ইতিহাসােমিটার

ইতিহাসােমিটার

১। আওরঙ্গজেব কি হিন্দুদের দেখতে পারতেন?

২। না, তার বড়াে ভাই—শাহজাদা দারাশুকো হিন্দুদের পাল টানবেন বলেই আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে পড়েন?

৩। কিংবা, শাহজাহান বাদশা বড়াে ছেলে দারাশুকোর পাল টানতেন বলেই সেজো ছেলে আওরঙ্গজেব দারা-বিদ্বেষী হয়ে পড়েন?—সেই দারা হিন্দুদের পাল টানতেন বলেই পরিণামে আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী?

৪| দারা হিন্দুদের পাল টানতেই বলেই মৌলবি-উলেমারা আওরঙ্গজেবের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে ওসকাতে শুরু করেন! আওরঙ্গজেব তাই দারা আর হিন্দুদের দেখতে পারতেন না। নয়তাে হিন্দুদের ওপর আওরঙ্গজেবের এমনিতে কোনও বিদ্বেষ ছিল না।

৫। তিনি একবারই প্রেমে পড়েন। সেই প্রেয়সী হিন্দু-হীরাবাঈ। আওরঙ্গজেব সারা জীবনে মাত্র দুবার মদের গ্লাস হাতে নেন। একবার ছােটো ভাই মুরাদকে ভুলিয়ে বন্দি করার জন্যে। আরেকবার হীরাবাঈয়ের তুলে ধরা সরাবের গ্লাস আওরঙ্গজেব হাতে নেন—ফিরিয়ে দিতে পারেননি। তাতেই হীরাবাঈ মুগ্ধ। তিনি বলেছিলেন—থাক শাহজাদা। তােমাকে খেতে হবে না। হাতে নিয়েছ এই যথেষ্ট।

৬। আসলে সবকিছুই ঘুরছিল একটি জিনিসকে ঘিরে। তা হল হিন্দুস্থানের বাদশার মসনদ। এই মসনদকে ঘিরে শাহজাদা দারাশুকো, আওরঙ্গজেব, বাদশা শাহজাহান, সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজ ও ধর্ম, যােদ্ধা রাজপুত সামন্তরাজার দল, | মৌলবি-মৌলানাদের রাজধর্ম ইসলাম, মুঘল ফৌজ এবং তাগদ যেন গােল্লাছুট

খেলছে। আসলে কহানি মসনদকা!

৭| সবকিছুরই শেষ তাগদ। ঘােড়সওয়ার, কামান, ফৌজ। তাগদের চশমায় চোখ রেখে আওরঙ্গজেব হিন্দুস্থানের মসনদের দিকে তাকিয়েছেন। তাই দরকার মতাে তিনি হিন্দু-বিদ্বেষী। আবার দরকার মতাে হিন্দুপ্রেমিকও। তাই মীর্জা রাজা জয়সিংকে একসময় দামি একখণ্ড হিরে আর একটি শাহি হাতিও তিনি ভেট পাঠিয়েছেন।

এই সব যুক্তির ভেতর রাস্তা হারিয়ে ফেললেন অমল পালিত। নিজের স্টাডিতে বিরাট সেকরেটারিয়েট টেবিলে সাদা কাগজ সাজানাে। তার পাশে তিন চারটে ভালাে কলম। একটি ডট পেন। তিনি কোশ্চেন করে থাকেন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস অনার্সের। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসে তিনি এগজামিনারও থাকেন।

বিধানসভার ভােটে একবার একটা বড়াে দল তাঁকে তাদের ক্যান্ডিডেট করতে চেয়েছিল। তিনি দাঁড়াননি। কারণ, ডক্টর পালিত তখনাে জানতেন—তিনি একজন প্রতিভাবান মানুষ। প্রতিভা কখনাে ভােটে দাঁড়ায় না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আগাগােড়া প্রথম। তখন থেকেই পরীক্ষায় মাঝারি বা খারাপ করা মানুষজন তাঁকে একজন প্রতিভা হিসেবে সম্ভ্রম দেখাত। কেন না তিনি স্বল্প বয়সেই রেজাল্টের জোরে ভালাে ভালাে মাইনের চাকরি, সম্মান পেতেন। একদিন যেদিন টের পেলেন—তিনি কিছু জিনিস মুখস্থ করে অন্য সবার চেয়ে তা ভালাে করে পরীক্ষার খাতায় গিয়ে ঢেলে দিতে পারেন—মানে ক্র্যামার্স ওয়ার্ল্ডে—মুখস্থ শক্তির দুনিয়ায় তিনি সবার সেরা—আর সে জন্যেই তিনি লােকমুখে সেরা ছাত্র—প্রতিভাধর—কিন্তু মানুষ কী করে আবিষ্কার করে, ভাবে, বানায়—তা তিনি জানেন না—তখন তিনি জানালেন, তাঁর কোনও দৃষ্টিকোণ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি—যার জোরে কোনও কিছুকে নিয়ে তিনি মৌলিক কোনও কথা বলতে পারেন।

যেমন—একটি মেয়েকে সুন্দর লাগে কেন? অন্য মেয়ের চেয়ে ? তিনি ভেবে দেখলেন—শুধুই সুষম হাত পা নাক চোখ মুখ নয়—গায়ের চামড়ার টেক্সচার কিংবা মাথার চুল নয়—আরও কিছু। এই আরও কিছু আসলে কী? যে দেখছে—তার মনের মাধুরী ? মেয়েটির হাসি? গলার স্বর ? ভঙ্গি? উপরন্তু মেয়েটির মত? তার মাথার ভেতরকার পড়াশুনাে, দেখার জগতের দিগন্ত ?

ডক্টর পালিত ন্যাশানাল প্রফেসর হবেন। এমনিতেই খুব অল্প বয়সে তিনি প্রফেসর হন। তারপর ইউ জি সি স্কেল টেলের একেবারে শেষধাপে তিনি অল্প বয়সেই পৌছে যান। এই সরকারি ফ্ল্যাটবাড়িটি বেশ বড়াে। সামান্য ভাড়া। নিয়েছেন সেই তিরিশ বছর আগে। এখন সকালবেলা। স্ত্রী মানসী এবার ঘুম থেকে উঠে তাঁকে চা দেবেন। ফাঁকা, নির্জনে ড. পালিত কোশ্চেন করতে বসেছিলেন। ক-দিনের ভেতরেই পেপার সেট করে ইউনিভার্সিটিতে জমা দিতে হবে।

ছেলেমেয়েরা বড়াে হয়ে যে-যার কাজের জায়গায়। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি— ছেলেরা চাকরিতে। জব্বলপুর, জামশেদপুর, কানপুর, ফতেপুর, হাজিপুর, মেদিনীপুর, দুর্গাপুর ইত্যাদি জায়গায় ছড়িয়ে।

ডক্টর পালিত জানেন—এখুনি ঘুম থেকে উঠে মানসী খুব সন্ত্রমভরে তাঁর টেবিলে চায়ের কাপ এনে রাখবে। কারণ, তিনি একজন বড়াে প্রফেসর। কোশ্চেন করেন। থিসিসের এগজামিনার। আগাগােড়া ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আগে বাংলা ছায়াছবির ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট নায়করা ল পড়তে যেত। ভাবী শ্বশুরকে সন্ত্রমভরে নুয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করত। সেরকম সম্ভ্রম নিয়েই ডক্টর পালিত খানিকবাদে মানসীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে মানসীর মুখে তাকাবেন। হাজার হােক মানসী একজন প্রতিভাধর ফার্স্ট ক্লাস ফাস্টের নিজের বউ। ড. পালিত মনে করার চেষ্টা করলেন—তিনি যে একজন সেরা, প্রতিভাধর এই কথাগুলাে কবে থেকে তাঁর মাথায় ঢােকানাে হয়েছে। আমি কোনওদিন কোনওকিছু আবিষ্কার করিনি। একটা গানের সুর দেওয়া, একজন হতাশ মানুষকে তার জীবনে বিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা ভালােবাসা আর ধৈর্যের ভেতর সমঝােতা এনে দেওয়ার মতাে কোনও কাজ আমি কোনওদিন করিনি। টেলিফোন, রেডিও, গ্রামােফোন আবিষ্কার তাে দূরের কথা। আমি মুখস্থ রাখতে পারি। আর সেসব কথা পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিতে পারি। আমার যতদূর মনে পড়ে—আমার ছােটোকাকি আর বড়ােজেঠি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেন—আমি সেরা—আমি প্রতিভাধর। সেইসঙ্গে যােগ হয় আমার অল্পবয়সে রেজাল্টের জোরে ভালাে চাকরি পেয়ে যাওয়া। অনেক পরে ডক্টর পালিত জানতে পারেন—ছােটোকাকি টায়েটোয়ে বি-এ। বড়ােজেঠি একবার কম্পার্টমেন্টাল।

আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি নিয়ে কোশ্চেন করতে গিয়ে ডক্টর পালিত ক-দিন ধরেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আওরঙ্গজেব পড়ছেন। যতই পড়ছেন ততই অবাক হচ্ছেন। আগে তাে এভাবে তিনি আওরঙ্গজেবকে দেখেননি।

সেইসব কথাই সাজিয়ে সাজিয়ে ভাবতে গিয়ে অমল পালিত ওইসব যুক্তির ভেতর রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। বেশ বড়াে ঘর। দোতলা থেকে সামনের বড়াে রাস্তা দেখা যায়। এঘরেই ডক্টর পালিতের শােওয়া-বসা, খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়া—ঘুমােনাে। টেবিলেই একটা খুদে ট্রানজিস্টর। ভাের ভাের বি-বি-সি-নয়তাে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা খবর শুনে থাকেন ডক্টর পালিত। খবরগুলােকে তাঁর মনে হয়—ভবিষ্যতের ইতিহাসের ছােটো ছােটো ধরতাই—বা, আগাম সিনপসিস।

খুব ছােটোবেলায় মামার বাড়িতে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে আলমগির যাত্রা দেখেছিলেন বালক অমল পালিত। আওরঙ্গজেব কিল্লা কান্দাহার অবরােধ করে দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে। সেই অবস্থায় হঠাৎ নিজের মাথার চুল দুই খাবলা খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন আলমগির। দারা! দারা! সর্বক্ষণ দারা। বড়েভাই দারাশুকোর কথা ছাড়া আর কি কোনও কথা নেই? হিন্দুস্থানের বাদশা শাহজাহানের পহেলা শাহজাদা দারাশুকো—আমার বড়েভাই দারাশুকো! তােমাকে ছাড়া আর কোনও চিন্তা নেই আমার ? শুধু এক চিন্তা–দারা। দারা আমায় সর্বক্ষণ কুরে কুরে খায় কেন? আমিও তাে বাদশা শাহজাহানের ছেলে। আব্বা হুজুর শাহজাহান। আপনি শুধু আপনার দারাকে ভালােবাসবেন? আপনার আওরঙ্গজেবকে ভালােবাসবেন না?

ডক্টর পালিতের গলিপথে আলমগির মিলিয়ে যান। তাঁর মনে হয়—আমি কীসের ইতিহাসের প্রফেসর ! এই ডায়ালগ ভেবে নিয়েই তাে আমি ইতিহাসের গবেষণার ছায়াঢাকা পথে ঘুরতে ঘুরতে এই সত্য আবিষ্কার করতে পারতাম পিতার অবহেলায়-অন্যায় পক্ষপাতিত্বে—ভালােবাসাহীন বঞ্চনায় আওরঙ্গজেব নামে শাহজাদা—হিন্দুস্থানের ভবিষ্যৎ বাদশা, আলমগির নিজেকে কোণঠাসা ভেবে দিনে দিনে দারার দুশমন হয়ে উঠেছেন—আর সেই দারা হিন্দুদের পাশ টানেন বলেই তিনিও হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে পড়েছেন। নয়তাে এই আওরঙ্গজেবই জৈনমন্দির চিন্তামন ভেঙে মসজিদ করলেও—মথুরায় কেশব রায়ের মন্দির ভাঙলেও—ধর্মচর্চার জন্যে নিষ্কর জমি দিয়ে জৈনসাহিত্যে—হিন্দুসাহিত্যে অজস্র প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আমি মুখস্থ করে প্রতিভাধর হয়েছি! প্রফেসর হয়েছি! আমি যদি সত্যিই প্রতিভাধর হতাম—তাহলে গ্রাহামবেল, টমাস আলভা এডিসনের মতাে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য উদ্ধারের জন্যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ দিয়ে—উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটা ইতিহাসমিটার কি আবিষ্কার করতে পারতাম না?—যা কিনা আওরঙ্গজেবের মন্দির ভাঙার আসল কারণ কিংবা মুঘল দরবারে ফারসি জানা হিন্দু কবিদের মাসােহারা বন্ধ করে দেওয়ার ঠিকঠাক কারণ খুঁজে বের করতে পারত।

আসলে ভারতে রেলপথ আর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজরা কাছাকাছি সময়ে বসায়। দুটোরই বয়স প্রায় দেড়শাে। এই এতগুলাে বছরে কত ছাত্র ট্রেনে চড়ে যে যার জায়গায় ভুল শিখে চলে গেল। এই এতগুলাে বছরে কত কত ছাত্রী বি-এ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে যার জায়গায় ভুল শিখে চলে গেল।

এই দেড়শাে বছরে কত কত মুখস্থে-ওস্তাদ প্রতিভাধর প্রফেসর সহজ সরল করে ছাত্রীদের আর ছাত্রদের বুঝিয়ে দিলেন—আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন। সেই সব ছাত্র—সেই সব ছাত্রী তাদের সারা জীবন ধরে সমাজের শরীরে দেড়শাে বছর ধরে তাদের ভুল শেখাটা ছড়িয়ে দিলেন—আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন!

আর! যদি একটা ইতিহাসসামিটার থাকত! থাকলে জানা যেত মুঘল যুগে মুঘলরা কি জুতাে পায়ে দিতেন। জানা যেত বাদশা-বেগম নূরজাহান সত্যিই কি লাহােরে মারা যান? সারা ইতিহাসে এর কোনও সঠিক হিসেব নেই। দেড়শাে বছর ধরে মুখস্থে-ওস্তাদ আমাদের প্রতিভাধর প্রফেসররা তাহলে কী করলেন ? শুধুই মাস মাইনে, সপ্তাহে আটটা। ক্লাস আর বছরে পাঁচ মাস ছুটি? তার বদলে তারা কোনও দৃষ্টিকোণ বা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারেননি—যা দিয়ে কল্পনার ময়ামে তাঁরা ইতিহাসের ছায়াঢাকা পথে অতীত থেকে খাঁটি সত্যিকে তুলে আনতে পারতেন। এ জন্যেই দরকার ছিল একটা ইতিহাসােমিটারের।

ডক্টর পালিত এইসব ভাবতে ভাবতেই একটা গেঞ্জি গায়ে দিলেন। তারপর একটা পাঞ্জাবি চাপালেন। হেমন্ত যায় যায়। ভাের ভাের বাতাসে হিম থাকে। হেঁটে আসবেন কিনা ভাবছেন—এমন সময় দেখলেন—তার ঘরের কোণে প্রায় বাঘের সাইজের একটা কালাে বেড়াল বসে। লেজ গুটিয়ে। রীতিমতাে লজ্জিত ভঙ্গিতে। কিন্তু মুখে-মুখের গোঁফে ঝাপিয়ে পড়ার চতুর হাসি।

ক-দিন ধরেই এই অতিকায় কালাে বেড়ালের সঙ্গে ডক্টর পালিতের দেখা হচ্ছে। ঠিক পড়ার টেবিলটার গায়ে ঘরের কোণে ও লাজুক মুখে বসে থাকে। তিনি কয়েকবার যাঃ! যাঃ! বলে চেঁচিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করেছেন। পাশের ঘর থেকে মানসী ছুটে এসেছেন। কাকে তাড়াচ্ছেন? ডক্টর পালিত আঙুল দিয়ে কালাে বেড়ালটাকে দেখাতে গিয়ে দেখেছেন—বেড়ালটা সেখানে নেই। হাওয়া। আসলে শুধু তিনি একাই ওকে দেখতে পান। কাউকে দেখাতে পারেন—

ডক্টর পালিত হাঁটতে না বেরিয়ে ফের তাঁর চেয়ারে বসলেন। সাদা কাগজগুলাে কোশ্চেনের জন্যে তাঁর দিকে তাকিয়ে। পাশেই কলম, ডটপেন।

মুঘল যুগের নানান ইতিহাস। বায়ুনি। কাফি খাঁ। লেন-পুল। যদুনাথ। ভিনসেন্ট স্মিথ। ঈশ্বরী প্রসাদ। নুমানী সিবলির লেখা ঔরঙ্গজিভ পর এক নজর। আওরঙ্গজেবের ওপর ষােলাে নম্বরের একটা কোশ্চেন করতে গিয়ে এই শীত ভােরে বিশাল এক টানাপােড়েনের ভেতর পড়ে ডক্টর পালিতের ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ার দশা। কোনদিকে যাবেন তিনি? আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী? না, বাবা শাহজাহানের দারার দিকে একচোখেমির দরুন সেই দারা হিন্দুদের বাঁচিয়ে চলায় আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে পড়েন? |

তারপর তাে ছিল আকবরের আমলের সুলহ্-ই-কুল—সর্বধর্মে সহিষ্ণুতা—যা কিনা সামাজিক ন্যায় বিচারকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। তাকে বিদায় দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন কাঠ মােল্লারা। তারাই মসনদের ওপর আওরঙ্গজেবের দাবি জোরদার করতে তাঁকে হুইসপার ক্যাম্পেন চালিয়ে ইসলামের ভরসা—জিন্দা পির করে তােলে।

মুঘলরা তাে তাগদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাইতাে জানেন ডক্টর পালিত। ঘােড়া দাবড়ে, কামান দেগে, হাতি চালিয়ে তারা তাদের জয়ের ইচ্ছা, ভােগের। খােয়াব, দখলের মুঠো সফল করেছেন। তারা তাে নিয়তিকে বিশ্বাস করতেন—

 হিন্দুকুশ পাহাড়, উসুরি নদী, সমরখন্দ, তৈমুরাবাদ পেছনে ফেলে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ওদের আসা। পথে গজনি, হিরাট, কান্দাহার। হেলমন্দ নদী। ঘােড়া, কামান, তােপ। হিন্দুস্থানে এসে মুঘলরা হাতির প্রেমে পড়ে গেলেন। কতরকমের হাতিদের চর্চা। জাহাঙ্গির হাতিদের আলানসঙ্গিনীর ব্যবস্থাও করেছিলেন। সরাব তাে তাদের খাওয়াতেনই। ঠিক লড়াইয়ের সময়।

হাতির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি হিন্দুস্থানি অভ্যেস তাদের হল। নিয়তিতে ভরসা। তাইতাে দারার জন্মের ছ-দিনের মাথায় শাহজাহান বাদশা ছেলের কপালে দুর্ভাগ্যের চিহ্ন দেখতে পান। গণতকার তাকে বলেন, আপনার—

যে-ছেলেটি গৌরবর্ণ সে-ই হবে মুঘল বংশের পতনের কারণ। বাদশা তাই। তিসরি শাহজাদাকে তার ছােটোবেলায় শ্বেত-সাপ বলে ডাকতেন। এটাও কি বাবার জন্যে আওরঙ্গজেবের মনে বিষ জমে ওঠার কারণ? শাহজাহান কি নিজের জীবনের বিদ্রোহী দিনগুলাের ছায়া এই ছেলের ভেতর দেখতে পেতেন? পেয়ে শিউরে উঠতেন? তাই এই বিজ্ঞপ্তি ? সব ক্ষমতার ভেতরেই বিদ্রোহের বীজ থাকে।

কী কোশ্চেন করব? প্রফেসর অমল পালিত ভাবলেন—এমন কোশ্চেন হতে পারে—আওরঙ্গজেব আদৌ হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন না। হিন্দুস্থানের মসনদকে ঘিরে তাগদের খেলায় তাকে হিন্দু-বিদ্বেষী না হয়ে উপায় ছিল না। কেননা, তা নাহলে তিনি দারার দুশমনদের সাহায্য পেতেন না।—এলুসিডেট।

ডক্টর পালিত জানেন—আসলে সেই সময়টা ছিল ধর্মে বড়াে বড়াে বিপ্লবের সময়। সেটা ছিল হৃদয় আর সমর্পণের যুগ। হিন্দুস্থানের পথে পথে আউল বাউলের গান। সুফি সাধকদের দিন। সন্ন্যাসী দরবেশদের ঈশ্বর খুঁজে বেড়াবার সময়।।

এক দরবেশ তাে গেয়েই বসলেন—

হিন্দু কহে শােন হাম বড়ে

মুসলমান কহে হাম।

এক মুঙ্গ-কা দো খান্দ হৈ

 কুন জিয়াদা কুন কাম ৷

তবে কি প্রশ্নটা এমন করা যায়—আকবরের আমলের হিন্দুয়ানির ব্যাকল্যাস আওরঙ্গজেবের উদ্ভব ?

নানারকম যুক্তির ভেতর ডক্টর পালিত দিশেহারা হয়ে পড়লেন। তিনি দেখলেন—তিনি সহজ, সরল, সিধেভাবে আওরঙ্গজেবকে হিন্দু-বিদ্বেষী বলতে পারছেন না। তবে কি আমারও একটা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে? দেড়শাে বছর ধরে রেলের বয়সি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক লক্ষ বি. এ. পাশ লােককে বুঝিয়েছে—আওরঙ্গজেব হিন্দু-বিদ্বেষী। তাই বুঝে নিয়ে তারা সমাজের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে ফল যা হবার তাই হয়েছে।

প্রফেসর পালিত দেখলেন, তিনি কিছুতেই আওরঙ্গজেবকে নিয়ে কোনও কোশ্চেন করতে পারছেন না। এবার মানসীর ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে এল। তিনি ঘরের কোণে তাকাতে সাহস পেলেন না। কেননা, তাঁর দেখা। অতিকায় কালাে বেড়ালটাকে তিনি এখন দেখতে পেলেও—মানসী উঠে এসে ওকে কিছুতেই দেখতে পাবে না। এ এক আশ্চর্য কালাে বেড়াল। লাজুক অথচ হিংস্র। ঠিক এই সময় টেবিলে রাখা খুদে ট্রানজিস্টরটা বেজে উঠল।

ভয়েস অব হিন্দুস্থান।

আজ অল হিজরি ১১১৬ সন সােমবার ১২ই জিলকাদা বাংলা সন ১১১৪-১৭ই চৈত্র।

ইসাহি ১৭০৭-২৬শে মার্চ।

জাহানাবাদ-দিল্লি থেকে বলছি : গতরাতে দৌলতাবাদে বাদশা আওরঙ্গজেবের এন্তেকাল হয়েছে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইল্লা ইলাহে রজেউন। তুমি যে পথে যাচ্ছাে আমরাও সেই পথের অনুগামী। আল্লা আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করুন। তার বয়স হয়েছিল ৮৯। আকবর বাদশার মতােই তিনিও প্রায় অর্ধশতাব্দী হিন্দুস্থানের মসনদে বসেছেন।

কী ব্যাপার? ডক্টর পালিত ছুটে গিয়ে ট্রানজিস্টরটা কঁকাতে লাগলেন। একলাফে তিনশাে বছর পিছিয়ে গেলাম কী করে?

নাছােড় ট্রানজিস্টর তখন বলে চলেছে, এখন হিন্দুস্থানের সামনে বিশাল সংকট। এখন প্রার্থনার সময়। এখন এক হয়ে থাকার সময়। হিন্দুস্থানের শাহেনশা—ইসলামের জিন্দাপির মরহুম বাদশা আওরঙ্গজেবই গুজরাটের রাস্তাঘাট দস্যুমুক্ত করেছিলেন। দক্ষিণের অজম্মা সব সুবায় তিনিই জাতজিরেতের বন্দোবস্ত করে চাষিদের বসিয়ে যান। আজ সেখানে আখ থেকে আঙুর সবই চাষ হয়ে থাকে। তার আমলেই পাঞ্জাবের দোয়ার অঞ্চলে সরেস জমিতে পাঠান আর আফগান অনুপ্রবেশকারীরা চোরাগােপ্তা করে যাচ্ছিল। মনে রাখতে হবে এই পাঠান আর আফগানরাই সব মিলিয়ে মােট চারশাে বছরের ওপর দিল্লিতে সুলতানি করে গেছে। বাদশা আওরঙ্গজেব তাদের হঠিয়ে দেন।

জানলা দিয়ে উক্টর পালিত দেখতে পেলেন একদল কিশাের চলেছে। তাদের মাথায় ফেজ। আগে আগে চলেছেন একজন মৌলবি সাহেব। বিশ্বাস হচ্ছিল না প্রফেসর পালিতের। ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনি থেকে তিনি মৌলবি সাহেবকে বললেন, আদাব আরজ! কোথায় চললেন ? | মৌলবি সাহেব থেমে পড়লেন। বললেন, এইসব মাদ্রাসার বাছাই ছেলেকে নিয়ে বারাণসী যাচ্ছি—

কী ব্যাপার ? ওরা সেখানে আয়ুর্বেদ পড়বে। পরীক্ষা নিয়ে এদের বাছাই করা হয়েছে। চলি—বলে মৌলবী সাহেব ফের রওনা দিলেন।

 প্রফেসর পালিত বিড়বিড় করে বললেন, এটা হল এখন অল হিজরি ১১১৬। ইসাহি ১৭০৭। এখন থেকে হাজার বছর আগে খলিফা হারুণ অল রসিদের আমলে বাগদাদের হাসপাতালে তিনি বারাণসীর কবিরাজ ধন্বন্তরীকে সুপারিনটেনডেন্ট করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তা আজ বাছাই মুসলমান ছেলেরা যে বারাণসীতে আয়ুর্বেদ পড়তে যাচ্ছে এতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু ওরা যাবে কী করে। হিন্দুস্থানের বাদশার এন্তেকাল হয়েছে। নদীতে নদীতে সবরকম খেয়া বন্ধ। বন্ধ সবরকম পালাগান, কথকতা। এখন মন্দিরে প্রার্থনা—মসজিদে মােনাজাত। রাস্তায় রাস্তায় অতি বিশ্বস্ত রাজপুত ফৌজের পাহারা এবার ছড়িয়ে পড়বে।

রাস্তায় বেরিয়ে তিনি দেখলেন, বেশির ভাগ দোকান পাটের ঝাপ বন্ধ। মােড়ে মােড়ে হামামের আসনে বেকার মানুষজনের গুলতানি। এখানে সেখানে দু-একজন ঘােড়সওয়ার। গাছতলায় তাদের ঘােড়া বেঁধে রাখা! একজনকে দেখে মনে হল—তিনি হিন্দু-দেওয়ান খানার দুদে কায়েত আমলা। নিশ্চয়ই ফারসিতে তুখােড় তিনি তর্কাতর্কির ভেতর দিব্যি যুক্তি দিয়ে আওরঙ্গজেবের পাশ ঠেলে কথা বলছেন। কথাগুলাে এরকম—

কে বলেছে বাদশা গান বাজনাকে কবর দিতে বলেছিলেন? ওসব রটনা। আজ তিনি নেই। আমি বলব, যে-মানুষ কথায় কথায় সাদি, হাফিজের রুবাই আওড়াতেন—তিনি কখনােই গানবাজনাকে কবর দিতে বলতে পারেন না। আর যারা বলেন, তিনি হিন্দুদের দেখতে পারতেন না—তাদের কাছে আমি জানতে চাই—কার আমলে হিন্দু মনসবদার সবচেয়ে বেশি হয়েছেন? ভুলে যাবেন না—আওরঙ্গজেব বাদশার আমলেই মারাঠারা সবচেয়ে বেশি মনসবদার হয়েছেন। ভুললে চলবে না—দিল্লির মসনদের লড়াইয়ে বাদশা আওরঙ্গজেবের সেনাপতিদের ২১ জনই ছিলেন হিন্দু। শাহজাদা দারার পক্ষে ছিলেন রাও ছত্রশাল। কিন্তু ছত্রশালের বড়ােছেলে তাে আওরঙ্গজেবের হয়ে লড়েছেন। বাদশা হিন্দু-বিদ্বেষী হলে এইসব তাবড় তাবড় যােদ্ধা কি তাঁর হয়ে লড়তেন?

প্রফেসর পালিত দেখলেন, সারা জমায়েত একদম নিশ্ৰুপ। ওদেরই ভেতর একজন শান্ত গলায় বললেন, সবটাই সাবেক বাদশা শাহজাহানের ভুল। এতকিছু ঘটত না—যদি না তিনি চোখ বুজে শুধু শাহজাদা দারারই নাম করে চলতেন।

কীরকম?

যে জানতে চাইল—তাকে অনেকটা দক্ষিণে নর্দার ওপারে তেলিঙ্গানার দিককার মানুষ মনে হল প্রফেসর পালিতের। রাজধানী দিল্লি-জাহানাবাদ-আগ্রার দিককার হাটে-বাজারের চলতি কলােকিয়াল উর্দু আটকে আটকে যায় লােকটির মুখে। নয়তাে এত ছােট্ট প্রশ্ন করত না। হিন্দুস্থানের নােক দক্ষিণ থেকে উত্তরে এলে এমনই করে থাকে। রাস্তা দিয়ে এইমাত্র একদল রাজপুত ঘােড়সওয়ার শহরের বড়াে চকের দিকে চলে গেল। আজ হামাম বন্ধ।

সেই লােকটি বলল, আমার ঠাকুর্দার বাবার মুখে ছেলেবেলায় একবার শুনেছিলাম—শাহজাহান বাদশা নাকি একবার শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে বরখাস্ত করেছিলেন—দক্ষিণের সুবেদারি থেকে।

সবাই আপত্তি করে উঠল। যাঃ! তা হতে পারে নাকি? শাহজাদা আওরঙ্গজেব অল্পবয়স থেকেই বাহাদুর মানুষ। তাঁকে বাদশা এভাবে বেইজ্জতি করতে পারেন নাকি?

প্রফেসর পালিত মনে মনে বললেন, হ্যা। শাহজাহান বাদশা আজ থেকে প্রায় ৬৩ বছর আগে দক্ষিণের সুবেদারি থেকে শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে বরখাস্ত করেছিলেন। তখন শাহজাদার নওজওয়ান বয়স মাত্র ২৬।

ভিড়ের ভেতর একজন বলল, ১৫/১৬ বছর বয়সেই শাহজাদা বর্শা ছুড়ে খ্যাপা হাতি আটকে বাদশার বাহাদুরি পান। তাঁকে কেন বরখাস্ত করা হবে?

প্রফেসর পালিত নিজে বললেন, হ্যা। আওরঙ্গজেবকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। দারার দিকে বাদশার একপেশে টান—আর অন্য দিকে দক্ষিণে সুবেদারি করতে গিয়ে বাদশার কাছ থেকে সেখানকার অজম্মায় কোনও সাহায্য বা সহানুভূতি না পেয়ে শাহজাদা আওরঙ্গজেব বাদশার খারাপ খারাপ চিঠিই পাচ্ছিলেন শুধু। এইসময় ওদের বড়দি শাহজাদি জাহানারা আগুনে পুড়ে যান। তাঁকে আগ্রায় দেখতে এসে আওরঙ্গজেব শাহি দরবারে-লােকজনের সঙ্গে কথায়বার্তায় বড়েভাই দারার বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথা বলে বসেন। তা কানে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহান বাদশা আওরঙ্গজেবকে বরখাস্ত করেছিলেন। অপমানে আওরঙ্গজেব তাঁর কোমরের তলােয়ার খুলে ফেলেন। ঠিক করেন ফকির হয়ে যাবেন। কিন্তু জাহানারার অনুরােধে শাহজাহান তাকে ফের সুবেদার করেন—তবে গুজরাটের। সেখানে গিয়েও আওরঙ্গজেব বসে থাকেননি। রাস্তাঘাট দস্যুমুক্ত করেছেন। সুবেদারি করতে গিয়ে শাহজাদা সুজা বা শাহজাদা। মুরাদের মতাে তিনি ভােগবিলাস, শিকারে ডুবে থাকেননি। বরং লােকহিতে নেমে পড়েছেন। অথচ সেই নওজওয়ান বয়সে শাহজাদারা তাে ভােগসুখেই ডুবে থাকেন।

এসব কথা গুলতানির ভিড়ে বলে কোনও লাভ নেই। ইতিহাস পড়তে গিয়ে—পড়াতে গিয়ে ডক্টর পালিত নওজওয়ান আওরঙ্গজেবের জেদ, লেগে পড়ে থাকার শক্তির বারবার প্রশংসা না করে পারেননি। হিন্দুকুশ পর্বত উমুরী নদীর গা ঘেঁষে শীতের ভেতর মুঘল ফৌজ নিয়ে ২৮ বছরের আওরঙ্গজেব হিন্দুস্থানে ফিরছিলেন। উমুরী উজবেকরা কসাক ধাচে হামলা করে হয়রান করছে। তুষার পেছল খাড়াই গিরিপথ দিয়ে ফেরা মহা কঠিন। পথে সুরকলি নদীতে দশহাজার সৈন্যই ভেসে গেল। ভেসে গেল কত যে হাতি, ঘােড়া, উট, কামান। শাহজাদা হিন্দুস্থানে ফিরে এলেন। পেছনে পড়ে থাকল জয় করা

বলম্বদান। সমরখন্দ, তৈমুরাবাদ যাবার রাস্তা। হিন্দুকুশের গায়ে উমুরী নদী। বাবর হুমায়ুনের দেশ। যা কিনা জয় করে হিন্দুস্থানের সামিল করার খােয়াব দেখেছিলেন বাদশা শাহজাহান। তাই তাে তিনি শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়েছিলেন। কোটি কোটি টাকার নিষ্ফল অভিযান।

হামামের চাতালের দিকে তাকিয়ে ডক্টর পালিত বুঝলেন, বসে থাকা মানুষজনের কারও বয়স চল্লিশের ওপর নয়। দেওয়ানখানার উঁদে কায়েত আমলাটিই বয়সে সবার চেয়ে বড়াে। তারই বয়স বড়ােজোর ৪৫/৪৬। ওরও জন্মের প্রায় ১২/১৩ বছর আগে শাহজাহান বাদশা শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে কিল্লা কান্দাহার উদ্ধার করতে পাঠিয়েছিলেন। ইরানি ফৌজ কিল্লা দখল করে বসে আছে। খারাপ কামান, ফৌজ নিয়ে আওরঙ্গজেব নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন। তার ওপর খােদ বাদশা কাবুলে বসে চিঠি মারফত লড়াই চালাচ্ছিলেন। আওরঙ্গজেব লড়াইয়ে খােলা হাত পাচ্ছিলেন না। মরিয়া আওরঙ্গজেব বাদশাকে লিখলেন, আমি খােলা তলােয়ার হাতে কিল্লা কান্দাহারের দেওয়াল বেয়ে উঠতে চাই। অনুমতি দিলেন না বাদশা। লিখে পাঠালেন, ঢের হয়েছে। ফিরে এসাে। তুমি অপদার্থ। এত পাঁয়তাড়া—এত খরচের পর ব্যর্থ?

আওরঙ্গজেব যুদ্ধ না করেই গজরাতে গজরাতে ফিরতে বাধ্য হলেন। আমি লড়াই দিয়েও অপদার্থ ? আব্বাহুজুরের হাতে অপমানিত! আর বড়েভাই দু-দুবার কান্দাহার অব্দি এসে দুশমনের মুখােমুখিই হলেন না—অথচ হিন্দুস্থানে ফিরে বাদশার হুকুমে বিজয়ীর সংবর্ধনা পেলেন সব জায়গায় ? এই কি বিচার ? এই কি ইনসাফি? আব্বাহুজুর, আমিও তাে আপনার ছেলে। শহরের রাস্তায় আজ আমির ওমরাহরা খালি পায়ে হেঁটে চলেছেন। তাদের চলাফেরার জন্যে কোনও সুখদোলা নেই। নেই কোনও হাতি ঘােড়া।

 গাড়ি। গাড়ির চাকা হল গিয়ে মানুষের সব চেয়ে বড়াে আবিষ্কার। গতি। গাড়ির চাকাই হল মানুষের আবিষ্কারের ইতিহাস। এই গাড়ি টানা হয় স্কুল পরিশ্রম করে। জীবন এক চলন্ত গতি। মৃত্যু তাতে এক ছেদ। এই জ্বলন্ত গতিময় জীবনই এক ইতিহাস। মুঘল শাহেনশারা রােজকার ইতিহাস লিখিয়ে রাখেন। যাঁরা লেখেন—তাঁরা হলেন ওয়াকেনবিশ। গতকাল সকালে আওরঙ্গজেব তাঁর মৃত্যুর আগে ক-বার নামাজ পড়েছেন তাও নির্ভুলভাবে ওয়াকেনবিশরা লিখে রেখেছেন। ওঁরা মাছিমারা ছাপােষা হিসেবনবিশ মাত্র। প্রতিভাধর নন। একটি ইতিহাসােমিটার কোনও প্রতিভাধর আবিষ্কার করতে পারলে কালের ঘণ্টাধ্বনিরও মানে খুঁজে পাওয়া যেত সহজেই।

ঠিক এই সময় বিশাল এক মিছিল এসে হাজির হল। তাদের হাঁটু অব্দি হিন্দুস্থানের দেহাতি ধুলাে। গায়ের পিরানে, আঙ্গিয়াতেও সেই ধুলাে। তারা বলতে বলতে আসছিল—

আওরঙ্গজেব
চল বসে

আওরঙ্গজেব

অমর রহে

হামামের চাতালে বসা গুলতানির দলটিও এই মিছিল দেখতে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পাহারায় ছড়িয়ে থাকা রাজপুত সেপাইরা ছুটে এসে সবাইকে পাকড়াও করতে লাগল। মিছিলের সবাই ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল। সেই চুঁদে কায়েত আমলার চুলের ঝুঁটি ধরেছে একজন সেপাই। আর সেই আমলা চেঁচিয়ে বলছে—আমায় ছেড়ে দাও। ভালাে হবে না কিন্তু। আমি দেওয়ানখানার দলিল দস্তাবেজ দেখাশুনাের মির মুনশি।

আর মির মুনশি! কে কার কথা শােনে। ডক্টর পালিতও ধরা পড়লেন। সবাইকে হাটিয়ে ঝােড়া মারতে মারতে সেপাইরা যেখানে নিয়ে তুলল—সেখানটা দেখেই চিনতে পারলেন অমল পালিত। এ যে যশিডি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। গত শীতেই তিনি এক বিকেলবেলায় মানসীকে সঙ্গে নিয়ে হাওড়া থেকে এখানে ট্রেনে করে এসে নেমেছিলেন। ক-দিনের ছুটি কাটাতে। সারা বছর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির পর তিনি এক এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে টান টান স্নায়ুগুলাে শিথিল করে নেন। গত বছরের জায়গাটা ছিল এই যশিডি। রেলপ্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরুলেই জায়গাটার নাম বদলে হয়ে যায় দেওঘর। নিচু হয়ে নেমে যাওয়া রাস্তাটা দূরে গিয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে। ওখানে শুকনাে বুক নিয়ে পড়ে আছে দারােয়া নদী। তার গা ধরে কয়েকমাইল হাঁটলে রােহিনী নামে একটা ছােট্ট জায়গা পাওয়া যায়। গত বছর শীতে বেড়াতে এসে এসব দেখে গেছেন ডক্টর পালিত। দেখে গেছেন ছােটো লাইনের রেলগাড়ি। বৈদ্যনাথ ধাম।

হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন—স্টেশন মাস্টারের টেবিলের পাশে ঘরের কোণে সেই অতিকায় কালাে বেড়ালটা বসে আছে। প্রায় বাঘের সাইজের। বেশ লাজুক ভঙ্গিতে সে তাকাচ্ছে। মুখে, গোঁফে কী এক চতুর হাসি। যে কোনও সময় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

স্টেশন মাস্টার ঘরে নেই। পাহারায় রাজপুত সেপাইরাও কোথায় মিলিয়ে গেছে। তিনি বেড়ালটাকে বললেন—যাঃ! যাঃ!

কাউন্টারে টিকিট বিক্রিতে বসা ছেলেটি অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। ডক্টর পালিতকে দেখল। দেখল ধুতি পাঞ্জাবিতে ঢাকা একজন প্রবীণকে। তারপর জানতে চাইল, কাকে ধমকাচ্ছেন?

দীর্ঘকাল ধরে প্রতিভাধর বলে পরিচিত মুখস্থে-ওস্তাদ—পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে সেরা হওয়া ডক্টর পালিত দেখলেন, সেই কালাে বেড়ালটা মিলিয়ে গেছে। থাকলেও বেড়ালটাকে শুধু তিনি একাই দেখতে পেতেন। অতিকায়। কালাে। লাজুক। ঠোটে, গোঁফে চতুর হাসি। যেকোনও মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়তে পারে। টিকিট বেচতে বসা কাউন্টারের ছেলেটি কিছুতেই ওকে দেখতে পেত না। আফসােস। যদি একটা ইতিহাসােমিটার আবিষ্কার করতে পারতাম। টমাস। আলভা এডিশন কিংবা গ্রাহাম বেলের আবিষ্কারের ধাঁচে। টেলিফোন। গ্রামােফোন। সিনেমা। দৃষ্টিকোণ আর দৃষ্টিভঙ্গির মিশেল দিয়ে। ইস! একটা ইতিহাসােমিটার। তাহলেই ঠিক ঠিক জানা যেত আওরঙ্গজেব সত্যি হিন্দু-বিদ্বেষী ছিলেন কিনা। কেননা, মৃত্যুর পর একজন বাদশার একই কাজের নানান ব্যাখ্যা বের করা যায়। তার ভেতর থেকে সঠিকটি বেছে নিতে দরকার হয় একটি ইতিহাসােমিটারের। তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওই অতিকায় কালাে বিড়ালের চতুর হাসি স্ক্যান করে নেওয়া যেত।

এমন সময় প্ল্যাটফর্মে ঝােলানাে লােহার পাটিতে হাতুড়ি মেরে ট্রেন আসার ঘণ্টা হল। ডক্টর পালিত বেরিয়ে এসে দেখলেন লােহার পাটিটি আগাগােড়া—

একটি স্যান্ডাে গেঞ্জি দিয়ে মােড়া। দেখেই চিনতে পারলেন। এ তাে আমার গায়ের গেঞ্জি। কী করে ওখানে গেল?

প্রফেসর পালিত পাঞ্জাবির নীচে হাত দিয়ে দেখলেন—তাঁর গায়ে গেঞ্জি নেই। তিনি চমকে উঠলেন। এ কী করে সম্ভব? পাঞ্জাবি খুললে তবে তাে গায়ের গেঞ্জি খােলা যায়। আশ্চর্য! গায়ে পাঞ্জাবি আছে। কিন্তু নীচে গেঞ্জি নেই। চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর পালিত। কী করে হল? তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারছেন না। তিনি বুঝলেন—সব গুলিয়ে গিয়ে তাঁর মাথার ভেতর যুক্তি সাজানাের সুতােগুলাে পট পট করে ছিড়ে যাচ্ছে। তিনি বুঝলেন, তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। তখন তাঁর মনে হল—এবার আমি ইতিহাসােমিটার আবিষ্কার করে সত্যিই সেরা—সত্যিই প্রতিভাধর হব। কেননা, আমি বুঝতে পারছি—আমার একটা দৃষ্টিকোণ—একটা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *