ইতিহাসের আলোকে আত্ম-দর্শন

ইতিহাসের আলোকে আত্ম-দর্শন

মুঘল-পূর্ব যুগের ভারতের মুসলিম শাসকরা পরিচিত ছিলেন তুর্ক বা তুরুক নামে। এঁদের অবশ্য স্বতন্ত্র গোত্রীয় ও দৈশিক নাম ছিল, যেমন খালজি, তুঘলক, লোদী, উজবক, আইবক, ঘোরী প্রভৃতি। তাঁরা যেমন একগোত্রীয় ছিলেন না, তেমনি তারা এক অঞ্চল থেকেও আসেননি। মধ্য এশিয়ার ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল তাদের বাস।

মুঘল-পূর্ব যুগে ভারতীয় ভাষায় ও সাহিত্যে প্রায় সর্বত্রই এঁদেরকে তুর্ক বা তুরুক বলে অভিহিত করা হয়েছে; জাতি-পরিচয়ে কোথাও মুসলমান বলে উল্লেখ করা হয়নি। কেবল ধর্ম প্রসঙ্গে মুসলমান বলে আখ্যাত হয়েছেন। পরবর্তীকালেও মুঘল, ইরানী, হারুই, বলখী, খোরাসানী, পার্সী, বোখারী, সমরখন্দী, কাশঘরী, তাব্ৰেজী, কুনিয়া, কাবুলী, পর্তুগীজ, ইংরেজ, ফিরিঙ্গি, আমানীয়, ওলন্দাজ, দিনেমার, হার্মাদ, ফরান্সিস প্রভৃতি নিবাসগত নামই পাই। অতএব মধ্যযুগে জাতি-পরিচয় ছিল দেশগত-ধর্মগত নয়। হিন্দু ও হিন্দুস্তানী পরিচয়ও দেশগত। এও বলা চলে বিদেশীরা এভাবেই এদেশে পরিচিত হত।

প্রমাণে ও অনুমানে বোঝা যায়, দেশজ মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলেই ধর্মভিত্তিক জাতি পরিচয় শুরু হয়। এবং তা মুঘল আমলেই বহুল প্রচলিত হয়। তখন থেকেই ভারতের হিন্দু মুসলমানের দুর্ভাগ্যের শুরু। কেননা, ধর্মচেতনা প্রবল হলে চৈত্তিক সংকীর্ণতা প্রশয় পায়। স্বধর্মী না হলেই মানুষকে পর ভাবা, শত্রু মনে করা এবং অবিশ্বাস করা ধার্মিক মানুষের প্রায় স্বভাবসিদ্ধ। এই হিন্দু-মুসলমান-শিখ পরিচয়ের প্রাবল্যবশে মুঘল আমলেই শুরু হয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও বৈর, দাঙ্গা ও হাঙ্গামা। ইংরেজ আমলে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক যখন ঘুচে গেল, তখন সমকক্ষতার ঔদ্ধত্যে ও দ্বান্দ্বিক স্বার্থের প্ররোচনায় লোভের ও লাভের বৈষম্যে এই বিরোধ ও বিবাদ বেড়ে চলে এবং স্বাধীনতা-উত্তর যুগে তা বর্বর পাশবিক মত্ততার রূপ ধারণ করে। নরহত্যার বীভৎসতা তাদের মনে উল্লাস জাগায়।

এ ব্যাপারে মুসলমানদের দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগই অধিক। একে তো ভারতরাষ্ট্রে তারা সংখ্যালঘু ও হিন্দুর অনুগ্রহজীবী, তার উপর মিথ্যা পরিচয়ে তারা হিন্দুর প্রতিহিংসাবৃত্তির শিকার। মধ্য এশিয়ার ও আরব-ইরানের বহুলোক শাসক ও শাসক-সহচর রূপে ভারতে আসলেও তাদের সংখ্যা এখনকার মুসলমানদের শতকরা তিনজনের বেশি যে নয় তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। কেননা যেসব দেশ থেকে মুসলমান শাসকরা এসেছে, সেখানেও জনসংখ্যা আজো বেশি নয়। এই ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের ফলে দেশী মুসলমানেরা কিছুটা মিথ্যা গৌরব লাভের দুর্বলতা বশে এবং কিছুটা আত্মপরিচয় বিস্মৃতির দরুন এই বিদেশী শাসক ও শাসক সহচরদেরকে নিজেদের জ্ঞাতি ভাবতে অভ্যস্ত হয়। এভাবে তাদের নিন্দা-গৌরবের ভাগীও হয়ে যায়। বিদেশী, বিজাতি ও বিধর্মী শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের যে স্বাভাবিক ক্ষোভ ও বিরূপতা ছিল, ইংরেজ আমলে জাতীয়তাবোধ বিকাশের ফলে তা তাদের মনে তীক্ষ্ণ ও তীব্র হয়ে উঠে এবং সাহিত্যে, ইতিহাসে ও রাজনীতিতে বিষবৃক্ষ জন্মাতে থাকে। আত্মবিস্মৃত দেশী মুসলমান যেমন তুর্কী-মুঘলদের নিন্দা-গৌরবকে নিজেদের বলে ভাবে, তেমনি তুকী-মুঘল শাসকের প্রতি অমুসলমানদের আরোপিত ও উচ্চারিত কলঙ্ক আর নিন্দাও তাদের গায়ে লাগে। তারা গায়ে মাখে বলেই হিন্দুরাও তাদেরকেই তুর্কী-মুঘলের বংশধর বলে জানে এবং পুরোনো পীড়ন ও ক্ষোভ স্মরণ করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে।

আজকের সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলমানের দুর্ভাগ্যের ও দুর্ভোগের অর্ধেক কারণ এ-ই। এই মনস্তাত্ত্বিক আধি থেকে সাধারণ হিন্দুর মুক্তিলাভের আশু-সম্ভাবনা কম। কাজেই ত্রস্ত ও নির্যাতিত ভারতীয় মুসলমানের যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হবে। তাদের ত্রাণপথ দৃষ্টি-সীমার মধ্যে নেই। পাকিস্তানেও হিন্দুনিধন হয়েছে, তবে তা সবসময় প্রতিশোধমূলক। উত্তেজনার কারণ ঘটিয়েছে ভারত। ভারতে হাজারোর্ধ্ব বার বড়-ছোট মুসলিম হত্যা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান অনুপম সংযম ও সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছে। পাকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ব বাঙলায় প্রতিশোধমূলক দাঙ্গা হয়েছে মাত্র চারবার কী পাঁচবার এবং নিজেরা বাধিয়েছে দুবার। এ তারতম্যের কারণও হয়তো শাসক জাতির অভিমান-পুষ্ট মুসলিম-মনে হিন্দু-বিদ্বেষের অভাব। 

তাছাড়া ব্রিটিশ আমলে হিন্দুদেরকে ধনে-মানে-বিদ্যায় উন্নত দেখেও অশিক্ষিত দরিদ্র মুসলমান তাদেরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত, সেই শ্রদ্ধার রেশও উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর হয়েছে। আবার দক্ষিণ ভারতে মুসলমানের সংখ্যা নগণ্য, তাই সেখানে হিন্দুরা মুসলমানকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে না। তাদের বর্তমান অস্তিত্ব গ্রাহ্যের মধ্যে নয় বলেই হিন্দুরা তাদের প্রতি উদাসীন, তাই তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। একই কারণে খ্রীস্টান কিংবা পাসীরাও নির্বিঘ্ন। কিন্তু উত্তর ভারতে মুসলিম সংখ্যা নগণ্য নয়, আর দিল্লী-কেন্দ্রী মুসলিম শাসনের স্মৃতিও হিন্দুমনে অম্লান। কাজেই পূর্বের লাঞ্ছনা-স্মৃতি, সম্পদ-লোভ এবং জীবিকার ক্ষেত্রে বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা উত্তর ও মধ্য ভারতীয় হিন্দুমনে মুসলিম নিধনে ইন্ধন যোগায়। এছাড়াও ধনে-জনে হৃতসর্বস্ব উদ্বাস্তুদের প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও অসহিষ্ণুতা এবং জীবিকাসমস্যাও উত্তরভারতে ঘন ঘন মুসলিম-হত্যায় প্ররোচনা দান করে। এর উপর সুবিধাবাদী রাজনীতির খেল তো রয়েইছে।

.

০২.

তুর্কী-মুঘল ও আরব-ইরানীর জ্ঞাতিত্ববোধ অন্যদিকেও মধ্যবিত্ত দেশী মুসলমানের সমূহ ক্ষতি করেছে। তারা নিজেদের চিরকাল স্বদেশে প্রবাসী ভেবেছে। তারা অনুকরণ করেছে বলখী বোখারীর, স্বপ্ন দেখেছে আরব-ইরানের, অনুসরণ করেছে দেশ-কাল-প্রতিবেশহীন জীবন-পদ্ধতি। তারা প্রতিবেশের অনুগত করে জীবন রচনায় ব্রতী হয়নি। এই প্রতিবেশিক প্রয়োজনের অস্বীকৃতিতে তাদের জীবন ছিন্নমূল ও কৃত্রিম হয়ে পড়েছিল। তাই বিগত হাজার বছরের মধ্যে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই দেশজ মুসলমানের উচ্চমানের কোনো অবদান প্রত্যক্ষ নয়। যে-মাটিতে তারা লালন পেয়েছে, সে মাটিকে তারা ভালবাসেনি। ধাত্রীরূপেও গ্রহণ করেনি। ইসলাম গ্রহণের পরে মধ্যবিত্ত দেশজ মুসলমানের দৃষ্টি আর কখনো মরুভূ আরব ও সরাব-সাকীর ইরান অতিক্রম করে স্বদেশে ফিরে আসেনি। তাই উনিশ শতকে ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম লিখিয়ে আঁকিয়েদের আলোচ্য ও অনুধ্যেয় বিষয় ছিল ইসলামপূর্ব ও ইসলাম-উত্তর যুগের আরব-ইরানী পুরাণ, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও দর্শন। হাফিজ জালন্ধরী, ফররুখ আহমদ অবধি সে-ধারা রয়েছে আজো অব্যাহত।

এই পদ্মা-কোকিলের দেশের মানুষ চোখ-কান বন্ধ করে রূপ দেখে বসোরাই গোলাপের, গান শোনে নাইসাপুরী বুলবুলের। বিন্ধ্য-হিমালয়ে তাদের মন ভরে না, হেরা-সিনাই-তুরে তাদের আকর্ষণ, আম-কলা-কাঠালে তাদের রুচি নেই, আরবি খেজুরে তাদের লোভ, দেশের শ্যাম নীলিমায় তারা ক্লান্ত, সাহারা তাদের মন ভোলায়। অমুসলিম হাতেম-নওশেরোয়া-রুস্তম তাদের আত্মীয়, পর হল কর্ণার্জুন-যুধিষ্ঠির। এমনি বিকৃত মন-বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়েছিল বলে তারা স্বস্থ ও সুস্থ ছিল না। বাস্তবকে তারা অবহেলা করেছিল, কিন্তু স্বপ্নও ছিল অনায়ত্ত। যদি দেশ-কাল প্রতিবেশের প্রয়োজনানুগ জীবন-ভাবনায় তারা ব্ৰতী হত, তাহলে তারা স্বস্থ ও সুস্থ জীবনের ফসলে ভরে তুলতে পারত তাদের জগৎ। তাতে তাদের মানস-জগৎ হত প্রশস্ত, চিত্তলোক হত আলোকোজ্জ্বল, গড়ে উঠত তাদের স্বকীয় একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। জীবনে, সাহিত্যে, দর্শনে তাদের অবদান হত গৌরবের ও গর্বের। স্বধর্মীর ইতিহ্য-গৌরবের সন্ধানে রিক্তচিত্তে কাঙালের মতো স্পেন থেকে গোবী মরু অবধি এমনি মানস-বিচরণের প্রয়োজন হত না। আধুনিক আরব, ইরান, মধ্য-এশিয়াও নয়, মধ্যযুগের মধ্য-এশিয়ায় ও মধ্যপ্রাচ্যে আজো তারা আওয়ারা হয়ে শক্তি, আদর্শ, ঐশ্বর্য ও প্রেরণার খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। তারা বাস করে একালে, ধ্যান করে অতীতের, স্বপ্ন। দেখে মরুভূর।

.

০৩.

আরো বড় বিড়ম্বনার কথা, যে-তুকী-মুঘলের জাতিত্ত্ব-স্বপ্ন দেশজ মুসলমানদেরকে চেতনার ক্ষেত্রে দেউলে করেছে, সে-তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠী কখনো দেশী মুসলমানকে আপনজন ভাবেনি। অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যই করেছে চিরদিন। তারা ছিল ঐশ্বর্যের উল্লাসে, প্রতাপ ও প্রভাবের দাপটে, আভিজাত্যের গর্বে, উপভোগের আনন্দে ও প্রতিপত্তির গৌরবে আকাশচারী। দেশী মুসলমানের সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক কোনো সামাজিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। দেশী খ্রীস্টান ও ইংরেজের মতোই ছিল সর্বব্যাপারে স্বাতন্ত্র্য। তারা তুর্কী-মুঘল শাসকের অনুগ্রহে আর্থিক ক্ষেত্রে উপকৃতও হয়নি। বড় চাকরিগুলো পেত বিদেশাগত মুসলমানেরা। এ পার্থক্য মুঘল আমলের শেষ দিন অবধি বর্তমান ছিল। তারা এদেশকে ও দেশের মানুষকে স্বদেশ ও স্বজাতি বলে গ্রহণ করেনি। সাতশ বছর শাসন-শোষণ করেও তারা এদেশকে মনে করত দারুল হর। অতএব দেশী মুসলমানকে তারা ইংরেজ যেমন করত দেশী খ্রীস্টানকে–কী অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই না করত! তুর্কী-মুঘলের জাতিত্বগবী উত্তরভারতীয় আজকের মুসলমানদের বাঙালির প্রতি অবজ্ঞার মধ্যে রয়েছে সেই পুরোনো স্মৃতির রেশ। তার প্রমাণ পাই এক ঐতিহাসিক দলিলে। ১৭৬৪ খ্রীস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ দরবারের পদস্থ মুসলিম কর্মচারীরা মেজর মুনরোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদনের জন্যে চুক্তিপত্রের যে-খসড়া তৈরি করেছিল, তার দু-একটি শর্ত এখানে উদ্ধৃত করছি। এতে বোঝা যাবে মুসলিম শাসকগোষ্ঠী সাতশ বছর পরেও বিদেশী শাসক-শোষকই থেকে গিয়েছিল। অবশ্য মুহম্মদ তুঘলক, ফিরোজ তুঘলক, শেরশাহ্ এবং আকবর ও জাহাঙ্গীর এর ব্যতিক্রম।

The company should in every respect regard as its own the honour and reputation of the Mughals who are strangers in this country and make them its confederates in every business. Whatever mughals whether Iranis or Turanis come to offer their services should be received on the aforesaid terms…. [ and that] should anyone be desirous of returning to his own country… he should be discharged in peace. (Quotation from Foot note 5. (pp. 12-13)] India, Reza Khan maintained. as a Dar-ul-Harb. (Reza Khans notę, Francis MSS. (I.O) Eur E 13 P. 417) He obviously shared the current notion of the Muslim Rulers in India, To whom it was not strictly a Dar-ul-Islam a muslim homeland. Muslims living in Hindustan (that is, North India) did so according to the same notion, as rulers or as sojourners only)–Calender of Persian Correspondence Vol. 1. No. 2423. Quoted by Dr. abdul Majed Khan in The transition in Bengali. (1765-75A. D.) P.12, and see also his Foot note 5. at PP. 12-13* [*পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।]

অথচ বাঙালি তথা ভারতীয় মুসলমানরা সিরাজদ্দৌলা, মীর কাসিম, টিপু ও বাহাদুর শাহ্ ওয়াজেদ আলির জন্যে পরম মমতায় ও চরম আত্মীয়তাবোধে কী কান্নাটাই না কাঁদে! দেশী মুসলমান যে বাদশাহর জাত ছিল না এবং মুঘল-শাসনের অবসানে তারা যে রাজ্যহারাও হয়নি, এ সত্য যতদিন উপলব্ধি না করবে, ততদিন তারা আত্মস্থ হবে না এবং আত্মত্রাণ, আত্ম-নির্মাণ ও আত্মোন্নয়নের সত্য ও সুষ্ঠু পথও তারা খুঁজে পাবে না।

এ সূত্রে মুঘলদের দুর্ভাগ্যের কথাও মনে জাগে। পারস্য রাজ্যের সহায়তায় দিল্লীর সিংহাসন ফিরে পেয়েছিলেন হুমায়ুন। সেই কৃতজ্ঞতায় ও অনুরাগে হুমায়ুন ইরানীদের চাকুরির আকারে আশ্রয় ও প্রশয় দিতে থাকেন। জাহাঙ্গীরের আমল থেকে শাহ আলমের কালাবধি বৈবাহিক ও সাংস্কৃতিক সূত্রে রাজ্যে ও রাজকার্যে ইরানী প্রভাব ও প্রতাপ পূর্ণতা পায়। এসব লোক ব্যক্তিগত লাভ ও লোভকেই জীবনের পরম ও চরম লক্ষ্য করে নিয়েছিল। এদের সঙ্গে জুটেছিল মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার আরো বহু গোত্রীয় মানুষ। ভারত ছিল তাদের চোখে সম্পদ আহরণের নির্বিঘ্ন ক্ষেত্র। রাজা ও রাজসরকারের সঙ্গে তাদের কোনো মমতার সম্পর্ক ছিল না। আনুগত্য ছিল চাকুরিগত। তাই দুর্বল বাদশাহর অক্ষমতার সুযোগে তারা মুঘল সাম্রাজ্য ভাগ করে নিল।

 মুঘল বাদশাহরা যদি স্বগোত্রীয়দের উপর নির্ভর করতেন, তাহলে গোত্র-স্বার্থেই সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব সাধনে তারা যত্ন করত। কাজেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল অমুঘল শাসক ও সেনাপতির আধিক্য। এরা সাম্রাজ্যের সঙ্কটকালে স্ব স্ব স্বার্থে দায়িত্ব ও কর্তব্যভ্রষ্ট হয়ে আনুগত্য প্রত্যাহার করেছিল। এখানে ইবন-খালদুনের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, কৌমচেতনা ও কৌমের সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসেই রাজশক্তির উদ্ভব, বিকাশ ও স্থিতি সম্ভব হয়। এবং সাম্রাজ্যের আয়ত্তাতীত ভৌগোলিক বিস্তৃতি, রাজ-পরিজনের বিলাসিতা, কৌম-চেতনায় শৈথিল্য ও আলস্য, ভিন্ন গোত্রীয় লোকদের শাসনকার্যে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রভৃতিই রাজবংশের পতনের মুখ্য কারণ। অন্তত মুঘল সাম্রাজ্য বিলুপ্তির ক্ষেত্রে উক্ত কারণগুলি সত্য হয়ে উঠেছিল।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইবন খালদুনের আমলে রাষ্ট্রিক জাতীয়তার উন্মেষ হয়নি। তাই তিনি গোত্র ও কৌম-চেতনার কথা বলেছেন। এ যুগে হলে তিনি দৈশিক কিংবা রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবাধ ও দেশপ্রেমের অভাবই দেশ বা জাতির রাষ্ট্রিক-পতনের কারণ বলে নির্দেশ করতেন।

পরিশিষ্ট

কৌতূহলী পাঠকের জন্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পূর্ণ বিবরণ সম্বলিত অংশ এখানে উদ্ধৃত হল :

Calender of Persian Correspondence.

 1764, Sept. 22.

2416. Zainul-abidin Khan to Major Munro. Has received through Asad khan his letter desiring the writer to joint the English army with as many able-bodied and well-mounted Moghals, Turanis, etc as possible. Although it is dishonourable for all men, particularly for men of family, to desret the service they are engaged in and go over to their Masters enemies, yet there are several reasons which justify such conduct in the Moghals. First, the Wazir, not withstanding his oath upon the Quarn, murderd the Nawab Muhammad Quli Khan, who was the glory of the Moghals, and who to the writer was dearer than a father or a brother. Secondly, the Wazirs behaviour to the Nawab Mir Qasim, who is a descendant of the Prophet, has been very shameful. It is not allowed by any religion that a person, who flees to another for protection with his family and effects, even if he be a person of low rank, should meet with treatment other than friendly. Why then has he in violation of his oath and agreement behaved in such a manner as to incur universal censure and reflect disgrace upon the Moghal name? Thirdly, he has never failed to break every engagement he has entered into and every oath he has taken. Fourthly, neither he nor his ministers pay any regard to his own sign-manual. Fifthly, with regar to the Moghals, who are starngers in this country, and who, having nothing to depend upon but their monthly pay, are brought ot distress whenever that is stopped, he thinks of nothing but how to oppress and ruin them. Moreover, he takes no notice of men and family, but places all his confidence in low and worthless people. Sixthly, he by no means makes a proper distinction between his friends and his enemies, but makes a practice of countenancing the latter and ill-treating the former. The assisting and supporting of such an oppressor is neither conformable to reason, nor to the Quran, nor to the rules of any religion, and the quitting of his service can reflect no dishonour upon anyone either in the sight of God or man. There fore if the English, who are celebrated for thir Justice and good faith, are desirous of an alliance with the Moghals, and are willing to agree to their just demands and swear to the observance of the agreement by the names of Jesus and Mary, and if the gentlemen of the Council put their seals to it and speedily forward it, a great number of Moghals and Turanis will without delay join the English army. Praises Ali Riza Khan and desires the Major to invite him back to the English service. Assures him that the .said Khan was carried away to the Wazirs camp, contrary to his own inclinations, by his troop of horse and the people of Tikari, that inspite of his Highnesss solicitations, he has refused to enter his service, that he has been greatly oppressed on account of his connection with the English, and that he is sincerely attached to them. Refers him to Mirza Iwaz Beg for particulars. (Trans P. L. R., 1759-64, No. 239. p.p. 476-478. Abs. P. L. R, 1759-65. P. 85.

Sept. 22.

2418. Zainul-abidin Khan to Asad Khan. Has received his letter together with Major Munros letters for the writer and Muhammad Baqir Khan. The Moghals, who have all been informed of the addressees commands, met and unanimously resolved to draw up a treaty and send it to him for his approval and for transmission to the gentlemen of the English council, that they may set their seals to it and swear to the observance of it upon the Bible and in the name of the Prophet Jesus and the Prophet Mary. God forbid that in the service of the English, the Moghals should meet with the same treatment as in that of the Wazir, and that when their business is done, they should be turned away, remote as they are from their native country and brouht to shame and distress. The addressee is a chief of the Moghals and a man of family and understanding. He should settle matters to his satisfaction. Whatever staisfies him, will satisfy the writer. And Whatever satisfies the writer, will satisfy all the Moghals. The merit or demerit of whatever may be done will be attributed to the writer, and the writer, before God, The prophet, and the common father of the Moghals, will attribute it all to the addressee. Desires that the territory by the Ganges and the Jumna may be made over to the Moghals rent-free. Mirza Taqi Khan, Muhammad Baqir Khan, Ali Riza Khan, Rustam Beg, Baba Beg Khan, Muhammad Taqi Khan, Muhammad Tahir Beg, Masum Ali Beg and all the other chiefs have empowered the writer to act for them. Mirza Muhammad Hasan is also ready to join in the conspiracy. Has heartily engaged himself in this dangerous business, Which may be the cause of much bloodshed. Ali Riza Khan has refused to enter the Wazirs service, although His Highness has offered him Rs. 1,000 a month besides a present of Rs. 2,000, which is more than he gives to any of his officers. Requests the addressee to prevail upon the English to invite him back to their army. Requests him also not to invite Mirza Mahdi Ali Khan to join the Moghals, lest he should take the first place. Will rejoice at the addressees elevation to the Nizamat of Oudh, irrespective of whether he is favourable to the writer or not, as it will conduce to the happiness of thousands of people, and as the interest of one individual must not be put in competition with that of the public. He is a man of understanding, but as the writer is more advanced in years, he takes the liberty of advising him that he should not do anything that may lessen him in the estimation of the English, who are men of penetration and foresight; and whose undertaking are conducted with wisdom. Requests to be favoured with a speedy reply. Refers him to Mirza Iwaz Beg for other particulars. PS. Requests him to procure as soon as possible a line or two from Major Munro to Rustam Beg Afshar and Baba Beg Khan, who are both men of consideration among the Moghals. (Trans. P.L.R., 1763 64, NO. 241, PP. 480-483. Abs P.L.R., 1759, P. 85).

Sept. 22. 2423. Paper of articles sent by the Moghals to Major Munro.

(1) The Company should in every respect regards as its own the honour and reputation of the Moghals, who are strangers in this country, and make them its confederates in every business. (2) They should be granted a proper place in the country of the habitation of their families and dependendants. (3) Whereas sixty rupees a month have been fixed for all but Jamadars, Hawaldars, and Dafahdars, there are several privates who have always been distinguished and have received from one to three hundred rupees a month. These men should be allowed something more than what they received in the Wazirs army. (4) Whatever Moghals, whether Iranis or Turanis come to offer their services, they should be received on the aforesaid terms. Moreover, a present of Rs. 100 per head should be immediately given them and a months pay advanced them. (5) At present there should not be raised any difficulties as to the size of horses. (6) Whenever a Moghal is killed in battle or dies a natural death, his son or relation should be received in his place. (7) As several men are in debt, a small sum of money should be sent to enable them to discharge their debt. (8) Should anyone be desirous of returning to his own country, his arrears should be immediately paid and he should be discharged in peace. (Trans. P.L.R. 1763-64, NO. 246, pp. 491-492)

Sept. 22

2424. Shah Mal, Qaladar of Rohtas, to Major Munro. Has answered his several letters. Remains firm in the fort in the hope of his favour and protection. Mir Sulaiman has arrived at Batein (?) fort in Akbarpur, idly relying upon his Highnesss deceitful promises of kindness and reward. But he has been plainly told that the people of Rohtas fort will by no means submit to the Wazir, Whose behaviour to the Nawab Ali Jah (Mir Qasim) has not been such as to make them believe that it will be for their interest to do so. Hopes that the Major will send some assistance as soon as possible. Numbers of the enemys troops are coming towards Rohtas. Some have already arrived at Tilloot, while other are stationed at Sasaram. If he is not speedily supported, he has no expectations but of becoming a sacrifice. Has already sent a paper of requests. Desires that an agreement properly executed and assuring him of protection may be sent. Desired also that some money may be granted to the people of the fort. They are now the companys servants, and any disgrace that they may suffer, will fall upon the English. .

(Trans. P.L.R, 1763-64, No. 247, pp, 486-488. Abs. P.L.R, 1759-65, : p. 83)

Sept. 22

2424A. Shah Mal, Qal-adar of Rohtas, to Major Munro. Has received his letter agreeing to set his hand to the writers paper of requests, but saying that Mir Asad Ali, the bearer of it, has not yet arrived. Encloses another paper. Although he is fully satisfied with what the Major has said in his letter, yet in compliance with the custom of the world, he requests that the paper will be properly signed, sealed and speedily sent to Rohtas together with some money and a body of troops. The enemys troops, which were at Tilloot, have scattered themselves on every side. Should they surround the fort, the garrison will be greatly distressed for want of provision. Makes repeated appeals for help. Refers him to Mir Asad Ali and Dr. Fullarton for particulars. (Trans. P. L. R, 1763-64, No. 248, pp, 488-490. Abş. P.L.R. 1759-65, p. 84)

N.B : Abbreviations.

Abs. P.L.R. Represents the volume of Abstracts of Persian Letters received.

Trans. P. L. R.– Represents the volume of Translations of Perisian letters received.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *