ইয়ুয়িয়াকোর শিশু
কিছু-কিছু মানুষ আছেন যাঁরা, একা হাতে ইতিহাসের গতিপথ পালটে দিয়েছেন৷ কয়েকজনের নাম বলতে পারবেন? আলেকজান্ডার, হিটলার, সুভাষচন্দ্র বসু এবং আরও অনেকে৷ তবে ভাবুন তো, এমন কেউও তো থাকতে পারে, যাদের নাম আমরা জানি না৷ ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া পাতায় হয়তো লেখা ছিল তাদের নাম; হয়তো আজও বহু মরুভূমির চাপা পড়া বালির স্তূপের নীচে শুয়ে আছে তারা! সাক্ষী দিচ্ছে কোনও বিস্মৃত অতীতের৷
আজকের গল্পে বর্ণিত তিনটি মমি, তাদের নাম, বিবরণ, মেডিক্যাল ডেটা, ইনকা সভ্যতার ইতিহাস-কোনওটাই আমার কল্পনাপ্রসূত নয়৷ প্রতিটা শব্দ অক্ষরে অক্ষরে সত্য; যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, কোথাও কোনও কল্পনার আশ্রয় নেই৷
১৯৯৯ সালে জোহান রেইনহার্ট ইয়ুয়িয়াকোর তিনটি মমি উদ্ধার করেন৷ ২০০১ সালে তাদের আর্জেন্টিনার জাতীয় সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়৷ আজও চাইলে, আর্জেন্টিনার Museum of High Altitude Archaeology গিয়ে দেখে আসতে পারেন চিরনিদ্রায় শায়িত ইয়ুয়িয়াকোর তিনটি শিশুকে৷
লিফটের দরজা খুলে যেতেই সেরানকে চোখে পড়ল আমার৷ লোকটাকে আজ তিরিশ বছর হল দেখছি অথচ এতদিনে চেহারার এতটুকু বদল আসেনি৷ সেই একইরকম ঘষা পাথরের মতো চামড়ার রং, কপালের একটা পাশে একটা পুরনো বিনাইন টিউমার৷ দুটো উজ্জ্বল কিন্তু ছোট চোখ এবং চোখের কোলে একইরকম কোলেস্টেরলের দাগ৷ এমনকি জামাকাপড় অবধি একই ধাঁচের পরে থাকে৷ পারপেল জ্যাকেটের উপরে খয়েরি হাঁটু অবধি ওভারকোট৷ এত একবগগা জামাকাপড় সিনেমার সুপারহিরো ছাড়া আর কারও দেখিনি৷
লিফট থেকে বেরোতেই সেরান এগিয়ে এল আমার দিকে৷ এবার কিন্তু একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল আমার৷ অন্যবার দেখা হলেই তার মুখে একটা কান এঁটো করা হাসি দেখতে পাই, এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পেলাম না৷ উলটে মনে হল কিছু একটা কারণে ভয়ানক চিন্তিত আছে৷ এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে কোনওরকম সম্ভাষণের পরোয়া না করেই টেনে নিয়ে চলল মেইন ল্যাবরেটরির দিকে৷
তার গতিক দেখে একটু স্তম্ভিত হয়েছিলাম৷ সেটা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার বলো তো?’
ব্যাপার যে কিছু একটা আছে সেটা ফোনে তার গলা শুনেই বুঝেছিলাম৷ সাধারণত আর্কিওলজির কাজে কোনও দরকার পড়লে শেষ ঠেকনা হিসেবে সে আমাকেই ফোন করে৷ তবে তার বেশিরভাগই তাত্ত্বিক আলোচনা৷ আজ মনে হয় তার থেকে বেশি সিরিয়াস কিছু ঘটেছে৷
আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে আমাকে সেই ভাবে টানতে-টানতেই সে বলল, ‘যেভাবে হোক একটা থিয়োরি দিতেই হবে আমাদের৷ একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দিন, একটু সময় চাই আমাদের…’
‘আরে দাঁড়াও ছোকরা৷ কীসব বলছ বুঝতে পারছি না৷ কিসের থিয়োরি?’
বুঝলাম সে গুছিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই৷ চোখের কোটর দুটো আরও গভীর দেখাল তার৷
আমি আর তেমন আপত্তি করলাম না৷ করিডোর পেরিয়ে আমাকে ল্যাবের দিকে নিয়ে চলল সেরান৷
আর্জেন্টিনার এই মেট্রোপলিটন শহর সালতায় এসে আমি থাকতে শুরু করেছি আজ বছর পাঁচেক৷ তার আগে গোটা কলম্বিয়ার প্রায় একশোরও বেশি আর্কিওলজিক্যাল ল্যাবে কাজ করেছি৷ ইদানীং আর সেসব কাজে তেমন আগ্রহ পাই না৷ শরীরেও জুত হয় না৷ তবে এখানে এই সালতায় অবসর জীবনে সেরানের সঙ্গে প্রাচীন পুঁথি, মমি কিংবা নতুন আবিষ্কৃত কোনও আর্কিওলজিক্যাল সাইট সম্পর্কে ফোনে আলোচনা চলে৷ সেও ঋদ্ধ হয়, আমারও একাকীত্ব কাটে৷
দিন পনেরো আগে সেরান আমাকে ফোন করে গল্পের ছলে বলে যে আতাকামা মরুভূমির কাছে ইয়ুয়িয়াকো নামে একটা আগ্নেয়পাহাড়ে প্রাচীন ইনকা সভ্যতার কিছু নিদর্শন মিলেছে৷ আরও সিরিয়াস কিছু পাওয়া যায় কি না তার খোঁজ চলছে৷ এর পরের পনেরো দিন আর তার পাত্তা পাইনি আমি৷ আজ সকালে ফোন করে জরুরি তলব৷ তারপর থেকে এখন অবধি সবই আমার কাছে অস্পষ্ট৷
ল্যাবের ভিতরে ঢুকে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিল সেরান৷ ল্যাবের ভিতরে অল্প আলো জ্বালানো আছে এখন৷ ঘরটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত৷ পাশেই রাখা চেয়ারে একটা ছোকরা বসে অপেক্ষা করছিল আমাদের৷ সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল৷ সেরান আঙুল তুলে তাকে নির্দেশ দিতে ঘরের একটা দেওয়ালের কাছে গিয়ে কয়েকটা আলো জ্বালিয়ে দিল সে৷ সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের একেবারে মাঝে পরপর তিনটে মানুষের সাইজের কাচের বাক্স আলোকিত হয়ে উঠল৷ তার ভিতরে মানুষের দেহের আকারে কিছু রাখা আছে—সম্ভবত মমি৷ আমি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম৷ বুঝলাম ইয়ুয়িয়াকোর এক্সক্যাভেশন সাইট থেকেই পাওয়া গেছে মমিগুলো৷ ব্যাপারটা তাজ্জব কিছু না… তবে…
‘চিলড্রেন অফ ইয়ুয়িয়াকো…’ ঘসঘসে গলায় বলল সেরান৷ আমার পাশে এসে দাঁড়াল সে৷
কাচের বাক্সগুলোর ভিতরে যে তিনটে মমি শোয়ানো আছে তাদের প্রথাগত মমি বলা চলে না৷ কারণ পচন থেকে রক্ষা করার জন্যে তাদের গায়ে-হাতে-পায়ে আলাদা করে কোনও আবরণ নেই৷ যেন তিনটে স্বাভাবিক মৃতদেহকে কেউ একটু গুটিসুটি মেরে বসিয়ে রেখে গেছে৷ একটু পরে এসে দাহ করবে ভেবেছিল কিন্তু ভুলে গেছে৷
স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি৷ জীবনে মমি আমি কম দেখিনি, কিন্তু এত নিটোল, অক্ষত মমি কোনও ছবিতেও চোখে পড়েনি আমার৷ তিনটে মানুষের চুল, হাতের নখ, চামড়া এমনকি ঠোঁটের ভাঁজগুলো অবধি স্পষ্ট বোঝা যায়৷ অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ মমিগুলো যে তিনটি ইনকা শিশুর সেটা জামাকাপড়ের ধরন স্পষ্ট করে দিচ্ছে৷ দুটো মেয়ে, একটা ছেলে৷ একটি মেয়ে বাকি দু-জনের থেকে বয়সে খানিকটা বড়৷ মিনিটখানেক তাদের ভালো করে দেখে সেরানের দিকে ফিরলাম, ‘এ তো কাপাকোচা মনে হচ্ছে৷’
‘ইয়েস, কাপাকোচা, সন্দেহ নেই আমাদের৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, কিসের জন্য?’ সেরান গম্ভীর মুখে বলল৷
ইনকা সভ্যতার মানুষ কথা বলত কেচুয়া ভাষায়৷ সে ভাষাতে কাপাকোচার অর্থ হল বলি৷ বিশেষ করে শিশু বলি৷ আজ থেকে প্রায় সাতশো বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার ডান প্রান্ত জুড়ে আন্দিজ পর্বতের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল ইনকা সভ্যতা৷ ইনকাদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি খুব কম৷ কারণ কোনও লিখিত ভাষা ছিল না তাদের৷ ফলে টাকাপয়সার চলও ছিল না৷ ব্যবসাবাণিজ্য হত আদান-প্রদানের উপরে ভিত্তি করে৷
তবে ইনকারা অর্থনৈতিক বা সামাজিক অগ্রগতির জন্যে ইতিহাসে জনপ্রিয় নয়৷ জনপ্রিয় তাদের অদ্ভুতুড়ে ও পৈশাচিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্যে৷ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে হিউম্যান স্যাক্রিফাইস নিয়ে এত অবসেসন দেখা যায়নি৷ প্রায় সবরকম শুভ-অশুভ কাজের আগেই রিচ্যুয়ালিস্টিক স্যাক্রিফাইস করত তারা৷ রাজার অভিষেক, রাজার পুত্রলাভ, কম ফলন, অধিক ফলন, রানির মৃত্যু সব অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণই নরবলি৷ এই নরবলি করা হত মূলত চারটে পদ্ধতিতে—গলায় ফাঁস লাগিয়ে, মাথায় বাড়ি মেরে, কিংবা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে৷ এছাড়া কিছু কিছু অঞ্চলে জীবন্ত শিশুদের হৃৎপিণ্ড খুবলে বের করে সেই রক্ত দেবতার শরীরে মাখিয়ে দিত তারা৷
সেরান বাক্সগুলোর চারপাশে পায়চারি করতে লাগল, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে এই তিনটে শিশুকে স্যাক্রিফাইস করা হয়৷ প্রথমে এদের ড্রাগ জাতীয় কিছু খাইয়ে অবচেতন করে পাহাড়ের মাথায় রেখে আসা হয়েছিল৷ পরে ওই পাহাড়েরই চুড়োর কাছে একটা এয়ারটাইট ঘরের ভিতরে বন্ধ করে রেখে আসা হয়, সেখানেই মারা যায় এরা৷’
‘কীরকম ঘর?’ আমি জিজ্ঞেস করি৷
‘ঘর ঠিক নয়…’ সেরান মাথা দোলায়, ‘দেড় মিটারের চেম্বার বলা চলে, তার ভিতরেই আমরা পেয়েছি মমিগুলো৷ পাঁচশো বছর ধরে ওখানেই পড়ে ছিল৷ এয়ারটাইট করে বন্ধ, তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় ঠান্ডাও থাকে সবসময়৷ সেই জন্যেই এদের মৃতদেহে পচন ধরেনি এখনও৷’
সেরানের কথা শুনে বুঝলাম মমিগুলো নিয়ে সে উদ্বিগ্ন৷ কিন্তু কেন? এমন কী অস্বাভাবিক আছে তিনটে শিশুর মমিতে?
প্রথম মমিটার কাছে এগিয়ে যায় সেরান, সেটা দেখিয়ে বলে, ‘এই কিশোরীটির নাম আমরা দিয়েছি লা ডনসিয়া৷ তিনজনের মধ্যে এর বয়সই সব থেকে বেশি, পনেরোর কাছাকাছি, অক্ষতযোনি৷ সেকালে সুন্দরী মেয়েদেরকে আলাদা করে বড় করা হত স্যাক্রিফাইস করে দেবতার কাছে অর্পণের জন্যে৷ তিন শিশুর মধ্যে ডনসিয়াকেই সব থেকে বেশি যত্ন নিয়ে স্যাক্রিফাইস করা হয়৷ দড়ি-টরি দিয়ে বাঁধা হয়নি৷ কোকা জাতীয় কোনও ড্রাগ ব্যবহার করে অবচেতন করা হয় তাকে…’
কথাটা বলে পাশের মমিটার দিকে এগিয়ে আসে সেরান, এটাও একটা মেয়ে, তবে বয়সে বেশ খানিকটা কম৷ আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে বলে, ‘ছ-বছর বয়সে স্যাক্রিফাইস করা হয় একে৷ মৃত্যুর পর কোনওভাবে বাজ পড়ে মাথা আর কাঁধের বেশ কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ স্থানীয় ভাষায় বজ্রপাতকে বলা হয় রায়ো৷ আমরা এর নাম দিয়েছি নিনিয়া দেল রায়ো৷’
দ্রুত পরের বাক্সটার সামনে সরে এসে আমার দিকে মুখ তুলে তাকায় সেরান, মনে-মনে কিছু একটা ভেবে নেয় সে, তারপর বলে, ‘এই মমিটার জন্যেই আজ সকালে ডেকে আনা আপনাকে… এল নিনিও…’
সেরানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় লাগল আমার৷ এত চিন্তিত আগে কোনওদিন দেখিনি আমি তাকে৷ পকেট থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করে কিছু যেন দেখল, তারপর বলল, ‘এল নিনিও মারা যায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, অন্য দুটো মমিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়নি, কিন্তু এল নিনিওকে বাঁধা হয়৷ এমনকি তার শরীরে চোট আঘাতের চিহ্নও আছে৷ দড়ি দিয়ে এত শক্ত করে তাকে বাঁধা হয় যে সেই দড়ির চাপেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে সে মারা যায়৷ তার মমির পাশে আমরা রক্তবমির চিহ্নও দেখেছি…’
সেরান প্রশ্নটা করার আগেই আমি বলে উঠি, ‘অ্যাবসার্ড৷ কাপাকোচার আগে, যেসব বাচ্চাকে স্যাক্রিফাইস করা হবে তাদের চূড়ান্ত যত্ন নিত ইনকারা৷ কারণ তাদের দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হচ্ছে৷ আগের দুটো মমিকে যেমন করা হয়েছে…’
‘দ্যট ইজ দ্য বিগ কোয়েশ্চেন প্রোফেসর…’ হাতটা মুখের সামনে তুলে একবার কপালের ঘাম মোছে সেরান, ‘কেন? কেন এই মমির উপর এমন পাশবিক অত্যাচার চালাল তারা?’
মমিটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি৷ দুটো হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে দুটো হাত সামনে করে বসে আছে বছর সাতেকের ছেলেটা৷ বোঝা যায় দড়ির চাপেই তার শরীরের কয়েকটা অংশ ভেঙেচুরে গেছে…’
‘কিন্তু আমাকে কী করতে বলছ?’ আমি মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলাম৷
থমথমে স্বরে সেরান বলল, ‘আমরা সবরকম মেডিক্যাল টেস্ট চালিয়েছি, দরকার পড়লে তার সবই দেওয়া হবে আপনাকে৷ মমিগুলো যখন উদ্ধার করা হয় সেই সময়কার সব ছবি আছে আমাদের কাছে৷ কনফিডেন্সিয়াল সমস্ত তথ্য আপনি হাতের কাছে পাবেন, কিন্তু এই রহস্যের আপনাকে সমাধান করতে হবে৷’
‘আমি!’ চমকে বলে উঠলাম, ‘আমি কী করে করব?’
‘সেটা আমাদের জানা নেই৷ তবে সময় নেই আমাদের হাতে…’ ঘড়ির দিকে তাকায় সেরান, ‘এইট আওয়ার্স লেফট৷’
‘হোয়াট ননসেন্স!’ আমি রাগত স্বরে বললাম, ‘তুমি কি নতুন বহাল হয়েছ এখানে? এটা কি ক্রসওয়ার্ড পাজেল যে টেবিলে বসলাম আর সলভ করে ফেললাম?’
‘আপনাকে আমরা জোর করছি না৷ জানি মমিগুলো আমরা বেশিক্ষণ এখানে রাখতে পারব না৷ সবরকম টেস্ট আর মডিফিকেশন হয়ে গেছে, আজ সন্ধের মধ্যে কিছু একটা কারণ না দেখাতে পারলে কাল সকালেই মিউজিয়ামে চলে যাবে এগুলো… ’
‘গেলেই বা, অসুবিধা কী?’ আমি হাত উলটে জিজ্ঞেস করলাম৷
‘আপনি বুঝতে পারছেন না প্রোফেসর৷ পনেরোশো বত্রিশ নাগাদ স্প্যানিশ অভিযাত্রী পিজারোর হাতে বন্দি হন শেষ ইনকা রাজা আতাহুলাপ্পা৷ পিজারো তাঁকে একটা থামের সঙ্গে বেঁধে দুটো অপশন দেন৷ এক, জীবন্ত দগ্ধ করে মৃত্যু, দুই গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা৷ আগুনে পুড়ে মরলে স্বর্গে গিয়ে শরীর থাকবে না, এই ভেবে আতাহুলাপ্পা দ্বিতীয় পন্থা পছন্দ করেন৷ লোহার শিকল গলায় পরিয়ে শ্বাসরোধ করে এক্সিকিউট করা হয় তাঁকে৷ এরপর থেকে খুব দ্রুত ইনকা সভ্যতা শেষ হয়ে যায়৷ সালটা খেয়াল করুন—পনেরোশো বত্রিশ… আমাদের খুঁজে পাওয়া মমিগুলো ওর কয়েকবছর আগে স্যাক্রিফাইস করা হয়…’
ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারছিলাম আমি, বললাম, ‘মানে তুমি বলছ স্প্যানিশ আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্যেই তিনটে শিশুকে স্যাক্রিফাইস করা হয়?’
‘আমি বলছি তিনশো বছরের সভ্যতা শেষ হওয়ার ঠিক মুখে একটা ধর্মান্ধ গোঁড়া জাতিগোষ্ঠী তাদের রাজার জীবনরক্ষার উদ্দেশ্যে তিনটে শিশুকে স্যাক্রিফাইস করল, কিন্তু তাদের এতদিনের রীতিনীতি পালন করল না৷ এল নিনিওকে মারধর এমনকি শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হল…’
মমির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ৷ মুখের উপর থেকে একবার হাত চালিয়ে নিয়ে বললাম, ‘বেশ, আমি চেষ্টা করব, কিন্তু তাতে লাভ হবে এমন কিছু কথা দিতে পারছি না৷’
আমার কথা শেষ হতেই বাইরের দরজার দিকে পা বাড়াল সেরান, যেতে-যেতে বলল, ‘আমি সব কাগজপত্র আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ আর যা যা দরকার হবে রডরিগোকে জিজ্ঞেস করলেই পাবেন৷’
বুঝলাম ঘরের দরজার কাছে চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটির নাম রডরিগো৷ সে আমার দিকে এগিয়ে এসে একটু হাসল৷ ঘরের বাকি আলোগুলো এতক্ষণে জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ আমি একবার দু-হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলাম, আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম, ‘তুমি এখানে কাজ করছ কতদিন?’
‘এই বছর দুয়েক৷’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল সে৷ ছোকরাকে দেখে মনে হয়৷ তার বয়স তিরিশের ঘরে৷ তার উপরে নতুন বহাল হয়েছে৷ যতক্ষণ না কাগজপত্র আসছে আমার করার কিছু নেই৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো যখন এক্সক্যাভেট করা হয় তুমি সামনে ছিলে?’
‘হ্যাঁ,’ উপর-নীচে মাথা নাড়ায় রডরিগেজ, ‘আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলাম স্যার৷’
‘স্যার বলার দরকার নেই৷ কিন্তু ভয় পেয়েছিলে কেন?’
সে একটু লাজুক হাসি হেসে বলে, ‘এত নতুনের মতো ছিল মৃতদেহগুলো যে মনে হচ্ছিল ওরা ঘুমিয়ে আছে৷’
‘ওদের চোখ কোনদিকে ছিল বলতে পারবে? মানে যখন ওদের উদ্ধার করা হয় তখন কোনদিকে তাকিয়ে ছিল ওরা?’
মাথার মধ্যে ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে থাকে রডরিগেজ৷ বলে, ‘তিনজন একদিকে তাকিয়ে ছিল না৷ তবে এল নিনিও আর ডনসিয়া উত্তর-পূর্ব দিকে চেয়ে ছিল, রায়োরটা আমার মনে পড়ছে না৷’
দুটো আঙুল থুতনির নীচে জড়ো করে ভাবনায় ডুব দিই আমি৷ কিছুটা সময় কাটতে রডরিগেজ বলে, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে?’
আমি থুতনি থেকে হাত সরিয়ে বলি, ‘শুধু এল নিনিওর মৃত্যুটাই নয়; এই মমিগুলোতে আরও কিছু অসঙ্গতি আছে৷ এদিকে এসো… একটা জিনিস দেখাই…’ কথাটা বলে লা ডনসিয়ার দিকে এগিয়ে আসি আমি, কাচের উপর দিয়ে রডরিগেজও ঝুঁকে পড়ে চোখ রাখে তার উপরে৷
‘মেয়েটার ঘন কালো চুলের মধ্যে কয়েকটা সাদা চুল দেখতে পাচ্ছ?’ আমি আঙুল দিয়ে জায়গাটা দেখাই তাকে৷
‘হ্যাঁ…’ ঘাড় নাড়ে রডরিগেজ, ‘অনেকগুলো সাদা চুল৷’
‘একটা পনেরো বছরের মেয়ের মাথায় সাদা চুল থাকার কথা নয়৷ সেকালে এই অঞ্চলে সাদা চুল একমাত্র বয়সের কারণ ছাড়া হত না…’
‘তাহলে কী করে সাদা হল চুলগুলো?’
আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘কোন কারণে প্রবল মানসিক দুশ্চিন্তায় ছিল লা ডনসিয়া৷ সেই কারণেই তার চুল সাদা হয়ে যায়৷ তাছাড়া…’
মুখ ফিরিয়ে আমি দেখলাম ঘরে ঢুকছে সেরান, তার পিছনে আরেকজন লোক৷ হাতে দুটো ফ্ল্যাপ ফাইল৷ সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, ‘ইনকারা সূর্যের উপাসক ছিল, সাধারণত সূর্য যেদিক থেকে ওঠে সেদিকে মুখ করেই স্যাক্রিফাইস করা হত তাদের৷ কিন্তু তুমি যা বললে তাতে মনে হচ্ছে সেটা পালন করা হয়নি এখানে…’
যে ঘরে মমিগুলো রাখা আছে তার ঠিক লাগোয়া একটা স্টাডিরুম আছে, সেদিকেই আমাকে হাত দেখাল সেরান৷ সঙ্গের লোকটা কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে গেল সেইদিকে৷ রডরিগেজ তাদের পিছু নিল৷ আমি একবার ভালো করে তিনটে মমি খুঁটিয়ে দেখে সে ঘরের ভিতরে ঢুকে এলাম৷
এই ঘরটা মমির ঘরের তুলনায় কিছুটা ছোট৷ একদিকে একটা প্রোজেক্টার রাখা আছে৷ তার ঠিক পিছনেই হোয়াইট বোর্ড৷ কিছু নোটস পিন দিয়ে আটকানো আছে তার উপরে৷ লেখালিখি করার জন্যে একটা বড় টেবিল, তার উপরে কিছু ড্রইং টুল৷ কয়েকটা ছবি সাজিয়ে রাখা আছে টেবিলে৷ সেরানের সঙ্গের লোকটা ছবিগুলো একদিকে করে কাগজপত্র এনে টেবিলের উপরে রেখে দিয়ে চলে গেল৷ আমি পাশের একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসে পড়ে উপরের কাগজটা হাতে তুলে নিলাম৷
‘প্রোফেসর…’ সেরান ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘আমরা ধরেই নিয়েছি কাল সকালের আগেই মমিগুলো নিতে লোক আসবে এখানে৷ কোনও প্রেশার দিতে চাই না৷ উই জাস্ট ওয়ান্ট ইউ টু টেক আ ল্যুক৷’
ঘাড় নেড়ে কাগজগুলো চোখের সামনে তুলে ধরলাম আমি৷ পরপর তিনটে মমির মেডিক্যাল এক্সামিনেশনের বিবরণ দেওয়া আছে৷ একটা জায়গায় এসে আমার চোখ আটকে গেল, মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোকা জাতীয় ড্রাগ পাওয়া গেছে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, অ্যালকোহলিক কিছু খাইয়ে ওদের অবচেতন করা হয়৷’ কাগজটা দেখতে-দেখতে বললাম, ‘কিন্তু পেটে খাবার-দাবার মেলেনি?’ ‘না…’ মাথা দোলায় সেরান৷
‘স্ট্রেঞ্জ!’ আমার মনের ভিতরে একটা খটকা দেখা দেয়, ‘পেটে ভালোমতো খাবার না থাকলে কোকা পুরোপুরি কাজ করতে পারে না৷ তাছাড়া আমি যতদূর জানি ইনকারা স্যাক্রিফাইস করার আগে যাকে স্যাক্রিফাইস করা হবে তাকে ভরপুর খাওয়াত৷ যাতে স্বর্গের দ্বার অবধি যেতে-যেতে তার খিদে না পেয়ে যায়৷ আমার অন্য একটা ইনকা মমির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে—খুয়ানিতা… একে মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে মেরে বলি দেওয়া হয়, এত জোরে মারা হয় যে খুলি মাথার একদিক থেকে অন্যদিকে সরে যায়, রক্তে ভরে যায়… বরফের মধ্যে জমে যাওয়ায় এর গোটা শরীরটাকেই তাজা অবস্থায় উদ্ধার করা গেছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে যে মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে শাকসবজি সমেত রীতিমতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হয়েছিল৷ কিন্তু এই তিন শিশু তাহলে অনাহারে থাকল কেন?’
ঠোঁট উলটে সেরান বলল, ‘খাবার-দাবার পাওয়া যায়নি তবে কিছু লিক্যুইডের ট্রেস পাওয়া গেছে৷ আননোন সাবস্ট্যান্স৷ সম্ভবত কোনও পোসন খাওয়ানো হয়েছিল তাদের৷ কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে তার মধ্যে কিছু অ্যানিমাল ব্লাড পেয়েছি আমরা৷ বাকি এলিমেন্ট কোনও জড়িবুটি হতে পারে, আইডেন্টিফাই করা সম্ভব হয়নি৷ তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, লিক্যুইডটা যদি রিচ্যুয়ালের অংশ হয় তাহলে অন্য জায়গার মমিতেও পাওয়া যাওয়ার কথা… পাওয়া যায়নি৷’
‘ঠিক যেন নতুন কোনও পদ্ধতিতে স্যাক্রিফাইস করা হয়েছিল এদের৷ কিন্তু ইনকারা যেরকম গোঁড়া ধার্মিক ছিল তাতে ধর্মীয় নিয়মকানুন সহজে পালটে যাওয়ার কথা নয়… তাহলে হঠাৎ…’
প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া গেল না৷ সেরান একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘এল নিনিওর শরীরের আশপাশে কিছু এনগ্রেভিংস পাওয়া গেছে, সেগুলো এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই৷ তবে ছবিগুলো আপনাকে দেখাতে পারি৷’
আমার সামনে কয়েকটা কালারড ফোটোগ্রাফ রাখে সেরান৷ সেগুলো হাতে তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে থাকি আমি৷ ছবিতে কতগুলো ছোট পাথরের ফলক দেখা যাচ্ছে৷ তার উপরে ছেনি জাতীয় কিছু দিয়ে কয়েকটা ছবি খোদাই করা আছে৷ ছবিগুলো ভালো করে দেখলে বোঝা যায় ইনকাদের সাধারণ জীবনযাত্রার ছবি সেগুলো৷
একটার পর একটা ছবি উলটে দেখে যেতে লাগলাম আমি৷ কোথাও তাদের বিস্তৃত চাষের জমিতে জল দেওয়া হচ্ছে, কোথাও একদল পশুকে বিশেষ কোনও কৌশলে এগিয়ে নিয়ে চলেছে কিছু মানুষ, কয়েক জায়গায় দেখা যাচ্ছে একটা গুলতি জাতীয় জিনিস ব্যবহার করে বড় হ্রদের মধ্যে ঢিল ছুঁড়ছে একদল লোক৷ এই শেষের জিনিসটা একটা রিচ্যুয়াল, এভাবে বর্ষাকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য আহ্বান জানাত ইনাকারা… কিন্তু…
আমার ভুরুটা কুঁচকে গেছিল, রডরিগেজ সেদিকে তাকিয়েই বোধহয় জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বুঝতে পারলেন প্রোফেসর?’
বুঝলাম আমাকে অকারণে দেরি করতে দেখলে তাড়া দেওয়াটাই ছোকরার একটা কাজ৷ বললাম, এসব আরটিফ্যক্ট ইজিপ্টে কোনও পিরামিডের ভিতরে পাওয়া গেলে অবাক হতাম না৷ কিন্তু ইনকারা মৃত্যুর পর আত্মার জেগে ওঠায় বিশ্বাস করত না৷ এখানে যে এইসব রেখেছে তার নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে৷’
‘কী কারণ?’ সেরান জিজ্ঞেস করে এবার৷
ছবিগুলো ভালো করে লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে৷’ ছবির স্ট্যাকটা আমি সেরানের সামনে ফেলে দিয়ে বলি, ‘যেসময়ে স্যাক্রিফাইসগুলো করা হয়েছে সে সময়ে ইনকা সভ্যতা প্রায় শেষের মুখে৷ তারা জানত যে আর বড়জোর কয়েক বছর তাদের সভ্যতা টিকে থাকবে৷ সভ্যতা চুলোয় যাক সেসব নিয়ে অত মাথা ঘামায়নি তারা৷ ইনকাদের সব থেকে বড় ভয় ছিল যে তাদের বিলুপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে তাদের ধর্মও পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে… এমনিতেই সে সময়ে স্প্যানিশ ইনভেডাররা একহাতে বাইবেল আর অন্য হাতে তলোয়ার নিয়ে শেষ করতে শুরু করেছে তাদের৷ প্রথমে বাইবেল, সেটা কাজে না লাগলে তলোয়ার৷ ফলে তারা নিজেদের সভ্যতার কিছু এপিটোমকে রেখে যেতে চেয়েছিল…’
সেরান আর রডরিগেজ ভালো করে লক্ষ করে ছবিগুলো, আমি বলতে থাকি, ‘বেশিরভাগ ছবিতেই দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হচ্ছে৷ কীভাবে দেবতার মন পেতে হবে সেটাও বলা আছে কোথাও-কোথাও… ইনকাদের না যিশু ছিল, না বাইবেল, তারা এভাবেই নিজেদের ধর্মের স্বাক্ষর রেখে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন হল…’ আমি একটু থেমে বলি, ‘সে স্বাক্ষর তারা তিনটে মৃত শিশুর দেহের আশপাশে রেখে গেল কেন?’
আরও বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সেরান৷ যাওয়ার আগে আমাকে আবারও একবার বলে গেল কোনও দরকার পড়লেই যেন রডরিগেজকে ডাকি৷ তবে আমার তাকে আর বিশেষ দরকার পড়ল না৷ কাগজপত্র উলটে তেমন দরকারি কিছু আর পাওয়া গেল না৷
বহুদিন একটানা কাজ করার অভ্যাস নেই৷ মাথাটা ধরে আসছিল৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ রডরিগেজ আমাকে উঠতে দেখে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘কোথাও যাবেন প্রোফেসর?’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘একটা ফাঁকা জায়গা, তোমার সিগারেট চলে?’
সে ইঙ্গিতটা বুঝে একটা চওড়া হাসি হেসে বলল, ‘অন ডিউটি খাই না শুধু, আসুন আমার সঙ্গে…’
মমির ঘরটা পেরিয়ে আমরা ল্যাবের করিডোর দিয়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ এখানে একটা বড়সড় ঘের বারান্দা করা আছে৷ এখন তার ভিতরটা ফাঁকা, জায়গাটা দেখতে মনোরম, তিনদিক খোলা বলে সালতা শহরের একটা বড় অংশ দেখা যায়৷ কিছুটা দূরে বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া থিয়েটারের উপর দিকের উঁচু গম্বুজটা চোখে পড়ে৷ তারপর অনেকটা পথ পেরলে একটা অতিকায় পাঁচিলের মতো লেমা ভ্যালির রেঞ্জ৷ মনে হয় শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে কেউ যেন পরিখা করে রেখেছে শহরটাকে ঘিরে৷ এখন অবশ্য সবই অন্ধকারে ঢেকে আছে৷ ভ্যালির নীলচে সবুজ রং বোঝা যাচ্ছে না৷
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি একটা সিগারেট মুখে রেখে আগুন জ্বালালাম, রডরিগেজ অনেকক্ষণ থেকে কিছু একটা বলবে বলে ইতস্তত করছিল, এতক্ষণে সিগারেটের ধোঁয়া মুখের সামনে থেকে সরাতে-সরাতে বলল, ‘একটা কথা আমার মনে হল প্রোফেসর, কিছু মনে করবেন না…’
আমি কথাটার উত্তর না দিয়ে তার দিকে মুখ তুলে তাকালাম, সে একবার ঘাড় চুলকে বলল, ‘আপনার ব্যাখ্যা শুনে মনে হল ক্রিশ্চান মিশনারিদের উপর বেশ রাগ আছে আপনার…’
ধোঁয়ার একটা রিং ছেড়ে হাসলাম, ‘রাগ আমার সব ধর্মের উপরই অল্পবিস্তর আছে… কারণ একটু-আধটু দুষ্টুমি কোন না কোনও সময় সবাই-ই করে এসেছে৷’
‘সে তো ইনকারাও করেছে…’
‘করেছে মানে৷’ আমি তার দিকে কিছুটা এগিয়ে এলাম, ‘কয়েক হাজার জীবন্ত শিশুকে আগুনে দগ্ধ করে মেরেছিল তারা৷ বাবা-মা নিজে এসে সূর্যের ছবি আঁকা থামে বেঁধে দিয়ে যেত তাদের ছেলেমেয়েকে আগুনে পোড়ানোর জন্যে৷ বলি দেওয়ার একমাস আগে থেকে মেয়েদের শেখানো হত কীভাবে জামাকাপড় তৈরি করতে হয়, মাটি দিয়ে বাসন তৈরি করতে হয়—মৃত্যুর পর তারা দেবতার সেবা করবে বলে৷ এই ধর্মীয় সংস্কার যদি বর্বরতা না হয় তবে বর্বরতা কাকে বলে?’
রডরিগেজ আর কিছু বলে না৷ আমি আবার লেমা ভ্যালির অন্ধকার বুকে চোখ রাখি, মন কিন্তু এতক্ষণে ঘোঁট পাকিয়ে গেছে৷ অনেকগুলো প্রশ্ন এসে জড়ো হয়েছে মনের ভিতর৷ তাহলে কি রিচ্যুয়ালের পদ্ধতি বদলে ফেলেছিল ইনকারা? নতুন যে লিক্যুইড বাচ্চা তিনটেকে খাওয়ানো হয়েছিল সেটা কী কাজ করত? দুটো মেয়েকে ঘরের ভিতর বন্ধ করে হত্যা করা হল কিন্তু ছেলেটাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হল কেন? লা ডনসিয়ার মাথায় সাদা চুল এল কী করে? কিসের চিন্তায় ডুবে থাকত সে?
সাম্রাজ্য শেষ হয়ে আসছে দেখে ঠিক কী করতে চাইছিল ইনকারা? পাথরের উপর খোদাই করা লেখাগুলো… একটা ক্ষীণ আলো দেখতে পাচ্ছি যেন৷ সমস্ত ঘটনাগুলো কোথাও একটা সুতো দিয়ে বাঁধা আছে৷ শুধু আমিই দেখতে পারছি না৷
মুখ ফিরিয়ে বলি, ‘আচ্ছা যেখান থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে তার আশপাশে সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া যায়নি?’
‘সেটাই আশ্চর্যের…’ কিছু ভেবে বলে রডরিগেজ, ‘গোটা অঞ্চলে একই সময়ে মৃত এমন বহু মানুষের হাড়গোড় পাওয়া গেছে৷ সমস্তটা দেখে মনে হয় গোটা গ্রামটাই যেন একসঙ্গে সুইসাইড করেছিল৷’
‘হোয়াট! রিচ্যুয়ালিস্টিক সুইসাইড!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ… বিষাক্ত কিছু খেয়ে মারা গেছিল সবাই, প্রায় একই সঙ্গে৷’
আমার হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল৷ মাথার ভিতরে মনে হল ক্ষীণ স্বরে কথা বলে উঠছে কেউ৷ কয়েকটা প্রাচীন প্রশ্নের উত্তর একটু-একটু করে ফুটে উঠছে মাথার ভিতরে৷ সবটা স্পষ্ট নয়, কিছুটা আন্দাজ করে নিতে পারলে…
‘রিপোর্টে দেখলাম মেয়ে দুটো জেনেটিক্যালি কানেক্টেড…’ আমি সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে বললাম৷ বারান্দার খোলা অংশ দিয়ে ভেসে আসা রাতের হাওয়াটা অলৌকিক মনে হল আমার৷ বেশ কিছুক্ষণ আগে রডরিগেজ একটা কথা বলেছিল, সেটা এখন মনে পড়ে গেল৷
‘দে ওয়্যার হাফ সিস্টারস…’ রডরিগেজ আমার শরীরের উত্তেজনাটা খেয়াল করে ভুরু কুঁচকে বলল৷
হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমি৷ মনের ভিতরে একটু আগে যে আলোটা দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা ক্রমশ বড় হচ্ছে, ‘দিস ইজ ইন্সেন, একই পরিবারের দু-জনকে একসঙ্গে স্যাক্রিফাইজ করা ইনকাদের ধর্মবিরুদ্ধ ছিল… ওঃ মাই গড…’ আমি দু-হাতে মাথার চুল খামচে ধরলাম৷
‘কী হয়েছে প্রোফেসর?’ রডরিগেজ আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি ধীরে-ধীরে মুখ তুললাম, ‘ওই তিনটে শিশুকে স্যাক্রিফাইস করা হয়নি রডরিগেজ…’
‘তাহলে?’ সে অবাক বিস্ময়ে তাকাল আমার দিকে৷
‘ওদের প্রিজারভ করা হয়েছিল, স্যাক্রিফাইস করা হয়েছিল বাকি গোটা গ্রামকে৷’ আমি মেঝের উপরেই বসে পড়লাম৷
‘মানে! কী বলতে চাইছেন আপনি?’
আমি একটা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলাম, উত্তরটা না দিয়ে একটা প্রশ্ন করলাম, ‘একটু আগে তুমি বলছিলে যখন মমিগুলোকে উদ্ধার করা হচ্ছিল তখন ওগুলোকে দেখে তোমার মনে হচ্ছিল ওরা ঘুমিয়ে আছে৷’
‘হ্যাঁ, বলেছিলাম, কিন্তু তাতে…’
‘ওরা সত্যি ঘুমিয়ে আছে…’ আমি মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললাম, ‘স্যাক্রিফাইস করার আগে যে অজ্ঞাত তরল ওদেরকে খাওয়ানো হয়ছিল সেটা ওদের শরীরকে একটা হাইবারনেশন স্টেটে রেখে দিয়েছে৷’
এতক্ষণে নিজের ওয়াকিতে কিছু একটা নির্দেশ পাঠিয়েছিল সেরান, তার পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমি নিজেই ঢুকে এলাম মমির ঘরে৷ এখনও কাচের বাক্সের ভিতরে একইভাবে শুয়ে আছে তারা৷ ঠিক মাতৃগর্ভে বড় হতে থাকা ভ্রূণের মতো৷ জন্মলাভের প্রতীক্ষায়৷
তাদের সামনে ধীরে-ধীরে এগিয়ে যাই আমি, সেরান নিজে থেকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না, রডরিগেজের সঙ্গে কিছু একটা আলোচনা করে নেয় চাপা স্বরে৷ আমি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, ‘ইয়ুয়িয়াকোর ইনকারা বুঝতে পেরেছিল তাদের সাম্রাজ্য এবং সেই সঙ্গে ধর্মও আর বেশিদিন টিকবে না৷ ক্রিশ্চিয়ানিটি এসে গ্রাস করে ফেলবে ওদের সব দেবতাকে৷ ইনাকারা জ্যোতিষে বিশ্বাস করত৷ ওরা হিসেব করে দেখে ইতিহাসের ঘড়িতে আবার কোন সময়ে জেগে উঠতে পারে ইনকা সভ্যতা৷ সেই সময়ের জন্যে তিনটে শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, কয়েকশো বছরের ঘুম…’
‘কিন্তু কেন? কয়েকশো বছর পরে তারা জেগে উঠলে লাভ কী?’ এবার প্রথম প্রশ্ন করে সেরান৷
‘টু রিপপুলেট, টু গ্রো…’ আমি তার দিকে ফিরে বললাম, ‘জেগে উঠে আবার ইনকা সভ্যতা আর তার ধর্মনীতিকে প্রচার করবে ওরা৷ ওদের সন্তানেরা… দে আর স্লিপিং মেসিহা…’
কথাগুলো মাথার ভিতরে গেঁথে নিতে একটু সময় লাগল সেরানের, সেটা হবার আগেই সে পরের প্রশ্নটা করল, ‘কিন্তু তাও আমাদের প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে৷ রিপপুলেটই যদি করার থাকে তাহলে এল নিনিওকে হত্যা করা হল কেন?’
‘ডোন্ট ইউ সি? এল নিনিওকে অন্য কেউ হত্যা করেনি, করেছে তার দুই মৃত্যুসঙ্গিনী, লা ডনসিয়া আর নিনিয়া ডেল রায়ো… দু-জনে শক্ত হাতে দড়ি জড়িয়ে ওই ঘরের ভিতরেই খুন করে সাত বছরের ছেলেটিকে৷ তার মুখ দিয়ে রক্ত আর বমি বেরিয়ে আসে…’
‘কিন্তু কেন?’
‘লা ডনসিয়ার মাথায় সাদা চুল সাক্ষ্য দেয় সে মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন কোনও কারণে দুশ্চিন্তায় ছিল৷ দশ বছর বয়স থেকে সে জানত কোনও একদিন কয়েকশো বছরের জন্যে শীতঘুমে পাঠানো হবে তাকে এবং তার হাফ সিস্টারকে৷ কিন্তু কয়েকশো কেন, কয়েক লক্ষ বছর পরেও জেগে উঠতে চায়নি সে… সে শুধু এল নিনিওকে তার দেড় ফুট ঘরের ভিতরেই শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করতে চেয়েছিল৷
পেটে খাবার ছিল না বলে তার এবং দেল রায়োর শরীরে কোকা কাজ করেনি৷ রায়ো সম্ভবত কোনও কারণে ছটফট করায় তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়৷ পাথরের ঘরে বন্দি হবার পরেই চোখ মেলে তাকায় লা ডনসিয়া, রায়োর শরীরকে বন্ধনমুক্ত করে সে, তারপর দুই বোনে সেই দড়ির ফাঁস পরিয়ে দেয় এল নিনিওর শরীরে, দু-জন দু-দিক থেকে সেই ফাঁসে জড়িয়েই শ্বাসরুদ্ধ করে মারে নিনিওকে…’
‘কিন্তু কেন? কী চাইছিল সে?’
লা ডনসিয়ার বাক্সটার কাছে এগিয়ে আসি আমি, তার বন্ধ হয়ে থাকা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকি, ‘যে ধর্ম মানুষকে বর্বরতা শেখায়, নিষ্পাপ শিশুদের বলিদান চায়, যে ধর্মের অনুসরণকারীরা অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের মোহে জড়িয়ে হাজার-হাজার শিশুকে হত্যা করে, মা-বাবা নিজের সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে ফেলে, সেই ধর্ম, সেই দেবতা আরেকবার জেগে উঠুক তা সে চায়নি… এল নিনিওকে মেরে ফেললে ইনকা সভ্যতার অন্তিম রক্তবিন্দুটাও শেষ হয়ে যাবে… তাদের রক্তলোভী দেবতা চিরকালের মতো বিদায় নেবে পৃথিবীর বুক থেকে… আজ থেকে পাঁচশো বছর আগের এই অশিক্ষিত দুই কিশোরী এইটুকু লুকানো ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে গেছিল মৃত্যুর দিকে৷’
কিছুক্ষণ ঘরের ভিতরের চাপা নিস্তব্ধতা ঘন হতে লাগল৷ রডরিগেজের ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি৷ ঘরের এককোণে একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসে পড়েছে সেরান৷ কয়েক মিনিট পরে প্রথম কথা ফুটল তার গলায়, ‘তার মানে ওদের যে তরলটা খাওয়ানো হয়…’
‘আমার পক্ষে বলা সম্ভব না; হতে পারে ওটা কিছুই না৷ ওদের হাজারটা কুসংস্কারের মধ্যে আরেকটা৷ কয়েকটা প্রাণীর রক্ত মিশিয়ে মন্ত্রতন্ত্র করে তৈরি করেছিল৷ ভেবেছিল ওই এলিক্সির অফ লাইফই কয়েক যুগ পরে ওদের জাগিয়ে তুলবে, তবে দুই বোন বিশ্বাস করেছিল সেটা৷ তারা ঈশ্বরকে, তাদের ধর্মকে অবিশ্বাস করত না, শুধু সেই নৃশংস ঈশ্বরের কফিনে পেরেক মারার সাহসটা ছিল তাদের৷’
আমার দুই সঙ্গী চুপ করে যায়৷ ভিতরের কোনও ঘর থেকে টেলিফোন বাজার আওয়াজ ভেসে আসে৷ ঘরের বাইরে অন্ধকার আরেকটু ঘন হয়ে আসতে থাকে৷ রাত বেড়ে উঠছে৷
ঘরে উপস্থিত দু-জনের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আমি উঠে পড়ি৷ বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার৷
‘আজ আসি, দরকার পড়লে যোগাযোগ কোরো…’
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা নাড়াল সেরান৷ তার চোখের কোলে কোলেস্টেরলের দাগ এখন আরেকটু গভীর দেখাচ্ছে৷ একদৃষ্টে মাটির দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে কিছু ভেবে চলেছে সে৷
হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়েই যাচ্ছিলাম ঘর থেকে৷ কী মনে হতে পিছন ঘুরে আবার ফিরে এলাম কাচের বাক্সের ভিতরে রাখা দুই বোনের মমির কাছে৷ খয়েরি টিউনিকের কাপড় জড়িয়ে ঠিক যেন অঘোরে ঘুমিয়ে চলেছে দুই বোন৷ হয়তো আর কোনওদিন ভাঙবে না ওদের ঘুম, হয়তো ভাঙবে, কে বলতে পারে?
তবে এই অন্ধকারে ভরা ঘরের ভিতর এখন শুধু ওদের মুখ দুটোর উপরেই সাদা আলো এসে পড়েছে৷ অন্ধকার ঘুচে গেছে সেখানে…