ইতিহাস পাঠকের দু-একটি জিজ্ঞাসা
এ যুগের মতবাদের মতোই ধর্মমাত্রেই কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষের বিদ্রোহ-বিপ্লবের দান। কোন বিশেষ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, আর্থিক নৈতিক কিংবা প্রশাসনিক বিপর্যয়ের প্রতিকারকল্পে জ্ঞানী-মনীষীর চিন্তা ও প্রয়াস প্রথমে মনন-বিপ্লবরূপে এবং পরে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে দ্ৰোহরূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিপ্লব-বিদ্রোহের অবসানে দ্রোহীদের জয়ে তাদের পরিকল্পিত ও অনুসৃত নিয়ম-পদ্ধতি ও নীতি-আদর্শ পরিণামে নবধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ হয়ে মানুষ সোনার মতোই জীবনে পায় লাবণ্য, মননে পায় ঔজ্জ্বল্য। সে তাপ অবসিত হলে আবার নেমে আসে গ্লানি। ম্লান হয়ে উঠে সমাজ-সংস্কার। নবতর অভাব ও প্রয়োজনবোধ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় মাথা উঁচু করে। নতুন ভাব-চিন্তা ও আয়োজন-বুদ্ধি নিয়ে পূরণ করতে হয় প্রয়োজন। উদ্ভব হয় নতুনতর ধর্মের। যারা প্রয়োজন-সচেতন ও আয়োজনে তৎপর তারা তরে, আর যারা প্রয়োজন মতো আয়োজনে অসমর্থ তারা মরে।–এ-ই প্রকৃতির নিয়ম। তাই ধর্মের অকারণ উদ্ভব যেমন নেই, তেমনি নেই কালান্তরে তার উপযোগ। হৃত-উপযোগ ধর্ম কালান্তরে প্রাণের প্রেরণা নয়, জীবনের অবলম্বন নয় সমাজের উপসর্গ–প্রগতির অন্তরায়।
স্বদেশে ধর্মমাত্রেই জীবন-চেতনারই প্রতিরূপ। তাই স্বদেশে যে-নতুন ধর্ম Practice, দেশান্তরে তা theory মাত্র। স্বদেশে যা real, দেশান্তরে তা-ই ideal এবং কালান্তরে তা। একটা idea, একটা কল্পনাসাধ্য Philosophy-র বেশি নয়। মানুষের সামান্য ধর্মের সাদৃশ্যবশে অঞ্চললাদ্ভূত ধর্ম দেশান্তরে প্রসার লাভ করে বটে, কিন্তু জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্পদ ও সম্বল হয়ে ওঠে না। যেহেতু তা theory হিসেবেই মন ভোলায়, তাই দেশান্তরে ব্যাপ্ত ও কালান্তরে স্থিতি পায়। কিন্তু ধর্ম যেখানে বাস্তব জীবনে সমস্যার সমাধান রূপে উদ্ভূত, সেখানে তা কালান্তরে হয় বিলুপ্ত। পশ্চিম এশিয়ার হযরত ইব্রাহিম থেকে হযরত ঈসা অবধি সকল চিন্তানায়ক। প্রবর্তিত ধর্ম-সমাজ এভাবে হয়েছে নিশ্চিহ্ন। স্বদেশে জরথুস্ত্রীর-জৈন-বৌদ্ধধর্মের পরিণামও স্মর্তব্য।
দেশ-কালের প্রতিবেশে উদ্ভূত বলেই তথা সামাজিক-নৈতিক-আর্থিক কিংবা প্রশাসনিক সমস্যার সমাধানের তাগিদজাত বিপ্লব-বিদ্রোহ প্রসূত বলেই ধর্ম তার উদ্ভব ক্ষেত্রের মানুষকে দেয় আত্মপ্রকাশের প্রেরণা ও আত্মবিস্তারের শক্তি। ইসলামের উদ্ভবে মরুভূ মক্কা-মদিনার জনগণ একদিন এমনি জীবন-স্বপ্নের বাস্তবায়নে বন্যার বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল অমোঘ শক্তিরূপে। চারদিককার ভুবন এলো তাদের দখলে। সিরিয়া-ইরাক-ইরান-মিশর-মরোক্কো-স্পেন-সিন্ধু-তুরান প্রভৃতি কত কত দেশ এল তাদের হাতে। পাঁচশ বছর ধরে চলল তাদের শাসন। পরিবর্তিত পরিবেশে তাদের ইসলামী প্রেরণা গেল উবে। মক্কা-মদিনার ঐতিহাসিক ভূমিকার হল অবসান। স্বদেশী ধর্ম মক্কা-মদিনার লোককে দিল ঐশ্বর্য ও সম্মান, করল শাসক, আর দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের রাখল পরপদানত। স্বদেশে ইসলামের মুখ্যদান জিগীষা। কিন্তু দেশান্তরে দীক্ষিত মুসলমানদের মক্কা-মদিনাবাসীর মতো জিগীষু করেনি ইসলাম। অতএব দেশান্তরে ও কালান্তরে ধর্ম যে মানুষের জীবন-প্রয়াসে প্রেরণার উৎস হতে পারে না– কেবল আচার ও আচরণই নিয়ন্ত্রণ করে,–এ তথ্য ও তত্ত্ব নতুন প্রত্যয়ে গ্রহণ করা আবশ্যিক। নইলে বিভ্রমমুক্ত পথ মিলবে না এগুবার।
প্রায় আড়াইশ বছর ধরে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল আজিজ, আবদুল কাদির সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, বেলায়েত আলী, তিতুমীর, মক্কার মুহম্মদ ইবন্ আবদুল ওহাব, জামালউদ্দিন আফগানী, শরীতুল্লাহ, দুদুমিয়া, কবি হালী, কবি ইকবাল প্রমুখ বহু জ্ঞানী, মনীষী, চিন্তানায়ক ও দেশনেতা দুনিয়াব্যাপী মুসলমানদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মাচারহীনতাই জাতীয় উত্থান ও পতনের কারণ। ইতিহাসের সমর্থন বিহীন এই ধারণায় গলদ ছিল বলেই তাদের প্রয়াস কোথাও সফল হয় নি। গত আড়াইশ বছর ধরে ধর্মীয় প্রেরণার মাধ্যমে তথা ধর্ম-সংস্কারের পন্থায়। মুসলমানদের উন্নতি বা আযাদী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বার বার। ধর্মের নামে তথা ধর্মভাবের মাধ্যমে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উন্নতি লাভ করতে হলে দেশজ নতুন ধর্মের প্রয়োজন। কেননা দেশজ নতুন ধর্মই কেবল প্রাণে দিতে পারে প্রেরণা, বাহুতে দিতে পারে বল।
এ কারণেই সুলতান মাহমুদ থেকে আরম্ভ করে নওয়াব সিরাজদ্দৌলা অবধি সাতশ বছরের মধ্যে আমরা জ্ঞানী-গুণী কিংবা রাজা-বাদশা বা পদস্থ দেশী মুসলমান পাইনে। বহিরাগত নবধর্ম তাদের জীবনে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল বলে প্রমাণ নেই। অথচ ভারতে অমুসলমানেরা রাজসরকারে যথাযোগ্য পদও পেয়েছেন, আবার স্বাধীন রাষ্ট্রও গড়ে তুলেছেন একাধিক। আর জ্ঞানী-মনীষীর তো কথাই নেই।
ভারতের অধিকাংশ মুসলমান নিম্নবর্ণের ও বিত্তের হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে দীক্ষিত হলেও উচ্চবর্ণের লোকও নগণ্য ছিল না। তাদেরও তো কোনো দান ও উন্নতি জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সুলভ নয়। অতএব এর কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র।
আমরা দেখেছি মধ্য এশিয়ার নানা গোত্রীয় লোকই ভারতে আধিপত্য করেছে। তুর্কী-মুঘল ইরানীরাই দখল করেছিল রাজ-সরকারের সব উচ্চপদ। এজন্যে শাসকদের এ-দেশী স্বজাতির সহযোগিতা দরকার হয় নি। ফলে অমুসলমানের অংশ দেশী অমুসলমানেরা পেয়েছে এবং মুসলমানের অংশ সাতশ বছর ধরে ভোগ করেছে তুর্কী-মুঘল-ইরানীরাই। এভাবে বঞ্চিত রইল দেশী মুসলমানেরা। পদলাভের পথ রুদ্ধ ছিল বলেই হয়তো তাদের শিক্ষার প্রেরণাও ছিল না– ছিল না ধনাগমেরও সহজ উপায়। তাই অর্থে-বিত্তে কিংবা বিদ্যায় তারা সমাজের উঁচুস্তরে উঠতে পারে নি কখনো। এখনকার দিনে যেমন পূর্ব পাকিস্তানে কল-কারখানা গড়ে উঠেছে অনেক, কিন্তু মালিকানা রয়েছে অবাঙালির হাতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান সমৃদ্ধ হচ্ছে, কার্যত বাঙালির দুঃখ ঘোচে নি। ঠিক এমনি অবস্থা ছিল ব্রিটিশ-পূর্ব যুগেও। দেশে ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু সে ঐশ্বর্য ছিল বিদেশাগত মুসলিমদের হাতে। আমাদের এ ধারণার পরোক্ষ সমর্থন পাই আরাকানের ইতিহাসে। সাময়িক বিচ্যুতি থাকলেও ১৬৬৫ সন অবধি চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অংশ। সেখানে তুর্কী-মুঘল-ইরানীর স্থায়ী প্রভাব ছিল না বলেই চট্টগ্রামবাসী বাঙলাভাষী বাঙালি মুসলমান রোসাঙ্গের শাসনকার্যে তাদের যথাযোগ্য স্থান পেয়েছে। তাই আমরা সতেরো শতকে আশরাফ খান, শ্রীবড় ঠাকুর, সৈয়দ মুসা, সোলায়মান, মাগন ঠাকুর, নবরাজ মজলিস প্রভৃতি দেশী মন্ত্রী পাই।
ইংরেজ আমলে দেশী খ্রীস্টানের ক্ষেত্রেও আমরা এমনি এক বিশেষ অবস্থা লক্ষ্য করি। ব্রিটেন থেকে স্বজাতি আনয়ন সম্ভব না হলে ইংরেজরা দেশী খ্রীস্টানকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে আশ্বস্ত হত, কিন্তু তেমন কোনো প্রয়োজন না হওয়ায় যদিও প্রচারকদের উৎসাহে ও তৎপরতায় খ্রীস্টান হয়েছে অনেক, কিন্তু শাসকের স্বজাতি বলে অনুগ্রহ পেয়েছে সামান্য। স্বজাতির পোষণে তাদের আত্মবিকাশ ছিল দুর্লক্ষ্য।
কাজেই সময় এসেছে নতুন দৃষ্টিতে ইতিহাস পাঠের। তুকী-মুঘল মুসলিম শাসনে আর্থিক, শৈক্ষিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেশী মুসলমানের সুযোগ ও সুবিধা, অবস্থা ও ভূমিকা, কৃতি ও সংস্কৃতি কী ছিল তা যাচাই করা প্রয়োজন। আমরা সাদা চোখে দেখছি পল্লী-আগ্রায় কিংবা দক্ষিণাত্যে অথবা গৌড়-সোনার গা-ঢাকা-মুর্শিদাবাদে পদস্থ দেশী মুসলমান অনুপস্থিত।
বাংলা দেশের ইতিহাসের যে-অংশের বিস্তৃত বিবরণ আমাদের হাতে এসেছে সে-অংশেও অর্থাৎ নওয়াবী আমলেও আমরা খাঁটি দেশজ বাঙালি পাইনে। বিদেশী মামলুকের মর্যাদা আর সুযোগও পায় নি দেশী গেরস্থ। উত্তর ভারত থেকে আগত ব্যক্তির পুত্র হুগলীবাসী জাস্টাস সৈয়দ আমীর আলী নওয়াবী আমলের বাংলার উচ্চ বর্ণের মুসলমানদের বংশধর সম্পর্কে বলেছেন,
These are called Hidustanis and few of them ever understand Bengali. In most of the districts of upper Bengal, such as Beerbhoom, Midnapur, Dinajpur, Maldah, Purneah and to some extent the English district of twenty four pergunnahs, the Mohammedans speak urdoo, though not with the same purity as a native of Lucknow or Delhi, and know only enough of Bengali for the purposes of social intercourse with their Hindoo neighbours.
নওয়াবী আমলে এই বহিরাগত মুসলমান বড় চাকুরেরা ও তাদের পরিজনেরা (This class of Muslims) treated the language of the subject races with contempt….. they were as ignorant of native vernaculars as any English administrator of the day.
এও সত্য যে সিরাজদ্দৌলা-মীর কাসেমের পতনের পর বিদেশাগত অনেক অভিজাতই উত্তর ভারতে চলে যায়, যারা নানা অসামর্থে যেতে পরে নি, সেই স্বল্প সংখ্যক পরিবারের কথাই বলেছেন সৈয়দ আমীর আলী ও ডক্টর মল্লিক।
অতএব, এই তুর্কী-মুঘল-ইরানী অবতংসরা ইংরেজ প্রশাসকদের মতোই সযত্নে স্বাতন্ত্র রক্ষা করেই প্রজা-সাধারণের সুখ-দুঃখ করেছিলেন প্রত্যক্ষ, আর পীড়ন-শোষণ চালিয়ে ছিলেন সর্বপ্রকার ছোঁয়া বাঁচিয়ে। দেশী খ্রীস্টান ও গোরা খ্রীস্টানের যেমন রয়েছে সমাজে ও ধর্মশালায় স্বাতন্ত্র, তেমনি শাসক ও শাসিত মুসলমানে ছিল দুস্তর ব্যবধান। সে-স্বাতন্ত্রের প্রাচীর অতিক্রম করে সাতশ বছরেও মিলতে পারে নি তারা। তাই রাজদরবারের বিদেশী মামলুক আর হাবসী দাসেও বর্তেছে তখৃতের অধিকার, হিন্দুরও ছিল বিদ্রোহের সুযোগ, কেবল দেশী মুসলমানেরই ছিল না পাত্তা। এখানে হাসান গঙ্গা বাহমন, ঈশা খান, কালা পাহাড়, মালিক কাফুর, মালিক খসরু, জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ (যদু) প্রভৃতি দেশী হিন্দুর বংশধরদের দৃষ্টান্ত দেওয়া হবে অসঙ্গত। কেননা, তাঁরা হিন্দু হিসাবেই বড়ো হয়েছিলেন অথবা ছিলেন বড়ো হিন্দু পরিবারের সন্তান।
দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস লেখক ডাব্লিউ. এ. হান্টারের ভূমিকা ছিল অনেকটা পশ্চিম এশিয়ার টি, ই, Lawrence-এর মতোই। মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ ও ব্রিটিশ-প্রীতি জাগানোর অভিনব কৌশল হিসেবে চমকপ্রদ নানা বানানো কথা তিনি তথ্যের আকারে সাজিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। একশ বছর ধরে মুসলমানরা তাই কপচিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে। এ-গ্রন্থে যদি কোনো সত্য থেকেও থাকে তবে তা বিদেশাগত শাসকশ্রেণী সম্পর্কেই প্রযোজ্য–দেশী মুসলমান সম্পর্কে নিশ্চিতই নয়।
তাছাড়া নওয়াবী আমলের বাঙলা কখনো ১৯০৫ সনের পরবর্তীকালের ভৌগোলিক বাঙলা ছিল না। বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যা মিলেই বাঙলা, অন্তত সিরাজুদ্দৌলার বাঙলা ছিল বাঙলা-বিহার। আর তা ১৯০৫ সন অবধি ছিল স্থায়ী। কাজেই একালের বাঙলার ইতিহাস চর্চায় বিহারকে বাদ দেয়া যায় না। পলাশী-উত্তর বাঙলায় হিন্দু ও ইংরেজের ভূমিকা ও তাদের শাসন-পীড়ন কিংবা পোষণ-শোষণ নীতি বাঙলা-বিহারে সমভাবে ছিল কার্যকর। বিহারকে বাদ দিয়ে কোম্পানী আমলের বাঙালি মুসলমানের বিত্তবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে-সব কথা ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যরূপে চালু রয়েছে, তা ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসার ফল নয়, হান্টার শ্রেণীর ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রশাসনিক প্রয়োজনপ্রসূত দান, সাম্রাজ্যিক নীতি প্রেরণাপ্রসূত বিশ্লেষণ। এজন্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বাঙালি মুসলমানের তথাকথিত অনীহা, লাখরাজ, আইমা, তঘমা, মদদ-ই মাশ ইত্যাদি হারানোর প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম প্রভৃতি বিহারী মুসলিম-জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য।
তখন হয়তো দেখা যাবে ইংরেজের প্রতি বিরূপতা কিংবা ইংরেজির প্রতি অনীহাই বাঙালি মুসলমানকে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে বিরত রাখে নি, শিক্ষার Tradition ছিল না বলেই তারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠায় নি। অবশ্য উচ্চবিত্তের মুসলমানরাও যথাসময়ে সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে দিয়েছিল এবং তাদের অনেকের শিক্ষা পূর্ণতা পায় নি পরিবেশের অভাবেই। কেননা ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়েছিল কোলকাতায়। সেখানে উচ্চবিত্তের মুসলমান ছিল অনেককাল অনুপস্থিত। কোলকাতা ও তার চার পাশের হিন্দুরাই পেয়েছিল ইংরেজি শিক্ষা প্রথমদিকে এবং ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ব্যতীত বৈদ্য, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের কাছে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার পারিবেশিক কারণেই রুদ্ধ ছিল বহুকাল। বিহারে বিদেশাগত মুসলিম অভিজাতের সংখ্যা ছিল বেশি, তাই ইংরেজি শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়েনি।
কেউ কেউ মনে করেন, মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি বিরূপতা ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবপ্রসূত। কিন্তু ওহাবী আন্দোলনের কেন্দ্র বিহার ও উত্তর প্রদেশে তৎসত্ত্বেও ইংরেজিশিক্ষা প্রসার লাভ করেছিল। আমরা জানি কোনো আন্দোলনের প্রভাবই সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী হয় না। মুসলিম সমাজে ওহাবী প্রভাবও সর্বাত্মক ছিল না। তাছাড়া, ১৮৬০ সনের পরে ওহাবী আন্দোলন স্তিমিত এবং সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমান সমাজে ইংরেজ ও ইংরেজি প্রতি প্রবল হতে থাকে। তবু বিশ শতকের দ্বিতীয়পাদের আগে বাঙলার মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষা লক্ষণীয়ভাবে প্রসারলাভ করে নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কালাপানি পার হলে জাত-যাওয়া ও সমাজ-চ্যুতি নিশ্চিত জেনেও উনিশ শতকে কোনো হিন্দু বিলেত যাওয়ার সুযোগ ছাড়ে নি। ওহাবী প্রভাব নিশ্চয়ই হিন্দুর ঐ ধর্মীয় সংস্কার ও লাঞ্ছনাভীতির চেয়ে প্রবল ছিল না কখনো। আসলে নিম্নবর্ণের হিন্দুর যেমন, নিম্নবিত্তের মুসলমানেরও তেমনি লেখাপড়ার ঐতিহ্যই ছিল না।
ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুর নতুন বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক পরিবেশে অর্থাগম হল অপরিমেয়। বিত্তশালী শ্রেণী গড়ে উঠল তাদের নিয়ে। অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমানের অবস্থা রইল অভিন্ন। তাদের দারিদ্রদুঃখ বাড়ল ভিন্ন কারণে। গ্রামীণ কৃষি-শিল্পজাত পণ্য বিনিময় (Bartar) নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের প্রভাবে মুদ্রা বিনিময় (Money currency) রীতিতে পরিবর্তিত হওয়াতে আর্থনীতিক কাঠামোতে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দেশের কৃষি-শিল্প নিয়ন্ত্রণের সাম্রাজ্যিক নীতির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিদেশী পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হয় তারা। এভাবে আয়ের পথ হল রুদ্ধ-ব্যয়ের পথ হল বিস্তৃত। তাই দারিদ্র্য হল ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে বুর্জোয়া রাজত্বে ইংরেজি জানা হিন্দু দালাল-মুৎসুদ্দী-বেনিয়ান-চাকুরে বেতন, ঘুষ ও সুদের আকারে কাঁচামুদ্রা অর্জন করে ঐশ্বর্যবান হতে থাকে যখন, তখন বিদেশাগত মুসলমানের স্বল্পসংখ্যক বংশধর ছোট লোকদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে পৈত্রিক-সম্পত্তি-নির্ভর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে মশগুল। কাজেই উচ্চবিত্তের ব্রাহ্মণ-কায়স্থের মতো বহিরাগত উচ্চবিত্তের মুসলমানও যে কোম্পানী রাজত্বের প্রসাদ পেয়ে ধনী-মানী শ্রেণীরূপে গড়ে উঠতে পারত, সে-সম্ভাবনা হল তিরোহিত। তাদের ঔদাসীন্যে হিন্দু বুর্জোয়া শ্ৰেণীই কেবল গড়ে উঠল-হিন্দু-মুসলিম মিশ্র বুর্জোয়া শ্রেণী আর গড়ে উঠতে পারল না। এবং এই শ্রেণীতে মুসলিম নামধারীর অনুপস্থিতিই ছিল ধর্মীয় স্বাজাত্যগর্বী বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভের কারণ। কিন্তু বহিরাগত মুসলিম অবতাংসরা বুর্জোয়া বিত্তের অংশ পেলে দেশী মুসলমানের বাস্তব ও বৈষয়িক কী উপকার হত–কেবল জাতীয় গৌরব-গর্ব করবার মতো নির্বোধ আত্মপ্রসাদ পাওয়া ছাড়া। যে-কয়টি পরিবার ইংরেজ আমলের দুশ বছর ধরে জমিদার হিসেবে টিকে ছিল, তারা দেশী মুসলমানের শিক্ষা বিস্তারে কী সহায়তা করেছে, স্কুল-কলেজ গড়েছে কয়খানা, ছাত্রবৃত্তি দিয়েছে কয়টি! অবশ্য পার্থিব নেতৃত্ব এবং অপার্থিব পুণ্য অর্জনের জন্য দান করেছে প্রচুর-লিল্লাহ দিয়েছে বটে। এরাই আরব-ইরানের খোয়াব দেখিয়ে, সমরকন্দ-বোখারার স্মৃতি জাগিয়ে, উর্দুর মহিমা কীর্তন করে স্বস্থ হতে দেয় নি বাঙালি মুসলমানকে। বারবার বহির্মুখখা ও ছিন্নমূল করবার সচেতন প্রয়াসে তারা দেশী লোকের অগ্রগতির পথ করেছিল রুদ্ধ; দৈশিক জীবন-চেতনা প্রসারে দিয়েছিল বাধা। সে-প্রয়াসে আজো তাদের বিরতি-বিরাম নেই।
অতএব মুসলিম শাসনকালে বিদেশাগত মুসলিম চাকুরে ও অভিজাতদের দ্বারা দেশী মুসলমানের কী উপকার হয়েছিল, আর ইংরেজ আমলে এদের তমঘা, আইমা মদদ-ই মাশ ও জমিদারী বাজেয়াপ্তির বা হারানোর ফলে বাঙালি মুসলমানের কী ক্ষতি হল, তা আজ খুঁটিয়ে দেখবার-বুঝবার প্রয়োজন আছে। নতুবা স্বধর্মীকে স্বজাতি মনে করে অভিন্ন স্বার্থের সুবাদে আস্থা রাখার বিড়ম্বনা কখনো ঘুচবে না।
1. Syed Ameer Ali; A Cry from the Indian Mohammedans Nineteenth Century, London. August 1882, PP 199-200 as quoted by Dr. Muin-ud Din Ahmed Khan, Islamic Studies P.P. 284 Journal of the Islamic Research Institute of Pakistan Vol. VI no 3 for September, 1967.
2.. Dr. A. R. Mullick-British Policy and the Muslims in Bengal 1757 1856. Asiatic Society of Pakistan Publication 1961, Dacca P. 48.