প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

ইতিহাস রচনায় সুকীর্তি – শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা

ইতিহাস রচনায় সুকীর্তি – শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা

বঙ্কিমচন্দ্র একদিন বলেছিলেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, না হলে বাঙালীর ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালী তাহাকেই লিখিতে হইবে। মা যদি মরিয়া যান, তবে মার গল্প করিতে কত আনন্দ! আর এই আমাদিগের সর্বসাধারণের মা জন্মভূমি বাঙ্গলাদেশ, ইহার গল্প করিতে কি আমাদের আনন্দ নাই?’ বঙ্কিমচন্দ্রের এই আহ্বানে যাঁরা যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আর-একটি নাম যুক্ত হল—ঐতিহাসিক সুধীরকুমার মিত্র।

হুগলি জেলা বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। এর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এমন সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন যা সমগ্র বাঙালি জাতির ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। কত উত্থান-পতন, কত ভাঙাগড়ার কাহিনি নিয়ে রচিত হয় একটি দেশের ইতিহাস। ইতিহাস শুধু তথ্য ও সাল-তারিখের স্তূপ নয়, ইতিহাসের মধ্যে থাকে একটি জাতির অন্তর্জীবনের পরিচয়। সেদিক থেকে বিচার করলে সুধীরকুমার মিত্রের দুই খন্ডে প্রকাশিত হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ একটি সার্থক গ্রন্থ।

এখানে লেখক শুধু হুগলি জেলার ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই তাঁর আলোচ্য বিষয়বস্তুকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তাকে সমগ্র বাঙালি জাতির অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত করে অসাধারণ বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। হুগলি জেলার বস্তুগ্রাহ্য জীবনধারার সঙ্গে বাঙালি জাতির অন্তর্গূঢ় যোগ স্থাপনের মধ্যেই লেখকের কৃতিত্ব। হুগলি জেলার ওপর দিয়ে যে পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেছে তা শুধু সেখানকারই সমাজ ও সংস্কৃতিকে নাড়া দেয়নি; সমগ্র বাঙালি জাতির প্রবহমান জীবনধারা ও সমাজ-সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে—এই সত্যটুকু তুলে ধরবার জন্যে লেখক যে অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, শ্রম, অনুশীলন, ভৌগোলিক জ্ঞান, ইতিহাস চেতনা ও বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শুধু হুগলিই নয়, সারা বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চায় এটি অপরিহার্য গ্রন্থ।

লেখক হয়তো হুগলি জেলার ইতিহাস রচনায় অনেকের কাছে উৎসাহ পেয়েছেন। কিন্তু তা না পেলেও তিনি একাজে ব্রতী হতেন। কারণ, হুগলি জেলার ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধিৎসা স্বতঃস্ফূর্ত, ঐতিহাসিক গবেষণার কাজে তাঁর নিষ্ঠা সহজাত। হুগলি জেলাকে তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন।

লেখক যে অধ্যবসায়ী তার প্রমাণ, হুগলির গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে তিনি তাকে জেনে নিয়েছেন, মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেছেন ঐতিহাসিক চোখ নিয়ে, বহু রাস্তাঘাটের বিবরণ সংগ্রহ করেছেন, প্রচলিত কাহিনি থেকে সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন, বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, চিঠিপত্র, দলিল, সরকারি কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন।

সংগৃহীত তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে লেখক প্রামাণ্য ঘটনার উল্লেখ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজস্ব বিরোধী মত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্বভাবসুলভ বিনয়ে মার্জিত ও পরিশীলিত ভাষায় লেখক তাঁর নিজস্ব ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পন্ডিতদের মতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বয়স হাজার বছরের বেশি নয়। কিন্তু এ-গ্রন্থের লেখক মীননাথের প্রসঙ্গ টেনে যুক্তি ও তথ্যের জাল বিস্তার করে এই সম্ভাবনাকেও আমাদের কাছে উজ্জ্বল করে তুলেছেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বয়স দেড় হাজার বছরও হতে পারে। এ-নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু লেখক যে সেই তর্কের দিকে আমাদের ঠেলে দিয়ে এক নতুন চিন্তার দরজা খুলে দিয়েছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের গর্ব তার জন্মলগ্ন সম্পর্কে সুস্থির ও সুচিন্তিত মতবাদ গড়ে তোলার জন্যে এ-তর্কের প্রয়োজন আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মলগ্ন সম্পর্কে এক উদ্যত জিজ্ঞাসাচিহ্ন—এ-গ্রন্থের এক আকর্ষণীয় দিক।

হুগলি জেলার যেসব বরেণ্য ঐতিহাসিক স্বমহিমায় ইতিহাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য অথচ যাঁদের আমরা স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলেছি, তাঁদের তিনি আমাদের সামনে নতুনভাবে উপস্থিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে রাধামাধব মিত্রের কথা উল্লেখ্য। হুগলির স্বনামধন্য কবি ঈশ্বর গুপ্তের এই প্রিয় শিষ্য ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পর গুরুর ধারা বজায় রেখে আট বছর সংবাদ প্রভাকর-এর সম্পাদনা করেন। রাধামাধব মিত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ড. সুকুমার সেনের এক ভ্রমাত্মক মন্তব্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ড. সুকুমার সেন উল্লেখ করেছেন যে, পাঁচ খন্ড কবিতাবলীর প্রকাশকাল (১৮৬৮-৭৩) খ্রি.। লেখক সুধীরকুমার কবিতাবলীর দ্বিতীয় ভাগের আখ্যানপত্রের প্রতিলিপি মুদ্রিত করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এর প্রকাশকাল ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং প্রথম ভাগ আরও আগে প্রকাশিত।

হুগলি জেলা যে বরেণ্য সাহিত্যিকদের দ্বারা অধ্যুষিত এক ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান সে-কথা সুধীরকুমার মিত্র সযত্ন প্রয়াসে আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু তাই নয়, হুগলি জেলার ওপর দিয়ে সময়ের নির্দেশে যে জীবনপ্রবাহ বয়ে চলেছে তার মূল খুঁজে বের করার জন্যেও লেখকের প্রচেষ্টা ও প্রযত্নের অন্ত নেই। হুগলির মাটির ওপর দিয়ে যে জনপ্রবাহ বয়ে চলেছে তার অন্তর্জীবনের মূল কোথায়, এই প্রশ্ন নিয়ে তিনি নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনা চালিয়ে গিয়েছেন। শুধুমাত্র কিছু দলিল, চিঠিপত্র, ছবি সংগ্রহ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। শুধু এসবের মধ্যেই যে একটা জাতির বৈশিষ্ট্য ও আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষাকে চেনা যায় না তা লেখক ভালোভাবেই জানেন। একটা জাতির বহির্জীবনের সঙ্গে অন্তর্জীবনের যোগাযোগ যে কোথায় সে প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে লেখক উচ্ছ্বাসের আবর্তে পথ হারাননি। তাঁর গ্রন্থ পড়তে গেলে বাঙালির অনেক পুরোনো কীর্তির ভগ্নস্তূপের স্মৃতিকথা আমাদের চোখে জল আনে।

গ্রন্থটি নিছক তত্ত্বের পাথর কাটার সাধনার সাক্ষ্য নয়। এ-গ্রন্থ পড়তে পড়তে চোখের সামনে যেন দেখতে পাই বাঙালির সামগ্রিক পরিচয়, অনুভব করতে পারি কাশীরাম দাস, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, কেরি, মার্শম্যান, ঈশ্বর গুপ্ত, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল প্রমুখ স্রষ্টার অবিস্মরণীয় ভূমিকা। কাশীরাম দাসের মহাভারত, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, রামপ্রসাদের সংগীত, রামমোহনের সাহিত্যিক ও সামাজিক অবদান, বিহারীলালের কাব্য—এসবই হুগলি জেলার গৌরব।

হুগলি জেলা এখানে উপলক্ষ মাত্র। হুগলি জেলাকে আশ্রয় করে সুধীরকুমার মিত্র এক আন্তরিক ঐতিহাসিক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর সুগভীর শ্রদ্ধা ভালোবাসার স্বাক্ষর রেখেছেন। বহু রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বাঙালি জাতি নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একদিন তার প্রধান কেন্দ্র ছিল হুগলি জেলা। ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ও অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক থেকে সেই হুগলি জেলারই কীর্তিকথা আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন সুধীরকুমার মিত্র।

স্মৃতির প্রদীপ ধরে পুরোনো কীর্তিকে তুলে ধরা, হুগলি সম্পর্কিত অজস্র তথ্যের সমন্বয়সাধন, ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে সত্যের আলোয় নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সমাজ জীবনের গভীরে অনুপ্রবেশ, জাতীয় জীবনে হুগলির গুরুত্ব নির্ধারণ, রাজনৈতিক আবর্তের জটিল সূত্রগুলোর বিশ্লেষণ, অজানা ঘটনা ও তথ্যের বর্ণনা—এসবই সুধীরকুমার মিত্রের কৃতিত্বের পরিচয়বাহী। চিঠিপত্র, দলিল, সরকারি কাগজ, বিচিত্র তথ্য ইত্যাদির মহাকায় ঠাসবুনোনি হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্থটি। কত সহজে লেখক বলে গেছেন এই জটিল ইতিহাস।

কোথায় উদ্ধারণ দত্ত বাংলায় দুর্ভিক্ষে অন্নসত্র খুলে গরিবদের অন্ন বিলিয়ে দিয়েছেন, পোর্তুগিজ জলদস্যুদের কুকীর্তির সাক্ষ্য হিসাবে কীভাবে ভাগীরথী একদিন ‘দস্যুনদী’ আখ্যা পেয়েছে। বর্গীদের নারকীয় অত্যাচারে একদিন বাঙালির জীবন কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, সরস্বতী নদীর উপকূলে রঘুনাথ প্রবর্তিত ‘উত্তরায়ণ’ মেলা যে কত বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ত্রিবেণীর নিঃস্ব সাধক জগন্নাথ পন্ডিত কীভাবে সপ্রচেষ্টায় টোল খুলে সুদীর্ঘ নব্বই বছর অধ্যাপনা করে জগতের সারস্বত সাধনার ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হয়েছেন, পান্ডুয়ার মেলা কীভাবে জি. টি. রোডের বাসের জানালায় চোখ মেলে দেওয়া মানুষদের অবাক করে দেয়। বৈঁচি গ্রামের একটি অবহেলিত দেউল কীভাবে তিন-শো বছরের ঐতিহ্য বহন করছে, গুপ্তিপাড়া নামে একটি গন্ডগ্রাম যে কত শ্রুতিধর পন্ডিতের লীলাভূমি ছিল—এইসব খবর আমাদের নখদর্পণে আসে সুধীরকুমারের এই গ্রন্থ পাঠ করলে।

এক বিস্তৃত ইতিহাসের অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়ে লেখক আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট করে তোলেন ফেলে আসা ইতিহাসের পুরোনো অধ্যায়, বিচিত্র আখ্যান, লোকায়ত বিবরণ, পুরোনো সংস্কারের চেহারা, কৌলীন্যপ্রথার অভিশাপ, উদার মনীষীদের আত্মত্যাগের অজানা তথ্য। এই বই পড়তে পড়তে দেখি, চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠছে ইতিহাসের কত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব—ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন, টেকচাঁদ ঠাকুর প্রমুখ। আর সেই সঙ্গে লেখকের অন্তর্দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেইসব সাধারণ মানুষগুলোরও সুখ-দুঃখের স্মৃতিকথা—শত শত শতাব্দীর ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যারা কাজ করে।

ঐতিহাসিক সুধীরকুমার একটি আঞ্চলিক ইতিহাসের কথা বলতে বলতে এক অনিবার্য সূত্রে গোটা বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে তাকে যুক্ত করে দিয়েছেন। প্রাচীনযুগে বাংলা কেমন ছিল, কী ছিল তার ভৌগোলিক অবস্থা, কোন কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে তা বর্তমান রূপ লাভ করেছে, বাংলা কখন কী নামে ভূষিত হয়েছে, কোন রাজার আমলে বাংলার গণজীবন কী অবস্থার মধ্যে কালক্ষেপ করেছে, বিভিন্ন সময়ে ভৌগোলিক সংস্থান অনুযায়ী কোন অঞ্চলের কী পরিচয় ছিল, বাংলার ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীক সীমা কখন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে—এসব বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আছে এই গ্রন্থে।

যেসব ঘটনার মধ্যে বাঙালির বৈশিষ্ট্য ও গৌরব বিধৃত আছে তাদের গুরুত্ব দিতে লেখক ভুলে যাননি। সেইসঙ্গে ইতিহাসের সঙ্গে জনজীবনের সম্পর্কটুকুও নির্ণয় করে লেখক ঐতিহাসিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলার জনজীবন যে বিচিত্র ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে তারও রহস্য উদ্ঘাটনে লেখক ইতিহাসের সঙ্গে জনজীবনের সম্পর্কের দিকে আঙুল তুলেছেন। এই সম্পর্ক নির্ণয়ই তো ঐতিহাসিকের কাজ।

কত পরস্পরবিরোধী মতবাদের জটিলতাকে অতিক্রম করে যুক্তির আলোয় লেখক এক পরিপূর্ণ সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন পাঠকের মন।

আলোচিত গ্রন্থ

হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ । (১ম ও ২য় খন্ড)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *