ইছামতী

ইছামতী

তপতী নির্লিপ্ত মুখে জানলার বাইরে তাকাল।

চলন্ত গাড়ি থেকে বাইরের অনেক ফালতু জিনিসকেই অপূর্ব শোভা বলে মনে হয়। থেমে-থাকা গাড়ি থেকে সেই একই জিনিস অসহ্য লাগে। সে থেমে থাকাটা যদি প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলতে থাকে এবং দৃশ্য যদি না বদলায়, তা হলে একসময় মনে হয় নিজের চোখদুটো গেলে দিলে কেমন হয়? ভাল হয়। কিন্তু মানুষ তার নিজের চোখ নষ্ট করতে পারে না। ফলে অসহ্য লাগলেও সেই দৃশ্য দেখতে হয়।

তপতী এখন একটা গোরুর মুখ দেখছে। গাড়ির জানলা আটকে একটা গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। গোরুর মুখটা পড়েছে একেবারে জানলার ওপর। সুতরাং গোরু ছাড়া বাইরের কিছু দেখার উপায় নেই। গোরুর গাড়ি যে নিজের পছন্দমতো এসে তপতীদের মারুতির পাশে দাঁড়িয়েছে তা নয়। ট্রাফিক জামের সময় কে কোথায় দাঁড়াবে তা পছন্দের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর। গত বছর পুজোর সময় তপতী নিউমার্কেট থেকে বাজার করে ফিরছিল। তখনও বিমল গাড়ি নেয়নি। নেবে নেবে করেছে। বাজার সেরে ট্যাক্সি ধরেছিল তপতী। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে গেল ট্রাফিক সিগন্যালে। তপতী হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে হাঁ। ট্যাক্সির একেবারে গায়ের ওপর একটা জিপসি এসে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে বসে আছে তাপস পাল! হালকা বেগুনি পাঞ্জাবি। ফরসা গায়ে দারুণ লাগছে। এটাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। তপতী অপর্ণা সেন বা দেবশ্রী রায় নয় যে তাপস পাল গাড়ি নিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াবে। আজও তাই হয়েছে। সেদিন ছিল ফিল্‌ম- স্টার ভাগ্য, আজ হয়েছে গোরু-ভাগ্য।

তপতী বেশ উৎসাহ পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, এই গোরুর মুখ সে এত ভাল করে দেখে নিল যে বছর খানেক পর মাঠে ঘাটে দেখা হলে আর চিনতে অসুবিধে হবে না গেরুও তাকে চিনে রাখল। দেখা হলে ঘাস চিবানো বন্ধ করে মুখ তুলবে। গম্ভীরভাবে বলবে, ‘নমস্কার ম্যাডাম, ভাল আছেন? আপনি ছিলেন নীল একটা মারুতিতে। আপনার স্বামী সাদা জামা পরে ড্রাইভারের সিটে বসে ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছিলেন। ছাই ফেলতে ভুলে যাচ্ছিলেন বলে সিগারেটের ছাই মাঝে মাঝে গাড়ির ভেতরেই পড়ে যাচ্ছিল। ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব? পারলে গাড়ির সিট কভারগুলো পালটে নেবেন। নীল গাড়িতে খয়েরি সিট একদম মানাচ্ছে না।’

তপতী হাসল। নিজের মনে হাসায় শব্দ হওয়ার কথা নয়। তপতীর হল। বিমল মুখ ফেরাল। তার ভুরু কোঁচকানো। ক্রোধের লক্ষণ। গতকাল সন্ধে থেকেই সে রেগে আছে। তপতী যখন বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব, তখন থেকে রাগের শুরু।

‘কেন, তুমি যাবে কেন? না, তুমি যাবে না।’

হ্যাঁ যাব। বেড়াতে যাব। হাসনাবাদে কি স্ত্রীদের প্রবেশের ব্যাপারে কোনও কড়াকড়ি আছে?

‘তপতী, তুমি ভাল করেই জানো আমি বেড়াতে যাচ্ছি না। তুমি কি আবার শুনতে চাও কেন আমাকে যেতে হচ্ছে?’

‘না, শুনতে চাই না। আমি যেটা শুনতে চাই সেটা হল, আমরা কি ওখানে গিয়ে একটা রাত থাকতে পারি না? ধরো কোনও হোটেলে থাকলাম। পরশু সকালে লাঞ্চ করে চলে এলাম। চমৎকার একটা বেড়ানো হল। উইক এন্ড ধরনের ব্যাপার। চট করে তো তোমার ছুটি হয় না।”

‘হাসনাবাদ রাতে থাকার মতো জায়গা নয়। দিনে থাকার মতোও নয়। তা ছাড়া তুমি গোড়াতেই গোলমাল করছ। মনে হচ্ছে না তুমি আমার যাওয়ার কারণ মন দিয়ে শুনেছ। আর একবার বলছি, শুনে নাও। দয়া করে এবার মন দিয়ে শোনো। আমাদের টাকিতে যে-স্কুলে পড়াশুনো করেছি সেই স্কুলে একজন মাস্টারমশাই ছিলেন। নাম অবনীশ বড়াল। আমরা রুটিনে লিখতাম এবি। এবি আমাদের অঙ্ক শেখাতেন। ভীষণ রাগী, অসম্ভব জোরে কান মুলতে পারতেন। সব স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাইরাই ভীষণ রাগী হয়, এবং জোরে কান মুলতে পারে। এটা কোনও গুণের কথা নয়। কিন্তু আমাদের অক্ষয়বাবুর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, পরীক্ষার সময় তিনি কাউকে কখনও ফেল করাতেন না। পরীক্ষার সময় অঙ্ক না পারলে তিনি কানমুলে দিয়ে বলতেন, গবেট, যে-অঙ্ক পারবি সেটাই কর। সেটাই তোর প্রশ্ন। মূর্খ কোথাকারে। তাঁর হাতে আমরা অজস্রবার কানসোলা খেয়েছি কিন্তু কখনও ফেল করিনি। অঙ্ক স্যাররা হন ফেল করানো স্যার অথচ আমাদের মাস্টামশাই ছিলেন পাশ করানোর মাস্টারমশাই। তিনি ফেলে বিশ্বাস করতেন না। যদি করতেন তা হলে মুশকিল ছিল, আমাদের অনেককেই হয়তো এক ক্লাসে বারকয়েক থেকে যেতে হত। ফলে রাগী হলেও এই স্যারের প্রতি আমাদের কোনও রাগ ছিল না, বরং একটা উইক পয়েন্ট ছিল।

তপতী আলমারি খুলল। এক একটা করে শাড়ি নামিয়ে দেখতে লাগল হাসনাবাদ সফরের জন্য কোন শাড়ি উপযুক্ত। হাসনাবাদে নদী আছে। সমুদ্রের শাড়ি যেমন পাহাড়ে মানাবে না, তেমনি নদীর শাড়িও নিশ্চয় আলাদা হওয়া উচিত। সবুজ চলবে? গাঢ় সবুজ নয়, হালকা সবুজ।

বিমল বলে চলেছে, ‘বৃদ্ধ মানুষটি খুবই অসুস্থ। একসপ্তাহ আগে খবর পেয়েছি, তিনি মৃত্যুশয্যায়। হয়তো অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যাবেন। ছেলেরা তাঁকে হাসনাবাদ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভরতি করেছে। দোতলায় জেনারেল ওয়ার্ড। সেখানে পনেরো নম্বর বেডে তাঁর চিকিৎসা চলছে। শুনলাম খুবই কষ্টে আছেন। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। লাস্ট উইকে অফিসে হঠাৎ অশোক এসে হাজির। অশোককে তুমি চেনো? চেনো না। আমার স্কুল লাইফের বন্ধু অঙ্কে বীভৎস রকমের কাঁচা। এখন বড় চাকরিবাকরি করে বিস্তর পয়সা করেছে। ও কোথাও থেকে স্যারের অসুখের খবর’পেয়ে আমার কাছে ছুটে এল। এসে বলল চল বিমল, স্যারকে দেখে আসি। শুনলাম, টাকাপয়সার অবস্থা খুব কাহিল। পয়সার অভাবে ঠিক সময় ছেলেমেয়েরা নাকি কলকাতায় আনতে পারেনি। এখন টু-উ লেট। যাই হোক কিছু টাকাপয়সা দিয়ে আসি, একবার দেখেও আসি। হাসনাবাদ কয়েক ঘণ্টার তো মামলা। গাড়িতে গেলে সন্ধের আগেই ব্যাক টু কলকাতা। অশোকের কথা শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল, এত বছর পর এসব হ্যাপার মধ্যে ঢোকা ঠিক হবে না। অফিসে অনেক কাজ। দুটো টেন্ডার নিয়ে ভয়ংকর ধরনের ঝামেলা চলছে।’

তপতী ভাবল, একটা সালোয়ার কামিজ নিলে কেমন হয়? নদীতে যদি নামতে হয়? সমুদ্রে সালোয়ার কামিজ পরে নামতে হয়। নদীতেও কি তাই? সালোয়ার কামিজের কথা ভাবতে ভাবতেই সে বলল, ‘তা হলে হ্যাপা নিলে কেন?’

‘পরে সিদ্ধান্ত বদল করলাম। যে-মানুষটা জীবনে বহুবার ফেলের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে শেষ একবার দেখে আসা উচিত মনে হল। সেন্টিমেন্টাল ডিসিশন বলতে পারো। সেন্টিমেন্টাল এবং ফুলিশ। তাও নিলাম। পরীক্ষা টরিক্ষার বালাই শেষ হয়ে গেছে কতদিন। তবু আজকাল মনে হয় সারাক্ষণ পরীক্ষা হলে বসে আছি। আশেপাশের সবাই ফেল করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মনে হল, খবর যখন পেয়েছি তখন এই সিচুয়েশেনে স্যারের কাছে একবার গেলে খারাপ হয় না। যাওয়া উচিতও। এরকম মানুষ তো আর খুব একটা নেই। থাকবেও না। দেরি হয়ে গেছে তবু শেষ সময় যদি কোনও কাজে লাগতে পারি। ধরো একটা ভাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করলাম। ওষুধটযুধের জন্য বাড়ির লোকদের হাতে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে এলাম। এই আর কী। অশোকের ভাবনাটার মধ্যে একটা গুডনেস আছে। সেটাকে চট করে অস্বীকার করতে পারলাম না। ঠিক হয়েছে, কাল ভোরে অশোককে তুলব। তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ। সোজা হাসপাতাল যাব। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার। দে ব্যাক। পথে খেয়ে নেব।’

‘না পথে খাব না। হাসনাবাদেই খাব। আমি নদীর ঘাটে বসে কোনওদিন খাইনি। শুনেছি নদীর ঘাটের দোকানগুলোতে খুব ঝাল দেয়। সত্যি?’

বিমল গম্ভীর গলায় বলল, ‘আশ্চর্য লাগছে তপতী। তুমি জিনিসটাকে একটা পিকনিকের চেহারা দিতে চাইছ! একজন বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষকে আমরা দেখতে যাচ্ছি আর তুমি লাফালাফি করছ খাওয়া নিয়ে? দু’দিন হল, ইডিয়ট অশোকটার জন্য ছোটবেলার অনেক কথা হঠাৎ করে মনে পড়ছে। মনটন বিশেষ ভাল নেই। ঘটনা তো আনন্দের কিছু নয়।’

তপতী হাসল। বলল,’ অবশ্যই আনন্দের। আমার স্বামী একটা দারুণ কাজে যাচ্ছে। এতে আনন্দ হবে না? ছেলেবেলার একজন প্রায় হারিয়ে-যাওয়া মাস্টারমশাইয়ের জন্য তোমার মন খারাপ হচ্ছে শুনে আমার তো আরও বেশি আনন্দ হচ্ছে। আমি এতদিন যে স্বামীটাকে জানতাম তার মন শুধু খারাপ হত ব্যাবসার অর্ডার না পেলে আর অফিসে প্রোমোশন আটকে গেলে। আজ তাকে কেমন নতুন নতুন মনে হচ্ছে। আর সেই কারণেই আমি তার সঙ্গে আগামীকাল বেরোতে চাই। আমি তো তোমার অফিসটুরে তোমার সঙ্গে যেতে চাইছি না। গত সপ্তাহে অফিস থেকে ফিরে তুমি যখন ঘটনাটা প্রথম বলেছিলে, তখনই আমি বুঝেছিলাম তোমার মন খারাপ। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই আমি যাব। এই চমৎকার ঘটনার আমি সাক্ষী হতে চাই। সেদিনই আমি সবটা শুনেছিলাম, তুমি মিছিমিছি আজ আবার গোটাটা বললে। আমি ছোট সুটকেসটা নিচ্ছি। তোমার পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটিটা ভরে নিয়ো।’

বিমল অবাক হয়ে তপতীর দিকে তাকাল। মনে হয় না একে আটকানো যাবে। বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘ইমপসিবল। থাকার কোনও প্রশ্নই নেই। তুমি গেলে চলো। ব্যস ওই পর্যন্ত। সন্ধের আগেই ফিরে আসব।’

রাগ আরও বাড়ল যখন রাতে অশোক টেলিফোন করে জানাল, কাল সে যেতে পারছে না। তার জ্বর হয়েছে। এমনি জ্বর নয়, ভাইরাল জ্বর। সারাশরীরে ব্যথা। এই অবস্থায় গাড়ি চেপে হাসনাবাদে যাওয়া তো দূরের কথা, খাট থেকে উঠে উঠে বারান্দা পর্যন্ত সে যেতে পারছে না। কিন্তু বিমল যেন অবশ্যই স্যারের কাছে যায় এবং তার কথাও বলে।

বিমল টেলিফোন নামাল। বলল, ‘অশোকের কথায় নাচাটাই আমার ভুল হয়েছিল। আমি যাব না।’

তপতী টিভি দেখতে দেখতে বলল, ‘তুমি না যাও, আমি যাব।’

বিমল খানিকটা গলা তুলে বলল, ‘ডোন্ট টক রাবিশ তপতী। এটা নিয়ে ফান করার মতো কিছু হয়নি। অশোক নিজে সব ঠিক করে এখন নিজেই জ্বরে শুয়ে পড়ল। লেট হিম গেট ওয়েল। তারপর যাওয়া যাবে। এতদিন যাইনি, আর ক’টা দিন দেরি করলে কিছু ক্ষতি হবে না। তা ছাড়া সেখানে তো কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই। আমি বরং দেখি অফিসের কোনও পিয়োন টিয়েনকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠানো যায় কিনা।’

‘অপেক্ষা করে থাকবে কেন? তুমি তো তোমার কোম্পানির বোর্ড মিটিঙে যাচ্ছ না যে ডিরেক্টররা তোমার জন্য বসে থাকবে। তার মধ্যে যদি তোমাদের কানমোলা স্যার মারা যান?

‘গেলে যাবে। আমি কী করব? সে তো এমনিই যেতেন। অশোক না এসে বললে কি আমি যাওয়ার কথা ভাবতাম? স্যারের কথা মনেই পড়ত না। এখন যেমন মনে পড়েছে তেমনি মন থেকে আবার সরেও যাবে।’

তপতী মহা উৎসাহে স্বামীর দিকে ঘুরে বসল এবং বলল, ‘একটা কাজ করা যাক, আমি একা বরং চলে যাই। গিয়ে বলি, স্যার, মাপ করবেন, আমার স্বামী অনেকদিন পর একটা ভাল কাজ করার চান্স পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না, ফেল মেরে গেলেন। আপনার কাছে আসার তাঁর খুবই ইচ্ছে ছিল, তবু উনি আসতে পারলেন না। সামান্য একটা জ্বর তাঁকে ফেল করিয়ে দিল। অঙ্কে সারাজীবন পাশ করলেই যে সবাই সব কাজে পাশ করে তা তো নয়। অনেক কাজে ফেলও করে। আপনি স্যার কিছু মনে করবেন না। এই আপেলদুটো রইল। আমার স্বামী পাঠিয়ে দিয়েছেন। খিদে লাগলে খেয়ে নেবেন।’

বিমল স্ত্রীর চোখের দিকে সরাসরি বলল, ‘তুমি কি আমাকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছ তপতী? ইউ ওয়ান্ট টু টিচ সামথিং? তপতী টিভি থেকে মুখ তুলে বলল ‘হ্যাঁ চেষ্টা করছি এবং মনে হচ্ছে সফলও হয়েছি।’

তপতী সফল হলেও বিমলের রাগ কমেনি। কলকাতা থেকে এতটা পথ সে প্রায় চুপ করেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। তপতীও আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থেকেছে। ওকে যে আনা গেছে সেটাই অনেক। পরিস্থিতি আর ঘোরালো না করাই ভাল।

তপতী না চাইলেও পরিস্থিতি ঘোরালো হল। নিজে থেকেই হল।

বসিরহাট শহরে ঢোকার সামান্য আগে বিমলের মারুতি দাঁড়িয়ে পড়ল। এমনি দাঁড়ানো নয়, শিকড়-গজানো দাঁড়ানো। সামনে পথ অবরোধ হয়েছে। আগু পিছুর নো চান্স। যেখানে আছ সেখানে বসে থাকো। তপতীদের গাড়িও বসে আছে। আশপাশের বাসটাসের প্রায় সকলেই নেমে পড়েছে। কয়েকজন ড্রাইভার তাস বের করে গাড়ির বনেটে পেতে মহানন্দে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। সম্ভবত পথ অবরোধ জন্যই এই তাস ওদের সঙ্গে থাকে। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, খেলার মাঝপথে ঝামেলা মিটে গেলেও কোনও অসুবিধে নেই। তাসটাস গুছিয়ে যে যার মতো ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়বে। পরবর্তী পথ-অবরোধে নেমে বাকিটা শেষ করে ফেলবে। আজকাল পথ অবরোধের কোনও অভাব হয় না।

তপতী-বিমলের গাড়ি থেকে নেমে পড়ার কোনও উপায় নেই। বাসযাত্রীরা হাটতে পারে, মারুতিযাত্রীর হাটতে পারে না তাদের গাড়ির মধ্যে বসে বসে ঘামতে হয়। দু’-তিন দিন পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। গাড়ি ফেলে চলে যেতে পারবে না। তপতী একবার ভেবেছিল, তাস খেললে কেমন হয়? নেমে একটু খোঁজাখুঁজি করলে আশপাশের দোকান থেকে এক প্যাকেট তাস কি পাওয়া যাবে না? তাস না হলে লুডো। অনেকবারই বাইরে বেড়াতে গিয়ে সন্ধের দিকে তারা হোটেলে বসে লুডো খেলেছে। নতুন কিছু ব্যাপার নয়। সব স্বামী-স্ত্রীরাই সময় কাটানোর জন্য লুড়ো খেলে। মুখে স্বীকার করে না। মুখে বলে, দু’জনে মিলে কখন যে ক’টাদিন কেটে গেল! বুঝতেই পারলাম না। আজও তেমনি গাড়ির ভিতর বসে লুডো খেললে সময়টা কেটে যেত। গল্প করলেও কেটে যেত। কিন্তু বিমল গল্প করতে চাইছে না। তপতীর কথার কোনও উত্তরই প্রায় সে দিচ্ছে না। দিলেও স্বাভাবিক উত্তর দিচ্ছে না রাগ-উত্তর দিচ্ছে।

‘কীসের জন্য রোড ব্লকেড বলতে পারো?’

‘না পারি না। আমি তো অবরোধ করিনি।’

‘তুমি রেগে আছ কেন?’

‘অন্যায় করছি। দু’ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আটকে বসে আছি। না রেগে খুশিতে নাচা উচিত ছিল।’

‘তুমি এমনভাবে বলছ যেন আমি অবরোধ করেছি। আমি তো অবরোধ করিনি।’

‘বলেছি সে কথা? একবারও বলিনি। তবে তুমি না এলে ভাল হত।’

‘কেন? তোমার কি মনে হয়, আমার জন্য বসিরহাটের লোকজন পথ-অবরোধ করেছে? নাকি আমি না থাকলে তুমি সুইচ টিপে গাড়ির পাশ থেকে ডানা বের করে উড়ে যেতে? অত মুখ গোমড়া করে থেকো না তো। তোমাকে তো বললাম, তুমি একটা ভাল কাজে যাচ্ছ। দেখবে, তোমার মাস্টামশাই তোমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন। উনি বিশ্বাসই করতে পারবেন না, এরকম খারাপ সময় তাঁর পাশে হারিয়ে যাওয়া একজন ছাত্র ফিরে এসেছে। তুমি যে সত্যি সত্যি যাচ্ছ আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে তুমি খানিকটা সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছ। কিন্তু তার জন্য এতক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকার কিছু নেই।’

‘সরি, তোমার মতো মুখ হাসিহাসি করার কোনও পদ্ধতি আমার মনে পড়ছে না।’

‘এক কাজ করো, তুমি ওই গোরুটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকো। দেখবে একটা মজার জিনিস হবে। গোরুটার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়ে যাবে। তখন আমার মতো তোমারও হাসি পাবে। ততক্ষণে আমি নেমে দেখে আসি কী হল। পারলে অবরোধওলাদের সঙ্গে কথাও বলব। সুন্দর মুখের যদি সর্বত্র জয় হয়, তা হলে অবরোধ হবে না কেন?’

তপতীর কথা বিশেষ কানে ঢুকল না বিমলের। তার মনে হচ্ছে, আবার প্রমাণ হল, সেন্টিমেন্টাল সিদ্ধান্ত মানুষকে সবসময়ই বিপদে ফেলে। আজও ফেলল। রাস্তার মাঝখানে আটকে পড়তে হল। ছোটবেলার মাস্টারকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করা শুধু যে উচিত হয়নি তা নয়, বড় ধরনের বোকামি হয়েছে।

তপতী গাড়ি থেকে নেমে দু’পা যেতে-না-যেতে সত্যিই অবরোধ উঠে গেল। সে গম্ভীরমুখে ফিরে এসে বলল, ‘যাও, অবরোধ তুলে দিয়ে এলাম। নাও গাড়ি ছাড়ো আর মুখটা একটু হাসিহাসি করো। পুলিশ গুলি চালালে রাস্তার সবাইকে হাত তুলে যেতে হয় জানো তো? তেমনি নিয়ম হল, অনেকক্ষণ আটকে থাকার পর গাড়ি চললে ভাইভারদের মুখে থাকবে হাসি। নিয়ম না মানলে পুলিশ ধরে। বসিরহাটের মোড়ে অনেক পুলিশ দেখে এলাম। গোমড়া মুখ দেখছে আর ধরে টপাটপ হাসি-কেস দিচ্ছে। হাসি-কেসে ফাইন কিন্তু হেভি ক্যাশে দিতে হবে। তুমি যে ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করবে তা হবে না।’

এতক্ষনে সম্ভবত বিমলের মন কিছুটা ভাল হয়েছে। কারণ, অল্প হলেও সে হাসছে।

আসল ঘটনাটা ঘটল হাসপাতালে পৌঁছোনোর পর।

বিকেলের মুখে মুখে বিমলদের গাড়ি এসে দাঁড়াল হাসপাতালের সামনে।

দোতলায় লম্বা ঘর। পা রাখতেই বোঝা গেল, ব্যবস্থা খুবই শোচনীয়। একপাশে সারি সারি লোহার খাট। তাতে যারা শুয়ে বসে আছে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। গায়ে ছেঁড়া কাঁথা, মাথার বালিশ ময়লায় কালো, বিছানার চাদর কোথাও আছে, কোথাও নেই। খাটের তলায় এঁটো থালার পাশে বেড়াল। দুপুরের খাওয়া শেষ করে তারা এখনও ভাত ঘুম দিচ্ছে। ঘরের দেয়ালে যেখানে সেখানে দড়ি। তাতে লুঙ্গি গামছা ঝুলছে। তপতী অবাক হয়ে দেখল, ঘরে জানলা কয়েকটা আছে ঠিকই, কিন্তু সেখান দিয়ে আলো হাওয়া ঢুকছে না। হাসপাতালের গরিব রোগীদের সম্ভবত আলো হাওয়াও বয়কট করে। সব থেকে ঝামেলার হল উৎকট গন্ধ। তপতীতর মনে মনে হচ্ছে, আর একটু থাকলে বমি উঠে আসবে। তপতী এরকম হাসপাতাল কখনও দেখেনি। সে বিমলের হাত চেপে ধরল। এখন মনে হচ্ছে, না এলেই ভাল হত। বিমলকেও আসতে না দিলে হত। বেচারিকে মাস্টারমশাইয়ের একটা খুব খারাপ স্মৃতি নিয়ে ফিরে যেতে হবে। কারও শেষ স্মৃতি খারাপ হলে ভয়ংকর হয়। সেই স্মৃতি মন থেকে সহজে যেতে চায় না। এখানেও তাই হবে। এই অবস্থা থেকে অসুস্থ মানুষ কখনও সুস্থ হয়ে ফিরতে পারে না। অসম্ভব।

আধো আলোতে পনেরো নম্বর খুঁজে এবং সেই খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বিমলদের প্রায় পাঁচ মিনিট সময় লেগে গেল। এখন ভিজিটিং আওয়ার চলছে। তবে বেশিরভাগ রোগীকেই কেউ দেখতে আসেনি।

পনেরো নম্বরে এসেছে। এক মহিলা খাটের ওপরই বসে। লম্বা ঘোমটায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। খাটের রোগীর দিকে তাকিয়ে বিমল চমকে উঠল। সেখানে যে-কিশোরটি শুয়ে আছে তার বয়স তেরো-চোদ্দোর বেশি কিছুতেই নয়। সাদা শাড়ি আর বেল্ট পরা রাগী ধরনের একজন কালো নার্স সেই রোগীর হাতে খুব বিরক্তির সঙ্গে স্যালাইনের সুচ লাগাচ্ছে। সম্ভবত শিরা পাওয়া যাচ্ছে না। তপতীর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। হাসপাতালে কাউকে দেখতে এসে যদি দেখা যায় বিছানায় অন্য রোগী শুয়ে আছে তা হলে সব থেকে খারাপ। পিজি হাসপাতালে তার ছোট মেসোমশাইয়ের ক্ষেত্রে এরকম হয়েছিল। ফলটল নিয়ে গিয়ে জানা গেল, তিনি মারা গেছেন। বিমলের বন্ধু খবর পেয়েছিল এক সপ্তাহ আগে। তার পরেও দুটো দিন গেছে। তখনই অবস্থা নাকি খারাপ ছিল। তা হলে মারা যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। তপতী ফিসফিস করে বলল, ‘কী হল বলো তো?’

বিমলও খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। সেও গলা নামিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, নার্সকে জিজ্ঞেস করি। নিশ্চয় আমরা ভুল করেছি। অশোক হয়তো বেড নম্বরটা ভুল দিয়েছে।’

নার্সের মনোযোগ পেতে বিমল একবার কাশল। নার্স মুখ তুলে তাকাল। চোখে অসম্ভব বিরক্তি। আবার মুখ নামিয়ে নিল। খাটে-বসা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে পরশু দিন ইঞ্জেকশন এনে দিতে বলা হয়েছিল না? এনেছেন? আনেননি?’

ঘোমটা টানা মহিলা মাথা নাড়ল।

‘আপনারা কী মনে করেছেন? মনে করছেন, হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেওয়া হবে? নাকি ওষুধ ছাড়াই পেশেন্ট ভাল হয়ে যাবে? কোনটা? নিন হাতটা শক্ত করে ধরুন। আঃ এই জায়গাটা ধরুন।’ স্যালাইনের ছুঁচ লাগানো হল। নার্স মহিলা একটানা বলে চলেছেন, ওষুধ কিনতে না পারলে ডাক্তারবাবুকে আজই বলে দেবেন। মেডিসিন ছাড়া ট্রিটমেন্টের কোনও পদ্ধতি তার জানা থাকতে পারে। বলবেন সেই পদ্ধতি আমাদের যেন তিনি বলে যান। শুধু স্যালাইন দিয়ে কিছু করা যাবে না। বুঝেছেন? মনে হচ্ছে না বুঝেছেন।’

মহিলা কোনও কথা বলছে না। বিমল আবার কাশল।

নার্স এবার মুখ না তুলে বলল, কী ব্যাপার?’

বিমল বলল, ‘আমরা কলকাতা থেকে আসছি। জেনারেল ওয়ার্ডের পনেরো নম্বর বেডে আমাদের একজন পেশেন্ট ভরতি হয়েছিলেন। আমার মাস্টারমশাই। নাম অবনীশ বড়াল। এটাই তো পনেরো নম্বর বেড?’

নার্স জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছে। এবার সে চলে যাবে। ঘোমটা-ঢাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ‘ছেলের পাশে বসে কাঁদলে কোনও লাভ হবে না। আপনার ছেলের যে-অসুখ হয়েছে তাতে কান্না কোনও ট্রিটমেন্ট নয়। শুনতে খারাপ লাগবে ঠিকই তবু শুনুন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা করুন। ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে যান। বাঁচাতে চাইলে সেখানকার বড় হাসপাতালে ভরতি করুন।’ নার্স হাঁটতে শুরু করেছে এবং হাঁটতে হাঁটতেই বিমলদের দিকে মুখ তুলে বলল, “আপনাদের পেশেন্ট রিলিজ পেয়ে গেছেন। আমি যতদূর জানি তিনি আপাতত সুস্থ।’

বিমল আনন্দ চেপে রাখতে পারল না। বলল, ‘সেকী! কবে ছাড়া পেলেন?’

রাগী নার্স দাঁড়াল। সুন্দর করে হেসে বললে, ‘এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা আমার নয়। এটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ছে না। নীচে অফিস আছে। সেখানে যান। গিয়ে দেখবেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বলার মতো কেউ নেই। সবাই চা খেতে গেছে। এখানে নিয়ম হল, ঘনঘন চা খেতে যেতে হয় এবং সকলকে একসঙ্গে যেতে হয়। আপনারা অপেক্ষা করবেন। চা খেয়ে ফিরে এলে ওদের জিজ্ঞেস করবেন। তবে আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন তাই ডিউটির বাইরেও আপনাদের কথার উত্তর দিচ্ছি। যে-পেশেন্টের কথা আপনারা বলছেন, কাল তার ছুটি হয়ে গেছে। কাল সকালে। বারাসত থেকে ভদ্রলোকের ছেলে না কে এসেছিল।’বলে আবার হাঁটতে শুরু করল এবং আবার থমকে দাড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘ও ভাল কথা, আপনাদের পেশেন চশমাটা ফেলে গেছেন। ওয়ার্ডের মাসির কাছে আছে। পারলে একটু অপেক্ষা করে নিয়ে যাবেন। মনে হচ্ছে মাসিও চা খেতে গেছে।’

নার্স চলে যাবার পরও বিমলরা দাঁড়িয়ে রইল। তপতীর বিশ্বাস হচ্ছে না। এই জায়গা থেকে কোনও মানুষ অসুখ সারিয়ে ফিরতে পারে! এতক্ষণ যে-জায়গাটাকে নরক বলে মনে হচ্ছিল, সেটাকে একদম অন্যরকম লাগছে। স্বামীর ছেলেবেলার মাস্টারমশাইকে সে চেনে না। কোনওদিন দ্যাখেওনি। তবু দু’দিন ধরে মানুষটাকে খুব সে মনে হচ্ছিল। ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগছে। যাকে দেখার জন্য এত কষ্ট করে ছুটে আসা তাকে দেখতে না পেয়েও ভাল লাগা একটা অন্যরকম জিনিস। তপতী এই জিনিসের মুখোমুখি জীবনে বোধহয় এই প্রথম হল।

বিমল বলল, ‘চলো।’

তপতী হেসে বলল, ‘কী, এতক্ষণে ভাল লাগছে তো?’

ওয়ার্ডে আলো জ্বালা হয়েছে। হাসপাতালের আলোতে ঘরের অন্ধকার কাটে না। এখানেও কাটেনি। তপতীরা পা বাড়াতেই হালকা একটা কান্নার শব্দ। তপতী মুখ ফেরাল। পনেরো নম্বর খাটে বসা মহিলা কাঁদছে। চাপা ধরনের নাকি কান্না। গরিব মানুষরা গলা খুলে কাঁদতে ভয় পায়।

তপতী বিমলকে বলল, ‘এক মিনিট।’ সে মহিলারা দিকে এগিয়ে এল।

খাটে শুয়ে থাকা ছেলেটির সম্ভবত অনেক জ্বর। ছেলেটির মাথায় জলপট্টি, ঘোমটার কারণে মহিলার মুখ এখনও দেখা যাচ্ছে না। রোগীর মুখ অবশা দেখা যাচ্ছে। চোখ বোজা। গলা পর্যন্ত চাদর। ময়লার কারণে চাদরের রং সাদা না অন্য কিছু। বোঝার উপায় নেই। একটা হাত বেরিয়ে আছে। তাতে স্যালাইনের সূচ ফোটানো। একটু আগে যাকে বছর যোলো-সতেরো মনে হচ্ছিল, এখন মনে হচ্ছে আরও কম।

তপতী মহিলার কানের কাছে গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনার ছেলে?’

মহিলা মুখ ফেরাল। ফেরালেও কোনও লাভ হল না। ঘোমটা চোখ পর্যন্ত নামাননা। তপতী আবার বলল, ‘আপনার ছেলের কী হয়েছে?’

উত্তর না দিয়ে মহিলা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল এবং মুখ ঘুরিয়ে আবার চাপা শব্দ করে কাঁদতে লাগল।

তপতী স্বামীকে বলল, ‘চলো।’

হাসপাতালের অফিস থেকে অবিনাশ বড়ালের ছেলের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া গেছে।

গাড়িতে উঠে বিমল স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ‘চলো আজ রাতটা এখানে থেকেই যাই। বাজারের কাছে একটা সরকারি গেস্ট হাউস আছে। কেয়ারটেকারকে দশটা টাকা দিলে একটা ঘর খুলে দেবে না? ঠিক দেবে।’

তপতী বলল, ‘সে কী, থাকবে? তুমি না বলেছিলে থাকবে না?

বিমল যেন একটু লজ্জা পেল। লাজুক ধরনের হেসে বলল, ‘না তা ঠিক নয়, আসলে স্যারের ভাল হয়ে যাওয়ার খবরে মনটা ভাল লাগছে। কাল সকালে যাওয়ার পথে তো বারাসত দিয়েই ফিরব। তখন না হয় একবার স্যারকে দেখে যাব। চাঁপাড়ালির কাছেই তো ঠিকানা। কী, ভাল হবে না?’

তপতীর মনে হচ্ছে, একটা গোলমাল হচ্ছে। খানিক আগেও যতটা খুশিখুশি লাগছিল, এখন যেন ততটা লাগছে না। পনেরো নম্বর বেডে বসে থাকা মহিলার মুখ মনে পড়ছে। আচ্ছা জ্বালাতন তো! কে না কে, তার জন্য মন খারাপ করবে কেন সে? তপতী মনের এনার্জির বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করল। যে করেই খুব দ্রুত খুশি ব্যাপারটা ফিরিয়ে আনতে হবে। উলটো পালটা ভেবে মুখ গোমড়া করে বিমলের মেজাজটা নষ্ট করে দেওয়ার মানে হয় না। ফালতু জিনিস ভাবলে বেড়ানোটাও মাটি হবে। সে হাসিমুখে বলল, ‘ভাল হবে না।’

বিমল অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, হবে না কেন?’

‘কারণ আমি সবুজ শাড়ি আনিনি।’

‘ওতে কিছু হবে না। তুমি তো আর বিয়েবাড়িতে আসোনি।’

দশ টাকায় হল না। কেয়ারটেকারকে ঠিক একশো টাকা দিতে হল। সে ভয়ংকর রকমের খাতির করে তিনতলার একটা ঘর খুলে দিল। ঘরের সঙ্গে বারান্দা। সেই দরজা খুলে তপতী একবারে হাঁ। সামনেই বয়ে চলেছে নদী, ইছামতী। এদিক থেকে ওদিক যেদিকে চোখ যায় শুধু নদী। মনে হচ্ছে গোটা নদীটা যেন তাদের এই ছোট বারান্দাটায় উঠে এসেছে। বারান্দা সেই জলে ভাসছে। বিয়ের এই সামান্য কয়েকটা বছরেই বিমলের সঙ্গে বহু নামকরা জায়গা বেড়িয়ে ফেলেছে তপতী। হাসনাবাদ কোনও নামকরা জায়গা নয়। তবু তপতীর গায়ে কাটা দিচ্ছে। এরকম তো নয় যে সে জীবনে নদী দেখেনি। তিস্তার পাথরে বসে থাকা অবস্থায় একটা ছবি তাদের বেডরুমে বাঁধিয়ে রাখা আছে। পায়ের কাছ থেকে সাদা ফেনা নিয়ে তিস্তা নদী ছুটছে। কান পাতলে ফ্রেমে বাঁধানো সেই ছবি থেকে মাঝে মাঝে জলের শব্দও শোনা যায়। অথচ কী আশ্চর্য, আজ মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রথম তার নদীর সঙ্গে দেখা হল।

সন্ধে হয়ে গেছে। এখনও যে-আলোতে নদী দেখা যাচ্ছে সে-আলো নদীর নিজের আলো। ওপারে সারি সারি টিমটিমে বাতি জ্বলছে। জলে এলোমেলো কয়েকটা নৌকো। সম্ভবত এই নৌকোদের ফিরে আসার তাড়া নেই। অথবা তারা ফেরার কথা ভুলে গেছে।

তপতী বলল, ‘অপূর্ব! দেখলে তো, তুমি থাকতে রাজি হচ্ছিলে না। এখন কেমন লাগছে, বলো?

বিমল হাসল। গাঢ় স্বরে বলল, ‘শেষপর্যন্ত তোমার ইচ্ছেমতোই হল। ইছামতীর মজা কী বলো তো? তোমার ইচ্ছে যদি তার পছন্দ হয় তা হলে সেটা সে পূরণ করে ছাড়ে। ইছামতী নামটা সেই জন্যই। তোমার ইচ্ছে মনে হচ্ছে তার পছন্দ হয়েছে।’

তপতী বলল, ‘তোমার মাথা। এখানে না থাকলে কী সুন্দর একটা জিনিস যে মিস করতাম।’

‘তপতী, থাকার মতো অবস্থা সত্যিই ছিল না। স্যারের জন্য মুডটা অফ হয়ে ছিল। অনেক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার হয় না? অশোকটাও গোলমাল করে দিল। মাঝখানে কতটা গ্যাপ গেছে। এখন মনে হচ্ছে একটু বেশি ইমোশনালি মুভড্‌ হয়ে পড়েছিলাম। যাক মানুষটা সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন দ্যাট ইজ গুড। এখন কয়েক ঘণ্টা আমরা এনজয় করতে পারি।’

তপতী বিমলের হাত ধরে বলল, ‘আমার মনে হয়, তোমার ইচ্ছেটা ইছামতীর মনে ধরেছিল। সেই তোমাকে নিয়ে এসেছে। এবার আমার একটা ইচ্ছে ইছামতীদেবী পূরণ করে দিলে বাঁচা যায়।’

‘ইচ্ছেটা শুনতে পারি কি?’

‘হ্যাঁ শুনতে পারো। একটা সবুজ শাড়ি কেনার ইচ্ছে। পুরো সবুজ নয়। অফ গ্রিন, হালকা সবুজ। নিয়ম হল, নদীর ধারে সবুজ শাড়ি পরে যেতে হয়।’

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই শব্দ করে হেসে ওঠে। তপতীর মনে হচ্ছে, খুব সম্ভবত তার মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।

দোকানে সবুজ শাড়ি পাওয়া গেল। কিন্তু হালকা সবুজ নয়, ক্যাটক্যাটে সবুজ। রঙের মধ্যে একটা গ্রাম্য ব্যাপার। বাধ্য হয়ে সেই শাড়িই কিনতে হল তপতীকে। বিমল বলল, স্যারের জন্য এক জোড়া ধুতি-পাঞ্জাবি নিলে কেমন হয় তপতী? স্যার মনে হয় খুশি হবেন। ধুতি, শাড়ি এবং রাতের জন্য বিমলের একটা পাজামা কিনে গেস্ট হাউসে ফিরতে ফিরতে অনেকটা সময় চলে গেল। ঠিক হল, কাল খুব ভোরে উঠতে হবে। উঠেই মুখটুখ না ধুয়ে যাওয়া হবে সোজা নদীর কাছে। নৌকোয় চেপে ঘণ্টাখানেক চক্কর। তারপর নদীর ধার থেকেই কচুরি আর চা খেয়ে বারাসত। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কলকাতায় পৌঁছোলে বিমল অনায়াসে অফিসের জরুরি মিটিং ধরতে পারবে।

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, সত্যি সত্যি নদীর ধারে কোনও দোকানে গিয়ে রাতের খাওয়া হবে। কিন্তু বিমল গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত। তা ছাড়া বেশি ঝালের ঝুকি নেওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। তা ছাড়া কোন ফাঁকে বিমল হুইস্কির একটা ছোট বোতল কিনে ফেলেছে। ঘরে এসে পাজামা পরে ঝটপট সে বোতল এবং গেলাস নিয়ে বসল। বলল, ‘তপতী, তুমিও একটা খেলে পারতে। জার্নির টায়ার্ড ব্যাপারটা কেটে যেত।’

‘আমি কাটাতে চাই না। টায়ার্ড ব্যাপারটা রাখতে চাই। একটা লুডো কিনে আনব? খেলবে?

দশটা বাজার আগেই গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার খাবার দিয়ে গেল ঘরে। তপতী বলল, ‘আজ আমরা ক্যালে ডিনারের মতো রিভার ডিনার করব।’

‘সেটা কী রকম?’

‘হাতে প্লেট নিয়ে বারান্দায় বসে খাব। মাঝদীতে লঞ্চে বসে খাওয়ার একটা এফেক্ট পাওয়া যাবে।’

কিন্তু সেরকম কোনও এফেক্ট পাওয়ার আগেই অন্য ধরনের সমস্যা হল। খাবার মুখে তুলতেই কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পেল তপতী।

নাক সিটকে বলল, ‘খাবার পচা নাকি গো?’

‘কই না তো?’ বিমল আরামে যাচ্ছে। সে একটা মুরগির হাড় কামড়াতে গিয়ে চোখ বুজে ফেলেছে।

তপতী আবার খাবার মুখে তুলল। উৎকট গন্ধ। গা পাক দিয়ে উঠল তার। আর তখনই গন্ধটা চিনতে পারল। আজ বিকেলে হাসপাতালে এই গন্ধ পেয়েছিল সে। অসুখের গন্ধ।

তপতী ছুটে বাথরুমে গেল এবং আলো জ্বালানোর আগেই বেসিন ভাসিয়ে বমি করল।

তপতীর ঘুম ভাঙল ঠান্ডা হওয়াতে। কোন ফাঁক দিয়ে ঘরে হাওয়া ঢুকছে। এখন ক’টা বাজে? সে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। শরীরটা ভার ভার লাগছে। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাড়াল। অনেক আলোই নিভে গেছে, ফলে এখন নদীকে আলাদা করে দ্যাখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে। প্রকৃতির এটাই মজা। দ্যাখা না গেলেও বোঝা যায়। এত রাতে কোথা থেকে যেন হেঁ হেঁড়া গান ভেসে আসছে। রাতের নদী নানারকম শব্দ বয়ে নিয়ে চলে। তপতীর একটু শীত শীত করছে। সে শাড়িটাকে ভাল করে জড়িয়ে বসল। বিমল ঘুমিয়ে কাদা। কাল রাতে আরও একবার বমি। হয়েছে। গেস্ট হাউসের নীচেই ওষুধের দোকান। বিমল দুটো হজমের ট্যাবলেট আর একটা ভ্যালিয়াম ফাইভ এনে দিল। বলল, ‘খেয়ে নাও। অনেকটা ধকল হয়েছে। নাভিতে অতক্ষণ বসে থেকেছ, হজমের প্রবলেম তো হবেই। রাতে ঠিকমতো ঘুমোলই দেখবে একদম ফিট।’

ঠিকমতো ঘুম কি হল? বোধহয় না। তা হলে মাঝরাতে ঘুম ভাঙবে কেন? তবে শরীর এখন ঝরঝরে লাগছে।

তপতী বারান্দায় বসে রইল। তার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। বিছানায় শুয়ে লাভ নেই, ঘুম হবে না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করার থেকে বারান্দায় বসে বাকি রাতটা কাটানো ভাল।

বেশিক্ষণ কাটাতে হল না। অল্প সময়ের মধ্যেই আলো ফুটতে শুরু করল। তপতী মুগ্ধ হয়ে সেই আলো দেখতে লাগল। তার মনে হল, নদীর ভোর হওয়া পৃথিবীর সেরা দৃশ্যগুলির একটা। সাদা রঙের একটা মায়াময় আলো তার গায়ের ওপর বিছানো। যে-মেয়েটি কাল রাতে গোপনে জলে নেমেছিল, সে বুঝি ভুল করে তার ওড়না ফেলে গেছে। সকালে নদী তার সেই ওড়না ফেরত দিতে চলেছে। খুব সুন্দর কিছু দেখার সমস্যা হল, ভেতরে ভেতরে একটা কষ্ট হয়। সেই কষ্ট বাড়তে থাকে। তখন এমন সব মানুষের জন্য মন কেমন করে যাদের জন্য মন কেমন করার কোনও কারণ নেই। কষ্টের জন্য দারুণ আনন্দ হয়। মনে হয় একটা কিছু করি।

তপতীরও করছে। বড় ধরনের একটা বোকামি করতে ইচ্ছে করছে তার। ইছামতীর কাছে সে কি সেই ইচ্ছের কথা বলবে?

তপতী উঠল। ঘরে ঢুকে সে ক্যাট্র্যাটে সবুজ শাড়িটা পড়ল। কাল রাতে রংটা যত খারাপ লেগেছে, এখন আর ততটা লাগছে না। কলকাতায় ফিরেই ফলস লাগাতে হবে। বিমল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। নিশ্চয় শীত করছে। তার গায়ে বিছানার চাদরটা ভাল করে চাপা দিল তপতী। বেচারির অল্পতেই ঠান্ডা লাগে।

একতলায় দরজা এখনও পুরো খোলেনি। অর্ধেক খোলা। মনে হয়, রোদ না ইলে এখানে দরজা পুরো খোলা হয় না। দরজার বাইরে টুল পেতে নিমডাল মুখে দারোয়ান। তাকে দেখে সে হাসতে গেল এবং মুখের নিমড়াল পড়ে গেল। তারপরেও সে আবার হাসল। বলল, “শুডমর্নিং ম্যাডাম। আপনি নিশ্চয়ই নদীর ধারে যাচ্ছেন? এদিক দিয়ে যান শর্টকাট হবে।’

তপতী হাসল। বলল, ‘না, আমি নদীর ধারে যাচ্ছি না। হাসপাতালটা কোনদিকে ভাই?’

বিমল গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তপতী মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তার বেশ ভয় করছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে, এই মুহূর্তে স্বামীর রাগ-এনার্জির মাত্রা ঠিক কতটুক। পদার্থবিদ্যায় বস্তুর এনার্জি মাপার যন্ত্র আছে, কিন্তু মনের এনার্জি মাপার কোনও যন্ত্র এখনও আবিষ্কার হয়নি। হলে ভাল হত। তা হলে হয়তো বোঝা যেত বিমলের রাগ কমার দিকে না বাড়ার দিকে? মনে হচ্ছে বাড়ার দিকে। বাড়ারই কথা। স্ত্রী বড় ধরনের বোকামি করলে স্বামীর না রেগে উপায়ই বা কী?

হাসনাবাদ থেকে বসিরহাট যাওয়ার রাস্তাটা একেবারে ঝাঁ চকচকে। গাড়ি অনায়াসে হাওয়ার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বিমল তা পারছে না। তাকে গাড়ি চালাতে হচ্ছে সাবধানে, গর্ত বাঁচিয়ে। কেননা, গাড়ির পিছনের সিটে একটি অচেনা অসুস্থ কিশোর তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। লুকিং গ্লাসে সেই কিশোরের মুখ বিমল দেখতে পাচ্ছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম সে গাড়িতে চাপল। গ্রাম্য মহিলার চোখ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। কারণ তার মুখ আজও ঘোমটায় ঢাকা। সে তার ছেলেকে নিয়ে কলকাতার কোন বড় হাসপাতালে চলেছে।

রোগী নিয়ে জোরে গাড়ি চালানো যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *