ইন্দ্র ও শ্রুবাবতী
আশ্রমবাসিনী এক তপস্বিনী নারীর ধ্যাননিমীলিত নেত্র বার বার চমকে জেগে ওঠে। সে তপস্বিনীর নাম শ্রুবাবতী।
আশ্রমের সম্মুখে বনবীথিকা, সেই বনবীথিকার ছায়াময় শান্তিকে যেন চমকে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় কোন্ এক রহস্যের কুণ্ডলদ্যুতি! শ্রুবাবতীর মনে হয়, অন্তরীক্ষের বক্ষ হতে একটি জ্যোতির্ময় কৌতুহল ভূতলে এসে বনবীথিকার নীপ চম্পক ও নীলাশোকের ছায়ানিবিড় স্নিগ্ধতার বক্ষ অন্বেষণ ক’রে বেড়ায়।
ঋষি ভারদ্বাজ দুশ্চর এক তপশ্চর্যা গ্রহণ করবেন বলে হিমালয়ে চলে গিয়েছেন। আশ্রমকুটীরে একাকিনী বাস করে তাঁর তপস্বিনী কন্যা শ্রুবাবতী। পীতকৌশেয়বসনা ও একবেণীধরা শ্রুবাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গিয়েছেন পিতা ভারদ্বাজ। কঠোর ব্রহ্মব্রতযাপন ক’রে কুমারী শ্রুবাবতী তার কামনাময় মনোলোকের সকল কল্পনাকে ক্লিষ্ট করছে দেখে সুখী হয়েছেন ভারদ্বাজ। দেখে গিয়েছেন ভারদ্বাজ, প্রভাতকল্পা শর্বরীর মত সুন্দর যে-কুমারীর অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের উদ্ভাস ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, সেই কুমারী স্বেচ্ছায় পাংশুলিপ্তা স্বর্ণরেখার মত নিষ্প্রভ হয়ে আশ্রমের ছায়াতরুতলে পড়ে থাকে।
চলে গিয়েছেন ঋষি ভারদ্বাজ। অতন্দ্রিত সবিতা কালচক্রে ধাবিত হয়ে অনেক দিবা রাত্রি কলা ও কাষ্ঠা রচনা করেছেন। এবং তপস্বিনী শ্রুবাবতীও অনেক তপস্যা করেছে। ষড়ঋতুর রঙ্গে লীলায়িত বনস্থলীর বক্ষে অনেক বর্ণচ্ছটা ও অনেক সৌরভ এসেছে আর চলে গিয়েছে। তপস্বিনী শ্রুবাবতীর দুই চক্ষুর ধ্যান কোন মুহূর্তেও বিচলিত হয়নি।
কিন্তু কে জানে, কি ছিল সেদিনের সেই আলোকে অনিলে ও সলিলে? এক প্রভাতে তপস্বিনী শ্রুবাবতীর জাগ্রত চক্ষুর দৃষ্টিকে যেন ক্ষণবিহ্বলতায় নিবিড় ক’রে দিয়ে এবং সেই বিহ্বল দুই চক্ষুতে নূতন এক ধ্যানের আবেশ সঞ্চারিত ক’রে চলে গোল নয়নমোহন এক রহস্যের কুণ্ডলদ্যুতি। এই প্রভাতের মত কত প্রভাতে বনস্থলীর বক্ষের নিভৃতে কলনাদিনী তটিনীর সলিলে স্নান করেছে শ্রুবাবতী, এবং মুক্তাময় সিকতার অজস্র দ্যুতিচ্ছবি দুই পায়ের উপেক্ষায় পিষ্ট ক’রে আশ্রমের কুটীরে ফিরে এসেছে। সিকতার সেই মুক্তার দ্যুতি কোনদিন যার দুই চক্ষুর কৌতূহল চমকিত করতে পারেনি, তারই দুই চক্ষু দু’টি কুণ্ডলের দ্যুতি দেখে বিস্মিত হয়। কে ঐ পথিক, চমকিত চামীকরকিরণে রচিত কলেবর যেন যৌবনায়িত লাবণ্যের চলোচ্ছল ছবি বিচ্ছুরিত ক’রে চলে যায়? কোথা থেকে এল আর কোথায় চলে গেল সেই দীপ্তকান্ত রূপমান? মণিময় কুণ্ডলের দ্যুতির চেয়ে কত নয়নাভিরাম তার নয়নদীধিতি!
তপস্বিনী শ্রুবাবতী যেন তার হৃদয়ের বিচলিত নিঃশ্বাসের মধ্যে ঐ প্রশ্ন আর বিস্ময়ের ধ্বনি শুনতে পায়। নিজ করকঙ্কণের শব্দে শঙ্কিতা অভিসারিকার মত চমকে ওঠে আর লজ্জিত হয় শ্রুবাবতী। তপস্বিনীর জটায়িত বেণীভার যেন চূর্ণ হবার জন্য শিউরে উঠেছে। দ্রুত ছুটে চলে যায় শ্রুবাবতী। আশ্রমকুটীরের ছায়াচ্ছন্ন নিভৃতের ভিতরে এসেও কি-যেন অন্বেষণ করে শ্রুবাবতী। তপস্বিনী তার ক্ষণবিহ্বল নেত্রের এক ভয়ংকর উদ্ভ্রান্তিকে লুকিয়ে ফেলবার জন্য গভীরতর এক অন্ধকারের আশ্রয় চায়।
সুস্থির হয়ে ধ্যানাসনে উপবেশন ক’রে তপস্বিনী শ্রুবাবতী। কিন্তু বুঝতে পারে, আজিকার প্রভাতের আলোক তপস্বিনীর দুই চক্ষুর উপর অতি কঠোর এক নিষ্ঠুরতার সাধ সফল ক’রে নিয়েছে। শ্রুবাবতীর নয়নপ্রান্ত হতে তপ্ত মুক্তাফলের মত দু’টি অশ্রু বিন্দু স্খলিত হয়, ধ্যানহারা তপস্বিনীর কৌশেয় বসনের প্রান্ত সিক্ত ক’রে তোলে।
সত্যই তপস্বিনীর নেত্রে নূতন এক স্বপ্নের আবেশ সঞ্চারিত হয়। দু’টি কুণ্ডলদ্যুতি স্বপ্ন। ভুলতে পারে না শ্রুবাবতী, এবং নিজের হৃদয়ের বিরুদ্ধেও আর বৃথা সংগ্রাম করে না। কে সে? কেন এল, কোথা হতে এল, আর কোথায় চলে গেল? সে পুরুষের দুই নেত্রে যেন অন্তরীক্ষের সকল নীলিমার পীযূষ নিবিড় হয়ে রয়েছে। কে জানে, ধূলিময় এই মর্ত্যলোকের কোন্ শ্যামলতার জন্য পিপাসা নিয়ে বনবীথিকার ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়ায় সেই বিপুল রূপের পুরুষ!
পীতকৌশেয় বসনে আবৃত এক প্রেমিকার কামনা যেন প্রতিক্ষণ তপস্যা করে। বিশ্বাস করে শ্রুবাবতী, তার এই নূতন তপস্যা ব্যর্থ হবে না। আশ্রমের তরুলতা ও পুষ্পের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় শ্রুবাবতী, মর্ত্যলোকের কামনাগুলি যেন এক সুন্দর দায়িতকে জীবনে অভ্যর্থনা করবার জন্য প্রতিক্ষণ তপস্যা করছে। মনে হয়, তৃষ্ণার্ত ধূলিকণিকা অন্তরের সকল কামনা দিয়ে আহ্বান করছে বলেই আকাশচর জলদ ধারা-বিগলিত আবেগে ভূতলে এসে স্নেহ লুটিয়ে দেয়। লতিকার আহ্বান শোনে দক্ষিণসমীর, কিশলয়ের আহ্বান শোনে প্রভাতমিহির। মর্ত্যের পুষ্প লতিকা আর কিশলয়ের মত নীরব তপস্যায় এক মর্ত্যনারীর কামনা যদি অহরহ তার জীবনপ্রিয় দয়িতকে আহ্বান ক’রে, তবে সে কি না এসে থাকতে পারে? নিমীলিত নেত্রে নিবিড় স্বপ্নের আবেশ ভরে দিয়ে সে হৃদয়দয়িতের কুণ্ডলদ্যুতিকে হৃদয়ের মধ্যে দেখতে পায় শ্রুবাবতী।
বুঝি সফল হবে আশ্রমবাসিনী এক মর্ত্যনারীর কামনার তপস্যা। ধ্যাননিমীলিত চক্ষু হঠাৎ চমকে জেগে ওঠে এবং মনে হয় শ্রুবাবতীর, সেই কুণ্ডলদ্যুতি যেন নিকটে এসে দাঁড়িয়েছিল। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকে শ্রুবাবতী, আশ্রম-প্রাণের প্রান্ত পার হয়ে ছায়াচ্ছন্ন বনবীথিকার নীরব পবনের বক্ষে মৃদুপুলকিত পদধ্বনির সঙ্গীত উপহার দিয়ে চলে গেল এক অধ্বনীন। শ্রুবাবতী তার স্বপ্নভারালস দুই নিমীলিত চক্ষুর দুর্ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে আশ্রমপ্রাঙ্গণের বাহিরে এসে দাঁড়ায়। বনবীথিকার দিকে দুই জাগ্রত চক্ষুর তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
ষড়ঋতুর রঙ্গে লীলায়িত বনস্থলীর মত পীতকৌশেয়বসনা প্রেমিকা শ্রুবাবতীরও অন্তরলোকে বিচিত্র বাসনার উৎসব লীলায়িত হয়। পাটল কুসুমের গন্ধভার তপ্ত ক’রে নিয়ে গ্রীষ্মের সঞ্চার দেখা দেয়। পরুষ পবনবেগে বনস্থলীর শুষ্ক পত্ররাশি উৎক্ষিপ্ত হয়ে কাতর উচ্ছ্বাস ছড়ায়। শুষ্ক বেণুবনে যেন জ্বালাবিমথিত পঞ্জরের ক্রন্দন বাজে। মধ্যাহ্নের নিদাঘার্ত বনবীথিকার বক্ষ হতে উৎসারিত ক্ষিপ্ত ধূলির মত্ততার দিকে দুই অপলক নয়নের উত্তপ্ত আগ্রহ প্রসারিত ক’রে তাকিয়ে থাকে শ্রুবাবতী। দেখতে পায় শ্রুবাবতী, সেই রূপবানের কুন্ডলের দ্যুতি অদূরের এক উদ্দালকের ছায়ার স্নেহ আহরণ করছে। শ্ৰবাবতীর মন বলে, কাছে এস পথিক, তপস্বিনীর জটায়িত বেণীভার এখনি বিগলিত হয়ে বিপুল চিকুরচ্ছায়া ছড়িয়ে দেবে। সে ছায়ার সব শীতলতা আর স্নেহ গ্রহণ ক’রে সুখী হও তুমি।
প্রাবৃষার মেঘারাবে চাতকীর হর্ষ ধ্বনিত হয় আকাশে, আর শ্রুবাবতী তেমনি আশ্রমপ্রাঙ্গণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, পুলকাঙ্কুরে সঙ্কুলতনু ভূকদম্বের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শ্রুবাবতীর তপস্যার আকাঙ্ক্ষিত সেই পথিক। নববারিস্নানে বনভূমির বক্ষের তৃণাঙ্কুর বৈদূর্যমণির মত ফুটে ওঠে; জেগে ওঠে মদূলকণ্ঠ ময়ূরের কেকা। শ্রুবাবতীর জটায়িত বেণীভারের উপর ঝরে পড়ে সিক্ত স্নিগ্ধ অর্জুনের মঞ্জরী। দ্বিধা ক’রে না, বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ ক’রে না, তপস্বিনী অবাধ আগ্রহে বাহু প্রসারিত ক’রে তুলে নেয় সেই মঞ্জরী। ইচ্ছা করে, স্নিগ্ধ অর্জুনের এই মঞ্জরীকে কর্ণভূষণ ক’রে নিয়ে এই মুহূর্তে এই তপস্বিনীর বেশ মিথ্যা ক’রে দিতে এবং ছুটে চলে যেতে তারই কাছে, যে প্রিয়দর্শনের কুণ্ডলদ্যুতি এখন ঐ ভূকদম্বের ছায়ার নিবিড়তার মধ্যে ফুটে রয়েছে। কিন্তু পারে না শ্রুবাবতী, আশ্রমের পুষ্প লতিকা ও কিশলয়ের মত মর্ত্যনারীর কামনাও যেন শুধু নীরবে তাকিয়ে বাঞ্ছিতকে আহ্বান করে, তুমি কাছে এসে এই সিক্ত অর্জুনের মঞ্জরী নিজ হাতে তুলে নিয়ে তাপসিকার দুই কানে দুলিয়ে দিয়ে যাও পথিক।
শারদ নভঃপটের অভ্রমালায় ও ভূতলের নবকাশবনের বক্ষে অমলধবল উৎসবের হর্ষ জাগে। অনিলপ্রকম্পিত বনান্তের সপ্তপর্ণ, কাননের কোবিদার ও উপবনের কুরুবকের যৌবন উল্লসিত হয়। নিবিড়তর হয়ে ফুটে ওঠে নীলোৎপলের নীলিমা আর বন্ধুজীবের রক্তিমা। সরোবরতটের হংসরুতানুনাদ আর শালিধান্যের সৌরভে বিচলিত ক্ষিতিরসরভস বায়ু প্রেমতাপসিকা শ্রুবাবতীর অন্তরে যেন সুধ্বনিময় সঙ্গীতের মুখরতা ও নিবিড় সৌগন্ধ্যের আবেশ বর্ষণ করে। দেখতে পায় শ্রুবাবতী, সেই পথিকের কুণ্ডলদ্যুতি নিকটতর হয়েছে। কোবিদার তরুর কম্পিত পল্লবের চঞ্চল ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পথিক। শ্রুবাবতীর মন বলে, কাছে এসে অনুভব ক’রে যাও পথিক, তোমারই জন্য কি দুঃসহ চঞ্চলতা সহ্য করছে ধ্যানহারা ধ্যানিনীর বক্ষের অনিল!
তপস্বিনীর কোমল কপোল নবস্ফুট লোধ্রের রেণু ছড়িয়ে দেয় হেমন্তের কৌতুকসমীর। শিশিরস্নেহে শিহরিত অঙ্গ নিয়ে মৃগাঙ্গনা বনপথে ছুটে চলে যায়। প্রিয়ঙ্গুলতিকার দেহে পাণ্ডুর অভিমান শিহরিত হয়। ক্রৌঞ্চনাদে হৃদয় চমকিত হলেও তপস্বিনী শ্রুবাবতীর অপলক নয়নের দৃষ্টি তেমনি অবিচলিত আগ্রহ নিয়ে বনবীথিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। এসেছে, আরও নিকট হয়ে এসেছে শ্রুবাবতীর সকল ক্ষণের আশার বাঞ্ছিত সেই পথিকের মুর্তি। বনবীথিকার যে কিংশুকের রক্তিমা শিখা হয়ে জ্বলছে, সেই কিংশুকের কাছে জ্বলছে সেই কুণ্ডলদ্যুতি। তপস্বিনীর কোমল কপোলে লোধ্ররেণুর চুম্বন লিপ্ত হয়ে থাকে। রেণুময় সে চুম্বনের চিহ্ন মুছে ফেলতে চায় না, পারেও না শ্রুবাবতী। শ্রুবাবতীর মন বলে, কাছে এসে জেনে যাও পথিক, তপশ্চারিণীর কপোলের এই রেণুময় চিহ্ন চকিত চুম্বনে মুছে দেবার অধিকার শুধু তোমারই অধরের আছে।
হিমকন্টকিত শীতবায়ুর নখরে আহত বনবীথিকার শাখী শ্যামপল্লবের সমারোহ হারিয়ে রিক্ত হয়; কিন্তু রিক্ত হয় না তপস্বিনীর নয়নের কৌতুহল। ইক্ষুবনের সৌরভ বক্ষে ধারণ ক’রে অকস্মাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে অলস শীতানিল, আর তপস্বিনী শ্রুবাবতীর নয়নও চঞ্চল হয়ে শুধু লক্ষ্য করে, সেই পথিকের কুণ্ডলদ্যুতি আশ্রমপ্রান্তের সন্নিকটে নক্তমালকুঞ্জের ছায়াবিরল নিভৃতের কাছে এসে স্থির হয়ে রয়েছে। তপস্বিনীর পীতকৌশেয় বসনের অঞ্চল যেন নিজেরই শিথিলিত লজ্জার শিহর সহ্য করতে গিয়ে আরও বিবশ ও বিচলিত হয়। শ্রুবাবতীর মন বলে, কাছে এসে সুখী হও পথিক। ছিন্ন কর তপস্বিনীর এই পীতকৌশেয় আবরণের শাসন। রিক্ত হিমবায়ুর স্পৃহা মিথ্যা ক’রে দিয়ে তোমার তপ্ত ও মত্ত দুই বাহুর কামনা খরায়িত ক’রে নখবিলিখনে আলিম্পিত কর তোমারই প্রণয় কামিনী এই তাপসিকার বিবশ তনু
আশ্রমপ্রাঙ্গণের নীলাশোকের আশা পল্লবিত ক’রে দেখা দিল পিকরবমুখর বসন্তের দিন। তাম্রপ্রবালের ভারে বিনম্র আম্রদ্রুমবাহু যেন আগ্রহভরে নিখিলের ভৃঙ্গগুঞ্জরন আর বিহঙ্গরবের মধুরতাকে আপন ক’রে নেবার জন্য বুকের কাছে পেতে চাইছে। দেখতে পায় শ্রুবাবতী, তার জাগ্রত নয়নের তপস্যার বাঞ্ছিত সেই পথিক সত্যই স্মিতহাস্যের সুষমায় বসন্তদিনের সব সুন্দরতাকে মধুর ক’রে দিয়ে চক্ষুর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
আগন্তুকের কুণ্ডলদ্যুতির হাস্য আরও প্রখর হয়ে ওঠে।—ঐ পীতকৌশেয় বসন আর জটায়িত বেণীভারের বন্ধনে জীবন ও যৌবন ব্যথিত ক’রে কোন্ সুখের জন্য তপস্যা করছ, ভারদ্বাজতনয়া?
শ্রুবাবতী বলে—এই পীতকৌশেয় বসন আর জটায়িত বেণীভার আপনারই প্রেমাভিলাষিণী এক নারীর দেহ মন ও প্রাণের কামনাকে গোপন ক’রে রেখেছে, মিথ্যা তপস্বিনীর মিথ্যা ক্লেশ বেশ ও কৃচ্ছ্র ক্ষমা করুন, অনঘ।
আগন্তুকের নয়নের বিস্ময় কৌতুকে দীপ্ত হয়ে ওঠে।—তুমি আমার প্রেমাভিলাষিণী?
শ্রুবাবতী—হ্যাঁ, প্রিয় অতিথি।
আগন্তুক—তুমি জান আমার পরিচয়?
শ্রুবাবতী—জানি না, জানবার সৌভাগ্য হয়নি কখনও, জানতে ইচ্ছাও করি না ধীমান্। শুধু জানি, তপস্বিনী শ্রুবাবতীর নয়ন হতে তার সকল ধ্যান কেড়ে নিয়ে সে-নয়নে এক বিপুলমধুর স্বপ্নের আবেশ সঞ্চারিত করেছে যে প্রিয় মূর্তি, সে-মূর্তি আপনারই মূর্তি। ব্রহ্মব্ৰতিনীর ভুল তপস্যায় তামসিক হৃদয়ের মিথ্যাকে মিথ্যা ক’রে দিয়ে আপনারই কুণ্ডলদ্যুতি আশ্রমবাসিনী শ্রুবাবতীর নয়নের স্বপ্নকে জ্যোৎস্নায়িত করেছে। তপস্বিনীকে করেছে প্রেমিকা।
আগন্তুক—ভুল বুঝেছ আশ্রমবাসিনী নারী, তোমার সাত্ত্বিক বা তামসিক, সত্য অথবা মিথ্যা, কোন তপস্যাকেই মিথ্যা ক’রে দেবার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না।
শ্রুবাবতী—আমার ভুল বুঝতে পারছি না, মহাভাগ। আপনি বলুন, আপনার মণিময় কুণ্ডলের দ্যুতি এই বনবীথিকার ছায়ায় ছায়ায় এতদিন ধ’রে কোন্ লতিকার শ্যামলতা আর সিগ্ধতা সন্ধান ক’রে ফিরেছে।
আগন্তুক—এই মর্ত্যের কোন শ্যামলতা আর স্নিগ্ধতার জন্য আমার বক্ষে ও নয়নে কোন তৃষ্ণা নেই, ঋষিকুমারী। শুধু আছে কৌতূহল।
শ্রুবাবতী—এ কেমন কৌতুহল?
আগন্তুক—শুধু কৌতূহল। মর্ত্যের এক আশ্রমবাসিনী নারী কার জন্য অথবা কিসের জন্য তপস্যা করে, শুধু এই একটি কৌতূহলের তৃপ্তির জন্য ঋষি ভারদ্বাজের আশ্রমের দিকে তাকিয়ে দেখেছে সুরপতি ইন্দ্রের চক্ষু।
চমকে ওঠে শ্রুবাবতীর দুই চক্ষুর বিস্ময়। আপনি সুপতি ইন্দ্র?
হেসে ওঠে ইন্দ্র। হ্যাঁ শ্রুবাবতী, স্বর্গাধীশ বাসবের নয়ন শুধু এইটুকু জানতে চায়, এই মর্ত্যের কোন্ তপস্বী আর কোন্ তপস্বিনীর ধ্যানে স্বর্গবাসনা আছে।
শ্রুবাবতী—তপস্বিনীরূপিণী শ্ৰবাবতীর নয়নে আর কোন ধ্যান নেই, শুধু আছে একটি স্বপ্ন এবং সে-স্বপ্নে বিন্দুমাত্র স্বর্গবাসনা নেই বাসব।
ইন্দ্রের দুই নয়নের কৌতূহল যেন ক্ষীণ বিদ্রূপের বিদ্যুতের মত শিহরিত হয়ে মর্ত্যনারীর এই মধুরভণিত অহংকারের ভুল ধরিয়ে দিতে চায়। ইন্দ্র বলেন—স্বর্গ চাও না, কিন্তু স্বর্গপতি বাসবের প্রণয় লাভের বাসনায় স্বপ্নায়িত ক’রে রেখেছ জীবন ও যৌবনের কামনা, কী অদ্ভুত তোমার স্বপ্ন শ্রুবাবতী!
শ্রুবাবতী—আশ্রমবাসিনী মর্ত্যনারীর স্বপ্নকে আপনি ভুল বুঝেছেন স্বর্গাধীশ। স্বৰ্গকে নয়, স্বর্গাধীশ ইন্দ্রকেও নয়, এই মর্ত্যেরই বনবীথিকাচারী এক সুন্দর পথিকের যৌবনবিমোহিত তনুশোভাকে ভালবেসেছে শ্রুবাবতী, উপবনের মাধবী যেমন নয়ন-নিকটের সহকারতরুর তরুণতনুর শোভাকে ভালবাসে। স্বৰ্গকে চাইনি, স্বর্গপতিকেও চাইনি। কোন দিনের কোন মুহূর্তে মনে হয়নি, বনতরুর ছায়ায় ছায়ায় যার কুণ্ডলদ্যুতি অপার্থিব এক জ্যোৎস্নায় হর্ষ সঞ্চার ক’রে ঘুরে বেড়ায়, সে হলো অমরলোকের বৃন্দারকবন্দিত বাসব। আমার নয়নের প্রতীক্ষা শুধু তাকেই চেয়েছে, যে আমার নয়নে এনে দিয়েছে প্রথম বিস্ময়, প্রথম মুগ্ধতা, অনুরাগে রঞ্জিত প্রথম ক্ষণবিহ্বলতা। বনবীথিকার এক পথিক আমার নয়নবীথির পথিক হয়েছে। সে পথিকেরই জন্য আশ্রমবাসিনী নারী এতদিন প্রতীক্ষার তপস্যা করেছে।
ইন্দ্র—এমন প্রতীক্ষার কোন অর্থ হয় না, শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—আমার প্রতীক্ষা সার্থক হয়েছে, বাসব।
ইন্দ্র—কি বলতে চাও, ঠিক বুঝতে পারছি না।
শ্রুবাবতী—মর্ত্যনারী আমি, ষড়ঋতুর রঙ্গে লীলায়িত এই মর্ত্যের সকল পুষ্প ও কিশলয়ের কামনার মত আমারও কামনা প্রতিক্ষণ প্রতীক্ষায় তপস্যা করেছে। এবং সে প্রতীক্ষা সফলও হয়েছে। আমার জীবনের নিদাঘের নিঃশ্বাস আজ মধুময় বসন্তের সৌরভকে কাছে পেয়েছে। এসেছেন আপনি, মর্ত্যনারীর প্রতীক্ষাকে আপনি তুচ্ছ করতে পারেননি, স্বর্গাধীশ।
ইন্দ্র—স্বর্গাধীশ বাসবের চক্ষু কোন মুগ্ধতা নিয়ে তোমার সম্মুখে আসেনি, শ্রুবাবতী। তোমার প্রতীক্ষার টানে নয়; আমি এসেছি আমার কৌতূহলের তৃপ্তির জন্য।
নিদাঘতাপিতা বনলতিকার মত ব্যথিতভাবে শুধু নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রুবাবতী। ইন্দ্র বলেন—মর্ত্যের প্রতীক্ষার টানে স্বর্গ কাছে নেমে আসে না, ঋষিকুমারী। এমন দুরাশার ভুল বর্জন কর, ভারদ্বাজতনয়া।
তেমনই নীরব হয়ে, যেন এই মিথ্যা দুরাশার লজ্জা সহ্য করবার জন্য নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রুবাবতী।
ইন্দ্র বলেন—স্বর্গপতি ইন্দ্রের কাছে প্রেম আশা করো না, মর্ত্যবাসিনী সুন্দরী মানবী। যদি ইচ্ছা থাকে, তবে আশা করো ইন্দ্রের অনুগ্রহ।
শ্রুবাবতী মুখ তুলে তাকায়—অনুগ্রহ?
ইন্দ্র—হ্যাঁ ঋষিতনয়া, স্বর্গ শুধু এই মর্ত্যকে করুণা করতে পারে, অনুগ্রহ করতে পারে, বর দান করতে পারে। তার বেশি কিছু পারে না। তার বেশি কিছু চাইবার অধিকারও এই মতের কোন প্রেম প্রণয় ও কামনার নেই।
শ্রুবাবতী—আশ্রমবাসিনী এই মর্ত্যনারীর জীবনকে কিসের অনুগ্রহ করতে চান বাসব?
ইন্দ্র—যদি স্বর্গলোকে স্থিতি লাভের বাসনা থাকে, তবে তারই জন্য তপস্যা কর ভারদ্বাজতনয়া। যথাকালে এবং তপস্যার অন্তে তুমি স্বর্গলোকে স্থিতিলাভ করবে, দেবরাজ ইন্দ্রের এই অনুগ্রহের বাণী শুনে এখন প্রীত হও, শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—আপনার অনুগ্রহের বাণী শুনে প্রীত হয়েছি বাসব কিন্তু আমার জীবনের কামনা আপনার এই অনুগ্রহ চায় না।
ইন্দ্রের মনের বিস্ময় ভ্রূকুটি হয়ে ফুটে ওঠে—কি তোমার জীবনের কামনা?
শ্রুবাবতী—আশ্রমবাসিনী এই মর্ত্যনারীর দুই নয়নের সকল আগ্রহ ধন্য ক’রে দিয়ে এই নীলাশোকের ছায়ার কাছে আপনি আর একবার এসে দাঁড়াবেন, আর ভারদ্বাজতনয়া শ্রুবাবতী এই মিথ্যা তপস্বিনীর মূর্তি মুছে দিয়ে মধুবাসরিকা বধূর মত দয়িতের বক্ষ বরণ করবার জন্য আপনার সম্মুখে এসে দাঁড়াবে।
ইন্দ্র—ধন্য তোমার কামনার দুঃসাহস। কিন্তু শুনে রাখ দুরাশার নারী, মর্ত্যের আদেশ পালন করবার জন্য স্বর্গের মনে কোন আগ্রহ নেই।
অশ্রুসজল হয়ে ওঠে শ্রুবাবতীর চক্ষু।—আদেশ নয় বাসব, মর্ত্যের প্রেম আশ্রমবাসিনী এই নারীর হৃদয়ে পূজা হয়ে ফুটে উঠেছে; এই ইচ্ছা পূজাচারিণীর হৃদয়ের ইচ্ছা।
ইন্দ্র—স্বর্গের কাছে যেতে চাও না, অথচ স্বৰ্গকে কাছে আনতে চাও, বিচিত্র এই পূজা পূজা নয় শ্রুবাবতী। স্বর্গের অপমান।
শ্রুবাবতী—স্বর্গের অপমান নয় বাসব, এই পূজা হলো পরাপূজা।
ইন্দ্র—সে কেমন পূজা?
শ্রুবাবতী—অমৃতত্ববিহীন মর্ত্যনারী আমি, ক্ষণকালের মধুরতাকে অনন্ত ক’রে রাখি, চিরবিরহের বেদনাতে চিরমিলনের স্বাদ পাই, ক্ষণিক শুভদর্শনের জন্য মরজীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত প্রতীক্ষা করি। আমার পরাপুজা বিরাজমানকে সতত আহ্বান করে, স্বচ্ছকে পাদ্য অর্ঘ্য দান করে, নির্মলকে স্নান করায়, রম্যকে আভরণ দেয়, নিত্যতৃপ্তকে নৈবেদ্য দেয় অনন্তকে, প্রদক্ষিণ করে, বেদাধারকে স্তোত্রে বন্দনা করে, স্বপ্রকাশকে নীরাজন ক’রে সুখী হয়। বুকের কাছে পাওয়ার জন্যই মর্ত্যের প্রাণ স্বর্গকে মাটি মাখিয়ে একটু ছোট ক’রে নেয় স্বর্গপতি। শ্রুবাবতীর প্রেমও স্বর্গপতি বাসবকে এই ধূলিময় ভূতলের তরুচ্ছায়ার কাছে প্রিয় অতিথির মত নয়নের সম্মুখে দেখতে চায়।
ইন্দ্র—তা হয় না শ্রুবাবতী। তুমি তোমার এই প্রেমাভিলাষ বর্জন কর। স্বর্গপতির জীবনের কোনক্ষণের কৌতূহল ভুলেও প্রেমাভিলাষ হয়ে তোমার আশ্রমের নীলশোকের ছায়ার কাছে কোনদিন ফিরে এসে দাঁড়াবে না।
শ্রুবাবতী—কিন্তু আমি প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকব, বাসব।
কপট তপস্বিনীর জটায়িত বেণীভার নৃতন এই প্রতিজ্ঞার আবেগে শিউরে উঠেছে। দেখে বিস্মিত ও বিরক্ত হন ইন্দ্র। স্বর্গপতির অধরে অবিশ্বাসের মৃদু বিদ্রূপের রেখা হেসে ওঠে।—কতকাল প্রতীক্ষা করবে, মরজীবনের নারী?
শ্রুবাবতী বলে—এই মরজীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
চলে গেলেন বাসব, নীলাশোকের ছায়া তেমনি সুস্থির হয়ে ভূতলে লুটিয়ে পড়ে থাকে।
কালচক্রে ধাবিত হয়ে অতন্দ্রিত সবিতা দিবা রাত্রি কলা ও কাষ্ঠা রচনা করেন এবং স্বর্গাধীশ বাসব একদিন তাঁর নিজেরই অন্তরের ভিতরে এক কৌতূহলের ধ্বনি শুনে চমকে ওঠেন ও বিস্মিত হন। মর্ত্যের এক আশ্রমবাসিনী নারী নীলাশোকের ছায়ার কাছে এখনও কি স্বর্গাধীশ বাসবের পদধ্বনি শুনবার জন্য প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে? অসম্ভব, বিশ্বাস হয় না বাসবের, এবং এই মিথ্যা কৌতূহলের বিরুদ্ধে ভ্রূকুটি হেনে আশ্বস্ত হতে চেষ্টা করেন বাসব। মনে হয়, মৃত্তিকাময় জগতের সে-নারীর প্রেম ও প্রতীক্ষা বনব্রততীর ক্ষণপুষ্পিত শোভার মত সেই বসন্তেরই চৈত্রশেষের সমীরিত হাহাকারে শেষ হয়ে গিয়েছে। শুধু প্রতীক্ষার জন্য প্রতীক্ষা, আশ্রমবাসিনী নারীর এত বড় অহংকারের ঘোষণা নিজেরই মিথ্যায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
শুধু জানতে ইচ্ছা করে বাসবের, মধুরপ্রলাপিনী পরভৃতার মত কলভাষিণী সেই মানবীর প্রেম নতন সঙ্গীত হয়ে আজিকার এই নবসন্তের প্রভাতে সেই নীলাশোকের ছায়ার কাছে কোন্ নূতন অতিথিকে বন্দনা করে? বনস্থলীর নিভৃতে পদ্মরাগে অরুণিত তটিনীতটের সরণিতে সে যৌবনবতীর অভিসার আজ অলক্তের চিহ্ন অঙ্কিত ক’রে কোন্ নূতন দয়িতের আলিঙ্গন লাভের জন্য ছুটে চলে যায়? বনসরসীর মুকুরায়িত সলিলের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে, লোধ্ররেণুলিপ্ত কোমল কপোলর উপর কোন্ প্রমিকের দশনদানে রচিত চুম্বন-ক্ষতচ্ছবি দেখে হেসে ওঠে নারী? কৌতুহল, বড় তীব্র কৌতূহল, স্বর্গাধীশ বাসবের নয়ন যেন দূর মর্ত্যলোকের এক বনবীথিকার দিকে তাকাবার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আর বিলম্ব করেন না বাসব। স্বর্গপতির স্যন্দননেমির হর্ষ মত্ত আবেগে ছুটে চলে এবং সেই বনবীথিকার নিকটে এসে শান্ত হয়। দেখতে পান বাসব, দূরান্তের সেই আশ্রমের প্রাঙ্গণে সেই নীলাশোকের কাছে ছায়াময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অচঞ্চলা তপস্বিনীর রিক্তা ও নিরাভরণা মূর্তি।
বিস্মিত হন বাসব। সত্যই যে জীবনের প্রথম নয়নবিহ্বলতায় বন্দিত বনবীথিকাচারী এক পথিকের প্রেমের জন্য অফুরান প্রতীক্ষা সহ্য করছে শ্রুবাবতী! সত্যই কি স্বর্গের জন্য কোন আকাঙ্ক্ষা নেই শ্রুবাবতীর মনে?
সুরপতি ইন্দ্রের কৌতুহল তাঁর এই চঞ্চলিত চিত্তের সব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। ভারদ্বাজতনয়া শ্রুবাবতীর প্রেম ও প্রতীক্ষার নিষ্ঠাকে একটি সুন্দর ছলনা দিয়ে পরীক্ষা করবার জন্য প্রস্তুত হন ইন্দ্র। লুকিয়ে ফেলেন দ্যুতিময় কুণ্ডলের মণি। বনবাসী ঋষিযুবার ছদ্মবেশ ধারণ করেন ইন্দ্র।
ধীরে ধীরে ছায়াচ্ছন্ন বনবীথিকার স্নিগ্ধতার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন ইন্দ্র। সুন্দরদর্শন এক ঋষিযুবা। তার কণ্ঠে যজ্ঞোপবীত, ললাটে ভস্ম- ত্রিপুণ্ড্রক, মস্তকে জটাভার, কর্ণে স্ফটিকমালা, হতে আষাঢ়দণ্ড ও স্কন্ধে কৃষ্ণাজিন। যেন এই বনলোকের এক পিপাসিত তপস্যার মূর্তি দূরান্তের আশ্রম-প্রাঙ্গণের এক নীলাশোকের ছায়ার দিকে তৃষ্ণার্ত দুই চক্ষুর কৌতূহল উৎসারিত ক’রে এগিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু চমকে ওঠে না নীলাশোকের ছায়া। পীতকৌশেয়বসনা তপস্বিনীর জটায়িত বেণীভারে কোন বিস্ময়ের শিহরন জাগে না। আগন্তুক ঋষিবার মুখের দিকে নিষ্কম্প শান্ত দৃষ্টি তুলে নীরবে সম্মান জ্ঞাপন করে শ্রুবাবতী।
ঋষিযুবা বলে—আমি তপস্বী বশিষ্ঠ।
শ্রুবাবতী—আমি ভারদ্বাজতনয়া শ্রুবাবতী।
বশিষ্ঠ—আমি তোমার আশ্রমের অতিথি শ্রুবাবতী; অতিথির প্রাপ্য সকল সমাদর আমি তোমার কাছে আশা করি আশ্রমবাসিনী।
শ্রুবাবতী—অতিথির প্রাপ্য সকল সমাদর আবশ্যই পাবেন ঋষি।
তরুণ বশিষ্ঠের নয়নের হর্ষ অকস্মাৎ এক নিবিড়মদির আবেদনে মন্থর হয়ে ওঠে। তাপিত বনমৃগের মত ব্যাকুল হয়ে নীলাশোকের ছায়ার আরও নিকটে এগিয়ে আসেন বশিষ্ঠ। প্রণয়োচ্ছল স্বরে আহ্বান করেন বশিষ্ঠ—শ্রুবাবতী!
শ্রুবাবতী—আদেশ করুন ঋষি।
বশিষ্ঠ—শুধু অতিথির প্রাপ্য সমাদর নয়, আশ্বাস দাও শ্রুবাবতী, তোমার সমাদরে অতিথির সকল আশা তৃপ্ত হবে।
শ্রুবাবতী—ক্ষমা করুন ঋষি, ভারদ্বাজতনয়ার কাছে এমন আশ্বাস আশা করবেন না।
বশিষ্ঠ—আমার সকল পুণ্য তুমি গ্রহণ কর শ্রুবাবতী, বিনিময়ে শুধু আশ্বাস দাও, তুমি আমার জীবনের সকল আনন্দের সহচরী হবে।
শ্রুবাবতী—ক্ষমা করুন পুণ্যবান, বৃথা এমন ভয়ংকর অনুরোধ ক’রে আশ্রমবাসিনী নারীর হৃদয়ের শান্তি ব্যথিত করবেন না।
বশিষ্ঠ—অকারণে ব্যথিত হয়ো না, শ্রুবাবতী। বশিষ্ঠের প্রিয়া হয়ে, বশিষ্ঠের পুণ্যে পুণ্যবতী হয়ে স্বর্গলোকে গিয়ে চিরসুখের জীবনে স্থিতি লাভ কর। আমার তৃপ্তি তোমারই মুক্তি হয়ে উঠবে শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—আমার মনে স্বর্গের জন্য কোন লোভ, কোন উল্লাস আর কোন ক্রন্দন নেই।
বশিষ্ঠ—স্বর্গের জন্য লোভ না হোক, মুক্তকণ্ঠে বল দেখি সুধাহীনা এই বসুধার নারী, তোমার হৃদয়ে আর প্রদোষমুদিতা কুমুদ্বতীর মত তোমার ঐ কুণ্ঠাসুন্দর যৌবনকলিকার শোণিতে প্রণয়বিহ্বল পুরুষের প্রেমের জন্য কোন লোভ নেই?
শ্রুবাবতী—আছে ঋষি, পীতকৌশেয়বসনা তপস্বিনী শ্রুবাবতীর নয়ন হতে সব ধ্যান কেড়ে নিয়ে সে-নয়নে প্রণয়স্মিত স্বপ্ন ভরে দিয়েছে যে পুরুষ, শুধু তারই প্রেমের জন্য লুব্ধ হয়ে আছি।
বশিষ্ঠ—কে সে?
শ্রুবাবতী—বাসব।
কপট বশিষ্ঠের নয়নে যেন অস্ফুট অথচ দুঃসহ এক বিশ্বাসের বিস্ময় চমকে ওঠে এবং ধীরে ধীরে প্রখর নয়নের কৌতূহল শান্ত ও নম্র হয়ে যায়। প্রশ্ন করেন বশিষ্ঠ— বাসবকে ভালবেসেছ তুমি, মর্ত্যনারী?
শ্রুবাবতী—হ্যাঁ ঋষি।
বশিষ্ঠ—কিসের জন্য?
শ্রুবাবতী—ভালবাসার জন্য।
বশিষ্ঠ— কিন্তু তুমি কি সত্যই বিশ্বাস কর শ্রুবাবতী, স্বর্গাধীশ বাসব কখনও ধূলিময় মতের কুটীরে এসে এক ঋষিতনয়ার প্রেমের প্রতিদানে প্রেম নিবেদন করবেন?
শ্রুবাবতী—মনারীর জীবনে এত বড় বিশ্বাসের কিবা প্রয়োজন ঋষি? মর্ত্যের প্রাণ শুধু ভালবাসার জন্যই ভালবাসতে জানে। জানি না, স্বর্গের প্রাণ কেন আর কেমন ক’রে ভালবাসে।
বশিষ্ঠ—স্বর্গের প্রাণ ভালবেসে শুধু সুখী হয়, আর সুখের জন্য ভালবাসে।
শ্রুবাবতী—মর্ত্যের প্রাণ ভালবেসে বেদনা পায়, তবু ভালবাসে।
কপট বশিষ্ঠের দুই চক্ষু যেন আবার এই মর্ত্যপ্রেমের অহংকারের আঘাতে কঠোর হয়ে ওঠে। আরও কঠোর এক পরীক্ষার ইচ্ছা কপট বশিষ্ঠের দুই চক্ষুর দৃষ্টিতে চঞ্চল হয়ে ওঠে। মতানারীর এই প্রেমের অহংকারকে আর একটি কঠিন ছলনার আঘাতে চূর্ণ ক’রে দিয়ে, তারপর সহাস্য করুণা আর সান্ত্বনা দিয়ে প্রেমিকা মর্ত্যনারীকে প্রীত ক’রে আর ধন্য ক’রে স্বর্গধামে চলে যাবেন স্বর্গাধীশ।
ক্ষুব্ধ তরঙ্গের মত ফেনিলোচ্ছল স্বরে আদেশ করেন বশিষ্ঠ—শুধু অতিথির প্রাপ্য সমাদর তোমার কাছ থেকে আশা করি শ্রুবাবতী। তার বেশি কিছু আশা করি না।
শ্রুবাবতী—বলুন, কোন্ সমাদরে আপনি প্রীত হবেন?
বশিষ্ঠ তাঁর কমণ্ডলু হতে পাঁচটি ক্ষুদ্র বদরিকা বের ক’রে শ্রুবাবতীকে বলে—এই পাঁচটি বদরিকা রন্ধন কর। সুরন্ধিত এই পাঁচটি বদরিকাই আমার দিনান্তের ভোজ্য। সূর্য অস্তমিত হবার পূর্বেই আমি আমার ভোজ্য গ্রহণ ক’রে তৃপ্ত হতে চাই।
শ্রুবাবতী—তথাস্তু ঋষি।
বশিষ্ঠ—কিন্তু একটি প্রশ্ন আছে।
শ্রুবাবতী—বলুন।
বশিষ্ঠ—যদি অতিথিকে এই সামান্য সমাদরেও তৃপ্ত করতে তুমি অক্ষম হও শ্রুবাবতী, তবে ক্ষুণ্ণ ও অপমানিত অতিথির অভিশাপও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে।
বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে শ্রুবাবতী—অভিশাপ?
বশিষ্ঠ—হ্যাঁ। কল্পনা করতে পার, কি অভিশাপ দেব আমি?
শ্রুবাবতী—না, আপনি বলুন।
বশিষ্ঠ—তোমার প্রেমের আস্পদ সেই বাসবকে তুমি চিরকালের মত ভুলে যাবে।
—অকরুণ ঋষি! শ্রুবাবতীর শিহরিত কণ্ঠস্বর আর্তনাদের মত ধ্বনিত হয়। পরক্ষণে, যেন নীলাশোকের চঞ্চলিত পল্লবের স্নিগ্ধ নিঃশ্বাসের স্পর্শে শান্ত হয়ে যায় শ্রুবাবতীর ত্রস্ত হৃদয়ের আর্ততা। দূরের বনবীথিকার ছায়াচ্ছন্ন অন্তরের দিকে তাকিয়ে কি-যেন চিন্তা করে শ্রুবাবতী। ধীরে ধীরে শান্ত ও কঠিন এক সংকল্পের আনন্দ তার অধররেখায় সুস্মিত হয়ে ওঠে।
শ্রুবাবতী বলে—অপেক্ষা করুন ঋষি। সূর্য অস্তমিত হবার পূর্বেই আপনি আপনার আকাঙিক্ষত ভোজ্য পাবেন।
কুটীরে প্রবেশ করে শ্রুবাবতী এবং একাকী নীলাশোকের ছায়ার কাছে দাঁড়িয়ে কপট বশিষ্ঠের নয়নে সেই কঠোর কৌতুক আরও প্রখর হয়ে জ্বলে ওঠে। ইন্দ্রজালের মায়া আশ্রমবাসিনী মর্ত্যনারীর প্রেমের অহংকারকে আর একবার আক্রমণ করেছে। পাঁচটি মায়াবদরিকা নিয়ে কুটীরের ভিতর চলে গিয়েছে শ্রুবাবতী, কোন অগ্নিতাপে সে মায়াবদরিকা রন্ধিত হবার নয়।
মধ্যাহ্নের সূর্য পশ্চিম দিগ্বলয়ের দিকে এগিয়ে চলে। ধীর ধীরে অপরাহ্নের আলোক নিষ্প্রভ হয়ে আসে। অস্তাচলের শিখরে আসন্ন সন্ধ্যার রক্তিম সঞ্চার জাগে। ইন্দ্রমায়ার কৌতুকে আশ্রমকুটীর হতে সকল ইন্ধনকাষ্ঠ সেই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। অপলক নয়নে কৌতুক নিয়ে কুটীরদ্বারের দিকে তাকিয়ে থাকেন কপট বশিষ্ঠ। মায়াবদরিকা রন্ধনে ব্যর্থ হয়ে, ইন্দ্রের মায়াভিশাপে অভিভূত প্রেমিকা শ্রুবাবতীর হৃদয় তার প্রেমের আস্পদ বাসবকে বিস্মৃত হয়ে ঐ কুটীরের ভিতর হতে ধীরে ধীরে এইখানে এসে, এই কপট বশিষ্ঠের সুন্দর মুখের দিকে তাকাবে। আর কতক্ষণ? অস্তাচলচূড়ার অন্তরালে ক্লান্ত তপনের শেষ রশ্মি বিদায় নেবার জন্য থরথর ক’রে কাঁপছে।
কিন্তু কই, ঐ নীরব কুটীরের বক্ষে কোন আর্তনাদ এখনও কেন জাগে না? কিংবা স্মৃতিহারা শূন্য হৃদয়ের নূতন কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে এখনও কেন নীলাশোকের ছায়ার দিকে এগিয়ে আসে না সেই নারী?
কপট বশিষ্ঠ তাঁর অন্তরের এই বিস্ময় সহ্য করতে না পেরে কুটীরের দ্বারের কাছে এসে দাঁড়ান।
অকস্মাৎ দারুমূর্তির মত স্তব্ধীভূত হয়ে যায় বিস্ময়চঞ্চল কপট বশিষ্ঠের শরীর। অগ্নিজ্বালাময় আর-এক বিস্ময়ের স্পর্শে কপট বশিষ্ঠের দুই চক্ষু হতে সকল কৌতুক ঝরে পড়ে যায়।
দেখতে থাকেন কপট বশিষ্ঠ, সুস্মিত হয়ে উঠেছে প্রেমিকা শ্রুবাবতীর নয়ন ও অধর। ইন্ধন নেই, কিন্তু পীতকৌশেয়বসনা নারী যেন তার নিজ তনুকেই ইন্ধনরূপে উৎসর্গ করবার জন্য অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। মর্ত্যভূমির প্রাণের এক ব্রততী তার জীবনের এত প্রিয় ঐ যৌবনপুষ্পিত দেহকে যেন এক মুহূর্তের মদকৌতুকে ভস্ম ও অঙ্গার ক’রে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। কপট বশিষ্ঠের অভিশাপকে চরম উপহাসের জ্বালায় ভস্মীভূত করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে শ্রুবাবতী। কী কঠিন এই মর্ত্যের মৃত্তিকার অহংকার!
শিউরে ওঠে কপট বশিষ্ঠের দৃষ্টি। দেখতে পান, সুস্মিত নয়নে ও অধরে এক শান্ত সঙ্কল্পের অহংকার নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে চলেছে শ্রুবাবতী। ত্বরিতপদে কুটীরের ভিতর প্রবেশ করেন কপট বশিষ্ঠ এবং শ্রুবাবতীর গতি রোধ করবার জন্য বাধা দিয়ে বলেন—থাম শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—থামতে পারি না ঋষি। বাধা দেবার চেষ্টা করবেন না।
বশিষ্ঠ—মর্ত্যের ক্ষণায়ুশাসিত জীবনের নারী, জীবনের মূল্য বিস্মৃত হও কেন?
শ্রুবাবতী—মর্ত্যের আশ্রমবাসিনী শ্রুবাবতী নামে এই নারীর জীবনের কোন মূল্য নেই, যদি সে জীবন তারই প্রেমের উপাস্য বাসবের কথা ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকে। সে-জীবন এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করতে চাই না ঋষি।
কপট বশিষ্ঠের নয়নের প্রখর কৌতূহল অকস্মাৎ স্নিগ্ধ এক বিশ্বাসের হর্ষ হয়ে ফুটে ওঠে। স্নিগ্ধ স্বরে বলেন—শান্ত হও, হৃদয়ের সব আক্ষেপ বর্জন কর শ্রুবাবতী। স্বর্গাধীশ বাসব আজ বিশ্বাস করে, মর্ত্যের আশ্রমবাসিনী এক পীতকৌশেয়বসনা ঋষিকুমারী তার জীবনের প্রতিক্ষণের কাম্য সেই পথিক বাসবকে ভালবেসেছে। প্রতিদান চায় না; উপকার, উপহার ও উপঢৌকন আশা করে না, মর্ত্যনারীর এই বেদনাভরা প্রেমের মূল্য বেদনাহীন স্বর্গের মনও তুচ্ছ করতে পারে না।
শ্রুবাবতী—স্বর্গের মনের কথা আর বাসবের বিশ্বাসের কথা আপনি কেন ঘোষণা করছেন ঋষি?
কপট বশিষ্ঠের নয়নে স্নেহসিক্ত কৌতুকের এক সুন্দর হাস্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে— আমি ঋষি নই, বশিষ্ঠও নই, স্বর্গাধীশ বাসব।
—প্রিয় বাসব! প্রেমতাপসিকার সফল প্রতীক্ষার আনন্দ প্রণয়সান্দ্র স্বরে উচ্ছ্বসিত হয়। স্মিত নয়নের সকল বাসনা উৎসারিত ক’রে বাসবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো শ্রুবাবতী। আর কোন দ্বিধা নেই, এই মুহূর্তে অনায়াসে বরমাল্য হাতে তুলে নিয়ে প্রেমিকের কন্ঠ স্পর্শ করতে পারে শ্রুবাবতী। যেন এক পৌর্ণমাসীর চন্দ্রিকার আশ্বাস দেখতে পেয়েছে শ্রুবাবতীর নয়ন। পীতকৌশেয় বসন আর জটায়ির বেণীভারের বন্ধনে ব্যথিত এক সাধ্বয়ন্তী প্রেমিকার সলজ্জ সাধ্বস এই মুহূর্তে প্রেমিকের কন্ঠ হতে উৎসারিত একটি প্রিয় সম্বোধনের স্পর্শে লুপ্ত হয়ে যাবে। শুধু একটি আহ্বান। শুধু দয়িতকণ্ঠের একটি প্রিয়সম্ভাষণ শোনবার জন্য শ্রুবাবতীর হৃদয়ের সকল পিপাসা উৎসুক হয়ে ওঠে, সেই আহ্বান ধ্বনিত হলেই সকল কুষ্ঠা হারিয়ে পীতকৌশেয়বসনা এক আশ্রমবাসিনী মর্ত্যনারী এই মুহূর্তে স্বর্গাধীশ বাসবের বক্ষে জটায়িত বেণীর লুটিয়ে দিয়ে তৃপ্ত হবে।
শ্রুবাবতী, পৃথিবীর এক পুষ্পিতযৌবনা ঋষিকুমারী যেন এক ক্ষণস্বপ্নের মধুরতার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছে, তার কোমল কপোলের লোধ্ররেণু ঝরে পড়ছে, কপালে পরিপীত পটীর রসের তিলক ফুটে উঠেছে। গলে গিয়েছে জটায়িত বেণীভারের ভার; নূতন কুন্তলে কুরুবকের শোভা উত্তংসিত হয়ে প্রেমিকাকে মধুবাসরিকার সাজে সাজিয়ে দিয়েছে।
বাসব ডাকেন—শ্রুবাবতী!
শ্রুবাবতী ক্ষণস্বপ্নের মধুরতা হঠাৎ ব্যথিত হয় এ কেমন আহ্বান? শ্রুবাবতী, শুধুই শ্রুবাবতী, যেন মর্তবাসিনী শত কোটি নারীর মধ্যে একটি নারীর নাম উচ্চারণ করছেন বাসব। সে আহ্বানে প্রেমিকের ব্যাকুলতা মদিরস্বরে মন্দ্রিত হয় না।
আবার বললেন বাসব—আশ্বস্ত হও ভারদ্বাজতনয়া, স্বর্গাধীশ বাসবের কাছ থেকে একটি বরবাণী শুনে প্রীত হও।
আর্তস্বরে প্রশ্ন ক’রে শ্রুবাবতী—বরবাণী?
বাসব—হ্যাঁ শ্রুবাবতী। আমি বিশ্বাস করি, তুমি আমাকে ভালবাস। তাই এই বর দান করি, তুমি তোমার মৃত্যুর পর স্বর্গালোকে গিয়ে আমার পরিণীতা পত্নী হবে।
করুণা করছে স্বর্গের মন। মর্ত্যের প্রেমকে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রীত ক’রে চলে যেতে চায় স্বর্গধামের অধীশ্বর। প্রিয়া শ্রুবাবতী, স্বর্গের মুখে এই স্বীকৃতি আর ধ্বনিত হলো না। শ্রুবাবতী তার ইহজীবনের কোন ক্ষণে এমন সম্বোধন শুনতে পাবে না।
মৃত্যর পর! যেন উচ্চভাষিত এক কঠোর বিদ্রুপের প্রতিশ্রুতি। শ্রুবাবতীর আহত মনের বেদনা তার মনেরই ভিতরে নীরবে হেসে ওঠে। স্বর্গের পুরুষ মৃত্তিকাময় এই ভূতলের কুটীরবাসিনী নারীর প্রেমবিহ্বল নয়নের প্রার্থনায় বন্দিত হয়েও এখনও এ-কথা বলতে পারছে না—আমি ভালবাসি। স্বর্গের সুধা কি এতই হিমাক্ত? বেদনাহীন স্বর্গের সবই কি শুধু শিলা?
শ্রুবাবতী বলে—আপনার বরবাণী আমার প্রতীক্ষার মৃত্যুবাণী, বাসব।
বাসব—কি বলতে চাও, ঋষিকুমারী?
শ্রুবাবতী—আপনি আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতীক্ষায় থাকতে বলছেন বাসব; কিন্তু এমন প্রতীক্ষার আর কোন অর্থ হয় না।
বাসব—কেন?
শ্রুবাবতী বলে—আমার মৃত্যুর পর, এই মর্ত্যনারীর ইহজীবনের অন্তে স্বর্গাধীশ যে বাসব আমার বরমাল্য গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দান করছেন, সে বাসব আমার বাসব নয়।
অমরপুরের অধীশ্বর, দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসন্ন অন্তরের শান্তি আবার এক মর্ত্যনারীর কুটিল প্রেমের অহংকারের আঘাতে ক্ষুব্ধ হয়।
বাসব বলেন—এক শুভক্ষণে স্বর্গলোকের নন্দনবনবীথিকায় পারিজাতের ছায়ার কাছে দাঁড়িয়ে বাসবের কণ্ঠে পরিণয়মাল্য অর্পণ করবে তুমি শ্রুবাবতী, মর্ত্যের বেদনাধূলিমলিন ইহজীবনের অন্তে এই পরমবরণীয় পরিণাম লাভের জন্য সশ্রদ্ধচিত্তে তপস্বিনীর মত প্রতীক্ষায় থাক।
শ্রুবাবতীর নয়নে অদ্ভুত এক সজল হাস্যদ্যুতি স্পন্দিত হতে থাকে।—আমার জীবন হতে প্রতীক্ষার সবেদন আনন্দটুকুও আপনি ছিন্ন ক’রে দিলেন বাসব। পারিজাতের ছায়া স্বর্গের নন্দনবনবীথিকাকে স্নিগ্ধ ও সুরভিত ক’রে রাখুক, মর্ত্যের প্রেমিকা নারী তার প্রতীক্ষাহীন ইহজীবনের শূন্যতা নিয়ে এই নীলাশোকের ছায়ার কাছে বিলীন হয়ে যাবে। মর্ত্যের বক্ষে শেষ নিঃশ্বাস সঁপে দেবার আগে শুধু বলে যাব, চাই না স্বর্গ, স্বর্গাধীশকেও চাই না, আমি আমার মর্ত্যের বনবীথিকার বাসবকে ভালবাসি।
বাসব—বড় উদ্ধত তোমার প্রতীক্ষাময় প্রেমের অহংকার, তার চেয়ে বেশি উদ্ধত তোমার প্রতীক্ষাহীন প্রেমের অহংকার। স্বর্গের প্রতিশ্রুতিকে তুচ্ছ ক’রে মৃত্তিকালিপ্ত মলিন মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেছ মর্ত্যনারী, স্বর্গাধীশের কাছে আর কোন করুণা আশা করো না। বিদায় দাও শ্রুবাবতী।
চলে গেলেন বাসব।
অতন্দ্রিত সবিতা কালচক্রে ধাবিত হয়ে দিবা রাত্রি কলা ও কাষ্ঠা রচনা করেন। আর মর্ত্যের এক আশ্রমপ্রাঙ্গণে নীলাশোকের ছায়ার কাছে অমাহতা কৃশ চন্দ্রলেখার মত প্রতিদিন ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয় অনশনব্ৰতিনী এক ব্রততীর দেহ। নীলাশোকের ছায়াস্নিগ্ধ মৃত্তিকার শয্যায় মৃত্যুবরণ করবার আগে যেন দুই নয়নের প্রিয় এক স্বপ্নের সঙ্গে বাসকোৎসব যাপন করছে প্রেমিকা শ্রুবাবতী। যে ইহজীবনের কুটীরদ্বারে দয়িতের পদধ্বনি কোনদিন শ্রুত হবে না। প্রতীক্ষাহীন সে ইহজীবনের একটি মুহূর্তও সহ্য করা যায় না।
তপস্বিনীর মূর্তি নয়। শ্রুবাবতী যেন তার শেষ স্বপ্নের সুষমায় নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে মত অভিলাষের নৈবেদ্যের মত মাটিরই উপর বর্ণ ও সৌরভের পুষ্প হয়ে পড়ে আছে। পীতকৌশেয় বসন নয়; জটায়িত বেণীভারও নয়। এক প্রেমিকা নারী যেন শেষ অভিসারে এই নীলাশোকের ছায়াতলে এসে দয়িতের সাথে মিলন লাভ করেছে। কবরীতে কুরুবক আর কপোলে লোধ্ররেণু নিয়ে রক্তাংশুকে শোভিতা এক মধুসরিকা যেন ক্লান্ত হয়ে ভূতলে লুটিয়ে পড়ে আছে।
প্রজাপতির পক্ষপরাগ মৃত্যুমুখিনী সে নারীর কবরী সুরভিত ক’রে দিয়ে যায়। রক্তাংশুকের লুন্ঠিত অঞ্চলে রাজীব রেণু ছড়িয়ে দিয়ে যায় ভৃঙ্গ। মৃত্যুমুখিনী নারীর আননে কখনও প্রভাতিকী আভা আর কখনও বা শুক্লা শর্বরীর জ্যোৎস্না হাসে।
আর, স্বর্গলোকের নন্দনবনবীথিকার পারিজাতের ছায়ার কাছে দাঁড়িয়ে বজ্ৰায়ুধ বাসবের হৃদয়ে দুঃসহ এক কৌতূহল চঞ্চল হয়ে ওঠে। মর্ত্যের এক নীলাশোকের ছায়ায় লিপ্ত এক আশ্রমের প্রাঙ্গণ যেন স্বর্গাধীশের বক্ষে এক মুষ্ঠি ধূলির জ্বালা নিক্ষেপ করেছে। তাই বার বার মনে পড়ে, এবং বার বার অন্তরের দুঃসহ কৌতূহল শান্ত করতে চেষ্টা করেন বাসব। স্বর্গের প্রতিশ্রুতিকে তুচ্ছ ক’রে স্বর্গাধীশ বাসবের বামাঙ্কশোভা হবার গৌরব তুচ্ছ ক’রে জীবনের প্রথম প্রণয়ে বিস্মিত নয়নের ক্ষণবিহ্বলতাকে চিরক্ষণময় স্বপ্নের মত নয়নে ধারণ ক’রে সত্যই কি মৃত্তিকার ক্রোড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মৃত্যুব্ৰতিনী নারী?
মর্তের জন্য স্বর্গের কৌতূহল! বড় দুঃসহ এই জ্বালাবিচলিত কৌতূহল। স্বর্গাধীশ বাসবের মনে হয়, সুধাহীনা বসুধার নারী যেন হেলাবহসিত লীলাভঙ্গে মৃত্যুর বেদনা বরণ ক’রে সুধানিষিক্ত স্বর্গের সকল সুখের অমরতাকে অসুখী ক’রে দিতে চাইছে। দেখতে ইচ্ছা করে, মর্ত্যপ্রেমের সুন্দর অহংকারের সেই বিচিত্র গৌরবচ্ছবি। কৃপা করুণা ও মহত্ত্বের দু’টি স্বর্গীয় নয়ন লুব্ধ হয়ে ওঠে। মর্ত্যলোকের এক নীলাশোকের ছায়ার জন্য তৃষ্ণার্ত হয় স্বর্গাধীশের তাপিত মনের কৌতূহল।
অন্তরীক্ষের অন্তর মথিত ক’রে ধ্বনিত হয় স্বর্গাধীশ বাসবের স্যন্দননেমির শিহরিত আর্তস্বর। মর্ত্যের বনস্থলীর শিরে সন্ধ্যার চন্দ্রলেখা কিরণ সম্পাত করে, যেন বিচলিত দ্যুলোকের অন্তর স্নেহ লাভের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ভূতলের শ্যামলতার বক্ষ অন্বেষণ করছে। স্বর্গাধীশ বাসবের রথ দূরন্ত কৌতূহলের মত ছুটে এসে বনবীথিকার ধূলির উপর দাঁড়ায়। নীরব ও নিস্তব্ধ আশ্রমপ্রাঙ্গণের পুষ্পিত নীলাশোকের দিকে তাকান বাসব। বাসবের কুণ্ডলদ্যুতি যেন ব্যথিত জ্যোৎস্নার মত বনবীথিকার ছায়ার বক্ষে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে থাকে। শ্রুবাবতী পীতকৌশেয়বসনা সেই প্রেমিকা নারী কি সত্যই মৃত্যু বরণ ক’রে এই মর্ত্যের ধূলিতে বিলীন হয়ে গিয়েছে? তবে এই সন্ধ্যার জ্যোৎস্নায় এখনও কেন দগ্ধ হয়ে অঙ্গার হয়ে যায়নি ঐ নীলাশোকের কুসুম?
শ্রুবাবতী! প্রিয়া শ্রুবাবতী! বজ্ৰায়ুধ স্বর্গাধীশের সুধাসিক্ত কণ্ঠ সুধাহীনা বসুধার এক নারীকে আহ্বান করতে গিয়ে আর্তস্বর উৎসারিত করে। জ্যোৎস্নায়িত সন্ধ্যার মর্ত্যভূমি দ্যুলোকের ক্রন্দন শুনতে পেয়েও কী কঠিন নিষ্ঠুরতায় নীরব হয়ে আছে! স্বর্গের আশাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে এই মর্তের মৃত্তিকা?
ধীরে ধীরে নীলাশোকের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন বাসব। স্বর্গের মন এতদিনে বেদনার স্বাদ পেয়েছে। স্বর্গের গর্বিত কামনা আজ নত হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে তার স্তোত্রের পাত্রীকে দেখতে পেয়েছে। বনবীথিকাচারী সেই পথিক তার জীবনের বাঞ্ছিতাকে আর একবার দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
সেই নীলাশোক। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন বাসব, নীলাশোকের ছায়ায় ভূতলে লুটিয়ে রয়েছে মর্ত্যপ্রেমের এক চন্দ্রলেখা। রক্তাংশুকে শোভিতা এক মধুবাসরিকা তার কবরীর কুরুবক, সুকোমল কপোলের লোধ্ররেণু, কপালের পটীররসতিলক আর বক্ষের পত্রলিখা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আছে। সত্যই, মরে গিয়েছে জটায়িত বেণীভারের বেদনায় বন্দিনী সেই তপস্বিনীর মূর্তি। আজ নীলাশোকের ছায়ায় শুধু এক ভূতললীনা প্রেমিকার মূর্তি তার নয়নের স্বপ্নের সঙ্গে বাসকোৎসব যাপন করছে।
ভূতললীনা শ্রুবাবতীর আরও কাছে এগিয়ে আসেন বাসব, এবং প্রেমিকা মর্ত্যনারীর মঞ্জরীবলয়িত একটি বাহু সাগ্রহে বক্ষে গ্রহণ করেন। প্রেমিকার কন্ঠাসক্ত পুষ্পমাল্য আর মৃদু নিঃশ্বাসের সৌরভ স্বর্গাধীশ বাসবের বক্ষের সকল অনুভব সুরভিত ক’রে দেয়। মর্ত্যের প্রেমিকা নারী প্রতীক্ষাহীন জীবনের শূন্যতা হতে চিরকালের মত মুক্ত হবার জন্য মৃত্যু আহ্বান করেছে, এবং কী অদ্ভুত এই সুধাহীনা বসুধার মৃত্তিকা, মৃত্যুরই বেদনা সুস্মিত জ্যোৎস্নারেখার মত শ্রুবাবতীর অধরে ফুটে রয়েছে।
—প্রিয়া শ্রুবাবতী! আহ্বান করেন বাসব।
শ্রুবাবতীর নিমীলিত নয়নের স্বপ্ন সেই আহ্বানের মধুর মন্দ্রে চমকিত হয়। মৃত্যুমুখিনী নারীর হৃদয়ের কাছে প্রেমিকার ব্যাকুলতা মধুপগুঞ্জনের মত ধ্বনিত হয়েছে, শ্রুবাবতীর নিমীলিত নয়ন কমলকলিকার মত ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।
—এসেছ, প্রিয় বাসব! শ্রুবাবতীর সফল বাসনার আনন্দ দূরান্তের কলবেণুক্বণিত গীতধ্বনির মত সুস্বরিত হয়।
—এসেছি, প্রিয়া শ্রুবাবতী।
—মর্ত্যনারীর ধূলিলীন হৃদয়ের কাছে কেন এসেছেন স্বর্গাধীশ বাসব?
আবার প্রশ্ন করেছে মর্তের মৃত্তিকা? এই প্রশ্ন যেন সুধাময় স্বর্গলোকের একটি রিক্ততার দিকে সন্দেহের ব্যথা নিয়ে এখনও তাকিয়ে আছে। কিন্তু আর ভুল করবেন না স্বর্গের বাসব। যে-কথা শুনতে পেলে স্বর্গকে বিশ্বাস করতে পারবে এই মর্ত্যের প্রাণ, সেই কথা মর্ত্যেরই ধূলি আর তৃণের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা ক’রে দেবার জন্য প্রস্তুত হন বাসব।
বাসব বলেন—একটি কথা বলতে এসেছি, শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—কী?
বাসব—আমি ভালবাসি।
বনস্থলীর সমীর হঠাৎ হর্ষে অশান্ত হয়, চঞ্চল হয় পষ্পিত নীলাশোক। ভূতললীনা চন্দ্রলেখাও যেন চঞ্চলিত এক উৎসবের আনন্দে লীন হয়ে যাবার জন্য বাসবের আলিঙ্গনে আত্মদান করে।
বাসব বলেন—চল, প্রিয়া শ্রুবাবতী।
শ্রুবাবতী—কোথায়?
বাসব—স্বর্গলোকে চল।
শ্রুবাবতী—আমি তো স্বর্গ চাইনি বাসব।
বাসব—কিন্তু স্বর্গ যে তোমাকে চায়।
পরিশিষ্ট
ব্যাসকৃত মহাভারতের যে পর্বের যে অধ্যায়ে উপাখ্যানগুলির মূলপরিচয় উল্লিখিত আছে:
উপাখ্যান | পর্ব | অধ্যায়-সংখ্যা |
পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা | বনপর্ব | ১৯২ |
সুমুখ ও গুণকেশী | উদ্যোগপর্ব | ১০৪ |
অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা | বনপর্ব | ৯৬ |
অতিরথ ও পিঙ্গলা | শান্তিপর্ব | ১৭৪ |
মন্দপাল ও লপিতা | আদিপর্ব | ২২৯ |
উতথ্য ও চান্দ্রেয়ী | অনুশাসনপর্ব | ১৫৪ |
সংবরণ ও তপতী | আদিপর্ব | ১৭১ |
ভাস্কর ও পৃথা | বনপর্ব | ৩০৫ |
অগ্নি ও স্বাহা | বনপর্ব | ২২৪ |
বসুরাজ ও গিরিকা | আদিপর্ব | ৬৯ |
গালব ও মাধবী | উদ্যোগপর্ব | ১১৫ |
রুরু ও প্রমদ্বরা | আদিপর্ব | ৯ |
অনল ও ভাস্বতী | সভাপর্ব | ৩১ |
ভৃগু ও পুলোমা | আদিপর্ব | ৫ |
চ্যবন ও সুকন্যা | বনপর্ব | ১২২ |
জরৎকারু ও অস্তিকা | আদিপর্ব | ১৩ |
জনক ও সুলভ | শান্তিপর্ব | ৩২১ |
দেবশর্মা ও রুচি | অনুশাসনপর্ব | ৪০ |
অষ্টাবক্র ও সুপ্রভা | অনুশাসনপর্ব | ১৯ |
ইন্দ্র ও শ্রুবাবতী | শল্যপর্ব | ৪৯ |