ইচ্ছার দাম
অরা বলল, তুমি তো কিছুই খেলে না, আমার খাওয়া বেশি হয়ে গেল।
এই বলে ডিভান ছেড়ে উঠে ও জানালার কাছে গেল, একটু দাঁড়িয়ে থাকল, তার পর ডিভানে ফিরে এসে বালিশটা টেনে নিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসল। বলল, রীতিমতো গরম পড়ে গেল। না?
রাজা বলল, বেশ। তবে তোমাদের হাজারিবাগের গরম কিন্তু আমার ভালো লাগে—বেশ শুকনো গরম—মনের আদ্রতা সব শুষে নেয়।
তোমার মনে আদ্রতা আছে নাকি?
আমার কথা তো বলিনি। যাদের মনে আছে, তাদের কথা বলছি।
তার পর ওরা দুজনে কেউই আর কোনো কথা বলল না।
অরার মা-বাবা খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমিয়েছেন। কাবুলি বেড়ালটি আদুরে আদুরে চোখ করে অরার গা-ঘেঁষে বসে আছে। রাজা জানালা দিয়ে বাইরে চাইল। ক্যানারি পাহাড়টি রোদে আর ধুলোর ঝড়ে কেমন মেঘলা দেখাচ্ছে—শুকনো শালপাতাগুলি উড়িয়ে ঘুরিয়ে ছড়িয়ে গরম হাওয়াটা জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে আসছে। বাইরের গেটে বোগোনভেলিয়ার ফুলেভরা ডাল হাহাকার তোলা হাওয়ায় উথাল-পাথাল করছে। গেটের পাশের বাঁদর-লাঠির গাছটির পাতা নড়ছে; পাতা ঝরছে।
এমন সব উষ্ণ হাহা-করা দুপুরে রাজার ইচ্ছা করে ও একটি শুকনো শালপাতার মতো উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে এই হতাশ হাওয়ায় ভর করে কোনো শান্ত নির্লিপ্তিতে সমর্পিত হয়। তার পর কোনো ক্ষীণ খয়েরি নদীর বালিতে অথবা কোনো রুক্ষ কালো পাহাড়ের গায়ে ও পড়ে থাকে। আর চলতে হয় না, ভাবতে হয় না, আর জ্বলতে হয় না তাহলে। শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে একদিন প্রস্তরীভূত হয়ে যেতে পারে।
অরা বলল, কী ভাবছ? বাইরে তাকিয়ে?
কিছু না। যদি বা ভাবতামও, ভাবনা তো কাউকে দেখানো যায় না।
দেখাতে চাও না, তাই দেখানো যায় না।
তা হলে তাই।
রাজা আর কথা বলল না। একটা সিগারেট ধরাল। কথার খেলা আর ভালো লাগে না। বহুদিন হল। যখনই ও আজকাল অরার কাছে আসে, ওর সঙ্গে কথা বলে, চোখে চায়, রাজার সমস্ত শরীর জুড়ে কী একটা জ্বালা কাঠের আগুনের মতো জ্বলে—ঠোঁটটা শুকিয়ে আসে—বুকটা হায় হায় করে। রাজার মনে হয়, কোনো-কোনোদিন অরারও নিশ্চয়ই ওরকম অস্বস্তি হয়। ও বড়ো চাপা মেয়ে। ওর মুখ দেখে কিছু বোঝা সহজ নয়। ওর বুকে ঝড় উঠলেও মুখ প্রশান্ত থাকে।
তবু রাজার বহুদিন মনে হয়েছে—ওরা দুজনে একটি টাব-পেয়ারে বসে দাঁড় টানছে ইচ্ছার জলে। রাজার হাতে স্ট্রোকের দাঁড় আর অরার হাতে বো—সাইডের। ওরা দুজনেই সামনে দাঁড় টেনে চলেছে কিন্তু কোনোদিন একসঙ্গে জল কাটেনি। ককসে কে কে আছে, রাজা জানে না। ভগবান-টগবান গোছের কোনো শক্তি নিশ্চয়ই আছে। সে কোনোদিন তাদের দুজনকে একসঙ্গে দাঁড় ফেলতে দেয়নি সিং-ক্রোনাইজেশান নামক ঘটনাটি ঘটেনি ওদের দুজনের জীবনে। একজন যখন খুব একান্তভাবে অন্যজনকে চেয়েছে, তখন সে কুঁকড়ে থেকেছে। আবার সে যখন হাত বাড়িয়েছে, জোরে দাঁড় ফেলে শক্ত হাতে জল কেটেছে, অন্যজনের দাঁড় তখন জলেই নেই। কার অভিশাপে এমন হয়েছে, রাজা জানে না। অরা জানে কি না অরাই জানে।
রাজা অরার দিকে তাকাল। একটা সাদা ছাপা ভয়েলের শাড়ি পরেছে আজ, মধ্যে হালকা পোলকা ডট বসানো। একটা নীলরঙা ফুল গুঁজেছে বেণীতে! ও বালিশে ভর করে আধো শুয়ে আছে।
ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রাজা হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল যে, আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। সব নেবে অথচ কিছুই দেবে না—এ বরাবর চলতে পারে না। ঘুমোবার সময়ে তার মুখ ভেবে ঘুমোবে, ঘুম ভেঙে প্রথম তার মুখ মনে পড়বে—পৃথিবীর আর কোনো মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারবে না, কারণ অনুক্ষণ সে-ই একা রাজার মন-জুড়ে চোখ-ভরে আছে—অথচ অরা তাকে বরাবরই এমন সাপের খোলসের মতো শীতলতায় মুড়ে রাখবে, এ হতে পারে না।
রাজা ভাবল, আজ মনে মনে অরাকে ঘেরাও করে ফেলবে, তার এতদিনের দাবি মেটাতেই হবে।
রাজা বলল, বইটা এখন রাখো, আমার দিকে তাকাও।
অরা দুটি উজ্জ্বল চোখ তুলে বলল, কী? হলটা কী?
কী হল তুমি জানো না?
না অসভ্যতা করবে না। প্লিজ, তুমি এমন কিছু চেয়ো না যাতে তুমি সকলের সমান হয়ে যাও। তুমি জানো না রাজা, তুমি আমার চোখে কত বড়ো! তোমাকে তো কতদিন বলেছি।
রাজা বলল, অসাধারণ হয়েই তো এতদিন কাটিয়ে দিলাম। তাতে লাভ হল না এককণা, নিজের মধ্যের জ্বালাটা, কেবল বেড়েই চলল। তোমার কোনো ধারণা আছে, তুমি আমাকে কতখানি যন্ত্রণা দিয়েছ এতদিন, এতবছর, প্রতিমুহূর্ত?
অরা মুখ নীচু করে বলল, আমি তো দিতে চাই না—তোমাকে একটুও যন্ত্রণা দিতে চাই না। আসলে তুমি যন্ত্রণা পেতে ভালোবাসো। এ তোমার একটা বিলাস—বেদনা-বিলাস। বলে অরা ওর বেড়ালটির নরম গায়ে হাত বোলাতে লাগল।
রাজা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখতে রাখতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথা বলল না।
অরা বালিশটা সরিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, কী? বাবুর রাগ হল বুঝি? তুমি আমাকে মুখে মুখেই ভালোবাসো। সত্যিই ভালোবাসলে তুমি আমার ইচ্ছার দাম দিতে।
রাজা তবুও কথা বলল না, জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
এই ইচ্ছার দামের কথা অরা অনেকদিন রাজাকে বলেছে। একমাত্র রাজাই জানে যে, অরার ইচ্ছার দাম কতভাবে এবং কীসের বিনিময়ে ও দিয়ে এসেছে। তবু অরা ওকে বারে বারে স্মরণ করায় তার ইচ্ছার দামের কথা। অথচ রাজার, যেন কোনো ইচ্ছাই নেই; থাকতে পারে না। রাজা যেন ভগবান, যেন ও রক্তমাংস শরীর-হৃদয়ের কোনো সাধারণ মানুষ নয়।
রাজার ইচ্ছা ছিল ও এয়ার ফোর্সের পাইলট হয়, কিন্তু বাবার ইচ্ছার দাম দিতে ও সলিসিটর হয়েছে। রাজার খুব ইচ্ছা ছিল ও মালিনীকে ব্যথা না দেয়, কিন্তু মার ইচ্ছার দাম দিতে ও মালিনীকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যথা দিয়েছে। আর আজ রাজার নিরুপায় ভালোবাসাকে অরা প্রতিমুহূর্তে পায়ে মাড়াচ্ছে—ওকে তার ইচ্ছার দাম দিতে বলছে। বলছে, ঠাকুরঘরের ভগবান হয়ে চিরদিন ওর মনের জগতে বাস করতে। মনটাই সব, শরীরটা শুধুই ঘৃণার—এমন কথা বলে বলে, রাজার নিজের শরীরের ওপরও অরা একটা ঘৃণা জন্মিয়ে দিয়েছে।
এই পৃথিবীতে কে-ই বা কার ইচ্ছার দাম দেয়?
কোনো নির্জন দুপুরের ফিরিওয়ালার মতো মনের ডালিতে তার সমস্ত সুগন্ধি ইচ্ছার ফুলগুলি সাজিয়ে রাজা কতদিন ফিরি করে ফিরেছে। কেউ তার ইচ্ছার কোনো দাম দেয়নি। তার সব ইচ্ছার ফুল রোদের তাপে এক এক করে শুকিয়ে গেছে। তবুও তার কাছেই সকলে ইচ্ছার দাম দাবি করে এসেছে। এবং ও এমনি বোকা, এমনি হৃদয়বান যে সকলের ইচ্ছার দাম দিতে দিতে সে নিজেকে বার বার বঞ্চনা করেছে।
‘ইচ্ছার দাম’ কথাটা শুনলেই আজকাল ভীষণ রাগ হয়ে যায় রাজার। ও সাধারণ, সাধারণ হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু অরার কাছে এলেই অরা বাটার দোকানের ম্যানেজারের মতো হেসে হেসে, রাজাকে ছোটো ছেলে ভেবে মহত্ত্বের মোহন মুখোশ পরিয়ে দেয়। প্রতিবার রাজা মহত্ত্বের মুখোশ পরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায়। এমন করে দিন আর কাটছে না।
হঠাৎ অরা বলল, জানো? তোমাকে বলতে ভুলে গেছিলাম—সেদিন এক কান্ড হয়েছে। গতমাসে যখন কলকাতায় গেছিলাম এষা, কোয়েল, মুনিয়া ওরা সকলে ধরল, চাইনিজ খাওয়াতে হবে। পার্ক স্ট্রিটে খেতে গেলাম। খাওয়ার পর যখন বেরোলাম, তখন দেখলাম কী জানো?
কী?
অরা একটু ভাবল, বলল তোমাকে বলছি, কিন্তু তুমি আর কাউকে বোলো না।
রাজা বলল, তুমিই যে সকলকে বলবে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। আমি বলব না সে সম্পর্কে নির্ভয়ে থাকতে পারো।
বলছি কিন্তু তা হলে—দেখলাম রঘুদা—মানে রিনিদির বর, ডেড ড্রাঙ্ক হয়ে একটা বার থেকে বেরোল—সঙ্গে একটি দারুণ ফিগার কিন্তু খারাপ মুখের মেয়ে—মেয়েটা হাঁটতে পর্যন্ত পারছিল না—এমন বেহুঁশ। ট্যাক্সি—ট্যা—ক্সি করে দু-বার ডাকল, তার পর ট্যাক্সিতে এমনভাবে দুজনে উঠে চলে গেল যে তোমাকে বলতে পারছি না। ফুটপাথে ভিড় জমে গেল। এষারা ওদের নিয়ে আলোচনা করতে লাগল—আমি লজ্জায় রঘুদাকে যে চিনি এমন কথা পর্যন্ত বলতে পারলাম না। কী খারাপ তাই না? ইশ বেচারি রিনিদি।
রাজা বলল, তুমি যদি আমায় কোনোদিন এমনভাবে দেখো, আমার সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা হবে?
অরা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ধারণা মানে? তোমার সঙ্গে কোনোদিন কথাও বলব না। বাড়ি ঢুকলে কুকুর লেলিয়ে দেব।
রাজা হাসল, বলল, এইখানে তোমাদের সঙ্গে পার্বতীদের অমিল। দেবদাসকে দেখে পার্বতীর অন্তত দয়া হয়েছিল। তোমাদের দয়াও নেই।
না, নেই। ওরকম উপমা আজকাল চলে না, শরৎ চ্যাটার্জির সময়ের দেবদাসেরা আজকাল আর জন্মায় না। তুমি কি বলতে চাও যে রঘুদার সঙ্গের মেয়েটির সঙ্গে রঘুদার কোনো ইমোশানাল কানেকশান ছিল? তবে? দেবদাসের মতো যদি শুধু মদ খেয়ে একজনের দুঃখ ভোলার জন্যে মরে যেত, তা হলে তার কেসটা কনসিডার করা যেত—কিন্তু এসব তো অত্যন্ত নোংরা ব্যাপার, বাজে ব্যাপার—রঘুদা ভালোবাসার কী জানে?
রাজা আবার হাসল। বলল তোমার ভয় নেই। আমি চেষ্টা করেও কোনোদিন রঘুদা হতে পারব না—কারণ তোমরা যাকে গাটস বলো আমার হয়তো সেটাই নেই, তা ছাড়া হয়তো আমি ওই যুক্তিতে বিশ্বাস করি না। একমুহূর্তের জন্যে যাকে-তাকে পেয়ে খুশি হবার চেয়ে সারাজীবন একজন বিশেষ কাউকে চেয়ে দুঃখ পাওয়া ভালো। পাওয়াটাই তো সব নয়, কী পাব সেটাই সব।
জানো অরা, তোমাকে ভালোবেসে আমার ইহকাল পরকাল সব গেল। তুমি আমার ভালোবাসা দু-হাতে ঠেলে সরালে আর আমি অন্য সকলের ভালোবাসা কাচের বাসনের মতো হাত থেকে ফেলে দিলাম। মজাই লাগে ভাবলে।
অরা কোনো জবাব দিল না। চুপ করে, গর্বিত চোখে রাজার মুখে চেয়ে রইল।
দুজনে আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।
কথায় কথায় বিকেল গড়িয়ে গেল।
হঠাৎ রাজা বলল, এই আমার কাছে এসো।
না। বলছি না অসভ্যতা কোরো না, বলল অরা।
কিন্তু রাজার মনে হলে, অরার মুখে সেই মুহূর্তে ও কী যেন এক অজানা আবির দেখতে পেল, যা ও আগে কোনোদিন দেখেনি—যেকোনো কারণেই হোক—এই জ্বালাধরা দুপুরে ওর কাবুলি বেড়ালের মতো অরার নিজেরও বোধ হয় একটু আদর খাবার ইচ্ছা হল। কিংবা নিজেকে তাই বোঝাল রাজা। রাজা হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে অরার কাছে যেতে গেল। যাবার আগে জানালার পর্দাগুলি টেনে দিতে গেল। এই অবকাশে অরা দৌড়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বাইরের বারান্দায় দাঁড়াল।
রাজার সমস্ত বুকে রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করতে লাগল, কোনোদিন ওর এমন হয়নি—কোনোদিন না। ও ডাকল, অরা। অরা উত্তর দিল না—বারান্দা থেকে বেড়ালটি মিঁয়াও করে উঠল। আবার রাজা ডাকল, অরা, এঘরে এসো। অরা উত্তর দিল, বলল, কী? কিন্তু ঘরে এল না। রাজা আরও একবার ডাকল। এবারে অরা এসে পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকল—এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজা ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল—অরা একটু সামনে ঝুঁকে রাজার আদর খেল—তার পর ফিসফিসিয়ে একনিশ্বাসে বলল, মা উঠে গেছেন; মা উঠে গেছেন। ছাড়ো। পরক্ষণেই ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ রাজা একা একা বসে থাকল পর্দাটানা ঘরে।
তার পর অরাকে খুঁজতে খুঁজতে দেখল অরা তার পড়ার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।—এখনও উত্তেজনায় জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। রাজা ডাকল, অরা। অরা মুখ না ফিরিয়েই ধীরে ধীরে বলল, কেন এমন করলে? তুমি ভারি অসভ্য; ভীষণ অসভ্য। আজ তুমি আমার চোখে সকলের সমান হয়ে গেলে রাজা, তুমি আমার ইচ্ছার দাম দিলে না।
রাজা ভেবেছিল, হয়তো অরা কাঁদবে, ভেবেছিল ওকে ঘৃণা করবে ওকে চলে যেতে বলবে; কিন্তু অরা কিছুই করল না—কেমন এক রহস্যময় হাসিতে মুখ রাঙিয়ে আবার বলল, আজ থেকে তুমি ছোটো হয়ে গেলে। ঈশ কেন এমন করলে?
রাজা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
স্মিথসাহেবের বাড়ির বাগানে কতরকম ফুল ফুটেছে—ফিকে বেগুনি-রঙা ফুলের থোকা হাওয়ায় দুলছে গোলাপি আকাশের পটভূমিতে। গয়ার বাসটি গোঁ-গোঁ করে লাল ধুলো উড়িয়ে নির্জন পথ বেয়ে আচমকা চলে গেল।
রাজার ঠোঁটে এখনও অরার ঠোঁটের মিষ্টি আমেজ ছিল। ওর বুকের কাছে অরার ছিপছিপে শরীরের ভার তখনও ফুলের গন্ধের মতো ভাসছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে রাজার ভীষণ কান্না পেল। এতদিন তো ওর যন্ত্রণায় কেমন এক গভীর আনন্দও ছিল কিন্তু আজকের এই পাওয়া—এই উষ্ণতা, এই সুবাস—সব কিছুতে কেমন যেন একটা দুঃখ আছে, হীনম্মন্যতা আছে। এতদিন ও বরাবর অরাকে অপরাধী করে এসেছিল, আজকে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হতে লাগল। রাজার খুব ইচ্ছা করল যে অরাকে বলে, আমার পুরোনো মহত্ত্বের ছিঁড়ে-যাওয়া মুখোশটা নিজে হাতে আবার আমাকে পরিয়ে দাও। ওর বলতে ইচ্ছা করল, অরা তোমার সব রঙিন ইচ্ছাগুলোকে আমি মাছরাঙা পাখির ডিমের মতো একটি একটি করে আমার প্রেমের উত্তাপে ফুটিয়ে তুলব একদিন না একদিন। তুমি দেখো অরা, তুমি দেখো। তোমাকে যে আমি সত্যিই ভালোবেসেছি, অরা, এ তো ভানমাত্র নয়। কিন্তু মুখর রাজা এখন মুখে কিছুই বলতে পারল না। কোনোরকমে বাধো-বাধো গলায় বলল, চলি।
প্রতিদিন অরা বারান্দা অবধি এগিয়ে দিতে আসে। কী সুন্দর হাসি হাসে, বলে রাজা আবার এসো। আজ অরা এল না, কিছু বললও না। যেমন দাঁড়িয়েছিল জানালার সামনে, তেমনি উদাস চোখে দাঁড়িয়ে রইল।
গেট পেরিয়ে নেমে ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা-বিছানো পথে মুখ নীচু করে হাঁটতে হাঁটতে রাজা ভাবতে লাগল। নিজেকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ও হাঁটতে লাগল। সত্যিই কি অরার ইচ্ছার দাম ও দেয়নি? ইচ্ছার দাম। সত্যিই কি দেয়নি?
হাওয়ায় বোগোনভোলিয়ার নাচ দেখতে দেখতে অরা নিজের মনে হেসে উঠল, মনে মনে বলল, অসভ্য! রাজাটা ভীষণ অসভ্য।
তার পর হিটারে চায়ের জল চাপিয়ে মাকে ডাকল, বলল, ও মা ওঠো না; বাইরে এসে দেখো, আজকের বিকেলটা কী সুন্দর।