ইয়াং ক্যালকাটা
কলকাতা শহরের গা থেকে তখনও পুরোনো সুতানুটির গন্ধ যায়নি। নব্য অভিজাত বাঙালি বাবুরা তখন শহরতলির বাগানবাড়িতে বাইজিনাচ আর আতশবাজির উৎসবে সাহেব—মেমদের অভ্যর্থনা করতে মশগুল। সমাজের অধোগতিতে বিচলিত হয়ে যাঁরা সমাজোন্নতিপ্রয়াসী হয়েছিলেন, তাঁরাও নবাবি বিলাসিতার সঙ্গে প্রগতির আদর্শের এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিচিত্র সংমিশ্রণ তখনই কলকাতা শহরে হয়েছিল বড়সাহেবদের বাহবার প্রলোভনে। দুর্গোৎসবের আসরে তার অনুষ্ঠান হত এবং লখনউ—বারাণসীর এক—দু—হাজারি বনেদি বাইজিরা সেই সুরের ‘ককটেল’ নূপুরনিক্বণ ও অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে পরিবেশন করতেন। এই সময় কলকাতা শহরে একদল তরুণ ছাত্র—সকলেরই দশের কোঠায় বয়স—সমাজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বায়োবৃদ্ধদের মনে এমন ত্রাস সঞ্চার করেছিলেন যা আজকের তরুণদের কাছেও তাজ্জব ব্যাপার মনে হবে। প্রায় একশো তিরিশ—চল্লিশ বছর আগেকার (১৮৩০—এর) কথা।
তখন কলকাতারও নাগরিক বয়ঃসন্ধিকাল। এতসব বিচিত্র অটোমোবিল, এত স্কুটার—টেম্পো ট্রাম—বাস পথে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটোছুটি করত না। অশ্বযান চলত কদমতালে, আর পালকি চলত দুলকি চালে। সময়ের গতি ছিল মন্থর, যদিও শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ার বিশুদ্ধ জ্ঞান ছাড়াও ঘড়ির ব্যাবসা করে কিছু সময়জ্ঞানও এ দেশে বিতরণ করেছিলেন। তাহলেও আজকের কলকাতার মানুষের মতো হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সঙ্গে ঘড়ির চক্রের টিকটিকানি একছন্দে বাঁধা ছিল না। সময় ও জীবন দুটোই চলত ঢিমেতালে। স্বার্থের ধান্দায় তখন কলকাতার নাগরিকদের আজকের মতো নাভিশ্বাস ওঠেনি। কলকাতার জনসংখ্যাও ছিল তখন আজকের প্রায় পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। স্কুল—কলেজ অনেক কম ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ছিলই না। মেয়েদের বিদ্যাভ্যাস বা স্কুল—কলেজে যাতায়াত তখন আরম্ভ হয়নি। পথেঘাটে মেয়েদের দেখা যেত না, বাড়িতেও না, একেবারে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো মেয়েদের দেখতে হত। তরুণ যুবকদের সংখ্যাও ছিল তখন লোকসংখ্যানুপাতে কম, কারণ শিশুমৃত্যুর প্রাবল্য ছিল সমাজে। বংশবৃদ্ধির যোগ্য বয়সে উত্তীর্ণ হবার আগেই তখন মানবলীলা সংবরণ করা ছিল প্রাকৃতিক ঘটনা। যৌবনপ্রান্তেই তখন বার্ধক্য পদার্পণ করত। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের নিষ্পেষণে তখন তারুণ্য—যৌবনের প্রাণনির্ঝর অল্পদিনেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, যজ্ঞকাঠ নয়—যা ঘষলে আগুন জ্বলে ওঠে, একেবারে ভিজে মরা কাঠ—যাতে আগুন জ্বালালেও শুধু ধোঁয়া হয়। বাংলার যে দশের কোঠার বয়সের তরুণদের কথা বলছি, তাঁরাও সকলে বালিকাবধূর বালকস্বামী ছিলেন। এই বালক—স্বামিত্বের সামাজিক দায়িত্ব একজন বিদ্রোহী তরুণের পক্ষে পালন করা যে কত কঠিন, তা আজকের দিনের সকল বন্ধনমুক্ত তরুণরা বাস্তবিকই উপলব্ধি করতে পারবেন না। তা—ও আবার এমন একটি স্তন্যপায়ী জীবের দায়িত্ব যে আজকালকার তরুণী—সঙ্গিনী—বান্ধবী বা প্রেমিকার মতো ‘চালু’ নয়, একেবারে নির্জীব পুঁটলির মতো অচালু। গৃহ বা পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হলে কোনো বিদ্রোহী তরুণদের পক্ষে ঘাড় বেঁকিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে একলা বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, বালিকাবধূর পুঁটলিটি পিঠে করে বেরুবার সমস্যা দেখা দিত। কিন্তু বেরুবার পথ কোথায়? শহরের পথে বউ নিয়ে একসঙ্গে চলার দৃশ্য দেখতে তখন কেউ অভ্যস্ত ছিল না। তা ছাড়া আশ্রয়ই বা কে দেবে, কোথায় পাওয়া যাবে? তরুণদের বিদ্রোহেরবহু বাধার মধ্যে এই বাধাও ছিল মস্ত বড় বাধা। মুক্ত বলাকার মতো উড্ডীয়মান বর্তমান সমাজের তরুণ—তরুণীদের কাছে এ বাধার দুরতিক্রম্যতা অচিন্তনীয়।
বাধা আরও ছিল। যেমন জ্যেষ্ঠশাসন ও বৃদ্ধশাসন তখন সমাজে ও পরিবারে মুক্ত তরবারির মতো সর্বদা সমুদ্যত থাকত। কর্তব্যবোধ তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে, নীতিবোধ নড়লে—চড়লে, অভ্যাস—আচরণ বিকৃত হলে, জ্যেষ্ঠদের রক্তচক্ষুর অগ্নিবর্ষণে তারুণ্যের উত্তাপ মুহূর্তেই হিমায়িত হয়ে যেত। ঘোড়ার পিঠে সহিসের চাবুকের চেয়ে ছাত্রের পিঠে শিক্ষকের চাবুকের ব্যবহারই ছিল অধিক স্বাভাবিক। বেত্রাঘাতের ব্যত্যয় ঘটলে শিশু ও তরুণের চরিত্রস্খলন হতে পারে, এই ছিল জ্যেষ্ঠদের বিশ্বাস। শাসন ও নিয়মানুগত্যের দিক থেকে বিচার করলে পরিবার ও সমাজ ছিল কতকটা কারাগারসদৃশ, তার লৌহবেষ্টনীর মধ্যে মানুষের ব্যক্তিত্বের সাবলীল স্ফূর্তি একরকম সুদূরপরাহত ছিল বলা চলে। তারুণ্যের সতেজ প্রাণদ্যুতি এই নীরন্ধ্র প্রতিবেশে স্বাভাবিক বিচ্ছুরণের পথ খুঁজে না পেয়ে গোপন দুষ্কৃতির রন্ধ্রপথে বিকীর্ণ হত। স্বাধীনতা ও সামাজিক অধিকার ছিল বয়োবৃদ্ধদের কুক্ষিগত, এবং বুদ্ধি—বিবেচনার দিক থেকে তাঁদের পক্বকেশ মস্তিষ্ক ছিল তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো উত্তুঙ্গ, অপরিপক্ব তরুণদের নাগালের অতীত।
এত রকমের সামাজিক বাধাবিপত্তির মধ্যেও বাংলার রাজধানী কলকাতা শহরে একদল তরুণ কিশোর বয়সের ছাত্র উনিশ শতকের দ্বিতীয়—তৃতীয় দশকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সমাজের প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে। ছাত্রদের নিজেদের গোষ্ঠীগত কোনো দাবি নয়, প্রশ্নপত্র সহজ—কঠিন বা পরীক্ষার পাশ—ফেলের দাবি নয়, শিক্ষাসংস্কারের দাবি নয়, অথবা ছাত্র আন্দোলনের কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিও নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এরকম কোনো দাবি উদ্ভবের মতো অনুকূল পরিবেশই তখন রচিত হয়নি। ছাত্র আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পরে, উনিশ শতকের ষষ্ঠ—সপ্তম দশক থেকে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, এঁরা ছিলেন এ দেশের প্রথম যুগের ছাত্র আন্দোলনের নেতা। কিন্তু ‘ইয়াং বেঙ্গল’ বা ‘ইয়াং ক্যালকাটা’ নামে পরিচিত তরুণ ছাত্রদল কোনো বিশেষ ছাত্র আন্দোলন বা দাবি দাওয়ার আন্দোলন করেননি। তাঁদের বিদ্রোহকে তাই ‘ছাত্র বিদ্রোহ’ বলা যায় না, ‘যুব বিদ্রোহ’ বলা যায়। তা ছাড়া, বিশেষ কোনো বাস্তব দাবি দাওয়া নিয়ে ছাত্র বা যুব আন্দোলনকে ‘যুব বিদ্রোহ’ বলা যায় না। যুব বিদ্রোহ সমাজের মূলনীতি ও গঠনের বিরুদ্ধে গভীর অসন্তাোষের প্রকাশ। কলকাতা শহরে ‘ইয়াং ক্যালকাটা’ গোষ্ঠীর বিদ্রোহ শুধু বাংলার নয়, আধুনিক যুগের ভারতের প্রথম যুব বিদ্রোহ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এই বিদ্রোহের পৃষ্ঠপট, প্রকৃতি ও লক্ষ্যায়তনের সঙ্গে বর্তমানকালের যুব বিদ্রোহের সাদৃশ্য আন্তরিক, পার্থক্য বাহ্য। কেবল তা নয়। পার্থক্যটা প্রধানত সাংখ্যিক বা ‘কোয়ান্টিটেটিভ’, গুণীয় বা ‘কোয়ালিটিটেটিভ’ নয়। সেকালের ‘ইয়াং ক্যালকাটা’র বিদ্রোহ ছিল বিকৃত ও জরাগ্রস্ত ‘হিন্দুসমাজ’—এর বিরুদ্ধে, একালের ‘ইয়াং ক্যালকাটা’র বিদ্রোহ হল যুগে যুগে প্রচারিত অজস্র রঙিন আদর্শের ভগ্নস্তূপের উপর প্রতিষ্ঠিত জরাজীর্ণ বিকৃত শ্রেণিবৈষম্যজর্জর ‘মানবসমাজ’—এর বিরুদ্ধে। বর্তমানে তাই ইয়াং ক্যালকাটা, ইয়াং প্যারি, ইয়াং রোম, ইয়াং বার্লিন, ইয়ং লন্ডন, শিকাগো—ওয়াশিংটন—নিউ ইয়র্ক—সকলের বিদ্রোহের সুর একই উচ্চগ্রামে বাঁধা এবং এই যুব বিদ্রোহের প্রকৃতি ও আদর্শায়তনের মধ্যে দৈশিক বা ভৌগোলিক ভিন্নতার চেয়ে কালিক অভিন্নতাই লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষক ডিরোজিওর ছাত্র ও শিষ্য বলে যাঁদের ‘ডিরোজিয়ান’ বলা হত, তাঁদেরই কেউ বলতেন ‘ইয়াং বেঙ্গল’, কেউ ‘ইয়াং ক্যালকাটা’। এই ইয়াং ক্যালকাটার বিদ্রোহের সুরও বেশ উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল। বস্তুত তখনকার অচলায়তন জ্যেষ্ঠতান্ত্রিক সমাজের উগ্রমূর্তির কথা মনে হলে তরুণদের বিদ্রোহী সুরের দুঃসাহসিক তীব্রতায় স্তম্ভিত হতে হয়। বিদ্রোহ কার বিরুদ্ধে, এবং কেন? বিদ্রোহের প্রেরণার উৎস কোথায়? বাংলা দেশের বাস্তব সামাজিক পরিবেশে তখন যুব বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ উদ্দীপক বিশেষ কিছু ছিল না। মানবসমাজের বিকাশের একটা বিশেষ সন্ধিক্ষণে ছিল এই উদ্দীপনার বস্তু। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হল সামন্ততন্ত্র—সমূহতন্ত্র থেকে ধনতন্ত্র—ব্যক্তিতন্ত্রের স্তরে উত্তরণের কাল। এই কালের অভ্যুদয় হয়েছিল—মূলত জ্ঞান বিজ্ঞানের কয়েকটি কালান্তরী কীর্তির সমাবেশে—বাংলা দেশের ভৌগোলিক সীমান্ত থেকে বহু দূরে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে, ইউরোপে। সেখানকার বস্তুতন্ত্রবাদী, যুক্তিবাদী এবং সংশয়বাদী, বিজ্ঞানবাদী, প্রত্যক্ষবাদী, যান্ত্রিক পরিণামবাদী দার্শনিকরা এবং বৈজ্ঞানিকরা সমাজ, মানুষ ও জীবন সম্বন্ধে পূর্বকালের প্রত্যয়গুলিকে চ্যালেঞ্জ করে পাশাপাশি নতুন প্রত্যয় গড়ে তুলেছিলেন। সমাজের কেন্দ্রস্থ চলনশক্তি হল লৌকিক মানবিক—অলৌকিক, অতিমানবিক বা ঐশ্বরিক নয়—এই ছিল নবযুগের নতুন জীবনবাণী। যন্ত্র ও বিজ্ঞানের প্রাথমিক অগ্রগতি আত্মনির্ভর মানবিক শক্তিকে অপরাজেয় প্রতিপন্ন করছিল। চারদিকের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতি মানুষের মনে একটা মসৃণ নিটোল প্রগতিবাদের অপরূপ মূর্তি তুলে ধরেছিল। শিল্পবিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব যেমন মানুষের আত্মশক্তির ভিত দৃঢ় করছিল, তেমনি সমাজের প্রগতিশীল পরিবর্তনে মানুষকে প্রায় অন্ধবিশ্বাসী করে তুলছিল। জান্তব যূথচেতনার কুয়াশালোক থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ সবেমাত্র ব্যষ্টিচেতনার প্রথম সূর্যালোকে তার পরিপার্শ্ব জীবন ও সমাজকে দেখতে আরম্ভ করেছিল। এই দৃষ্টিও নতুন, দৃষ্টিশক্তিও নতুন। অভিনব নয়, বৈপ্লবিক। অবয়বস্পর্শী নয়, ইন্দ্রিয়ভেদী এবং চৈতন্যলোকের গর্ভাগার পর্যন্ত প্রসারিত।
সুদূর ইউরোপ থেকে এই যুগান্তকারী সমাজদর্শন, এই বৈপ্লবিক জীবনবোধ, ব্যক্তিচেতনা ও প্রগতিবিশ্বাস, কলকাতা শহরের গোলদিঘিতে হিন্দু কলেজের (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ) একদল তরুণ ছাত্রের মনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করল। কেবল আদর্শের আঘাতে যে কী ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হতে পারে তরুণদের মনে, ইয়াং ক্যালকাটার কীর্তি তার সাক্ষী। বিদ্রোহের মন্ত্রদাতা গুরু হলেন একজন ফিরিঙ্গি শিক্ষক—ডিরোজিও। তিনিও বয়সে তরুণ, ছাত্রদের চেয়ে দু—তিন বছরের বেশি বড় নন। ডিরোজিও যখন হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন তখন তাঁর বয়স সতেরো—আঠারো। ছাত্রদের বয়স তেরো থেকে পনেরো—ষোলো। অর্থাৎ শিক্ষক—ছাত্র সকলেই ‘টিনএজার’। আজকের প্রেসিডেন্সি কলেজের পূর্বসংস্থা হিন্দু কলেজ। সেখানে যে আজ থেকে একশো চল্লিশ বছর আগে একজন শিক্ষকের সঙ্গে একদল ছাত্রের এরকম তারুণ্যের সংযোগ ঘটেছিল—এবং তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের মধ্যে—তা সত্যিই আজকের দিনেও যেন ভাবা যায় না। আঠারো বছরের শিক্ষক ডিরোজিও এমন কী জীবনমন্ত্রে তাঁর তরুণ ছাত্রদের দীক্ষা দিয়েছিলেন যা তাদের মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং যে আগুনের হলকায় সমাজের জীর্ণ কঙ্কাল পর্যন্ত ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। নবযুগের জীবনমন্ত্র, নবজীবনের দর্শন ও বিজ্ঞানের মন্ত্র। নতুন জীবনবোধ ও সমাজচেতনার মন্ত্র। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদার মন্ত্র। যুক্তিবাদ ও বুদ্ধিবাদের মন্ত্র। প্রগতিবাদের মন্ত্র। নবযুগের দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিকদের রচনা ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের পাঠ করে শোনাতেন, ক্লাসের পাঠ্য বিষয়ের বাইরে জ্ঞান—বিজ্ঞানের বিচিত্র জগতের রূপ তিনি ছাত্রদের মানসনেত্রের সামনে তুলে ধরতেন। ডিরোজিওর ছাত্ররাই বলেছেন যে, তাঁর ক্লাস ছিল প্লেটো—আরিস্ততলের ‘আকাদেমি’র মতো। বদ্ধ ক্লাসের চার দেয়ালের মধ্যে ছাত্রদের কৌতূহল নিবৃত্ত হত না। ক্লাসের বাইরে কলেজের এ কোণে—সে কোণে ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে ধরত, জানবার অদম্য আগ্রহ তারা দমন করতে পারত না। কলেজের বাইরে গোলদিঘি থেকে মৌলালির দরগার কাছে লোয়ার সার্কুলার রোডে ডিরোজিওর গৃহের পথে চলতে চলতে আলোচনা হত শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের। তাতেও তরুণদের আকাঙ্ক্ষা মিটত না। এসব কথা কেউ তো কখনো তাদের বলেননি, সমাজ ও পরিবারের কর্তারা কেউ না। বাল্যকাল থেকে এতদিন তারা শুধু সকালে উঠে মনে মনে বলেছে, সারাদিন যেন তারা ভালো হয়ে চলে, এবং গুরুজনেরা যা আদেশ করেন তা—ই যেন মন দিয়ে পালন করে। ডিরোজিও অন্য কথা বলতেন। ক্লাসের কক্ষ থেকে কলেজের বারান্দা ও উঠোন থেকে পথ, পথ থেকে ডিরোজিওর বাড়ির বৈঠকখানা পর্যন্ত আলোচনা চলত। আলোচনা থেকে বিতর্কের সূত্রপাত হত। মতামতের আদান প্রদানে ও বিতর্কে উৎসাহ দিতেন ডিরোজিও। তিনি কখনো বলতেন না যে তাঁর কথা ছাত্ররা শিরোধার্য করে নিক, সর্বদা তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে বলতেন। তাঁর কথা তো দূরের কথা, কোনো গুরুজনের কথা, ঋষিতুল্য লোকের কথা, এমনকী ঈশ্বরের বাক্যও ডিরোজিও নির্বিচারে মেনে নিতে বলতেন না। তিনি বলতেন, বুদ্ধিমান মানুষ তার নিজের বুদ্ধি, যুক্তি, বিবেক ও বিচারশক্তি দিয়ে ন্যায়—অন্যায় কর্তব্য—অকর্তব্য বিচার করবে, শাস্ত্রবচন, গুরুবচন বা দৈববচন বলে কিছু অন্ধের মতো গ্রহণ বা পালন করবে না। আজকের দিনে তথাকথিত গণতন্ত্রের তূর্যনিনাদের মধ্যেও কোনো সমাজনেতা, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা পার্টি তাঁদের ভক্তদের গণতন্ত্রের এই প্রাথমিক অধিকারটুকু দিতেও সাহস করবেন কি না সন্দেহ। ডিরোজিও শিক্ষক হয়ে তাঁর ছাত্রদের এই অধিকার দিয়েছিলেন, গণতন্ত্রের শৈশবকালে।
এই গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বাভাবিক প্রকাশক্ষেত্র হল স্বতন্ত্র বিদ্বৎসভা ও বিতর্কসভা। হিন্দু কলেজে ও ডিরোজিওর পারিবারিক গৃহের বৈঠকখানায় এই অধিকারের অবাধ স্ফূর্তি ব্যাহত হত। কাজেই তরুণদের বিতর্কসভা গঠিত হল, নাম ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’, স্থান শ্রীকৃষ্ণ সিংহর মানিকতলার বাগানবাড়ি, পরে যেখানে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। রেভারেন্ড লালবিহারী দে লিখেছেন যে, মানিকতলার এই বাগানবাড়ির হলঘরে ইয়াং ক্যালকাটা গোষ্ঠীর সেরা রত্নরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ সামাজিক, নৈতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কের ঝড় বইয়ে দিতেন। ঝড়ের মধ্যে জীর্ণ পুরাতনের বিরুদ্ধে তরুণদের বিদ্রোহী মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেত। ভয়ংকর ক্ষোভের প্রচণ্ড প্রকাশ। মনে হত যেন কোনো গুহাভ্যন্তর থেকে সিংহশাবকরা গর্জন করছে।
সিংহশাবকরা হলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও ডিরোজিওর অন্য ছাত্ররা। তাঁদের মুখের বুলি ছিল ‘ডাউন উইথ হিন্দুয়িজম, ডাউন উইথ অর্থোডক্সি’! এ বুলি উত্তোলিত ঝান্ডায় পথের মিছিলে প্রচারিত হত না, বিতর্কসভায় ধ্বনিত হত। সেই বিতর্কের মান সম্বন্ধে আলেকজান্ডার ডাফ লিখেছেন, প্রত্যেক বিষয়ে মতবাদ ব্যক্ত করার সময় বক্তারা ইংরেজি সাহিত্য থেকে, বিশেষ করে বায়রন—স্কট—বার্নস থেকে অনর্গল উদ্ধৃতি প্রয়োগ করতেন। ঐতিহাসিক বিষয় হলে রবার্টসন ও গিবন, রাজনৈতিক বিষয় হলে অ্যাডাম স্মিথ ও জেরেমি বেন্থাম, বৈজ্ঞানিক বিষয় হলে নিউটন ও ডেভি, ধর্মবিষয় হলে হিউম ও টমাস পেইন, আধ্যাত্মিক বিষয় হলে লক, রিড স্টুয়ার্ট, ব্রাউন প্রমুখ মনীষীদের রচনা তরুণ তার্কিকরা নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে অবলীলাক্রমে আবৃত্তি করতেন। আলোচনা হত হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের নানা রকমের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি নিয়ে। তরুণদের এই বিতর্কসভার আলোচনাতেই বাইরে হিন্দুসমাজের কর্ণধাররা রীতিমতো বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন।
সমাজে তখন কোনো শ্রেণিগত বা গোষ্ঠীগত দাবিদাওয়া নিয়ে গণ—আন্দোলন গড়ে ওঠার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। হিন্দু কলেজের ছাত্রসংখ্যাও তখন পাঁচশোর বেশি ছিল না। অধিকাংশই সম্ভ্রান্ত ও সংগতিপন্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের সন্তান আলালের ঘরের দুলাল। পরিবার ও সমাজের বিরুদ্ধে কিচ্ছু করার মতো সাহস তাঁদের অনেকেরই ছিল না। ডিরোজিওর শিক্ষাদর্শের প্রভাব তাঁদের অনেকের উপরেই পড়েনি। কাজেই ইয়াং ক্যালকাটা তরুণচক্র আয়তনে যে খুবই ক্ষুদ্র ছিল তা বোঝা যায়। খুব বেশি হলে কুড়ি—পঁচিশজন তরুণ ছিলেন এই চক্রভুক্ত। তাঁদেরই সারথ্য করতে হয়েছিল বাংলার, এবং ভারতের প্রথম তরুণ বিদ্রোহের। তার উপর সারথ্যের পন্থাও ছিল তখন অত্যন্ত পরিমিত। ছাত্র মিছিলের পুরোভাগে বজ্রমুষ্টি ও ঝান্ডা প্রদর্শনের দিন তখনও আসেনি। হিন্দু কলেজের সমকক্ষ বিদ্যালয়ও তখন ছিল না এবং সারথিদের আহ্বানে কোনো ছাত্র—সমাবেশের সম্ভাবনাও তখন ছিল না। একমাত্র উপায় ছিল সভাসমিতিতে আলোচনা এবং নিজেদের মুখপত্রে সমালোচনা। বিদ্রোহের এই পথই ইয়াং ক্যালকাটাকে তখন গ্রহণ করতে হয়েছিল।
এ পথেও বাধা ছিল অনেক। প্রথম বাধা ও বড় বাধা হল কোনো মুখপত্র প্রকাশ ও প্রচার করার মতো আর্থিক সামর্থ্য তরুণদের থাকার কথা নয়। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবীণরা এদিক দিয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ ছিলেন। পত্রিকার সংখ্যাও ছিল তাঁদের অনেক বেশি। দিনের পর দিন তাঁরা সেইসব পত্রিকায় তরুণদের ধ্যানধারণা ও আচার—ব্যবহারের দুর্মর সমালোচনা করতেন। মাত্র দু—তিনখানি ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় (যেমন পার্থিনন, এনকোয়্যারার, জ্ঞানান্বেষণ) তরুণরা তার জবাব দিতেন। তরুণদের জবাবের নমুনা এই : ‘আমরা হিন্দুধর্মের তথাকথিত পবিত্র মন্দির ত্যাগ করেছি বলে গোঁড়া বৃদ্ধরা আমাদের উপর মারমুখী হয়েছেন। আমাদের তাঁরা সমাজচ্যুত করবেন, আমরা কুসংস্কার বর্জন করতে চাই এই অপরাধে। কিন্তু আমাদের বিবেক ও বুদ্ধি যথেষ্ট সজাগ এবং আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস যে, আমরা যা করছি তা খুবই ন্যায়সংগত। অসীম ধৈর্য ধরে আমরা আমাদের কর্তব্য করব। প্রতিজ্ঞা করেছি আমাদের প্রতিপক্ষ বয়োবৃদ্ধরা যদি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আমাদের উপর খড়্গহস্ত হন, আমরা ভীত হব না, প্রয়োজন হলে মৃত্যুও বরণ করব। সংগ্রাম করে আমরা যেটুকু অধিকার অর্জন করেছি তা একতিলও ছাড়ব না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমাজের প্রবীণ কর্ণধাররা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কীভাবে প্রতিদিন নানা রকমের প্রচারপত্র বিলি করে আমাদের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে কলঙ্ক রটাচ্ছেন। যাবতীয় অপকৌশল প্রয়োগ করে তাঁরা আমাদের দমন করতে উদ্যত হয়েছেন, কোনো ধর্মবোধে বা নীতিবোধে বাধছে না। কিন্তু কোনো অপকৌশল, কোনো চক্রান্ত বা হুমকির কাছে আমরা মাথা হেঁট করব না। যত নির্মম হোক, সমস্ত অত্যাচার আমরা সহ্য করতে প্রস্তুত, কারণ আমরা জানি একটা জাতিকে সংস্কারমুক্ত, উদার ও উন্নতিশীল করতে হলে সমাজে খানিকটা গন্ডগোল ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবেই। কাজেই গন্ডগোল আমরা করব, হল্লা করব, চেঁচামেচি করব, তারস্বরে প্রতিবাদ করব, সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকবৃত্তির বিরুদ্ধে।’
তরুণদের প্রতিবাদের ভাষা ক্রুদ্ধ ও কঠোর, কিন্তু অসংযত ও অশালীন নয়। বাইরের আচার—ব্যবহারে মধ্যে মধ্যে অবশ্য তরুণ ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ অসংযত ও অশালীনতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন গোলদিঘিতে বসে মদ্যপান করা এবং মুসলমানের দোকান থেকে গোমাংস কিনে খাওয়া তখন অনেক তরুণের কাছে প্রগতিশীল কর্ম বলে মনে হত। এ কথা রাজনারায়ণ বসু, লালবিহারী দে, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং আরও অনেকে লিখে গেছেন। তখনকার দিনে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করাও বেশ দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল, প্রগতির লক্ষণ তো বটেই। যৌবনে যাঁরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করতেন, তাঁরা কেউ কেউ দীক্ষাগ্রহণের পরে কিঞ্চিৎ সুরাপান করে সেলিব্রেট করতেন। রাজনারায়ণ বসু নিজেও তা—ই করেছিলেন। এ ছাড়া তরুণরা মধ্যে মধ্যে নিজেদের পাড়া—প্রতিবেশীদের উপরেও নানা রকমের উপদ্রব করতেন। যেমন ব্রাহ্মণপাড়ায় কোনো বন্ধুবান্ধবদের গৃহে বসে মাংস ভক্ষণ করে ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর ঘরে হাড় নিক্ষেপ করে গোহাড় গোহাড় বলে হল্লা করে তাঁরা ব্রাহ্মণদের উত্তেজিত করতেন। এরকম ঘটনা ইয়াং ক্যালকাটা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রবক্তা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেই ঘটেছিল, উত্তর কলকাতায় গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে। তার জন্য কৃষ্ণমোহনকে পাড়া ও পরিবার ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। কোনো হিন্দুপাড়ায় বন্ধুবান্ধবদের গৃহেও তাঁর স্থান হয়নি। অবশেষে চৌরঙ্গি অঞ্চলে সাহেবপাড়ায় গিয়ে তাঁকে বাস করতে হয়েছিল।
এই সময় কৃষ্ণমোহন (১৮৩১ সালে) হিন্দুসমাজের সমালোচনা করে একটি ছোট নাটিকাও লিখেছিলেন। নাটিকাটির নাম : The Persecuted of Dramatic Scenes, Illustrative of the Present State of Hindu Society in Calcutta. তখন তাঁর বয়স সতেরো—আঠারো বছর। নাটিকাটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন হিন্দু যুবকদের। উৎসর্গের ভাষা এই :
The following pages are inscribed to them with sentiments of affection, and strong hopes of their appreciating those virtues and mental energies which elevate man in the estimation of a philosopher.
উৎসর্গের ভাষা ও ভাব লক্ষণীয়। তরুণদের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য যে কত মহৎ ছিল তা কৃষ্ণমোহনের এই উৎসর্গপত্রে অভিব্যক্ত মনোভাব থেকে বোঝা যায়। ভূমিকায় কৃষ্ণমোহন বলেছেন, নাটকীয় গুণ হয়তো এই নাটিকার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই, লেখার মধ্যেও অনেক ত্রুটি আছে, কিন্তু তবু লেখার উদ্দেশ্যের কথা মনে করে পাঠক ও দর্শকরা সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি উপেক্ষা করবেন বলে তিনি মনে করেন। উদ্দেশ্য হল, হিন্দুসমাজে যাঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাঁরা যে কত দূর জঘন্য চরিত্রের লোক তা প্রকাশ করে দেওয়া। নাটকটি কাঁচা লেখা হলেও আজকালকার একশ্রেণির রাজনৈতিক প্রচার—সাহিত্যের তুলনায় সুপাঠ্য বলা চলে।
ইয়াং ক্যালকাটার হিন্দুসমাজবিদ্বেষে একদল ইংরেজ বেশ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন, সকলে নন। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছিলেন বিদেশি মিশনারিরা। আলেকজান্ডার ডাফ তাঁদের গুরুস্থানীয়। মিশনারিদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুসমাজের নবীন—প্রবীণদের আদর্শ—সংঘাতের এই সুযোগে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত হিন্দু তরুণদের খ্রিস্টধর্মে ধমান্তরিত করা। এই উদ্দেশ্য কিছুটা তাঁদের সফল হয়েছিল। অবশ্য সাময়িক সাফল্য। বিদ্রোহী তরুণদের তাঁরা সহজেই তাঁদের দিকে আকর্ষণ করেছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তাঁদের ঘন ঘন বক্তৃতাও শুনিয়েছিলেন। তা—ই নিয়ে হিন্দু কলেজে ও হিন্দুসমাজে শোরগোল হয়েছিল। নষ্টের গুরু বলে হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিও পদচ্যুত হয়েছিলেন। পদচ্যুতির কিছুদিন পরে অকস্মাৎ ডিরোজিওর মৃত্যু হয়। তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ—যেমন মহেশচন্দ্র ঘোষ ও কৃষ্ণমোহন—খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। হিন্দুসমাজে ছেলেধরার আতঙ্ক হয়। গুজব রটে যে, মিশনারিরা ছেলেদের ভুলিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে খ্রিস্টান করছেন। শহরময় কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম রটে যায় ‘পাতিফিরিঙ্গি কেষ্টা বন্দ্যো’।
বৃন্দাবন ঘোষালরা গুজব রটনার কাজে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণ বৃন্দাবন ঘোষাল প্রত্যহ সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিদ্রোহী তরুণদের সম্বন্ধে আজগুবি সব গল্প করে বেড়াতেন। এইটাই তাঁর পেশা ছিল। বিনিময়ে যৎসামান্য দক্ষিণা ও কিছু চাল—ডাল—ভুজ্জিও তিনি পেতেন। বলা যায় না, তরুণদের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে মিথ্যা কলঙ্ক রটাতে যাঁরা শহরে প্রচারপত্র বিলি করতেন, সেই ধনবান সমাজপ্রধানারাই হয়তো পয়সা দিয়ে বৃন্দাবন ঘোষালের মতো জীবন্ত প্রচারপাত্র নিয়োগ করেছিলেন। করা আশ্চর্য নয়। একসময় রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরকে পথে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে প্রহার করার ভয় দেখানো হয়েছিল। বিদ্রোহী তরুণদেরও তা করা হয়নি বলে মনে হয় না। পিতৃগৃহ ও পরিবার থেকে শুধু কৃষ্ণমোহন নন, দক্ষিণারঞ্জন ও আরও কয়েকজন বিতাড়িত হয়েছিলেন। তার জন্য তাঁদের যে কী দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়েছিল, আজকের দিনে তা কল্পনা করা যায় না। কাউকে কাউকে অসহ্য পারিবারিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। তুকতাক, বশীকরণ—মারণ—উচাটন প্রভৃতি জাদুকরি অস্ত্রও তরুণদের বিদ্রোহী মন শান্ত—সুস্থ করার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু জাদুমন্ত্রতন্ত্রও ব্যর্থ হয়েছিল।
ইয়াং ক্যালকাটার বিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছিল তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের তরুণদের মধ্যে যখন শিক্ষক ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রগোষ্ঠী সকলেই ‘টিনএজার’ ছিলেন। কুড়ি বছর থেকে কুড়ির শেষ পর্যন্ত (প্রায়) তাঁদের এই বিদ্রোহের শিখা অনির্বাণ ছিল। তার মধ্যে অবশ্য বিদ্রোহের তীব্রতর তারতম্য হয়েছে, স্বরগ্রামেরও পরিবর্তন হয়েছে। ১৮২৮—৩৩ সালের মতো সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আর কখনো তা ওঠেনি। তরুণরা যুবক হয়েছেন, যুবকদের যৌবনও ক্রমে স্থির পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে, দেশের ও সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, অনেক নতুন সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা এবং সর্বপ্রকারের বোধশক্তির বোধও বেড়েছে। যিনি একদা ছিলেন ‘পাতিফিরিঙ্গি কেষ্টা বন্দ্যো’ সেই কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক পরবর্তীকালে শিক্ষা—সমাজ—রাজনীতিক্ষেত্রে দেশের অগ্রগণ্য নেতা হয়েছেন।
‘ইয়াং ক্যালকাটা’র এই বিদ্রোহের সঙ্গে ইদানীন্তন কলকাতার তরুণ বিদ্রোহ বা ছাত্র বিদ্রোহের তফাত কী, এ প্রশ্ন মনে হওয়া স্বাভাবিক। তার উত্তর ইয়াং ক্যালকাটার বিদ্রোহের প্রকৃতি বিচারের উপর নির্ভর করে। প্রথমে মনে হয় কালের ব্যবধানের বিশালতার কথা। কালের দূরত্ব দিয়ে কেবল তার গুরুত্ব পরিমাপ করা যায় না। সমাজের অগ্রগতির দ্রুততার ধারার উপর কালের দূরত্বের গুরুত্ব নির্ভর করে। যেমন ১৮২৮—৩০ থেকে ১৯২৮—৩০ একশো বছরের ব্যবধান, ১৯২৮—৩০ থেকে ১৯৬৮—৭০ মাত্র চল্লিশ বছরের। তা সত্ত্বেও শেষের চল্লিশ বছরের কালিক দূরত্ব ও গুরুত্ব আগের একশো বছরের তুলনায় অনেক বেশি। আবার আগের একশো বছরের গুরুত্ব তার আগের এক হাজার বছরের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। ঐতিহাসিক কালটাকে যদি লোকোমোটিভের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে তা চলার বেগ দিয়ে বিচার করতে হয়। কালের গুরুত্ব, বিশেষ করে, সামাজিক গুরুত্ব। শুধু বেগ বা ‘ভেলসিটি’ নয়, তার ত্বরণক্রম বা ‘রেট অফ অ্যাকসিলারেশন’ও বিশেষ বিচার্য। পাশ্চাত্য সমাজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক উৎপাদনব্যবস্থার মৌল পরিবর্তনের ফলে সমাজজীবনে নতুন চলনশক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল আঠারো—উনিশ শতক থেকে। আমাদের দেশে ইংরেজদের আগমনে বাইরের সমাজজীবনে এই চলনশক্তি বিশেষ সঞ্চারিত হয়নি, যেটুকু হয়েছিল তা অতি সামান্য, তার বেগ বা ত্বরণ কোনোটাই ছিল না। কারণ সেই চলনশক্তির বৈজ্ঞানিক—অর্থনৈতিক উপাদনগুলিই তৈরি হয়নি এবং বিদেশি শাসকরা তাঁদের স্বার্থেই তা তৈরি হতে দেননি। তার ফলে গতিশীলতায় পাশ্চাত্য সমাজের সঙ্গে, জীবনদর্শনের সঙ্গে আমাদের সামান্য সংযোগ হয়েছিল মানসিক ক্ষেত্রে, বাস্তব সামাজিক ক্ষেত্রে নয়। এই সংযোগের প্রথম পথ খুলে দিয়েছিল কলকাতার হিন্দু কলেজের পাশ্চাত্য শিক্ষা। সমাজবিজ্ঞানী আইজেনস্টাডট তাঁর ‘ফ্রম জেনারেশন টু জেনারেশন’ গ্রন্থে বিভিন্ন দেশে যুবসমাজের বিকাশ ও ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা—প্রসঙ্গে বলেছেন, যেদেশে অর্থনৈতিক গতির সঙ্গে সামাজিক গতির সংগতি থাকে না, সে দেশের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয় বেশি এবং বৈদেশিক শাসনাধীনে থাকলে রাজনৈতিক চেতনাও প্রখর হয়। এইসব দেশের যুবসমাজ নিজের জ্ঞান—বুদ্ধি দিয়ে স্বদেশি সমাজকে নানাদিক থেকে অনুদার ও স্থিতিশীল মনে করেন এবং পরিবারকে (ফ্যামিলি) এই অনুদার ও অনুন্নত সমাজের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। সেইজন্য তাঁদের বিদ্রোহ মূলত ‘ইন্টিলেকচুয়াল’ বা বুদ্ধিপ্রণোদিত এবং তার লক্ষ্য ‘সমাজ’ ও ‘পরিবার’ দুইই।
ইয়াং ক্যালকাটা তরুণগোষ্ঠীর বিদ্রোহও মূলত বুদ্ধিপ্রণোদিত বিদ্রোহ। পাশ্চাত্য দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও মনীষীরা সেই বিদ্রোহের প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। প্রাথমিক ভাবসংঘাতেই তাঁদের তরুণ মানসে পাশ্চাত্যের যে সমাজপ্রতিমাটি ভেসে উঠেছিল, সেটি উদার উন্নতিশীল স্বাধীন যুক্তিবুদ্ধিনির্ভর ব্যক্তিকৃতিমুখী (অ্যাচিভমেন্ট—ওরিয়েন্টেড) সমাজের প্রতিমা। হিন্দুসমাজের বহু পুরাতন মূর্তির সঙ্গে এই নতুন সমাজমূর্তির কোনো মিল কোনোদিক থেকে ছিল না। হিন্দুসমাজ ছিল কূপমণ্ডূক রক্ষণশীল ঐতিহাসিক (‘ট্র্যাডিশনাল’) ও কুলকৃতিমুখী বা ‘অ্যাসক্রিপটিভ’, ব্যক্তিকৃতিমুখী নয়, উন্নতিশীলও নয়। কাজেই ইয়াং ক্যালকাটা গোষ্ঠীর বিদ্রোহের প্রথম লক্ষ্য হয়েছে হিন্দুসমাজ ও হিন্দুধর্ম, এবং তার সঙ্গে পরিবার। হিন্দুধর্মের প্রতি বিরাগ সাময়িকভাবে ঘটনাচক্রে পরিতৃপ্ত হয়েছে খ্রিস্টধর্মে। আর হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিদ্বৎসভার উত্তপ্ত বিতর্কে ও পত্রিকাদির রচনায় সমস্ত আবেগ নিঃশেষ করে দিয়ে শান্ত হয়ে গিয়েছে।
ইদানীন্তন কলকাতার তরুণদের মনে যে বিদ্রোহ ধূমায়িত হচ্ছে এবং যার ভয়াবহ অগ্ন্যুদগিরণ মধ্যে মধ্যে আমরা দেখতে পাই, তার উদ্দীপনার উৎস অনেক। আজকের তরুণদের সমস্যাও বহু রকমের বিচিত্র সমস্যা। প্রথম সমস্যা, জনসংখ্যার বিস্ফোরণের ফলে—এবং তার সঙ্গে গড় আয়ুবৃদ্ধির ফলে—সমাজে যেমন প্রৌঢ়—বৃদ্ধের সংখ্যা বেড়েছে তেমনি তরুণ ও যুবকদের সংখ্যাও দ্রুতহারে বেড়েছে ও বাড়ছে। এই বিশাল তরুণসমাজ ক্রমে শিক্ষাক্ষেত্রে ও স্বাধীন কর্মক্ষেত্রে এমন সব অচিন্তনীয় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন যা উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। যে বয়সে আশা ও কল্পনার রঙে বিশ্বভুবন রাঙিয়ে যাবার কথা, সেই বয়সে অগাধ নৈরাশ্যের অন্ধকারে তাঁদের জীবনের নিভৃত গৃহকোণটিও আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তার উপর আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অতি—উৎকট আমলাতান্ত্রিক স্থূলতা যত বাড়ছে, তত যেন সমাজের গলায় বয়োবৃদ্ধদের শাসনরজ্জুর ফাঁস পড়ছে এবং যুবসমাজের সতেজ প্রাণ তার মধ্যে হাঁসফাঁস করছে। অর্থাৎ বিগতযৌবন যাঁরা তাঁদের প্রাণহীন হৃদয়হীন ব্যুরোক্রাসির মধ্যে যাঁরা আগতযৌবন তাঁরা দিব্যচক্ষে আজ দেখতে পাচ্ছেন জগদগম ডেমোক্রাসির মর্মন্তুদ অপমৃত্যু। তার উপর বৈজ্ঞানিক কারণে বার্ধক্য যত পশ্চাদপসরণ করছে তত যেন বয়োবৃদ্ধরা তাঁদের যৌবনচেতনার প্রান্তটি আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন এবং তাঁদের কর্মরাজ্যে তরুণ ও যুবকদের প্রবেশপথ রুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর হচ্ছেন। ঘোর আদর্শবাদী রাজনৈতিক পার্টিই হোক আর যে—কোনো আমলাতান্ত্রিক সংস্থাই হোক, সর্বত্রই দেখা যায় উপরতলায় ‘জেরন্টোক্রাসি’ (বৃদ্ধতন্ত্র) কায়েম হয়ে বসেছে। এরকম বহু সমস্যার কণ্টকাকীর্ণ মহারণ্যে প্রবেশ করে তরুণ ও যুবকরা আজ নিষ্ক্রমণের পথ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রত্যেকটি সমস্যার বিস্তারিত সামাজিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তাঁদের ক্রুদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ হবার সংগত কারণ আছে। এত রকমের উদ্দীপনা সেকালের ‘ইয়াং ক্যালকাটা’র বিদ্রোহের মূলে ছিল না। তাই বর্তমান কলকাতার তরুণ বিদ্রোহ হিন্দুসমাজের ব্যভিচার ও বিকৃতির বিরুদ্ধে নয় শুধু, সমগ্র মানবসমাজের যুগযুগান্তের অন্যায়—অবিচার, ব্যভিচার ও বিকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
১৯৬৮