ইতি কথা
তিনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সংসারে কোনোদিনই অন্তঃপুরিকা ছিলেন না। সদ্য চাকরি পাওয়া, সামান্য কিছু লেখালিখি, বিশাল যৌথ পরিবারের প্রায় – বাতিল এক সদস্য শ্যামলকে বিবাহ করা থেকে শুরু করে স্থানাভাব এবং লেখার অবকাশ খোঁজার কারণে একটি চার বছরের আর একটি তিন মাসের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৬৫-র উত্তাল সময়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চম্পাহাটি নামের প্রায়-অপরিচিত জায়গায় ভাড়াবাড়িতে এসে ওঠা নিশ্চয়ই কোনো নিছক অনুগতপ্রাণা মহিলার পরিচয় নয়। তারপর সেই চম্পাহাটি-পর্ব তো এক বিশাল টানাপোড়েনের ইতিহাস। চম্পাহাটি-পর্বে শ্যামলের সব রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা, জীবনযাপন এবং সেই পর্ব-শেষে সর্বনাশের মুখোমুখি স্বপ্নভঙ্গ শ্যামলের সঙ্গে তিনিও অভিযাত্রী। শহরে ফিরে এসে ঘনঘন বাসাবদল, চাকরির অনিশ্চয়তা, প্রবল অর্থসংকট, লেখক- স্বীকৃতির দোলাচল — এই মহিলা অকম্পিত, নিরুত্তাপ। যাঁরা শ্যামল-ইতির পরিবারের সঙ্গে সামান্যতমও সম্পর্কিত, তাঁরা জানেন, কী মানসিকতায় কী ব্যবহারে বা কথাবার্তায়, প্রায় সব দিক দিয়েই শ্যামল এবং ইতি দুই ভিন্ন মেরুর। কিন্তু তা সত্বেও এই মহিলা কখনো-সখনো অস্বচ্ছন্দ হলেও তালভঙ্গ হতে দেননি শ্যামলের নিজস্ব জীবনযাপনে। স্বল্পবাক তিনি কিন্তু কুণ্ঠিত নন, প্রতিঘাত জানেন না তাই ভুল হয় অন্তর্মুখীন কিনা। ভুল শ্যামলও করতেন তাই বিরক্ত হতেন, অসহিষ্ণু হতেন। অথচ এই মহিলা কী প্রবলভাবে জানতেন এই অসহিষ্ণুতা এই অধৈর্যের পরেও শ্যামল কী ভীষণ পারিবারিক, কী ভীষণ স্নেহপ্রবণ, বন্ধুত্বের কাঙাল, সখ্যের ভিখারি। ভালবাসে ইতিকে, নির্ভর করে ইতিকে। সাহিত্যসভা থেকে শুরু করে সম্বর্ধনা, বিদেশভ্রমণ থেকে নিমন্ত্রণরক্ষা, আত্মীয়পরিজন-বন্ধুবান্ধব — সর্বত্রই শ্যামলের সঙ্গী তাই ইতি। তার ছিঁড়েছে, ইতি জানতেন কী নিশ্চিন্ততায় — এটা সাময়িক। ছেঁড়া তার জোড়া লেগে গেছে। তিনি শ্যামলের সাহিত্যের অনুপ্রেরণাদাত্রী নন, সমালোচকও নন, হতে চাননিও কখনও, কিন্তু শ্যামল তাঁকেই পড়ে শোনান প্রথম পাণ্ডুলিপি, মুখে মুখে বলেন লেখার খসড়া, পত্রিকায় প্রকাশের পর তাঁর পাঠের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। প্রথম উপন্যাস ‘বৃহন্নলা’ (অর্জুনের অজ্ঞাতবাস) থেকে শুরু করে কত গল্প কত উপন্যাসে কত রূপে কত ঢঙে প্রধান বা অপ্রধান নারীচরিত্রে ইতি রয়ে গেছেন তাঁর কথা বলার ভঙ্গি নিয়ে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা নিয়ে, চাহনি নিয়ে, সংলাপ নিয়ে। বেহিসেবি শ্যামল, বেপরোয়া শ্যামল, আবেগতাড়িত তাঁর স্বামী লেখা হয়ে গেলেই সেই লেখার দিকে আর ফিরেও তাকান না, নতুন লেখায় মেতে ওঠেন, বই হয়ে বেরোলে দু-একদিন নাড়াচাড়া করেন — তাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যা কিছু ফাইলবন্দী করে রাখা বা আলমারিতে লুকিয়ে রাখা ভাগ্যিস এই মহিলা শ্যামলের অগোচরে করেছিলেন, নাহলে পরবর্তী সময়ের শ্যামল-সংগ্রাহকদের বিপদ আরও বাড়তো। এই যে মহিলা যিনি শ্যামল থেকে শুরু করে শ্যামলের সমসাময়িক বা উত্তরসুরী সবার চোখে অন্তর্মুখীন, স্বল্পবাক, আড্ডার নীরব শ্রোতা, মতামত ব্যক্ত করার ব্যাপারে বড্ডো সংক্ষিপ্ত — তিনি শ্যামলের মৃত্যুর বারো বছর বাদে এত স্মৃতিমুখর, এত সংবেদনময় বিশ্লেষক, এত শ্যামলের মুগ্ধ পাঠিকা! সমগ্র লেখা জুড়ে এত ভালবাসা, এত আঘাতবিহীন অভিমান, এত ক্ষমা, এত অকপট স্বীকারোক্তি। পাঠক হিসেবে এ যে আমাদের অভাবনীয় প্রাপ্তি। এত সাবলীল গদ্য। এত সহজিয়া। যা ছিল বালুকাময় তা খুঁড়ে আনার ব্যাপারে সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবশ্যই কৃতিত্ব তাঁর দুই দৌহিত্রসম যুবকের — সৌরভ দে এবং দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের, কিন্তু খনন এবং সিঞ্চন তো এই মহিলারই। অবরুদ্ধ জলস্রোত মুক্ত হলে যে কী অপরূপ সৌন্দর্য — এই ক্ষুদ্র গ্রন্থটি তার প্রমাণ। সবচেয়ে বড়ো বিস্ময়, শ্যামলের মতো বর্ণময় মানুষ এবং বিচিত্রগামী লেখককে নিয়ে লিখতে বসে তাঁর স্ত্রী পরিচয়েও এই মহিলা — ইতি গঙ্গোপাধ্যায় — শ্যামলবন্দনা বা শ্যামলভজনা করেননি। দোষে-গুণে, প্রেমে-অপ্রেমে, গ্রহণে-প্রত্যাখ্যানে, সারল্যে-রুক্ষতায়, বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে একটি মানুষকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন — তিনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় — দৈবক্রমে যাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিপান্ন বছরের। মৃত্যুর পরেও তো সম্পর্ক থেকে যায়।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক শিলাদিত্য সাহিত্যপত্রিকার ২০১৩ উৎসব সংখ্যায়। সামান্য পরিমার্জন করে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হল। পুস্তক আকারে প্রকাশের সব কৃতিত্ব অভিযান পাবলিশার্স-এর কর্ণধার মারুফ হোসেনের। মারুফ যে শ্যামল-অনুরাগী।
পরিশেষে বলি, এই গ্রন্থটি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনী নয়। ইতি গঙ্গোপাধ্যায় নাম্নী মহিলা, যিনি সামাজিক পরিচয়ে তাঁর স্ত্রী, তিনি তাঁকে যেভাবে পেয়েছেন বুঝেছেন তার স্মৃতিচারণ — এবং বোধকরি আংশিক স্ফুরণ। তবু এই ক্ষুদ্র গ্রন্থটি শ্যামল-অনুরাগীদের কাছে প্রিয় গ্রন্থ হবে, আশা করি। ভবিষ্যৎ শ্যামল-গবেষকদের কাছেও এই গ্রন্থটি প্রয়োজনীয় হবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আশা এবং বিশ্বাস বাস্তবায়িত হোক।
সমীর চট্টোপাধ্যায়
নববর্ষ, ১ বৈশাখ ১৪২১
১৫ এপ্রিল ২০১৪
৩৫ কাশীপুর রোড
কলকাতা ৭০০০০২