ইয়ারগোর সেই লোকটা

ইয়ারগোর সেই লোকটা

লোকটাকে প্রথম দেখি প্লেনের ভেতর। হংকং থেকে সোল যাওয়ার সময়। মাথার মেক্সিকান টুপি, পরনে ঢিলেঢালা পোশাক। মুখটা মঙ্গোলীয়। আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা মিটিমিটি হাসছিল।

তিন—চারদিন পরেই ওলিম্পিক গেমস শুরু সোলে। ক্যাথে প্যাসিফিকের ওই ফ্লাইটে ভারতের কিছু অ্যাথলিটও যাচ্ছেন ওলিম্পিকে অংশ নিতে। ওঁরা বসে আছেন পেছনের দিকে। অর্থাৎ ইকনমি ক্লাসে। আমি রয়েছি এগজিকিউটিভ ক্লাসের আসনে। মাঝে ভারী পরদা টাঙানো। এগজিকিউটিভ ক্লাসে খুব বেশি লোক নেই। আট—দশজন ছড়িয়ে—ছিটিয়ে বসে। চার—সাড়ে চার ঘণ্টার ফ্লাইট। যাত্রীরা অনেকেই জিরিয়ে নিচ্ছেন আলো নিভিয়ে।

ঘুম—ঘুম পাচ্ছিল। হাতঘড়িতে দেখলাম সকাল প্রায় আটটা। তার মানে কলকাতায় এখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। কলকাতার সঙ্গে হংকংয়ের সময়ের পার্থক্য আড়াই ঘণ্টার। ঘড়িতে আর সময়টা বদলানো হয়নি। ভেবেই রেখেছিলাম, সোলে পৌঁছে একেবারে সময় পালটে নেব। দিন কুড়ি থাকতে হবে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীতে। দু’বছর আগে অবশ্য একবার সোলে গিয়েছিলাম। এশিয়ান গেমসের সময়।

জানলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঝলমলে আকাশ। নীচে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ। একটু আগে পাইলট জানিয়ে দিয়েছেন, ছত্রিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে আমরা উড়ছি। চার—সাড়ে চার ঘণ্টা প্লেনের ভেতর বসে থাকা খুব কষ্টকর। ভাবলাম, একটু ঘুমিয়ে নিই।

চোখটা সবে বুজেছি। হঠাৎ শুনি, ”এই কালকেতু, তুমি এখানে? এয়ারপোর্টে তো দেখলাম না!”

চোখ খুলেই দেখি ও এম নাম্বিয়ার। আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন পি টি ঊষা।

বললাম, ”এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”

নাম্বিয়ার বললেন, ‘ককপিটে। ঊষি এই ফ্লাইটে যাচ্ছে শুনে পাইলট ওকে দেখতে চেয়েছেন।’

কথাটা আমাকে বলেই নাম্বিয়ার ঘুরে মলয়ালম ভাষার কী যেন বললেন ঊষাকে। ঘাড় নেড়ে বাধ্য মেয়ের মতো ঊষা এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে চলে গেলেন ককপিটের দিকে। নাম্বিয়ার বসে পড়লেন আমার পাশে।

ঊষার কোচ নাম্বিয়ারকে চিনি বিরাশির এশিয়ান গেমস থেকে। ওদের প্রথম দেখি পাতিয়ালার সাই কেন্দ্রে। আমার সঙ্গে খুব হৃদ্যতা দু’জনের। সোল এশিয়ান গেমসের পর নাম্বিয়ারের সঙ্গে কী একটা ব্যাপার নিয়ে যেন মনোমালিন্য হয়েছিল ঊষার। কালিকটের ‘মলয়ালম মনোরমা’ কাগজের এক রিপোর্টার আমাকে গল্প করেছিল নেহরু কাপ ফুটবলের সময়। তারপর এই প্রথম দেখা নাম্বিয়ারের সঙ্গে। মনে—মনে ঠিক করলাম, প্রসঙ্গটা তুলব।

কিন্তু সরাসরি এই অপ্রিয় কথাগুলো তো আর তোলা যায় না। তাই কথা শুরু করলাম ঊষার ফর্ম নিয়ে। নাম্বিয়ার খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন। একবার শুরু করলে আর থামতে চান না। আমাকে বোঝাতে লাগলেন, ওলিম্পিকে ঊষা পদক পাবেনই।

কথায়—কথায় বললাম, ”ঊষা যদি মেডেল না পান, সারা দেশ কিন্তু খুব দুঃখ পাবে। বাহান্ন সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত, ওলিম্পিকের কোনো ব্যক্তিগত পদক কোনো ভারতীয় আনতে পারেননি। প্রায় ছত্রিশ বছর হয়ে গেল।’

নাম্বিয়ার অবাক হয়ে বললেন, ”তাই নাকি? কে পেয়েছিলেন ওই পদকটা?”

”কে ডি যাদব। হেলসিঙ্কি ওলিম্পিকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় উনি ব্রোঞ্জ পান। ওটাই শেষ ব্যক্তিগত পদক।”

”ছি ছি…কী অবস্থা আমাদের!”

”ওলিম্পিকে গিয়ে আমাদের খুব খারাপ লাগে, জানেন। সবসময় আমাদের লিখতে হয় এডুইন মোজেস, ফ্লেরেন্স গ্রিফিথ জয়নার, কার্ল লুইস আর সের্গেই বুবকাদের নিয়ে। আমাদের কোনও তারকা নেই। এক আছেন ঊষা। যদি মেডেল পান, তা হলে লেখার খোরাক কিছু পাওয়া যাবে।’

”এবার পাবে। লস অ্যাঞ্জেলিস ওলিম্পিকেই হয়ে যেত। আমারই ভুলে ঊষি হার্ডলসের মেডেলটা পেল না।”

এর কিছুক্ষণ পরই কথা তুললাম। ঊষার সঙ্গে ঝামেলার কথাটা। নাম্বিয়ার বললেন, ”দ্যাখো কালকেতু, তোমার কাছে গোপন করার কিছু নেই। ঊষার মাথা খাচ্ছে ওর চারপাশের কিছু লোক। এখন টাকা—পয়সা পেয়েছে। ওর চারপাশে ভিড় বাড়বেই।”

”এরা কারা?”

”ওলিম্পিক হয়ে যাক, বলব। তবে একটা কথা, তুমি কিন্তু কিছু লিখতে পারবে না।”

নাম্বিয়ার কথাটা শেষ করতেই দেখি ককপিট থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে আসছেন ঊষা। ওঁকে দেখে নাম্বিয়ার উঠে পড়লেন। ”চলি, কাল থেকে ভিলেজের মাঠে প্র্যাকটিস করাব। পারলে এসো। ওই অবধি তোমাকে কেউ আটকাবে না।”

নাম্বিয়ার আর ঊষা চলে যাওয়ার পরই সেই অদ্ভুত লোকটার দিকে প্রথম চোখ পড়েছিল। লোকটা মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। শুনছিল না বলে আমাদের কথা গিলছিল বলা ভাল। চোখাচুখি হতে লোকটা মিটিমিটি হাসল।

হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান…এই অঞ্চলের লোকেরা মোটামুটি একই রকম দেখতে। আলাদা করে চিনতে অসুবিধে হয়। লোকটা হাসল বলেই একটু অবাক লাগল। সোল যাচ্ছে যখন, নিশ্চয়ই ওলিম্পিক সংক্রান্ত কোনো কাজে। খেলোয়াড় নয়। আমাদের মতো রিপোর্টার হতে পারে। অথবা খেলার কর্মকর্তা। এমনও হতে পারে, ওলিম্পিক গেমস দেখার জন্য যাচ্ছে।

মরুকগে যাক। আমার কী এসে—যায়। সিটটা একটু পেছনদিকে হেলিয়ে, আরাম করে গা—টা এলিয়ে দিলাম। একটু ঘুমিয়ে নিলে ভাল হয়। সোল পৌঁছবার পর আর বিশ্রাম নেওয়ার উপায় থাকবে না। টানা পনেরো—ষোলোটা দিন খাটতে হবে। দিনে সতেরো—আঠারো ঘণ্টা। ওলিম্পিক গেমস হচ্ছে খেলার সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। তা দেখার সুযোগ জীবনে কমই আসে।

চোখ বুজেও রেহাই নেই। লোকটার মুখটা ভেসে উঠল। হঠাৎই মনে হল, এশিয়ার এই অঞ্চলের লোকেরা তো এইরকম ঢিলেঢালা পোশাক পরে না। অথবা মেক্সিকান টুপি? অদ্ভুত তো। চোখ খুলে দেখি, ডান দিকের কোণে লোকটা যেখানে বসে ছিল, সেই সিটে কেউ নেই।

বোধ হয় টয়লেটে গেছে। অথবা অন্য কোনও ফাঁকা সিটে গিয়ে বসে আছে। ভেবে ফের চোখ বুজলাম। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় সেই বেটিংয়ের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার পর মোহন চন্দ্রকুমার ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে বাদ চলে গেছে। মোহন হংকংয়ের ছেলে। ও আর যদি জানত, আমি হংকংয়ে এক রাত্তির কাটিয়েছি, তা হলে আমাকে আর আস্ত রাখত না।

”…সার ‘ভেজ’, না ‘নন ভেজ’?”

চোখ খুলে দেখি, এয়ার হোস্টেস মেয়েটি খাবারের ট্রলি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ব্রেকফাস্ট দেবেন। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে। হাসি মুখে উত্তরের প্রতীক্ষায়। সকালে নন ভেজ খাওয়ার মোটেই ইচ্ছে নেই। তাই ভেজ খাবারের কথাই বললাম।

নামী এয়ারলাইনারগুলি অনেক সময় চমৎকার সব উপহার দেয় যাত্রীদের। এশিয়ান গেমসের সময় ‘ক্যাথে প্যাসিফিক’—এর ফ্লাইটে ছোট্ট—ছোট্ট অনেক জিনিস দিয়েছিল। তাসের প্যাকেট, চাবির রিং, কাপড়ের চশমা। একবার ভাবলাম, মেয়েটার কাছ থেকে চেয়ে নিই। পরক্ষণেই মনে হল, নাঃ, হ্যাংলামি হয়ে যাবে।

এয়ার হোস্টেস খাবার দিয়ে যাওয়ার পরই ফের চোখে পড়ল সেই অদ্ভুত লোকটার দিকে। এক্কেবারে আমার বাঁ দিকের সামনের সিটে বসে রয়েছে। পরনে নীল ব্লেজারের মতো কোট, সাদা জামা আর ট্রাউজার্স। নীল রঙের টাই। একটু আগে নাম্বিয়ার ঠিক ওই একই পোশাকে গল্প করে গেছেন আমার সঙ্গে। ভারতীয় দল এবার ওলিম্পিকের মার্চ পাস্টে ওই পোশাকেই অংশ নেবে। তা হলে কি লোকটা ইন্ডিয়া টিমের সঙ্গে যাচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারলাম না।

লোকটা মুখ ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখল। মুখ টিপে হেসে ফের জানলার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাকে চেনে? এমনও হতে পারে, কোনও জায়গায় হয়তো আলাপ হয়েছিল। কোনও খেলার আসরে। হয়তো আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু সেটাই বা বলি কী করে? একবার যার সঙ্গে আমার আলাপ হয়, তাকে কখনও আমি ভুলি না। রিপোর্টারদের ভুললে চলে না।

এয়ার হোস্টেস খাবার দিতে—দিতে বাঁ দিকে গেছেন ট্রলিটা নিয়ে। একটা ব্যাপার দেখে অবাক লাগল, ওই অদ্ভুত লোকটার পাশ দিয়ে মেয়েটি চলে গেলেন, একবার জিজ্ঞেসও করলেন না, খাবার দেবেন কি না। কেন জানি না, মনে হল, মেয়েটি দেখতে পাননি লোকটাকে।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে, একবার ভাবলাম, যাই পেছনের দিকে ঘুরে আসি। ইন্ডিয়ান টিমের অনেকেই রয়েছে। গল্পগুজবে কিছুটা সময় অন্তত কেটে যাবে। ঘণ্টাখানেক একভাবে বসে আছি। পায়ে জং ধরে গেছে। কলকাতায় এই সময়টায় রোজ ‘সাউথ ক্লাব’—এ গিয়ে টেনিস খেলি।

উঠব—উঠব করছি, এসে হাজির রুদ্রাংশু সেন। দৈনিক বাংলা কাগজের রিপোর্টার। এবারই প্রথম ওলিম্পিক কভার করতে যাচ্ছে। বলল, ”মিস্টার নাম্বিয়ারের সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দেবেন কালকেতুদা। আপনার সঙ্গে নাকি দারুণ সম্পর্ক?”

রুদ্রাংশুর পরনে চোস্ত আর হালকা নীল পাঞ্জাবি। ছেলেটা খুব শৌখিন। বেশ ভাল লাগছে ওকে দেখতে। বললাম, ”তুই কি কোনও জলসায় যাচ্ছিস?”

”কেন কালকেতুদা?”

”না রে, এমনিই বললাম। নাম্বিয়ারের সঙ্গে নিজে গিয়ে কথা বল না! লোকটা খুব মিশুকে।”

”গিয়েছিলাম। পাত্তাই দিল না।”

”ঠিক আছে, আলাপ করিয়ে দেব। তুই কি সোলে প্রেস ভিলেজে থাকবি?”

”না গো। অত টাকা খরচ করতে পারব না। বাইরে সস্তার কোনও হোটেলে থাকতে হবে আমাকে।”

”শোন, দিল্লি থেকে মোহন পিচোরতি বলে একটা ছেলে আসছে। ‘দিল্লি টুডে’ কাগজের। ও একজন রুম পার্টনার চাইছে। যদি দু’জনে একটা ডাবল রুম ভাড়া নিয়ে থাকিস, খরচ কম পড়বে।”

”আমার কোনও অসুবিধে নেই। ছেলেটা কবে পৌঁছবে?”

”পরের ফ্লাইটেই।”

রুদ্রাংশু আইলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। যাতায়াতে অসুবিধে হচ্ছে এয়ার হোস্টেস সেই মেয়েটির। বারবার ‘এক্সিউজ মি’ বলছেন। মেয়েটির দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ রুদ্রাংশু বলল, ”কালকেতুদা, এই মেয়েটাকে ঠিক বাঙালিদের মতো দেখতে, তাই না?”

কথাটা শুনে মেয়েটি একবার ঘুরে তাকালেন। তারপর নিজের মনে কাজ করতে লাগলেন। রুদ্রাংশুকে বললাম, ”এই কথাটা না বললেও পারতিস।”

লজ্জা পেয়ে রুদ্রাংশু বলল, ”না কালকেতুদা, বাংলা বুঝতে পারেনি।”

আরো তিন—চার মিনিট কথা বলে রুদ্রাংশু চলে গেল পেছনের দিকে। ঘুমটা চটকে দিয়ে গেল। সিটের সামনে খবরের কাগজ পড়ে আছে। একটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বেন জনসন আর কার্ল লুইসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে চমৎকার একটা লেখা বেরিয়েছে। মন দিয়ে সেই লেখাটা পড়তে শুরু করলাম। লিখেছেন গ্যারি স্মিথ বলে একজন আমেরিকান। সত্যিই ওঁরা লিখতে পারেন বটে। মনে—মনে ঠিক করলাম, সোলে এবারই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

”ওলিম্পিকে যাচ্ছেন বুঝি?”

কানের পাশে কথাটা শুনে মুখ ঘোরালাম। সেই অদ্ভুত লোকটা। আমার ডান পাশের সিটে এসে বসেছে। পরনে সেই নীল ব্লেজারটা আর নেই। বদলে হালকা নীল পাঞ্জাবি। লোকটা ম্যাজিক জানে নাকি? ঘন—ঘন পোশাক বদলাচ্ছে। ঠিক ওই রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেই তো একটু আগে রুদ্রাংশু আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

লোকটা মিটিমিটি হাসছে। বিস্ময়ের ভাবটা চেপে রেখে বললাম, ”হ্যাঁ।”

লোকটা প্রশ্ন করলে, ”আপনি কোন জায়গা থেকে আসছেন?”

ভারত বললে বুঝবে না। বললাম, ”ইন্ডিয়া।”

”ওহ আপনি ইন্দো। আপনাদের ইন্দোনেশিয়ারই একজনের সঙ্গে দু’দিন আগে আলাপ হল মেক্সিকোয়। লোকটা আমাকে একটা টুপি উপহার দিয়েছিল।”

ইন্ডিয়া আর ইন্দোনেশিয়া যে এক দেশ নয়, ভাবলাম সেটা বলি। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার এই দিকটায় লোকে ভারতীয়দের বলে ইন্দো। গতবার সোলে গিয়ে সেটা জেনেছি। কিন্তু ওই অদ্ভুত আর পাগলাটে লোকটাকে, যে ইন্ডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার পার্থক্য জানে না, তাকে অত কিছু বোঝাতে যাওয়া অর্থহীন। লোকটা বোধ হয় লাতিন আমেরিকার দিকে থাকে। না, তাই বা বলব কেন? লাতিন আমেরিকার লোকেরা আবার খুব কম ইংরেজি বলে।

”তোমাদের ইন্দো, অনেকদিন ওলিম্পিকের মেডেল পায়নি, তাই না?”

”হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন?”

”তুমিই তো একটু আগে দুঃখ করছিলে।”

”হ্যাঁ।”

লোকটা কী যেন ভাবল মনে—মনে। তারপর বলল, ”এবার যদি একটা মেডেল পাও, খুশি হবে?”

”নিশ্চয়ই। সারা দেশ আনন্দ পাবে। মেডেলটা যে পাবে, সারা দেশ তাকে মাথায় করে নাচবে।”

”তাই বুঝি!” লোকটা এমনভাবে কথাটা বলল, যেন ইচ্ছে করলেই ভারতকে একটা মেডেল দিতে পারে। এই পাগলা লোকের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। তাই কাগজটা ফের চোখের সামনে মেলে ধরলাম। পড়তে—পড়তে ঘুম এসে গেল।

ঘুম যখন ভাঙল, প্লেনটা তখন সোলের বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে। লোকজন সব নামতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি ওপরের বাঙ্ক থেকে হ্যান্ডব্যাগটা নামিয়ে, দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি হ্যাঙারের মুখে সেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটি দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি। আমার দিকে ছোট্ট একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। বোধ হয় কোনো উপহার হবে।

”থ্যাঙ্ক ইউ।”

বলতেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ”থ্যাঙ্ক ইউ না বলে, বলুন ধন্যবাদ।”

ওঁকে বাংলায় কথা বলতে শুনে এমন চমকে উঠলাম যে, হাত থেকে প্যাকেটটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল।

এয়ার হোস্টেস মেয়েটি বললেন, ”আমি শিলচরের মেয়ে। বাঙালি। বছরদুয়েক হল, ক্যাথে প্যাসিফিকে চাকরি করছি। আমার শুভেচ্ছা নেবেন। ওলিম্পিক থেকে আপনারা অবশ্যই একটা মেডেল নিয়ে ফিরবেন।” বলেই তিনি ককপিটে ঢুকে গেলেন।

।।২।।

ওলিম্পিক ‘কভার’ করতে গিয়ে সোলে অদ্ভুত—অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি আমি। ভাল—ভাল খবর পেয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোনো কিছু ঘটার আগে, কে যেন আমাকে ঠেলে সেখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

প্রমাণ দিতে পারব না। কিন্তু অনুভব করছি। এটা বুঝতে পারি, সোল শহরে পৌঁছবার পরদিনই। বিকেলের দিকে ভিলেজের প্র্যাকটিস স্টেডিয়ামে গিয়েছি ঊষা আর নাম্বিয়ারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। দেখি ওঁরা নেই। অন্য দেশের বহু নামী অ্যাথলিট প্র্যাকটিস করছেন। গ্যালারিতে বসে ফ্লো জো—কে দেখতে পেলাম। মানে, ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারকে। ওঁর স্বামী আল জয়নার প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য অবশ্য ওঁদের কাছে যাওয়া যাবে না।

হঠাৎ মনের ভেতর কে যেন বলল, কালকেতু বসে থেকো না। স্টেডিয়ামে এক চক্কর মেরে দ্যাখো, বড় খবর পেলেও পেতে পারো। কে যেন ঠেলে দিল আমাকে। হাঁটতে লাগলাম। ঠিক উলটো দিকে যেতেই দেখি, কাঠের লম্বা একটা বেঞ্চিতে একজন কালো অ্যাথলিট শুয়ে আছেন। তাঁর পা ‘ম্যাসাজ’ করছেন আর—একজন। মুখটা ভীষণ চেনা। চট করে মনে পড়ল, আরে… বেন জনসন! আমার মাত্র দু’ হাত দূরে?

এই সুযোগ ছাড়া যায় না। ইন্টারভিউ নিতেই হবে। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবাক হয়ে জনসনকে দেখছি। ঊরু দুটো যেন তালগাছের গুঁড়ি। সারা শরীরের পেশি ফেটে বেরোচ্ছে। ঈশ্বর যাঁকে দেন, এমনভাবেই ঢেলে দেন। যিনি ম্যাসাজ করছিলেন, ঘেমে অস্থির তিনি। ভাল করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম জনসনের কোচ চার্লি ফ্রান্সিস।

প্রায় আধঘণ্টা পর চার্লি ফ্রান্সিস ম্যাসাজ বন্ধ করলেন। তারপর পাশে রাখা সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখলেন। ভদ্রলোক লাইটার খুঁজে পাচ্ছেন না। এই সুযোগে আমি লাইটার এগিয়ে দিলাম।

ফ্রান্সিস সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ”ধন্যবাদ।”

নিজের পরিচয় দিয়ে তারপর বললাম, ”বেন জনসনের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারি?”

”বলুন। তবে কার্ল লুইস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবেন না।”

বেন জনসন গায়ে ট্র্যাকসুট চাপাচ্ছেন। সেই ফাঁকে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। তারপর ব্যাগ থেকে ছোট্ট টেপ রেকর্ডার বের করে ইন্টারভিউ শুরু করে দিলাম। আমাকে কথা বলতে দেখে চার—পাঁচজন জাপানি রিপোর্টারও কোত্থেকে জুটে গেলেন। সোলে পৌঁছবার পর থেকে বেন জনসন আর কাউকে ইন্টারভিউ দেননি। আমিই প্রথম সেই সুযোগ পেয়েছি। ওলিম্পিক ভিলেজে উনি থাকছেন না। আছেন বড় একটা হোটেলে। কোন হোটেলে, কেউ জানে না।

সেদিন উড়তে—উড়তে ফিরে এলাম প্রেস সেন্টারে। বেন—এর সেই ইন্টারভিউটা গুছিয়ে লিখলাম। রুদ্রাংশু দু—একবার জিজ্ঞেস করল, ”কী পাঠাচ্ছ কালকেতুদা?”

বললাম, ”কিচ্ছু না।” সবকিছু সবাইকে বলা যায়? আমি সত্যিই ভাগ্যবান। রিপোর্টারদের ক্ষেত্রেও লাক ফ্যাক্টরটা কাজ না করলে মুশকিল।

পরদিন আবার অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ইন্ডিয়ান টিমের সঙ্গে দু’জন ভারোত্তোলক ছিলেন। একজনের নাম সুব্রমনিয়ম। প্রেস সেন্টারে গিয়ে দুপুরবেলা থেকেই কেন জানি না, আমার মনে হতে লাগল, ভারোত্তোলকদের খোঁজ নিলে কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে। সাধারণত, রিপোর্টারদের নজর থাকে হকি, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার—এইসব বড়—বড় খেলার দিকে। ছোট খেলায় কেউ যায়ই না।

প্রেস সেন্টারে বসে থাকার সময় মনের ভেতর কে যেন ঠেলতে লাগল, কালকেতু বসে থেকো না। ওয়েট লিফটিং হল বেশি দূরে নয়। বাসে যেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগবে না। এখনই চলে যাও।

শেষ পর্যন্ত উঠে পড়লাম। প্রেস সেন্টারের পাশেই দাঁড়িয়ে প্রচুর লাক্সারি বাস। বিভিন্ন খেলার কেন্দ্রে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। ‘ওয়েট লিফটিং’ লেখা বাসটাতে উঠে দেখা হয়ে গেল সুরেন্দ্র সিংহ—এর সঙ্গে। দু’জনে গল্প করতে লাগলাম। সুরেন্দ্র সিংহ ভারোত্তোলনের কোচ। কিন্তু সরকার পাঠিয়েছেন পর্যবেক্ষক হিসেবে। ফিরে গিয়ে সরকারের কাছে রিপোর্ট দেবেন ভারোত্তোলকদের পারফরম্যান্স সম্পর্কে।

কথায়—কথায় হঠাৎ তিনি বললেন, ”সুব্রমনিয়মের কীর্তির কথা শুনেছেন মিঃ নন্দী?”

বললাম, ”না তো। কী হয়েছে?”

”এত টাকা খরচ করে ওকে এখানে পাঠানো হল। অথচ নামতেই পারল না।”

”কেন?”

”এখানে আসার পর এত খেয়েছে যে, শরীরের ওজন পাঁচ কেজি বাড়িয়ে ফেলেছে। যে—ওজনের গ্রুপে ওর নামার কথা ছিল, নামতে পারছে না।”

”তাই নাকি? ছেলেটা এখন কোথায়?”

”শ্যেফ দ্য মিশন আজই ছেলেটাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছেন। খবরটা কেউ জানেন না। আপনার ‘স্কুপ’ হয়ে যাবে।”

সেদিনই খবরটা করে দিলাম। রুদ্রাংশু এসে পরদিন কাঁদো—কাঁদো মুখে বলল, ”কালকেতুদা, তুমি তো আমার চাকরি খাওয়ার ব্যবস্থা করছ। রোজ—রোজ এমন সব খবর পাঠাচ্ছ, আমার অফিস তো আমার ওপর প্রচণ্ড রেগে রয়েছে।”

শুনে মনে মনে হাসলাম। ওলিম্পিক গেমস ইয়ার্কি মারার জায়গা নয়, অথবা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ানোর। এক মুহূর্তের শিথিলতার জন্য অনেক বড়ো খবর মিস হয়ে যেতে পারে।

রোজ সন্ধেবেলার দিকে ভারতীয় দলের শেফ দ্য মিশন কে পি সিংহ দেও একবার করে প্রেস সেন্টারে আসেন। ভারতীয় দলের সব খবর দিয়ে যান। মাঝে—মধ্যে ভারতীয় খাবারও খাইয়ে যাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু দিচ্ছেন রোজ রোজ ব্যর্থতার খবর। কেউ প্রথম রাউন্ডেই হেরে গেছেন। কেউ ওয়াকওভার পেয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে। সাত—আটদিন পর এমন একটা অবস্থা হল, হকি, কুস্তি আর তিরন্দাজি ছাড়া ভারতীয়রা আর কোনো খেলায় টিকে নেই। এমনকী, পি টি ঊষাও চরম ব্যর্থ। তারপর থেকে নাম্বিয়ারকে চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছি না।

একদিন পুসান থেকে ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচ দেখে ফিরছি। সোল থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ওই শহর। সময় বাঁচানোর জন্য ওলিম্পিক কমিটির লাক্সারি বাসে না উঠে ট্যাক্সি নিয়েছি। হাইওয়ে দিয়ে হু—হু করে ট্যাক্সি ছুটছে। হঠাৎ নজরে পড়ল, ট্যাক্সির ভেতর ছোট্ট টিভি সেট—এ মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলা চলছে। দক্ষিণ কোরিয়া বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের। ড্রাইভার মন দিয়ে খেলা দেখছেন। মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। সর্বনাশ! যে—কোনও মুহূর্তে অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে।

”ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে আছি। শেষ পর্যন্ত খেলাটা শেষ হল। সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে হ্যান্ডবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল দক্ষিণ কোরিয়া। আনন্দে ট্যাক্সি ড্রাইভার গান গাইতে শুরু করলেন। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললেন, ”হেই মিস্টার, ইউ ইন্দো?”

বললাম, ”ইয়েস।”

”ইন্দো, নো মেডেল?”

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললাম, ”নো মেডেল।”

”কোরিয়া গোল্ড। হ্যান্ডবল। আই ভেরি হ্যাপি।”

সত্যি বলতে কী, আমার চোখে প্রায় জল এসে গেল। এই কথাগুলো বলার সুযোগ আমরা কবে পাব? এমনভাবে আনন্দ করার সুযোগ? ভদ্রতা করে বললাম, ”কোরিয়া ভেরি গুড।”

একটু পরেই সোলের প্রেস সেন্টার এসে গেল। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া দিতে গেলাম। ড্রাইভার আঁতকে উঠে বললেন, ”নো মানি। নো মানি। কোরিয়া গোল্ড। আই ভেরি হ্যাপি।”

ওলিম্পিকে আমাদের দেশ কোনো কিছুই পায় না। অন্য দেশের রিপোটারদের কাছেও আমরা তাই ওজন পাই না। মাঝে একদিন প্রেস সেন্টারে ফ্যাক্স মেশিনে খবর পাঠাবার সময় কথা হচ্ছিল পাশে দাঁড়ানো একজন আমেরিকান সাংবাদিকের সঙ্গে। ছেলেটা আমারই বয়সী। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল পি টি ঊষার কথা। কেমন ফর্মে ঊষা আছেন। লস অ্যাঞ্জেলিস ওলিম্পিকের পর সময় কমাতে পেরেছেন কি না, ইত্যাদি। হঠাৎ মেশিনে খবর পাঠাতে এলেন কেনিয়ার এক সাংবাদিক। ব্যস, অমনই আমার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ চলে গেল আমেরিকার সেই ছেলেটির। কেনিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। কেনিয়া প্রচুর বিশ্বমানের অ্যাথলিট উপহার দিয়েছে। তাঁরা কেউ—কেউ সোলে সোনাও জিতবেন। তাঁদের অ্যাথলিটদের সম্পর্কে আমেরিকার খবরের কাগজগুলোর উৎসাহ তো থাকবেই। আমাদের সেরকম কে আছেন? এক ঊষা।

সোলে দিন সাতেকের পর থেকে খানিকটা লজ্জাই পেতে শুরু করলাম। ফ্যাক্স মেশিনে খবর পাঠাবার সময় যেসব কোরিয়ান মেয়ে আমাদের সাহায্য করত, তারা রোজই জিজ্ঞেস করত, ”নান্দি, তুদে এনি মেদেল?”

বলতাম, ”নো মেদেল।”

মেয়েরা বলত, ”ওহ, তুমরো দেফিনিত।”

অর্থাৎ কালকে নিশ্চয়ই পদক পাবে। ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিটা তিরের মতো এসে বিঁধত বুকে। কিন্তু কী করে বলি, এক হকি টিম ছাড়া মেডেল আনার মতো কেউ নেই।

প্রেস সেন্টারে যেখানে রোজ আমি বসতাম, তার ঠিক উলটো দিকে বসত কানাডার দুই সাংবাদিক। তাদের মধ্যে একজন আবার ক্যান্টনের লোক—লি মিং। কানাডার ভিক্টোরিয়া শহরের এক রেডিও কোম্পানির রিপোর্টার। রোজই দেখা হত কিছু সময়ের জন্য। রাতের দিকে। ভারতের সঙ্গে সোলের সময়ের পার্থক্য সাড়ে চার ঘণ্টার। কিন্তু কানাডার সঙ্গে বারো—সাড়ে বারো ঘণ্টার। সোলে যখন রাত একটা, সেই সময় কলকাতায় রাত সাড়ে আটটা। আর ভিক্টোরিয়ায় বেলা সাড়ে বারোটা।

লি আর তার সতীর্থ রিপোর্টার প্রেস সেন্টারে ঢুকত রাত এগারোটার সময়। আমরা ভারতীয় সাংবাদিকরা প্রেস সেন্টার থেকে বেরোতাম ওখানকার রাত আড়াইটার সময়। প্রেস ভিলেজে ফিরে ঘণ্টাপাঁচেক ঘুমিয়ে পরদিন সকাল আটটা—সাড়ে আটটার সময় বেরিয়ে পড়তাম। সারাদিন ঘোরাঘুরিতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ঘুম কম হত বলে, রাতের দিকে কোনো কোনো দিন চোখ ঢুলে আসত প্রেস সেন্টারে।

এমনই একটা ব্যস্ততার দিনে, রাত আটটার সময় হঠাৎ প্রেস সেন্টারে নজরে পড়ল, প্লেনে দেখা সেই অদ্ভুত লোকটাকে। কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে বসল। তারপর বলল, ”কেমন আছ?”

লোকটার পরনে রঙিন পোশাক। মাথায় একটা রঙিন ফেজ। এই পোশাক নাইজিরিয়া, কেনিয়ার রিপোর্টারদের গায়ে মাঝে—মাঝে দেখি। সেই সময় আমি রিপোর্ট লিখছি। কথা বলার ইচ্ছে নেই। তবু ভদ্রতা করে বললাম, ”ভাল।”

”না, না। তুমি মোটেই ভাল নেই। ইন্দোনেশিয়া একটাও মেডেল পায়নি। তুমি এখন লোকের সঙ্গে কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছ। কী, ঠিক কি না?’

লোকটা থট রিডিং জানে নাকি? একটু অবাকই হলাম। কোত্থেকে লোকটা এসেছে, কে জানে? সেদিনও ইন্ডিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছিল। ফেলুক, আমার কী এসে যায়। লোকটাকে কাটাবার জন্যই বললাম, ”তুমি ঠিকই বলেছ।”

লোকটা এর পরই বলল, ”সেদিন প্লেনের ভেতর আমি একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার পাশ থেকে উঠে যাওয়ার পর। তুমি কি সেটা কুড়িয়ে পেয়েছ?”

মনে পড়ল। সত্যিই তো, কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। চৌকো পাথরের মতো একটা জিনিস। পাশের সিটে সেটা পড়ে ছিল। কুড়িয়ে সেটা তখন হ্যান্ডব্যাগে ভরে রাখি। তাড়াতাড়ি সেটা বের করে দিলাম, ”এই নাও তোমার জিনিস।”

লোকটা জিনিসটা পকেটে চালান করে দিল। আমাদের সামনে বিরাট একটা বোর্ড। তাতে লেখা, কোন দেশ ক’টা পদক পেয়েছে। ইন্দো মানে ইন্ডিয়ার পাশে তিনটে শূন্য। সোনা—রুপো—ব্রোঞ্জ কোনো পদকই পায়নি। অদ্ভুত লোকটা একদৃষ্টিতে পদক—তালিকার দিকে তাকিয়ে আছে। লেখায় ব্যস্ত আমি। লেখা শেষ করে উঠতেই দেখি, লোকটা নেই। কখন চলে গিয়েছে টেরও পাইনি।

ফ্যাক্স সেন্টারে গিয়ে রিপোর্টটা কলকাতায় পাঠাতে সময় লেগে গেল ঘণ্টাখানেক। তারপর প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেল। নীচে বেসমেন্ট—এ খাবারের প্রচুর দোকান। কিন্তু আমাদের রসনা তৃপ্ত করার মতো কিছু নেই। একদিন অক্টোপাস খাচ্ছি, তো অন্যদিন শুধু সেদ্ধ ডিম। সোল শহরে মাত্র একটাই ভারতীয় রেস্তরাঁ। অনেক দূরে। রোজ—রোজ সেখানে গেলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যায়। শেফ দ্য মিশন কে পি সিংহ দেও এক প্যাকেট গাঁঠিয়া আর ডালমুট দিয়ে গিয়েছিলেন সন্ধ্যার দিকে। বসে—বসে সেটাই চিবোলাম।

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। উলটো দিকে বসে কানাডার রিপোর্টার লি মিং টেলিফোনে প্রথম বুলেটিন পাঠাচ্ছেন। ডোপ… সাসপেক্ট… বেন জনসন… ফার্স্ট রিপোর্ট… এইসব অনেক কথা বলছে। আমি এত ক্লান্ত, আমার মাথায় কিছু ঢুকছেই না। শূন্য দৃষ্টিতে লি’র দিকে তাকিয়ে রয়েছি। টেলিফোনে কথা শেষ করে লি মিং আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন। আমি ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লাম। প্রেস সেন্টারে আর থাকার দরকার নেই। রাতের দিকে আর খবর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি হয়ও, রয়টার—এপি দিয়ে দেবে।

প্রেস ভিলেজে ফিরেই চট করে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে—সঙ্গে ঘুম নেমে এল। ভোরের দিকে স্বপ্নে দেখলাম, সেই অদ্ভুত লোকটা বিছানার সামনে এসে বলছে, ”এই ওঠো। টিভি খুলে দ্যাখো, কাল রাতে ওলিম্পিকে বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে।” চোখ থেকে ঘুমটা যাচ্ছে না দেখে সেই অদ্ভুত লোকটা আমার চোখের সামনে চৌকো পাথরের মতো জিনিসটা তুলে ধরল। সঙ্গে—সঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। কই, কেউ নেই! ঘুম কেটে যেতেই মনে পড়ল, অদ্ভুত লোকটা টিভি খুলতে বলেছিল। উঠে গিয়ে চট করে টিভির সুইচ অন করলাম।

দেখি, বেন জনসনকে ঘিরে প্রচুর লোক। বেনের মা কাঁদছেন। সোল এয়ারপোর্টে বিমানে উঠছেন জনসন। ভাষ্যকার বললেন, ”বেন জনসন ডোপ করার দায়ে ধরা পড়েছেন। তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

সঙ্গে—সঙ্গে লি মিংয়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। কাল রাতে তো লোকটা ডোপিংয়ের খবরই পাঠাচ্ছিল। এত বিরাট খবরটা আমি ইচ্ছা করলে তো কলকাতার কাগজে একদিন আগেই দিতে পারতাম। যদি লি মিংকে একবার মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতাম!

নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল। ছি ছি, এত বড় স্কুপ করার সুযোগটা কেন এভাবে নষ্ট করলাম!

।।৩।।

সত্যি বলতে কী, কাজে আর তেমন উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। গেমস শেষ হতে এখনও চার দিন বাকি। আর্জেন্টিনার কাছে হেরে ভারতীয় হকি দল পদক পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট করেছে।

শেফ দ্য মিশন কে পি সিংহ দেও দু’—তিনদিন হল আর প্রেস সেন্টারে আসছেন না। ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র কুস্তিগিররা ছাড়া আর কেউ প্রতিযোগিতায় টিকে নেই।

ভিলেজ থেকে প্রেস সেন্টারের দিকে আসতে—আসতে একদিন হঠাৎ মনে হল, প্লেনে—দেখা অদ্ভুত লোকটা আমার কাছ থেকে চৌকো পাথরের মতো সেই জিনিসটা নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই উৎসাহ অনেক কমে গিয়েছে। খবরের আগাম গন্ধটা আর আগের মতো পাচ্ছি না। মনের ভেতর থেকে কেউ আর ঠেলে পাঠাচ্ছে না আমাকে।

একদিন দুপুরে অ্যাথলেটিকস স্টেডিয়ামে বসে আছি। পাশে বসে গল্প করছেন সুইডেনের এক সাংবাদিক। বিয়র্ন বর্গের কথা। বাঁ দিকে জ্যাভেলিন প্রতিযোগিতা চলছে। একটু পরে শুরু হবে পোল ভোল্ট। তাতে নামবেন সের্গেই বুবকা। আসলে বুবকা—কে দেখার জন্যই স্টেডিয়ামে গেছি। সুইডিশ সাংবাদিক আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে মাঝেমধ্যে লক্ষ রাখছেন দূরে জ্যাভেলিন প্রতিযোগিতার দিকে।

সেটা লক্ষ করেই একসময় জিজ্ঞেস করলাম, ”কী দেখছ তুমি মন দিয়ে?”

সাংবাদিক বললেন, ”জ্যাভেলিনে আমাদের একজন কম্পিটিটর আছে, মেডেল পেতে পারে।”

”তোমরা কটা মেডেল পেয়েছ এখনও পর্যন্ত?”

”এগারোটা। তোমার দেশ?”

”একটাও না।”

”সে কী! তোমাদের এত বড় দেশ, একটাও মেডেল পাওনি?”

কী উত্তর দেব! চুপ করে রইলাম।

সুইডিশ সাংবাদিক এবার বললেন, ”ইন্ডিয়া দেশটা সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানি না। তোমাদের দেশে তো টেনিস খেলাও হয়।”

বললাম, ”হ্যাঁ। তবে তেমন জনপ্রিয় খেলা নয়।”

”কোন খেলাটা সবচেয়ে জনপ্রিয়?”

”ফুটবল।”

”সে কী! তোমাদের দেশে ফুটবল খেলা হয়, জানতাম না তো।”

”প্রায় একশো বছর ধরে খেলা হচ্ছে। তোমাদের দেশ থেকে এ এফ কে গোথেনবার্গ টিমটাও একবার আমাদের দেশে গিয়ে খেলে এসেছে। একবার আমাদের দেশ ওলিম্পিকে চতুর্থ স্থানও পেয়েছে।”

”তাই নাকি? তা হলে এখন তোমাদের দেশ বিশ্বকাপে খেলে না কেন?”

”ফুটবলের মান ভালো নয়।”

”তোমাদের দেশের সেরা দু’জন স্পোর্টসম্যানের নাম বল।”

একটু ভেবে বললাম, ”সুনীল গাওস্কর আর প্রকাশ পাডুকোন। একজন ক্রিকেটার…”

”প্রকাশ পাডুকোনের নাম শুনেছি। কিন্তু গাওস্কর কে? কী ধরনের খেলা এই ক্রিকেট?”

”অনেকটা বেসবল খেলার মতো।”

”ওহ, আমাদের দেশে চল নেই।”

বাইনোকুলারে চোখ লাগালেন সুইডিশ তরুণটি। হঠাৎ সারা স্টেডিয়াম জুড়ে হাততালি। কী ব্যাপার, বুঝে ওঠার আগেই দেখি, ছেলেটা লাফিয়ে উঠে নিজের জামাটা ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর ডেস্কের ওপর উঠে জামাটা পতাকার মতো ওড়াতে—ওড়াতে সুইডিশ ভাষায় কী যেন বলতে শুরু করলেন। আমি হাঁ করে ওঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছি দেখে বললেন, ”জ্যাভেলিনে আমরা গোল্ড মেডেল পেয়েছি। এ বারের ওলিম্পিকে প্রথম গোল্ড। উফ, আমার যা আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না।”

মাঠের মধ্যে চোখ গেল। সুইডেনের যে জ্যাভেলিন থ্রোয়ার সোনা জিতেছেন, তিনি দৌড়তে—দৌড়তে ভি. আই. পি আর প্রেস গ্যালারির দিকে আসার পথে জ্যাভেলিনটা শূন্যে ছুড়ে দিলেন। তারপর দু’বার ডিগবাজি খেয়ে নাচতে শুরু করলেন।

সেই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে রাখলেন ফোটোগ্রাফাররা। দৃশ্যটা দেখে আমার চোখে জল এসে গেল। কবে আমরাও এরকম আনন্দ করতে পারব ওলিম্পিকে?

মনটা এত খারাপ হয়ে গেল যে, প্রেস সেন্টারে ফিরে চুপচাপ বসে রইলাম। উলটো দিকে বসে আছে আমারই চেনা এক রিপোর্টার দিলু। মন দিয়ে কী যেন লিখছে। দিলুর হাতের লেখাটা খুব সুন্দর। একবার চোখাচোখি হতেই লেখা থামিয়ে ও বলল, ”কালকেতুদা, সফট ড্রিঙ্কস আনতে যাচ্ছি। আপনার জন্য আনব?”

প্রেস সেন্টারে বিনা পয়সায় সফট ড্রিঙ্কস পাওয়া যায়। পানীয় জল নেই, তাই তৃষ্ণা মেটাবার ব্যবস্থা সফট ড্রিঙ্কস দিয়েই। বললাম, ”নিয়ে এসো।”

অফিসে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। কাগজ নিয়ে বসলাম। কিন্তু কী লিখব ঠিক করে উঠতে পারলাম না। বসে ভাবছি, হঠাৎ সফট ড্রিঙ্কসের ক্যান টেবিলে রেখে দিলু হাসিমুখে বলে উঠল, ”কনগ্র্যাচুলেশন কালকেতুদা।”

অবাক হয়ে বললাম, ”কিসের জন্য কনগ্র্যাচুলেশন?”

”বা রে! আপনাদের দেশ আজ একটা মেডেল পেল, আপনি জানেন না?”

চমকে উঠে বললাম, ”কী বলছ তুমি? আমাদের দেশ মেডেল পেয়েছে?”

”ঠাট্টা করছেন, না আপনি সত্যিই জানেন না?”

”সত্যিই জানি না।”

”ওই তো, বোর্ডে দেখুন। পদক তালিকায় ইন্ডো—র পাশে লেখা একটা ব্রোঞ্জ।”

সিট ছেড়ে দৌড়ে গেলাম পদক তালিকার সেই বিরাট বোর্ডটার দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই, ইন্ডো মানে ইন্ডিয়ার পাশে লেখা একটা ব্রোঞ্জ। কে পেলেন ওই পদকটা! কোনও কুস্তিগির? ভারতীয় দলে বাকিরা তো সব খেলায় হেরে গেছেন। ভারত একটা পদক পেয়েছে ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চ হল।

প্রেস সেন্টারে আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ভারতের কোনো সাংবাদিক নেই। তা হলে কি ওঁরা আগেই খবর পেয়ে পদকজয়ী কুস্তিগিরকে ইন্টারভিউ করতে চলে গেছেন? হতেও পারে, খবরটা সঠিক কি না, তা আগে জানা দরকার। হাতে অনেক সময় আছে। গেমস ভিলেজে গিয়ে পরে কুস্তিগিরকে ইন্টারভিউ করা যাবে।

নিজের সিটে ফিরে এসে প্রথমে গেমস ভিলেজে ফোন করলাম। অপারেটর বললেন, ভারতীয় দলের অফিসে কেউ নেই। এটা শুনে মনে হল, পদক জেতার খবর পেয়ে সবাই বোধ হয় কুস্তির ইন্ডোর হলে চলে গেছেন। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। একবার ওই ইন্ডোর হলে যাওয়া দরকার।

সঙ্গে—সঙ্গে প্রেস সেন্টারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওলিম্পিকের নানা খেলা নানা জায়গায় হচ্ছে। কুস্তির ইন্ডোর হল দেড় কিলোমিটার দূরে। প্রেস সেন্টার থেকে সেখানে যাওয়ার জন্য দশ মিনিট অন্তর বাস ছাড়ে। সাংবাদিকরা ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই বাসে।

”কী খবর, তুমি খুশি তো?”

কানের পাশ থেকে বলা কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। সেই অদ্ভুত লোকটা। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। মুখে মিটিমিটি হাসি। লোকটার পরনে ইন্ডিয়ান ব্লেজার। মাথায় হলুদ পাগড়ি। কোত্থেকে এই পোশাক জোগাড় করল, ভাবছি। তখনই ফের বলল, ”এবার নিশ্চয়ই লেখার কিছু খোরাক পেয়েছ।”

লোকটা কি মেডেল জেতার কথা বলছে? কী করে জানল? মুখ থেকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন বেরিয়ে এল, ”আপনি কে বলুন তো?”

”চিনবে না। আমি তোমাদের এই গ্রহের লোকই নই।”

কী বলছে লোকটা? পাগল নাকি? গ্রহের লোক নই। তবে কোন গ্রহের লোক? অন্য গ্রহের লোক তো গল্প—উপন্যাসে পাওয়া যায়। আমাকে বোকা বানাচ্ছে। বললাম, ”তুমি কোন গ্রহের লোক।”

”ইয়ারগো। নাম শুনেছ?” লোকটার মুখ দেখে মনে হল, সত্যি কথা বলছে।

”না, কখনও শুনিনি।”

”আমাদের গ্রহটা খুব সুন্দর। তোমাদের এখানকার মতো নয়। আমাদের গ্রহে আলাদা কোনও দেশ নেই। তোমাদের এই গ্রহের কথা ছেলেবেলাতে বইতে পড়েছিলাম। দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। তাই চলে এসেছি।”

শুনে বিশ্বাস করতে পারছি না! আবার অবিশ্বাসই বা করি কী করে। লোকটাকে প্রথম যেদিন দেখি, সেদিন থেকে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। ওই ঘন—ঘন পোশাক বদলানো। হঠাৎ উদয় হওয়া। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। আমি নিজে স্বপ্ন দেখছি কি না, বোঝার জন্য একবার বাইরের দিকে তাকালাম। না, এই তো বাস হু—হু করে ছুটছে। দূরে দেখা যাচ্ছে সোল—এর সবচেয়ে বড়ো বাড়ি। তেষট্টিতলা ওই বিখ্যাত বড়ি।

লোকটা বোধ হয় থট রিডিং জানে। বলল, ”তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। যে স্পেসশিপে আমি এসেছি, সেটা আছে মেক্সিকো বলে একটা জায়গায়। ওখানেই এসে প্রথমে নামি। ওখানেই প্রথম তোমাদের ওলিম্পিক গেমসের কথা শুনি। তাই নির্জন পাহাড়ের এক কোণে স্পেসশিপ রেখে এখানে এসেছি। মাঝে দু’দিন ছিলাম এক মরুভূমির দেশে।”

বললাম ”তোমার নাম কী?”

”ইয়ারগো। আমাদের গ্রহ খুব উন্নত। সেখানে কোনওরকম ভেদাভেদ নেই। এমন কী, কারো আলাদা নাম পর্যন্ত নেই।”

”আমি খুশি কি না, জিজ্ঞেস করছিলে কেন?”

”সেদিন প্লেনের ভেতর তুমি খুব দুঃখ করছিলে। ওলিম্পিকে মেডেল না পাওয়ার জন্য। তাই আজ সকালে তোমাদের একজনকে মেডেল পাইয়ে দিলাম।”

”পাইয়ে দিলাম মানে?”

”সে তুমি বুঝবে না। আমরা অনেক কিছু পারি, যা তোমরা পারো না। তোমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছ। আমাদের গ্রহেও খেলাধুলো হয়। তবে এমন সোজা খেলা নয়। তোমাকে একটা ছোট্ট ক্যাসেট দিতে পারি। তাহলে আন্দাজ পাবে।”

লোকটা পকেট থেকে ছোট্ট একটা ভিডিও ক্যাসেট বের করে আমাকে দিল। সেটা হাতে নেওয়া মাত্রই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। মনের ভেতর টগবগে একটা ভাব ফিরে এল। লোকটাকে এবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞেস করলাম, ”ইয়ারগো, তুমি আমাদের দেশের কুস্তিগিরকে চিনলে কী করে?”

”তার কস্টিউমে ইন্ডো লেখা ছিল।”

”তুমি লেখা বুঝতে পারলে কি করে?”

”এমন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় আমরা বড়ো হয়েছি, আমাদের এসবে অসুবিধে হয় না। শুধু দেশ আর লোকের নামগুলো মনে থাকে না। তোমার নাম তো নাম্বিয়ার, তাই না?”

শুনে হাসি পাচ্ছিল। বললাম, ”না, নাম্বিয়ার সেই লোকটার নাম, প্লেনে যে আমার পাশে বসে কথা বলছিল।”

হঠাৎ বিপ—বিপ একটা শব্দ শুনে ইয়ারগো নামের লোকটা সতর্ক হয়ে উঠল। পকেট থেকে কী একটা বের করে কানে লাগাল। পাশ থেকে শব্দতরঙ্গ টের পাচ্ছি। ইয়ারগোর মুখ—চোখের রং পালটে যাচ্ছে। খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে ওকে। একটু পরেই অবশ্য স্বাভাবিক হয়ে গেল।

বাসের জানলা দিয়ে চোখে পড়ল, ইন্ডোর হলের গম্বুজটা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। আমার পাশে বসে রয়েছে অন্য গ্রহের জীব। বিশ্বাস করা কঠিন। লোকটা দাবি করছে, অন্য গ্রহ থেকে এসেছে। এই অভিজ্ঞতা, মনে—মনে ঠিক করে নিলাম, অবশ্যই ‘আনন্দমেলা’র পাঠকদের জন্য লিখব। অন্য কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, তারা করবেই।

ইয়ারগো চুপ করে বসে আছে দেখে বললাম, ”এখন কিন্তু তুমি চাক্ষুষ প্রমাণ দাওনি, তুমি ভিন গ্রহের লোক। আমরা যা পারি না, তুমি তা পারো?”

”দেখবে?” বলে চারপাশে তাকাল ইয়ারগো। বাসে আমরা দু’জন ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। ড্রাইভার একমনে বাস চালাচ্ছেন। ”দ্যাখো, ড্রাইভারের মাথার টুপিটা এখনই তোমার নাগালে এসে যাবে।”

কথাটা শেষ হতে—না—হতেই টুপিটা এসে আমার কোলের ওপর পড়ল। বাসের ড্রাইভার টেরও পেলেন না। ইয়ারগো হো—হো করে হেসে উঠল। আমার বিশ্বাস জন্মানোর জন্য এর পর সে আরও অদ্ভুত কাণ্ড করল। জানলা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ছুটন্ত বাসের সমান্তরাল ভাসতে লাগল সিনেমায় দেখা বার্ডম্যানের মতো। তারপর টুক করে ফের নিজের সিটে এসে বসল।

শরীরের ভেতর রোমাঞ্চ জাগছে। আর্থার সি ক্লার্ক অথবা আইজ্যাক আসিমভ এই ইয়ারগোর সঙ্গে পরিচিত হলে হয়তো আটশো পাতার বই—ই লিখে ফেলতেন। কলম্বোতে একবার আর্থার সি ক্লার্কের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। ভদ্রলোককে চিঠি লিখে জানাতে হবে ইয়ারগোর কথা।

কুস্তির ইন্ডোর হল এসে গেল। ইয়ারগো এবার বলল, ”চলি বন্ধু, আর হয়তো দেখা হবে না। স্পেসশিপ থেকে সিগন্যাল পেয়েছি, তোমাদের গ্রহের কিছু লোক আমার স্পেসশিপের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। ক্ষতি করে দিতে পারে। আমাকে এখনই ওখানে চলে যেতে হবে।”

হ্যান্ডশেক করে ইয়ারগো হাইওয়ের দিকে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলাম। দেশে ফিরে যখন গল্প করব, তখন হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না, এই অদ্ভুত লোকটা ভারতীয় খেলাধুলোয় কী সাহায্য করে গেল। লোকটার অসীম ক্ষমতা, সন্দেহ নেই। হয়তো এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, যা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

ইয়ারগো চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পরই আমার মনে পড়ল, ইন্ডোর হলে আমি ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। ভারতের একজন কুস্তিগির ওলিম্পিকের পদক পেয়েছে। সেই খবর জোগাড় করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে কলকাতায় পাঠাতে হবে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা সাড়ে চারটে বাজে। তার মানে কলকাতায় এখন বেলা বারোটা। হাতে অনেক সময় আছে।

ধীরেসুস্থে ইন্ডোর হলে ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বিরাট তিনটি ম্যাট। রঙিন, ওলিম্পিকের ম্যাসকট আঁকা তাতে। একেবারে ছবির মতো। তিনটি ম্যাটেই লড়াই চলছে। গ্যালারিতে বেশ ভিড়। বেশ উত্তেজনা। ভারতের কেউ আছেন কি না, তা দেখার জন্য চোখ বোলাতে লাগলাম। ব্লেজার দেখে চেনা যাবে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও, কাউকে চোখে পড়ল না।

খানিকটা দমে গেলাম। তা হলে কি ভারতের প্রতিযোগী বা কর্তারা গেমস ভিলেজে ফিরে গেছেন? হতেও পারে। গেমস ভিলেজ দশ কিলোমিটার দূরে। যেতেই সময় লেগে যাবে প্রায় একঘণ্টা। ওখানে ঢোকার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। গেলেও খুব একটা লাভ হবে না। উলটে প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যাবে।

হলের লাগোয়া ছোট্ট একটা প্রেস রুম আছে। সেখানে ঢুকে রেজাল্ট চেয়ে নিলাম। ভাল করে চোখ বুলিয়ে কোথাও দেখতে পেলাম না, ভারতের কোনো প্রতিযোগী ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন। মন খারাপ করে ফিরে আসছি, হঠাৎ হলের বাইরে মুখোমুখি দেখা ক্যাথে প্যাসিফিকের সেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটির সঙ্গে। যেচেই জিজ্ঞেস করলাম, ”আপনি এখানে?”

এয়ার হোস্টেস বললেন, ”ওলিম্পিক গেমস দেখার জন্য দিন তিনেক ছুটি পেয়েছি আমরা। তাই ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনি এখানে?”

নিজের পরিচয় দিলাম। সাংবাদিক শুনে মেয়েটি বললেন, ‘মিঃ নন্দী, আপনাদের প্রেস সেন্টার একবার ঘুরিয়ে দেখাবেন? আমার খুব কৌতূহল দেখার জন্য। তার আগে আমার পরিচয় দিই। আমার নাম পারমিতা চ্যাটার্জি।”

বললাম, ”ভাল দিনেই যেতে চাইছেন। শুনেছি, আজ সকালে আমাদের একজন কুস্তিগির একটা মেডেল জিতেছেন। তাঁরই খোঁজে এখানে এসেছিলাম। আচ্ছা, এত খেলা থাকতে আপনি কুস্তি দেখতে এলেন কেন?”

পারমিতা বললেন, ”আমার স্বামী হংকংয়ের কুস্তি ফেডারেশনের কর্তা। তাই আমারও ইন্টারেস্ট আছে। কিন্তু আপনি যা বললেন, বোধ হয় সত্যি নয়। ইন্ডিয়ার কেউ মেডেল জিতলে নিশ্চয়ই আমি শুনতাম। সকালের দিকে একজনের লড়াই ছিল। পাপ্পু যাদব না কী যেন নাম। আড়াই মিনিটের মধ্যে চিত হয়ে হেরেছে। আমার স্বামী এ নিয়ে একবার ঠাট্টাও করলেন।”

পারমিতার মুখে কথাটা শুনে সত্যিই দমে গেলাম। মনে—মনে ঠিক করে নিলাম, সোজা প্রেস সেন্টারেই ফিরে যাব। সময় নষ্ট করব না। ভারতের অন্য রিপোর্টারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ফিরে এসেছেন। তাঁদের কাছ থেকে খবর পাওয়া যাবে।

বাসে ওঠার সময় ঝামেলা। ড্রাইভার কিছুতেই উঠতে দেবেন না পারমিতাকে। আমাদের গলায় ঝোলানো ‘ই’ কার্ড। পারমিতার তা নেই। ‘ই’ কার্ড ছাড়া আর কাউকে নাকি বাসে তোলার নিয়ম নেই। দু—চারবার অনুরোধ করার পর পারমিতাই বললেন, ”মিঃ নন্দী, ছেড়ে দিন। আমি হোটেলে ফিরে যাচ্ছি। কবে ফিরবেন দেশে? ফেরার দিন ক্যাথে প্যাসিফিকের কাউন্টারে গিয়ে একবার আমার খোঁজ করবেন।”

প্রেস সেন্টারে ফিরে এলাম আধঘণ্টা পর। নিজের সিটে গিয়ে বসতেই এল দিলু। বলল, ”কালকেতুদা, ফালতু পরিশ্রম করলেন। ব্রোঞ্জ মেডেল ইন্ডিয়ার কেউ জেতেনি। জিতেছে ইন্দোনেশিয়ার একজন। এখানে ভুল করে পদকটা ইন্ডিয়ার পাশে লিখে দিয়েছিল। এখন আবার শুধরে দিয়েছে।”

শরীর থেকে সমস্ত উৎসাহ যেন চলে গেল। চুপ করে বসে রইলাম। ইয়ারগো এত বড় ভুল করে গেল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *