ইন্দ্র চন্দ্র – বরুণকৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়

ইন্দ্র চন্দ্র – বরুণকৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়

ওভালোটিন কালারের ট্যারালিনের টুকরোটা।

আধ ইঞ্চিটাক লম্বা। সেই অনুপাতেই চওড়া টুকরোটা বাসব একাগ্র মনে নিরীক্ষণ করছিল। এই দামি কাপড়ের অংশটা কোনো শার্ট বা বুশ কোটের যে ছেঁড়া অংশ, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

বাসব ট্যারালিনের টুকরোটা পকেটে রেখে দিয়ে মুখ খুলল। ফুট চারেকের মধ্যেই পড়ে রয়েছে মৃতদেহটা।

চাপ চাপ রক্তের মাঝে আড়াআড়ি পড়ে থাকা দেহটা বীভৎস দেখাচ্ছে। পাঁজরার একটু নীচে এখনও গেঁথে রয়েছে ছোরাখানা। তার সুন্দর কারুকার্য করা বাঁটটা জেগে রয়েছে উপরে। ঘরের মধ্যে মৃত্যুর মতোই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

শুধু থেকে—থেকে একটা ফুপিয়ে কান্নার শব্দ নিস্তব্ধতায় আঘাত হানছে। কাঁদছেন রাত্রি। রাত্রি গুপ্তা।

বাসব পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিল। সিগারেট ধরাল তারপর।

স্থানীয় থানার ইনসপেক্টর বিরাজ সোম নিজের কাজ অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছেন। মৃতদেহ এবং ঘটনাস্থলের ছবি নেওয়া হয়েছে কয়েকটা। ফিঙ্গার প্রিন্টের ব্যর্থ অনুসন্ধান করে এখন তিনি বারান্দায় গেছেন বাড়ির সকলকে বাজিয়ে দেখবার জন্যে।

বাসব ঘরের বাইরে এল।

বিরাজ সোম তখন বাড়ির পুরানো চাকর বলাইকে প্রশ্ন করছেন। শৈবাল একধারে নীরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কি বললে? দুর্ঘটনার আগের দিন? তখন রাত্রি কটা হবে?

আজ্ঞে বাবু, তা কি করে বলব! আচমকা ঘুম ভেঙে গেল একটা আওয়াজে। বিছানায় উঠে বসে দেখলুম বারান্দায় আলো জ্বলছে।

তারপর তুমি বিছানায় বসে বসেই বোধ হয় সেই আলোর শোভা দেখতে থাকলে?—ঝাঁঝালো কণ্ঠে বিরাজ সোমের প্রশ্ন।

আজ্ঞে না বাবু। আমি ঘরের বাইরে এলুম তাড়াতাড়ি, আলোটাও নিভে গেল।

দুর্ঘটনার দিন রাত্রে তুমি—

আজ্ঞে আমি বাড়ি ছিলুম না। ছুটি নিয়েছিলাম।

শৈবাল বাসবের কাছে এগিয়ে এল। ও তখন বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে কি চিন্তা করছিল।

কিরকম বুঝলে?

বাসব ওর দিকে তাকিয়ে বলল, বিরাজবাবুর ব্যূহ ভেদ করে বোঝার এখনও সুযোগ আর পেলাম কই।

শৈবাল হাসল।

তবে ডাক্তার,—বাসব আবার বলল, একেবারেই যে কিছু চোখে পড়েনি তা নয়! যেমন এই কাপড়ের টুকরোটা—

বাসব পকেট থেকে কাপড়ের টুকরোখানা বার করল। শৈবাল এক নজর দেখে নিয়েই বলল, এ তো ট্যারালিনের টুকরো দেখছি!

এক্সজ্যাক্টলি। আজকাল শৌখিন সমাজে এই দামি কাপড়ের বিশেষ আদর দেখা যাচ্ছে। আমি টুকরোটা পেয়েছি ওই ঘরের হ্যান্ডেলে।

হ্যান্ডেলে?

তুমি লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে ওই ঘরের দরজাগুলোর হ্যান্ডেল কিরকম অদ্ভুতদর্শন। কিছু আটকালে না ছিঁড়ে উপায় থাকে না। আমার মনে হয় কাল রাত্রে হত্যার পর কেউ, অবশ্য হত্যাকারীও হতে পারে, দ্রুতপদে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় জামার কিছু অংশ হ্যান্ডেলে আটকে ছিঁড়ে রয়ে যায়।

শৈবাল বলল, বুঝলাম সবই। কিন্তু তোমার এই অনুমানে কি লাভ হল, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না আদপেই।

লাভ—লোকসানের হিসেবটা অবশ্য এখন আমি তোমায় দেব না। দু—একদিন ধৈর্য ধরে থাকতে হবে।—ওকথা থাক, চল, মিসেস গুপ্তাকে এখন সান্ত্বনা দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

রাত্রি গুপ্তার সঙ্গে বাসবের আলাপ বেশ কয়েক দিনের। আলাপের সূত্রপাতটাও সম্পূর্ণ নাটকীয়। বাসব অবশ্য সেদিন অনুমান করতে পারেনি এই নাটকীয় আলাপের পরিণতি গড়াবে আজকের এই রক্তাক্ত পরিবেশে। যদিও খুবই ঘোরালো পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়েই রাত্রি গুপ্তা দিন কয়েক আগে বাসবের কাছে সাহায্যের জন্যে উপস্থিত হয়েছিলেন। আলাপের সূত্রপাত ওখানেই। বাসবের পরিষ্কার মনে আছে—সেদিনও—

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো ক্রমেই জমাট বাঁধছে। হাওয়ার বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে ওই সঙ্গে।

বৃষ্টি নামবে।

ক্যামেল উলের র‌্যাগটা আরো ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শৈবাল বলল, এরকম শীত অনেকদিন কলকাতায় পড়েনি, কি বল?

বাসব সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিল, হুঁ। বছরের পর বছর ধরে কলকাতায় শীত যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

হ্যাঙ্গার ফোর্ড স্ট্রিটের বাড়ির বসবার ঘরে দুটো সোফায় বসে ওদের কথা হচ্ছে। শৈবাল কয়েক দিন ধরে এ বাড়িতেই আছে। সোমা বাপের বাড়ি যাওয়ায়, হাওয়া বদলের মতো শৈবালের এই বাড়ি বদল। বাসবের অনুরোধে ও এখন এ বাড়িতেই থাকবে বেশ কয়েক দিন।

কিন্তু যাই বল ডাক্তার,—বাসব আবার বলে, শীতকালটা কিন্তু বেশ। সব রকম মানুষের পক্ষেই বেশ উপাদেয় ঋতু।

বেশ হলেও, ডাক্তারি শাস্ত্রে বলে গরমকালের চেয়ে মানুষ শীতকালেই বেশি রোগে পড়ে।

তা হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য দিক দিয়ে সময়টা অত্যন্ত ভালো। আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছাড়াও এই সময়ে মানুষের মনে কর্মপ্রেরণা প্রবল হয়ে ওঠে। এমন কি অপরাধীরাও গরম কালের চেয়ে শীতকালেই বেশি অপরাধ করে।

অর্থাৎ?

শেষবারের মতো টান দিয়ে সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলতে ফেলতে বাসব বলল, সেদিন ফ্রি প্রেস ক্রিমিনাল পড়ছিলাম—তাঁরা সমগ্র বিশ্বের অপরাধের একটা হিসেব খাড়া করেছেন। তুলনামূলক ভাবে তাতে দেখানো হয়েছে, ১৮৬২ সাল থেকে ১৯৫৯ অবধি পৃথিবীতে যত খুন, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদি হয়েছে, তা প্রায় সমস্তই শীতকালে। অপরাধীদের শীতকালের উপর দুর্বলতার জন্যেই যে এরকমটা হয়েছে তা নয়, এর কারণ হল—

শৈবাল বাধা দিল, থাক, বিস্তৃতভাবে আর তোমাকে সমস্ত প্রবন্ধটা বলতে হবে না। আমি প্র্যাকটিকাল লোক—কার্যক্ষেত্রে কিন্তু বিশেষ কিছু প্রমাণ পাচ্ছি না।

বাসব হেসে ফেলল।

বেশ কিছুদিন সম্পূর্ণ বেকার বসে রয়েছে বাসব। হাতে কোনো কেস নেই। শৈবালের ইশারা সেই ধার ঘেঁষেই গেছে।

তুমি ঠিকই বলেছ ডাক্তার। তবে একদিকে এটা সুলক্ষণ। দেশে অপরাধের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই লোকে আমাকে আর ডাকছে না।

শৈবাল হেসে বলল, তোমার ব্যবসার তাহলে কি হবে?

ফেল পড়বে। তারপর আমি একটা বিড়ির দোকান করব। এ আমার অনেক দিনের পরিকল্পনা। দেখেছি সাধারণ লোকের বিড়ির প্রতি বেশ টান আছে। ও ব্যবসা ফেল পড়বার নয়।

উচ্চ হাস্যে নিজের কথা শেষ করল বাসব। কিন্তু হাসির রেশ সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আর্তরব তুলে কলিংবেল বেজে উঠল।

থেমে থেমে কয়েকবারই চলল যন্ত্রের ঝঙ্কার। বাহাদুর দ্রুত ভেতর দিক থেকে ছুটে এল দরজা খুলে দিতে।

শৈবাল বলল, এই শীতের সকালে আবার কে এল?

বাসব সোজা হয়ে বসে বলল, বোধ হয় বিড়ির দোকানটা উপস্থিত আমায় আর করতে হচ্ছে না।

পরমুহূর্তে বাহাদুরের পেছনে পেছনে একটি সুন্দরী মহিলাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখা গেল। বয়স চব্বিশ থেকে সাতাশের মধ্যে। পরনে কাশ্মীরি প্রিন্টের শাড়ির ওপর পিকক ব্লু কালারের দামি ব্লেজারের ওভারকোট।

মাথার রুক্ষ চুলগুলো এলোমেলো। সিঁথিতে সিঁদুরের চিহ্ন। মুখে ভীত—সন্ত্রস্ত ভাব।

বাসব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন। বসুন।—

ভদ্রমহিলা একটা সোফায় বসে পড়ে দ্রুত কণ্ঠে বললেন, বিপদে পড়েই আমাকে এখানে আসতে হল। আমি বাসববাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

আমিই—বলুন?

কথাটা খুবই গোপনীয়…মানে…

ভদ্রমহিলা শৈবালের দিকে তাকালেন।

বাসব বলল, আপনার সঙ্কোচের কোনো কারণ নেই। ইনি আমার বিশিষ্ট বন্ধু শৈবাল রায়। আপনি এঁর সামনে সমস্ত কিছু স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। তবে প্রথমে আপনার নামটা জানতে পারলেই আমাদের সুবিধা হয়।

রাত্রি গুপ্তা।

এরপর মিসেস গুপ্তা সবিস্তারে নিজের বক্তব্য বলে গেলেন। বেশ নাটকীয় ভাবেই সমস্ত বর্ণনা করলেন তিনি। একটা গল্পের মতোই তাঁর বর্ণনার কাঠামোটা। বাসবকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে তিনি অনেক আগম থেকেই নিজের কাহিনীর জের টানলেন—

কলেজ থেকে সবে ফিরেছে রাত্রি। বেলা তখন চারটে। অবশ্য বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই কথাটা তার কানে এসেছে। অনুপই ওকে সংবাদটা জানিয়েছে প্রথমে।

দিদি, তোর বিয়ে—

বিয়ে! খুব ফাজিল হয়েছিস না?—ছোট ভাইকে ধমকে ওঠে রাত্রি।

ও, বিশ্বাস হল না বুঝি? সত্যি বলছি। এই তো ঘণ্টা দুয়েক আগে দামি মোটরে চড়ে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনিই তো বাবার সঙ্গে কথা বলে তোমার বিয়েটা তাঁর ভাইপোর সঙ্গে ঠিক করে গেলেন।

রাত্রির ভ্রু কুঁচকে উঠল। ও আর একটা কথাও না বলে রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

নিজের ঘরে ফিরে কাপড় বদলাতে বদলাতে ও অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, কই, কেউ তো তাকে দেখতে আসেনি। তাকে না দেখেই পাত্রপক্ষ পাত্রীনির্বাচন করে ফেললেন। এরকম ভাবে বিয়ের ব্যবস্থা আজকাল বাংলাদেশে আছে নাকি! তবে—

ওর চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল—মা এলেন ঘরে।

কোনো ভূমিকা না করেই তিনি রাত্রির বিয়ের সংবাদ দিলেন। ছেলেটি খুবই ভালো। বিত্তশালী এবং বিদ্বান। ওকে এক গানের জলসায় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ছেলের কাকা। তিনিই খোঁজখবর করে এসেছিলেন আগে একদিন এখানে নিজের ভাইপোর সম্বন্ধ নিয়ে। আজ কথাটা পাকাপাকি করে গেলেন।

কিন্তু বলি—বলি করেও নিজের আপত্তিটা মায়ের সামনে তুলে ধরতে পারল না রাত্রি। তার ভিরু মন সঙ্কোচের বেড়ায় তাকে আটকে রাখল।

মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চিন্তার সমুদ্রে তলিয়ে গেল রাত্রি। কি হবে—ও আর শোভন যে ভবিষ্যতের রঙিন ছবি এঁকেছে, তা কি এইভাবেই মুছে যাবে?

সমস্ত শোনার পর কিছুক্ষণ শোভন নীরব রইল, তারপর বলল, তোমার বাবা যা করছেন, তোমার ভালোর জন্যেই করছেন রাত্রি।

কিন্তু—না—না, এরকম ভালো আমি চাই না।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। হাজার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটল না রাত্রির। এক বর্ষণ—শ্রান্ত সন্ধ্যায় ওর বিয়ে হয়ে গেল রবীন গুপ্তর সঙ্গে।

তারপর—

তারপর গড়িয়ে গেছে কিছুদিন। কাজ—পাগল স্বামী নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। কার্যসূত্রে কলকাতার বাইরে দূর—দূর শহরে তাঁর যাতায়াত। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে রাত্রি। সকলের চোখ বাঁচিয়ে শোভন এসেছে তার কাছে—প্রায়ই এসেছে।

এইভাবে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ—

মাসখানেক আগে একদিন হঠাৎ রাত্রির চোখে পড়ল বাগানের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটি লোক নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের বাড়ির দিকে।

রাত্রি প্রথমে গা করেনি। ভেবেছে এমনি হয়তো।

কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ওর ভুল ভেঙে গেল। ও লক্ষ করল ওই লোকটি যে শুধু বাড়ির সামনেই দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকে, তাই নয়, বরং ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে সর্বদা।

রাত্রির ভয় হল। কে এই লোকটা? কেনই বা লোকটা তার পিছনে এইভাবে লেগে রয়েছে?

শোভনের সঙ্গে পরামর্শ করল ও। শোভনও কোনো হদিশ খুঁজে পেলো না, এই প্রহেলিকার।

এদিকে পর পর দুটো বেনামা চিঠি এসেছে ডাকে, রাত্রির নামে। শোভনের সঙ্গে অসঙ্গত ভাবে মেলামেশা করার উল্লেখ রয়েছে তাতে। ভয় দেখানো হয়েছে, এখনও নিজেকে সংযত না করলে স্বামীর গোচর করা হবে সমস্ত কথা।

ভেঙে পড়েছে রাত্রি। একটা দুরন্ত ভয়। একটা আতঙ্ক ওর মনের মধ্যে পাক খেয়ে চলেছে। কে ওই লোকটা—আর চিঠিই বা দিচ্ছে কে?

চিন্তা—কাতর মন নিয়ে কয়েক রাত্রি স্রেফ পায়চারি করে কাটিয়েছে রাত্রি। না—না, স্বামীর কাছে এ পরিস্থিতি সরল হোক, এ ও চায় না। কোনো স্ত্রীরই তা কাম্য নয়।

তাই আজ ও সোজা চলে এসেছে বাসবের কাছে। বাসবের নাম ও শুনেছিল। টেলিফোন গাইড থেকে ঠিকানাটা সংগ্রহ করা ওর পক্ষে খুব কঠিন হয়নি।

নিজের কাহিনী শেষ করলেন রাত্রি গুপ্তা।

বাসব সহজ ভাবে প্রশ্ন করল, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন?

আপনি আমায় ওই লোকটির হাত থেকে বাঁচান বাসববাবু। আমি আর এইভাবে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে পারছি না।

বাসব একটু থেমে বলল, বেশ, আমি আপনার কেসটা টেক আপ করলাম। কিন্তু আপনার সম্পূর্ণ সহযোগীতা আমার চাই, অর্থাৎ আপনাকে আমি যখন যা প্রশ্ন করব, তার উত্তরগুলো আপনি আমায় সঠিকভাবে দেবেন।

আমি সাধ্যমতো আপনাকে সাহায্য করব।

এই সময়ে বাহাদুর তিন কাপ কফি দিয়ে গেল।

বাসব একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, আপনি যখন আজ সকালে নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার কাছে আসেন, তখনও কি লোকটি আপনাকে অনুসরণ করছিল?

হ্যাঁ। আমার মনে হয় এখনও সে এ বাড়িরই সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ডাক্তার, তুমি একবার বাইরের দিক থেকে ঘুরে এসো তো। মহাপ্রভুটির সাক্ষাৎ পাও কিনা দেখে এসো।

শৈবাল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাসব আবার প্রশ্ন করল, আপনার স্বামী এখন কোথায়?

মাস দুয়েক হল ওয়ালটেয়ারে আছেন। আগামী সোমবারে কলকাতায় ফেরার কথা আছে।

কিসের ব্যবসা করেন তিনি?

একটা কন্সট্রাকশন কোম্পানি আছে তাঁর।

ওয়েল মিসেস গুপ্তা—প্লিজ ডোন্ট মাইণ্ড, শোভনবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা এখন কি ধরনের?

একটু চুপ করে থেকে রাত্রি গুপ্তা উত্তর দিলেন, বন্ধুর মতো। উনি একজন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

শৈবাল ফিরে এল এই সময়ে।

কি হল ডাক্তার?

লোকটি বাড়ির সামনেকার ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

রাত্রি গুপ্তা আর্তকণ্ঠে বললেন, দেখলেন তো! আবার এ বাড়ি থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে ও আমায় অনুসরণ করবে।

আপনি কুমারী জীবনে এ লোকটিকে কখনো দেখেছেন?

না।

আচ্ছা, আপনি এখন আসুন। দেখি, কতদূর কি করা যায়। ভালো কথা, ঠিকানাটা আপনার রেখে যাবেন।

মিসেস গুপ্তা নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে স্বামীর নামাঙ্কিত একটা কার্ড বার করে বাসবের হাতে দিলেন।

আইভরি কার্ড। বাসব দুটো আঙুল দিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, আরেকটা কথা, যে উড়ো চিঠিগুলো আপনি পাচ্ছেন, তার এক আধখানা আমার দরকার হবে।

আমার কাছে তো উপস্থিত নেই, পরে আপনাকে পাঠিয়ে দেব। তাহলে আজ আমি উঠি।

আপনি বিশেষ চিন্তিত হবেন না। যতদূর অনুমান করছি, উপস্থিত আপনার ভয়ের কিছু নেই।

এরপর ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন মিসেস গুপ্তা।

বেলা তখন তিনটে। বাসব একাই বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। মোড়ের মাথায় এসেই একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসল ও, তারপর রাত্রি গুপ্তার দেওয়া কার্ডের ঠিকানায় পৌঁছতে ওর বিশেষ অসুবিধা হল না।

অবশ্য বাসব ঠিক বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল না। বেশ কিছু এ—ধারেই নেমে পড়ল ও।

চমৎকার তেতলা বাড়িখানা রবীন গুপ্তর। আধুনিক স্থাপত্যের চরম নিদর্শনস্বরূপ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বাসব কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই থেমে গেল। বাড়িটির ঠিক সামনে রাস্তার এ—প্রান্তে একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়ায় কুয়াশা রচনা করছে।

ইনিই তাহলে তিনি।

রাস্তায় বিশেষ লোকচলাচল ছিল না। বাসব নিজেকে যতদূর সম্ভব গোপন করে লোকটির দিকে তাকাল। বেশ লম্বা, চওড়াও সেই অনুসারে। গায়ের রং কালো। বিশেষত্বহীন মুখশ্রী। পরনে ডেক্রনের ট্রাউজার আর সাদা সার্ট।

সময় কেটে চলল।

লোকটির সিগারেট শেষ হয়ে গেছে কখন। সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে রবীন গুপ্তর বাড়িটির দিকে তাকিয়ে। বাসবও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সেই ভাবে।

আরো আধঘণ্টা কাটল।

লোকটি পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছল একবার, তারপর বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল। বাসব দূরত্ব ও গোপনতা বজায় রেখে অনুসরণ করল ওকে।

বড় রাস্তায় এসেই লোকটি টালিগঞ্জগামী একটা ট্রামে চেপে বসল। বাসবও উঠল তাতে। হাজরার মোড়ে গিয়ে লোকটি নামল ট্রাম থেকে। বাসবও নামল।

চেতলাগামী তেত্রিশ নম্বর বাসটি এই সময়ে এসে দাঁড়াল। লোকটি চড়ে পড়ল তাতে। বাসবও অনুসরণ করল তাকে। চেতলা—বাজারে বাস থেকে নামল লোকটি। তারপর দুর্গাপুর ব্রিজের দিকে এগিয়ে চলল। বাসব অন্যান্য লোকের সঙ্গে গা মিশিয়ে লোকটির পিছনে পিছনে চলল।

ব্রিজ পার হয়েই দ্রুত এগিয়ে চলল লোকটি। বাসবও নিজের গতি দ্রুত করল। কিন্তু ওকি… কোথায় গেল সে? সামনে আর দেখা যাচ্ছে না লোকটিকে। নিশ্চয়ই কোনো গলির মধ্যে ঢুকে গেছে।

বাসব আন্দাজ মতো একটা গলির মধ্যে গিয়ে ঢুকল। এতখানি পরিশ্রম তার ব্যর্থ হল নাকি! লোকটির চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

বাসবের কপালে ভাঁজে ভাঁজে চিন্তার রেখা দেখা গেল। মন্থর পদে ও গলি থেকে বেরিয়ে আসবার জন্যে পা বাড়াল। এই সময়ে কে যেন বলে উঠল, সিগারেট প্লিজ—

বাসব মুখ ফিরিয়ে দেখল, ঠিক তার হাত পাঁচেক পিছনে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার আধ—খোলা সিগারেট—কেস। ও নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল—

আপনি আমায় অনুসরণ করছেন—লোকটি আবার বলল, তা আমি প্রথম থেকেই জানি।

বাসব নিজেকে ফিরে পেয়েছে এতক্ষণে। ও সহজ কণ্ঠে বলল, বুঝতে যখন পেরেছেন, তখন অবশ্য আর লুকিয়ে—ছাপিয়ে লাভ নেই। মিসেস গুপ্তার পক্ষ থেকেই আমি জানতে চাইছি, কেন আপনি তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে বেড়াচ্ছেন?

এর অবশ্য একটা সঙ্গত কারণ আছে। তবে আপনাকে তা বলতে আমি বাধ্য নই।

আইনের চোখে আপনি অপরাধ করছেন, একথা ভুলে যাবেন না।

অপরাধ! হাসল লোকটি, বেশ তো। আইনের সাহায্যে আমাকে যদি নিবৃত্তি করতে পারেন তো করুন।

বাসব লোকটির কথাবার্তায় অবাক না হয়ে পারে না। কি করণীয় তার এখন? লোকটির অজান্তে তার আস্তানা দেখে যাওয়াই ছিল ওর উদ্দেশ্য, কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েই সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল।

বাসবকে চুপ করে থাকতে দেখে লোকটি আবার বলল, আপনি তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করুন, আমি চললাম। আমার সময়ের দাম আছে।

লোকটি আর দাঁড়াল না। দ্রুত অদৃশ্য হল একটি বন্ধ দোকান—ঘরের পাশ দিয়ে। বাসব অবশ্য আর তাকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করল না। মন্থর পদে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ফিরে চলল।

পরের দিন ভোরে। শৈবাল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, কালকের অভিযানের কি হল? রাত্রে তো কিছু উচ্চবাচ্য করলে না—

কি আর বলব বল? বাসব বাবাজির চরম পরাজয় ঘটেছে কাল।

এরপর কালকের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল বাসব।

সমস্ত শুনে শৈবাল বলল, আচ্ছা ঘোড়েল লোক যা হোক।

আমি কেবল ভাবছি, কি স্বার্থ তার একটি মহিলার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবার?

এই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন শব্দ তুলে। বাসব রিসিভারটা তুলে নিল, হ্যালো।

অপর প্রান্ত থেকে রাত্রি গুপ্তার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে…হ্যালো—মিস্টার ব্যানার্জি—আমি মিসেস গুপ্তা—তাড়াতাড়ি চলে আসুন এ—বাড়িতে একবার—একটা খুন হয়েছে—

খুন!

হ্যাঁ—যে লোকটা আমায় ফলো করছিল সেই খুন হয়েছে আমাদের লাইব্রেরি ঘরে।

আমি এখুনি আসছি। আপনি পুলিশকে এখনো একথা জানাননি বোধ হয়—স্থানীয় থানায় রিং করুন—কুইক—

বাসব রিসিভারটা নামিয়ে রেখেই বিস্মিত শৈবালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনার বিচিত্র পরিবেশ ডাক্তার। সন্দেহজনক সেই লোকটাই খুন হয়েছে শুনছি।

ওরা মিনিট পনেরোর মধ্যেই রবীন গুপ্তর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। পুলিশ অবশ্য ওদের আগেই সেখানে হাজির হয়েছিল।

লাইব্রেরি ঘরের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে আছে মৃতদেহটা। মৃতের পরনে এখনো সেই ডেক্রনের ট্রাউজার আর সাদা শার্ট।

বাসব ইন্সপেক্টর বিরাজ সোমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে পড়ল।

কি হে, দাঁড়িয়ে পড়ে কি এত চিন্তা করতে লাগলে?

শৈবালের কণ্ঠস্বরে চটকা ভাঙল ওর। অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল ও।

মৃদু হেসে বলল, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। চল—

কয়েক পা এগিয়েই বিরাজ সোমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের। তিনি দ্রুত কণ্ঠে বাসবকে বললেন, শুনলাম মিসেস গুপ্তা নাকি আপনার ক্লায়েন্ট। বেশ, আপনি যা দেখে—টেখে নেবার নিন, আমি না হয় তারপরে ঘরে চাবি দেব।

বিরাজ সোমের শ্লেষটা প্রায় হজম করেই বাসব উত্তর দিল, আপনি যখন রয়েছেন তখন অবশ্য আমার দেখা—না—দেখা একই কথা, তবু—চল ডাক্তার।

বেশ বড় লাইব্রেরি ঘরখানা। মেঝেয় পুরু করে কার্পেট পাতা। দেওয়ালের সঙ্গে আলমারিগুলো ফিক্সড করা। তাকে তাকে বইয়ের সারি। ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিলকে কেন্দ্র করে সারি সারি চেয়ার।

বাসব আরেকবার ঘরের চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। মৃত্যুর মতোই নিথর, নিস্তব্ধঘরখানা। মৃতদেহটা তখনও পড়ে রয়েছে মেঝেয়।

বাসব ঝুঁকে পড়ে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অ্যালকোহলের গন্ধ বেরুচ্ছে, আমার মনে হয়—

কিন্তু কথা শেষ করার আগেই ওর দৃষ্টি পড়ল টেবিলের ওপর। বাসব এগিয়ে গেল সেদিকে। টেবিলের ওপর কয়েকখানা বই ছড়ানো রয়েছে আর তার মাঝে একটা কার্ডের মতো কি পড়ে রয়েছে। বাসব হাতে তুলে নিল সেখানা। চৌকো একটা কার্ড। তার ওপর মোটা কালো হরফে লেখা রয়েছে আট অক্ষরটি।

বাসব সেখানা নিজের পকেটে রেখে দিয়ে, শৈবালকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল লাইব্রেরি থেকে।

রাত্রি গুপ্তা তখন নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। রবীন গুপ্তের কাকা অসীম গুপ্ত তখন বারান্দার একধারে মুহ্যমানের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। বাসব এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। উনি মুখ তুলে তাকালেন।

মৃদু কণ্ঠে বাসব বলল, আপনাকে আমি গোটাকতক প্রশ্ন করতে চাই অসীমবাবু?

ফিকে হেসে তিনি বললেন, বলুন।

আপনি মৃত লোকটিকে চেনেন?

না।

আগে দেখেছেন কখনো?

বারকতক দেখেছি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।

আপনার মনে সন্দেহ জাগেনি, কেন লোকটা আপনাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে?

না। কারণ ব্যাপারটা এত তলিয়ে দেখিনি আমি।

আপনি কখন জানতে পারলেন এই দুর্ঘটনার কথা?

সকাল প্রায় সাড়ে ছটা আন্দাজ সময়ে। বাড়ির পুরোনো চাকর বলাই গিয়ে আমায় খবরটা দিলে।

কাল রাত্রে কোনোরকম শব্দ—টব্দ পেয়েছিলেন?

না। তাছাড়া শব্দ পাওয়ার কথাও নয়, কারণ আমি থাকি বাড়ির পিছনের ব্লকে। মানে বাড়িটা পার্টিশন করা আর কি। সামনের ব্লকটা আমার ভাইপোর, আর পিছনেরটা আমার।

ও। আপনার ভাইপোকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে? উনি এখন ওয়াল্টেয়ারে আছেন, না?

এই খানিক আগে করা হয়েছে। কিন্তু কি বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো? আমাদের বাড়িতেই এই কাণ্ড।

বাসব ধীর কণ্ঠে বলল, আমিও কম অবাক হচ্ছি না। আচ্ছা, মিস্টার গুপ্ত, এই ব্লকে বাইরে থেকে ঢোকবার কটা রাস্তা আছে?

তিনটে—মানে যা দিয়ে ডায়রেক্ট লাইব্রেরি ঘরে আশা যায়।

কোথায়, কোথায়, বলুন কাইন্ডলি?

একটা পার্লারের সামনেকার দরজা, একটা উঠোনের দিকের দরজা আর একটা এই বারান্দারই শেষদিকের দরজা। অবশ্য ও—দরজাটা সব সময়ে বাইরের দিক থেকে তালা দেওয়াই থাকে।

বাইরের দিক থেকে, অর্থাৎ রাস্তার দিক থেকে, কেন?

কারণ দরজাটার ঠিক এ—ধারেই মিটার—বোর্ডটা আছে। তাই মিটার রির্ডারের সুবিধের জন্যে ওই ধার দিয়ে তালা লাগানো। যে মিটার রিড করার সময় তালা খুলে ভেতরে আসে, সেই আবার কাজ শেষ করে তালা বন্ধ করে চলে যায়।

অদ্ভুত ব্যবস্থা তো! আপনি কি করেন অসীমবাবু?

শৈবাল খুঁটিয়ে দেখছিল অসীম গুপ্তকে এতক্ষণ। গৌরবর্ণ, মোটাসোটা চেহারা, শান্তসৌম্য মুখের ভাব। কাঁচাপাকা একমাথা চুল।

অসীম গুপ্ত বললেন, হুণ্ডির কারবার করি। অকৃতদার, একলা মানুষ—চলে যায় ভালো ভাবেই।

ধন্যবাদ মিস্টার গুপ্ত, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। এখন একবার আমি মিসেস গুপ্তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বেশ তো। বারান্দার শেষের ওই ঘরখানায় বৌমা আছেন, আপনারা যান—

বাসব আর শৈবাল নির্দিষ্ট ঘরে দিকে এগিয়ে গেল।

রাত্রি গুপ্তা বিছানার ওপর নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছেন। বাসব দরজার কাছ থেকে বলল, ভেতরে আসতে পারি?

ভেজা চোখে মুখ ফেরালেন মিসেস গুপ্তা। বললেন, আসুন।

ঘরে প্রবেশ করল ওরা।

কোনো ভূমিকা না করেই বাসব আরম্ভ করল, এরকম ভাবে যে হঠাৎ ব্যাপারটা ঘটে যাবে, তা আমি কল্পনাও করিনি। তবে আপনি একটু বেশি মাত্রায় নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

আমার ভীষণ ভয় করছে মিস্টার ব্যানার্জি। চিনি না জানি না, এরকম একটা লোক আমাদের বাড়িতেই খুন হল!

আপনি ভয় পাবেন না। যদিও আমি কেসটা অন্যভাবে টেকআপ করছিলাম, তবু এ—ব্যাপারের যথাসাধ্য করব।

মিনতি ভরা কণ্ঠে রাত্রি গুপ্তা বললেন, আমি পুলিশকে আপনার কথা বলেছি—প্লিজ, এর একটা নিষ্পত্তি আপনাকে করতেই হবে।

আমি তো আগেই বললাম সেকথা। যাক, এখন কাজ আরম্ভ করা যাক। ওই লোকটির সঙ্গে আপনার কোনোদিন কথাবার্তা হয়েছে?

একদিনের জন্যেও না।

কাল ক’টায় আপনি বাড়ি ফিরেছিলেন?

সন্ধে সাড়ে সাতটার পর।

তখনও কি লোকটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল?

না, সন্ধের পর থেকে বড় একটা ওকে দেখা যেত না।

বাড়ি ফেরার পর আপনি কি কি করলেন মিসেস গুপ্তা?

প্রথমে কাপড় বদলে কিছুক্ষণ রেডিও শুনি। তারপর রাত্রের খাওয়াটা সেরে শুতে যাই দশটার পর।

শুতে যাওয়ার আগে দরজাগুলো কি আপনিই বন্ধ করেছিলেন?

হ্যাঁ। তাছাড়া উপায়ও ছিল না, কারণ বলাই কাল ছুটি নিয়েছিল।

কাল রাত্রে আপনি তাহলে—

বাসবকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রাত্রি গুপ্তা বললেন, কাল আমি বাড়িতে একলাই ছিলাম। আমার খুড়শ্বশুর অবশ্য পিছনের ব্লকে ছিলেন। তবে ওই ব্লক থেকে এই ব্লকে আসার কোনো দরজা নেই, মাঝখানে পার্টিশান ওয়াল দেওয়া। আমার বেশ ভয় ভয় করছিল, তারপর কোন সময়ে যে ঘুমিয়ে পড়েছি আর মনে নেই।

আপনার ঘুম ভাঙল বোধ হয় ভোরে?

সাতটার পর কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে গিয়ে পার্লারের সামনেকার দরজাটা খুলে দিলাম। বলাই ঢুকল ভেতরে।

তারপর বলাই বোধ হয় মৃতদেহটা আবিষ্কার করল?

হ্যাঁ। ও লাইব্রেরি—ঘরে ঝাড়পোঁছ করতে গিয়েই দেখতে পায় মৃতদেহটা।

আচ্ছা মিসেস গুপ্তা, বারান্দার দরজার তালাটা নাকি বাইরে থেকে দেওয়া মিটার রিডের সুবিধের জন্য। হঠাৎ এরকম ব্যবস্থা আপনারা চালু করলেন কেন?

না করে উপায় ছিল না। দেখছেনই তো আমাদের পরিবারে কত লোক কম। আমরা প্রায়ই বাড়ির বাইরে বাইরে থাকায় কয়েকবার মিটার রিডই হয়নি—লাইট প্রায় কেটে যাওয়ার উপক্রম। তাই এরকম ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

ধরুন, আপনারা কেউ বাড়ি নেই, এই সময় লোকটি মিটার রিড করতে এসে মূল্যবান কিছু চুরি করে নিয়ে পালাল, তখন?

সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। লোকটিকে আমরা অত্যন্ত বিশ্বাসী বলেই জানি। আগে ও ইলেকট্রিক ওয়্যারিং এর কাজ করত। এমন কি এ—বাড়ির ওয়্যারিং ওই করেছে।

বাসব একটু চিন্তা করে বলল, শোভনবাবুর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের কথা নিশ্চয়ই আপনার স্বামী জানেন না?

মাথা নীচু করে রাত্রি গুপ্তা উত্তর দিলেন, না।

ওয়েল মিসেস গুপ্তা, এখন তাহলে আমরা উঠলাম। আপনি যে উড়ো চিঠি পেয়েছেন, তার একখানা উপস্থিত আমায় দিলে ভালো হয়।

রাত্রি গুপ্তা খাট থেকে নেমে ওয়ার্ডরোবের কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর তার পাল্লাটা খুলে ভেতরের ড্রয়ারের মধ্যে থেকে একটা চিঠি বার করে বাসবের হাতে দিলেন। বাসব চিঠিটা পকেটে রেখেই সান্ত্বনাসূচক কয়েকটা কথা বলল মিসেস গুপ্তাকে। তারপর শৈবালকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সারাদিনের মধ্যে একটা কথাও বলল না বাসব। গভীর চিন্তায় ডুবে রইল।

বিকেল পাঁচটার সময় শৈবালকে বাড়িতে থাকতে বলে বাসব বেরিয়ে পড়ল।

ফিরে এল আটটার পর। মুখের চিন্তিত ভাবটা কেটে গেছে, তার পরিবর্তে ওকে বেশ আনন্দিতই মনে হচ্ছে এখন। বাড়ি ফিরেই টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। একটা নাম্বার ডায়েল করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অপর প্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

শৈবাল একতরফা কথা শুনে যেতে লাগল।—হ্যালো, কে মিসেস গুপ্তা—আপনাদের বারান্দার দরজা অর্থাৎ যার তালা বাইরের দিক থেকে বন্ধ, তার ক’টা চাবি আছে—কি বললেন দুটো—ও—কি বললেন, একখানা থাকে মিটার রিডারের কাছে আর অন্যখানা আপনার চাবির রিঙে—শুনুন, দেখুন তো আপনার চাবির রিঙে দ্বিতীয় চাবিখানা আছে কিনা—বেশ তো আমি হোল্ড করছি— কি বললেন, চাবিটা নেই—আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন—আমি কিন্তু হচ্ছি না মিসেস গুপ্তা—ভালো কথা, চাবির রিংটা থাকত কোথায়—ভ্যানিটি ব্যাগে—আচ্ছা, গুড নাইট।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখল বাসব।

সোফায় এসে বসল। একটা সিগারেট ধরাল তারপর।

শৈবাল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার হাবভাব ক্রমেই ভীষণ হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। আমার কাছে এদিকে সবই…

ধোঁয়া বলে মনে হচ্ছে।—বাসব ওর কথাটা পূর্ণ করল।

যাক, এসো মার্ডারটা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। তুমি তো ডেডবডির পজিশান দেখেছ ডাক্তার। এ বিষয়ে তোমার কি ধারণা?

আমার মনে হয় নিহত ব্যক্তি দরজার দিকে পিছন করে টেবিলের উপর ঝুঁঁকে কিছু দেখছিল। এই সময়ে হত্যাকারী তাকে পিছন থেকে স্ট্যাব করে।

আমারও তাই মনে হয়। তারপর বডিটা গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আমি ঘটনাটা এইভাবে সাজিয়েছি মোটামুটি, মৃত লোকটি কোনো বিশেষ কারণে বারান্দার দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে আসে। প্রশ্ন উঠতে পারে সে দরজার চাবি পেল কোথা থেকে। আমার মনে হয় হত্যাকারী আগেই রাত্রি গুপ্তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চাবিটা চুরি করে এবং ওই লোকটি ও সে নিজে একই সঙ্গে বাড়ির ভেতর ঢোকে। এখানে ধরে নিতে হবে হত্যাকারী ও লোকটির মধ্যে বিশেষ আলাপ ছিল। তারপর তোমার কথা মতো খুন হয়ে যাওয়ার পর খুনি ওখান থেকে সরে পড়ে। হত্যাকারী একজন বলশালী লোক। তা না হলে ছোরাখানা দেহের এতখানি অভ্যন্তরে যেতে পারে না।

কিন্তু দুটো জিনিস রহস্যই থেকে যাচ্ছে। এক, লোকটি কে এবং কেন ও বাড়িতে গিয়েছিল। আর দুই, হত্যার উদ্দেশ্য কি?

তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু ও দুটো ব্যাপারেই আমি এখনও কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারিনি। কিছুক্ষণ আগে থানায় গিয়ে আমি কয়েকটা জিনিস নিয়ে এসেছি। এগুলি সবই নিহত ব্যক্তিটির পকেটে পাওয়া গেছে।

বাসব পকেট থেকে বার করল একে একে—একটা নোটবই, ফাউন্টেন পেন, একটা চিঠি, একটা সিনেমার আধ—ছেঁড়া টিকিট।

শৈবাল বলল, এগুলো থেকে কোনো সূত্র আবিষ্কার করতে পারবে বলে তুমি বিশ্বাস কর?

আমার তো মনে হয় পারব।

বাসব জিনিসগুলো পকেটে ভরতে ভরতে আবার বলল, আমি এখন ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে তোমায় একটা প্রশ্ন করি—

কর।

কয়েকদিন থেকে ভীষণ ঠান্ডা চলছে, তবু মৃত ব্যক্তির গায়ে আমরা কোনো গরম কাপড় দেখতে পাইনি কেন? এই প্রচণ্ড শীতে শুধু একটা সার্ট গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরুবার কি কারণ থাকতে পারে, বলতে পার?

শৈবাল আশ্চর্য হয়ে ভাবে। তাই তো, এ জিনিসটা তো সে মোটেই খেয়াল করেনি। হত ব্যক্তির গায়ে ছিল ডেক্রনের ট্রাউজার আর শাদা সার্ট মাত্র।

দু’ঘণ্টা পরে বাসব বেরিয়ে এল ল্যাবরেটরি ঘর থেকে। হস্তস্থিত সিগারেটে দীর্ঘ টান দিয়ে বলল, কি ডাক্তার, যা বলে গিয়েছিলাম ও—বিষয়ে ভেবে কিছু ঠিক করতে পারলে?

আমার মনে হয় লোকটির গায়ে কোট ছিল, নিহত হওয়ার পর সেখানা খুলে নেওয়া হয়েছে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। খুন হওয়ার আগের দিন যখন লোকটির সঙ্গে আমার দেখা হয় তখনও তার গায়ে ওই জামাকাপড়ই ছিল। হয়তো সে বিকেল বেলাতেই ফিরে এসেছিল আবার এবং কোনোক্রমে বারান্দার ওই দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল। তারপর—

তাহলে তো তোমার আগের থিয়োরি টিকছে না?

কই আর টিকছে। যাক, ওকথা পরে ভাবলেই চলবে। এখন তুমি আমার একটা আবিষ্কারের কথা শোন। আমি ওই জিনিসগুলো পরীক্ষা করে বুঝতে পেরেছি নিহত ব্যক্তিটি বাংলাদেশের লোক তো নয়ই বরং সুদূর রাজপুতানার অধিবাসী।

কি রকম?

আমি নোটবইটা, ফাউন্টেন পেনের খোল ইত্যাদি অনুবীক্ষণ দিয়ে দেখলাম তাদের খাঁজে খাঁজে বালির প্রচুর কণা জমা হয়ে রয়েছে।

বালির কণা!

হ্যাঁ। রাজপুতানা বালির দেশ, ওখানকার অধিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসে বালির কণা পাওয়া যাবে, এতে আর বৈচিত্র্যের কি আছে। তাছাড়া ওই চিঠিখানাও এসেছে অমরকোট থেকে।

চিঠি আর নোটবুকে কি আছে?

বিশেষ কিছু নেই। নোটবইটায় খাপছাড়া ভাবে রোজকার খরচ লেখা। চিঠিখানা হিন্দিতে রামস্বরূপ নামে কোনো লোকের লেখা। অতি মামুলি চিঠি। মৃত লোকটিকে চিঠিতে অমিয়বাবু হিসেবে উল্লেখ করা রয়েছে।

বাসব আর কিছু বলল না। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিতে দিতে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

পরের দিন একটা টেবিলকে কেন্দ্র করে তিনটে চেয়ারে বসে রয়েছে বাসব, শৈবাল আর শোভন। রাত্রি গুপ্তার বন্ধু শোভন রায়।

ঠিকানাটা আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিল বাসব। তাই আজ সকালেই শৈবালকে সঙ্গে নিয়ে ও চলে এসেছে শোভন রায়ের বাড়িতে।

আপনার সঙ্গে তাহলে হপ্তাখানেক মিসেস গুপ্তার দেখা হয়নি?

বাসবের কথার উত্তরে মিঃ রায় বললেন, না। কয়েকদিন বিশেষ কাজে আমি ব্যস্ত ছিলাম।

আপনি উড়োচিঠি আর ওই লোকটির সম্বন্ধে কি জানেন?

বিশেষ কিছুই না। রাত্রি পর পর দুটো উড়ো চিঠি পেয়েছিল আর ওই লোকটি কিছুদিন ধরে ওকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত—আমি এইটুকুই জানি।

হুঁ। আপনার সঙ্গে রবীন গুপ্তের আলাপ আছে?

না।

অথচ আপনি তাঁর বাড়ি যাতায়াত করতেন!

তীব্র কণ্ঠে শোভন রায় বললেন, আপনি কি মিন করছেন?

বাসব নির্বিকার কণ্ঠে বলল, সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে। রাত্রি গুপ্তার সঙ্গে আপনার এত দহরম—মহরম অথচ তাঁর স্বামী মিঃ গুপ্তর সঙ্গে মৌখিক আলাপটুকু পর্যন্ত আপনার নেই।

আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করবার ইচ্ছেই আমার আছে। তবে আপনি অফট্র্যাকে চলে যাচ্ছেন।

একেবারেই না। রাত্রি গুপ্তার সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক মিস্টার রায়?

ব্যক্তিগত কোনো কথা আমি এখানে আলোচনা করতে চাই না।

অবশ্য আপনি না বললেও আমার কিছুই অজানা থাকবে না। চল ডাক্তার, ওঠা যাক। আচ্ছা মিস্টার রায়—গুড ডে।

ট্যাক্সিতে করে বাড়ি ফিরতে ওদের মিনিট আটেকের বেশি লাগল না। বাইরের ঘরেই এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছিলেন।

ওদের দেখেই তিনি বললেন, আমি রবীন গুপ্ত।

বাসব এগিয়ে এসে বলল, কী সৌভাগ্য। বসুন—বসুন—নিশ্চয়ই আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে?

না—না। এই আসছি। কাল রাত্রেই ফিরেছি ওয়াল্টেয়ার থেকে।

শৈবাল খুঁটিয়ে দেখল ভদ্রলোককে। গৌরবর্ণ সুন্দর মুখশ্রী। দেহের গঠনে বেশ শক্তিমান বলেই মনে হয়। বয়স তেত্রিশ—চৌত্রিশের মধ্যেই।

বাসব সিগারেট কেসটা এগিয়ে ধরল তাঁর দিকে। একটা সিগারেট তুলে নিয়ে অগ্নি সংযোগ করতে করতে মিঃ গুপ্ত বললেন, আমারই বাড়িতে যে এরকম একটা ইন্সিডেন্ট হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। এসে শুনলাম, রাত্রির অনুরোধে আপনি কেসটা হাতে নিয়েছেন। তাই সোজা চলে এলাম আপনার কাছে। যদি কোনো রকম সাহায্য হয়।

খুবই ভালো কাজ করেছেন মিস্টার গুপ্ত। আচ্ছা, আপনি মর্গে গিয়ে ডেডবডি দেখে এসেছেন?

হ্যাঁ। কাল রাত্রেই দেখেছি। লোকটিকে আদপেই চিনতে পারলাম না।

আপনার কিছু খোয়া গেছে বাড়ি থেকে?

আমার স্ত্রীর কাছে খোঁজ করেছিলাম, ও তো বললে কিছুই হারায়নি।

আপনার মোটর আছে?

এই রকম প্রশ্নে একটু আশ্চর্য হলেন রবীন গুপ্ত। বললেন, না। তবে কেনবার ইচ্ছে রয়েছে।

আপনার পারিবারিক বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে পারি নিশ্চয়ই?

ও সিওর। কি জানতে চান বলুন?

আমি আপনাদের পরিবারের বিষয় কিছু জানতে চাই। কিছু অতীতের কথা—কিছু বর্তমানের।

একটু নীরব রইলেন মিঃ গুপ্ত। মনে মনে সমস্ত বিষয়টা গুছিয়ে নিলেন যেন। তারপর আরম্ভ করলেন, আমার পারিবারিক ইতিহাস আমারই যে খুব ভালো করে জানা, তা নয়। তবে যতটুকু জানি আপনাকে বলছি। আমার দাদু বীরেন গুপ্ত, অত্যন্ত ধনশালী ব্যক্তি ছিলেন। স্বভাবে তিনি ছিলেন একরোখা ও রাশভারী। তাঁর তিন ছেলে, আমার বাবা, আমার মেজকাকা অসীম গুপ্ত আর ছোটকাকা অচীন গুপ্ত। দাদুর বেশ বয়স হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি উইল করবার মনস্থ করলেন। উইল—ও হল যথাসময়ে, কিন্তু উইলের মর্মকথা ছেলেদের জানতে দেওয়া হল না। এদিকে ভাইয়ে ভাইয়ে বেশ মনোমালিন্য দেখা গেছে—বিশেষে বাবার সঙ্গে ছোটকাকার। ছোটকাকাকে কিন্তু দাদু খুব ভালোবাসতেন। সেবার গরমে উনি ছোটকাকাকে নিয়ে সিমলা বেড়াতে গেলেন। হপ্তাখানেক পরে সিমলা থেকে তার এল, দাদু নাকি পাহাড়ের উপর থেকে খাদে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। সকলে স্তম্ভিত হলেন। যথাসময়ে উইল পড়া হল। কিন্তু কী আশ্চর্য—দাদু ছোটকাকাকে এক কপর্দকও দিয়ে যাননি। ছোটকাকা ক্ষেপে উঠলেন। তাঁর মতে এ—উইল জাল। বাবাও বললেন, দাদু খাদে পড়ে যাননি। তাঁকে ছোটকাকাই ধাক্কা মেরে ফেলে খুন করেছেন। একথা শোনবার পর জোঁকের মুখে নুন পড়ল যেন। গুম হয়ে গেলেন তিনি এবং পরের দিন আর বাড়িতে তাঁকে পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজি, পুলিশে খবর দেওয়া সবই হল, কিন্তু ফল কিছুই পাওয়া গেল না। তবে বছর খানেক পরে জানা গেল, ছোটকাকা ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তারপর কত বছর কেটে গেছে, বাবা মারা গেছেন। অবশ্য মারা যাওয়ার আগে তিনি মেজকাকার সঙ্গে পার্টিশান করে নিয়েছিলেন। এই আমাদের পারিবারিক ইতিহাস।

একটানা এতক্ষণ বলার পর থামলেন রবীন গুপ্ত।

বাসব বলল, ছোটকাকাকে আপনার মনে আছে?

না। আমি ছোটবেলা থেকেই মধ্যপ্রদেশের সুবিখ্যাত সিন্ধিয়া স্কুলের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। পড়া শেষ করে যখন বাড়ি ফিরি, তখন ছোটকাকা মারা গেছেন।

হুঁ। শোভন রায় বলে কাউকে আপনি চেনেন?

না।

আপনার দাম্পত্য জীবন কেমন মিস্টার গুপ্ত?

খুবই ভালো। কিন্তু একথা কেন মিস্টার ব্যানার্জি?

এমনি। কফি খাবেন তো?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই কফি এল। দু—একটি সৌজন্যসূচক কথা বলতে বলতে কফি শেষ করলেন মিঃ গুপ্ত। তারপর তিনি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

ডাক্তার, কি রকম বুঝলে ভদ্রলোককে?

আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে যেন একটু বেশি মাত্রায় ইন্টারেস্টেড মনে হল।

তা ছাড়া কত বেশি কথা বলেন ভদ্রলোক লক্ষ করলে?

সন্ধেবেলায় পোস্টমর্টমের রিপোর্ট পাওয়া গেল। যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তাই। শুধু বেশির মধ্যে জানা গেল মৃত লোকটির শরীরের মধ্যে সায়নাইড আর অ্যালকোহল পাওয়া গেছে।

বেশ রাত্রি করে বাসব বাড়ি ফিরল। শৈবাল তখনও জেগে বসে রয়েছে। বাসব থানায় পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা দেখার পর সোজা রবীন গুপ্তর বাড়ি চলে গিয়েছিল।

শৈবাল প্রশ্ন করল, এত দেরি হল তোমার?

বাসব সোফায় বসতে বসতে বলল, আর বল কেন? মিসেস গুপ্তাকে দিয়ে একটা চিঠি লেখাবার ছিল।

চিঠি!

হ্যাঁ, হে। ওখান থেকে বেরিয়েই সোজা গেলাম চৌরঙ্গি পাড়ার এক সিনেমা হলে। ওখান থেকে আবার রিপন স্ট্রিটের এক দর্জির দোকানে।

দর্জির দোকানে? তুমি যে ক্রমেই—

আহা—হা, ব্যস্ত হয়ো না ডাক্তার। সমস্ত ধাঁধার উত্তর তুমি কালই পাবে।

শৈবাল প্রায় লাফিয়ে উঠল, বল কি? তুমি জানতে পেরেছ লোকটার পরিচয়?

শুধু তাই নয়। হত্যাকারীও আমার চোখে ধরা পড়ে গেছে। আচ্ছা, জিনিসটা তোমার কাছে একটু সরল করে আনি। বারান্দার দরজার চাবিটা মিসেস গুপ্তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চুরি গেছে নিশ্চয়ই শুনেছ?

হ্যাঁ।

আচ্ছা বল তো, কার পক্ষে ওই চাবিটা চুরি করা সবচেয়ে সহজ?

শৈবাল এক মিনিট চিন্তা করে বলল, রবীন গুপ্ত যখন এখানে ছিলেন না, তখন—মিসেস গুপ্তার বিশেষ বন্ধু শোভন রায়, তাঁর পক্ষেই অবশ্য ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে—তুমি তাহলে বলতে চাও…

বাসব মৃদু হাসল, আমি আজ আর কিছুই বলতে চাই না। রাত হয়েছে, চল, খেয়ে শুয়ে পড়া যাক।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় বাসবের অনুরোধে সকলে একত্রিত হয়েছেন রবীন গুপ্তের ড্রইং রুমে।

মিসেস গুপ্তা, অসীম গুপ্ত, শোভন রায় ও রবীন গুপ্ত।

বাসব শৈবালকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল সাতটার পর। ওর হাতে একটা ফোলিও ব্যাগ।

সোফায় ওরা বসল দুজনে।

সকলের মুখের ওপর একটা থমথমে ভাব। বাসব সকলের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাদের এইভাবে বিরক্ত করার দরুন দুঃখিত। না করেও উপায় ছিল না। পুলিশ ওয়ারেন্টের সাহায্যে কালই একজনকে অ্যারেস্ট করবে, তাই—

গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে রবীন গুপ্ত বললেন, অ্যারেস্ট! কাকে?

আপনার স্ত্রীকে।

আমাকে! বিস্ময়ে ভেঙে পড়লেন রাত্রি গুপ্তা। কিন্তু আমি…আমি তো…

আমি জানি আপনি কি। পুলিশ অযথা আপনাকে সন্দেহ করেনি। তারা খবর পেয়েছে, দুর্ঘটনার দিন রাত এগারোটার পর আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ—গি—গিয়েছিলাম। খুনের সঙ্গে তার…

তবে আপনি আমায় মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন? আপনি বলেননি, সন্ধ্যো সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফিরে আপনি রাতভোর বাড়িতে ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন?

এই শীতেও ঘেমে উঠেছেন মিসেস গুপ্তা। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, আমি কোনো কারণে মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন—

আপনি উত্তেজিত হবেন না রাত্রি দেবী। শান্ত হোন। শুধু আপনিই যে মিথ্যে কথা বলেছিলেন তাই নয়—রবীনবাবু, আপনি কলকাতাতেই ছিলেন, অথচ সকলের কাছে প্রচার করে বেড়িয়েছেন, ওয়াল্টেয়ারে থাকার বিষয়ে। এর অর্থ কি?

রবীন গুপ্ত যেন ফেটে পড়বেন। তিনি নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। আমি কলকাতাতেই ছিলাম, কিন্তু তাতে কি এল গেল? নিশ্চয়ই এতে প্রমাণ হচ্ছে না আমি হত্যাকারী?

বাসব ও—কথায় কান না দিয়ে বলল, আপনারা কাল সকালে পুলিশ আসবার আগেই নিজের নিজের পরিষ্কার অ্যালিবাই আমায় দেবেন, এটাই আশা করব। অবশ্য না দিলেও যে আমার খুব ক্ষতি হবে তা নয়। এই ফোলিওর মধ্যেই হত্যাকারীর বিরুদ্ধে দুটো বড় প্রমাণ আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। এক—একটা ট্যারালিনের টুকরো। দুই—সিনেমায় জিনিস জমা রাখার আট নম্বরের একটা টোকেন। হত্যাকারীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার পক্ষে ও—দুটোই যথেষ্ট। চল ডাক্তার—

বাসব আর একটি কথাও না বলে, ঘরের চারটি নিশ্চল স্তম্ভিত মূর্তির সামনে দিয়ে শৈবালকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

একটানা ঝিল্লির ঐক্যরব শোনা যাচ্ছে।

সশব্দে দুটো বাজল কোথায়। চারধারে কালো অন্ধকার—শীতের রাত যেন চিরদিনের মতো পৃথিবীকে গ্রাস করছে।

বাসব আর শৈবাল গভীর ঘুমে অচেতন।

মৃদু শব্দ হল কোথায়।

বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে একটা ছায়ামূর্তি। বিরাট অলেস্টারে সারা দেহ তার ঢাকা। মাথায় মাইন ক্যাপ। ছায়ামূর্তি বাগানের মধ্যে দিয়ে বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়াল। অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে বাথরুমের জানলাটা খুলে ফেলল আগন্তুক। তারপর গরাদহীন জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে আগন্তুক এগিয়ে চলল, বাথরুম পেরিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে। এ—ঘর ও—ঘরের পর শোবার ঘরে এসে থামল ও। সন্তর্পণে খাটের কাছে এগিয়ে গেল। ঝুঁঁকে দেখল লেপের মধ্যে থেকে মাথা বার করে গভীর ঘুমে অচেতন দুজনে। ভারী নিশ্বাস পড়ছে। আগন্তুক শোবার ঘর পেরিয়ে বাইরের ঘরে এল। ঘরের চতুর্দিকে টর্চের আলো ফেলে কি যেন খুঁজে বেড়াতে লাগল। একসময়ে ওর দৃষ্টি পড়ল ম্যাল্টিলপিসের উপর। টর্চের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ফোলিও ব্যাগটা। আগন্তুকের দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল। দ্রুতবেগে এগিয়ে গিয়ে ব্যগ্র হাতে ফোলিওটা তুলে নিতে গেল আগন্তুক, কিন্তু—

ঠিক সেই মুহূর্তে দপ করে জ্বলে উঠল ঘরের আলোটা।

একটু ভুল হচ্ছে মিস্টার গুপ্ত। ট্যারালিনের টুকরো আর টোকেনটা ফোলিওর মধ্যে নেই।

বাসবের কণ্ঠস্বরে ঘুরে দাঁড়ালেন মিঃ গুপ্ত। একটা অগ্নিময় দৃষ্টি দিয়ে তিনি যেন তাকে পুড়িয়ে ফেলতে চাইলেন।

এই সময়ে বারান্দায় কয়েক জোড়া ভারী জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। শৈবাল দরজা খুলে দিল। সদলে বিরাজ সোম ঘরে প্রবেশ করলেন।

বাসব মৃদু হেসে বলল, আপনার পাংচুয়ালিটির জন্য ধন্যবাদ। আসামি এখানেই উপস্থিত। আপনি অচিন্ত্য গুপ্তের হত্যার অপরাধে রবীনবাবুর কাকা অসীম গুপ্তকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।

বিরাজ সোম অসীম গুপ্তের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন অসীমবাবু। চোখের সেই তীব্র দৃষ্টিটা ম্লান হয়ে এসেছে। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নত করলেন।

আমি দুঃখিত মিস্টার গুপ্ত। ইন্সপেক্টর সোম বললেন, কর্তব্যের অনুরোধে আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।

মাথা তুললেন অসীমবাবু। বললেন, আমি রেডি ইন্সপেক্টর। চলুন—

বাসব ও শৈবালকে নৈশ আহারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রবীন গুপ্তা। আহারের পর সকলে ড্রইংরুমে এসে বসেছেন।

অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ শীত একটু কম।

খাপছাড়া ভাবে গল্প চলেছে। একসময় রবীনবাবু বললেন, আপনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন মৃত ব্যক্তিটি আমার কাকা?

তা কি করে পারব। তবে আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস জানবার পরই আন্দাজ করেছিলাম।

আপনি প্রথম থেকেই সমস্ত ব্যাপারটা বলুন মিস্টার ব্যানার্জি! রাত্রি গুপ্ত অনুরোধ জানালেন।

বাসব একটা সিগারেট ধরিয়ে আরম্ভ করল, মিসেস গুপ্তা এলেন একদিন আমার বাড়িতে। একটি লোক নাকি কিছুদিন ধরে ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করছে। কথা প্রসঙ্গে এও জানতে পারলাম, শোভন রায় নামে একটি লোকের সঙ্গে রাত্রি দেবীর বিশেষ আলাপ ছিল এবং এখনো বন্ধুত্ব বজায় আছে। উনি আমার কাছে সাহায্য চাইলেন ওই লোকটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে। আমি গভীর ভাবে ভাবতে লাগলাম কোনোরকম ক্ষতি না করে শুধু ছায়ার মতো অনুসরণ করার মধ্যে কি স্বার্থকতা থাকতে পারে। ঠিক যেন পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে মিসেস গুপ্তাকে। হঠাৎ আমার একটা কথা মনে এল—পাহারাই দিচ্ছে না তো লোকটা, সম্ভবত মিস্টার গুপ্তের নির্দেশে।

এই সময়ে রবীন গুপ্ত বললেন, আপনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন মিস্টার ব্যানার্জি। মেজকাকা আমায় একদিন বললেন, তিনি নাকি একজনকে প্রায়ই এ—বাড়িতে আসতে—যেতে দেখেছেন। আমার সন্দেহ হল। ভাবলাম, আমি কলকাতার বাইরে বাইরেই থাকি—রাত্রি কি তবে—। যদিও আমি স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসি, তবু মনের মধ্যে একটা খটকা লাগল। আমি রাত্রিকে ওয়াচ করবার ব্যবস্থা করালাম।

যাই হোক, আমার অনুমানটা ঠিক কিনা প্রমাণ করবার জন্যে, সেদিন বিকেলে লোকটিকে অনুসরণ করলাম। কিন্তু ফল কিছুই হল না, মাঝ থেকে ধরা পড়ে গিয়ে নাজেহাল হয়ে ফিরে আসতে হল। পরের দিন সকালে খবর পেলাম লোকটি খুন হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে চারটি জিনিস আমার চোখে পড়ল। এক, ট্যারালিনের একটা টুকরো। দুই, মৃতের মুখে অ্যালকোহলের গন্ধ। তিন, একটা টোকেন। চার, মৃতব্যক্তির গায়ে কোনোরকম গরম কাপড় না থাকা। আরেকটা জিনিস জানতে পারা গেল, বারান্দার দরজাটা রাস্তার ধার দিয়ে তালা দেওয়া মিটার রিডারের সুবিধা হওয়ার জন্যে নাকি। এক—আধদিনের ব্যবধানে রাত্রি দেবী, অসীমবাবু, শোভন রায় এবং রবীনবাবু আমার কাছে তাঁদের বক্তব্য বললেন। রবীনবাবুর পারিবারিক ইতিহাস বলার পরই আমার মনে একটা খটকা লাগল। মৃতের পকেটে যে জিনিসগুলো পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো পরীক্ষা করে আমি বুঝতে পেরেছিলাম লোকটি বালি প্রধান দেশের অধিবাসী। ওই জিনিসগুলোর মধ্যে একটা চিঠিও ছিল। জনৈক রামস্বরূপ অমরকোট থেকে লিখেছে। অমরকোট রাজস্থানের একটা ছোট জায়গা। কাজেই পুলিশের সাহায্যে খোঁজ—খবর নিতে অসুবিধা হল না। অমরকোটে মৃত লোকটির আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেল। সেখানে এমন কতকগুলো জিনিস পাওয়া গেল, যাতে প্রমাণ হল উনি রবীনবাবুর কাকা অচিন গুপ্ত। ছদ্মবেশে ওখানে বাস করছিলেন।

বাসব থামল। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে প্রশ্ন করল, অচিনবাবুকে আপনি কিভাবে এ—কাজে নিয়োগ করলেন মিস্টার গুপ্ত?

মেজকাকার মুখে রাত্রির সম্বন্ধে ও—কথা শোনার পর, আমি তাঁরই কাছে পরামর্শ চাইলাম এ—বিষয়ে কি করা যায়? উনি বললেন একটু নজরে নজরে রাখতে। ঠিক এই সময়েই আমার অচেনা ছোটকাকাটি আমার কাছে এলেন চাকরির সন্ধানে। আমি প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম। ওঁকে মোটা মাইনে দিয়ে বহাল করলাম কাজে—ওঁর ডিউটি হল রাত্রিকে ওয়াচ করা।

বাসব আবার বলতে শুরু করল, প্রথমে আমি সন্দেহ করিনি অসীমবাবুকে। কিন্তু তাঁর একটু সময়ের গরমিল আমায় ভাবিয়ে তুলল। উনি আমায় বলেছিলেন ভোর সাড়ে ছটার সময় ভৃত্য বলাইয়ের মুখে প্রথম খুনের কথা জানতে পারেন। আবার মিসেস গুপ্তা বললেন, বেলা সাতটার পর কলিংবেলের শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। উনি দরজা খুলে দিতে বলাই ঘরে প্রবেশ করে। কাজেই অসীমবাবুর পক্ষে বলাইয়ের মুখ থেকে সাড়ে ছটার সময় খুনের কথা জানা সম্ভব নয়। এদিকে রবীনবাবুও আমার কাছে কিছু সত্য লুকিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমায় বলেন, কাল রাত্রে ওয়াল্টেয়ার থেকে ফিরেছি। তিনি অবশ্য কথাটা তলিয়ে দেখে বলেননি, নইলে বুঝতে পারতেন, ওয়াল্টেয়ার থেকে কলকাতায় ফেরার রাত্রে কোনো ট্রেন নেই। সোজা ওখান থেকে মোটরে এসেছেন কিনা জানবার জন্যে প্রশ্ন করে জানলাম ওঁর মোটরকার নেই। আবার মিসেস গুপ্তা বললেন, তিনি সন্ধ্যার পর থেকে ভোর অবধি বাড়িতেই ছিলেন। অথচ বিটের পুলিশ দেখেছে রাত্রি সাড়ে এগারোটার পর তাঁকে বাড়ি ফিরতে। পরে অবশ্য আমি জানতে পেরেছি, উনি শোভন রায়ের কাছে গিয়েছিলেন। তাই না মিসেস গুপ্ত?

রাত্রি গুপ্তা সহজ কণ্ঠে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মিস্টার ব্যানার্জি। আপনি এত কথা যখন জানেন, তখন এ কথাও নিশ্চয়ই জানেন, আমি শুভাকাঙ্ক্ষী বললেও, আসলে শোভন দিনের পর দিন ধরে আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। কেন জানি না কিছুদিন ধরেই ও আর আমাদের বাড়িতে আসত না। সেদিন ও টেলিফোনে সাড়ে নটার সময় পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দেখা করতে বলে আমায়। তারপর ঘণ্টা দুয়েক অনির্দিষ্ট ভাবে আমরা ট্যাক্সিতেই ঘুরে বেড়াই। ও আমার কাছে একটা বড় রকম টাকার দাবি জানায়। আমি ওকে বহু ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করি, এইভাবে ও যেন আমার ক্ষতি না করে আর। শোভন আমায় ভয় দেখাতে থাকে। টাকা না দিলে ও নাকি আমার স্বামীকে কি সব বলবে।

বাসব আরেকটা সিগারেট ধরাল।

হ্যাঁ, এই রকমই আমি অনুমান করেছিলাম। মৃত ব্যক্তির পকেটে একটা সিনেমার টিকিট পাওয়া গিয়েছিল। আট লেখা টোকেনটা পকেটে ফেলে আমি টিকিটের উপর নাম ছাপা নির্দিষ্ট সিনেমা হলে গেলাম। টোকেনটা যে মাল জমা দেওয়ার, তা আমি বুঝে নিয়েছিলাম। কাউন্টারে গিয়ে বললাম, তাড়াতাড়িতে ভুলে গিয়ে জিনিসটা নিতে পারিনি সেদিন, তাই—। তারা টোকেন নিয়ে মালটা দিয়ে দিল। জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা ছাতা আর একটা কোট। পুলিশের সাহায্যে ওই ছাতার বাঁট থেকে পাওয়া গেল একটা হাতের ছাপ, এবং আমি নিশ্চিত জানতাম অসীমবাবুর হাতের ছাপের সঙ্গে তার হুবহু মিল হবে। কোটটা অবশ্য অচিনবাবুর। মিসেস গুপ্তার কাছে একসময়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, গুপ্ত পরিবারের জামাকাপড় তৈরি হয় রিপন স্ট্রিটের ‘টিপটপে’। পুলিশের নাম করে ওখানে গিয়ে খোঁজ করতেই জানা গেল, কিছুদিন আগে অসীমবাবু ওভালোটিন কালারের একটা ট্যারালিনের সার্ট এখানে করিয়েছেন। এরপর যা ঘটেছে, তা আপনারা জানেনই।

শৈবাল বলল, কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য কি?

আমার মনে হয়, অর্থের অভাবে অচিনবাবু কলকাতায় এসে অসীমবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। অসীমবাবুর পুরো সম্পত্তি করায়ত্ত করার দুরন্ত লোভ ছিল। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলেন না। এখন তিনি দেখতে পেলেন সুবর্ণ সুযোগ তাঁর সামনে উপস্থিত। রগচটা ছোট ভাইটিকে হাতের মুঠোয় আনতে তাঁর খুব বেশি কষ্ট হল না। তিনি ভাইকে বোঝালেন, তার দুরবস্থার জনে দায়ী তাঁদের মৃত বড় ভাই। সে অবশ্য নাগালের বাইরে, তবে তার ছেলে রয়েছে। কেউটের বাচ্চা কখনো ঢোঁড়া হতে পারে না, কাজেই—রবীনবাবুকে তাঁর স্ত্রীর সম্বন্ধে বলে তিনি কাজ খানিকটা এগিয়েই রেখেছিলেন, এখন অচিনবাবুকে পরামর্শ দিলেন ভাইপোর কাছে চাকরি নিতে। দুর্ঘটনার আগের দিন দুই ভাই সিনেমা গেলেন। দুজনেই একটু রং—এ ছিলেন। তাই সিনেমা থেকে বেরুবার সময় টোকেন দিয়ে মাল ছাড়িয়ে আনার কথা মনে পড়ল না। দুজনে ফিরে এলেন অসীমবাবুর বাড়িতে। অসীমবাবুর নেশা কেটে গেল ক্রমে, কিন্তু অচিন চুর হয়ে ছিলেন। কোনো সময়ে মিসেস গুপ্তার ব্যাগ থেকে চুরি করে আনা চাবিটা তাঁর কাছেই ছিল। প্ল্যান মাফিক তিনি এবার কাজে নামলেন। একে প্রচণ্ড শীত, তায় অন্ধকার। পিছনের গলিতে লোক চলাচল ছিলই না। অসীমবাবু নিজের মত্ত ভাইটিকে নিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে এ—বাড়িতে এলেন। তাঁর নিশ্চয়ই জানা ছিল তখন বাড়িতে বলাই বা মিসেস গুপ্ত কেউই থাকবেন না। তারপর মদে চুর একজন লোককে হত্যা করতে তাঁর খুব অসুবিধা হয়নি। অবশ্য ওখান থেকে চলে আসার সময় পকেট থেকে টোকেনটা পড়ে যায় এবং দরজার হ্যান্ডেলে জামার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে রয়ে যায়। অচিনবাবুকে হত্যা করার উদ্দেশ্য হল রবীনবাবুকে ফাঁসানো।

কিভাবে?

অতি সহজেই! তাই জন্যেই অচিনবাবুকে আপনার কাছে চাকরি করতে পাঠানো হয়েছিল। এ—পাড়ার সকলেই অচিনবাবুর ব্যবহারে সন্দেহাকুল হয়ে পড়েছিলেন। স্বাভাবিক, একটা লোক যদি দিনের পর দিন ধরে কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সে—বাড়িতে যদি কোনো সুন্দরী মহিলা থাকেন, তাহলে সকলের মনেই একটা বিশেষ ধরনের প্রশ্ন উদয় হবেই। তাছাড়া ওয়াল্টেয়ারে খোঁজ করলেই জানা যাবে রবীনবাবু ওখানে নেই। কাজেই পুলিশ সহজেই তাঁকে এবং সম্ভব হলে তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করবে। এরপর হয় ফাঁসি, নয় দীর্ঘ মেয়াদের কারাবাস। তখন স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত সম্পত্তি অসীমবাবুর হাতে চলে আসবে।

শৈবাল বলল, তুমি মিসেস গুপ্তাকে দিয়ে কাকে যেন একটা চিঠি লিখিয়েছিলে—সেটা কি ব্যাপার?

মিসেস গুপ্তা অত্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওঁর ভয় ছিল এই গোলমালে শোভন রায় সংক্রান্ত ব্যাপারটা রবীনবাবু জেনে ফেলবেন। আমি তাঁকে বললাম, রবীনবাবুর কিচ্ছু অজানা নয়। আপনি বরং শোভন রায়কে জানিয়ে দিন আর আপনি তাঁকে ভয় করেন না।…আচ্ছা, মিস্টার গুপ্ত, আপনি হঠাৎ সে—সময় কলকাতায় এলেন কেন?

আসলে মেজকাকা যাই বলুন, তবু রাত্রিকে ঠিক সন্দেহ করতে পারছিলাম না। একজন লোক নিযুক্ত করেও মনে ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই সকলের অজান্তে নিজেই চলে এলাম সরজমিন তদন্ত করতে।

মৃদু হাসল বাসব। এখন নিশ্চয়ই সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই?

আমাকে আর লজ্জা দেবেন না মিস্টার ব্যানার্জি।

ঢং ঢং করে দশটা বাজল এই সময়ে।

বাসব আর শৈবাল উঠে দাঁড়াল।

মিসেস গুপ্তা দ্রুত কণ্ঠে বললেন, একি, উঠছেন! আপনার…

চেকটা না হয় কালই পাঠিয়ে দেবেন। আচ্ছা নমস্কার।

তারপর ওরা দুজন বিদায় নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *