1 of 2

ইন্টারভিউ – বিমল কর

ইন্টারভিউ – বিমল কর

এক

কনক হাসতে হাসতে ধনুকের মতন বেঁকে ক্রমশ নুয়ে গেল। হাসির দমক আর থামে না; শেষে আর দম নিতে না পেরে গলা বন্ধ হয়ে এল। কয়েক মুহূর্ত পরে ধনুকের ছিলে কেটে যাবার মতন তার শরীর সোজা হল। সোজা হয়ে বসে হাঁপাতে লাগল, মুখ হাঁ করে, বড় বড় স্বাস নিতে শুরু করল। হাসির দমকে তার চোখের কোলে জল এসেছে, মুখ টকটকে লাল।

অনুকূলচন্দ্র এতক্ষণ একদৃষ্টে কনকের হাসি দেখছিলেন, এবার স্ত্রী আশালতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “একে এক গ্লাস জল এনে দাও, গলা শুকিয়ে গেছে।”

আশালতার কোলে উলের গোলা, হাতে কাঁটা; উল বুনতে বুনতে হাত কখন থেমে গেছে, মুখে কেমন উদ্বেগ। এমন করে কেউ হাসে নাকি! বাব্বা, কী মেয়ে!

বোনের দিকে তাকিয়ে আশালতা বলল, “কী সৃষ্টিছাড়া হাসি তোর! আমার সামনে ওভাবে হাসিস না, ভয় করে। …জল খাবি?”

কনক আঁচলে মুখ মুছে নিল, চশমাও মুছল। তার চোখেমুখে তখনও হাসির ছটা লেগে আছে, তবু হাসির দমকে ক্লান্ত হয়েছে সামান্য। কনক বলল, “বারে, দোষ আমার!” বলে আড়চোখে অনুকূলচন্দ্রকে দেখিয়ে বলল, “হাসাচ্ছেন উনি, আর আমি হাসতে পারব না।”

আশালতা উঠল। এক গ্লাস জল হাতের কাছে থাকা ভাল। যে ভাবে মেয়েটা হাসে, এক নাগাড়ে, ভয় করে।

যেতে যেতে আশালতা বলল, “তোর চাকরি হবে না। অসভ্যর মতন হাসিস। তোকে কে কলেজে পড়াতে নেবে?”

আশালতা চলে গেলে কনক পুরনো হাসির কথাটা মনে করতে করতে বলল, “আপনাদের কলেজে এমন রত্নটিকে কোথা থেকে আনা হয়েছে জামাইবাবু?”

“পাটনা!”

“গোরু!”

“তুমি কি কলকাতার মোষ দেখবে, তাও আছে।”

“ইস নিজে কোথা থেকে এসেছেন?”

“আমরা এখানে সাতজন কলকাতার রয়েছি। তার মধ্যে পাঁচজন পুঃ, দুজন স্ত্রী। মেজরিটি।”

“পুঃ আবার কি?” কনক চোখ উঁচিয়ে শুধলো, ততক্ষণে আশালতা জল নিয়ে ফিরে এসেছে।

অনুকূলচন্দ্র বাঁকা চোখে স্ত্রীর দিকে একটিবার তাকিয়ে নিলেন, তার পর বললেন, “একসময় ওটা পুং ছিল, আমরা পুরুষরা প্রবল ছিলাম, প্রতাপ ছিল আমাদের। হাতে ‘ং’-এর তরোয়ালটা থাকত। এখন তরবারি ভগ্ন, দুর্বল ‘পুঃ, তুচ্ছার্থক ‘পুঃ’-ও বলতে পার।”

কনক আবার হেসে উঠল।

আশালতা বলল, “তা পুঃ কেন, ফুঃ বললেই হয়।”

অনুকূলচন্দ্র মাথা নোয়ালেন, সবিনয়ে বললেন, ‘ন কস্মমাত্মনঃ প্রিয়ং করিষ্যে।”

“সংস্কৃত জানি না-সোজা বাংলায় বলুন”, কনক বলল। বলে আশালতার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু খেয়ে ফেলল। শীতের দিনেও ঠাণ্ডা জল অতটা খেয়ে বেশ আরাম পেল কনক।

অনুকূলচন্দ্র বললেন, “ওটা পুরুষের গুরুমন্ত্র। স্বয়ং কালিদাস দুষ্মন্তুর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন। তুমি তো ভাই পুরুষ নও, বিয়েও করনি, করব করব মনে করে কোনও প্রিয়জনের সঙ্গে ঘোরাফেরাও করছ না। ওর মানে তুমি বুঝবে না। এটা আমাদের ইষ্টসাধনের মন্ত্র।”

আশালতা ততক্ষণে নিজের জায়গায় বসেছে। বলল, “যখন তখন তোমার ওই সংস্কৃত শ্লোক, না হয় বাংলা কাব্যি আওড়ানো।…কাজের কাজ কি করছ বলো। যেমন ভগ্নীপতি, তেমনি শালি। আগে কাজের কাজ মিটুক, তারপর যত খুশি হাসিঠাট্টা করো।”

অনুকূলচন্দ্র চিন্তিত হবার ভান করে একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া গিলতে ও ছাড়তে লাগলেন। আশালতার দিকে তাকালেন একবার। চোখের দৃষ্টিতে কোথাও যেন একটা মতলব ছিল বা ফন্দি। কনক আসার আগে স্ত্রীকে রীতিমতো সব বুঝিয়েছেন, আশালতা সহজে কি বুঝবে। যাহোক, এখন পর্যন্ত আশালতা কোথাও কিছু মচকায়নি।

কনক বলল, “আপনি জুবিলি কলেজের পুরনো, সিনিয়ার প্রফেসার, সংস্কৃত আর বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড। আপনার কোনও ভয়েস নেই।”

অনুকূলচন্দ্র জবাব দিলেন, “আমি তো এখানে প্যাসিভ ভয়েস—” তাঁর চোখ একবার স্ত্রীর দিকে পড়ল, তারপর মুখ ফিরিয়ে কনকের দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার ব্যাপারটায় যে অ্যাকটিভ ভয়েস—সে হল ওই কুসুম হালদার। ওই ছোকরাই বটানি ডিপার্টমেন্ট চালাচ্ছে।”

পুরনো কথা মনে পড়ায় কনক হেসে ফেলল, বলল, “তার মানে যা করার তা করবে ওই বটানি ব্রহ্মচারী।

আশালতা বলল, “কুসুমবাবুকে তো তুমি বললে পার। তোমার শালি জানলে…”

“শালা জানলে হত, শালি জানলে হবে না।”

“কেন হবে না?” কনক তর্ক করার মতন করে বলল।

“হবে না। কুসুম তার ডিপার্টমেন্টে মেয়ে লেকচারার নেবে না।”

“বাঃ বাঃ, মজা আর কি! কেন নেবে না। আপনাদের কলেজ কো-এডুকেশান; প্রফেসারস স্টাফেও কজন মেয়ে আছেন। আর আমার বেলায় হবে না। কই বিজ্ঞাপনে আপনাদের কলেজ-কমিটি তো লিখে দেননি, মেয়েরা দরখাস্ত করতে পারবে না—বরং উল্টো কথাই লেখা ছিল।”

অনুকূলচন্দ্র জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, বললেন, “না হওয়াটা অত্যন্ত অন্যায়। জুবিলি কলেজ নতুন, কিন্তু তার ঐতিহ্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। সারা বিহারে এরকম একটা কি বলে যেন…সহাবস্থানের প্রিনসিপল মেনে চলা কলেজ তুমি আর পাবে না….কিন্তু ওই যে, যা বললাম, আমাদের বটানি-কুসুম সাংঘাতিক রকমের ‘পুং’। মেয়েদের দু চোখে দেখতে পারে না।…আরে কলেজে নিজেদের কলিগ—চার-পাঁচজন মহিলার ছায়া মাড়াবে বলে নিজের ডিপার্টমেন্টের ঘরে সব সময় বসে থাকে যে মানুষ—সে তোমায় তার আন্ডারে চাকরি দেবে! অসম্ভব!”

“চাকরি দেবার মালিক নাকি উনি?” কনক এবারে বেশ রেগে গেছে।

অনুকূলচন্দ্র বললেন, “তা খানিকটা তো তাই। কাল যখন ইন্টারভিউ দিতে যাবে, দেখবে কমিটির একজন মেম্বার, আমাদের প্রিনসিপ্যাল সাহেব আর ওই হতভাগা বসে আছে। ওর ডিপার্টমেন্ট, ওই যা করার করবে, আমাদের এখানে সেটাই নিয়ম কিংবা প্রপার ওয়ে বলতে পার।…কাজেই চান্স নেই-ই ধরতে পার।”

কনক উত্তেজিত হয়ে বলল, “ভদ্রলোক এমন অসভ্য কেন?”

“ওই রকমই।”

“আমার প্রপার কোয়ালিফিকেশান রয়েছে। আমার হাই সেকেন্ড ক্লাস।”

“আমার তো মনে হয় ফার্স্ট ক্লাস, সুপিরিয়র ক্লাস।” অনুকূলচন্দ্র চোখ মটকে হাসলেন, “যে পাবে বক্ষে ধারণ করবে।”

“ইয়ার্কি মারবেন না।…ভদ্রলোককে আমি ফেস করব। দেখি কি করে। আমি মামলা করব…”

“তুমি তো গাইতে টাইতেও পার!”

“তার সঙ্গে বটানি পড়াবার কি সম্পর্ক?”

“না, কিছু নয়। এমনি বললাম। মেয়েদের আর পাঁচটা গুণও তো ধরতে হয়।”

আশালতা এবার বলল, “তুই তো কী সুন্দর থিয়েটার করতে পারতিস। সেই যে একবার কি একটা বইয়ে যেন প্যান্ট কোট পরে সাহেবও সেজেছিলি। খুব বড় পার্ট…। কী সুন্দর মানিয়েছিল…”

কনক রীতিমত রেগে গিয়েছিল, বলল, “আমি কি এখানে থিয়েটার করতে এসেছি।”

অনুকূলচন্দ্র গভীর মনঃসংযোগে কি ভাবছিলেন, অন্তত সেরকম ভান করছিলেন। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে এবং ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বললেন, “ওই যে…”

আশালতা তাকালেন, কনকও তাকাল। কনক কিছু বুঝতে পারল না। সামান্য তফাতে কলেজ হোস্টেলের মাঠে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলছে।

অনুকূলচন্দ্র কনককে কাছে ডাকলেন। আঙুল দিয়ে দূরে একটি মানুষকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “ওই যে পাজামা পরে হেঁটে যাচ্ছে, গায়ে একটা গরমফঅসভ্য, ডার্টি। কাল একবার ফতুয়া…ওই লোকটাই কুসুম হালদার। ও হোস্টেলেই থাকে, সুপারিনটেনডেন্ট, আমি সিনিয়ার সুপারিনটেনডেন্ট বলে ফ্যামিলি কোয়ার্টার পেয়েছি। ও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিছু করে না। সব ঝক্কি আমায় বইতে হয়।…হতভাগা কি করে পায়চারি করছে দেখছ, যেন কত বড় ফিলজফার!”

কনক বিরক্ত চোখে দূরের মানুষটাকে দেখল। অসভ্য, ডার্টি। কাল একবার দেখে নেবে কনক ইন্টারভিউয়ের সময়। চাকরি হবে না—না হোক, চাকরির জন্যে তার গরজ নেই। নেহাত এখানে দিদি জামাইবাবু আছে, আর সদ্য সে পাশ করেছে, তাই চাকরি করার শখ হয়েছিল। লোকটাকে কাল শিক্ষা দিতে হবে।

কনক বলল, “আপনাদের বটানি বেহ্মচারীকে কাল আমি দেখে নেব।”

অনুকূলচন্দ্র হঠাৎ মুখ ফেরালেন, শালির দিকে তাকালেন, তারপর স্ত্রীর দিকে। চোখে মুখে একটা ফন্দি এবং চাপা হাসি ভেসে উঠছে। কনকের হাত ধরে ফেললেন, বললেন, “একটা কাজ করো না। কালকে হবে অফিসিয়াল ইন্টারভিউ, আজ একবার আনঅফিসিয়াল প্রিভিউ হয়ে যাক না। কুসুম একটু জব্দ হোক। একটা শিক্ষা দিয়ে দাও।” অনুকুলচন্দ্র বললেন।

তারপর কুসুম হালদারকে জব্দ করার যে ফন্দিটা মাথায় এসেছে তা শালি ও স্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন।

আশালতা বলতে লাগল, “না না, ছি ছি,—তোমার কি মাথা খারাপ। হোস্টেলে ছেলেগুলো রয়েছে। না…!”

কনকও মাথা নাড়তে লাগল। “যাঃ ফাজলামি আর কি। শেষ পর্যন্ত কেলেঙ্কারি হবে…না, ও আমি পারব না।”

আশালতা যতই না না করুক তাতে তেমন জোর ছিল না। তার আপত্তিটা কৃত্রিম কি না তাই বা কে জানে!

কনকও অবশেষে নিমরাজি হল। লোকটাকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার বলেই হয়তো।

অনুকূলচন্দ্র বললেন, “ঘাবড়াবার কিছু নেই, আমি তো রয়েছি, যথাসময়ে তোমায় উদ্ধার করব।”

কনক হেসে বলল, “করুন যা খুশি। আমি উঠলাম। যা শীত, স্নান করে রোদ পুইয়ে নিই গে।…তারপর খেয়ে দেয়ে নাক ডাকব; কাল গাড়িতে সারারাত জেগে।”

কনক ও আশালতা উঠে গেল।

দুই

রাত প্রায় আটটা হবে। হোস্টেলের দোতলার একেবারে এক-প্রান্তের একটি ছোট ঘরে কুসুম বিছানার কাছে হেলানো চেয়ারে পায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। বেশ শীত, জানলা প্রায় বন্ধই, দরজা আধ ভেজানো, মোটা একটা পরদা ঝুলছে দরজায়। কাল কলেজ হয়ে বড়দিনের ছুটি শুরু হবে। হোস্টেলে আজ খাওয়া দাওয়া হাসি তামাসার ধুম পড়েছে, বেশির ভাগ ছেলেই কাল দুপুর নাগাদ বাড়ি পালাবে। তারপর হোস্টেল ফাঁকা।

কুসুমের পিঠের দিকে টেবিল, টেবিলের ওপর কেরাসিন ল্যাম্প। কিছু বই কাগজপত্র, ঘড়ি, চায়ের কাপ টেবিলে। একপাশে একটা বইয়ের র‍্যাক, আলনা, উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে বেতের গোল টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত কাগজ।

দরজায় খুব মৃদু টক টক শব্দ হল, তারপর পরদা সরিয়ে একটি মুখ উঁকি দিল।

কুসুম মুখ তুলে তাকাল। “কে?”

পরদা সরিয়ে একটি মূর্তি প্রবেশ করল। গায়ে লম্বা গরম কোট—অনেকটা অলেস্টার মতন, গলা জড়িয়ে পুরু একটা মাফলার—বুকের কাছে একটা প্রান্ত ঝুলছে, কপাল-কান ঢাকা টুপি, মাথা দেখা যাচ্ছে না। পরনে পাজামা, না কি মালকোঁচা মারা ধুতি—কুসুম ঠিক বুঝতে পারল না। কোনও ছাত্র নয় যে তা বুঝে এবং চোখে চশমা ও বেশভূষার আড়ম্বর দেখে কুসুম যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল প্রথমটায়, তারপর পিঠ সোজা করে বসতে বসতে বলল, “কি চাই?”

আগন্তুক অতি ভক্তিভরে হাত তুলে কুসুমকে নমস্কার করল।

কুসুম নমস্কারের বিনিময়ে শুধু একটু মাথা নোয়াল। “কাকে চাই আপনার?”

মাফলারের প্রান্তটা মুখের কাছে ধরে যেন কাশি সামলাচ্ছে, কনক গলার স্বর লুকোবার চেষ্টা করে বলল, “প্রফেসর হালদারকে।”

কুসুম ঠিক বুঝল না, কানে কেমন যেন লাগল কথাটা। পিঠ আরও একটু সোজা করল। “আমিই প্রফেসার হালদার।”

“জানি।”

কুসুম সামনের মূর্তিটির আপাদমস্তক ভাল করে দেখার চেষ্টা করল। টেবিল বাতিটায় তেমন আলো হয় না। হাত বাড়িয়ে বাতির পলতে উসকে দিতেও কেমন সংকোচ হল।

“কি দরকার আপনার?” কুসুম খুব নজর করে মূর্তির পা দেখতে লাগল।

“বসব একটু?” অন্যপক্ষ বলল।

“বসুন।”

বইয়ের র‍্যাকের দিকটায় আবছা অন্ধকার যেখানে বেশ গাঢ় কনক সেখানে একটা চেয়ার টেনে বসল।

কুসুম অপেক্ষা করল কয়েক মুহূর্ত, বলল, “বলুন।”

“এখানে বড় ঠাণ্ডা। বেশ শীত।”

“হ্যাঁ। কি দরকার বলুন?”

“এ সময় গরম চা এক পেয়ালা পেলে…।”

“এখানে চায়ের ব্যবস্থা নেই।”

“টেবিলে কাপ দেখছি।”

“এটা কলেজ হোস্টেল, চায়ের দোকান নয়।”

“বললে চাকরে এনে দেবে না?”

কুসুমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাত বাড়িয়ে আলোটা যতটা পারল উজ্জ্বল করে দিল। দিয়ে ভাল করে কনককে দেখল। তারপর লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। “আপনি কে? এখানে কেন এসেছেন?”

কনক মুখ টিপে হাসল। বলল, “গলার স্বর ধরে চিনতে পারলেন বুঝি।”

“কে আপনি? কি দরকার?”

“বলছি, অত ব্যস্ত কেন!…এক পেয়ালা চা পেলে সত্যি বড় খুশি হতুম। গলায় যা ব্যথা…। এই ঠাণ্ডায়…”।

“বাড়াবাড়ি করছেন।”

“রাগ করছেন।…বসুন না আপনি। আমার খুব খারাপ লাগছে। না বসলে কি করে বলি।”

কি ভেবে কুসুম আবার বসল। “তাড়াতাড়ি বলুন।”

“আমার নাম কনক রায়। বটানি নিয়ে পাশ করেছি এবছর। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি। হাই সেকেন্ড ক্লাস। এখানে চাকরির দরখাস্ত দিয়েছি। কাল ইন্টারভিউ। আপনাকে একটু ধরতে…মানে এই সামান্য আলাপ-পরিচয় করে যেতে এসেছি।

কুসুম নাক দিয়ে শব্দ করল অদ্ভুত ধরনের, তারপর বলল, “এটা কলেজ নয়, হোস্টেল, ছেলেরা থাকে।”

“কেন, ছেলেরা কি বাঘ?”

“না…মানে এই চেহারায় এরকম পোশাক পরে…”

“মেয়ের পোশাকে রাত্তির বেলায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলে কি ভাল হত! ঢুকতে পেতাম ভেতরে!…পাঁচজনের চোখে পড়ত। এই পোশাকে কেউ বুঝবে না কিছু। চাকরবাকর তো দেখল আমায়, কেউ কিছু বলল না।…এক নজরে কি আমায় ধরা যায়—! আপনিও প্রথমে পারেননি।” কনক হাসল। সে মাথার টুপি খুলল, গলার মাফলারটাও সরাল। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, গলাটাও আটকে আসছে।

কুসুম কেমন চমকে গেল। কান পেতে বাইরের শব্দ শুনল, তারপর বলল, “হাসবেন না, জোরে জোরে কথাও বলবেন না। প্লিজ…!”

কনক চোখের কেমন এক ভঙ্গি করল। তারপর বলল, “আপনি আপনার ডিপার্টমেন্টে মেয়ে লেকচারার নেবেন না। তাই একটু বলতে এলুম।”

কুসুম এতক্ষণে খানিকটা ধাতে এসেছে, বলল, “কে বললে আপনাকে আমার ডিপার্টমেন্টে মেয়ে-লেকচারার নেওয়া হবে না?”

“শুনলাম। একজন বললেন।”

“তিনি কে?”

“নাম তো জানি না। আমি একজনের নামে চিঠি এনেছিলাম কলকাতা থেকে, তাঁরই জানাশোনা কোনও প্রফেসার আপনাদের কলেজেরই।”

কুসুম ঠোঁট কামড়ে যেন ভাবল। দু পলক দেখল কনককে, তারপর বলল, “আপনি এখানে ক্যানভাসিং করতে এসেছেন?”

“হ্যাঁ…না। সুপারিশ ঠিক নয়, রিকোয়েস্ট করতে এসেছিলাম। চাকরিটা আমার বড় দরকার। ঘাড়ে মস্ত বড় ফ্যামিলি।”

“কলকাতায় থাকেন?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“হরিশ মুখার্জি রোড-এ।”

“বাড়িতে কে কে আছেন?”

“মা বাবা ভাই বোন…সে অনেক, বড় সংসার।”

“আপনি ম্যারেড না আনম্যারেড?”

“দেখতেই পাচ্ছেন।”

“ভেজিটেবল সেল আর অ্যানিম্যাল সেল-এ তফাত কি?”

মানুষটা তার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছে নাকি। কনক যা যা ভেবে এসেছিল, এখানে এসে দেখছে তার বিপরীত হাওয়া বইছে। কোথায় কনক নেবে ‘আপার হ্যান্ড’—জামাইবাবু যা বলে দিয়েছিলেন, তা নয়—ওই কুসুমই এখন ‘আপার হ্যান্ড’ নিচ্ছে। ব্যাপার কী? এ মানুষ তো—জামাইবাবুর ব্যাখ্যা মতন গোরু বা ছাগল নয়, যথেষ্ট সেয়ানা।

“কী হল, জানেন না? জাল ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন নাকি চাকরি খুঁজতে!” কুসুম বিদ্রুপ করে বলল।

কনক চটে গেল। কোথাকার একটা পাটনার পাশ করা ছেলে তাকে বটানি বোঝাবে! আস্পর্ধা কত!

কনক বলল, “তফাত অনেক। যেমন আপনাতে আমাতে।”

কুসুম থ মেরে গেল। কোনও রকমে ঢোঁক গিলে বলল, “রসিকতা করছেন।”

“আপনিই করছেন। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে যা জানে তা আমায় জিজ্ঞেস করার মানে কি!”

“আপনার তো জাল ডিগ্রি।”

“জাল!”

“পোশাকের মতন।”

“তা হলে আমি বলব আপনি জোচ্চোর।”

কুসুম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। “কি বললেন?”

“বললাম আপনি জোচ্চোর।”

“বাঃ চমৎকার! কী ল্যাংগুয়েজ।…আপনি এসেছেন কলেজে চাকরি নিতে!”

“চাই না আপনার চাকরি।…এমন অসভ্য মানুষের আন্ডারে কোনও মেয়ে চাকরি করতে পারে না।…”

“আপনার মতন সভ্য মেয়েকেও কেউ চাকরি দেবে তা তো মনে হয় না।”

“থামুন। আমায় সভ্যতা শেখাবেন না। নিজে শিখুন।”

“আপনিও দয়া করে চেঁচাবেন না, এটা হোস্টেল।”

“আমি চেঁচাব।”

“লোকে অন্য রকম ভাববে!”

“কি!…” কনকের মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল দপ করে, “আপনি কী মিন করলেন?”

“তেমন কিছু না; আর পাঁচজনে যা ভাবতে পারে তাই বললুম।”

“অসভ্য, আনকালচার্ড কোথাকার…” কনক রাগে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে উঠে পড়ল। সে চলে যাচ্ছে।

কুসুম দু লাফে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, পথ আটকে দিল কনকের। “আরে, আরে…এভাবে যাচ্ছেন কি! মাথা ঠাণ্ডা করে যান। নীচে ছেলেরা রয়েছে। জানতে পারলে আমার যে চাকরি যাবে।”

“যাক। আপনার চাকরি যাওয়াই দরকার।”

“মাথার টুপিটা পরুন, চুল দেখা যাচ্ছে…। চুলের খুব বিউটি তো আপনার।”

“জংলি কোথাকার।”

“মাফলারটা আরও একটু গলার তলায় নামান, ওভারকোটের কলারটা তুলে বুক…সরি, ছাতি ঢেকে নিন। মানে আপনার…ছেলেগুলোর যা দৃষ্টি।”

“ইডিয়েট।” কনক রাগের মাথায় কুসুমকে ঠেলে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল।

কুসুম দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। এভাবে আপনি যেতে পারবেন না। মাথা ঠাণ্ডা করুন, যেমন ভাবে এসেছিলেন, সেইভাবে চুপি চুপি চলে যেতে হবে, যেন কেউ জানতে না পারে। আমায় বিপদে ফেলে আপনি পালাবেন, তা হবে না।”

অগত্যা কুসুম গরম টুপিটা মাথায় পরল, মাফলারটা গলায় জড়াল, কোর্টের কলার উঁচু করল। এইসব করতে করতে তার মুখে যা আসছিল কুসুমকে বলে যাচ্ছিল। বাঁদর, গোরু ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগেও কার্পণ্য ছিল না।

এমন সময় বারান্দায় পায়ের শব্দ। কুসুমের ঘরের দিকেই আসছে। কুসুম আতংকের একটা শব্দ করে দিশেহারা হয়ে কনককে খপ করে ধরে ফেলে টানতে টানতে বিছানার কাছে নিয়ে গেল। লুকিয়ে পড়ুন খাটের তলায়…কী সর্বনাশ! লুকিয়ে পড়ুন…বলতে বলতে সে টেবিল বাতিটাও নিবিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার।

খাটের তলায় আধখানা লুকোতে পেরেছে কনক, অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সে আঁতকে উঠে শব্দ করল।

কুসুম কনকের পাশে মাটিতে বসে ফিসফিস করে বলল, “চুপ।”

ঘর অন্ধকার এবং নিঃশব্দ।

বাইরে কে যেন কুসুমকে ডাকল। কুসুম বলল, “সর্বনাশ! অনুকূলদা…!”

কনকের বুক ধক করে উঠল, “জামাইবাবু।”

বাইরে অনুকূলচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কাশলেন।

জামাইবাবু বলেছিলেন, আমি আছি পেছনে—তুমি নির্ভয়ে এগিয়ে যাও। এই কি জামাইবাবুর পেছনে থাকা! কনক রাগে দুঃখে ভয়ে লজ্জায় ক্ষেপে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কুসুমের জামা ধরে কি যেন বলতে গেল, জামার বদলে কুসুমের চুলের গোছা তার মুঠোয় এল। বেশ করে ঝাঁকুনি দিয়ে কনক বলল, “এটা কি করলেন আপনি! হাঁদা, গাধা কোথাকার! ঘরের দরজা বন্ধ করে বাতি নিবিয়ে দিলেন যে, এখন কি হবে!…বাইরে জামাইবাবু!”

কুসুম বলল, “বড্ড লাগছে, চুল ছাড়ুন।”

“আপনি ঘরের দরজা বন্ধ করলেন কেন?”

“বন্ধ নয়, ভেজানো রয়েছে।”

“ন্যাকামি করবেন না…। অন্ধকার ঘর, দরজা ভেজানো, আমরা দুজন এখানে…এর কৈফিয়ত কি?”

“কৈফিয়ত দিতে হবে না!… নেক্সট চান্স-এ দেখবেন দরজায় খিল দেব।…প্লিজ! বিশ্বাস করুন। অনুকূলদা জানেন। প্রি-অ্যারেঞ্জড…”

কুসুম বোধ হয় হেসে ফেলল। কনক আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল। প্রি-অ্যারেঞ্জড!…ও, এই মতলব। অনুকূলচন্দ্রকে হাতের কাছে না পেয়ে কুসুমকেই আবার খামচে ধরল কনক। কুসুম যন্ত্রণায় শব্দ করে উঠল।

কনক বলল, “জোচ্চোর কোথাকার।”

কুসুম বলল, “জাল কাঁহাকার।”

তারপর দুজনেই কেন যেন হেসে উঠতে গিয়ে সামলে নিল। যদিও ওদের পরস্পরের চোখ মনে মনে পরস্পরকে হাসতে দেখছিল।

১৫ মে ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *