ইনস্পেক্টর রনি

ইনস্পেক্টর রনি

আমি বন্দুক সমেত ডানহাতটা সামনে টান-টান করে বাড়িয়ে ধরলাম। ছাড়া, লক্ষ করেছেন, হাতটা সামান্য কাঁপছে?’

ডক্টর মজুমদার আমার হাতটা ধরে সামান্য নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘কাঁধের জয়েন্টটা একবার চেক করে দিচ্ছি। আর সফ্টওয়্যারটা একটু ঠিকঠাক করে দিলেই কাঁপুনিটা থেমে যাবে।’

শুরু হল ডক্টর মজুমদারের খুঁটিনাটি চিকিৎসা। আমি চুপচাপ্ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখতে লাগলাম লেসার বন্দুক-ধরা হাতটা। কেমন অবাক লাগল। আমার শরীরের কোথায় কী একটা মাইক্রোপ্রসেসর রয়েছে, তার প্রোগাম সামান্য রদবদল করে দিলেই বন্দুক-ধরা হাতের কাঁপুনি থেমে যাবে। কী আশ্চর্য! অবশ্য এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর পক্ষে সবই সম্ভব। রোবটশাস্ত্র আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় দুনিয়া-জোড়া নাম। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ শুধু-শুধু এঁকে বিশাল অঙ্কের মাইনে দিয়ে রাখেনি। তা ছাড়া, এই যে আমি এখন বেঁচেবর্তে চলেফিরে বেড়াচ্ছি, তা একমাত্র ডক্টর মজুমদারের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। নইলে আমি এখন কোথায়! এক মারাত্মক অ্যাকসিডেন্টের পর এই মানুষটাই আমাকে জোড়াতালি দিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। এটা আমার দ্বিতীয় জীবন। আগের জীবনটা তেমন করে মনে পড়ে না।

প্রতি মাসে একবার করে আমি অভিজিৎ মজুমদারের কাছে চেক আপের জন্যে আসি। এখনও এসেছি সেইজন্যেই।

আমার কাঁধের কাছে ধাতব ঢাকনাটা খুলে ডক্টর মজুমদার কীসব করছিলেন। এসব কাজের সময় মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন তিনি। ফলে আমি কিছুই টের পাচ্ছিলাম না। বরং বিশ বাই তিরিশ মাপের বিশাল ঘরের বিচিত্র জিনিসগুলো দেখছিলাম।

ঘরটা অগোছালো। দেওয়ালে টাঙানো নানা ছবি। শরীরের বিভিন্ন হাড়ের গঠন, স্নায়ুবর্তনি, হাত-পায়ের নানারকম জয়েন্ট, আরও কত কী! এ ছাড়া, ঘরে ছড়ানো রয়েছে রাজ্যের ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট, সল্ডারিং আয়রন, তার, ধাতুর পাত, মাইক্রোপ্রসেসর কিট, আর দুটো কম্পিউটার। এর মধ্যে একটা লালবাজারে আমাদের হেড কোয়ার্টারে হোস্ট কম্পিউটারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে। ফলে এটাই ওঁর অফিস, এটাই ওঁর বাড়ি।

এখন রাত দশটা। ডক্টর মজুমদার আমাকে সাধারণত রাতেই আসতে বলেন। কারণ তখন ওঁর ল্যাবের আর সব লোকজন থাকে না। উনি জানেন, আমি নিরিবিলি পছন্দ করি।

হঠাৎই ডানহাতের সাড় ফিরে পেলাম। ডক্টর মজুমদার আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাথার মাঝখানটায় টাক, চারপাশে সাদা চুলে ঝালর। বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষটি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। বয়সের ভারে একটু নুয়ে গেছেন। ফরসা চামড়া তামাটে হয়ে গেছে। চোখের নীচে ভাঁজ পড়েছে। ঘিয়ে রঙের ঢোলা জামা, তার চেয়েও ঢোলা কালো প্যান্ট। কোমরে সেকেলে ঢঙের বেল্ট৷ এই আমার জীবনদাতা, ঈশ্বর।

‘নাও, রনি, এবারে ডানহাতটা নাড়াও দেখি—।’

ওঁর কথামতো কাজ করলাম। না, আর কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এই বৃদ্ধ নিশ্চয়ই জাদু জানেন।

ঘরের শেষপ্রান্তে এককোণে একটা চৌকো বোর্ডে অনেক কালো বৃত্তের ছবি—শুটিং টারগেট। বৃদ্ধ বললেন, ‘রেডি- ľ

আমি টারগেট বোর্ড লক্ষ্য করে লেসার বন্দুক উঁচিয়ে ধরলাম। এখান থেকে দূরত্ব ঊনতিরিশ ফুট। আমার ডিসট্যান্স মিটার সেইরকমই সংকেত জানাচ্ছিল আমাকে।

‘অন ইয়োর মার্ক—।’

আমার অপ্টো-ইলেকট্রনিক তীক্ষ্ণ চোখ টারগেটের ঠিক মাঝখানের কালো বিন্দুটাই শুধু দেখতে পাচ্ছিল।

তৎক্ষণাৎ ফায়ার করলাম—পাঁচ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে আঠেরোবার। ডক্টর মজুমদার হেসে বললেন, ‘দারুণ!’ তারপর রওনা হলেন টারগেট বোর্ডের দিকে। বোধহয় স্বচক্ষে দেখতে চান, সেখানে প্রতিবারের মতো শুধু একটাই ক্ষতচিহ্ন রয়েছে কি না।

‘ফায়ার—!’

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ডক্টর মজুমদারকে দেখতে লাগলাম। উনি টারগেটের ছাপা কাগজটা হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। বুল্স আইয়ের ফুটো দিয়ে আমাকে দেখতে-দেখতে মজা করে বললেন, “তোমার টিপ একেবারে যাচ্ছেতাই, রনি। আঠেরোবার ফায়ার করলে, আর টারগেটে একটাই মাত্র ফুটো!’

আমি কষ্ট করে হাসলাম। মুখের পেশিতে টান লাগছিল। ডক্টর মজুমদার মুখের সামনে থেকে কাগজের আড়াল সরিয়ে অবাক হয়ে আমার হাসি দেখলেন। বললেন, ‘বাঃ, তুমি দেখছি রসিকতা বুঝতে পারছ! জানো, একটা সত্যিকারের রোবট কখনও রসিকতা বুঝতে পারে না!’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘আমি যে আসলে কী, তা-ই আমি জানি না, ডক্টর—।

আমার মাথার মধ্যে কষ্ট হচ্ছিল। কতগুলো স্মৃতি হাঁকপাঁক করছিল ফিরে আসার জন্যে। কিন্তু কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না ওরা।

অভিজিৎ মজুমদার একটা টুলে বসে পড়ে গালে হাত দিলেন। চোখ বুজে কীসব চিন্তা করলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওসব কথা থাক, রনি। তুমি আমার কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। জানি, আমাকে তুমি হতাশ করবে না। একটু সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর পুরোনো কথা যখন যা মনে পড়বে, সব টেপ করে রাখবে—যেন কোনওরকম ভুল না হয়।’

এসব কথা উনি প্রায়ই বলেন। প্রতি মাসেই একবার করে শুনতে হয়। কিন্তু এতে কী লাভ, তা জানি না।

অভিজিৎ মজুমদার হঠাৎই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাছে এসে বললেন, ‘নাও, এবারে শেষ কাজটুকু হয়ে যাক—প্রশ্ন-উত্তরের খেলা।’ প্রত্যেকবারই সব পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে এই প্রশ্ন-উত্তরের পরীক্ষা দিতে হয় আমাকে। যদি আমার উত্তরে কোনও গোলমাল হয়, তা হলে উনি বুঝতে পারেন আমার ব্রেন সার্কিট ঠিকমতো কাজ করছে না। এই পরীক্ষায় পাশ করলেই আমার ছুটি।

‘তুমি কে?’ ডক্টর মজুমদারের প্রথম প্রশ্ন।

আমার ইলেকট্রনিক স্মৃতিকোষে রাখা যাবতীয় তথ্য গড়গড় করে আওড়ে গেলাম।

‘আমার নাম রনি সরকার। লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অপারেশন ডিভিশনের ইনস্পেক্টর।’ ‘তোমরা আর কে কে আছ?’ ‘কেউ নেই। আমি একা—।’ ‘আমি একা’ এই শব্দ দুটো আমার মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলে ঘোবাফেরা করতে লাগল অনেকক্ষণ। ‘তুমি থাকো কোথায় ?? ‘১৬৩ বিবেকানন্দ রোড, ব্লক-জি, ফ্ল্যাট নাম্বার ২৭২।’ ‘আমি তোমার কে হই?’ ‘আপনি, আপনি আমাকে প্রাণ দিয়েছেন। আপনি না থাকলে আমি…।’ বৃদ্ধ ধমক দিয়ে বললেন, ‘না, আমি তোমার বন্ধু। তোমার ভালো চাই।’ আমি ওঁর কথাগুলো আবৃত্তি করলাম, ‘আপনি আমার বন্ধু, আমার ভালো চান।’

ডক্টর মজুমদার হাসলেন, বললেন, ‘এই তো ভালোছেলের মতো কথা!’ তারপর কিছুক্ষণ আনমনে কী ভেবে বললেন, ‘তোমার গলার আওয়াজে সামান্য একটু মেটালিক নয়েজ রয়ে গেছে। ওটা কী করে বাদ দেওয়া যায় দেখি। পারলে পরের মাসের চেক আপের সময় ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের একটা কম্পিউটার বিপ-বিপ শব্দ তুলে ‘অন’ হয়ে গেল। হেড কোয়ার্টার থেকে কোনও খবর দেওয়ার থাকলেই এই কম্পিউটারটা চালু হয়ে যায়।

ডক্টর মজুমদার ব্যস্তভাবে ওটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ওঁর পায়ে ধাক্কা লেগে বসার টুলটা কাত হয়ে পড়ে গেল। মেঝেতে কিছু কাগজপত্র ছিল— সেগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। ততক্ষণে বৃদ্ধের অভিজ্ঞ হাত কি-বোর্ডের বোতাম টিপতে শুরু করেছে।

আমি ‘আসি, ডক্টর’ বলে বেরিয়ে আসছিলাম, ডক্টর মজুমদার ডাকলেন আমাকে, ‘হেড কোয়ার্টার থেকে তোমাকে চাইছে। ইমার্জেন্সি।’

আমি ভারী-ভারী পা ফেলে কম্পিউটারটার দিকে এগোলাম। লেসার বন্দুকটা ঊরুর লাগোয়া সিকিওরিটি চেম্বারে রেখে দিলাম। হেড কোয়ার্টার থেকে এত রাতে আবার কী ইমার্জেন্সি কল? আমি যে এখানে রুটিন চেক আপের জন্য আসছি সেটা অপারেশন ডিপার্টমেন্টের ওসি জানেন। কারণ খবর রেখে আসাটাই আমাদের রেওয়াজ।

কম্পিউটারের পরদার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক পুরোপুরি চালু হয়ে গেছে। কারণ, গোটা-গোটা হরফে ফুটে উঠেছে আমার কোড নম্বর আর নির্দেশ : এক্ষুনি আমাকে পৌঁছে যেতে হবে সল্টলেক সিটিতে, এই ব্লকের ৬৭ নম্বর বাড়িতে। উলটোডাঙা ভি. আই. পি. রোডের মুখে এ. এস. আই. বর্মন অপেক্ষা করবে। তার কোড নম্বরও ফুটে উঠল পরদায়। আমি যেন বর্মনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে যাই। যাওয়ার পথে বর্মন আমাকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে।

আমি সম্মতি জানিয়ে বোতাম টিপে আমার কোড নম্বর জানালাম এবং বললাম যে, এক্ষুনি রওনা হচ্ছি। তারপর শেষ বোতামটা টিপতেই কম্পিউটারের সব লেখা মুছে গেল পলকে।

ডক্টর মজুমদার আমার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘উইশ য়ু বেস্ট অফ লাক।’

আমি বেরিয়ে আসার আগে প্রতিভাবান বৃদ্ধ মানুষটিকে কয়েক মুহূর্ত দেখলাম। এই লোকটি ছাড়া আর কেউই আমাকে ভালোবাসে না। ওঁর চোখে আমি যেরকম স্নেহ-ভালোবাসা-মাখানো দৃষ্টি দেখি, আর কারও চোখে দেখি না। অথচ ভাসা-ভাসা মনে পড়ে, পুরোনো জীবনে আমি কী সুখীই না ছিলাম!

উলটোডাঙা ভি. আই. পি. রোডের গাড়িটা পার্ক করতেই সন্দীপ বর্মন কোথা থেকে এসে গাড়িতে উঠল। আমার গাড়ির মাথায় ঘুরপাক-খাওয়া লাল-নীল বাতি রয়েছে। সুতরাং গাড়িটা চিনে নিতে ওর অসুবিধে হয়নি। ওকে দেখেই সামনের সিটের দরজা খোলার অটোমেটিক বোতাম টিপে দিয়েছিলাম। লক্ষ করলাম, বর্মন একটু ইতস্তত করছে। বোধহয় আমার পাশে বসে পথ চলায় ওর পুরোপুরি সায় নেই। আমি জানি, সহকর্মীরা আমাকে একটু-আধটু এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু একসঙ্গে কাজ করতে গেলে আর উপায় কী! প্রথম-প্রথম আমার খারাপ লাগত, কিন্তু এখন মজা পাই।

সুতরাং বর্মনকে ডাকলাম, ‘আরে, কী ভাবছেন, উঠে আসুন জলদি—।’ বর্মন উঠে বসল আমার পাশে। গাড়ির দরজা কোনওরকম শব্দ না করেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে গেল আবার। ড্যাশ-বোর্ডের সেলুলার ফোন চালু করে হেড কোয়ার্টারে জানিয়ে দিলাম যে, বর্মন আমার গাড়িতে উঠে পড়েছে, আমরা আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সল্ট লেক সিটির নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছি।

বর্মনের চেহারা মোটার দিকে, তবে গায়ে জোর আছে। আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে যাওয়ার আগে প্রায় সাত সেকেন্ড টিকে ছিল। আগে কথায়-কথায় আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করত, পাঞ্জায় হেরে যাওয়ার পর থেকে আর করে না।

সন্দীপ বর্মনের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, থুতনিতে ভাঁজ, রগের চুলে নুনমরিচ। সিগারেট খাওয়ার ভীষণ নেশা ওর। গাড়ি চলতে শুরু করতেই লাইটার জ্বেলে ফস করে সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘সরকার, এটা দয়া করে বকে জানাবেন না।’

আমি ধাতব শব্দ করে হাসলাম। বললাম, ‘না, বলব না। কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? কোনও ইমার্জেন্সি কাজে?’

বর্মন ভুরু বাঁকিয়ে তাকাল আমার দিকে। বলল, ‘আমরা প্রফেসর রূপেশ কোঠারির বাড়ি যাচ্ছি। ওঁর এগেইনস্টে কিডন্যাপিংয়ের চার্জ আছে।’

আমি চমকে উঠলাম। প্রফেসর রূপেশ কোঠারি! আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। গত বছরে নোবেল পুরস্কারের তালিকায় তাঁর নাম উঠেছিল। হয়তো এবারে পেয়ে যাবেন। ওঁর ইউনিফায়েড জেনারেল থিয়োরি অব স্পেস-টাইম’কে বলা হয় গত সত্তর বছরের সেরা আবিষ্কার। কারণ একাত্তর বছর আগে ডিজিটাল কম্পিউটার আবিষ্কার করেছিলেন জন ভিনসেন্ট অ্যাটানাসফ ও ক্লিফোর্ড বেরি।

সেই রূপেশ কোঠারির বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ!

আমার মুখে অভিব্যক্তিগুলো ঠিকঠাক ফোটে না। সেটাই হয়তো বৰ্মন লক্ষ করছিল। দেখেছি, সহকর্মীরা সবসময় আমাকে কৌতূহলের চোখে দেখে। সন্দীপ বর্মন নির্বিকারভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। আমি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ অটোপাইলটের ওপরে ছেড়ে দিয়ে বর্মনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বললাম, ‘ব্যাপারটা খোলাখুলি জানতে পারি??

উত্তেজিত হলে আমার গলার স্বরে ধাতব ঝংকার বেড়ে যায়। অন্তত ডক্টর মজুমদারের বক্তব্য তাই। এখন গলাটা অনেকটা সেইরকম শোনাল বলেই মনে হল।

বর্মন এবারে মুখ খুলল। ওর কাছ থেকে গোটা গল্প শোনা গেল।

রূপেশ কোঠারি ও বিক্রম সেনগুপ্ত দুই নামজাদা বিজ্ঞানী, আর ছোটবেলাকার বন্ধুও বটে। পদার্থবিদ্যার গবেষণায় ডক্টর কোঠারির খ্যাতি রীতিমতো ঈর্ষা করার বিষয়। আর পাশাপাশি বিক্রম সেনগুপ্ত ভারতের একজন সম্মানিত বিজ্ঞানী হলেও, আন্তর্জাতিক আসরে কখনও রূপেশ কোঠারির মর্যাদা পাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁরা দুজনে যৌথভাবে গবেষণা করেছেন, দুজনের নামে বিদেশের পত্রপত্রিকায় কয়েকটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ওঁরা একটি চাঞ্চল্যকর তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন, তবে কে এর প্রধান আবিষ্কারক, তা নিয়ে দুজনের মধ্যে বেধে গিয়েছিল ঠান্ডা লড়াই।

মনে পড়ে গেল, তিনদিন আগেই টিভি, নিউজপেপারে এই বিতর্কের খবর প্রচার করা হয়েছে এবং বিক্রম সেনগুপ্ত আবিষ্কারের সিংহভাগ দাবি করেছেন। তিনি এও বলেছেন, অধ্যাপক কোঠারির বহু গবেষণাপত্রেই তাঁর অবদান রয়েছে। সোজা কথায়, কোঠারি তাঁর গবেষণার ফল আগে একাধিকবার আত্মসাৎ করেছেন।

কিন্তু এইবারে তিনি আর চুপ করে থাকতে পারেননি।

‘এ-ব্যাপারে রূপেশ কোঠারি কী বলছেন?’ আমি জানতে চাইলাম। সন্দীপ বর্মনের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেটা গাড়ির ডিসপোজাল বক্সে ফেলে দিয়ে বলল, ‘কী আবার বলবে, একই কথা। তিনি বলছেন, বহু ক্ষেত্রেই তিনি দয়া করে নিজের গবেষণায় বিক্রমকে ভাগ বসাতে দিয়েছেন। বিক্রম সেনগুপ্ত ব্যর্থ বিজ্ঞানী, অন্তত রূপেশ কোঠারির মতে।’

‘এর মধ্যে কিডন্যাপিং এল কোত্থেকে?’

বর্মন হাসল, বলল, ‘শুনলে আপনি হাসবেন। আজ রাতে ডক্টর কোঠারির বাড়িতে ডক্টর সেনগুপ্তের নেমন্তন্ন ছিল—সপরিবারে। সেনগুপ্তের স্ত্রী আলসারের রোগী, তাই নেমন্তন্নে যাননি। তবে সেনগুপ্ত তাঁর মেয়ে নিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোঠারির বাড়িতে। নিনির বয়স বছর বারো, ক্লাস সিক্সে পড়ে, লোরেটো— বউবাজারে। খাওয়াদাওয়ার শেষে নিনি নাকি ডক্টর কোঠারির ল্যাবরেটরি দেখতে চায়। বিক্রম সেনগুপ্ত তখন ড্রইংরুমে বসে কী একটা ম্যাগাজিন দেখছিলেন। রূপেশ কোঠারি নিজের বাড়িতেই বিশাল ল্যাবরেটরি করেছেন, সেটা আবার ড্রইংরুমের লাগোয়া। ফলে, বলতে গেলে একরকম সেনগুপ্তের চোখের সামনে দিয়েই নিনি আর কোঠারি ল্যাবে ঢুকেছে, কিন্তু ল্যাব থেকে ওরা কেউ বেরোয়নি। কয়েক মিনিট পরেই সেনগুপ্ত ল্যাবে গিয়ে দেখেন, সেখানে কোঠারি একা দাঁড়িয়ে একটা ইলেকট্রোম্যাগনেটের সামনে ঝুঁকে পড়ে কী যেন করছেন। নিনি নেই। ভোজবাজির মতো মেয়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!’

বুঝলাম—তারপরই হইচই, লালবাজারে টেলিফোন ইত্যাদি হয়েছে। রূপেশ কোঠারি প্রকাণ্ড মাপের বিজ্ঞানী, কিন্তু অভিযোগটাও তো নেহাত ছোট মাপের নয়।

বর্মনের কাছেই শুনলাম, ব্যাপারটা হেড কোয়ার্টারে পৌঁছয় সাড়ে আটটা নাগাদ। সঙ্গে-সঙ্গে তদন্তকারী দল হাজির হয়েছে ডক্টর কোঠারির আস্তানায়। সেই দলে বর্মনও ছিল।

ডক্টর সেনগুপ্ত কোঠারির বাড়িতেই ছিলেন। কোঠারি বিয়ে-থা করেননি। সুতরাং বাড়িতে দুজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ নেই। পুলিশ যতরকমভাবে সম্ভব জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ওঁদের, তবে যথারীতি ‘কোনও লাভ হয়নি। তারপর তারা হিমশিম খেয়ে গেছে দুই বিজ্ঞানীকে নিয়ে। আমি সমস্যাটার কথা অবাক হয়ে ভাবছিলাম। বললাম, ‘কিডন্যাপিংয়ের ব্যাপারে কোঠারি কী বলছেন?’

সল্টলেকের ভেতরে ফাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি হুহু করে ছুটছিল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাওয়া খেতে-খেতে বর্মন বলল, ‘কোঠারি বলছেন, নিনি একাই ল্যাব ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আর সেনগুপ্ত বলছেন, অসম্ভব। কারণ এক মুহূর্তের জন্যও ল্যাবের দরজা তাঁর চোখের আড়াল হয়নি। ব্যস!’

গাড়ির সেলুলার ফোন বিপ-বিপ করে বেজে উঠল। ফোন তুলে কানে দিলাম।

‘রনি সরকার বলছি— ‘

ওপাশ থেকে এ. সি. বিকাশ মিত্রের গলা শোনা গেল।

‘সরকার, আপনারা স্পটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছেন। বর্মন আপনাকে সব কথা হয়তো বলেছে, তবে সব খবর জানাতে পারলেও একটা ব্যাপার ও বলতে পারবে না। এই কেসে হঠাৎ আপনাকেই বা ডেকে পাঠানো হল কেন? সেটাই এখন আপনাকে জানাচ্ছি—আপনার জানা দরকার।’ চিফ একটু থেমে আবার বললেন, ‘নিনির উধাও হওয়ার পেছনে কোনও সায়েন্টিফিক মিস্ট্রি রয়েছে বলে আমার ধারণা। কোঠারির ল্যাবের সমস্ত ডিটেইল্স আমাদের চাই। আমি জানি, আপনার অপ্টো-ইলেকট্রনিক চোখে কিছুই এড়িয়ে যায় না। আর আমার এই ডিপার্টমেন্টে বিজ্ঞানের মারপ্যাঁচ আপনার চেয়ে ভালো কেউই বোঝে না। সুতরাং, বেস্ট অফ লাক।’

লাইন কেটে গেল।

সন্দীপ বর্মন একটা কথাও শুনতে পায়নি। ভুরু উঁচিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কে?’

আমি বললাম, ‘বসের ফোন।’

আর বারো সেকেন্ডের মধ্যেই ডক্টর রূপেশ কোঠারির বাড়িতে পৌঁছে গেলাম আমরা।

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক স্থাপত্যের বিশাল বাড়িটা দেখে মনেই হয় না, এ-বাড়িতে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। নিনিকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে তো?

দোতলার আধুনিক সুসজ্জিত ড্রইংরুমে ওঁদের দুজনকে পেলাম। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে দুটো সোফায় বসে। একজনের হাতে একটা ম্যাগাজিন। অন্যজন দেওয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপির প্রতিকৃতি দেখছেন। দেখেই বোঝা যায়, দুই বিজ্ঞানীর এখনও আড়ি রয়েছে, ভাব হয়নি।

আমাদের ঢুকতে দেখেই দ্বিতীয়জন ছেঁড়া স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে লাফিয়ে উঠলেন সোফা ছেড়ে। সন্দীপ বর্মনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘নিনিকে পাওয়া গেল, ইনস্পেক্টর?

ভদ্রলোক যেরকম উদ্গ্রীব এবং তাঁর মুখচোখ যেরকম উদ্ভ্রান্ত, তাতে সন্দেহ নেই, ইনিই বিক্রম সেনগুপ্ত। পরনে ছাই রঙের সাফারি স্যুট। কপাল বেশ বড়। মাথার চুল তেলতেলে, পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখ বড়-বড়, বুদ্ধিদীপ্ত। ভুরু ঘন এবং টানা। মুখে বয়সের সূক্ষ্ম ভাঁজ। কথা বলেন সামান্য টেনে-টেনে।

বর্মন বেশ গম্ভীর মুখে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

‘ইনস্পেক্টর রনি সরকার। আপনাদের কেসটা এখন ইনিই ইনভেস্টিগেট করবেন- ľ

রূপেশ কোঠারি ইতিমধ্যে হাতের ম্যাগাজিন নামিয়ে রেখেছেন টেবিলে। কৌতূহলী চোখে আমাকে লক্ষ করতে-করতে উঠে এসেছেন কাছে। স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন হ্যান্ডশেক করার জন্য।

সাধারণত আমি হ্যান্ডশেক ব্যাপারটা এড়িয়ে চলি। কিন্তু এখন এড়ানো গেল না। আড়ষ্টভাবে হ্যান্ডশেক করলাম। হাতের চাপ যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলাম একই সঙ্গে। তবুও লক্ষ করলাম, রূপেশ কোঠারির মুখে কিছুটা যন্ত্রণা ও বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছে।

ঘরে বেশ কয়েকটা সোফা ছিল। আলাপের পালা শেষ করে আমরা ছড়িয়েছিটিয়ে বসলাম সোফাগুলোয়। আমি যে-সোফাটায় বসলাম, সেটা মচমচ শব্দ করে উঠল। তবে তার বেশি কিছু হল না।

অধৈর্য বিক্রম সেনগুপ্তকে হাতের ইশারায় শান্ত হয়ে বসতে বললাম আমি। তারপর রূপেশ কোঠারিকে উদ্দেশ করে বললাম, ‘প্রফেসর কোঠারি, পুরো ব্যাপারটা আপনার মুখ থেকে আর একবার শুনব। প্লিজ, বিরক্ত হবেন না।’

কোঠারি শব্দ করে হাসলেন। ওঁকে বয়সের তুলনায় ছোট দেখাচ্ছিল। চনমনে চোখ। লম্বাটে মুখ। দাড়ি এমনভাবে কামিয়েছেন যে, এত রাতেও খোঁচাখোঁচা দাড়ি বেরোয়নি। সরু করে ছাঁটা গোঁফ। আর মাথার চুল প্রায় কদমছাঁট। পরনে সবুজ রঙের সরু চেক-কাটা বুশ শার্ট। সাদা টেরিকটের প্যান্টের ভেতরে গুঁজে পরেছেন।

কোঠারির গলার স্বর বেশ চমৎকার। ভদ্রলোক বিজ্ঞান না শিখে গান শিখলেও বোধহয় কেউকেটা হতে পারতেন। প্রায় ধারাবিবরণী দেওয়ার মতো করে নিনির উধাও হওয়ার ব্যাপারটা বলে গেলেন তিনি। ওঁর কথা বলার ফাঁকেফাঁকেই বিক্রম সেনগুপ্ত উত্তেজিত হয়ে বাধা দিয়ে উঠছিলেন, বর্মন কোনওরকমে তাঁকে নিরস্ত করে রাখল।

শুনছিলাম, আর বারো বছরের নিনির কথা ভাবছিলাম। মেয়েটা গেল কোথায়?

রূপেশ কোঠারির গল্পে নতুন আর কিছু পাওয়া গেল না। সুতরাং, বর্মনকে বিক্রম সেনগুপ্তের কাছে বসতে বলে ডক্টর কোঠারিকে নিয়ে এগোলাম ল্যাবরেটরির দিকে। বললাম, ‘চলুন প্রফেসর কোঠারি, আপনার ল্যাবরেটরিটা একবার দেখব— ‘

প্রফেসর কোঠারি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, যার অর্থ হল, ‘ল্যাবরেটরি দেখে আপনি কি কিছু বুঝবেন?’

আমি ওঁর তাকানোয় আমল দিলাম না। কোঠারি জানেন না, আমি ঘুরেঘুরে ওঁর ল্যাবরেটরি দেখা মানেই ল্যাবরেটরির প্রতিটি ইঞ্চি ধরা পড়ে যাবে আমার অপ্টো-ইলেকট্রনিক চোখে এবং রেকর্ড হয়ে যাবে ভিডিয়ো টেপে।

বর্মন আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলতে চাইল। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘কিছু বলবেন?’

ও তখনও ইতস্তত করছে দেখে বুঝলাম, দুই বিজ্ঞানী হাজির থাকায় ও ঠিক মুখ খুলতে পারছে না। আমি ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘জোরে বলার দরকার নেই, শুধু ঠোঁট নাড়লেই আমি বুঝতে পারব—।

বর্মনের বোধহয় খেয়াল নেই, আমি লিপ রিড করতে পারি। আমার কথায় ওর খেয়াল হল। শুধু ঠোঁট নেড়ে ও বলল, ‘আমরা ল্যাবরেটরি তন্নতন্ন করে দেখেছি, ওখানে কিছু নেই। তা ছাড়া, প্রত্যেকটা জানলায় শক্তপোক্ত গ্রিল লাগানো—।’

আমি হাত নেড়ে ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘ঠিক আছে।

তারপর কোঠারির সঙ্গে ঢুকে গেলাম ল্যাবরেটরিতে।

ল্যাবরেটরি আমি আগে অনেক দেখেছি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ডক্টর কোঠারির ল্যাব আমাকে চমকে দিল।

বিশাল মাপের ঘরে প্রচুর যন্ত্রপাতি। তার কোনও কোনওটার চেহারা যেমন প্রকাণ্ড, তেমনই কিম্ভূত। চেনা যন্ত্রের মধ্যে একটা পার্টিক্ল অ্যাকসিলারেটর আর একটা এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন স্পেট্রোমিটার চোখে পড়ল।

রূপেশ কোঠারির খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। সুতরাং ওঁকে ল্যাবরেটরি তৈরির টাকা দেওয়ার সংস্থার অভাব নেই। তা ছাড়া, বহু বিদেশি যন্ত্রপাতি তিনি স্রেফ উপহার হিসেবে পেয়েছেন।

আমি ল্যাবরেটরি দেখছিলাম আর মনে-মনে এ-পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের লজিকগুলো যাচাই করে দেখছিলাম। কোথায় গেল নিনি?

একটা বারো বছরের মেয়ে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলে চিন্তার ব্যাপার। আর এক্ষেত্রে যেহেতু ব্যাপারটা হয়েছে রূপেশ কোঠারির বাড়িতে, সেহেতু তাঁর দুশ্চিন্তা হওয়া উচিত আরও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় তাঁকে যেন বেশ নিশ্চিন্তই দেখাচ্ছে। হাসিখুশি, খোশমেজাজি। বরং বিক্রম সেনগুপ্তের হাবভাব অনেক স্বাভাবিক। ওইরকম একটা মেয়ে হারিয়ে গেলে যেরকম দুঃখ পাওয়ার কথা, যেরকম উদ্ভ্রান্ত হওয়ার কথা, ওঁকে দেখে ঠিক সেইরকম মনে হয়েছে। মেয়ে হারানোর কষ্ট বড় সাংঘাতিক। আমি জানি। আমারও একটা মেয়ে ছিল। কতই বা বয়স ছিল? সাত? আট? ঠিক মনে পড়ছে না।

রূপেশ কোঠারির কথায় সংবিৎ ফিরল। কোঠারি তখন বলছিলেন, ‘মিস্টার সরকার, বলুন, আমার ল্যাবের কী-কী দেখতে চান আপনি?’

একপাশের একটা টেবিলে নানান কাগজপত্রের স্তূপ পড়ে ছিল। আমি সেদিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বললাম, ‘প্রফেসর কোঠারি, ডক্টর সেনগুপ্তের সঙ্গে আপনার কী ঝামেলা আছে জানি না, তবে এটা বলতে পারি, একটা ছোট মেয়ে বোধহয় কোনও দোষ করেনি—। বেচারা কৌতূহলের বশে শুধুই আপনার ল্যাব দেখতে চেয়েছিল।’

প্রফেসর কোঠারি বেশ বিরক্তভাবে বললেন, ‘ভেবেছিলাম, আপনি বোধহয় অন্যদের তুলনায় বেশি ইনটেলিজেন্ট। এখন দেখছি, আমারই ভুল। কম করে হাজারবার আমি বলেছি যে, নিনির ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানি না। ল্যাব দেখতেদেখতে ও হঠাৎই এ-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে। তারপর কোথায় গেছে, সে আমি কী করে বলব!’

আমি টেবিলের কাছে গিয়ে কয়েকটা কাগজ উলটে পালটে দেখলাম। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘আপনার ল্যাবের যন্ত্রগুলোর বিষয়ে আমাকে একটু সহজ করে বুঝিয়ে বলুন—যদি আপনার কোনওরকম আপত্তি না থাকে।’

‘না, না, আপত্তির কী আছে?’ রূপেশ কোঠারি দু-দিকে দু-হাত ছড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন। ‘তবে, সবই কমপ্লিকেটেড অ্যাপারেটাস, কতটা সহজ করে বোঝাতে পারব জানি না।

শেষদিকে ওঁর কথার মধ্যে একটা অবজ্ঞার সুর ধরা পড়ল। আমি সেটা গায়ে মাখলাম না। কারণ আমার শরীরে লুকিয়ে রাখা অটো-রেকর্ডার শুরু থেকেই চালু হয়ে গেছে। যাবতীয় শব্দ ধরা পড়েছে সেই নিখুঁত যন্ত্রে। পরে সেই যন্ত্র প্লে-ব্যাক করে শোনা হবে বারবার। তারপর বিশেষজ্ঞরা তার চুলচেরা বিচার করবেন। সুতরাং যন্ত্রগুলোর বিবরণ বা কার্যপ্রণালী আমি না বুঝলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবে বোঝার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।

ডক্টর কোঠারি বলতে শুরু করলেন। যন্ত্রগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। তাঁর কথার মধ্যে নানান জটিল শব্দ উঁকি মারতে শুরু করল : স্পেস-টাইম কার্ভেচার, ট্যাকিয়ন অ্যাকসিলারেটর, এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন, রিলেটিভ রিলেটিভিটি, অ্যান্টিগ্র্যাভিটেশন, ফিথ ফোর্স এস্টিমেশন ইত্যাদি।

এইসব কথার ফাঁকে আমি টেবিলের কাগজপত্রগুলোই ঘাঁটছিলাম। যদি কোনওকিছুর হদিশ পাওয়া যায়! এর মধ্যে হঠাৎই বিক্রম সেনগুপ্ত ক্ষিপ্তভাবে ছিটকে এলেন ঘরের মধ্যে। চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ইনস্পেক্টর সরকার, এভাবে আপনি ওর কাছ থেকে কোনও কথা বের করতে পারবেন না। ও বড় শক্ত চিজ—।’

সঙ্গে-সঙ্গে সন্দীপ বর্মন এসে ঘরে ঢুকল। ও হাই তুলতেই তাকালাম হাতঘড়ির দিকে। রাত হয়েছে। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।

বর্মন তাড়াতাড়ি এসে প্রফেসর সেনগুপ্তের হাত ধরল, বলল, ‘প্লিজ প্রফেসর, ও-ঘরে চলুন। এরকম করলে ইনভেস্টিগেশনে অসুবিধে হবে— ‘

প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল দুজনের। তখন আমি বর্মনকে ইশারায় থামতে বললাম। ডক্টর সেনগুপ্তের সাফারি স্যুটে ভাঁজ পড়েছে, মাথার পরিপাটি চুল আর ততটা পরিপাটি নেই।

রূপেশ কোঠারি একটি যন্ত্রের পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাত নেড়ে কাল্পনিক ধুলো ঝাড়লেন চেক শার্ট থেকে। লম্বাটে মুখে সামান্য যেন মজার ছোঁয়া।

আমি বিক্রম সেনগুপ্তকে কাছে ডাকলাম। গলা নামিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘ড্রইংরুমে বসে আপনি এমন কিছুই শুনতে পাননি, যাতে ব্যাপারটার একটা আঁচ পাওয়া যায়! ভালোভাবে মনে করে দেখুন তো!’

ডক্টর সেনগুপ্ত মাথার চুল ঠিকঠাক করতে-করতে বললেন, ‘মনে করে নতুন কী আর বলব! সবই তো বলেছি—’ অসহায় চোখে বর্মনের দিকে তাকালেন তিনি।

আমার মাথার ভেতরে বিভিন্ন লজিক কাটাকুটি খেলছিল। রূপেশ কোঠারির চোখেমুখে সামান্য তাচ্ছিল্য, বিদ্রূপ—এইসব আরও উত্তেজিত করে তুলেছে বিক্রম সেনগুপ্তকে।

আমি ওঁকে জিগ্যেস করলাম, ‘আচ্ছা, প্রফেসর কোঠারি নিনির সঙ্গে কী কথা বলছিলেন? আপনি শুনতে পাননি কিছু?

সেনগুপ্ত বললেন, ‘পাব না কেন? পুলিশকে সেসব বলেওছি।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘নেহাতই মামুলি ছেলেমানুষি কথা।’

আমি বর্মনকে বললাম, ‘মিস্টার বর্মন, আপনি প্রফেসর কোঠারিকে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। আমরা একটু নিরিবিলি কথা বলব।’

সন্দীপ বৰ্মন ঠোঁট উলটে এমন একটা মুখের ভাব করল, যার অর্থ ঃ হুজুরের যা মর্জি।

ওরা চলে যাওয়ার পর সেনগুপ্তকে বললাম, ‘প্রফেসর, আপনার সেই মামুলি ছেলেমানুষি কথাগুলো এবারে আর-একবার বলুন, প্লিজ।

একটু সময় নিয়ে বিক্রম সেনগুপ্ত বোধহয় মনে-মনে গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘এই একবার শুনলাম নিনি বলছে, বাব্বাঃ, ঘরটা কত বড়! এতসব যন্ত্র দিয়ে কী হয়? উত্তরে রূপেশ বলল, বিজ্ঞানের নানারকম গবেষণার কাজ হয়। তারপর আরও কী কী বলেছিল, ভালো করে খেয়াল করিনি। আবার একসময় নিনির কথা কানে এল : কাকু, একটাও খেলার যন্ত্র নেই? তাতে রূপেশ বলল, আছে, এই তো—লুকোচুরি খেলার যন্ত্র। নিনি বলল, কই, দেখি—। তারপর আর কোনও কথা শুনতে পাইনি।’

আমি বললাম, ‘নিনিকে আপনি খুব ভালোবাসতেন?’

অবাক মারমুখী নজরে আমাকে দেখলেন ডক্টর সেনগুপ্ত। প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘ভালোবাসতেন? তার মানে? এখনও ভালোবাসি, ইন্সপেক্টর। ওকে আপনি যে করে হোক খুঁজে এনে দিন—প্লিজ…।’

শেষদিকে ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন। গলার স্বর ভেঙে গেল। হাত ঘষলেন চোখে।

আমার কষ্ট হচ্ছিল। শরীরের ভেতরে লজিক সার্কিটগুলো ঠিকঠাক কাজ করছিল। মনে হল, বিক্রম সেনগুপ্ত বড় অসহায়। নিনি অন্তর্ধান রহস্যের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ডক্টর রূপেশ কোঠারির আস্তিনের ভেতরে। কোঠারি পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু পিতৃস্নেহ সম্পর্কে ওঁর জ্ঞান স্রেফ শূন্য।

ডক্টর সেনগুপ্তকে বললাম, ‘আপনি ড্রইংরুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন—।’ বিক্রম সেনগুপ্ত চলে যেতেই ঘরে আমি একা, আর শুধু কতকগুলো জটিল যন্ত্র। এর মধ্যে সত্যিই কি কোনও লুকোচুরি খেলার যন্ত্র রয়েছে?

যন্ত্রগুলো একে-একে দেখতে-দেখতে আবার ফিরে গেলাম টেবিলের কাছে। কাগজপত্রগুলো দেখতে শুরু করলাম আবার।

খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে হঠাৎই একটা কাগজে নজর আটকে গেল আমার। সাদা কাগজে কালি দিয়ে চৌকোনা ঘর আঁকা রয়েছে একটা। সেই ঘরের ভেতরে কিছুটা দূরত্বে আঁকা রয়েছে দুটো বিন্দু। বিন্দু দুটোর মাঝামাঝি বরাবর একটা ভাঁজের দাগ রয়েছে। তা ছাড়া, ঘরের ছবিটার বাইরে ছোট মাপের কয়েকটা জ্যামিতিক ছবিও আঁকা রয়েছে।

কেন জানি না, ছবিটা দেখামাত্রই একটা বিদ্যুৎরেখা যেন ঝলসে উঠল মাথার ভেতরে। কাগজটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম ল্যাবের বাইরে। ড্রইংরুমের দরজায় উঁকি মেরে রূপেশ কোঠারিকে ডেকে নিলাম।

কোঠারি বেশ হাসিখুশি মেজাজে চটপটে পায়ে উঠে এলেন আমার কাছে। গালে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস, ইনস্পেক্টর—।’

আমি ওঁকে নিয়ে ল্যাবের প্রায় মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘প্রফেসর কোঠারি, আমি আপনার লুকোচুরি খেলার যন্ত্রটা দেখতে চাই—

টের পেলাম, কথাগুলো বলার সময় আমার গলায় ধাতব ঝংকার বেশ প্রকট হল।

আমার কথায় রূপেশ কোঠারি যেন খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। মুখের হাসিখুশি ভাবের ওপরে চকিতে কটা মলিন ছায়া নেমে এল। একটু সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘লুকোচুরি খেলার যন্ত্র? তার মানে?’

এইবার আমি ওঁর বাঁ-হাতটা চেপে ধরলাম। ওঁর গায়ের জোরকে সরাসরি উপেক্ষা করে ওঁকে ঠেলে বসিয়ে দিলাম ফোমের গদিওয়ালা একটা সুদৃশ্য টুলের ওপরে। বললাম, ‘ডক্টর কোঠারি, আপনার নাম দুনিয়া-জোড়া। সামনের বছরে নোবেল প্রাইজও পেতে পারেন। কিন্তু নিনিকে ফিরিয়ে না দিলে কি কাউকে মুখ দেখাতে পারবেন?’

কথা শেষ করে আমি ওঁকে হাতের ভাঁজ করা কাগজটা দেখালাম। বললাম, ‘আপনার মতো একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে কিডন্যাপার বলে ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। এই ব্যাপারটা জানাজানি হলে সবাই হয়তো বিক্রম সেনগুপ্তের অভিযোগগুলোই সত্যি বলে ধরে নেবে। ডক্টর সেনগুপ্তের বহু রিসার্চের ফল আপনি স্রেফ হজম করে নিজের নামে ছাপিয়েছেন, জালিয়াতি করে নাম কিনেছেন বিজ্ঞানীদের জগতে।’

রূপেশ কোঠারির মুখ ধীরে-ধীরে পালটে যাচ্ছিল। হাসির রেশটুকুও সেখানে আর নেই। এখন শুধু রাগ থমথম করছে। ডানহাত দিয়ে বাঁ-হাতের একটা জায়গা ম্যাসাজ করছিলেন। ওই জায়গাটাই একটু আগে আমি চেপে ধরেছিলাম।

রূপেশ কোঠারি ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন টুল ছেড়ে। হাত নেড়ে উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, ‘না ইনস্পেক্টর, রূপেশ কোঠারি আজ পর্যন্ত কোনওদিনও কারও রিসার্চে ফাঁকি দিয়ে ভাগ বসায়নি! আপনি জানেন, বিক্রমের জন্য আমি কী না করেছি! আর ও কিনা টিভি নিউজে আমার নামে যা-তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে!’

কথা বলতে-বলতে কোঠারি চলে গেলেন একটা দেওয়াল আলমারির কাছে। এক হ্যাঁচকায় তার পাল্লা খুলে একটা মোটা ফাইল বের করে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমার বায়োডেটা। মাধ্যমিক থেকে সব রেজাল্টই রয়েছে। কখনও সেকেন্ড হইনি। আর রিসার্চ পেপারের লিস্টটাও দেখুন।’

আমি ফাইলটা নিয়ে খুলে দেখলাম। সত্যিই, ভদ্রলোক অদ্বিতীয়। ওঁর সব গবেষণাপত্রই ছাপা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নামী জার্নালগুলোতে।

হাঁপাতে-হাঁপাতে কোঠারি বললেন, ‘বিক্রমের জন্য আমি অনেক করেছি। কিন্তু হিংসেয় ওর এখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমার নামে যাচ্ছেতাই কাদা ছেটাচ্ছে—

আমি ফাইলটা রেখে দিলাম টুলের ওপরে। বললাম, ‘আর তাইতেই আপনার মতো লোকেরও মাথা খারাপ হয়ে গেল?’

রূপেশ কোঠারি ফাইলটার ওপরেই ধপ করে বসে পড়লেন। মাথা ঝুঁকিয়ে দু-ভুরুর মাঝের অংশটা চেপে ধরলেন বাঁ-হাতে। মাথা নাড়লেন বারকয়েক। একটা চাপা শব্দও বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।

যখন মুখ তুললেন, তখন একেবারে ভাঙাচোরা মানুষ। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন ‘স্পেস-টাইম কার্ভেচার’ যন্ত্রটির দিকে। ভাঙা গলায় বললেন, ‘এটাই সেই লুকোচুরি খেলার যন্ত্র। নিনি এই ঘরেই আছে, অথচ আবার নেই। এই ঘরের স্পেসে একটা ভাঁজ তৈরি করে ওকে আমি লুকিয়ে ফেলেছি। রাগের মাথায় হঠাৎ যে কী হয়ে গেল…।’

কী বলতে-বলতে যন্ত্র চালু করে দিলেন তিনি। যন্ত্রের কয়েকটা বাতি জ্বলে উঠল। অসংখ্য ডিজিটাল মিটারে রিডিং পালটাতে লাগল খুব তাড়াতাড়ি। আমার শরীরের কয়েকটা সেন্সর সার্কিট হঠাৎই যেন একটা ঝটকা খেল। আর তারপরই…।

ল্যাবরেটরির মেঝেতে আবির্ভূত হল নিনি। পরনে কচি কলাপাতা রঙের সুন্দর কুচি-দেওয়া ফ্রক, তাতে সোনালি জরির কাজ। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে অঘোরে।

আমি আচমকাই ওর নাম ধরে ডেকে উঠলাম, ‘নিনি!’

হঠাৎই মনে পড়ল, আমার মেয়ের নাম ছিল টুসি। নিনির মতোই মিষ্টি নাম। মিষ্টি মেয়ে। নামটা আলতো করে উচ্চারণ করলাম, যাতে রেকর্ড হয়ে যায়। এটা শুনলে অভিজিৎ মজুমদার খুশি হবেন।

বোধহয় আমার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন বিক্রম সেনগুপ্ত। তিনি প্রায় ছুটেই ঢুকে পড়লেন ঘরের মধ্যে। নিনিকে দেখে পাগলের মতো মেয়ের নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর ঘুমন্ত মেয়েকে আদর করতে লাগলেন। মনে হচ্ছিল, চারঘণ্টা নয়, চার যুগ পরে বিক্রম সেনগুপ্ত মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন। ওঁদের দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। আমার চোখে হয়তো জল আসত, কিন্তু এল না। কারণ, আমার শরীরে ল্যাক্রিম্যাল গ্ল্যান্ডগুলো বসানো হয়নি। অভিজিৎ মজুমদার এখনও বসাতে দেননি। ওগুলো না থাকলে চোখের জল তৈরি হয় না।

নিনির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ওর চোখ ফোলা। হয়তো কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জেগে উঠেই ও ‘বাপি’ বলে ডেকে উঠল। জড়িয়ে ধরল বাবাকে। ডক্টর সেনগুপ্তের পিছন-পিছন ঘরে ঢুকেছিল সন্দীপ বর্মন। আচমকা নিনিকে দেখে ও কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ইনস্পেক্টর সরকার, কী ব্যাপার?’

আমি বললাম, ‘পরে বলছি—।’

রূপেশ কোঠারি ইতিমধ্যে বন্ধুর কাছে চলে এসেছেন। নিনির মাথায় আদর করে চুমু খেলেন একটা।

বিক্রম সেনগুপ্ত মেয়েকে কোল থেকে নামাতেই কোঠারি ‘বিক্রম!’ বলে বন্ধুকে একেবারে বুকে জাপটে ধরলেন। বললেন, ‘আমার মাথার মধ্যে একটা অমানুষ ঢুকে পড়েছিল। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

কোঠারির কণ্ঠস্বরে বেদনা ছিল। চোখ চিকচিক করছে। ওঁর অনুশোচনা মিথ্যে নয়। ডক্টর সেনগুপ্ত কোঠারির ডাকে সাড়া দিলেন। বললেন, “নিনিকে ফিরে পেয়েছি, তাই যথেষ্ট। তোমার ওপরে আমার আর কোনও রাগ নেই। শুধু তুমি নও, ভুল আমিও করেছি। তোমার মতো বন্ধুকে হিংসে করাটা আমার অন্যায় হয়েছে। গবেষণার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমার কোনও তুলনাই চলে না।’

এবারে আমার আর বর্মনের বিদায়ের পালা।

বিক্রম সেনগুপ্ত তাঁর সমস্ত অভিযোগ ফিরিয়ে নিলেন।

নিনি বলল, ‘বাপি, বাড়ি চলো, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’

সন্দীপ বর্মন আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমারও ইনস্পেক্টর সরকার। চলুন, এবারে যাওয়া যাক—

আমরা বেরিয়ে এলাম রূপেশ কোঠারির বাড়ি ছেড়ে। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। টেলিফোন করে হেডকোয়ার্টারে জানিয়ে দিলাম, কাজ শেষ। নিনিকে পাওয়া গেছে, আর ডক্টর সেনগুপ্ত সব অভিযোগ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

সন্দীপ বৰ্মন একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ‘বসকে বলবেন না।’ তারপর ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে হাই তুলল একটা।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল আমাদের। বর্মন বোধহয় বুঝল, আমি নিজে থেকে মুখ খুলব না। তখন বাঁকা সুরে জিগ্যেস করল, ‘নিনিকে কী করে পাওয়া গেল, সেটা জানতে পারি কি?’

আমার হাসি পেল। কয়েক ঘণ্টা আগে রূপেশ কোঠারির বাড়ি যাওয়ার পথে বর্মন আমাকে উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখতে চেয়েছিল। এখন দান উলটে গেছে। কোঠারির ল্যাব থেকে পাওয়া চৌকোণা ঘর-আঁকা কাগজটা আমার কাছেই ছিল। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ অটোপাইলটের ওপরে ছেড়ে দিয়ে কাগজটা সমান করে পেতে নিলাম কোলের ওপরে। তারপর ড্যাশ-বোর্ডের খুদে ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে বর্মনকে বললাম, ‘এটা ভালো করে দেখুন—।’

সন্দীপ বর্মন ছবিটার ওপরে ঝুঁকে পড়ল।

আমি বলতে শুরু করলাম, ‘এই চৌকোনা ঘরটা একটা টু ডাইমেনশান ওয়ার্ল্ড—দ্বিমাত্রিক জগৎ। তার মধ্যে এই ফুটকি দুটো হচ্ছে, ধরে নিন, দ্বিমাত্রিক জগতের দুটি প্রাণী। এরা কাগজের গায়ে লেপটে ঘুরে বেড়ায় এই চৌকোনো ঘরে চৌহদ্দির মধ্যে। চৌহদ্দির লাইনগুলোই হচ্ছে ওদের কাছে দেওয়াল। কিন্তু আপনি বা আমি হচ্ছি ত্রিমাত্রিক জগতের জীব। আমরা যে কেউই ইচ্ছেমতো একটা দ্বিমাত্রিক প্রাণীকে তুলে নিয়ে আসতে পারি আমাদের জগতে। তার জন্যে ওদের দেওয়াল টপকানোর দরকার নেই—স্রেফ ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেই হল। সুতরাং দ্বিমাত্রিক জগতের প্রাণীকে কোনও ঘর থেকে দেওয়াল না ভেঙে কিডন্যাপ করতে গেলে ত্রিমাত্রিক জগতের তৃতীয় মাত্রা বা থার্ড ডাইমেনশনের দিক থেকে এগোতে হবে। এ ছাড়া, আর একভাবে ব্যাপারটা হতে পারে…।’

বর্মন সিগারেটে টান দিচ্ছিল ঘন-ঘন। কাগজটা একমনে দেখছিল। আমার কথার খেই ধরে বলে উঠল, ‘কাগজটা ভাঁজ করে?’

আমি হাসতে চেষ্টা করলাম। মুখের পেশিতে টান লাগল। বললাম, ‘ঠিক তাই। এই দুটো ফুটকির মাঝ-বরাবর কাগজটা ভাঁজ করে দিলে একটা ফুটকি আর একটা ফুটকিকে সরাসরি দেখতে পাবে না। কিন্তু এই ভাঁজটা করতে হবে ত্রিমাত্রিক জগতের মধ্যে দিয়ে। কারণ, তখন কাগজটা আর নিছক দ্বিমাত্রিক সমতল থাকছে না— ভাঁজ হয়ে গেছে। রূপেশ কোঠারি ঠিক একইভাবে ওঁর ল্যাবের স্পেসে একটা ভাঁজ তৈরি করে ফেলেছিলেন—ওই ‘স্পেস-টাইম কার্ভেচার’ মেশিন দিয়ে। ন্যাচারালি, ভাঁজটা করতে হয়েছে ফোর্থ ডাইমেনশনাল স্পেসের মধ্যে দিয়ে। আর স্পেস-টাইম নিয়ে ওঁর গবেষণা তো বলতে গেলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস—

নির্জন অন্ধকার পথ ধরে গাড়ি ছুটছিল। বর্মনের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে ও বলল, ‘সরকার, নিনি মেয়েটা বেশ লাকি। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও, ওই যে ফোর্থ ডাইমেনশনাল স্পেস না কী বললেন, ওখান থেকে দিব্যি বেড়িয়ে এল—।’

আমি নিনির কথা ভাবলাম। তারপরই মনে পড়ল টুসির কথা। টুসি এখন কোথায়! ওর মিষ্টি মুখটা যে এখনও আমার মাঝে-মাঝে মনে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *