ইরাক-আযম বিজয় (দ্বিতীয় পর্যায়)
ওমরের রাজনীতি ছিল বিজয়-অভিযান ইরাক ও সিরিয়া সীমান্তেই রোধ করা এবং আরও অগ্রসর না হওয়া। এভাবে কেবল আরবীভাষীদের নিয়েই এক অখণ্ড আরব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর এ নীতির পরিচয় মেলে একটি স্মরণীয় উক্তি থেকে মাদায়েনের যুদ্ধের পর সা’দ বিন-ওক্কাস যখন পর্বতমালার অপরদিকে অভিযান করার অনুমতি ভিক্ষা করেন, তখন ওমর আক্ষেপ জানিয়ে বলেছিলেন: যদি আমাদের ও পারসিকদের মধ্যে একটা আগুনের পাহাড় বিদ্যমান থাকতো, তা হলে তারা আমাদের এলাকা আক্রমণ করতে পারতো না, আর আমরাও তাদের এলাকায় হামলা চালাতেম না। আমাদের পক্ষে মরুর সম্পদই যথেষ্ট। আমার নিকট মুসলিমদের নিরাপত্তা মালে- গনিমতের চেয়ে বেশি কাম্য। ওমর এই নীতিই অনুসরণ করতে চেষ্টা করতেন। প্রকৃত সত্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রনীতির এই ছিল মৌল ভিত্তি। রসূলে আকরমেরও প্রথম ইচ্ছা ছিল, জাজিরাতুল-আরব ও সীমান্ত এতোখানি নিরাপদ ও সবল হয়ে ওঠে যে, পারসিক বা রোম সাম্রাজ্য তার উপর হামলা না চালাতে পারে। তিনি আরও ইচ্ছা করতেন, যেন কিরা ও সীজার এবং মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের শাসকরা সংগ্রাম-সংঘাত ব্যতিরেকেই ইসলামের বাণী স্বীকার করে নেয়। আবুবকরেরও এই ছিল প্রথম রাজনীতি। প্রথম খলিফা হিসেবে যখন আঁ-হযরতের নির্দেশ অনুযায়ী রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ওসামার নেতৃত্বে সিরিয়া সীমান্তে পাঠানো হয়, মুসান্না সায়েবানী যখন ইরাক অভিযানে অগ্রসর হন এবং খালিদ-বিন ওলিদ তাঁর সাহায্যার্থে অগ্রসর হয়ে পারসিকদের উপর জয়লাভ করেন, কিংবা তার পরে সিরিয়ার যখন ইসলামের বিজয়কেতন উড়ানো হয়, তখন আবুবকর বা ওমরের এমন ইচ্ছা ছিল না যে, সিরিয়া বা ইরাকের বহিঃস্থ অঞ্চলে মুসলিম অভিযান চালানো যাবে।
কিন্তু অনেক সময় ঘটনাচক্রে এমন হয়ে ওঠে এবং পরিবেশ এমন রূপ ধারণ করে, যখন মানুষের ইচ্ছার উপর জোর থাকে না এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে রাজনীতির পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ঠিক এমনই পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল পারসিকদের আচরণে। তাদের অস্থিরতা ও সমরপ্রবণতা কিছুতেই দমিত হচ্ছিল না। বারে বারে তারা সৈন্য সংগ্রহ করে যুদ্ধ করেছে, বারে বারে তারা মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিদ্রোহ-বহ্নি জাগিয়ে তুলেছে। নিহাওন্দের যুদ্ধের পর ওমরের মন এদিকে তীক্ষ্ণভাবে আকৃষ্ট হয়। তিনি সাহাবা শ্রেষ্ঠদের এক বৈঠক আহ্বান করে এর প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে তাঁদের পরামর্শ চাইলেন। তাঁরা অভিমত প্রকাশ করেন, যতদিন ইয়েজর্দিকে পারস্যের ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না, ততদিন এ সব ষড়যন্ত্রের অবসান হবে না। কারণ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কায়ানীয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বেঁচে থাকতে পারসিকদের আশা-ভরসা লুপ্ত হতে পারে না।
ওমর যুক্তির সারবত্তা স্বীকার করেন এবং দৃঢ় সঙ্কল্প করেন, পারস্যের সব প্রদেশেই অভিযান চালিয়ে সমগ্র ইরাক-আযম অধিকার করতে হবে এবং পারসিকদের বিদ্রোহী মনোভাবও একেবারে নিঃশেষ করে দিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে তিনি স্বয়ং কতকগুলি ঝাণ্ডা প্রস্তুত করেন এবং এক একটি পারস্যের এক এক প্রদেশের নামাঙ্কিত করে প্রসিদ্ধ সেনানায়কদেরকে সেগুলি দান করেন। খোরাসানের ঝাণ্ডার ভার পেলেন আহনফ-বিন্- কয়েস, সবুর ও আদর্শের প্রদেশের ঝাণ্ডা পেলেন, মাজাশা-বিন্ মাসুদ, ইসতিখারের ঝাণ্ডা পেলেন ওসমান বিন্-আল্ অসল-সাকাফী, ফাসার ঝাণ্ডা পেলেন সাবিয়াহ্ বিহম্-আল্ কিনানী, কিরমানের ঝাণ্ডা পেলেন সুহায়েল বিন-আদি, সিস্তানের ঝাণ্ডা পেলেন আসিস-রিন্-ওমর, মাকরানের ঝাণ্ডা পেলেন হাকামবিন্-ওমর আল্-তাগলাবী এবং আজরবাইজানের ঝাণ্ডার অধিকারী হলেন ওৎবাহ্। একুশ হিজরীর (৬৪১ খ্রি.) মধ্যে এসব সেনানায়ক বাহিনী নিয়ে নিজ নিজ ভারার্পিত প্রদেশাভিমুখে রওয়ানা হন।
সর্বপ্রথমে আক্রমণ করা হয় ইস্পাহান। আবদুল্লাহ বিন্-আবদুল্লাহ্ ইস্পাহানে উপস্থিত হয়ে দেখেন, প্রদেশকর্তা ইস্তান্দার বিরাট বাহিনী নিয়ে পথরোধ করে আছেন। উভয়পক্ষে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলে পারসিক বীর শহরবাজ্ জাদুয়াহ্ আবদুল্লাহকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। প্রথম সংঘাতেই জাদুয়াহ নিহত হন এবং প্রদেশরাজ ইস্তানদার ভীত হয়ে সন্ধি করেন। আবদুল্লাহ ইস্পাহান শহরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে নগরপাল ফাদুফান্ তাঁকে বাধা দিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে। কিছুক্ষণ দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করে ফাদুফান্ প্রতিদ্বন্দ্বীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে সন্ধি করেন এই শর্তে যে, যারা জিয়া দিয়ে শহর বাস করতে স্বীকৃত হবে, তাদের আশ্রয় দিতে হবে; আর যারা শহর ছেড়ে চলে যেতে চাইবে তাদেরকে যেতে দিতে হবে। আবদুল্লাহ এ শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি স্বাক্ষর করেন।
ইতিমধ্যে সংবাদ আসে, হামাদানে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। ওমরের আদেশে নুয়াইম বিন-মাক্রান্ বারো হাজার সৈন্য নিয়ে হামাদান অবরোধ করেন। দীর্ঘদিনের অবরোধের পর হামাদান বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু দাইলাম, রায় ও আজরবাইজানের শাসকরা সম্মিলিতভাবে রোদ্ উপত্যকায় যুদ্ধদান করে। এ যুদ্ধ নিহাওন্দের যুদ্ধের মতোই ভীষণ ও রক্তক্ষয়ী হয়। শেষে সম্মিলিত বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ওমর পূর্বেই সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, জসর বা সেতুবন্ধের যুদ্ধের পরাজয়বার্তা নিয়ে আরওয়াহ্ নামক যে সংবাদবাহক ওমরের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনিই এ যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে যখন উপস্থিত হন, তখন ওমর আশঙ্কিত হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন আরওয়াহ্ বিজয় সংবাদ দান করে তাঁর শঙ্কা দূর করেন।
ওমর নুয়ায়েমকে নির্দেশ দেন হামাদানে অন্য একজনকে শাসক নিযুক্ত করে রায় প্রদেশের দিকে অগ্রসর হতে। রায়ের শাসনকর্তা ছিলেন বারাম চোবিনের পৌত্র সিয়াওয়াশ। তিনি দিয়াওয়ান্দ, তাবারিস্তান, কাউস্ ও জুর্জানের নিকট সাহায্য ভিক্ষা করে রায় শহরকে সুরক্ষিত করে তোলেন। জেবিন্দি নামক পারসিক প্রধান নুয়ায়েমের সঙ্গে হাত মিলান এবং তার সহায়তায় শহরটি শীঘ্রই অধিকৃত হয়। অতঃপর জেবিন্দিকে রায় অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত শাসক নিযুক্ত করে নুয়ায়েম রায় শহরেই অবস্থান করেন। তাঁর ভাই সুয়াইদ কুমাস দুর্গটি দখল করেন। কুমাস্ অধিকৃত হওয়ায় প্রকৃত প্রস্তাবে সারা ইরাক-আযম মুসলিমদের পদানত হয়।
ঐতিহাসিক বালাজুরীর মতে হুদায়ফাহ্-বিন-ইয়ামান, নিহাওন্দ থেকে অগ্রসর হয়ে আজরবাইজানের রাজধানী আর্দবেলে উপস্থিত হন। স্থানীয় শাসক নানা স্থান থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে হুদায়ফাকে বাধা দান করেন, কিন্তু পরাজিত হয়ে বার্ষিক আট লক্ষ দিরহাম কর দিয়ে সন্ধি করেন। হুদায়ফাহ্ মুকান ও জাবালানি দখল করতে অগ্রসর হলে সারা আজরবাইজানে বিদ্রোহ শুরু হয়। তখন ওমর ওৎবাকে প্রেরণ করেন। ওবা দ্বিতীয়বার আজরবাইজান জয় করেন।
নুয়ায়েমের ভাই সুয়াইদ কুমাস জয় করে জুর্জানের দিকে অগ্রসর হলে, তথাকার শাসক রুজবান ভীত করে হয়ে জিয়া দিতে স্বীকৃত হন। তাবারিস্থানের শাসক এ সন্ধির কথা অবগত হয়ে আর বাধা না দিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে সন্ধি করেন পাঁচলক্ষ দিরহাম শালিয়ানা কর দিতে স্বীকৃত হয়। এদিকে আজরবাইজান অধিকার করে বুকাইর যাব্ শহরে উপস্থিত হন। এখানে একদল সাহায্য-সেনা মদিনা থেকে উপস্থিত হয়। বাবের শাসক ছিলেন একজন অগ্নিপূজক। তিনি মুসলিমদের প্রস্তাব দিলেন, সমগ্র পারস্য মুসলিমদের পদানত হওয়ায় তিনিও সন্ধি করতে রাজী আছেন এই শর্তে যে, জিয়ার পরিবর্তে তিনি প্রয়োজনমত সামরিক সাহায্য দান করবেন। জিয়া কর সামরিক আশ্রয় দানের পরিবর্তেই গ্রহণ করা হতো, এজন্যে তাঁর এ প্রস্তাব সহজেই গৃহীত হয়। অতঃপর মুসলিমরা অগ্রসর হতে থাকে এবং খিজারের রাজধানী বলখারের নিকটবর্তী হয়। কিন্তু মুসলিমরা বায়দা জয় করার পরই ওমরের খেলাফতের অবসান হয়।
সতেরো হিজরীতে (৬৩৮ খ্রি.) ফারস্ প্রথমে আক্রমণ করা হয়। সা’দ কাদিসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করলে পর আলা বিন-আল্-হাদরামী বাহ্রায়েন থেকে সমুদ্র; পথে ফারস্ আক্রমণ করেন। আলা ছিলেন সা’দের প্রতিদ্বন্দ্বী, এজন্যে তিনি একটা বিরাট রকম জয় করবার লোভে ওমরের অনুমতি ব্যতিরেকেই এ আক্রমণ আরম্ভ করেছিলেন। ইস্তিখারে মুসলিম সৈন্যরা জাহাজ থেকে অবতরণ করে। খালিদ-বিন্-মুন্নির ছিলেন তাদের নায়ক। স্থানীয় শাসক একটি বিরাট বাহিনী নিয়ে মুসলিমদের গতিরোধ করে। তিনি মুসলিমদের জাহাজগুলি দখল করে তাদের সমুদ্রপথ বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু খালিদ কিছুমাত্র শঙ্কিত না হয়ে মুসলিমদের উৎসাহ দিলেন : তোমরা মোটেই ভীত হয়ো না। শত্রুরা আমাদের জাহাজগুলি দখল করে আমাদের কাবু করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের দেশ-সহ আমাদের জাহাজগুলি পুনরায় দখল করে তাদেরকেই কাবু করে ফেললো। তাঁর উত্তেজনায় মুসলিমরা অল্পসংখ্যক হয়েও বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শত্রু সৈন্য বিধ্বস্ত করে দেয়। শত্রুরা জাহাজগুলি ডুবিয়ে দেওয়ায় তারা বস্ত্রা অভিমুখে যাত্রা করে। কিন্তু পারসিকরা সে পথও বন্ধ করে দেয়।
ওমর এ সংবাদ অবগত হয়ে আলোকে হঠকারিতার জন্যে তিরস্কার করেন, কিন্তু ওবাকে নির্দেশ দেন শীঘ্রই একদল সেনা পাঠিয়ে মুসলিমদের উদ্ধার করতে। আবু সাবরা বারো হাজার সৈন্য নিয়ে ফারদের দিকে অগ্রসর হন ও বিপদগ্রস্ত মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পারসিকরা চারদিক থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে এবং ভীষণ যুদ্ধ দান করে। কিন্তু আবু সাবরারই জয় হয়। তার উপর অন্য আদেশ না থাকায় তিনি বসরায় প্রত্যাগমন করেন। নিহাওন্দের যুদ্ধের পর পারস্যের দিকে দিকে যখন মুসলিমরা ছড়িয়ে পড়ে, সামগ্রিক আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে, তখন ফারস্ প্রদেশেও একদল মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়। এখানের পারসিকরা তোজ্ শহরে যুদ্ধের জন্য জমায়েত হতে থাকে। কিন্তু মুসলিমদের উপস্থিতিতেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সাবুর, আদর্শের তোজ্ ও ইস্তিখার একের পর এক অধিকৃত হয়। এইরূপ কিরমান অধিকার করতে সুহায়েল প্রেরিত হন। কিরমানের শাসনকর্তা কাও অন্যান্য স্থান থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে অতুল বিক্রমে যুদ্ধদান করেন, কিন্তু শেষে পরাজিত ও নিহন হন। মুসলিমরা জির ও সিরজান পর্যন্ত অভিযান চালায়। জির সেকালে একটি প্রধান বাণিজ্য- কেন্দ্র ও সিরাজান প্রধান শহর ছিল। এখানে বহু উট ও মেষ মুসলমানদের দখলে আসে।
আসিম-বিন-ওমর সিস্তান অধিকার করেন। এখানের অধিবাসীরা যুদ্ধের পর সন্ধি করে এই শর্তে যে, তাদের আবাদী জমিগুলি অক্ষত থাকবে। এই প্রদেশটি অধিকার করার পর সিন্ধু ও বলখের মধ্যবর্তী অঞ্চল মুসলিমদের অধিকার করা সুগম হয়ে যায়। হাকাম মাক্রান্ জয় করতে প্রেরিত হন। তিনি মাকরান নদীতীরে উপস্থিত হয়ে লক্ষ্য করেন, স্থানীয় শাসক রাসল পূর্বেই নদীতীরে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত আছেন। মাকরান-বিজয়ের সংবাদবহ সুহর-আবদী ওমরের নিকট এক কবিত্বপূর্ণ ভাষায় মাকরানের ধন সম্পদ ও লোক-চরিত্রের চিত্র তুলে ধরেন। ওমর তা শ্রবণ করে হাস্যসহকারে বলেন, অবস্থার বর্ণনায় কবিত্বের প্রয়োজন কী? সুহর বলেন, যা সত্য, তা বলেছি।
অতঃপর বিভিন্ন সেনানায়ককে ওমর নির্দেশ পাঠান, আর অগ্রগতির প্রয়োজন নেই। এজন্যে মাকরান ছিল ওমরের শেষ বিজয়চিহ্ন। ঐতিহাসিক বালাজুরী অবশ্য বলেন যে, মুসলিমরা দায়বল ও থানার নিম্ন-অঞ্চল পর্যন্ত অধিকার করেছিল। তাঁর কথা সত্য হলে ধরতে হয় যে, ওমরের আমলে সিন্ধু ও ভারতের দ্বারদেশ পর্যন্ত ইসলাম বিস্তৃত হয়েছিল।
আহনফ্-বিন্-কয়েস খোরাসান জয় করতে আদিষ্ট হন। তিনি বাইশ হিজরীদের (৬৪৩ খ্রি.) খোরসানের দিকে রওয়ানা হন এবং হিরাতে উপস্থিত হয়ে অঞ্চলটি অধিকার করেন। অতঃপর তিনি মার্ত-শাজাহানের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় ফেরার শাহানশাহ্ ইয়েজর্দি মার্ভে অবস্থান করছিলেন। তিনি মুসলিমদের আগমনের বার্তা শুনেই পলায়ন করেন। আহনফ্ তাঁকে তাড়া করে মার্ভওদ্ পর্যন্ত অভিমান করেন। তখন ইয়েজর্দি অনন্যোপায় হয়ে বলখে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আহনফ্ বলখেও তাঁকে তাড়া করলে তিনি অনন্যোপায় হয়ে কোনক্রমে নদী পার হয়ে তাতার রাজ্যে প্রবেশ করেন। আহনফ্ নৈশাপুর ও তখারিস্তান পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগ জয় করেন এবং ওমরকে সংবাদ পাঠান যে খোরাসান পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগ মুসলিমদের পদানত।
ওমর প্রথম থেকেই অগ্রগতির পক্ষে ছিলেন না এবং সাম্রাজ্যবাদও তার রাজনীতি ছিল না। খোরাসান জয়ের সংবাদ পেয়ে তিনিও বলেছিলেন: আমাদের ও খোরাসানের মধ্যে যদি একটি অগ্নির নদী প্রবাহিত থাকতো! তিনি আহনকে প্রাচ্যের মুক্তা বলে প্রশংসা করেন. কিন্তু নির্দেশ দেন, আরও অগ্রগতি নিষিদ্ধ। মদিনায় যখন খোরাসান বিজয়ের সংবাদ আসে, তখন ওমর সমস্ত মদিনাবাসীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন: অগ্নিপূজকদের সাম্রাজ্য আজ খতম হয়ে গেল, আর তারা ইসলামের উপর আঘাত হানতে পারবে না। কিন্তু মনে রেখো! তোমরাও যদি সত্যপথ থেকে ভ্রষ্ট হও, তা হলে আল্লাহ তোমাদেরও হাত থেকে এ রাজশক্তি কেড়ে নিয়ে অন্যকে দান করবেন।
ভাগ্যাহত ও বিতাড়িত শাহানশাহ্ ইয়েজগির্দের অন্তিমদশার উল্লেখ এখানে নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অসহায়ের মতো তুর্কিস্তানে পলায়ন করলেও তিনি মনে প্রাণে এ আশা পোষণ করতেন, একদিন-না-একদিন পারস্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠবে, তখন তাঁর সুযোগ মিলবে মুসলিমদের উপর শেষ প্রতিশোধ গ্রহণ করার। এরূপ দুরাশার বশবর্তী হয়ে তিনি গোপনে পারস্যের আপন পক্ষীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। হযরত ওসমানের সময় এ রকম বিদ্রোহের সূচনাও হয়েছিল এবং সুযোগ বুঝে ইয়েজর্দি তুর্কিস্তান থেকে মার্ভে পুনরায় আগমন করেন ও নিজের পক্ষীয়দেরকে একত্রিত করেন। কিন্তু মুসলিমরা শীঘ্রই এ বিদ্রোহ দমন করে ফেলে। তখন ইয়েজগির্দের সঙ্গীর অনুভব করে, অতঃপর আর তাঁর পুনরুত্থানের সম্ভাবনা নেই এবং তাঁর ভাগ্যোদয়ের কল্পনা করাও দুরাশা মাত্র। অতএব তারা একে একে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করলো। নিরুপায় শাহানশাহ্ পুনরায় তুর্কিস্তানে পলায়নের জন্যে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু এবার পলায়ন সহজ হলো না। তাঁর সঙ্গীসাথী একজনও নেই এবং মুসলিমরাও পারসিক গুপ্তচর লাগিয়েছিল তাঁকে বন্দী করে ফেলতে। অনন্যোপায় হয়ে তিনি নদীতীরে এক ফলওয়ালার কুটিরে আত্মগোপন করেন এবং সেখানেই নির্মমভাবে নিহত হন। পারসিকরাই তাঁকে নিহত করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। একটি কাহিনী আছে যে, ফলওয়ালা তাঁর শাহী পরিচ্ছদ দেখে লুব্ধ হয় এবং নিদ্রিত অবস্থায় তাঁকে হত্যা করে। তুর্কীরা তাঁর সন্ধানে এসে তাঁকে মৃতাবস্থায় দেখে ফলওয়ালাকে সপরিবারে হত্যা করে ও সকলের লাশ পানিতে ফেলে দেয়। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে একটি অতি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্যেরও শেষ হয়ে যায়। এ সাম্রাজ্য প্রায় বারো শতকেরও ঊর্ধ্বকাল প্রাচ্যের এক বিশাল ভূখণ্ডে অতুলনীয় শান-শওকতের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং ধন- সম্পদে শিল্পে ও সংস্কৃতিতে সমকালীন পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় ছিল। ইরানের শাহানশাহের পুনরুত্থান হতে সময় লেগেছিল আট শতক কিংবা তারও বেশি।
এ বিশাল সাম্রাজ্য অধিকার করতে আরব জাতিতে এক দশক ধরে সংগ্রাম সংঘাত চালাতে হয়েছে, মুসলিম বাহিনীকে সিরিয়া বা মিসরের চেয়েও বেশি রক্তক্ষয়ী দুর্মর প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে হয়েছে। পারস্য অভিযানে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার মুসলিম বাহিনীকে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে। পারসিকরা ছিল আর্যজাতি, সেমিটিক নয়। তাদের জাতীয় সত্তা ও সংহতির নিরঙ্কুশ অস্তিত্ব ছিল বহু শতাব্দী ধরে এবং ক্ষাত্রশক্তি এরূপ বলিষ্ঠ ও সুশৃঙ্খল ছিল যে চার শতকেরও অধিককাল রোমক রাজশক্তির বিরুদ্ধে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শক্তি পরীক্ষায় তা দুর্মর ও অনমনীয় ছিল। কিন্তু মাত্র আরব জাতির হাতে। পরবর্তী তিন শতকব্যাপী আরব-শাসনাধীনে তাদের মাতৃভাষা ফারসীর স্থানে আরবীর প্রাধান্য ছিল সরকারী ভাষা হিসেবেই নয়; তাদের বিদগ্ধ সমাজের, এমন কি অনেকখানি সাধারণের কথ্যভাষা হিসেবেও। তবে তাদের জাতীয় সত্তার অবলুপ্তি ঘটে নি এবং অধীন জাতি হয়েও তাদের মাতৃভাষা পুনরায় আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিন শো বছরের মধ্যেই। এবং বিশ্বের অমর কাব্য ‘শাহনামা’ তার সার্থক ফলশ্রুতি। ইসলামের কারামাতিয়ান আন্দোলন, যা বহু বছর ধরে খেলাফতের ভিত্তি পর্যন্ত টলমল করে রাখতো, তার উৎপত্তি হয়েছিল পারস্যের মধ্যেই। এবং শীয়া মযহাবের উন্নয়ন ও প্রসারণ এবং মিসরে দুই শতাব্দীব্যাপী রাজগিতে প্রতিষ্ঠিত ফাতেমীয়া বংশের প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল এই পারস্যে। পারসিক শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা ও কাব্যপ্রীতি আর জগতের সাধারণ সম্পদ হয়ে ওঠে এবং এ হিসেবে বিজিতরা বিজেতার উপর জয়ী হয়। ইসলাম-জগতের কয়েকটি উজ্জ্বল জ্ঞানী জ্যোতিষ্কের অভ্যুদয়ও হয়েছিল ইরানী মুসলিমদের থেকে।