ইয়াজদার্গিদের হিরে
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে সশব্দে সোফায় বসে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেন, অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! অদ্ভু-উ-ত!
তার চোখ দুটো গুলি-গুলি এবং গোঁফের ডগা তির তির করে কাঁপছিল। এ-পকেট ও-পকেট খোঁজাখুঁজি করে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ফ্যালাইয়া আইছি।
বুঝলাম জিনিসটা নস্যির কৌটো। উত্তেজনার সময় ওঁর মুখে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসে। তাছাড়া খানিক নাটুকে স্বভাবের মানুষও বটে। সামান্য ব্যাপারে তিলকে তাল করে ফেলেন। পেশাদার গোয়েন্দা হওয়ার দরুন সবসময় সবকিছুতে সন্দিগ্ধ হয়ে রহস্য খোঁজেন।
বিশালদেহী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চোখ বুজে সম্ভবত কোনও দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতি দেখছিলেন এবং সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে সেটির জৈব গোত্র বিচার করছিলেন। জানালা দিয়ে ছিটকে পড়া রোদ্দুরে ওঁর চওড়া টাক ঝকমক করছিল। বললেন, অদ্ভুতের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আছে হালদারমশাই!
হঃ! ঠিক কইছেন, হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। ভূত। ভূত!
হাসি চেপে বললাম, কোথায় দেখলেন হালদারমশাই?
হালদারমশাইয়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে সার্ভিস করছি। রিটায়ার্ড লাইফে প্রাইভেট ডিটেকটিভ অ্যাজেন্সি খুলছি। ড্যাঞ্জারাস-ড্যাঞ্জারাস ক্যাস হাতে লইছি। কখনও ভূত দেখি নাই। কাইলই রাত্রে স্বচক্ষে দ্যাখলাম।
ভূত দেখলেন?
হঃ! ভূত ছাড়া কী? নিজের একখান চক্ষু খুইলা বেসিনে রাখল। জলে ধুইয়া ফের পইরা লইল।
হাসতে-হাসতে বললাম, নকল চোখ বা নকল দাঁত অনেকেই পরেন।
হালদারমশাই চটে গিয়ে বললেন, জয়ন্তবাবু! আমি পোলাপান না। বেসিনের জলে রক্ত দেখছি।
ভূতের শরীরে রক্ত থাকে নাকি?
হালদারমশাই আরও খাপ্পা হয়ে কী বলতে যাচ্ছিলেন, ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। ওঁর জন্য স্পেশাল কফি অর্থাৎ তিনভাগ দুধ একভাগ লিকার। উনি কফির দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আমার বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বন্ধু এতক্ষণে চোখ খুলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। অভ্যাসমতো আওড়ালেনও ‘কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে’। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডারউইনসায়েবের বিবর্তনবাদ ভূতের ক্ষেত্রেও খাটে ডার্লিং! নিয়ানডারথ্যাল মানুষ থেকে ক্রোম্যাগনন মানুষ। তা থেকে হোমো-সাপিয়েন্স, আমরা যে-মানুষ। সেইরকম আদিম ভূত থেকে বর্তমান ভূত। এ-ভূতের রক্তও থাকতে পারে। হলিউডে তৈরি সায়েবভূতের ছবি দেখেছে। ড্রাকুলার ভূত রক্তচোষা ভূত ছিল। দিশি ভূত ঘাড় মটকাত। কিন্তু রক্ত খেত না। বিলিতি ভূতের চরিত্রই অন্যরকম। তারা যেমন রক্ত খায়, তেমনই তাদের শরীরে রক্তও থাকে। আধুনিক সায়েবভূত কীরকম, চিন্তা করো!
হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। বললেন, কর্নেলস্যার! ঠিক ধরেছেন। লোকটার চেহারা সাহেবগো মতো।
এবার একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, ব্যাপারটা খুলে বলুন তো হালদারমশাই!
কফি শেষ করে হালদারমশাই যা বললেন তা মোটামুটি এই :
গতকাল সন্ধ্যায় তিনি দমদম এলাকায় এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরতে রাত প্রায় দশটা হয়ে যায়। যশোর রোডের মোড়ে ট্যাক্সি বা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন। শীতের রাত। ঘন কুয়াশা। রাস্তাঘাট সুনসান নিঝুম। হঠাৎ দেখলেন, তার পাশ দিয়ে একটা লোক রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার মধ্যিখানের আইল্যান্ডে বাগান করেছে পুরসভা। ঝোপঝাড়ে কালো হয়ে আছে। লোকটা সেখানে যেতেই কেউ সেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে গুলি ছুঁড়ল। অমনই লোকটা তাকে দু-হাতে ধরে ওপরে তুলে আছাড় মারল। তারপর হনহন করে এগিয়ে ওপারের একটা বাড়ির গেটে ঢুকে গেল। কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা।
পর-পর কয়েকটা গাড়ি চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই দৌড়ে গেলেন। আবছা আলোয় দেখলেন, দলপাকানো রক্তাক্ত একটা দেহ ফুটপাত ঘেঁষে পড়ে আছে। এক্ষেত্রে অন্য কেউ হলে চ্যাঁচামেচি করে লোক ডাকত। কিন্তু হালদারমশাই স্বভাব-গোয়েন্দা। তাই সেই শক্তিমান লোকটার খোঁজেই ছুটে গেলেন।
গেটটা জরাজীর্ণ এবং ভেতরে প্রায় একটা জঙ্গল। তার ভেতর হানাবাড়ির মতো একটা দোতলা বাড়ি। ছায়ার আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই পাঁচিল ডিঙোলেন। আগাছার জঙ্গলে ঢুকে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ নীচের একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল।
সাহস করে এগিয়ে একটা খোলা জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলেন, সেই লোকটা বাথরুমে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। একটা চোখ রক্তাক্ত। হালদারমশাই বুঝলেন, আততায়ীর গুলি তার চোখেই লেগেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সে সেই চোখটা উপড়ে নিয়ে বেসিনে ট্যাপ খুলে ধুল। চোখের গর্ত থেকে সম্ভবত খুদে গুলিটাও টেনে বের করে ফেলল। তারপর চোখটা আবার পরে নিল।
দৃশ্যটা শুধু ভয়ংকর নয়, বীভৎসও। এই পর্যন্ত দেখে হালদারমশাইয়ের নার্ভের অবস্থা শোচনীয়। তিনি আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে পালিয়ে এলেন। ততক্ষণে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। গাড়ি চাপা পড়ে দুর্ঘটনা ধরে নিয়েই তারা উত্তেজিত। কিন্তু গোয়েন্দার স্বভাব। হালদারমশাই গুলির শব্দ শুনেছেন। তাই আগ্নেয়াস্ত্রটি খুঁজছিলেন। একটু পরে তা দেখতেও পেলেন। পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের কালচে রঙের রিভলভারটা পড়ে আছে হাত তিরিশেক দূরে ফুটপাতের ওপর। লোকের চোখ এড়িয়ে সেটি কুড়িয়ে নিলেন। তারপর গ্যারাজগামী একটি বাস দৈবাৎ পেয়ে গেলেন।
সারারাত ঘুমোতে পারেননি হালদারমশাই। পুলিশকে জানাতে ভরসা পাননি। কারণ তাকে নিয়ে পুলিশ মহলে প্রচুর ঠাট্টাবিদ্রূপ চালু আছে। তাছাড়া নিজেই এই রহস্যের সমাধান করার লোভ রয়েছে। তাই ভেবেচিন্তে কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করতে এসেছেন।….
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট। বললেন, সাহেবের মতো চেহারা?
হালদারমশাই বললেন, কতকটা মানে, মড়ার মতো দেখতে। মাথায় ঝাঁকড়া চুলগুলি কেমন লালচে। গড়নে আমার মতো লম্বা। তবে রোগাও না, মোটাও না।
বয়স অনুমান করতে পারেন?
হালদারমশাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, জয়ন্তবাবুর কাছাকাছি হইব।
তা হলে যুবক বলা চলে।
হঃ! জয়ন্তবাবুর মতোই গোঁফদাড়ি কিছু নাই।
পোশাক?
প্যান্ট সোয়েটার। সোয়েটারের রং ব্লু– সরি! নেভি-ব্লু। বলে হালদারমশাই জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে খুদে একটি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে কর্নেলকে দিলেন।
কর্নেল রিভলভারটি কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে দেখার পর বললেন, সিক্স রাউন্ডার চিনে অস্ত্র। কাজেই চোরা বেআইনি জিনিস। এটা আমার কাছে রাখতে আপত্তি আছে হালদারমশাই?
হালদারমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। তবে কর্নেলস্যার, এখনই সেই বাড়িটা চেক করনের দরকার। চলেন, যাই গিয়া।
উৎসাহের সঙ্গে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেই সময় ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী একটু পরে একটা নেমকার্ড এনে বলল, এক সায়েব বাবামশাই! বেরৎ নাক।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, নিয়ে আয়। তারপর অস্ত্রটি টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন।
হালদারমশাই ধপাস করে বসে পড়েছিলেন। আমিও একটু চমকে উঠেছিলাম। সায়েবভূতের কথা শোনার পর বেরৎ অর্থাৎ কিনা বৃহৎ নাকওয়ালা সায়েবের আবির্ভাবে বুক ধড়াস করে ওঠারই কথা। হালদারমশাই গুলি-গুলি নিষ্পলক চোখে বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল কার্ডটা টেবিলে রেখে বললেন, পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত ম্যাডান জুয়েলার্সের মালিক এফ এস ম্যাডান।
হালদারমশাই আশ্বস্ত হয়ে শ্বাস ছাড়লেন। আমিও।
সুটপরা ঢ্যাঙা রোগাটে গড়নের এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে করজোড়ে নমস্কার করে ইংরেজিতে বললেন, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বলতে চাই।
হিরেচুরি সম্পর্কেই কি?
ম্যাডান একটু হেসে বললেন, তা হলে আমি ঠিক লোকের কাছেই এসেছি।
আপনি বসুন। তবে কী অর্থে আমাকে ঠিক লোক বললেন, জানি না। আপনার বাড়ির গোপন বেসমেন্টে রাখা ইস্পাতের ভল্ট থেকে ১৮২ ক্যারেটের একটা হিরে চুরির খবর গত মাসে কাগজে সবিস্তার বেরিয়েছিল। আপনার দাবি, হিরেটি নাকি ঐতিহাসিক।
ম্যাডান আমাদের দেখে নিয়ে বললেন, আমার কিছু গোপন কথা আছে।
কর্নেল আমাদের দুজনের পরিচয় দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আপনার গোপন কথা এঁদের কাছে আমি গোপন রাখতে পারব না, মি. মাদান। কাজেই–
ম্যাডান ওঁর কথার ওপর বললেন, কী বললেন? মাদান? আপনি তা হলে পারসি ভাষা জানেন?
সামান্যই। ম্যাডান স্ট্রিট যাঁর নামে, তিনিও আপনাদের জোরাস্তারি ধর্মের লোক ছিলেন। বাঙালি বসু যেমন ইংরেজিতে বোস হয়েছেন, মাদানও তেমনি ম্যাডান। যাইহোক, বলুন আপনার গোপন কথা।
ম্যাডান একটু ইতস্তত করে বললেন, একমাস হয়ে গেল, পুলিশ কিছু করতে পারল না। ফরেন্সিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, লেসার রশ্মি দিয়ে ইস্পাতে ভল্টের একটা অংশ গলিয়েছে চোর। বেসমেন্টে ঢোকার গোপন দরজার লকও গলিয়েছে। এই পর্যন্তই।
আপনি বলেছেন, হিরেটা ঐতিহাসিক। একটু বুঝিয়ে বলুন।
পারসিক সাসানীয় বংশের শেষ সম্রাট ইয়াজদাগির্দের মকুটে এই হিরে বসানো ছিল। তিনিও আমাদের জোরাস্তারি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বর্তমান বাগদাদের কিছু দূরে হিরার যুদ্ধে খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে তিনি আরবদের হাতে পরাজিত হন। তার মুকুট থেকে পবিত্র হিরেটি খুলে নিয়ে পালায় তার এক অনুচর। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। প্রায় সাড়ে তেরশো বছর এ-হাত ও-হাত ঘুরে হিরেটি যায় এক ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের হাতে। তার বংশধর গত জুন মাসে নিউইয়র্কের নিলামঘরে সেটি বেচতে দেন। ১২ লক্ষ ডলারে আমার এজেন্ট কিনে নেন। বিশ্বের সব বড়ো নিলামকেন্দ্রে আমার এজেন্ট আছেন। ম্যাডান একটু দম নিয়ে বললেন, দুঃখের কথা কী জানেন কর্নেল সরকার? এই অধম ফিরুজ শাহ মাদানেরই পূর্বপুরুষ সম্রাট ইয়াজদার্গিদের সেই অনুচর। প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্যও আপনাকে দেখাতে পারি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, পবিত্র হিরে আপনি উদ্ধার করে দিন। এর জন্য যত টাকা লাগে আমি দিতে রাজি। আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, পুলিশের পক্ষে এ কাজ দুঃসাধ্য।
নিউ ইয়র্কের নিলামঘরে আপনার এজেন্টের নাম কী?
টেডি পিগার্ড। খুব বিশ্বস্ত লোক। জমিজমা-সম্পত্তির কারবারি। আবার অন্যের হয়ে নিলামঘরে হরেকরকম জিনিস নিলামেও ডাকেন। বলা দরকার কর্নেলসায়েব, আমার মতো ওঁর অনেক মক্কেল আছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মক্কেলের সঙ্গে ওঁর বোঝাপড়া আছে। কোন্ জিনিস কোন্ মক্কেলের হয়ে নিলামে কিনতে চাইছেন বা কেনেন, তা পিগার্ড এবং সেই মক্কেল ছাড়া ঘুণাক্ষরে আর কেউ জানতে পারবে না। পিগার্ড তা জানাবেন না। আপনি তো জানেন, ব্যবসাবাণিজ্যে কিছু নীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। বলে উঠলেন, হঃ! ট্রেড সিক্রেট।
ট্রেড সিক্রেট। সায় দিলেন ম্যাডান। এভাবে বহু রত্ন আমি পিগার্ডের মারফত কিনেছি। প্রায় কুড়ি বছরের যোগাযোগ তার সঙ্গে। এই পবিত্র হিরে যে নিলামে বিক্রি হবে, তা পিগার্ডই আমাকে জানিয়েছিলেন। তার কারণ বুঝতেই পারছেন। জোরাস্তারি সম্রাটের মুকুটের হিরে এবং আমিও একজন জোরাস্তারি। তো শুনেই আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। আমাদের পরিবারে বংশপরম্পরা এই হারানো হিরের কাহিনি চালু আছে। আমার ঠাকুরদার হাতে লেখা বৃত্তান্তে এর উল্লেখ আছে। খবর পেয়েই চলে গেলাম নিউইয়র্ক। পিগার্ডকে বললাম, এই হিরে আমার চাই। চিন্তা করুন কর্নেলসায়েব, এ-যাবৎকাল সর্বোচ্চ দরে ওই নিলামঘরে একটুকরো হিরে বিক্রি হল। রেকর্ড দর!
কর্নেল বললেন, পিগার্ডকে আপনি বলেছিলেন হিরেটার সঙ্গে আপনাদের পরিবারের সম্পর্ক আছে?
নাহ। ম্যাডানসায়েব চাপা গলায় বললেন, বলিনি। তার কারণ পিগার্ড তা হলে বেশি কমিশন দাবি করতেন।
আপনার বাড়িতে আর কে আছেন?
আমার মেয়ে খুরশিদ আর জামাই কুসরো। আমার স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন।
আর কেউ আছেন?
আয়া, খানসামা, বাবুর্চি, আমার ড্রাইভার, দারোয়ান- এরা আছে। কিন্তু পবিত্র হিরের ব্যাপারটা তাদের জানার কথা নয়।
আপনার মেয়ে-জামাইয়ের?
তারা জানত।
আপনার জামাই কী করেন?
আমার দোকানের দায়িত্ব তারই হাতে।
কলকাতায় আপনার আত্মীয়স্বজন নিশ্চয় আছেন?
অবশ্যই আছেন।
হালদারমশাই ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। নিজস্ব ইংরেজিতে বললেন, ইয়োর ডটার বাই সিলিপ অব টাং-।
ম্যাডান রুষ্টভাবে বলেন, নো!
হালদারমশাই দমে গিয়ে আবার ফেলে আসা নস্যির কৌটো খুঁজতে থাকলেন। কর্নেল বললেন, যাইহোক। সম্রাট ইয়াজদার্গিদের হিরে যে আপনার বাড়িতে আছে এবং কোথায় লুকোনো আছে, সে কথা কেউ জানতে পেরেছিল। সে যদি সত্যি লেসার রশ্মি ব্যবহার করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, সে একজন বিজ্ঞানী। কারণ এখনও বিজ্ঞানী ছাড়া লেসার রশ্মি ব্যবহার কেউ করতে জানে না। করার ঝুঁকি সাংঘাতিক।
পুলিশও তাই বলছে।
বলে ম্যাডানসায়েব কৌটোর ভেতর পকেট থেকে একটা ব্যাংকের চেকবই বের করলেন। ফি–বাবদ আপনাকে অগ্রিম কিছু টাকা দিতে চাই কর্নেল সরকার। আমি আজ বিকেলের প্লেনে ক’দিনের জন্য বাইরে যাব। দরকার হলে আমার বাড়ি বা দোকানে টেলিফোনে কুসরোর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তাকেও বলে যাব আপনার কথা।
ম্যাডান চেকবই খুললে কর্নেল বললেম, দুঃখিত মি. ম্যাডান। আমি ফি নিই না।
সে কি! এই কেসে আপনাকে–।
মি. ম্যাডান, আমি ডিটেকটিভ নই। বলে কর্নেল হালদারমশাইকে দেখিয়ে দিলেন। উনি ডিটেকটিভ। কী হালদারমশাই, কেস নেবেন নাকি?
হালদারমশাই হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন। ম্যাডান বললেন, কর্নেলসায়েব! আমি কিন্তু আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে আপনি কেসটা নিন। আমার বিশ্বাস, আপনিই পবিত্র হিরে উদ্ধার করে দিতে পারবেন।
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। কোনও কথা বললেন না।
ম্যাডানসায়েব দ্বিধার সঙ্গে বললেন, দয়া করে যদি আমার সঙ্গে আসেন, আমার বাড়ির গোপন বেসমেন্ট এবং ভল্ট দেখাতে পারি। আমার মনে হচ্ছে, আপনার দেখা দরকার।
কর্নেল বললেন, আপাতত দরকার দেখছি না।
তা হলে আপনি কেস নিচ্ছেন না?
আপনি কবে ফিরছেন বাইরে থেকে?
আগামী রবিবার।
ফিরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
ম্যাডানসায়েব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।
হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। ক্যাসটা লইলেন না কর্নেলসার? প্রচুর রহস্য! প্রচুর।
তার চেয়ে সাংঘাতিক রহস্যের খবর আপনি এনেছেন। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে লাগলেন। একটু পরে কাকে বললেন, সোমা নাকি? আমি কর্নেল না! না! শোনো! গত রাত্রে যশোর রোডে একটা অ্যাকসিডেন্ট– হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ইনটারেস্টেড। পরিচয় পাওয়া গেছে? এক সেকেন্ড। লিখে নিচ্ছি। কর্নেল টেবিলে রাখা প্যাড টেনে কী সব লিখে নিলেন। চাপা দুর্বোধ্য কিছু কথাবার্তাও বললেন।
হালদারমশাই বললেন, ক্কী? ক্কী?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ম্যাডানসায়েবের হঠাৎ এতদিন পরে আমার কাছে আসার কারণ খুঁজছিলাম, হালদারমশাই! আমার যখনই সন্দেহ হয়, কেউ কোনও তথ্য গোপন করে আমার সাহায্য চাইছে, তখন তার কেস নেওয়া আমি পছন্দ করি না। গত রাত্রে আপনার দেখা ভূতটা যাকে আছাড়ে মেরেছে, তার নাম জামসিদ নওরোজি।
চমকে উঠে বললাম, পারসি নাম!
হ্যাঁ। তার চেয়ে বড়ো কথা, ভদ্রলোকের একটা কিউরিয়ো শপ আছে। প্রত্নদ্রব্যের দোকান। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আবার তার দোকানটাও ম্যাডান জুয়েলার্সের ওপরতলায়। কাজেই চলুন হালদারমশাই, সেই ভূতের আখড়াটি দেখে আসা যাক। জয়ন্ত! তুমিও চলো তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কয়েক কিস্তি লোভনীয় খাদ্য পেয়ে যাবে।
.
০২.
প্রথমে চোখে পড়ল জংধরা ছোট্ট গেটের পাশে সাঁটা একটুকরো চৌকো ফলক। তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে : Human Genome Research Centre.
দোতলা বাড়িটা সত্যিই হানাবাড়ি। গেটে তালা বন্ধ। ভেতরে আগাছার জঙ্গল। চারদিকে দেওয়ালঘেরা এই বাড়ির অবস্থাও জরাজীর্ণ। পলেস্তারা খসে গেছে কোথাও-কোথাও। কার্নিসে গাছ গজিয়ে আছে। পুরোনো আমলের বাগানবাড়ি হতে পারে। ডাইনে বিশাল এলাকা জুড়ে কী কারখানা গড়া হচ্ছে। বাঁ দিকে একফালি খোয়াবিছানো রাস্তা এবং নতুন পুরোনোয় ঘেঁষাঘেষি অনেক বাড়ি। একটাতে ঘন গাছপালা। হঠাৎ করে মনে হয় গ্রাম শহরে মেশানো কোনও মফস্সল জনপদ।
কর্নেল বাইনোকুলারে গেট থেকে ভেতরটা দেখছিলেন। বললাম, এ কিসের গবেষণাকেন্দ্র?
কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, জেনেটিক্সের।
হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ক্কী? ক্কী?
জবাব না দিয়ে কর্নেল ফুটপাত ধরে এগিয়ে গেলেন একটা পান-সিগারেটের দোকানের দিকে। হালদারমশাই আমার দিকে তাকালেন। বললাম, জেনেটিক ব্যাপারটা আমিও বুঝি না হালদারমশাই। শুধু এটুকু বলতে পারি, এখানে সম্ভবত কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র গড়া হবে। তাই আগেভাগেই ফলক সেঁটে দিয়েছে।
গভমেন্টের কারবার! দেখি, নস্য পাই নাকি। বলে হালদারমশাইও সেই দোকানটার দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন।
আমি আমার ক্রিমরঙা মারুতি গাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। এভাবে একানড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। পড়েছি দু-দুজন ছিটগ্রস্তের পাল্লায়। বরাতে কী আছে কে জানে। বসে থাকতে থাকতে গেটের ভেতর দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম। সেইসময় হঠাৎ দোতলার একটা জানালা খুলে গেল এবং একটা মুখ দেখলাম।
নাহ। ভূতের মুখ বলে মনে হল না। গোলগাল অমায়িক এবং বেশ সভ্যভব্য মানুষের মুখ। আপনমনে হাসছেন তিনি। উৎসাহে গাড়ি থেকে নেমে ওঁকে ডাকব ভাবছি, হঠাৎ জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল। তা হলে বাড়িটাতে এখন কেউ আছেন। কিন্তু বাইরের থেকে গেটে তালা কেন? খটকা লাগল।
কর্নেল এবং হালদারমশাই ফিরে এলে কথাটা বললাম। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, তুমি বসন্তবাবুকে দেখেছ। শুনলাম ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল। তাই ওঁর ছোটোভাই রাজেনবাবু ওঁকে বাড়িতে আটকে রেখে বাইরে যান। রাজেন অধিকারী নাকি বাঙ্গালোরে কী চাকরি করতেন। সম্প্রতি এই পৈতৃক বাড়িতে এসে উঠেছেন।
হালদারমশাই ততক্ষণে গেটের কাছে হেঁড়ে গলায় ডাকাডাকি শুরু করেছেন, বসন্তবাবু! বসন্তবাবু! মি. অধিকারী।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই, বসন্তবাবুকে ডেকে লাভ নেই, তা ছাড়া পাগলের পাল্লায় পড়া কাজের কথা নয়। আসুন আমরা একবার এক জায়গায় যাব।
হালদারমশাই চাপা গলায় বললেন, কর্নেলসাব, এই চান্স। ছাড়া ঠিক নয়। কাল রাত্তিরে যা স্বচক্ষে দেখেছি, তার তদন্ত করা দরকার।
আপনি তা হলে তদন্ত করুন। আমরা চলি।
হালদারমশাই কান করলেন না। গেটের গ্রিলের খাঁজে পা রেখে উঠে গেট পেরিয়ে গেলেন। বললাম, সর্বনাশ। হালদারমশাই করছেন কী।
কর্নেল গাড়িতে ঢুকে বললেন, ওঁর কাজ উনি করুন। গাড়ি ঘোরাও। আমরা এবার যাব চন্দ্রকান্তবাবুর বাড়ি।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত?
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ ডার্লিং। এই হিউম্যান জেনোম ব্যাপারটা সম্পর্কে ওঁর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের সঙ্গে আমাদের অনেক বছরের পরিচয়। উনি থাকেন এখান থেকে এক কিমি উত্তরে একটা প্রত্যন্ত এলাকায়। সদর রাস্তা থেকে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ রাস্তায় ঢুকে আরও জঙ্গুলে এলাকায় ওঁর ডেরা। নিরিবিলি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপযুক্ত জায়গা। ওঁর একটি রোবট আছে। তার নাম ধুন্ধুমার। ডাকনাম ধুন্ধু। এই বিকট নামের কারণ আছে। শব্দটি উচ্চারণ করলে যে ধ্বনির সৃষ্টি হয় তা রোবটটিকে নাকি সক্রিয় করে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় মনুষ্যাকৃতি রোবটটিকে সোনিক রোবট বলা চলে।
তবে ধুন্ধুকে আমার বড় ভয় করে। যন্ত্রমানুষ আর পোষা বাঘ প্রায় একই জিনিস।
গাড়ির হর্ন দিতেই অটোমেটিক গেট খুলে গেল। বিজ্ঞানী প্রবরকে সহাস্যে এগিয়ে আসতে দেখলাম। চিবুকে তেকোনা দাড়ি, একরাশ আইনস্টাইনি চুল। বেঁটেখাটো মানুষটি বড়োই সদালাপী। কর্নেল এবং আমার সঙ্গে কড়া হ্যান্ডশেক করে ড্রইংরুমে ঢোকালেন। ধুন্ধুকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।
আরও নিশ্চিন্ত হলাম শুনে যে, ধুন্ধুর কী ভাইরাসঘটিত অসুখ হয়েছে। ল্যাবে তার চিকিৎসা চলছে।
চন্দ্রকান্ত বললেন, আজকাল আর সিন্থেটিক কফি খাই না। ন্যাচারাল কফি খাওয়াচ্ছি।
কর্নেল বললেন, কফি পরে হবে। আগে কাজের কথা সেরে নিই।
বলুন! এ বেলা আমার হাতে অঢেল সময়।
হিউম্যান জেনোম সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
বিজ্ঞানী ভুরু কুঁচকে তাকালেন। জেনোম? আপনি কি জেমস ডি ওয়াটসনের তত্ত্বের কথা বলছেন? নোবেল- লরিয়েট ওয়াটসন?
হ্যাঁ। ওঁর হিউম্যান জেনোম প্রজেক্টের কথা শুনেছি।
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। আমি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের কারবারি। তবে ইদানীং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমার লাইন জেনেটিকসের কাছাকাছি এসে পড়ছে। তো জেনোম প্রজেক্ট! মানুষের প্রতি দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। ক্রোমোজোমের মধ্যে আছে মালার মতো সাজানো অসংখ্য জিন। সঠিক হিসাব এখনও করা যায়নি। ওয়াটসনের মতে, একজন মানুষের দেহে ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ জিন আছে। প্রতিটি জিনে আছে তিনশো কোটি ডি এন এ। এই ডি এন এ-র মধ্যে সংকেতে লুকনো আছে মানুষের বংশগত বহু লক্ষণ বা চরিত্র। ওয়াটসন ডি এন এ-র গঠন খুঁজে সেই সংকেতগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন। সেটাই ওঁর জেনোম প্রকল্প।
জেনোমতত্ত্ব কেউ কি এ পর্যন্ত বাস্তবে কাজে লাগাতে পেরেছেন?
চন্দ্রকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। স্রেফ তত্ত্ব। তবে স্বয়ং ওয়াটসনেরই মতে, একে কাজে লাগিয়ে বড়োজোর বংশানুক্রমিক আদিব্যাধি নির্মূল করা যায়। এই পর্যন্তই।
এর অপব্যবহার করা কি সম্ভব?
বাস্তবে কাজে লাগাতে পারলে অপব্যবহার সম্ভব বইকী।
কী ধরনের অপব্যবহার?
চন্দ্রকান্ত খিক-খিক করে খুব হাসলেন। সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করা যায়। শরীরের গড়ন বদলে দেওয়া যায়। তবে তার জন্য জেনোমের দরকার কী? সেটা স্রেফ কিছু খাইয়ে বা অপারেশন করেও করা যায়। মোট কথা, তত্ত্বটা এখনও নিছক তত্ত্বই।
এ-শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেন-আমেরিকায় জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য জেনেটিক্সের ইউজেনিক তত্ত্ব নিয়ে খুব হইচই বেধেছিল। নাৎসি জার্মানিতে ইউজেনিক তত্ত্ব লক্ষ লক্ষ ইহুদি হত্যার কারণ হয়েছিল। বিজ্ঞানের চেয়ে বিজ্ঞানীরা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। ইদানীং দেখছি, জেনেটিক্সের নানা তত্ত্বের উদ্ভট-উদ্ভট ব্যাখা শুরু হয়েছে।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, জেনোম প্রকল্পের সাহায্যে কৃত্রিম মানুষ তৈরি করা সম্ভব?
চন্দ্রকান্ত আবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর ফিক করে হাসলেন। বহুবছর আগে নোবেলজয়ী আণবিক জীববিজ্ঞানী জাক মোদে বলেছিলেন, ল্যাবে মানুষ গড়ে ফেলবেন। ফুঃ! মানুষ ইজ মানুষ।
কৃত্রিম ডি এন এ অণু তৈরি কি সম্ভব?
চন্দ্রকান্ত অবাক হয়ে বললেন, আপনার পয়েন্টটা কী?
এই এলাকায় একটি হিউম্যান জেনোম রিসার্চ সেন্টার খোলা হয়েছে বা হবে জানেন?
চন্দ্রকান্ত ভুঁড়ি নাচিয়ে আর এক দফা হাসলেন। আপনি নিশ্চয় রাজেন অধিকারীর কথা বলছেন? আমেরিকার কোনও ইউনিভার্সিটিতে জেনেটিক্স বিভাগে অধ্যাপক ছিলেন ভদ্রলোক। শুনেছি মাত্র। আলাপ হয়নি। এ-ও শুনেছি, ভালমানুষ দাদার ওপর পরীক্ষা চালাতে গিয়ে তাকে পাগল করে ফেলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী?
কর্নেল আগাগোড়া সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন, আমি আপনার সাহায্য চাই চন্দ্রকান্তবাবু!
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চিবুকের তেকোনা দাড়ি চুলকোচ্ছিলেন। এটা ওঁর চিন্তাভাবনার লক্ষণ। একটু পরে বললেন, হালদারমশাইয়ের দেখা প্রথম ঘটনাটা, মানে পারসি ভদ্রলোককে তুলে আছাড় মারাটা চিন্তাযোগ্য বিষয়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটা ওঁর দেখার ভুল হতেও পারে। মানে, চোখ উপড়ে বেসিনে দেওয়া এবং রক্ত! তারপর সেই চোখ থেকে গুলি বের করা। হালদারমশাইকে তো বিলক্ষণ জানি!
বলে চন্দ্রকান্ত হেসে উঠলেন। বললাম, গুলির শব্দ শুনেছিলেন হালদারমশাই! ঘটনাস্থলে পাওয়া রিভলভারটা তার প্রমাণ।
গুলিটা নকল পাথুরে চোখে লেগেছিল। চন্দ্রকান্ত আবার দাড়ি চুলকোতে থাকলেন। যাইহোক, লোকটার গায়ের জোরই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। কোনও কথা বললেন না। আমি বললাম, আপনি বিজ্ঞানী। এ-যুগে ফ্র্যাংকেনস্টাইন কাহিনি কি বাস্তবে সম্ভব নয়? আপনিই বললেন, জেনোমতত্ত্ব কাজে লাগিয়ে শরীরের গড়ন বদলানো যায়। শারীরিক শক্তিও তা হলে বদলানো যায়?
চন্দ্রকান্ত বললেন, তা যায়। তবে
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, আপনার ধুন্ধুমার যন্ত্রমানুষ মাত্র। কিন্তু কৃত্রিম চামড়া, কৃত্রিম পেশি-শিরা-উপশিরা, কৃত্রিম হৃৎপিন্ড-ফুসফুস এবং কৃত্রিম রক্ত তো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে এ যুগে। বাকি রইল কৃত্রিম মগজ। কোনও বিজ্ঞানী কি এইসব জুড়ে কৃত্রিম মানুষ তৈরি করতে পারেন না?
পারেন, স্বীকার করছি। কিন্তু সেই কৃত্রিম মানুষও আসলে রোবট ছাড়া কিছু নয়। কারণ, তার কৃত্রিম মগজ মানুষের মগজের মতো স্বাধীন চিন্তা করতে পারবে না। যে তাকে তৈরি করছে, তারই চিন্তাভাবনা বা ইচ্ছা তাকে কনট্রোল করবে।
কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। তা হলে তাকে রিমোট কনেট্রোল সিস্টেমে চালানো যাবে।
ঠিক। একশোভাগ ঠিক। চন্দ্রকান্ত চাপাস্বরে বললেন, এখন কথা হচ্ছে, রাজেন অধিকারী তা করতে পেরেছেন কি না।
আমি না বলে পারলাম না, ম্যাডানসায়েবের হিরে চুরি তা হলে রাজেনবাবুরই কীর্তি। জেনোম রিসার্চের জন্য প্রচুর টাকার দরকার। হিরেটার দাম এ-বাজারে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। জয়ন্ত খাঁটি সাংবাদিক হতে পারল না বলে ওর সমালোচনা করি বটে, তবে ওর মধ্যে সাংবাদিক সুলভ চটজলদি সিদ্ধান্ত করার স্বভাব আছে। ডার্লিং! তোমাকে বারবার বলেছি, বাইরে থেকে যা যেমনটি দেখাচ্ছে, ভেতরে তা তেমনটি নয়।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। চলুন না, রাজেন অধিকারীর সঙ্গে আলাপ করে আসি। যদি উনি এতক্ষণ না ফিরে থাকেন, আমি এম পি ডি দিয়ে বাইরে থেকে কিছু ডেটা সংগ্রহ করে নেব।
বললাম, এম পি ডি মানে?
মাল্টিপারপাস ডিটেক্টর। আমারই আবিষ্কার। চন্দ্রকান্ত সগর্বে বললেন। ওঁর বাড়ির ভেতর কী কাজকর্ম হয়, তার হদিস পেয়ে যাব।
কর্নেলও উঠলেন। বললেন, আমার ভয় হচ্ছে, হালদারমশাই কোনও কেলেঙ্কারি না বাধান। একগুঁয়ে মানুষ। আত্মবিশ্বাস প্রচণ্ড। আবার ওই জিনিসটা তাকে বিপদে ফেলে। অন্তত তার অবস্থা জানার জন্যও আমাদের ওখানে আবার যাওয়া দরকার মনে হচ্ছে।
বিজ্ঞানী নিজের গাড়ি বের করলেন। ওঁর গাড়ি আগে, আমাদেরটা পেছনে। বিজ্ঞানীর গাড়ি বলে কথা! সদর রাস্তায় পৌঁছে রকেটের বেগে উধাও হয়ে গেল। বললাম, কী অদ্ভুত মানুষ!
কর্নেল হেসে বললেন, সম্ভবত আমরাও আরও অদ্ভুত মানুষের পাল্লায় পড়তে চলেছি ডার্লিং।
আপনি কি কৃত্রিম মানুষের কথা সত্যিই বিশ্বাস করেন– মানে যাকে গত রাতে হালদারমশাই দেখেছেন?
নিছক একটা থিয়োরি, জয়ন্ত। বলে কর্নেল বাইনোকুলার তুলে রাস্তার ধারের গাছে হয়তো পাখি খুঁজতে থাকলেন।
সেই বাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড় করালাম। বিজ্ঞানী প্রবরের গাড়িটা খুঁজে পেলাম না। বললাম, সর্বনাশ। চন্দ্রকান্তবাবুকে কৃত্রিম মানুষ হাপিস করে দেয়নি তো?
কর্নেল গাড়ি থেকে বেরিয়ে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবুর অভ্যাস খোদার ওপর খোদকারী করা। ন্যাচারাল কফির বদলে সিন্থেটিক কফি খান। খিদে পেলে নাকি এনার্জি ক্যাপসুল খান। কৃত্রিম অর্থাৎ ওঁর ভাষায় সিন্থেটিক মানুষের প্রতি আসক্তি স্বাভাবিক। যাই হোক, গেটের দরজায় আর তালা আঁটা নেই। হুঁ ওই দ্যাখো ওঁর গাড়ি!
বলে কর্নেল গেট ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেলন! আমি গাড়ি ঢোকাতে সাহস পেলাম না। বেরিয়ে গিয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম।
এবড়োখেবড়ো খোয়া-ঢাকা রাস্তা। দু-ধারে বিচ্ছিরি জঙ্গল। বাড়িটার সামনে চন্দ্ৰকান্তের গাড়ি দাঁড় করানো। আমরা সেখানে যেতেই তার সাড়া পাওয়া গেল ঘরের ভেতর থেকে। চলে আসুন। কর্নেল!
সেকেলে হলঘর বললেই চলে। ঝাড়বাতিও আছে। পুরোনো আসবাবপত্রে সাজানো বনেদি পরিবারের বৈঠকখানা। চন্দ্রকান্ত আলাপ করিয়ে দিলেন রাজেন অধিকারীর সঙ্গে। রাজেনবাবুর বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি। রোগা হাড়গিলে চেহারা। পরনে গলাবন্ধ কোট আর ঢোলা পাতলুন। মাথায় কাঁচাপাকা সন্নেসিচুল। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। কেমন ভুতুড়ে চেহারা যেন।
তবে হাসিটা অমায়িক এবং হাবভাবেও বড়ো বিনয়ী। শশব্যস্তে অভ্যর্থনা করে আমাদের বসালেন। বললেন, হিউম্যান জেনোম রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে ক্রমশ আপনাদের মতো বিশিষ্ট মানুষদের আগ্রহ জাগাতে পেরেছি, এ আমার সৌভাগ্য। দেশে ফিরে আসার পর বিজ্ঞানী মহলে শুধু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্র হয়ে উঠেছিলাম। এখন দেখছি, সমঝদার বিজ্ঞ মানুষেরও অভাব নেই। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতিঃপদার্থবিদ মি. চন্দ্রকান্ত চৌধুরীকেও আমি আকর্ষণ করতে পেরেছি।
চন্দ্রকান্ত সহাস্যে বললেন, এবং একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানীকেও! উনি কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন।
কর্নেল বললেন, এবং একজন নামকরা সাংবাদিককেও! কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। ঠোঁটের কোনায় দুষ্টু হাসি।
রাজেনবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু! আমার এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু লিখুন। এদেশে এই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে জেনোম প্রজেক্ট। গভর্নমেন্ট মানেই আমলাতন্ত্র। কিন্তু সরকারি বিজ্ঞানীদের আমলাতন্ত্র আরও সাংঘাতিক। বলে, টাকা দিচ্ছি। তবে বোর্ড গড়তে হবে। তাতে ওঁরা থাকবেন। বুঝুন ব্যাপার! লাল ফিতের ফাঁসে দম আটকে শেষে আমিই মারা পড়ব।
কর্নেল বললেন, আপনার ল্যাব আছে নিশ্চয়?
আছে- মানে, সবে গড়তে শুরু করেছি।
জয়ন্তকে আপনার ল্যাব দেখিয়ে ব্যাপারটাকে বুঝিয়ে বলুন। তা হলে ও সেইভাবে কাগজে লিখবে। আর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় লেখা মানেই প্রচণ্ড প্রভাব সৃষ্টি।
জানি, জানি। বলে উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন রাজেন অধিকারী। আসুন আপনারাও আসুন!
ল্যাবরেটরি মানেই বিদঘুটে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক জিনিসপত্র, নানারকম গন্ধ। তার সঙ্গে একালে হরেক সাইজের কম্পিউটার এবং ভিশনস্ক্রিন যুক্ত হয়েছে। তা চন্দ্ৰকান্তের ল্যাব এবং রাজেনবাবুর ল্যাবের মধ্যে একটাই ফারাক চোখে পড়ল। জারে রঙিন তরল পদার্থে চুবানো ইঁদুর, আরশোলা টিকটিকি ইত্যাদি সরীসৃপ-পোকামাকড়। তারপর আঁতকে উঠলাম দেখে, কবজি থেকে কাটা একটা হাত। মানুষের হাত। আমার চমক লক্ষ্য করে রাজেনবাবু বললেন, হাসপাতালের মর্গ থেকে জোগাড় করেছি। এবার জেনোম ব্যাপার বুঝিয়ে বলি।
আমার পকেটে রিপোর্টারস নোটবই সবসময় থাকে। উনি বকবক শুরু করলে আমি নোট নেওয়ার ভান করে যা খুশি লিখতে থাকলাম। চন্দ্রকান্ত একটা কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকে আছেন দেখলাম। কিন্তু কর্নেল কোথায় গেলেন?
প্রায় আধ ঘন্টা টানা বকবক করে এবং এটা ওটা দেখিয়ে রাজেন অধিকারী যখন থামলেন, তখন আড়চোখে তাকিয়ে কর্নেলকে ঢুকতে দেখলাম।
একটু পরে আমাদের বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত এলেন রাজেন অধিকারী বললেন, আপনাদের জন্য সব সময় দরজা খোলা।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত কেন কে জানে, একটি কথাও না বলে তার গাড়ি নিয়ে আগের মতোই উধাও হয়ে গেলেন। আমরা এগোলাম ভি আই পি রোডের দিকে। যেতে যেতে বললাম গোপন তদন্তের ফল বলতে আপত্তি আছে?
কর্নেল হাসলেন, বন্দি হালদারমশাইকে উদ্ধার করতে পেরেছি। তিনি ভোঁ-কাট করেছেন।
চমকে উঠে বললাম, অ্যাঁ?
কর্নেল শুধু বললেন, হ্যাঁ।
.
০৩.
কোনও গুরুতর চিন্তাভাবনার সময় আমার বৃদ্ধ বন্ধুটির চোখ বুজে যায়। ডাকলেও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। হালদারমশাইয়ের ব্যাপারটা তখনকার মতো জানা গেল না। শুধু ভাবছিলাম, জারে চুবোনো সেই কাটা হাতটার কথা এবং শিউরে উঠছিলাম। হালদারমশাই জোর বাঁচা বেঁচেছেন তা হলে। আমরা পৌঁছোতে দেরি করলে গোয়েন্দা ভদ্রলোককে নিশ্চয় কুচিকুচি করে কেটে জেনোমবিজ্ঞানী রাজেন অধিকারী জারে চুবিয়ে রাখতেন।
কর্নেলের বাড়ির লনে গাড়ি ঢুকিয়ে দেখি, উনি তখনও ধ্যানস্থ। বললাম, এসে গেছি বস।
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, কখনও কানমলা খেয়েছ, ডার্লিং?
হঠাৎ এই অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, কানমলা? তার মানে?
নিশ্চয় খেয়েছ। বিশেষ করে তোমার ছেলেবেলা পাড়াগাঁয়ে কেটেছে যখন। কর্নেল আস্তে-সুস্থে গড়ি থেকে বেরোলেন। একটু হেসে বললেন, কানমলা খাওয়া খুব অপমানজনক ব্যাপার। কাউকে চূড়ান্ত অপমান করতে হলে কানমলে দেওয়াই যথেষ্ট। কারও কান ধরলেই সে জব্দ হয়। শুধু মানুষ নয় জয়ন্ত! জন্তুজানোয়ারও কান ধরলে জব্দ।
ব্যাপারটা কী?
তুমি কি গাড়িতেই বসে থাকবে, না কি বেরোবে?
ঘড়ি দেখে বললাম, বারোটা বাজে। প্রেস ক্লাবে লাঞ্চের নেমতন্ন আছে। এক মন্ত্রী ভাষণ দিতে আসবেন।
ঠিক আছে। তা হলে তুমি এসো। বলে কর্নেল চলে গেলেন।
একটু অভিমান নিশ্চয় হল। হালদারমশাইয়ের বন্দি হওয়া এবং কানমলা ব্যাপারটা জানার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই খেয়ালি বৃদ্ধের রকমসকম বরাবর দেখে আসছি। যথাসময়ে নিজে থেকেই জানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। কাজেই গাড়ি ঘুরিয়েই তখন স্থানত্যাগ করলাম।
সন্ধের দিকে একবার ভেবেছিলাম কর্নেলের বাড়ি যাব! কিন্তু উনি যখনতখন হুট করে বেরিয়ে নিপাত্তা হয়ে যান। তাই টেলিফোন করলাম। ষষ্ঠীচরণ ফোন ধরেছিল। এককথায় জানিয়ে দিল, বাবামশাই বেইরেছেন।
হালদারমশাইয়ের ফ্ল্যাটে রিং করলাম। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
বিজ্ঞানী চন্ত্রকান্তকে রিং করলাম। ফোনে তখনই সাড়া এল, জয়ন্তবাবু নাকি?
অবাক হয়ে বললাম, গলা শুনেই লোক চেনার যন্ত্র তৈরি করেছেন বোঝা যাচ্ছে।
ঠিক তা-ই। বিজ্ঞানীর হাসি ভেসে এল। আমার সোনিম থিয়োরি–
ঝটপট বললাম, জেনোম থিয়োরির পর সোনিম থিয়োরি এলে আমার বারোটা বেজে যাবে চন্দ্রকান্তবাবু! প্লিজ! থিয়োরি থাক।
সহজ ব্যাপার জয়ন্তবাবু! ইংরেজিতে এস ও এন আই এম সোনিম। শব্দ! ধ্বনি! বুঝলেন তো?
চন্দ্রকান্তবাবু–
ল্যাবে বসে আছি, জয়ন্তবাবু! আমার ঘরে যাঁরা আসেন, তাঁদের গলার স্বর, শব্দ উচ্চারণের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গি ইত্যাদি সব রেকর্ড করে রাখি। কম্পিউটারে সেই ডেটা অ্যানালিসিস করে নিই। তারপর টেলিফোনের সঙ্গে কম্পিউটারের কানেকশন! ব্যস! সো ইজি।
প্লিজ! আমি জানতে চাইছি আপনার সেই মাল্টিপারপাস ডিটেক্টর যন্ত্রে রাজেনবাবুর বাড়ি সম্পর্কে কী তথ্য পেলেন?
ডেটা অ্যানালিসিস চলছে। এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। আরও দু-একটা দিন লেগে যাবে হয়তো।
কৃত্রিম মানুষের কোনও হদিস পেলেন কি?
নাহ। তবে একটা অদ্ভুত ধ্বনিতরঙ্গ ধরা পড়েছে। কোনও পার্থিব বস্তু বা প্রাণী এই ধ্বনিতরঙ্গের কারণ নয়, এটুকু বলতে পারি।
চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি তো হালদারমশাইকে ভালোই চেনেন।
খুউব চিনি।
রাজেনবাবুর বাড়ি ঢুকে উনি বিপদে পড়েছিলেন। আমরা যখন ওঁর ল্যাবে ছিলাম, তখন কর্নেল ওঁকে দেখতে পান। বন্দি অবস্থায় ছিলেন। কর্নেল ওঁকে উদ্ধার করেন।
হাঃ হাঃ হাঃ! কর্নেল আমার পাশে বসে আছেন। কথা বলুন।
কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ডার্লিং! তখন যে কথাটা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আবার বুঝতে চেষ্টা করো। কানমলা! প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে হলে তার কান ধরে ফেলবে। কেমন? যখনই কেউ তোমার ওপর হামলা করবে, তোমার লক্ষ্য হবে তার কান। ভুলো না কিন্তু।
চটে গিয়ে বললাম, এই নাক-কান মলে প্রতিজ্ঞা করছি–।
নাক নয়, কান। তুমি কান মলে প্রতিজ্ঞা করার ব্যাপারটা লক্ষ্য করো, জয়ন্ত। তা হলেই বুঝতে পারবে, কান একটা ভাইটাল প্রত্যঙ্গ। মানুষ শুধু নাকমলে প্রতিজ্ঞা করে না, কানও মলতে হয়। তবে নাহ। নিজের কান নিজে মলে নিজেকে জব্দ করার অর্থ হয় না।
ছাড়ছি।
কান ধরে আছ নাকি?
নাহ। ফোন।
ফোনের সঙ্গে কানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ডার্লিং! ফোন মানে ধ্বনি। ধ্বনি আমরা কান দিয়েই শুনি।
খাপ্পা হয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। ঠিক করলাম, এসব উদ্ভুটে ব্যাপারে কিছুতেই নাক গলাব না। এমনকী, ওই বৃদ্ধ ঘুঘুর মুখদর্শনও আর করব না।
পরদিন বিকেলে পত্রিকা-অফিসে রাজেন অধিকারীর টেলিফোন পেলাম। রাজেনবাবু বললেন, মি. জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
জয়ন্ত চৌধুরী বলছি।
মি. চৌধুরী! খবরটা তো বেরোল না আপনাদের কাগজে? খুব আশা করে ছিলাম।
বেরোবে। আসলে আমাদের কাগজে বিজ্ঞাপনের চাপ খুব বেশি তো! সবসময় সব খবরকে জায়গা দেওয়া যায় না।
শুনুন! ব্যাপারটা সায়েন্টিফিক কিনা! কাজেই জটিল। আপনার লেখার সুবিধে হবে বলে আমি একটা আর্টিকল-আকারে লিখে লোক দিয়ে পাঠাব কি?
পাঠাতে পারেন। কিন্তু এখনই আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে যেতে হবে। ফিরতে দেরি হতে পারে। নীচের রিসেপশনে দিয়ে যেতে বলবেন আপনার লোককে।
— না জয়ন্তবাবু! ওটা আপনার হাতে সরাসরি পৌঁছোনো দরকার। কারণ এর আগে আমি সব কাগজে রাইট-আপ পাঠিয়েছি। ছাপা হয়নি। প্রেস কনফারেন্স ডেকেছি। কেউ আসেনি। আমাকে আসলে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। হ্যাঁ, ছোটোখাটো কাগজ ছেপেছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। হয় না। বড়ো কাগজে বেরোলে লক্ষ লক্ষ লোকের নজরে পড়ে।
বুঝেছি। আপনি এক কাজ করুন। খামে আমার নাম লিখে পাঠান। তা হলেই আমি পেয়ে যাব।
ঠিক আছে। আসলে আমি আজই কদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। তাই এত তাড়া।
এক মিনিট মি. অধিকারী! কাল সকালে কি আপনার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল? হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
একটু পরে সাড়া এল। ঢুকেছিল। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
রিপোর্টারদের খবরের সোর্স বলা বারণ। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
লাইন কেটে গেল। বুঝলাম, বোকামি করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পরে হালদারমশাইকে ফোন করলাম। রিং হতে থাকল। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। টেলিফোনের গন্ডগোল অথবা হালদারমশাই কোথাও পাড়ি জমিয়েছেন। ভদ্রলোক রহস্য-অন্ত-প্রাণ যাকে বলে। হয়তো ইয়াজদার্গিদের হিরের খোঁজেই হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন।
রাত দশটায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম প্রতিদিনের মতো। রাজেন অধিকারীর কোনও রাইট-আপ বা আর্টিকল কেউ রিসেপশনে জমা দিয়ে যায়নি। সত্যি, মুখ ফসকে কথাটা বলা বোকামি হয়েছে। লোকটা সতর্ক হয়ে গেছে।
সল্টলেকে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে মাসখানেক হল উঠেছি। রাস্তা খাঁ খাঁ জনহীন। শীতের রাতে কুয়াশা জমে আছে গাছপালায়। হঠাৎ দেখি প্রায় তিরিশ মিটার দূরে একটা লোক রাস্তার মাঝখান দিয়ে আসছে। হর্ন দিয়েও তাকে সরানো গেল না। পাগল-টাগল হবে। তাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আবার সামনে এসে দাঁড়াল। দুটো ল্যাম্পপোস্টের মধ্যবর্তী জায়গা। দু-ধারে গাছ এবং ঝোপঝাড়। ব্রেক কষেই দেখি তার গায়ে নেভিব্লু সোয়েটার।
তারপর তার চেহারার দিকে চোখ গেল। ও কি মানুষ? ও কী মানুষ?
হালদারমশাইয়ের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে আমার গাড়ির সামনে এসে ঝুঁকে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, গাড়িটা সে দুহাতে উলটে ফেলে দেওয়ার মতলব করছে।
এক লাফে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। অমনই সে আমার দিকে এগিয়ে এল। অদ্ভুত জ্বলজ্বল নীলচে চোখে হিংস্রতার ছাপ।
মুহূর্তে কর্নেলের কথাটা মনে পড়ে গেল। আমাকে ধরার আগেই মরিয়া হয়ে আমি তার ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার কান দুটো ধরে মোচড় দিলাম। অমনই সে ধড়াস করে নেতিয়ে পড়ল। একেবারে চিৎপাত।
এরপর আর নার্ভ ঠিক রইল না আমার। সটান গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
ফ্ল্যাটে ফিরে প্রতিজ্ঞা ভুলে কর্নেলকে রিং করলাম। আমার হাত তখন কাঁপছিল। কর্নেলের সাড়া পেয়েই বললাম, এইমাত্র দানোটার পাল্লায় পড়েছিলাম। আপনার কথামতো–।
কানমলে জব্দ করেছ তো?
হ্যাঁ। সাংঘাতিক ব্যাপার। ভাগ্যিস আপনার পরামর্শটা মনে পড়েছিল। নইলে জামসিজ নওরোজির মতো হাড়গোড়-ভাঙা দলাপাকানো মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে থাকতাম। শীতের রাতে সল্টলেকের ব্যাপার তো জানেন। চেঁচিয়ে মাথা ভাঙলেও কেউ বেরিয়ে আসত না।
কর্নেলের হাসি শোনা গেল। বললেন, ডার্লিং! তোমার ওপর তো রাজেনবাবুর রাগ হওয়ার কথা নয়। উনি কাগজে প্রচার চান।
আমারই বোকামি। উনি বিকেলে ফোন করেছিলেন। বলে ঘটনাটা সবিস্তার জানিয়ে দিলাম।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বরাবরই বন্দি হন, সে তো জানো! এবারও মুখে টেপ-সাঁটা অবস্থায় বাথরুমে বন্দি ছিলেন। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা ছিল। দরজায় পাহারা দিচ্ছিল তোমার দেখা দানো আমার ভাষায় কৃত্রিম মানুষ। বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের সিন্থেটিক কফির মতো সিন্থেটিক ম্যানও বলতে পারো। তো তার পাল্লায় পড়ে আমারও বাঁচার কথা ছিল না। দৃশ্যটা কল্পনা করো জয়ন্ত! বাথরুম খোলা। হালদারমশাই পড়ে আছেন। দানোটা দরজার সামনে আমাকে দেখেই দু-হাত বাড়াল। জায়গাটা করিডরমতো। কয়েক হাত দূরে দোতলার সিঁড়ি। হঠাৎ দেখি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন এক ভদ্রলোক। মুখে শিশুর হাসি। দেখামাত্র বুঝলাম রাজেনবাবুর দাদা সেই পাগল ভদ্রলোক। মিটিমিটি হেসে চোখ নাচিয়ে চাপা গলায় বললেন, কান মলে দিন ব্যাটাচ্ছেলের! জব্দ হবে। ব্যস! দানোটা হাত বাড়াতেই আমি তার কান দুটো ধরে জোরে মলে দিলাম। কাজেই তোমাকে কান মলে দেওয়ার কথা বলে আসলে সতর্ক করেই দিয়েছিলাম।
থ্যাংকস বস! কিন্তু কালই পুলিশকে জানিয়ে দেননি কেন?
হালদারমশাই জানিয়েছিলেন। পুলিশ গিয়ে কোনও হদিস পায়নি। মাঝখান থেকে হালদারমশাই পুলিশের জেরায় জেরবার হয়েছেন।
উনি কোথায় আছেন? ফোনে পাচ্ছি না কাল থেকে।
দমদমে ওঁর সেই আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। আসলে রাজেনবাবুর বাড়ির দিকে সারাক্ষণ নজর রাখার জন্য ওখানে ডেরা পেতেছেন।
আমার নার্ভ বিগড়ে গেছে, বস! রাখছি।
সকালে চলে এসো। চন্দ্রকান্তবাবুর আসার কথা আছে।
যাব।
ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন অবস্থায় বসে রইলাম। কলকাতা মহানগরে এমন একটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক দানো ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কি বিশ্বাস করতে চাইবে?
সারাটা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়েছিলাম। একটু শব্দ হলেই চমকে উঠি। ওই ভয়ংকর দানোকে কোনও অস্ত্রেই জব্দ করা যাবে না। শুধু কান মললেই ব্যাটাচ্ছেলে কাত। কাজেই যদি সে রাতবিরেতে হানা দেয়, তার কান মলে দেওয়ার জন্যই জেগে থাকা দরকার।
শেষ রাতে কখন একটুখানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেটা জেগে ওঠার পর বুঝলাম। নিজের ওপর চটে গেলাম। ভাগ্যিস দানোটা ওত পাততে আসেনি।
যখন কর্নেলের তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে পোঁছোলাম, তখন প্রায় সাড়ে নটা বাজে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ভাষণ দিচ্ছেন এবং কর্নেল মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। ইশারায় আমাকে বসতে বললেন কর্নেল। ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল।
চন্দ্রকান্ত বলছিলেন, ক্লোনিং আর জেনোম এক জিনিস নয়। ক্লোনিং বলতে সাদা বাংলায় কলম করা। হাজার বছর আগেও মানুষ জেনেটিকস না জেনেও ক্লোনিং করেছে। এক জাতের উদ্ভিদের সঙ্গে আর এক জাতের উদ্ভিদ কিংবা এক জাতের প্রাণীর সঙ্গে আর এক জাতের প্রাণীর ক্লোনিং করেছে। কিন্তু আধুনিক জেনেটিকসের থিয়োরির অপব্যাখ্যা করে কেউ কেউ বলছেন, দেহকোষের ডি এন এ অণুতে কারচুপি করে মানুষকে গাধা করা যায়। কিংবা ধরুন, একই মানুষের অসংখ্য আদল গড়া যায়। হুবহু তারা এক। এভাবে অসংখ্য কর্নেল কিংবা এই চন্দ্রকান্ত চৌধুরী বাজারে ছাড়া যায়। কিন্তু আমি বলব, এটা বাড়াবাড়ি। এটা স্রেফ গুল। বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান। মশাই, মানুষ ইজ মানুষ! জেনোম থিয়োরি কখনও দাবি করছে না, মানুষকে গাধা কিংবা দানো বানানো যায়।
কর্নেল বললেন, সিন্থেটিক ম্যানের ব্যাপারটা বলুন চন্দ্রকান্তবাবু!
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। রাজেন অধিকারীর বাড়িতে অদ্ভুত ধ্বনিতরঙ্গ অ্যানালিলিস করে বুঝেছি, আমার তৈরি শ্রীমান ধুন্ধুর মতোই কোনও রোবোট আছে। কিন্তু সে রোবোট ধুন্ধুর চেয়ে বহুগুণে উন্নত। তার দেহ ধাতু দিয়ে তৈরি নয়।
কৃত্রিম হাড়-মাংস-চামড়া দিয়ে তৈরি!
ঠিক, ঠিক। চন্দ্রকান্ত নড়ে বসলেন। কিন্তু ওইসব জিনিসকে একেবারে কৃত্রিম বলতে দ্বিধা হচ্ছে। সম্ভবত মৃত মানুষের দেহকোষের ডি এন এ অণুতে কোনও প্রক্রিয়ায় কারচুপি করে হাড়-মাংস-রক্ত-চামড়া ইত্যাদি তৈরি করেছেন রাজেন অধিকারী। তারপর জোড়া দিয়ে একটা মানুষ গড়েছেন।
জেনোম প্রজেক্ট তা হলে সফল করতে পেরেছেন রাজেনবাবু?
বিজ্ঞানী চিবুকের দাড়ি চুলকে বললেন, সম্ভবত।
আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, কাল রাতে দানোটা আমাকে
হাত তুলে চন্দ্রকান্ত বললেন, শুনেছি। কিন্তু কান ধরলে কেন ও জব্দ হয় জানেন কি? আমার কাছে শুনুন। আপনাকে আমার সোনিম থিয়োরির কথা বলেছি। রাজেনবাবুর এই রোবটটিও ধ্বনিতরঙ্গের সাহায্যে চালিত হয়। কানই ধ্বনিতরঙ্গের একমাত্র গমনপথ। কাজেই ওর কান চেপে ধরলে রাজেনবাবুর রিমোট কনট্রোল থেকে পাঠানো ধ্বনিতরঙ্গ ওর ব্রেনে ঢুকতে বাধা পায়। তখন স্বভাবত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
কর্নেল বললেন আমার ধারণা, ওর কানের সঙ্গে কোনো সূক্ষ্ম রিসিভিং যন্ত্র ফিট করা আছে। কানে চাপ পড়লে কিছুক্ষণের জন্য সেটা অকেজো হয়ে যায়।
বললাম, রাজেনবাবুর দাদা বসন্তবাবু সেটা জানেন?
যেভাবে হোক, জানতে পেরেছেন। বলে কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজলেন।
কিন্তু সম্রাট ইয়াজদার্গিদের হিরের কোনও খোঁজ পেলেন না চন্দ্রকান্তবাবু? আপনার ডিটেক্টরে কোনও খোঁজ মেলেনি?
চন্দ্রকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। রাজেনবাবুর বাড়িতে কোনও হিরেটিরে নেই মশাই!
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবু! আপনার ওই যন্ত্রটি কতটা দূরত্বের পরিধি খুঁজতে পারে?
চারদিকে একশো মিটার পরিধির দূরত্ব খুঁজতে পারে।
ওপরের দিকে?
ভার্টিক্যালি? চন্দ্রকান্ত একটু হাসলেন। আমি হাত তুললে যতটা উঁচু হয়, ততদূর পর্যন্ত।
তার মানে দোতলার কিছু ডিটেক্ট করা যায় না আপনার যন্ত্রে?
নাহ। হাতে ওটা দেখলে ওঁর সন্দেহ হত কি না বলুন?
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাঁ। কে? হালদারমশাই নাকি? কোথা থেকে বলছেন? … কী আশ্চর্য! ওখানে কেন গেলেন? … বলেন কী! কাকে দেখেছেন? বসন্তবাবুকে? …হ্যাঁ, প্রচুর রহস্য।… হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছে। ওয়েট অ্যান্ড সি।…উইশ ইউ গুড লাক। রাখছি।
কর্নেল ফোন রেখে প্রথমে একচোট হাসলেন। তারপরে বললেন, হালদারমশাই গোপালপুর-অন-সি থেকে ট্রাংককল করে জানালেন, গত রাতে রাজেনবাবু এবং তার দানোটিকে ফলো করে হাওড়া স্টেশনে যান। তখন রাত প্রায় এগারোটা। মাদ্রাজ মেল ছাড়ার কথা রাত আটটা ৪৫ মিনিটে। আড়াই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। ওঁর ধারণা, রাজেনবাবু সে খবর জেনেই দেরি করে স্টেশনে যান। যাইহোক, গোয়েন্দামশাই ওঁদের ফলো করে গোপালপুর অন-সি-তে পৌঁছেছেন। উঠেছেন আমার বন্ধু স্মিথসায়েবের ওশান হাউসে। দোতলার বারান্দা থেকে এক পলকের জন্য নাকি সামনে বালিয়াড়িতে একটা ভাঙা ঘরের ভেতর বসন্তবাবুকে দেখেছেন। নেমে গিয়ে তার আর পাত্তা পাননি। এদিকে রাজেনবাবু উঠেছেন লাইটহাউসের ওদিকে ওবেরয় গ্র্যান্ডে। কাজেই–।
ওঁর কথার ওপর বললাম, প্রচুর রহস্য।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চোখ নাচিয়ে বললেন, চলুন কর্নেল! গোপালপুর অন-সি নিরিবিলি জায়গা। রাজেনবাবুর রোবটটিকে জব্দ করে জেনেটিক্সের মিস্ট্রি সলভ করা যাবে। এই চান্স ছাড়া উচিত নয়।
কর্নেল চোখবুজে দাড়িতে হাত বললেন, গেলে আপনাকে খবর দেব।
আমি উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, নওরোজি জানতে পেরেছিলেন, কে হিরে চুরি করেছে। তাই তাকে মরতে হল। এবার হালদারমশাইয়ের বরাতে সাংঘাতিক বিপদ ঘটে না যায়। আমাদের যাওয়া উচিত, কর্নেল!
হালদারমশাইকে কানমলার পরামর্শ দিয়েছি ডার্লিং! ভেবো না।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কিন্তু যাচ্ছি। বিজ্ঞানের এমন রহস্যময় আবিষ্কার হাতে-নাতে যাচাইয়ের চান্স ছাড়তে রাজি নই কর্নেল! গোপালপুর উপকূলের মতো সুনসান নির্জন জায়গা ভারতের কোনও সমুদ্র তীরে নেই। আমি রাজেনবাবুর অজ্ঞাতসারে রোবটটির ওপর পরীক্ষা চালাব।
উনি খুব জোরে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল ধ্যানস্থ। বললাম, চলি বস। আপনি ধ্যান করুন।
তবু কর্নেলের সাড়া নেই। অগত্যা মনে-মনে চটে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং বেরিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে একটা কাজে বেরোতে যাচ্ছি, কর্নেলের ফোন এল। জয়ন্ত! তৈরি হয়ে থাকো। আমি আধঘণ্টর মধ্যে যাচ্ছি।
কী ব্যাপার?
আমরা গোপালপুর-অন-সি রওনা হব।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। এইমাত্র ম্যাডানসায়েবের জামাই কুসরো এসেছিলেন। আজ ভোরবেলায় গোপালপুরে–অন-সি বিচে তার শ্বশুর ম্যাডানসায়েবকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশ ট্রাংককলে লালবাজারের থ্রু দিয়ে খবর দিয়েছে।
মার্ডার নাকি?
তা আর বলতে? তবে ঘাড় মটকে মারা হয়েছে।
সেই শয়তান রোবটটা! সেই দানো ব্যাটাচ্ছেলে!
তৈরি থেকো ডার্লিং! যাচ্ছি।
ফোন নামিয়ে রেখে দেখি, এই শীতে ঘাম দিচ্ছে। শরীর কাঁপছে। আবার সেই বিভীষিকার মুখোমুখি হওয়া কি ঠিক হবে? জীববিজ্ঞানী রাজেন অধিকারী যদি তাঁদের দানোর কানের বদলে এবার অন্য কোনও প্রত্যঙ্গে গোপনে রিসিভারযন্ত্র ফিট করে রাখেন?
.
০৪.
বাসে চেপে পুরী। পুরী থেকে ফের বাসে চিল্কা রেলস্টেশন। তারপর ট্রেনে গঞ্জাম জেলার বহরমপুর স্টেশন। সেখান থেকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে গোপালপুর-অন-সি-তে যখন পৌঁছোলাম, তখন রাত প্রায় দশটা। সমুদ্রের ব্যাকওয়াটারের দিকে স্মিথসায়েবের ওয়াশ হাউস। স্মিথসায়েব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। একসময় কলকাতার বন্দর অফিসে চাকরি করতেন। কর্নেলের পুরোনো বন্ধু।
বাড়ির নীচের তলায় উনি থাকেন। ওপরতলায় দুটো স্যুট। একটাতে হালদারমশায় আছেন।
আছেন, মানে ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে নেই। দরজায় তালা আঁটা। স্মিথসায়েব তার গেস্টদের ব্যাপারে নাক গলান না। তবে স্মিথসায়েবের মতে, এই গেস্ট ভদ্রলোক ছিটগ্রস্ত। কারণ আজই বিকেলে তাঁক বিচের মাথায় মুঘল আমলের ভাঙাচোরা পাথুরে বাড়িগুলির ভেতর সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। সন্ধের দিকে একবার তাকে বিচে জগিং করতেও দেখেছেন। স্মিথসায়েব ওঁর প্রতি বেজায় অখুশি।
স্মিথসায়েব গেস্টদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ওঁর পরিচারিকা মারিয়াম্মা আমাদের খাবার দিয়ে গেল। দেখলাম কর্নেল তার সুপরিচিত।
কর্নেল তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, পাশের ভদ্রলোক কি খেয়ে বেরিয়েছেন?
মারিয়াম্মা বলল, উনি বাইরে খান। কখন আসেন কখন যান, জানি না।
সে এঁটো থালাবাটি গুছিয়ে চলে যাচ্ছে, কর্নেল ডাকলেন, একটা কথা, মারিয়াম্মা!
বলুন স্যার!
আসার পথে শুনলাম নীচে নাকি কে খুন হয়ে পড়ে ছিল আজ?
মারিয়াম্মা বুকে ক্রস এঁকে ভয় পাওয়া গলায় বলল, সে এক বীভৎস দৃশ্য স্যার! শয়তান ছাড়া এ কাজ কার হতে পারে? মাথাটা মুচড়ে পিঠের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে গলার স্বর চাপা করল। জেলেবস্তিতে শুনেছি, গতকাল সন্ধ্যায় ওরা একটা অদ্ভুত পাখিকে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসতে দেখেছে। পাখিটার ডানা নাকি বিশাল। দক্ষিণে লাইটহাউসের ওধারে উঁচু বালির টিলা আছে। সেদিকেই পাখিটা এসে নেমেছিল। শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়।
মারিয়াম্মা চলে গেলে বললাম, মারিয়াম্মার গল্পটা বিশ্বাস করলেন?
কর্নেল দাড়ি নেড়ে চুরুটের ধোঁয়ার ভিতর বললেন, হ্যাঁ!
আমি পাখিটার কথা বলছি!
আমিও তা-ই বলছি।
গুল! বলে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কর্নেল এসবে বিশ্বাস করেন ভাবা যায় না।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে বললেন, হালদারমশাই পাখিটার পাল্লায় পড়লেন কিনা ভাবছি। এখনও ফিরলেন না। যাইহোক, একটু জিরিয়ে নিয়ে বেরোব।
এত রাতে কোথায় বেরোবেন?
কর্নেল হাসলেন! গোপালপুর অন-সি-তে শীতের তত উপদ্রব নেই। সমুদ্রতীরের আবহাওয়া সবসময় নাতিশীতোষ্ণ।
বাইরে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এই দোতলা থেকে সামনে বালিয়াড়ির নীচে সমুদ্র দেখা যায়। কুয়াশার আড়ালে সমুদ্র ঢাকা পড়েছে। ছেঁড়া ঘুড়ির মতো চাঁদটাকে অসহায় দেখাচ্ছে। মুঘল আমলের ভাঙচুর বাড়িগুলো কুয়াশামাখানো আবছা জ্যোৎস্নায় বড় বেশি ভূতুড়ে। বিচে ক্রমাগত ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। বাতাসে শীতের তীক্ষ্ণতা নেই। কিন্তু বিরক্তিকর।
বাঁদিকে বালিয়াড়িতে কালো লম্বাটে জিনিসগুলো দেখেই বুঝলাম জেলেদের ভেলানৌকো। সেখানে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। এত রাতে সামুদ্রিক শীতের হাওয়া খেতে কে বেরোল কে জানে!
একটু পরে মূর্তিটা সটান এসে এই বাড়ির নীচের রাস্তায় দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বললাম, হালদারমশাই নাকি?
তখনই ছায়ামূর্তিটা বাঁ দিকের রাস্তায় চলে গেল। তারপর একেবারে নিপাত্তা। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ঘরে ঢুকে দেখি, কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি কিছু বলার আগেই বললেন, চলো বেরোনো যাক।
দরজায় তালা এঁটে আমরা নেমে এলাম। রাস্তায় পৌঁছে সন্দেহজনক লোকটার কথা বললাম। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। খুব ভয়ে ভয়ে হাঁটছিলাম। কখন কোথায় দানোটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বলা যায় না। রাস্তা খাঁ খাঁ, জনহীন। ল্যাম্পপোস্টগুলো দূরে-দূরে। তাই কোথাও কোথাও জ্যোৎস্না-কুয়াশা-আঁধার মিলেমিশে আছে।
প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর বললাম, আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
কর্নেল সামনে আঙুল তুলে বললেন, ওই যে আলো জুগজুগ করেছ, ওখানে।
যেখানে পৌঁছেছি, সেখানটা কাঁচা রাস্তা। বালিতে ভর্তি। দু-ধারে ঝোপঝাড়। কিছু উঁচু গাছ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের হাতে টর্চ আছে। কখনও পায়ের সামনে আলো ফেলছে। হঠাৎ একটা ছোট্ট ঢিল এসে আমার গায়ে লাগল। ভীষণ চমকে উঠে বললাম, কর্নেল! কে ঢিল ছুঁড়ছে।
কর্নেল বললেন, ভূত! চলে এসো।
কী আশ্চর্য! সত্যি ঢিল ছুঁড়ল যে!
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার পর-পর কয়েকটা ছোট্ট ঢিল এসে পড়ল। কর্নেল টর্চের আলো ফেলামাত্র ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হল। কেউ কোথাও নেই। অথচ কে ঢিল ছুঁড়ছে রাতদুপুরে? কর্নেল চারদিকে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, দৌড়োতে হবে। কুইক!
কর্নেল সত্যি দৌড়োতে শুরু করলেন। আমিও ভ্যাবাচাকা খেয়েও ওঁকে অনুসরণ করলাম। এই সময় পেছনে কোথাও খিখিখিখি… হিহিহিহি… হোহোহোহো…এই ধরনের বিকট হাসি শোনা গেল।
কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে কর্নেল দাঁড়িয়ে গেলেন। বললাম, কী অদ্ভুত–
ভূত! কর্নেল হাঁসফাঁস করে বললেন, রোসো! মিনিট দু-তিন জিরিয়ে নিই। বাপস! বালিতে দৌড়োনো সহজ নয়।
কিছুক্ষণ পরে সেই আলোর কাছে পৌঁছে দেখি, গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ি এবং গেটে সঙিনধারী পুলিশ। বুঝলাম থানায় এসেছি।
দুজন অফিসার একটা ঘরে বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখেই এক গলায় সম্ভাষণ করলেন, হাই ওল্ড বস!
আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর জানলাম একজন সি আই ডি ইনস্পেকটার সুখরঞ্জন দাস, অন্যজন অফিসার-ইন-চার্জ জগপতি রাউত। দুজনেই চমৎকার বাংলা বলেন। সুরঞ্জনবাবু বললেন, দেরি দেখে ভাবছিলাম ওশান হউসে গিয়ে খোঁজ নিই! কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
কর্নেল বললেন, নাহ, চমৎকার এসেছি।
জগপতিবাবু বললেন, আমি বহরমপুর-গঞ্জাম স্টেশনে জিপ পাঠাতে চেয়েছিলাম। মি. দাস নিষেধ করলেন। আপনি নাকি পুলিশের জিপে চাপা পছন্দ করেন না!
জগপতিবাবু হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, কখনও কখনও করি না। ওতে আমার কাজের অসুবিধে হয়। যাইহোক, মি. দাস, সেই চিঠিটা দেখতে চাই।
সুখরঞ্জনের ইশারায় জগপতিবাবু দেওয়ালে আঁটা আয়রনচেস্ট থেকে একটা ফাইল বের করলেন। ফাইলের ভেতর একটা কাগজে সাঁটা অজস্র কুচি এবং কুচিগুলোতে কিছু লেখা আছে। কর্নেল ঝুঁকে গেলেন। ইতিমধ্যে তাঁর হাতে আতশকাচ বেরিয়ে এসেছে।
সুরঞ্জনবাবু বললেন, কুচিগুলো ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের ওদিকে নীচু জমিতে পড়ে ছিল। শিশিরে অধিকাংশ চুপসে গেছে। আর পড়ার উপায় নেই। আমি যেভাবে জোড়াতালি দিয়েছি, তা ভুল হতেই পারে। তবে মোটামুটি এটুকু বোঝা যায়, কেউ ম্যাডানসায়েবকে এখানে আসতে বলেছিল। হাতের লেখা হিজিবিজি। তাছাড়া ইংরেজি বানানও ভুল।
জগপতি বললেন, ঠিক তাই। ভদ্রলোককে মার্ডার করার জন্যই ডেকেছিল। জুয়েল ফেরত দেওয়াটা ছল।
বুঝলাম, এঁরা সম্ভবত কেসটা জানেন। বললাম, কিন্তু ঘাড় মটকে খুন সম্পর্কে আপনাদের ধারণী কী?
জগপতি হাসলেন। ভূতের কীর্তি বলে রটেছে। তাছাড়া আগের রাতে নাকি প্রকাণ্ড একটা পাখি সমুদ্র থেকে উড়ে আসতে দেখেছে জেলেরা। তবে মর্গের রিপোর্টে বলছে, সত্যি কতকটা ঘাড় মটকে– মানে মুন্ডুটা মুচড়ে ঘুরিয়ে খুন করেছে। প্রকাণ্ড জোর আছে খুনির গায়ে।
বললাম, তা হলে–।
এবার বাধা দিলেন কর্নেল! রুষ্টভাবে বললেন, প্লিজ জয়ন্ত! এখন কোনও প্রশ্ন নয়।
চুপ করে গেলাম। একটু পরে কর্নেল ফাইলটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মি. দাস। কাল সকালে, ধরুন আটটা নাগাদ আমি সি-বিচে অপেক্ষা করব। আপনি আমাকে দেখিয়ে দেবেন, কোথায় ম্যাডানসায়েবের বডি পড়ে ছিল।
সুখরঞ্জনবাবু বললেন, অবশ্যই। আর আপনি বলেছিলেন গ্র্যান্ডে গত তিনদিনের আবাসিকদের লিস্ট দিতে। এই নিন। এতে আপনার বলা নামের কেউ নেই। একুশ নম্বর ডাবলস্যুটে দুজন ভারতীয় আছেন। একজন অবাঙালি মুসলিম মইনুদ্দিন আমেদ এবং অন্যজন তার গোয়ানিজ বন্ধু পিটার নাজারেথ। দুজনেই চামড়াব্যবসায়ী। নাজারেথ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শয্যাশায়ী অবস্থা।
আমেদের মুখে দাড়ি আছে কি?
আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিম। মাথায় টুপি। পরনে শেরোয়ানি-চুস্ত। সুখরঞ্জনবাবু আমাদের বিদায় দিতে এলেন। গেটের কাছে এসে বললেন, আপনার সন্দেহভাজন লোক দুটো এখানকার কোনও হোটেলে ওঠেনি। তন্নতন্ন খোঁজা হয়েছে। তবে কারও বাংলো বা বাড়িতে খুঁজতে সময় লাগবে! আবার এমনও হতে পারে, তারা ম্যাডানসায়েবকে খুন করেই চলে গেছে।
আমাদের হালদারমশাইয়ের খবর নিয়েছেন?
আজ দুপুরে থানায় এসেছিলেন। আপনি আসছেন কি না জানতেই এসেছিলেন। কিন্তু উনি তো ওশান হাউসেই আছেন?
আছেন। তবে দেখা হয়নি। ওঁর সম্পর্কে আমার দুর্ভাবনা আছে, মি. দাস! খুব অ্যাডভেঞ্চার প্রবণ মানুষ। কোনও বিপদে না পড়েন?
সুখরঞ্জনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কথাবার্তা হাবভাবেই সেটা বুঝেছি। আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, রিটায়ার করেই যেন কলকাতা চলে যাই এবং ওঁর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢুকি।
সুখরঞ্জনবাবু চলে গেলেন। এবার কর্নেল অন্য রাস্তায় এগোলেন। এটা পিচমোড়া সুন্দর রাস্তা। দু-ধারে ল্যাম্পপোস্ট। কর্নেল বললেন, ওই রাস্তাটা শর্টকাট ছিল। এই রাস্তায় ওশান হাউস অনেকটা দূর। কিন্তু উপায় নেই ডার্লিং! এই শীতের রাতে ভূতের ঢিল খেতে আমার আপত্তি আছে।
বললাম, ভূত-টুত নয়। রাজেনবাবু সেই দানোকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন! আমাদের ছাই করে দিতে পারেন।
আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ! তা হলে বড্ড বেশি ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে যে?
কর্নেল হাসলেন। তা হচ্ছে। চিন্তা করো, ম্যাডানসায়েবের বাড়ির মাটির তলার ঘরে লুকোনো ইস্পাতের ভল্ট গলিয়ে হিরে চুরি! তাছাড়া লেসারঅস্ত্র দূর থেকে প্রয়োগ করা যায়। দানোটা তোমাকে কানমলার সুযোগই দেবে না।
হেসে ফেললাম। ভ্যাট! হেঁয়ালি করা আর ভয় দেখানো আপনার স্বভাব।
হঠাৎ কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, স্বভাব কী বলছ জয়ন্ত! ওউ দ্যাখো, গাছের আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কুইক! আমরাও লুকিয়ে পড়ি।
রাস্তার দু-ধারে গাছ এবং ঝোপঝাড়। মাঝে-মাঝে একটা করে বাংলোবাড়ি। কর্নেল আমাকে টেনে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলেন। গুঁড়ি মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলাম দুজনে। আমি কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি।
এক সময় কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তেমনই চাপা স্বরে বললেন, চলো!
রাস্তায় গিয়ে বললাম, কোথায় লোক দেখলেন?
কর্নেল বললেন, ওই দ্যাখো, চলে যাচ্ছে!
আন্দাজ তিরিশ মিটার দূরে রাস্তার বাঁকে একটা আবছা মূর্তি সদ্য মিলিয়ে যাচ্ছে। হন্তদন্ত হেঁটে বাঁকে পৌঁছে দেখি, আবছা মৃর্তিটা যেন হাঁটছে না। রাস্তার ওপর ভেসে যাচ্ছে।
সে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, কপালে দুর্ভোগ আছে ডার্লিং! আবার বালি আর জঙ্গল ভাঙতে হবে। একটা বালির টিলা ডিঙোতেও হবে। এসো।
পা বাড়িয়ে বললাম, ও কে?
সেই দানোটা বলেই মনে হল। হুঁ, তুমি ঠিকই বলেছিলে। বড্ড বেশি ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তবে ঝুঁকি নেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ম্যাডানসায়েবকে মেরে রাজেন অধিকারী গোপালপুর-অন-সি ছেড়ে চলে যায়নি এটা জানা গেল। কিন্তু কেন যায়নি, সেটাই রহস্য। এটা জানা গেলেই রহস্যের সমাধান হবে। এমনকী, ইয়াজদার্গিদের হিরেও সম্ভবত উদ্ধার করতে পারব।
বালিয়াড়ি, জঙ্গল এবং একটা আস্ত বালির পাহাড় ডিঙিয়ে সমুদ্রের বিচে পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। তারপর ওশান হাউসে যখন পৌঁছোলাম, তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। পা নাড়তেই যন্ত্রণা কটকট করে উঠছে।
হালদারমশাইয়ের স্যুটে তেমনই তালা আঁটা। ফেরেননি। কোনওরকমে জুতো খুলে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। অভ্যাসমতো প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মুচকি হেসে বললেন, যেভাবে ঘুমোচ্ছিলে, দানোটা এসে তোমার ঘাড় মটকাবার চমৎকার সুযোগ পেত।
বললাম, আপনি যেভাবে মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন, আপনারও ঘাড় মটকানোর সুযোগ ছিল।
দেখা যাচ্ছে, সে এসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে না।
কিন্তু গত রাতে সে গাছের আড়ালে ওত পেতে দাঁড়িয়েছিল!
কর্নেল প্রজাপতি ধরা জাল ঝেড়েমুছে গুটিয়ে রাখছিলেন। বললেন, আমাদের জন্য ওত পাততে যায়নি। জায়গাটা দেখে এলাম। ওড়িশার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর বাংলোবাড়ির কাছে সে দাঁড়িয়েছিল। ওই বাড়িতে এমনই কেউ আছে, যার ঘাড় মটকাতে গিয়ে থাকবে। কোনও কারণে সে সুযোগ পায়নি। তাই তাকে রাজেন অধিকারী সরিয়ে নিয়েছে, কিংবা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। হ্যাঁ- রিমোট কনট্রোলের সাহায্যেই।
সায় দিয়ে বললাম, ঠিক বলেছেন। দানোটা গুলতির বেগে যেন ভেসে যাচ্ছিল।
বাথরুম সেরে এসে দেখি, মারিয়াম্মা ব্রেকফাস্ট এনেছে। খেতে বসে কর্নেল বললেন, বাংলোবাড়িটার দরজায় তালা। পরে খোঁজ নেব, কে আছে ওখানে। প্রাক্তন মন্ত্রী ভদ্রলোক কদাচিৎ আসেন শুনলাম। এলে ওঁর লোকজনও সঙ্গে থাকে। কেউ নেই। সম্ভবত ওঁর কোনও পরিচিত লোক এসে থাকবে। তবে সে যে-ই হোক, তাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।
হালদারমশাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল এতক্ষণে। বললাম, হালদারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?
কর্নেল গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন। তখনই উঠে গিয়ে দেখে এলাম, ওঁর স্যুটের দরজায় তেমনই তালা আঁটা। অজ্ঞাত ত্রাসে বুকটা ধড়াস করে উঠল।
কিছুক্ষণ পরে সি আই ডি ইনস্পেকটার সুরঞ্জনবাবু এসে গেলেন। আমরা সামনের বালিয়াড়ি পেরিয়ে গেলাম। বিচে তত কিছু ভিড় নেই। বিচ ধবে প্রায় আধ কিমিটাক হাঁটার পর লাইটহাউসে ছাড়িয়ে গিয়ে বালির একটা টিলার কাছে পৌঁছোলাম। সুরঞ্জনবাবু দেখিয়ে দিলেন, কোথায় ম্যাডানসায়েবের মৃতদেহ পড়ে ছিল।
কর্নেল বাইনোকুলারে বালির বিশাল টিলাগুলো দেখছিলেন। হঠাৎ হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। তারপর টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। আমরা ওঁকে অনুসরণ করলাম। টিলার মাথায় উঠে কর্নেল বললেন, ম্যাডানসায়েবের জুতোর ছাপ কিনা জানি না। তবে ছাপগুলো লক্ষ্য করুন মি. দাস! পশ্চিমদিকের ঢাল থেকেই ছাপগুলো উঠে এসেছে। ওই দেখুন। স্বাভাবিক চড়াইয়ে ওঠার ছাপ। ওদিকে বালিটা জমাট। এই টিলার মাথায় আসার পর বিচের দিকে নেমে যাওয়া ছাপগুলো দেখুন। বিচের দিকটা ঢালু। বালি নরম। ক্রমশ স্টেপিংয়ের দূরত্ব বেড়েছে। ছাপও গম্ভীর হয়েছে। বাঁ দিকে কোনাকুনি নেমে গেছে ছাপগুলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভদ্রলোক দৌড়ে নেমেছিলেন। কিন্তু বাঁ দিকে কোনাকুনি কেন? চুড়োয় এসে নীচে বাঁদিকে কি কাউকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন?
কর্নেল বাইনোকুলারে ডান দিকটা দেখে এগিয়ে গেলেন। বললেন, এই যে! এখানে কেউ, দাঁড়িয়েছিল। মাই গুডনেস! সে একলাফে প্রায় তিরিশ ফুট নীচে পড়েছে। ওই দেখুন গভীর দুটো ছাপ কর্নেল নেমে গেলেন হন্তদন্ত। আবার খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ডেডবডির দূরত্ব এখান থেকে আরও তিরিশ ফুট। জোয়ারের জল ওখান পর্যন্ত আসে না। তার মানে, সে দ্বিতীয় লাফে ম্যাডানসায়েবকে ধরে ফেলেছে। অস্বাভাবিক লং জাম্প!
সুখরঞ্জনবাবু ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, অসম্ভব! একেবারে অসম্ভব।
.
০৫.
রাজেন অধিকারীর দানোটার কথা বলার জন্য উশখুশ করছিলাম। কিন্তু কর্নেলের হাবভাব আঁচ করেছি, পুলিশকে তিনি হাতের তাস দেখাতে চান না। অবশ্য বরাবর তার এই স্বভাব।
সুখরঞ্জনবাবু বললেন, কর্নেল! আপনার এই থিয়োরিটা কিন্তু মানতে পারছি না। যে তিরিশ ফুট লং জাম্প দিতে পারে, সে অলিম্পিকের মেডেল জেতা খেলোয়াড়। আপনি কি বলতে চাইছেন খুনি কোনও খেলোয়াড়?
কর্নেল বাইনোকুলারে দূরে বিচের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, চলুন ফেরা যাক। তারপরে হাঁটতে-হাঁটতে ফের বললেন, খেলোয়াড় বইকি। মি. দাস, আমরা এক সাংঘাতিক খেলোয়াড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী।
সুখরঞ্জনবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু পরে ঘড়ি দেখে বললেন, আমাকে এখনই এক জায়গায় যেতে হবে। পরে যোগাযোগ করব’খন।
উনি চলে যাওয়ার পর আমরা বিচ ধরে হাঁটছিলাম। ডাইনে সমুদ্রে এখানে-ওখানে কালো-কালো ছোটোবড়ো পাথর দেখা যাচ্ছে। ঢেউয়ে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। মুহুর্মুহু ব্রেকারের গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। চাপ চাপ ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিচের মাথার পাথরে তৈরি ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ। প্রকাণ্ড সব পাথরের চাঙড় বিচে এসে পড়েছে। একটা ভাঙা ঘরে জানালায় কাউকে উঁকি মারতে দেখলাম। গোলগাল মুখ। মুখে কেমন একটা হাসি। হঠাৎ মুখটা চেনা মনে হল। তখনই মনে পড়ে গেল, রাজেনবাবু বাড়ির দোতলার জানালায় এই মুখটাই দেখছিলাম। দ্রুত বললাম, কর্নেল! কর্নেল! ওই দেখুন সেই বসন্তবাবু। রাজেনবাবুর দাদা।
কর্নেল বললেন, দেখেছি। ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাও কি?
ওঁর কাছে জানা দরকার, উনি এখানে কেন এসেছেন।
চলে যাও তা হলে।
আপনিও চলুন!
কর্নেল হাসলেন। ডার্লিং! আমি পাগলকে বড্ড ভয় করি, সে তো তুমি জানো! তুমি ইচ্ছে করলে ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারো। যাও, চলে যাও!
তীব্র কৌতূহলের চাপে পড়েই পাথরের চাঙড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। ওপরে উঠে সেই ভাঙা পাথুরে ঘরটার দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলাম। কিন্তু জানলায় দেখা সেই মুখটা নেই।
ভেতরে উঁকি মেরে কাউকে দেখতে পেলাম না। ঘরগুলো বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফাঁকা জায়গা দিয়ে এগিয়ে চারদিকে তন্নতন্ন খুঁজে আর বসন্তবাবুর পাত্তা পেলাম না। সবখানে বালির স্তূপ। পোড়া পোড় ঘরগুলোর মেঝেও বালিতে ভর্তি। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ওধারে পিচ-রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। রাস্তায় গিয়ে একপলকের জন্য দেখলাম, বসন্তবাবু ওপাশের একটা পোড়ো জমির পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেলেন। পাগলের পেছনে দৌড়োনোর মানে হয় না।
বিচে ফিরে গিয়ে কর্নেলকেও দেখতে পেলাম না। অদ্ভুত মানুষ তো!
খানিকটা হেঁটে জেলেদের ভেলানৌকোর কাছে পৌঁছোলাম। উঠে গিয়ে ওশান হাউস চোখে পড়ল। সেখানে গিয়ে দেখি নীচের বারান্দায় বসে স্মিথসায়েব হোমিয়োপ্যাথির ওষুধ বিলোচ্ছেন। একতঙ্গল গরিবগুরবো চেহারার রুগি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে স্মিথ-সায়েব সম্ভাষণ করলেন, গুড মর্নিং?
মর্নিং মি. স্মিথ! কর্নেলসায়েব কি ফিরেছেন?
ফিরলে দেখতে পেতাম।
মি. হালদার?
স্মিথ উদ্বিগ্নমুখে বললেন, না। আমি চিন্তিত মি. চৌধুরী। পুলিশকে খবর দিয়েছি।
আমার ঘরের চাবি কর্নেলের কাছে। ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় স্মিথসায়েবের কাছে আছে। কিন্তু ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। আবার বিচে ফিরে গেলাম। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চমৎকার সময় কাটানো যায়। এদিকটা একেবারে খাঁ খাঁ জনহীন। জেলেবস্তির ছোট্ট ছেলেমেয়ের দঙ্গল খানিকটা দূরে সমুদ্রে নেমেছ। ওটাই ওদের খেলা। কেউ কেউ জলের ভেতর উঁচিয়ে থাকা পাথরেও উঠেছে। ওদের ভয় করছে না?
নিশ্চয় করছে না। সমুদ্র ওদের আপনজন। সমুদ্র ওদের লড়াই করে বেঁচে থাকতে শেখায়। ওরা যেন সমুদ্রের পাঠশালার পড়ুয়া।
কতক্ষণ পরে আনমনে ডানদিকে মুঘল আমলের ভাঙা কুঠিবাড়িগুলোর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল একটা মাথা উঁকি মেরে এগোচ্ছে। স্তূপের আড়াল দিয়ে কেউ গুঁড়ি মেরে কোথাও চলেছে। একটু পরে আর তাকে দেখা গেল না। মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বসন্তবাবু নন তো?
বালি ও ধ্বংসস্তূপ এবং ভাঙা ঘরের ফোকর গলিয়ে সাবধানে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ঘরের বালিতে পড়ে থাকা একটা কাগজের চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুটটা পড়ে নেই আসলে। একটুকরো পাথর চাপা দেওয়া আছে এক কোনায়।
চিরকুটটা তুলে দেখি, আঁকাবাঁকা ইংরেজি হরফে যা লেখা আছে, তার মানে দাঁড়ায় :
আজ রাত দশটায় এখানে আসুন। দেখা হবে।
হালদারমশাইয়ের ভাষায় প্রচুর রহস্য। ঝটপট ভেবে নিয়ে চিঠিটা সেই অবস্থায় রেখে দিলাম। তারপর তেমনই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে খানিকটা তফাতে একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে বসে রইলাম। এখান থেকে ওই ঘর এবং নীচের বিচ মোটামুটি চোখে পড়ে।
এমন ভঙ্গিতে বসেছিলাম, কেউ দেখলে ভাববে, নিছক সমুদ্রদর্শন করছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে বিচের দিক থেকে একটা লোককে উঠে আসতে দেখলাম। প্রথমে তাকে সায়েব ভেবেছিলাম। পরে দেখি খাঁটি সায়েব নয়। তবে কতকটা সায়েব-সায়েব গড়ন। লম্বা নাকটা দেখার মতো। পরনে জিনস-জ্যাকেট। মাথায় রোদ-বাঁচানো টুপি। বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্রিশ মনে হল।
লোকটা সেই ঘরের কাছে এসে চাপা গলায় কাকে ডাকল, হ্যালো।
বারকতক ডাকার পর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। তারপর ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ল।
আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। হন্তদন্ত ছুটে গিয়ে সেই ঘরের ফোকরের সামনে দাঁড়ালাম। লোকটা চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে ইংরেজিতে বলল, এই পাথরের বাড়িগুলো ভারি অদ্ভুত। কে তৈরি করেছিল জানেন কি?
চার্জ করার ভঙ্গিতে বললাম, কে আপনি?
ট্যুরিস্ট, আশা করি আপনিও ট্যুরিস্ট?
তার কথায় কান না করে বললাম, ওখানে একটা চিঠি ছিল, চিঠিটা নিতেই কি আপনি এসেছেন?
চিঠি! কী বলছেন আপনি?
ঠিক বলছি। চিঠিটা আমি দেখেছি। আপনি সেটা নিয়েছেন। এবার বলুন কে আপনি?
পেছন থেকে কর্নেলের কথা ভেসে এল। সাবধান ডার্লিং! সেই দানোর কথা ভুলো যেয়ো না।
শোনামাত্র ভ্যাবাচাকা খেয়ে একলাফে লোকটার কান ধরতে গেলাম। লোকটাও একলাফে সরে গেল। কর্নেল এসে অট্টহাসি হেসে বললেন, সেমসাইড হয়ে যাচ্ছে জয়ন্ত! আলাপ করিয়ে দিই, ইনি ম্যাডানসায়েবের জামাই মি. কুসরো। আর মি. কুসরো! আমার স্নেহভাজন বন্ধু সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী মাঝে-মাঝে অতুৎসাহী হয়ে পড়ে। আসলে এটা ওর ভয় পাওয়ারই প্রতিক্রিয়া!
কুসরো হেসে ফেললেন। সত্যি বলতে কি, আমি ভয় পেয়েছিলাম। যাই হোক, সেই ভদ্রলোক আমার জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। এই দেখুন।
কর্নেল চিঠিটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, এটা আমার কাছে থাক। রাত নটা নাগাদ ওশান হাউসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর সব ব্যবস্থা হবে। আপনি বরং নীচের দিকে না গিয়ে সদর রাস্তা ধরে বাংলোয় যান। সাবধানে যাবেন।
কুসরো তখনই ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে চলে গেলেন। বললাম, শ্বশুর চিঠির ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এবার জামাইকেও চিঠির ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। ব্যাপারটা এই তো?
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, তখন বসন্তবাবুকে কোথায় হারিয়ে ফেললে?
রাস্তার ওধারে। তো মি. কুসরো কি শ্বশুরের ডেডবডি নিতে এসেছেন?
হ্যাঁ। ওঁর বাবার বন্ধু এক প্রাক্তন মন্ত্রীমশাই। তার সাহায্যে আর্মির হেলিকপ্টারে ম্যাডানসায়েবের বডি সকালেই কলকাতা পাঠনো হয়েছে। কুসরো যাননি। মানে, কলকাতায় উনি যখন আমাকে ফোন করেন, তখন আমি ওঁকে একটা দিন থেকে যেতে বলেছিলাম। তবে জানতাম না, কুসরো মন্ত্রীমশাইয়ের বাংলোয় উঠেছেন। উঠে অবশ্য ভালোই করেছেন। কারণ আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চৌধুরীর সান্নিধ্যে থাকলে উনি নিরাপদ।
অবাক হয়ে বললাম, ওই বাংলোতে চন্দ্রকান্তবাবুও উঠেছেন নাকি?
হ্যাঁ। চলো, চন্দ্রকান্তবাবুকে ওশান হাউসে বসিয়ে রেখে এসেছি।
বুঝলাম, আমি যখন বসন্তবাবুর পেছনে ছুটছিলাম, তখন কর্নেল আমাকে ফেলে সেই বাংলোয় চলে গিয়েছিলেন। তাই ওঁকে আর দেখতে পাইনি। কিন্তু হঠাৎ ওভাবে চলে না গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন। কেন করেন নি? এমনকী ঘটেছিল যে, প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের বাংলোর দিকে ছুটে গিয়েছিলেন?
যেতে-যেতে কথাটা তুললাম। কর্নেল বললেন, বাইনোকুলারে দেখেছিলাম, বিজ্ঞানী ভদ্রলোক ওঁর ডিটেক্টর যন্ত্র নিয়ে ব্যাকওয়াটারের ওদিকে ঘুরঘুর করছেন। কাজেই ওঁর কাছে না গিয়ে পারলাম না। হ্যাঁ, গত রাতে দানোটা বাংলোয় ঢুকতে পারেনি। বিজ্ঞানীর কারবার! মারাত্মক কী অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে নাকি বাংলোটা ঘিরে রেখেছিলেন।
কিন্তু হালদারমশাইয়ের কী হল?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, জানি না।
ওশান হাউসের দোতলায় আমাদের স্যুটে ঢুকে দেখি, বিজ্ঞানীপ্রবর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছেন। কারণ ওঁর নাক ডাকছে। আমি যেই চন্দ্রকান্তবাবু বলে ডেকেছি, আমনিই তড়াক করে সোজা হলেন এবং বললেন, হিরে আছে! শিয়োর!
হাসতে-হাসতে বললাম, স্বপ্ন দেখছিলেন বুঝি?
চন্দ্রকান্ত চোখ কচলে বললেন, সরি! সারারাত ঘুমোইনি। ঘুমোনো দরকার। বলে আমার দিকে তাকালেন। হ্যালো জয়ন্তবাবু! আসুন, আসুন। আপনার কথা ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
কেন বলুন তো?
হিরেটা উদ্ধার হয়ে গেলে আপনাকে একটা রোমহর্ষক স্টোরি দেব। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় বেরোলে হইচই পড়ে যাবে। আমার মাথা তো গুলিয়ে গেছে মশাই। ভাবা যায়? হিরেতে এক ধরনের রশ্মি আছে, যা প্রাণীর দেহকোষের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। হিরে ঠিক যেভাবে কাচ কাটতে পারে, সেইভাবে হিরের সেই বিস্ময়কর রশ্মিপ্রবাহ ডি এন এ অণুতে কেটেকুটে– চন্দ্রকান্ত হঠাৎ কথা থামিয়ে ফিক করে হাসলেন।
কর্নেল আতশকাচ দিয়ে চিঠিটা দেখতে ব্যস্ত। আমাদের কথা দিকে ওঁর কান নেই।
বললাম, চন্দ্রকান্তবাবু! আপনি বললেন, হিরে আছে। কোথায় আছে?
চন্দ্রকান্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, এখানেই।
এখানেই মানে? গোপালপুর-অন-সি-তে?
শিয়োর। ওই ব্যাকওয়াটারের কাছাকাছি কোথাও লুকোনো আছে। ডিটেক্টরে সাড়া পেয়েছি কিন্তু ঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারছি না, এটাই সমস্যা।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে বললাম, হিরেটা এখানে এল কী করে? আনল কে? কেনই বা আনল?
চন্দ্রকান্ত চিবুকের দাড়ি খুঁটতে-খুঁটতে বললেন, তা জানি না মশাই! কর্নেল ওসব রহস্য জানেন বলেই আমার ধারণা।
কর্নেল চিঠিটা পকেটস্থ করে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবু! মি. কুসরো বাংলোয় ফিরে গেছেন। লাঞ্চের সময় হয়ে এল। উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করবেন।
বিজ্ঞানী তখনই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, হ্যাঁ চলি! আমার একটা লম্বা ঘুমও দরকার।
উনি চলে গেলে বললাম, প্রাক্তন মন্ত্রী ভদ্রলোক কি চন্দ্রকান্তবাবুর পরিচিত?
পরিচিত না হলে চন্দ্রকান্তবাবু ওখানে উঠবেন কেন? বাংলোটা বেশ বড়ো। অনেক ঘর। কাজেই প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের পক্ষে তার একাধিক প্রিয়জনকে ঠাঁই দেওয়ার অসুবিধে নেই। কেয়ারটেকার গোমস তার প্রিয়জনদের সেবার জন্য বহাল রয়েছে। বলে কর্নেল উঠলেন। তুমি কি স্নান করবে? আমি বলি, বরং সমুদ্রে স্নান করে এসো। স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
আঁতকে উঠে বললাম, মাথাখারাপ? এখানকার সমুদ্র মানুষখেকো। সবসময় হাউমাউখাঁউ করে চ্যাঁচাচ্ছে। জলের ভেতর পাথরগুলো যেন সমুদ্রের দাঁত। বুঝলেন তো? পেলেই পাথরের দাঁতে চিবিয়ে গিলে ফেলবে।
তা হলে সুইচ টিপে মারিয়াম্মাকে ডাকো। গরম জল করে দেবে। আমি তো সপ্তাহে একদিন স্নান করি। আজ আমার স্নানের দিন নয়।
দুপুরের খাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস। পুরোনো বাংলায় একে বলে ভাতঘুম। কিন্তু কর্নেল বাদ সাধলেন। বললেন, এখনই মিলিটারির জিপ আসবে। তৈরি থাকো।
মনে পড়ে গেল, এখানে সেনাবাহিনীর একটা ঘাঁটি আছে। ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এখানে এসেছেন একটা রহস্যের সমাধনে। কিন্তু এসেই কখন সেনাবাহিনীর কোনও স্নেহভাজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন দেখা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে মিলিটারি জিপে আমরা যেখানে পৌঁছোলাম, সেটা উঁচুতলার অফিসারদের কোয়ার্টার এলাকা। বাংলোবাড়ি এবং সুদৃশ্য লন, ফুলবাগিচা। একটা বাংলোর লনে ঘাসের ওপর চেয়ারটেবিল পেতে একজন শিক সামরিক অফিসার পাইপ টানছিলেন। কর্নেলকে দেখে এগিয়ে এসে সম্ভাষণ করলেন। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনিও এক কর্নেল। কর্নেল পরমজিৎ সিং।
পরমজিৎ বললেন, পুরোনো ক্যানটিং-রেকর্ডে আপনার দেওয়া নামটা পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, ভদ্রলোক সোলজার্স ক্যানটিনে ফুড সাপ্লায়ার ছিলেন।
কর্নেল বললেন, ওশান হাউসের মি. মিথের কাছে কথায়-কথায় জানতে পারি, এই নামের ভদ্রলোক একসময় এখানে ছিলেন। ফুড কনট্রাক্টরি করতেন। ধন্যবাদ কর্নেল সিং। অসংখ্য ধন্যবাদ!
বেয়ারা কফি রেখে গেল। কফি খেতে-খেতে পরমজিৎ একটু হেসে বললেন, কিন্তু এবার যে রহস্যটা জানতে ইচ্ছা করছে কর্নেল সরকার? বুঝতে পেরেছি আপনার এবারকার গোপালপুর–অন-সি-তে আসার উদ্দেশ্য সেই বিরল প্রজাতির জগন্নাথ প্রজাপতি ধরা নয়, আমাদের একজন প্রাক্তন ফুড সাপ্লায়ারকে ধরা। কিন্তু রেকর্ডে ওঁর বিরুদ্ধে তো কিছুই নেই। অসুস্থতার জন্য কারবার গুটিয়ে কলকাতা ফিরে যান। উনি কি সেই জুয়েলার ম্যাডানসায়েবের মার্ডার কেসে জড়িয়ে পড়েছেন?
কর্নেল জোরে মাথা নাড়লেন।না, না! উনি অত্যন্ত সদাশয় পরোপকারী মানুষ।
তা হলে ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন, শুনি।
যথাসময়ে জানাব।
এরপর দু জনে সামরিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। আলাপ এবং কফি খাওয়া শেষ হলে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি কর্নেল সিং! পরে দেখা হবে। একটু তাড়া আছে।
কর্নেলের নির্দেশে এবার মিলিটারি জিপ আমাদের লাইট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। আমরা বস্তি এলাকার ভেতর দিয়ে একটা নীচু জায়গায় নেমে গেলাম। বললাম, কোথায় যাচ্ছি?
কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বালির টিলাগুলো দেখে নিয়ে বললেন, চলো তো!
যেতে-যেতে বললাম, সেই ফুট সাপ্লায়ার ভদ্রলোক কে?
বসন্ত অধিকারী।
চমকে উঠে বললাম, অ্যাঁ?
হ্যাঁ। কর্নেল হাসলেন। বসন্তবাবুকে ঠিক বদ্ধ পাগল বলা চলে না। তবে মাথায় একটু গন্ডগোল ঘটেছে, সেটা ঠিকই। এই গোপালপুর-অন-সির প্রত্যেকটি ইঞ্চি ওঁর নখদর্পণে। ডার্লিং! কাল রাত্তিরে উনিই ভূত হয়ে আমাদের ঢিল ছুঁড়ছিলেন। আমুদে চরিত্রের মানুষ। মজা করার সুযোগ পেলে ছাড়তে চান না।
বালির টিলার কাছে পৌঁছে বললাম, কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোন চুলোয়?
ধৈর্য ধরো জয়ন্ত! বলে কর্নেল টিলায় উঠতে থাকলেন। ক্রমশ সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ পরে সমুদ্র চোখে পড়ল। চুড়োয় ওঠার পর বাইনোকুলারের বাঁ দিকে কিছু দেখে কর্নেল বললেন, ওই যে দেখছ একটা হোটেল। তুমি এখানে বসে লক্ষ রাখো। যদি দ্যাখো, শেরোয়ানিচুস্ত-টুপিপরা কোনও মুসলিম ভদ্রলোক এবং তার সঙ্গী বিচে নামছেন, তুমি গিয়ে ওঁদের সঙ্গে ভাব জমাবে। যেভাবে হোক, কথায়-কথায় ওঁদের আটকে রাখবে। আমি সেই সুযোগে হোটেলে ঢুকে স্যুটে হানা দেব।
কর্নেল হনহন করে সোজা এগিয়ে গেলেন। তারপর অদৃশ্য হলেন। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। শীতের বেলা পড়ে আসছিল। বসে আছি তো আছি। কতক্ষণ পরে দেখি, সেই মুসলিম ভদ্রলোক এবং তার সঙ্গী কখন আমার ঠিক নীচে বিচের ওপর চলে এসেছেন। দু জনে বিচ ধরে দক্ষিণে এগোচ্ছেন। তবে হাঁটার গতি বেশ দ্রুত।
গতরাতে থানায় ওঁদের কথা শুনেছি। নাম দুটি মনে পড়ল। মইনুদ্দিন আমেদ এবং পিটার ন্যাজারেথ। দু জনেই নাকি চামড়া ব্যবসায়ী। কিন্তু কর্নেলের দৃষ্টি ওঁদের ওপর পড়ল কেন?
একটু ইতস্তত করে বিচে নেমে গেলাম। ওঁরা ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। ওদিকটা একেবারে নির্জন খাঁ খাঁ। বাঁ দিকে সমুদ্র সামনে গজরাচ্ছে। হন্তদন্ত এগিয়ে হালো বলে সম্ভাষণ করলাম। কিন্তু সমুদ্রের গর্জনে কথাটা হারিয়ে গেল। দুটো বালির টিলার মধ্যিখানে খাড়ির মতো একটা সঙ্কীর্ণ জায়গা দেখা যাচ্ছিল। সমুদ্রের জল সেখানে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। জলটা পিছিয়ে সমুদ্রে সরে গেলে ওঁরা দুজনে খাড়িটা পেরিয়ে ডাইনে অদৃশ্য হলেন। ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
আবার সমুদ্রের জল এসে খাড়িতে ঢুকল। তারপর জলটা পিছিয়ে যেতেই খাড়ি পেরিয়ে গেলাম। ডাইনে ঘুরে দেখি, বালিয়াড়িতে একটা পাথরের ঘর অর্ধেকটা ডুবে আছে। ফাটলধরা পোড়ো ঘর। ছাদ ধসে পড়েছে। এ-ও নিশ্চয় মুঘল আমলের কোনও বাড়ি। মইনুদ্দিন এবং ন্যাজারেথ সেখানে ঢুকে গেলেন।
সাবধানে এগিয়ে সেই ঘরের কাছে গেলাম। গুঁড়ি মেরে বসলাম। হঠাৎ একটা আর্তনাদ ভেসে এল। তারপর কেউ চিৎকার করে উঠল খ্যানখেনে গলায়, শাট আপ।
গুঁড়ি মেরে পাথরের চাঙড়ের আড়ালে গিয়ে উঁকি দিলাম। যা দেখলাম তা সাংঘাতিক ব্যাপার। দিনশেষের আবছা আলোয় ঘরের মেঝেতে বালিতে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রাখা হয়েছে একটা লোককে। তার হাত দুটো পিঠের দিকে বাঁধা। এবং লোকটা আর কেউ নয়, আমাদের হালদারমশাই!
ন্যাজারেথ তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে চুল খামচে ধরে আছে। মইনুদ্দিন সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে, স্পিক দ্য ট্রুথ!
আর সহ্য করতে পারলাম না। একলাফে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম মইনুদ্দিনের ওপর। তার টুপি খসে পড়ল। সে হুংকার দিয়ে কিছু বলল। ন্যাজারেথ অমনই বালিতে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। ততক্ষণে মইনুদ্দিনের সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি বেধে গেছে। তার দাড়ি খামচে ধরেছিলাম। উপড়ে এল। তখনই চিনতে পারলাম তাকে। কী আশ্চর্য, এ তো সেই রাজেন অধিকারী।
চেনামাত্র তাকে ছেড়ে ন্যাজারেথের কান ধরতে লাফ দিলাম। ন্যাজারেথ যে সেই দানো অর্থাৎ কৃত্রিম মানুষ, এ-ও মুহূর্তে বুঝে গেছি। কিন্তু তার কান মলে দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। সে আমাকে ঠেলে বালির ওপর ফেলে দিল। রাজেন অধিকারীও আমার বুকের ওপর এসে বসল। মুখে নিষ্ঠুর হাসি।
আমি তার দিকে হাত ওঠানোর সুযোগ পেলাম না। আমার দুই বাহুতে সে দুই পা চাপিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে কী একটা খুদে কালোবোতামের মতো জিনিস আমার কপালে সেঁটে দিল। মনে হল, অতল শূন্যে তলিয়ে যাচ্ছি।
.
০৬.
প্রথমে ভেবেছিলাম একটা বিকট দুঃস্বপ্ন দেখছি। চাঁদের আলোয় জায়গাটা মোটামুটি স্পষ্ট। আমার নিম্নাঙ্গ নিঃসাড়। ঠান্ডায় জমে গেছে। তারপর বুঝলাম আমার কোমর পর্যন্ত বালিতে পোঁতা এবং হাত দুটো পেছনে বাঁধা। যন্ত্রণা টের পেলাম। তখন সব কথা মনে পড়ে গেল। ডাকলাম, হালদারমশাই! হালদারমশাই!
কোনার দিকে ছায়া। সেখান থেকে হালদারমশাইয়ের করুণ সাড়া এল, আছি।
একটা কিছু করা দরকার, হালদারমশাই।
হালদারমশাই রুগির গলায় অতি কষ্টে বললেন, চব্বিশ ঘণ্টা পোঁতা আছি জয়ন্তবাবু। পায়ে একটুও শক্তি নাই।
আপনাকে কোথায় ধরেছিল?
সি বিচে কাইল রাত্তিরে অগো ফলো কইরা কইরা বিপদ বাধাইছি।
এই সময় বাইরে ধুপধুপ শব্দ কানে এল। হালদারমশাই চাপা গলায় বললেন। চুপ কইরা থাকেন। চক্ষু খুলবেন না।
চোখ বোজার আগে দেখে নিলাম, দুটো লোক আসছে। একজনের কাঁধে মড়ার মতো কেউ ঝুলছে। তারা ঘরে ঢুকলে চিনতে পারলাম। রাজেন অধিকারী এবং তার দানো। দানোর কাঁধে আর একজন মড়ার মতো লোক। রাজেন অধিকারী হুংকার দিল তখনকার মতো। অমনই দানোটা মড়া নামিয়ে বালিতে গর্ত খুঁড়তে থাকল। গর্তটা সে হাত দিয়েই খুঁড়ছিল। বুঝলাম, রাজেন অধিকারীর হুংকার সম্ভবত বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের ভাষায় সোনিম। বিশেষ ধ্বনিতরঙ্গের সাহায্যে হুকুম জারি।
দানোটা যাকে আমাদের মতো কোমর পর্যন্ত পুঁতে হাত দুটো পেছনে বাঁধল, সে যে মড়া নয় তা একটু পরে বুঝলাম। রাজেন অধিকারী তাকে বলল, হিরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, না বলা পর্যন্ত এই অবস্থায় থাকো।
সে হি হি করে হেসে উঠল।
শাট আপ। পাগলামি ঘুচিয়ে দেব। বলো হিরে কোথায়?
বলব না!
না বললে দাদা বলে খাতির করব না আর।
ইস! আমি তোর সত্যিকার দাদা নাকি? বেশি জাঁক দেখাসনে রাজু। সব ফাঁস করে দেব। যখন বাপ-মা মরে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলি, তোকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেছিলাম। তুই নেমকহারাম!
চুপ! টাম্বোকে হুকুম দিলে এখনই তোমার মুণ্ডু মুচড়ে দেবে।
তাই দে না। মলে তো বেঁচে যাই। ওরে হতভাগা তোর বাবার আত্মার সঙ্গে আমার সবসময় দেখা হয় জানিস! দাঁড়া! ডাকছি তাকে। প্রমথ! প্রমথ! কাম অন! তোমার হারামজাদা পুত্রটিকে এসে শায়েস্তা করো দিকি।
শাট আপ! বলো হিরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
হিরে তোর বাপের? নওরোজিসায়েবের সঙ্গে চক্রান্ত করে ম্যাডানসায়েবের হিরে চুরি করেছিলি। ওই ভূতটাকে দিয়ে নওরোজিকে মারলি। শেষে ম্যাডানসায়েবকে মারলি। পাপের ভয় নেই তোর?
রাজেন অধিকারী ফুঁসে উঠল। তুমিও কম পাপী নও। আমার ল্যাব থেকে হিরে চুরি করে ম্যাডানসায়েবকে চিঠি লিখেছিলে এখানে আসতে। তুমি থাকো ডালে-ডালে, আমি থাকি পাতায়-পাতায়। এবার ম্যাডানসায়েবের জামাইকে হিরে ফেরত দেওয়ার চক্রান্ত করেছ। সে-খবরও আমি রাখি, যাক গে বলো-হিরে কোথায় রেখেছ?
হালদারমশাই বলে উঠলেন, বসন্তবাবু! আপনি ভুল করছেন। হিরে কলকাতায় ম্যাডানসায়েবেরে দিয়া দিলেই পারতেন। এই ট্রাবল হইত না!
রাজেন অধিকারী ঘুরে দাঁড়াল। তবে রে ব্যাটা টিকটিকি! বলে তেমনই হুংকার দিতেই টাম্বো গিয়ে হালদারমশাইয়ের চুল খামচে ধরল। হালদারমশাই আর্তনাদ করলেন।
বসন্তবাবু বললেন, আপনি ভালো বলেছেন মশাই! কলকাতায় হিরে দিলে এই রাজু ব্যাটাচ্ছেলে ঠিক টের পেয়ে যেত। ওর যন্তরমন্তরে সব ধরা পড়ে যেত। সেজন্যেই গোপালপুরে আসতে লিখেছিলাম। আমার চেনা জায়গা। তা আপনাকে দেখছি জ্যান্ত পুঁতেছে? হিহি-হোহো করে একচোট হাসার পর বসন্তবাবু এতক্ষণে আমাকে দেখতে পেলেন। বললেন, মলো ছাই। এ আবার কে? ও রাজু! একে কেন পুঁতলি?
রাজেন অধিকারী তেড়ে এল। চুপ! এই শেষবারের মতো বলছি, বলো হিরে কোথায়?
বসন্তবাবু ভেংচি কেটে বললেন, তোর বাপের হিরে? দাঁড়া তোর বাপের আত্মাকে ডাকি। সে নিজে এসে বলুক, হিরে কার? বলে ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন। চাপা গলায় বললেন, রাতবিরেতে তোর বাপ পাখি হয়ে সমুদ্রের ওপর চক্কর দিয়ে বেড়ায়। আমি নিজের চোখে দেখছি। তা জানিস?
রাজেন অধিকারী বলল, তাহলে মরো! টাম্বো! টাম্বো! টাম্বো!
তার হাতে টর্চের মতো একটা জিনিস থেকে নীলচে আলো জ্বলে উঠল। তারপর যা দেখলাম, শিউরে উঠলাম। দানোটা হালদারমশাইয়ের চুল ছেড়ে দিয়ে বসন্তবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল এবং পকেট থেকে কী একটা বের করল। সেটা আর কিছু নয়, একটা কালো রঙের ছোটো সাপ। সাপটার লিকলিকে জিভ। বসন্তবাবুর মুখের কাছাকাছি সে সাপটাকে নিয়ে গেল। বসন্তবাবু আর্তনাদ করলেন, প্রমথ! প্রমথ! বাঁচাও!
তিনি সম্ভবত রাজেন অধিকারীর বাবার প্রেতাত্মাকে ডাকার জন্য সমুদ্রের দিকে মুখ ঘোরালেন। তারপরই চেঁচিয়ে উঠলেন, ওই সে আসছে! ওই দ্যাখ রাজু। পাখি হয়ে তোর বাপ উঠে আসছে।
অতিকষ্টে মুখ ঘুরিয়ে দেখি, কী অদ্ভুত। সমুদ্রের আকাশে বিশাল লম্বা ডানাওলা একটা পাখি উঠে আসছে এই বালিয়াড়ির দিকে।
রাজেন অধিকারী পাখিটাকে দেখামাত্র হুংকার দিল। তখন দানোটা এক লাফে বাইরে চলে গেল। নীলচে আলোটা নিভিয়ে রাজেন অধিকারীও বেরোল। বাইরে এক পলকের জন্য চোখ ঝলসানো আলো দেখলাম। সেই আলোয় দেখতে পেলাম, কেউ রাজেন অধিকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারপর ধস্তাধস্তি, হাঁকডাক, বালিতে ধুপধুপ শব্দ। জ্যোৎস্নায় অনেক ছায়ামূর্তির ছুটোছুটি।
হালদারমশাই চাপা স্বরে বলে উঠলেন, খাইছে!
সেই সময় বাইরে কর্নেলের সাড়া পেলাম। জয়ন্ত! জয়ন্ত!
চেঁচিয়ে বললাম, এখানে! এখানে!
টর্চের আলো এসে পড়ল আমাদের ওপর। তারপর কর্নেলকে দেখতে পেলাম। বললেন, কী সর্বনাশ! হালদারমশাইকেও পুঁতেছে দেখছি।
হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, হঃ!
কয়েকজন পুলিশ ঘরে ঢুকে বাঁধন খুলে দিয়ে বালি সরিয়ে আমাদের ওঠাল। আমি পা ছড়িয়ে বসলাম। হালদারমশাই কিন্তু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পা ছোঁড়াছুড়ি করে বললেন, আই অ্যাম অলরাইট। বাট হেভি ক্ষুধা পাইছে।
বসন্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাই। প্রমথের আত্মাকে দেখা করে আসি।
কর্নেল বললেন, বসন্তবাবু! প্রমথ কে?
ওই শয়তানটা রাজুর বাবা। বড্ড ভাল লোক ছিল মশাই। না, না! যাই দেখা করে আসি। পর-পর দু’বার পাখি হয়ে উড়ে এল আমার সঙ্গে দেখা করতে।
.
বসন্তবাবু বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। পা বাড়াতে গেছি, হঠাৎ পায়ের কাছে কর্নেলের টর্চের আলোয় সেই সাপটাকে দেখতে পেলাম। চমকে উঠে সরে গেলাম। কর্নেল সাপটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, এ-ও কিন্তু কৃত্রিম সাপ জয়ন্ত! তবে টাম্বোর মতো নয়। জেনোম থিয়োরির সঙ্গে এটার সম্পর্ক নেই। এটা নেহাত খেলনা সাপ। চলো, বেরোনো যাক।
বাইরে গিয়ে দেখি, পুলিশের দঙ্গল ছায়ামূর্তির মতো বিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। একটা দেওয়ালের আড়াল থেকে সি আই ডি অফিসার সুরঞ্জনবাবু বেরিয়ে এলেন। বললেন, সায়েন্টিস্ট ভদ্রলোকের কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম কর্নেল। দিনে-দিনে পৃথিবীটা ওঁরা একেবারে অন্যরকম করে দিচ্ছেন। মাথা ঠিক রাখা কঠিন।
কর্নেল বললেন, চন্দ্রকান্তবাবুর চেয়ে সেরা বিজ্ঞানী এখন আপনাদের হাতে মি. দাস! শিগগির গিয়ে ওঁকে আর্মির কর্নেল সিংহের জিম্মায় রাখার ব্যবস্থা করুন। কিছু বলা যায় না। পুলিশের হাজত ওকে আটকে রাখার মতো শক্ত জায়গা নয়। রাজেন অধিকারী এ-যুগের এক জাদুকর বিজ্ঞানী।
সুরঞ্জনবাবু হন্তদন্ত চলে গেলেন। আমরা সামনে বালির টিলার দিকে যাচ্ছিলাম। টিলার মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্নায় আবছা দেখা যাচ্ছে তাকে। কর্নেল ডাকলেন, বসন্তবাবু!
কোনও সাড়া এল না। কাছে গিয়ে আবার কর্নেল বললেন, বসন্তবাবু। দেখা হল প্রমথবাবুর আত্মার সঙ্গে?
বসন্তবাবু গলার ভেতর বললেন, নাহ। দেরি দেখে প্রমথ উঠে গেল। ওই দেখুন যাচ্ছে।
জ্যোৎস্নার সমুদ্রের আকাশে সেই বিশাল পাখিটাকে ক্রমশ দুরে কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে দেখলাম। হালদারমশাই চমকানো গলায় বলে উঠলেন, কী? কী?
কর্নেল হাসলেন। পাখি নয়, হালদারমশাই। হ্যাং গ্লাইডার।
সঙ্গে-সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের যে একটা হ্যাং গ্লাইডার আছে। কী ভুলো মন আমার। বললাম, কর্নেল, তা হলে মারিয়াম্মা যে ভূতুড়ে পাখির কথা বলছিল–।
আমার কথার ওপর কর্নেল বললেন, ডার্লিং। তুমি সবই বোঝো। তবে দেরিতে। চন্দ্রকান্তবাবু কলকাতা থেকে হ্যাং গ্লাইডারে চেপে এসেছিলেন। এখন ফিরে যাচ্ছেন।
বসন্তবাবু পা বাড়িয়ে বললেন, যাই। ম্যাডানসায়েরের জামাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে ওর শ্বশুরের হিরে ফেরত দিই গে।
কর্নেল বললেন, হিরে উনি ফেরত পেয়েছেন বসন্তবাবু।
কী বললেন? বসন্তবাবু হি-হি হো-হো করে বেজায় হাসতে লাগলেন। হিরে ফেরত পেয়েছে? কী করে পাবে মশাই? এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি, কার সাধ্যি খুঁজে বের করে?
যাকে আপনি প্রমথবাবুর আত্মা বললেন, তিনিই খুঁজে বের করেছেন। ব্যাকওয়াটারের ওখানে একটা মন্দিরের ভেতর আপনি পুঁতে রেখেছিলেন। কালো রঙের একটা ছোট্ট কৌটোতে। তাই না?
সর্বনাশ। বলে বসন্তবাবু দৌড়ে বিচে নামতে থাকলেন।
কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন, বরং ম্যাডানসায়েবের জামাই যে-বাংলোতে উঠেছেন, সেখানে চলে যান বসন্তবাবু।
হালদারমশাই এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, এখানে থাকা ঠিক না, কর্নেল সার। হেভি ক্ষুধা পাইছে। তাছাড়া আমার সন্দেহ হয়। রাজেন অধিকারীর ভূতটা কোথাও ঘাপটি পাইত্যা-বইয়্যা রইছে। পুলিশ অরে ধরতে পারে নাই।
টাম্বোকে চন্দ্রকান্তবাবু লেজার পিস্তলের একটা শটেই ছাই করে দিয়েছেন হালদারমশাই।
অ্যাঁ? কই? কই?
কাল সকালে এসে দেখবেন। চলুন, এবার ফেরা যাক।
কর্নেল আমাদের সোজা নিয়ে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের সেই বাংলোতে। কুসরো অপেক্ষা করছিলেন কর্নেলের জন্য। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, বসন্তবাবু খুশি-খুশি মুখে বসে পা দোলাচ্ছেন এবং মিটিমিটি হাসছেন। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল। ডিনার টেবিলে বসে হালদারমশাই খাদ্যে মন দিলেন। কর্নেল বললেন, বসন্তবাবু আমাদের গতরাতে ঢিল ছুঁড়ে ভয় দেখাচ্ছিলেন কেন বলুন তো?
বসন্তবাবু মুরগির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, টিল নয়। ছোটো-ছোটো বালির গোটা।
কিন্তু কেন?
আপনারা আমার কাজে বাগড়া দেবেন ভেবেছিলাম। বুঝলেন না? পুলিশ এতে নাক গলাক, এটা আমার পছন্দ নয়। পুলিশ যদি জানতে পারত, আমার কাছে হিরে আছে, কেলেঙ্কারি হত না? আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম পিটিয়ে কথা বের করে ছাড়ত। ওরে বাবা! আমি পুলিশ দেখলেই কেটে পড়ি।
আর একটা কথা বসন্তবাবু!
বলুন। আমার মন খুব ভালো হয়ে গেছে। সব কথার জবাব দেব।
আপনি হিরের কথা কী জানতে পেরেছিলেন?
রাজুর কাছে প্রায়ই একটা লোক আসত। দুজনে চুপিচুপি কথা হত। আড়াল থেকে শুনতাম। পরে বুঝলাম, কী সাংঘাতিক চক্রান্ত চলেছে। লোকটা নাকি আমেরিকার কোন সায়েবের কাছে জানতে পেরেছে, কুসরোসায়েবের শ্বশুর কোনও সম্রাটের হিরে কিনেছেন। সেই হিরে চুরির মতলব করেছে ওরা। কী যেন নাম লোকটার? নও… নও… দুচ্ছাই!
কুসরো বললেন, নওরোজিসায়েবের কিউরিয়য়া শপ আছে। বিদেশে তার অনেক চর আছে। তাদেরই কেউ খবরটা দিয়ে থাকবে- ভদ্রলোক আমার শ্বশুরের চেনা লোক ছিলেন। এদিকে আমার শ্বশুরও তত চতুর মানুষ ছিলেন না। মনে হচ্ছে, কোনও কথায় মুখ ফসকে হিরের কথা তিনিও বলে থাকবেন। এমনকী, হিরেটা দেখিয়েও থাকবেন।
বললাম, নওরোজির সঙ্গে কীভাবে রাজেনবাবুর পরিচয় হল?
কর্নেল বললেন, নওরোজির এক ভাই আমেরিকায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক্সের অধ্যাপক। সেখানেই রাজেনবাবু রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। গত মাসে সেই অধ্যাপক কলকাতা এসেছিলেন। নওরোজি সেই উপলক্ষে পার্টি দেন। রাজেনবাবুও পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এসব খবর নিয়ে তবে গোপালপুরে ছুটে এসেছিলাম।
বসন্তবাবু বললেন, রাজু বরাবর এইরকম স্বার্থপর।
কর্নেল বললেন, নওরোজি নিশ্চয় জানতেন না, টাম্বো কৃত্রিম মানুষ। টাম্বোকে তাহলে গুলি করতেন না।
বসন্তবাবু বললেন, শয়তান রাজু নও.. নও, দুচ্ছাই! রাজু সেই লোকটাকে একদিন বলেছিল, হিরে চুরি গেছে। কে চুরি করেছে? না- ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ওই ভূতটা। কাজেই মারো গুলি! দে বডি ফেলে। হি হি হি হি। বডি ফেলতে গিয়ে নিজেরই বডি পড়ে গেল। হো হো হো হো…।
হালদারমশাই এতক্ষণে বললেন, হঃ। বডি পড়া স্বচক্ষে দেখছিলাম। সে ক্কী পড়া।
কর্নেল বললেন, আপনার বডিও পড়ে যেত। জোর বেঁচে গেছেন।
হঃ। বলে হালদারমশাই জলের গ্লাস তুলে নিলেন।