ইন্দিরা গান্ধি (১৯১৭–১৯৮৪) – বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
সম্ভবত বিশ্বের কোনো কালে কোনো মহিলা এতখানি গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত হননি, যতখানি হয়ছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি। তিনি দেশশাসন ও দেশের অগ্রগতিতে অভূতপূর্ব গৌরবময় অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত ইন্দিরা গান্ধি ছিলেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ।
এই মহীয়সী মহিলার জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর, ভারতের বিখ্যাত নেহরু পরিবারে। পিতা ছিলেন ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মা কমলা নেহরু। ইন্দিরা গান্ধি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ইন্দিরার পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের এলাহাবাদে। শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ পরিবারটি ছিল ভারত তথা সারা বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়।
ইন্দিরা বাল্যকাল থেকেই ছিলেন অপূর্ব দৈহিক সৌন্দর্যের অধিকারিণী। তাই তাঁর পিতার সহযোগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সুধীমহল বাল্যকালে আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘প্রিয়দর্শিণী’ বলে।
১৯২২ সালে পাঁচ বছর বয়সে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা সবরমতী গান্ধি আশ্রমে কয়েক মাস অবস্থান করেন। পরের বছর ১৯২৩ সালে তিনি প্রথম ভর্তি হন সেন্ট মিসিলিয়া স্কুলে।
১৯২৬ সালে হঠাৎ তাঁর মা কমলা নেহরু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ মাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ইউরোপে, ঐ সময় ইন্দিরাও গিয়েছিলেন মায়ের সঙ্গে। দীর্ঘ দুবছর ইউরোপে মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন স্বদেশে। ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসে তিনি ভর্তি হলেন এলাহাবাদের সেন্ট মেরি কনভেন্টে।
পিতা জওহরলাল নেহরু ছিলেন মহাত্মা গান্ধির ভাবশিষ্য। সুতরাং সেই সূত্রে বল্যকালেই ইন্ধিরাও মহাত্মার সংস্পর্শে আসার এবং তাঁর আদর্শ গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। ১৯২৮ সালে এগারো বছর বয়সেই তিনি গান্ধিজির চরকা সংঘের শিশু বিভাগে যোগদান করেন। চরকায় সুতাকাটা ছিল ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের আদর্শের প্রতীকস্বরূপ। ইন্দিরা গান্ধিরও সেই শিশুবয়সেই স্বদেশি আন্দোলনের হাতেখড়ি হয় এভাবে। এরপর তিনি ১৯৩০ সালে ‘বানর সেনা’ নামে অন্য আরো একটি সংগঠনের সদস্য হন তিনি।
১৯৩৪ সালে ইন্দিরা পিপল্স্ ওন স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন বিশ্বভারতীতে—সাহচর্য লাভ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের।
১৯৩৫ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহরু দ্বিতীয় বারের মতো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য আবার নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। লন্ডনেই তিনি ১৯৩৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন।
মাকে হারিয়ে ইন্দিরা খুবই মর্মাহত ও নিঃসহায় হয়ে পড়েন। তার পর থেকেই মাতৃহারা কন্যার একমাত্র সম্বল ছিলেন পিতা জওহরলাল নেহেরু।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ইন্দিরা ছিলেন পিতার প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী। পিতা জওহরলাল দীর্ঘদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি যখনই কোনো রাজনৈতিক সফরে যেতেন দেশে কিংবা বিদেশে, তাঁর সঙ্গী হতেন ইন্দিরা। এমনি করে তিনি অল্পবয়সেই পৃথিবীর বহু দেশ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
শান্তিনিকেতনের পর তিনি ব্রিস্টল এবং অক্সফোর্ডেও পড়শোনা করেন। পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে থেকেই তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়েয়ে পড়েন। ১৯৩৮ সালেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেন (তখনও তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্রী)।
তারপর ১৯৪১ সালে পড়াশোনা শেষ করে লন্ডন থেকে স্বদেশে ফিরে এসে কংগ্রেস নেতা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে পার্টির কাজ করতে শুরু করেন।
এর পরের বছর ১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ তিনি বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ ফিরোজ গান্ধির সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
ইন্দিরার দু’ ছেলে। ১৯৪৪ সালে রাজীব (ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) এবং এর দুবছর পরে ১৯৪৬ সালে সঞ্জয়ের জন্ম হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতে ইংরেজশাসনের অবসান ঘটে—ভারত স্বাধীন হয়। এই সময় তিনি মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। শেষ বয়সে, ১৯৪৮ সালের ২৯ জানুয়রি নিহত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত গান্ধিজি যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করতেন, ইন্দিরা গান্ধি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
১৯৫৩ সালে ইন্দিরা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়ে জোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে পরিচিত হন। এবছরই পিতার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রথম সম্মেলনে গিয়ে তিনি চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ড. সুকর্নর মতো বিশ্বনেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই বছরেরই শেষভাগে ইন্দিরা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং সমাজসেবায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য মাদার অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে তিনি এলাহাবাদ নগর কংগ্রেস কমিটির সভনেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে হন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী।
এই সময় পিতা জওহরলাল নেহেরু ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ইন্দিরা ছিলেন পিতার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক উপদেষ্টা। শোনা যায়, এই সময় কন্যা ইন্দিরার পরামর্শ ছাড়া নেহেরু বড় কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নিতেন না। ইন্দিরাই ছিলেন পিতার নেপথ্য পরিচালিকা।
১৯৬০ সালে ইন্দিরার জীবনে নেমে আসে এক দুঃখময় ঘটনা। স্বামী ফিরোজ গান্ধি পরলোকগমন করেন। এর পর থেকেই তিনি হয়ে যান নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য সর্বক্ষণই তিনি ডুবে থাকতেন কাজে।
দীর্ঘ একটানা ১৭ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ১৯৬৪ সালের ২৭ মে পিতা জওহরলাল নেহরু পরলোকগমন করেন।
নেহেরুর মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধিও এই প্রথম বারের মতো মন্ত্রিপরিষদে প্রবেশ করেন। তিনি হন তথ্য ও বেতারমন্ত্রী। ২০ আগস্ট (১৯৬৪ সাল) তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্যসভার সদস্যপদ লাভ করেন।
এর পর ১৯৬৬ সালের ২৯ জানুয়ারি মোরারজি দেশাইকে পরাজিত করে তিনি সংসদে কংগ্রেস দলের নেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ সালের ১২ মার্চ তিনি কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেত্রী নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভা বাতিল করা হয়। লোকসভা বাতিল করার প্রেক্ষিতে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ অব্যাহত থাকার বৈধতা নিয়ে মামলা হয়। তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন এবং আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ১২ মার্চ মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
ইন্দিরা গান্ধির জীবনের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তাদান।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক সৈন্যবাহিনী আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে বাঙালিদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কয়েক মাসের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
ইন্দিরা গান্ধিও কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পাক- সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে। তিনি দেশে দেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে শুরু করেন এই তৎপরতা। অবশেষে তিনি নিজেই সেপ্টেম্বর মাসে বের হন বিশ্বসফরে—বাংলাদেশের গণহত্যা ও শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বজনমত গঠনের জন্য। তিনি সফর করেন আমেরিকা ও রাশিয়াসহ ইউরোপের বহু দেশ।
৩ ডিসেম্বর (১৯৭১ ) পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন ইন্দিরা সরকারও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে নেমে পড়ে যুদ্ধে। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর এক যৌথ কমান্ড। বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর হাতে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধির দান অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ তিনি এদেশ সফরে এসেছিলেন।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস পরাজিত হলে মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্বক্ষণ ইন্দিরা গান্ধিকে হেনস্থা করার অপচেষ্টা চালান। কিন্তু ইন্দিরা ধৈর্য ও তৎপরতার সঙ্গে সকল বাধা মোকাবেলা করেন। তার ফলে ১৯৮০ সালে সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কংগ্রেস দল। তিনি পুনরায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
এই বছরেই তাঁর জীবনে আর একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তাঁর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান।
তারপর আসে বিশ্বের ইতিহাসের সেই মর্মান্তিক ক্ষণটি। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রিটেনের খ্যাতনামা অভিনেতা ও পরিচালক পিটার উস্তিনভ-এর সঙ্গে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিতে এসে নিজ দেহরক্ষীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এই হত্যাকাণ্ড ছিল বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কলঙ্কময় ঘটনা। তাঁর ঘাতকরা ছিল শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সদস্য। পাঞ্জাবের শিখ বিছিন্নতাবাদী প্রবণতাই ইন্দিরাহত্যার প্রধান কারণ। পরে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারের রায়ের ভিত্তিতে ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকারী বিয়ন্ত সিং ও কোহার সিংকে ফাঁসি দেওয়া হয় (১৯৮৯ সালের জানুয়ারি)।
ইন্দিরা গান্ধি ছিলেন সারা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। প্রবল ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশ্বে সত্যি বিরল।