ইন্দ্রজাল
আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে অদ্ভুত সব গল্প শুনিয়ে যান। বলেন তো সবই সত্যি, তবে সে বিষয়ে আমি হলফ করে কিছু বলতে পারব না। কিন্তু আমার নিজের সেই সুরুলের সার্কাসওয়ালার রুমালের পুতুল নাচের কথাটা এক বর্ণ বাড়িয়ে বলিনি।
কিন্তু ওগল্প শুনে আমাদের প্রিয় বন্ধু ড. সেনগুপ্ত বললেন, ‘তা কী করে সম্ভব হতে পারে, আপনিই বলুন।’ আমি একটু গরম হলাম, ‘তাই যদি বলতে পারতাম তা হলে আর আশ্চর্যের কী বাকি থাকত? যেমন দেখেছিলাম, তেমন বলেছিলাম। আমার সঙ্গে পূর্ণিমা ঠাকুর ছিলেন। তিনিও দেখেছিলেন।’
তখন আসকারা পেয়ে আমাদের প্রিয় বন্ধুটি এক আশ্চর্য গল্প বললেন। সেও নাকি সত্যি। তিনি নিজে না দেখলেও যেসব প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁকে ব্যাপারটা বলেছিলেন, তাঁদের অবিশ্বাস করা যায় না।
একজন সত্যিকার সাধুর গল্প। লোকে বলত তাঁর অনেক অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু খ্যাতি পাবার জন্য তিনি এতটুকু লালায়িত ছিলেন না আর ক্ষমতার প্রমাণ দেবারও কোনও আগ্রহই ছিল না। তবু লোকে ছাড়ত না। একবার সন্ধ্যাবেলায় এলাহাবাদের কাছে কোনও বাগানে, অনেকে মিলে তাঁকে কোণঠাসা করেছিলেন। কিছু না দেখে তাঁরা নড়বেন না।
শেষটা মরিয়া হয়ে তিনি বললেন, ‘বেশ, নেহাৎ যখন ছাড়বেনই না, একটা ছোট জিনিস দেখাচ্ছি। আপনারা কী খেতে চান?’
এমন কথা শুনে তাঁরা হকচকিয়ে গেলেন। খেতে কে না ভালবাসে, কিন্তু সবাই মিলে হঠাৎ একটা নাম করা মুশকিল। সাধু বললেন, ‘আচ্ছা, দইবড়া খাবেন?’ শুনে সবাই মহা খুশি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই খাব। দইবড়া তো ভাল জিনিস।’
সাধু তখন একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সাজসরঞ্জাম, পুথি-মাদুলি, কিচ্ছু ছিল না। এক্কেবারে খালি হাত। তারপর একটু ইতস্তত ভাবে চারদিকে তাকাচ্ছেন দেখে দর্শকদের ধৈর্য থাকে না, ‘কী হল মশাই? দইবড়া কোথায়?’
সাধু বললেন, ‘দইবড়া এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। খুব ভাল দইবড়াই আনছি। কিন্তু একথাও বলে দিচ্ছি যে খেয়ে আপনাদের অনুতাপ হতে পারে!’
এমনি কথা শুনে সবাই হেসে উঠল, ‘অনুতাপ হবে কেন? বেশি খেয়ে একটু অসুখ করলেও অনুতাপ হবে না!’ সাধু তখন শূন্যে দু’হাত তুলে, আকাশের দিকে মুখ করে ডাকতে লাগলেন, ‘আ-যা! আ-যা!’ আর সঙ্গে সঙ্গে মস্ত এক হাঁড়ি ভরতি বড় বড় দইবড়া শূন্য থেকে তাঁর হাতে এসে পড়ল। যেমনি চেহারা, তেমনি খোসবো!
সবাই হাঁড়ির ওপর হুমড়ি দিয়ে পড়লেন। নিমেষের মধ্যে হাঁড়ি সাফ! বন্ধুরা তখন হাত-মুখ মুছে, চারদিকে চেয়ে সাধুকে দেখতে না পেয়ে, তাঁর অসাধারণ ক্ষমতার গুণগান করতে করতে যে যার বাড়ির পথ ধরলেন।
কিছু দূর এগিয়েই একটা মেথর-পট্টি। সেখানে মহা শোরগোল। মনে হল কিছু একটা ঘটেছে। একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে আসতেই সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার? তোমাদের হলটা কী?’
ছেলেটা বলল, ‘তাজ্জব কি ব্যাপার! আজ আমাদের দইবড়া খাবার দিন। একেকবার একেকজনের বাড়িতে দইবড়া হয়। আজ ফুফু খুব ভাল করে দইবড়া করে, বড় হাঁড়ি করে এক জায়গায় রেখেছিল। তা হাঁড়িসুদ্ধ দইবড়া উধাও! কোথায় গেল কেউ ভেবে পাচ্ছে না! তাই নিয়ে ঝগড়া লেগেছে!’
শুনে সকলের আক্কেল গুড়ুম!
এই গল্প শুনে আমাদের আরেকটা গল্প মনে পড়েছিল। সত্যি ঘটনা, বিবেকানন্দস্বামী আমেরিকায় বক্তৃতা দিতে দিতে বলেছিলেন। ‘জ্ঞানযোগ’ বইটিতে আছে। তাঁর ছাত্র বয়সের কথা। সাঁতরাগাছি কিংবা ওইরকম কোথাও এক সাধু এসেছিলেন। সকলে বলত তাঁর অনেক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, কিন্তু কাউকে কিছু দেখাতে চাইতেন না।
বিবেকানন্দ তখনও বিবেকানন্দ হননি। কলেজে পড়তেন, নাম নরেন দত্ত। সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। একজন সহপাঠী এসে বললেন, ‘এইরকম এক সাধু এসেছেন। চল দেখে আসি বুজরুকি কি না।’
গেলেন তাঁরা। দেখলেন নাগা সন্ন্যাসী, গায়ে কাপড় নেই। এক ভক্তের ঘরে বসে আছেন; চারদিকে লোকজন। ভক্তও আছে, আবার অবিশ্বাসীও আছে। সবাই তাঁর ক্ষমতার প্রমাণ দেখতে চায়। শেষটা তিনি বললেন, ‘এসব দেখানো আমাদের উচিত নয়। তবু তোমরা অবিশ্বাস করছ বলে কিছু দেখাচ্ছি।’
ঘরে জায়গা নেই। সাধু বাইরে খোলা জায়গায় গিয়ে বসলেন। দর্শকরা চারদিক ঘিরে দাঁড়ালেন। পৌষ মাস, বেজায় শীত। দর্শকদের মধ্যে কার মায়া লাগল, সে তাঁকে একটা কম্বল দিল। সেটি গায়ে জড়িয়ে তিনি বসলেন।
তারপর ভিড়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘কী খাবে?’ এক চ্যাংড়া ছোকরা বলে উঠল, ‘ল্যাংড়া আম!’ পৌষ মাসে ল্যাংড়া আম!
সাধু তেমনি শান্ত মুখে কম্বলের তলা থেকে রাশি রাশি ল্যাংড়া আম বের করে দিতে লাগলেন। একেকবারে পঁচিশ-ত্রিশটা করে। তাই দেখে সবাই হতভম্ব!
সাধুর সামনে ল্যাংড়া আমের পাহাড় জমে গেল। তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘খাও, খাও খারাপ জিনিস নয় এসব!’ সেদিন সবাই পেট ভরে ল্যাংড়া আম খেল। বহুদিন পর্যন্ত ওইখানে তার খোসা আর আঁটি পড়ে ছিল। কয়েকটা আঁটির শেকড় বেরিয়েছিল পর্যন্ত।
কেউ বলল না যে সাধু সবাইকে সম্মোহিত করে ভোগা দিয়েছিলেন। ভোগার আমের আঁটির কি কল বেরোয়?
এ গল্প শুনে আমার ননদ বললেন, ‘আশ্চর্য ঘটনা হামেশাই ঘটছে। আমাদের ব্যারাকপুরের বাড়ির একতলা ভাড়া নিল নিরীহ চেহারার একজন লোক। বলল— আপনারা শান্তি ভালবাসেন; তা আমাদের কুকুর বেড়াল গোরু মোষ টিয়া কাকাতুয়া বা ছেলেপুলে নেই। শুধু গিন্নি আর আমি! যা বললেন না তা হচ্ছে তাঁদের ২২টা ট্রাকের ব্যাবসা। দিনরাত হুড়মুড় ঘড়ঘড় দুমদাম ঘাচর ম্যাচর! আমাদের ঘুম শিকেয় উঠল আর আমার অমন হাজারি-কাঁঠালের গাছ, সেও কঁঠাল দেওয়া বন্ধ করে দিল!!’