ইলেভেন মিনিটস – ১৫

পনেরো 

আরও তিন মাস গেল। এল শরৎ। সবকিছু কেমন দ্রুত এবং ধীরগতিতে ঘটছে, মারিয়া বুঝতে পারছে সময় আসলে দু’টি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে চলছে। সে সেই অদৃশ্য নারীর করুণ হাসির কথা ভুলতে পারে না যে নারী তাকে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় সঙ্গ দিত, তাকে বলত জীবন অত সরল নয়, এতদিনে মারিয়া বুঝতে পেরেছে থেমে যাবার একটি সঠিক মুহূর্ত আছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাস তিনেক বাদে দেশে ফিরবে। ছোট একটি খামার বাড়ি কিনবে (মারিয়া প্রত্যাশার অনেক বেশি আয় করছে), কয়েকটি গরু কিনবে (ব্রাজিলিয়ান, সুইস নয়), বাবা মাকে বলবে তার সঙ্গে থাকার জন্য। কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে ব্যবসা শুরু করবে। 

খামার করার পরে মারিয়া নিজের শহরে ফিরবে। ব্যাংকে বড় অঙ্কের সুইস ফ্রাঁ রাখবে। ওই ব্যাংকে তার বান্ধবীর প্রেমিক থাকে সে মারিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। 

‘হাই, কেমন আছ তুমি? আমাকে তোমার মনে আছে?’ বলবে ছেলেটা।

মারিয়া তখন ছেলেটার নাম মনে করার চেষ্টা করার ভান করবে, শেষে বলবে না, তার মনে পড়ছে না। বলবে সে এক বছর পরে ইউরোপ থেকে ফিরেছে (ইউরোপ শব্দটা সে খুব ধীরে এবং স্পষ্ট উচ্চারণে বলবে যাতে ছেলেটার কলিগরা শুনতে পায়)। 

কে সে? ছেলেটা তখন তাদের স্কুল জীবনের কথা বলবে। মারিয়া বলবে: ‘ওহ্, হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে…’ তবে চেহারায় এমন ভাব ফুটিয়ে রাখবে যেন মনে করতে পারছে না। এভাবে প্রতিশোধ নেবে সে। মারিয়ার খামার যখন দাঁড়িয়ে যাবে, সে জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটির খোঁজে উৎসর্গ করবে নিজেকে : খুঁজে নেবে তার প্রকৃত ভালোবাসাকে, যে মানুষটি তার জন্য এতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে যদিও তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি মারিয়ার। 

মারিয়া ‘ইলেভেন মিনিটস’ নামে একটি বই লিখবে ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন সে খামারের দিকে পুরোপুরি মনোযোগী হতে আগ্রহী, এটাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা কাজে লাগাতে না পারলে দেশে ফেরাটাই বৃথা হয়ে যাবে। 

সেদিন বিকেলে মারিয়া গেল তার সেরা এবং একমাত্র বন্ধু লাইব্রেরিয়ানের কাছে। গবাদি পালন এবং খামার গঠনের ওপরে বই চাইল। লাইব্রেরিয়ান বলল : 

‘কয়েক মাস আগে তুমি যখন এখানে এসে সেক্সের ওপরে বই চাইলে, তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার। অনেক সুন্দরী, কমবয়েসী মেয়েই সহজে টাকা কামাই করার লোভে ভুল পথে ধাবিত হয়। ভুলে যায় একদিন তারা বুড়ো হবে, তখন না পাওয়া ভালোবাসার জন্য আফসোস করবে।’ 

‘ভুল পথে বলতে কী আপনি পতিতাবৃত্তি বোঝাচ্ছেন?’ 

‘শব্দটা কর্কশ শোনালেও জবাব হলো- হ্যাঁ।’ 

‘আমি তো আপনাকে বলেইছি আমি একটা কোম্পানিতে আছি। তাদের মাংস আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা। কিন্তু আমি যদি পতিতাবৃত্তি বেছেও নিতাম, সঠিক সময়ে এ পেশা থেকে কি বিদায় নেয়া যেত না? অল্প বয়েসি মেয়েরা তো ভুল করেই।’ 

‘মাদকাসক্তরা এ কথাই বলে যে কখন থামতে হবে তোমাকে তা জানতে হবে। তবে কেউ থামে না।’ 

মারিয়া লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে এল। আজ বিকেলে তার তেমন কোনও কাজ নেই। সে রাস্তায় হাঁটতে লাগল। হঠাৎ হলুদ একটা ফলকে চোখ আটকে গেল। ওতে লেখা : ‘রোড টু সান্তি য়াগো।’ মানে কী এ কথার? রাস্তার ওপাশে একটা বার দেখা যাচ্ছে। কোনও কিছু বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করতে হয়, এ মতবাদে বিশ্বাসী মারিয়া বার-এ ঢুকল। 

‘আমি ঠিক জানি না কথাটার মানে কী,’ বার-এর মেয়েটি বলল, এখানে খাবারের দাম সাংঘাতিক চড়া, কফির দাম তিনগুণ। যেহেতু টাকা আছে পকেটে তাই কফির অর্ডার দিল মারিয়া। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা খামারের ওপর লেখা বইটি মেলে ধরল। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছে না- খুবই বিরক্তিকর লেখা। এরচে’ ওর যে কোনও ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলা সহজ। তারা জানে কীভাবে টাকা নাড়াচাড়া করতে হয়। 

কফির দাম চুকিয়ে সিধে হলো মারিয়া, বার-এর ওয়েট্রেসকে মোটা অঙ্কের বকশিস দিল (সে একটা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে- যত বেশি ব্যয় করবে তত বেশি আয় হবে), তারপর পা বাড়াল দরজার দিকে। এমন সময় একজন কথা বলে উঠল পেছন থেকে। মারিয়া জানে না এই মুহূর্ত থেকে বদলে গেল তার সমস্ত পরিকল্পনা, তার ভবিষ্যৎ, তার খামার গড়ার স্বপ্ন, সুখ নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা, তার আত্মা, জগতে তার স্থান, সবকিছু। 

‘একটু দাঁড়ান।’ 

বিস্মিত হয়ে একপাশে তাকাল মারিয়া। এটা কোপাকাবানা নয় যেখানে পুরুষরা মহিলাদেরকে এভাবে ডাকতে পারে। যদিও মেয়েরা এ আহ্বানের জবাবে বলে : ‘না, আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে আপনি থামাতে পারবেন না।’ 

কণ্ঠটা অগ্রাহ্য করতে যাচ্ছিল তবে কৌতূহলের জয় হলো শেষে। কণ্ঠের মালিকের উদ্দেশ্যে ঘুরল মারিয়া। অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পেল : মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে লম্বা চুলের, বছর ত্রিশের এক যুবক। তার চারপাশে ছবি আঁকার সরঞ্জাম ছড়ানো। যুবক চেয়ারে বসা এক লোকের ছবি আঁকছে। বার-এ ঢোকার সময় এদেরকে লক্ষ করেনি মারিয়া। 

‘যাবেন না। এ ছবিটা আঁকা প্রায় শেষ করে এনেছি। আপনারও একটা ছবি আঁকতে চাই।’ 

মারিয়া বলল, ‘না, ছবি আঁকার ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই।‘

‘আপনার ভেতরে বিশেষ একটা আলো আছে। অন্তত একটা স্কেচ করতে দিন।’ 

‘স্কেচ’ কী জিনিস? ‘বিশেষ আলো’ বলতেই বা এ লোক কী বোঝাচ্ছে? অবশ্য এ লোক যদি কোনও বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হয়ে থাকে তাহলে মারিয়া তার ছবি দিয়ে অমর হয়ে থাকবে। তার ছবি প্রদর্শিত হবে প্যারিস কিংবা সালভাদর ডা বাহিয়ায়! কিংবদন্তী হয়ে উঠবে মারিয়া? 

মারিয়ার মনের কথা বুঝতে পেরেই বোধহয় ওয়েট্রেস নরম গলায় বলল, ‘উনি খুব বিখ্যাত আর্টিস্ট।’ 

মারিয়া যা ভেবেছে! সে উল্লাস প্রকাশ না করে শান্ত ভাব ফুটিয়ে রাখল চেহারায়। 

‘উনি মাঝে মাঝে এখানে আসেন। সঙ্গে থাকেন দামী ক্লায়েন্ট। এ বার এর পরিবেশ নাকি তাঁর ভালো লাগে। তাই এখানে আসেন। উনি বিখ্যাত লোকদের ছবিই বেশি আঁকেন। চেম্বারে বসা মানুষটি রসায়নবিদ। নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।’

‘যাবেন না,’ চিত্রশিল্পী বলল আবার। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে আমার। আপনি যা ইচ্ছে খেতে পারেন। সব খরচ আমার।’ 

মারিয়াকে যেন সম্মোহন করা হয়েছে, সে বার-এ এসে বসে পড়ল। একটা অ্যানিসেটের অর্ডার দিল। দেখছে লোকটার কাজ। 

‘আমি বিখ্যাত কেউ নই। কাজেই অন্য কোনও ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এ লোক আমার ঘরানার নয়।’ 

মারিয়া দেখছে কত দ্রুত ছবি আঁকছে যুবক। ক্যানভাসটা খুব বড়। মুখ দেখতে পাচ্ছে না মারিয়া। এমন যদি হয় ওর জন্য নতুন কোনও সুযোগ সৃষ্টি হলো? এ লোককে দেখে মনে হচ্ছে না সে মারিয়ার সঙ্গে রাত কাটানোর প্রস্তাব দেবে! 

ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে কাজ শেষ করল চিত্রকর। 

মারিয়া এতক্ষণ ব্রাজিলের কথা ভেবেছে, ওখানে কী রকম উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে তার কথা চিন্তা করেছে। 

‘ধন্যবাদ, এখন আপনি নড়াচড়া করতে পারেন,’ চিত্রশিল্পী বলল রসায়নবিদকে, তিনি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। মারিয়ার দিকে ফিরল সে, সরল গলায় বলল : 

‘ওই কোণায় গিয়ে আরাম করে বসুন। আলোটা চমৎকার।’ 

‘যেন সবকিছু নিয়তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যেন এরচে’ স্বাভাবিক ঘটনা আর নেই, যেন এই মানুষটিকে সারাজীবন ধরে চেনে মারিয়া অথবা এ মুহূর্তটিকে সে স্বপ্নে দেখেছে এবং এখন জানে বাস্তবে কী করতে হবে, মারিয়া অ্যানিসেটের গ্লাস, নিজের ব্যাগ এবং খামারের ওপর লেখা বই নিয়ে লোকটার নির্দেশিত জায়গায় চলে এল- জানালার ধারের একটি টেবিলে। চিত্রকর ব্রাশ, বড় ক্যানভাস, নানান রঙ মেশানো কতগুলো ছোট বোতল এবং এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল মারিয়ার পাশে। 

‘এখন নড়াচড়া করবেন না।’ 

‘আমার জীবন সারাক্ষণ নড়াচড়ার মধ্যেই আছে।’ 

মারিয়া ভাবল খুব বুদ্ধিদীপ্ত একটা মন্তব্য করেছে। তবে লোকটা কোনও কথা বলল না। স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করল মারিয়া, কারণ মানুষটা যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে তা রীতিমত অস্বস্তিকর। সে রাস্তার ফলকের দিকে ইঙ্গিত করল! 

‘রোড টু সান্তিয়াগো’ কথাটার মানে কী?’ 

‘ওটা তীর্থযাত্রীদের রাস্তা। মধ্যযুগে গোটা ইউরোপ থেকে লোক আসত এখানে, এ রাস্তা ধরে যেত স্পেনের শহর সান্তিয়াগো ডি কমপোস্তেলায়।’ 

চিত্রকর ক্যানভাসের একটা কিনারা মুড়ে নিল, প্রস্তুত করল ব্রাশ। মারিয়া বুঝতে পারছে না কী করবে। 

‘আমি ওই রাস্তা ধরে হাঁটলে স্পেনে পৌঁছে যাব?’ 

‘হ্যাঁ। দুই তিন মাস লাগবে। এটা কথা বলি? দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকুন। আমার দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। জিনিসপত্রগুলো টেবিল থেকে নামিয়ে ফেলুন।’ 

‘এগুলো বই,’ লোকটার কর্তৃত্ব সুলভ সুরে খানিকটা বিরক্ত মারিয়া, তার ইচ্ছে করল লোকটাকে বলে সে সংস্কৃতিমনা এক নারীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে যার বেশিরভাগ সময় কাটে লাইব্রেরিতে, দোকানে নয়। কিন্তু লোকটা নিজেই বইগুলো মেঝেতে নামিয়ে রাখল। তারপর আঁকতে শুরু করল ছবি। নোবেল বিজয়ীর ছবি যেমন গভীর মনোযোগে আঁকছিল সে, সেভাবে ক্যানভাসে তুলি চালাচ্ছে। মারিয়া ভাবল লোকটা তার ছবি এঁকে দেয়ার জন্য আবার পয়সা চাইবে না তো? 

‘জানালার দিকে ঘুরুন।’

বিনা প্রতিবাদে লোকটার নির্দেশ পালন করল মারিয়া। এটা তার চরিত্রের সঙ্গে যায় না। সে রাস্তার লোক দেখছে, দেখছে হলুদ ফলক। ভাবছে কয়েক শতক আগে এ রাস্তাটার চেহারা কেমন ছিল। এর মধ্যে মানবসভ্যতার কত পরিবর্তন হয়েছে। রাস্তাটার কতটা উন্নতি হয়েছে? হয়তো এ লোকের ছবিও শহরে জাদুঘরে ঝোলানো থাকবে পাঁচশ বছর ধরে… 

ছবি এঁকে চলেছে লোকটা। কিন্তু মারিয়া ভেতরে শুরুর সেই উত্তেজনাটা খুঁজে পাচ্ছে না এবং নিজেকে অপ্রয়োজনীয়, অগুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। অস্বস্তিবোধের কারণটাও অবশ্য ধরে ফেলল মারিয়া। আসলে বহুদিন বাদে কেউ তাকে স্রেফ পণ্য হিসেবে দেখছে না, নারী হিসেবেও নয়। এমন কিছু হিসেবে যা ঠিক মারিয়ার উপলব্ধিতে আসছে না। ওর মনে হচ্ছে, ‘এ লোক আমার আত্মা দেখতে পাচ্ছে, আমার ভয়, আমার দুর্বলতা, আমি সব জানি বলে যে ভান করি আসলে কিছুই জানি না, তাও সে বুঝে ফেলছে। 

‘আমি একটু…’ 

‘প্লিজ, কথা বলবেন না।’ বলল লোকটা, ‘আমি এখন আপনার আলো দেখতে পাচ্ছি।’ 

এর আগে কেউ এমন করে বলে নি মারিয়াকে। তারা বলেছে ‘আমি তোমার খাড়া খাড়া মাই দেখছি,’ ‘তোমার সুডৌল উরু দেখছি, ‘তোমার মধ্যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মাথা খারাপ করা রূপ দেখতে পাই,’ ইত্যাদি। এ ধরনের মন্তব্য শুনে অভ্যস্ত মারিয়া। কিন্তু তার আলো? লোকটা কি গোধূলি বেলার আলো বোঝাচ্ছে? 

‘আপনার ভেতরকার আলো,’ মারিয়া তার কথা বুঝতে পারে নি বলে মন্তব্য করল চিত্রকর। 

তার ভেতরকার আলো! হায়, এ চিত্রশিল্পী তো মারিয়া সম্পর্কে কিছুই জানে না। মারিয়া জানে তার ভেতরে কোনও আলো নেই। সে আর দশটি মেয়ের মতই সাধারণ, নীরবে নিজের একাকীত্ব সহ্য করে, কৃতকর্মের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে, যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সবল হবার ভান করে। 

আলো ঘরে কীভাবে প্রবেশ করে? খোলা জানালা দিয়ে। আলো মানুষের ভেতরে কীভাবে প্রবেশ করে? ভালোবাসার খোলা দরজা দিয়ে। কিন্তু মারিয়ার দরজা তো বন্ধ। এ লোক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হতে পারে বটে তবে সে জানে না কিছুই। 

‘কাজ শেষ,’ বলল যুবক, গোছাতে শুরু করল জিনিসপত্র। 

মারিয়া নড়ল না। যেখানে বসা ছিল, বসে রইল। মন চাইছে জিজ্ঞেস করে ছবিটি দেখা যাবে কিনা। একবার ভাবল বলবে না। কিন্তু কৌতূহলের জয় হলো। দেখতে চাইল সে ছবি। চিত্রকর ওর মুখ এঁকেছে শুধু। তার অবিকল চেহারা। এ ছবি যদি সে অন্য কোনওদিন দেখত, যদি না জানত মডেলটা কে, মারিয়া বলত ছবির মেয়েটি যেন আলোয় উদ্ভাসিত। 

‘আমার নাম র‍্যালফ হার্ট,’ নিজের পরিচয় দিল যুবক। ‘আপনাকে আরেকটা ড্রিঙ্ক দিতে বলি?’ 

‘না, ধন্যবাদ।’ 

‘আরও দু’টো অ্যানিসেট, প্লিজ, মারিয়ার জবাব অগ্রাহ্য করল সে, ফিরল মারিয়ার দিকে। ‘আপনি কী করেন?’ 

এ প্রশ্নটা শুনতে চায় না মারিয়া। তবু শুনতে হয়। জবাব দিল :

‘নাইটক্লাবে কাজ করি।’ 

একটা বোঝা যেন নেমে গেল কাঁধ থেকে। 

‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আগে কোথাও যেন দেখেছি।’ 

মারিয়ার মনে হলো লোকটা ওর সঙ্গে সেধে আলাপ জমাতে চায়। এ লোক কিছুক্ষণ আগে তাকে হুকুম করছিল, নিশ্চিত ছিল, কিন্তু এখন তাকে লাগছে আর দশটা পুরুষের মত, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে যেন। 

‘এই বইগুলো কীসের?’ 

তাকে বইগুলো দেখাল মারিয়া। খামার প্রকল্প গঠন। লোকটাকে আরও বেশি অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। 

‘আপনি কি যৌনকর্মী?’ 

লোকটার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। মারিয়ার পোশাক দেখে কি মনে হয় সে পতিতা? খেলাটা উপভোগ করছে মারিয়া। ওর তো হারাবার কিছু নেই। 

‘পুরুষ মানুষের মাথায় বুঝি এ ছাড়া অন্য কিছু নেই?’ 

লোকটা ব্যাগে রেখে দিল বই। 

‘সেক্স এবং ফার্ম ম্যানেজমেন্ট। দু’টোই খুব বিরক্তিকর, নীরস বিষয়।’ 

কী! খুব রাগ হলো মারিয়ার। তার পেশা সম্পর্কে বাজে কথা বলার সাহস পায় কী করে এ লোক? মারিয়া ঠিক কী করে তা এখনও জানে না সে, স্রেফ অনুমান করেছে। সে লোকটাকে উপযুক্ত জবাব দেবে সিদ্ধান্ত নিল। 

‘আমার কাছে কিন্তু ছবি আঁকার চেয়ে নীরস কাজ অন্য কিছু মনে হয় না। চুপচাপ পাথর হয়ে বসে থাকো, তার একটা ছবি আঁকো। এ যেন ফটোগ্রাফ, অরিজিনালের ধারে কাছেও যেতে পারে না। এই মরা জিনিস শুধু চিত্রকর ছাড়া আর কারও কাছে কোনও অর্থ বহন করে না। আপনি জোন মাইরোর নাম শুনেছেন? এক আরব ভদ্রলোকের কাছে একটি রেস্টুরেন্টে বসে নামটি প্রথম শুনি আমি। তবে ওই নাম আমার জীবনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি।’ 

খুব বেশি কথা বলে ফেলল নাকি, ভাবল মারিয়া। ইতিমধ্যে ড্রিঙ্ক চলে আসায় ছেদ পড়ল আলোচনায়। চুপচাপ মদ গিলল দু’জনে কিছুক্ষণ। এখন ওটা থাক, ভাবল মারিয়া। র‍্যালফ হার্টও হয়তো একই কথা ভাবছে। কিন্তু বিশ্রী স্বাদের পানীয় বাধা হয়ে দাঁড়াল। ওরা এখনও শেষ করতে পারে নি গ্লাস দু’টো। 

‘ফার্ম ম্যানেজমেন্টের ওপরে বই কেন? 

‘মানে?’ 

‘আমি রু ডি বার্নেতে গিয়েছিলাম। আপনি যে-ই বললেন নাইটক্লাবে কাজ করেন, মনে পড়ে গেল ওখানে দেখেছি আপনাকে। তবে ছবি আঁকার সময় এসব ভাবিনি আমি। যদিও আপনার ‘আলো’টা খুব শক্তিশালি ছিল।’ 

মারিয়ার মনে হলো তার পায়ের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। এই প্রথম যে কাজ করছে তার জন্য লজ্জা হলো ওর। যদিও লজ্জা পাবার কিছু ছিল না; কাজটা সে করছে নিজের পেট এবং পরিবারের সংসার চালাতে। লোকটারই বরং লজ্জা পাওয়া উচিত সে রু ডি বার্নেতে গেছে বলে; সাক্ষাতের সমস্ত আনন্দ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। 

‘শুনুন, মি. হার্ট, আমি ব্রাজিলিয়ান বটে তবে সুইটজারল্যান্ডে আছি গত ন’মাস ধরে। আমি বুঝতে পেরেছি সুইসরা এত সতর্কভাবে চলাফেরা করে কারণ এটা খুব ছোট একটা দেশ এবং এখানে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। আপনার সঙ্গে আমার মাত্র পরিচয় হলো, কাজেই আমি কী করি না করি তা জিজ্ঞেস করা মোটেই উচিত হয়নি। 

‘আপনি যদি মনে করে থাকেন আমাকে অপমান করে মজা পাবেন, বলব বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আপনার বিশ্রী স্বাদের অ্যানিসেটির জন্য ধন্যবাদ। আমি ড্রিঙ্কটা শেষ করব। তারপর একটা সিগারেট ধরাব, সবশেষে চলে যাব। তবে আপনি চাইলে এখন চলে যেতে পারেন। একজন পতিতার সঙ্গে একজন বিখ্যাত চিত্রকরের একই টেবিলে বসে থাকা মানায় না। কারণ আমি তা-ই। একজন পতিতা। আমি আপাদমস্তক একজন পতিতা এবং এটা যে খুশি জানুক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার সবচেয়ে বড় গুণ ওটাই : নিজের সঙ্গে প্রতারণা করি না আমি।’ গলার স্বর ক্রমে চড়া হয়ে উঠল মারিয়ার। 

‘হ্যাঁ, আমি একজন পতিতা। আমি আর নব্বই দিনের মধ্যে এই বাজে জায়গাটা ছেড়ে চলে যাব। সঙ্গে থাকবে প্রচুর টাকা, ব্যাগ ভর্তি তুষারপাতের ছবি এবং এখানকার লোকদের আগাপাশতলা জেনে নেয়ার অভিজ্ঞতা!’ 

আতঙ্কিত হয়ে মারিয়ার কথা শুনছে ওয়েট্রেস। তবে রসায়নবিদ এদিকে নজর দিচ্ছেন বলে মনে হলো না। হয়তো ভেবেছেন মাতাল হয়ে আবোল তাবোল বকছে মেয়েটা। 

‘আমার কথা বুঝতে পারছেন, মি. হার্ট? আমি আগাগোড়া একজন পতিতা, পায়ের নখের ডগা থেকে চুল পর্যন্ত- আর এটাই আমার বড় গুণ?’ 

চিত্রকর শুনছে। নড়াচড়া করতেও যেন ভুলে গেছে। মারিয়া আত্মবিশ্বাসের তুফান টের পেল বুকের মাঝে 

‘এবং আপনি, স্যার, একজন চিত্রকর যিনি মডেলদের মন বোঝেন না। আমি বুঝতে পারি না আপনি কী করে একটি মেয়ের মধ্যে ‘বিশেষ আলো’ দেখতে পান যে কিনা স্রেফ পতিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়! শেষ শব্দগুলো ধীরে এবং উচ্চকিত কণ্ঠে বলা হলো। ঝিমুতে থাকা রসায়নবিদ যেন ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠলেন, ওয়েট্রেস বিল নিয়ে এল। 

‘আপনাকে পতিতা হিসেবে দেখিনি আমি, দেখেছি একজন নারী হিসেবে,’ বিলের দিকে তাকাল না র‍্যালফ, ধীর, শান্ত গলায় বলল, ‘আপনার মধ্যে একটা আলো আছে। জ্বলজ্বল করছে। আলোটা এসেছে তীব্র ইচ্ছা শক্তি থেকে। আলোটা আছে আপনার চোখে।’ 

অসহায় বোধ করল মারিয়া। এ লোক তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। মারিয়া ভেবেছে এ লোক তাকে বিছানায় নিয়ে যেতে চাইছে। ও আর কিছু যেন ভাবতে পারছে না। 

‘আপনি গ্লাসের মধ্যে অ্যানিসেট দেখতে পাচ্ছেন?’ বলে চলল চিত্রকর। ‘আপনি শুধু অ্যানিসেট দেখেন কিন্তু আমি দেখি অন্য কিছু। কারণ আমি যা করি তার ভেতরের জিনিসটা দেখতে চাই। আমি দেখি গাছটা কোত্থেকে এল, প্রবল ঝড়ো বাতাস সয়ে কীভাবে টিকে রইল ওটা, দেখতে পাই যে হাত শস্য তুলেছে সে হাত, দেখি জাহাজে করে নিয়ে আসা হচ্ছে ওটাকে, অ্যালকোহলে পরিণত হবার আগে এর গন্ধ এবং রঙ কী রকম ছিল দেখতে পাই। কিন্তু আপনি যখন ছবির দিকে তাকাবেন, শুধু এক গ্লাস অ্যানিসেট দেখতে পাবেন। 

‘আপনি যখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আমি আপনার শৈশব, কৈশোর, আপনার ডানা ভাঙা স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, আপনার ইচ্ছা শক্তি- সব আমি এঁকে ফেলেছি… 

মারিয়া কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে। কিছু বলতে পারছে না। থমথমে নীরবতা নেমে এল দু’জনের মাঝে। অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলতে ঘড়ি দেখল মারিয়া। 

‘আমি এখন উঠব। আপনি বললেন কেন সেক্স বিরক্তিকর জিনিস?’ 

‘এ প্রশ্নের জবাব আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন।’ 

‘আমি জানি কারণ এটা আমার কাজ। একই কাজ আমি প্রতিদিন করি। কিন্তু আপনি ত্রিশ বছরের যুবক…’ 

‘উনত্রিশ।’ 

‘… তরুণ, সুদর্শন, বিখ্যাত, আপনার তো সঙ্গীর খোঁজে রু ডি বার্নেতে যাবার কথা নয়।’

‘কিন্তু আমি গিয়েছি। আপনার ক’জন সহকর্মীর সঙ্গে বিছানাতেও গেছি। নারী সঙ্গের অভাবের কারণে নয়, সমস্যাটা আমার নিজেকে নিয়ে। 

মারিয়া ঈর্ষার খোঁচা অনুভব করল, একই সঙ্গে আতঙ্কিতও হলো। ওর এখনই চলে যাওয়া উচিত। 

‘ওটা ছিল আমার শেষ চেষ্টা। এখন আশা ছেড়ে দিয়েছি।’ ‘কোনও শারীরিক সমস্যা?’ 

‘না। আয়্যাম জাস্ট নট ইন্টারেস্টেড।’ 

এ হতে পারে না। 

‘বিল মিটিয়ে চলুন একটু হাঁটি। আমার ধারণা অনেকেরই এরকম সমস্যা হয় তবে কেউ স্বীকার করে না। আপনার মত সরল স্বীকারোক্তি ও কেউ দেয় না।’ 

সান্তিয়াগোর রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। রাস্তাটা প্রথমে খাড়া হয়ে পরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে। এরপর লেকের দিকে মোড় নিয়েছে, তারপর পাহাড়ের দিকে সেঁধিয়েছে, হারিয়ে গেছে দিগন্ত রেখায়, স্পেনের কোথাও। লাঞ্চ শেষে কাজে ফিরছে মানুষ। মা প্রাম ঠেলছেন, ট্যুরিস্টরা লেকের মাঝখানে রূদ্ধশ্বাস সৌন্দর্যের আঁধার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝর্ণার ছবি তুলছে, মুসলিম মহিলাদের মাথায় রুমাল জড়ানো, ছেলে-মেয়েরা জগিংয়ে ব্যস্ত। এরা যেন সবাই তীর্থযাত্রী, চলেছে পৌরাণিক শহর সান্তি য়াগো ডি কমপোস্তেলা’র খোঁজে। এদের সঙ্গে সামিল হয়েছে লম্বা চুলের এক যুবক, তার কাঁধে ভারী ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি ব্রাশ, রঙ, ক্যানভাস, পেন্সিল তার পাশে এক তরুণী। এই সুন্দরীর কাঁধেও আছে একটি ব্যাগ। ব্যাগটিতে খামার বাড়ি সম্পর্কিত বইপত্র। এরা কেন এ রাস্তা ধরে হাঁটছে জানে না, যেন এটাই পৃথিবীর সবচে’ স্বাভাবিক ঘটনা; যুবক মেয়েটির সম্পর্কে সব কিছু জানে কিন্তু মেয়েটি ছেলেটি সম্পর্কে কিছুই জানে না। 

মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করবে তার সম্পর্কে। প্রথমে ইতস্তত করল যুবক। তবে মেয়েটি জানে কীভাবে পুরুষের পেট থেকে কথা বার করতে হয়। যুবক জানায় সে দু’বার বিয়ে করেছে (উনত্রিশ বছরের যুবকের জন্য এটা একটা রেকর্ড বটে), নানান দেশ ঘুরেছে, রাজা রানী, বিখ্যাত অভিনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে বহু পার্টিতে গেছে। তার জন্ম জেনেভায়, তবে বেড়ে ওঠা মাদ্রিদ, আমস্টারডাম, নিউ ইয়র্ক এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের তারবেস শহরে। এটি পর্যটন কেন্দ্র না হলেও এ শহরকে তার ভালো লাগে পাহাড় সারি এবং উষ্ণ হৃদয়ের অধিবাসীদের জন্য। কুড়ি বছর বয়সে আর্টিস্ট হিসেবে সে নাম কামায়। সে এই জীবনে বহু টাকা রোজগার করেছে, সে যথেষ্ঠ ধনী। সে যা কিছু করতে পারে, যেখানে খুশি যেতে পারে, যার সঙ্গে ইচ্ছা সাক্ষাৎ করতে পারে, একজন পুরুষ মানুষ যত রকম ভাবে জৈবিক আনন্দ লাভ করতে পারে, সব রকম অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে। কিন্তু সব থাকা সত্ত্বেও, খ্যাতি, টাকা, নারী, ভ্রমণ, সে অসুখী, তার জীবনে আনন্দ পাবার উপকরণ একটিই— তার কাজ। 

‘আপনাকে কি মেয়েরা ব্যথা দিয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল মারিয়া। প্রশ্নটা বোকার মত হয়ে গেছে বুঝতে পারল পরক্ষণে। 

‘না, মেয়েরা কখনও আমাকে ব্যথা দেয়নি। দুই স্ত্রীকে নিয়েই আমি সুখী ছিলাম। তবে তাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারিনি আমি, তারাও পারেনি। সাধারণ আর দশটা দম্পতির মতই। এরপর আমি সেক্সের ব্যাপারে পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমি এখনও ভালোবাসার তাগিদ অনুভব করি, সঙ্গ চাই, তবে সেক্স… কিন্তু আমরা সেক্স নিয়ে কথা বলছি কেন?’ 

‘কারণ আপনি নিজেই তো বললেন আমি একজন পতিতা।’ 

‘আমার জীবন খুব একটা চিত্তাকর্ষক নয়। আমি খুব কম বয়সে সাফল্য পেয়ে গেছি যা খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জোটে। আমি এখন যা-ই আঁকি না কেন, প্রচুর দামে বিকোয়। সমালোচকরা অবশ্য ক্রুদ্ধ হয়। কারণ তারা মনে করে তারাই একমাত্র ‘চিত্রকলা’ সম্পর্কে তাবৎ জ্ঞান রাখে।’ 

নিজের জীবন সম্পর্কে বলে যেতে লাগল চিত্রকর, জানাল প্রতি সপ্তাহে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তার আমন্ত্রণ আসে। বার্সেলোনায় তার একজন এজেন্ট আছে- মারিয়া কি জানে ওটা কোথায়? হ্যাঁ, মারিয়া জানে, ওটা স্পেনে। 

এ এজেন্ট চিত্রকরের সব কিছুর দেখ ভাল করে। তার টাকা, নিমন্ত্রণ, প্রদর্শনী। তবে সে চিত্রকরকে কখনও চাপ দিয়ে কিছু করতে বলে না। এখন তার ছবির দারুণ চাহিদা। 

‘আমার গল্প কেমন লাগল?’ জিজ্ঞেস করল র‍্যালফ হার্ট। 

‘অন্যরকম। অনেক মানুষ আপনার সঙ্গে মিলিত হতে চাইবে।’ 

র‍্যালফ মারিয়া সম্পর্কে জানতে চাইল। 

‘আসলে আমি তিনজন, বিষয়টা নির্ভর করে কার সঙ্গে কখন আছি তার ওপর। প্রথমজন নিষ্পাপ এক বালিকা, যে পুরুষের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ভান করে পুরুষের শক্তি ও শৌর্যের গল্প শুনে বিমোহিত। দ্বিতীয়জন চটুল এক নারী, যে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সর্বশেষ জন বোদ্ধা একজন মা যে এক কান দিয়ে গল্প শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। আপনি কোন জনের কথা জানতে চান?’ 

‘শুধু তোমার সম্পর্কে, ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এল র‍্যালফ।

মারিয়া নিজের সম্পর্কে সব বলল ওকে। ব্রাজিল থেকে চলে আসার পরে এই প্রথম নিজেকে উজাড় করে দিল কারও কাছে। আবিষ্কার করল আসলে রিওতে ওই প্রথম সপ্তাহ এবং সুইটজারল্যান্ডে প্রথম মাসটা বাদে উত্তেজক তেমন কিছু ঘটে নি ওর জীবনে। শুধু বাড়ি, কাজ, বাড়ি, কাজ— অন্য কিছু নয়। 

কথা শেষ করে ওরা আরেকটি বার-এ এসে বসল। এ বারটি শহরের আরেকপ্রান্তে, সান্তিয়াগো রোড থেকে অনেক দূরে। ওরা একে অন্যের কথা ভাবছে। ভাবছে নিয়তি ওদের জন্য কী নির্ধারণ করে রেখেছে কে জানে। 

‘পুরো ছবি কবে দেখতে পাব?’ জানতে চাইল মারিয়া। 

বার্সেলোনার এজেন্টের কার্ড ওকে দিল র‍্যালফ। 

‘মাস ছয় পরে একে ফোন কোরো, যদি তখনও ইউরোপে থাকো। দ্য ফেসেস অব জেনেভা নামে প্রদর্শনী হবে, বার্লিনে। তারপর ইউরোপে ট্যুর হবে।’ 

ক্যালেন্ডারের কথা মনে পড়ল মারিয়ার। আর নব্বই দিন হাতে আছে। সে ভাবল : 

‘জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কী? বেঁচে থাকা নাকি বেঁচে থাকার ভান করা? আমি কী ঝুঁকি নিয়ে বলব এখানে যে ক’টি দিন ছিলাম তার মধ্যে সবচে’ সুন্দর বিকেলটা কেটেছে আজ। আমার কথা ও মনোযোগ দিয়ে শুনেছে, কোনও মন্তব্য করেনি বা বাধা দেয়নি বলে কী ওকে ধন্যবাদ দেব? নাকি স্রেফ নারীর ইচ্ছাশক্তির বর্ম পরে, কিছু না বলেই চলে যাব?’ 

ওরা যখন সান্তিয়াগোর রাস্তা ধরে হাঁটছিল, র‍্যালফকে যখন নিজের কথা বলছিল, নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছিল মারিয়ার। এ যেন জীবনের উপহারের থেকেও বেশি। ‘আমি আবার আসব। তোমাকে দেখতে,’ বলল র‍্যালফ। 

‘না, এসো না। শীঘ্রি ব্রাজিল ফিরে যাব আমি। আমাদের তো পরস্পরকে দেয়ার কিছু নেই।’ 

‘আমি তোমার ক্লায়েন্ট হিসেবে আসব। 

‘তাহলে ওটা আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার শামিল হবে।’ 

‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। তুমি আমাকে রক্ষা করতে পারবে।’

এ মন্তব্য সে আগেও করেছে, বলেছে সেক্স নিয়ে তার কোনও আগ্রহ নেই। মারিয়ার ইচ্ছে করল বলে সেক্স নিয়ে তার অনুভূতিও একইরকম। নিজেকে চোখ রাঙাল ও- সে বহুবার ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে’, কিছু না বলাই ভালো। 

কী করুণ একটা ব্যাপার! সেই ছোট ছেলেটির সঙ্গে আবার একত্রিত হয়েছে মারিয়া। তবে সে এখন তার কাছে পেন্সিল চাইছে না, সামান্য সঙ্গ প্রার্থনা করছে। নিজের অভীতের দিকে ফিরে তাকায় মারিয়া, এবং প্রথমবারের মত ক্ষমা করে দেয় নিজেকে : ওটা তার দোষ ছিল না, 

ছিল নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ছোট ছেলেটির, সে প্রথমবার চেষ্টার পরেই হাল ছেড়ে দেয়। ওরা শিশু ছিল আর শিশুরা এরকমই হয়— আসলে তার এবং ছেলেটি, কারোরই কোনও দোষ ছিল না, এ উপলব্ধি স্বস্তি এনে দেয় মারিয়ার মাঝে, ওর মন ভালো হয়ে যায়। সে তার জীবনে আসা প্রথম সুযোগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে নি। জীবনে এরকমই ঘটে। 

কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সে যত কারণই দেখাক না কেন (আমি ব্রাজিলে ফিরে যাচ্ছি, আমি নাইটক্লাবে কাজ করি, আমরা পরস্পরকে খুব কমই চিনি, সেক্সের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই, প্রেম-ট্রেম আমার হবে না, কীভাবে খামার চালাতে হয় শিখতে চাই আমি, আমি চিত্রকলার কিছু বুঝি না, ভিন্ন পৃথিবীতে আমাদের বাস), জীবন তাকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। মারিয়া এখন আর শিশু নয়, একটা কিছু তাকে বেছে নিতে হবে। 

মারিয়া সিদ্ধান্ত নিল কিছুই বলবে না। সে র‍্যালফের সঙ্গে ও দেশের প্রথামাফিক হ্যান্ডশেক করল, তারপর বাড়ি ফিরে এল। ও যদি তার মনের মানুষ হয়ে থাকে, মারিয়ার নীরবতা তাকে ভীত করে তুলবে না। 

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, একই দিনে লেখা : 

আজ, যখন আমরা সান্তিয়াগোর অদ্ভুত রাস্তা ধরে, লেকের ধার দিয়ে হাঁটছিলাম, আমার সঙ্গী, চিত্রকর, যার জীবন আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা- জলে একখণ্ড নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারল। পাথরটা জলে পড়ল, তিরতির ঢেউ উঠল বৃত্ত সৃষ্টি করে, কাঁপতে কাঁপতে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে, একটা হাঁসের গা স্পর্শ করল। অপ্রত্যাশিত ঢেউ দেখে ভয় পেল না হাঁস, খেলা করতে লাগল। 

ওই ঘটনার কয়েকঘণ্টা আগে আমি একটি ক্যাফেতে ঢুকেছিলাম। সেখানে একটি কণ্ঠ শুনতে পাই, যেন ঈশ্বর একখণ্ড নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মেরেছেন ওই জায়গায়। শক্তির একটা ঢেউ আমাকে এবং ক্যাফের কিনারে বসে ছবি আঁকতে ব্যস্ত চিত্রকর, দু’জনকেই স্পর্শ করে। সে ওই পাথর খণ্ডের কম্পন টের পেয়ে যায়, আমিও। তো এখন কী? 

চিত্রকর জেনে যায় তার মডেলের উপস্থিতি, মিউজিশিয়ান বুঝতে পারে তার বাদ্য যখন ঠিকমত বাজে। আর আমি, আমার ডায়েরিতে যে সব কথা লেখা দেখতে পাই, বুঝতে পারি এ আমি লিখি নি, লিখেছে আলোয় ভরা ‘এক নারী’ সেই নারী যদিও আমি তবু তা অস্বীকার করি আমি। 

আমি এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারি জীবন, লেকের হাঁসটির মত আনন্দও গ্রহণ করতে পারি। 

ওই নুড়িখণ্ডটির একটি নাম আছে : প্যাশন। প্যাশন আমাদেরকে সঙ্কেত পাঠায় যা আমাদের জীবন চলার পথ প্রদর্শক হয়ে থাকে। 

আমার বিশ্বাস করতে মন চাইছে আমি প্রেমে পড়েছি। এমন একজনের প্রেমে পড়েছি যাকে আমি চিনি না, জানি না। যে আমার সাজানো পরিকল্পনার মধ্যে নেই। এতদিন ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণ করেছি, অস্বীকার করেছি ভালোবাসা, কিন্তু এখন ঘটছে তার বিপরীত ঘটনা : আমি নিজেকে ভাসিয়ে যেতে দিয়েছি তার কাছে যে আমাকে ভিন্ন চোখে দেখছে। 

তার ফোন নাম্বার আমার কাছে নেই, জানিও না সে কোথায় থাকে; আমি হয়তো তাকে হারিয়ে ফেলব, নিজেকে দোষী করব আরেকটি সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার জন্য। 

যদি তাই ঘটে, যদি ইতিমধ্যে তাকে হারিয়ে ফেলি আমি, অন্তত এটুকু সান্ত্বনা পাব ভেবে জীবনের অন্যতম সুখী একটি দিন উপভোগ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। পৃথিবী যে রকম নিষ্ঠুর, সেখানে এরকম একটি সুখী দিন পাওয়া অলৌকিকই বলব। 

ষোলো 

ওই রাতে কোপাকাবানায় গিয়ে মারিয়া দেখে র‍্যালফ তার জন্য অপেক্ষা করছে। খদ্দের বলতে একমাত্র সে-ই আছে। মিলান মারিয়াকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছিল। 

‘আমার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবে?’ জিজ্ঞেস করল র‍্যালফ। 

‘আমার কাজ আছে। চাকরি খোয়াতে চাই না।’ 

‘আমি এখানে খদ্দের হিসেবে এসেছি। তোমাকে পেশাদারী প্রস্তাব দিচ্ছি।’ 

এই মানুষটি, যাকে সেদিন বিকেলে ক্যাফেতে প্রবল আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল, যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলি চালাতে জানে ক্যানভাসের বুকে, যার সঙ্গে বড় বড় লোকের ওঠা-বসা, যার বার্সেলোনায় এজেন্ট আছে এবং নিঃসন্দেহে যে প্রচুর টাকা কামাই করে, সে এখন নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করছে; সে এমন এক জগতে প্রবেশ করেছে যেখানে তার আসা উচিত হয় নি; সে সান্তিয়াগো রোডের রোমান্টিক ক্যাফেতে আর নেই। বিকেলের আনন্দটা হঠাৎ মরে গেছে। 

‘তো, ড্রিঙ্ক করবে?’ 

‘পরের বার। আজ রাতে আমার ক্লায়েন্ট আছে।’ 

মিলান মারিয়ার শেষ কথাটা শুনে ফেলল। তবে পাত্তা দিল না। মারিয়া যার সঙ্গে খুশি বিছানায় যাক, সেটা তার ব্যাপার। মিলান নিজের কমিশন বুঝে পেলেই খুশি। মারিয়ার বিছানা সঙ্গীর ব্যাপারে সে সিদ্ধান্ত দেয়ার কেউ না। সেই রাতে, একজন বৃদ্ধ, একজন অ্যাকাউটেন্ট এবং একজন ইনস্যুরেন্স সেলসম্যানকে সঙ্গ দেয়ার পরে, মারিয়ার ডায়েরি থেকে : 

এই চিত্রকর আমার কাছে চায় কী? সে বুঝতে পারছে না আমাদের দু’জনের দেশ, সংস্কৃতি এবং সেক্স আলাদা? তার কী ধারণা আমি তাকে প্রচুর আনন্দ দিতে পারব এবং আমার কাছ থেকে কিছু শিখতে চাইছে? 

সে কেন ‘আমি এখানে একজন কাস্টমার হিসেবে এসেছি’ ছাড়া অন্য কিছু বলল না? তার জন্য কি একথাটা বলা সহজ ছিল না : ‘তোমাকে আমি মিস করছি’ কিংবা ‘তোমার সঙ্গে বিকেলটা আমি দারুণ উপভোগ করেছি?’ আমিও একইভাবে সাড়া দিতাম (কারণ আমি প্রফেশনাল)। আমার নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো তাকে বুঝতে হবে। কারণ আমি নারী, আমি দুর্বল। আমি যখন ওই জায়গাটাতে যাই, ভিন্ন একজন মানুষ হয়ে উঠি। ও পুরুষ। ও চিত্রকর। ওর বোঝা উচিত প্রতিটি মানুষের মূল লক্ষ্য হলো পরিপূর্ণ ভালোবাসার অর্থ বুঝতে পারা। ভালোবাসার দেখা যেখানে সেখানে মেলে না, ভালোবাসা পাওয়া যায় আমাদের মাঝে; আমরা এটাকে জাগিয়ে তুলি। কিন্তু এ কাজটা করার জন্য আরেকজনকে দরকার। পৃথিবী তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন আমরা পরস্পরের সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারি। ও বলেছে সেক্স নিয়ে ও ক্লান্ত। আমিও। আমরা কেউই জানি না এটা আসলে কী। ওর উচিত ছিল আমাকে রক্ষা করা, আমার উচিত ছিল ওকে রক্ষা করা। কিন্তু ও আমার জন্য সে রকম কোনও রাস্তা রাখে নি। 

সতেরো 

ভয় লাগছে মারিয়ার। বুঝতে পারছে দীর্ঘ মাসগুলোর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, চাপ, ভূমিকম্প, তার আত্মার অগ্নিগিরি এখন ইঙ্গিত দিচ্ছে বিস্ফোরণ ঘটল বলে। আর এটা যে মুহূর্তে ঘটবে— নিজের আবেগ-অনুভূতি আর চাপা দিয়ে রাখতে পারবে না মারিয়া। কে এই দুর্বৃত্ত চিত্রকর, যে হয়তো নিজের জীবন সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছে, যার সঙ্গে মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা কাটিয়েছে মারিয়া, সে তার হাতটা পর্যন্ত ধরে নি, তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করে নি- তার কথা এত মনে পড়ে কেন? 

কেন মারিয়ার বুকের মাঝে দুরুদুরু ঘন্টা বাজে? কারণ ও বুঝতে পারছে একই ঘটনা তার জীবনেও ঘটছে, না, মারিয়া ভুল বলছে। র‍্যালফ হার্টের আসলে এক নারীর দরকার যে তার ভেতরের আগুনটাকে জ্বালিয়ে দিতে পারে, যে আগুন র‍্যালফের বুকে প্রায় নিভে গেছে। 

মারিয়া কেন তার কথা ভাবছে? সেও কি মারিয়ার কথা ভাবছে নাকি এ মুহূর্তে অন্য কোনও নারীর ছবি আঁকছে এবং বলছে তার মধ্যে ‘বিশেষ এক আলো’ আছে এবং তাকেও মারিয়ার মতো সেক্স গডেস ভাবছে? 

র‍্যালফের কথা মন থেকে জোর করে দূর করার জন্য নানান কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখল মারিয়া। নিউ মার্কেটে গেল, তার বাবার কাছে চিঠি লিখল। জানাল কেমন ধরনের জমি সে কিনতে চাইছে। কবে ফিরবে তার কোনও দিনক্ষণ জানাল না, তবে শীঘ্রি যাবার ইঙ্গিত দিল। 

মারিয়া ঘুমাল। ঘুম থেকে জাগল। আবার ঘুমাল। সে লাইব্রেরি থেকে যে বইগুলো নিয়ে এসেছে, সুইস কৃষকদের তা খুব কাজে দেবে, তবে ব্রাজিলীয়দের কোনও কাজে লাগবে না- দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ। 

বিকেল নাগাদ টের পেল মারিয়া তার ভেতরের ভূমিকম্প, অগ্নিগিরি আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে। স্বস্তিবোধ করল সে; এরকম হঠাৎ আবেগের ঘটনা আগেও ঘটেছে, পরদিনই তা আবার থিতু হয়ে এসেছে— ভালো, তার পৃথিবী বদলাচ্ছে না। তার একটি পরিবার আছে যারা তাকে ভালোবাসে, একজন লোক আছে যে মারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে এবং তাকে ঘনঘন চিঠি লিখছে, বলছে তার দোকান আরও বড় করেছে। মারিয়া যদি আজ রাতেই প্লেনের টিকেট কাটে, ছোটখাট একটি খামার কেনার টাকা সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে। মারিয়া তার স্বপ্নের কথা জানে। এ স্বপ্ন পূরণে যা খুশি করতে পারবে সে। 

তবে তার এ স্বপ্নে সেরকম কোনও পুরুষের স্থান নেই যে কিনা মারিয়া মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না অথবা তার শহরে বাস করে না। 

ভূমিকম্পের রেশ কমে এলে মারিয়া বুঝতে পারল ওর নিজেরও দোষ আছে। ও কেন র‍্যালফকে বলল না : ‘আমি একা, তোমার মতই দুঃখী, গত রাতে তুমি আমার মাঝে আলো দেখেছ। এখানে আসার পরে কোনও পুরুষ মানুষ এই প্রথম এত সুন্দর কথা আমাকে বলল।’ 

রেডিওতে পুরানো দিনের গান বাজছে : ‘জন্মাবার আগেই মরে যায় আমার ভালোবাসা।’ হ্যাঁ, মারিয়ার জীবনেও তা-ই ঘটেছে, এটাই তার নিয়তি। 

দুইদিন পরে, মারিয়ার ডায়েরি থেকে : 

প্যাশন বা আবেগ একজন মানুষকে এমনভাবে পাগল করে তোলে সে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়, কাজে যেতে মন চায় না, ঘুম আসে না। প্যাশনকে অনেকে ভয় পায় কারণ এটা তার চলার পথে যা পায় সব ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে। 

কেউ চায় না তার জীবন বিড়ম্বনার মাঝে কাটুক। তবে কেউ কেউ তাদের সমস্যার সমাধান খোঁজে আবেগের মাঝে। তারা তাদের সুখ-দুঃখের জন্য অপরকে দায়ী করে। আমি জানি না আমি আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করব নাকি করব না। 

আঠারো 

তৃতীয় দিন, যেন কবর থেকে উঠে এসেছে, ফিরে এল র‍্যালফ হার্ট। কিন্তু মারিয়া তখন আরেক খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলছে। র‍্যালফকে দেখে খদ্দেরকে বিনীত গলায় মারিয়া বলল সে নাচতে যেতে পারবে না। কারণ আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। 

মারিয়া উপলব্ধি করতে পারছে সে আসলে গত তিনদিন ধরে র‍্যালফ হার্টের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ও নিজের নিয়তিকে মেনে নিল। 

নিজের সঙ্গে রাগ করল না মারিয়া; সে সুখী, সে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে, কারণ একদিন সে এ শহর ছেড়ে চলে যাবে; মারিয়া জানে এ ভালোবাসা সম্ভব নয়, তবুও কোনও কিছু প্রত্যাশা ছাড়াই সে জীবনের কাছে যা চেয়েছে তা পেতে পারে। 

র‍্যালফ জানতে চাইল মারিয়া তার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবে কিনা। মারিয়া ফ্রুট জুস ককটেল চাইল। বার-এর মালিক গ্লাস মোছার ভান করে সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল মারিয়ার দিকে। মেয়েটার মত বদলে যাবার কারণ কী? আশা করল ওরা এখানে বসে শুধু মদ পান করবে না, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেখল র‍্যালফ মারিয়াকে তার সঙ্গে নাচার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওরা রুটিন মাফিক কাজ করছে; দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোনও কারণ নেই। 

মারিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরল র‍্যালফের হাত, গালে ঠেকে রইল গাল। আর মিউজিক- ওহ্, এত চড়া, কথাই বলা যায় না। অবশ্য স্বল্প যে ক’টি বাক্য বিনিময় হলো দু’জনের মধ্যে তা নিতান্তই বাণিজ্যিক। এখন এটা স্রেফ সময়ের প্রশ্ন : ওরা কি হোটেলে যাবে? প্রেম করবে? কাজটা কঠিন কিছু হবে না। কারণ র‍্যালফ আগেই বলেছে সেক্সের ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ নেই— শুধু শরীরে শরীর মিলানো। 

আজ রাতে মারিয়ার ভূমিকা হবে ‘আন্ডারস্টান্ডিং মাদার’-এর, র্যালফ হার্ট অন্য সবার মতো বেপরোয়া একজন মানুষ। মারিয়া যদি নিজের ভূমিকায় ভালো খেলতে পারে, কোপাকাবানায় শুরু থেকে যে সব নিয়ম- কানুন অনুসরণ করে এসেছে সে, সেগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে চিন্তার কিছু নেই। তবে মানুষটাকে এত কাছে ঘেঁষতে দেয়াটা একদিক থেকে বিপজ্জনকই বটে, ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছে মারিয়া— গন্ধটা ভালো লাগছে ওর— ওর স্পর্শ টের পাচ্ছে- স্পর্শটা ভালো লাগছে মারিয়ার- বুঝতে পারল ও আসলে র‍্যালফের জন্যই অপেক্ষা করছিল— এই উপলব্ধিটা ভালো লাগল না ওর। 

.

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে, সমস্ত নিয়ম-কানুন পালন করল ওরা। লোকটি বার মালিকের কাছে গিয়ে বলল : 

‘আমি আজ সারারাত ওর সঙ্গে কাটাতে চাই। আমি তিনগুণ বেশি পারিশ্রমিক দেব।’ 

কাঁধ ঝাঁকাল বার মালিক। আবার ভাবল ব্রাজিলের মেয়েটা ভালোবাসার ফাঁদে পা দিতে চলেছে। মারিয়া প্রস্তাব শুনে বিস্মিত হলো। সে ধারণা করেনি র‍্যালফ হার্ট এখানকার নিয়ম-কানুন সব জানে। 

‘আমার বাসায় চলো।’ 

এটাই বরং ভালো, ভাবল মারিয়া। মিলানের পরামর্শের বিরুদ্ধাচারণ করা হয়ে যায়, তবু মারিয়া সিদ্ধান্ত নিল অন্তত এবার সে আইন ভঙ্গ করবে। র‍্যালফ হার্ট সত্যি বিয়ে করেছিল কিনা এটা জেনে নেয়াই শুধু নয়, ওর জানতে ইচ্ছা করছে বিখ্যাত চিত্রকররা কীভাবে বসবাস করে। একদিন এ নিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখবে মারিয়া। তাহলে সবাই জানতে পারবে ইউরোপে থাকাকালীন বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবান মহলের সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল মারিয়ার। 

আধঘণ্টা বাদে জেনেভার কাছে, কলোনি নামে ছোট একটি গাঁয়ে হাজির হলো ওরা। এখানে একটি গির্জা আছে, আছে বেকারী, টাউন হল, সবকিছু ছবির মত গোছানো, র‍্যালফ হার্ট সত্যি দোতলা একটি বাড়িতে বাস করে, অ্যাপার্টমেন্টে নয়! মারিয়ার প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো : র‍্যালফ সত্যি ধনী দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া : ওর যদি সত্যি বিয়ে হতো, এসব করার সাহস হতো না। কারণ কারও না কারও চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। 

তার মানে র‍্যালফ হার্ট ধনী এবং ব্যাচেলর। 

হলঘরে ঢুকল ওরা, সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়, চলে এল বাড়ির পেছন দিকের দুটি ঘরে। এখান থেকে বাগান দেখা যায়। একটি ঘরে আছে ডাইনিং টেবিল, দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলছে। অপর ঘরে রয়েছে সোফা এবং চেয়ার, বুক শেলফ, সিগারেট বোঝাই ছাইদানি এবং নোংরা গ্লাস। বোঝাই যায় অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। 

‘কফি খাবে?’ 

মাথা নাড়ল মারিয়া। খাবে না। তুমি আমাকে পটাতে পারবে না। আমি আমার ভেতরের দানবগুলোর সঙ্গে এখনও লড়াই করে চলেছি, নিজের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, করছি তার বিপরীত। তবে ধীরে ধীরে ঘটুক সব ঘটনা : আমি পতিতার ভূমিকায় অভিনয় করব, যদিও আমার আত্মার ভেতরে বাস করছে একটি কন্যা যে চায় আদর-স্নেহ। সব কিছুর সমাপ্তির পরে তুমি আমাকে কফি খাওয়াতে পার। 

‘বাগানের শেষ মাথায় আমার স্টুডিও, আমার আত্মা। এখানে যে সব পেইন্টিং এবং বইপত্র দেখছ এগুলো হলো আমার মস্তিষ্ক ‘ 

নিজের অ্যাপার্টমেন্টের কথা মনে পড়ল মারিয়ার। তার বাড়ির পেছনে কোনও বাগান নেই। তার কোনও বইও নেই শুধু লাইব্রেরি থেকে আনা বইগুলো ছাড়া। যে জিনিস মাগনা পাওয়া যায় তার জন্য পয়সা খরচ করে কে? মারিয়ার ঘরে কোনও পেইন্টিংও ঝুলছে না, শুধু সাংহাই অ্যাক্রোবেটিক সার্কাসের একটি পোস্টার ছাড়া। মারিয়া স্বপ্ন দেখে একদিন ওখানে যাবে। 

র‍্যালফ হুইস্কির একটি বোতল তুলে নিল, মারিয়ার দিকে এগিয়ে দিল একটি গ্লাস। 

‘না, ধন্যবাদ।’ 

নিজের গ্লাসে মদ ঢালল র‍্যালফ, এক ঢোকে সাবাড় করল পুরোটা- বরফ ছাড়াই। বুদ্ধিজীবীদের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগল সে। আলোচনা যতই মজার হোক না কেন, মারিয়া জানে যা ঘটতে চলেছে তা নিয়ে শঙ্কিত র‍্যালফ। কারণ ওরা এখন একা। পরিস্থিতি মারিয়ার নিয়ন্ত্রণে।

গ্লাসে আবার হুইস্কি ঢালল র‍্যালফ, তারপর উদাস গলায় বলল : 

‘আমি তোমাকে চাই।’

বিরতি। দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। মারিয়া ইচ্ছে করেই কথা বলল না। দেখতে চায় র‍্যালফ কী বলে। 

‘আমি তোমাকে চাই, মারিয়া। তোমাকে আমার দরকার। কারণ তোমার ভেতরে আছে আলো, যদিও জানি না তুমি সত্যি আমার কথা বিশ্বাস করেছ কিনা, হয়তো ভাবছ আমি কথা বলে তোমাকে প্রলুব্ধ করতে চাইছি। আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না : ‘কেন আমি? আমার মধ্যে বিশেষত্ব কী আছে?’ তোমার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই, অন্তত আমি কিছু দেখতে পাইনি। তবু- আমার জীবনের রহস্যই এটা— আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না।’ 

‘আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করবও না,’ মিথ্যা বলল মারিয়া। 

‘আমি যদি ব্যাখ্যা খুঁজতে যাই তো বলব : আমার সামনে যে নারীটি বসে আছে সে কষ্ট জয় করতে শিখেছে, ইতিবাচক কিছুতে তার রূপান্তর ঘটেছে, সৃষ্টিশীল কিছু, কিন্তু এ দিয়ে বোঝা যায় না কিছুই।’ 

বলে চলল র‍্যালফ : 

‘আর আমি কী? আমার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে, আমার ছবি আছে যা পৃথিবীর নানান দেশের গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়। আমি আমার স্বপ্ন উপলব্ধি করতে পেরেছি, আমার গ্রামের মানুষজন আমাকে মনে করে সৌভাগ্যের বরপুত্র, আমার সাবেক স্ত্রীরা কখনও খোরপোশ দাবি করেনি, আমার শরীর- স্বাস্থ্য ভালো, চেহারাও মন্দ নয়, একজন মানুষ যা চায় তার সবই আছে আমার… অথচ তবু আমি এখানে এক নারীকে বলছি, যার সঙ্গে এক বিকেলে ক্যাফেতে পরিচয়, তাকে বলছি। ‘আমি তোমাকে চাই।’ তুমি জানো একাকীত্বর মানে কী?’ 

‘জানি।’ 

‘কিন্তু তুমি জান না যখন সবার সঙ্গে থেকেও নিজেকে একা মনে হয় সে যন্ত্রণার কথা। তুমি প্রতিরাতে পার্টির দাওয়াত পাচ্ছ, ককটেল পার্টি হচ্ছে, থিয়েটারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান… মেয়েরা সবসময় ফোন করছে তোমাকে, সেইসব মেয়ে যারা তোমার কাজ পছন্দ করে, যারা বলে তোমার সঙ্গে সাপার করতে তাদের খুব ভালো লাগে- তারা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা নারী। কিন্তু কিছু একটা তোমাকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, বলে, ‘যেয়ো না। ওখানে আনন্দ পাবে না। সারা রাত ওদের আনন্দ দিতে এবং পৃথিবীকে কতটা আনন্দ দিতে পার এ প্রমাণ করতেই সমস্ত শক্তি খুইয়ে ফেলবে তুমি।’ 

‘তাই আমি বাড়িতেই থাকি, স্টুডিওতে যাই এবং তোমার মধ্যে যে আলো দেখেছি তা দেখার চেষ্টা করি। আর কাজ করার সময়ই কেবল আলোটা দেখতে পাই।’ 

‘কিন্তু তোমাকে আমি কী দিতে পারি যা তোমার নেই?’ জিজ্ঞেস করল মারিয়া। 

তিন নম্বর হুইস্কি গিলল র‍্যালফ। গলা জ্বালিয়ে পেটে নেমে গেল তরল পদার্থটা, ঢুকল রক্ত স্রোতে, সাহস জাগিয়ে তুলল মনে, মারিয়াও কেমন নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে, যদিও এক ফোঁটা মদও স্পর্শ করেনি। আবার র‍্যালফ যখন কথা বলল, সংহত শোনাল কণ্ঠ! 

‘আমি তোমার ভালোবাসা কেনার স্পর্ধা করি না। তবে আমাকে বলেছ সেক্স সম্পর্কে সবকিছু জান তুমি। তাহলে আমাকে শেখাও। অথবা ব্রাজিলের গল্প বলো। যা খুশি করো। যতক্ষণ তোমার সঙ্গে আমি আছি যা ইচ্ছা বলতে পার তুমি। 

এরপরে কী? 

‘আমি আমার দেশের মাত্র দুটি জায়গা চিনি : আমার শহর যেখানে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং রিও ডি জেনিরো আর সেক্সের কথা যদি বলো, মনে হয় না তোমাকে কিছু শেখাতে পারব। আমি তেইশে পা দেব, আমার চেয়ে তুমি বয়সে ছ’বছরের বড়। তবে আমি জানি তুমি দারুণভাবে জীবনযাপন করছ। লোকে আমাকে টাকা দেয় তারা যা করতে চায় সেজন্য। আমি কী চাই সেজন্য নয়। 

‘একজন পুরুষ যেসব কাজ করার স্বপ্ন দেখে তার কোনওটিই বাদ দিইনি আমি, একবারে তিনটি মেয়েকে নিয়েও বিছানায় গেছি। কিন্তু শিখতে পারিনি কিছুই।’ 

আবার নীরবতা, তবে এবারে মারিয়ার কথা বলার পালা। 

‘তুমি কি প্রফেশনাল হিসেবে আমাকে চাইছ?’ 

‘তুমি যেভাবে চাইছ সেভাবে আমি তোমাকে চাই। তুমি জানো, মারিয়া, আমি কী বলেছি। আমাকে শেখাও। এভাবেই হয়তো রক্ষা পাব আমি। তুমিও হয়তো রক্ষা পাবে, দু’জনেই ফিরে পাব জীবন। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি তোমার চেয়ে মাত্র ছ’বছরের বড়। কিন্তু এ বয়সেই অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে আমার। আমাদের দু’জনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম, তবে দু’জনেই বেপরোয়া।’ 

ও এসব কথা বলছে কেন? এটা সম্ভব নয় তবু এটাই সত্যি। তারা এর আগে মাত্র একবার সাক্ষাৎ করেছে তবু তাদের পরস্পরকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ভাবা যায় ওরা যদি পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে কী ঘটবে; ধ্বংসাত্মক একটা ঘটনা ঘটবে। 

মারিয়া বুদ্ধিমতী নারী, বহুদিন ধরে বই পড়ছে সে, পর্যবেক্ষণ করছে মানুষ; তার জীবনের একটা লক্ষ্য আছে, কিন্তু তার একটা আত্মাও আছে, ‘আলো’কে জানার জন্য যে আত্মার তার প্রয়োজন। সে যা তা নিয়ে বেজায় ক্লান্ত, যদিও শীঘ্রি ব্রাজিলে ফিরে যাবার বিষয়টা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে, তবে সে মনে করে তার শিক্ষা এখনও সম্পূৰ্ণ হয়নি। র‍্যালফ হার্ট চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে শিখেছে সব কিছু, আর এখন সে এই মহিলাকে, এই পতিতাকে অনুরোধ করছে তাকে রক্ষা করার জন্য, কী অদ্ভুত! 

মারিয়ার সঙ্গে আরও অনেক পুরুষ এরকম আচরণ করেছে। অনেকের যৌন উত্তেজনা জাগ্রত হয়নি, কেউ বা শিশুদের মত আদর খেতে চেয়েছে, কেউ বা মারিয়াকে তার বউ করতে চেয়েছে কারণ তারা জেনে উত্তেজিত হয়েছে মারিয়ার প্রেমিকের সংখ্যা অসংখ্য। মারিয়ার সঙ্গে যদিও ‘বিশেষ ক্লায়েন্ট’দের কারও এখন তক সাক্ষাৎ হয়নি, তবে মানব আত্মায় পূর্ণ ফ্যান্টাসির এই বিশাল জগত ইতিমধ্যে সে আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের পৃথিবীতে থেকে অভ্যস্ত এবং কেউ মারিয়াকে বলেনি : 

‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’ উল্টো তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে মারিয়াকে । 

অনেক পুরুষ মারিয়াকে টাকা দিয়েছে, বদলে শুষে নিয়েছে তার শক্তি। তবে মারিয়া এসব থেকেও কিছু না কিছু শিখেছে। এদের কেউ যদি সত্যি ভালোবাসার সন্ধান করে এবং সেক্স যদি সত্যি সেই অনুসন্ধানের একটা অংশ হয়ে থাকে, তাহলে এখানে মারিয়ার জায়গা কোথায়? প্রথম সাক্ষাতে কী ঘটবে বলে সে মনে করে? 

সত্যি কী ঘটবে বলে সে আশা করে? 

‘আমি একটি উপহার চাই,’ বলল মারিয়া। 

তার কথা বুঝতে পারল না র‍্যালফ হার্ট। উপহার? 

সে রাতের টাকা অগ্রিম চুকিয়ে দিয়েছে আগেই, ট্যাক্সিতে বসে। কারণ নিয়মকানুন জানা আছে র‍্যালফের। ও কী বলতে চাইছে? 

মারিয়া র‍্যালফের একটা হাত ধরে তাকে বসার ঘরে নিয়ে এল। 

‘আমরা বেডরুমে যাব না,’ বলল সে। 

মারিয়া প্রায় সবগুলো বাতি নিভিয়ে দিয়েছে, পা মুড়ে বসল কার্পেটে, ওর সামনে বসতে বলল র‍্যালফকে। ঘরে ফায়ার প্লেস আছে লক্ষ করে বলল: 

‘আগুন জ্বালাও।’ 

‘কিন্তু এখন তো গরম লাগছে।’ 

‘আগুন জ্বালাও। তুমি বলেছ আজ রাতে আমি যেভাবে বলব সেভাবে চলবে।’ 

স্থির দৃষ্টিতে র‍্যালফের দিকে তাকাল মারিয়া, আশা করল ও আবার ‘আলো’টা দেখতে পাবে। অবশ্যই আলো দেখতে পেয়েছে র‍্যালফ। কারণ সে বাগানে গিয়ে কিছু ভেজা কাঠ নিয়ে এল। কয়েকটা পুরানো খবরের কাগজও ফেলল ফায়ার প্লেসে যাতে লাকড়িতে আগুন ধরতে সুবিধে হয়। রান্না ঘরে গেল র‍্যালফ হুইস্কি আনতে, মারিয়া ডাকল তাকে। 

‘আমি কী চাই তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছ?’ 

‘না, করিনি।’ 

‘তোমার সঙ্গে যে রয়েছে তারও একটা অস্তিত্ব আছে। তার কথাও ভাবো। চিন্তা করে দ্যাখো তার হুইস্কির চাই নাকি জিন অথবা কফি। তাকে জিজ্ঞেস করো সে কী চায়।’ 

‘তুমি কী খাবে?’ 

‘ওয়াইন। এবং চাই তুমি আমাকে সঙ্গ দেবে।’ 

হুইস্কির বোতল রেখে রান্না ঘরে আবার ঢুকল র‍্যালফ। ফিরে এল ওয়াইনের বোতল হাতে। ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে; মারিয়া বাকি বাতিগুলোও নিভিয়ে দিল। এখন ঘরে আলো বলতে শুধু ফায়ার প্লেসের আগুন। 

মারিয়া হ্যান্ডব্যাগ খুলল। ভেতরে সুপার মার্কেট থেকে কেনা একটি কলম। একটা কিছু হলেই হলো। 

‘এটা তোমার জন্য। আমি ফার্ম নিয়ে লেখালেখির জন্য কলমটা কিনেছিলাম। দুইদিন ব্যবহার করেছি, আজও খানিকটা লিখেছি। শেষে ক্লান্ত লাগলে আর লিখিনি। এর মধ্যে লেগে রয়েছে আমার শরীরের খানিকটা ঘাম, কিছু মনোযোগ, আমার ইচ্ছাশক্তি। এই কলমটা আমি তোমাকে দিলাম।’ 

সে র‍্যালফের হাতে দিল কলম। 

‘তোমার পছন্দের কিছু কিনে দেয়ার বদলে তোমাকে এমন একটা জিনিস দিলাম যা একান্তই আমার নিজের। একটা উপহার। আমার পাশে বসা মানুষটির প্রতি সম্মান জানানোর একটি চিহ্ন, তাকে বলা যেন সে বুঝতে পারে তার পাশে থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে এখন আমার ক্ষুদ্র একটি অংশ থাকছে যা আমি তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়েছি।’ 

সিধে হলো র‍্যালফ, পা বাড়াল একটা বুক শেলফের দিকে। ফিরে এল হাতে কী যেন নিয়ে। ওটা বাড়িয়ে ধরল মারিয়ার দিকে। 

‘এটা একটা ক্যারিজ। ছেলেবেলায় যে ইলেকট্রিক ট্রেন নিয়ে খেলতাম কারণ এ গাড়িটি তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। নিজে নিজে খেলার অনুমতি ছিল না, বাবা বলতেন ট্রেনটা আমেরিকা থেকে আনা, খুব দামী। উনি লিভিং রুমে ট্রেনটা কবে বসাবেন সে অপেক্ষা করতাম আমি। কিন্তু বেশিরভাগ রোববার তার কেটে যেত গান শুনে। তাই এ ট্রেন ছেলেবেলায় আমাকে একটুও সুখী করতে পারেনি। আমার কাছে গোটা ট্র্যাক, ইঞ্জিন, বাড়িঘর এমনকী ম্যানুয়াল পর্যন্ত আছে। ট্রেনটা থেকেও যেন আমার ছিল না। কোনওদিনই ওটাকে নিয়ে খেলা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। 

‘আমাকে অন্য যেসব খেলনা দেয়া হয়েছিল, ওগুলোসহ ট্রেনটাকে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করত। কিন্তু ধ্বংস করিনি। কারণ প্রাচীন এই ট্রেন আমাকে সবসময় শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে শৈশব আমার যাপন করা হয়নি। হয়তো বাবা ট্রেনটা আমাকে দেননি আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ হয়ে যাবার ভয়ে।’ 

মারিয়া ফায়ার প্লেসের দিকে তাকাল। র‍্যালফও চাইল ওদিকে। কেউ কিছু বলছে না শুধু লাকড়ি পোড়ার কটকট আওয়াজ শুনছে। ওরা ওয়াইন পান করছে এমন ভঙ্গিতে যেন কথা না বলাটা বা অন্য কিছু না করাটা কোনও বিষয় নয়। ওরা দু’জনে একত্রে একই দিকে তাকিয়ে রইল। 

‘আমার জীবনেও প্রাচীন ট্রেনের ভূমিকা কম ছিল না,’ কিছুক্ষণ পরে বলল মারিয়া। ‘এর মধ্যে একটি হলো আমার অন্তর। আমি হৃদয় নিয়ে খেলা করেছি যখন পৃথিবী তার ট্রাক সাজিয়েছে। তবে সেটা সবসময় সঠিক ছিল না।’ 

‘কিন্তু তুমি তো ভালোবাসতে।’ 

‘ওহ্, হ্যাঁ। ভালোবাসতাম। আমি গভীরভাবে ভালোবাসতাম। এমন গভীরভাবে ভালোবাসতাম যে আমার ভালোবাসা যখন আমার কাছে উপহার চাইল তখন ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলাম।’ 

‘বুঝতে পারলাম না কথাটা।’ 

‘বুঝতে হবে না। আমি তোমাকে শেখাচ্ছি কারণ আমি এমন কিছু আবিষ্কার করেছি যার কথা আগে জানতাম না। উপহার প্রদান। কাউকে একান্ত নিজের কিছু দেয়া। তোমাকে আমি আমার অত্যন্ত দামী একটি জিনিস দিয়েছি : যে কলম দিয়ে আমার স্বপ্নের কথা লিখেছি সেটা। তোমার অত্যন্ত দামী একটা জিনিস আমি পেয়েছি : ট্রেনের ক্যারিজ, তোমার শৈশবের একটা অংশ যে শৈশবে তুমি ভালোবাসতে না।’ 

‘আমি তোমার অতীত রোমন্থন করছি, তুমি আমার বর্তমান রোমন্থন করছ, ব্যাপারটা মজার না? 

কথাগুলো বলার সময় একবার চোখের পাতা কাঁপল না মারিয়ার, তার যেন মনে হয়েছে এটাই সেরা আচরণ। উঠে দাঁড়াল সে, কোট র্যাক থেকে টেনে নিল জ্যাকেট, চুমু খেল র‍্যালফের গালে। র‍্যালফ হার্ট সিধে হবার চেষ্টা করল না, আগুনের দিকে সম্মোহিতের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে, সম্ভবত তার বাবার কথা ভাবছে। 

‘আগে কখনোই বুঝতে পারিনি কেন ক্যারিজটা রেখে দিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি : তোমাকে দেয়ার জন্যই বোধহয় ওটা ফেলে দিইনি। বাড়িটিকে এখন অনেক হালকা মনে হচ্ছে।’ 

র‍্যালফ বলল আগামীকাল সে বাকি ট্র্যাক, ইঞ্জিন, স্মোক পিন ইত্যাদি কোনও চিলড্রেন হোমে দিয়ে দেবে।’ 

মারিয়া আবার চুমু খেল র‍্যালফের গালে, পা বাড়াল সামনের দরজার দিকে। র্যালফ এখনও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে, মারিয়া নরম গলায় জানতে চাইল র‍্যালফ ওর জন্য দরজাটা খুলে দেবে কিনা। 

সিধে হলো র‍্যালফ। মারিয়া বলল র‍্যালফকে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার ভালোই লাগছিল। তবে ব্রাজিলীয়দের একটি কুসংস্কার আছে : কারও বাড়িতে প্রথম গেলে, যাবার সময় নিজে দরজা খুলতে নেই। খুললে ওই বাড়িতে আর ফেরা হবে না। 

‘আর আমি ফিরে আসতে চাই। 

‘যদিও আমার জামাকাপড় খুলিনি এবং তোমার ভেতরে প্রবেশ করিনি, এমনকী তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি, তবু আমরা প্রেম করেছি।’ 

হেসে উঠল মারিয়া। র‍্যালফ প্রস্তাব দিল মারিয়াকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। প্রত্যাখ্যান করল মারিয়া। 

‘আমি আসব, তোমার সঙ্গে কাল দেখা করব। তারপর সাক্ষাৎ হবে কোপাকাবানায়।’ 

‘না। দাঁড়াও। সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করো। অপেক্ষা খুব কষ্টের আমি এই অনুভূতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে চাই, জানাতে চাই তুমি আমার সঙ্গে আছ, এমনকী যখন তুমি আমার পাশে।’

.

ঠাণ্ডা, অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল মারিয়া। জেনেভায় এভাবে বহুবার হেঁটেছে সে। এ হাঁটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দুঃখ, একাকীত্ব, ব্রাজিলে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা, অর্থকড়ির হিসাবনিকাশ, টাইমটেবিল, সেই ভাষার জন্য নস্টালজিয়া যে ভাষায় অনেকদিন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে না মারিয়া। 

হাঁটছে মারিয়া, চোখের সামনে ভাসছে একটু আগের স্মৃতি। চল্লিশ মিনিট যে লোকটার সঙ্গে ফায়ার প্লেসের সামনে বসে ছিল ও, তার কথা ভাবছে। সেই লোকটি যে জ্ঞানও দিল ও, তার কথা ভাবছে। সেই লোকটি যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভাসিত। মনে পড়ছে সেই মেয়েটিকে যে অনেকদিন আগে লেকের পাশে হাঁটার সময় ভাবছিল সে ওই জীবনে প্রবেশ করবে কি করবে না, কারণ এ জীবন তো তার নয়— সেদিন বিকেলে মেয়েটির মুখে দারুণ করুণ একটুকরো হাসি ফুটে ছিল। ওই মেয়েকে সে দ্বিতীয়বার দেখেছে। ভাঁজ করা ক্যানভাসে, এখন সে আবার তার মাঝে ফিরে এসেছে। 

কিছুক্ষণ হাঁটার পরে একটা ট্যাক্সি নিল মারিয়া। ওর নিজেকে আবার দারুণ একা লাগছে। আসলে এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করাই উচিত। যে সুন্দর অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করেছে তা উদ্বেগের কারণে এলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সত্যি যদি আরেকটি মারিয়ার অস্তিত্ব থেকে থাকে, সঠিক সময়ে তার প্রত্যাবর্তন ঘটবে। 

উনিশ 

দিন যায়। মারিয়া যে ফাঁদটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল তাতে আবার আটকে যায় ও। তবে ওর দুঃখ হচ্ছে না, উদ্বেগও বোধ করছে না। একদিক থেকে বলা যায়, ওর তো হারাবার কিছু নেই। ও মুক্ত। 

মারিয়া জানে যতই রোমান্টিক পরিবেশ থাকুক না কেন একদিন র‍্যালফ হার্ট উপলব্ধি করবে সে স্রেফ একটা বেশ্যা আর সে নিজে একজন বিখ্যাত চিত্রকর। মারিয়ার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক। মারিয়া বাস করে বহুদূরের এক দেশে যেখানে অভাব-অনটন মানুষের নিত্যসঙ্গী, আর র‍্যালফ হার্ট বাস করে স্বর্গে, সুসংহত তার জীবন, জন্ম থেকে নিরাপত্তাবেষ্টিত। র‍্যালফ সেরা সব স্কুলে পড়াশোনা করেছে, শিক্ষা পেয়েছে বিশ্বসেরা জাদুঘর এবং গ্যালারি থেকে, অথচ মারিয়া মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ। মারিয়াদের জীবনে স্বপ্ন কখনও প্রলম্বিত হয় না এবং মারিয়া নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছে বাস্ত বতা তার স্বপ্ন পূরণ হতে দেবে না। তবে তার আনন্দ এখন এটাই যে বাস্ত বতাকে সে বলতে পারছে ওটাকে তার দরকার নেই, সুখী হবার জন্য সে কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। 

এক সপ্তাহ ধরে মারিয়া ভাবার চেষ্টা করছে কী করলে সুখী করা যাবে র‍্যালফ হার্টকে। সে একটা জিনিসই দিতে পারে যেটাকে র‍্যালফ মারিয়ার বিশেষত্ব বলে মনে করে, সেক্স। 

মারিয়া আবার পর্ণো ছবি দেখা শুরু করল। যথারীতি কোনও মজা পেল না। ছবি ওর কোনও কাজে আসছে না দেখে মারিয়া জেনেভা আসার পরে এই প্রথম সিদ্ধান্ত নিল কিছু বই কিনবে। যদিও ওর ধারণা একবার পড়া হয়ে গেলে সে বই আর কাজে লাগে না, ফেলে রাখতে হয় বাড়িতে। সান্তিয়াগোর রাস্তায় র‍্যালফের সঙ্গে হাঁটার সময় একটি বইয়ের দোকান চোখে পড়েছিল মারিয়ার। সে ওই দোকানে গেল। জিজ্ঞেস করল সেক্সের ওপর বইপত্র আছে কিনা। 

‘প্রচুর আছে,’ জানাল দোকানি। ‘এ বিষয়ের ওপর আলাদা একটা সেকশনই আছে। কারণ লোকে সেক্সের বই পড়তে খুব পছন্দ করে। প্রতিটি উপন্যাসেই আপনি কোনও না কোনও সেক্স সীন পাবেন। প্রেমের গল্পেই হোক কিংবা মানবিক আচরণ নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা হোক, সবাই সেক্স নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে।’ 

অভিজ্ঞতা থেকে মারিয়া জানে সেক্স নিয়ে লোকে যতই মাতামাতি করুক, বিছানায় ওঠার এগারো মিনিট বাদে সব উত্তেজনা শেষ। এর মধ্যে কোনও সৃষ্টিশীল ব্যাপার নেই। 

স্বর্ণকেশী তরুণী দোকানির বিশ্বাস পৃথিবীর সবকিছু বইয়ের মধ্যে ব্যাখ্যা করা আছে। এর সঙ্গে তর্ক করে আসলে লাভ নেই। মারিয়া জানতে চাইল বিশেষ সেকশনটি কোন দিকে। ওখানে গিয়ে সমকামী নারী- পুরুষ, গির্জার সন্ন্যাসিনীসহ নানান জনের সেক্স স্ক্যান্ডালের ওপরে বই পেল মারিয়া। কিছু বইতে প্রাচ্যমতে মিলনের কয়েকটি সচিত্র ভঙ্গিমা দেখানো হয়েছে। অস্বাভাবিক সব ভঙ্গি নিয়ে ছবির নারী-পুরুষ যৌনমিলনে লিপ্ত। তবে বইয়ের নাম মারিয়াকে আকর্ষণ করল : Sacred Sex। 

বইটি কিনে বাড়ি ফিরল মারিয়া। রেডিও ছেড়ে দিয়ে বিশেষ একটি স্টেশন ধরল (ঠাণ্ডা মিউজিক মারিয়াকে চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে)। বইটি খুলে পাতা ওল্টাতে লাগল। যে সব ছবি দেয়া আছে ওই রকম ভঙ্গিতে মিলিত হতে গেলে আপনাকে সার্কাসের অ্যাক্রোব্যাট হতে হবে। বইয়ের লেখাগুলো একেবারেই নীরস। 

মারিয়া তার পেশা থেকে জেনেছে শুধু বিভিন্ন আসন করেই যৌনতৃপ্তি দেয়া যায় না, বৈচিত্র্য আসে প্রাকৃতিক ভাবেই, নাচের মত, কিছু না ভেবেই যেন পদক্ষেপ নেয়া। তবু বইতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল মারিয়া 

ঘণ্টা দুই বাদে সে দু’টি সিদ্ধান্তে এল। 

প্রথমত, ওর খিদে লেগেছে। সাপার খাওয়া দরকার। কারণ কোপাকাবানায় ফিরতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, যে এ বই লিখেছে সে কিছু না জেনেই লিখেছে। সেক্স সম্পর্কে ঘোড়ার ডিমও জানে না। কতগুলো ফাঁকা তত্ত্ব আর প্রাচ্যের অর্থহীন কিছু আসনের ছবি এবং নির্বোধের মতো কিছু পরামর্শ ছাড়া কিছু নেই বইতে। মারিয়া বই পড়ে জেনেছে লেখক হিমালয়ে গিয়ে ধ্যান নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে (জায়গাটা কোথায় দেখতে হবে মারিয়ার) কিছু যোগ ব্যায়ামের কোর্সে শামিল হয়েছে (যোগ ব্যায়ামের কথা শুনেছে মারিয়া), এবং অন্যান্য লেখকদের প্রচুর উদ্ধৃতি করেছে। কিন্তু আসল জিনিস ছুঁয়েও দেখেনি। সেক্স তত্ত্ব, ব্যভিচার, সালাম বা কুর্নিশ নয়। কী করে এই মহিলা এমন একটা বিষয়ের ওপর বই লিখল যা কিনা মারিয়ার মত মেয়েও জানে না। 

এরকম চতুর্থ শ্রেণীর একটা বই লিখে যদি এই লেখিকা পয়সা পেতে পারে তা হলে মারিয়া নিজের জীবন নিয়ে যে বইটি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ব্যাপারে সিরিয়াস চিন্তাভাবনা শুরু করে দিতে পারে। মারিয়া তার বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছে : ইলেভেন মিনিটস। এটা ভুয়া কোনও বই হবে না— হবে তার আত্মজীবনী। 

তবে বই লেখার সময় বা আগ্রহ কোনওটাই এমুহূর্তে নেই মারিয়ার। সে র‍্যালফ হার্টকে কীভাবে সুখী করা যায় এবং ফার্ম করা যায় সে ব্যাপারে নিজের শক্তি ব্যয় করবে। 

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, বিরক্তিকর বইটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার পরে! 

একটি পুরুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে এবং আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। সাধারণ একটা কারণ প্রেমের জোয়ারে গা ভাসাতে দিয়েছি নিজেকে : এ থেকে কিছু পাবার আশা আমার নেই। আমি জানি আর তিন মাসের মধ্যে আমি চলে যাব অনেক দূরে এবং সে হয়ে থাকবে স্রেফ একটা স্মৃতি। কিন্তু আমি ভালোবাসা ছাড়া আর বাঁচতে পারছিলাম না; আমি আমার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি। 

আমি র‍্যালফ হার্টের জন্য একটি গল্প লিখছি- পুরুষটির নাম ওটাই। আমি জানি না আমি যে ক্লাবে কাজ করি সেখানে ও আসবে কিনা। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে এতে কিছু আসবে যাবে না। ওকে নিয়ে চিন্তা করা, ওকে নিয়ে ভালোবাসাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে। যখন এ দেশ ছেড়ে চলে যাব আমি, তখন স্মৃতিতে অনুরন তুলবে একটি মুখ, একটি নাম, একটি ফায়ার প্লেস। আমি এখানে যেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, যে সব প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, ওই স্মৃতির সঙ্গে তুল্য হবে না কিছুই। 

ও আমার জন্য যা করেছে আমিও ওর জন্য তা-ই করতে চাই। বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি এবং বুঝতে পেরেছি হুট করেই ওই ক্যাফেতে যাওয়া হয়নি আমার; শরীর পরস্পরকে দেখার অনেক আগেই দুই আত্মার পরিকল্পিত বৈঠক হয়েছে। 

সাধারণভাবে বলতে গেলে, এ ধরনের সাক্ষাৎ বা বৈঠক সংগঠিত হয় যখন আমরা একটি সীমারেখায় পৌঁছে যাই! এই বৈঠকগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। তবে আমরা এগুলো প্রায়ই ঘটতে দিই না। আমরা বেপরোয়া বা মরিয়া হয়ে উঠলেও আমাদের যদি হারাবার কিছু না থাকে, আমরা যদি জীবন নিয়ে পূর্ণ উল্লসিত হই, তখন অজানা বিষয়টি স্বরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটায়, নিজেদের ব্রহ্মাণ্ড পরিবর্তন করে দিক। 

সবাই জানে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কারণ আমরা সকলে এই উপহারটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কারও কারও ভালোবাসার স্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে, কিন্তু আমাদের বেশিরভাগের বিষয়টি নতুন করে শিখতে হয়। 

আমাদের শরীর শিখে যায় আত্মার ভাষায় কথা বলতে, যার নাম সেক্স, আর সেটাই আমি আমার পুরুষটিকে দিতে চাইছি যে আমাকে আমার আত্মা দিয়েছে, যদিও তার কোনও ধারণাই নেই আমার কাছে তার গুরুত্ব কতটা, সে এটাই আমার কাছে জানতে চেয়েছে এবং সে জানবেও; আমি তাকে অত্যন্ত সুখী দেখতে চাই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *