ইতিহাসের উত্তরাধিকার – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
১
সম্প্রতি উগ্রহিন্দুর আক্রমণে সেকুলার মতাবলম্বীরা কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ভারতবর্ষ যে নানা ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর মিলনভূমি, ভারতের জাতীয়তা যে ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের স্বার্থ যে আসলে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী—এসব কথা এখনও বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব এসে পড়েছে। ওদিকে উগ্রহিন্দুরা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, গণতান্ত্রিক ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও হিন্দুর স্বার্থ কেন স্বীকৃত হবে না, অথচ সংখ্যালঘুর স্বার্থ কেন মর্যাদা পাবে? রাষ্ট্রের আইনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেওয়াটাই তো সাম্প্রদায়িকতা, তা তুলে দেওয়ার দাবিই যথার্থ সেকুলার রাষ্ট্রের দাবি। উগ্রহিন্দু আরও বলছেন, বিদেশি আক্রমণের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে প্রকৃত জাতীয়তার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হবে; এক্ষেত্রে ইংরেজ যে-অর্থে বিদেশি, পাঠান বা মুঘল শাসকেরাও সেই অর্থেই বিদেশী। উগ্রহিন্দুর অভিযোগ, এই দাবির বিরোধিতা করে সেকুলাররা প্রকৃত জাতীয়তারই বিরোধিতা করছেন।
প্রকৃত জাতীয়তার সংজ্ঞা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষ্য একটা বিরাট ভূমিকা নিয়ে ফেলেছে। অযোধ্যায় মসজিদের ব্যাপারে সেকুলার ঐতিহাসিকেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে সেখানে আদৌ কোনও মন্দির ছিল না। একাধিক রাজনৈতিক দল, এমন কি সরকারের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে প্রত্নতত্ত্ব আর ইতিহাসের সাক্ষ্য বিচার করে স্থির হোক, বাবরি মসজিদ তৈরি হওয়ার আগে সেখানে কোনও মন্দির ছিল কি না। যেন মন্দির থেকে থাকলে উগ্রহিন্দুর দাবি যথার্থ বলে প্রমাণিত হবে। সেকুলার ইতিহাসচর্চার সংকট এইখানেই—আজকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে জাতীয়তার ইতিহাসের সামঞ্জস্য আনা। সংকট এইজন্য যে জাতীয়তার যে ইতিহাস গত শতাব্দী থেকে লেখা হয়ে এসেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে এমন সব কাহিনী, ধারণা, ব্যাখ্যা যা আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের প্রধান উপাদান। সত্যি বলতে কি, বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলে একটা সাংঘাতিক সত্য বেরিয়ে আসবে। সেটা হল যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদেরই প্রতিচ্ছবি, আয়নায় মুখ দেখার মতো—তার রূপ, আকৃতি, গড়ন, অবিকল এক।
অন্য অঞ্চলের কথা বলতে পারব না, বাংলার ইতিহাসচর্চার ইতিহাস থেকে এরকমই দেখতে পাচ্ছি।
২
বঙ্কিম যে অত ক্ষোভ করে বলেছিলেন ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই’, তাঁর ক্ষোভের অনেক কারণ ছিল বটে, কিন্তু কথাটা তিনি সম্পূর্ণ সত্যি বলেননি। ইতিহাস যথেষ্টই ছিল। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস সমালোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিম ঐ প্রবন্ধেই বলেছেন, ‘বালকশিক্ষার্থে যে সকল পুস্তক বাঙ্গালা ভাষায় নিত্য নিত্য প্রণীত হইতেছে…’ ইত্যাদি। ইতিহাসের বই লেখা হচ্ছিল অনেক। বঙ্কিমের আপত্তি, তাতে বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস থাকছিল না। এই প্রকৃত ইতিহাস কী, তা নিয়েও বঙ্কিমের মত ছিল স্পষ্ট। প্রকৃত ইতিহাস হল পূর্বপুরুষের গৌরবের স্মৃতি। ‘এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে, কীৰ্ত্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীৰ্ত্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙ্গালী।’ কথাটা যে কতটা লজ্জার তা বোঝাবার জন্য বঙ্কিম তারপর জুড়ে দিয়েছেন, ‘উড়িয়াদিগেরও ইতিহাস আছে’। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আসলে তাঁর ক্ষোভ হল, বাঙালির স্বরচিত বাংলার ইতিহাস নেই। ‘আমাদিগের বিবেচনায় একখানি ইংরেজি গ্রন্থেও বাঙ্গালার প্রকৃত ইতিহাস নাই’। কেন? কারণ সাহেবরা কেবল বিজাতীয় মুসলমানদের সাক্ষ্য অবলম্বন করে বাংলার ইতিহাস লিখেছেন, তাতে বাঙালির সাক্ষ্য নেই। বাঙালির কাছে এই ইতিহাস গ্রহণীয় নয়। ‘আত্মজাতি গৌরবান্ধ, মিথ্যাবাদী, হিন্দুদ্বেষী মুসলমানের কথা যে বিচার না করিয়া ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করে, সে বাঙ্গালী নয়।’ তার পর এই ‘স্বকপোলকল্পিত’ ইতিহাসের মুসলমান লেখকদের ওপর বঙ্কিমের উষ্মা—‘গোহত্যাকারী, ক্ষৌরিতচিকুর’ ইত্যাদি— তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য সত্ত্বেও এগুলো নিছকই গালাগাল, সুতরাং উদ্ধৃতি না বাড়ানোই ভাল।
বিদেশি শাসকের লেখা ইতিহাসে পরাধীন জাতি তার নিজের কথা খুঁজে পাবে না, নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে—জাতীয়তাবাদের এ হল প্রাথমিক শ্লোগান। স্বরচিত ইতিহাসের অভাব নিয়ে বঙ্কিমের ক্ষোভ নিঃসন্দেহে তাঁর জাতীয়তাবাদেরই প্রকাশ।১ কিন্তু এখানে প্রথম যা লক্ষণীয় তা হল, পরাধীন স্বজাতির কথা বলতে গিয়ে বঙ্কিম যদিও কখনও বলছেন ‘বাঙ্গালী’, কখনও বলছেন ‘ভারতবর্ষীয়’, উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু মুসলমান শাসক বিদেশী, আক্রমণকারী। (বাংলার স্বাধীন সুলতানদের নিয়ে অবশ্য কিছুটা দোটানা আছে বঙ্কিমের ভাবনায়, সে প্রসঙ্গে পরে আসব।) দ্বিতীয় লক্ষণীয়: ‘হায়! বাঙ্গালীর ঐতিহাসিক স্মৃতি কই?’ বলে তিনি যখন আক্ষেপ করছেন, তখন যে-ইতিহাসবোধ তাঁর কাম্য তা কিন্তু কোনও ‘দেশী’ ইতিহাসবোধ নয়। এই ঐতিহাসিক স্মৃতির কাঠামো সম্পূর্ণ আধুনিক এবং ইউরোপীয়। তৃতীয়, ১৮৮০ সালে বঙ্কিম যখন আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙ্গালী, তাহাকেই লিখিতে হইবে’, ততদিনে কিন্তু অনেক বাঙালি লেখকই বাংলা এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখেছেন। সে-সব বই বিস্তর লোক পড়ত। প্রতি বছর নতুন সংস্করণ বেরোত, এমন বইও ছিল তার মধ্যে। বঙ্কিম সেগুলিকে ‘বালপাঠ্য’ বলে অবজ্ঞা করলেও আশ্চর্যের কথা হল এইসব বই-এর লেখকদের ইতিহাসবোধ কিন্তু বঙ্কিমেরই অনুরূপ। তৎকালীন ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ইতিহাস-লেখকদের মধ্যে বঙ্কিম মোটেই ব্যতিক্রম ছিলেন না।২
৩
এই ইতিহাসবোধ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। উনিশ শতকের গোড়ায় লেখা ইতিহাসের বই সম্পূর্ণ অন্য ঐতিহাসিক স্মৃতি ধারণ করে আছে। ঐ গোড়ার যুগের সবচেয়ে সুলিখিত বইটির কথাই ধরা যাক—মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের রাজাবলি (১৮০৮)।৩ সাহেবদের ফরমায়েশে লেখা কিন্তু বাংলা ছাপা বই-এর মধ্যে প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাসটি লিখতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে (আনুমানিক ১৭৬২-১৮১৯) যে নতুন করে গবেষণা করতে হয়েছিল, এমন মনে হয় না। তাঁর রচনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, ইতিহাসের ঘটনা এবং তার পারম্পর্য সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণ নিশ্চিতি। দিল্লি ও বাংলার সিংহাসনে ‘যে যে রাজা ও বাদশাহ ও নবাব হইয়াছেন’, তার একটা প্রচলিত বিবরণই মৃত্যুঞ্জয় লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলার পণ্ডিতসমাজ, বিশেষ করে কুলগ্রন্থ-রচয়িতাদের মহলে যে এ-রকম একটা ইতিহাস সুপ্রচলিত ছিল, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।৪ বাঙালির ঐতিহাসিক স্মৃতি অবশ্যই ছিল।
এই স্মৃতিকথনে কালপরিমাপের ব্যবস্থা ছিল নিশ্ছিদ্র। মৃত্যুঞ্জয়ের ইতিহাস শুরু হচ্ছে এইভাবে:
পিতৃকল্পাদি ত্রিংশত কল্পের মধ্যে ঘটীযন্ত্রের ন্যায় কালচক্রের ভ্ৰমণবশতো বর্ত্তমান শ্বেতবরাহ কল্প যাইতেছে একৈক কল্পেতে চতুর্দ্দশ মনু হয় তাহাতে শ্বেতবরাহ কল্পের মধ্যে বৈবস্বত নামে সপ্তম মনু যাইতেছে। একৈক মনুতে ২৮৪ দুই শত চৌরাশি যুগ হয়। তাহার মধ্যে বৈবস্বত নামে সপ্তমে মনুতে ১১২ এক শত বার যুগের যুগ এই কলিযুগ যাইতেছে। ইহার পরিমাণ ৪৩২০০০ চারি লক্ষ বত্রিশ হাজার বৎসর ইহার মধ্যে ১৭২৬ সতের শত ছাব্বিশ শকাব্দ পর্য্যন্ত গত ৪৯০৫ চারি হাজার নয় শত পাঁচ বৎসর। বাকি ৪২৭০৯৫ চারি লক্ষ সাতাইশ হাজার পঁচানব্বুই বৎসর। (পৃ. ৩-৪)
বছর গোনার হিসেবও একই রকম সুনিশ্চিত—কলিযুগের শুরু থেকে শেষ অবধি কোনও ফাঁক নেই। প্রথম ৩০৪৪ বছর ধরে প্রচলিত ছিল যুধিষ্ঠির রাজার শক। তার পরের ১৩৫ বছর বিক্রমাদিত্য রাজার শক। এই দুই শক গত।
বর্ত্তমান নর্মদা নদীর দক্ষিণ তীরে শালিবাহন নামে রাজার শক যাইতেছে এ শক বিক্রমাদিত্য রাজার শকের পর ১৮০০০ আঠার হাজার বৎসর থাকিবে তাহার পর বিজয়াভিনন্দন নামে রাজা চিত্রকূট পর্বত প্রদেশে হইবেন তাহার শক শালিবাহন রাজার শকের পর ১০০০০ দশ হাজার বৎসর পর্য্যন্ত হইবে।
তাহার পর পরিনাগার্জুন নামে এক রাজা হইবেন তাহার শক এই কলির ৮২১ আট শত একুশ বৎসর শেষ থাকা পর্যন্ত থাকিবে তাহার পর সম্ভল দেশে গৌতব্রাহ্মণের ঘরে কল্কিদেবের অবতার হইবে এই মতে ৬ ছয় শককৰ্ত্তা রাজারদের মধ্যে ১ এক গত ১ এক বর্তমান ও তিন ভাবী। (পৃ. ৮)
এই কালগণনা পদ্ধতির আর যাই দোষ থাক, অনিশ্চয়তার অভিযোগ নিশ্চয় আনা যাবে না এর বিরুদ্ধে।
কালের মতো স্থানের ব্যাপারেও মৃত্যুঞ্জয় সমান সতর্ক। এই ইতিহাস কোথাকার ইতিহাস?
আকাশ বায়ু তেজো জল ভূমি এই পঞ্চভূতের মধ্যে পৃথিবীর আট আনা অন্য অন্য আকাশাদি চারিভুতের দুই দুই আনা…এই ভূমিপিণ্ডের অর্ধ্বেক লবণ-সমুদ্রের উত্তর এই জম্বুদ্বীপ। …এই পৃথিবী সপ্তদ্বীপা। এ সপ্তদ্বীপের মধ্যে জম্বুদ্বীপ নামে এই দ্বীপ। এই জম্বুদ্বীপ নয় খণ্ড…এই নববর্ষের মধ্যে ভারতবর্ষ নামে পৃথিবীর নব ভাগের এক ভাগ এই। ভারতবর্ষের নব ভাগ সে সকল ভাগের নাম এই ঐন্দ্র কসেরু তাম্রপর্ণ গভস্তিমত নাগ সৌম্য বারুণ গন্ধর্ব কুমারিকা এই নবখণ্ডের মধ্যে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা যাহাতে আছে সে কুমারিকা খণ্ড এই।
আর আর খণ্ড সকলের মধ্যে অন্ত্যজ লোকের বসতি। (পৃ. ৪-৬)
এহেন যে সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, তার মধ্যে জম্বুদ্বীপ, তার আবার নয় বর্ষ ইত্যাদি, সেই পৃথিবীর শাসনকর্তাদের ইতিহাস রাজাবলি। ইতিহাসের শুরু কোথায়?
পরেমশ্বর এই পৃথিবীর পালন নিমিত্ত ইক্ষ্বাকু নামে অশ্বত্থ বৃক্ষরূপ রাজাকে সত্যযুগে প্রথমত আরোপিত করিয়াছিলেন ঐ রাজার স্কন্ধ শাখাদ্বয় রূপ সূৰ্য্যবংশ ও চন্দ্রবংশ এই দুই বংশের ধারাবাহিক সন্তান-পরম্পরাতে চারি যুগে এই পৃথিবী মণ্ডল অধিকৃত ছিলেন। এই উভয়বংশীয় রাজারদের মধ্যে মহত্তম ধর্ম্ম তপোবল প্রভাবে কেহ কেহ সপ্তদ্বীপ পৃথিবীর শাসন করিয়াছেন কেহ্ কেহ্ মহত্তর ধর্ম্ম তপস্যা বল ও প্রতাপে জম্বুদ্বীপ মাত্রের অধিকার করিয়াছেন। কেহ কেহ মহাধর্ম্ম তপোবল বশতঃ ভারতবর্ষ মাত্রের অধিকার করিয়াছেন কেহবা কুমারিকা খণ্ড মাত্রের রাজা ছিলেন এই দুই বংশের রাজারদের মধ্যে একতর সম্রাট হইলে অন্যতর মণ্ডলেশ্বর হইতেন। ইহারদের বিবরণ পুরাণেতিহাসাদি শাস্ত্রে বিস্তারিত আছে। (পৃ. ৬-৭)
কয়েকটা কথা এখানে পরিষ্কার বলে রাখা যাক। মৃত্যুঞ্জয়ের ধারণায় পৃথিবীর প্রতিপালক শাসনকর্তারা পরমেশ্বর প্রেরিত। ধর্মের তপস্যাবলে তাঁরা এই অধিকার ভোগ করেন। সেই তপস্যা শুধু মহৎ, না মহত্তর, না মহত্তম, তার ওপর নির্ভর করছে এঁদের আধিপত্যের সীমানা। মহত্তম ধর্মতপস্যার প্রভাবে সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি হওয়াও সম্ভব ছিল। এমন ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের ইতিহাসকে আমরা অনেকেই হয়তো ইতিহাস বলে মানতে রাজি হব না, যদিও একটু পরেই দেখা যাবে যে নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিও এই ধারণার সঙ্গেই গ্রথিত হয়ে রয়েছে। যাই হোক, অকারণ ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মৃত্যুঞ্জয়ের কাহিনীগুলিকে ওঁরই সূত্র অনুসারে বলা যাক—‘পুরাণেতিহাস’।
তবে পুরাণ হোক আর যা-ই হোক, রাজাবলি-র হিসেবে কোনও ফাঁক নেই। ‘এই কলির আরম্ভ অবধি ৪২৬৭ চারি হাজার দুই শত সাতষট্টি বৎসর পর্যন্ত ১১৯ এক শত উনিশ জন নানাজাতীয় হিন্দু দিল্লীর সিংহাসনে সম্রাট হন।’ (পৃ. ১০) গণনা শুরু হচ্ছে রাজা যুধিষ্ঠির থেকে—হ্যাঁ, সেই মহাভারতের রাজা যুধিষ্ঠির। তাঁর রাজত্বের শুরু থেকে ২৮ জন ক্ষত্রিয় রাজা ১৮১২ বছর শাসন করেন। ‘এই পর্য্যন্ত কলিতে বাস্তব ক্ষত্রিয় জাতির বিরাম হইল।’ তার পর এল ‘মহানন্দ নামে ক্ষত্রিয়ের ঔরসেতে শূদ্রা গর্ভজাত’ নন্দবংশীয় ১৪ জন রাজার ৫০০ বছরের শাসন। ‘এই নন্দ অবধি রাজপুত জাতির সৃষ্টি হয়।’ এর পর বৌদ্ধ রাজাদের পালা—‘গৌতম বংশজাত বীরবাহু, অবধি আদিত্য পৰ্য্যন্ত নাস্তিক মতাবলম্বি ১৫ পনের জনেতে ৪০০ চারি শত বৎসর। এই সময়ে নাস্তিক মতের অত্যন্ত প্রচার হওয়াতে বৈদিক ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন প্রায় হইয়াছিল।’ তার পর বিচিত্র সব রাজবংশের তালিকা—ময়ূর বংশীয় নয় জন, ষোল জন যোগী, চার জন বৈরাগী ইত্যাদি। অবশ্য ‘বিক্রমাদিত্যেরা পিতাপুত্রে দুই জনেতে ৯৩ বৎসর’ আছেন। আর আছেন ‘ধী সেন অবধি দামোদর সেন পৰ্য্যন্ত বঙ্গদেশীয় বৈদ্য জাতি ১৩ তের জনেতে ১৩৭ এক শত সাইত্রিশ বৎসর এক মাস৷’ সেনেরা বঙ্গদেশীয় বৈদ্য জাতি এবং দিল্লির সিংহাসনে! তার পর ‘চোহান রাজপুত জাতি’-র রাজত্বের শেষে
পৃথারায় এক জনেতে ১৪ চৌদ্দ বৎসর সাত মাস।…এই পর্য্যন্ত হিন্দু রাজারদের সাম্রাজ্য ছিল।
তাহার পর মুসলমানেরদের সাম্রাজ্য হইল। যবনদের সাম্রাজ্য হওয়া অবধি ১৭২৬ শকাব্দ পর্য্যন্ত ৫১ জনেতে ৬৫১ ছয় শত একান্ন বৎসর তিন মাস আটাইশ দিন গত হইয়াছে। (পৃ. ১২-৩)
পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা ছাড়াও এই তালিকার বৈশিষ্ট্য হলো বংশানুক্রমিক পারম্পর্যে মহাভারতের চরিত্র থেকে মগধের সম্রাট পর্যন্ত অনায়াসে চলে আসা। এবং রাজবংশের পারম্পর্যে ‘আমীর তৈমুরের সন্তান’ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম পর্যন্ত এসে তালিকা শেষ করা। পুরাণ, ইতিহাস এবং সমসাময়িক, সবটাই একই কালানুক্রমিক ছকে বাঁধা, একটার সঙ্গে আর-একটার কোনও বিরোধ নেই, একটা থেকে আর-একটাতে যেতেও তাই কোনও অসুবিধা নেই। বঙ্কিমের যুগে এসে পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে তফাৎ করা হবে, পৌরাণিক বিবরণের থেকে ইতিহাসের মালমসলা বের করার পদ্ধতি নিয়ে যে-সব আলোচনা হবে, মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তায় তার আভাসটুকুও নেই। ইংরেজের ফরমায়েশে লেখা হলেও রাজাবলি-র ইতিহাসবোধ সম্পূর্ণ প্রাক-ঔপনিবেশিক।
তাই হিন্দু রাজবংশের অবসান আর ‘যবন সম্রাট’-দের অভ্যুত্থানের বিষয়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের মতো এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কী বলেন, তা জানতে কৌতূহল হয়। আরও কৌতূহল হয় যখন দেখি যে শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ ঘুরি-র হাতে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের বিবরণ জড়িয়ে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে। কাহিনীটা এইরকম।
পৃথ্বীরাজের পিতার দুই স্ত্রী ছিল। এক স্ত্রী মানুষের মাংস খেত। স্বামীকেও সে নরমাংস খাওয়া অভ্যেস করায়। অপর স্ত্রীর পুত্রকে একদিন সেই রাক্ষসী খেয়ে ফেলে। অপর স্ত্রী তখন পালিয়ে ভাইয়ের আশ্রয়ে যায় এবং সেখানে এক পুত্রসন্তান প্রসব করে। তার নাম হয় পৃথু। পৃথু বড় হয়ে তার পিতার সঙ্গে মিলিত হয়। পিতার অনুরোধে পৃথু তার পিতার শিরচ্ছেদ করে একুশ জন স্বজাতীয় স্ত্রীলোককে সেই মাংস খাওয়ায়। পরে রাজা হয়ে পৃথু সেই একুশ জনের পুত্রকে তার সামন্ত করে। ‘এইরূপে পৃথুরাজার পিতৃহত্যা করাতে পূৰ্ব্ব হইতেও অধিক অখ্যাতি দিনে দিনে বাড়িতে লাগিল ও পূৰ্ব্বে যে রাজারা কর দিত তাহারা কেহ কর দিল না।’ মোট কথা রাজা হিসেবে পৃথ্বীরাজ বড় একটা লোকমান্য ছিলেন না।
এমন সময় শিহাবুদ্দিন ঘুরির আক্রমণ উপস্থিত হলো।
রাজা যবনদের প্রাগল্ভা শুনিতে পাইয়া অনেক বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরদিগকে আনাইয়া কহিলেন হে পণ্ডিতেরা এমন কোনহ যজ্ঞের আরম্ভ কর যাহাতে যবনেরদের প্রতিভা ও প্রাগল্ভা উৎরোত্তর হ্রাস হয়। পণ্ডিতেরা আজ্ঞা করিলেন হে মহারাজ এমন যজ্ঞ আছে আমরা কহিতেও পারি কিন্তু আমরা যে সময়ে অবধারণ করিব সে সময়ে যজ্ঞের যূপস্থাপন যদি হয় তবে সে যূপ যাবৎ থাকিবে তাবৎ যবনেরা এ দেশে কখনও আসিতে পারিবে না। রাজা পণ্ডিতেরদের এই বাক্যে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া বড় সমারোহ করিয়া যজ্ঞের আরম্ভ করিলেন। যূপস্থাপনের সময় হইলে পণ্ডিতেরদের অনুমতি মাত্রে যূপস্থাপন করিতে যূপ উঠাইতে নানা যত্ন করিলেন যূপ কদাচ উঠিল না। তদনন্তর পণ্ডিতেরা কহিলেন হে মহারাজ ঈশ্বরের যে ইচ্ছা সেই হয় পুরুষ ঈশ্বরেচ্ছার ওপর প্রবল নয় কিন্তু তাহার সহকারী বটে ঈশ্বরেচ্ছা সহকৃত পুরুষ কার্য্যসাধক হয় অতএব নিবৃত্ত হও বুঝি এ সিংহাসন যবনাক্রান্ত হইবে।
পণ্ডিতদের কথায় পৃথ্বীরাজ ‘যুদ্ধে শৈথিল্য করিলেন’। শিহাবুদ্দিন শত্রুসৈন্য ধ্বংস করে দিল্লি পৌঁছে গেলেন। পৃথ্বীরাজ তখন
অন্তঃপুর হইতে নির্গত হইয়া শাহাবুদ্দীনের সহিত ঘোরতর রণ করিলেন কিন্তু ঈশ্বরেচ্ছাতে শাহাবুদ্দীন যবন ঐ রঙ্গভূমিতে পৃথুরাজাকে ধরিয়া পৃথুরাজা জয়চন্দ্র রাজার জামাতা হন [স্মরণীয়, জয়চাঁদ ইতিমধ্যেই মুহম্মদ ঘুরির সহায়তা করেছেন] এই অনুরোধে তাহাকে নষ্ট করিলেন না কিন্তু কএদ করিয়া খাড়া খাড়া আপন দেশে গজনেনে পাঠাইয়া দিলেন। (পৃ. ১০৯-১০)
আবার মনে করিয়ে দিই, রাজবংশের পত্তন হয় ঈশ্বরেচ্ছায়। ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে তবেই সেই রাজত্ব বজায় থাকে। নরমাংস ভক্ষণ এবং পিতৃহত্যার মতো চরম পাপাচারের দোষ লেগেছিল চৌহান রাজবংশে। পৃথ্বীরাজ যে ঈশ্বরের বিরাগভাজন হয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল যজ্ঞের আসরে। সুতরাং মুহম্মদ ঘুরির যুদ্ধজয় এবং ‘যবন রাজত্ব’-র প্রতিষ্ঠা একান্তই ঈশ্বরের ইচ্ছায় সম্পন্ন ঘটনা: ‘পুরুষ ঈশ্বরেচ্ছার ওপর প্রবল নয় কিন্তু তাহার সহকারী বটে ঈশ্বরেচ্ছা সহকৃত পুরুষ কাৰ্যসাধক হয়’। মৃত্যুঞ্জয়ের অর্ধশতাব্দী পর যখন পুরাণেতিহাস বর্জন করে দস্তুরমতো ইতিহাস লেখা হবে, তখন কিন্তু থানেসরের যুদ্ধের এই বিবরণ আপাদমস্তক বদলে যাবে। ইংরেজি-শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা ঈশ্বরেচ্ছাকে অত সহজে মেনে নেবেন না।
তবে রাজার অধর্মাচরণের কারণ সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় এর পর আরও দু-একটা কথা বলেছেন। সে আলোচনাটা মৃত্যুঞ্জয় শুরু করছেন এই বলে: ‘শাহাবুদ্দীন যবনের দিল্লীর সিংহাসন অধিকার হওয়ার বিষয়ে যবনেরা যে রূপ বলে তাহা লিখি।’ (পৃ. ১১২-৩) বলতে গিয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছেন মাহমুদ গজনভির পিতা নাসরুদ্দিন সবুক্তগিনের হিন্দুস্থান আক্রমণের সময়ে।
এই নাসরুদ্দীন হিন্দুস্থানে যে সময়ে আইল তখন হিন্দুস্থানের রাজা সকলের পরম্পর একবাক্যতা কাহারও ছিল না এবং যে যে দেশের রাজা সে সে দেশের বাদশাহ করিয়া আপনাকেই জানিত কেহ কাহারও আয়ত্ত ছিল না। এবং এমন রাজা একও ছিল না যে স্বপরাক্রমে অন্য অন্য রাজারদিগকে স্বাধীন করে ইহা অনুসন্ধান করিয়া এ হিন্দুস্থানে যবনেরদের সঞ্চার হইল। কেননা শত্রুসঞ্চারের ও রাষ্ট্র বিভ্রাটের প্রধান কারণ পরস্পর অনৈক্য ও স্ব স্ব প্রাধান্য ও যখন সেকন্দর শাহ যবনস্থানে বাদশাহ হইয়াছিলেন তখন তিনি এ হিন্দুস্থানে একবার আসিয়া দেশের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরদের ধার্ম্মিকতা ও পাণ্ডিত্যাদি দেখিয়া কহিলেন যে এ দেশে এ রূপ হকিমেরা আছেন সে দেশের রাজারদের পরাজয় কখনও অন্য দেশীয় রাজারদের হইতে হইতে পারে না। এই কহিয়া স্বদেশে গেলেন আর কখনও এ হিন্দুস্থানে আইলেন না। সম্প্রতি তাদৃশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের অভাব প্রযুক্ত এ দেশীয় রাজারা দৈববলেতে হীন হইয়া যবন হইতে ক্রমে ক্রমে সকলেই পরাজিত হইলেন। (পৃ. ১২১-২)
সুলতানী ও মুঘল রাজত্বের বিবরণ মৃত্যুঞ্জয় মোটামুটি প্রচলিত ফারসি গ্রন্থ থেকেই নিয়েছেন। হিন্দুস্থানের রাজাদের অনৈক্য কিংবা ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে আলেকজান্ডারের মন্তব্য ফেরিশ্তা বা অন্য কোনও ফারসি ইতিহাসে থেকে থাকতে পারে। কিন্তু রাজারা ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হলেন এবং দৈববলে হীন হয়ে পড়লেন, তার কারণ যে ব্রাহ্মণদের ব্যর্থতা, এই যুক্তি বলা বাহুল্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরই যুক্তি। ধর্মরক্ষা এবং রাজাকে সৎপথে চালিত করা ব্রাহ্মণের কর্তব্য। সেই কর্তব্য তারা পালন করেনি, তাই দেবরোষে হিন্দু রাজত্বের পতন ঘটল এবং দৈব ইচ্ছায় যবনদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। ব্রাহ্মণের অধঃপতনের জের হিসেবে ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি অন্যের ওপর গিয়ে পড়ল। পরে দেখব, ইতিহাস-রচনায় দৈব হস্তক্ষেপের ভূমিকা যত ক্ষীণ হয়ে আসবে, এই অধঃপতনের গল্পটা ততই এক সামগ্রিক সামাজিক অবক্ষয়ের কাহিনীতে পরিণত হবে।
মৃত্যুঞ্জয়ের বিবরণে গজনির মাহমুদ কর্তৃক সোমনাথ মন্দির ধ্বংসের ঘটনার কথা এখানে বলে রাখা যাক। তা হলে পরবর্তীকালের ইতিহাস-রচনার সঙ্গে এর তুলনা করা যাবে। মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা মোটামুটি আমাদের পরিচিত বর্ণনাই—ফারসি সূত্র থেকে নেওয়া। কিন্তু সোমনাথ মন্দিরের বিগ্রহ সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় একটি কথা বলছেন যা পরবর্তীকালে আর কোথাও পাব না। ‘সোমনাথ নামে অতি বড় এক দেব প্রতিমা ছিলেন সে প্রতিমা পূৰ্ব্বে মক্কাতে ছিলেন যবনেরা যে অবধি মনুষ্য সৃষ্টি বলে তদবধি চারি হাজার বৎসর যখন গত হইয়াছিল তখন হিন্দুস্থানের এক রাজা মক্কা হইতে সে প্রতিমা উঠাইয়া আনিয়া ঐ স্থানে স্থাপন করিয়াছিলে…।’ (পৃ. ১২৯) সোমনাথের মূর্তি আদিতে মক্কায় ছিল, কোনও হিন্দু রাজা তা গুজরাটে নিয়ে আসেন, মাহমুদ আবার সেই মূর্তি দখল করে গজনিতে নিয়ে যান—এরকম কাহিনী কোনও ফারসি বইতে আছে কি না বলতে পারব না, কিন্তু পরবর্তীকালে কোনও বাঙালি ঐতিহাসিক যে এ-কথা আর লেখেন নি, তা প্রায় নিশ্চিত।
এই পরের যুগের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে দু-জন মুঘল সম্রাটকে নিয়ে খুব উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, তাই এঁদের বিষয়ে মৃত্যুঞ্জয় কী বলছেন, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। আকবর সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় উচ্ছ্বসিত। ‘শ্রীবিক্রমাদিত্যের পর এই হিন্দুস্থানে এখন পর্য্যন্ত গুণেতে অকবর শাহের সম সম্রাট আর কেহ হয় নাহি।’ (পৃ. ১৯৫) ধর্মরক্ষা ও প্রজার প্রতিপালনে আবশ্যক সবরকম গুণ ছাড়াও আকবরের চরিত্রের যে-দিকটি মৃত্যুঞ্জয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন, সেটা হল যে আকবর ‘নানাবিধ শাস্ত্রজ্ঞান জন্য পারমার্থিক বুদ্ধি প্রতিভাতে মহম্মদের মতে অনাস্থা করিয়া মনে মনে হিন্দুরদের মতেই আস্থা করিতেন অতএব ইরান ও তুরানের রাজারা ইহাকে অনুযোগ করিয়া লিখিতেন।’(পৃ. ১৯১) এমন কি ‘ইনি গোমাংস ভক্ষণ করিতেন না এবং কিল্লার মধ্যেতেও গোবধ বারণ করিয়া দিয়াছিলেন তৎপ্রযুক্ত তদবধি এখনও তাঁহার কিল্লাতে গোবধ হয় না।’ (পৃ. ১৯৪) অপর পক্ষে আওরঙজেব সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয় লিখছেন:
ইনি মহম্মুদী মতে অতি বড় তৎপর হইলেন। আর প্রধান প্রধান অনেক দেবস্থান নষ্ট করিলেন। হিন্দুরদের মতে সূৰ্য্যার্ঘ্য ও গণেশপূজাদি দেবকৃত্য সকল বাদশাহি কিল্লার মধ্যে অকবর অবধি নিয়মিত ছিল যে সকল আইনের মধ্যে অনেক আইনের অন্যথা করিয়া স্বকপোলরচিত অনেক আইন জারি করিলেন। (পু. ২১৪)
কিন্তু সেইসঙ্গে আবার একথাও লিখছেন:
ইনি প্রধান প্রধান অনেক দেবস্থানের ব্যাঘাত করিয়াছিলেন কিন্তু জ্বালামুখী ও লছমনবালাতে বিলক্ষণ প্রতিফল পাইয়া তাঁহারদিগকে মানিয়া সেবার্থে অনেক টাকার ভূমি নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। পরে ঐ আওরঙ্গাবাল ১২ বার বৎসর থাকিয়া এক ব্রাহ্মণের শাঁপে বিকৃত শব্দ করিতে করিতে মরিলেন। (পৃ. ২২১)
রাজা যেখানে ঈশ্বরপ্রেরিত, ঈশ্বরের অনুগ্রহেই যেখানে তাঁদের রাজ্যপাটে অধিকার, সেখানে রাজচরিত্রের মতিগতি বিচার করা মোটামুটিভাবে ঈশ্বর আর রাজাদের মধ্যেকার ব্যাপার। সাধারণ প্রজার সেখানে একমাত্র ফলভোগ করা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। অবশ্য ভাল রাজা আর মন্দ রাজার প্রভেদ প্রজা জানে, কারণ সুশাসন কিংবা অপশাসনের ফল সে-ই ভোগ করে। সুতরাং আকবরের মতো মহান সম্রাটের সে গুণগান করে। আবার আওরঙজেব যখন তাঁর দুষ্কর্মের ফলস্বরূপ ‘ব্রাহ্মণের শাঁপে বিকৃত শব্দ করিতে করিতে’ মারা যান, সে-গল্প বলতে বলতে প্রজা যেন দেবরোষের কঠোরতায় খানিক শিউরে উঠে শেষ পর্যন্ত ধর্মের জয় সম্বন্ধে আশ্বস্তই হয়। কিন্তু শাসনকার্যের অনুষ্ঠানের সঙ্গে সে কখনও নিজেকে জড়ায় না, রাজার জায়গায় নিজেকে বসাবার কথা ভাবতেই পারে না। রাজত্বের ইতিহাসে সে নিজের ইতিহাস খোঁজে না। ‘কীর্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তি’ বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে যে সমগ্র জাতির ইতিহাস প্রকাশ করা যায়, এমন কথা মৃত্যুঞ্জয়ের আদৌ বোধগম্য হত বলে মনে হয় না। কয়েক হাজার বছরের রাজপুরুষদের বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁর নিজের অবস্থান একটিই—স্থির এবং অপরিবর্তনীয়। সে অবস্থান প্রজার অবস্থান। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি পৃথ্বীরাজের অপকর্মের প্রতিফল যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমনি আকবরের গুণপনাকে ধন্য ধন্যও করেছেন। কিন্তু স্বজাতীয় অথবা বিজাতীয় বলে পৃথ্বীরাজ কিংবা আকবরের কৃতকর্মের ঐতিহাসিক দায় তাঁর ওপর এসে বর্তাতে পারে, এমন সম্ভাবনা তাঁর চিন্তাতেও আসেনি। রাজাবলি জাতীয় ইতিহাস নয়, কারণ ইতিহাসের কর্তা এখানে রাজা এবং দৈবশক্তি; কোনও জাতীয় ঐক্যবন্ধনের সূত্র ধরে ঐতিহাসিকের নিজস্ব চৈতন্য ইতিহাসের কর্তার স্থানটি এখানে দখল করে নিতে পারে নি। বঙ্কিম যে জাতীয় ইতিহাসের কথা বলবেন, তার রচয়িতা যেমন ‘তুমি, আমি, সকলে’, সে-ইতিহাসের কর্তাও তেমনি ‘তুমি, আমি, সকলে’। এই নতুন ইতিহাসবোধে আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার সৌভাগ্য মৃত্যুঞ্জয়ের হয়নি। তাই বাঙালি ব্রাহ্মণ প্রজার একান্ত বিশিষ্ট অবস্থান থেকেই তিনি রাজারাজড়ার কাহিনী বলে গেছেন।
বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসের গল্প শোনাবার সময়ই মৃত্যুঞ্জয়ের অবস্থানটি সব চেয়ে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। মৃত্যুঞ্জয়ের জন্ম পলাশির যুদ্ধের সামান্য পরে, সুতরাং সেই সময়কার ইতিহাস তাঁর বাল্য-যৌবনের জনশ্রুতি। সিরাজউদ্দৌলার অত্যাচার সম্বন্ধে তাঁর ঘৃণা প্রবল। ‘বিশিষ্ট লোকেরদের ভার্য্যা ও বধূ ও কন্যা প্রভৃতিকে জোর করিয়া আনাইবাতে ও কৌতুক দেখিবার নিমিত্তে গর্ভিণী স্ত্রীরদের উদর বিদারণ করানেতে ও লোকেতে ভরা নৌকা ডুবাইয়া দেওয়ানেতে দিনে দিনে অধৰ্ম্ম-বৃদ্ধি হইতে লাগিল।’(পৃ. ২৬৮-৯) সিরাজ যখন রাজা রাজবল্লভের ‘জাতিধ্বংস করিতে উদ্যত হইলেন’, তখন রাজবল্লভ কলকাতায় ইংরেজদের শরণাপন্ন হলেন। ইংরেজরা তাঁকে নবাবের হাতে তুলে দিতে রাজি হল না। তখন ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা কম্পানি বাহাদুরের কুঠী ও কলিকাতা শহর লুট করিয়া আপন সৰ্ব্বনাশের হেতু করিয়া মুরশিদাবাদে [গেলেন]।’(পৃ. ২৭০) ইংরেজরা সাময়িকভাবে কলকাতা ত্যাগ করতে বাধ্য হল। এর পরের কাহিনী মৃত্যুঞ্জয়ের কথাতেই শুনুন:
[সাহেব লোকেরা] পুনরায়…আসিয়া কলিকাতা শহরের লুটেতে মহাজন ও মুদি বকালি গৃহস্থ প্রভৃতি লোকেরদের মধ্যে যাহার যে ক্ষতি হইয়াছিল তাহার যে যেমন জায় করিয়া দিলেক তাহাকে তেমনি বেবাক দিয়া খ্বাজে পিৎরুস আরমানি দ্বারা মহারাজ দুর্লভরাম ও ফৌজ বকসী জাফরালী খাঁ ও জগৎ সেঠ মহতাবরায় ও তাঁহার ভ্রাতা মহারাজ স্বরূপচন্দ্র প্রভৃতি কথক প্রধান লোকেরদের সহিত সাহিত্য করিয়া অর্থ ও কিঞ্চিৎ সৈন্য সংগ্রহ করিয়া শরণাগত প্রতিপালনরূপ ধর্ম্মতাকা উঠাইয়া যুদ্ধার্থে পলাশিতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। (প. ২৭১)
যুদ্ধে যা হবার তা তো হল। সিরাজ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালালেন। পরে ধরা পড়লেন।
তাহার পর ঐ জাফরালী খাঁর পুত্র মীরণ সাহেব লোকেরদিগকে ও মহারাজ দুর্লভরাম প্রভৃতিকে সম্বাদ না দিয়াই নবাব সিরাজদ্দৌলার মৃত্যু ভয়েতে নানাপ্রকার কাতরোক্তি না শুনিয়া আপন হস্তে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ঐ ছিন্ন-শরীর হাতির ওপর চড়াইয়া শহর ভ্রমণ করাইয়া ঈশ্বরেচ্ছামতে নবাব মহাবৎজঙ্গের আপন মুনিবের পুত্র অথচ আপন মুনিব নবাব সরফরাজ খাঁকে কপটে মারিয়া নবাব হওয়ার ও অলীভাস্কর প্রভৃতি মহারাষ্ট্রেরদের সরদার লোকেরদিগকে কপটে কাটাইবার ও স্বয়ং সিরাজদ্দৌলার বলাৎকারে পরস্ত্রীদিগের আনয়ন প্রভৃতি দৌরাত্ম্যের প্রতি ফল লোকতঃ প্রকাশ করিল। (পৃ. ২৭৬)
ঈশ্বরেচ্ছার সহকারী হলেন মীরন, সিরাজ তাঁর দুষ্কর্মের ফল ভোগ করলেন। কিন্তু মীরনের পরিণাম কী হল?
তদনন্তর নবাব মীরণ আজীমাবাদ হইতে মুরশিদাবাদে আসিতেছেন পথে রাজমহল মোকামে নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামী করার ফলস্বরূপ বজ্রাঘাতে মরিলেন। এইরূপে নবাব মীরণ মরিলে পর তাহার কবরের ওপরেও দুইবার বজ্রাঘাত হইল। (পৃ. ২৮১)
আর মীরজাফর? ‘এইরূপে নবাব জাফরালী খাঁ পুনর্বার দুই বৎসর সুবেদারী করিয়া সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে নিমখারামীর ফল গলৎকুষ্ঠ রোগে অতিশয় ব্যামোহ পাইয়া মরিলেন।’ (পৃ. ২৮৯)
ইতিহাসের প্রধান শক্তি দৈব। তার ক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত জয় হয় ধর্মের। এই বিশ্বাস নিয়েই মৃত্যুঞ্জয় বাংলার ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম পর্বের কথা বলে তাঁর কাহিনী শেষ করছেন। তখন তাঁর অবস্থান কোম্পানিরূপ বৃক্ষের একেবারে নীচে আলবালের ভেতর—সেই কোম্পানি যে শরণাগতের প্রতিপালনের দায় কাঁধে নিয়ে ধর্মপতাকা উড়িয়ে পলাশির যুদ্ধ জিতেছে।
এইরূপে নন্দবংশজাত বিশারদ অবধি শাহ আলম বাদশাহ পর্যন্ত ও মুনইম খাঁ নবাব অবধি নবাব কাসমলী খাঁ পৰ্য্যন্ত কোন কোন সম্রাট রাজারদের ও নবাবদের ও তাঁহারদের চাকর লোকেরদের স্বামিদ্রোহাদি নানাবিধ পাপেতে এই হিন্দুস্থানের বিনাশোন্মুখ হওয়াতে পরমেশ্বরের ইচ্ছামতে ঐ হিন্দুস্থানের রক্ষার্থ আরোপিত কম্পানি বাহাদুরের অধিকার রূপ বৃক্ষের পুষ্পিতত্ত্ব ও ফলতত্ত্বের সমাবধায়ক যে বড় সাহেব তৎকর্ত্তৃক ঐ কম্পানি বাহাদুরের অধিকার রূপ বৃক্ষের আলবালতে নিরূপিত পাঠশালার পণ্ডিত শ্রীমৃত্যুঞ্জয় শর্মাকর্তৃক গৌড়ীয় ভাষাতে রচিত রাজতরঙ্গ নামে গ্রন্থ সমাপ্ত হইল। (পৃ. ২৯৪-৫)
মনে রাখা যাক, ঈশ্বরেচ্ছায় কোম্পানির অধিকার লাভ। উদ্দেশ্য প্রজার প্রতিপালন। সেই উদ্দেশ্য সাধিত না হলে, প্রজাপালনের পরিবর্তে উৎপীড়ন হলে, দৈবশক্তির ক্রিয়ায় রাজ্যাধিকার আবার অন্যের হাতে ন্যস্ত হবে, আবার ধর্মের জয় হবে।
৪
আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবোধ শিক্ষিত বাঙালির মনে গেঁথে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এরকমই ছিল ঐতিহাসিক স্মৃতির গড়ন। মৃত্যুঞ্জয়ের রচনায় এই স্মৃতির একটা বিশেষ ধরনের প্রকাশ ঘটেছে যা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি ব্রাহ্মণ-সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাক-ব্রিটিশ যুগের মুসলমান লেখকদের ইতিহাসচিন্তাও কি একই রকম ছিল? পাঠান বা মুঘল শাসকশ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত দরবারের ঐতিহাসিকদের কথা এখানে উঠছে না, কারণ সে-সব তারিখ-সাহিত্য বাংলায় লেখা হতো না। বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে ভারতবর্ষ বা বাংলার রাজারাজড়ার ইতিহাস নিয়ে যে-ধরনের রচনা প্রচলিত ছিল, তার একটা নমুনা দিলে দেখা যাবে যে ইতিহাসে দৈবশক্তির প্রভাব, কৃতকর্মের প্রতিফল এবং পরিশেষে ধর্মের জয়, এই লক্ষণগুলি সেখানেও সমানভাবেই উপস্থিত। নমুনাটির ছাপার সময় অবশ্য অনেক পরে, ১৮৭৫ সালে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ কবিদের লেখা পুঁথিসাহিত্যের আদলটি এখানে এতই স্পষ্ট এবং ইউরোপীয় ইতিহাসশিক্ষার প্রভাব এমনই অনুপস্থিত যে ধরে নিতে অসুবিধা নেই, বরিশালের কবির ব্যবহৃত ‘দীল্লির রাজাদির নাম’ বিবৃত করার ছকটি অনেক দিনের প্রচলিত একটি ছক।৫ ‘শ্ৰীযুক্ত মুন্সী আলিমদ্দিন দ্বারায় বিরচিত নিবাস রুকন্দী থানে মেহেন্দিগঞ্জ’ এই তালিকাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে :
দীল্লিনাম কিহেতু হইল হিন্দুস্থান।
আদ্যন্ত নৃপতি গণ নির্ণয় বিধান ॥
এই নির্ণয় কিন্তু হিন্দু লেখকের পক্ষে করা সম্ভব নয়:
হিন্দুগণ চৌযুগী যে, কহয় তাহারে।
সৰ্ব্বত্রে মরম এরা বুঝিবারে নারে ॥
সত্য ত্রেতা দ্বাপরাদি কলি চারিযুগ।
হিন্দুতে রাজত্ব তথা করে সুখভোগ ॥
এই মুখবন্ধের পর ‘সাহাআলম বাহাদুর বাদসাহেগাজী’ পর্যন্ত ৫৯ জন বাদশাহের নামের তালিকা। কেবল নামেরই তালিকা; কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা বা বাদশাহ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য, কিছুই নেই। তারপর ঘটল দৈবের এক আশ্চর্য কাণ্ড।
দৈবেতে ইংরাজ আইলেন এ আলয়।
করিলেন নবাবেরে যুদ্ধে পরাজয় ॥
ইংরাজ লইল রাজ্য বেশির পাইয়া।
তদবধি রাজত্ব মহারাণী ভিক্টোরিয়া ॥
কুমার সিংহের দফা সারিয়ে কোম্পানি।
ইজারা বর্খাস্তে এসে খাস মহারাণী ॥
১৮৫৭-র সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কুঁয়ার সিং-এর বিদ্রোহ দমন, এটাও বেশ আশ্চর্যের। এর পর মহারাণীর রাজত্বের স্তুতি এবং আধুনিক শিল্পের অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানার ফিরিস্তি।
সাশিতের সীমা বিচারের একশেষ।
যাঁহার আমলে নাহি প্রজাদের ক্লেশ ॥
আছিল কড়ির চল দিল উঠাইয়া।
পয়সা হতে যথা যেই লইছে কিনিয়া ॥
ডাকেতে চালায় লোকে খবরাখবর।
গ্যাসের বাতিতে আলো করিল সহর ॥
আগ্বোটে মানিল হারি পিনিস্ আর নায়।
রেলেতে সপ্তাহ পথ দণ্ডকেতে যায় ॥
কলিকাতা বসিয়ে বিলাতে কে কি করে।
পলকেতে পায় তত্ত্ব তারের নির্ভরে ॥
ন্যায় বিচারে কার অন্যায় যদি হয়।
অপর আফিসে তাহা শুধরিয়ে লয় ॥
কিন্তু এমন যে সুশাসিত মহারাণীর রাজত্ব, তার পরমায়ু কতদিন?
প্রজাদের সুভাগ্যে রাজত্ব মহারাণী।
পরেতে প্রজার ভাগ্যে কি হয় না জানি ॥
বিশেষ করে ইংরেজরা যদি তুরস্ক অধিকার করে বসে, তা হলে এক সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবে।
যবে রূম আমল করিবেন সে রাণি।
মক্কা ও মদিনা বাকি রহিবেক জানি ॥
হাহাকার রাজ্যেতে হইবে উৎপাত।
সবজাত ভাঙিয়ে হইবে এক জাত ॥
কিন্তু তার পর নানা প্রলয়ংকর ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার সুধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে।
উত্তরিবে ইসানবি হইতে আকাশ।
পুনঃ মুসলমানি মত পাইবে প্রকাশ ॥
পূর্ব্ব কি পশ্চিম আদি উত্তর দক্ষিণ।
তবেসে হইবে খণ্ড প্রলয়ের চিন ॥
আয়াত কুদ্দিয়াতে এহেন নিরূপণ।
হাদিস হইতে যাহা উত্তম গণন ॥
পশ্চিমেতে উদয় হইলে দিবাকর।
তোবাদ্বার আবদ্ধ জানহ তদন্তর ॥
হাতেক দো উপরে উঠিয়া দিনমণি।
অস্ত হইবেক দীর্ঘ হইবে রজনি ॥
হবে রাত্র ছ সাত রাত্রের পরিমিত।
জাগিয়া ভাবিয়া লোক হইবে নিদ্রিত ॥…
হিজিরি সন তেরশত হইলে পূরণ।
চৌদ্দশত না পূরিতে জান সৰ্ব্বজন ॥
দেখিবেক যে সকল রহিবে জীবিত।
অধিক আশ্চৰ্য্যকাণ্ড হবে পৃথিবীত ॥
এর সঙ্গে তুলনীয়: ‘তাহার পর পরিনাগার্জুন নামে এক রাজা হইবেন তাহার শক এই কলির ৮২১ বৎসর শেষ থাকা পর্য্যন্ত থাকিবে তাহার পর সম্ভল দেশে গৌত-ব্রাহ্মণের ঘরে কল্কিদেবের অবতার হইবে…’ ইত্যাদি। ইতিহাসবোধের খুব একটা পার্থক্য আছে কি?
৫
পার্থক্যটা তা হলে এল কখন? স্বভাবতই ইংরেজি শিক্ষা, এবং আরও বিশেষ করে ইউরোপের ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদির চর্চা শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে যখন চালু হল, তখনই ইতিহাসের গল্প বলার পুরনো ছকটা ভেঙে একটা নতুন ছক তৈরি হতে শুরু করল। তা ছাড়া আধুনিক ইউরোপীয়ের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসটা কেমন দেখাবে, সেটা ইউরোপীয় লেখকরা নিজেরাই ততদিনে আঁকতে শুরু করে দিয়েছেন। আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণ থেকে যখন ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা চালু হল, তখন থেকেই আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রকরণ অবলম্বন করে ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার কাজ শুরু হয়ে গেল।
ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় গোড়া থেকেই উৎসাহী ছিল। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শুরু করে বহু প্রতিষ্ঠান সেই উৎসাহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কিন্তু মজার কথা হল, ইংরেজের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাস কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারল না। প্রাচ্যবিদ্যার ফসল সে কিছু কিছু নিল; অনেক কিছুই নিল না। যা নিল, তাও সে সাজাবার চেষ্টা করল সম্পূর্ণ নতুন একটা ছকে। সেই ছকের সে নাম দিল ‘জাতীয় ইতিহাস’। এই জাতীয় ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের জাতীয়তাবোধেরও ইতিহাস।
এই প্রসঙ্গে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের দিকপাল ব্যক্তিদের রচনার সঙ্গে আমরা যথেষ্ট পরিচিত। অপেক্ষাকৃত অল্পখ্যাত লেখকদের কিছু উদাহরণ দেব এখানে। এঁদের লেখায় মৌলিকতা কম। বরং পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ধারণাগুলিকে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠী, বিশেষ করে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিই এঁরা আরও ভাল পারতেন। সুতরাং ব্যাপক অর্থে শিক্ষিত বাঙালির ধ্যানধারণার একটা ছবি এই জাতীয় বই থেকে পাওয়া যাবে, এটা মনে করা অসঙ্গত নয়।
১৮৫৭-৫৮ নাগাদ অনেকগুলো স্কুলপাঠ্য বাংলা ইতিহাসের বই প্রকাশিত হয়। সম্ভবত নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনট্রান্স পরীক্ষার পাঠ্যসূচীর দিকে দৃষ্টি রেখে স্কুলের মাঝারি ক্লাসের জন্য লেখা হয়ে থাকবে এই বইগুলো। ততদিনে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের রাজাবলি প্রকাশিত হবার পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাহেব ছাত্রদের বাংলা ভাষা ও সেইসঙ্গে দেশীয় ইতিহাস শেখাবার জন্য লেখা হয়েছিল সেই বই। এখন লেখা হতে লাগল বাঙালি ছাত্রদের শেখাবার জন্য সাহেবদের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাসের বঙ্গানুবাদ।
মার্শম্যানের বাংলার ইতিহাসের একটি খণ্ড অনুবাদ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অপর অংশটি বিদ্যাসাগরের অনুরোধে অনুবাদ করেন রামগতি ন্যায়রত্ন।৬ মূল ইংরেজি বই-এর প্রভাব ফুটে উঠেছে এর ভাষাতেও। ‘সুলতান সুজা বাঙ্গালার গভর্ণর হইয়া আগমন করিলেন’, ‘মুরশিদ জামাতাকে আপনার ডেপুটি করিয়া উড়িষ্যাতে পাঠাইয়া দেন’—প্রশাসনিক শব্দের ব্যবহারই জানিয়ে দিচ্ছে যে এই ইতিহাসের রচয়িতা ইংরেজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আলিবর্দি খাঁ-র আমলে মারাঠা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে বই যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে কিন্তু রামগতি পরবর্তী ইতিহাসের আকস্মকিতার কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন।
তৎকালে [মহারাষ্ট্রীয়দিগের] এতাদৃশ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল যে তাঁহারাই এই দেশের অধীশ্বর হইবেন বলিয়া সকলে সম্ভাবনা করিত। কিন্তু দৈবের কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা! যাঁহারা এই দেশে কেবল সামান্য রূপ বাণিজ্য করিতে আসিয়াছিলেন; মধ্যে মধ্যে যাঁহাদের এদেশ পরিত্যাগ করিয়া যাইবার সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা হইত; যাঁহাদের এদেশের রাজা হওয়া স্বপ্নেরও অগোচর ছিল সেই ইঙ্গরেজরা আলীবর্দ্দির সিংহাসনারূঢ় সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিয়া ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের প্রায় একেশ্বর হইয়া উঠিয়াছেন। (পৃ. ১৭৯-৮০)
১৮৫৯-এ যা দৈবের মহিমা, তার দু-বছর আগেই এক চরম সংকটমুহূর্তে যে ইংরেজ রাজত্বের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি জানিয়েছিল পরিপূর্ণ আস্থা, ১৮৬৯-এ এক ‘মেড ইজি’ গোছের বইতে দেখছি৭ সেই ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার উপায় সম্বন্ধেই সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। ‘ক্লাইব কিরূপে জয়ী হল?—যদি মীরজাফর কৃতঘ্নতা পূৰ্ব্বক ক্লাইবকে বঞ্চনা না করিতেন, তাহা হইলে ক্লাইবের জয়লাভ সহজ হইত না।’ (পৃ. ১১০-১) অথবা পরবর্তী ইংরেজ শাসনকর্তাদের ন্যায়নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন: ‘নন্দকুমারের প্রাণবধ কি ন্যায়ানুসারে বিহিত হইয়াছিল?—তাঁহার অপরাধ কোন মতেই প্রাণদণ্ডের উপযুক্ত নহে, কেবল দুরাচার হেস্টিংসের অন্যায় অনুরোধে প্রধান জজ ইলাইজা ইম্পি ঐ মহাপাপের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন।’ (পৃ. ১২৬-৭)
১৮৭২-এর এক শিশুপাঠ বাঙ্গালার ইতিহাস-এ আবার পাচ্ছি৮ সেই ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। লেখক ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারে সিরাজ অত্যাচারী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু অন্ধকূপ হত্যার জন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। অথচ তাঁরই বিরুদ্ধে পাতা হল ষড়যন্ত্রের জাল। মীরজাফর সম্বন্ধে সিরাজ সন্দিহান ছিলেন। ‘তিনি সেনাপতি মীরজাফরকে কোরাণ স্পর্শ করাইয়া দিব্য করান। তাহাকে সেনাপতি “আমি কখন কৃতঘ্ন হইব না” এই কথা বলেন।’ (পৃ. ২০) মীরজাফর প্রতিশ্রুতি রাখলেন না, যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।
মোহনলাল নামক নবাবের অন্য একজন সেনাপতি ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিলেন। যদি এই যুদ্ধ আর কিছুক্ষণ চলিত, তাহা হইলে ক্লাইবকে নিশ্চয় হারিতে হইত। কিন্তু তৎকালে রাজলক্ষ্মী ইংরাজদিগের ভাগ্যে প্রসন্ন থাকায়, মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব পরাজিত ও ক্লাইব জয়ী হইলেন। (পৃ. ২২)
ক্ষেত্ৰনাথের ঘৃণা প্রধানত মীরজাফর ও মীরণের প্রতি। ‘মীরজাফর নিষ্ঠুর, নির্ব্বোধ, অর্থলোভী ও অকর্ম্মণ্য ছিলেন। তিনি নবাব হইয়া প্রধান প্রধান হিন্দুদিগের সর্ব্বস্ব হরণ মানস করেন।’ (পৃ. ২৭) ‘মীরণ অতি নরাধম ও নির্ব্বোধ এবং নিষ্ঠুর, সে এরূপ দুরাত্মা ছিল যে তার অত্যাচারে লোকেরা, সিরাজের সমুদায় কুব্যবহার ভুলিয়া যায়।’ (পৃ. ৩১)
মীরকাসিমের বেলাতেও সেই একই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনী। মীরকাসিম যেমন
সকল জিনিষের মাশুল উঠাইয়া দিলেন। ইহাতে কি ইংরাজ, কি বাঙ্গালী সকলকেই সমান করা হইল, এবং পূৰ্ব্বে ইংরাজ ভিন্ন অপরাপর লোকদের ব্যবসাতে অনেক হানি হইত, এরূপ হওয়াতে তাহাদের লাভ হইতে লাগিল। ইহাতে ইংরাজেরা তাঁহার উপর রাগিয়া উঠিলেন ও যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক হইলেন।…মীরকাসিমের যে সৈন্য বাঙ্গালার সমুদায় রাজার সৈন্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, তাহারা যে কোন যুদ্ধে জয় লাভ করিতে পারিল না, অবশ্যই ইহার কোন গুপ্ত কারণ ছিল, তাহার কোন সন্দেহ নাই। গার্গিনের বিশ্বাসঘাতকতাই তাহার প্রধান কারণ। (পৃ. ৩৪-৫)
ওদিকে দিল্লির সম্রাটের অবস্থা তখন করুণ।
সম্রাট এই সময়ে বড় দুরবস্থায় পড়িয়াছিলেন, এমনকি, তাঁহার নিজের রাজধানী পর্য্যন্ত পরের হস্তগত ছিল। বসিবার সিংহাসন ছিল না। ইংরাজদিগের খানা খাইবার টেবেল এক্ষণে তাঁহার সিংহাসন হইল। সমুদায় ভারতবর্ষের সম্রাট তাহাতে বসিয়া ইংরাজদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানীর সহিত তিন কোটি প্রজা অৰ্পণ করিলেন। যে দিল্লীর সম্রাটের জাঁকজমকের পরিসীমা ছিল না, যাঁহার প্রতাপে সমুদায় ভারতবর্ষ কম্পিত হইয়াছিল, এক্ষণে সেই সম্রাটের এরূপ অবস্থা অবশ্যই দুঃখজনক তাহার আর সন্দেহ নাই। (পৃ. ৪১)
শুধু রাজ্য দখলেই নয়, রাজ্যচালনাতেও ইংরেজরা প্রায়শই চক্রান্ত আর বলপ্রয়োগের রাস্তা নিত।
ক্লাইব এইরূপে রাজ্যে সুনিয়ম স্থাপন করায়, দেশীয় দিগের উপর যে দৌরাত্ম্য হইতেছিল তাহার অনেক কম হইয়া আসে। ইহার পূর্ব্বে ইংরাজেরা দেশীয় লোকদিগের উপর এমনি অত্যাচার করিয়াছিলেন যে, তাহাতে সমুদায় বাঙালিরা ইংরাজদের নাম শুনিয়া ঘৃণা করিতেন!…ক্লাইব চলিয়া গেলে, কোম্পানির কার্য্যের আবার গোলযোগ ঘটিতে লাগিল। (পৃ. ৩৯)
নন্দকুমারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের জন্য হেস্টিংস ‘সকলেরই নিকট এবং ইতিহাস মধ্যে অতিশয় ঘৃণিত হইয়া রহিয়াছেন।’ (পৃ. ৫৯) ১৮৫৭-তে সিপাহিরা যেমন ইংরেজদের ওপর অত্যাচার করেছিল, ‘বিদ্রোহ শান্তির সমকালে খ্রীষ্টধৰ্ম্মাভিমানী ইংরাজেরাও বিপক্ষদিগের অপকারের প্রতিশোধ ও আপনাদের হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য ফাঁসী কাষ্ঠে বদ্ধ মৃতদেহের অভ্যন্তর হইতে যকৃত বাহির করিয়া অগ্নিতে দগ্ধ করেন।’ (প. ৯৮)
কিন্তু সিপাহিদের বিদ্রোহ দমন করার পরেও যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল, তা নয়।
কোন কালেই গরিবের ও দুৰ্ব্বলের মা বাপ নাই। সকল স্থানের গোলবোগ চুকিয়া গেলে, বাঙ্গালায় একটী হুলস্থূল কাণ্ড ঘটিয়া উঠিল। ঐ সময়ে বাঙ্গালার নীল প্রধান দেশে নীলকর সাহেবদের কার্দ্দানী বাড়িতে লাগিল। তাহারা গরিব প্রজাদিগের প্রতি যেরূপ নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিল, তাহাতে তাহাদিগকে কখনোই মানুষের মধ্যে গণনা করা যাইতে পারে না। (পৃ. ১০০)
সত্যি কথা বলতে কি, ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাস লিখতে গিয়েই কিন্তু ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির ইতিহাসচিন্তা থেকে ঈশ্বর, ধর্ম, ন্যায়নীতি ইত্যাদি মাপকাঠিগুলো লোপ পেয়ে গেল। চূড়ান্ত নীতিহীনতার আশ্রয় নিয়েও যে ক্ষমতা দখল এবং ভোগ করা যায়, বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাস যেন সেই সত্যটাকেই হাজির করে দিল ইউরোপীয় শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত বাঙালির কাছে।
১৮৭০-এ প্রকাশিত কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর জনপ্রিয় পাঠ্যবই-এর৯ নবম সংস্করণে দেখছি ইংরেজের রাজত্ব লাভের কাহিনীটিকে সম্পূর্ণ নীতিবিগর্হিত ক্ষমতার লড়াই হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। যেমন উমিচাঁদের সঙ্গে ক্লাইভের প্রতারণা: ‘ক্লাইবের এই কাৰ্যটী অতিশয় গর্হিত বলিয়া সকলেই তাঁহার নিন্দা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহার মতে শঠের সহিত শঠ্যতা করায় কোন পাতিত্য নাই “শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ”।’ (পৃ. ৪৩-৪)
অথবা ১৭৭২ সালে সরাসরি গভর্নর কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থার প্রবর্তন :
‘জোর যার মুলুক তার’। এই অবধি কোম্পানির দেওয়ানত্ব গিয়া প্রকৃত পক্ষে রাজত্ব আরম্ভ হইল। সম্রাট সবল থাকিলে এই কর রহিত করা উপলক্ষে তুমুল কাণ্ড ঘটিত। কিন্তু এখন আর তাঁহাতে কিছুই ছিল না; সুতরাং হেস্টিংস যাহা মনে করিলেন তাহাই হইল। (পৃ. ৭০)
সিরাজউদ্দৌলার রাজত্ব সম্বন্ধে মৃত্যুঞ্জয়ের লেখায় যে সুস্পষ্ট ঘৃণার ভাব ছিল, কৃষ্ণচন্দ্রে তার কিছুই নেই। বরং সিরাজের কার্যকলাপের একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন ইংরেজরা যখন কলকাতার দুর্গ সংস্কার শুরু করল, সিরাজ তা ভেঙে ফেলার আদেশ দিলেন।
কোন্ রাজাই বা বিদেশীয় লোককে আপনার অধিকার মধ্যে দুর্গ নির্ম্মাণ করিতে দেন?…কোথা হইতে কতগুলা বণিক আসিয়া তাঁরই অধিকার মধ্যে থাকিয়া তাঁহারই আদেশ অমান্য করিতেছে, এ অবমাননা আর সহ্য হইল না; ক্রোধ উদ্বেল হইয়া উঠিল। (পৃ. ৩৮)
কিংবা অন্ধকূপ হত্যা।
সিরাজউদ্দৌলা কি অশুভক্ষণেই কলিকাতায় পদার্পণ করিয়াছিলেন, তিনি এই অন্ধকূপ-হত্যার বিন্দু বিসর্গও জানিতেন না, তাঁহার আজ্ঞানুসারে কিছু ইংরেজ বন্দী দিগের ঐ কারাবাস নির্দ্দিষ্ট হয় নাই, অথচ ইহা হইতেই তাঁহার সর্বনাশ উপস্থিত হইয়াছিল। নিতান্ত মদমত্ততা প্রযুক্ত তিনি মার্জ্জার ভ্রমে ব্যাঘ্র শরীরে হস্তাৰ্পণ করিয়াছিলেন। শেষে সেই অজ্ঞানতাদোষে স্বয়ং রাজ্যভ্রষ্ট ও প্রাণে নষ্ট হইয়া আপন বংশের দুর্দ্দশার একশেষ ঘটাইলেন। বলিতে কি, কলিকাতার এই অন্ধকূপ হত্যা ঘটাতেই ভারতভূমিতে ইংরেজ অভ্যুদয়ের সূত্রপাত হইয়াছিল। (পৃ. ৪০)
সিরাজের পতনের কারণ অধর্মাচরণ নয়, নিছক অজ্ঞানতা। আর সে অজ্ঞানতা কী? বেড়াল ভেবে বাঘের গায়ে হাত দেওয়া।
ইতিহাস এখন দৈবশক্তির লীলাক্ষেত্র কিংবা ধর্মাধর্মের যুদ্ধ থেকে নিছক ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। ইংরেজ রাজত্বের সূত্রপাত এখন আর দৈবের অনির্বচনীয় মহিমা নয়। কোন রাজনৈতিক অবস্থায় ইংরেজের জয়লাভ অসম্ভব করে তোলা যেত, শিক্ষিত বাঙালি এখন তাই নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
যদি এদেশ এক জন প্রবল অধিপতির অধীন থাকিত, অথবা স্থানে স্থানে যাঁহারা প্রভু ছিলেন, তাঁহাদের পরস্পর একতা এবং প্রণয় থাকিত, তাহা হইলে ইংরেজরা এদেশে কদাপি ঈদৃশ প্রভাবশালী হইতে পারিতেন না, তাহা হইলে এদেশ অদ্যাপি মুসলমান রাজাদিগেরই অধিকৃত থাকিত। হয়ত এদেশে কেহই ইংরেজদিগের নামও শুনিতে পাইত না। (পৃ. ২১৪)
বই শেষ হচ্ছে ইংরেজ রাজত্বের সুফলের একটা ফিরিস্তি দিয়ে, কিন্তু তাতে যে রাজত্বলাভের নৈতিক দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় না, সে ইঙ্গিতও কৃষ্ণচন্দ্র দিচ্ছেন বেশ খোলাখুলিই। ‘সে যাহা হউক, যে উপায়ে ইংরেজদিগের এই সুবিস্তীর্ণ রাজ্য উপার্জিত হইয়া থাকুক না কেন, বস্তুত তাঁহাদের দ্বারা এদেশের অশেষবিধ হিত সম্পাদিত হইয়াছে একথা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক।’ (পৃ. ২৩৮) জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি আমরা।
১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরির বই-এর১০ বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকছে: ‘ইংরাজী ইতিহাসের অনুবাদ পাঠ করিয়া যাঁহাদিগের ভ্রান্তি জন্মিয়াছে তাঁহাদিগের জন্য এই পুস্তকখানা লিখিয়াছি।’ আধুনিক ইউরোপীয় জাতীয় ইতিহাস-রচনার সারমর্মটি ক্ষীরোদচন্দ্রের মনে কতটা দাগ কেটেছে তার প্রমাণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এই মন্তব্যটি:
ফরাসি ও ইংরাজেরা চিরদিন পরস্পরের বিদ্বেষী। ভারতবর্ষে মোগল পাঠানের কলহ যেমন প্রবাদ মধ্যে পরিগণিত হইয়া পড়িয়াছে, ইয়োরোপে ইংরাজ ও ফরাসির বিদ্বেষ সেই রূপ গণ্য হয়। সুতরাং ভারতবর্যেও যে তাহারা পরস্পরকে পীড়ন না করিয়া নির্ব্বিবাদে এক স্রোতের জলপান করিবে কেহ বিশ্বাস করে নাই। (পৃ. ১১৫) বই শেষ হচ্ছে এই মন্তব্য দিয়ে:
সামান্য বণিকভাবে ভারতবর্যে বাণিজ্য করিতে আসিয়া ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ঘটনা স্রোতে বিংশতি কোটী প্রজার অধীশ্বর হইয়া উঠেন, এবং কোম্পানির অংশীদারেরা লক্ষপতি ও ক্রোরপতি হইয়া বিদেশীয় বিভিন্ন জাতির রীতি নীতির স্থাপয়িতা হইয়া দাঁড়ান। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এরূপ অমানুষী ঘটনা আর হয় নাই। (পৃ. ২১১)
৬
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম, তাঁর অবস্থান প্রজার অবস্থান। ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। কিন্তু এই দুই প্রজা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সত্তর বছরের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালি নামক জীবটি অনেক বদলে গেছে। ক্ষেত্রনাথের সময় সে নিজেকে ইউরোপের ‘মিডল ক্লাস’-এর অনুকরণে ‘মধ্যবিত্ত’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছে। শুধু যে বিত্তের দিক দিয়েই সে মধ্যবর্তী, তাই নয়। সামাজিক কর্তৃত্বের ক্ষেত্রেও সে এখন মধ্যস্থের ভূমিকা নিয়েছে। যারা বিত্তশালী, সমাজের মাথা হিসেবে স্বীকৃত, তারা যে কর্তৃত্ব করার পক্ষে অযোগ্য—নতুন মধ্যবিত্ত এই অভিযোগ এনে হাজির করেছে সমাজের সামনে। অন্যদিকে যারা দরিদ্র, অত্যাচারিত, তাদের হয়ে বলার দায়িত্বটাও সে তুলে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে। এখন মধ্যস্থ হওয়ার অর্থ, একদিকে শাসকবর্গের বিরোধিতা, অন্যদিকে প্রজাবর্গের নেতৃত্ব। প্রজা হয়েও ক্ষেত্ৰনাথের সমসাময়িক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিন্তু চৈতন্যের স্তরে অন্তত নিজেকে রাষ্ট্র চালনার উপযুক্ত বলে ভাবতে শুরু করেছে।
সেই সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল নীতিগুলিও গভীর ভাবে গেঁথে গেছে তার মনে। দেশের পুরনো সমাজব্যবস্থা যে কাম্য নয়, তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, এই বিশ্বাস ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে ততদিনে প্রায় সর্বজনীন হয়ে গিয়েছিল। কথাটা মনে রাখা দরকার, কারণ উনিশ শতকের শেষদিকে এসে সমাজচিন্তার যে ধারাটিকে ‘সনাতনপন্থী’ বা ‘রক্ষণশীল’ বলা হয়, হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যে ধারা, তার নেতারাও যে প্রবলভাবে সংস্কারপন্থী এবং হিন্দুসমাজের আধুনিকীকরণের প্রবক্তা, এ-কথাটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। তথাকথিত ‘উদারপন্থী’ আর ‘রক্ষণশীল’দের মধ্যে অন্য যা-ই তফাত থাকুক, পুরনো সমাজকে বদলে আধুনিক জগতের উপযোগী করে তুলতে হবে, এ-বিশ্বাস দুজনের মনেই সমান দৃঢ় ছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের অসংখ্য গৌণ লেখকদের নিতান্ত মামুলি রচনা পড়লেও এই নতুন মূল্যবোধের কথা পাওয়া যাবে। সামাজিক কর্তৃত্বের বেলায় যেমন একটা নতুন ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল—সমদর্শিতা। ১৮৬৬ সালে তারাকৃষ্ণ হালদার নামে একজন বারাণসী থেকে নানা সামাজিক বিষয়ে একটি প্রবন্ধের বই লেখেন।”১১ নিঃসন্দেহে রক্ষণশীল হিন্দু। ‘যুবতীগণের প্রতি ব্যবহার বিষয়ক’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘কি গৃহমধ্যে কি অন্য স্থানে, কোন খানেই কোন যুবতী যেন একাকিনী অবস্থান করিতে না পান।’ (পৃ. ৬৯) অথচ তিনি পণপ্রথার বিরোধী, কুলীনবিবাহের বিরোধী। এই তারাকৃষ্ণ ‘রাজভক্তি বিষয়ক’ প্রবন্ধে লিখছেন,
পূৰ্ব্বকালে যখন এই দেশ হিন্দুজাতির শাসনাধীন ছিল তখন রাজগণের পক্ষপাতিতা দোষে জাতি বিশেষ অপর সমস্ত জাতির উপর সম্পূর্ণ প্রভুত্ব করিতেন, ঐ সকল জাতিকে স্বর্গ বা নরকগামী করণের কর্ত্তা ছিলেন। …যখন এই রাজ্য যবনদিগের হস্তে ছিল তখন তাঁহারা হিন্দুবর্গকে নাস্তিক ও অধার্মিকের শেষ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন। স্বজাতি প্রজাবর্গের প্রতি যাবতীয় বিষয়েই অনুগ্রহ, হিন্দু প্রজাদিগের প্রতি সৰ্ব্বতোভাবেই নিগ্রহ করিতেন। …ব্রিটিস জাতির রাজনিয়মাবলীতে এ সকল দোষের লেশও নাই, তাঁহারা আপন জাতীয় ধর্ম্মোপদেষ্টাকে এবং এ দেশস্থ ডোমপ্রভৃতি যৎপরোনাস্তি নীচ ব্যক্তিকে বিচারকালে সমান দেখেন। …ঐ জাতির পক্ষপাতশূন্যতা গুণের অধিক প্রশংসা কি করিব? (পৃ. ১৩৪-৬)
এখান থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেই পরের কথাটা পেয়ে যাচ্ছি। বর্তমান হিন্দু সমাজের যে জীর্ণ অধঃপতিত অবস্থা, তার কারণই মুসলমান শাসন। ১৮৭৬-এ ভোলানাথ চক্রবর্তী নামে একজন বক্তৃতা দিচ্ছেন:১২
যে দিন যবনের উষ্ণীষ বঙ্গ রাজ্যে প্রবেশ করে, সেই দিন হইতেই এদেশের দুর্ভাগ্য ও অবনতির সূত্রপাত হয়। নিষ্ঠুর যবনশাসনে এদেশ ক্রমশঃ উৎসন্ন হইয়া যায়। যেমন এক প্রবল বাত্যা আসিয়া বন উপবন ভগ্ন ও হতশ্রী করে, সেই রূপ নৃশংস দুরাচার যবন জাতি আসিয়া আমাদের জন্মভূমি বঙ্গভূমির সমুদায় সুখসৌভাগ্য বিনষ্ট করিয়াছিল। অজস্র অত্যাচার স্রোত সহ্য করিয়া—নিরন্তর নিপীড়িত হইয়া বঙ্গ সন্তানেরা নিতান্ত নিবীর্য ও হীনসাহস হইয়া পড়ে। ধৰ্ম্ম বিকৃত ভাব ধারণ করে। স্ত্রীশিক্ষা একেবারে রহিত হয়। যবনাক্রমণ নিবারণ জন্য স্ত্রীজাতিকে নিভৃত নির্জ্জন গৃহে রুদ্ধ করিয়া রাখা হইতে লাগিল। এক সময় দেশের এমনি দুরবস্থা ঘটিয়াছিল, যে, ধনীর ধন, মানীর মান ও সতীর সতীত্ব সমূহ বিপদের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। (পৃ. ১০)
জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের কাঠামোর অর্ধেকটা পেয়ে গেলাম এখানে। আদিতে জাতির ইতিহাস ছিল গৌরবের আলোয় উজ্জ্বল—ধন, বল, বিদ্যা, ধর্ম, সব দিক দিয়েই সভ্যতার চরম উৎকর্যে পৌঁছেছিল সে। এখানে জাতি বলতে কখনো বাঙালি, কখনো হিন্দু, কখনো আর্য, কখনো ভারতবর্ষীয়, যে-কোনও একটা বলা যেতে পারত, কিন্তু যুক্তির কাঠামোটা একই। তার পর এল জাতির অবক্ষয়ের যুগ। অবক্ষয়ের কারণ মুসলমান শাসন, অর্থাৎ জাতির পরাধীনতা। জাতীয়বাদী ইতিহাসের এই কাঠামোর বাকি অংশটা ভোলানাথ চক্রবর্তীর লেখায় পাচ্ছি না। কারণ জাতীয় সমাজের সংস্কার এবং পুনরুজ্জীবনের কথা বললেও, এই সংস্কারের সম্ভাবনা তাঁর মতে একান্তভাবেই ইংরেজ শাসনের ওপর নির্ভরশীল।
সকল বিষয়েরই সীমা আছে। যখন মুসলমানদিগের অত্যাচার নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিল, তখন জগদীশ্বর তাহা হইতে পরিত্রাণের উপায় বিধান করিলেন। …যে দিন এদেশে বৃটিশ পতাকা প্রথম উড্ডীন হয়, সেই দিন হইতেই এদেশের পুনঃ সৌভাগ্যের সূত্রপাত হইয়াছে। বলুন দেখি, যদি এ পর্য্যন্ত যবনাধিকার অব্যাহত থাকিত, তবে আজ দেশের কি দশা ঘটিত? অতএব একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে যে পরমেশ্বরের মঙ্গলের জন্য ইংরাজ জাতিকে এদেশে আনয়ন করিয়াছেন। বৃটিশ অধিকারে যবনদিগের অত্যাচার নিবারিত হইয়াছে। …যবন শাসনের সহিত বৃটিশ শাসনের তুলনাই হইতে পারে না। অন্ধকার ও আলোকে যত অন্তর, দুঃখ ও সুখে যত প্রভেদ, যবন শাসন ও বৃটিশ শাসনে তদপেক্ষাও অধিক প্রভেদ প্রতীয়মান হয়। (পৃ.১১-২)
অবশ্য ভোলানাথ চক্রবর্তী না মানলেও, ১৮৭০-এর দশকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের যুক্তির বাকি অংশটুকুও যথেষ্ট চালু হয়ে গিয়েছে। তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস-এর অষ্টাদশ সংস্করণ বেরোয় ১৮৭৮ সালে।১৩ তারিণীচরণ (১৮৩৩-১৮৯৭) ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক এবং সমাজ-সংস্কারক। তাঁর লেখা স্কুলপাঠ্য ইতিহাস আর ভূগোলের বই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি নামে সমসাময়িক অন্য অনেক স্কুলপাঠ্য বই-এ দেখা যাচ্ছে তারিণীচরণেরই সংক্ষিপ্তসার। অনেক সময় হুবহু উদ্ধৃতি। এই বইটি থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের নানা কাহিনী একটু বিস্তারিতভাবে উপস্থিত করতে চাই। তা হলে আজকের উগ্রহিন্দু প্রচারের মালমসলা জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার ভেতর তার জন্মলগ্ন থেকেই কীভাবে সঞ্চিত হয়ে এসেছে, তার একটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
৭
প্রথম বাক্যেই চমক লাগে। ‘ভারতবর্ষ ক্রমান্বয়ে হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টানদিগের অধিকৃত হইয়াছে, এবং তদনুসারে এদেশের ইতিবৃত্ত হিন্দু, মুসলমান ও খৃস্টান এই তিন রাজত্বকালে বিভক্ত।’ (পৃ. ১) রাজাবলি থেকে দেশের ইতিহাস-এ উত্তরণটি লক্ষণীয়। ‘রাজাবলি’ আর লেখা হবে না, এখন থেকে যা লেখা হবে সবই ‘দেশের ইতিবৃত্ত’। কিন্তু এই যে দেশের ইতিবৃত্ত, তার পর্ব ভাগ করা হল রাজত্বের চরিত্র অনুযায়ী। আর রাজত্বের চরিত্র নির্ধারিত হচ্ছে শাসকের ধর্ম অনুসারে। দেশ আর রাজত্বের মধ্যে সম্বন্ধ এখানে নিত্য এবং অভেদ্য। শুধু তাই নয়, আপাতদৃষ্টিতে নানা সময় নানা রাজ্য আর রাজা দেখতে পাওয়া গেলেও, প্রকৃত অর্থে রাজত্ব একটিই। তা দেশেরই সমব্যাপী। তার চিহ্ন রাজধানী অথবা সিংহাসন। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজত্ব হল দেশের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ; রাজধানী বা সিংহাসন সেই সার্বভৌম রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র। দেশটা যেখানে ভারতবর্ষ, তার সমব্যাপী সার্বভৌমত্ব’ তাহলে একটিই। সেই সার্বভৌমত্বের চিহ্নস্বরূপ কেন্দ্রও একটিই। তা না হলে মুহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করলেন, তাতে সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের র্ব বদলে যাবে কেন? অথবা পলাশির যুদ্ধকে মুসলমান রাজত্বের অবসান এবং খ্রিস্টান রাজত্বের সূত্রপাত বলব কেন? দেশ বা জাতি, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্র—আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে এই তিনটি ধারণার মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালির মনেও তা এবার আশ্রয় পেল।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতার আর-একটি দৃষ্টান্ত পরের পৃষ্ঠাতেই পাওয়া যাবে। ‘অধুনা যে সকল সংস্কৃত গ্রন্থ পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশই কাব্য ও কল্পিত উপন্যাসে পূর্ণ; রাজতরঙ্গিনী ভিন্ন একখানিও প্রকৃত পুরাবৃত্ত দেখা যায় না।’ (পৃ. ২) প্রকৃত পুরাবৃত্ত কাকে বলে, তা অবশ্য ততদিনে ইউরোপীয় ইতিহাসবিদেরা স্থির করে দিয়েছেন। ‘ভারতের প্রকৃত পুরাবৃত্ত নাই’, এটা সাহেবদের ভারতবিদ্যাচর্চার একটা বিশেষ আবিষ্কার। মৃত্যুঞ্জয়ের এমন কথা কখনো মনে হয় নি। তারিণীচরণ কিন্তু নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়েছেন কথাটা।
এর পর ভারতবর্ষের অধিবাসীদের কথা।
অতি প্রাচীন সময়ে ভারতবর্ষে, পরস্পর অতিশয় বিভিন্ন, দুই সম্প্রদায়ের লোকের বসতি ছিল। তন্মধ্যে এক সম্প্রদায় শরীরের দৈর্ঘ্য ও গঠন প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের অনেক অনুরূপ। অধুনা সেই সম্প্রদায়ের সন্ততি হিন্দু নামে খ্যাত। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা খর্ব্বকার, কৃষ্ণবর্ণ ও অতিশয় অসভ্য ছিল। ইদানীং ইহাদের সন্ততি খস, ভিল্ল, পুলিন্দ, সাঁওতাল প্রভৃতি জঙ্গলা জাতি নামে পরিচিত। (পৃ. ২)
আদিতে ভিন্ন, কিন্তু পরে মিশে গেছে, এমন সম্প্রদায়ও ছিল। হিন্দুদের মধ্যে প্রথম তিন বর্ণ দ্বিজ নামে পরিচিত, কিন্তু শূদ্রেরা ঐ নামে অধিকারী নয়। ‘ইহাতেও প্রতীয়মান হইতেছে যে, আদৌ প্রথমোক্তেরা শেষোক্তদিগের হইতে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিলেন। পরে শেষোক্তরা সেই সম্প্রদায়ে গৃহীত, কিন্তু সৰ্ব্ব-নিকৃষ্ট শ্রেণীতে গণিত হয়।’ (পৃ. ৪)
তা ছাড়া ভারতের উত্তর ভাগ থেকে ক্রমশ দক্ষিণের দিকে হিন্দু ধর্মের প্রসারের একটি ধারণাও তারিণীচরণে আছে। সেই প্রসার স্পষ্টতই রাজত্বের প্রসার।
আদৌ দক্ষিণাবর্ত্ত জঙ্গলময় এবং অহিন্দু সভ্য জাতিদিগের নিবাসস্থল ছিল। রামচন্দ্র সর্ব্বপ্রথম ভারতবর্ষের ঐ ভাগে হিন্দু পতাকা উড্ডীন করেন। …অদ্যাপি দক্ষিণাবর্ত্ত হিন্দুদিগের আদিম উপনিবেশ সংস্থাপনের অনেক জনশ্রুতি শুনিতে পাওয়া যায়। (পৃ. ২৭)
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের আধুনিক চিহ্ন রামচন্দ্রের হাতে পত্পত্ করে উড়ছে, এ-ছবি একশো বছর আগের ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণের কল্পনায় সহজেই এসে গিয়েছিল। তবে এ-হেন রামচন্দ্র যে দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের দমন করে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, এ-কথায় আজকের উগ্রহিন্দু বোধ হয় বিব্রতই হবেন।
প্রকৃত পুরাবৃত্তের অভাবে ইতিহাসের কাহিনী নির্মাণে বড় বড় ফাঁক থেকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মৃত্যুঞ্জয়ের ইতিহাসভাবনা থেকে আমরা কত দূর সরে এসেছি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে তারিণীচরণের এই মন্তব্যে :
ইয়ুরোপীয় পুরাবিদেরা, বিবিধ যুক্তি দ্বারা প্রতিপন্ন করিয়াছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ খৃষ্টীয়-শকারম্ভের চতুর্দশ শতাব্দীর পূৰ্ব্বে ঘটিয়াছিল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর বহুকাল পৰ্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিবৃত্ত এরূপ অপরিয়ে, অসম্বন্ধ ও গোলযোগে আবৃত যে তাহা হইতে কোনরূপ বিবরণ সঙ্কলন করা দুঃসাধ্য। (পৃ. ১৬-৭)
যেটুকু বিবরণ তারিণীচরণ সংগ্রহ করেছেন, তাতে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। মোটামুটিভাবে ইংরেজদের লেখা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস যে সময় যেমন প্রচলিত ছিল, সেরকমই লিখেছেন তিনি। শুধু বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে একটি কৌতূহল জাগাবার মতো মন্তব্য করেছেন।
[বুদ্ধ] হিন্দুধর্মের পরম শত্রু হইয়া উঠেন; এ জন্য হিন্দুরা তাঁহাকে নাস্তিক ও ধর্মলোপক বলিয়া বর্ণনা করিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, তাঁহার প্রণীত ধৰ্ম্মে অতি পবিত্র বিবিধ উপদেশ প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি যুক্তিহীন কিছুই মান্য করিতেন না। কোন জাতি যতই কেন প্রাচীন সংস্কারের পরতন্ত্র হউক না, চিরাগত মতের বিরুদ্ধে প্রবলতর যুক্তি প্রদর্শন করিতে পারিলে পরিণামে অবশ্যই অন্ততঃ কিয়দংশেরও মত পরিবর্তন ঘটিয়া উঠে। (পৃ. ১)
এখানে লক্ষণীয়, বৌদ্ধ ধর্মমতের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা হচ্ছে না। বরং হিন্দুধর্মের আভ্যন্তরীণ একটি যুক্তিবাদী সমালোচনা হিসেবেই তাকে উপস্থিত করা হচ্ছে। তা না হলে, পর্বভাগের প্রথম সূত্র অনুসারে বৌদ্ধ রাজাদের আমলটিকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের স্বতন্ত্র একটি পর্ব বলতে হত। তার আর প্রয়োজন হচ্ছে না; হিন্দু রাজত্বকালের মধ্যেই তাকে জায়গা করে দেওয়া যাচ্ছে।
প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত বহুলাংশে অস্পষ্ট হলেও একটি বিষয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের কোনও অভাব নেই। সেটি হল ‘আদিম ভারতবর্ষীয়দিগের সভ্যতা ও পাণ্ডিত্য’। তারিণীচরণের ষষ্ঠ অধ্যায়ের এই হল বিষয়। মূল প্রতিপাদ্য এইরকম:
প্রাংশু ও বামনে, বলী ও ক্ষীণে যা বৈলক্ষণ্য, আদিম ও আধুনিক হিন্দুতে তদপেক্ষাও অধিক। পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্বকালে বৈদেশিক ভ্রমণকারীরা ভারতবর্ষে আসিয়া আৰ্য্যবংশের সাহসিকতা, বাঙ্নিষ্ঠা, সারল্য প্রভৃতি সদ্গুণের পরাকাষ্ঠাদর্শনে বিস্মিত ও চমৎকৃত হইতেন, অধুনা ঐ সকল গুণের অভাবই প্রধানরূপে কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। তখন হিন্দুরা দিগ্বিজয়ে নির্গত হইয়া সময়ে সময়ে তাতার চীন প্রভৃতি দেশে আপনাদিগের পতাকা উড্ডীন করিতেন; অধুনা বহুদূর হইতে এক ক্ষুদ্র দ্বীপের কতিপয় সৈনিক আসিয়া ভারতভূমির উপরে কর্তৃত্ব করিতেছে। তখন হিন্দুরা স্বজাতীয় ভিন্ন সকলকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেন: অধুনা সেই স্নেচ্ছেরা আসিয়া আর্য্যসন্তানগণের উপরে নিয়ত অবজ্ঞা বর্ষণ করিতেছে। তখন হিন্দুদিগের অর্ণবতরী সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপে নিয়ত যাতায়াত করিত, অদ্যাপিও তাহার সন্নিহিত বালিদ্বীপে তাহার ভূরি নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায়; অধুনা সমুদ্রগমণের নামেই হিন্দুদিগের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, এবং কেহ কোনরূপে যাইলে তিনি সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া আইসেন। (পৃ. ৩২)
প্রাচীন গৌরব, বর্তমান অধঃপতন। পুরো গল্পটা কিন্তু আমাদের নিয়ে। প্রাচীন ভারতের শৌর্যবান নায়কেরা আমাদেরই পূর্বপুরুষ। আর আজকের হীনবল ভারতীয় বলা বাহুল্য আমরা। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা যে ‘তাতার চীন প্রভৃতি দেশ’ জয় করেছিলেন, সমুদ্র পেরিয়ে তাঁরা যে বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন এবং ভিন্ন জাতীয়দের ‘ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেন’, এ আমাদেরই গৌরব। আর আজকে ‘আর্যসন্তানেরা’ যে নিজেরাই অপরের পদানত, অন্য জাতির অবজ্ঞার পাত্র, তা আমাদের কলঙ্ক। ক্ষমতার মাপকাঠিতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভারতবাসীর স্থান আজ নেমে গেছে বহু নীচে, কিন্তু এককালে সেই স্থান ছিল ওপরে।
কেবল বীরত্বই নয়, বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও প্রাচীন ভারতের কৃতিত্ব সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
পূৰ্ব্বকালে যখন প্রায় সমুদয় মেদিনী ঘোর মূর্খতা-রজনীতে আচ্ছন্ন ছিল, তখনও ভারতবর্ষে বিদ্যার নির্ম্মল আলোক কোনরূপেই নিষ্প্রভ ছিল না। তীক্ষ্ণমণীষা-সম্পন্ন হিন্দুরা দর্শনশাস্ত্রে অতি আদিম কালে যে সকল মত উদ্ভাবিত করিয়া গিয়াছেন, এখনও ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা তৎসমুদায় লইয়া আন্দোলন করিতেছেন। (পৃ. ৩৩)
লক্ষণীয়, এই বিষয়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সাক্ষ্য তারিণীচরণের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত প্রাচীন ভারতে বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষের যে-কটি দৃষ্টান্ত তিনি দিচ্ছেন— জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, তর্কশাস্ত্র, আর ভাষা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে—তার সব ক-টিই উনিশ শতকের প্রাচ্যবিদ্যাবিৎ সাহেবদের আবিষ্কার। যুক্তিটা যেন এই রকম: আজকের ভারতবাসীদের হীন অবস্থা দেখে ইউরোপীয়েরা তাদের অবজ্ঞা করে বটে, কিন্তু চিরকাল ভারতীয়রা এরকম ছিল না; ইউরোপীয় পণ্ডিতেরাই স্বীকার করছেন যে প্রাচীন ভারতে জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা উৎকর্যের শিখরে পৌঁছেছিল। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের পুরো কাহিনীটা সাজানোর ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার এই অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
তারিণীচরণের ইতিহাসটি যে জাতীয়তাবাদী, তার আরও একটি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রাচীন গৌরব আর পরবর্তী অবক্ষয়ের এই কাহিনীটির শেষে নীতিকথার গল্পের মতো একটি উপদেশ আছে। সেটি হল, সমাজের সংস্কার করো, অবক্ষয়ের চিহ্ন এইসব কুসংস্কার মুছে ফেলে প্রাচীন আদর্শের পুনরুদ্ধার করো। যে-সব ভ্রান্ত আচার আর বিশ্বাসের জন্য ভারতবাসী আজ সকলের ঘৃণার পাত্র, প্রাচীনকালে তার কিছুই ছিল না, কারণ ইউরোপীয়েরাই স্বীকার করেছেন প্রাচীনকালে আমরা অতি সভ্য ছিলাম।
অধুনা হিন্দু সীমন্তিনীগণ দাসীর ন্যায় ব্যবহৃত, বন্দীর ন্যায় অবরুদ্ধ ও ইতর জন্তুর ন্যায় নিরক্ষর দৃষ্ট হয়। কিন্তু সার্দ্ধ সহস্র বর্ষ পূর্বে অবলোকন করিলে স্ত্রীদিগকে আদরণীয়, শিক্ষণীয় ও অনেক পরিমাণে অনবরুদ্ধ দেখা যায়। তখন বাল্যবিবাহ কোথায়? কেহই চতুর্ব্বিংশতি বর্ষের ন্যুন বয়সে দারপরিগ্রহ করিতেন না। (পৃ. ৩৩)
জাতীয়তাবাদীর কাছে প্রাচীন ভারত হয়ে উঠল তার ক্লাসিকাল আদর্শ। আর প্রাচীন থেকে বর্তমানের মাঝের অংশটা হল তমসাবৃত মধ্যযুগ। বলা বাহুল্য এই ছকও ইউরোপীয় ইতিহাসে অনুমোদিত। উনিশ শতকের সুট-বুট পরা ইংরেজ যদি প্রাচীন গ্রিসকে তার ক্লাসিকাল উত্তরাধিকার বলে দাবি করতে পারে, তা হলে উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিই বা ‘ব্যাদে আছে’ বলে গর্ব করবে না কেন?
আধুনিক ইউরোপের আদলে ইতিহাসচর্চা চালু হওয়ার পর ঐতিহাসিক স্মৃতির গড়নে পরিবর্তনগুলো কোথায় এল, সেটা একটু লক্ষ করা উচিত। রাজাবলির-কালক্রম ছিল নিচ্ছিদ্র; এখন বিশ্বাসযোগ্য পুরাবৃত্তের অভাবে সেখানে অনেক ফাঁকফোকর দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, আগে যা ছিল কেবল রাজারাজড়ার ইতিবৃত্ত, এখন তা হয়ে গিয়েছে ‘আমাদের’ ইতিহাস—পুরাবৃত্তের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমগ্র জাতির অখণ্ড ইতিহাস। রাজত্ব হস্তান্তর আগে যেখানে ছিল দৈবের ইচ্ছা, এখন তা সমগ্র সমাজনীতির উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সূচক। সেই উৎকর্ষ বা অপকর্ষ আবার বিচার করতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য জাতির সঙ্গে তুলনার মধ্যে দিয়ে। মৃত্যুঞ্জয়ের সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, তার মধ্যে জম্বদ্বীপ, ইত্যাদি পৌরাণিক কল্পনা এখন বাতিল; এখন ভারতবর্ষের ইতিহাসকে তার জায়গা খুঁজে নিতে হচ্ছে অন্যান্য জাতির ইতিহাসের প্রতিযোগী হিসেবে।
এই যে নতুন এক বিশ্ব ইতিহাস, তা বিভিন্ন জাতির স্বতন্ত্র ইতিহাসের যোগাযোগে উৎপন্ন। এর প্রমাণ তারিণীচরণের কাহিনীর পরের অংশেই পাওয়া যাচ্ছে। ‘আদিম ভারতবর্ষীয়দিগের সভ্যতা ও পাণ্ডিত্য,’ এই অধ্যায়ের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস শেষ। এর পর তারিণীচরণ পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতবর্ষের বাইরে, সপ্তম শতাব্দীর আরবে। প্রশ্ন করতে পারি, দ্বাদশ শতকে ভারতবর্ষে রাজত্বের পরিবর্তনের গল্পই যদি বলতে হয়, তবে সপ্তম শতকের আরবে গিয়ে সে-গল্প শুরু করতে হবে কেন? উত্তরটা অবশ্য আমরা সকলেই জানি, অত্যন্ত সহজ উত্তর সেটা। কিন্তু এই সহজ উত্তরের পেছনে উনিশ শতকের ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার অনেক গঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে।
মহম্মদ স্বীয় শিষ্যদিগের নাম মুসলমান অর্থাৎ ভক্ত এবং তদ্ভিন্ন যাবতীয় মনুষ্যের নাম কফির অর্থাৎ ধর্মভ্রষ্ট রাখিলেন। …স্বীয় শিষ্যগণকে কাফরদিগের বিনাশের জন্য তরবারি ধারণের আজ্ঞা দিয়া [মেহম্মদ] কহিলেন, পরমেশ্বর সম্প্রতি আদেশ করিয়াছেন ভ্রান্তির উচ্ছেদ জন্য যে সকল মুসলমান সমরশায়ী হইবেন, তাঁহারা বিবিধ বিলাসবস্তু-সমন্বিত স্বর্গধামে যাইয়া, কজ্জলনয়না অপ্সরাগণের সহবাসে, পরমসুখে কালহরণ করিবেন; কিন্তু রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিলে, পরকালে নরকে পতিত ও দুঃসহ দুঃখ-দাবদাহে অজস্র দগ্ধীভূত হইতে থাকিবেন। আরব জাতি স্বভাবতই নির্ভীক ও সমরপ্রিয়; তাহাতে ইহলোকে শত্রুর ধন-লুণ্ঠন ও পরলোকে প্রাগুক্তরূপ সুখভোগের প্রত্যাশা পাওয়াতে মুসলমানদিগের খড়ঙ্গ সৰ্ব্বত্রই অনিবার্য হইয়া উঠিতে লাগিল, সমস্ত আরব মহম্মদের অধীন হইল এবং তাঁহার মৃত্যুর অল্পকাল পরেই কাবুল হইতে স্পেন পর্যন্ত তাবৎ দেশে মুসলমান পতাকা উড্ডীন হইয়া উঠিল। যেরূপ স্বল্পকালের মধ্যে এক রাজ্যের পরেই অন্য রাজ্য, এক দেশের পরেই অন্য দেশ, মুসলমানদিগের পদানত হইয়াছিল, পুরাবৃত্তে সেরূপ আর কখনই দেখা যায় নাই। ঈদৃশ দিগ্বিজয়োন্মত্তেরা যে নতুন সম্পদের আকর ভারতবর্ষ লাভে লোলুপ হয় নাই ইহা কখনই সম্ভব নহে। (পৃ. ৩৬-৭)
গল্পের শুরুতেই যতগুলো কথা বলে নেওয়া হল, তাতেই পাঠককে পরের ঘটনার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হচ্ছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারায় এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতির ইতিহাস এসে মিশবে। সেই ভিন্ন ইতিহাসের উৎপত্তি মুহম্মদের সময়। অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় দিল্লিতে যে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং পরের সাড়ে তিনশো বছরে যে-রাজত্বে একাধিক পরিবর্তন হবে, তার পরিচয় শুধু তুর্কো-আফগান বা মুঘল রাজত্ব নয়, সামগ্রিকভাবে তা ইসলামের ইতিহাসের অংশ। এই ইতিহাসের যারা নায়ক, তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বলে দেওয়া হচ্ছে এখানে। তারা সমরপ্রিয় এবং বিশ্বাস করে যে বিধর্মীদের বিনাশ করা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। ধনলুণ্ঠন আর স্বর্গে অপ্সরাদের সঙ্গে সহবাসের লোভে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করতেও প্রস্তুত। তারা দিগ্বীজয়ী নয়, ‘দিগ্বিজয়োন্মত্ত’। ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যের আকর্ষণে তারা স্বভাবতই লোলুপ।
উনিশ শতকের ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাই জানবেন যে একদিকে যেমন উইলিয়াম জোনস প্রভৃতি প্রাচ্যবিদ্যাবিদের গবেষণায় প্রাচীন ভারতের কাব্য-দর্শন নিয়ে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক তেমনি প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে মুসলিম রাজত্বের অপদার্থতা সম্বন্ধেও ইংরেজ লেখকেরা মোটামুটি একমত ছিলেন। এই অপদার্থতার কাহিনী বলা বাহুল্য ব্রিটিশ শাসনের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে উপস্থিত করা হত। জেমস মিল-এর অবশ্য প্রাচীন ভারত এবং মুসলিম শাসন, উভয় পর্ব সম্বন্ধেই সমান অশ্রদ্ধা ছিল। তা ছাড়া সুলতানী এবং মুঘল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রতত্ন আদতে ইসলামী, সুতরাং তার গুণাগুণ ইসলামের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য, এ-ধারণাও ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই চালু করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয় এডওয়ার্ড গিবনের সময় থেকে সুপ্রচলিত ইসলাম সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের যাবতীয় প্রেজুডিস।১৪ আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় এ-দেশেও যখন জাতীয় ইতিহাস লেখা শুরু হল, তখন একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতকে কল্পনা করে নেওয়া হল সমস্ত আধুনিকতার ক্লাসিকাল সূত্র হিসেবে, তেমনি মুসলিম শাসনকে ঠেলে দেওয়া হল মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। এবং আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপের ইসলাম সম্বন্ধে সবরকম কুসংস্কার আরোপ করা হল ‘মুসলিম জাতীয় চরিত্র’ নামক একটি কাল্পনিক ধারণার ওপর। দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তী অধ্যায়ের ভারতের ইতিহাসে এই চরিত্রটিকে এবার সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে। এই মুসলমানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, সে ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু, যুদ্ধপ্রিয়, দুর্নীতিপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর।
আরবে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা থেকে যে নতুন কাহিনী শুরু হল, তারিণীচরণ তাকে ভারতবর্ষের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় তথাকথিত দাস রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে আরবদের সিন্ধ আক্রমণ, মাহমুদ গজনভির দফায় দফায় পঞ্জাব, সিঁন্ধ, গুজরাট আক্রমণ—এই সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তারিণীচরণ। প্রতিটি কাহিনীর মোটামুটি একই ছক। মুহম্মদ ইব্ন-কাসিমের সিন্ধ আক্রমণ, মাহমুদ গজনভির পঞ্জাব আক্রমণ এবং মুহম্মদ ঘুরির যুদ্ধ জয়—এই তিনটি দৃষ্টান্ত দিলে ছকটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মুহম্মদ কাসিম ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ‘সিন্ধুরাজা ডাহিরের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধে নামলেন।
দৈব তাঁহার অনুকূল হইল। তাঁহার সেনাদিগের নিক্ষিপ্ত একটা জ্বলৎ গোলক আসিয়া রাজার হস্তীকে আহত করাতে হস্তী একান্ত ভীত হইয়া রণস্থল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। রাজসেনারা, রাজা পলায়ন করিলেন ভাবিয়া, চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। পরে দৃষ্ট হইবে যে, এইরূপ দুর্দ্দৈব হেতু ভারতবর্ষীয়েরা জয়লাভের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা সত্ত্বেও, অনেকবার মুসলমানদিগের নিকট পরাভূত হইয়াছেন। (পৃ. ৩৮)
বলে রাখা দরকার, এই ‘দৈব’ কিন্তু মৃতুঞ্জয়ের দৈব নয়। দুর্দৈব এখানে নিছকই দুর্ঘটনা, অধর্মাচরণের প্রতিফলস্বরূপ দৈবরোষ নয়। ‘ভারতবর্ষীয়দের’ দুর্ভাগ্য যে জয়লাভের সম্পূর্ণ যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র দুর্ঘটনার জন্য তারা বারে বারে যুদ্ধে পরাজিত হয়।
অবশেষে, প্রচুর সাহসিকতা প্রকাশ করিয়া [সিন্ধুরাজা] শক্তহস্তে নিধন প্রাপ্ত হইলেন। পরে রাজধানী আক্রান্ত হইল; কিন্তু ডাহিরের পত্নী স্বামীর অনুরূপ সাহস অবলম্বন করিয়া নগর-রক্ষার চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে আহারসামগ্রীর অপ্রতুল হইয়া উঠিল। তখন শক্তহস্তে পতনের অপেক্ষা মরণ শ্রেয়ঃ জ্ঞান করিয়া তিনি নগরবাসীদিগকে তাহার আয়োজন করিতে কহিলেন। সকলে সম্মত হইল; সর্ব্বত্র চিতা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। তদনন্তর পুরুষেরা স্নানাদি সমাপন করিয়া, অসিহস্তে বহির্গত হইয়া, অনতিদীর্ঘকাল-মধ্যেই মুসলমানদিগের কর্তৃক নিহত হইল। (পৃ. ৩৮)
যুদ্ধে পরাজয়ের এই গল্পটি পরে আবার পাব। তার দুটি উপাদান বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। এক, শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে হিন্দু রমণীর সাহস। আর দুই, যুদ্ধে প্রাণত্যাগ হিন্দু পুরুষের কাছে একটি যজ্ঞ—আত্মাহুতির অনুষ্ঠান: ‘সর্বত্র চিতা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল’, ‘স্নানাদি সমাপন করিয়া…নিহত হইল’। এর সঙ্গে তুলনীয়, ‘কজ্জলনয়না অপ্সরাগণের সহবাসে’ প্রলুব্ধ মুসলমান সৈন্যের যুদ্ধলিপ্সা।
কাসিম প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প বলছেন তারিণীচরণ, সেটিও এই ছকেরই অংশ।
সিন্ধুদেশের জয়াবসানে কাসিম ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশের উদ্যোগ পাইতেছিলেন, এমন সময়ে, এক স্ত্রীর চাতুৰ্য্যজাল তাঁহার কাল হইয়া উঠিল। সমরশেষে সিন্ধুদেশে যে সমস্ত স্ত্রী বন্দী হয়, তন্মধ্যে রাজা ডাহিরের দুই দুহিতা ছিল। উহারা যেমন উচ্চকুলজাতা তেমনি অসাধারণ রূপলাবণ্যসম্পন্না ছিল। কাসিম ইহাদিগকে খলিফার উপযুক্ত উপঢৌকন জ্ঞান করিয়া তৎসন্নিধানে প্রেরণ করিলেন। মুসলমানপতি জ্যেষ্ঠার রূপে মোহিত হইয়া তাহার প্রতি সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। অমনি সে বিগলিত অশ্রুধারা বর্ষণ করিয়া কহিল, হায়! আমি এক্ষণে ভবৎসদৃশ জনের অনুরাগের যোগ্য নহি, কাসিম পূর্ব্বেই আমার ধর্ম নষ্ট করিয়াছে। খলিফা ভৃত্যের ঈদৃশ ব্যবহার শ্রবণমাত্র, ক্রোধান্ধ হইয়া আজ্ঞা করিলেন, কাসিমকে চৰ্ম্মে বদ্ধ করিয়া আমার সন্নিধানে আনয়ন কর। আজ্ঞা সম্পন্ন হইলে, খলিফা রাজকুমারীকে কাসিমের শব প্রদর্শন করাইলেন। তখন সে হর্ষোৎফুল্ল নয়নে কহিল, কাসিম সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী; জনকজনকীর মৃত্যু ও তাঁহাদের প্রজাবর্গের অবমাননার প্রতিশোধ দিবার জন্যই আমি তাহার এরূপ মিথ্যাপবাদ করিয়াছিলাম। (পৃ. ৩৯)
হিন্দুনারীর সাহসিকতার সঙ্গে আরও একটি বৈশিষ্ট্য যোগ হল—উপস্থিত বুদ্ধি। আর যুদ্ধে আত্মাহুতির পাশাপাশি আরও একটি কাহিনীরও সৃষ্টি হল— আত্মীয়-স্বজন-স্বজাতির মৃত্যুর শোধ নেওয়ার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা।
একাদশ শতাব্দীর গোড়ায় মাহমুদ গজনভির সময়ে চলে আসা যাক। ‘মুসলমানদিগের মধ্যে ইহারই দৌরাত্মে সর্ব্বপ্রথম ভারতবর্ষ বিপৰ্য্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠে, এবং ইঁহারই পর হইতে হিন্দুদিগের স্বাধীনতা, কৃষ্ণপ্রতিপচ্চন্দ্ৰমার ন্যায়, ক্রমশই ক্ষয়গ্রস্ত ও বিলুপ্ত হইয়া আইসে।’ (পৃ. ৪১) মাহমুদের কয়েকটি গুণ তারিণীচরণ স্বীকার করছেন, যেমন সাহস, বিচক্ষণতা, যুদ্ধকুশলতা এবং অধ্যবসায়। অবশ্য মাহমুদ যে জ্ঞান-বিজ্ঞান-কাব্য-শিল্পচর্চার একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, সে-কথা বলছেন না।
কিন্তু তিনি যেমন ঐ সকল গুণান্বিত ছিলেন তেমনি, অন্ততঃ লোকতঃ মুসলমান-ধর্ম্মে একান্ত ভক্ত, দেবদেবীর অর্চনার দারুণ বিদ্বেষী, এবং যৎপরোনাস্তি অর্থপিশাচ ও গৌরবাকাঙ্ক্ষীও ছিলেন। ভারতবর্ষ তাঁহার তাবৎ আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের প্রকৃত ক্ষেত্র ছিল। (পৃ. ৪২)
তথাকথিত ‘মুসলমান চরিত্রের’ এ আর-একটি বৈশিষ্ট্য। ইসলামের প্রতি অনুরাগ যেখানে যুদ্ধের কারণ, সেখানেও তা প্রকৃত ভক্তি নয়, লোকদেখানো ধার্মিকতা।
মাহমুদ শাহিয়া বংশের রাজা আনন্দপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন (তারিণীচরণ লিখছেন অনঙ্গপাল)।
‘মুসলমানেরা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ধ্বংস ও হিন্দুধর্মের বিলোপ সঙ্কল্প করিয়াছে এবং লাহোর গ্রহণ করিতে পারিলেই অমনি অন্যান্য ভাগ আক্রমণ করিবে, সুতরাং সকলে একযোগ হইয়া ম্লেচ্ছদিগের দমন করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে’ এই বলিয়া [অনঙ্গপাল] সুমুদয় প্রধান প্রধান হিন্দু রাজার নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাঁহার আবেদনও নিষ্ফল হয় নাই। দিল্লী, কনোজ, উজীন, গোয়ালিয়ার, কালিঞ্জর প্রভৃতির রাজারা অনঙ্গপালের সহিত একযোগ হইলেন: রাশি রাশি সেনা আসিয়া পাঞ্জাবে উপস্থিত হইল। মামুদ তাদৃশ আকস্মিক বলোপচয়ে ভীত হইয়া আত্মরক্ষার উদ্দেশেই পেশোয়ারের সন্নিধানে অবস্থিত রহিলেন। দিন দিন হিন্দুসৈন্য বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। দূরদেশ হইতেও হিন্দু মহিলাগণ, হীরকাদি বিক্রয় ও স্বর্ণালঙ্কার দ্রবীভূত করিয়া, যুদ্ধের সংস্থান পাঠাইতে লাগিলেন…। (পৃ. ৪৩-৪)
মাহমুদ লাহোর দখল করলে ‘সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা’ ধ্বংস হবে, এই ইতিহাস-জ্ঞান বলা বাহুল্য রাজা আনন্দপালের থাকা সম্ভব ছিল না। এ তারিণীচরণেরই কথা। কিন্তু কথাগুলিকে তাঁর সৃষ্ট ‘অনঙ্গপাল’ চরিত্রটির মুখে বসিয়ে দিয়ে তিনি কিন্তু এই কাহিনীটিকে সমগ্র হিন্দু জাতির যুদ্ধে পরিণত করে ফেলতে পারছেন: ‘রাজারা একযোগ হইলেন’, ‘রাশি রাশি সেনা আসিয়া পাঞ্জাবে উপস্থিত হইল’, ‘দূরদেশ হইতে হিন্দু মহিলাগণ যুদ্ধের সংস্থান পাঠাইলেন’ ইত্যাদি। কিন্তু তার পরেই এল দুর্দৈব। ‘অতঃপর মুসলমান-শিবির হইতে একটা জ্বলৎ-বন্দুক অথবা তীক্ষ্ণশর আসিয়া হিন্দু-সেনানায়ক অনঙ্গপালের হস্তীর অঙ্গে বিদ্ধ হইল। মাতঙ্গ রণক্ষেত্র হইতে রাজাকে পৃষ্ঠে করিয়া পলায়ন করিল। অমনি হিন্দুসৈন্য ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।’ (পৃ. ৪৪) এ-গল্পের শেষেও আছে প্রতিহিংসার ঘটনা, তবে এবারে একটু অন্য ধরনের।
মামুদের সহিত মৈত্রীনিবন্ধন কনোজরাজ হিন্দুভূপাল সমাজে ঘৃণা ও নিগ্রহের ভাজন হইয়াছিলেন; তচ্ছ্রবণে গজনিপতি শরণাগতের প্রতিপালন সঙ্কল্পে দশম বার ভারতবর্ষে উপস্থিত হন। কিন্তু তিনি পহুঁছিবার পূর্বেই কালিঞ্জরধিপতি কনোজ-রাজের প্রাণসংহার সম্পন্ন করেন। (পৃ. ৪৬)
বলা বাহুল্য, এটিও একটি অনুষ্ঠান, সুতরাং ‘প্রাণসংহার করেন’ নয়, ‘প্রাণসংহার সম্পন্ন করেন’।
মুহম্মদ ঘুরির সেনারা ছিলেন
পৰ্বতবাসী, কষ্টসহ ও সমরচতুর; এ দিকে হিন্দু রাজারা পরস্পর অনৈক্যদৃষিত, তাঁহাদের সৈন্যকুল অপেক্ষাকৃত শান্ত ও বিশৃঙ্খলা; সুতরাং মহম্মদ অনায়াসেই জয়লাভ করিবেন আপাতত এরূপ বোধই হইতে পারে, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা হয় নাই। প্রায় কোন হিন্দু রাজাই ঘোর সংগ্রাম বিনা স্বাধীনতা বিসর্জ্জন করেন নাই। বিশেষ রজঃপূতেরা কখনই পরাভূত হয় নাই। মুসলমান রাজত্বের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ সম্পন্ন হইয়াছে, রজঃপূতের অদ্যাপিও স্বাধীন রহিয়াছে। (পৃ. ৫৩)
হিন্দু রাজারা শুধু যে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন নি, তাই নয়, মুহম্মদের প্রথম আক্রমণের পর ‘হিন্দুরা বিংশতি ক্রোশ পর্যন্ত মুসলমানদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাড়াইয়া গিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।’ (পৃ. ৫৪) দ্বিতীয় বার জয়চাঁদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুহম্মদের কপটাচারের ফলে পৃথ্বীরাজের পরাজয় ঘটে। মৃত্যুঞ্জয়ের কাহিনীর সঙ্গে তারিণীচরণের এই বিবরণের কোনওই মিল নেই। শেষে প্রতিহিংসার গল্পও আছে। ‘গোক্ষুর’ নামে এক পার্বত্য জাতি মুহম্মদের হাতে পরাস্ত হয়েছিল। তাদের কয়েকজন সুযোগ পেয়ে রাত্রে মুহম্মদের তাঁবুতে প্রবেশ করে নিদ্রিত সুলতানকে হত্যা করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে।
এর পর ভারতে সুলতানদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধর্মান্ধ শাসকদের হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী একাধিকবার আসবে। যেমন সিকন্দর লোদি।
সেকেন্দর তীর্থ-পর্য্যটন ও পৰ্ব্বাহ্নে গঙ্গা প্রভৃতি পবিত্র সরিতে স্নান নিষেধ এবং নানাস্থানের দেবালয় চূর্ণ করিলেন। একদা কোন ব্রাহ্মণ ঘোষণা করেন ‘কায়মনোবাক্যে অনুষ্ঠান করিলে সকলপ্রকার ধর্ম্মই পরমেশ্বরের সমান গ্রাহ্য’। সেকেন্দর তাঁহাকে ধরিয়া আনিলেন, এবং তিনি আপনার অনন্যবিদ্বেষী মত পরিত্যাগে অস্বীকৃত হইলে, নিষ্ঠুর নৃপতি তাঁহার প্রাণসংহার করিলেন। কোন ইষ্টনিষ্ট মুসলমান তীর্থযাত্রা প্রতিষেধ অন্যায় বলাতে ‘পাষণ্ড! পৌত্তলিকদিগের পোষকতা করিতেছিস’ বলিয়া রাজা কর্তৃক ভর্ৎসিত হইলে, তিনি উত্তর করিলেন, “না, আমি তাহা করিতেছি না, আমি বলিতেছি রাজাদিগের প্রাজাপীড়ন অতিশয় অন্যায়’। তচ্ছ্রবণে সেকেন্দর ক্ষান্ত হইলেন। (পৃ. ৮৩)
অওরঙজেবের প্রতি তারিণীচরণের লেখনীর খোঁচা বলা বাহুল্য সব চেয়ে তীক্ষ্ণ। ‘আরাঞ্জিব প্রতারক, পরস্বাপহারক ও মনুষ্যঘাতক ছিলেন।’ (পৃ. ২২০) ‘মুসলমান ধৰ্ম্মে আস্থাপ্রকাশ তাঁহার স্বার্থসাধনের পক্ষে উপকারীই হইয়াছিল।…বস্তুতঃ আরাঞ্জিব ধৰ্ম্ম বা সন্নীতি কিছুরই অনুরোধে আপন স্বার্থ পরিত্যাগ করিতেন না।’ (পৃ. ১৭৩)
অপর পক্ষে আকবর সম্বন্ধে তারিণীচরণ প্রশংসার কথাই বলেছেন, তবে প্রশংসার কারণটি তাৎপর্যপূর্ণ।
আকবর মুসলমান ধৰ্ম্ম-নির্দ্দিষ্ট কতিপয় অযৌক্তিক কর্ম্ম-কলাপের বিলোপ সাধনের চেষ্টা পাইয়াছিলেন। হিন্দুদিগের পক্ষেও তিনি অনেক অযৌক্তিক পদ্ধতি রহিত করিবার প্রয়াস পান। তিনি অগ্নি-পরীক্ষা, বিধবাদিগের অমতে তাহাদিগকে স্বামীর চিতায় আরোপণ এবং বাল্য বিবাহ নিষেধ করেন। বিধবাদিগের পুনৰ্ব্বার বিবাহ করিতেও অনুমতি দেন।…ধর্ম্ম বিষয়ে আকবরের প্রাগুক্তরূপ উদার মত দেখিয়া গোঁড়া মুসলমানেরা তাঁহার অত্যন্ত বিদ্বেষী হইয়াছিল। অনেকেই তাঁহাকে নাস্তিক বলিত। (পৃ. ১৪১)
ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষতা নয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মেরই অযৌক্তিক আচারের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন বলে আকবর প্রশংসনীয়।
মুসলমান রাজার ছলনার সাহায্যে যুদ্ধজয়ের কাহিনীও আরও আছে। যেমন শের শাহ-র রাইসিন দুর্গদখল। দুর্গে অবরুদ্ধ ‘হিন্দু রাজা’-র সঙ্গে আক্রমণকারীদের চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু
মুসলমানেরা পূৰ্ব্বকৃত নিয়ম অসিদ্ধ, এই ভান করিয়া, তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। তাহারা অতিশয় সাহসের সহিত আত্মরক্ষা করিতে লাগিল, কিন্তু অবশেষে পরাস্ত ও মুসলমানদিগের নিষ্ঠুর হস্তে নিহত হইল। ….সেরের এই বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্রূরতার বিশেষ উদ্দেশ্য কি ছিল জানা যায় না। যাহা হউক, পরিণামে তাঁহাকে এই ঘোর অপরাধের জন্য বিলক্ষণ শাস্তি ভোগ করিতে হইয়াছিল। (পৃ. ১০৪)
মুসলমান শাসকদের সঙ্গে কোনো কোনো হিন্দু রাজার মৈত্রীর বিষয়টিও আবার এসেছে। যেমন মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের বৈবাহিক সম্পর্ক।
যে সকল রজঃপূত রাজারা এইরূপ বিবাহদানে সম্মত হইতেন, তাঁহারা সম্রাটের বিলক্ষণ অনুরাগভাজন ও অনুগৃহীত হইয়া উঠিতেন। তন্নিবন্ধন তাদৃশ বিবাহ জাতিভ্রংশক ও অবমানকর জ্ঞান করা দূরে থাকুক, উদয়পুরের অধিপতি ভিন্ন, সমুদয় রজঃপূত রাজারাই তদ্দ্বারা আপনাদিগকে কৃতার্থ ও সম্মানিত বোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু উদয়পুরপতি সেই সমুদয় যবনান্ত রাজাদিগের সহিত আদান-প্রদান পর্য্যন্তও পরিত্যাগ করিলেন। সেই হেতু অধুনা উদয়পুরের রাজবংশ জাত্যাংশে রজঃপূতদিগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পবিত্র বলিয়া সম্মানিত হইয়া থাকে। তাঁহার সহিত আদান প্রদানে অন্যান্য রাজারা অতিশয় শ্লাঘা জ্ঞান করেন। (পৃ. ১২৫-৬)
৮
আগেই বলেছি, তারিণীচরণের ইতিহাস বই-এর শুধু যে প্রতি বছর নতুন সংস্করণ বেরোত তাই নয়, অন্য অনেক পাঠ্যবই-ই তারিণীচরণকে মডেল ধরে নিয়ে লেখা হত।১৫ এরকম বেশ কয়টি বই-এর মধ্যে একটি হল ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর, ‘বরিশাল জিলার অন্তর্গত গোপালপুরে নিবাসী শ্রীছৈয়দ আবদুল রহিম দ্বারা সংগৃহীত।’১৬ অধিকাংশটাই তারিণীচরণ অবলম্বনে লেখা। কিন্তু অল্প কয়টি জায়গায় পরিবর্তন আছে: সেগুলি লক্ষ্য করার মতো।
প্রথমেই আর্যদের কথা। আবদুল রহিম কথাটা অন্যভাবে লিখছেন। ‘হিন্দুর ভারতবর্ষের আদি নিবাসী নহেন, ইহারা সিন্ধু নদের পশ্চিম তীর হইতে আসিয়া, বাহুবলে ভারতবর্ষের অধিবাসী হইয়াছেন।’ (প. ২) তারিণীচরণ লিখেছিলেন, ‘অনার্যেরা আর্যসম্প্রদায়ে গৃহীত হয়’, ‘আর্যের উপনিবেশ স্থাপন করে’, ‘হিন্দুপতাকা উড্ডীন করে’ ইত্যাদি। আবদুল রহিম লিখছেন, ‘বাহুবলে ভারতবর্ষের অধিবাসী হইয়াছেন’।
এর পর ইতিহাসের ঘটনার বর্ণনায় কিন্তু মোটামুটি তারিণীচরণকেই অনুসরণ করছেন তিনি। যেমন, মহম্মদ গজনবী ও মহম্মদ গোরী এতদুভয়ের মধ্যে মহম্মদ গোরীই হিন্দুদিগের প্রধান অপকারী, কারণ মহম্মদ গজনবী কেবল ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়া লুঠপাঠ পূৰ্ব্বক ডাকাইতি করিতেন, আর মহম্মদ গোরী হিন্দুদিগের পরম স্বাধীনতা-রত্ন হরণ করেন।’ (পৃ. ১৬)
অথবা, ‘মহাত্মা আকবর জিজিয়া কর উঠাইয়া দিয়াছিলেন, দুরাত্মা আরঞ্জিব তাহা পুনঃ সংস্থাপিত করিলেন।’ (পৃ. ৭৮) এমন-কি, ‘মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ আরঞ্জিবের গোঁড়ামি ও দৌরাত্ম’, এই বিষয়ে তারিণীচরণের প্রতিধ্বনি করে একটি প্রশ্নের উত্তরও আছে।
পরিবর্তন আবার আসছে একেবারে শেষ প্রশ্নে এসে। প্রশ্নটা এই: ‘শিক্ষক। তুমি মুসলমান রাজত্বের বিবরণ পাঠ করিয়া কি উপদেশ পাইলে?’ এর উত্তরে সৈয়দ আবদুল রহিম লিখছেন :
ছাত্র। আৰ্য! আমি মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত পাঠ করিয়া নিশ্চয় জানিয়াছি। রাজত্ব ইহকাল ও পরকালের ভয়ানকাম্পদ। ইহাতে ঈশ্বর দত্ত ক্ষমা ও দয়াবৃত্তি এককালীন বিসর্জন দিতে হয়। হায়! কি আক্ষেপের বিষয়, যাহার সঙ্গে একত্র আহার বিহার ও শয়ন উপবেশন করিয়া বহুদিন অতিক্রম করা হইয়াছে। …ভয়ঙ্কর রাজত্বের নিমিত্ত এমন স্নেহাস্পদ সহোদরের শোণিত পাত পূৰ্ব্বক অম্লানবদনে মেদিনীকে রঞ্জিত করিতেছে। রাজত্ব তুমি মনুজ নিকরের মনকে কিরূপ পাষাণময় কর, তাহা আমি মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস পাঠ করিয়া সুন্দররূপ বুঝিয়াছি। তোমার জন্য পিতা মাতা ভ্রাতা ভগ্নীর ও অন্য অন্য মানব কুলের শিরোচ্ছেদ এমন কি, স্থায়ীধন ধর্মও তুচ্ছ বলিয়া গণিত হয়। হায় রাজত্ব! ধন্য তোমার প্রলোভন শক্তি। (পৃ. ১০০-১)
তারিণীচরণের কাছে পাঠ নেওয়া সত্ত্বেও আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার সারমর্ম এই ছাত্রটির মনে মোটেই প্রবেশ করে নি। সৈয়দ আবদুল রহিমের নিজস্ব বয়ানে আমরা। সেই মৃত্যুঞ্জয়ের প্রজার কথাই এখনও শুনতে পাচ্ছি।
এখনও পাচ্ছি, কিন্তু বেশিদিন আর পাব না। ভারতীয় সমাজসংস্কৃতির ক্লাসিকাল সূত্রগুলির মধ্যে যদি ইসলামের কোনও জায়গা না থাকে, তা হলে বিকল্প ঐতিহ্য হিসেবেই ইসলামকে ভাবা হবে। ১৮৮৬ সালে শেখ আবদুর রহিম হজরত মহম্মদের জীবনী১৭ লিখতে গিয়ে ঠিক তারিণীচরণেরই মতো ইংরেজ পণ্ডিতদের উদ্ধত করে দাবি করছেন:
ইসলাম ঈসায়ী ধৰ্ম্ম অপেক্ষা মানবজাতির বিশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছে। দর্শন ও বিজ্ঞান শাস্ত্র প্রভৃতি এসিয়া মহাদেশের মোসলমান ও স্পেনদেশীয় মুরগণ কর্ওৃক ইউরোপ মহাদেশে আনীত হইয়াছিল।…স্পেনদেশীয় মোসলমানগণ ইউরোপের দর্শন শাস্ত্রের জন্মদাতা। (পৃ. ১৭৩)
কিন্তু তার পরই ইসলাম সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদ:
ইতিপূৰ্ব্বে বঙ্গভাষায় হজরত মহম্মদের যে কয়খানি জীবনী বাহির হইয়াছে, তাহা প্রায় সমস্তই অসম্পূর্ণ বিশেষতঃ ঐ সকল পুস্তক ইংরাজী গ্রন্থাবলম্বনে লিখিত বলিয়া কোন কোন বিষয় মোসলমানদিগের উপযোগী হয় নাই। হজরতমহম্মদ তরবারি বলে স্বীয় ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছেন বলিয়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণ তাঁহার নামে যে বৃথা দোষারোপ করিয়া থাকেন, এই পুস্তক পাঠ করিলে তাহা কতদূর সত্য, সকলেই সহজে বুঝিতে পারিবেন। (ভূমিকা)
এর পর আরও সরাসরি ভারতে মুসলিম শাসন সম্বন্ধে প্রচলিত মতের—বলা উচিত হিন্দু লেখকদের দ্বারা প্রচলিত মতের—খণ্ডন করা হচ্ছে :
যদিও কোন কোন মোসলমান শাসনকর্তা ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে লোকের ওপর অত্যাচার করিয়াছেন, কিন্তু তাহা ধৰ্ম্মবিগর্হিত কার্য্য, তথাপিও তাহা দেখিয়া যে, ইসলামের উপর উক্তরূপ দোষারোপ করা উচিত নহে। (পৃ. ১৭৮)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এই আবদুর রহিম সম্পাদিত মিহির ও সুধাকর পত্রিকাতে প্রায় বঙ্কিমের সুরেই ‘বঙ্গীয় মুসলমানদিগের উপযোগী জাতীয় ইতিহাস’ লেখার আহ্বান জানানো হবে।১৮ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে শতাব্দীর শেষ বছরগুলিতে আবদুল করিম লিখবেন ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস (১৮৯৮) কিংবা ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখবেন ইতিহাসাশিত কাব্য অনল প্রবাহ(১৮৯৯)।১৯ এঁদের চেতনা বাংলার আধুনিক ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চেতনা। প্রজাবর্গের নেতা, এইক্ষেত্রে বাংলার মুসলমান প্রজার নেতা হিসেবে তাঁদের অবস্থান সম্বন্ধে তাঁরা সম্পূর্ণ সচেতন। ‘হায় রাজত্ব! ধন্য তোমার প্রলোভন শক্তি!’ বলে আর তাঁরা বই শেষ করবেন না।
৯
একদিকে আধুনিক ইতিহাসবিদ্যা, রাষ্ট্র আর জাতির সমীকরণ, জাতীয় একাত্মবোধ এবং জাতির স্বাধীনতারক্ষায় বাহুবলের ভূমিকা, আর অন্য দিকে জাতীয় ইতিহাস বলতে কেবল হিন্দুর স্মৃতি, হিন্দুর ঐক্য, হিন্দুর বাহুবল—বিশেষ করে বঙ্কিমের রচনায় এই দু-টি ধারণার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ বলেছেন, এখানে একটা স্ববিরোধ আছে। বঙ্কিম আহ্বান জানাচ্ছেন বটে যে নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হবে, এবং এ-ও দাবি করছেন যে সে ইতিহাস হবে বাহুবলের ইতিহাস, কারণ বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত পরতন্ত্র একমাত্র বাহুবলের সাহায্যেই ধ্বংস করা যায়, কিন্তু এই বাহুবলের ইতিহাস বঙ্কিম খুঁজেছেন প্রাক-ব্রিটিশ যুগে। উপনিবেশের পর্বে পরাধীন জাতির ঐতিহাসিক মুক্তি যে আধুনিক চেতনা, তার শর্তগুলো উপস্থিত করেও বঙ্কিম কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাহুবল প্রয়োগের কথা বলছেন না। তিনি শোনাচ্ছেন কেবল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতির বাহুবলের কাহিনী। এর ফলে বঙ্কিম তাঁর নিজের প্রস্তাবটি নিজেই ভেস্তে দিচ্ছেন।
বঙ্কিমকে যদি তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস-রচয়িতাদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেখি, তাহলে প্রথমেই দেখতে পাব যে সে-সময়কার নগণ্য পাঠ্যপুস্তক লেখকদের মধ্যে অনেক কম পরিশীলিত হলেও মোটামুটি একই ধরনের ইতিহাসবোধ প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয়ত, এই নতুন ইতিহাস-রচনার সব চেয়ে প্রভাবশালী ধারাটির মধ্যেও ঠিক একই স্ববিরোধ উপস্থিত। তৃতীয়ত, এই স্ববিরোধের কারণ বোঝাতে গিয়ে বঙ্কিমের ক্ষেত্রে যদিও বা বলি—রণজিৎ গুহ যেমন বলেছেন-যে চেতনার অন্তরালে স্বাধীনতার আসল লড়াই ব্রিটিশের বিরুদ্ধেই ছিল কিন্তু প্রস্তাবটা তখনও প্রকাশ্যে হাজির করা যায়নি, অন্য লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু সে-কথাটা বলতে পারব না। কারণ ইতিহাস লেখার স্বাধীনতা আর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, এই দুই সংগ্রামই যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, একথা ১৮৮০-র দশকে একাধিক বাঙালি লেখক বেশ সরাসরিই বলেছেন। সমস্যা হল, ব্রিটিশ শাসন এবং মুসলিম শাসন, দুটোকেই তাঁরা বলেছেন পরতন্ত্র। উভয় ক্ষেত্রেই জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায় বাহুবল। কোনও স্ববিরোধ নেই এখানে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নতুন বাংলা সাহিত্য এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় ইতিহাসের এই ছকটির যে কী-একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তা আবিষ্কার করলে একটু চমকেই যেতে হয়। আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ইতিহাস-রচনা চালু হওয়ার পর থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত এর প্রায় কোনও ব্যতিক্রম নেই। জাতীয়তাবোধের ইতিহাসের এই দিকটা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি আছে বলেই বোধ হয় কথাটা ভুলে যাওয়ার একটা ঝোঁক আছে আমাদের মধ্যে। তাতে কিন্তু উগ্রহিন্দু প্রচারের সব চেয়ে জোরাল উপাদানটিকেই হিসেবের বাইরে রেখে দেওয়া হয়।
বস্তুত জাতীয়তার অর্থ হিন্দু জাতীয়তা, এই ধারণাটিকে কোনও প্রাক-আধুনিক ধর্মীয় মতাদর্শের ভগ্নাবশেষ বলে ভাবলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ধারণাটি সম্পূর্ণ আধুনিক। আধুনিক অর্থেই তা যুক্তিবাদী; অযৌক্তিক আচার-ব্যবহার কুসংস্কার বিরোধী। আধুনিক অর্থেই তা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক; রাষ্ট্রের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কট্টরপন্থী এবং সমাজনীতি নির্ণয় ও সংস্কারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী। এই মতবাদের মুল আবেদন ধর্মীয় নয়, রাষ্ট্রীয়। সেই অর্থে এর যুক্তির কাঠামো সম্পূর্ণ সেকুলার। একটু ভাবলেই দেখা যাবে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ইতিহাসবোধ কোনও অর্থেই সেকুলার ছিল না। তুলনায় তারণীচরণ আদ্যোপান্ত সেকুলার।
সত্যি কথা বলতে কি, এই মতবাদে ‘হিন্দুত্ব’ ধারণাটির আদপেই কোনো ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। ‘হিন্দু’ হওয়ার জন্য কোনও বিশেষ ধর্মীয় আচার বা বিশ্বাস বা চিহ্নের প্রয়োজন নেই। হিন্দুদের মধ্যে অজস্র সাম্প্রদায়িক পার্থক্য এই মতবাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এমন-কি বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মের মতো বেদবিরোধী ব্রাহ্মণবিরোধী ধর্মকেও অনায়াসে হিন্দু বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। একই ভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং বর্ণসমাজের বাইরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলিকেও হিন্দুজাতির অংশ বলে দাবি করা চলে; কিন্তু ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম নিশ্চিতভাবে এই জাতীয়তার বাইরে।
অন্তর্ভুক্তি এবং বহিষ্কারের যুক্তিটা তাহলে কী? যুক্তিটা আসলে ঐতিহাসিক উৎপত্তির যুক্তি। বৌদ্ধ বা জৈনধর্ম ‘হিন্দু’, কারণ তা ভারতে উদ্ভূত। ইসলাম বা খ্রিস্টানধর্ম ভারতীয় নয়, বিদেশি। এখানে ‘ভারত’ বলতে সম্পূর্ণ আধুনিক অর্থে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানাবিশিষ্ট সার্বভৌম রাষ্ট্রই বোঝাচ্ছে। আগেই দেখেছি, জাতীয়তাবোধের জন্ম থেকেই আমাদের ইতিহাসকল্পনায় এই সার্বভৌমত্বের ধারণা এসে গেছে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যই এই যে সার্বভৌমত্বের ভৌগৌলিক সীমা আর নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে কোনও দ্বিধা বা অসঙ্গতি সে বরদাস্ত করতে পারে না। হিন্দু জাতীয়তাবাদ গত একশো বছর ধরে এই আধুনিক ঐতিহাসিক যুক্তি ব্যবহার করেই নিজেকে প্রকৃত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলে দাবি করে চলেছে।
তাহলে হিন্দু নয় অথচ ভারতের অধিবাসী, এমন জনগোষ্ঠীর স্থান কোথায়? এর একাধিক উত্তর আছে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রত্ব মেনে নিয়ে যে-উত্তর, তাতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংখ্যাই হল প্রধান নির্ণায়ক। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু, বাকিরা সংখ্যালঘু। উগ্রহিন্দুর বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে সংখ্যালঘুদের কর্তব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব এবং প্রাধান্য মেনে নেওয়া। এই উত্তরটি আধুনিক জাতীয়তাবাদের আদিপর্ব থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। ভূদেব মুখখাপাধ্যায়ের স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৭৬) মনে করুন।২০ পানিপতে আহমদ শাহ আবদালির সঙ্গে মারাঠাদের যুদ্ধ চলেছে। এমন সময় মারাঠা সেনাপতির দূত আহমদ শাহ-র কাছে গিয়ে বললেন যে যদিও মুসলমানেরা চিরকাল হিন্দুদের প্রতি অন্যায় করে এসেছে, তবু হিন্দুরা ক্ষমাশীল।
…আপনি নিজ দলবল সহিত নির্ব্বিঘ্নে স্বদেশ গমন করুন। ভারতবর্ষনিবাসী যদি কোন মুসলমান আপনার সমভিব্যাহারে যাইতে ইচ্ছা করেন, তাহাতেও কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। তবে তাদৃশ মুসলমানের পক্ষে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত এ দেশে প্রত্যাগমন নিষিদ্ধ।
কাল্পনিক ইতিহাস। তাই আহমদ শাহ বললেন,
তুমি মহারাষ্ট্র-সেনাপতিকে গিয়া বল…আর কখনও ভারতবর্ষ আক্রমণে উদ্যম করিব না।
এই কথা শুনিয়া দূত অভিবাদনপূৰ্ব্বক কহিল, মহারাজের আজ্ঞা শিরোধার্য্য। আমার প্রতি আর একটি কথা বলিবার আদেশ আছে। এ দেশীয় যে সকল মুসলমান নবাব, সুবাদার, জমিদার, জায়গীরদার প্রভূতি আপনার সমভিব্যাহারী না হইবেন, তাহারা অবিলম্বে যে যাঁহারা আপনাপন অধিকার এবং আবাসে প্রতিগমন করুন। মহারাষ্ট্রীয় সেনাপতি বলিয়াছেন ‘ঐ সকল লোকের পূর্ব্বকৃত সমস্ত অপরাধ মার্জ্জনা হইল’। (পৃ. ৩৪৪)
এর পর ভারতের সমস্ত প্রান্তের শাসকবৃন্দের সভা বসল। ‘একজন গম্ভীর প্রকৃতির মধ্যবয়স্ক পুরুষ’ বললেন:
‘ভারতভূমি যদিও হিন্দুজাতীয়দিগেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইহার পর নহেন, ইনি উহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইহার পালিত সন্তান।
‘এক মাতারই একটি গর্ভজাত ও অপরটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়—সকলের শাস্ত্র মতেই হয়। অতএব ভারতবর্ষ-নিবাসী হিন্দু এবং মুসলমানদিগের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ জন্মিয়াছে…
‘এক্ষণে সকলকে সম্মিলিত হইয়া মাতৃদেবীর ভার গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু সকলের কৰ্ত্তা একজন না থাকিলেও সম্মিলন হয় না। কোন ব্যক্তি আমাদিগের সকলের অধিনায়ক হইবেন? দৈবানুকুলতায় এ বিষয়েও আর বিচার করিবার স্থল নাই। রাজাধিরাজ রামচন্দ্রের নিমিত্ত এই যে সিংহাসন প্রস্তুত হইয়াছে,…পৃথিবী টলিলেও আর ইহা টলিবে না—আর ঐ দেখ, মহামতি সাহ আলম বাদশাহ স্বেচ্ছাতঃ রাজা রামচন্দ্রকে আপন শিরোভূষণ মুকুট প্রদান করিয়া তাঁহার হস্তে সাম্রাজ্য পালনের ভার সমর্পণ করিবার নিমিত্ত আসিতেছে।’(পৃ. ৩৪৫-৬)
মুঘল বাদশাহ মারাঠা রাজা রামচন্দ্রের হাতে শাসনভার তুলে দিলেন।
নিমেষ মধ্যে সকলের গাত্রোত্থানের আজ্ঞা হইল। উঠিয়া আর কেহই সাহ আলমকে দেখিতে পাইলেন না। দিল্লীর সিংহাসনোপরি শিবাজী বংশ-সস্তৃত রাজা রামচন্দ্র একাকী উপবিষ্ট—তাঁহার শিরোদেশে সাহ আলম প্রদত্ত সেই রাজমুকুট। (পৃ. ৩৪৬-৭)
যাঁরা ভূদেবের এই আশ্চর্য রচনাটি পড়েননি, তাঁদের জানাই যে এর পর একটি ব্যবস্থাপক সভায় ভারতবর্ষের নতুন শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। সম্পূর্ণ আধুনিক শাসনতন্ত্র, নিঃসন্দেহে ভূদেবের সমসাময়িক নবপ্রতিষ্ঠিত জার্মান রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায় রচিত। তাতে এমনই শক্তিশালী এক সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমান তালে পাল্লা দিয়ে ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক শক্তিকে চিরতরে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর হিসেব করে অন্য যে-উত্তরটি আমরা পাই, তাকেই স্বাধীন ভারতে ‘সেকুলার’ বলা হয়ে থাকে। এই মতটির বক্তব্য, সংখ্যাগুরুর উৎপীড়ন থেকে বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রের উচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে রক্ষা করা। সমস্যা হল, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় সম্প্রদায় অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বের কোনও ব্যবস্থা নেই, অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হচ্ছে। ফলে স্বাতন্ত্রের সব চেয়ে প্রকট চিহ্নধারী ব্যক্তি বা সংগঠনই সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত হয়। স্বাধীনতার পর ভারতের মুসলিম সমাজে সংস্কার-আন্দোলন যতটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে, পৃথিবীর কোনও মুসলিম দেশে তা হয়নি।
তৃতীয় একটি উত্তরও অবশ্য আছে। তবে সেটি সমাজ-জীবনে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা স্বীকার করে না। বাংলায় এই মতটির একাধিক প্রবক্তা ছিলেন। স্বদেশী-পরবর্তী যুগে রবীন্দ্রনাথের লেখায় এই মতটির প্রতিফলন সুপরিচিত। রাষ্ট্রনীতির সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর জনজীবনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পরিক আদানপ্রদান ও সৌহার্দ্যের যে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, এই মতের প্রবক্তারা সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁরা বলেন, রাজারাজড়ার যুদ্ধবিগ্রহে নয়, এই লোকাচার-দেশাচারের জগতেই ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবে। এই ইতিহাস, বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের ইতিহাস। ভারতীয় জনজীবনের বিভিন্নতা সবরকম ধর্মবিশ্বাসকেই ধারণ করতে পারে; রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত বিবাদ তাকে স্পর্শ করে না।
এই উত্তরটা নিয়েও অবশ্য মুশকিল আছে। প্রথম অসুবিধা হল, আধুনিক ইতিহাসবোধের সঙ্গে একে কিছুতেই খাপ খাওয়ানো যায় না। এর যুক্তিটা আসলে ইতিহাসের ঊর্ধ্বে অবস্থিত। ইতিহাসে যা-ই পরিবর্তন ঘটে থাকুক না কেন, ভারতের সমাজজীবনের অন্তর্নিহিত সত্য এক এবং অপরিবর্তিত—এই হল এর বক্তব্য। ফলে কোথাও না কোথাও আধুনিক ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতীয় সমাজদর্শনের একটা মৌলিক পার্থক্য এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ন্যাশনালিজম নামে ইংরেজি বক্তৃতায় যেমন সরাসরিই বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ আধুনিক ইউরোপের এক মারাত্মক আবিষ্কার, ওটা আমাদের ঘাড়ে না চাপলেই আমাদের মঙ্গল। দ্বিতীয় অসুবিধা, উৎপত্তির সমস্যাটা এখানেও এড়ানো যাচ্ছে না। লোকাচারের ঢিলেঢালা ঐক্যের কাঠামোয় ইসলামকে সেই ভূদেবের মতো ‘পালিত সন্তান’ হিসেবেই একমাত্র জায়গা দেওয়া যায়। ফলে এই ধরনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ধর্মীয় ‘সমন্বয়’-এর উদাহরণ—ইসলাম যেখানে দেশীয় জল-হাওয়ার প্রভাবে ‘ভারতীয়’ চেহারা ধারণ করেছে। তৃতীয় অসুবিধা, লৌকিক আচার-বিশ্বাসকে যতই খাতির করা হোক না কেন, উচ্চমার্গের সংস্কৃতির সঙ্গে তার মৌলিক বিরোধ মুছে ফেলা যায় না। লোকসমাজের স্বাতন্ত্র্য সত্যি সত্যি স্বীকার করে নিলে আধুনিক সংস্কার-আন্দোলনের যৌক্তিকতাই হারিয়ে যায়। ‘বিভেদের মাঝে ঐক্য’-র এইসব নিদর্শনকে আধুনিক জাতীয় জীবনের মঞ্চে হাজির করতে হলে তাকে রীতিমতো সাবান ঘষে সাফসুতরো করে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাই করেছিলেন। আজকালকার ‘ফেস্টিভাল অফ ইণ্ডিয়া’ বা ‘অপনা উৎসব’ অন্যভাবে তাই করছে। তাতে লোকজীবনের নিজস্বতা বজায় থাকছে কি?
এই তিনটে উত্তরের কোনওটাতেই কিন্তু ইসলামের উত্তরাধিকারে সমগ্র ভারতীয় জাতির কোনো দাবি থাকতে পারে, এ সম্ভাবনাকে স্বীকার করা হয় নি। জাতীয় ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণা অনিবার্যভাবে টেনে নিয়ে গেছে একটিমাত্র সূত্রের দিকে, যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্যের উৎপত্তি এবং যার নাম প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা। ইসলাম এখানে হয় বিদেশী আক্রমণের ইতিহাস, না হলে দেশজ লোকাচারের অন্তর্গত। ইসলামের নিজস্ব ক্লাসিকাল ঐতিহ্যের স্থান ভারতের ইতিহাসের বাইরে।
মজার কথা হল, ইউরোপের ক্লাসিকাল ঐতিহ্যকে কিন্তু আমাদের আধুনিকতা অনায়াসেই আপন করে নিয়েছে। ইউরোপের ঐতিহ্য বিশ্বজনীন, এটাই বোধ হয় যুক্তি। এতে যে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষণটি প্রকাশ পাচ্ছে, সেটা অবশ্য আমরা স্বীকার করি না। ইউরোপ যত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আমাদের পরাধীন করতে পেরেছে, পাঠান-মুঘল সৈন্যেরা তার ধারে কাছেও কোনওদিন পৌঁছতে পারে নি। কিন্তু আমাদের স্বাদেশিকতা ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে আজও অনুকরণীয় মনে করে।
১০
চতুর্থ একটি উত্তরও অবশ্য ছিল। সেটি এতই অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ যে তাকে উত্তর না বলে বলা উচিত উত্তরের সম্ভাবনা। তাতে ভারতের ইতিহাসের অখণ্ডতা সম্বন্ধে একটা সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। উৎপত্তির প্রশ্নটাও সেখানে অনিশ্চিত। এই ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় না বলে বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয়।
বঙ্কিমের লেখাতেই এই আভাস রয়েছে।২১ ‘রাজা ভিন্ন-জাতীয় হইলেই রাজ্যকে পরাধীন বলিতে পারা যায় না। ‘বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলকেই বঙ্কিম প্রকৃত রেনেসাঁসের যুগ মনে করতেন।
পরাধীনতার একটি প্রধান ফল ইতিহাসে এই শুনা যায় যে, পরাধীন জাতির মানসিক স্ফূৰ্ত্তি নিবিয়া যায়। পাঠানশাসনকালে বাঙ্গালীর মানসিক দীপ্তি অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল। …এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালার যেরূপ মুখোজ্জল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্ব্বে বা তৎপরে আর কখনও হয় নাই। (পৃ. ৩৩২)
আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দীপ্তি হইল? …এ আলোক নিবিল কেন? (পৃ. ৩৩৯)
যে আকবর বাদশাহের আমরা শতমুখে প্রশংসা করিয়া থাকি, তিনিই বাঙ্গালার কাল। তিনিই প্রথম প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালাকে পরাধীন করেন। …মোগলই আমাদের শত্রু, পাঠান আমাদের মিত্র।’ (পৃ. ৩৩২)
ভারতের ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাস, দুই ধারায় ঘোর অসংগতি এসে যাচ্ছে এখানে। রাষ্ট্র বা জাতির সার্বভৌম কেন্দ্র কোনটা, তাও আর স্থির থাকছে না। একদিকে দেখা যাচ্ছে, আর্যদের বাংলায় অনুপ্রবেশ অপেক্ষাকৃত দেরিতে। তা হলে আর্যসভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে বাঙালির দাবি কি দুর্বল হয়ে পড়ে?
অনেকেই মনে করিবেন যে, বাঙ্গালার ও বাঙ্গালীর বড় লাঘব হইল। আমরা আধুনিক বলিয়া বাঙ্গালীজাতির অগৌরব করা হইল; আমরা প্রাচীন জাতি বলিয়া আধুনিক ইংরেজদিগের সম্মুখে স্পর্দ্ধা করি—তা না হইলে আমরাও আধুনিক হইলাম। আমরা দেখিতেছি না যে, অগৌরব কিছু হইল। আমরা সেই প্রাচীন আর্যজাতিসম্ভূতই রহিলাম—বাঙ্গালায় যখন আসি না কেন, আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ সেই গৌরবান্বিত আৰ্য। বরং গৌরবের বৃদ্ধিই হইল। আর্যগণ বাঙ্গালায় তাদৃশ কিছু মহৎ কীৰ্ত্তি রাখিয়া যান নাই—আৰ্যকীৰ্ত্তিভূমি উত্তর পশ্চিমাঞ্চল। এখন দেখা যাইতেছে যে, আমরা সে কীৰ্ত্তি ও যশেরও উত্তরাধিকারী। সেই কীর্তিমন্ত পুরুষগণই আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষ। দোবে, চোবে, পাঁড়ে, তেওয়ারীর মত আমরাও ভারতের আর্য্যগণের প্রাচীন যশের ভাগী বটে। (পৃ. ৩২৬)
কিন্তু অন্য দিকে প্রশ্ন উঠছে, বাঙালিদের মধ্যে আর্য কারা? জাতি হিসেবে বাঙালির উৎপত্তি কোথায়? সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এক দীর্ঘ প্রবন্ধে বঙ্কিম ভাষাতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের নানা আবিষ্কার জড়ো করে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন। সেইসব বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যের অধিকাংশই এখন মনে হবে সম্পূর্ণ আষাঢ়ে। এই প্রবন্ধটিও বঙ্কিমের অন্যান্য লেখার তুলনায় এখন প্রায় বিস্মৃতই বলা চলে। কিন্তু প্রবন্ধের সিদ্ধান্তটি অখণ্ড জাতীয় ইতিহাস লেখার পক্ষে খুব স্বস্তিজনক ছিল না।
ইংরেজ একজাতি, বাঙ্গালীরা বহুজাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আৰ্য, দ্বিতীয় অনাৰ্য্য হিন্দু, তৃতীয় আযানার্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙ্গালীসমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনাৰ্য বা মিশ্ৰিত আৰ্য্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে প্রায় কেবলই আৰ্য। এই জন্যে দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালীজাতি অমিশ্রিত আৰ্যজাতি বলিয়াই বোধ হয় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস এক আৰ্য্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিতে হয়। (পৃ. ৩৬৩)
শুধু বঙ্কিমেই নয়, অন্য লেখকদের রচনাতেও এই সম্ভাব্য স্বতন্ত্র ইতিহাসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের যে বইটিকে বঙ্কিম ‘সুবর্ণের মুষ্টিভিক্ষা’ বলেছিলেন, তাতে দেখছি বলা হচ্ছে যে ভারতের অন্যত্র যা-ই ঘটে থাকুক, বাংলায় অন্তত বাহুবলের কারণে মুসলমান ধর্মের প্রসার ঘটেনি।২২ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ইংরেজ আমলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে মুসলমান সুলতান বা নবাবদের সময় বাংলায় ‘এদেশীয়দিগের উচ্চ রাজ কর্ম্ম প্রাপ্তির কোন বাধা ছিল না।’২৩ আর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ‘জাতীয়করণ’ প্রক্রিয়াটা আমরা আগেই লক্ষ করেছি।
কথা হলো, দুটি স্বতন্ত্র ‘জাতীয়’ ইতিহাস—একটি আৰ্য-সভ্যতা-উদ্ভূত, প্রধানত উত্তরভারত কেন্দ্রিক, ‘ভারতবর্ষীয়দিগের’ ইতিহাস, অন্যটি অনিশ্চিত সূত্র থেকে উদ্ভূত, ‘বহুজাতিক’ বাঙালির ইতিহাস—এই দুই ইতিহাসের ক্রমপর্যায়, গতিপথ, ছন্দের যে বৈসাদৃশ্য, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের যে জটিলতা, তাতে ভিন্নতর কোনও ইতিহাসবোধের সম্ভাবনা নিহিত ছিল কি? এ-প্রশ্নের বিশদ আলোচনার জায়গা এই প্রবন্ধে আর নেই। বাংলায় ইতিহাস রচনার এই ধারাটি অন্তঃশীলা। গত একশো বছর ধরেই আর্য হিন্দু-ভারতবর্ষের পর্বতপ্রমাণ ভারে তা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছে। তবে সামান্য যে কটি উদাহরণ দিলাম, তা থেকেই তো দেখা যাচ্ছে যে এই ভিন্ন ইতিহাসে পাঠান আর মুঘলকে একত্র করে ‘মুসলমান শাসনকাল’ নাম দিয়ে পর্ব ভাগ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাঠানপর্ব আর মুঘলপর্বের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ এসে যাচ্ছে। অথবা বাংলায় মুসলমান ধর্মের প্রসারের কথা বলতে গিয়ে ‘মুহম্মদ বলিলেন, তরবারি লইয়া কাফেরদের নির্মূল করো’, এইভাবে গল্প শুরু করা যাচ্ছে না।
ভাবা যেতে পারে, এরকম স্বতন্ত্র ইতিহাস যদি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লেখা হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’-এর ভারকেন্দ্রটা আর্যাবর্তে কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে দিল্লির সিংহাসনে আর বেঁধে রাখা যাবে না। ইতিহাসের কেন্দ্রিকতার প্রশ্নটাই অনেক অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বিষয়টা তখন আর ‘জাতীয়’ ইতিহাস আর ‘আঞ্চলিক’ ইতিহাসের ব্যাপার থাকবে না। কোনটা সমগ্র আর কোনটা অংশ, কে অবয়ব কে অবয়বী, এ-প্রশ্নও নতুন করে বিচার করতে হবে। তাই বলছিলাম, এই বিকল্প ইতিহাসের সামগ্রিকতা যদি কিছু থাকে, তবে তা রাষ্ট্রীয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয়।
কিন্তু এই বিকল্প ইতিহাস রচনার জন্য প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত আমাদের নেই। ভারতের ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণাটাই যে আজ পর্যন্ত ভারতের অধিবাসীদের খণ্ডিত করে চলেছে, এই সত্যটা না বুঝতে পারলে বিকল্প ইতিহাস খোঁজার পথ প্রশস্ত হবে না।
টীকা
১ উনিশ শতকে বাঙালির ইতিহাসচিন্তা এবং সেই পটভূমিতে বঙ্কিমের ইতিহাস-বিষয়ক রচনার তাৎপর্য নিয়ে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেছেন Ranajit Guha, An Indian Historiography for India :A Nineteenth Century Agenda and its Implications (Calcutta, 1988)
২ ‘বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয় খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত বাংলার ইতিহাস সংক্রান্ত বঙ্কিমের প্রবন্ধগুলি সুপরিচিত। এখানে শুধু ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ এবং ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ প্রবন্ধ দুটি থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৫৪), পৃ. ৩৩০-৩, ৩৩৬-৪০।
৩ মৃত্যুঞ্জয় শর্মণঃ, রাজাবলি (শ্রীরামপুর, ১৮০৮)।
৪ অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রচলিত রাজবংশের তালিকা সম্বন্ধে রমেশচন্দ্র মজুমদারের একটি আলোচনা আছে। ‘সংস্কৃত রাজাবলী গ্রন্থ’, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৬, ৪ (১৩৪৬), পৃ. ২৩২-৯। গৌতম ভদ্র আমায় এই সূত্রটির খোঁজ দিয়েছেন।
৫ মুন্সী আলিমদ্দিন, দীল্লির রাজাদির নাম (বরিশাল, ১৮৭৫)।
৬ রামগতি ন্যায়রত্ন, বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম ভাগ, ‘হিন্দু রাজাদিগের চরমাবস্থা অবধি নবাব আলীবর্দি খাঁর অধিকার কাল পর্যন্ত’ (হুগলি, ১৮৫৯)।
৭ রামসদয় ভট্টাচার্য, বাঙ্গালা ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর (কলকাতা, ১৮৬৯)।
৮ ক্ষেত্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশুপাঠ বাঙ্গালার ইতিহাস, বীর হাঙ্গাম হইতে লার্ড নর্থব্রুকের আগমন পর্য্যন্ত (কলকাতা, ১৮৭২)।
৯ কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরেজদিগের অধিকারকাল (কলকাতা, ১৮৭০; প্রথম প্রকাশ, ১৮৫৯)।
১০ ক্ষিরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, সমগ্র ভারতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (কলকাতা, ১৮৭৬)।
১১ তাবাকৃষ্ণ হালদার, চমৎকার স্বপ্নদর্শন (কলকাতা, ১৮৬৮)।
১২ ভোলানাথ চক্রবর্তী, সেই একদিন আর এই একদিন, অর্থাৎ বঙ্গের পূর্ব ও বর্তমান অবস্থা (কলকাতা, ১৮৭৬)।
১৩ তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রথম ভাগ (কলকাতা, ১৮৭৮; প্রথম প্রকাশ ১৮৫৮)।
১৪ এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য J.S. Girewal, Muslim Rule in India: The Assessments of British Historians (Calcutta, 1970)
১৫ একটি বই দেখেছি যা সম্পূর্ণভাবেই তারিণীচরণের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ—গোটা গোটা অনুচ্ছেদে হুবহু এক। জীবনকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের পুরাবৃত্ত (কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ, ১৮৭৫; প্রথম প্রকাশ ১৮৬৮)।
১৬ ছৈয়দ আবদুল রহিম, ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর (ঢাকা, ১৮৭০)।
১৭ শেখ আবদুর রহিম, হজরত মহম্মদের জীবন চবিত ও ধর্ম্মনীতি (কলকাতা, ১৮৮৬)।
১৮ এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য Rafiuddin Ahmed. The Bengal Muslims 1871-1906. A Quest for Identity (Delhi. 1981), p.93-7,
১৯ Guha. An Indian Historiography.p. 62-67
২০ ভূদেব রচনা সম্ভার, প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত, (কলকাতা, ১৯৬২), পৃ. ৩৪১-৭৪।
২১ বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয় খণ্ডের এই প্রবন্ধগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিলাম এখানে ‘বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস,’ ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’। বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৩১৯-২৭, ৩৩০-৩, ৩৩৬-৪০, ৩৪১-৬৩।
২২ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস (কলকাতা, ১৮৭৫), পৃ ৬১-২।
২৩ কৃষ্ণচন্দ্র রায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইংরাজদিগের অধিকাবকাল (কলকাতা, চতুর্দশ সংস্করণ, ১৮৭৫), পৃ. ২৪৫।