ইতরবিশেষ
ডিটেকটিভ কল্কেকাশি ডালহৌসি এলাকার একটা ন’তলা বাড়ির ছ’তলায় উঠলেন। এই তল্লাটে কাল সকালে একটা নয়-ছয় হয়ে গেছে— ওই তলাতেই। গেজেটেড অফিসার১ শ্রী এস চৌধুরী নিজেকে শেষ করেছেন ছ’তলার থেকে লাফিয়ে পড়ে।
নামজাদা সরকারি কর্মচারী শ্রী এস চৌধুরী। একটা বিভাগের হর্তাকর্তা দণ্ডমুণ্ডবিধাতা। সম্প্রতি প্রমোশন পেয়েছিলেন, পদ্মবিভূষণ২ হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছিল। চিরকুমার মানুষ, সংসারের কোনও ঝুট-ঝামেলা নেই, রেস খেলেন না, মদ্যপায়ী নন, কোনও বদখেয়ালের কথা শোনা যায়নি কখনও, দেনা-পত্তর ছিল না। প্রচুর অর্থ, ভালো স্বাস্থ্য, অঢেল স্বাচ্ছন্দ্য। এমন লোকের হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসার কোনও মানে হয় না। তেমন কিছু কারণ ছিল না কোনও।
পুলিশও কোনও কারণ খুঁজে পায়নি। পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় পাকস্থলীতে মাদকের চিহ্নমাত্রও পাওয়া যায়নি। ‘সাময়িক উন্মাদনার বশে আত্মহত্যা’ করোনোরের রায়ে মঞ্জুর হয়েছে।
পুলিশি তদন্তের যবনিকাপাত ওইখানেই।
কিন্তু ডিটেকটিভ কল্কেকাশির কাছে ব্যাপারটা রহস্যময় বলে বোধ হয়েছে। সাফল্যের চূড়ায় বসে কেউ কি নিঃশেষ হতে চায়, নিজেকে বিনষ্ট করে যায়— এটা যেন কী রকম?
কালকের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আজকের খবর কাগজে পড়ে তাঁর মনে হল রহস্যটার একটা কিনারা হওয়া দরকার।
লিফট তাঁকে টেনে তুলে অকুস্থলের কিনারায় পৌঁছে দিল।
লিফট থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে তিনি এসে চৌধুরী মার্কামারা নেমপ্লেটওয়ালা চৌধুরী সাহেবের চেম্বার পেলেন। এগিয়ে গেলেন ভেতরে।
শূন্য ঘরের একান্তে এক টেবিলে চুপ করে বসে তাঁর একান্ত সচিব। টাইপরাইটার সামনে নিয়ে একটি সুসজ্জিতা তরুণী।
‘নমস্কার!’ বলে মেয়েটি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে দিল— ‘বসুন’।
‘আপনি… আপনি কি চৌধুরীসাহেবের স্টেনো…?’
‘স্টেনো কাম সেক্রেটারি। আমার নাম মিস সমাদ্দার। মিস শীলা সমাদ্দার। কী জানতে চান বলুন আমার কাছে?’
‘তথ্য যা কিছু জানবার তা সবই তো প্রায় জানা হয়ে গেছে— সে বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা নেই’, বললেন কল্কেকাশি; ‘আমি কেবল ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে চাইব, যদি আপনি কিছু না মনে করেন।’
‘না না, কী মনে করব! এ বিষয়ে আপনাদের সবরকম সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত।’ জানালেন শীলা সমাদ্দার।
‘আচ্ছা মিস সমাদ্দার, ইদানীং চৌধুরীসাহেবের কি কোনও ভাবান্তর আপনি লক্ষ্য করেছিলেন?’
‘ভাবান্তর? তা বলতে পারেন বটে। তাঁর অন্তরের ভাব একটু একটু যেন আঁচ পাচ্ছিলাম ইদানীং…’
‘চৌধুরীসাহেবের বয়েস কত হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?’
‘তা পঞ্চাশ পেরিয়েছিল বোধ হয় চৌধুরীর, আই মিন… মিস্টার চৌধুরীর। প্রৌঢ়ই বলতে হবে, যদিও তাঁকে দেখাত যুবকের মতোই।’
‘বটে? তা, আপনি কি তাঁকে নাম ধরে ডাকতেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, কিছুদিন থেকে আমাদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতা… একটু বন্ধুত্বের সম্পর্ক— মানে, বেশ কিছুদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করলে যা হয়ে থাকে—’ বলে শীলাদেবী সলজ্জ চোখ দুটি নামালেন।
‘হ্যাঁ, তা তো হওয়ার কথাই।’ সায় দিলেন কল্কেকাশি। ‘কতদিন ধরে আপনি এখানে কাজ করছেন?’
‘অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম। ট্রান্সফার হয়ে এই ডিপার্টমেন্টে এসেছি আজ মাস তিনেক— প্রথম মাসটা তিনি আমাকে প্রায় লক্ষ্যই করেননি।’
‘মানে, তিনি লক্ষ্য ঠিকই রেখেছিলেন বলা যায়। আপনাকে না জানতে দিলেও আপনার ওপর বেশ নজর ছিল তাঁর। তাই না?’
‘তা ঠিক।’ মেনে নিলেন শীলাদেবী। ‘আপনারা ডিটেকটিভ মানুষ। সবকিছু ধরতে পারেন ঠিক ঠিক। ঘুরেফিরে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছবেনই আপনারা।’
‘বিলক্ষণ!’ বলে কল্কেকাশি মৃদু হাসলেন। ‘তারপর?’
‘প্রায় মাসখানেক আগে শৈলেশবাবু কী রকম হয়ে যেন তাঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন একদিন। এলেন আমার ঘরে… আমি তখন টাইপ করছিলাম। এ রকমটা আগে কখনও তাঁকে দেখিনি। এসে দাঁড়ালেন আমার টেবিলের সামনে..’
‘তারপর?’
‘চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। কী যেন বলবেন, বলতে পারছেন না মুখ ফুটে। কী রকম নার্ভাস যেন। তারপরে সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললেন কোনোরকমে… মিস সমাদ্দার আজ সন্ধেয় তোমার সঙ্গ কি আমি পেতে পারি? এখন… যদিও আমার এক তরুণ বন্ধু আছে যার সঙ্গে রোজ আমি বেরুই তবুও মনিবের মন রাখতেই হয়… আমি বললাম, মিস্টার চৌধুরী আপনি কী বলছেন?…’
‘মানে আপনি রাজি হয়ে গেলেন?’
‘হ্যাঁ। আমি বললাম, মিস্টার চৌধুরী আপনি কী বলছেন। আপনার সঙ্গে আমি বেরুব না? তারপরে আপিস থেকে একসঙ্গে বেরুলাম আমরা একটা ট্যাক্সিতে। গেলাম একটা সিনেমায়। সেখান থেকে গ্র্যান্ডে৩। সিনেমায় আর ডিনারে সেদিন প্রায় সত্তর আশি টাকার মতোন খরচ হয়েছিল চৌধুরীর। অথচ আপিসের লোকদের কাছে শুনতাম উনি নাকি হাড় কেপপন।…’
‘তারপর গ্র্যান্ড হোটেলের ফেরতা?’ শুধালেন কল্কেকাশি।
‘হোটেলের থেকে আবার একটা ট্যাক্সি করে উনি আমাকে নিয়ে পৌঁছে দিলেন আমার ফ্ল্যাটে…’
‘আপনার ফ্ল্যাটে?’
‘হ্যাঁ, আমরা অফিসের কয়েকটি মেয়ে মিলে পাশাপাশি কয়েকটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থাকি সি-আই-টি বিল্ডিংয়ে৪।’
‘বুঝেছি। তারপর?’
‘আমাদের বাড়ির গেটে এসে তিনি আমার হাতখানি নিজের মুঠোর মধ্যে ধরলেন। আমি তাঁকে বাধা দিলাম না। হাত ধরলে আর কী যায় আসে? তাতে আমি কোনও দোষ দেখলুম না। তারপর উনি বললেন, চলো, তোমার ঘরটা কেমন গোছানো দেখে আসি। আমি বললুম, আসুন, কিন্তু ইতরবিশেষ কিছু হবে না তো? তিনি জবাব দিলেন, না, না, ইতরবিশেষ কিছু নয়।’
‘উনি গেলেন আপনার ঘরে?’
‘হ্যাঁ। গেলেন। কিছুক্ষণ থাকলেনও। না, ইতরবিশেষ কিছু ঘটেনি। তারপর কয়েকদিন বেশ কাটল। কিছু হল না। তারপর আবার একদিন চৌধুরী এসে বলল, ‘থিয়েটারের দুখানা টিকিট কেটেছি। শীলা, চলো আজ আমরা থিয়েটারে যাই!’
‘গেলেন থিয়েটারে নিশ্চয়ই?’
‘গেলাম। থিয়েটার থেকে প্রিন্সেসে। সেখানে খাওয়া সেরে ট্যাক্সি করে রেড রোডে৫ কয়েক চক্কর ঘোরা হল। সেদিন শৈলেশের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। রাত প্রায় বারোটা নাগাদ শৈলেশ বাসায় পৌঁছে দিল আমায়। সেদিন সে একটু হঠকারিতাই করে বসল…’
‘ইতরবিশেষ?’
‘না, ঠিক তা না। একটু আদর করবার চেষ্টা করল কেবল। আমি বিশেষ বাধা দিলাম না। বন্ধুর মতো গালের ওপর একটা…’
‘ভদ্রলোক বোধ হয় তিলে তিলে নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলেছেন, ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে উঠেছেন মনে হয়?’
‘যা বলেছেন। তারপর এই পরশুদিন রাত্তিরে মানে এই দুর্ঘটনার আগের দিন আবার আমরা বেরুলাম এক সঙ্গে। সেদিন কোনও থিয়েটার সিনেমায় নয়, লেকে ঘুরে বেড়ালাম আমরা পাশাপাশি, অনেক চকোলেট কিনে দিলেন তিনি আমায়— অনেক ফুল। তারপর একটা বার-এ নিয়ে গেলেন আমাকে। সেখানে অল্প কিছু খাওয়ার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন, অল্প একটু মদ্যপানে আমার কোনও আপত্তি আছে কিনা। উচ্চশ্রেণির মদ অবিশ্যি। আর সেখানে নাকি খানার সঙ্গে একটুখানি পান করার রেওয়াজ। কাজেই নিয়মরক্ষার খাতিরে অল্প একটু খেতে হল আমায়। উনিও একপাত্র পান করলেন, তার বেশি নয়। আমি এক চুমুক মাত্র। তারপর সেখান থেকে সোজা আমার বাসায়।’
‘ইতরবিশেষ কিছু হল বুঝি সেদিন?’ বলে কল্কেকাশি একটু আমতা আমতা করলেন— ‘মাফ করবেন জানতে চাইছি বলে। আমাদের কর্তব্যের খাতিরেই…’
ঘাড় নাড়লেন শীলাদেবী। ‘না, না ইতরবিশেষের ধার দিয়েই নয়।’
‘বুঝতে পারছি এখন— কেন এমনটা হল।’ বললেন, কল্কেকাশি, ‘নিতান্ত হতাশ হয়ে… মানে, স্রেফ হতাশার জন্যেই এই কাণ্ডটা করে বসেছেন চৌধুরীসাহেব।’
‘না, ঠিক তা নয়। বরং একটু আশা পাওয়ার পরহ… পরের দিনের ঘটনাটা বলি। এ রকম মর্মান্তিক আর হয় না। এগারোটার সময় আমি বসে বসে টাইপ করছি। ওঁর কুঠুরির থেকে উনি হুড়মুড় করে হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি চোখ তুলে চেয়েছি আর উনি জিজ্ঞেস করেছেন, আচ্ছা, ইতরবিশেষের জন্যে তুমি কত চার্জ করো শীলা?’— ‘একশো টাকা’ শুনে তিনি যেন কেমন আর্তনাদ করে উঠলেন… একশো’ টাকা। মাত্র মাত্র একশো টাকা! তুচ্ছ একশো টাকার জন্যই তোমার ইতরবিশেষ? এই বলে সোজা তিনি জানালার দিকে ছুটে গেলেন। তারপরই ওই জানালা টপকে ছ’তলার ওপর থেকে সটান…’
শীলা কথাটা আর শেষ করতে পারে না। দু-হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে।
‘আচ্ছা এবার আসি শীলাদেবী। নমস্কার।’
ডিটেকটিভ কল্কেকাশি ওঠেন।
‘মাত্র একশো টাকায় ইতরবিশেষ?’ আপন মনেই গুনগুন করেন তিনি ফেরার সময়।
***
১. গেজেটেড অফিসার : ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারে বা যে-কোনো রাজ্য সরকারি দপ্তরে কর্মরত উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল বা ভারতের রাষ্ট্রপতি কোনও ব্যক্তিকে সরকারি উচ্চ পদে নিয়োগ করলে তা সরকারি মুখপত্র বা গেজেটে-এ নোটিশ হিসাবে প্রকাশ করতে হয়। যে আধিকারিকদের নিয়োগ গেজেটে নোটিশ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের গেজেটেড অফিসার বলা হয়।
২. পদ্মবিভূষণ : ভারত প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব। সর্বোচ্চ খেতাব ভারতরত্ন-র পরই এর স্থান। পদ্মবিভূষণের অধস্তন খেতাব যথাক্রমে পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রী। ১৯৫৪ সালে এই খেতাব প্রচলিত হয়। প্রথম বছর এই খেতাব অর্জন করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জাকির হুসেন, বালাসাহেব গঙ্গাধর খের, জিগমে দোর্জি ওয়াংচুক, নন্দলাল বসু এবং ভি কে কৃষ্ণ মেনন।
৩. গ্রান্ডে: গ্র্যান্ড হোটেল। অবস্থান চৌরঙ্গি রোডে। চৌরঙ্গি রোডের নতুন নাম জওহরলাল নেহরু রোড। শ্রীমতী অ্যানি মস্ক-এর ১৮৭০-এর প্রতিষ্ঠা করা বোর্ডিং হাউস এবং লাগোয়া কিছু জমি কিনে নিয়ে ইস্পাহান থেকে আগত আর্মেনিয়ান সাহেব অ্যারাথুন স্টিফেন বিংশ শতকের গোড়ায় গ্র্যান্ড হোটেল কিনে নিয়ে এর নামকরণ করেন ‘ওবেরয় গ্র্যান্ড’। কলকাতার প্রথম সারির অভিজাত হোটেলগুলির মধ্যে অন্যতম।
৪. সি-আই-টি বিল্ডিং : সি-আই-টি অর্থাৎ ক্যালকাটা ইমপ্রূভমেন্ট ট্রাস্ট কর্ত,ক নির্মিত বহুতল বাড়ি। সিআইটি নির্মিত বাড়ি কলকাতা শহরে একাধিক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটির ঠিকানা ১০৭, উল্টাডাঙ্গা মেইন রোড। কোনও কোনও বাড়ি বসবাসের জন্য আবার বেশ কিছু বাড়ি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৫. রেড রোড : ময়দানের ভিতর ও ফোর্ট উইলিয়াম লাগোয়া অঞ্চল দিয়ে ইউরোপীয় অভিজাতদের ব্যবহার্য এই রাস্তাটি নির্মাণ করা হয় ১৮২০ সালে। রেড রোড নামের বিশেষ কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনেকে মনে করেন নেটিভদের এই রাস্তায় প্রবেশাধিকার না থাকায়, তাদের প্রতি সাবধানবাণী হিসেবে রেড রোড নাম দেওয়া হয়েছিল। স্যর আশুতোষের প্রতিবাদে তৎকালীন গভর্নর এই আইন রদ করেন। ১৯৮৫ সালে এই রাস্তার নতুন নাম দেওয়া হয় প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধি সরণি।