ইঁদারায় গন্ডগোল
গাঁয়ে একটা মাত্র ভালো জলের ইঁদারা। জল যেমন পরিস্কার, তেমনি সুন্দর মিষ্টি স্বাদ, আর সে জল খেলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়।
লোহা হজম হওয়ার কথাটা কিন্তু গল্প নয়। রামু বাজিকর সেবার গোবিন্দপুরের হাটে বাজি দেখাচ্ছিল। সে জলজ্যান্ত পেরেক খেয়ে ফেলত, আবার উগরে ফেলত। আসলে কি আর খেত! ছোট-ছোট পেরেক মুখে নিয়ে গেলার ভান করে জিভের তলায় কি গালে হাপিস করে রেখে দিত।
তা রামুর আর সেদিন নেই। বয়স হয়েছে। দাঁত কিছু পড়েছে, কিছু নড়েছে। কয়েকটা দাঁত শহর থেকে বাঁধিয়ে এনেছে। তো, সেই পড়া নড়া আর বাঁধানো দাঁতে তার মুখের ভিতর এখন বিস্তর ঠোকাঠুকি গন্ডগোল। কোনও দাঁতের সঙ্গে কোনও দাঁতের বনে না। খাওয়ার সময়ে মাংসের হাড় মনে করে নিজের বাঁধানো দাঁতও চিবিয়ে ফেলেছিল রামু। সে অন্য ঘটনা। থাকগে।
কিন্তু এইরকম গন্ডগোলে মুখ দিয়ে পেরেক খেতে গিয়ে ভারী মুশকিলে পড়ে গেল সেবার। পেরেক মুখে অভ্যেস মতো এক গ্লাস জল খেয়ে সে বক্তৃতা করছে। ‘পেরেক তো পেরেক, ইচ্ছে করলে হাওড়ার ব্রিজও খেয়ে নিতে পারি। সেবার গিয়েওছিলাম খাব বলে। সরকার টের পেয়ে আমাকে ধরে জেলে পোরার উপক্রম। তাই পালিয়ে বাঁচি।’
বক্তৃতা করার পর সে আবার যথানিয়মে ওয়াক তুলে ওগরাতে গিয়ে দেখে, পেরেক মুখে নেই একটাও। বেবাক জিভের তলা আর গালের ফাঁক থেকে সাফ হয়ে জলের সঙ্গে পেটে সেঁধিয়েছে।
টের পেয়েই রামু ভয় খেয়ে চোখ কপালে তুলে যায় আর কি। পেটের মধ্যে আট-দশটা পেরেক। সোজা কথা তো নয়। আধঘণ্টার মধ্যে পেটে ব্যথা, মুখে গাঁজলা, ডাক্তার-কবিরাজ এসে দেখে বলল, ‘অন্ত্রে ফুটো, পাকস্থলীতে ছ্যাঁদা, খাদ্যনালি লিক, ফুসফুস ফুটো হয়ে বেলুনের মতো হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছে, আশা নেই।’
সেই সময়ে একজন লোক বুদ্ধি করে বলল, ‘পুরোনো ইঁদারার জল খাওয়াও।’
ঘটিভরা সেই জল খেয়ে রামু আধ-ঘণ্টা খানেকের মধ্যে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যিই লোহা হজম হয়ে গেছে।
ইাঁদারার জলের খ্যাতি এমনিতেই ছিল, এই ঘটনার পর আরও বাড়ল। বলতে কী, গোবিন্দপুরের লোকের এই ইঁদারার জল খেয়ে-খেয়ে কোনও ব্যামোই হয় না।
কিন্তু ইদানীং একটা বড় মুশকিল দেখা দিয়েছে। ইঁদারায় বালতি বা ঘটি নামালে দড়ি ছিঁড়ে যায়। দড়ি সবসময়ে যে ছেঁড়ে, তাও নয়। অনেক সময়ে দেখা যায়, বালতির হাতল থেকে দড়ির গিঁট কে যেন সযত্নে খুলে নিয়েছে। কিছুতেই জল তোলা যায় না। যতবার দড়ি-বাঁধা বলতি নামানো হয়, ততবারই এক ব্যাপার।
গাঁয়ের লোকেরা বুড়ো পুরুতমশাইয়ের কাছে গিয়ে পড়ল। ‘ও ঠাকুরমশাই, বিহিত করুন।’
ঠাকুরমশাই মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন। দু:খের সঙ্গে বললেন, ‘ভায়ারা, দড়ি তো দড়ি, আমি লোহার শেকলে বেঁধে বালতি নামালাম, তো সেটাও ছিঁড়ে গেল। তার ওপর দেখি, জলের মধ্যে সব হুলস্থলু কাণ্ড হয়েছে। দেখেছ কখনো, ইঁদারার জলে সমুদ্রের মতো ঢেউ ওঠে? কাল সন্ধেবেলায় দেখলাম নিজের চক্ষে। বলি, ও ইঁদারার জল আর কারো খেয়ে কাজ নেই।
পাঁচটা গ্রাম নিয়ে হরিহর রায়ের জমিদারি। রায়মশাই বড় ভালো মানুষ। ধর্মভীরু, নিরীহ, লোকের দু:খে বোঝেন।
গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকেরা তাঁর দরবারে গিয়ে হাজির।
রায়মশাই কাছারি ঘরে বসে আছেন। ফরসা, নাদুস-নুদুস চেহারা। নায়েবমশাই সামনে গিয়ে মাথা চুলকে বললেন, ‘আজ্ঞে গোবিন্দপুরের লোকেরা সব এসেছে দরবার করতে।’
রায়মশাই মানুষটা নিরীহ হলেও হাঁকডাক বাঘের মতো। রেগে গেলে তাঁর ধারেকাছে কেউ আসতে পারে না। গোবিন্দপুর গাঁয়ের লোকেদের ওপর তিনি মোটেই খুশি ছিলেন না। তাঁর সেজো ছেলের বিয়ের সময় অন্যান্য গাঁয়ের প্রজারা যখন চাঁদা তুলে মোহর বা গয়না উপহার দিয়েছিল, তখন এই গোবিন্দপুরের নচ্ছার লোকেরা একটা দুধেল গাই দড়ি বেঁধে টানতে-টানতে নিয়ে এসে এক গাল হেসে, নতুন বউয়ের হাতে সেই গরু-বাঁধা দড়ির একটা প্রান্ত তুলে দিয়েছিল।
সেই থেকে রায়মশাইয়ের রাগ। গরুটা যে খারাপ, তা নয়। রায়মশাইয়ের গোয়ালে এখন সেইটেই সবচেয়ে ভালো গোরু। দু-বেলায় সাত সের দুধ দেয় রোজ। বটের আঠার মতো ঘন আর মিষ্টি সেই দুধেরও তুলনা হয় না। কিন্তু বিয়ের আসরে গোরু এনে হাজির করায় চারদিকে সে কী ছি-ছিছিক্কার। আজও সেই কথা ভাবলে রায়মশাই লজ্জায় অধোবদন হন। আবার রাগে রক্তবর্ণও হয়ে যান।
সেই গোবিন্দপুরের লোকেরা দরবার করতে এসেছে শুনে, রায়মশাই রাগে হুহুংকার ছেড়ে বলে ওঠেন, ‘কী চায় ওরা?’
সেই হুংকারে নায়েবমশাই তিন হাত পিছিয়ে গেলেন, প্রজারা আঁতকে উঠে ঘামতে লাগল, স্বয়ং রায়মশাইয়ের কোমরের কষি পর্যন্ত আলগা হয়ে গেল।
গোবিন্দপুরের মাতব্বর লোক হলেন পুরুত চক্কোত্তিমশাই। তাঁর গালে সব সময়ে আস্ত একটা হত্তুকি থাকে। আজও ছিল। কিন্তু জমিদারমশাইয়ের হুংকার শুনে একটু ভিরমি খেয়ে ঢোঁক গিলে সামলে ওঠার পর হঠাৎ টের পেলেন, মুখে হত্তুকিটা নেই। বুঝতে পারলেন, চমকানোর সময়ে সেটা গলায় চলে গিয়েছিল, ঢোঁক গেলার সময়ে গিলে ফেলেছেন।
আস্ত হত্তুকিটা পেটে গিয়ে হজম হবে কিনা কে জানে! একটা সময় ছিল, পেটে জাহাজ ঢুকে গেলেও চিন্তা ছিল না! গাঁয়ে ফিরে পুরোনো ইঁদারার এক ঘটি জল ঢকঢক করে গিলে ফেললেই জাহাজ ঝাঁঝরা। বামুন-ভোজনের নেমতন্নে গিয়ে, সেবার সোনারগাঁয়ে দু-বালতি মাছের মুড়ো-দিয়ে রাঁধা ভাজা সোনামুগের ডাল খেয়েছিলেন, আরেকবার সদিপিসির শ্রাদ্ধপ্রাশনে দেড়খানা পাঠার মাংস, জমিদারমশাইয়ের সেজো ছেলের বিয়েতে আশি টুকরো পোনা মাছ, দু-হাঁড়ি দই আর দু-সের রসগোল্লা। গোবিন্দপুরের লোকেরা এমনিতেই খাইয়ে। তারা যেখানে যায়, সেখানকার সবকিছু খেয়ে প্রায় দুর্ভিক্ষ বাধিয়ে দিয়ে আসে। সেই গোবিন্দপুরের ভোজনপ্রিয় লোকদের মধ্যে চক্কোত্তিমশাই হলেন চ্যাম্পিয়ন! তবে এসব খাওয়া-দাওয়ার পিছনে আছে পুরোনো ইঁদারার স্বাস্থ্যকর জল। খেয়ে এসে জল খাও। পেট খিদেয় ডাকাডাকি করতে থাকবে।
সেই ইঁদারা নিয়েই বখেরা। চক্কোত্তিমশাই হত্তুকি গিলে ফেলে ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। হত্তুকি এমনিতে বড় ভালো জিনিস। কিন্তু আস্ত হত্তুকি পেটে গেলে হজম হবে কিনা সেইটেই প্রশ্ন। পুরোনো ইঁদারার জল পাওয়া গেলে হত্তুকি নিয়ে চিন্তা করার প্রশ্নই ছিল না।
চক্কোত্তিমশাই করজোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘রাজামশাই, আমাদের গোবিন্দপুর গাঁয়ের পুরোনো ইঁদারার জল বড় বিখ্যাত। এতকাল সেই জল খেয়ে কোনও রোগ-বালাই আমরা গাঁয়ে ঢুকতে দিইনি। কিন্তু বড়ই দু:খের কথা, ইঁদারার জল আর আমরা তুলতে পারছি না।’
রায়মশাই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, ‘হবে না? পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার ছেলের বিয়েতে যে বড় গরু দিয়ে আমাকে অপমান করেছিলে?’
চক্কোত্তিমশাই জিভ কেটে বললেন, ‘ছি-ছি, আপনাকে অপমান রাজামশাই? সেরকম চিন্তা আমাদের মরণকালেও হবে না। তাছাড়া ব্রাহ্মণকে গো-দান করলে পাপ হয় বলে কোনও শাস্ত্রে নেই। গো-দান মহা পূণ্য কর্ম।’
রায়মশায়ের নতুন সভাপণ্ডিত কেশব ভট্টাচার্যও মাথা নেড়ে বললেন, ‘কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।’
রায়মশাই একটু নরম হয়ে বললেন, ‘ইঁদারার কথা আমিও শুনেছি। সেবার আমায় গোবিন্দপুর থেকে পুরোনো ইঁদারার জল আনিয়ে খাওয়ানো হয়। খুব উপকার পেয়েছিলাম। তা, সে ইঁদারা কি শুকিয়ে গেছে নাকি?’
চক্কোত্তিমশাই ট্যাঁক থেকে আর একটা হত্তুকি বের করে লুকিয়ে মুখে ফেলে বললেন, ‘আজ্ঞে না। তাতে এখনো কাকচক্ষু জল টলটল করছে। কিন্তু সে জল হাতের কাছে থেকেও আমাদের নাগালের বাইরে। দড়ি বেঁধে ঘটি-বালতি যা-ই নামানো যায় তা আর ওঠানো যায় না। দড়ি কে যেন কেটে নেয়, ছিঁড়ে দেয়। লোহার শিকলও কেটে দিয়েছে।’
রক্তচক্ষে রায়মশাই হুংকার দিলেন, ‘কার এত সাহস?’
এবার হুংকার শুনে গোবিন্দপুরের লোকেরা খুশি হল। নড়ে-চড়ে বসল। মাথার ওপর জমিদারবাহাদুর থাকতে ইঁদারার জল বেহাত হবে, এ কেমন কথা!
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘আজ্ঞে, মানুষের কাজ নয়। এত বুকের পাটা কারো নেই। গোবিন্দপুরের লেঠেলদের কে না চেনে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মাথার ওপর আপনিও রয়েছেন। লেঠেলদের এলেমে না কুলোলে আপনি শাসন করবেন। কিন্তু এ কাজ যাঁরা করছেন, তাঁরা মানুষ নন। অশরীরী।’
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উপমা শুনে একটু রেগে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অশরীরীর কথা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে কানে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলেন রায়মশাই, ‘ওরে, বলিস না, বলিস না।’
সবাই তাজ্জব।
নায়েবমশাই রোষকষায়িত লোচনে গোবিন্দপুরের প্রজাদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘মুখ সামলে কথা বলো।’
চক্কোত্তিমশাই ভয়ের চোটে দ্বিতীয় হত্তুকিটাও গিলে ফেলতে-ফেলতে অতি কষ্টে সামাল দিলেন।
রায়মাশাইয়ের বড় ভূতের ভয়। পারতপক্ষে তিনি ও নাম মুখেও আনেন না, শোনেনও না। কিন্তু কৌতুহলেরও তো শেষ নেই। খানিকক্ষণ কান হাতে চেপে রেখে, খুব আস্তে একটুখানি চাপ খুলে বললেন, ‘কী যেন বলছিলি?’
চক্কোত্তিমশাই উৎসাহ পেয়ে বলেন, ‘আজ্ঞে সে এক অশরীরী কাণ্ড। ভূ—’
‘বলিস না! খর্বদার বলছি, বলবি না!’ রায়বাবু আবার কানে হাত চাপা দেন।
চক্কোত্তিমশাই বোকার মতো চারদিকে চান। সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করে। নায়েবমশাই ‘চোপ!’ বলে একটা প্রকাণ্ড ধমক মারেন।
একটু বাদে রায়বাবু আবার কান থেকে হাতটা একটু সরিয়ে বলেন, ‘ইঁদারার জলে কী যেন?’
চক্কোত্তিমশাই এবার একটু ভয়ে-ভয়েই বলেন, ‘আজ্ঞে সে এক সাঙ্ঘাতিক ভূতুড়ে ব্যাপার!’
‘চুপ কর, চুপ কর! রাম-রাম-রাম-রাম!’
বলে আবার রায়বাবুর কানে হাত। খানিক পরে আবার তিনি বড়-বড় চোখ করে চেয়ে বলেন, ‘রেখে ঢেকে বল।’
‘আজ্ঞে, বালতি-ঘটির সব দড়ি তেনারা কেটে নেন। শেকল পর্যন্ত ছেঁড়েন। তাছাড়া ইঁদারার মধ্যে হাওয়া বয় না, বাতাস দেয় না, তবু তালগাছের মতো ঢেউ দেয়, জল হিলিবিলি করে ফাঁপে!’
‘বাবা রে!’ বলে রায়বাবু চোখ বুজে ফেলেন।
ক্রমে-ক্রমে অবশ্য সবটাই রায়বাবু শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দিনটাই মাটি করলি তোরা। নায়েবমশাই, আজ রাতে আমার শোওয়ার ঘরে চারজন দারোয়ান মোতায়েন রাখবেন।’
‘যে আজ্ঞে।’
গোবিন্দপুরের প্রজারা হাতজোড় করে বলল, ‘হুজুর আপনার ব্যবস্থা তো দারোয়ান দিয়ে করালেন, এবার আমাদের ইঁদারার একটা বিলিব্যবস্থা করুন।’
‘ইঁদারা বুজিয়ে ফ্যাল গে। ও ইঁদারা আর রাখা ঠিক নয়। দরকার হলে আমি ইঁদারা বোজানোর জন্য গো-গাড়ি করে ভালো মাটি পাঠিয়ে দেবখন।’
তখন শুধু গোবিন্দপুরের প্রজারাই নয়, কাছারি-ঘরের সব প্রজাই হাঁ-হাঁ করে উঠে বলে, ‘তা হয় না হুজুর, সেই ইঁদারার জল আমাদের কাছে ধন্বন্তরী। তা ছাড়া জল তো নষ্টও হয়নি, পোকাও লাগেনি, কয়েকটা ভূত—’
রায়বাবু হুংকার দিলেন, ‘চুপ! ও নাম মুখে আনবি তো মাটিতে পুঁতে ফেলব।’
সবাই চুপ মেরে যায়। রায়বাবু ব্যাজার মুখে কিছুক্ষণ ভেবে ভট্টাচার্যমশাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ তো লেঠেলদের কর্ম নয়, একবার যাবেন নাকি সেখানে?’
রায়মশাইয়ের আগের সভাপণ্ডিত মুকুন্দ শর্মা একশো বছর পার করে এখনও বেঁচে আছেন। তবে একটু অথর্ব হয়ে পড়েছেন। ভারী ভুলো মন আর দিনরাত খাই-খাই। তাঁকে দিয়ে কাজ হয় না। তাই নতুন সভাপণ্ডিত রাখা হয়েছে কেশব ভট্টাচার্যকে।
কেশব এই অঞ্চলের লোক নন। কাশী থেকে রায়মশাই তাঁকে আনিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষমতা বা পাণ্ডিত্য কতদূর, তার পরীক্ষা এখনও হয়নি। তবে লোকটিকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়। চেহারাখানা বিশাল তো বটেই, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল—তা সেও বেশি কথা কিছু নয়। তবে মুখের দিকে চাইলে বোঝা যায়, চেহারার চেয়েও বেশি কিছু এঁর আছে। সেটা হল চরিত্র।
জমিদারের কথা শুনে কেশব একটু হাসলেন।
পরদিন সকালেই গো-গাড়ি চেপে কেশব রওনা হয়ে গেলেন গোবিন্দপুর। পিছনে পায়ে হেঁটে গোবিন্দপুরের শ-দুই লোক।
দুপুর পেরিয়ে গাঁয়ে ঢুকে কেশব মোড়লের বাড়িতে একটু বিশ্রাম করে ইঁদারার দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে গোবিন্দপুর আর আশপাশের গাঁয়ের হাজার-হাজার লোক।
ভারী সুন্দর একটা জায়গায় ইঁদারাটি খোঁড়া হয়েছিল। চারদিকে কলকে ফুল আর ঝুমকো জবার কুঞ্জবন, একটা বিশাল পিপুল গাছ ছায়া দিচ্ছে। ইঁদারার চারধারে বড়-বড় ঘাসের বন। পাখি ডাকছে, প্রজাপতি উড়ছে।
কেশব আস্তে-আস্তে ইঁদারার ধারে এসে দাঁড়ালেন, মুখখানা গম্ভীর। সামান্য ঝুঁকে জলের দিকে চাইলেন। সত্যিই কাকচক্ষু জল। টলমল করছে। কেশব আস্তে করে বললেন, ‘কে আছিস! উঠে আয়, নইলে থুথু ফেলব।’
এই কথায় কী হল কে জানে। ইঁদারার মধ্যে হঠাৎ হুলুস্থুল পড়ে গেল। প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ঢেউ দিয়ে জল একেবারে ইঁদারার কানা পর্যন্ত উঠে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে বোঁ-বোঁ বাতাসের শব্দ।
লোকজন এই কাণ্ড দেখে দে-দৌড় পালাচ্ছে। শুধু চক্কোত্তিমশাই ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘থুথু ফেলবেন না, থুথু ফেলবেন না’ বলতে-বলতে ইঁদারা থেকে শয়ে-শয়ে ভূত বেরোতে থাকে। চেহারা দেখে ভড়কাবার কিছু নেই। রোগা লিকলিকে কালো-কালো সব চেহারা, তাও রক্তমাংসের নয়—ধোঁয়াটে জিনিস দিয়ে তৈরি। সবকটার গা ভিজে সপসপ করছে, চুল বেয়ে জল পড়ছে।
কেশব তাদের দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ঢুকেছিলি কেন এখানে?’
‘আজ্ঞে ভূতের সংখ্যা বড্ডই কমে যাচ্ছে যে! এই ইঁদারার জল খেয়ে এ তল্লাটের লোকের রোগ-বালাই নেই। একশো-দেড়শো বছর হেসে খেলে বাঁচে! না মলে ভূত হয় কেমন করে? তাই ভাবলুম, ইঁদারাটা দখল করে থাকি।’ বলে ভূতেরা মাথা চুলকোয়।
কেশব বলেন, ‘অতি কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।’
ভূতেরা আশকারা পেয়ে বলে, ‘ওই যে চক্কোত্তিমশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওঁরই বয়স একশো বিশ বছর। বিশ্বাস না হয়, জিগ্যেস করুন ওঁকে।’
কেশব অবাক চোখে চক্কোত্তির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বলে কী এরা মশাই? সত্যি নাকি?’
একহাতে ধরা পৈতে, অন্য হাতের আঙুলে গায়ত্রী জপ কড়ে ধরে রেখে, চক্কোত্তি আমতা-আমতা করে বলেন, ‘ঠিক স্মরণে নেই।’
‘কূট প্রশ্ন। কিন্তু আপাতগ্রাহ্য।’ কেশব বললেন।
ঠিক এই সময়ে চক্কোত্তির মাথায়ও ভারি কূট একটা কথা এল। তিনি ফস করে বললেন, ‘ভূতেরা কি মরে?’
কেশব চিন্তিতভাবে বললেন, ‘সেটা কূট প্রশ্ন!’
চক্কোত্তি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘কিন্তু আপাতগ্রাহ্য। ভূত যদি না-ই মরে, তবে সেটাও ভালো দেখায় না। স্বয়ং মাইকেল বলে গেছেন, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’।
ভূতেরা কাঁউমাঁউ করে বলে উঠল, ‘তা সে আমরা কী করব? আমাদের হার্ট ফেল হয় না, ম্যালেরিয়া, ওলাওঠা, সান্নিপাতিক, সন্ন্যাস রোগ হয় না—তাহলে মরব কীসে! দোষটা কি আমাদের?’
চক্কোত্তি সাহসে ভর করে বলেন, ‘তা হলে দোষ তো আমাদেরও নয় বাবা সকল।’
কেশব বলেন, ‘অতি কূট প্রশ্ন।’
চক্কোত্তি বলে উঠলেন, ‘কিন্তু আপাতগ্রাহ্য।’
শ-পাঁচেক ছন্নছাড়া বিদঘুটে ভেজা ভূত চারদিকে দাঁড়িয়ে খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে কেশবের দিকে তাকিয়ে আছে। কী রায় দেন কেশব!
একটা বুড়ো ভূত কেঁদে উঠে বলল, ‘ঠাকুরমশাই, জলে ভেজানো ভাত যেমন পান্তা ভাত, তেমনি দিনরাত জলের মধ্যে থেকে থেকে আমরা পান্তো ভূত হয়ে গেছি। ভূতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এত কষ্ট করলুম, সে কষ্ট বৃথা যেতে দেবেন না।’
‘এও অতি কূট প্রশ্ন।’ কেশব বললেন।
চক্কোত্তিমশাই এবার আর ‘আপাতগ্রাহ্য বললেন না। সাহসে ভর করে বললেন, ‘তাহলে ভূতেরও মৃত্যুর নিদান থাকা চাই। না যদি হয়, তবে আমিও ইঁদারার মধ্যে থুথু ফেলব। আর তারই বা কী দরকার! এক্ষুনি আমি এইসব ভূত বাবাসকলের গায়েই থুথু ফেলছি।’
চক্কোত্তিমশাই বুঝে গেছেন, থুথুকে ভূতেদের ভারী ভয়! বলার সঙ্গে-সঙ্গে ভূতেরা আঁতকে উঠে দশ হাত পিছিয়ে চেঁচাতে থাকে, ‘থুথু ফেলবেন না! থুথু দেবেন না!’
কেশব চক্কোত্তিমশাইকে এক হাতে ঠেকিয়ে রেখে ভূতেদের দিকে ফিরে বললেন, ‘চক্কোত্তিমশাই যে কূট প্রশ্ন তুলেছেন, তা আপাতগ্রাহ্য বটে। আবার তোমাদের কথাও ফেলনা নয়। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে, ভূত কখনও মরে না। সুতরাং ভূত খরচ হয় না, কেবল জমা হয়। অন্যদিকে মানুষ দুশোবছর বাঁচলেও একদিন মরে। সুতরাং মানুষ খরচ হয়। তাই তোমাদের মুক্তি টেঁকে না!’
ভূতেরা কাঁউমাঁউ করে বলতে থাকে, ‘আজ্ঞে, অনেক কষ্ট করেছি!’
কেশব দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘তা হয় না। ঘটি-বাটি যা সব কুয়োর জলে ডুবেছে, সমস্ত তুলে দাও, তারপর ইাঁদারা ছাড়ো। নইলে চক্কোত্তিমশাই আর আমি দুজনে মিলে থু—’
আর বলতে হল না। ঝপাঝপ ভূতেরা ইঁদারায় লাফিয়ে নেমে ঠনাঠন ঘটি-বালতি তুলতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ঘটি-বালতির পাহাড় জমে গেল ইঁদারার চারপাশে।
পুরোনো ইঁদারায় এরপর ভূতের আস্তানা রইল না। ভেজা ভূতেরা গোবিন্দপুরের মাঠে রোদে পড়ে থেকে-থেকে ক’দিন ধরে গায়ের জল শুকিয়ে নিল। শুকিয়ে আরও চিমড়ে মেরে গেল। এত রোগা হয়ে গেল তারা যে, গাঁয়ের ছেলেপুলেরাও আর তাদের দেখে ভয় পেত না।