ইলেভেন মিনিটস – ১

এক 

একদেশে ছিল এক পতিতা, নাম তার মারিয়া। দাঁড়ান, দাঁড়ান। ‘এক দেশে ছিল’ কথাটা বাচ্চাদের রূপকথার মত শোনাচ্ছে না! আর ‘পতিতা’ শব্দটি তো প্রাপ্তবয়স্কদের। এরকম প্রত্যক্ষ বিভেদ নিয়ে কি করে গল্প শুরু করি? কিন্তু আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেহেতু এক পা দিয়ে রেখেছি রূপকথার ভুবনে, আরেক পা নরকের অতল খাদে, কাজেই শুরুটা এভাবেই হোক না। 

এক দেশে ছিল এক পতিতা, নাম তার মারিয়া। 

আরও অনেক বারবণিতার মতই সে জন্ম নিয়েছিল কুমারী, নিষ্পাপ একটি মেয়ে হিসেবে, কৈশোরে স্বপ্ন দেখত সে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের দেখা পেয়েছে (ধনী, সুদর্শন, বুদ্ধিমান), তাকে বিয়ে করছে (বিয়ের পোশাক পরে), দু’টি সন্তান হয়েছে তাদের (তারা বড় হয়ে বিখ্যাত হবে) এবং বাস করছে চমৎকার একটি বাড়িতে (সেখান থেকে সাগর দেখা যায় )। 

মারিয়ার বাবা ভ্রাম্যমান সেলসম্যান, কাঠখোট্টা ভাষায় যাকে বলে ফেরিঅলা। তার মা অতি সাধারণ গৃহিণী। মারিয়ারা থাকে ব্রাজিলের এক মফস্বলে, তাদের শহরে একটি মাত্র সিনেমা হল, একটি নাইটক্লাব এবং একটি ব্যাংক। মারিয়া সব সময় স্বপ্ন দেখে একদিন হঠাৎ করেই হাজির হয়ে যাবে তার স্বপ্নের রাজপুত্তুর, ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে দুনিয়া দখল করতে। 

স্বপ্নের রাজকুমারের দেখা পাবার আশায় প্রতীক্ষায় প্রহর গোণে মারিয়া। এগারো বছর বয়সে তার জীবনে প্রস্ফুটিত হলো প্রথম প্রেম। প্রেমে পড়ল মারিয়া, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে। 

মারিয়া সেদিন আবিষ্কার করল স্কুলের যাত্রাপথে সে একা নয়, আরেকটি ছেলেও একই রাস্তা ধরে স্কুলে যায়। ছেলেটি পাড়ারই, মারিয়া যে সময় স্কুলে যায়, একই সময় সে-ও স্কুলে যাচ্ছে। দু’জনের মাঝে বাক্য বিনিময় হয় না একবারও, তবে স্কুলে যাওয়ার সময়টুকু দারুণ উপভোগ করে মারিয়া। ধুলো মেখে, চাঁদি ফাটা গরমে প্রবল তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে ছেলেটি আগে আগে হাঁটে, মারিয়া ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। 

একই দৃশ্য অভিনীত হতে লাগল মাসের পর মাস; মারিয়া, পড়াশোনায় যার প্রবল অনীহা এবং টিভি দেখা যার একমাত্র শখ, প্রার্থনা করতে থাকে দিনগুলো যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়। তার বয়সী মেয়েদের মত ছুটির দিনগুলো মারিয়ারও নিতান্তই নীরস এবং একঘেয়ে কাটে। মারিয়ার প্রচণ্ড রাগ হয় কারণ দিনগুলো বিশাল লম্বা হলেও ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে সে মাত্র দশ মিনিট কাটানোর সময় পায় এবং বাকি হাজার হাজার ঘণ্টা তার ভেবে চলে যায় ছেলেটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলে কী মজাটিই না হতো। 

সুযোগটা মিলেও গেল একদিন। 

সেদিন সকালে, স্কুলে যাবার পথে ছেলেটি এল মারিয়ার কাছে, জানতে চাইল মারিয়া তাকে একটি পেন্সিল ধার দিতে পারবে কি না। মারিয়া জবাব দিল না; আসলে অপ্রত্যাশিত এই আগমনে সে বরং বিরক্তই হয়েছে, তার পদক্ষেপ দ্রুততর হলো। সে আতঙ্ক বোধ করল দেখে ছেলেটি তার দিকেই আসছে, শঙ্কিত বোধ করল ভেবে ও হয়তো জেনে যাবে মারিয়া তাকে কতটা ভালোবাসে, তার জন্য কত ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে, কত স্বপ্ন দেখে তার হাত সে নিজের মুঠোয় পুরে নিয়েছে, তার সঙ্গে স্কুলের গেটের সামনে দিয়ে হন হন করে এগিয়েছে, চলে গেছে রাস্তার শেষ মাথায়, যেখানে- লোকে বলে— রয়েছে বিরাট এক শহর, সেখানে চলচ্চিত্র এবং টিভি তারকারা বাস করেন, আছে প্রচুর প্রেক্ষাগৃহ এবং মজা করার হাজারও উপকরণ। 

সেদিন সারাদিন পড়ায় মন বসাতে পারল না মারিয়া, ছেলেটির সঙ্গে কেন অমন অদ্ভুত আচরণ করল ভাবতেই নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তবে একই সংগে মনের গভীরে স্বস্তি অনুভব করছে কারণ সে জানে ছেলেটির নজর কেড়েছে সে, পেন্সিল চাওয়াটা কথা বলার সুযোগ সৃষ্টির অজুহাত মাত্র। কারণ মারিয়া লক্ষ করেছে ছেলেটি যখন তার কাছে এল, তার পকেটে কিন্তু পেন্সিল ছিল। মারিয়া ছেলেটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকল— রাত যায়- মারিয়া রিহার্সাল দেয় কীভাবে সে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলবে। 

কিন্তু কথা বলার সুযোগ আর আসে না। যদিও একই সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে দু’জনে। মারিয়া কখনও কয়েক কদম সামনে, ডান হাতে পেন্সিল, আবার কখনও ইচ্ছে করে পিছিয়ে পড়ে, বারবার তাকায় ছেলেটির দিকে। কিন্তু ছেলেটি মারিয়ার সঙ্গে কোনও বাতচিৎ করে না। মারিয়া ছেলেটিকে এক তরফা ভালোবেসে যাবার যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে লাগল। 

স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। একদিন সকালে মারিয়া ঘুম থেমে জেগে দেখে তার পা মাখামাখি হয়ে গেছে তাজা খুনে। ও নির্ঘাৎ মারা যেতে চলেছে, নিশ্চিত হয়ে গেল মারিয়া। সে ছেলেটিকে একটি চিঠি লিখবে সিদ্ধান্ত নেয়। বলবে ছেলেটি ছিল তার জীবনের একমাত্র প্রেম। এরপর মারিয়া বনে চলে যাবে। ওখানে যে দুই ভয়ঙ্কর দানব থাকে তাদের যে কোনও একজনের হাতে খুন হয়ে যাবে সে। ওই দুই দানব ওদের শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। একটি হলো মায়া নেকড়ে, অপরজন মুলা-সেম- কাবেসা (এক ধর্মযাজকের রক্ষিতা, খচ্চরের রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায় রাতের আঁধারে)। তবে মারিয়ার খোঁজ না পেয়ে তার বাবা মা হয়তো ভাববেন কেউ তাদের সুন্দরী মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। একদিন মারিয়া ফিরে আসবে ধনী এবং খ্যাতিমান হয়ে। ওদের দরিদ্র শহরের গরীব বাবা-মা’রা এরকমটাই আশা করেন কিনা। এদিকে মারিয়াকে দেখতে না পেয়ে তার কিশোর প্রেমিক নিদারুণ জ্বালায় দগ্ধ হবে। মারিয়াকে সে ভুলতে পারবে না। নিজেকে সে নির্যাতন করবে কেন মারিয়ার সঙ্গে কথা বলে নি। 

তবে চিঠি লেখা হয়ে ওঠে না। কারণ তার মা ঘরে এসে রক্তমাখা চাদর দেখে হেসে বলেন : 

‘তুমি এখন বড় হয়ে গেছ।’ 

মারিয়া বুঝে উঠতে পারে না পায়ের রক্তের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠার মধ্যে কী সম্পর্ক। কিন্তু মা ওকে সন্তুষ্ট করার মত কোনও ব্যাখ্যা দিলেন না; তিনি শুধু বলেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, আজ থেকে, প্রতি মাসে চার/পাঁচদিন মারিয়াকে তার দু’পায়ের মাঝখানে পুতুলের বালিশের মত একটি জিনিস পরে থাকতে হবে। মারিয়া জিজ্ঞেস করে ছেলেদের ট্রাউজার রক্ত ভরে গেলে তারা রক্তপাত বন্ধ করতে কোনও টিউব ব্যবহার করে কিনা। জবাব আসে, এ রকম রক্তস্রাবের ঘটনা কেবল মেয়েদের ক্ষেত্রেই ঘটে। 

মারিয়া এ বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশ জানায় কিন্তু অবশেষে ‘মাসিক’-এর ব্যাপারটিতে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তার জীবনযাত্রাও বদলে যায়। ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাপ একদম বন্ধ। তাকে শুধু শহরের গির্জায় যাবার অনুমতি দেয়া হয় এবং সেন্ট অ্যান্থনির সামনে শপথ নিতে হয় সে কখনও সেধে কোনও ছেলের সঙ্গে কথা বলতে যাবে না। 

পরদিন নিজের সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরে স্কুলে যায় মারিয়া ছুটির অসহ্য দিনের সমাপ্তি ঘটেছে বলে সে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে রাস্তায় ছেলেটিকে দেখতে পায় না মারিয়া। আরেকটি যন্ত্রণাকাতর সপ্তাহ চলে যায়। মারিয়া স্কুলের বান্ধবীদের কাছে জানতে পারে ছেলেটি শহর ছেড়ে চলে গেছে। ‘দূরের কোনও শহরে গেছে বলে শুনেছি’ জানায় একজন। 

ওই মুহূর্তে মারিয়া বুঝতে পারে কিছু কিছু জিনিস কখনও ফিরে পাওয়া যায় না। জানতে পারে ‘দূরে কোনও শহরে’ আছে, সে পৃথিবীটি বিশাল। সে তুলনায় তাদের নিজেদের শহরটি অতিশয় ক্ষুদ্র, এজন্যই তাদের শহর ছেড়ে দূরে চলে যায় মানুষ। 

মারিয়ারও ইচ্ছে করে চলে যেতে। কিন্তু ওতো এখনও অনেক ছোট। তবু ধুলো মাখা নোংরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে মারিয়া সিদ্ধান্ত নেয় সেও একদিন ছেলেটির পথ ধরবে। সে ভার্জিন মেরীর কাছে প্রার্থনা করে মেরী যেন তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবার সুযোগ করে দেন। 

ছেলেটি ঠিক কোথায় গেছে, খোঁজ-খবর করেও জানা সম্ভব হয় না। ছেলেটির জন্য মন খারাপ হয় মারিয়ার। তার মনে হতে থাকে পৃথিবীটা অনেক বড়, এখানে ভালোবাসা খুব বিপজ্জনক এবং ভার্জিন মেরী এতদূরের স্বর্গলোকের বাসিন্দা যে তাঁর কানে ছোটদের প্রার্থনা পৌঁছায় না। 

দুই 

তিন বছর কেটে গেল; মারিয়া ভূগোল এবং অঙ্ক শিখল, টিভিতে সে এখন নিয়মিত নাটক দেখে; স্কুলে পড়ল প্রথম যৌন পত্রিকা; নিজের নীরস, একঘেয়ে জীবনের বর্ণনা দিয়ে লিখতে শুরু করল ডায়েরি। স্কুলে যে সব বিষয় নিয়ে গল্প করা হয়— সাগর, বরফ, পাগড়ি মাথায় পুরুষ, অলঙ্কার পরা অভিজাত নারী, এদেরকে স্বচক্ষে দেখার অভিলাষ ব্যক্ত করে মারিয়া তার ডায়েরিতে। 

পনের বছর বয়সে মারিয়া আবার প্রেমে পড়ল। হলি উইক অনুষ্ঠানে গিয়ে ছেলেটির সঙ্গে তার পরিচয় হলো। 

ছেলেবেলার ভুলের পুনরাবৃত্তি করল না মারিয়া। তারা কথা বলল, সম্পর্ক মোড় নিল বন্ধুত্বে এবং পার্টি ও সিনেমায় যেতে লাগল একত্রে। প্ৰথম ছেলেটির মতো দ্বিতীয় ছেলেটির ক্ষেত্রেও একই জিনিস লক্ষ করল মারিয়ার। সে প্রেমিকের অবর্তমানেই বরং তার প্রতি বেশি প্রেম অনুভব করছে, সে কল্পনা করে পরের দিন যখন মিলিত হবে, কী কথা বলবে, একত্রে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত সে স্মরণ করে, চেষ্টা করে বুঝতে। সে কী ঠিক কাজটি করেছে আর ভুলটাই বা কী করেছে। নিজেকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তরুণী ভাবতে ভালো লাগে মারিয়া। যার জীবন থেকে কিনা ফস্কে গেছে প্রথম প্রেম এবং যে এই যন্ত্রণার স্বরূপ জানে। এখন সে এই লোকটিকে বিয়ে করার জন্য সকল শক্তি দিয়ে লড়াই করতে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। মারিয়া একে বিয়ে করে তার সন্তান জন্ম দেবে, সাগর তীরে তাদের বাড়ি হবে— এ স্বপ্নে সে বিভোর। সে মা’র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলল। 

মা মিনতির গলায় বললেন,’ কিন্তু তুমি তো এখনও ছোট, সোনা।’ 

‘তুমি কিন্তু বাবাকে ষোলো বছর বয়সে বিয়ে করেছ।’ 

মা আর বললেন না যে আকস্মিক গর্ভধারণের কারণে ওই সময়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। ‘তখন ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম’ বলে মা তর্কের অবসান ঘটান। 

পরদিন মারিয়া তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গাঁয়ের ধারে গেল বেড়াতে। ওরা অল্পস্বল্প কথা বলছে, মারিয়া জানতে চাইল ছেলেটি ঘুরে বেড়াবে কিনা। জবাব না দিয়ে বয়ফ্রেন্ড মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। 

মারিয়ার প্রথম চুম্বন! এ মুহূর্তটির জন্য কত না স্বপ্ন দেখেছে সে! চুমু খাওয়ার জন্য নিসর্গও কত চমৎকার- সারস উড়ছে, অস্ত যাচ্ছে সূর্য, দূর থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীত। মারিয়া পিছিয়ে যাবার ভান করল, কিন্তু পরক্ষণে সিনেমা এবং টিভিতে দেখা দৃশ্যের মত আলিঙ্গন করল প্রেমিককে : ছেলেটির ঠোঁটে ঘষতে লাগল নিজের রসে টসটস অধর, মাথাটা ছন্দবদ্ধভাবে ডানে-বামে ঘোরাচ্ছে। টের পেল তার দাঁতের ফাঁকে ঢুকে গেছে প্রেমিকের জিভ। স্বাদটা দারুণ লাগল মারিয়ার কাছে। 

হঠাৎ বিরতি দিল ছেলেটি। জিজ্ঞেস করল : 

‘তুমি চাওনা?’ 

কী জবাব দেবে মারিয়া? ওকি চায় ঘটনাটা ঘটুক? অবশ্যই চায়। কিন্তু কোনও নারীর এভাবে নিজেকে মেলে ধরা উচিত নয়, বিশেষ করে তার ভবিষ্যৎ স্বামীর কাছে, তাহলে বাকি জীবনটা সে হয়তো মারিয়ার ‘হ্যাঁ’ বলার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু খুঁজে বেড়াবে, ভাববে মারিয়া সহজলভ্য বস্তু। মারিয়া চুপ করে রইল। 

ছেলেটি আবার চুমু খেতে লাগল মারিয়াকে। তবে এবার আগের মত উৎসাহ নিয়ে নয়। আবার থেমে গেল ছেলেটি। লাল মুখ। মারিয়া বুঝতে পারে কিছু একটা ভজকট হয়ে গেছে, তবে সমস্যাটা জানতে চাইতে ভয় লাগল ওর। প্রেমিকের হাত ধরল ও, একসঙ্গে ফিরে এল শহরে অন্যান্য নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে, যেন কিছুই ঘটেনি ওদের মধ্যে। 

.

সে রাতে মারিয়া ডায়েরিতে লিখল : 

আমরা যখন কারও সঙ্গে মিলিত হই এবং প্রেমে পড়ি, তখন আমাদের মনে হয় গোটা পৃথিবী চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। আজ সূর্যাস্তের সময় আমার এমনই মনে হয়েছিল। কিন্তু কী যে হঠাৎ করে হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সুন্দর কি এত দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? 
জীবন খুব দ্রুত এগিয়ে চলে। আমাদেরকে এক লহমায় নিয়ে যায় স্বর্গ থেকে নরকে। 

.

পরদিন বিষয়টি নিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলল মারিয়া। ওরা সবাই ওকে তার ভবিষ্যৎ ‘বাগদত্ত’র সঙ্গে ঘুরতে যেতে দেখেছে। বান্ধবীরা আগ্রহে মরে যাচ্ছে কী ঘটেছে জানার জন্য, মারিয়া উৎসাহে টগবগ করতে করতে চুম্বনের বর্ণনা দিয়ে চলল। যেই বলল ছেলেটির জিভ যখন তার দাঁত স্পর্শ করেছে তখন মারিয়া কামড়ে দিয়েছে জিভ, হেসে উঠল একটি মেয়ে। 

‘তুমি তোমার মুখ খোলো নি?’ 

হঠাৎ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় মারিয়ার কাছে- ছেলেটির প্রশ্ন, তার হতাশা। 

‘কীসের জন্য?’ 

‘ওর জিভ তোমার মুখের মধ্যে ঢোকানোর জন্য।’ 

‘তাতে কী হবে?’ 

‘তাতেই সবকিছু হয়। নারী-পুরুষ এভাবেই চুমু খায়।’ 

.

মারিয়ার অনভিজ্ঞ চুম্বন অভিজ্ঞতা নিয়ে বান্ধবীরা খুব হাসাহাসি করে। মারিয়াও হাসার ভান করে, যদিও তার আত্মা কাঁদছিল। যে সব ছবি সে দেখেছে ওগুলোকে মনে মনে গালিগালাজ করে মারিয়া। কারণ সিনেমায় সে দেখেছে চুমু খাওয়ার সময় মেয়েটির চোখ বুজে যায়, হাত রাখে পুরুষের মাথায়, মেয়েটি নিজের মাথা ঈষৎ ডানে-বামে নাড়াতে থাকে। তবে চুম্বনের আসল বিষয়টিই তারা দেখায় নি। মারিয়া আবার চুমু খাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে। 

তিন দিন পরে ছেলেটির সঙ্গে মারিয়ার দেখা হলো স্থানীয় এক ক্লাবের পার্টিতে, দেখল তার এক বান্ধবীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওই বান্ধবীই মারিয়ার কাছে চুমুর অভিজ্ঞতা শুনতে চেয়েছিল। মারিয়া বান্ধবীকে দেখেও না দেখার ভান করে। সে তার অন্য বান্ধবীদের সিনেমা তারকা, স্থানীয় ছেলেদের নিয়ে গল্প করতে থাকে। তার বান্ধবীরা তার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, এ বিষয়টিও অগ্রাহ্য করে মারিয়া। 

বাড়ি ফিরে এসে সারা রাত কাঁদল ও। পরবর্তী আটটি মাস দগ্ধ হলো ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায়। অবশেষে এ সিদ্ধান্তে এল প্রেম-ট্রেম তার জন্য নয়। তাকে প্রেম করার জন্য তৈরি করা হয় নি, প্রেমও তার জন্য প্রস্তুত নয়। সন্ন্যাসিনী হবার সিদ্ধান্ত নেয় মারিয়া। ঠিক করে বাকি জীবনটা উৎসর্গ করবে এমন এক ভালোবাসার জন্য যা তাকে আঘাত করবে না, অন্তরে সৃষ্টি করবে না যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতের। সে যীশুর জন্য ভালোবাসায় কাটিয়ে দেবে সারা জীবন। স্কুলে আফ্রিকাগামী মিশনারীদের নিয়ে পড়ানো হয়, মারিয়ার ধারণা ওই জগতে প্রবেশ করাই তার জন্য ভালো হবে। সে এই নীরস জীবন থেকে মুক্তি পাবে। পরিকল্পনা করে কনভেন্টে ঢুকবে, শিখবে প্রাথমিক চিকিৎসা, (শিক্ষকরা বলেছেন আফ্রিকায় বহু লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে), ধর্মের ক্লাসে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে, কল্পনায় দেখতে থাকে সে আধুনিক যুগের সন্ন্যাসিনী হয়ে মানুষের জীবন রক্ষা করছে এবং সিংহ ও বাঘ অধ্যুষিত আফ্রিকার অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নির্ভয়ে। 

পনেরো বছর বয়সে মারিয়া শুধু শিখলই না যে মুখ খুলে চুমু খেতে হয়, প্রেম যে যন্ত্রণা দেয় তাও সে জানল। তবে এ বয়সে সে আরেকটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হলো : স্বমেহন। হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা। সে বাড়িতে বসে মা’র জন্য অপেক্ষা করছিল। অলস হাত ঘোরাঘুরি করছিল নিজের যৌনাঙ্গে। ছেলেবেলা থেকেই যৌনাঙ্গ ঘাটাঘাটি করে আসছে সে, মজা লাগে এতে। একদিন বাবা ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন মেয়ের গালে। মারিয়া চড় খেয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারে নি তার দোষটা কী। কারণ বাবা ব্যাখ্যা করেন নি। তবে মারের কথাটা জীবনে ভোলে নি সে, পরে জেনেছে জনসমক্ষে একান্ত অঙ্গ নিয়ে ঘষাঘষি শোভনীয় নয়। যেহেতু রাস্তায় বসে কাজটা করা যাবে না এবং বাড়িতে নিজের কোনও ঘর ছিল না তা-ই মারিয়া যৌনাঙ্গ ঘর্ষণের আনন্দের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। 

সেদিন বিকেলে, চুমু খাওয়ার মাস ছয় পরে, মা’র বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছিল, মারিয়ার করার মত কোনও কাজও ছিল না; বাবা তার এক বন্ধুর সঙ্গে বাইরে গেছেন, টিভিতেও চিত্তাকর্ষক কিছু দেখাচ্ছিল না, সে নিজের শরীর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অপ্রত্যাশিত লোম চোখে পড়লে তুলে ফেলবে। যোনি দেশ ফাঁক করে দেখছিল মারিয়া। অবাক হয়ে লক্ষ করল তার যৌনাঙ্গের ঠিক উপরে ছোট্ট একটি মাংসখণ্ড ফুলে আছে; মাংসখণ্ডে আঙুল ছোঁয়াল মারিয়া। অদ্ভুত আবেশে শিরশির করে উঠল তনু-মন। সে বারবার আঙুল দিয়ে ঘষতে লাগল জায়গাটা। অসহ্য একটা সুখে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ও। সারা শরীরে কী যে একটা সুখ! ভাষায় প্রকাশ করার নয়। দেখতে দেখতে যোনির উপরের মাংসখণ্ডটি শক্ত ও খাড়া হয়ে উঠল ওখানটাতে যত ঘষছে মারিয়া, তত স্বর্গসুখে আকুল হয়ে উঠছে। হঠাৎ সুখময় অনুভূতিটা প্রচণ্ড হয়ে উঠল, শক্ত মাংসখণ্ডে দ্রুততর হয়ে উঠল আঙুল চালনা, মারিয়ার শরীর ঝাঁকি খেতে লাগল, মুখ দিয়ে ‘আহ্! আহ্!’ গোঙানি বেরিয়ে আসছে, ও যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না, শুনতে পাচ্ছে না, পুরো দুনিয়া আকস্মিক হলুদ রঙ ধারণ করল। তীব্র সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে, গোঙাতে গোঙাতে রেতঃপাত ঘটল পঞ্চদশী মারিয়ার। 

রেতঃপাত! 

এ যেন স্বর্গে ভাসতে ভাসতে তারপর প্যারাসুটে চেপে ধীরগতিতে মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন। ঘামে জবজবে মারিয়ার গা, কিন্তু পূর্ণ একটা শক্তিতে বলীয়ান। সে তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। তাহলে এর নাম সেক্স! কী দারুণ একটা অনুভূতি! এ সুখের জন্য পুরুষ মানুষের দরকার হয় না যারা নারী শরীর চায় কিন্তু নারীর অনুভূতির মূল্যায়ন করে না। এ সুখের রাজ্যে একা একাই প্ৰবেশ করতে পারে মারিয়া, কারও হাত ধরার দরকার নেই। 

আবার হস্তমৈথুন করল মারিয়া। এবারে কল্পনা করল এক সিনেমা তারকাকে। কল্পনায় দেখল তারকাটি ওকে আদর করছে, ওর সারা শরীরে হাত বোলাচ্ছে, হরণ করছে মারিয়ার অনাঘ্রাতা যৌবন। মুভিস্টারের কথা কল্পনা করতে করতে আবার সুখের স্বর্গে চলে গেল মারিয়া, স্খলনের পরে ভাসতে ভাসতে নেমে এল মাটির পৃথিবীতে। প্রথমবারের চেয়েও বেশি মজা পেল। মজাটা আবার নিতে ইচ্ছে করল মারিয়ার। সম্ভব হলো না মা এসে পড়ায়। 

মারিয়া তার নতুন আবিষ্কার নিয়ে গল্প করল বান্ধবীদের সঙ্গে। তবে সদ্য এ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার কথা চেপে গেল। ওদের প্রায় সবাই— দু’জন বাদে- এ অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত, তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সাহস পায় নি কেউ। মারিয়ার মনে হলো সে যেন একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। ‘গোপন স্বীকারোক্তি’র একটা খেলা যেন এটা, মারিয়া তার নেত্রী। সবার কাছে একে একে জানতে চাইল কে কীভাবে স্বমেহন করে। শুনল হস্তমৈথুনে একেকজন একেকরকম কৌশল অবলম্বন করে। একজন জানাল প্ৰচণ্ড গরমের সময় (ঘামলে নাকি সেক্স বাড়ে) সে হাঁসের পালক ঘষতে থাকে ওই জায়গাটায় (জায়গাটির নাম সে জানে না)। আরেকজন বলল তাকে তার ছেলেবন্ধু ওখানটা ঘষে দেয়, তার অতিদ্রুত রেতঃপাত ঘটে (মারিয়া ভাবে, এ আনন্দ পেতে ছেলে বন্ধুর দরকার নেই) একজন বাথরুমে বসে শাওয়ারের মুখ ব্যবহার করে। শাওয়ার থেকে ঝিরঝির ধারায় জল পড়ে, জলের স্পর্শে অতুলনীয় সুখ পাওয়া যায়। (মারিয়ার বাসায় শাওয়ার নেই। তবে সে বড়লোক কোনও বান্ধবীর বাসায় গিয়ে এ অভিজ্ঞতাটা সঞ্চয় করবে।) 

স্বমেহন আবিষ্কার এবং এটা করার নানান কৌশল জানার পরে সন্ন্যাসিনী হবার চিন্তা বাদ দিয়ে দিল মারিয়া। মাস্টারবেশন আশ্চর্য সুখ দেয় মারিয়াকে। যদিও ওর দু’একজন বান্ধবী বলেছে মাস্টারবেশনে যৌনাঙ্গে দাগ পড়ে যায়, পাগল হয়ে যায় মানুষ, মা হতে পারে না। কিন্তু এতসব ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সপ্তাহে অন্তত একদিন, বিশেষ করে বুধবার (ওইদিন বাবা তাস খেলতে যান বন্ধুদের সঙ্গে) এ আশ্চর্য আনন্দের সঙ্গী হয় মারিয়া। 

একই সঙ্গে ছেলেদের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল মারিয়া এবং ক্ষুদ্র এ শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার তাগিদ আরও বেশি অনুভব করছিল। সে তৃতীয় এবং চতুর্থবারের মত প্রেমে পড়ল। সে এখন জানে কীভাবে চুমু খেতে হয়। সে ওদেরকে স্পর্শ করে, নিজেকে ছুঁতে দেয়, কিন্তু সবসময়ই একটা না একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। অমুক ছেলেটির সঙ্গে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মারিয়ার সম্পর্কের অবসান ঘটে ওই মুহূর্তে যখন ছেলেটির সঙ্গে আর মিলিত হওয়া সম্ভব হয় না। 

দীর্ঘদিন পরে মারিয়া উপসংহারে পৌঁছায় পুরুষরা আসলে তার জন্য শুধু যন্ত্রণা এবং হতাশাই নিয়ে আসে। 

এক বিকেলে এক মাকে তার দু’বছরের ছেলের সঙ্গে খেলা করতে দেখে মারিয়া ভাবে সে ঠিকই বিয়ে করবে, তার সন্তান হবে, থাকবে সাগর-তীরে বাড়ি, তবে সে আর কোনওদিন কারও প্রেমে পড়বে না। কারণ প্রেম সবকিছু নষ্ট করে দেয়। 

তিন 

বয়ঃসন্ধিকাল পার হয়ে আসে মারিয়া। সে যত বড় হচ্ছে, ততই যেন তার রূপ ফেটে পড়ছে। তার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমরেরা তার পাশে গুঞ্জন করে। কোনওদিন প্রেম না করার প্রতিজ্ঞা সত্ত্বেও সে একেকদিন একেক ছেলের সঙ্গে ডেট করে। এমনি একদিন ডেটিং-এ কুমারীত্ব বিসর্জন দিল মারিয়া। একটি গাড়ির পেছনের আসনে শুয়ে। 

পরস্পরের শরীর স্পর্শ করছিল ওরা। ছেলেটি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কারণ তার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে একমাত্র তারই নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতা নেই। সে মারিয়ার শরীরে প্রবেশ করল। স্বমেহন মারিয়াকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যৌন মিলন তাকে দিল ব্যথা! এবং এ কাজটা করতে গিয়ে তার স্কার্টে রক্ত লেগে গেল (এ রক্তের দাগ তুলতে গিয়ে জান শেষ হয়ে গিয়েছিল মারিয়ার)। প্রথম চুম্বনের জাদুকরী অনুভূতি ছিল না এর মধ্যে- সারস পাখির উড়ে যাওয়া, সূর্যাস্ত, সঙ্গীত… তবে ও নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল না মারিয়া। 

ছেলেটির সঙ্গে আরও কয়েকবার মিলিত হলো মারিয়া। যদিও ছেলেটি আর চাইছিল না বলে তাকে হুমকি দিতে হয়েছে। মারিয়া বলল সে যা বলছে তা যদি ছেলেটি না করে তবে সে তার বাবাকে বলে দেবে ছেলেটি তাকে ধর্ষণ করেছে। মারিয়ার বাবার ভয়ে ছেলেটিকে মারিয়ার নির্দেশ পালন করতে হলো। ছেলেটিকে মারিয়া ব্যবহার করছিল কিছু শেখার আশায়। একজন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মিলনে কতটা আনন্দ পাওয়া যায় জানতে চাইছিল মারিয়া। 

তবে যৌন মিলনের বিষয়টি তেমন পরিষ্কার হলো না মারিয়ার কাছে। তার কাছে স্বমেহন বরং অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক এবং কম ঝামেলামুক্ত মনে হয়েছে। অথচ মারিয়া যত পত্রিকা পড়েছে, টিভি অনুষ্ঠান দেখেছে, তার বান্ধবীদের কাছে শুনেছে, সবকিছু এবং সবার বক্তব্য এক— যৌন আনন্দের জন্য পুরুষ অবশ্য প্রয়োজনীয়। মারিয়া ভাবে তার বোধহয় ভয়ানক কোনও যৌন সমস্যা হয়েছে। সে এটা ভুলে থাকতে পড়ায় বেশি বেশি মনোযোগী হলো। প্রেমের মত সুন্দর বিষয়টি সে ভুলে গেল। 

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, যখন তার বয়স সতের : 

আমার লক্ষ্য হলো ভালোবাসা কী তা বুঝতে পারা। আমি জানি আমি যখন প্রেমে পড়তাম তখন কেমন জীবন্ত হয়ে উঠতাম, কিন্তু এখন আমার সবকিছু আছে, অথচ কোনও কিছুই আমাকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে না। তবে ভালোবাসা ভয়ানক জিনিস : আমি আমার বান্ধবীদের কষ্ট পেতে দেখেছি এবং চাই না ওরকম ঘটনা আমার জীবনেও ঘটুক। ওরা আমার সরলতা নিয়ে হাসি- ঠাট্টা করত। কিন্তু এখন জানতে চায় আমি কীভাবে পুরুষদের বশ করি। আমি শুধু হাসি, কিছু বলি না। কারণ আমি তো আসলে প্রেমে পড়ি না। প্রতিটি দিন আমি আবিষ্কার করি পুরুষরা কত অসহায়, অস্থির, অনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষ। অবাক ব্যাপার, আমার কয়েকজন বান্ধবীর বাবাও আমাকে প্রেম করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি তাঁদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি। 

প্রথমে স্তম্ভিত হয়েছি, পরে ভেবেছি পুরুষ জাতটাই এরকম। 

যদিও আমার লক্ষ্য ভালোবাসা কী তা জানা এবং যদি ও আমি যাদেরকে মন দিয়েছি তাদের কথা ভেবে যন্ত্রণাবিদ্ধ হই, তবু আমি দেখতে পাই যারা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে তারা আমার শরীর জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে আর যারা আমার দেহ উত্তপ্ত করতে পেরেছে তারা আমার অন্তর ছুঁতে পারে নি। 

চার 

উনিশে পা দিল মারিয়া, বিদায় জানাল কলেজ জীবন, এক কাপড় ব্যবসায়ীর দোকানে চাকরি পেয়ে গেল। খুব দ্রুত তার বস তার প্রেমে পড়ল। তবে মারিয়া এখন জানে নিজেকে স্পর্শ করতে না দিয়েও কীভাবে পুরুষদের ব্যবহার করতে হয়। লোকটা মারিয়ার শরীর ছোঁয়ার সুযোগই পেল না যদিও নিজের সৌন্দর্যের শক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন মারিয়ার ছেনালিপনায় কখনও আপত্তি ছিল না। 

সৌন্দর্যের শক্তি। সবাই সুন্দরী হলে কুৎসিত মেয়েদের কী হবে? মারিয়ার কিছু বান্ধবী আছে যাদেরকে পার্টিতে কেউ ফিরে দেখে না, কোনও পুরুষ তাদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। এরা স্বাধীনচেতা, যদিও মারিয়ার ধারণা এদের জীবনটা কষ্টের। 

মারিয়া জানে সে কতটা আকর্ষণীয়া, মা’র বেশিরভাগ বকবক এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেলেও একটা কথা সে কখনও ভোলে না : ‘রূপ, মাগো চিরস্থায়ী নয়।’ এ কথাটা গুরুত্ব দেয় বলেই বসের কাছে সে নিজেকে দুর্লভ করে রাখে। বস তাকে একটু ছোঁয়ার আশায় তার বেতন বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ (মারিয়া জানে না কতদিন সে বসকে এভাবে সুতোয় ঝুলিয়ে নাচাতে পারবে, তবে যদ্দিন পারে, ঝোলাবে। এর মধ্যে ভালো পয়সা কামিয়ে নেবে মারিয়া)। বস মারিয়াকে ওভারটাইম দেয় (কর্মঘণ্টা শেষ হবার পরেও মারিয়া কাজ করে। এবং বস ইচ্ছে করেই মারিয়াকে আটকে রাখে। তার দুশ্চিন্তা মারিয়াকে নির্দিষ্ট সময়ে ছুটি দিলে সে যদি সন্ধ্যায় বেড়াতে যায় তাহলে হয়তো মারিয়ার কোনও প্রেমিক পুরুষ জুটে যাবে!) 

টানা দু’বছর কাপড়ের দোকানে কাজ করল মারিয়া, প্রতি মাসে বাবা- মা’কে টাকা দিল জমা রাখার জন্য। স্বপ্নের শহরে অন্তত এক সপ্তাহ কাটিয়ে আসার মত টাকা জোগাড় হয়ে গেল মারিয়ার। সেই শহরে যাবে সে যেখানে সিনেমা ও টিভি তারকারা বাস করেন, যে শহরের ছবি আছে তার কাছে : রিও ডি জেনিরো। 

মারিয়ার বস প্রস্তাব দিল সে মারিয়াকে রাজধানী থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। সমস্ত খরচ তার। মিথ্যা বলল মারিয়া। জানাল বিশ্বের সবচে’ বিপজ্জনক শহরের একটিতে যেহেতু সে যাচ্ছে, কাজেই তার মা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ওখানে এক কাজিনের বাসায় তাকে উঠতে হবে। সে কাজিন আবার জুডো জানে। 

‘তাছাড়া, স্যার,’ বলল মারিয়া, ‘বিশ্বস্ত কাউকে না পেলে আপনি তো দোকান ছেড়ে যেতেও পারবেন না।’

‘আমাকে ‘স্যার’ বলো না,’ বলে তার বস। মারিয়া তার চোখে ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ দেখতে পায়। বিস্মিত হয় সে। কারণ- তার ধারণা ছিল বস শুধু তাকে বিছানায় নিয়ে যেতেই আগ্রহী, কিন্তু তার চোখ বলছে বিপরীত কথা : ‘তোমাকে আমি একটি বাড়ি কিনে দেব, একটি পরিবার দেব, তোমার বাবা-মাকে কিছু টাকা দেব।’ ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্ফূলিঙ্গ একটু উস্কে দেয় মারিয়া। 

বলে সে চাকরিটা খুব মিস করবে, কারণ তার কলিগরা তার বসের খুব প্রশংসা করেছে। মারিয়া তার বসকে নিয়ে যেতে চায় না কারণ জীবনে এই প্রথম সে স্বাধীনভাবে কোথাও যাবার পরিকল্পনা করেছে। সে সবকিছু করবে— সাঁতার কাটবে সাগরে, অচেনা মানুষদের সঙ্গে গল্প করবে, দোকানপাট ঘুরে দেখবে, অপেক্ষা করবে স্বপ্নের রাজপুত্তুরের যে এসে ওকে নিয়ে যাবে। এই স্বপ্নে বাগড়া দিতে কাউকে সঙ্গী করতে রাজি নয় মারিয়া। 

‘একটা সপ্তাহই তো?’ মদির হাসি ফোটায় মারিয়া। 

‘ও দেখতে দেখতে চলে যাবে। আমি শীঘ্রি এসে আবার আপনার কাজে যোগ দেব।’ 

করুণ চেহারা নিয়ে বস মারিয়াকে ছুটি দেয়। সিদ্ধান্ত নেয় মারিয়া ফিরে এলেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে, এখনই জোরাজুরি করে সবকিছু নষ্ট করার মানে হয় না। 

টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে স্বপ্নপুরীতে পৌঁছুল মারিয়া। কোপাকাবানায় (কোপাকাবানা! সেই সাগর সৈকত, সেই আকাশ) সস্তা একটি হোটেলে উঠল। ব্যাগট্যাগ রাখার আগেই সঙ্গে নিয়ে আসা বিকিনি হাতে ছুটল সৈকত অভিমুখে। মেঘলা দিনে ফুঁসে উঠেছে সাগর। বড় বড় ঢেউগুলো ভীত চোখে দেখল মারিয়া, তবু সাহস সঞ্চয় করে নেমে পড়ল জলে। 

কেউ জানে না এটাই মারিয়ার প্রথম সমুদ্র-স্নান। কিছুক্ষণ জলে হুটোপুটি করে বালুকা বেলায় উঠে এসেছে মারিয়া, স্যান্ডউইচ বিক্রেতা এক মহিলা তার দিকে এগিয়ে এল। সঙ্গে সুদর্শন চেহারার এক কৃষ্ণাঙ্গ। তাদের পেছনে আরেকজন। কৃষ্ণাঙ্গ মারিয়ার কাছে জানতে চইল আজ রাতে মারিয়া তাকে সঙ্গ দিতে পারবে কিনা। অপরজন পর্তুগীজ জানে না, অঙ্গভঙ্গি করে জানতে চাইল মারিয়া ডাবের জল খাবে কি না। 

স্যান্ডউইচ কিনল মারিয়া কারণ ‘না’ বলতে বিব্রত বোধ করছিল, তবে অচেনা লোক দু’টির সঙ্গে কথা বলল না। হঠাৎ হতাশা গ্রাস করল তাকে : সে তো এখন যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে, তাহলে এরকম হাস্যকর আচরণ করছে কেন? উপযুক্ত কোনও ব্যাখ্যা না পেয়ে চুপচাপ বসে রইল বালুর উপর। এখন গরম চলছে, তবু সাগরের জল আশ্চর্য ঠাণ্ডা 

পর্তুগীজ না জানা লোকটা হাতে পানীয় নিয়ে আবার হাজির হলো। গ্লাসটা দিল, মারিয়াকে। লোকটার সঙ্গে কথা বলতে হবে না ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মারিয়া, ডাবের জলের গ্লাসে চুমুক দিল। হাসল লোকটার দিকে তাকিয়ে। লোকটাও ফিরিয়ে দিল হাসি। এই অর্থহীন আলাপচারিতা কিছুক্ষণ চালিয়ে গেল ওরা। মারিয়া একটু হাসছে, প্রত্যুত্তরে লোকটাও দাঁত দেখাচ্ছে। লোকটা অবশেষে পকেট থেকে লাল রঙের একখানা অভিধান বের করল। অদ্ভুত উচ্চারণে বলল- ‘বোনিটা’- ‘সুন্দরী’। মারিয়া হাসল আবার। তার স্বপ্নের রাজপুত্তুরকে অবশ্যই মারিয়ার দেশের ভাষা জানতে হবে এবং বয়স হতে হবে আরও কম। 

লোকটা ছোট বইটির পাতা উল্টে যেতে লাগল :

‘সাপার… আজ রাতে?’ 

তারপর সে বলল

‘সুইটজারল্যান্ড!’ 

তারপর কথা শেষ করল সে এমন দু’টি শব্দ উচ্চারণ করে যা স্বর্গের ঘন্টার মত বাজল। এ শব্দ যে কোনও ভাষায় বলা যায়। 

‘কাজ! ডলার!’ 

সুইটজারল্যান্ড নামে কোনও রেস্টুরেন্টের কথা জানা নেই মারিয়ার, স্বপ্ন কি সত্যি এত দ্রুত পূরণ হয়? সে বলল, আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। তবে আমি একটা চাকরি করছি এবং ডলার কেনার কোনও ইচ্ছেও আমার নেই। 

মারিয়ার একটা কথাও বুঝতে পারল না লোকটা, হতাশায় গুঙিয়ে উঠল। আরও কিছু মুচকি হাসি বিনিময়ের পরে সে কিছুক্ষণের জন্য মারিয়াকে ছেড়ে গেল। ফিরে এল একজন দোভাষী নিয়ে। দোভাষীর মারফত জানাল, সে সুইটজারল্যান্ড থেকে এসেছে (ওটা দেশ, রেস্টুরেন্ট নয়) এবং সে মারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চায় একটি সম্ভাব্য চাকরির প্রস্তাব দেয়ার জন্য। দোভাষী বিদেশী টুরিস্টদের দেখাশোনার দায়িত্বে আছে, পাশাপাশি হোটেলে নিরাপত্তা রক্ষীরও চাকরি করে। সে বলল : 

‘আমি আপনার জায়গায় হলে এ প্রস্তাব লুফে নিতাম। এ লোক খুব মালদার ব্যবসায়ী, ইউরোপে কাজ করার জন্য নতুন প্রতিভা খুঁজছে। চাইলে এ লোকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। তারা ধনী হয়ে গেছে, বিয়ে শাদী করে মা-ও হয়েছে। সন্তানদের অপহরণ হয়ে যাওয়া কিংবা বেকার হবার ভয় তাদের নেই।’ 

আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মারিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য সে যোগ করল; ‘তাছাড়া সুইটজারল্যান্ড দারুণ চকোলেট এবং ঘড়ি বানায়।’ 

মারিয়ার স্টেজে অভিজ্ঞতা বলতে হলিউইকে স্থানীয় কাউন্সিল আয়োজিত নাটকে পানি বিক্রেতার ভূমিকায় অভিনয়। তবে সে এ প্রস্তাবে উত্তেজিত হয়ে উঠল। ভাবল ভার্জিন মেরী তাকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। অন্তত এ লোকের প্রস্তাবের সুযোগে ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে। বাড়ি গিয়ে গল্প করতে পারবে সে। আমন্ত্রণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল মারিয়া। সে এতক্ষণ হেসে হেসে এবং বিদেশীটা যা বলছে তা সব বুঝতে পেরেছে, এমন অভিনয় করে বেজায় ক্লান্ত। দোভাষী এসে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। 

তবে মারিয়ার সমস্যা হলো রেস্টুরেন্টে পরে যাবার মতো ভালো পোশাক তার নেই। যেহেতু এ লোকগুলোকে সে চেনে না এবং এদের সঙ্গে ভবিষ্যতে হয়তো কোনওদিন আর দেখাও হবে না, কাজেই সত্যি কথা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করল না মারিয়া। ‘আমি মাত্র উত্তর-পুব থেকে এসেছি। রেস্টুরেন্টে পরে যাবার মতো ভালো পোশাক আমার নেই। 

দোভাষীর মাধ্যমে লোকটা জানাল এ নিয়ে মারিয়াকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সে মারিয়ার হোটেলের ঠিকানা চাইল। সেদিন সন্ধ্যায় এমন একটি পোশাক চলে এল মারিয়ার কাছে যা জীবনেও সে দেখে নি, সেই সঙ্গে এমন দামী জুতো, মারিয়ার সারা বছরের বেতনের সমান। 

মারিয়া ভাবছে, এ হলো সেই রাস্তার শুরু যে রাস্তা পাড়ি দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছে সে শৈশব আর কৈশোর থেকে। যে শহরে সে থাকে সেখানে খরা মানুষের নিত্যসঙ্গী, ওই শহরের ছেলেদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, ওখানকার জীবনে নেই কোনও বৈচিত্র্য। মারিয়া নিজেকে রাজকুমারী হিসেবে রূপান্তর ঘটাতে প্রস্তুত! এক লোক তাকে কাজ এবং ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে, কিনে দিয়েছে অসম্ভব দামী এক জোড়া জুতো এবং রূপকথার গল্প থেকে উঠে আসার মতো অদ্ভুত সুন্দর একটি পোশাক! মারিয়ার শুধু দরকার ছিল সামান্য মেকআপের। সেটার ব্যবস্থা করে দিল হোটেল রিসেপশনিস্ট। সে মারিয়াকে সাবধানও করে দিল সব বিদেশীকে যেমন বিশ্বাস করা উচিত হবে না তেমনি এমনটি ভাবার কারণ নেই যে রিও’র প্রতিটি পুরুষ ছিনতাইকারী। 

সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করল মারিয়া। সে স্বর্গ থেকে আসা উপহার গায়ে চড়াল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল নিজেকে, আফসোস করল কেন ক্যামেরা নিয়ে আসেনি, তাহলে মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখা যেত। 

নিজেকে আয়নায় দেখতে বিভোর মারিয়া হঠাৎ খেয়াল করল ডিনারে যাবার সময় হয়ে গেছে। সে সিন্ডেরেলার মত ছুটল হোটেলে, সেখানে সুইস ভদ্রলোক অপেক্ষা করছে। 

মারিয়াকে বিস্মিত করে দিয়ে দোভাষী জানাল সে ওদেরকে সঙ্গ দিতে পারছে না। 

‘ভাষা নিয়ে ভয় নেই। আসল কথা হলো লোকটি আপনার সঙ্গ কতটুকু উপভোগ করছেন।’ 

‘কিন্তু আমি কী বলছি সে যদি বুঝতে না পারে?’ 

‘আপনাদের কথা না বললেও চলবে। ইশারা-ইঙ্গিতই যথেষ্ট।’ বলল দোভাষী কাম-নিরাপত্তা-কর্মকর্তা মেলসন। ‘এঁকে কিছু বোঝানোর দরকার নেই। উনি যেন আপনার সান্নিধ্য উপভোগ করেন সেদিকে খেয়াল রাখবেন। উনি বিপত্নীক, নিঃসন্তান; তাঁর একটা নাইটক্লাব আছে, দেশের বাইরে কাজ করতে আগ্রহী এমন ব্রাজিলিয়ান নারী খুঁজছেন। বলেছিলাম আপনি তার টাইপ নন। কিন্তু বললেন আপনি যখন সাগর থেকে উঠে আসছেন দৃশ্যটা দেখে তখনই নাকি আপনার প্রেমে পড়ে গেছেন তিনি। বলেছেন আপনার বিকিনিটা খুব সুন্দর 

বিরতি দিল সে। 

‘তবে খোলাখুলিই বলি, এখানে কোনও বয়ফ্রেন্ড জোগাতে চাইলে ভিন্ন রকমের বিকিনির দরকার হবে আপনার। আপনার বিকিনিটা পুরানো ফ্যাশনের।’ 

মারিয়া ভান করল মেলসনের কথা যেন শুনতে পায় নি। সে বলে চলল:

‘আমার মনে হয় না ইনি স্রেফ আপনার প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করছেন। এ লোক আপনার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছেন যাতে তাঁর ধারণা হয়েছে আপনি তাঁর ক্লাবের সেরা আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারবেন। অবশ্য ইনি জানেন না আপনি গান কিংবা নাচ পারেন কিনা। তবে এসব শিখে নিতে পারবেন। ওই ইউরোপীয়গুলো সব একরকম। তারা এখানে এসে মেয়েদের দেখে ভাবে প্রতিটি ব্রাজিলিয়ান মেয়েই সুন্দরী এবং তারা সাম্বা নৃত্য জানে। উনি যদি সিরিয়াস হন, চুক্তিপত্র দেখে নেবেন, দেশ ছাড়ার আগে দেখে নেবেন ওতে সুইস কনস্যুলেটের দস্তখত আছে কিনা। আমি কাল সৈকতে থাকব, হোটেলের বিপরীতে, আমার সঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে কথা বলতে চাইলে আসতে পারেন।’ 

সুইস লোকটা এতক্ষণ হাসি মুখে ওদের পাশেই দাঁড়ানো ছিল, দোভাষীর কথা শেষ হলে মারিয়ার হাত ধরল, একটা ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল, সেদিকে পা বাড়াল। 

 ‘এ লোকের যদি অন্য কোনও মতলব থাকে,’ যোগ করল মেলসন, ‘আর আপনারও যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তিনশ ডলার নেবেন। এক রাতের জন্য ওটাই স্বাভাবিক দর। এর কম নেবেন না।’ 

রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে ওরা, মারিয়া কিছু বলার আগে বারবার রিহার্সাল দেয়া কথাগুলো বলে ফেলল লোকটা। আলোচনা হলো খুবই সরল : 

‘কাজ? ডলার? ব্রাজিলিয়ান তারকা?’ 

মারিয়া অবশ্য দোভাষী-কাম-নিরাপত্তা কর্মকর্তার কথা ভাবছিল : এক রাতের জন্য তিনশ ডলার। দারুণ! এ লোককে নিয়ে মারিয়া তার বসের মতই খেলা করতে পারে। এ লোককে তার ভালোবাসার দরকার নেই। একে বিয়ে করলে প্রচুর টাকা পাবে মারিয়া। তার হারাবার কিছু নেই। লোকটার বয়স হয়েছে। বেশিদিন হয়তো বাঁচবেও না- এর মৃত্যুর পরে ধনী হয়ে যাবে মারিয়া। 

খাওয়ার সময় খুব কমই কথা হলো দু’জনে— শুধু গতানুগতিক হাসি। লোকটা তাকে কী একটা ভাষায় লেখা একটা অ্যালবাম দেখাল। তাতে বিকিনি পরা মেয়েদের ছবি (মারিয়ার বিকিনির চেয়ে অনেক সুন্দর এবং অনেক খোলামেলা), নিউজপেপার কাটিং, চটকদার লিফলেট, এর মধ্যে শুধু ‘ব্রাজিল’ শব্দটি বুঝতে পারল মারিয়া, তাও ভুল বানানে লেখা (স্কুলে ওদেরকে ‘Brasil’ শেখানো হয়েছে, ‘Brazil’ নয়)। 

প্রচুর মদ গিলল মারিয়া, লোকটা মানা করল না। যথার্থ ভদ্রলোকের মত আচরণ করল সে মারিয়ার সঙ্গে। মারিয়া যখন বসল এবং উঠে দাঁড়াল, চেয়ার ধরে থাকল সে। শেষে মারিয়া বলল সে খুব ক্লান্ত, পরদিন সে লোকটির সঙ্গে সৈকতে আবার সাক্ষাৎ করতে চায়। 

লোকটাকে খুশি খুশি মনে হলো। নিজের ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে মারিয়ার প্রস্তাবে রাজি হলো। 

মারিয়ার ডায়েরি থেকে, যেদিন তার পরিচয় হলো সুইস লোকটার সঙ্গে : 

আমার মন বলছে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, কিন্তু ভুল করা তো জীবনেরই অংশ। পৃথিবী আমার কাছে কী চায়? চায় কী যে আমি ঝুঁকি না নিয়ে যেখান থেকে এসেছি সেখানে আবার ফিরে যাই এজন্য যে জীবনের কাছে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস আমার নেই? 
আমি আমার জীবনের প্রথম ভুলটা করেছি এগারো বছর বয়সে যখন ওই ছেলেটা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল তাকে আমি একটা পেন্সিল ধার দিতে পারব কিনা; তখন থেকে বুঝতে পারছি মাঝে মাঝে দ্বিতীয়বার কোনও সুযোগ আসে না পৃথিবী তোমাকে যা দেয় সে উপহারই গ্রহণ করা উচিত। 
আমি যদি কারও প্রতি বা কোনও কিছুর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চাই তাহলে সবার আগে নিজের প্রতি বিশ্বস্ত হতে হবে। প্রকৃত ভালোবাসা পেতে হলে প্রথমে মিডিওকার 
ভালোবাসা পেতে হবে। আমার এই ছোট্ট জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে কেউ কোনও কিছুর মালিক নয়, সবকিছুই একটা ভ্রম— তা বস্তুবাদী বা আধ্যাত্মিক যা-ই হোক। যারা ভাবে তারা তাদের কিছু হারিয়েছে (এরকম ঘটনা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ঘটেছে আমার জীবনে) তারা শেষে বুঝতে পারে আসলে তাদের কিছুই ছিল না। 
আর আমার নিজের যদি কিছু না-ই থাকে, আমার যা নয় তার খোঁজে সময় নষ্ট করার কোনও মানে নেই; বরং এমনভাবে বাঁচা উচিত যেন আজকের দিনটাই আমার জীবনের প্রথম (কিংবা শেষ) দিন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *