ইমেল বিছানো পথে
‘বরবটির বীজ নিতে হবে দশ গ্রামের মতো। এমনি বীজ নয়, বালিখোলায় ভাজা বীজ। দু’কাপ জলে ফেলে সেই বীজ সিদ্ধ করতে হবে অল্প আঁচে। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ পর মিশ্রণ থকথকে হয়ে গেলে আগুন থেকে নামাতে হবে। তারপর বীজসিদ্ধ জল পরিষ্কার কাপড়ে ছেকে আলাদা করে নিতে হবে সাবধানে। কুসুম কুসুম সেই গরম জল খাওয়ার নিয়ম হল দিনে দু’বার। বেশি হলে তিনবার। যাদের অল্প ঠান্ডাতেই সর্দিকাশির ধাত তাদের পক্ষে এই জল অব্যর্থ। তবে এতে কাজ না দিলে…।’
এই পর্যন্ত পড়ে শিবনাথবাবু বই বন্ধ করলেন।
বই শিবনাথবাবুর কোনও প্রিয় জিনিস নয়। স্কুল কলেজটুকু বাদ দিলে এই ছেষট্টি বছরের জীবনে বই তিনি বেশ কমই পড়েছেন। কিন্তু এই বইটি তিনি গত তিনমাস ধরে বারবার পড়ছেন, উলটেপালটে তারিয়ে তারিয়ে দেখছেন। এর কারণ বই নয়, বইয়ের বিষয়। বইয়ের বিষয় খুবই ইন্টারেস্টিং। তরিতরকারির গোপন রহস্য। পড়তে পড়তে শিবনাথবাবু কোনও কোনও সময় উত্তেজনাও বোধ করছেন। আলু, পটল, শিম, বেগুনের মতো অতি সামান্য জিনিসের ভেতর যে এত বড় বড় সব ক্ষমতা ঘাপটি মেরে আছে কে জানত! এইজন্যই বোধহয় কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে বলতে পারে? বেগুনে বাত কমে, শিমের ভেতর আছে অম্বলের যম, ঝিঙেতে মাথা ধরা পালায়! বাপ রে!
একটু আগে শিবনাথবাবু শুরু করেছিলেন বরবটি বিষয়ক পরিচ্ছেদটি। সর্দি কাশির দাওয়াই বানানোর কায়দাকানুন শেখবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ মন দিতে পারলেন না। বই বন্ধ করলেন।
বৃষ্টি কি ধরল?
জানলা বন্ধ। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। জানলার মোটা, ঘষা কাচের ওপাশে খানিক আগে পর্যন্ত বড় বড় জলের ফোঁটা পড়েছে। মোটা কাচের ওপর জলের ফোঁটা কেমন যেন ঘোলাটে লাগে। মনে হয় রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। এখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুই অন্ধকার। বৃষ্টি বাড়ল না কমল বোঝা মুশকিল।
বিকেল থেকেই শিবনাথবাবুর টেনশনের মতো হচ্ছে। বড় কিছু নয়, চাপা টেনশন। শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি। অম্বলের ভাব হলে অনেক সময় এরকম অস্বস্তি হয়। সমস্যাটা ঠিক কোথায় বোঝা যায় না, শুধু কিছু একটা হচ্ছে বোঝা যায়। এখন অবশ্য অম্বলের ব্যাপার নেই। অন্য ব্যাপার। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। পারবেন তো? এই বুড়ো বয়েসে পারবেন তো? নিজে করা তো দূরের কথা, কেউ করছে এমনটাও চোখে দেখেননি কখনও। ছেলেটা অবশ্য বলেছে, চিন্তার কিছু নেই, করে দেবে। কী যেন নাম ছেলেটার? প্রশান্ত? তপন? কল্যাণ? এই রে, নাম ভুলে গেলে সমস্যা। ওই ছেলে এখন ভরসা। যার ওপর ভরসা করতে হবে তার নাম ভুলে যাওয়া বিচ্ছিরি ব্যাপার। বাসবী শুনলে রেগে যাবে।
‘একটা কাজ যদি ঠিক করে করো।’
‘করলাম তো। বিকেলে গিয়েই তো কথা টথা সব বলে এলাম। সত্যি, খরচ তোমার কমই।’
‘তোমার তো ওটাই মুশকিল। বেশি কথা বলো। বেশি কথা বলো বলে কাজের কথা ভুলে যাও।’
‘কাজের কথা কিছু ভুলিনি বাসবী। শুধু নামটা ভুলে গেছি।’
অবধারিতভাবে এইসময় বাসবী ধমক দেবে।
‘থামো, চুপ করো। একদম চুপ করো তো।’
শিবনাথবাবু নাম মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ছে না। খানিকটা অস্থির মনেই জানলার দিকে তাকালেন ফের। অন্ধকার। অন্ধকারের এই এক খারাপ স্বভাব। টেনশন বাড়িয়ে দেয়।
বৃষ্টির কী অবস্থা?
দেখতে পারলে হত। তবে বৃষ্টি বোঝার জন্য সবসময় চোখে দেখতে হয় না। আওয়াজ শুনলেও হয়। একেকটা বৃষ্টির একেকটা রকম আওয়াজ। শুধু জোর বা হালকা নয়, বৃষ্টির আওয়াজ সময়ের সঙ্গেও বদলায়। একই বৃষ্টি দিনের বেলায় যে আওয়াজ করে, রাতে তা করে না। তখন তার আওয়াজ হয় অন্যরকম। রাত যত গভীর হয় সেই আওয়াজ ঘন হয়ে। আসে। হয়তো কোনও একসময় বৃষ্টি থেমে যায়, কিন্তু আওয়াজ থামতে চায় না। মাথার ভেতর চলতেই থাকে।
জানলাটা খুলবেন? শিবনাথবাবুর সাহস হচ্ছে না। বাসবীদেবী জানতে পারলে রাগারাগি করতে পারে। করাটাই স্বাভাবিক। সন্ধের পর থেকে শিবনাথবাবু কতবার যে জানলা খুলে বৃষ্টি দেখেছেন তার ঠিক নেই। কয়েকবার তো জলের ঝাপটায় ঘর ভেসে গেল।
অঞ্জলি প্রথমবার কিছু বলেনি। সে ছিল পাশের ঘরে। বাসবীর কাছে বসে টিভি দেখছিল। ডাক দিতে ন্যাতা বালতি এনে নিঃশব্দে ঘর মুছে আবার টিভি দেখতে চলে যায়। আর পাঁচটা কাজের লোকের মতো অঞ্জলিরও খুব টিভির নেশা। বারবার উঠতে হলে বিরক্ত হয়। দ্বিতীয়বার ডাক দেওয়ায় সে যতটা না বিরক্ত হল তার থেকে অবাক হল বেশি। এমনিতেই মেয়েটার চোখদুটো বড়। অবাক হলে সেই চোখ আরও বড় হয়ে যায়। সেই বড় বড় চোখ তুলে বলল, ‘দাদু, এটা আপনি কী করেন! জানলা খুলে বারে বারে ঘর ভাসান কেন?’
শিবনাথবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘আমি কি ইচ্ছে করে ভাসাই?’
অঞ্জলি শান্তভাবে বলল, ‘আমার তো তাই মনে হয়। ইচ্ছে করেই ভাসান। নইলে বৃষ্টি কি নিজে জানলায় টোকা মেরে বলল, একটু জানলাটা খোলেন তো, খুলে একটা গামছা দেন, ভিজে মাথাটা মুছি?’
কাজের লোকেদের নিয়ম হল, বেজার মুখে থাকতে হবে। যেন সবসময়েই বিরক্তি। কিন্তু অঞ্জলির বেলায় নিয়ম উলটো। তার হাসির রোগ আছে। সেই হাসি শুনলে কোনও কোনও সময় রাগে মাথা ঝনঝন করে। ইচ্ছে করে জোরে একটা ধমক দিই। অনেক সময় ধমক দিতেও হয়। কিন্তু এখন অসুবিধে আছে। বাসবী শুনতে পাবে। ঘরে জল ঢোকার ঘটনাও জানবে। বাসবী আজকাল চেঁচামেচি শুরু করলে চট করে থামতে চায় না। এই বাষট্টি বছর বয়সেও ছেলেমানুষের মতো হয়ে যায়। দোষের কিছু নয়। একা থাকলে কতরকম সমস্যা হয়। কাহাতক বুড়ো স্বামীর মুখ আর টিভির পরদা দেখা সম্ভব? এতে মেজাজে গোলমাল হতে বাধ্য।
অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে শিবনাথবাবু মুখে আঙুল দিলেন। বললেন, ‘চুপ কর। চুপ কর। তোর দিদা শুনতে পাবে।’
‘শুনতে পেলেই ভাল। আপনে যা শুরু করেছেন তাতে একটা বকা খাওয়া দরকার। হি হি। আমরা ঘরে জল ফেললে মা কানমলা দেয়। দিদা যদি… হি হি।’
শিবনাথবাবু হিসহিসে গলায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘ফাজিল মেয়ে আবার হাসে? চুপ কর বলছি। তুই বরং একটা কাপড় দে, আমি নিজেই মুছে দিচ্ছি। যা তোকে কিছু করতে হবে না।’
অঞ্জলি আবার ন্যাতা নিয়ে আসে। জল মুছতে মুছতে বলে, ‘জল মোছাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল, সন্ধের পর ন্যাতা বালতি ধরা ঠিক নয় দাদু। শলিলে পাপ লাগে।’
কিশোরীটির কথায় শিবনাথবাবু অবাক হন। যে বাড়ির ছেলে আমেরিকার মতো একটা দেশে মাস্টারি করছে সে বাড়ির কাজের মেয়ের মুখে এসব কী কথা! ছি ছি। তাও সূর্য যদি কোনও হাবিজাবি বিষয়ের মাস্টার হত। কিন্তু তা তো নয়। সূর্যর বিষয় হল জেনেটিক্স। জেনেটিক্স একটা জটিল এবং আধুনিক বিষয়। শহর থেকে খানিক দূরে তার কলেজ। ক্লাসরুম থেকে একই সঙ্গে পাহাড় এবং লেক দেখা যায়। বরফ পড়লে সেই লেকে কলেজের মাস্টার এবং ছাত্রছাত্রীরা স্কি করে। স্কি কোনও সহজ ব্যাপার নয়, যথেষ্ট কঠিন একটা জিনিস। ব্যালান্স আর মনোসংযোগ না থাকলে এ জিনিস করা যায় না। সূর্যর মতো ছেলেও এবার বরফে পা হড়কে পড়ল। বাঁ হাতের কনুইতে লাগল চোট। বেশি নয়, অল্প চোট। কিন্তু তাতেই ছোটখাটো চেহারার সুন্দরমতো এক ছাত্রী ছুটে এসে সূর্যকে ধরে নিয়ে গেল কলেজের মেডিকেল রুমে। প্রথমে বরফ ঘষে, ওষুধ স্প্রে করে ব্যথা কমায়, তারপর নিজের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। ঢাউস ব্যান্ডেজ। কাঁধ থেকে একেবারে কবজি পর্যন্ত। সূর্য বারবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, এত কিছুর দরকার নেই। সামান্য লেগেছে মাত্র। একটু পরে নিজে থেকে ঠিক হয়ে যাবে। সেই মেয়ে কোনও কথাই শুনল না। উলটে নিজের মাথার স্কার্ফ খুলে সূর্যর হাত গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়।
ছোটখাটো এই মেয়েটির নাম সুচিয়ং। বাড়ি বেজিং শহরের পশ্চিমপ্রান্তে। স্কলারশিপ নিয়ে সূর্যদের কলেজে পড়তে এসেছে মাত্র দু’বছর। এক সপ্তাহের মাথায়, সূর্য সুচিয়ংকে বিয়ে করে ফেলে এবং ‘সুচি, সুচি’ বলে ডাকতে শুরু করে। তাদের বিয়ের ফটোও চলে আসে দ্রুত। ফটোতে দেখা গেল, সূর্য এবং সুচি পাশাপাশি দাড়িয়ে। সূর্যর হাতে ব্যান্ডেজ। গোলাপি স্কার্ফ দিয়ে সেই ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত ঝুলছে গলা থেকে। বোকা বোকা মুখে সূর্য হাসছে।
বাসবীদেবী ফটো সরিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই স্কার্ফ তোমার ছেলে কতদিন গলায় ঝুলিয়ে রাখবে বলে মনে হয়?’
ছেলের বিয়ের খবরে খুবই খুশি হয়েছিলেন শিবনাথবাবু। একমাত্র ছেলে বলে কথা। তার বিয়েতে বাবা খুশি হবে না তো কে হবে? তা ছাড়া একটা বলার মতো বিয়ে করেছে হারামজাদা। জনে জনে গল্প করার মতো। পুত্রবধূ অনেকেরই আছে। ফরসা, কালো, রোগা, মোটা অনেকরকম। কিন্তু চিনা পুত্রবধূ কার আছে? অন্তত চেনা জানা কারও নেই। তিনি গদগদ গলায় স্ত্রীকে বললেন, ‘সে তোমার ছেলের বউকে জিজ্ঞেস করো না।’
বাসবীদেবী আরও গম্ভীর হয়ে গেছেন। বললেন, ‘কী করে করব? ওই মেয়ে ইংরেজিও নাকি ভাল জানে না। পরশু টেলিফোনে সূর্য বলল, সে চিনা ভাষা শিখছে। এই কারণে দশদিন কলেজ ছুটিও নিয়েছে। এই দশদিন সে ফোন করতে পারবে না।’
শিবনাথবাবু হেসে বললেন, ‘না পারুক। দশ কেন, সেরকম হলে একমাস ফোন করতে হবে না। চিনা ভাষা সহজ কিছু নয়। খুবই কঠিন। তবে তোমার ছেলের মাথাটা পরিষ্কার কিনা, সেটা একটা নিশ্চিন্তি। মনে হয় না তার পক্ষে ভাষা শিক্ষায় খুব বেশি সময় লাগবে। তা ছাড়া পাশে স্ত্রী আছে। স্ত্রী থাকলে কঠিন কাজে সময় বেশি লাগে না। কী বলে?’
কথা শেষ করে শিবনাথবাবু বোকার মতো হাসলেন।
বাসবীদেবী সেদিকে তাকালেন না। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘না লাগলেই ভাল। অন্তত মেয়েটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাতের স্কার্ফটা তো খুলতে হবে। তার জন্যও তো ভাষাটা জানা দরকার।’
এসব যাই হোক, যে বাড়ি ছেলে সুদূর প্রবাসে জেনেটিক্সের মতো জটিল বিষয় নিয়ে মাস্টারি করে এবং স্কি করতে গিয়ে চিনা কন্যাকে বিয়ে করে ফেলে সে বাড়িতে অনেক কিছুর জায়গা থাকতে পারে, কিন্তু কুসংস্কারের কোনও জায়গা নেই। অন্য সকলের মতো কাজের লোকেরও সেটা জানা উচিত।
শিবনাথবাবু অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছিঃ এসব আবার কী কথা! কে তোমাকে এসব আজেবাজে কথা শেখাল অঞ্জলি? পাপ পুণ্য আবার কী? আর যদি বা থাকে তার সঙ্গে সকাল বিকেলের কোনও সম্পর্ক নেই। সকালে যেটা খারাপ, বিকেলেও সেটা খারাপ।’
শিবনাথবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে গম্ভীরমুখে বলতে লাগলেন। তাঁর গলায় একটা মাস্টার মাস্টার ভাব। এটা তাঁর আগে ছিল না, ইদানীং হয়েছে। কোনও কোনও সময় কথার ধরন শুনলে মনে হচ্ছে মানুষটা কোনও কলেজের শিক্ষক। ছোটখাটো কলেজ নয়, হোমরা চোমরা বড় ধরনের কলেজ। তিনি সেই কলেজের টিচার্সরুমে বসে বিগ ব্যাঙ অথবা জীবকোষের গঠন সংক্রান্ত ভারী কোনও বিষয় নিয়ে হালকা মনে গল্প করছেন। ছেলের কাছ থেকে শুনেছেন, বড় জায়গার নিয়মই নাকি এরকম। গল্পের বিষয় যত ভারী হয়, মন তত হালকা হতে থাকে। অথচ সারা জন্ম মাস্টারির এক মাইলের মধ্যে দিয়েও হাঁটেননি শিবনাথবাবু। এমনকী বেকার অবস্থায় টিউশনিও নয়। ছ’বছর আগে সরকারের সার্বিক স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। সার্বিক স্বাস্থ্য বিভাগে থাকার কারণে খাটা পায়খানা উচ্ছেদ থেকে শুরু করে বোরিক তুলোর হিসেব রাখা পর্যন্ত অনেক কাজই করতে হয়েছে, কিন্তু মাস্টারি করতে হয়নি। ক্লাস ফোরের পর নিজের একমাত্র ছেলেটিকেও পড়াতে হয়নি। সে দায়িত্ব ছিল বাসবীর। তা হলে? তা হলে এই বুড়ো বয়েসে এরকম হচ্ছে কেন? অনেক সময় ছেলে বাবার মতো হাবভাব, ধরনধারণ করে। বাবা কি কখনও ছেলের মতো করতে চায়?
এটা ঠিক নয়। শিবনাথবাবু সতর্ক হলেন।
অঞ্জলি ফ্রক সামলে মেঝের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘সবকিছু শেখাতে লাগে না দাদু। গরিব মানুষ নিজে নিজেই শেখে। এই যে আমি ঘর মুছি, কাপড় কাচি, কোথায় শিখেছি? কাপড় কাচার ইস্কুলে?’
‘ঠিক আছে তোকে পাকা পাকা কথা বলতে হবে না। তাড়াতাড়ি কর। হাতে সময় নেই।’
অঞ্জলিকে বহুবারই এই কথা বলা হয়েছে। সে শোনেনি। পাকা কথা বলা তার অভ্যেস। শুধু কথা নয়, মাঝেমধ্যে পাকাদের মতো কাজও করে। তার মধ্যে কোনও কোনওটা তো অতি মারাত্মক। এবারের শীতেই এরকম একটা কাণ্ড করেছিল।
জানুয়ারির শুরুতে সূর্য আর সুচি এককাঁড়ি চকোলেট পাঠাল। এই ওদের এক স্বভাব। চেনা, অল্প চেনা, এমনকী অচেনা কেউ কলকাতা যাচ্ছে খবর পেলেই হল। অমনি বুড়ো-বুড়ির জন্য তার হাতে গাদাখানেক চকোলেট ধরিয়ে দেবে। চকোলেট ধরাতে একবার তো স্বামী স্ত্রী মিলে ম্যানহাটন এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গাড়ি ছুটিয়ে এসেছিল।
ছেলে, ছেলে বউয়ের এই চকোলেট কাণ্ডে বাসবীদেবী বেশ খুশিই হন। তবু মিথ্যে বিরক্তি দেখিয়ে তিনি স্বামীকে বলেন, ‘বলো তো কাণ্ড, এত চকোলেট এখন খাবেটা কে? আগেরবারের গুলোই তো গাদাগুচ্ছের পড়ে আছে। এই নড়বড়ে দাঁতে এসব জিনিস কি চিবোনো যায় না চিবোনো মানায়?’
শিবনাথবাবু হেসে বললেন, ‘শুধু দাঁত বলেছ কেন বাসবী? সুগারের ভয় নেই? আমি বাবা দুটোর বেশি খাচ্ছি না।’
বাসবীদেবী মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি কিন্তু এবার সূর্যকে বারণ করে দেব। এ আবার কীরকম আদিখ্যেতা। বাড়িতে একটা বাচ্চা কাচ্চা থাকলে কথা ছিল। নাতি নাতনি নিয়ে যে ঘর করব সে ভাগ্য তো আর হল না! বিস্কুট লজেন্স নিয়ে ঘর করে কী লাভ?’
শিবনাথবাবু দু’বার গলা খাঁকারি দেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আহা, আদিখ্যেতা বলছ কেন বাসবী? বাবা মাকে কিছু দেওয়া কি আদিখ্যেতা হল? সন্দেশ রসগোল্লার মতো ধরোই না। ওদেশে তো আর সন্দেশ রসগোল্লা পাওয়া যায় না। তাই… হা হা।’
রসিকতা খুবই নিম্নমানের। তবু কথাটা বলে শিবনাথবাবু শব্দ করে হাসতে লাগলেন। বাসবীদেবীর ইচ্ছে হল চাপা ধমক দিয়ে স্বামীর হাসি থামিয়ে দেন। কিন্তু এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। এখন মাথা ঘামাতে হবে চকোলেট নিয়ে। এগুলোর গতি কী। হবে? সত্যি এদিক ওদিক বিলিয়েও সেবার চকোলেট শেষ হল না।
শিবনাথবাবু রাতে শোওয়ার আগে ফ্যানের রেগুলেটর কমাতে কমাতে বললেন, ‘অঞ্জলিকে ক’টা দিয়ে দাও না। ওর তো শুনেছি ভাই-টাই কারা সব আছে। আছে না?’
বাসবীদেবী ঝাঁঝিয়ে বললেন, ‘বোকার মতো কথা বোলো না তো। বয়স যত বাড়ছে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোমার। কাজের লোককে এই জিনিস দেব! আঁ! বলছ কী! হুট করে এমন এক-একটা কথা বলো না, ওই মেয়ে তো একেবারে ঘাড়ে চেপে বসবে।’
শিবনাথবাবু বুঝলেন কথাটা বলা ঠিক হয়নি। বোকার মতো হয়ে গেছে। বাসবী মিথ্যে বলছে না। বয়স যত বাড়ছে কথাবার্তায় বোকা ভাবও বাড়ছে। এটা ঠিক নয়, কন্ট্রোল করতে হবে। কথায় বোকাভাব কন্ট্রোল করবার উপায় কী? ফ্যানের রেগুলেটরের মতো যদি কোনও যন্ত্র থাকত ভাল হত।
‘না না তা হলে ছেড়ে দাও। ঘাড়ে যখন উঠবে বলছ তখন দিয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া এমনি চকোলেট লজেন্স হলে একটা কথা ছিল। এ একেবারে বাইরের জিনিস। কে জানে বাবা, বাইরের জিনিস পেলে ওই মেয়ে হয়তো ঘাড়ের বদলে তোমার মাথাতেই উঠে বসবে।’
বাসবীদেবী মশারির ভেতর থেকেই স্বামীর দিকে তাকালেন। একটা সময় ছিল যখন মশারির কাপড় হত ঘন। ভেতরে মানুষকে দেখাত ছায়া ছায়া, ভূতের মতো। অনেকদিন হয়ে গেল সে অবস্থা আর নেই। এখন মশারি খুবই স্বচ্ছ। পাতলা, ফিনফিনে। ভেতরের মানুষ তো দূরের কথা, স্ত্রীর রেগে যাওয়া পাকানো চোখও স্পষ্ট দেখা যায়। শিবনাথবাবুও দেখতে পেলেন। পেয়ে চুপ করে গেলেন।
পরদিন সকালে বাসবীদেবী একটা ঠোঙা অঞ্জলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘নে, বাড়ি নিয়ে যা। সবাইকে দিস। বলবি দাদাবাবু পাঠিয়েছে। বিদেশি। কম পড়লে আমায় বলে আরও ক’টা নিয়ে যাস। অসুবিবে কিছু নেই, আরও আছে। তবে বলে নিবি। না বলে জিনিস নেওয়া আমি পছন্দ করি না। তোর দাদাবাবু যখন ছোট ছিল কখনও আমায় না বলে কিছু নিত না। আমি বাড়ি না থাকলে অপেক্ষা করত। ফিরলে জিজ্ঞেস করত। আমি হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে না। মনে রাখবি অঞ্জলি, এমনি এমনি আমার ছেলে হিরের টুকরো হয়নি। লেখাপড়ার পাশাপাশি আরও অনেক গুণ আছে তার।’
এ বাড়ির ছেলের প্রশংসা শুনে শুনে অঞ্জলি অভ্যস্ত। এই সময়টায় সে মুখ ফিরিয়ে নিজের কাজ করে। মুখ ফেরানো অবস্থাতেই ঠোঙা নিল সে। তবে পরদিনই সেই ঠোঙা ফিরিয়ে আনল! ঠোট বেঁকিয়ে বলল, ‘ইস মাগো, এ আবার মানুষে খায়? তিতা। বিষ তিতা। ভাই তো মুখে দিয়েই থু দিল। সেই থু পড়ল ঘরের মেঝেতে। মা ভাইয়ের পিঠে ক’টা কিল দিল, তারপর ঠোঙা টান মেরে ফেললে উঠানে। আমি তুলে আনছি। নিন, আপনে রেখে দিন দিদা। এ জিনিস আমাদের চলবে না। আপনার হিরের টুকরো ফিরলে হাতে ধরিয়ে দেবেন।’
কাজের মেয়ের হাত থেকে ম্যানহাটনের চকোলেট ফিরিয়ে নেওয়া একটা ভয়ংকর অপমানের ব্যাপার। তার ওপর আবার ছেলের পাঠানো চকোলেট। কাজের চাপে যে ছেলে গত পাঁচ বছর বাপ-মায়ের কাছে আসতে পারেনি, সে চকোলেট কেন, চকোলেটের মোড়ক পাঠালেও মাথায় তুলে রাখা উচিত। তার বদলে এ কী কাণ্ড!
বাসবীদেবী নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘বাইরের মিষ্টি জিনিস প্রথমে একটু তেতোই হয় অঞ্জলি। তবে তেতো ভাব কাটতে সময় লাগে না। এসব ভাল জিনিস খাওয়া একটা অভ্যেসের ব্যাপার।’
অঞ্জলি ঘরের কোনায় ছেড়ে রাখা বাসি কাপড় তুলতে তুলতে বলল, ‘ভালই তো, ক্ষতি কী? কোনও ক্ষতি নাই। অভ্যেস করেন, যত খুশি অভ্যেস করেন। দাদু আর আপনে বসে বসে নিমপাতা আর উচ্ছে চিবিয়ে দাদাবাবুর লঞ্জেচুস খাওয়ার অভ্যেস করেন। বলেন তো দুটো করলাও ধুয়ে দিই। হি হি। করলার লঞ্জেচুস৷ হি হি।’
এই পাকামি এবং গা জ্বালানো হাসির পর সামান্য কাজের মেয়েকে বরখাস্ত করাটা কোনও অপরাধ নয়। এমনকী শাস্তি হিসেবে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর ভাঙা মাসের মাইনে নিয়ে বেশ কদিন ঘোরালেও বলবার কিছু থাকে না। কিন্তু তা করা যাবে না। পাকামি এবং গা জ্বালানো হাসি বাদ দিলে এই মেয়ের সবটুকু ভাল। এমনি ভাল নয়, অতিরিক্ত ভাল। একা বাড়িতে পড়ে থাকা এই বুড়ো বুড়ির সেবা যত্নে কিশোরীটির কোনও খুঁত নেই। বরং বেশি নজর রয়েছে। ঝড় বৃষ্টিতে কামাই নেই। জ্বর জারি হলেও গায়ে চাদর জড়িয়ে চলে আসে। এসে বলে, ‘আজ আর কাচাকাছি করব না। শীত শীত লাগে।’
‘শীত লাগে তো এলি কেন? নিশ্চয় জ্বর হয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে গায়ে চাদর দিয়েছিস যে বড়।’
‘নতুন চাদর দেখাতে গায়ে দিয়েছি দিদা! শীত আসতে কত দেরি, চাদর ততদিনে পুরনো হয়ে যাবে না?’
রাতে দুধটুকু পর্যন্ত কাপে কাপে ঢেলে রাখে। বাড়ি যাওয়ার আগে বলে, ‘খেয়ে নেবেন। না খেয়ে মরলে বিপদ আছে। তখন রোগাভূত হয়ে দুধ চুরি করে খেতে হবে।’
এই মেয়ের পাকামো আর গা জ্বালানো হাসি সহ্য না করে উপায় কী?
অঞ্জলি ঘর মুছে বেরিয়ে গেলে শিবনাথবাবু কান পেতে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলেন। জল পড়ছে। ছর ছর ছর ছর! কোথা থেকে পড়ছে। এটা একটা ভাল লক্ষণ। ছাদ বা কার্নিশ থেকে জল পড়ার আওয়াজ মানে বৃষ্টি পরে এসেছে। ভেরি গুড়।
অন্যদিন বিকেলের ভ্রমণ সেরে এসেই হাতের ঘড়ি খুলে ফেলেন শিবনাথবাবু। আজ খোলেননি। হাতে ধরে রাখা ‘তরিতরকারির রহস্য’ টেবিলে রেখে কবজি উলটে সময় দেখলেন। দশটা বেজে সাত মিনিট। ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালেন। এবার তৈরি হতে হয়। তৈরি হওয়ার কিছু নেই, চট করে ধুতি পাঞ্জাবিটা পরে ফেলা! হালকা দেখে একটা চাদর নিতে হবে নাকি? বৃষ্টির জন্য নিশ্চয় বাইরে ঠান্ডা ঠান্ডা থাকবে। না থাকলেও প্রিকশান নেওয়া উচিত। বাড়িতে বুড়ো বুড়ি একা মানুষ, অসুখ বিসুখ যত কম হয় তত মঙ্গল। বাসবী কোথায় গেল? এখনও টিভি দেখছে? এরপর কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। বাসবীর অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখার নেশা। চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিদেশের ছবি খোঁজে। বরফ পড়ছে, গাড়ি ছুটছে, ঝলমলে রাস্তা, বড় বড় বাড়ি এইসব। কোনও কোনও সময় আবার ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
‘দেখো, দেখো একেবারে ওদের কিচেনের মতো না? ফ্রিজের ঠিক পাশে মাইক্রোওভেন। মাথার ওপর মশলাপাতির সেল্ফ। ওদিকটা সবজি কাটার টেবিল। গ্রাইন্ডার, মিক্সার। রটা আলাদা হলেও টেবিলটা কিন্তু সূর্যদের মতোই চওড়া। চওড়া নয়। কী গো চুপ করে আছ কেন?’
শিবনাথবাবু তখন খাটে। উলটো মুখে শোওয়া। টিভি দেখতে পাচ্ছেন না। টেবিল চওড়া না সরু জানেন না।।
‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন সাতবার ওদের রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসেছ। সাতবার তো দূরের কথা, এত বছরে একবারও তো হল না।’
বাসবীদেবী ঝাঝিয়ে ওঠেন। বলেন, ‘ওমা, এ আবার কী কথা! ঘর চিনতে ওখানে যাওয়ার কী আছে? ওরা ছবি পাঠায়নি? সুচি তো ফ্ল্যাট বদলালে আগে ছবি পাঠায়। বেডরুম, কিচেন, ব্যালকনি কোনটা পাঠায় না? বলো কোনটা পাঠায় না? ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। মনে করে করে সব পাঠায়। একবার বাথরুমের ছবি পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। মনে নেই আমরা। খুব হাসলাম? এর মধ্যে সব ভুলে গেলে? যত বুড়ো হচ্ছ তত তোমার মাথাটা যাচ্ছে।’
শিবনাথবাবু মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আহা চটছু কেন? আসলে কী জানো, কোথায় যেন শুনেছিলাম, বিদেশের রান্নাঘর হল মারাত্মক জিনিস। ডলারের থেকেও মারাত্মক। মেয়েরা ডলার ছেড়েও ফিরে আসতে পারে, কিন্তু অমন চকচকে রান্নাঘর ছেড়ে আসতে পারে না। ভাবতে পারো রান্নাঘরে একটা আরশোলা নেই! আমার কী মনে হয় জানো বাসবী? এই যে তোমার ছেলে আর ছেলের বউ এখানে আসতে পারে না তার প্রধান কারণ…।’
এবার বাসবীদেবী ধমক দেন। জোর ধমক নয়, রাত বেশি বলে চাপা ধমক। ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘চুপ করো। একদম চুপ করো। এটা ক্লাসরুম নয়, আর আমিও তোমার ছাত্রী নই যে যা খুশি বকবে। ক’দিন ধরে লক্ষ করেছি তোমার মধ্যে একটা বোকা মাস্টার ধরনের ভাব এসেছে। পারলেই লেকচার দিচ্ছ। ব্যাপার কী বলো তো?’
শিবনাথবাবু খানিকটা আপনমনেই বিড়বিড় করেন। বলেন, ‘আমারও মনে হচ্ছে, তবে কারণটা ঠিক ধরতে পারছি না বাসবী।’
শাড়ি পরে বাসবীদেবী তৈরি হয়েই আছেন। শুধু চুলটা একটু আঁচড়ে নিলেই হবে। এত রাতে সেটুকু না করলেও হয়। কে দেখবে? তার ওপর বৃষ্টি বাদলার দিন। ইস, বৃষ্টির আর সময় পেল না। তিনি টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন বটে কিন্তু সেদিকে মন নেই। স্বামী পাশে এসে দাড়াতে মুখ তুললেন।
‘এমা এটা কী পরেছ? ইস্তিরি করা পাঞ্জাবিটা তো বের করে রেখেছি।’
শিবনাথবাবু বুকের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘এই জল কাদায় কাচা জিনিস পরে কী হবে? তোমার ছেলের ওখান থেকে তো আর কাচিয়ে আনা যাবে না।’
আবার নিম্নমানের রসিকতা। অন্যদিন হলে এই রসিকতা শুনে বাসবীদেবী স্বামীকে ধমক দিতেন। এটা তাকে প্রায়ই করতে হয়। এতদিন হয়ে গেল, তবু মানুষটার ভেতর থেকে পুরনো দিনের ছাপোষা কেরানিটি মাঝেমধ্যেই শামুকের মতো মুখ বের করে ফেলে। বোকার মতো আচরণ করে, বোকার মতো কথা বলে। তখন সূর্যর কথা মনে থাকে না। আরে বাবা, তুমি না হও তোমার ছেলে তো বড় মানুষ। কথা বলার সময় এইটা। মাথায় থাকবে না? বাধ্য হয়ে ধমক দিতে হয়। ধমক দিয়ে শামুকটা খোলের মধ্যে ঢোকাতে হয়।
তবে বাসবীদেবী আজ কিছু বললেন না। বোঝাই যাচ্ছে মানুষটা টেনশনের মধ্যে আছে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বয়েসে পৌঁছে যদি এমন একটা কাজ করতে হয় যার মাথা মুন্ডু কিছুই জানেন না, বোঝেন না, টেনশন তো হবেই। মনের এই অবস্থা সামলাতে নিম্নমানের রসিকতা করে ফেলাটা কিছু দোষের নয়।
বাসবীদেবী নিজেও চিন্তিত। তাঁরও ভয় ভয় করছে। গম্ভীর মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাশে মেঝেতে বসা অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অ্যাই মেয়ে, ঘুমিয়ে পড়বি না কিন্তু। টিভি দেখ। কী বলেছি মনে আছে? বেল বাজালেই দরজা খুলবি না, আগে আমাদের গলা শুনবি তারপর খুলবি। মনে থাকবে?’
মুখে রাতদিনের কাজের লোক বলা হলেও অঞ্জলি এ বাড়িতে রাতে থাকে না। শুধু বুড়ো বুড়ির অসুখ বিসুখ হলে অন্য কথা। তখন তাকে জোর করেও বাড়ি পাঠানো যাবে না। আজ কারও অসুখ হয়নি, তবু তাকে রাতে থাকতে হবে। উপায় কী? আজ শিবনাথবাবু, বাসবীদেবী কখন ফিরবেন ঠিক নেই। তাড়াতাড়ি ফিরলেও এই ছোট মফসল শহরে তখন সেটা হবে অনেক রাত। ওইসময় একটা কিশোরী মেয়ে একা একা খালের পাড়ে বাড়ি ফিরতে পারে না। আর এই বাড়িতে এমন কোনও জোয়ান পুরুষ মানুষ নেই যে তাকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে আসবে। অগত্যা আজ রাত তাকে এখানেই কাটাতে হচ্ছে।
বাসবীদেবী মাথায় দ্রুত চিরুনি বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘কী রে মনে আছে তো? আমাদের গলা শুনে দরজা খুলবি।’
অঞ্জলি টিভির থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘দিদা, তোমাদের গলা যদি কেউ নকল করে? শুনেছি চোর ডাকাতে খুব নকল করতে পারে। একবার কাঁচরাপাড়ায় আমার মামিমার ঘরে মামার গলা নকল করে চোর ঢুকে পড়েছিল। তারপর কী কাণ্ড গো! হি হি। বাইরে থেকে সবাই বলে, অ্যাই দরজা খোল, দরজা খোল। চোরটা অমনি মামার গলা নকল করে… হি হি…।’
বাসবীদেবীর খুব ইচ্ছে করল দু’ পা এগিয়ে অঞ্জলির গালে একটা চড় লাগান। দাঁতের একটা পার্টি খুলে পড়ে যাক এবং মেয়েটার হাসি বন্ধ হোক। অতি কষ্টে বাসবীদেবী নিজেকে সামলালেন। এখন মারধর তো দূরের কথা, বকাঝকার সময়ও নয়। স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, হ্যাগো ওরা দোকান খুলে রাখবে তো।
শিবনাথবাবু বেতের চেয়ারে বসে জুতো পরছেন। প্রথমে চামড়ার জুতোটা পায়ে গলিয়েছিলেন। এখন সেটা খুলে রবারের স্যাক পরছেন। সম্ভবত জুতোটায় কোনও গোলমাল হয়েছে। নইলে ফিতে আটকাতে সমস্যা করছে কেন? বৃদ্ধ বয়েসে পা বাড়ল না তো?
‘দোকান নয় বাসবী, একে বলে সাইবার কাফে। কম্পিউটার নিয়ে কারবার।’
‘ওই হল। আমি বাবা ওসব চা কফি বুঝি না। দোকানে ঠিকমতো বলে রেখেছ তো? তোমার যা ব্যাপার। হয়তো গিয়ে দেখব, ঝাপ ফেলে পালিয়েছে।’
‘পালাতে পারে। তবে আমি বিকেলেই বলে এসেছি। ছেলেটা মিত্তিরের ভাইপো। ওরই বিজনেস। কলকাতা থেকে ক’টা কম্পিউটার এনে বসিয়েছে। আমাকে তো খুব খাতির যত্ন করল।’
শিবনাথবাবু ইচ্ছে করেই নামের মধ্যে গেলেন না। নাম এখনও মনে পড়েনি। চোখে দেখলে হয়তো মনে পড়ে যাবে। অনেকসময় এটা হয়। চোখের আড়ালে থাকলে মনে থাকে না। ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’ কথাটা কি আর এমনি এমনি হয়েছে? তবে কথাটা সবসময় সত্যি হলেও নিজের সন্তানের বেলাতে নয়। এই যে সূর্য এতদিন চোখের বাইরে, সে কি আর মন থেকে মুছে যাচ্ছে? একেবারেই নয়, মোটেই নয়। বরং আরও বেশি বেশি করে চেপে বসছে।
চটি গলাতে গলাতে বাসবীদেবী খুব বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘রাখো তোমার খাতির যত্ন। আমার সব জানা আছে। এই জল ঝড় মাড়িয়ে গিয়ে কী দেখব কে জানে। উফ কী যে ঝামেলায় পড়লাম। এই বয়েসে নতুন করে এসব হয়।’
কথাটা ঠিক নয়, ওই ছেলে সত্যি সত্যি শিবনাথবাবুকে খাতির করেছে। টুল এনে বসতে দিয়েছে। বলেছে, ‘মেসোমশাই কোনও চিন্তা নেই। আপনি মাসিমাকে নিয়ে শুধু চলে আসুন। আমেরিকা কেন, সেরকম হলে আন্টার্কটিকা পর্যন্ত চলে গিয়ে আপনাকে ছেলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। পেঙ্গুইনের পাশে বসে সূর্যদা গল্প করবে। ইমেলের মজাই এটা মেলোমশাই। এক মিনিটে যেখানে সেখানে যাওয়া যায়। এই হাফ পাড়াগাঁয়ে আমি কি এমনি এমনি এই বিজনেস খুলেছি? আপনারা শুধু মুখে বলবেন আর আমি ফটাফট টাইপ করে যাব। চ্যাট কাকে বলে দেখবেন। জানেন মেলোমশাই, পাড়ায় সবাই বলত, সূর্যদা একটা জিনিয়াস হবে। আমি তখন খুব ছোট। ভাল করে বুঝতাম না। এখন দেখুন হল তো?’
খাতির যত্ন এবং ছেলের প্রশংসায় খুশি হলেন শিবনাথবাবু। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। বললেন, ‘তুমি বাপু কিন্তু খুলে রেখো। অত রাত তো।’
মিত্তিরের ছেলে দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘মেসোমশাই, রাত তো হবে। রাত হবে না? এক-একটা দেশের এক একটা টাইম। আমাদের রাত তো ওদের দিন। ওদের দিন তো আমাদের রাত। এই কারবারের মজা তো ওখানে, রাত দিন বুঝে চলতে হয়।’
সূর্যই হিসেব করে রাত এগারোটার পর সময় ঠিক করেছে। এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে, বাসবীদেবী সময় শুনে আঁতকে উঠলেন। টেলিফোন কানে চেপে ধরে বললেন, ‘এগারোটা! খোকা তুই কী বলছিস! অত রাতে তোর বাবাকে নিয়ে যাব কী করে?’
‘মা, বোকার মতো কথা বোলো না। এখানে তোমাদের থেকে অনেক বেশি বয়সের মানুষ ড্রাইভ করে কয়েক শো মাইল চলে যায়। হাউ? কী করে? তা ছাড়া বাবা তো বলল, জায়গাটা কাছে। মিনিট পনেরোর ওয়াকিং। কোন জায়গাটা যেন? বাজারের কাছে?’
‘হ্যাঁরে, অন্য কোনও সময় নেই?’
‘থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। খুবই আছে। তোমাদের রাতের বদলে আমাদের রাত আছে। কিন্তু সেই সময়তেই আবার আমরা নেই। আমাকে রাত জেগে পরের দিনের জন্য (নোট তৈরি করতে হয়। ওইসময় তোমাদের সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব। তোমার বউমার। আবার হোল ডে ধকল। নিজের রিসার্চ সামলে, মেয়ে সামলে… ওকেও তো রাতে একটু রেস্ট দিতে হবে। হবে না?’
বাসবীদেবী কাঁপা গলায় বললেন, ‘থাক ওসব, আমার বাবা টেলিফোনই ভাল। সপ্তাহে একবার কথা বলি তাতেই হবে। তা ছাড়া ওসব জিনিস তোর বাবা কি এই বয়েসে পারবে? পারবে না। ছেড়ে দে খোকা।’
ওপাশ থেকে সমুদ্র পাহাড় টপকে ভেসে আসে সূর্যর বিরক্ত গলা।
‘উফ মা, তোমাকে একই কথা কতবার বোঝাব? কতবার বোঝাব তোমাকে? টেলিফোনের খরচ এখন অনেক বেড়ে গেছে। এই ধরনের বিলাসিতা আমাদের মানায় না। আমাদের সংসারে খরচ বাড়ছে। সুচি রাগারাগি করে। এই যে ও বোজ বেজিং-এ ওর কাজিনের সঙ্গে গল্প করে, সে কি টেলিফোনে করতে হয়? যেখানে সেখানে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে। তা ছাড়া মা আরও একটা জিনিস আছে, সেটা তোমাদের বুঝতে হবে।’
‘আবার কী হল? শরীর টরির খারাপ নয় তো?’ বাসবীদেবীর গলায় উদ্বেগ।
’লাস্ট টু মা তোমাদের একটা ডলারও পাঠাতে পারিনি, কেন পারিনি সেটা একবার ভেবে দেখেছ মা? বিকজ আমাদের মেয়ের এডুকেশন। তোমার নাতনির লেখাপড়া। এখানে এখন এডুকেশন কস্ট দিন দিন বাড়ছে। শুধু এখানে কেন, সব দেশেই এক কাণ্ড! এটা একটা গ্লোবাল ফেনমেনন। আমাদের সকলকেই এটা মেনে নিতে হবে। প্লিজ, একটু বোঝো মা। আজকালকার দিনে সবদিক থেকে আমাদের সাশ্রয় করতে হবে। টেলিফোনের বদলে ইমেল এখন অনেক সস্তা, অনেক সহজ। কম্পিউটারের সামনে বসবে, ব্যস।’
‘সে বাবা, সস্তা দামি যাই হোক, আমরা কম্পিউটারের কী জানি? না, না আমরা পারব না।’
সূর্য এবার রেগে যায়। বলে, ‘দুধের ছেলেমেয়েরা যেটা পারে তোমরা কেন পারবে না! তা ছাড়া এটা সায়েন্স টেকনোলজি। এটা আমাদের সকলকে অ্যাড করাতে হবে। না জানলে শিখতে হবে। নো নো মা, এটা আমি মানব না, কিছুতেই মানব না। তুমি আগে আমার ইমেল আই ডি লিখে নাও। হাতের কাছে পেন আছে?’
পেন ছিল না, তবে পেনসিল ছিল। বাসবীদেবী তিনবার কাটাকুটির পর লিখলেন।
‘সূর্য অ্যাট দ্য রেট অফ…।’
বাসবীদেৰী স্বামীর দিকে না ফিরেই ফিসফিস করে বললেন, ‘কাগজটা নিয়েছ? ওই যে নম্বর না কী লেখা কাগজটা?’
শিবনাথবাবু মাথা নাড়লেন। রাস্তা অন্ধকার। পাশের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঝড় বৃষ্টি হলে এখানে সবার আগে রাস্তার আলোগুলো নিভে যায়। আজও নিভেছে। চারপাশের বাড়িগুলোতেও অনেকে শুয়ে পড়েছে আলো নিভিয়ে। ফলে অন্ধকারটা যেন বেশি। তবে একটা বাঁচোয়া বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ কেটে আকাশের অস্পষ্ট আলো এসে পড়ছে মাটিতে। বৃষ্টি নেই তবু মাথায় ছাতা খুলে রেখেছেন শিনাথবাবু। জোর বৃষ্টির পর বাতাসে একরকম জলের ফোটা উড়ে বেড়ায়। তাদের চোখে দেখা যায় না, গায়ে মাথায় পড়ে শিরশিরে একটা ভাব তৈরি করে।
বাসবীদেবী শাড়ির কুঁচিটা হাতে তুলে হাঁটছেন। না, শাড়িটা ভাঙা ঠিক হয়নি। কাদা-টাদায় একসা না হয়ে যায়। একটা রিকশা পাওয়া যাবে না? টর্চটা আনা উচিত ছিল। বয়েসের এই আর এক মুশকিল। সময়মতো অনেক দরকারি জিনিসের কথা মনে থাকে না, অনেকটা বাদে মনে পড়ে। এটা বিচ্ছিরি। একেবারে ভুলে গেলে একটা কথা ছিল।
সামনের ছিপছিপে জমা জল এড়াতে গিয়ে বাসবীদেবী ছোট একটা ইটের টুকরোয় হোঁচট খেলেন। সামান্য হোঁচট। ডান পায়ের কড়ে আঙুলটা কনকনিয়ে উঠল!
‘উফ।’
শিবনাথবাবু এগিয়ে এসে স্ত্রীর হাত ধরলেন।
‘লাগল?’
‘না।’
‘সাবধানে হাঁটো।’
‘চুপ করো, বেশি কথা বলো না।’
শিবনাথবাবু ভেবেছিলেন চাপা ধমক দেওয়ার পর বাসবীদেবী তাঁর হাত ছাড়িয়ে নেবেন। কিন্তু নেননি। তিনি বুড়ো মানুষটার হাত ধরেই আছেন।
দু’জনে হাঁটছেন সাবধানে, ভয়ে ভয়ে। যতটা পারা যায় পায়ের তলার জল বাঁচিয়ে, গর্ত এড়িয়ে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, আলো আঁধারে নড়বড়ে দুটো মানুষ হেঁটে চলেছে। হেঁটে চলেছে এক অচেনা, অজানা পথ ধরে।
কথা সাহিত্য শারদীয়া, ১৪১৪