পাস্তার উৎস সন্ধানে
বেশিরভাগ খাবারের ইতিহাস বইতে পরিষ্কার লেখা আছে, মার্কো পোলো ১২৯৫ সালে কুবলাই খানের দরবার থেকে ইতালিতে ফিরলে তিনিই সঙ্গে করে পাস্তা নিয়ে ফেরেন। একেবারে ভুল কথা। ইতালীয়রা তার অনেক আগে থেকেই পাস্তা খেয়ে অভ্যস্ত। ১২৭৯ সালে পঞ্জিও বাস্তোনে নামের এক মৃত ইতালীয়র ছেড়ে যাওয়া সম্পদের তালিকায় আরও অনেক জিনিসের সঙ্গে এক ব্যাগ শুকনো পাস্তাও ছিল। ময়দা দিয়ে সরু লম্বা খাবার বানানোর প্রচলন অনেক আগেকার। ডিউরাম প্রজাতির বিশেষ এক গম সেমোলিনা থেকে এগুলো বানানো হত। সিমুই বা সেমুই নাম সম্ভবত সেমোলিনা থেকেই এসেছে। চিনারা অবশ্য চালের গুঁড়ো বা রাগি থেকেও নুডল বানাত। কিন্তু এর শুরু ঠিক কবে, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরাও দ্বিধান্বিত। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এট্রুস্কান সভ্যতার এক শিলালিপিতে নাকি পাস্তা বানানোর যন্ত্রের ছবি সহ বর্ণনা আছে। রোমানদের নিজস্ব পাস্তা ডিশ ছিল। রোমান লাসানাম বা রান্নার কড়াই থেকে আসা সেই পাস্তা আজও লাসানিয়া বা লাসানে নামে রেস্তোরাঁ আলো করছে। ১১৫৪ সালে সিসিলির পালের্মোতে রীতিমতো ডিউরাম গমের ময়দা দিয়ে লম্বা লম্বা নলের মতো পাস্তা বানানো হত। এই ময়দায় গ্লুটেন বেশি, তাই যা খুশি আকার দেওয়া যেত সহজেই। পাস্তা ধীরে ধীরে ইতালীয়দের পেড়ে ফ্যালে। ঘুমের মধ্যেও তারা পাস্তার স্বপ্ন দেখত। ১৩৫১ সালে বোকাচিও তাঁর বিখ্যাত বই ডেকামেরনে এমন এক কাল্পনিক দেশের কথা লেখেন, যেখানে পাহাড়গুলো সব চিজ দিয়ে তৈরি আর তা বেয়ে সেখানকার অধিবাসীরা রোল করছে একের পর এক সুস্বাদু পাস্তা। ১৩০০ সনের দিকে পাস্তা এর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ করার সুবিধা এবং পুষ্টিগুণের জন্য লম্বা সমুদ্রযাত্রায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এদিকে ইতালিতে পাস্তা ধীরে ধীরে উত্তরে নেপলসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সপ্তদশ শতকে এটি নেপলসে জেঁকে বসতে সক্ষম হয়। ১৮৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইতালীয় Risorgimento-এর সময় এটি মুখ্য খাবারের একটিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইতালীয় সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গিসেপ্পো গ্যারিবল্ডি ১৮৯১ সালে পেল্লেগ্রিনো আরটুসির লেখা “La Scienza in cucina e l’Arte I Mangiar bene” নামের বইয়ের দারুণ প্রশংসা করে সবাইকে পড়তে বলেছিলেন। মজার ব্যাপার, বইটি লেখা হয়েছিল পাস্তাকে কেন্দ্র করেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা থেকে ইতালিতে আগত টমেটো সসকে ইতালীয়রা শুরুতে স্বাগত জানায়নি। ধীরে ধীরে এই ভুল ধারণা কেটে যায়। পাস্তায় এর ব্যবহার হতে বাধা থাকে না। টমেটো সস ছাড়া পাস্তা এখন ভাবাই যায় না।
রাজনীতিতেও পাস্তাকে ব্যবহারের উদাহরণ আছে। মুসোলিনি ঠিক করলেন ইতালির এই জাতীয় খাদ্য উৎপাদনের জন্য আরও বেশি জমিতে ডিউরাম গম লাগানো হবে। বিরোধীরা উলটো প্রচার করে দিলেন। বললেন মুসোলিনি নাকি পাস্তা ব্যান করতে চলেছেন। ব্যস! আর যায় কোথায়? প্রাণ যায়ে পর পাস্তা না যায়ে। গোটা ইতালিতে দাঙ্গা বেধে গেল। বিশ শতকের শুরুর দিকে ইতালিতে ফিউচারিস্ট আঁকিয়েদের গোষ্ঠী প্রথম পাস্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। তাঁরা যে-কোনো অধীনতার বিরোধী ছিলেন। এমনকি সেটা পাস্তার হলেও। এই আন্দোলন বেশিদিন টেকেনি। মুশকিল হল আন্দোলনকারীরাই খিদে পেলে পাস্তা খেয়ে পেট ভরাতেন।
পাস্তা মূলত দু প্রকার: pasta fresca (টাটকা, যা কিনা বানাবার পরপরই রেঁধে খেয়ে ফেলা হয়) ও pasta secca (শুকনো, যেটা সেই মরা মানুষের সম্পত্তিতে পাওয়া গেছিল)। এই দুরকম পাস্তাকে ছশোর বেশি প্রকারে ভাগ করা সম্ভব, যার প্রত্যেকটিই অন্যটি থেকে কোনো-না-কোনোভাবে আলাদা ও অনন্য। পাতলা পাত, ফলা কিংবা লম্বা সুতোর ন্যায়, সিলিন্ডার আকৃতির, নানা আকারের ও স্বাদের এবং নানা আঞ্চলিক ধরনের পাস্তার অস্তিত্ব এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান। তাদের নামও অনেকরকম। সব মনে রাখা সম্ভব না। ঘণ্টার মতো দেখতে ক্যাম্পানোলি, শামুকের খোলের মতো দেখতে কনচিগ্লি, চাকতির মতো করজেট্টি, প্রজাপতির মতো ফারফ্যাল্লে, টিউবের মতো বোকাটিনি… কত বলব? তবে বিশ্বে যত পাস্তা বিক্রি হয় তার তিন ভাগের দুই ভাগ হল স্প্যাগেটি। মানে সরু দড়ি। এখানে জানিয়ে রাখি, গ্যালিলিও তাঁর সেই বিখ্যাত বল আর দড়ির পরীক্ষায় লিখেছেন, ‘attached two balls to spaghetti’। ১৮৩৬ সালে, মানে হালেই এই ধরনের পাস্তাকে এই নামে ডাকা শুরু হয়। এই পাস্তা বানানো সহজ, রান্না সহজ, মেশিনে বানানো যায় হাজার হাজার টন, ফলে দাম কম। শ্রমিক আর নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যে এই পাস্তার জুড়ি নেই। তবে ইতালীয়রা আমেরিকায় গিয়ে এই পাস্তা এত জনপ্রিয় করে দেয় যে সস্তা আর কম বাজেটের ওয়েস্টার্ন মুভিকেও স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন নামে ডাকা শুরু হয় (দি গুড, দি ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি এই ধরনের ছবির সেরা উদাহরণ)। বার্লি থেকে তৈরি পাস্তাকে বলে ম্যাকারনি, যা গ্রিক মাকারিয়া থেকে এসেছে। মানে? বার্লি থেকে তৈরি।
স্প্যাগেটিকে আরও সরু সরু সুতোর মতো করলে যা তৈরি হবে, তার নাম ভার্মিসেল্লি বা ছোটো কেঁচো। এটা আমরা দুধ দিয়ে, চিনি দিয়ে সিমাইয়ের পায়েস বানিয়ে খাই। পাস্তার দুই পরতের মাঝে পুর ভরা থাকলে তাকে বলে র্যাভিওলি বা টরটেলিনি (ছোটো কেক)। এই টরটেলিনি নিয়ে একটা দারুণ গল্প আছে। বলার লোভ সামলানো মুশকিল। বিখ্যাত ইতালিয়ান সুন্দরী লুক্রেসিয়া বোরজিয়া একবার মোদেনার এক হোটেলে এসে ওঠেন। তাঁকে দেখে হোটেলের মালিক এতটাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে লুকিয়ে তিনি লুক্রেসিয়ার কামরার চাবির ফুটোয় চোখ রাখেন। ঘরে লুক্রেসিয়া তখন উলঙ্গ। কিন্তু মৃদু আলোতে সেই মালিক লুক্রেসিয়ার নাভি শুধু দেখতে পান। সেই রাতেই নাভি দর্শনের সেই স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে তিনি লুক্রেসিয়ার নাভির মতো দেখতে এক পাস্তা বানান। সেই পাস্তাই টরটেলিনি।
এই গল্পের পর আর কিছু বলা যায় না। পাস্তা তবে এই অবধিই থাক।
পিজ্জা কি সত্যিই ইতালিয়ান?
পাস্তা খাঁটি ইতালির হলেও পিজ্জা একেবারেই অনুপ্রবেশকারী। হাজার বছরেরও আগে গ্রিক আর পারস্যে ব্যাপক হারে পিজ্জা খাবার প্রচলন ছিল। সম্রাট প্রথম দরায়ুসের সৈন্যরা নাকি সেই ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই আগুনের উপরে লোহার ঢাল রেখে তাতে মোটা রুটি, চিজ আর খেজুর মিশিয়ে পৃথিবীর প্রথম পিজ্জাটি বানান। একই সময় গ্রিকরাও চিজ আর অলিভ অয়েল দিয়ে এক মোটা রুটি বানাতেন। নাম ছিল পিত্তা। অনেকেই ভাবেন এই পিত্তাই পরে পিজ্জা নাম নিয়েছে। অবশ্য অন্য মতও আছে পিজ্জা কথাটা নাকি জার্মান পিজ্জো থেকে এলেও আসতে পারে। পিজ্জো মানে চিবানো। তবে লিখিত ভাবে প্রথম পিজ্জা শব্দটা দেখা যায় ইতালিতেই। নাপেলসের কাছে এক ল্যাটিন পাণ্ডুলিপিতে পিজ্জা তৈরির রেসিপি পাওয়া গেছে। সে পাণ্ডুলিপিও বহু পুরোনো, ৯৯৭ অব্দের। ধীরে ধীরে পিজ্জাও পাস্তার মতো ইতালির খাবার হয়ে ওঠে। বাচ্চা বুড়ো, গরিব বড়োলোক, সবাই পিজ্জায় মেতে গেল।
একেবারে শুরুতে টপিং হিসেবে দেওয়া হত টমেটো, অরিগানো, রসুন আর অলিভ অয়েল। নেপলসের এই আদিমতম পিজ্জা এখনও পাওয়া যায় মারিয়ানা পিজ্জা নামে। নাবিক বা মেরিনাররা এই পিজ্জার ভক্ত ছিল, সেই থেকে এমন নাম। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, বহুদিন পর বাড়িতে ফিরে আসা নাবিকদের জন্য নাকি এই পিজ্জা রেঁধে রাখতেন তাঁর গিন্নি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিজ্জাদের মধ্যে একটা হল পিজ্জা মার্গারিটা। মার্গারিটা মারিয়া থেরেসা জিওভান্না ১৮৭৮ সালে ইতালির রানি হন। তাঁর মতো জাতীয়তাবাদী, সুবক্তা, কলার সমঝদার রানি তখনকার দিনে (এখনও) বিরল। তাঁর নামেই আফ্রিকার তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ মার্গারিটা পিকের নাম রাখা হয়েছিল। ১৮৮৯ সালে তিনি নেপলসে এলে পিজারিয়া দি পিয়েত্রোর মালিক কাম হেড শেফ রাফাল এস্পোসিতো ইতালির জাতীয় পতাকা সবুজ, সাদা আর লালে রাঙানো (চিজ, টমেটো আর পুদিনা পাতা মিশিয়ে) এক পিজ্জা বানিয়ে রানিকে উৎসর্গ করেন। আজও সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অরিজিনাল পিজ্জা এই পিজ্জা মার্গারিটা।
পাস্তার মতো পিজ্জাও ইতালীয়দের হাত ধরে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। ১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পিজ্জারিয়া বা পিজ্জার দোকান গড়ে ওঠে মানহাটানের স্প্রিং স্ট্রিটে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল এর প্রতিষ্ঠাতা জেনারো লোম্বারডি-র নামানুসারে ‘জি লোম্বারডিস।’ এখনও সেই আগের স্বাদের পিজ্জা বিক্রি করে যাচ্ছে এই দোকান, যদিও ১৯০৫ সালের সে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। পিজ্জার আসল জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ‘পিজ্জা হাট’-এর মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৯ সালে ‘লিটল সিজারস’, ১৯৬০ সালে ‘ডমিনোস’ এবং ১৯৮৯ সালে ‘পাপা জনস’-এর মতো বিখ্যাত পিজ্জা কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠার পর পিজ্জা পৌঁছে যেতে থাকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে। এখন তো শুধু ফোনের অপেক্ষা আর গরম গরম পিজ্জা নিয়ে পিজ্জাবালক আপনার দরজায় কড়া নাড়বে, থুড়ি কলিং বেল বাজাবে।
চাউমিন আর চপস্যুই
আমরা যতই চাউমিন বলি না কেন, আসলে এ জিনিস নুডলস ছাড়া কিছু না। নুডলস খাওয়ার সবথেকে পুরোনো নিদর্শন রয়েছে ৪০০০ বছর আগেকার চিনে। ২০০৫ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে কাজ করার সময়ে মাটির পাত্র খুঁজে পান, যেখানে ফক্সটেইল মিলেট এবং ব্রুমকর্ন মিলেটের সন্ধান পাওয়া যায়। এই দুটোই লাগে নুডলস তৈরিতে। নুডলসের লিখিত নথি প্রথম পাওয়া যায় ২৫-২২০ সালের মধ্যে পূর্ব হান সাম্রাজ্যকালে লেখা একটা বইতে। গমের ময়দা থেকে তৈরি নুডলস হান রাজত্বের প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়। ট্যাং সাম্রাজ্যকালে সর্বপ্রথম নুডলস কেটে সুতোর মতো তৈরি করা হয়। ইউয়ান রাজত্বকালে শুকনো নুডলস তৈরির প্রচলন হয়। নবম শতকের শুরুর দিকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে চিনের গমের নুডলস জাপানে আসে। ১৩ শতকে পারস্যের জনগণ নুডলস খেত প্রমাণ আছে। বিভিন্ন উপাদান থেকে নুডলস তৈরির গবেষণা চলতেই থাকে। ১৯২ থেকে ১৮৯৭ সালে কোরিয়ার জোসেয়ন রাজত্বকালে বাজরা থেকে নুডলস তৈরি আবিষ্কার হয়। চাইনিজ নুডলসের উপর ভিত্তি করে তৈরি র্যামেন নুডলস ১৯০০ সালে জাপানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চাউমিন শব্দটা এসেছে চিন দেশের তাইশানের শব্দ শব্দ চাউ-মেইং থেকে। মানে ভাজা নুডলস। দোকানে দোকানে নুডলস কেবলই এক খাবার হয়ে রয়ে যেত, যদি না এক ভদ্রলোক আসতেন। ইনি একা হাতে নুডলসকে শেফের হাত থেকে একেবারে নবিশ রাঁধুনির কাছে পৌঁছে দেন। ভদ্রলোকের নাম জুলিয়াস ম্যাগি।
১৮৭২ সাল। সুইজারল্যান্ড৷ জুলিয়াস ম্যাগি খুঁজে বেড়াচ্ছেন চটজলদি পুষ্টিকর খাবারের রেসিপি৷ কারণ সুইস সরকারের নির্দেশ। মহিলারা বেশিরভাগ সময়েই বাইরে কাজ করেন, আবার সরকারি কর্মীরা যাতে কাজে ফাঁকি দিয়ে খাবারের পিছনে বেশি সময় নষ্ট না করেন, সেই কারণেই এমন সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছিল৷ তাই এমন খাবার চাই, যা বানাতে বেশি সময় লাগবে না, আবার পুষ্টিকরও হবে৷ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আবিষ্কার ম্যাগির রেসিপি৷ যদিও সেসময়, নুডলস নয়, ম্যাগি ছিল কেবলই ‘ফ্লেভার’৷ ১৮৭২ সালেই বাবার মিলের কাজ দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়ে জুলিয়াসের হাতে৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিখ্যাত ফুড প্রোডাকশন গড়ে তোলেন তিনি৷ ম্যাগির ফ্লেভার আবিষ্কার করার পরেই জার্মানিতে তিনি নতুন কোম্পানি তৈরি করেন৷ সেটা এখনও সেখানেই আছে৷ নুডলসের আগে ম্যাগি ছিল শুধুই মশলা, যা জলে গুলে সহজেই স্যুপ তৈরি করা যেত৷ মোট তিন রকমের ফ্লেভারের মশলা বাজারে নিয়ে আসেন জুলিয়াস৷ এর প্রায় বেশ কয়েক বছর পরেই আসে হাতবদলের পালা৷ ১৯৪৭ সালে ম্যাগির ‘রাইট’ কিনে নেয় নেসলে কোম্পানি৷ এদিকে সেই ১৮৫৮ সালে জাপানের ‘নিশিন ফুডস’-এর আবিষ্কারক মুমুফুকু আনদু সর্বপ্রথম ইনস্ট্যান্ট নুডলস তৈরি করেছিলেন। ১৮৫৮ সালেই তাঁরা ‘চিকিন র্যামেন’ কোম্পানি শুরু করেন। নেসলে ম্যাগির মশলা সঙ্গে দিয়ে সেই ইনস্ট্যান্ট নুডলস বাজারে আনলেন। রং দিলেন হলুদ-লাল। সমীক্ষায় দেখা গেছে এই দুই রংই নাকি খিদের ভাব জাগ্রত করে। ভারতের বাজারে ছড়িয়ে পড়ে ম্যাগি নুডলস৷ এরপরেই চড়চড় করে জনপ্রিয়তা পায় ম্যাগি৷ শুধু নুডলস নয়, ম্যাগি সস, পরে ম্যাগি মশলাও বাজারে বিকোতে শুরু করে হুহু করে৷ মাত্র দুই মিনিটে বানানো না গেলেও সস্তায় পুষ্টিকর খাবার (!) হিসেবে এর জুড়ি নেই।
চপস্যুই নিয়ে অবশ্য দারুণ একটা গল্প প্রচলিত। সত্যি মিথ্যে জানা নেই। এক রেস্তোরাঁয় গভীর রাতে একদল গোল্ডমাইনার এলেন। হাতে বিপজ্জনক সব অস্ত্র। পেটে বুভুক্ষু খিদে। রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার সব বাড়ন্ত। কুক ছিল যে চিনা লোকটি, সে সাফ জানাল খাবার শেষ। কিন্তু এঁরা ভালো কথায় মানার লোক না। খেতে দাও নইলে প্রাণ দাও। ঠেলার নাম বাবাজি। বেচারা যা যা বেঁচে ছিল, তরিতরকারি, মাংসের কুচি, মাছের টুকরো, সব মিলিয়ে মিশিয়ে সস দিয়ে নুডলস দিয়ে পেশ করল। খিদের মুখে তাঁদের অমৃতসম লাগল এই খাবার। জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম এই খাবারের? চিনা শেফ বাঁকা হেসে বলল ‘চপস্যুই’, ক্যান্টনিজে যার মানে ফেলা ছড়ানো খাবার। ইউরোপিয়ান মাইনাররা তো দারুণ খুশ। তবে অনেকে আবার এই গল্প মানেন না। তাঁদের মতে চিনারা আমেরিকায় এলে তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন। তাই ফেলে দেওয়া মাংস বা সবজির টুকরো দিয়েও খাবার রেঁধে খেতে হত তাঁদের। আর সেই দারিদ্র্য থেকেই চপস্যুই-এর উদ্ভব। তাই মেনল্যান্ড চায়নায় বসে মহার্ঘ চপস্যুই খেতে খেতে মনে রাখবেন আদতে এটা কিন্তু একটি আদর্শ প্রোলেতারিয়েত খানা।
ডিমসাম কিংবা মোমো
সেই সূদূর অতীতে চীনাংশুক বা চিনা সিল্ক যখন ছড়িয়ে পড়ছিল দেশে দেশে, তখন তাঁদের সেই চলার পথে, সেই সিল্ক রুটে গজিয়ে উঠেছিল প্রচুর চায়ের দোকান। প্রথমে মনে করা হত চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু খেলে মানুষ অহেতুক মোটা হয়ে যায়। পরে যখন জানা গেল চা নিজেই হজমের কাজ করে, তখন চায়ের সঙ্গে অনুপান হিসেবে নানা স্ন্যাক্স খাওয়া শুরু হয়। ঠিক সেই সময় থেকেই তেলবিহীন স্টিমে সিদ্ধ মাংসের পুরে ভরা ডিমসাম চিনাদের রসনাকে তৃপ্ত করেছিল। চিনা ভাষায় ডিম মানে হৃদয় আর সাম মানে তৃপ্তিদায়ক। মনোহরা এই খাবার ধীরে ধীরে চায়ের অপরিহার্য সঙ্গী হয়ে ওঠে। চিনারা ইয়ুম চা বললে শুধু চা না, চায়ের সঙ্গে ডিমসাম খাওয়াও বুঝত। কীভাবে চায়ের সঙ্গে ডিমসাম খেতে হবে তা নিয়ে আস্ত বই লেখা হয়েছে চিনদেশে। ভাবা যায়! মার্কো পোলো চিনদেশ ভ্রমণে এসে অন্য অনেক কিছুর মতো ডিমসামকেও ইউরোপে পরিচিত করান। এই ডিমসামই যখন তিব্বত ঘুরে রেশম ব্যবসায়ীদের হাত ধরে নেপালে এল, নাম নিল মোমো। মোমো মানে ভাপে রান্না করা। প্রথাগতভাবে এই খাদ্য তৈরির সময় চমরী গাই-এর মাংসকে পুর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভারতে মুরগি ও মোষের মাংস দিয়ে তৈরি মোমোই বেশি জনপ্রিয়। আমিষ মোমোর পাশাপাশি নিরামিষ মোমোও হয়ে থাকে। অনেকের হয়তো মনে আছে ফেলুদা আর জটায়ুকে সেই কাঠমান্ডু পাড়ি দিতে হয়েছিল মোমো খাবার জন্য। ২০০০ সালের মাঝামাঝি ভারতের সমস্ত মেগাসিটিতে এই খাবারটি ছড়িয়ে পড়ে। আর এখন তো পাড়ায় পাড়ায় মোমোর স্টলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। মোমোর দোকানের নাম আগে নেপালি রাখা হত অথেন্টিসিটি বোঝাতে। বাঙালি মোমো বিক্রেতার দোকানের নাম ‘হামরো মোমো।’ আজকাল সেই বালাই নেই। জয় মা তারা মোমো সেন্টার বা বাবা লোকনাথ মোমো আমি নিজে দেখেছি। ক্রসওভারের চরম আর কী!
পিকিং-এর হাঁস এবং হাজার বছরের পুরোনো ডিম
চিনাদের খাবারের মধ্যে অন্যতম সেরা ডেলিকেসি হল পিকিং ডাক। ব্যাপারটা আর কিছুই না, মোটাসোটা একটা গোটা হাঁসের কচমচে রোস্ট। কিন্তু এই পিকিং ডাক রান্না আবিষ্কারই হত না, যদি না মিং বংশের রাজারা নানকিং থেকে পিকিং-এ রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যেতেন। নানকিং-এর হাঁসেরা ছিল ছোটো আর তাই তেমন ভালো রোস্ট হত না। রাজধানী পিকিং-এ নিয়ে যাবার সময় মালবাহী সব জাহাজ থেকে প্রচুর খাদ্যকণা জলে পড়ে যায়। আর সেই খাবার খেয়ে নানকিং-এর নদীনালার হাঁসরা বেশ ফুলেফেঁপে মোটাসোটা হয়ে যায়। যত দিন যেতে লাগল, এই হাঁসেরা আর ডায়েট কন্ট্রোল না করতে পেরে আকারে বড়ো হল আর পিকিং-এর রাঁধুনিরা এদের রোস্ট করে রাজার পাতে উপস্থিত করতে লাগল। একসময় জাহাজ চলা বন্ধ হল। কিন্তু ততদিনে পিকিং ডাকের চাহিদা বেড়েছে। সাধারণ হাঁসকেই প্রচুর গিলিয়ে গিলিয়ে মোটা করা হত, যাতে তার মাংস আরও মুচমুচে, আরও সুস্বাদু হয়। চিনারা ধীরে ধীরে হাঁসের চামড়াকে সুন্দর বাদামি সোনালি রং দেওয়া শিখল। সেই চামড়া অবশ্য রাজারা খেতেন না। তাঁরা শুধু ভিতরের নরম মাংসটা খেতেন। চামড়া খেত চাকর খানসামারা। ব্রিটেনে অবশ্য এই রান্নাকে ক্রিস্পি অ্যারোমেটিক ডাক নামে ডাকা হয়, যদিও আসলে তা পিকিং ডাকই।
হাজার বছরের পুরোনো ডিম কিন্তু হাজার বছর পুরোনো না। সেইরকম হলে সেই ডিম আদৌ খাওয়া যেত কি না সন্দেহ। তবে এই রেসিপি হাজার বছরের বেশি পুরোনো। হাঁস, কোয়েল বা মুরগির ডিমকে ক্ষারীয় মাটি মিশিয়ে বহু বছর রেখে দেওয়া হয়। গল্প আছে একবার এক চিনা মিস্ত্রি নাকি বাড়ি বানাতে গিয়ে নিচে চাপা পড়া বেশ কিছু ডিম অক্ষত অবস্থায় পান। সাহস করে খেয়ে দেখেন, খেতে মন্দ নয়। সেই নাম না-জানা ভদ্রলোকই নাকি হাজার বছরের ডিম সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। মাটির সঙ্গে নুন মেশানোও নাকি তাঁরই প্ল্যান।
প্রথমে কাদা মাখিয়ে ডিম একশো দিন রেখে দেওয়া হত, যতক্ষণ না ডিমের সাদা অংশ কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এখন অবশ্য মাস প্রোডাকশনের যুগে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই এই কালচে রং আনা সম্ভব হচ্ছে। চিন, বর্মা, জাপান, হ কং-এ রাস্তায় স্ট্রিট ফুড হিসেবে, বিয়েবাড়ি, অনুষ্ঠানবাড়িতে এই ডিম থাকবেই। এই ডিমের ডেভিল নাকি দুরন্ত খেতে। যাঁরা খেতে চাইছেন তাঁদের একটা কথা জানিয়ে রাখি। এতদিন রেখে দেওয়ায় ডিমের প্রোটিনের একটা অংশ অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়, আর সেই গন্ধ ডিমে কামড় দিলেই পাবেন। শুরুতে বলা হত এই ডিম নাকি তিন মাস মূত্রের জালায় ডুবিয়ে রাখা হয়। ভাবা আশ্চর্য না, কারণ খেলেই আপনার মনে হতে পারে, ‘গন্ধ শুঁকে মরতে হবে এ আবার কী আহ্লাদ? থাইল্যান্ডে তাই এর নাম থাই ইউ মা, মানে ঘোড়ার মূত্রে ডোবানো ডিম।
একবার চিন ভ্রমণকালে রবি ঠাকুর সহ শান্তিনিকেতনী অতিথিদের নাকি চিনারা এই ডিম দিয়ে বরণ করেছিল। বেশ গাঢ় নীল ডিমগুলো খেয়ে নন্দলাল বসু কোনোক্রমে টিকে গেলেও ক্ষিতিমোহন সেন মশাইয়ের সারারাত বারেবারে বমি বাহ্যে অবস্থা খারাপ। সবারই প্রায় সেই দশা। ব্যতিক্রম একমাত্র গুরুদেব স্বয়ং। তিনি বেশ কটি ডিম খেয়েও স্থির। সবাই অবাক। পরে জানা গেল গুরুদেব নাকি প্রায় ম্যাজিকের কায়দায় ডিমগুলোকে মুখে না ঢুকিয়ে দাড়ির আড়ালে বুকে পাতা ন্যাপকিনের তলা দিয়ে শিল্পীসুলভ কৌশলে সরাসরি জোব্বার পকেটে চালান করেছিলেন। সাধে কি বলে গুরুদেব!