দশ
তাহলে এভাবেই সব কিছুর শুরু। এত সহজে। এ অচেনা শহরে কাউকে সে চেনে না, তবে গতকাল যে যন্ত্রণা সে সয়েছে, আজ নিজেকে দারুণ স্বাধীন মনে হচ্ছে। কারণ কাউকে তার কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না।
জীবনে এই প্রথম, গত কয়েক বছরের মধ্যে, সিদ্ধান্ত নিল মারিয়া, সারাটা দিন সে নিজের কথাই শুধু ভাবছে। এতদিন তার ভাবনা জুড়ে ছিল নানান মানুষ : তার মা, স্কুলের বান্ধবীরা, তার বাবা, মডেল এজেন্সির লোকজন, ফরাসী শিক্ষক, ওয়েটার, লাইব্রেরিয়ান, রাস্তার অচেনা মানুষজন। এরা কেউ তো তার কথা ভাবে না, সে এক বেচারী বিদেশী, কাল যদি সে নিখোঁজ হয়ে যায়, এমনকী পুলিশও তার খোঁজ করবে না।
চমৎকার। মারিয়া সকাল সকাল বেরুল। নাস্তা সেরে নিল পরিচিত ক্যাফেতে, লেকের ধারে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াল। উদ্বাস্তুদের বিক্ষোভ দেখল। ছোট একটি কুকুর নিয়ে হাঁটছিল এক মহিলা, মারিয়াকে বলল ওই শরণার্থীরা হলো কুর্দ। মারিয়া জিজ্ঞেস করল :
‘কুর্দরা কোত্থেকে এসেছে?’
মারিয়া অবাক মহিলা এ প্রশ্নের জবাব জানে না বলে। পৃথিবীটা এমনই, লোকে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা জানে সবকিছু। কিন্তু সাহস করে প্রশ্ন করুন, ওরা জবাব দিতে পারবে না।
একটি ইন্টারনেট ক্যাফেতে ঢুকল মারিয়া। জানল কুর্দরা এসেছে কুর্দিস্তান থেকে। এ দেশটির আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই, তুরস্ক এবং ইরাকের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। মারিয়া লেকের ধারে গেল কুকুরঅলা মহিলার খোঁজে। পেল না। কুকুরটা হতো বিক্ষোভকারীদের ব্যানার, মাথার রুমাল, বাজনা আর চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হয়ে আর থাকতে চায় নি।
‘আমি আসলে ওই মহিলার মতই ভান করি সব কিছু জানি। আসলে জানি না কিছুই। তবে আরব লোকটাকে সেদিন ওই কথা বলার পরে সে কী শকড় হয়েছিল? বলেছিলাম দু’টি সফট ড্রিঙ্কের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় ছাড়া আর কিছু জানি না আমি। নাহ্, লোকটা বোধহয় আমার সততায় খুশি হয়েছে। বেশি বুদ্ধি দেখাতে গেলে ধরা খেয়ে যাই আমি। কাজেই আর এরকম করছি না!’
মডেল এজেন্সির কথা ভাবছে মারিয়া। ওরা কি জানত আরব লোকটা আসলে কি চাইছে? নাকি ওরা সত্যি ভেবেছে লোকটা মারিয়াকে তার দেশে নিয়ে যাবে কাজ দেয়ার জন্য?
সত্যি যা-ই হোক, মারিয়ার কিছু এসে যায় না। জেনেভার এই ধূসর সকালে নিজেকে খুব একটা একা লাগছে না ওর। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি, কুর্দরা বিক্ষোভ করছে, ট্রামগুলো প্রতিটি স্টপেজে থামছে সময় মতো, দোকানদাররা তাদের গহনা ডিসপ্লে করছে জানালার ধারে, খুলে যাচ্ছে ব্যাংক, ভিখিরীগুলো ঘুমাচ্ছে, সুইসরা কাজে যাচ্ছে। মারিয়ার একা লাগছে না কারণ পাশে আরেকজন নারীর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে, অদৃশ্য এক নারী। আগে এই নারীর অস্তিত্ব টের পায়নি সে। এখন পাচ্ছে।
অদৃশ্য নারীকে উদ্দেশ্য করে হাসল মারিয়া। এই নারীকে তার মনে হচ্ছে ভার্জিন মেরীর মতো, যীশুর মা। নারীও হাসল মারিয়ার দিকে তাকিয়ে। তাকে সাবধানে থাকতে বলল। বলল মারিয়া যেভাবে সরল চোখে সবকিছু দেখছে, তেমন সহজ নয় জীবন। মারিয়া নারীর উপদেশ অগ্রাহ্য করল। বলল সে যথেষ্ট বড় হয়েছে এবং নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়ার সামর্থ্য রাখে এবং সে বিশ্বাস করে না কেউ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। সে এখন জানে এমন লোকও আছে যে মারিয়ার সঙ্গ পেতে এক হাজার ফ্রাঁ ব্যয় করতে প্রস্তুত, তারা এক ঘণ্টা কাটাবে মারিয়ার দুই পায়ের ফাঁকে। মারিয়াই সিদ্ধান্ত নেবে সে হাজার ফ্রাঁ দিয়ে প্লেনের টিকেট কেটে যে শহরে সে জন্মেছে সেখানে ফিরে যাবে নাকি আরও কিছু দিন এখানে থেকে আরও টাকা কামাই করবে বাবা-মাকে একটি বাড়ি কিনে দিতে, নিজের জন্য সুন্দর সুন্দর পোশাক এবং স্বপ্নের জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য।
মারিয়ার পাশের অদৃশ্য নারী আবারও বলল জীবন এত সহজ নয়। মারিয়া নারীকে তার চিন্তা-ভাবনায় নাক গলাতে নিষেধ করল। কারণ তাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মারিয়া এবারে আরও সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ শুরু করল সে ব্রাজিলে ফিরে যাবে কী যাবে না। ওর স্কুল জীবনের বান্ধবীরা, যারা জীবনেও শহর ছেড়ে বাইরে যায় নি, তারা বলবে মারিয়া চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছে। আসলে আন্তর্জাতিক তারকা হবার প্রতিভাই ওর নেই। মা মন খারাপ করবেন কারণ মারিয়া তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাবে বলেছিল। যদিও মারিয়া মাকে বোঝাবে সে টাকা পাঠিয়েছে ঠিকই কিন্তু ডাকঘর থেকে ওটা চুরি গেছে। বাবা মারিয়ার দিকে ‘আমি জানতাম এমনই হবে’ দৃষ্টিতে তাকাবেন; মারিয়াকে আবার দোকানে যোগ দিতে হবে, কাপড় বিক্রি করবে এবং বিয়ে করবে দোকানের মালিককে সেই মারিয়া যে কিনা প্লেনে ভ্রমণ করেছে, খেয়েছে সুইস পনির, শিখেছে ফরাসী ভাষা এবং বরফে হেঁটেছে।
অন্যদিকে মারিয়ার জন্য হাজার ফ্রাঁ কামাইয়ের সুযোগ থেকে যাচ্ছে। তবে সুযোগটা হয়তো বেশিদিন থাকবে না- কারণ রূপ তো বাতাসের মত দ্রুত বদলে যায়— তবে বছর খানেকের মধ্যে সে নিজের পায়ে দাঁড়াবার মত টাকা আয় করতে পারবে, ফিরে যেতে পারবে নিজের পৃথিবীতে। কিন্তু আসল সমস্যা হলো মারিয়া জানে না কী করবে, কীভাবে শুরু করবে। ‘ফ্যামিলি নাইটক্লাব’-এর কথা মনে পড়ল। এক মেয়ে রু ডি বার্ন নামে একটি জায়গার কথা বলেছিল।
রাস্তার এক লোককে ডেকে জানতে চাইল মারিয়া সে রু ডি বার্ন চেনে কিনা। লোকটা সন্দিগ্ধ চোখে দেখল মারিয়াকে। জিজ্ঞেস করল সে রাস্তার কথা জানতে চাইছে নাকি যে রাস্তাটা সুইটজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নের দিকে গেছে তার কথা জানতে চাইছে। না, বলল মারিয়া, আমি জেনেভার রাস্তার কথা জানতে চাইছি। লোকটা মারিয়ার আপাদমস্তক দেখল, তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে হাঁটা দিল। তার ধারণা তাকে বোকা বানানোর জন্য এ প্রশ্ন করেছে। টিভি প্রোগ্রামে সে দেখেছে এ রকম প্রশ্ন করে পথচারীদের বোকা বানানো হয়। মারিয়া মিনিট পনেরো চোখ বুলাল ম্যাপে— শহরটা খুব বেশি বড় নয়— অবশেষে যে জায়গা খুঁজছিল, পেয়ে গেল।
তার অদৃশ্য বন্ধু, মারিয়া যখন ম্যাপ দেখছে, চুপচাপ ছিল, এবার সে বলল, এটা নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, মারিয়া আসলে এমন একটা রাস্তায় যাচ্ছে যেখান থেকে ফেরার পথ নেই।
মারিয়া বলল সে যদি বাড়ি যাওয়ার মত যথেষ্ট পয়সা কামাই করতে পারে তাহলে যে কোনও পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। তাছাড়া, সে যে সমস্ত মানুষ দেখেছে তারা কেউই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা হতে চেয়েছে একরকম, হয়েছে আরেক রকম। এটাই জীবনের নিয়ম।
‘আমরা আসলে অশ্রুর রাজ্যে বাস করি,’ মারিয়া বলল তার অদৃশ্য বন্ধুকে। ‘আমরা স্বপ্ন দেখি, কিন্তু জীবন খুব কঠিন, করুণ। তুমি কী বলতে চাইছ লোকে আমাকে দোষারোপ করবে? কেউ ব্যাপারটা জানবে না- এটা আমার জীবনের একটা অধ্যায় মাত্র।
করুণ, মিষ্টি হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল মারিয়ার বন্ধু।
মারিয়া মেলায় গিয়ে রোলার কোস্টারের টিকেট কিনে তাতে চড়ে বসল। সবার সঙ্গে সে-ও ইচ্ছে মত গলা ফাটিয়ে চেঁচাল। জানে এতে আসলে কোনও বিপদ নেই, এ স্রেফ একটা খেলা।
একটা জাপানি রেস্টুরেন্টে খেল মারিয়া। যদিও কী খাচ্ছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই ওর। শুধু জানে খাবারটা খুব দামী। আর খরচ করে মজাই পাচ্ছে ও। নিজেকে সুখী মনে হচ্ছে। ওর এখন আর ফোনের অপেক্ষা করতে হবে না কিংবা পাই পয়সা গুণে খরচও করার দরকার পড়বে না।
সেদিন বিকেলে মডেল এজেন্সিকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি মেসেজ পাঠাল মারিয়া। বলল আরবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হয়েছে। এজেন্সি ইচ্ছে করলে এ ধরনের আরও সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারে।
নিজের ছোট ঘরে ফিরে এল মারিয়া। সিদ্ধান্ত নিল যত টাকাই কামাই করুক সে কোনওদিন টিভি কিনবে না। সময়টা সে ব্যয় করবে ভাবনার পেছনে। তাকে অনেক অনেক ভাবতে হবে।
ওই রাতে মারিয়ার ডায়েরি থেকে (মার্জিনে অবশ্য সে লিখেছে ‘নিশ্চিত নই’):
পুরুষ কেন নারীকে টাকা দিয়ে কিনে নেয় সে কারণটা আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি : সে সুখী হতে চায়। পুরুষ শুধু রেতঃপাতের জন্য এক হাজার ফ্রাঁ খরচ করে না। সে সুখী হতে চায়। আমিও চাই। সবাই চায়। যদিও কেউ সুখী নয়। আমার হারাবার কী আছে, যদি আমি কিছুদিনের জন্য…শব্দটা ভাবতে বা লিখতে কঠিনই লাগছে…তবু পরিষ্কার বলি… আমার হারাবার কী আছে যদি সিদ্ধান্ত নিই আমি কিছুদিনের জন্য পতিতা বৃত্তির পেশা বেছে নেব?
সম্মান। আত্মসম্মান ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যখন আমি চিন্তা করি ভাবি এসব কী আদৌ আমার ছিল? আমি তো বলিনি আমাকে জন্ম দেয়া হোক। আমাকে ভালোবাসার মতো কাউকে পাই নি। আমি সব সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন জীবনের ওপর ছেড়ে দিয়েছি আমাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার।
এগারো
পরদিন এজেন্সি থেকে ফোন এল। জানতে চাইল, ফ্যাশন শো কবে হচ্ছে। কারণ প্রতিটি কাজের জন্য তারা কমিশন পায়। আরবের সঙ্গে কী ঘটেছে এরা কিছুই জানে না, বুঝতে পারল মারিয়া। বলল, আরব ভদ্রলোক নিজেই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
লাইব্রেরিতে গেল মারিয়া। সেক্স সম্পর্কিত কিছু বইপত্র চাইল। এক বছর যে বিষয় নিয়ে সে কাজ করবে ঠিক করেছে, এবং যে জগত সম্পর্কে সে বলতে গেলে কিছুই জানে না, ওই দুনিয়া সম্পর্কে জানতে চায় মারিয়া। জানতে চায় খদ্দেরদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করবে, কীভাবে তাদেরকে রতি তৃপ্তি দেবে এবং বিনিময়ে কীভাবে আদায় করবে টাকা।
লাইব্রেরিয়ান জানাল লাইব্রেরিটি যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, এখানে টেকনিক্যাল কাজের ওপর অল্প কিছু বই আছে। শুনে দারুণ হতাশ মারিয়া। বইগুলোর সূচিতে চোখ বুলিয়ে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে দিল। কারণ এতে তেমন কিছু লেখা নেই। সুখ বা রতি তৃপ্তি নিয়ে কিছুই লেখেনি, যৌন উত্তেজনা, ধ্বজভঙ্গ, সতর্কতা ইত্যাদি নীরস বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে শুধু। The psychology of frigidity in women নামের বইটি নেবে কিনা ভাবল মারিয়া। যদিও ও নিজে স্বমেহন ছাড়া যৌন তৃপ্তি পায় না।
এখানে আনন্দ লাভের জন্য আসেনি মারিয়া, কাজে এসেছে। সে লাইব্রেরিয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল। ঢুকল একটি দোকানে। সম্ভাব্য ক্যারিয়ারের জন্য এই প্রথম বিনিয়োগ করল- পুরুষের চোখে কামোদ্দীপক কিছু ড্রেস কিনল। তারপর ম্যাপে দেখা জায়গাটিতে চলে এল। রু ডি বার্ন। রাস্তার মাথায় একটি গির্জা (পরশু রাতে যে জাপানি রেস্টুরেন্টে ও সাপার করেছে, চার্চটি তার খুব কাছে), রয়েছে কিছু দোকানপাট। সস্তায় ঘড়ি বিক্রি করে। দূরপ্রান্তে ক্লাব। এ ক্লাবগুলোর কথা শুনেছে মারিয়া। এ মুহূর্তে বন্ধ সবগুলো।
লেকের ধারে চলে এল মারিয়া— কোনও রকম বিব্রত বোধ ছাড়াই কিনে নিল গোটা পাঁচেক পর্ণো ম্যাগাজিন। জানতে চায় কী ধরনের কাজ ওকে করতে হবে। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এল রু ডি বার্নেতে। ‘কোপাকাবানা’ নামে একটি বার পছন্দ হলো মারিয়ার।
এখনও ও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি, নিজেকে শোনাল মারিয়া, এটা স্রেফ একটা এক্সপেরিমেন্ট। নিজেকে ওর এই মুহূর্তে দারুণ স্বাধীন লাগছে।
.
‘কাজ খুঁজছি আমি,’ বার-এর মালিককে বলল মারিয়া। লোকটা বার-এর পেছনে গ্লাস ধুচ্ছিল। বার-এ কয়েক সারি টেবিল ফেলা, দেয়াল ঘেষে রয়েছে কতগুলো সোফা, এ কোণায় ডান্স ফ্লোর। ‘কাজ করতে চাইলে ওয়ার্ক পারমিট দরকার জানাল বার মালিক।
মারিয়া ওয়ার্ক পারমিট দেখাল। লোকটা খুশি হলো মনে হলো।
‘আগে কোথাও কাজ করেছ?’
কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না মারিয়া; যদি বলে হ্যাঁ, লোকটা জানতে চাইবে কোথায়। আর না বললে ওকে হয়তো কাজই দেবে না।
‘আমি বই লিখছি।’
মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল কথাটা, যেন অদৃশ্য একটা কণ্ঠ কথাটা বলে দিল ওকে সাহায্য করার জন্য। মারিয়া লোকটার চেহারা দেখে বুঝতে পারল সে বুঝে গেছে মারিয়া মিথ্যা কথা বলছে। তবে ভান করল বিশ্বাস করেছে।
‘কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলো। প্রতিরাতে এখানে কমপক্ষে ছ’টি ব্রাজিলিয়ান মেয়ে আসে। কাজেই বুঝে নাও, তুমি কতটুকু কী করতে পারবে।’
মারিয়া বলতে যাচ্ছিল কারও পরামর্শ তার দরকার নেই, তাছাড়া এখনও কাজ করার ব্যাপারে সে কোনও সিদ্ধান্তও নেয়নি, কিন্তু কথাটা বলার সুযোগ পেল না। লোকটা বার-এর অন্যপ্রান্তে চলে গেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে মারিয়াকে।
মেয়েরা একে একে হাজির হতে লাগল। বার মালিক কয়েকজন ব্রাজিলীয় তরুণীকে ডেকে বলল, মারিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কেউই সেধে কথা বলতে চাইছে না। প্রতিযোগিতার ভয়, ধারণা করল মারিয়া। সাউন্ড সিস্টেম চালু হয়ে গেছে, বাজছে ব্রাজিলের গান। এমন সময় কয়েকটি মেয়ে ঢুকল ঘরে। দেখে মনে হয় এশীয়। যেন জেনেভার বরফ পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ।
বার-এ প্রায় দুই ঘণ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল মারিয়া, পান করার কিছু নেই। কতগুলো সিগারেট ধ্বংস করল। মন বলছে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ও। প্রশ্ন জাগছে— ‘আমি এখানে কী করছি?’ তার ব্যাপারে বার-এর মালিক বা মেয়েগুলোর কোনও রকম আগ্রহ নেই, এ বিষয়টি উপলব্ধি করে ক্রমে বিব্রত বোধ করছে মারিয়া। এমন সময় এক ব্রাজিলীয় তরুণী এগিয়ে এল মারিয়ার কাছে।
‘তুমি এখানে এসেছ কী জন্য?’
মারিয়া বলতে পারত সে বই লিখছে। কিন্তু মিথ্যা বলতে ইচ্ছা করল না। সত্যি কথাটাই বলল।
‘সত্যি বলতে কী, আমি জানি না কীভাবে আমি শুরু করব কিংবা শুরু করতে চাই কিনা।’
সরাসরি খোলামেলা এ জবাবে অবাক হলো মেয়েটি। সে গ্লাসের পানীয়তে চুমুক দিল, সম্ভবত হুইস্কি। ব্রাজিলিয়ান গান শুনল কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করে বলল সে তার বাড়ি খুব মিস করছে। তারপর যোগ করল আজ রাতে তেমন খদ্দের আসার সম্ভাবনা নেই কারণ জেনেভায় একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হবার কথা ছিল। ওটা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। মারিয়া এ কথার পরেও চলে যাচ্ছে না দেখে সে বলল:
‘দ্যাখো, ব্যাপারটা খুব সরল, তোমাকে তিনটে নিয়ম মেনে চলতে হবে: এক : যার সঙ্গে তুমি কাজ করছ তার প্রেমে পড়া চলবে না। দুই : কোনও প্রতিশ্রুতিতে ভুলো না এবং পাওনা টাকা সরাসরি আদায় করে নেবে। তিন : মাদক ব্যবহার চলবে না।
বিরতি।
‘আর কাজ শুরু করলে এখনই। আজ রাতে যদি ক্লায়েন্ট ছাড়া তোমাকে বাড়ি ফিরতে হয়, তুমি দ্বিতীয়বার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবে এবং এখানে ফিরে আসার সাহস আর হবে না।’
মারিয়া হতাশ হয়ে চটজলদি সিদ্ধান্ত নিল। ‘ঠিক আছে। আমি আজ রাতেই শুরু করতে চাই কাজ।’
মারিয়া এ কথা আর বলল না যে আসলে গতকাল থেকেই সে শুরু করে দিয়েছে কাজ।
ব্রাজিলিয়ান মেয়েটি বার মালিকের কাছে গেল। একে মিলান নামে সম্বোধন করল। লোকটা মারিয়ার কাছে এল কথা বলতে।
‘তুমি সুন্দর আন্ডারওয়্যার পরে এসেছ তো?’
কেউ— মারিয়ার বয়ফ্রেন্ড, আরব লোকটি, তার বান্ধবীরা, কখনও এ ধরনের প্রশ্ন তাকে করেনি। কিন্তু জীবন যেখানে যেরকম— এখানে সবকিছু সরাসরি।
‘আমি ম্লান নীল রঙের প্যান্ট পরেছি, ব্রা পরিনি,’ জানাল মারিয়া উৎসাহী ভঙ্গিতে। কিন্তু ওকে ভর্ৎসনা করল বার মালিক।
‘কাল কালো প্যান্টি, ব্রা এবং মোজা পরে আসবে। এক এক করে সব পোশাক খুলতে হবে। এটাই রীতি।’
মারিয়া এখানে সবে কাজ করতে এসেছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মিলান জানাল কোপাকাবানায় লোকে স্ফূর্তি করতে আসে বটে তবে এটা বেশ্যালয় নয়। লোকে এখানে মনের মতো নারীর খোঁজে আসে। কেউ যদি মারিয়ার টেবিলে আসে, সে বলবে :
‘তুমি আমার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবে?
মারিয়া এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ বা না যা খুশি বলতে পারে। ইচ্ছে হলে সে লোকটাকে সঙ্গ দিতে পারে, তবে এক রাতে একবারের বেশি ‘না’ বলার নিয়ম নেই। জবাব ইতিবাচক হলে মারিয়া ফ্রুট জুস ককটেল চাইবে, এটি বার-এর সবচে’ দামী ড্রিঙ্ক। কাস্টমারকে অবশ্যই তার জন্য কোনও অ্যালকোহল পছন্দ করতে দেবে না।
এরপরে মারিয়া নাচের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে। ‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’ ছাড়া বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট এখানে পরিচিত মুখ, কাজেই এদের তরফ থেকে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই। পুলিশ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতি মাসে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে হয়। তারা পরীক্ষা করে দেখে মেয়েদের শরীরে কোনও যৌন রোগ বাসা বেঁধেছে কিনা। কনডম ব্যবহার বাধ্যতামূলক। যদিও পরীক্ষা করার উপায় নেই এই নিয়ম পালন করা হচ্ছে কিনা। মারিয়া যেন কোনওভাবেই কোনও স্কান্ডালের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে— কারণ বিবাহিত মিলানের সমাজে যথেষ্ট সম্মান রয়েছে, সে তার ক্লাব-এর খ্যাতির ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন।
নিয়ম কানুন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে যেতে লাগল মিলান : নাচ শেষে তারা ফিরে আসবে টেবিলে, খদ্দের মারিয়াকে তার হোটেলে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেবে। স্বাভাবিক রেট হলো সাড়ে তিনশ ফ্রাঁ, এর মধ্যে পঞ্চাশ ফ্রাঁ পাবে মিলান, টেবিল ভাড়া হিসেবে।
মারিয়া বলার চেষ্টা করল :
‘কিন্তু আমি এক হাজার ফ্রাঁ পেয়েছি…’
বার মালিক ভান করল যেন শোনেইনি কথাটা, কিন্তু ব্রাজিলীয় মেয়েটি মন্তব্য করল :
‘ও ঠাট্টা করছে।’
মারিয়ার দিকে ঘুরল সে, পরিষ্কার পর্তুগীজ উচ্চারণে, জোর গলায় বলল:
‘জেনেভার সবচে’ দামী এলাকা এটি। ও কাজ আর কখনও কোরো না। সে জানে এখানকার রেট কী এবং জানে এক রাতের জন্য কেউ এক হাজার ফ্রাঁ দেয় না। শুধু ‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’ ছাড়া। তবে সেরকম ক্লায়েন্ট কালেভদ্রে জোটে এবং তাও যদি তোমার সঠিক যোগ্যতা থাকে।’
যুগোশ্লাভ মিলান, যে এ দেশে আছে গত বিশ বছর ধরে, বলল :
‘রেট হলো সাড়ে তিনশ ফ্রাঁ।’
‘আচ্ছা,’ অনুগত গলা মারিয়ার
প্রথমে লোকটা তার আন্ডারওয়্যারের রং জানতে চেয়েছে, এখন তার শরীরের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করছে।
তবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় পেল না মারিয়া। লোকটা অনর্গল উপদেশ বর্ষণ করেই চলেছে : মারিয়াকে অবশ্যই কারও বাড়ি যাওয়া চলবে না এবং পাঁচতারা কোনও হোটেল ছাড়া অন্য কোনও হোটেলে যাবার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা যাবে না। ক্লায়েন্টের যদি কোথাও যাবার জায়গা না থাকে, মারিয়া পাঁচ ব্লক পরের স্থানীয় হোটেলে নিয়ে যাবে তাকে। এবং ওখানে যাবার জন্য ট্যাক্সি ব্যবহার করবে মারিয়া যাতে রু ডি বার্নের অন্যান্য ক্লাবের মেয়েরা তাকে চিনতে না পারে। তবে শেষের শর্তটা বিশ্বাস হলো না মারিয়ার। আসলে তাকে ট্যাক্সিতে যেতে বলা হচ্ছে যাতে অন্য কোনও ক্লাব মালিকের চোখে না পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে আরও’ ভালো কাজের প্রস্তাব পেয়ে যেতে পারে মারিয়া।
‘আবারও বলছি : ডিউটিতে থাকার সময় মদ খাওয়া চলবে না। আমি গেলাম। এখুনি ব্যস্ত হয়ে উঠতে হবে আমাকে।’
‘ওকে ধন্যবাদ বলো।’ ব্রাজিলীয় মেয়েটি বলল পর্তুগীজে।
মারিয়া ধন্যবাদ দিল বার মালিককে। লোকটা হাসল। তবে উপদেশ এখনও শেষ হয়নি তার :
‘একটা কথা বলতে ভুলে গেছি : ড্রিঙ্কের জন্য অর্ডার দেয়া এবং ক্লাব ত্যাগ, পুরো কাজটা ঘড়ি ধরা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে করতে হবে। সুইটজারল্যান্ডের সব জায়গায় ঘড়ি আছে। যুগোশ্লাভ এবং ব্রাজিলিয়ান- দেরকেও সময়ানুবর্তী হতে হবে। মনে রেখো, তোমাদের কমিশনের ওপর নির্ভর করে আমার সংসার চলে।
.
লোকটা মারিয়াকে টলটলে মিনারেল ওয়াটার দিল, তাতে এক চিলতে লেবু চিপে দিল। অপেক্ষা করতে বলল ওকে। ধীরে ধীরে ভরে উঠছে ক্লাব। লোকজন আসছে, তাকাচ্ছে চারপাশে, পছন্দের টেবিল দখল করে নিচ্ছে, যেন পার্টিতে এসেছে একে অন্যকে অনেকদিন ধরে চেনে। যেন সারাদিনের পরিশ্রম শেষে একটু আড্ডা মারতে এসেছে। একেকটি পুরুষ একেকজন সঙ্গিনী খুঁজে নিচ্ছে, সেই সঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে মারিয়া। অবশ্য এখন ও আগের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। হয়তো দেশটা সুইটজারল্যান্ড বলে অথবা আজ হোক বা কাল হোক সে অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধান পাবে, পাবে টাকা অথবা স্বামী, যে স্বপ্ন সে বুকের মাঝে লালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। অথবা- অকস্মাৎ উপলব্ধি করে মারিয়া- হয়তো বহুদিন পরে রাতের বেলা এমন এক জায়গায় এসেছে যেখানে মিউজিক বাজছে, লোকে তার ভাষায় কথা বলছে। সে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে মেতে উঠেছে আড্ডায়। তাদের সঙ্গে গল্প করছে, হাসছে, ফ্রুট জুস ককটেল পান করছে।
এখনও কোনও মেয়ে এসে হ্যালো বলেনি মারিয়াকে। তবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার; শত হলেও সে এখানে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিযোগী, একই ট্রফির জন্য প্রতিযোগিতা করছে। হতাশ হবার বদলে গর্ব অনুভব করছে মারিয়া- সে নিজের জন্য লড়াই করছে, সে অসহায় নয়। সে ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে চিরদিনের জন্য চলে যেতে পারে বাইরে। তবে ও জানে এতদূর আসার সাহস সে করেছে, এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে যার কথা কল্পনাও করেনি কোনওদিন। সে নিয়তির শিকার নয়, নিজেকে বলল মারিয়া : সে নিজেই ঝুঁকি নিয়েছে, নিজের সীমারেখা অতিক্রম করেছে, যে সব অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করছে, একদিন, যখন সে বুড়ো হয়ে যাবে, স্মৃতিচারণ করবে এসব নিয়ে- হয়তো তখন সব অবিশ্বাস্য মনে হবে।
মারিয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে কেউ তার কাছে আসছে না। আগামীকাল এটাকে দুরন্ত একটা স্বপ্ন বলে মনে হবে যে স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি করার সাহস ওর হবে না। মারিয়া বুঝতে পেরেছে এক রাতের জন্য এক হাজার ফ্রাঁ পাবার মত ঘটনা মাত্র একবারই ঘটে; ওর হয়তো প্লেনের টিকেট কিনে ব্রাজিলে ফিরে যাওয়াই উচিত হবে। সময় কাটাতে সে হিসেব করতে লাগল এসব মেয়ে কীরকম কামাই করে : ওরা যদি প্রতিরাতে তিনবার করে বাইরে যায়, তাহলে প্রতি চার ঘণ্টায় যা আয় করবে তা মারিয়া দুই মাস দোকানে কাজ করে যা কামাই করবে তার সমান।
টাকার অঙ্কটা কি খুব বেশি? এক রাতে হাজার ফ্রাঁ পেয়েছে মারিয়া, তবে সেটা ছিল নিতান্তই ভাগ্য। একজন সাধারণ পতিতা এর চেয়ে বেশি আয় করতে পারে, মারিয়া বাড়ি ফিরে ফরাসী শিখিয়ে যা কামাই করবে তারচে’ এই অঙ্কটা অনেক বেশি হবে। কাজের মধ্যে শুধু তাদেরকে বার-এ খানিকটা সময় কাটাতে হবে, নাচতে হবে, দুই পা ফাঁক করতে হবে খদ্দেরের জন্য। ব্যস, এই। এমনকী বাতচিৎ করারও প্রয়োজন নেই।
টাকা দরকারী জিনিস, ভাবল মারিয়া, কিন্তু টাকাই কি সব? একদিনে সাড়ে তিনশ ফ্রাঁ। সপ্তাহে পাঁচ দিন। উহ্, অনেক টাকা! এক মাসে তো কম আয় করছে না মেয়েগুলো। ওরা দেশে ফিরে গিয়ে ওদের বাবা মা’র জন্য বাড়ি কিনে দেয় না কেন? নাকি অল্প সময়ের জন্য ওরা কাজ করতে এসেছে? অথবা- প্রশ্নটা করতে ভয় পেল মারিয়া- কাজটা কি ওরা উপভোগ করছে?
‘আমার সঙ্গে ড্রিঙ্ক করবে?’
মারিয়ার সামনে ত্রিশ/বত্রিশ বছরের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে বিমানবাহিনীর পোশাক।
পৃথিবীটা হঠাৎ স্লো মোশনে ঘুরতে শুরু করল, মারিয়া যেন নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে এল। বিব্রত বোধ করল ও, লাল হয়ে উঠেছিল গাল, নিজেকে সামলে নিল। মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল। ও বুঝতে পারছে এ মুহূর্ত থেকে ওর জীবনটা বদলে যাচ্ছে চিরতরে।
ফ্রুট জুস ককটেল এল। অল্পসল্প কথা হলো। তুমি এখানে কী করছ, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, না? এই গানটা আমার বেশ পছন্দ, অ্যাবার গান আমার খুব ভাল লাগে। তুমি কি ব্রাজিল থেকে এসেছ? তোমার দেশ সম্পর্কে বলো, শুনি। ও হ্যাঁ, তোমাদের দেশে তো কার্নিভাল উৎসব হয়। তোমরা, ব্রাজিলের মেয়েরা সত্যি খুব সুন্দরী।
হাসছে মারিয়া, চেহারায় লাজুকভাব ফুটিয়ে তুলে গ্রহণ করল প্রশংসা। ডান্স ফ্লোরে উঠে এল ওরা, তবে মারিয়ার একটা চোখ থাকল মিলানের ওপর। সে মাঝে মাঝে মাথা চুলকাচ্ছে আর কব্জিতে বাঁধা ঘড়িতে টোকা দিচ্ছে। লোকটার গা থেকে কোলনের গন্ধ আসছে। মারিয়া বুঝতে পারছে সব ধরনের গন্ধের সঙ্গে ওকে অভ্যস্ত হতে হবে। এটা পারফিউমের গন্ধ। ওরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে নাচছে। লোকটার শক্ত পৌরুষের স্পর্শ পাচ্ছে মারিয়া ওর দুই উরুর সন্ধিস্থলে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে লোকটা। উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ওকে বুকের সঙ্গে চাপছে।
আবার ফ্রুট জুস ককটেলের অর্ডার দিল লোকটা। সময় বয়ে চলেছে। মিলান বলেছে সর্বাধিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট ব্যয় করতে পারবে সে। ঘড়ি দেখল মারিয়া। লোকটা জিজ্ঞেস করল মারিয়া কাউকে আশা করছে কিনা। ও জবাব দিল ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ওর কয়েকজন বন্ধু আসবে। লোকটা মারিয়াকে তার হোটেলে যাবার আমন্ত্রণ জানাল।
হোটেলে চলে এল ওরা। সাড়ে তিনশ ফ্রাঁর মামলা দশ মিনিটে খতম। লোকটা খুব উত্তেজিত ছিল। বলল এমন তৃপ্তি জীবনে পায়নি সে। তবে মারিয়ার কোনও অনুভূতি হয়নি। লোকটা যখন তার শরীর ছেনেছুনে একাকার করছে, মারিয়া তাকে উৎসাহ দিয়েছে ঠিকই, তবে পুরোটাই যান্ত্রিকভাবে। সে একজন অভিনেত্রী। তাকে অভিনয় করতে হবে সে-ও তৃপ্তি পেয়েছে। মিলান তাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে। গোসল সেরে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বিদায় নিল মারিয়া। তাকে ধন্যবাদ দিল। তৃপ্ত লোকটা ঘুম জড়ানো চোখে তাকে বিদায় জানাল।
আবার ক্লাবে ফিরতে ইচ্ছে করছে না মারিয়ার, বাড়ি যেতে মন চাইছে। কিন্তু মিলানকে পঞ্চাশ ফ্রাঁ’র হিসগ বুঝিয়ে দিতে হবে। এরপর আরেকজন লোক এল, আরেকটি ককটেল, ব্রাজিল নিয়ে আরও প্রশ্ন, হোটেল, আবার গোসল। এরপর আবার বার-এ প্রত্যাবর্তন। বার মালিককে কমিশন প্রদান। মিলান জানায় মারিয়া ইচ্ছে করলে এখন বাড়ি ফিরতে পারে। কারণ আজ রাতে আর খদ্দের মিলবে না।
ফেরার পথে ট্যাক্সি না পেয়ে হাঁটতে লাগল মারিয়া। দেখল অন্যান্য ক্লাব, ঘড়ি বোঝাই দোকান, গির্জা (বন্ধ… সব সময় ওটা বন্ধ থাকে)। কেউ তার দিকে ফিরে চাইল না।
ঠাণ্ডার মধ্যে হাঁটছে মারিয়া। গায়ের হাড় জমিয়ে দেয়া শীতও যেন অনুভব করছে না। কাঁদছে না সে, যে টাকা কামাই করেছে তা নিয়েও ভাবছে না, এক রকম ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। কেউ কেউ জন্মগ্রহণ করে জীবনকে একাকী মোকাবেলার জন্য। এর মধ্যে ভালো-খারাপ নেই। এ স্রেফ সাধারণ একটা জীবন। মারিয়া তাদেরই একজন।
যা ঘটেছে তা নিয়ে ভাবার চিন্তা করে মারিয়া : আজই কাজ শুরু করেছে সে, ইতিমধ্যে নিজেকে ভাবছে পেশাদার হিসেবে। যেন বহুদিন ধরে কাজটা করছে সে, সারাজীবন ধরে করছে। অদ্ভুত একটা অহঙ্কার হলো মারিয়ার; ও খুশি কারণ ও পালিয়ে যায়নি, তাকে এখন শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হবে কাজটা সে চালিয়ে যাবে কী যাবে না। যদি চালিয়ে যায় তাহলে নিশ্চিত করতে হবে এ লাইনে সে সবার সেরা।
জীবন এখানে শেখাচ্ছে- খুব দ্রুত। কীভাবে টিকে থাকতে হয় তা শিখছে মারিয়া। তবে টিকে থাকতে হলে ওকে সবার সেরা হতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।
মারিয়ার ডায়েরি থেকে, এক সপ্তাহ পরে :
আমি আত্মাহীন শরীর নই। আমার একটি আত্মা আছে যার দৃশ্যমান একটি শরীর রয়েছে। আমি গত এক সপ্তাহ ধরে এই আমার উপস্থিতি যেন আগের চেয়ে বেশি টের পাচ্ছি। আত্মা আমাকে কিছু বলে না, আমার সমালোচনা করে না, আমার জন্য দুঃখিতও হয় না : শুধু আমাকে লক্ষ করে।
আজ আমি বুঝতে পেরেছি কেন এসব ঘটছে : আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা, যেন আমার জন্য আর জরুরি নয় সে এবং ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করছে না। কিন্তু ভালোবাসার কথা না ভাবলে আমার কোনও অস্তিত্বই থাকে না।
দ্বিতীয় রাতে যখন কোপাকাবানায় গেলাম, আমাকে ওরা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করল। এক রাতে একটি মেয়ে সাধারণত একজন সঙ্গীই পায়। কিন্তু আমি শুরু করতে গিয়েই পেয়েছি দু’জন। আমাকে ওরা সহকর্মী হিসেবে মেনে নিয়েছে।
ওরা সবাই স্বপ্ন দেখে কেউ একজন আসবে, সে সত্যিকারের নারী হিসেবে ওদেরকে মূল্যায়ন করবে- সে হবে বন্ধু, প্রেমিক, সঙ্গী। কিন্তু ওরা সবাই জানে এরকম কখনোই ঘটবে না।
আমি ভালোবাসার কথা লিখতে চাই। আমি বারবার ভাবতে চাই এবং লিখতে চাই ভালোবাসা নিয়ে— নইলে আমার আত্মা বাঁচবে না।
বারো
ভালোবাসাকে যতটাই প্রয়োজনীয় এবং দরকারি ভাবুক না কেন মারিয়া, সে প্রথম রাতের উপদেশের কথা ভোলেনি। তাই ভালোবাসা সে ডায়েরির পাতায় বন্দি করে রেখেছে। সে এখন সবার সেরা হবার স্বপ্ন দেখছে, চাইছে স্বল্প সময়ের মধ্যে যত বেশি সম্ভব টাকা রোজগার করতে। সে খুব কমই চিন্তা ভাবনা করে এবং যে কাজটা করছে তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও খুঁজে পেতে চাইছে।
মুশকিল হলো এ প্রশ্নটাই : এ কাজ করার আসল কারণ কী?
কাজটা মারিয়া করছে কারণ করা দরকার। নাহ্, কথাটা ঠিক না- সবারই টাকা কামাই করা দরকার, তবে সবাই সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জানে না। মারিয়া কাজটা করছে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। না, কথাটা মিথ্যা বলা হলো। পৃথিবীতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কম জিনিস নেই- যেমন স্কি করা বা লেক জেনেভায় নৌকা চালানোর মধ্যেও অন্যরকম অভিজ্ঞতার ব্যাপার রয়েছে। মারিয়া এসবের প্রতি কখনও আগ্রহ বোধ করেনি। সে কাজটা করছে কারণ তার হারানোর কিছু নেই। কারণ তার জীবন চলছে হতাশার মাঝ দিয়ে।
না, এসব কথা একটিও সত্যি নয়। কাজেই এসব ভুলে যাওয়াই ভালো এবং ওর নির্দিষ্ট পথে যা আছে তা নিয়েই চলা উচিত। অন্যান্য পতিতাদের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে মিল রয়েছে মারিয়ার, এদের সর্বোচ্চ স্বপ্ন হলো বিয়ে করে নিরাপদ জীবনযাপন। এসব নিয়ে যারা ভাবছে হয় তাদের স্বামী আছে (মারিয়ার সহকর্মীদের বেশিরভাগের বিয়ে হয়ে গেছে) অথবা কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। মারিয়া বোঝার চেষ্টা করে তার সহকর্মীরা কেন এ পেশা বেছে নিল।
ওরা বলে স্বামীদেরকে অর্থ সাহায্য করতে হয় (স্বামীরা কি ঈর্ষাকাতর হয় না? তাদের স্বামীদের কোনও বন্ধু যদি এক রাতে ক্লাবে এসে হাজির হয়ে যায়? এ প্রশ্ন করার সাহস হয় না মারিয়ার), তারা তাদের বাবা-মা’র জন্য বাড়ি কিনতে চায়, তারা এ কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ পায় না (এটা ঠিক কথা হলো না, কারণ সুইটজারল্যান্ডে ক্লিনার, ড্রাইভার এবং রাঁধুনীর চাকরির অভাব নেই)।
এরা কেউই সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তাই মারিয়াও স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড়া করায় না। সে লক্ষ করে তার মালিক মিলান ঠিকই বলেছে : মারিয়াকে আর কেউ সঙ্গদানের জন্য হাজার ফ্রাঁ’র প্রস্তাব দেয়নি। সে সাড়ে তিনশ ফ্রাঁ দাবি করেছে বলে কেউ অনুযোগও করেনি।
এক মেয়ে একদিন বলল :
‘পতিতাবৃত্তি অন্য পেশার মত নয় : এখানে নবাগতরা বেশি বেশি কামায়, অভিজ্ঞরা কম উপার্জন করে। কাজেই সব সময় ভান করতে হবে তুমি নবাগত।’
‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’ কে বা কারা এখনও জানে না মারিয়া। শুধু প্রথম রাতে এদের কথা শুনেছিল। এরপর আর কেউ এদের নিয়ে একটি কথা ও বলেনি। ধীরে ধীরে এ ব্যবসার সবচে’ প্রয়োজনীয় কৌশলটি শিখে ফেলল মারিয়া, কাউকে কখনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে নেই। হাসতে হবে বেশি, কথা যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল, ক্লাবের বাইরে কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যাবে না। সবচে’ জরুরি উপদেশটি দিল ফিলিপিনের মেয়ে নিয়া :
‘তোমার ক্লায়েন্টদের যখন বীর্যপাত হবে, তুমিও এমনভাবে গোঙাতে থাকবে যেন তোমারও রেতঃপাত হচ্ছে। এতে কাস্টমাররা খুশি হয়।’
‘কিন্তু কেন? ওরা তো নিজেদের তৃপ্তি পাবার জন্য পয়সা দেয়?’
না। তুমি ভুল ভাবছ। পুরুষ বীর্যপাত ঘটিয়ে প্রমাণ করে না যে সে পুরুষ। সে নিজেকে তখনই সত্যিকারের পুরুষ ভাবতে পারে যখন সে নারীকে রতিসুখ দিতে পারে। আর সে যদি কোনও পতিতাকে তৃপ্তি দিতে পারে তাহলে নিজেকে সে পৃথিবীর সেরা খেলুড়ে ভেবে গর্ব অনুভব করে।
তেরো
ছয় মাস কেটে গেল। প্রয়োজনীয় সব কিছুই এ সময়ের মধ্যে শিখে ফেলল মারিয়া। যেমন কোপাকাবানা কীভাবে কাজ করে জেনে গেল ও। রু ডি বার্ন- এর অন্যতম দামী ক্লাব বলে এখানকার খদ্দেররাও অত্যন্ত অভিজাত, নির্বাহী শ্রেণীর। এরা রাত করে বাড়ি ফেরে ‘ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সাপার’-এর ধুয়ো তুলে। তবে এসব ‘সাপার’ চুকে যায় রাত এগারোটার মধ্যে। এ ক্লাবের বেশিরভাগ পতিতার বয়স আঠারো থেকে বাইশের মধ্যে, তারা গড়ে বছর দুই কাজ করে। তারপর নতুন লোক নেয়া হয়। পুরানোরা চলে যায় নিওনে, সেখান থেকে জেনিয়াম। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মেয়েদের দামও কমতে থাকে, কাজের সময় ঘণ্টা ক্রমে হ্রাস পেতে শুরু করে। এদের শেষ আশ্রয় ঘটে ট্রপিকাল এক্সট্যাসিতে, এরা ত্রিশোর্দ্ধ নারীদের গ্রহণ করে। তবে এখানে আসার পরে খুব বেশি রোজগারের সুযোগ তাদের হয় না। কোনমতে লাঞ্চের খরচটা জুটে যায়। সারা দিনে ক্লায়েন্ট হিসেবে দু’একজন ছাত্র পায়। এরা বড় জোর সস্তা এক বোতল মদ কিনে দেয়ার সামর্থ্য রাখে।
মারিয়া এ পর্যন্ত বহু পুরুষের সঙ্গে বিছানায় গেছে। এদের বয়স কত, কী রকম পোশাক পরেছে কিংবা তাদের গা থেকে ঘামের গন্ধ আসে কিনা এসব বিবেচ্য নয় মারিয়ার কাছে। খদ্দের ধূমপান করলেও সে কিছু মনে করে না তবে যারা সস্তা আফটার শেভ মেখে আসে গালে কিংবা গা থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বেরোয় অথবা বাসি জামাকাপড় পরে, এদেরকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না মারিয়া।
কোপাকাবানা নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা। আর সুইটজারল্যান্ড সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে পতিতা হিসেবে কাজ করতে গেলে ওয়ার্ক এবং রেসিডেন্স পারমিট দরকার হয় এবং এ দেশে কাগজপত্র পেতে কোনও সমস্যা নেই, সামাজিক নিরাপত্তাও মেলে। মিলান সব সময় বলে সে চায় না তার বাচ্চারা ট্যাবলয়েড পত্রিকায় তার নাম দেখুক। এ জন্য পুলিশদের মতোই সে আইনকানুন রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর।
পতিতারা সারা সপ্তাহ কাজ করে। রোববারটা বিশ্রাম পায়। বেশিরভাগ পতিতা ধর্মকর্মে বিশ্বাসী। তারা গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে।
মারিয়া বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছে তার প্রতি পাঁচজন খদ্দেরের একজন সেক্সে আগ্রহী নয়, তারা গল্প করতে চায়। তারা বার এবং হোটেল রুমের ভাড়া চুকিয়ে দেয়, কাপড় খোলার পর্ব এলে পুরুষটি কাপড় খুলতে মানা করে। তারা কাজের চাপ, অবিশ্বস্ত স্ত্রী, তারা কতটা একা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বকবক করে।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগত মারিয়ার। এক রাতে সে এক বিখ্যাত কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় ফরাসী নির্বাহীর সঙ্গে হোটেলে গেল। নির্বাহী তাকে বললেন :
‘তুমি জানো পৃথিবীতে সবচে’ একা কে? সফল ক্যারিয়ারের একজন এক্সিকিউটিভ। সে প্রচুর টাকা বেতন পায়, সবাই তাকে বিশ্বাস করে, সে বাচ্চাদের নিয়ে ছুটি কাটাতে যায়, তাদের হোমওয়ার্ক করে দেয়। কিন্তু এরাই পরে প্রশ্ন করে : ‘কীভাবে এ পেশা বদলে আরও বেশি আয় করা যায়?’
‘এক্সিকিউটিভ বা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সব আছে তবু তারা নিঃসঙ্গ। কেন? কারণ তাদের কথা বলার কেউ নেই। সে ভালো কাজের অফার পেলেও তা কলিগদেরকে বলতে পারে না। কারণ তারা তাকে ছাড়তে চাইবে না। সে স্ত্রীর সঙ্গেও সবকিছু শেয়ার করতে পারে না। কারণ স্ত্রী তার ঝুঁকিগুলো নেবে না বা নিতে পারবে না। সে তার জীবনের বৃহত্তম সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলার মত মানুষ খুঁজে পায় না। ভাবতে পার এই মানুষটার মনের মাঝে কী রকম উথাল-পাথাল চলে?’
না, এই মানুষটি পৃথিবীর সবচে’ নিঃসঙ্গ নয়। পৃথিবীর সবচে’ নিঃসঙ্গ মানুষ হলো সে নিজে : মারিয়া। তবু ক্লায়েন্টের কথায় তাল দেয় সে বড় বকশিস পাবার লোভে। তবে নির্বাহীর কথা শুনে উপলব্ধি করে মারিয়া ক্লায়েন্টদের প্রবল মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করার কোনও উপায় তাকে বের করতে হবে। এতে তার সেবার মান যেমন বেড়ে যাবে, সেই সঙ্গে বাড়তি কিছু পয়সাও আসবে পকেটে।
মারিয়া যখন বুঝতে পারল শরীরের টেনশন থেকে মুক্ত হবার মত আত্মার টেনশন থেকে মুক্ত হওয়াও জরুরি, সে আবার লাইব্রেরিতে যেতে শুরু করল। সে বৈবাহিক সমস্যা, মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতির বই পড়তে চাইল। লাইব্রেরিয়ান এই তরুণীকে খুব পছন্দ করে। সে খুশি হলো মেয়েটি সেক্স বাদ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করছে দেখে।
খবরের কাগজের নিয়মিত পাঠিকা হয়ে উঠল মারিয়া। বিশেষ করে অর্থনীতির পাতা সে খুঁটিয়ে পড়ে। এর কারণ তার ক্লায়েন্টদের বেশিরভাগ বিজনেস এক্সিকিউটিভ। সে আত্ম-উন্নয়নের বইয়ের সন্ধান করে, কারণ তার ক্লায়েন্টরা তার কাছে পরামর্শ চায়। মারিয়া মানবিক আবেগ নিয়ে পড়াশোনা করে। কারণ তার প্রতিটি খদ্দেরই কোনও না কোনওভাবে মানসিক আবেগের যন্ত্রণায় দগ্ধ।
মারিয়া মাত্র ছ’মাসের মাথায় পরিচিতি পেয়ে গেল অন্যরকম একজন পতিতা হিসেবে। তার ক্লায়েন্টরা অত্যন্ত সুনির্বাচিত, বিশ্বস্ত এবং বড় লোক। তার কলিগরা তাকে হিংসা করে তবে সম্মানও করে।
সেক্স মারিয়ার জীবনে নতুন কিছু যোগ করেনি। তার কাছে সেক্স মানে দু’পা ফাঁক করে দেয়া, খদ্দেরকে কনডম ব্যবহার করতে বলা, ভালো বকশিসের আশায় গোঙাতে থাকা (ফিলিপিনো নিয়াকে ধন্যবাদ, শীৎকারের কারণে মারিয়া অতিরিক্ত পঞ্চাশ ফ্রাঁ আয় করে) এবং কাজ শেষে গোসল সেরে নেয়া এ আশায় যে জলের ধারা তার আত্মা পরিষ্কার করে তুলবে।
মারিয়া চুমোচুমির মধ্যে যায় না। পতিতাদের কাছে চুম্বন পবিত্ৰ বিষয়। নিয়া বলেছে প্রেমিকের জন্য চুমু সংরক্ষণ করে রাখতে, স্লীপিং বিউটির গল্পের মত; যে চুমু ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে মারিয়াকে, ওকে নিয়ে যাবে রূপকথার রাজ্যে।
যৌন সঙ্গমে মারিয়ার কখনোই রেতঃপাত ঘটে না। সে কোনও মজাও পায় না, উত্তেজনাও বোধ করে না। সে সঙ্গমের কলা কৌশল শিখতে মাঝে মাঝে পর্ণোছবি দেখে। তবে এসব কৌশল খদ্দেরের জন্য প্রয়োগ করে না। কারণ এতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়। এত নষ্ট করার সময় কোথায় মারিয়ার? মিলান খুশি হয় যখন দেখে তার মেয়েদের কেউ কেউ এক রাতে তিনজন খদ্দের সামলাচ্ছে।
ছয় মাস শেষে ব্যাংকে মারিয়ার ষাট হাজার সুইস ফ্রাঁ জমে গেল। সে এখন ভালো রেস্টুরেন্টে খায়, একটি টিভি কিনেছে (টিভি কখনোই দেখে না মারিয়া, তবে ঘরে যন্ত্রটি আছে বলে খুশি) ভাবছে কিছু দিনের মধ্যে ভাল কোনও অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাবে। ইচ্ছে করলেই এখন বই কিনতে পারে মারিয়া তবে লাইব্রেরিতে যাবার অভ্যাসটি ধরে রেখেছে। বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে এটা তার সেতুবন্ধন, নিরেট, খাঁটি এক দুনিয়া। সে লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে মজা পায়। লাইব্রেরিয়ান মারিয়ার হাসিখুশি চেহারা দেখে আনন্দিত। তার ধারণা মারিয়া বয়ফ্রেন্ড ও চাকরি দুটোই পেয়ে গেছে, যদিও এ ব্যাপারে কখনও সে প্রশ্ন করে না। কারণ সুইসরা প্রকৃতিগতভাবেই লাজুক স্বভাবের এবং সরল।
এক উষ্ণ রোববারের সন্ধ্যায়, মারিয়ার ডায়েরি থেকে : সকল পুরুষ, লম্বা-খাঁটো দুর্বিনীত, চুপচাপ, বন্ধুত্ব পরায়ণ-শীতল, প্রত্যেকের একটা ব্যাপারে মিল আছে : এরা যখন ক্লাবে আসে, ভয়ে যেন শিঁটিয়ে থাকে। এদের মধ্যে বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা জোরে জোরে কথা বলে তাদের ভয় গোপন করে, মদ খেয়ে ভয় দূর করার চেষ্টা করে। তবে আমি বুঝতে পেরেছি, অল্প কিছু উদাহরণ ছাড়া— মিলান যে ‘স্পেশাল ক্লায়েন্ট’দের সঙ্গে আমার এখনও পরিচয় করিয়ে দেয় নি, এরা ছাড়া— সকলেই ভীত ও শঙ্কিত।
এদের কীসের ভয়? ভয় তো পাব আমি। আমি ক্লাব ছেড়ে তাদের সঙ্গে অচেনা হোটেলে যাই, আমাকে কেউ হামলা করলে ঠেকানোর মত শারীরিক শক্তি বা অস্ত্র কোনোটাই আমার নেই। পুরুষরা বড্ড অদ্ভুত। কোপাকাবানায় যারা আসে শুধু তাদের কথা বলছি না, পর্যন্ত যত পুরুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, প্রত্যেককেই আজব চীজ মনে হয়েছে। তারা আপনাকে ধরে মারবে, চিৎকার করবে, হুমকি দেবে, তারপরও মেয়েদের ভয়ে কাঁপতে থাকবে। তারা শুধু নিজেদের বউকেই নয়, সব মেয়েকেই ভয় পায়।
চোদ্দ
জেনেভায় আসার পর যে সব পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে মারিয়ার এরা প্রত্যেকে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী বলে জাহির করতে চায়, এমন ভান করে যেন গোটা বিশ্ব তাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু তাদের চোখ দেখে মারিয়া বুঝতে পারে এরা তাদের বউকে প্রচণ্ড ভয় পায়, আতঙ্কে থাকে হয়তো পুরুষাঙ্গ উদ্রিত হবে না। এরা জুতোর দোকান থেকে জুতো কিনে আনার পরে তা যদি পায়ে না গলাতে পারে, ফিরে যায় ওই দোকানে। হয় জুতোর দাম ফেরত চায় কিংবা নতুন এক জোড়া জুতো দাবি করে। কিন্তু পতিতাদের কাছে এসে যদি লিঙ্গ খাড়া করতে না পারে, লজ্জায় আর এ মুখো হয় না। কারণ তারা ভাবে তাদের পুরুষত্বহীনতার কথা অন্য পতিতারাও জেনে ফেলেছে।
মারিয়া ভাবে, আমি যদি ওদেরকে উত্তেজিত করতে না পারি তাহলে তো লজ্জা আমার পাওয়া উচিত। কিন্তু উল্টো ওরা লজ্জিত হয়।
বিব্রতকর এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মারিয়া সব সময় পুরুষদেরকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করে। কেউ যদি মাতাল হয়ে থাকে কিংবা মনে হয় এর যৌনশক্তি তেমন প্রবল নয়, ফুল সেক্সের দিকে যায় না মারিয়া। সে তার খদ্দেরকে আদর করে, হস্তমৈথুন করে দেয়। এতে তারা আরও বেশি সুখ লাভ করে।
মারিয়ার সতর্ক নজর থাকে তার খদ্দেররা যেন লজ্জা বোধ না করে। তার ক্লায়েন্টরা সব বড় বড় কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা। কত চাপের মধ্যে তাদেরকে থাকতে হয়। তারা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হতে ক্লাবে আসে। সাড়ে তিনশ ফ্রাঁ ব্যয় করে এক রাতের বিনোদনে। ‘এক রাত? আরে, মারিয়া, তুমি অতিরঞ্জিত করছ। আসলে তো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। জামা কাপড় খোলা, যৌন উদ্দীপক পোজ দেয়া, ফালতু কথাবার্তা, আবার জামা-কাপড় পরা ইত্যাদি কাজগুলোর পেছনে যে সময়টা ব্যয় হয় তা বাদ দিলে শুধু সেক্সের জন্য আসলে তুমি ব্যয় করছ এগারো মিনিট।
এগারো মিনিট। গোটা পৃথিবীটা ঘুরছে এই এগারো মিনিটের জন্য। এগারো মিনিটের আনন্দ পেতে পুরুষ কত কিছুই না করছে? এগারো মিনিট শেষ, মামলা খতম। পয়সা হজম।
এই এগারো মিনিট মারিয়ার ব্যাংক ব্যালান্স বৃদ্ধি করছে, সে বাড়িতে মাকে টাকা পাঠাতে পারছে, স্বপ্নের জিনিসপত্র কিনতে পারছে, সে সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমের ভালো একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠে আসতে পেরেছে সবই এগারো মিনিটের দৌলতে। এগারো মিনিটের এই নিষিদ্ধ দুনিয়া নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। এ দুনিয়ায় মারিয়া প্রবেশ করে শরীর নিয়ে, মস্তিষ্ক নিয়ে নয়।
মারিয়া তার খদ্দেরদের তিন ভাগে ভাগ করেছে : এক্সটার্মিনেটর (এ নামে একটা ছবি দেখেছে মারিয়া, উপভোগ করেছে খুব), এরা ক্লাবে ঢোকে গায়ে মদের গন্ধ নিয়ে, ভান করে কাউকে দেখছে না, তবে লক্ষ রাখে সবাই তাদের খেয়াল করছে কিনা। এরা ডান্স ফ্লোরে অল্প কিছুক্ষণ নাচে, তারপর সোজা হোটেলে চলে যায়। দ্বিতীয় দলটি হলো প্রিটি উত্তম্যান টাইপ (এটিও সিনেমা থেকে ধার করা নাম), এরা বেশ ভদ্রসভ্য, যেন হঠাৎ করেই ঢুকে পড়েছে ক্লাবে, এমন একটা ভাব থাকে, তারা শুরুতে খুব মিষ্টি আচরণ করে, – তবে হোটেলে ঢুকে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগে। তবে এক্সটার্মিনেটরদের চেয়েও এদের যৌনক্ষুধা প্রবল। তিন নম্বর হলো গডফাদার টাইপ (বলাবাহুল্য এটিও সিনেমার নাম), এরা নারী শরীর স্রেফ পণ্য বলে মনে করে। এরাই হলো জেনুইন : নাচে, গল্প করে, কখনও বকশিস দেয় না, জানে না তারা কী কিনছে এবং এর মূল্য কত এবং কোনও মেয়েকে তাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে দেয় না, এদেরকেই প্রকৃত অর্থেই ‘অ্যাডভেঞ্চারার’ বলা চলে।
মারিয়ার ডায়েরি থেকে, এদিন তার মাসিক হয়েছে এবং কাজে যেতে পারে নি :
আমাকে অনেকেই ভাবে সাহসী, সুখী, স্বাধীন নারী। ধ্যাত- আমি তা মোটেই নই। আমি এগারো মিনিটের চেয়েও জরুরি যে শব্দটি উচ্চারণ করা দরকার তা করতে পারি না। শব্দটি হলো— প্রেম।
সারাজীবন আমি ভেবেছি প্রেম বা ভালোবাসা হলো এক ধরনের স্বেচ্ছা ক্রীতদাসত্ব। এটি মিথ্যা কথা যে স্বাধীনতার অস্তিত্ব তখনই থাকে যখন ভালোবাসা বর্তমান থাকে। আসলে যারা মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে পারে কেবল তারাই নিজেদেরকে মুক্ত ভাবতে পারে। কাজেই আমি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি বা শিখছি তা অর্থহীন। আমি আশা করছি এ সময়টা দ্রুত পার হয়ে যাবে। নিজেকে নিয়ে আমি গবেষণা করতে পারব- নিজেকে খুঁজে পাব মানুষের কাঠামোয় যে আমাকে বুঝতে পারবে এবং আমাকে কষ্ট দেবে না।
কিন্তু এসব আমি কী বলছি? প্রেমে পড়লে কেউ কারও ক্ষতি করতে পারে না। আমরা আমাদের অনুভূতির জন্য নিজেরাই দায়ী, এজন্য অন্যদেরকে দায়ী করা চলে না। আমি যাকে ভালোবাসি তাকে যখন হারিয়ে ফেলি, খুব কষ্ট হয় আমার। তবে এখন আমার মনে হচ্ছে আসলে কেউ কাউকে হারায় না, কারণ কেউ কারও নয়।