ইতিহাসের ইতিহাস

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সবসময়েই আমার বুকের মাঝে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা কাজ করে। মাঝে মাঝেই পথেঘাটে রেল স্টেশনে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমার হয়তো একজন মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হয়, টুকটাক কথার পর হঠাৎ করে সেই মানুষটি বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা!” আমি তখন সব সময়েই দ্বিতীয়বার তাঁর হাত স্পর্শ করি এবং সেই মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষটির মাঝে আমি টগবগে তেজস্বী একজন তরুণকে খুঁজে পাই। আমি জানি সেই তরুণটি কিন্তু নিজের জীবনকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা সবাই জানি কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসের ভেতর আত্মসমর্পণ করেছিল, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিল তারা কিন্তু তখন সেটি জানত না। তারা সবাই কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করার জন্যেই গিয়েছিল। তাই সবসময়েই আমি মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির হাত স্পর্শ করে বলি, “থ্যাংকুু! আমাদেরকে একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে।”

মাঝে মাঝে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর সাথে আমার দেখা হয়, সে লাজুক মুখে আমাকে বলে, “আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা”, আমি তখন আবার তার মুখের দিকে তাকাই। তার লাজুক মুখের পিছনে তখন আমি তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব আর গৌরবের আলোটুকু খুঁজে পাই। আমি তখন তার বাবার খোঁজ-খবর নিই। বেশিরভাগ সময় আবিষ্কার করি তিনি আর বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকেন তাহলে আমি সেই তরুণ কিংবা তরুণীকে বলি তাঁর কাছে আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে।

একাত্তর সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, দেশ স্বাধীন হবার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে তখন আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তারাও ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে। কমবয়সী তরুণ কিন্তু এর মাঝে তাদের ভেতর কী বিস্ময়কর দেশের জন্যে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমি তাদের দেখি এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাই!

একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি, পিরোজপুরে মাঠে দুইএকদিন লেফট রাইট করা ছাড়া খুব লাভ হয়নি। আমার বাবাকে মেরে ফেলার পর পুরো পরিবারকে নিয়ে একেবারে বনের পশুর মতো দীর্ঘদিন দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। একটু স্থিতু হয়ে যখন বর্ড়ার পার হবার পরিকল্পনা করছি, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র তের দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেল– আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হল না। এই নিয়ে আমার ভেতরে বহুদিন একটা দুঃখবোধ কাজ করত এবং আমার বয়সী মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আমি হিংসায় জর্জরিত হতাম।

খুবই ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সেই (হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী) হিংসাটুকু গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে শিখেছি দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক য্ত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকি মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে কিন্তু আর কখনওই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাঁদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তাঁরাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়। (তাই আমি যখন দেখি, অল্প কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বের করে ফেলছে, তখন আমার মনে হয় গলায় আঙুল ঢুকিয়ে তাদের উপর হড় হড় করে বমি করে দিই!)

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভেতরে এখন গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি সব সময়ে চেষ্টা করে এসেছি নূতন প্রজন্মের ভেতর সেই অনুভূতিটুকু সঞ্চারিত করতে, যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পৌঁছে দিতে। একটি সময় ছিল যখন এই দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ত, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো হত, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হত– তখন এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর যে গভীর অভিমান জমা হয়েছিল আমি সেই কথা কখনও ভুলতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমরা সেই সময়টি পেছনে ফেলে এসেছি। এই দেশের মাটিতে আমরা আর কখনও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করতে চাই না।

তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে। এ কে খন্দকার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ষোলই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম তৈরি করে নূতনভাবে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং আমাদের তরুণেরা সেটা আগ্রহে গ্রহণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভালোবাসা এদেশে আবার নূতন করে প্রচারিত হয়েছে।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছেন। মনে আছে তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পথটুকু আমি গাড়িতে তাঁর পাশে বসে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এ রকম একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশে বসে আছি চিন্তা করেই আমি শিহরিত হয়েছিলাম। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলেছিলেন, তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমরা তাঁদের নিয়ে আমাদের একটা খোলা চত্বরে তাঁদের হাতে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম। এতদিনে গাছগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে অনেক বড় হয়েছে, আমরা সেই চত্বরটিকে ‘সেক্টর কমান্ডারস চত্বর’ বলে ডাকি।

সে কারণে যখন আমি দেখি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে তীব্র ভাষায় শুধু সমালোচনা নয় অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সেটি আমাকে তীব্রভাবে আহত করে। যারা তাঁকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করছেন, তারা কি বুঝতে পারছেন না এভাবে আসলে আমরা শুধু আমাদের নিজেদেরকেই না, আমরা মুক্তিযুদ্ধকেও অপমান করছি? তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করছি? খবরের কাগজে দেখেছি বার্ধ্যকের কথা বলে তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, কাউকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না তাঁকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা, বিতর্ক এবং অপমানই হচ্ছে মূল কারণ। আমরা আমাদের দেশে একজন মানুষকে তাঁর নিজের মত প্রকাশের জন্যে এভাবে অসম্মান করব আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

২.

এটি অবশ্য কেউ অস্বীকার করবে না যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমাদের সবারই কম বেশি মন খারাপ হয়েছে। আমরা সবাই আশা করেছিলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, সেটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু তিনি যেটুকু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তার থেকে বেশি ইতিহাসকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি একজন সৈনিক, তাঁর বিশ্লেষণ হয়েছে সৈনিকের চোখে, ইতিহাসবিদ সাধারণ মানুষ কিংবা রাজনৈতিক মানুষের সাথে তাঁর বিশ্লেষণ মিলবে তার গ্যারান্টি কোথায়?

সবচেয়ে বড় কথা এই বইয়ে তিনি যা লিখেছেন সেখানে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাগুলো ছাড়া অন্য সব কথাই কিন্তু আমরা সবাই অন্য জায়গায় শুনেছি। আমার দুঃখ হয় অন্য মানুষের মুখে আগে শুনে থাকা কথাগুলোর জন্যে আজকে তাঁর মতো একজন মানুষকে এত অসম্মান করা হল।

আমি মোটেই বইটি নিয়ে আলোচনা করব না, শুধু বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় নিয়ে করা বলব। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার লিখেছেন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণটি শেষ করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। হুবহু এই বিষয়টি লিখেছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইটিতে। তিনি অবশ্য ‘জয় পাকিস্তান’ লিখেননি, তিনি লিখেছিলেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’। পরবর্তী কোনো একটি সংস্করণে তিনি বই থেকে এই কথাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন, আমি ধরে নিচ্ছি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই তথ্যটি ভুল ছিল, তিনি ভুল সংশোধন করেছেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার যেহেতু দাবি করেননি তিনি নিজের কানে বঙ্গবন্ধুকে জয় পাকিস্তান বলতে শুনেছেন তাই আমি ধরে নিচ্ছি বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান যেখান থেকে এই তথ্যটি পেয়েছেন তিনিও সম্ভবত একই জায়গায় সেটি পেয়েছেন। এই বিচিত্র তথ্যসূত্রটি কী! আমার মনে হয় এর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন সৈয়দ বদরুল আহসান, ডেইলি স্টার পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণটি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচার করা হয়, তখন স্থানীয় পত্রিকাগুলো তাদের দেশের মানুষ কেন বিচলিত না হয় সে জন্যে বক্তৃতার শেষে এই কথাটুকু জুড়ে দিয়েছিল। সেই কথাটিই এখনও নানাজনের কথায় চলে এসেছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে। তিনি লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধের পরও তিনি একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। আমি ইতিহাসবিদ নই, আমি নির্মোহভাবে চিন্তা করতে পারি না কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ আছে, ছোটদের জন্যে ২২ পৃষ্ঠার একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্যে আমাকে অনেক বই পড়তে হয়েছিল! আমি পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার সিদ্দিক সালিকের বইয়ে দেখেছি তিনি লিখেছেন, পঁচিশে মার্চ রাতে খুবই ক্ষীণভাবে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি কোথা থেকে এসেছিল তার একটি ব্যাখ্যা তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের বইটিতে ( ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ , পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭) দেওয়া আছে। ট্রান্সমিটার বানানোতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন বলেই হয়তো পাকিস্তান মিলিটারির হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

যাই হোক, আমি আগেই বলেছি আমি আসলে এই বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে বসিনি। অনেকেই সেটা লিখছেন। সবচেয়ে বড় কথা, একাত্তরে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক দুটি শব্দ ছিল, এতদিন পর দুটি শব্দকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে কি বাংলাদেশের জন্ম হত?

৩.

আগেই বলেছি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়– আমার মতো অনেকেরই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মতো যে সব মানুষের এক ধরনের ছেলেমানুষী উচ্ছাস রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি মনে কষ্ট পেয়েছে। তবে আমার ধারণা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের, যে ভাষায় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমার ধারণা তিনি নিজেও নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে কথাগুলো ইতিহাসের সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছি সেই কথাগুলো তো বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর জন্যে আরও অনেকেই আগে এভাবে বলেছে– তাহলে এই বইয়ে সেটি লিখে কার লাভ হল?

আমিও ভাবছিলাম, কার লাভ হল, এখন হঠাৎ করে উপলব্ধি করেছি যে লাভ হয়েছে বইয়ের প্রকাশকের! বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা এবং তারা একটু পরে পরে বইটির বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটির বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খুবই স্থূলভাবে বলা যায়, এটি করে বই বিক্রি হচ্ছে, একজন সেই বই কিনছে, সেই বই পড়ছে আর মন খারাপ করছে আর ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর ক্যাশ বাক্সে একটু করে অর্থ যুক্ত হচ্ছে। আমি যদি একজন প্রকাশক হতাম তাহলে কি শুধুমাত্র কিছু অর্থ উপার্জন করার জন্যে এ রকম একটি বই প্রকাশ করে এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষটিকে এ রকম অসম্মানের দিকে ঠেলে দিতাম? কিছুতেই দিতাম না।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তাঁর মত প্রকাশ করার জন্য ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়ে বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্টে পেতে পারে বলে তিনি বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্যে সময় নেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে– একজন মানুষকে অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত অর্থ উপার্জন পৃথিবীর একমাত্র পথ নয়।

বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি খচখচ করছিল, বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের উপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতূহলটি মেটানোর জন্যে আমি ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম, তাদের কাছে অনুরোধ করলাম তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কি আমি এক নজর দেখতে পারি? তারা একটু ইতস্তত করে আমাকে জানালেন, সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তাদের কাছে নেই। কিছু আছে। তবে তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত সে রকম সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে।

আমি লেখালেখি করি, তাই এই উত্তর শুনে আমি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল এই বইটি কেমন করে লেখা হয়েছে কিংবা ‘প্রস্তুত’ করা হয়েছে সেটা খুব কৌতূহলউদ্দীপক একটা বিষয় হতে পারে। বই লেখা আর বই প্রস্তুত করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমরা কি ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর কাছ থেকে এই বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেতে পারি। আমাদের মনের সান্ত্বনার জন্য?

আমরা সবাই জানি এই বইটি লেখার জন্যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব দেবেন না আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে, খন্দকার মুশতাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী বলা হচ্ছে সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম।

কিন্তু সবার কাছে আমার একটি খুব সোজা একটি প্রশ্ন। এই বইটি লেখার দায়ভার কি শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কি খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন সেটি কেমন কথা? আমরা কি কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি?

হুবহু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে এবং আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই ঘটনাটি মনে আছে। ২০০৭ সাল ‘প্রথম আলো’র রম্য সাপ্তাহিকী ‘আলপিন’-এ একটা অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সেই নিরীহ কার্টুনটিকে একটা ইসলামবিরোধী রূপ দিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে দেয় এবং আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। শুধু তাই নয়, এটা প্রকাশ করার অপরাধে ‘আলপিন’-এর সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করা হল।

এখানেই শেষ নয় আমরা দেখলাম ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেলেন। (আমার ধারণা ছিল সংবাদপত্র আদর্শ এবং নীতির কাছে কখনও মাথা নত করে না, সেদিন আমার সেই ধারণাটিতে চোট খেয়েছিল।)

এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নাটকীয় ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম কোনো কিছু বিতর্কিত বা আপত্তিকর ছাপানো হলে লেখকের সাথে সাথে প্রকাশকদেরও সেই দায় গ্রহণ করতে হয়। আগে গ্রহণ করেছে।

আমার খুব ইচ্ছে আমাদের সবার কাছে সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের দায়ভার প্রকাশক খানিকটা হলেও গ্রহণ করে তাঁকে যেন তাঁর সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *