ইডেনে গুঁতোগুঁতি
এপিডেমিক মানে মহামারি। কখনও বসন্ত কলেরা, কখনও ডেঙ্গু, কখনও ফ্লু। কোনও কোনও অসুখের প্রতিষেধক টিকা বা ইনজেকসন বেরিয়েছে। ফুটবল এমন এক এপিডেমিক যার কোনও প্রতিষেধক নেই। অতি সামান্য ব্যাপার। ফাঁকা মাঠ। দুপাশে দুই গোল পোস্ট। জার্সি পরা দুদল খেলোয়াড়। গোলমতো একটা বল। পায়ে পায়ে বল একবার এ-মাথা থেকে ও-মাথা, আবার ও-মাথা থেকে এ-মাথা। গ্যালারিতে রোদে চিংড়ি পোড়া লাখ-লাখ দর্শক। চিল-চিৎকার করে নেচে-কুঁদে দিনের শেষে প্রায় আধমরা। কারুর আধকপালে, কারুর ফুল-কপালে। রাত-ভোর হতে না হতেই আবার প্রস্তুতি। আবার আসা-সোঁটা নিয়ে পিল-পিল মাঠমুখো।
মাঠের ব্যাপার মাঠে শেষ হলেই বাঁচা যেত। সকালে অন্তত গোটাতিনেক কাগজ দেখা চাই। কোন কাগজ কী বলছে? রেফারিদের বিশেষজ্ঞদের মতামত কি? মুখে-মুখে ফুটবলের পরিভাষা। বল নিয়ে ওঠা। ইনসাইড ডজ, আউটসাইড ডজ, ফ্লোটার, সুইপার ব্যাক। বিদেশি খেলায় খেলা মাঠেই থাকে, দিশি খেলা সময়-সময় মাঠের বাইরে চলে আসে। দর্শকরা খেলতে-খেলতে বাড়ি ফেরেন। গাড়ির কাঁচ চুরমার, নিরীহ পথচারীদের মাথায় তবলা বাজানো। চুলের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেওয়া। পুলিশের সঙ্গে একহাত। ফুটবলের কল্যাণে এখনও ঘোড়সোয়ার পুলিশ দেখা যায়। তাদের কাজ হল ফ্যানদের তাড়া করে খানায় ফেলে দেওয়া অথবা ফ্যানেদের তাড়া খেয়ে আস্তাবলে ফিরে আসা।
ফুটবল অতি পুষ্টিকর খেলা। দৌড় আছে, ঠ্যাঙে-ঠ্যাঙে বাধিয়ে ফেলে দেওয়া আছে। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা যেমন বল লাথানো শেখেন তেমনি খুকচ করে বিপক্ষের খেলোয়াড়কে ধরাশায়ী করা যায় সে কায়দাও রপ্ত করেন। সারামাঠ চষে বেড়াচ্ছেন দু’ডজন পাওয়ার প্যাক ব্যাটারি। এঁদের হ্যান্ডল করতে পারেন একমাত্র দুঁদে রেফারি। তাঁর ঠোঁটে বাঁশি। এ-পকেটে হলুদ কার্ড, ও-পকেটে লাল কার্ড। খুব বাড়াবাড়ি দেখালেই তিনি শেয়াল যেভাবে কুমিরছানা দেখিয়েছিল সেইভাবে কখনও হলুদ, কখনও লাল কার্ড দেখান। মাঠের তিনি হেডপণ্ডিত। বেশি দামালপনা করলেই টাইট দিয়ে ছেড়ে দেন। সময়-সময় নিজেও টাইট হয়ে যান। রগচটা খেলোয়াড়, কোচ অথবা সাপোর্টাররা মার-মার করে তেড়ে আসেন। তখন আর লাল, হলুদে সামলানো যায় না। ঢালধারি, লাঠিধারি আমি অকৃত্রিম পুলিশ বাহিনীকে নামতে হয় আসরে। কিছু প্রাচীন দাওয়াই ছাড়তে হয়।
ভাষার যেমন ব্যাকরণ আছে। খেলারও তেমনি ব্যাকরণ আছে। খাদ্যের যেমন মশলা আছে, খেলার তেমনি পদ্ধতি। মোদ্দা কথা, বল গোলে ঢোকাতে হবে। সে চিনে কায়দায় ঢুকতে পারে, লাতিন আমেরিকান কায়দায় ঢুকতে পারে অথবা ইউরোপীয় কায়দায়। সব কায়দা মিলেমিশে অন্তহীন সংকর কায়দাও হতে পারে। কোনও দলের ডিফেন্স ভালো, কোনও দলের অফেন্স ভালো, কোনও দল আবার অফেন্সিভ। নামেই ঠ্যাঙাঠেঙি।
একালে প্লেয়ার আর চিত্রতারকার প্রায় সমান-সমান খাতির। বিদেশি খেলোয়াড়দের বেশ হিরো-হিরো দেখতে। ভাষ্যকার অন্তত বারদশেক বলবেন, লম্বে খিলাড়ি, যিসকা লম্বে-লম্বে বাল। আবার এও শুনিয়ে দেবেন, এই খেলোয়াড়ের আন্তর্জাতিক বাজার দর দশ হাজার ডলার, কি দশ লাখ ডলার। যার পায়ে যেমন কাজ। আচ্ছা ফুট-ওয়ার্ক। অ্যাকসান রিপ্লেমে দেখিয়ে। ফুট-ওয়ার্ক এখন আর শুধু নাচিয়ের পায়ে নেই, দামি ফুটওয়ার্ক ফুটবলারদের পায়ে। সে পা আবার ইনসিওর করা পা। এ কি গুরু আমাদের হরিপদদার গোদা পা? বাসের ফুটবোর্ডে যে পায়ে গোটা দুয়েক পা চেপে থাকে। যে পা সারাদিন কলকাতার কোপানো রাস্তা দুরমুশ করে! যে পা শুধু সংসারের ঘটিবাটিতে কিক লাগায়! এ হল সেই ছিরিরাধিকের পা, কেষ্ট ঠাকুর বলেছিলেন, দেহি পদ পল্লবমুদারম। এ পা বিকল হলে ঘরে বসে মিলিয়ান ডলার।
কবি বলেছিলেন, ওরে! তোরা নতুন কিছু কর। মাঠে ইউরোপিয়ান, ল্যাটিন আমেরিকান, চিন, ভারত মায় সারা ভূ-খণ্ডের বাঘা-বাঘা খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে-দেখতে এক ধরনের এক ঘেঁয়েমি এসে যেতে পারে। বড় ব্যাকরণ সম্মত খেলা! বল এর পা থেকে ওর পা, ওর পা থেকে তার পা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে বিপক্ষের গোলসীমায়। কখনও ডান কোণ, কখনও বাঁ-কোণ ফুঁড়ে গোল তাক। প্রায়শই নিশানার ঠিক থাকবে না। বল গোলের মাথার ওপর দিয়ে ভেসে চলে যাবে। নব্বই মিনিট ধরে এই চলবে। শ্রম আর পণ্ডশ্রম। এরই মাঝে দুর্লভ একটি গোল হবে। পেশাদার খেলোয়াড়দের ধরন-ধারণই আলাদা। যে পক্ষ গোল করলেন, সেই পক্ষ তখন নিজেদের সীমানায় তানানানা করে সময় নষ্ট করবেন। কত কায়দাই যে এইসব ডলার খেকো খেলোয়াড়রা জানেন। এঁরা আবার বড়দরের অভিনেতাও। লাগল কি লাগল না, চিৎপাত হয়ে কাটা ছাগলের মতো কাতরাতে লাগলেন। টিভির হিন্দি ধারা ভাষ্যকার বড় সুন্দর বলেন, উনে টোকরায়া। আমাদের ভারতীয় খেলোয়াড়রা বিদেশি কোচের হাতে পড়েছেন, এইসব কায়দা হয়তো রপ্ত করে ফেলবেন। নিজে ফাউল করে নিজেই উলটে পড়ে ধড়ফড় করতে থাকবেন। দু-দলই বিদেশের হলে দর্শকদের জোর একটু একটু কমে যায়। আমরা সার্পোটার হতে চাই। দু’প্রান্তে দু’দল সাপোর্টার চিল্লে জিতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। দেড় ঘণ্টা ধরে ধুন্ধুমার কাণ্ড। আমরা বুঝি ঘটি বাঙালের খেলা। তার আলাদা এক স্বাদ। যেন ইলিশের কাঁচা ঝাল! অন্য মাছ লাগে না। এত সায়েব নিয়ে আমরা কি করব! ভালো উচ্চমানের খেলা ঠিকই, কিন্তু ভীষণ প্রাোফেসানাল। যতটুকু না করলে নয় ঠিক ততটুকুই। তার ওপর নানা সমস্যা। দলের বিশ্বমানের খেলোয়াড়টিকে বিপক্ষ এমন জোঁকের মতো ধরে থাকেন যে তিনি আর খেলতেই পারেন না। ভাষ্যকারের বিশেষণেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। নামকরা দল সম্পর্কে প্রচার মাধ্যম আমাদের প্রত্যাশা এমন বাড়িয়ে দেয়, মাঠে আমরা অরণ্যদেব খুঁজি। মনে করি প্রতিটি বলই গাইডেড মিসাইলের মতো গোলে ঢুকবে। কখনও মনেই হয় না মানুষে খেলছে। প্রত্যাশা পূর্ণ না হলে বিরক্ত হই। সবসময় মিরাকল খুঁজি! এমন একটা কিছু ঘটবে যা কখনও ঘটেনি।
ভারত খেলোয়াড় তৈরি করতে না পারুক ভালো দর্শক তৈরি করেছে। টিকিটের লাইন মাইলের পর মাইল সর্পিল। অফিসে-অফিসে টিভি। একটায় দফতর খালি। এখানে-ওখানে একটি কি দুটি দুর্ভাগা কর্মী টিং টিং করছেন। সকলেই জানেন, একদিন কাজকর্ম বিশেষ হবে না। বাসের লাইনে উৎকণ্ঠিত বেরসিক! ঘন-ঘন ঘড়ি দেখছেন, মাঠ থেকে দেড় লাখ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রায় অচল যানবাহন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে ফুটবল, এদিকে রাজনৈতিক মিছিল। ওদিকে গোলের চিৎকার, এদিকে মিছিলের স্লোগান। ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। পাতাল রেল পিণ্ডি চটকাচ্ছে। দুই দলে ক্ষমতার লড়াই চলেছে। কখনও সব বন্ধ। কখনও আংশিক বন্ধ। দিল্লি কলকাতায় ফোঁসফোঁসানি। মাঠের ভেতরে দুদল, লাথাবে ফুটবল। মাঠের বাইরে দুদল লাথাবে সাধারণ মানুষ। সবই খেলা। কবেকার সেই লাইন, আজও সমান সত্য, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা!