ইতিহাসের রক্তাক্ত দৃশ্য
বিশ্বজিৎ তৈমুর লং!
হ্যাঁ, ‘বিশ্বজিৎ’ উপাধি তাঁরই প্রাপ্য। উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে রুশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত দেশে দেশে সগর্বে উড়েছিল তাঁর রক্তাক্ত জয়পতাকা এবং সমগ্র ইউরোপের রাজারাজড়ারা সর্বদাই সভয়ে তাঁকে খোশামোদ করে তুষ্ট রাখতে চাইতেন।
ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন ওই তৈমুরেরই ষষ্ঠ বংশধর। তারপর একে একে সিংহাসনে বসেন হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাজাহান। শাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন দারা সুকো। আজ আমরা এই দারারই করুণ জীবনকাহিনি বর্ণনা করব।
দারার কথা বলতে তৈমুরের কথা মনে পড়ল বিশেষ এক কারণে। তৈমুরের রক্তে কী বিশেষত্ব ছিল জানি না, কিন্তু তাঁর বংশধররা গৃহবিপ্লব, পিতৃদ্রোহ ও ভ্রাতৃবিরোধ প্রভৃতির দ্বারা নিজেদের কলঙ্কিত করেছিলেন যেন বংশানুক্রমেই।
তৈমুরের মৃত্যুর পরেই তাঁর পুত্রগণ সিংহাসনের জন্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে করেছিলেন অস্ত্রধারণ। ফলে তৈমুরের সৃষ্ট অমন বিশাল সাম্রাজ্য কেবল খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েনি, তার অধিকাংশই তাঁর বংশধরদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।
বাবর প্রথমে ছিলেন ক্ষুদ্র এক নরপতি। কেবল ব্যক্তিগত শক্তি ও প্রতিভার প্রসাদেই তিনি অধিকার করতে পেরেছিলেন দিল্লির সিংহাসন। তাঁর পুত্র ও পৌত্র হচ্ছেন হুমায়ুন ও আকবর। সিংহাসনের কোনও ভাগীদার ছিল না বলেই তাঁদের আর ভাইয়ে ভাইয়ে কাটাকাটি করতে বা গৃহযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে হয়নি।
কিন্তু তারপরেই দেখা গেল, আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর হয়েছেন পিতৃদ্রোহী এবং জাহাঙ্গীরের পুত্র শাজাহানও করেছেন পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ। তারপর ঔরংজীবও বংশের ধারা বজায় রাখতে ছাড়লেন না, সম্রাটের আসন অধিকার করলেন তিনি পিতৃদ্রোহ এবং ভ্রাতৃহত্যার দ্বারা।
এবং নিয়তির ওই অভিশাপ থেকে ঔরংজীব নিজেও অব্যাহতি লাভ করেননি। ঔরংজীবের জীবনকালেই তাঁর পুত্র আকবর বিদ্রোহী হয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরেই অন্যান্য পুত্ররা সিংহাসন লাভের জন্যে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে পিতারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। তারপরেও মোগল রাজবংশ ওই অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। ভ্রাতৃহত্যার দ্বারা তা কলঙ্কিত হয়েছিল আরও কয়েকবার।
এমন সব অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত এবং একই মারাত্মক দৃশ্যের পৌনঃপুনিক অভিনয় পৃথিবীর আর কোনও রাজবংশের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যাবে না।
সম্রাট শাজাহানের চার পুত্র ও দুই কন্যা—তাঁদের নাম যথাক্রমে দারা সুকো, মহম্মদ সুজা, মুহিউদ্দীন মহম্মদ ঔরংজীব ও মহম্মদ মুরাদ বক্স এবং জাহানারা ও রোশেনারা। শাজাহান যাঁর নাম স্থাপত্যে অমর করে রেখে গিয়েছেন, সেই মমতাজমহলই হচ্ছেন এই ছয় সন্তানের জননী।
দারা সুকো ছিলেন জ্যেষ্ঠ। পৃথিবীর সব দেশেই একটা সাধারণ নিয়ম প্রচলিত আছে। জ্যেষ্ঠ রাজপুত্রই হন সিংহাসনের অধিকারী। সুতরাং সম্রাট শাজাহান যে দারাকেই নিজের উত্তরাধিকারী রূপে নির্বাচন করবেন, এটা কিছুমাত্র অন্যায় বা অভাবিত কথা নয়।
কিন্তু তার উপরে একটা বিষয় সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সম্রাট শাজাহানের হাবে-ভাবে-ব্যবহারে সর্বদাই জাহির হয়ে পড়ত যে, তিনি ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন জ্যেষ্ঠপুত্র দারাকেই। এই পক্ষপাতিতা অন্যান্য রাজপুত্রদের ভালো লাগত না।
তবে এ ব্যাপারটাও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর প্রত্যেক সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের মধ্যেও দেখা যায়, একাধিক পুত্রের পিতারা নিজের কোনও একটি ছেলেকে অন্য সন্তানদের চেয়ে বেশি ভালো না বেসে পারেন না।
এমনকী পিতার পক্ষপাতিতার জন্য যে-ঔরংজীব তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে সবচেয়ে বিষদৃষ্টিতে দেখতেন, তিনিও তাঁর অতি অক্ষম কনিষ্ঠ পুত্র কামবক্সকে তাঁর অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে বেশি আদর করতেন।
সাধারণ গৃহস্থ পিতার সম্বল বা সম্পদ হয় নগণ্য কিংবা যৎসামান্য। সে ক্ষেত্রে পিতার একদেশদর্শিতার ফলে পুত্রদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা গেলেও তা আর বেশি দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে না। কিন্তু যেখানে ভারতবর্ষের মতো বিপুল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে কথা, সেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল না থাকলে গুরুতর অনর্থপাতের সম্ভাবনাই বেশি। দেখা গেছে, মুকুটের লোভ পারিবারিক স্নেহের বন্ধন মানে না—পিতা ও পুত্রও হতে পারে পরস্পরের শত্রু। এক্ষেত্রে তাই হয়েছিল।
দারা ছিলেন শাজাহানের নয়নের মণি। দারাকে তিনি নিজের কাছে কাছে রাখতে চাইতেন অহরহ। এবং দারার প্রতি তাঁর এই অতিরিক্ত স্নেহটা বিশেষভাবে জাহির হয়ে পড়ায় অন্যান্য পুত্রের মন হয়ে উঠেছিল হিংসায় পরিপূর্ণ। একটা দৃষ্টান্ত দিই।
শাজাহান তাঁর প্রত্যেক পুত্রকে বালক বয়স থেকেই উপযুক্ত শিক্ষকের অধীনে রেখে নানা বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর ছেলেদের রাজকার্যে হাতেনাতে অভিজ্ঞ করবার জন্যে প্রেরণ করতেন সাম্রাজ্যের এক-এক প্রদেশে রাজপ্রতিনিধিরূপে।
দাক্ষিণাত্য ছিল অশান্তিপূর্ণ এবং রাজধানী দিল্লি থেকে বহুদূরে। শাজাহানের নির্দেশে ঔরংজীবকে রাজপ্রতিনিধিরূপে যেতে হয়েছিল সেইখানে।
মুরাদকেও পাঠানো হয়েছিল দক্ষিণের আর এক প্রদেশে।
মোগল সম্রাটরা নরকের মতো ঘৃণা করতেন সুদূর বাংলাদেশকে, কারণ সেখানকার আবহাওয়া পশ্চিমাদের ধাতে সইত না। দ্বিতীয় রাজপুত্র সুজা প্রেরিত হয়েছিলেন ওই বঙ্গদেশেই।
পাঞ্জাব, এলাহাবাদ ও মূলতান প্রভৃতি প্রদেশ ছিল না অশান্তিকর ও আপত্তিকর, বরং অর্থকর বলেই তাদের খ্যাতি ছিল। সেই সব প্রদেশেই দারাকে রাজপ্রতিনিধির পদে নিযুক্ত করা হত। উপরন্তু, দারাকে অত দূর পর্যন্তও যেতে হত না, তিনি নিজে থাকতেন পিতার আশেপাশেই, প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনা করতেন তাঁর দ্বারা নিযুক্ত কোনও প্রতিভূ।
শাজাহান যখন সসম্মানে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, তখন থেকেই দারা হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি,—তাঁর আসন ছিল সম্রাটের পরেই। তাঁকে ‘শাহী-বুলন্দ-ইকবাল’ (বা মহৎ সৌভাগ্যের রাজা) নামে সুদুর্লভ ও মহাসম্মানকর উপাধিতে ভূষিত এবং চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী সৈনিকের নায়কের পদ প্রদান করা হয়েছিল। যে প্রভূত অর্থ তাঁর জন্যে বৃত্তি বলে বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা বহু নৃপতিরও হিংসা উদ্রেক করতে পারত। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতানুসারে, দারার বাৎসরিক বৃত্তির পরিমাণ ছিল দেড় কোটি থেকে দুই কোটি টাকা। আজকের হিসাবে ওই টাকার পরিমাণ হবে কত গুণ বেশি, সকলে তা কষে দেখতে পারেন।
রাজসভায় সম্রাটের কাছেই থাকত যুবরাজ দারার জন্যে নির্দিষ্ট সোনার সিংহাসন—ময়ূর সিংহাসনের চেয়ে তার উচ্চতা খুব কম ছিল না। সামরিক পদমর্যাদায় দারার পুত্ররাও ছিলেন সম্রাটের অন্যান্য পুত্রদের সমকক্ষ।
মুখাপেক্ষী কিংবা সামন্ত রাজা, উপাধি বা পদপ্রার্থীরা এবং সম্রাটের বিরক্তিভাজন কৃপাপ্রার্থীরা শাজাহানের কাছে যাওয়ার আগে দারার কাছে গিয়ে ধরনা দিতেন। পদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং নূতন উপাধিধারীগণ যুবরাজের কাছে নতি স্বীকার করবার জন্য স্বয়ং সম্রাট কর্তৃক আদিষ্ট হতেন।
শেষের দিকে সম্রাটের সামনে বসে বা তাঁর অনুপস্থিতিকালেও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন দারাই স্বয়ং। এমনকী তিনি স্বাধীনভাবে সম্রাটের নাম ও শীলমোহর পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারতেন।
ব্যাপার দেখে অন্যান্য রাজপুত্রের মনে হিংসা ও ক্রোধের সীমা ছিল না। এইভাবে দিল্লির রাজপরিবারের মধ্যে গোড়া থেকেই বোনা হয়েছিল বিষবৃক্ষের বীজ।
শত্রুরা দারার চরিত্রকে কালো রঙে এঁকে দেখাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য দেখে বোঝা যায়, সেটা হয়েছে অপচেষ্টা মাত্র।
দারা ছিলেন ভদ্র ও বিনয়ী এবং বন্ধু ও দুর্গতদের সাহায্য করবার জন্যে প্রস্তুত। পত্নী ও পুত্রদের তিনি খুব ভালোবাসতেন এবং পিতাকেও করতেন রীতিমতো শ্রদ্ধা।
কিন্তু তিনি আজন্ম লালিতপালিত হয়েছিলেন অসামান্য সৌভাগ্যের কোলে, যখন যা চেয়েছেন তা পেয়েছেন অনায়াসেই এবং কখনও কিছুমাত্র দুঃখবোধ করেননি। তাই ছিল না তাঁর দূরদৃষ্টি ও মানুষ চেনার ক্ষমতা। মনের ও বুদ্ধির জোরে প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না।
শাজাহানের কন্যা জাহানারার আত্মজীবনীতে প্রকাশ, প্রপিতামহ আকবর যে স্বপ্ন দেখতেন, প্রপৌত্র দারা নিজের জীবনে তাকেই সম্ভবপর করে তোলবার চেষ্টা করতেন। আকবর হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের অবসান এবং এক নূতন ও উদার ধর্মমত প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। দারারও কাম্য ছিল তাই।
কিন্তু কেবল স্বপ্ন দেখেই রাজদণ্ড পরিচালনা করা যায় না। সর্বত্র উদারতার সাধনা করা রাজধর্মের বিরোধী। আকবর ছিলেন কূটকচালে রাজনীতিতে বিশেষ অভিজ্ঞ—দারা যা ছিলেন না। আকবরের ছিল প্রথম শ্রেণির যুদ্ধপ্রতিভা। দারাও যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু সেনাপতির কর্তব্যপালন করতে পারতেন না।
একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক দারার ধর্মমত সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার সারমর্ম হচ্ছে এই :
দারা ছিলেন সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, তাই তিনি ইহুদিদের ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, মুসলমানদের সুফিধর্ম (যার সঙ্গে আমাদের বৈষ্ণবধর্মের মিল দেখা যায়) এবং হিন্দুদের বেদান্তধর্ম অনুশীলন করেছিলেন।
তাঁর দ্বারা একদল হিন্দু পণ্ডিতের সাহায্যে পারসি ভাষায় উপনিষদ অনূদিত হয়েছিল। তাঁর আর একখানি পুস্তকের নাম হচ্ছে, ‘মাজমুয়া-উল-বাহারিণ’ বা ‘দুই সাগরের সম্মিলন’। তা পাঠ করলে বোঝা যায়, তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন এক মিলনক্ষেত্র আবিষ্কার করা, যেখানে এসে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে সম্মিলিত হতে পারে।
তিনি হিন্দু যোগী লালদাস ও মুসলমান ফকির সারমাদের পদতলে বসে শিষ্যের মতো মনোযোগ দিয়ে উভয়ের উপদেশবাণী শ্রবণ করতেন।
তাবলে তিনি স্বধর্মবিরোধী ছিলেন না। তিনি মুসলমান সাধুদের একখানি জীবনচরিত সংকলন করেছিলেন। শিষ্যরূপে তাঁর দীক্ষা হয়েছিল মুসলমান সাধু মিয়ান মীরের কাছে—কোনও কাফেরের পক্ষে যা ছিল অসম্ভব। দারার নিজের কথাতেই প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি ইসলামের মূল ধর্মমতে অবিশ্বাসী ছিলেন না।
কিন্তু তিনি ছিলেন হিন্দুদের বন্ধু। অন্যান্য গোঁড়া মুসলমানের মতো তিনি কোনও দিনই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ বা ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করতে পারতেন না। এইসব কারণে, বিশেষ করে হিন্দুদের কাছে দারা ছিলেন অত্যন্ত লোকপ্রিয়।
আলোচ্য নাটকীয় কাহিনির প্রধান ও প্রথম নায়ক দারা এবং দ্বিতীয় নায়ক হচ্ছেন ঔরঙ্গজিব। এইবারে তাঁরও একটু পরিচয়ের দরকার।
ঔরঙ্গজিব ছিলেন দারার চেয়ে কিছু কম, চার বৎসরের ছোট। সম্রাট শাজাহানের অন্যান্য পুত্রের মতো বাল্যে ও যৌবনে উপযুক্ত শিক্ষকদের অধীনে তিনিও বিদ্যালাভের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন।
আরবি, পারসি, হিন্দি ও তুর্কি ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল। কাব্যের প্রতি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা না থাকলেও তিনি কয়েকজন কবির উপদেশপূর্ণ রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং দরকার হলেই মুখে মুখে তাঁদের বচন উদ্ধার করতে পারতেন। তিনি ইতিহাস পছন্দ করতেন না, কিন্তু ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে ভালোবাসতেন। নাচ-গান-ছবি তিনি পছন্দ করতেন না।
জাহানারার আত্মকাহিনিতে বালক ঔরঙ্গজিব সম্বন্ধে একটি কাহিনি পাঠ করা যায়। পিতামহ জাহাঙ্গীর ও পিতা শাজাহান দুজনেই প্রথম বয়সে হয়েছিলেন পিতৃদ্রোহী। শাজাহানেরও তাই ভয় ছিল যে, তাঁর পুত্রেরাও হয়তো কোনওদিন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। সেইজন্যে এক ভবিষ্যদবক্তা সন্ন্যাসীকে তিনি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমার কোনও ছেলে কি আমার বিরুদ্ধাচারণ করে সাম্রাজ্য নষ্ট করবে?’
সন্ন্যাসী বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’
—’কে সে?’
—’যে সবচেয়ে ফরসা।’
ঔরঙ্গজিবের গায়ের রং ছিল অতিশয় শুভ্র। ভবিষ্যদবাণীর সময় তাঁর বয়স ছিল দশ বৎসর মাত্র। শাজাহান কিন্তু সেই দিন থেকেই তাঁকে আর ভালো চোখে দেখতেন না এবং তার নাম রেখেছিলেন ‘শ্বেতসর্প’।
বালক বয়েস থেকেই ঔরঙ্গজিব ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর। এখানে তাঁর সাহস ও বীরত্বের একটি গল্প দেওয়া গেল :
কিন্তু তার আগে আর একটা কথা বলা উচিত। মোগল সম্রাট ও রাজপুত্ররা—অর্থাৎ তৈমুরের বংশধররা চিরদিনই ছিলেন বীরত্ব ও সাহসের জন্যে বিখ্যাত, তৈমুরের রক্তে কাপুরুষের জন্ম হয়নি বললেও চলে। মোগল রাজবংশের উৎপত্তি যে তৈমুরের রক্ত থেকেই, এর জন্যে তাঁরা ছিলেন মনে মনে গর্বিত।
ঔরঙ্গজিবের ছোট ছেলে কামবক্স ছিলেন নির্বোধ, নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও প্রমোদপ্রিয়—তাঁকে অকালকুষ্মাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করলেও অন্যায় হবে না।
মেজো ভাই সম্রাট বাহাদুর শাহের সঙ্গে যুদ্ধ পরাস্ত হয়ে অনায়াসেই তিনি পলায়ন করতে পারতেন। কিন্তু পালাবার নাম মুখেও না এনে লড়তে লড়তে সাঙ্ঘাতিকরূপে আহত হয়ে তিনি প্রাণত্যাগ করেন এবং মরবার আগে বলে যান—আমি হচ্ছি তৈমুরের বংশধর, পাছে কেউ আমাকে কাপুরুষ ভাবে সেই ভয়েই স্বেচ্ছায় আমি মৃত্যুকে বরণ করেছি।
এইবারে গল্পটা বলি।
যে সময়ের কথা বলছি তখন ঔরঙ্গজিবের বয়স মাত্র চৌদ্দো বৎসর।
সম্রাট শাজাহানকে হাতির লড়াই দেখানো হচ্ছে, আশেপাশে দর্শকরূপে রাজপুত্র ও আমির-ওমরাওদের সঙ্গে উপস্থিত আছে সৈন্যসামন্ত ও এক বৃহতী জনতা।
আচম্বিতে একটা হাতি খেপে গিয়ে তেড়ে এল অশ্বারোহী ঔরঙ্গজিবের দিকে। তখনও পালাবার পথ খোলা ছিল, কিন্তু ঔরঙ্গজিব সে কথা মনেও আনলেন না। পাছে ঘোড়া ভয় পেয়ে সরে পড়ে, তাই তিনি তার বল্গা টেনে রেখে স্থিরভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হাতিটা আরও কাছে এগিয়ে এল, ঔরঙ্গজিব বল্লম তুলে সজোরে তার দিকে নিক্ষেপ করলেন।
হইহই রব উঠল চারিদিকে। আমির-ওমরাও এবং অন্যান্য লোকজন ছুটোছুটি ও চেঁচামেচি করতে লাগল—হাতিকে ভয় পাওয়াবার জন্যে অনেক আতসবাজি ছোড়া হল—কিন্তু বৃথা!
মত্তমাতঙ্গ ছুটে এসে শুঁড়ের এক আঘাতে ঘোড়াটাকে মাটির উপরে পেড়ে ফেললে—আর রক্ষা নেই!
ঔরঙ্গজিব এক লাফে মাটির উপরে লাফিয়ে পড়ে, খাপ থেকে তরোয়াল খুলে অটল পদে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন হাতির সামনে।
হঠাৎ দৈবগতিকে হল দৃশ্য পরিবর্তন! একে তো ভীষণ হট্টগোলে, বল্লমের খোঁচায় ও আতসবাজির সশব্দ অগ্নিকাণ্ডে হাতিটা চমকে ও ভেবড়ে গিয়েছিল, তার উপরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হাতিটাও আবার রুখে উঠে তাকে আক্রমণ করতে আসছে দেখে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে পৃষ্ঠভঙ্গ দিতে কালবিলম্ব করলে না।
ফাঁড়া উৎরে গেল ভালোয় ভালোয়, সকলে আশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
শাজাহান তাঁর বীর সন্তানকে সাদরে বুকের ভিতরে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বুঝলেন, একদিক দিয়ে ঔরঙ্গজিব হচ্ছেন তাঁরই যোগ্য পুত্র, কারণ তিনিও যৌবনে পিতা জাহাঙ্গীরের চোখের সামনে তরবারি হাতে নিয়ে নির্ভয়ে আক্রমণ করেছিলেন এক বন্য ও দুর্দান্ত ব্যাঘ্রকে।
ঔরঙ্গজিব লাভ করলেন ‘বাহাদুর’ উপাধি এবং পুরস্কার স্বরূপ দুই লক্ষ টাকা দামের উপহার ও নগদ পাঁচ হাজার মোহর।
ছেলের গোঁয়ারতুমির জন্য সম্রাট যখন মৌখিক ভর্ৎসনা করলেন। ঔরঙ্গজিব উত্তরে বললেন, ‘পলায়নই ছিল লজ্জাকর। আমি মরলেও সেটা লজ্জার বিষয় হত না। মৃত্যু সম্রাটকেও ছেড়ে দেয় না, তাতে সম্মানহানি হয় না।’
দারা বাপের আদুরে ছেলে বলে রাজপুত্ররা সবাই অসন্তুষ্ট ছিলেন, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু দারার প্রতি ঔরঙ্গজিবের অসন্তোষ, ক্রোধ ও আক্রোশ ছিল আর সকলেরই চেয়ে বেশি। এ বিদ্বেষ তাঁর বাল্যকাল থেকেই এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিদ্বেষও বেড়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে।
ঔরঙ্গজিব তখন দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধি এবং তাঁর বয়স ছাব্বিশ বৎসর। জ্যেষ্ঠ দারা পিতার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র বলে মন তাঁর তিক্তবিরক্ত। তাঁর তখনকার মৌখিক ভাষায় এবং চিঠিপত্রে দারার প্রতি এই বিষম আক্রোশটা সর্বদাই প্রকাশ পেত। তার উপরে সেই সময়ে এমন এক ঘটনা ঘটল যার ফলে সেই বিরাগটা হয়ে উঠল দস্তুরমতো বিজাতীয়।
দৈবগতিকে আগুনে পুড়ে সহোদরা জাহানারার জীবন নিয়ে টানাটানি চলছে। বোনকে দেখবার জন্যে ঔরঙ্গজিব এলেন আগ্রা শহরে।
সেই সময়ে সেখানে যমুনাতীরে দারা নিজের জন্যে তৈরি করিয়েছিলেন এক নতুন প্রাসাদ। একদিন তিনি পিতা ও তিন ভ্রাতাকে প্রাসাদ দেখবার জন্যে আমন্ত্রণ করলেন।
গ্রীষ্মের দারুণ উত্তাপ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে সেখানে ভূগর্ভে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি কক্ষ এবং তার মধ্যে আনাগোনা করবার জন্যে ছিল একটিমাত্র দ্বার।
দারার সঙ্গে সঙ্গে শাজাহান, সুজা ও মুরাদ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন, কিন্তু ঔরঙ্গজিব একা বসে রইলেন দ্বারের কাছে।
শাজাহান বারংবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, তাঁর ওই আশ্চর্য ও অশোভন ব্যবহারের কারণ কী, তিনি কিন্তু চুপ করে বসে রইলেন সেইখানেই, কোনও জবাব দিলেন না।
তাঁর এই অবাধ্যতার শাস্তি হল গুরুতর। কেবল তাঁর বৃত্তিই বন্ধ করে দেওয়া হল না, দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধিত্ব ও রাজসভায় প্রবেশাধিকার থেকেও তিনি বঞ্চিত হলেন।
সুদীর্ঘ সাতমাসকালে অলসভাবে বসে থাকবার ও অপমানকর জীবনযাপন করবার পর অবশেষে জাহানারার কাছে তিনি তাঁর অবাধ্যতার কারণের কথা খুলে বললেন :
—’ঘরের একটি মাত্র দরজা, বাইরে যাবার দ্বিতীয় পথ নেই। আমি ভেবেছিলুম সেখানে সুযোগ পেয়ে দারা আমাদের সকলকে হত্যা করে সিংহাসনের পথ সুগম করে ফেলবেন! তাই পাহারা দেওয়ার জন্যে আমি দরজার কাছেই বসেছিলুম।’
দেখা যাচ্ছে, যৌবন বয়সেই ঔরঙ্গজিবের মনে ধারণা জন্মেছিল, দারাই হচ্ছেন তাঁর প্রধান শত্রু এবং সিংহাসনের লোভে ভ্রাতৃহত্যা—এমনকী পিতৃহত্যা করাও অত্যন্ত স্বাভাবিক।
এই একটি ঘটনার মধ্যেই ঔরঙ্গজিব-চরিত্রের সমস্ত রহস্যের হদিশ পাওয়া যাবে। বীজ থেকে বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে তখনই, বাকি কেবল ফল ধরা!
সাতমাস পরে ভগ্নী জাহানারা ভ্রাতা ঔরঙ্গজিবের জন্য পিতার কাছে ধরনা দিলেন। মেয়েদের মধ্যে জাহানারাই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়পাত্রী। তাঁর অনুরোধ শাজাহান ঠেলতে পারলেন না, ঔরঙ্গজিবের অপরাধ মার্জনা করে রাজপ্রতিনিধিরূপে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন গুজরাট প্রদেশে।
১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ। পরিপূর্ণ সুখ, সমৃদ্ধি ও গৌরবের মাঝখানে ভারত সম্রাট শাজাহান অকস্মাৎ সাংঘাতিক ব্যাধির আক্রমণে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।
সম্রাট বাইরে আর দেখা দেন না, দরবারও আর বসে না। রোগীর গৃহে রাজ-সভাসদদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রোগশয্যার পাশে যেতে পারতেন একমাত্র দারাই।
হপ্তাখানেক ধরে চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টার পর সম্রাটের অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হল বটে, কিন্তু ওই পর্যন্ত। তিনি শয্যা ছাড়তে পারলেন না। চিকিৎসকরা উপদেশ দিলেন বায়ুপরিবর্তন করতে। দিল্লি থেকে তাঁকে আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হল। তবু তাঁর অসুখ সারল না।
ইতিমধ্যে নিজের আসন্নকাল উপস্থিত হয়েছে ভেবে, সম্রাট আমির-ওমরাওদের আহ্বান করে সকলের সামনে ঘোষণা করেছেন, তাঁর অবর্তমানে সিংহাসনের মালিক হবেন যুবরাজ দারাই।
আগ্রায় এসে সম্রাট আশ্রয় গ্রহণ করেছেন দারার নিজস্ব প্রাসাদেই। দারা সেখানে আর কাউকে ঢুকতে দেন না, একাই সেবাশুশ্রূষা করে পিতাকে নিরাময় করে তোলবার চেষ্টায় নিযুক্ত থাকেন এবং সম্রাটের নামে নিজেই রাজকার্য পরিচালনা করেন।
ওদিকে বাইরে গুজবের অন্ত নেই। দিকে দিকে জনরব উঠল, সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, স্বার্থসিদ্ধির জন্যে দারা সে খবর গোপন রাখতে চান।
সুজা, মুরাদ ও ঔরঙ্গজিব এই সুযোগই খুঁজছিলেন, স্বরূপ প্রকাশ করতে তাঁরা আর বিলম্ব করলেন না।
বাংলাদেশের রাজপ্রতিনিধি সুজা সেইখানে বসেই নিজেকে ভারতসম্রাট বলে ঘোষণা করলেন।
গুজরাটের তখনকার রাজপ্রতিনিধি মুরাদও পিছনে পড়ে থাকবার পাত্র নন—তিনিও ধারণ করলেন ভারতসম্রাটের পদবি!
দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধি ছিলেন ঔরঙ্গজিব। ভ্রাতাদের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন ধূর্ত ও সাবধানী। তিনি সহজে মুখোশ খুললেন না। তিনিও সৈন্যাদি সংগ্রহ করে যুদ্ধের তোড়জোড় করতে লাগলেন বটে, কিন্তু গাছে কাঁঠাল দেখেই গোঁফে তেল মাখতে চাইলেন না—অর্থাৎ প্রথমেই ধারণ করলেন না সম্রাট উপাধি।
মুরাদ ছিলেন তাঁর কাছেই এবং তিনি জানতেন ভাইদের মধ্যে মুরাদই হচ্ছে সবচেয়ে নির্বোধ। তার উপরে তিনি উগ্র এবং গোঁয়ার-গোবিন্দ। কিন্তু তিনি ছিলেন রীতিমতো যোদ্ধা; একবার রণক্ষেত্রে গিয়ে দাঁড়ালেই তাঁর ধমনীর মধ্যে তৈমুরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠত। এমন লোককে সহজেই দলে টানা যায় এবং এমন লোককে দলে টানতে পারলে যথেষ্ট শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা।
অতএব ঔরঙ্গজিব মিষ্ট কথায় মুরাদকে বোঝালেন যে, দারা হচ্ছে অধার্মিক, নমাজ পড়ে না, রমজানের উপবাস করে না, তার বন্ধু হচ্ছে হিন্দু যোগী, সন্ন্যাসী ও ব্রাহ্মণগণ। শর্ত হল যে, আগে দুইজনে মিলে এমন নাস্তিক লোককে পথ থেকে সরাতে হবে, তারপরে যুদ্ধে জয়লাভ করলে মুরাদ হবেন পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও সিন্ধু প্রদেশের মুকুটধারী স্বাধীন নরপতি এবং সাম্রাজ্যের বাকি অংশ লাভ করবেন ঔরঙ্গজিব। সেইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, শর্তের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন বলে ঔরঙ্গজিব পবিত্র কোরান পর্যন্ত স্পর্শ করতে ভোলেননি। সরল বিশ্বাসী মুরাদও এই শর্তে রাজি হয়ে গেলেন।
সবাই মিলে একজোট হয়ে দাঁড়াবে আক্রমণ করবার জন্যে। সুজাকেও ফুসলে দলে ভেড়াবার ইচ্ছা ছিল ঔরঙ্গজিব ও মুরাদের, কিন্তু বাংলা অত্যন্ত দূরদেশ বলে ইচ্ছাটা শেষ পর্যন্ত কার্যে পরিণত হয়নি।
ইতিমধ্যে শাজাহান রোগমুক্ত হয়ে সমস্ত খবর শুনলেন। তাড়াতাড়ি স্বহস্তে পত্র লিখে সিংহাসনপ্রার্থী তিন পুত্রকে জানালেন যে, তিনি ইহলোকেই বর্তমান এবং সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত। কিন্তু তাতেও ফল হল না। পুত্ররা সন্দেহ করলেন জালপত্র পাঠিয়ে দারা তাঁদের ঠকাবার চেষ্টা করছে।
সম্রাটের সম্মতি নিয়ে দারা তখন সুজা, ঔরঙ্গজিব ও মুরাদের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক বৃহৎ ফৌজ প্রেরণ করলেন। সেই তিন ফৌজের সঙ্গে গেলেন শাজাহানের প্রধান প্রধান খ্যাতিমান সেনাপতিরা, ফলে দারার কাছে আগ্রায় যে সেনাদল রইল, তাদের চালনা করবার মতো যোগ্য সেনাপতির অভাব হল অত্যন্ত।
এই গৃহযুদ্ধের সময়ে রোগদুর্বল, জরার্জর শাহাজানের অবস্থা হয়েছিল অতিশয় করুণ। যারা এখন পরস্পরের সঙ্গে হানাহানি করতে উদ্যত, তারা প্রত্যেকেই তাঁর নিজের রক্তে গড়া পুত্র, কত আদরের ও স্নেহের নিধি, তাদের যে-কোনও একজনকে আঘাত করলে সে আঘাত বাজবে তাঁর নিজেরই বুকে!
যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে ভারতসম্রাট শাজাহান সাধারণ পিতার মতোই কাতরভাবে তাঁর সেনাপতিদের কাছে মিনতি জানালেন যেন তাঁর পুত্রদের কোনও অনিষ্ট না হয়, যেন বিনা যুদ্ধেই মিষ্ট কথায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের আবার যথাস্থানে ফিরে যেতে বলা হয়!
যুদ্ধ যখন বাধে, তখন সাজাহানের বয়স আটষট্টি। তাঁর প্রত্যেক পুত্রও তখন যৌবনের সীমা অতিক্রম করেছেন—দারার বয়স হয়েছিল তেতাল্লিশ, সুজার বয়স একচল্লিশ, ঔরঙ্গজিবের উনচল্লিশ এবং মুরাদের তেত্রিশ।
ঔরঙ্গজিব ও মুরাদের বিরুদ্ধে যে সেনাদল প্রেরিত হয়েছিল তার সেনাপতি ছিলেন মহারাজা যশোবন্ত সিংহ এবং কাসিম খাঁ ছিলেন তাঁর সহযোগী সেনাপতি। উজ্জয়িনী নগরের নিকটস্থ ধরমাট নামক স্থানে দুইপক্ষের প্রথম শক্তিপরীক্ষা হয়। উভয় পক্ষেই সৈন্যসংখ্যা ছিল কিছু বেশি—পঁয়ত্রিশ হাজার।
রাজপুত ও মুসলমান নিয়ে দারার সৈন্যদল গঠিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ছিল না কিছুমাত্র একতা। রাজপুতরা বীরের মতো লড়তে ও মরতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই ছিল বিশ্বাসঘাতক এবং মনে মনে ঔরঙ্গজিবের পক্ষপাতী। তাই যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গিয়েছিল, চব্বিশজন রাজপুত সর্দার নিহত হয়েছেন এবং মুসলমানদের মধ্যে মারা পড়েছেন একজন মাত্র সেনাপতি। মুসলমানরা কেবল যে ভালো করে লড়েনি, তা নয়; লড়াই শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চার-চারজন মুসলমান সেনাপতি শত্রুপক্ষে যোগদান করেছিল।
উপরন্তু ঔরঙ্গজিবের ফৌজে ছিল সুনিপুণ ফরাসি ও ইংরেজ গোলন্দাজগণ; দারার বা সম্রাটের ফৌজে ছিল না আগ্নেয়াস্ত্র। কজেই ধরতে গেলে কামানের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল তরবারিকে।
এমন যুদ্ধের ফল যা হওয়া উচিত, তাই হল। হাজার হাজার রাজপুত সৈন্য প্রাণদান করলে বটে, কিন্তু জয়লাভ করতে পারলে না। যশোবন্ত সিংহকে রণক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করতে হল।
জাহানারা বলেন, আগ্রায় যখন খবর এল, ধরমাটের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ঔরঙ্গজিব সদলবলে রাজধানীর দিকে ছুটে আসছেন, তখন বিপুল সম্পদের মধ্যেও হতভাগ্য সম্রাট শাজাহান আকাশের দিকে হাত তুলে আর্তকণ্ঠে বলে উঠেছিলেন—’হে ঈশ্বর, তোমারি ইচ্ছা!’
তারপর তিনি নিজেই যুদ্ধযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে সেনাপতিদের আহ্বান করে আদেশ দিলেন, ‘অবিলম্বে সৈন্য সমাবেশ করো!’
কিন্তু সম্রাটের পরামর্শদাতাদেরও মধ্যে ঔরঙ্গজিবের চরের অভাব ছিল না। তারা বেশ জানত, শাজাহান স্বয়ং সেনাদলের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়ালে বিলুপ্ত হবে বিদ্রোহী পুত্রদের সমস্ত আশা-ভরসা! অতএব তারা নানা মিথ্যা কারণ বা ভয় দেখিয়ে যুদ্ধযাত্রা থেকে সম্রাটকে নিরস্ত করে।
দারা তাড়াতাড়ি ষাটহাজার নূতন সৈন্য সংগ্রহ করে ঔরঙ্গজিব ও মুরাদকে বাধা দেওয়ার জন্যে অগ্রসর হলেন। এই নূতন সৈন্যরা দলে ভারী হল বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল শিক্ষিত যোদ্ধার অভাব।
এবারও ফৌজের মধ্যে মুসলমান সেনানী ও সৈনিকদের মধ্যে অনেকেই ছিল শত্রুপক্ষের চর বা ঔরঙ্গজিবের পক্ষপাতী। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের উনত্রিশ মে তারিখে সামুগড়ের প্রান্তরে যে যুদ্ধ হল, তাতেও প্রধান অংশ গ্রহণ করলে রাজপুত যোদ্ধারাই—তারাই হিন্দুদের প্রিয় দারার স্বার্থরক্ষার জন্যে দলে দলে লড়তে ও মরতে লাগল এবং ফৌজের প্রায় অর্ধেক মুসলমান সৈন্য ছিল বিশ্বাসঘাতক, তারা মুখরক্ষার জন্যে করলে কৃত্রিম যুদ্ধের অভিনয় মাত্র।
ফলে এবারেও হল যুবরাজ দারার শোচনীয় পরাজয়।
সামুগড়ের যুদ্ধে সম্রাটের ফৌজ পরাজিত এবং ঔরঙ্গজিব ও মুরাদ সসৈন্যে আগ্রার দিকে ধাবমান, এই দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে এল এক ফিরিঙ্গি ভগ্নদূত।
রাত্রের অন্ধকারে গা ঢেকে পরাজিত, পরিশ্রান্ত ও দুঃখে মুহ্যমান দারা কয়েক জন অনুচরের সঙ্গে আগ্রায় ফিরে এলেন বটে, কিন্তু দুর্গের মধ্যে প্রবেশ না করে নিজের প্রাসাদের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।
দুর্গের মধ্যে অপেক্ষা করছিলেন বৃদ্ধ সম্রাট শাজাহান—গভীর নিরাশার প্রস্তরীভূত মূর্তির মতো। প্রিয় পুত্র দারাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠালেন, কিন্তু উত্তরে দারা লিখে জানালেন, ‘এই শোচনীয় দুর্দশার দিনে সম্রাটের কাছে মুখ দেখাবার ক্ষমতা আমার নেই। আমার সামনে রয়েছে যে সুদীর্ঘ পথ, আপনার আশীর্বাদ ও আদেশ পেলে আমি এখন সেই পথেরই পথিক হব।’
মর্মাহত শাজাহানের মনে হল, তাঁর আত্মা যেন দেহপিঞ্জর ত্যাগ করে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু শত্রুরা এখন হিংস্র শার্দূলের মতো অসহায় দারার বিরুদ্ধে বেগে ছুটে আসছে, তাঁর আর দুঃখ প্রকাশ করবারও অবসর নেই। তিনি তৎক্ষণাৎ দুর্গপ্রাসাদের ধনভাণ্ডার খুলে পুঞ্জ পুঞ্জ ধনরত্ন স্নেহাস্পদ দারার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
আগ্রা থেকে দারা যাবেন দিল্লিতে। সেখানকার শাসনকর্তার কাছেও সম্রাটের আদেশ গেল—দিল্লির ধনভাণ্ডারের চাবি যেন দারার হাতে সমর্পণ করা হয়।
জন বারো অনুচর ও রক্ষী নিয়ে পলাতক দারা সহধর্মিণী নাদিরা বানু ও সন্তানদের সঙ্গে বিপদজনক আগ্রা নগরী ত্যাগ করলেন। বিজয়ী সৈন্যদলের সঙ্গে নিষ্ঠুর ঔরঙ্গজিব আগ্রা অধিকার করতে আসছে, একবার তার কবলে গিয়ে পড়লে যে তাঁর মুক্তিলাভের কোনও উপায়ই থাকবে না, এ কথা দারা ভালো করেই জানতেন।
তারপর আগ্রায় যে অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হল তার কথা এখানে বর্ণনা করবার দরকার নেই, কারণ আমাদের এখন যেতে হবে এই কাহিনির নায়ক দারার পিছনে পিছনে।
তবে দু-চারটে কথা উল্লেখযোগ্য। ঔরঙ্গজিব আগ্রা অধিকার ও দুর্গ অবরোধ করলেন। তাঁকে বোঝাবার জন্যে একবার শেষ চেষ্টা করবার উদ্দেশ্যে ঔরঙ্গজিবের সঙ্গে সম্রাট দেখা করতে চাইলেন।
কিন্তু ঔরঙ্গজিব নারাজ।
তখন সম্রাট-কন্যা জাহানারা নূতন এক প্রস্তাব নিয়ে ভ্রাতা ঔরঙ্গজিবের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। প্রস্তাবটি হচ্ছে এই :
সম্রাটের ইচ্ছা যে, সাম্রাজ্য চার রাজপুত্রদের জন্যে চার ভাগে বিভক্ত করা হোক।
দারাকে দেওয়া হোক পাঞ্জাব ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলি।
মুরাদের জন্যে গুজরাট, সুজার জন্যে বঙ্গদেশ এবং ঔরঙ্গজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ সুলতানের জন্যে দাক্ষিণাত্য।
সাম্রাজ্যের বাকি অংশ এবং সাজাহানের অবর্তমানে সিংহাসনের অধিকারী হবেন দারার বদলে ঔরঙ্গজিব।
ঔরঙ্গজিব কিন্তু নিজের সংকল্পে অটল। জবাবে জানালেন, ‘দারা হচ্ছে ইসলামে অবিশ্বাসী ও হিন্দুদের বন্ধু। সত্য ধর্ম ও সাম্রাজ্যের শান্তির জন্যে দারাকে একেবারে উচ্ছেদ না করে আমি ছাড়ব না।’
১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাজাহান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং সুদীর্ঘ সাত বৎসরকাল আগ্রা দুর্গে বন্দিজীবন যাপন করবার পর তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স পূর্ণ চুয়াত্তর বৎসর।
মুরাদের সম্বন্ধে এখানে বিশেষ কিছু বলবার নেই। নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ঔরঙ্গজিব যে তাঁকে স্বহস্তচালিত যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছেন, নির্বোধ মুরাদ শেষ পর্যন্ত এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করতে পারেননি—যেদিন তাঁর চটকা ভাঙল, সেদিন তিনি বন্দি। সে হচ্ছে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের পঁচিশে জুন তারিখের কথা। তিন বৎসর পরে গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে পলায়নের চেষ্টা করেছিলেন বলে ঔরঙ্গজিবের ইচ্ছানুসারে কাজীর বিচারে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন।
সুজাও করেছিলেন সিংহাসনের লোভে অস্ত্রধারণ। প্রথম যুদ্ধে তিনি দারার পুত্র সুলেমান সুকোর কাছে পরাজিত হন, কিন্তু তারপর তাঁর সঙ্গে দারার কাহিনির আর কোনও সম্পর্ক নেই। তারপর তিনি ঔরঙ্গজিবের কাছে বার বার হার মেনে ভারত ছেড়ে আরাকানে গিয়ে মগদের হাতে মারা পড়েন, কিন্তু সে সব কথা হচ্ছে এখানে অবান্তর।
অতঃপর দারার জীবনের কথা বলতে গেলে বলতে হবে কেবল দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনার কাহিনি। এতদিন জীবন ছিল তাঁর সুদীর্ঘ এক সুখস্বপ্নের মতো, কিন্তু সামুগড়ের যুদ্ধের পর তিনি এ জীবনে আর এক মুহূর্তের জন্যেও সুখশান্তির ইঙ্গিত পর্যন্ত দেখতে পাননি। সুখ আর দুঃখ, দুয়েরই দান পেয়েছিলেন তিনি অপরিমিত মাত্রায়।
দিল্লিতে এসে দারা আবার নতুন ফৌজ গঠনের জন্যে তোড়জোড় করতে লাগলেন। কতক সৈন্য সৃংগৃহীত হল বটে, কিন্তু তাদের সংখ্যা হল না সন্তোষজনক।
তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলেমান সুকোকে বাইশ হাজার সৈন্য দিয়ে সুজার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত দুই সেনাপতি—মির্জ্জা রাজা জয়সিংহ ও দিলির খাঁ। দারা তাঁদের দিল্লিতে এসে তাঁর সঙ্গে যোগদান করতে বললেন।
কিন্তু তাঁদের আগে আগেই বিপুল এক বাহিনী নিয়ে দিল্লির দিকে আসতে লাগলেন স্বয়ং ঔরঙ্গজিব। উপায়ান্তর না দেখে দারা প্রস্থান করলেন লাহোরের দিকে, সঙ্গে রইল তাঁর দশহাজার সৈন্য।
দিল্লিতে পৌঁছে ঔরঙ্গজিব প্রথমে নিজেকে ভারত সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন। তারপর যাত্রা করলেন লাহোরের দিকে।
দারা হতাশভাবে বললেন, ‘আমি ঔরঙ্গজিবকে বাধা দিতে পারব না। আর কেউ হলে এইখানে দাঁড়িয়েই তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করতুম।’
দারা আবার পলায়ন করলেন মুলতানের দিকে। সেখানেও পিছনে পিছনে এলেন সদলবলে ঔরঙ্গজিব। দারা মুলতান থেকে পালালেন সক্কর শহরের দিকে এবং তারপর কান্দাহারের পথে এবং তারপর আবার স্থান থেকে স্থানান্তরে।
এমন সময় খবর এল সুজা সসৈন্যে আগ্রার নিকটবর্তী হয়েছেন। দারার অবস্থা তখন একান্ত অসহায়, কারণ তাঁর অধিকাংশ সৈন্য হতাশ হয়ে তাঁর পক্ষ পরিত্যাগ করেছে। আপাতত কিছুকাল তিনি আর মাথা তুলতে পারবেন না বুঝে ঔরঙ্গজিব সমস্ত শক্তি একত্র করে সুজার বিরুদ্ধে করলেন যুদ্ধযাত্রা। কিছুদিনের জন্য দারা পেলেন রেহাই।
পর বৎসর—অর্থাৎ ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দ। খাজোয়ার ক্ষেত্রে সুজাকে পরাজিত ও বিহারের দিকে বিতাড়িত করে ঔরঙ্গজিব খবর পেলেন যে, দারা রাজস্থানে গিয়ে বাইশ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে আবার যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনিও যাত্রা করলেন দারার উদ্দেশ্যে।
আজমীরের চার মাইল দক্ষিণে দেওরাই গিরিসঙ্কটের কাছে আবার দুই ভ্রাতার শক্তি পরীক্ষা হল। এবারে দারা চারিদিক সামলে প্রাণপণে যুঝে প্রথমটা ঔরঙ্গজিবকে বেশ কাবু করেও শেষ পর্যন্ত আবার হার মানতে বাধ্য হলেন। এই হল তাঁর শেষ প্রচেষ্টা। এর পর তিনি হয়ে পড়লেন একবারেই নিঃস্ব ও শক্তিহারা।
তারপর দারা বাস্তুহারার মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দেশে দেশে, দিকে দিকে। কিন্তু তিনি যেখানেই যান, পিছনে লেগে থাকে শত্রুচর। প্রথমে তাঁর সঙ্গে ছিল দুই হাজার সৈনিক, কিন্তু ক্রমেই তারা দলে দলে বা একে একে অন্নকষ্ট, জলকষ্ট ও পথকষ্ট সইতে না পেরে তাঁকে পরিত্যাগ করে গেল।
নির্জ্জন মরুপ্রদেশ—তৃষ্ণায় সর্বদাই প্রাণ টা-টা করে, খাদ্য মেলাও দুষ্কর। হিন্দুস্থানের যুবরাজ চলেছেন দুপুরের ঝাঁ-ঝাঁ রোদে ধুঁকতে ধুঁকতে ও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে; তাঁর পরনে ময়লা সুতির পোশাক, পায়ে আট আনা দামের জুতো, সঙ্গে আছে মাত্র একটি ঘোড়া, নারীদের ও মালপত্তর বহনের জন্য গুটিকয় উট এবং মাত্র কয়েকজন বিশ্বাসী অনুচর।
তারপর দুর্ভাগ্যের উপরে দুর্ভাগ্য! তাঁর রুগ্না সহধর্মিনী ও বিশ্ববিখ্যাত আকবর বাদশাহের প্রপৌত্রী, নাদিরা বানু আর কষ্ট সইতে না পেরে প্রাণত্যাগ করলেন। সে আঘাতে দারা একেবারেই ভেঙে পড়লেন। জীবন্মৃত অবস্থায় তিনি বোলান গিরিসঙ্কটের নিকটস্থ দাদার নামক স্থানের আফগান জমিদারের কাছে পেলেন শেষ আশ্রয়। সে হচ্ছে ভয়াবহ আশ্রয়।
জমিদারের নাম মালিক জিওয়ান। কয়েক বৎসর আগে সম্রাট শাজাহান আদেশ দিয়েছিলেন, তাকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু যুবরাজ দারার প্রার্থনায় প্রাণদণ্ড থেকে সে অব্যাহতি লাভ করে।
বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ মালিক জিওয়ান প্রচুর পুরস্কারের লোভে তার প্রাণরক্ষক দারাকেই আজ নিঃসহায় অবস্থায় পেয়ে গ্রেপ্তার করে সমর্পণ করলে শত্রুপক্ষের হস্তে!
সম্রাট ঔরঙ্গজিব আদেশ দিয়েছেন, দিল্লির রাজপথে আবালবৃদ্ধ-বনিতার সামনে মিছিল করে দারাকে দেখিয়ে আনতে হবে!
একটা কর্দমাক্ত ছোট মাদী হাতি তার পিঠের উপরে খোলা হাওয়ায় উপবিষ্ট পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী এবং সম্রাট শাজাহানের প্রিয়তম পুত্র দারা সুকো! ঠিক পাশেই বসে তাঁর চতুর্দশ বর্ষীয় দ্বিতীয় পুত্র সিপির সুকো।
দারার পরনে ধূলিধূসরিত কর্কশ ও নিকৃষ্ট পোশাক, মাথায় অতি দীনদরিদ্রের উপযোগী ময়লা পাগড়ি, আজ তাঁর কণ্ঠে নেই আর রত্নহার। তাঁর হস্তযুগল মুক্ত বটে, কিন্তু পদযুগল শৃঙ্খলে আবদ্ধ। পিছনে বসে আছে নগ্ন কৃপাণ হস্তে কারারক্ষক নজর বেগ।
প্রচণ্ড সূর্য মাথার উপরে করছে অগ্নিবর্ষণ। দিল্লির এই রাজপথই একদিন দেখেছে যুবরাজ দারার সুখসৌভাগ্য ও বদান্যতা। অপমানে মাথা নুইয়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে দারা নিশ্চেষ্টভাবে বসে রইলেন স্তম্ভিতের মতো।
পথের ধার থেকে জনৈক ভিখারি কাতর কণ্ঠে ফুকরে উঠল, ‘হে দারা, যখন তুমি প্রভু ছিলে, তখন সর্বদাই আমাকে ভিক্ষা দান করতে। কিন্তু আজ আর তোমার দান করবার কিছু নেই।’
সেই সময়ে মাত্র একবার মুখ তুলে ভিখারিকে দেখে দারা নিজের কাঁধ থেকে আলোয়ানখানা খুলে তার দিকে নিক্ষেপ করলেন।
দারাকে হাস্যাস্পদ করবার জন্যই জনসাধারণের সামনে বার করা হয়েছিল। কিন্তু তার ফল হল উলটো। সেই বিপুল জনতার পুরুষ, নারী ও শিশুরা এমন তারস্বরে সম্মিলিত কণ্ঠে আর্তনাদ করতে লাগল, যেন তারা নিজেরাই পড়েছে কোন ভীষণ দুর্ভাগ্যের কবলে। দানশীলতার জন্য দারা ছিলেন জনতার মানসপুত্রের মতো।
মিছিলের ভিতরে ক্রুদ্ধ জনতা বিশ্বাসঘাতক মালিক জিওয়ানকেও লক্ষ করেছিল। চরম অকৃতজ্ঞতার পুরস্কার স্বরূপ সে এখন লাভ করেছে সম্মানজনক বক্তিয়ার খাঁ উপাধি এবং একহাজার অশ্বারোহী সৈন্যের নায়কত্ব। কিন্তু মনে মনে গুমরেও কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস করেনি, কারণ মিছিলের সঙ্গে অসংখ্য সশস্ত্র সৈনিক।
কিন্তু পরদিন নূতন খাঁ-সাহেব যখন নিজের দলবল নিয়ে ঔরঙ্গজিবের রাজসভায় যাচ্ছিল, ক্ষিপ্ত জনসাধারণ চারিদিক থেকে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ করলে, তার কয়েকজন অনুচরকে মেরে ফেললে এবং তাকেও যে নির্দয়ভাবে হত্যা করত সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কেবল সদলবলে কোতোয়াল এসে পড়াতে কোনওক্রমে সে প্রাণে বেঁচে গেল।
আবার হল বিচার-প্রহসন। জ্যেষ্ঠ দারার উপরে প্রাণদণ্ডের হুকুম দিলেন সেজো ভাই ঔরঙ্গজিব।
রাত্রিবেলা। পুত্র সিপির সুকোর সঙ্গে কারাগৃহে বসে ছিলেন দারা, এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়াল সশস্ত্র নজর বেগ ও তার অনুচরেরা।
তাদের মুখ দেখেই দারা বলে উঠলেন, ‘বুঝেছি, তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছ।’
নজর বেগ বললে, ‘না, আমরা সিপির সুকোকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
কিন্তু বালক সিপির বাবাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না, সে কাঁদতে কাঁদতে দারার দুই পা জড়িয়ে ধরলে। দারাও সক্রন্দনে পুত্রকে বদ্ধ করলেন আলিঙ্গনের মধ্যে, কিন্তু নির্মম ঘাতকরা সিপিরকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
দারা তখন একখানা কলম-কাটা ছুরি নিয়ে আততায়ীদের একজনকে আহত করলেন এবং অন্যান্য সকলের উপরেও করতে লাগলেন ঘন ঘন মুষ্টির আঘাত—ভেড়ার মতো তিনি প্রাণ দিতে নারাজ!
কিন্তু একদল সশস্ত্রের সঙ্গে একজন নিরস্ত্রের যুদ্ধ কতক্ষণ চলতে পারে? দারার দেহের উপরে হতে লাগল, ঘন ঘন শাণিত ছোরার আঘাত।
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল সিপিরের যন্ত্রণাপূর্ণ তীব্র ক্রন্দনধ্বনি, কিন্তু তার মধ্যেই দারার কারাকক্ষ হয়ে পড়ল, একেবারে নিস্তব্ধ। সেখানে ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে রক্তের লেখন, মেঝের উপরে রক্তগঙ্গার ঢেউ, দিকে দিকে কেবল রক্ত আর রক্ত আর রক্ত! এবং এই বীভৎস ও ভয়াল রক্তোৎসবের মাঝখানে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আছে সম্রাটপুত্রের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ!
সিপিরের বুকফাটা কান্না আর থামল না। আজও পাষাণ-কারাগারের অন্দরে বন্দি হয়ে আছে সেই মৌন ক্রন্দনরব। প্রাণের কানে শোনা যায় সেই নীরব ক্রন্দন!
ওদিকে দাদার ছিন্নমুণ্ড স্বচক্ষে না দেখে ঔরঙ্গজিব নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাঁর কাছে দারার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মুণ্ড প্রেরিত হল।
সেই কাটা মুণ্ড দেখে ছোট ভাই ঔরঙ্গজিব কী বলেছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা নেই। তবে তিনি যে কিছুমাত্র অনুতপ্ত হননি, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।