ছা মত বেত মেরেছে। একটুও প্রতিবাদ করেনি। অপরকে বেত মেরে যৌনতৃপ্তি পাবার এই পদ্ধতিকে বলে স্যাডোম্যাসোকিজম। এ ধরনের অভিজ্ঞতার স্বাদ এর আগেও নিয়েছে টেরেন্স। তার বিখ্যাত ইংরেজ গায়িকা স্ত্রীকে ধরে সে মারত। মারত ঈর্ষা এবং হিংসা থেকে। মেয়েটা ভালোবাসত টেরেন্সকে। বুঝতে পারত না টেরেন্স কেন তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছে।
একবার এক মিউজিশিয়ান স্টুডিওতে একটি বই ফেলে রেখে যায়। বইটির নাম Venus in Furs। লেখক লিওপোল্ড ভন শাচার-মালোচ। বইটি পড়ার পরে টেরেন্স নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে শুরু করে।
বইয়ের একটি পাতায় ছিল :
‘অপূর্ব সুন্দরী নারীটি তার সমস্ত জামা কাপড় খুলে ফেলে নগ্ন হয়ে গেল। হাতে তুলে নিল চাবুক। ‘তুমিই এটা চেয়েছ,’ বলল সে। ‘কাজেই তোমাকে আমি চাবকাবো।’ ‘ওহ্, ইয়েস’ গুঙিয়ে উঠল তার প্রেমিক, ‘প্লিজ, মারো।’
টেরেন্সের স্ত্রী স্টুডিও’র গ্লাস স্ক্রীনের অপর পাশে দাঁড়িয়ে রিহার্সাল দিচ্ছিল। টেরেন্স ভাবছিল তার স্ত্রীর সঙ্গে পিয়ানোবাদকের প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক রয়েছে। বুঝতে পারছিল স্ত্রী তাকে পাগল করে তুলেছে।
টেরেন্স সুদর্শন, সফল একজন মানুষ। তবু স্যাডিস্ট জীবন কেন তার পছন্দ?
কারণ এরকম জীবন সে চেয়েছে। সে কষ্ট পেতে চেয়েছে কারণ জীবন খুব বেশি সাজানো গোছানো হয়ে উঠেছিল তার জন্য, আর এত কিছু পাবার যোগ্য সে ছিল না— টাকা, সম্মান, খ্যাতি। সে টের পাচ্ছিল তার ক্যারিয়ার তাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে হবে। আর এ বিষয়টি ভীত করে তোলে তাকে। কারণ বহু মানুষকে উঁচু থেকে ধপাশ করে পপাত ধরণীতল হতে দেখেছে টেরেন্স।
বইটা পড়ে ফেলেছিল টেরেন্স। বেদনা এবং তৃপ্তির রহস্যময় সম্পৃত্ততা নিয়ে যত বই চোখে পড়েছে, সব পড়ত সে। সে ভিডিও ভাড়া করে আনত, বই আনত। কিন্তু স্ত্রীকে দেখতে দিত না। স্ত্রী জানতে চাইত এগুলো কী। সে কী অসুস্থ? টেরেন্স জবাব দিত ‘না’। সে নতুন একটি প্রচ্ছদ করার জন্য গবেষণা করছে। তারপর আবেগশূন্য গলায় বলেছিল :
‘আমরা বিষয়টা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
তারা কাজটা করেছে। ভীরু বক্ষে। পর্ণো দোকান থেকে আনা ম্যানুয়েল ব্যবহার করেছে। ক্রমে নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে তারা, পৌঁছে যায় বিপজ্জনক সীমায়, অনুভব করে তাদের দাম্পত্য বন্ধন যেন দৃঢ়তর হচ্ছে। তারা যেন নিষিদ্ধ, গোপন একটি কাজ করছিল।
তাদের যৌন অভিজ্ঞতা রূপ নেয় শিল্প কলায়; তারা নতুন আউটফিট তৈরি করে— চামড়ার সঙ্গে ধাতব যন্ত্র। তার স্ত্রী পায়ে বুট, সাসপেন্ডার বেল্ট নিয়ে, চাবুক হাতে যখন মঞ্চে উঠত, উন্মাদ হয়ে যেত দর্শক। তার স্ত্রীর নতুন রেকর্ড ইংল্যান্ডের চার্টে শীর্ষে উঠে যায় এবং জয় করে বাকি ইউরোপ। টেরেন্স অবাক হয়ে যায় দেখে তরুণরা ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসি কত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে।
চাবুক হয়ে ওঠে দলটির লোগো। চাবুকের ছবি নিয়ে বাজারে হুহু করে বিক্রি হতে থাকে টি-শার্ট, স্টিকার, পোস্টকার্ড এবং নকল উল্কি।
.
টেরেন্সের স্ত্রী জানে তার স্বামী কী উদ্দেশে জেনেভা এসেছে। সে বাধা দেয়নি। বরং খুশিই হয়েছে ভেবে যে সারা সপ্তা কঠোর পরিশ্রমের পরে মানুষটা একটু আমোদস্ফূর্তি করতে পারবে।
যে মেয়েটি এইমাত্র ঘর থেকে চলে গেল সে সব বুঝতে পেরেছে। টেরেন্সের মনে হচ্ছে মেয়েটির আত্মা আর তার আত্মা যেন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে মেয়েটির প্রেমে পড়তে প্রস্তুত নয় তার মন। কারণ টেরেন্স তার স্ত্রীকে ভালোবাসে। তবে টেরেন্সের ভাবতে ভালো লাগছে সে মুক্ত এবং নতুন সম্পর্কের স্বপ্ন দেখতে পারছে।
টেরেন্স মেয়েটিকে নিয়ে আরও এক্সপেরিমেন্ট করবে, এবারে আরও কঠিন স্টেজে পা দেবে : মেয়েটি হবে সাচার-মালোচ-এর ‘ভেনাস ইন ফারস’-এর ডোমিনাট্রিক্স, দ্য মিস্ট্রেস।’ যে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে। যদি এ পরীক্ষায় পাশ করে যায় মেয়েটি, টেরেন্স তার জন্য হৃদয় খুলে দিতে প্রস্তুত।’
মারিয়ার ডায়েরি থেকে, ভদকার প্রভাবে এখনও মাতাল!
আমার যখন হারাবার কিছু ছিল না তখন আমার সব ছিল। যখন আমি কে তা অনুসন্ধানের চেষ্টা থেকে বিরত হলাম, তখন নিজেকে খুঁজে পেলাম।
যখন ব্যথা-বেদনা-অপমানের সমস্ত অভিজ্ঞতা আমার হলো, আমি ছিলাম মুক্ত। জানি না আমি অসুস্থ কিনা, এটা স্বপ্ন কিনা কিংবা এটা একবারই ঘটেছে কিনা। আমি জানি এটা ছাড়াই বাঁচতে পারব। কিন্তু আমি এটা আবার করতে চাই, চাই এক্সপেরিমেন্টের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে, আরও সামনে এগোতে।
শারীরিক ব্যথা কতটা পাব এ নিয়ে আমি ভীত ছিলাম। তবে খুব বেশি বেদনা পাইনি। বহু মাস পরে যখন আমার রাগ মোচন ঘটল, (যদিও বহু পুরুষ আমার শরীরটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেও বিন্দুমাত্র সুখ দিতে পারেনি), আমার তখন মনে হয়েছিল- সত্যি এটা ঘটছে? ঈশ্বর মানুষের মুক্তির জন্য তাদের বেদনা উৎসর্গ করতে বলেছেন। তবে মানুষের মুক্তির ব্যাপারে বা তার কিংবা আমার মুক্তির ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। আমি শুধু ওখানে ছিলাম, ব্যস।
সেক্স-এর শিল্প হলো নিয়ন্ত্রিত সমর্পণের শিল্প।
চব্বিশ
এবারে কল্পনায় নয়, সত্যি ট্রেন স্টেশনে এসেছে মারিয়া র্যালফের সঙ্গে। মারিয়ার অনুরোধে আসতে হয়েছে। সে পিজ্জা খাবে। গত পরশু এ শহরে এসেছে র্যালফ মারিয়ার সঙ্গে দেখা করবে বলে। তবে মারিয়া র্যালফের কথা ভাবছে না। চিন্তা-ভাবনা করার আরও চিত্তাকর্ষক বিষয় পেয়ে গেছে সে।
মারিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে পিজ্জা খাচ্ছে র্যালফ। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না খুব একটা মজা পাচ্ছে। মারিয়া ভাবছে এ লোককে নিয়ে এখন সে কী করবে? ক্লাবে এসে র্যালফ যখন মারিয়াকে ড্রিঙ্ক করার প্রস্তাব দিল, মারিয়া চিন্তা করেছে বলে দেয় সে এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়, অন্য কাউকে যেন খুঁজে নেয় র্যালফ। আগের রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য কাউকে প্রয়োজন ছিল মারিয়ার।
‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’দের সেবা করেছে এমন দু’একজন পতিতার সঙ্গে মারিয়া কথা বলার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু এরা কেউই তাদের অভিজ্ঞতার কথা মারিয়াকে বলবে না। কারণ মারিয়া বুদ্ধিমতী, দ্রুত শিখে নিতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার, কোপাকাবানায় সে একটা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত পুরুষকে চেনে মারিয়া, একমাত্র র্যালফ হার্টই তাকে বুঝতে পারে। মিলান তাকেও ‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’ হিসেবে ধরে নিয়েছে। কিন্তু র্যালফ এমন প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকায় মারিয়ার দিকে, সবকিছু কেমন গুবলেট হয়ে যায়।
তুমি বেদনা, যন্ত্রণা এবং তৃপ্তির ব্যাপারে কতটুকু জান?’ নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করে বসল মারিয়া।
পিজ্জা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল র্যালফের।
‘সবকিছু। তবে এসব এখন আমাকে বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট করে না।’
চটজলদি জবাব এল। অবাক হলো মারিয়া। তা হলে কী সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে কিছুই জানে না? এটা কেমন পৃথিবী?
‘আমি আমার ভেতরের দানব এবং অন্ধকার দিকগুলোর সঙ্গে লড়াই করেছি,’ বলল র্যালফ। ‘শুধু ওই এলাকা নয় আরও অনেক এলাকা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার চেষ্টা করেছি। শেষ যেবার মিলিত হলাম আমরা, আমি কামনার মাঝ দিয়ে ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম আমার সীমারেখা, তবে বেদনা নয়। আমি প্রবেশ করেছিলাম আমার আত্মার গভীরে এবং আমি জানি আমি এখনও ভালো জিনিস চাই, এই জীবন থেকে আরও ভালো জিনিস।’
র্যালফ আসলে বলতে চেয়েছে, ‘এসব ভালো জিনিসের মধ্যে তুমিও আছো। কাজেই ওই রাস্তায় যেয়ো না, প্লিজ।’ কিন্তু বলার সাহস হলো না; বদলে একটা ট্যাক্সি ডাকল, ড্রাইভারকে বলল ওদেরকে লেকের তীরে নিয়ে যেতে, যেখানে প্রথম দিন সাক্ষাতের পরে ঘুরে বেরিয়েছিল দু’জনে। অনুরোধের অর্থ বুঝতে পারল মারিয়া তবে বলল না কিছুই।
লেকের বাগানের ধারে চলে এল ওরা। এখনও গ্রীষ্ম চলছে, তবে সাঁঝ ঘনালেই ঠাণ্ডা পড়ে।
‘আমরা এখানে কী করছি?’ ট্যাক্সি থেকে নামল মারিয়া। ‘বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা লেগে যাবে আমার।’
‘তুমি ট্রেন স্টেশনে বেদনা এবং তৃপ্তি নিয়ে যা বলেছ ওই কথাগুলো নিয়ে ভাবছি আমি। জুতো খুলে ফেলো।’
মারিয়ার মনে পড়ে যায় একবার এক খদ্দের একই অনুরোধ করেছিল তাকে। স্রেফ মারিয়ার নগ্ন পা দেখেই পুরুষাঙ্গ উদ্রিত হয়ে গিয়েছিল তার।
‘বললাম তো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।’
‘যা বললাম করো,’ গোঁ ধরে রইল র্যালফ। ‘ঠাণ্ডা লাগবে না। আমার কথা বিশ্বাস করো। আমিও তো তোমার কথা বিশ্বাস করছি।
যে কোনও কারণেই হোক, মারিয়া বুঝতে পারল র্যালফ তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার কোনও সাহায্যের দরকার নেই। মারিয়া নিজের নতুন পৃথিবী নিয়ে সন্তুষ্ট। এ পৃথিবী থেকে সে শিখেছে বেদনা বা কষ্ট কোনও সমস্যা নয়। ব্রাজিলের কথা মনে পড়ে যায় ওর। ভিন্ন পৃথিবী শেয়ার করার মত কোনও পার্টনার ওখানে হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। ব্রাজিল যেহেতু তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, মারিয়া খুলে ফেলল জুতো। মোজা ভেদ করে ছোট নুড়ি পাথরের খোঁচা লাগল পায়ের পাতায়। এতে কিছু এসে যায় না। নতুন মোজা কিনে নেবে মারিয়া।
‘জ্যাকেট খোলো।’
‘না’ বলতে পারত মারিয়া, কিন্তু গত রাত থেকে যেহেতু ‘হ্যাঁ’ বলার আনন্দ উপভোগ করছে তাই বিনাবাক্যব্যয়ে খুলে ফেলল জ্যাকেট। ওর উষ্ণ শরীরে দ্রুত জেঁকে ধরতে লাগল শীত।
‘আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলব।’
‘আমি এখানে হাঁটতে পারব না। মাটি বোঝাই পাথর।’
‘আমি চাই তুমি এ পাথরের স্পর্শ নাও। চাই ওগুলো তোমাকে ব্যথা দিক, ছিলে যাক চামড়া, কারণ আমার মত তুমিও কষ্টের সঙ্গে তৃপ্তিকে মেলাতে শুরু করেছ।’
কিছু না বলে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল মারিয়া, ঠাণ্ডায় আগুন ধরে গেল পায়ের পাতায়, নুড়ির খোঁচা লাগছে চামড়ায়। র্যালফ পাশে বকবক করছে কিন্তু ব্যথা এবং ঠাণ্ডায় তার কথায় মনোযোগ দিতে পারছে না মারিয়া।
‘তোমার হাতে একটা কালশিটে দাগ দেখলাম আজ।’ হঠাৎ বলল র্যালফ। হ্যান্ডকাফের দাগ। দাগটা ঢাকার জন্য হাতে অনেকগুলো ব্রেসলেট পরেছে মারিয়া, কিন্তু র্যালফের অভিজ্ঞ চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়নি।
‘তোমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তোমাকে ওই ধাপের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি তোমাকে বাধা দেব না, তবে তোমার জানা উচিত এর কোনও কিছুর সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক নেই।’
‘কোন্ ধাপ?’
‘বেদনা এবং তৃপ্তি, স্যাডিজম এবং ম্যাসোকিজম। যে নামে খুশি তুমি একে সম্বোধন করতে পার, তবে তুমি যদি মনে করো এটাই তোমার সঠিক রাস্তা, কষ্ট পাব আমি, আমি স্মরণ করব কামনার সেই অনুভূতি, আমাদের সাক্ষাৎ, সান্তিয়াগোর রাস্তায় দু’জনে মিলে হাঁটা, তোমার আলোর কথা। তোমার দেয়া কলমটি সারা জীবন আগলে রাখব আমি, এবং যতবার অগ্নিকুণ্ডে আগুন জ্বালাব, তোমার কথা মনে পড়বে আমার। তবে তোমার খোঁজে আসব না আর কোনদিন।’
ভয় পেল মারিয়া; অনুভব করল ওকে সত্য বলার এখনই সময়, সে ওর চেয়ে ভালো জানে এরকম ভান না করা।
‘সম্প্রতি যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে— আসলে বলা উচিত গত রাতে- এরকম অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। আর ভাবলেই ভীত হয়ে উঠি যে নিজের সম্মান নিজেই নষ্ট করছি আমি।’
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে মারিয়ার- দাঁতে দাঁত ঠকঠক বাড়ি খাচ্ছে, পা ব্যথায় বিষ।
‘কুমানো নামের একটি জায়গায় আমার ছবির প্রদর্শনী চলছিল, অনেকের সঙ্গে এক কাঠুরেও এসেছিল প্রদর্শনীতে।’ বলে চলল র্যালফ যেন মারিয়ার কথা শুনতে পায়নি। ‘আমার ছবি পছন্দ হয়নি তার, তবে আমি কী অনুভব করছি কিংবা আমার অভিজ্ঞতা সবই যেন সে ওই ছবি দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল। পরদিন সে আমার হোটেলে এসে জানতে চায় আমি সুখী কিনা। যদি সুখী হই তাহলে যা করছি তাই যেন চালিয়ে যাই। আর যদি সুখী না হই তাহলে তার সঙ্গে যেন কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসি।
‘কাঠুরে আমাকে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করেছিল যেভাবে আজ তোমাকে আমি বাধ্য করছি। ঠাণ্ডা কী জিনিস টের পাইয়ে দিয়েছিল সে আমাকে। কষ্টের সৌন্দর্য বুঝতে বাধ্য করেছিল। তবে ওই বেদনা ছিল প্রকৃতি সৃষ্ট, মনুষ্য সৃষ্ট নয়। সে বলেছিল এর নাম শু-গেন-দো, একটি সুপ্রাচীন প্রাকটিস।
কাঠুরে আমাকে বলেছিল ব্যথা বেদনা যেন আমি না ডরাই, তাহলে আত্মার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে, তাছাড়া শরীরকেও মনের দাস বানাতে শিখতে হবে। সে আমাকে বলে ভুল রাস্তায় আমি যন্ত্রণার ব্যবহার করছি। এবং এটা ঠিক হচ্ছে না মোটেই।
‘এই অশিক্ষিত আমি নিজেকে যতটা না জানি তারচেও বেশি চিনে ফেলেছিল। এতে বিরক্তবোধ করি আমি তবে একই সঙ্গে এ ভেবেও গর্ববোধ হচ্ছিল, আমি যা ভাবছি তা আমার ছবি যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ।’
মারিয়ার পায়ে ধারাল একখণ্ড পাথর ঢুকে গেল। তবে ভয়ানক ঠাণ্ডার জন্য ব্যথাটা প্রায় টেরই পেল না। তার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। তার কাটা পা ধাক্কা খেল আরেকটা পাথরে। চিৎকার করে উঠল মারিয়া। তার ইচ্ছে করল থেমে দাঁড়ায়। কিন্তু নিজের সম্মান হানির ভয়ে থামল না। সে নগ্ন পায়ে আরও অনেকখানি রাস্তা হাঁটতে পারবে, এতে তার জান যাবে না। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল মারিয়ার : কেমন হয় কাল রাতে যদি সে আহত পায়ের জন্য কোপাকাবানায় যেতে না পারে। অথবা ফ্লুতে যদি সে আক্রান্ত হয়ে পড়ে? মনে পড়ল খদ্দেরদের কথা যারা তাকে আশা করছে, মিলানের কথা যে তাকে খুব বিশ্বাস করে, টাকা, খামার, বাবা মা’র কথা। কিন্তু পায়ের প্রচণ্ড ব্যথা এসব চিন্তা ঝেঁটিয়ে দূর করে দিল। মারিয়া শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে বদল করতে লাগল। আশা করল র্যালফ হার্ট তার করুণ অবস্থার কথা বুঝতে পেরে তাকে থামতে বলবে এবং পায়ে জুতো গলাবার সুযোগ পাবে মারিয়া।
কিন্তু র্যালফকে একদম আলাদা একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে, বহু দূরের, মারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে এককদম এগোল। তারপর আরেক কদম।
তীব্র ব্যথায় অন্য কিছু ভাবতে পারছে না মারিয়া। সে হাঁটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এমন সময় অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো : ও ওর সীমায় পৌঁছে গেছে, এর পরে শুধু শূন্যতা, যেখানে মারিয়া ভাসছে।
মারিয়ার চারপাশটা কেমন স্বপ্নময় হয়ে ওঠে : স্বল্প আলোকিত বাগান, কালো হ্রদের জল, পাশে হাঁটা নীরব যুবক, মাঝে মাঝে হাঁটতে বেরুনো দম্পতি দর্শন, তারা লক্ষ করছে না নগ্ন পায়ের রক্তাক্ত মারিয়াকে। মারিয়া জানে না এটা ঠাণ্ডা নাকি ব্যথার জন্য হলো, হঠাৎ শরীরের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে ফেলে সে, এমন এক পরিবেশে প্রবেশ করে যেখানে কামনা বা ভয় নেই। শুধু আছে রহস্যময়- একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে মারিয়া- রহস্যময় শান্তি। ব্যথার বাধা ওর জন্য আর কোনও প্রতিবন্ধকতা নয়।
এরপরে মারিয়ার যেটুকু মনে পড়ে ত।হলো র্যালফ তাকে সিধে হতে সাহায্য করছিল (কারণ মারিয়া হাঁটু ভেঙে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে), তার গা মুড়ে দেয় জ্যাকেটে। মারিয়া নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এতে অবশ্য কিছু আসে যায় না; সে সুখী, সে ভয় পায়নি সে ভয়কে করেছে জয়। র্যালফের সামনে নিজেকে ছোট হতে দেয়নি মারিয়া।