ইন আ ফলিং এয়ারপ্লেন

ইন আ ফলিং এয়ারপ্লেন

“আশা করছি আমার প্রশ্নের জন্য কিছু মনে করবেন না, মিস, কিন্তু আপনি কি নস্ট্রাডামুস এর ভবিষত্বাণীর ব্যাপারে কিছু জানেন?

আমি তখন জানালা দিয়ে বাইরের মেঘ দেখছিলাম। চোখ সরিয়ে এনে আমার পাশে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালাম। তার পরনে ম্যাটম্যাটে ধূসর বর্ণের সুট। আর চেহারাটা একদম বৈশিষ্ট্যহীন। শহরের রাস্তায় বের হলে এরকম লোক প্রচুর দেখা যায়। লোকটার বয়স ত্রিশের মত হবে, তারমানে আমার মতই বয়স।

“ভবিষ্যৎবানী? আপনি বলতে চাইছেন ওই যে ১৯৯৯ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ওই ধরনের কিছু?”

লোকটা মাথা ঝাঁকাল।

“হ্যাঁ, ওসব জানি,” আমি বললাম। “যখন ছোট ছিলাম তখন এসব নিয়ে অনেক হৈচৈ হত। কিন্তু..মাফ করবেন,” সিট আর মাঝের করিডরের দিকে চোখ বুলিয়ে বললাম আমি, “আপনার কি মনে হচ্ছে না এরকম কিছু নিয়ে কথা বলার জন্য এখন সময়টা আসলে ঠিক নয়?”

“আসলে ঠিক করে বললে এই সময়টার কারনেই আমি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাইছি।”

আমাদের সারিতে তিনটা সিট। এক জনের জন্য একটা করে। আমি বসেছিলাম জানালার পাশের সিটে। লোকটা বসেছিল মাঝখানের সিটটাতে। করিডরের সাথের সিটটা খালি ছিল।

“এটা কি কোন ধরনের খাতির জমানোর চেষ্টা নাকি?”

“একদমই না। আমি বিবাহিত,..যদিও আমার স্ত্রী আর আমি এখন আর একত্রে বসবাস করছি না,” লোকটা কাঁধ ভাগ করে বলল। “নস্ট্রাডামুসের কথা যেটা বলছিলাম। উনার ভবিষৎবাণীর উপর আমার অনেক বিশ্বাস ছিল। আমি আসলেই বিশ্বাস করতাম যে ১৯৯৯ সালে মানবজাতি ধুয়ে মুছে বিলিন হয়ে যাবে। আমার মনে হয়েছিল আমি নিজেও বাঁচব না।”

“আমারও তাই,” আমি বললাম। “হাইস্কুলে পড়ার সময় নস্ট্রাডামস সম্পর্কে জানতে পারি। উনার ভবিষ্যত্বাণী শুনে এতটা আতংকিত হয়েছিলাম যে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। সত্যি সত্যি মনে হয়েছিল যে আমি মারা যাব, আমার বাবা-মা মারা যাবেন। এর আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল মৃত্যু খালি অন্য মানুষদের হয়। কিভাবে ১৯৯৯ সালে আমার বয়স একুশ হবে তা নিয়ে খালি ভাবতাম আমি।”

লোকটা কাঁধ সোজা করে তাকাল। চোখে অবাক দৃষ্টি। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পুরোপুরি কুইজ শো এর হোস্টদের মত।

“তারমানে আপনি আমার বয়সি। একই স্কুল ইয়ার।”

“তাই বুঝি? একুশের পর জীবন নিয়ে আমার কাছে কোন প্ল্যান ছিল না।”

“কিন্তু শেষ তো হয়নি নাকি? পৃথিবীর কথা বলছি। হতে পারে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি কিন্তু তখন থেকে আমার মনে হয় আমাকে হয়ত অতিরিক্ত কিছু সময় দেয়া হয়েছে আরো কয়েক বছর বাঁচার জন্য।” লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, গলা ভারি শোনাল। আমরা প্লেনের সবচেয়ে পেছনের সারিতে বসে আছি। আমার বাম পাশের জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল। নিচে ঘন সাদা মেঘ, ভেড়ার লোমের মত ঘন। বেশ শান্তিময় একটা দৃশ্য, স্বর্গের দৃশ্য ঠিক যেমনটা হতে পারে বলে আমি কল্পনা করেছিলাম।

“ব্যাপারটা একটু ক্লান্তিদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে,” লোকটা মলিন হেসে বলল। আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে সিটের পেছনে লুকিয়ে ছিলাম। কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে নিচু গলায় কথা বলছিলাম। দেখে মনে হতে পারে কোন বয়স্ক দম্পতি, চাইলেও যাদের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই।

“আমার মনে হয় না এছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে।”

লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল আর দুই সিটের মাঝখানের ফাঁকে মুখ চেপে ধরল যাতে করিডর দেখা যায়, যেটা আসলে দৃষ্টিকোনের কারনে সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় সে আমাকে বলল, “আমি অনেক দিন থেকেই আসলে কথাটা ভাবছি, এই প্লেনে ওঠার অনেক আগে থেকেই। নস্ট্রাডামুসের ভবিষ্যত্ববানী মিথ্যা প্রমানিত হওয়ার পর ১৯৯৯ থেকে যেসব নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে তারা মৃত্যু নিয়ে কি ভাবে? আমি একদম নিশ্চিত যে মৃত্যুর ব্যাপারে তাদের ধারণা আপনার আমার থেকে আলাদা। যারা ১৯৯৯ এর আগে জনুগ্রহন করেছিল তাদের মাথার উপর ওই ভবিষ্যত্ববানী খড়গের মত ঝুলছিল। আমাদের উপর অভিশাপের ছায়া ফেলছিল। এমনকি যেসব শিশু-কিশোর ব্যাপারটা বিশ্বাস করত না, তাদের মনেও কিছুটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখনকার বাচ্চারা একদম আলাদা। দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেল কিনা কিংবা তারা মারা যাবে কিনা এসব নিয়ে তাদের মনে কোন চিন্তা নেই।”

“আপনার তাই মনে হয়?” আমি বললাম। “নস্ট্রাডামুসকে বাদ দিলেও আরো হাজারটা জিনিস আছে যার কারনে ওদের মনে ধ্বংস কিংবা মৃত্যুর চিন্তা আসতে পারে। প্রতিদিনই গাড়ি দুর্ঘটনা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগও আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। আমার অন্তত তাই ধারণা।”

লোকটা বড়জোর এক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকাল।

“আপনার যুক্তি বুঝতে পারছি। হয়ত ঠিকই বলছেন।” সে আবার তার মুখ সিটের ফাঁকে চেপে ধরল সামনে দেখার জন্য। মুখে তখনো মলিন হাসি। প্লেনটা একটু কাত হল। একই সময়ে আমরা একটা ক্যান গড়ানোর শব্দ পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই এরকম হচ্ছে। প্রতিবার প্লেনটা কোনদিকে একটু কাত হলেই একটা ক্যান সামনে পেছনে গড়াগড়ি করছে।

“কখনো কল্পনাও করিনি যে কোন প্লেন ক্রাশে আমার মৃত্যু হবে। আপনি করেছেন? আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এই প্লেনটা কোথাও আছড়ে পড়বে। আপনার কি মত?”

“হ্যাঁ, ভয়ের ব্যাপার। এখনো অনেক কিছু বাকি আছে যা আমি করতে চাই। প্লেন ক্রাশে মৃত্যু…নাহ…এখনো বিশ্বাস ক ব্যাপারটা।”

আমি কাঁধ যাগ করে মাথাটা একটু তুললাম যাতে সিটের উপর দিকে সামনে কি হচ্ছে তা দেখতে পারি। নিউ ইয়ার কিংবা ওবনের (জাপানি বুদ্ধিস্ট অনুষ্ঠান) সময় হলে প্লেন ভর্তি থাকত। কিন্তু বছরের এই সময়ে প্লেনের মাত্র অর্ধেকের মত ভর্তি ছিল। হাতে পিস্তল করিডোরে নিয়ে একজন হাইজ্যাকার দাঁড়িয়ে আছে।

***

আধঘণ্টা আগে প্লেনটাকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। টেক অফের কিছুক্ষণ পরই। অল্প বয়সি এক যুবক, দেখে মনে হয় কলেজের ছাত্র, প্লেনের সামনের দিকে বসে ছিল। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে লাগেজ ব্যাক থেকে কিছু একটা বের করতে থাকে। কেবিন ক্রু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বসতে বলে। ছেলেটা ব্যাগ থেকে পিস্তলের মত কিছু একটা বের করে মেয়েটার বুকে চেপে ধরে।

তারপর অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে, যেমন “ব্যাপারটা ভুলে যাও, ভুলে যাও। আমাকে ভুলে যাও। আমাকে ভুলে যাও।”

ছেলেটা রঙ ওঠা পুরনো ময়লা একটা সোয়েটার পরে ছিল। তার উপরে একটা সাদা কোট। চুলগুলো কোঁকড়া। মাঝখানের এক ফালি চুল এন্টেনার মত খাড়া হয়ে ছিল। পিস্তল ধরা হাতটা কাঁপছিল। সত্যি বলতে কি পিস্তলটা দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছিল নকল, মনে হচ্ছিল ওয়াটার গান ধরে আছে।

“ভুলে যেতে পারব না, এটাই আমার চাকরি। আমাকে আমার কাজ করতে হবে,” ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট পিস্তলের ব্যারেল উপেক্ষা করে বলল। মনে হয় মেয়েটাও আমার মত পিস্তলটাকে খেলনা ভেবেছিল। ছেলেটা পিছিয়ে গেল। মনে হল সিটে বসতে যাচ্ছে।

ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট সামনে এগিয়ে গেল যেন ছেলেটার সাথে জিতে গিয়েছে। নিজেকে কি মনে করেন আপনি? সিট বেল্ট বেঁধে রাখার সাইন এখনো অন। আপনি কি ভেবেছেন এখন সিট ছেড়ে উঠলে কি আসে যায়? আর এসব কি পোশাক? মাঝে মধ্যে দু-একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন তো খুলে দেখতে পারেন, নাকি? কি জঘন্য অবস্থা!”

বাকি সব যাত্রি ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে ছেলেটাকে ঝাড়তে দেখে মজা নিচ্ছিল। ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর পিস্তলটা কেবিন অ্যাটেন্ডেন্টের দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে দিল। শুকনা একটা ধপ শব্দ হল আর মেয়েটা কলাগাছের মত করিডোেরে পড়ে গেল। যাত্রিদের হাসি হাসি মুখ মুহূর্তেই হাঁ হয়ে গেল। তাদের কিছুই করার ছিল না হাঁ করে দেখা ছাড়া। অপরিচ্ছন্ন পোশাক পড়া ছেলেটা করিডোর দিয়ে ককপিটের দিকে এগিয়ে গেল।

যাওয়ার সময় সে বলতে লাগল, “কেউ নড়বেন না, প্লিজ। যে নড়বেন তাকে আমি গুলি করব। পাইলটের সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনাদের সাথে এরকম করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।”

সে সামনে পেছনে কয়েকবার তার মাথা ঝাঁকাল। আর হাঁটার মধ্যেও কেমন একটা অদ্ভুত নার্ভাস ভঙ্গি ছিল। প্লেনের সামনের দিকে বসা একটা লোক উঠে দাঁড়াল। সুন্দর একটা সুট পড়া সুদর্শন এক যুবক।

“এক মিনিট দাঁড়াও!” লোকটা গম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বলল। ছেলেটা থামল, ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছিল।

“কি..?”

“এটা মজা করার কোন ব্যাপার না। খেলনা দিয়ে স্টুয়ারডেসকে ভয় দেখাচ্ছিলে আর সেজন্য ক্ষমা চাওনি?”

“যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু কিছু আসে যায় না,” ছেলেটা বলল। “আপনার সুটটা দারুণ। বাজি ধরে বলতে পারি আপনি ভাল কোন কলেজে পড়েছেন। পাশ করার পর ভাল চাকরি করছেন, ওর গলায় ঈর্ষা।

“ঠিকই ধরেছ। আমি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়।”

ছেলেটা পিস্তল তুলে লোকটাকে গুলি করল। তারপর যাত্রিদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল আর কেউ টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে কিনা। কেউ হাত তুলল না। ছেলেটা ঘুরে ককপিটে ঢুকে গেল। ছেলেটা অদৃশ্য হতেই কেবিনের যাত্রিদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেলেটা ফিরে এলে আবার সবাই চুপ হয়ে গেল।

“সবাই শুনুন প্লিজ। আমি জানি আপনারা কেউ কেউ হয়ত বাড়িতে ফিরছেন অথবা কোথাও ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে আমি এই ফ্লাইটের গন্তব্য বদলে দিয়েছি। হানেদা এয়ারপোর্টের বদলে আমরা এখন যাচ্ছি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র হলগুলোর দিকে।”

এক মুহূর্তের জন্য থেমে সে সবাইকে কথাগুলো হজম করার সুযোগ দিল। তারপর আবার শুরু করল। “আর দেড় ঘন্টার মধ্যে আমরা ক্যাম্পাসের বিল্ডিংগুলোর উপর ক্রাশ করব। আমি আপনাদেরকে আমার সাথে মৃত্যুবরণ করার জন্য আহবান করছি। প্লিজ। পর পর পাঁচ বার আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি। মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই।”

কলেজের ছাত্রর মত দেখতে ছেলেটা আসলে কলেজের ছাত্র ছিল না। সে ছিল বেকার আর মরিয়া। আর আমরা, যাত্রিরা ওর আত্মহত্যার প্ল্যানে আটকা পড়েছি।

***

আরেকবার গুলির শব্দ হলে আমি আর ধূসর সুটের লোকটা এক সাথে করিডরের দিকে তাকালাম। ছেলেটা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। সামনে একটা লাশ পড়ে আছে। আমি বললাম কেউ নড়বেন না! তারপরেও কেন নড়ছেন?!”

গুলির শব্দে হাত দিয়ে কান ঢাকা যাত্রিদের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করল সে। সযোগ আছে ভেবে কয়েকজন যাত্রি সিট থেকে পেছন থেকে আক্রমণ করার চিন্তা করেছিল। ছেলেটার চেহারার অধৈর্য অভিব্যক্তি যেন বলছিল, “চেষ্টা করেই দেখুন খালি!” দেখে মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে কাবু করা সহজ কাজ হবে। এমনকি আমিও, যার শরীরে শক্তি কম, আমারও ইচ্ছা করছিল একবার চেষ্টা করে দেখতে। ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল সে জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু তারপরেও, ছেলেটাকে ধরার জন্য যে কয়জন চেষ্টা করেছিল তাদের সবাইই কেবিনে গড়াতে থাকা একটা খালি ক্যানে পিছল খেয়ে পড়ল। তারপর ছেলেটা গুলি করে তাদের নড়াচড়া পুরোপুরি থামিয়ে দিল।

ক্যানটা কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত গড়াতে থাকল। একবার একজনের পায়ের নিচে পড়লে ছিটকে গিয়ে আবার অন্য কোথাও গিয়ে পড়ত।

“ছেলেটা আসলে বেশ লাকি,” আমার পাশের লোকটা বলল। এখনো সিটের পিছনে লুকিয়ে আছে। প্রায় সব যাত্রিই সিটের পেছনে মাথা নিচু করে রেখেছে। যদি কোনভাবে কোন বুলেট ছিটকে গিয়ে লাগে এই ভয়ে।

“সবার পা গিয়ে কেন ওই শালার খালি ক্যানটার উপরই পড়ছে? সবাই বোধহয় তাদের প্ল্যান নিয়ে এতটাই মগ্ন যে পা কোথায় ফেলছে সেদিকে খেয়াল নেই।”

হাইজ্যাকার যদি এই আলোচনা শুনতে পায় তাহলে আমাদেরকে কি বলতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তবে আমি নিশ্চিত যে যতক্ষণ আমরা সিটের পেছনে আমাদের মাথা নিচু করে রাখছি ততক্ষন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে না।

“আমার মনে হয় শুধু যাদের পা নেই তারাই খালি ক্যানে পা ফেলবে না,” লোকটা মন্তব্য করল। “যেমন ভুত। কিন্তু তবুও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এই ছেলে আমাদেরকে জোর করে ওর সুইসাইড ট্রিপে নিয়ে যাচ্ছে।”

“আপনার কি মনে হয় এই প্লেন সত্যি ধসে পড়তে যাচ্ছে?”

“গল্প-উপন্যাস হলে কোন এক একশন হিরো এসে পরিস্থিতির দখল নিত।”

“আপনি বলতে চাইছেন সে আমাদেরকে রক্ষা করত?”

বলতে গেলে, যদি কোন ছোট গল্পের বইয়ের শেষটা তাড়াহুড়া করে লিখতে হয় তাহলে এরকমই সমাপ্তি হওয়া উচিত। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমরা সবাই ক্রাশ করতে যাচ্ছি। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলো আজ ভয়াবহ আতংকের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।”

লোকটা তার তর্জনী কপালে ঠেকিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়াল যেন শোক প্রকাশ করছে। নাটুকে অঙ্গভঙ্গি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই প্লেনে চড়ার পেছনে আমার অন্য একটা কারন আছে। আর সেটা হাইজ্যাক হওয়া নয়।

প্লেন ক্রাশ করে মরার আইডিয়াটা আমার পছন্দ হল না। একদম ছোটবেলা থেকে পুরোটা জীবন ভেবে এসেছি শান্তির সাথে মৃত্যুবরণ করব। আকাশে কখনো তারা খসে পড়তে দেখলে আমি কখনো সুখি বৈবাহিক জীবন কিংবা সফল ক্যারিয়ার চাইনি। বরং আমি চেয়েছি আমার মৃত্যু হোক ঘুমের মধ্যে।

“মরতে যাচ্ছি এই চিন্তাটা আমার কোনভাবেই হজম হচ্ছে না, আমাদের কি কিছুই করার নেই?”

“জানি কি বলতে চাইছেন। যে মুহূর্তে আমরা হিট করব, বর্ণনাতীত ব্যথা অনুভূত হবে। আমাদের হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো গুড়ো হয়ে যাবে। শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে, আগুনের শিখা আমাদেরকে খেয়ে ফেলবে। পুরোটাই জঘন্য ব্যাপার।”

“তরও অন্তত আশা করছি তাড়াতাড়ি মরব…”

“সেটা তো সহজ!” লোকটা উৎসাহের সাথে বললেও গলার স্বর নিচু রাখল যাতে হাইজ্যাকার শুনে না ফেলে। “তাড়াতাড়ি মরতে চাওয়া কোন সমাধান না। কে জানে কপালে কি আছে? ও যদি কোন ভুল করে আমরা হয়ত তাহলে বেঁচে যেতেও পারি। কিংবা হয়ত ডালপালায় ঝুলে থেকে নাড়িভুড়ি বের হয়ে কয়েক ঘন্টা ভুগে ভুগে মরব।”

হঠাৎ আমার চোখের সামনে আমার মৃত্যুদশা ভেসে উঠল মনে হল। কষ্টে মোচড়াচ্ছি, বমি বমি ভাব হচ্ছে, আর বগল ঘামে ভিজে আছে।

“আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে, আমি অবশ্যই শান্তিময় মৃত্যু বেছে নিতাম।”

আমার অধৈর্য বিড়বিড় শুনে লোকটা আঙুল দিয়ে এমনভাবে ঠকঠক শব্দ করল যেন ছেলেটা শুনতে না পায়।

“এই কথাগুলো শোনার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম।” সে বলল।

আমি একটু সরে বসলাম।

“কি বলতে চাইছেন? আঙুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছেন যেন খুব ফুর্তিতে আছেন? কমন সেন্স না থাকারও একটা লিমিট আছে!”

“মাফ করবেন। আমি বোধ হয় আপনাকে এখনো বলিনি, আমি একজন সেলসম্যান।”

লোকটা তার সুট এর পকেট থেকে কিছু একটা বের করল। তারপর মুখটা আমার কাছে আনল।

“এটা দেখুন।”

লোকটার হাতে একটা ছোট সাইজের হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ, ভেতর স্বচ্ছ কোন তরল ভরা।

“এটার একটা শট নিলে যে কেউ কষ্টবিহীন মৃত্যুবরণ করবে। আমার কাছে আর এই একটাই আছে। আপনি কি কিনতে চান?”

কেউ একজন সিট থেকে উঠে অল্পবয়সি ছেলেটার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল। তারপর আমাদের কানে খালি ক্যানটা নড়ার শব্দ এল। তারপর গুলির শব্দ।

“আপনি বলছেন সিরিঞ্জের ভেতরের ডাগটা ইয়থানাসিয়া? যন্ত্রণাবিহীন মৃত্যু দিতে পারবে?”

“ঠিক তাই। আপনি যদি প্লেন ক্রাশ করার আগেই এই ইনজেকশনটা গ্রহণ করেন তাহলে কোন ভয়, কোন অনুভূতি ছাড়াই মৃত্যুবরণ করতে পারবেন। কিন্তু যদি কিনতে চান তাহলে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

“কেন?”

“কারন ডাগটা কাজ করতে আধা ঘন্টার মত সময় লাগে। যদি ধরে নেই প্লেন ক্রাশ করার আগে আমাদের হাতে এক ঘন্টার মত সময় আছে তাহলে আপনার হাতে ত্রিশ মিনিটের মত সময় আছে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। নাহলে ডাগটা ঠিক মত কাজ করবে না, আর আপনিও অন্য জগতে যাওয়ার আগে টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখা পাবেন। সুতরাং সময় নষ্ট করবেন না।”

“আপনি আসলে কে বলুন তো? আজরাইল নাকি?”

“আমি সেফ সাধারণ একজন সেলসম্যান। আপনার নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে ভেবে যে কেন আমার কাছে একটা ইয়থানাসিয়া ডাগ আছে? আচ্ছা, এখন আপনাকে বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আসলে আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করছিলাম।”

হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা স্যুটের পকেটে রেখে লোকটা দূরে কোথাও তাকিয়ে নিজের গল্প বলা শুরু করল।

“একদম ছোট থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল একজন সেলসম্যান হব। স্বপ্নটা একটু অদ্ভুত, জানি। আমার শিক্ষকরাও আমাকে তাই বলেছিলেন। এর মধ্যে আকর্ষণটা কোথায় তা আপনি জানতে চাইতে পারেন। আমি শুধ বলতে পারি সেটা হল লোকজনের সাথে কথা বলার মধ্যে, তাদের কাছে। দরাদরি করে প্রোডাক্ট বিক্রি করার মধ্যে।”

“আপনার স্বপ্ন তাহলে সত্যি হয়েছে, আপনি তো এখন একজন সেলসম্যান।”

লোকটা মাথা ঝাঁকাল, কিন্তু মুখে হাসি নেই।

“কিন্তু সত্যি কথা হল, এই কাজের জন্য আমার কোন মেধা নেই। দশ বছর হয়ে গেল সেলসম্যান হিসেবে কাজ করছি, কোন উন্নতি দেখছি না। আমার পরে যারা শুরু করেছিল তারাও এখন আমার চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। কোম্পানিতে আমার অবস্থান এখন মাত্র স্কুল থেকে বের হয়ে নতুন চাকরি পাওয়া একজনেরও নিচে। আমার স্ত্রী আমার উপর আশা ছেড়ে দিয়েছে। সে আমাকে ছেড়ে এখন টোকিওতে নিজের বাবা-মা এর সাথে গিয়ে থাকছে।”

“তারমানে আপনার মনে হচ্ছে যে আপনার জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যে কারনে আপনার উচিত আত্মহত্যা করা?”

লোকটা মাথা ঝাঁকাল।

“আমাকে বোঝে এমন একজনের সাথে কথা বলেছি। সে একজন ডাক্তার। তার কাছ থেকে অনেক টাকা দিয়ে এই ইয়থানাসিয়া ডাগ কিনেছি।

“কি ধরনের জঘন্য ডাক্তার হলে এমন কাজ করতে পারে?

“খুবই বয়স্ক আর খানিকটা ভ্রু ঢিলা ধরনের ডাক্তার হলে। ভাগটা হাতে পাওয়ার পর আমি এই প্লেনে চড়ে আত্মহত্যা করার জায়গাটায় যাচ্ছিলাম।”

“ও আচ্ছা আপনার প্ল্যান ছিল অন্য কোথাও গিয়ে আত্মহত্যা করার?”

“হ্যাঁ আমার প্ল্যান ছিল আমার শ্বশুরবাড়ির দরজার সামনে বসে আত্মহত্যা করার। আমার স্ত্রী বাসা থেকে বের হয়ে আমার মৃতদেহে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এরকম একটা দৃশ্য আমার চোখে ভাসছে। ব্যাপারটা ওর জন্য কঠিন শক হবে। আর ও বিশাল রকমের ঝামেলাতেও পড়বে। ওর প্রতিবেশীরা যে ওকে আর আগের মত পছন্দ করবে না, তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।”

“কি ভয়াবহ!”

“আপনার সমালোচনা বরং আপনার কাছেই রাখুন। এদিকে আমার প্ল্যান মাঠে মারা গেল এই হাইজ্যাকিঙের জন্য। তাই ভাবছিলাম আপনি আমার ইয়ুথানাসিয়া ডাগটা কিনবেন কিনা। সেলসম্যান হিসেবে মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছা হল কারো কাছে কিছু একটা বিক্রি করতে পারা। আপনি আমার কাছ থেকে ডাগটা কিনলে আমিও শান্তি নিয়ে মরতে পারি।” সে দুঃখী দুঃখী চোখে বলল। বৃষ্টিতে ভেঁজা কুকুরের চোখে যেরকম দৃষ্টি থাকে।

আমি এক মিনিট চিন্তা করলাম। আইডিয়াটা খারাপ না কিন্তু। “কিন্তু ডাগটা নিশ্চয়ই অনেক দামী? কত?”

“আপনার পার্সে কত আছে?”

সিট থেকে মাথা না হলে আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে ওয়ালেটটা বের করলাম। তারপর খুলে লোকটাকে দেখালাম আমার কাছে কত আছে।

“তিনটা দশ হাজার ইয়েনের নোট আর কিছু ভাংতি। একটা ব্যাংক কার্ড দেখতে পাচ্ছি। একাউন্টে কত আছে?”

“প্রায় তিন মিলিয়ন ইয়েনের মত।”

“তারমানে সব মিলিয়ে তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েনের মত দিতে পারবেন।”

“এত্ত দাম! আমার সর্বস্ব চলে যাবে।”

“আপনি তো এসব নিয়ে কবরে যেতে পারবেন না। ভেবে দেখুন। আপনার ব্যাংক কার্ড আর পিন নাম্বারটা দিন।”

“দাঁড়ান দাঁড়ান, এক মিনিট। আপনি আর হাইজ্যাকার একসাথে কাজ করছেন তাই না? আপনাদের ধান্দা হল প্লেন হাইজ্যাক করে এই ডাগ বিক্রি করে টাকা পয়সা কামানো।”

সেলসম্যান নাক টেনে শব্দ করল। “আপনার ধারণা জালিয়াতি করার জন্য আমি এইসব খুনাখুনি করছি?” থুতনি নাড়িয়ে করিডোরে পড়ে থেকে এয়ারহোস্টেসের দিকে ইঙ্গিত করল।

“ঠিক আছে, আপনাকে বিশ্বাস করছি। কিন্তু তারপরেও আমার ধারণা একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ এর জন্য সর্বস্ব দিয়ে দেয়া বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে দশ হাজার ইয়েন দিব। সেটাও আমার কাছে অনেক বেশি মনে হচ্ছে।”

সত্যি বলতে কি আমি ডাগটা চাই। আমি যদি সত্যি সত্যি মরার মুখে থাকি তাহলে এখন এসব টাকা আমার কাছে স্রেফ কিছু কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর লোকটাকে ব্যাংক কার্ড দিলেও সে টাকা তুলতে পারছে না, সে-ও তো একসাথেই মরবে। ও আর আমি তো একই প্লেনেই বসে আছি যেটা ক্রাশ করতে যাচ্ছে। এই ভাগ্য এড়ানোর কোন উপায় নেই। কিন্তু আমি জিদ ধরে থাকলাম।

“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েন! খুবই বাড়াবাড়ি।”

“এরকম একটা সময়ে আপনি দাম নিয়ে মুলোমুলি করছেন? আমি যদি এই জিনিস এখন দশ হাজার ইয়েনে বিক্রি করি তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে? পরের জন্মে আর জেগে উঠতে পারবে?”

“আপনার আত্মার কথা জানি না,” আমি বললাম, “কিন্তু আমার পুরো জীবন চলেছে লোকজনকে দাম কমানোর কথা বলে। দিনের পর দিন আমি সবজির দোকানে কিংবা মাছের দোকানে গিয়ে লোকজনের সাথে দাম কমানো নিয়ে মুলোমুলি করেছি। এখানেই আমার আনন্দ। আমি বলতাম বাঁধাকপিতে পোকা, কিংবা মাছটা একটু নরম হয়ে গিয়েছে। কোন না কোন একটা খুঁত ধরে আমি একটু সস্তায় কেনার চেষ্টা করতাম। পুরো দিনের মধ্যে ওই একটা সময়েই আমার যা একটু মানুষের সাথে যোগাযোগ হত।”

“কি দুঃখজনক জীবন। আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানে কারো সাথে কথা বলেন না?”

“না, একদমই না। আমি একটা মাঙ্গা ক্যাফেতে পার্টটাইম কাজ করি। কেউ আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আমি তাকে উপেক্ষা করি। আমি ওই ধরনের মানুষ যারা সবসময় অন্যদের ভয় পায়। সেজন্যই একা থাকি, বিয়েও করিনি।”

“কি নিদারুন অপচয়! আমার বলা হয়ত ঠিক হচ্ছে না কিন্তু আপনি দেখতে খারাপ নন। আপনার ফিগার…”

“জানি।”

“আমি জানি আমার বলা ঠিক হয়নি।”

“কিন্তু আমি কিছু ট্রমায় ভুগেছি যে কারনে লোকজনের সংস্পর্শে ভয় পাই। স্পষ্ট করে বললে পুরুষদের ক্ষেত্রে। অনেক বছর আগে এক লোক আমার সাথে কিছু খারাপ কাজ করেছিল।”

“খারাপ কাজ?”

“হ্যাঁ, যে রকম খারাপ কাজের কথা কেউ লেখার আগে দুইবার ভাববে।”

লোকটা একথা শুনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। আমি নিচু গলায় তাকে জানালাম হাইস্কলে থাকতে আমার

লে থাকতে আমার সাথে কি হয়েছিল। যে লোকটা আমার মন আর শরীর দুটোই টুকরো টুকরো করেছিল তার নাম আর চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

সেলসম্যান লোকটা মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল। তার কপাল আর ভুরু থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। হাত দিয়ে মুখ চেপে আছে যেন অসুস্থ বোধ করছে। চোখগুলো লাল দেখাল যেন এখনি কেঁদে ফেলবে।

“কী ভয়ংকর। মনে হল যেন কোন থ্রিলার উপন্যাসের কাহিনী শুনলাম। যেখানে ক্রিমিনাল একজন যুবতী নারী। যার অপরাধের মোটিভ হল অতীতে নির্মমভাবে রেপড হওয়া।”

“বুঝলেন তো?” আমি বললাম। “আসল কাহিনী হল, মাত্র কিছুদিন আগে আমি ওই লোকটার বাসার ঠিকানা আবিষ্কার করেছি, যে আমার সাথে এসব করেছিল। টোকিওর এক প্রাইভেট গোয়েন্দাকে ভাড়া করেছিলাম।”

“আপনি কেন তাকে খুঁজে বের করতে চাইছিলেন?”

“আবার জিগায় প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নেয়ার জন্য! গোয়েন্দার দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে এখন বিবাহিত। একটা বাচ্চাও আছে। সে সুখি জীবন কাটাবে আর আমি বসে বসে আঙুল চুষব? না! সেকারনেই আমি এই প্লেনে চড়েছি। আমার ইচ্ছা ছিল হানেদা এয়ারপোর্টে নামার পর সোজা তার বাড়িতে যাব, তারপর তার চোখের সামনে তার বাচ্চাকে নির্যাতন করব।”

“আর আপনি আমাকে মাথা খারাপ বলছেন? আপনি নিজে কি?”

“আমাকে একা থাকতে দিন। এসবের থেকে মুক্তি চাই আমি।”

আবারো আমরা প্লেনের ভিতর খালি ক্যানটাকে গড়াতে শুনলাম। তারপর গুলির শব্দ হল। এবার আর আমরা কষ্ট করে তাকালামও না। দুজনেই পুরোপুরি নিশ্চিত যে আবারও কেউ একজন উঠে ছেলেটাকে ধরার চেষ্টা করেছে আর ক্যানে পা দিয়ে উল্টিয়ে পড়েছে। তারপর গুলি খেয়ে মরেছে।

“যাই হোক, দশ হাজার ইয়েন দিয়ে আমার একদমই পোষাবে না। যদিও আপনার মত কাউকে একথা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে, যার জীবনের সকল আনন্দ কিনা দামদামি করায় সীমাবদ্ধ।।”

‘শুনুন। আমি যা বলছি শুনুন। আমি একটা ভাল প্রস্তাব পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না এখন। আপনি ওই ডাক্তারকে কত দিয়েছেন?”

“এই একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ এর জন্য আমি ডাক্তারকে তিন মিলিয়ন ইয়েন দিয়েছি। গাধার বাচ্চা ডাক্তার। এই জিনিস আমার মত সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। যে কারনে দাম এত বেশি নিয়েছে। কিন্তু দেখুন দামটা একদম আপনার ব্যাংক একাউন্টে যা আছে তার সমান। একদম খাপে খাপ মিলে যাওয়ার মত একটা লেনদেন।”

“আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে আসলে কতখানি বিশ্বাস করা যায়। কিভাবে বুঝব আপনি সত্যি বলছেন? আপনি হয়ত তিন মিলিয়ন দিয়ে কিনেননি, এখন বানিয়ে বলছেন।”

সেলসম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই সে মিথ্যা বলছিল কিনা। সে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল।

“মূল দাম যত বেশি ততই ভাল, তাই নয় কি?” অন্যদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল। মনে হল বিরক্ত।

আমি চিন্তা করলাম ওই ইয়থানাসিয়া ডাগের মূল্য আসলে এখন কত হওয়া উচিত। যে লোক প্ল্যান ক্রাশে মৃত্যু নিয়ে যত ভীত হবে, সে নিশ্চয়ই তত বেশি মূল্য দেয়ার জন্য রাজি থাকবে? কিন্তু ডাগটার মূল্য নির্ধারণের জন্য কি সেটাই একমাত্র ভিত্তি?

“আচ্ছা এটা বলুন, আপনি নিজে কেন ডাগটা ব্যবহার করছেন না?”

“আর কেউ না বুঝলেও আপনি বুঝবেন বলে আমার ধারণা। আমি চাই জীবনের একদম শেষ মহুর্তে কাউকে কিছু বিক্রি করে সন্তুষ্টি পেতে।”

আমি এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সিটের পেছন থেকে মাথা তুলে পিস্তল হাতের অল্পবয়সি ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে করিডরের মাঝে দাঁড়িয়ে উদ্ভটভাবে পিস্তলটা রিলোড করছিল। হিরো মুডে থাকা দুজন পুরুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য লাফিয়ে উঠে ওকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, একজন খালি ক্যানটায় পা ফেলে উলটে পড়ল। আর দ্বিতীয়জন তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আমরা পরপর দুটো গুলির শব্দ পেলাম। তারপর আবার সব চুপচাপ।

“আমি বুঝতে পারছি। এটা আর কোন ব্যবসায়িক লেনদেন নেই। জুয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

সেলসম্যানের দিকে তাকালাম। তার চেহারা দেখে মনে হল শক খেয়েছে।

“আপনি বলেছেন মারা যাওয়ার আগে কাজ করতে ইনজেকশনটার ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে। যে কারনে আমার তাড়াতাড়ি মনস্থির করতে হবে। প্লেন ক্রাশে মরতে না চাইলে আমার আসলে প্লেন পড়া শুরু হওয়ার আগেই ডাগটা ইঞ্জেক্ট করতে হবে। এখানেই জুয়া শুরু। কারন ধরুন আমিও ড্রাগ নিলাম আর ওদিকে ছেলেটাও ধরা পড়ল, প্লেনটাও নিরাপদে হানেদা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল?”

আমার পাশে বসা সেলসম্যানের দিকে তাকালাম। সে মা আছে। নার্ভাস ভঙ্গিতে নিজের গলা পরিস্কার করছে।

আমি বলে চললাম। “সেক্ষেত্রে ইনজেকশন নেয়ার কারনে আমি শান্তির সাথে মৃত্যুবরণ করব ঠিকই কিন্তু জানতে পারব না যে প্লেন ক্রাশ করল নাকি করল না। আমি কখনো জানতে পারব না, জিনিসটা আমি যে কারনে কিনলাম তা কাজ করল নাকি করল না। আর আপনি, বেঁচে যাওয়ার পর প্লেন থেকে নেমে সোজা ব্যাংকে যাবেন আর আমার একাউন্ট সাফ করে দিবেন। আপনার জন্য চমৎকার লাভ। যদি আমরা ধরে নেই আপনি আসলে এই ইনজেকশনের জন্য একশ ইয়েন দিয়েছেন তাহলে আপনার লাভ হবে দুই মিলিয়ন নয় শত নিরানব্বই হাজার নয়শ ইয়েন।”

“স্বীকার করছি, সেরকম একটা সম্ভাবনা অবশ্যই আছে,” সেলসম্যান বলল। “যদিও আপনি বলার আগে আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি।”

“আপনি খুবই বাজে ধরনের মিথ্যুক।”

“আসলে হ্যাঁ, আপনি যেরকম বললেন সেরকম সম্ভাবনা আসলেই আছে যে প্লেনটা হয়ত শেষ পর্যন্ত ক্রাশ করল না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। পিস্তল হাতে কিরকম জবরজং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে নিজের পায়েই গুলি করে বসতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাগ্য ওর পক্ষেই খেলছে। কেউ এখন পর্যন্ত ওকে ছুঁতেও পারেনি। সবকিছুর নিয়ন্ত্রন ওর হাতেই রয়েছে। এরকম যদি চলতে থাকে তাহলে আমার কোন সন্দেহ নেই যে আর ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমরা টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলোর উপর ধসে পড়তে যাচ্ছি।”

“যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে আপনি এসব বলছেন যাতে আপনি ডাগটা বিক্রি করতে পারেন। বাজি ধরে বলতে পারি মনে মনে আপনি আশা করছেন কেউ একজন ঠিকই ছেলেটাকে ধরাশায়ী করে ফেলবে।”

“সেরকম কিছু আমি জানি না।”

লোকটার ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল। ধূর্ত শেয়ালের মত হাসি।

“আমি ওরকম বাজি ধরতাম যদি এতে আমার কোন সুবিধা দেখতে পেতাম,” সে বলল, “কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট যে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ডাগটা কিনবেন কি কিনবেন না। যদি আপনার মনে হয় কেউ ছেলেটাকে প্লেনসহ আত্মহত্যা করা থেকে আটকাতে পারবে না তাহলে আপনার উচিত হবে ড্রাগটা কেনা। যদি আপনি মরতেই বসেন তাহলে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুবরণ করা অনেক ভাল। অন্যদিকে আপনি যদি ভাবেন, ছেলেটা যা করতে চাইছে তাতে ব্যর্থ হবে তাহলে আপনার জন্য ড্রাগটা না কেনাই ঠিক হবে। প্লেন যদি ক্রাশ না করে তাহলে শান্তিপূর্ণ মৃত্যুবরণ করাও বোকামি হবে।”

“এসব আপনি বলছেন আমাকে পটানোর জন্য। খুবই বাজে আইডিয়া।”

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আগের মতই বাইরে খালি নীল আকাশ আর সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছিল।

“ব্যাপারটা আসলে ইন্টারেস্টিং। আমার মনে হয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ছেলেটাকে আরো কিছুক্ষণ আমার খেয়াল করে দেখা উচিত। দাম নিয়ে আমরা আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?”

“দামাদামি নিয়ে আমরা এর মধ্যেই অনেক কথা বলেছি। আমি এর মধ্যে কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না। আপনি শুধু আমাকে আপনার পিন নাম্বারটা জানাবেন।”

লোকটা কথাগুলো বলতে বলতেই আমি উপলদ্ধি করলাম আমি মারা যাওয়ার পর লোকটা এমনিতেও চাইলে আমার লাগেজ হাতড়াতে পারবে। ত্রিশ হাজার ইয়েন একদম নিশ্চিতভাবে হারাবো। ওকে পিন নাম্বার দিব কি দিব না সেটার উপর নির্ভর করছে সে কতটুকু কি পেতে যাচ্ছে। অন্য কথায় বললে হয় সে হয় ত্রিশ হাজার ইয়েন পাচ্ছে নয়ত তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েন পাচ্ছে।

“আচ্ছা বলুন তো, আপনার পিন নিশ্চয়ই আপনার জন্মতারিখ নয়?”

“হলে কি খুব খারাপ কিছু?”

সে তার কাঁধ তুলল, চেহারা দেখে মনে হল অবাক হয়েছে।

“আপনি জানেন নিশ্চয়ই, আপনার জন্মতারিখ জানা আমার জন্য কঠিন হবে না। আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সেই আছে। এর অর্থ হল আপনি ইতিমধ্যেই মূল্য তিন মিলিয়ন ত্রিশ হাজার ইয়েনে নির্ধারণ করে ফেলেছেন।”

“আপনিই জিতলেন। আমার জীবন এমনিতেও শেষ ওমিতেও শেষ।”

আমার হাসি দেখে লোকটাও হাসল।

“এই যে আপনারা দুজন,” উপর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল। “মনে হচ্ছে ওখানে আপনারা দুজন খুব ভাল সময় কাটাচ্ছেন?”

“এক মিনিট দাঁড়ান, আমাদেরকে একটু সময় দিন।” সেলসম্যান বলল। “আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে আলাপ করছি। প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে গিয়েছি। তারপর মাথা তুলে দেখতে গেল কে কথা বলছে। দেখার পর ওর গলার স্বর হাঁসের মত ফসফ্যাসে শোনাতে লাগল।

“ওহ! আমি দুঃখিত…”

“একদমই না। আমি দুঃখিত আপনাদের ডিস্টার্ব করার জন্য। দয়া করে আপনাদের ব্যবসায়িক আলাপ চালিয়ে যান।”

কথাগুলো যে বলছিল সে হল হাইজ্যাকার স্বয়ং। ছেলেটা করিডোরে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে পিস্তলটা ধরে আছে। আমি পিস্তলটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।

কাছের এক সিট থেকে একজন বিশালদেহী লোক উঠে হাইজ্যাকারের দিকে এগুলো। দেখে মনে হচ্ছিল জুডো প্রশিক্ষক ধরনের কেউ হবে হয়ত। আমি আর সেলসম্যান শক্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম জুডো এক্সপার্ট আর পিস্তল হাতের দুর্বল ছেলেটার লড়াই দেখার জন্য, কিন্তু যেরকম ভেবেছিলাম, জুডো ফাইটারটা ক্যানে পা পিছলে সিটের কোনায় বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটিয়ে পড়ে থাকল। হাইজ্যাকার ছেলেটা ওর ঘাড়ে আঘাত করে তারপর পরীক্ষা করল লোকটা বেঁচে আছে কিনা।

“অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের দুজনকে খেয়াল করছি,” অল্পবয়সি ছেলেটা আমাদের সারির খালি সিটটায় বসল। ডান থেকে বামে, আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম, সেলসম্যান মাঝখানের সিটে, আর হাইজ্যাকার করিডোরের সাথের সিটে। হাইজ্যাক হওয়ার পর পৌনে এক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে।

“আপনারা সিটের পেছনে লুকিয়ে বসে কিছু একটা নিয়ে ফিসফিস করছিলেন। আমার মনে হয় আপনারা পরিকল্পনা করছিলেন কিভাবে আমার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়া যায়। কিংবা আপনারা হয়ত আমার চেহারা, আমার পোশাক, আমার স্কুলের নাম নিয়ে বাজে কথা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। প্রথমে আমি তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে আমি উপলদ্ধি করলাম…কিভাবে বলা যায়…আপনারা দুজন অন্য যাত্রিদের থেকে অন্যরকম আচরণ করছিলেন।”

“তাই নাকি?” আমি বললাম, কুঁকে ভাল করে ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। হাইজ্যাকারকে দেখে মনে হল বিব্রতবোধ করছে। খালি হাতটা দিয়ে মাথার চুল শোয়ানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু মাঝখানের এক ফালি চুল এন্টেনার মত সোজা হয়েই থাকল।

“অন্য সব যাত্রিরা ভয়ে রীতিমত জমে আছে। এমনকি যারা হিরো হওয়ার চেষ্টা করছে তারাও। কেউ কেউ পাগলের মত কাঁদছে। কেউ কেউ ভুতের মত সাদা মুখ করে রেখেছে। কিন্তু আপনাদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে ঘরের লিভিং রুমে বসে খোশ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনারা কি আমার পিস্তলটাকে ভয় পাচ্ছেন না? নাকি আপনারা ভেবেছেন আমার মত দেখতে কেউ এই কাজে সফল হবে না তাই ভয়ের কিছু নেই? আপনারা কি ভাবছেন, এই ছেলে যে কিনা টি-বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ পায়নি আর সে কিনা প্লেন হাইজ্যাক করবে!”

“না একদমই না,” সেলসম্যান বলতে গেল। “আমরা ভাল ভয় পেয়েছি। যেমন উদাহরনস্বরূপ…”

“..আমি বলতে চাইছি, আপনার কথা আর কাজ দেখে মনে হচ্ছে সবকিছু নিয়েই আপনার জটিলতা আছে। যে কারনে আপনাকে ভারসাম্যহীন মনে হয়। এবং সেটা অবশ্যই ভয়ের ব্যাপার,” আমি বললাম।

“জটিলতা? আমি অতদুর যাব না। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয় লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, রাস্তায় আমার পাশ দিয়ে যে কুকুর হেঁটে যায়, টিভি শো এর হাইস্কুলের মেয়েরা-আমার মনে হয় সবাই জানে আমি কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি, আর সবাই আমাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসাহাসি করে।”

“হা হা…” সেলসম্যান বলল, আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যাতে মনে হল বলতে চাইছে এই ছেলে সত্যি সত্যি বিপদজনক। “আপনি খুবই সেনসিটিভ,” গলার স্বর কত্রিম শোনাল।– আমি চারপাশে তাকালাম। প্লেনের সবাইকে ভয়ে অসুস্থ দেখাচ্ছিল। কেউ সরাসরি আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সবাই এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। কাছাকাছি বসে থাকা লোকজন মনে হচ্ছিল আমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য কান পেতে আছে। আমি আবার অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে তাকালাম আর বললাম, “আমাদেরকে অন্য যাত্রিদের মত আতংকিত লাগছে না তার কারন হয়ত আমাদের দুজনের আসলে অন্যদের মত হারানোর তেমন কিছু নেই।”

হাইজ্যাকার ছেলেটা এমনভাবে মাথা ঘোরাল যেন আরো বিস্তারিত জানতে চায়।

“হ্যাঁ আমি প্লেন ক্রাশ করে মরা নিয়ে ভীত, কিন্তু অন্যদের সাথে তুলনা করলে আমরা দুজন ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।”

আমি সেলসম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে ব্যাখ্যা করলাম যে লোকটা আগেই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। আর আমার ক্ষেত্রে আমি বললাম যে হাই স্কুলে থাকতে এক লোক আমাকে রেপ করেছিল, আমি সেটার প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছিলাম। ছেলেটাও সব শুনে সেলসম্যানের মত হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।

“এরপর থেকে আমি আর কোন পুরুষকে কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি।”

ছেলেটার চোখগুলো খানিকটা লালচে দেখাল। সে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকল। কয়েকবার মনে হল সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শেষ পর্যন্ত বলল, “যে লোকটা আপনার সাথে বাজে কাজ করেছে তাকে কি আপনি খুন করতে চাইছিলেন?”

“সম্ভবত। আমি চাই ওর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হোক। জানি না এছাড়া আর কিভাবে আমার শান্তি হবে। সে যাই হোক, এইসব কারনে এই সেলসম্যান ভদ্রলোক আর আমি নিজেদেরকে যাবতীয় সুখ থেকে মুক্ত করে ফেলতে পেরেছি। এখন যদি আমরা আমাদেরকে কোন সুখহীন বাস্তবতায় আবিষ্কার করি, যেমন জোর করে প্লেনক্রাশে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা, তাহলে আমাদের আসলে কিছু যায় আসেনা।

“সেজন্যই আপনারা এত শান্তভাবে বসে কথা বলতে পারছিলেন।” হাইজ্যাকার ছেলেটা বলল।

সে চুপ করে বসে এক মুহূর্ত চিন্তা করল তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “আপনার মন শক্ত। আপনার সাথে ভয়াবহ কিছু হয়েছে কিন্তু তারপরেও আপনি থেমে থাকেন নি। আপনি আপনার প্রতিশোধের ছক কেটেছেন, বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন।”

“কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে মরতে যাচ্ছি।”

যখন এটা বললাম, পাশে বসা সেলসম্যান আমাকে বলল, “হা হা হা, ভাল বলেছেন।”

আমি আরেকটু সামনে ঝুঁকে অল্পবয়সি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম। এতে সে একটু অবাক হল আর একটু গুটিয়ে গেল।

“এখন আমাকে বলুন আপনার কেমন লাগছে? এই যে নিরীহ মানুষজন ভর্তি পুরো একটা প্লেন হাইজ্যাক করলেন।”

“ওকে এসব প্রশ্ন করবেন না!” সেলসম্যান বলল। ধাক্কা দিয়ে আমাকে সিটে পাঠিয়ে দিল।

“এক মিনিট দাঁড়ান, এটা জরুরী। প্রশ্নটা আসলে সে কাজটা করতে কতখানি মরিয়া। এরসাথে আমার ড্রাগটা কেনার সিদ্ধান্ত জড়িত।”

“ও আচ্ছা, তাহলে যুক্তি আছে।” সেলসম্যান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

“ভাগ? কি নিয়ে কথা বলছেন আপনারা?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।

সেলসম্যান আর আমি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলাম, ছেলেটাকে ইয়থানাসিয়া ডাগ সম্পর্কে কিছু বলা ঠিক হবে কিনা। শেষে আমরা ওকে সব খুলে বললাম-হাইপোডারমিক, আমার কেনার চিন্তা, হাইজ্যাকিং ব্যর্থ হলে সেলসম্যানে লাভ, সবকিছু।

“তারমানে আপনি অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ইনজেকশনটি কিনবেন কি কিনবেন না?” হাইজ্যাকার প্রশ্ন করল। আমি মাথা ঝাঁকালাম। সেলসম্যান কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে পরিস্কার করে হাইজ্যাকারকে বলল, “আপনার কি মনে হয়? আপনি এই কাজে কতখানি অবিচল? আমি বলতে চাইছি আত্মহত্যা করা ঠিক আছে কিন্তু আপনি আমাদের সবাইকে এর মধ্যে টানছেন কেন?”

অল্পবয়সি ছেলেটা শান্ত অভিব্যক্তি নিয়ে সেলসম্যানের দিকে ঘুরল। সেলসম্যান ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটু পিছিয়ে গেল।

“কারন সবকিছু সহ্যর সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সে বলল।

***

“আমার মায়ের সবসময়ের বিশ্বাস ছিল টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। অন্য কোন সম্ভাবনা তার চিন্তার বাইরে ছিল। মা বলতেন, কেউ যদি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারে তাহলে সে মানুষের জাত না, গরু-ছাগল বা সে-ধরনের কিছু। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারা ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য যা বলেন।”

“পাশ করার পর কি করতেন?” সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল।

“ওই প্রশ্ন কখনো আমার মাথায়ই আসেনি। আমার একমাত্র চিন্তা ছিল শালার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে ভর্তি হওয়া যায়। আর কোন কিছুতেই কিছু আসে যায় না আমার। যে কারনে আমি রাতের বেলা বাসায় থেকে খালি পড়াশুনা করতাম। সবাই যখন মেয়েদের সাথে ডেট করছে কিংবা গেমস খেলছে, আমি তখন শুধুই পড়াশুনায় ব্যস্ত থেকেছি।”

“আর যখন পড়াশুনা করতেন না তখন কি করতেন?” আমি জানতে চাইলাম।

“তখন আমি আচার বানাতাম।”

সেলসম্যান আর আমার মধ্যে চোখাচোখি হল।

“আমার শখ হল জাপানি আচার বানানো,” সে বলল। “এর মধ্যে এত কাজ আছে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, তারপর সে বলতে থাকল কিভাবে সঠিকভাবে সবজি কাটতে হবে, কিরকম কচকচে হতে হবে, কোন সময়ে কিরকম আচার হয়, কতটুকু লবণ দিতে হয় ইত্যাদি। কথাগুলো বলার সময় ওর বেশ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

“যখন বাসায় একা থাকতাম আর সবকিছু নিস্তব্ধ থাকত, তখন আচার বানানো আমাকে শান্তি দিত। প্রাইমারী স্কুলে থাকতে আমি আচার বানানো শুরু করি…”

সেলসম্যান নিচু গলায় আমাকে বলল, “মনে হচ্ছে এই ছেলে প্রাইমারি থেকেই আউলা কিসিমের। আপনার কি মনে হয়?”

“স্কুলের সবাই এই নিয়ে হাসত। ওরা বলত আমার পোশাকগুলো পুরনো আমলের। নতুন কিছু কিনতে আমার ভয় হত। মনে হত দোকানের লোকজন আমাকে দেখে হাসবে। আমার জন্য ফ্যাসনেবল হওয়া একটু

অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? মা আমার জন্য যা কিনে আনতেন আমি তাই পড়তাম। একমাত্র যা আমি নিজে কিনেছি তা হল নোটবুক আর লেখালেখির জিনিসপত্র। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন তাদের জমানো টাকা দিয়ে সিডি কিনছে আমি তখন আমার হাত খরচের টাকা দিয়ে কিনেছি ফাউন্টেইন পেন। আমি সবসময় পড়াশুনা করতাম, যে কারনে স্কুলের কেউ আমার সাথে খেলতে চাইত না। তারা সবাই গোপনে গোপনে আমাকে ‘গন্ধমাদন ডাকত। অথচ আমি প্রতিদিনই গোসল করতাম।”

“একদম ভাল নাম না,” আমি বললাম, যদিও আমি টের পাচ্ছিলাম ছেলেটার শরীর থেকে হালকা আচারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

“আমার মা আর সব আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চিত ছিল, আমি টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাব। কিন্তু পারিনি।”

“কেন?”

“তারা নেয় নি।”

“সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু কেন? প্রতিবছর পরীক্ষার সময় কি আপনি অসুস্থ থাকতেন বা কিছু?”

“না।”

“অন্য কাউকে সাহায্য করছিলেন যে নিজে সময় পাননি?” সেলসম্যান প্রশ্ন করল। “নাকি কোন ডুবতে থাকা বাচ্চাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন? নাকি কোন ব্রেন টিউমারওয়ালা মৃত্যুপথযাত্রি বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে ছিলেন? অল্পবয়সি ছেলেটা দুঃখি মুখ নিয়ে খালি মাথা নেড়ে চলল।

“আমি নিজেও জানি না কেন। আমি আমার টিচারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন আমি ভাল গ্রেড পাচ্ছিনা। তারা বলেছিলেন আমি নাকি টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মত যথেষ্ট ভাল নই। যত চেষ্টা করি না কেন গ্রেড উঠবে না। আমার উচিত হাল ছেড়ে দেয়া।”

ছেলেটা যথেষ্ট স্মার্ট ছিল না। প্লেনের কেউ কোন কথা বলল না কিন্তু সবার চেহারা দেখেই সেটা ভাবছে বোঝা যাচ্ছিল। ছেলেটা নিজেই বলল, “এটা অন্যায়, স্রেফ অন্যায়।” তারপর নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল।

“আমার মা, আমার আত্মীয়রা, সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বুঝতে পারছেন আমার তখন কেমন লাগছিল? কিভাবে বোঝাব? সবাই যখন আমাকে প্রথমবার বলল যে আমি কখনো টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব না, তখন তাদের কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এই বছর, পর পর পাঁচ বার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করার পর, বাধ্য হলাম মেনে নিতে যে আমাকে দিয়ে এই কাজ আর কখনো হবে না- তাহলে আমি কি করব? আমার মা আমাকে সবসময় শিখিয়ে এসেছেন, টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উপর আমার পুরো জীবন নির্ভর করছে। সবাই এখন আমাকে করুনার চোখে দেখে। যেখানেই যাই আমার মনে হয় সবাই আমাকে নিয়ে হাসছে।”

সে মাথা নিচু করে সিট থেকে সামনে ঝুঁকে থাকল। খালি হাতটা দিয়ে মুখ ঢাকা।

“কি জঘন্য ব্যাপার, সে গুঙিয়ে উঠল। কণ্ঠ নিচু আর হাত দিয়ে মুখ ঢাকা থাকায় চেহারা না দেখা গেলেও আমি ওকে বিড়বিড় করতে দেখতে পাচ্ছিলাম।

“আমি ওদের হাসি শুনতে পাই। আমার ক্লাসমেটদের কণ্ঠ শুনতে পাই। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে…আমার এন্টেনার মত দাঁড়িয়ে থাকা চুল নিয়ে…কোন মেয়ের হাত কখনো ধরিনি কেন সেটা নিয়ে…সবাই মনে মনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, আহ, পারছি না, আমাকে একা থাকতে দিন…একা থাকতে দিন…পারছি না আমি আর…সবাইকে খুন করে ফেলব, এই দুনিয়ার সবাইকে খুন করে ফেলতে চাই আমি…কিন্তু এটা অন্যায়…কেউ প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন…আমি আর এটা নিতে পারছি না। পালানোর কোন পথ খোলা নেই আমার সামনে…”

এখনই মোক্ষম সময় ছেলেটার থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার, কিন্তু কেউ তা করল না। ছেলেটার দুর্ভাগ্য এতটাই বিচিত্র যে কেউ ওকে আক্রমণ করার কথা ভাবতেও পারল না। ছেলেটার ভেতরের অন্ধকার অংশ তার কথাগুলোর সাথে বেরিয়ে এসেছিল, ওর কণ্ঠের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ব্যথা সবাইকে সচের মত আঘাত হানছিল।

“ঘৃণা…ঘৃণা…সবার প্রতি আমার অনুভূতি শুধু এই একটাই, সবাই…অসহ্য…আমি সবাইকে খুন করতে চাই…আমি চাই আমার মরিয়া ভাব, আমার হতাশা সবাই উপলদ্ধি করুক…দুনিয়ার সবাই…”

ছেলেটা অবশেষে মুখ থেকে হাত সরাল। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। কিন্তু আমার মনে হল ওর চোখগুলো থেকে আগুন বের হচ্ছে।

“কিন্তু সবাইকে তো আর খুন করা সম্ভব না। তাই এই প্লেনটা হাইজ্যাক করাই আমার কাছে ভাল মনে হল। এতটুকু একজনের পক্ষে করা সম্ভব। প্লেন ক্রাশ করলে প্লেনের যাত্রিরা, টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলোতে থাকা লোকজন, সবাই মরবে কোন কারন ছাড়া। এরপর এই ভয়ংকর খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই আমার আশা। কিছুদিন আগে আমি অনলাইনে আমার আচার বিক্রি শুরু করেছি। বিক্রি খুব ভাল হচ্ছে। বানানোর সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। মাত্র এক বছরে আমি তিন মিলিয়ন ইয়েন আয় করে ফেলেছি।”

“সে তো আমার আয়ের চেয়েও বেশি, সেলসম্যান বলল।

“কিন্তু আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। বিষয়টা টাকার না, আমি আমার টাকা খরচ করে এই পিস্তলটা কিনেছি।”

“কার থেকে কিনেছেন?”

“পেছনের গলির এক লোকের থেকে। ভাঙা জাপানিজ বলে। সম্ভবত চাইনিজ হবে।”

আমার সন্দেহ হল ওই চাইনিজ লোক সত্যি ছিল কিনা কিন্তু কিছু বললাম না।

“আমি তার থেকে পিস্তল আর গুলি কিনি, তারপর এই প্লেনে চড়ে বসি।”

“কিন্তু পিস্তল নিয়ে প্লেনে উঠলেন কিভাবে? সিকিউরিটি ধরেনি?”

“চেকের সময় হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছি, হাসিমুখে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।”

“বলেন কি….”

টাকার ক্ষমতা খুবই বাজে জিনিস।

“আর সেভাবেই আমরা এখন এই পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি।”

ছেলেটা ওর ঘড়ি দেখল।

“বাহ, সময়টা দেখুন। টি-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ধসে পড়তে আর মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি।”

তারপর সে সরাসরি আমার দিকে তাকাল।

“আমি এই প্লেনটা ক্রাশ করাতে যাচ্ছি। না করলে আমি জানি না কিভাবে এর থেকে মুক্তি পাব। লোকজনকে যত দুঃখ দিয়েছি…আমি সবাইকে দেখাতে চাই মৃত্যু কতখানি অর্থহীন একটা ব্যাপার।”

ছেলেটার মুখ থেকে সমস্ত অপ্রতিভ আর স্নায়বিক দুর্বলতা মুছে গিয়েছে। চোখগুলো তেজের সাথে জ্বলছিল। সে তার মৃত্যুর মিশন নিয়ে বদ্ধপরিকর। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেলসম্যানের দিকে ঘুরলাম।

“আমি ডাগটা কিনব। আমি এই জুয়া খেলতে রাজি। আজকে হোক কালকে হোক আমি এমনিতেও শান্তিতে মরতে চাই।”

“আপনি নিশ্চিত?” সেলসম্যান প্রশ্ন করলেন।

“আমি আর কিছু পরোয়া করি না,” কেবিনের চারদিকে তাকালাম আমি। করিডরের উপর লাশের স্তূপ পড়ে আছে।

“ছেলেটার চোখের দিকে যখন তাকিয়েছি তখন আমি গভীরে লুকানো কিছু একটা দেখতে পেয়েছি। আমি নিশ্চিত এই প্লেন ক্রাশ করবে আর সেই সাথে সবাই জাহান্নামের বাসিন্দা হতে যাচ্ছে।”– “কি বলছেন..? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি,” সেলসম্যান নিজেকেই নিজে বলল।

“আমি ড্রাগটা কিনব। আমার মত বদলাবে না।”

আমি লোকটাকে আমার ওয়ালেট দিলাম। আমি যে আমার সমস্ত ক্যাশ আর ব্যাংক কার্ড ওর হাতে তুলে দিয়েছি তা নিয়ে আমার কোন আফসোস হল না।

সেলসম্যান নিজের স্যুটের পকেট থেকে হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা বের করল। সরু কাঁচের টিউবটার মধ্যে বর্ণহীন তরল দেখা যাচ্ছিল। আমার দৃষ্টি, হাইজ্যাকারের দৃষ্টি, করিডরের দুই পাশে বসা সমস্ত লোকের দৃষ্টি এই মুহূর্তে এই বস্তুটার উপর নিবদ্ধ।

“একজনের জীবন প্রদীপ নেভানোর জন্য এইটুকু তরল কি যথেষ্ট?” হাইজ্যাকার প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ। এটা হল মিষ্টি, কষ্টহীন মৃত্যু, সেলসম্যান সিরিঞ্জটা আমার হাতে দিতে দিতে বলল। আমি সাবধানে হাতে নিলাম যেন পড়ে না যায়। সিরিঞ্জটা মুঠোয় ধরে রাখলেও এর কোন ওজন টের পাচ্ছিলাম না। চোখের সামনে এনে বর্ণহীন তরলটার দিকে তাকালাম, কাঁচের সিরিঞ্জে কেমন যেন কৌণিকভাবে বাঁকা হয়ে আছে। সিরিঞ্জটা আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি কাড়ল। কেউ কেউ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ভাল করে দেখার জন্য।

“এভাবে সবাই তাকিয়ে থাকলে মৃত্যুকে বেছে নেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য।”

এ কথা শুনে কেউ কেউ কাশি দিল, কেউ কেউ অন্য দিকে তাকাল।

“আপনার হাতে নষ্ট করার মত সময় নেই। ডাগটা কাজ করার জন্য ত্রিশ মিনিটের মত সময় লাগে কিন্তু।”

আমি বাম হাতা কনুইয়ের উপর পর্যন্ত গুটিয়ে নিলাম।

“আগে কখনো নিজে নিজে ইনজেকশন দেইনি। কি করতে হবে?”

“একভাবে পুশ করলেই হল। ডাক্তার বলেছিল যেভাবেই দেয়া হোক না কেন মৃত্যু নিশ্চিত।”

সেলসম্যানের কথাগুলো শুনে আমার আস্থা বাড়ল। আঙুল দিয়ে চেপে সুঁইয়ের কাভারটা সরিয়ে ফেললাম। রুপালি রঙের লম্বা সুইটা মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এল। এক মুহূর্ত সুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে তাকালাম।

“আমি ধরে নিচ্ছি আপনি এই প্লেনটা ক্রাশ করানোর ব্যাপারে সিরিয়াস। আমি আপনার উপর ভরসা করছি যে আপনি এই প্লেনের সবাইকে ভয়ের শেষ মাথায় নিয়ে যাবেন।”

ছেলেটা অস্পষ্টভাবে মাথা ঝাঁকাল।

“আপনার শান্তিময় মৃত্যু বথা যাবে না।”

“এই কথাবার্তা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে…”

আমি মাঝখান দিয়ে বলা সেলসম্যানের কথা উপেক্ষা করলাম। সিরিঞ্জে চাপ দিয়ে কয়েক ফোঁটা তরল বের হতে দিলাম। তারপর সুইটা আমার বাম বাহুতে ঢুকিয়ে চাপ দিলাম। সুঁই ঢোকায় তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা বোধ হল। সিরিঞ্জের চাপের সাথে সাথে ঠান্ডা একটা ভাব পুরো হাতে ছড়িয়ে পড়ল মনে হল।

সিরিঞ্জের ভেতর সব ফুরিয়ে গেলে আমি সুইটা বের করে খালি সিরিঞ্জটা সেলসম্যানকে ফিরিয়ে দিলাম। তারপর হাতা নামিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। “শেষ,” বললাম। গভীর অন্ধকার আমার সামনে ছড়িয়ে পড়ল।

***

“দেখুন কত দ্রুত কাজ করছে! সে এখনই নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে…”

“আমি মিথ্যা বলেছিলাম যে ত্রিশ মিনিট সময় লাগবে। জিনিসটা আসলে সাথে সাথে কাজ করে। ডাক্তার তাই বলেছিল আমাকে।”

“তাহলে কেন ও কথা বললেন?”

“আমি ওকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বেশি সময় নিতে দিতে চাইনি। মানে ধরুন যদি আপনি ধরা পড়ে যান, ব্যবসা করার জন্য তখন অনেক দেরি হয়ে যেত না?”

“আপনার কথা বুঝতে পারছি। তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি এখনো আশাবাদী যে আমি ধরা পড়তে পারি?”

“ আমার সর্বোচ্চ চাওয়া সেটাই কি হওয়া স্বাভাবিক নয়? সেটা হলে আমি ব্যাঙ্কে গিয়ে ওর সব টাকা তুলে নিতে পারব। সত্যি বলতে কি আমি একদম অল্প টাকায় ডাগটা ডাক্তারের কাছ থেকে কিনেছিলাম। সুতরাং পুরোটাই লাভে লাভ। আমি হয়ত টাকাটা দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব। কিংবা অন্তত আরেকবার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করার আগে কিছুদিন ভাল সময় কাটাতে পারব…আহ একম আনকোরা নতুন একটা জীবন। সবকিছু বদলে ফেলে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করার কথা কি আপনি কখনো কল্পনা করেননি?”

“না। আমার ঘণা আমার জন্য এতটাই প্রবল ছিল যে, পজেটিভ কোন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আপনি যখন নিজেকে মৃতমানুষ হিসেবে চিন্তা করবেন তখন নতুন জীবনের কল্পনা করা অসাধ্যই। অন্তত আমার জন্য অসাধ্য। কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা সাহায্য প্রয়োজন। শুধু আপনার কাছে না, যে যে আমাকে শুনতে পারছেন তাদের সবাইকেই বলছি। আমি চাই আপনারা সবাই সিট থেকে উঠে প্লেনের সামনের দিকে যাবেন এখন। সামনের দিকে কিছু সিট খালি আছে। কিছু সিট আগে থেকেই খালি ছিল। সব মিলিয়ে অর্ধেকের মত সিট খালি আছে। আমি চাই আপনারা সবাই একসাথে বসবেন। আমার জন্য লক্ষ্য রাখা সহজ হয় তাহলে।”

“কোন সমস্যা নেই। চলুন সিট অদল বদল করা যাক। কিন্তু আমরা যদি সবাই সামনে গিয়ে বসি তাহলে প্লেনটা ভারসাম্য হারিয়ে আগেই ক্রাশ করে বসবে না?”

“আমরা এমনিতেও ক্রাশ করতেই যাচ্ছি। সুতরাং সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”

“ঠিক আছে। এই মহিলার কি হবে?”

“সে আর করিডরের লাশগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। বাকিরা সবাই সামনে যান। যারা এখনো জীবিত আছেন, সবাই। এইটা আমার নির্দেশ। নাকি আপনারা এমন কারো থেকে নির্দেশ পেতে চান না যে কিনা টি-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি?”

***

আমি মরে গিয়েছিলাম কিন্তু আবার চোখ খুললাম, তারপর ঘাড় ডলতে ডলতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তখনো সেই একই সিটে বসে আছি। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোন প্রেতাত্মা যে এখনো প্লেনে বসে আছে।

পাশে তাকালাম কিন্তু সেলসম্যান সেখানে নেই। হাইজ্যাকারকেও দেখা গেল না। চারিদিক অন্ধকার হয়ে মারা যাওয়ার আগে শোনা ওদের কথাগুলো আমার মনে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা সবাইকে সামনে গিয়ে বসার নির্দেশ দিচ্ছিল।

আমি, যে কিনা এখন একজন ভুত, উঠে দাঁড়িয়ে সিটের উপর থেকে সামনে তাকালাম। ওই যে, প্লেনের সামনের অর্ধেক লোকজনে গাদাগাদি হয়ে আছে। সবাই আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। প্লেনের প্রায় মাঝখান থেকে বাকি সিটগুলোসহ যেখানে আমি বসে ছিলাম, সব খালি।

পেছনের অর্ধেকে কোন জীবিত মানুষ না থাকলেও করিডোরে লাশগুলো পড়ে ছিল। প্লেনের সামনের অংশ মনে হচ্ছিল জীবিত মানুষের এলাকা। আর পেছনের অর্ধেক মৃতদের এলাকা।

সামনে একজায়গায় এন্টেনার মত খাড়া হয়ে থাকা চুল চোখে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা প্লেনের পেছনের দিকের এক সিটে বসে আছে। মৃতদের এলাকায় একমাত্র জীবিত মানুষ, এবং নিঃসঙ্গ।

কেউ কোন কথা বলছিল না। একমাত্র শব্দ ছিল ইঞ্জিনের শব্দ। আমি নিঃশব্দে ছেলেটার সিটের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম। করিডোরে পড়ে থাকা লাশগুলোর উপর আমার পা পড়ল। আমি সাবধানতার সাথে আমার পা ফেলছিলাম যাতে খালি কৌটাটা গড়িয়ে এলে পা দিয়ে না বসি। আমি সোজা ছেলেটার সিটের পেছনে এসে দাঁড়ালাম আর ওর মাথায় উঁচু হয়ে থাকা চুলের দিকে তাকালাম। ও গভীর মনোযোগর সাথে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল যেন কোন কিছুই দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়। আমি যেন টের পাচ্ছিলাম যে ওর মনোযোগ ওর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

আঙুলের মাথা দিয়ে আমি ছেলেটার উঁচু হয়ে থাকা চুলে স্পর্শ করলাম। উপলদ্ধি করলাম ভূত বা প্রেতাত্মা সম্পর্কে সবাই যা বলে তা সত্যি। কাউকে না জানিয়ে তারা সব কিছু স্পর্শ করতে পারে। আমার ইচ্ছা করল ভুত হয়ে কোন বুড়ো মানুষের টাক মাথায় তবলা বাজাতে। ঈগল যেভাবে শিকার খোঁজে সেভাবে আশেপাশে তাকিয়ে একজন টেকোকে খুঁজে পেলাম।

লোকটার দিকে এগুতে যাব এমন সময় ছেলেটা পিস্তলটা পাশের সিটে নামিয়ে হাত পা টানটান করছিল। আমি আস্তে করে সেটা হাতে নিয়ে দেখলাম কেমন লাগে। আশ্চর্যজনকভাবে জিনিসটা বেশ ভারি ছিল। জিনিসটা শক্ত আর মনে হচ্ছিল যেন সত্যি সত্যি ধাতব কিছু একটা ধরে আছি। ভূতরা সত্যি সত্যি কোন জিনিস তুলতে পারে উপলদ্ধি করে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি পিস্তলটা নিয়ে কিছু অ্যাকশন পোজ দিলাম।

“অ্যাঁ? কি হচ্ছে এসব?” অল্প বয়সি ছেলেটা হতবুদ্ধি হয়ে বলল। হাত-পা টান টান শেষে আমার দিকে ফিরে দেখে আমি একজন নারী পুলিশের মত পোজ দিয়ে আছি। সে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

“আপনি কি আমাকে দেখতে পারছেন? আপনি ভুত দেখতে পারেন নাকি?”

সামনে বসা সবার মাথা এদিকে ঘুরে গেল। একজন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লোকটা ওই সেলসম্যান। সে হা করে আমাকে বলল, “আপনি এখনো বেঁচে আছেন কেন?” আমি পুলিশের ভান বন্ধ করে বললাম, “আয় হায়, আমি ভেবেছিলাম আমি মরে গিয়েছি…”

“দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না আর যাই হোক! নিজের দিকে ভাল করে তাকান! আপনি নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, বাতাসে ভাসছেন না।”

আমি নিজের পায়ের দিকে তাকালাম। ওগুলো আসলেই ভাসছে না। তারমানে সেলসম্যানের কথা অনুযায়ী আমি আসলে বেঁচে আছি। আমি নিজে ইনজেকশন পুশ করার পরও মরিনি। আমি পিস্তলটা সেলসম্যানের দিকে তাক করলাম।

“আপনি আমাকে বোকা বানিয়েছেন! ওটার মধ্যে কোন ইয়থানাসিয়া ডাগ ছিল না!”

পিস্তলের লাইন অফ ফায়ার থেকে সরার জন্য সেলসম্যান আবার সিটে বসে পড়ল। ওর সারিতে বসা বাকি লোকজন চিৎকার করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কেবিনের মধ্যে বিশাল গন্ডগোল শুরু হল।

“এক মিনিট দাঁড়ান! আমি নিজেও বুঝতে পারছি না এখানে কি হচ্ছে।” সে চিৎকার করে বলল। সিট থেকে মাথা নামিয়ে রেখেছে। এক মুহূর্ত পর সে বড় করে ঢোঁক গিলল।

“ওইটা পরোই ডাক্তারের শয়তানি! সে আমাকে বোকা বানিয়েছে আর আমাকে নকল ডাগ দিয়েছে!”

আমি ওর দিকে পিস্তল ধরে থাকলাম।

“ওর কথা ভুলে যান! আমার কি হবে এখন? আমি আমার শান্তিময় মৃত্যু পাইনি, এখন সবার সাথে আমাকেও ক্রাশ করে মরতে হবে।”

তখনো সিটটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বসে থাকা সেলসম্যান দ্রুত মাথা নাড়ল। “দাঁড়ান দাঁড়ান! শান্ত হন। আপনি কি বুঝতে পারছেন

আপনার হাতে ওটা কি ধরে আছেন?”

“বোকার মত কথা বলবেন না!”

“আপনি যদি জানেন কি ধরে আছেন তাহলে সেটা আমার দিকে তাক করে আছেন কেন? আপনার তো ওটা অন্য কারো দিকে তাক করে থাকা উচিত, তাই নয় কি?” সেলসম্যান আমার পাশে দাঁড়ানো অল্প বয়সি ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করল। “ওর দিকে পিস্তল তাক করে বলুন আত্মসমর্পণ করতে।”

আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। সে সিট থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ওকে কেন আত্মসমর্পণ করতে বলব? আমি বাজি ধরে বলতে পারি ও প্লেন ক্রাশ করাতে চেয়েছিল।”

“আপনি একটা গাধা!”

অন্য যাত্রিরা ধুয়ে দিতে লাগল। আমি আরও পরিস্কারভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করলাম, আর ওদের কথার অর্থ বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে আমি ছেলেটার অস্ত্র দখল করেছি মানে হল প্লেন আর ক্রাশ করতে যাচ্ছে না।

পিস্তলটা সেলসম্যানের দিক থেকে সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাক করলাম। সেলসম্যানকে দেখে মনে হল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

আমি ছেলেটাকে ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললাম। “দুঃখিত, কিছুক্ষণ আগেও আপনার পক্ষে ছিলাম আমি।”

সে স্রেফ তার মাথা ঝাঁকাল, তারদিকে যে পিস্তল তাক করা সেটা খেয়াল করার কোন নমুনা দেখাল না।

“চিন্তার কিছু নেই,” সে কাঁধ যাগ করে বলল আর ডান হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢুকালো। আমার কাছে আরেকটা পিস্তল আছে।”

কেবিনের মধ্যে টেনশন আরেক ধাপ বাড়ল। যাত্রিদের কেউ কোন টু শব্দ করল না, এক বিন্দু নড়ল না। শুধু অল্প বয়সি ছেলেটার অভিব্যক্তি দেখে মনে হল সে সবকিছুর নিয়ন্ত্রনে আছে। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে সে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

“আমার জ্যাকেটের পকেটে আরেকটা পিস্তল আছে। আমি এখন আপনাকে গুলি করব।”

আমি ওর ডান হাত ভালভাবে দেখতে পারছিলাম না। “একদম নড়বেন না,” আমি বললাম, “হাত যেখানে আছে সেখানেই রাখুন।”

“আপনি যদি গুলি খেতে না চান তাহলে আপনাকেই প্রথমে গুলি করতে হবে, সে শান্তভাবে হাসল। তারপর আবার বলা শুরু করল। “এক শীতের রাতে আমি পড়াশুনা করছিলাম, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি দিনের আলো ফোঁটা শুরু করেছে। তখন আমি জানালা খুলে রাতের ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকতে দিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম নাক থেকে নিশ্বাস বের হয়ে ঠান্ডা ধোঁয়ার মত জমে যাচ্ছিল। পুরোপুরি সকাল হতেই আমি দেখতে পেলাম চারপাশ বরফে সাদা হয়ে আছে। আমার খুব খুশি লাগছিল কারন আমি আসলেই আমার পুরো মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতে পেরেছিলাম। ওই সকালটাকে আমি ভালবাসি। এখন যেহেতু আমি অনেক মানুষ মেরে ফেলেছি, আমি আর সেই সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখতে পাব না।”

বলতে বলতে সে তার ডান হাত জ্যাকেটের ভেতর থেকে বের করে আমার দিকে তাক করল। আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ট্রিগার টেনে দিলাম। হাতের তালুতে পিস্তলের রিকয়েলের ধাক্কাটা মনে হল যেন ভারি কোন বল এসে আঘাত করেছে। বাতাস স্যাঁত করে এসে আমার মুখে লাগল যেন বাতাস নিজেই ফেটে গিয়েছে। প্লেনের সবাই মাথা নিচু করে বসে পড়ল। অল্প বয়সি ছেলেটা করিডরে লুটিয়ে পড়ল। ওর ডান হাতে শুধু একটা ফাউন্টেইন পেন ধরা ছিল।

আকাশের রঙ বিকেল থেকে গোধূলিতে বদলে গেল আর আমি ওর সন্তানকে আমার কোলে নিয়ে ওর বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। ওর সন্তান ছিল একটা মেয়ে, কিন্ডারগারটেনের বয়সি। সে বাসায় একা ছিল। অপরিচিত একজনকে দেখে ওর মধ্যে কোন আড়ষ্টভাব দেখা গেল না, সহজেই আমাকে আপন করে নিল। আমার কোলে এসে বসল। আমরা একসাথে টিভিতে খবর দেখতে লাগলাম। একটু পরই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

রুমের কোনায় রাখা টিভিটায় তখন দুপুরে ঘটা হাইজ্যাকিঙের খবরটা দেখাচ্ছিল। একটার পর একটা ছবি ভেসে আসছিল-প্লেন ল্যান্ড করার দশ্য, যাত্রিদের বের করে নেয়ার দৃশ্য, পলিশের প্রবেশের দৃশ্য ইত্যাদি। যাত্রিদের ছবির সময় এক ঝলক আমি আমার আর সেলসম্যানের চেহারা দেখতে পেলাম।

“আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য ফ্লাইট ছিল এটা,” প্লেন থেকে নামার পর সেলসম্যানকে বলতে শুনেছিলাম কথাটা। সে দু পা দিয়ে মাটিতে বাড়ি দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিল যে আসলে শক্ত মাটিতে আবার ফিরে এসেছে। “আশা করছি আবার অনেকদিন মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে না।”

আমাকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল কারন আমি নিজের বাহুতে অজানা কোন তরল ইনজেক্ট করেছিলাম বলে আমাকে পরীক্ষা করা দরকার ছিল। আমার সাথে আরো অনেক যাত্রিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল, মূলত বিভিন্ন সময়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কারনে।

আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি, ভাবলাম। এমন সময় আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা একটু নড়ে উঠল। আমার বুকে মুখ চেপে থাকল। দেখে মনে হচ্ছিল সুখি। একটা কন্ডোমিনিয়াম বিল্ডিঙের তিন তলায় এই অ্যাপার্টমেন্ট। জানালাগুলো দক্ষিণমুখি। যে কারনে রুমগুলোতে বেশ আলো ঢোকে। জানালার কাছে ফুলদানিতে কিছু ফুল রাখা। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মূল দরজা খোলার শব্দ কানে এল।

“কই সবাই? আমি চলে এসেছি।” একজন পুরুষের কণ্ঠ, যা আমি স্কুলের পরে আর শুনিনি, কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে। আমি হল দিয়ে তার পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনলাম। তারপর লিভিং রুমের দরজা খুলে গেল। সে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল আমি ফ্লোরে বসে আছি আর ওর কন্যা আমার কোলে ঘুমাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টি মিলিত হল। আমার স্মৃতির সাথে ওর চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আমি বলব না অনেক আগে সে আমার সাথে কি কি করেছিল কিন্তু সেই ক্ষতগুলো এখনও আমার শরীরে, আমার মনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে।

“স্বাগতম,” আমি বললাম। এক মুহূর্তের জন্য সে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখল। কিন্তু আমাকে মনে পড়তে তার বেশি সময় লাগল না। আর

সে এক পা সামনে এগুলো।

“তু..তুমি এখানে কি করছ…”

“আমি তোমাকে খুঁজে বের করেছি,” আমি বললাম। পাশে রাখা ছুরিটা হাতে নিলাম। এখানে আসার পথটা বেশ এডভেঞ্চারাস ছিল অবশ্য। আমার প্লেন হাইজ্যাক হয়েছিল, গোলাগুলি হয়েছিল…”

“আমার স্ত্রী কোথায়…” আমার হাতে ছুরি দেখে সে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল।

“শপিঙে, সম্ভবত। সে তোমার মেয়েকে এখানে একা রেখে গিয়েছে।” আমি ছুরিটা ঘুমন্ত মেয়েটার গলার কাছে ধরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার নাম টিভিতে বলল। আমি স্ক্রিনের দিকে তাকাতে দেখলাম আমার চেহারার একটা ক্লোজআপ ছবি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে। খবর পাঠক বলছিল উদ্ধারকৃত যাত্রিদের একজন আমি, আমাকে কিভাবে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, তারপর আমি নিখোঁজ। আমার মনে পড়ল পুলিশ হাসপাতালের রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিল কিছু প্রশ্ন করার জন্য। আমি বলেছিলাম আমাকে টয়লেটে যেতে হবে, তারপর সোজা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাই। সে টিভির ছবির সাথে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখল।

“তুমি কি পরিকল্পনা করছ?”

“আশ্চর্যজনক সব ঘটনা, আর তার সাথে কিছু দুর্ভাগ্য। তুমি কি কখনো ভেবেছিলে যে এরকম কোন কিছু তোমার সাথেও হতে পারে?”

“প্লিজ, আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।” সে হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসল। কাঁদতে কাঁদতে সে আর তার বন্ধুরা আমার সাথে হাই স্কুলে যা করেছে তার জন্য মাফ চাইল। রুমের ভেতর একমাত্র শব্দ ছিল ওর ফোঁপানোর শব্দ। তারপর মূল দরজা খুলে গেল আর ওর স্ত্রী অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। শপিং ব্যাগ হাতে সে এসে লিভিং রুমে ঢুকল আর দেখল তার স্বামী ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আর আমার হাতে ছুরি। আর মহিলার চেহারা দেখে আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম কি হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। পিচ্চি মেয়েটার ঘুমন্ত মুখ আমার বুকে চেপে ছিল। অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। মেয়েটার গলায় ছুরি ধরে রেখে আমি খবর দেখতে থাকলাম।

অবশেষে স্ক্রিনে একজন অল্প বয়সি যুবকের চেহারা দেখা গেল। খবর পাঠক তার অপরাধের বর্ণনা দিল। কিভাবে সে প্লেন হাইজ্যাক করেছে, কিভাবে কেবিন ক্রু আর যাত্রিদের খুন করেছে। আমার মনে পড়ল ও মারা যাওয়ার আগে আমাকে কি বলেছিল, সেই সুন্দর সকালের গল্প, চারিদিক সাদা হয়ে ছিল। আমি মেয়েটার গলা থেকে ছুরি সরিয়ে নিলাম।

“একদিনে দুজনকে খুন করতে পারব না আমি।”

আমি মেয়েটাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজার দিকে যাওয়ার সময় ওকে আর ওর স্ত্রীকে পাশ কাটিয়ে যেতে হল আমার। ও মাথা নিচু করে ছিল, আমার দিকে তাকাল না, কিন্তু ওর স্ত্রী চেহারায় বিভ্রান্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল।

আমি ওর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ওর বিল্ডিং ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল বলে আকাশের রঙ তখন টকটকে লাল। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম, রাস্তায় লোকজনের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগল। জানি না আমার গন্তব্য কোথায়, খালি জানি আমাকে দৌড়াতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *