ইউরোপ: আজ ও আগামী কাল

ইউরোপ: আজ ও আগামী কাল

আধুনিক রাজনীতিতে বিভিন্ন জাতিকে ‘বিত্তবান’ ও ‘সর্বহারা’ এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা প্রথাসিদ্ধ। গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশ হল যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভার্সাই, ট্রিয়ানন ও নিউল্লির সন্ধিগুলির ফলে লাভবান হয়েছে। আর সেইসব দেশ সর্বহারা, যারা এইসব সন্ধির কোনও কোনওটির ফলে নিজেদের প্রদেশ হারিয়েছে কিংবা সন্ধিগুলির শর্তাদি সম্বন্ধে যাদের অভিযোগ আছে। ইউরোপে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ভূতপূর্ব অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য থেকে যেসব রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে তারা ‘বিত্তবান’দের দলে। অন্যদিকে জার্মানী, ইতালি, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া ও বুলগেরিয়া ‘সর্বহারা’দের দলে। গত যুদ্ধের ফলে যদিও রাশিয়া বহু প্রদেশ হারিয়েছিল তবু সে এখন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী এবং সেজন্যে তাকে ‘বিত্তবান’দের দলে ফেলা হয়। যদিও যুদ্ধের শেষে ইতালি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য থেকে ভূখণ্ড দখল করেছিল তবু তাকে ‘সর্বহারা’র দলে ফেলা হয় এই কারণে যে, যুদ্ধের লুঠের আরও বখরা পাবার প্রত্যাশা তার ছিল। ১৯১৫ সালে লন্ডনের গোপন চুক্তির শর্তদ্বারা ইতালিকে মিত্রপক্ষে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। এই চুক্তি অনুসারে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাকে ডালমাসিয়ান উপকূল-সহ আরও কয়েকটি বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে শান্তি সম্মেলন যুগোস্লাভিয়াকে ডালমাসিয়ান উপকূল দিয়েছিল (শান্তি চুক্তিতে যুগোস্লাভিয়ার নামকরণ করা হয়েছে সার্ব, ক্রোট ও স্লোভেনদের রাজ্য রূপে)।

‘সর্বহারা’দের মধ্যে বুলগেরিয়া বেশি শান্ত। ১৯১২ সালের বল্‌কান যুদ্ধ এবং মহাযুদ্ধের ফলে সে তার সকল প্রতিবেশী দেশের (রুমানিয়া, গ্রিস ও সার্বিয়া—এখন যুগোস্লাভিয়া) কাছে নিজের দেশ হারিয়েছে। কিন্তু সে গোপনে তার অভিযোগ পুষে রেখেছে এবং সুদিনের প্রত্যাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, যদিও সে বিরুদ্ধ শক্তিগুলির বৃত্তের মধ্যে নিজেকে অসহায় বোধ করে। হাঙ্গেরি অন্তত প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয়। তার সমর্থকগণ সারা ইউরোপে ঘুরে বড় শক্তিগুলির মধ্যে তার সীমান্ত সংশোধনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্যে প্রচারকার্য চালান। সামরিক দিক থেকে বিচার করলে হাঙ্গেরির আজ আর কোনও গুরুত্ব নেই; সে তার পূর্বতন দেশের ও জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি হারিয়েছে চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া (আগে সার্বিয়া) এবং রুমানিয়ার কাছে।

অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে বিপ্লব সৃষ্টির জন্যে ব্যস্ত সোভিয়েট রাশিয়াকে দৈত্যাকৃতির বিস্ফোরক শক্তি বলে গণ্য করা হত। কিন্তু আজ সে অবস্থা নেই। লেনিনের মৃত্যুর পর ও ট্রট্‌স্কির ক্ষমতাচ্যুতির পর স্টালিনের পরিচালনাধীন সোভিয়েট রাশিয়া সোভিয়েট সীমান্তের মধ্যে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে একমাত্র আগ্রহী। জার্মানীর হঠাৎ পুনরভ্যুদয় এই প্রবণতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। সুতরাং রাশিয়া ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রভাবাধীন লীগ অফ নেশনসে যোগ দিয়েছে এবং ‘সামরিক নিরাপত্তা ও শান্তি’র ধ্বনি তুলে ইউরোপে বর্তমান অবস্থার রদবদল প্রতিরোধের জন্যে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করছে। আজ ইউরোপে ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসী জার্মানী হল প্রকৃত বিস্ফোরণাত্মক শক্তি। তাদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েট রাশিয়া। ইউরোপের জটিল দাবার ছকে অসংখ্য চাল চলছে এবং দিনের পর দিন দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটছে।

মহাযুদ্ধের আগে ‘শক্তির ভারসাম্য’ রক্ষা করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছিল। স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যে একটা গোপন বোঝাপড়া থাকত এবং যেসব সম্ভাব্য বিরুদ্ধ শক্তি তাদের সঙ্গে যোগ দিতে অস্বীকৃত হত তাদিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলাবার চেষ্টা করা হত। ১৯১৯ সালে যে জাতিসংঘ গড়ে তোলা হয়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল গোপন দৌত্যের অবসান এবং যে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগোষ্ঠীগুলি পৃথিবীকে বিভক্ত করে যুদ্ধকে জিইয়ে রাখত তার অবসান ঘটানো। এর পরিবর্তে একটা নতুন কর্মপদ্ধতি চালু করা হয়েছিল এবং তার লক্ষ্য ছিল সকল দেশকে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত করে তাদিকে ‘সামূহিক নিরাপত্তা ও শান্তি’র জন্য যৌথভাবে দায়ী করা। জাতিসংঘ ও তার নতুন কর্মপদ্ধতি উভয়েই লক্ষ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়, কারণ এমন কিছু শক্তি আছে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী নয়। এদের মধ্যে জাপান ও জার্মানী এখন আর সংঘের সদস্য নয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো কখনই এর সদস্যই হয়নি।

ইউরোপের সাম্প্রতিক গোলযোগের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝতে হলে ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসী জার্মানীর লক্ষ্যগুলি বুঝতে হবে। ১৯২২ সালে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইতালি আক্রমণাত্মকভাবে সম্প্রসারণের কথা ভাবছে—পৃথিবীতে একটা বড় স্থান পাবার কথা এবং রোম সাম্রাজ্য পুনরুজ্জীবনের কথা। কিন্তু ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে পর্যন্ত ইতালি নিজেই জানত না তার সম্প্রসারণের নীতি কোন্ দিক অনুসরণ করে চলবে। যে যুগোস্লাভিয়া তাকে ডালমাসিয়ান উপকূল থেকে বঞ্চিত করেছে তার বিরুদ্ধে ইতালির অভিযোগ ছিল। ফ্রান্সের প্রতি তার বিদ্বেষ ছিল এই কারণে যে ইতালির স্যাভয় ও নাইস জেলা তার দখলে গেছে, উত্তর আফ্রিকায় বিরাট ইতালিয় জনসংখ্যা-সহ টিউনিসিয়া তার দখলে ছিল এবং ভৌগোলিক বিচারে যে কর্সিকা দ্বীপ ইতালির, ফ্রান্স তারও মালিক হয়েছিল। ইতালি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের এই কারণে বিরোধী ছিল যে ব্রিটেন ইতালিয় ‘মাল্টা’ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল এবং ফ্রান্সের সম্মতিক্রমে ভূমধ্যসাগরকে একটি ব্রিটিশ হ্রদে পরিণত করেছিল।

ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে উত্তেজনা খুব তীব্র ছিল এবং তার ফলে ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যবর্তী সীমান্ত সুরক্ষিত করা হয়েছিল ও উভয়দিকে কড়া পাহাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপর ১৯৩৯ সালে হঠাৎ নাৎসী দানবের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং ফলে সারা ইউরোপের রূপান্তর ঘটেছিল। নতুন বিপদের বিরুদ্ধে সমর্থন ও মৈত্রীর আশায় ফ্রান্স ব্রিটেনে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটেন ন যযৌ ন তস্থৌ নীতি নিয়ে বসেছিল। হয়তো সে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে আশা পোষণ করছিল যে এতে ইউরোপে ফ্রান্সের প্রভুত্ব বিস্তার প্রতিহত হবে। হয়তো সে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার ঐতিহ্যগত নীতিকে সরলভাবে অনুসরণ করে চলছিল। কিন্তু ফ্রান্স জালে পড়ে বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়েছিল ইতালি ও সোভিয়েট রাশিয়ার দিকে। ফ্রান্স ইতালিয় সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে জার্মানীর বিরুদ্ধে তা সমাবেশ করতে চেয়েছিল এবং সে আরও চেয়েছিল জার্মানীর পূর্বদিকে একটি মিত্রশক্তি। এইভাবে লাভাল-মুসোলিনি চুক্তি ও ফরাসী-সোভিয়েট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে সম্পাদিত লাভাল-মুসোলিনি চুক্তি ইতালির ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের দিক নির্ণয় করে দিয়েছিল। ইতালি ফ্রান্সের সঙ্গে তার বিরোধের অবসান ঘটিয়েছিল এবং ইউরোপে তার ভূখণ্ড বিস্তারের উচ্চাকাঙক্ষা ছেড়েছিল। পরিবর্তে ফ্রান্স আফ্রিকায় তার আত্মসম্প্রসারণের অধিকার মেনে নিয়েছিল। আবিসিনিয়া ধর্ষণ তার পরিণতি।

আবিসিনিয়া বিজয়ের পর মুসোলিনি একটি বক্তৃতায় পৃথিবীর সামনে ঘোষণা করেছিলেন যে ইতালি এখন ‘সন্তুষ্ট’ শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবিসিনিয়া সংযোজনকে ব্রিটেন আফ্রিকায় তার রক্ষিত ভূমিতে অনধিকার প্রবেশ বলে গ্রহণ করেছিল এবং এই বক্তৃতাটি ইঙ্গ-ইতালিয় বন্ধুত্ব নবীকরণের সম্ভাবনার দিকে নজর রেখে করা হয়েছিল। সেই প্রত্যাশা অবশ্য পূর্ণ হয়নি। যদিও ব্রিটেন প্রথমে আবিসিনিয়ার প্রশ্নে ইতালিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং পরে মুসোলিনির বাগাড়ম্বর ও হুমকির সামনে পিছু হটেছিল তবু সে সেই অপমান ভোলেনি। ভূমধ্যসাগরীয় ও নিকট প্রাচ্যের জাতিগুলির কাছে তার যে মর্যাদা হানি হয়েছিল, তা পূরণের উদ্দেশ্যে সে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তার নৌ-ঘাঁটি ও বিমানঘাঁটিগুলির শক্তি বাড়াতে নৌবাহিনীর First Lord স্যার স্যামুয়েল হোর ভূমধ্যসাগর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং পরিদর্শন শেষে ঘোষণা করেছিলেন যে ব্রিটেন ওই এলাকা থেকে সরে আসবে না। অ্যান্টনি ইডেনের মতো মন্ত্রিসভার অন্যান্য মন্ত্রী এই মর্মে ঘোষণা করেছিলেন যে ভূমধ্যসাগর ব্রিটেনের জীবন-সূত্র—এটা তার সহজ চলাচলের পথ মাত্র নয়, এটা তার যোগাযোগকারী প্রধান পথ।

ব্রিটেনের পক্ষে ভূমধ্যসাগরে নিজের শক্তি রক্ষা ও সে শক্তি আরও বাড়ানর সঙ্কল্প ইতালিকে বিরক্ত ও শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছে, কারণ ইতালিও তার নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে নিজের প্রভাব বাড়াতে সমান কৃতসঙ্কল্প এবং একমাত্র ব্রিটেনের স্বার্থ বিনষ্ট করে তা করা সম্ভব। সুতরাং এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে বর্তমান ইঙ্গ-ইতালিয় উত্তেজনা ইল ডুচের (Il Duce) বদমেজাজের ফল নয় কিংবা এটা একটা সাময়িক ব্যাপারও নয়। যে পর্যন্ত না বিরোধী দু’টি শক্তির যে-কোনও একটির স্বেচ্ছায় পিছু হটা কিংবা হেরে যাবার মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে ভবিষ্যৎ কর্তৃত্বের প্রশ্নটির চূড়ান্ত সমাধান হয়, সে পর্যন্ত এটা চলবে। নেভিল চেম্বারলেন ও সিনর মুসোলিনির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-সুলভ পত্র-বিনিময় হতে পারে, রাষ্ট্রদূতেরা ও বৈদেশিক মন্ত্রীরা হাত মেলাতে পারেন কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ও শক্তি থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণগুলি যতদিন থাকবে ততদিন তাও অব্যাহত থাকবে।

স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে ভূমধ্যসাগরে ব্রিটেনের নতুন আগ্রহের উত্তর ইতালি দিয়েছে। এটা চিন্তা করা কিংবা এরকম বলা শিশুসুলভ হবে যে, ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট লক্ষ্যের প্রতি সহানুভূতির দরুন কিংবা তার কমিউনিজম বিদ্বেষের দরুন, ইতালি ফ্রাঙ্কোর সমর্থনে গেছে। ফ্রাঙ্কোর প্রতি তার রাজনৈতিক সহানুভূতি যে-কোনও অবস্থায় থাকবে, কিন্তু সে যে ফ্রাঙ্কোর জন্যে নিজের রক্ত ও অর্থ নিঃশেষে ঢেলেছে তা মূলত সমরকৌশলের দরুন। জার্মানীর ক্ষেত্রেও এই একই সত্য এবং যিনি তা বোঝেন না তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের কিছুই বোঝেন না।

নিজের অস্ত্রসজ্জায় অগ্রগতি সত্ত্বেও ইতালি কোনওক্রমে ব্রিটেনের সমকক্ষ নয়। সারা বিশ্বে ব্রিটেনের অস্ত্রসজ্জা আবিসিনিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে ইতালির অবস্থা দুর্বলতর করে তুলেছে। ইতালির সঙ্গে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন জিব্রাল্টার ও সুয়েজ নিয়ন্ত্রণ করে ইতালিয় নৌ-বাহিনীকে আবদ্ধ করে রাখতে পারে এবং অর্থনৈতিক অবরোধের সৃষ্টি করতে পারে। এটা ইতালির পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতালিকে কয়লা, লোহা, তেল, পশম, তুলো প্রভৃতি অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয় এবং যেখানে তার নৌবাহিত বাণিজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ আসে আটলান্টিক মহাসমুদ্রের বুক দিয়ে, তার আমদানির শতকরা আশিভাগ আসে ভূমধ্যসাগর দিয়ে। তার তীরভূমি দীর্ঘ ও দুর্ভেদ্য এবং একমাত্র ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য করতে পারলে তার পক্ষে আফ্রিকাস্থিত অধীন দেশ লিবিয়া, ইরিট্রিয়া ও আবিসিনিয়ার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা সম্ভব। এইসব কারণে মাল্টা ও সাইপ্রাসের মতো ব্রিটিশ নৌ-ঘাঁটি থেকে আক্রমণ-সহ অর্থনৈতিক অবরোধ ইতালির ভয়ঙ্কর বিপদ সৃষ্টি করতে পারে এবং এমনকি তার শ্বাসরোধ করতে পারে। সে ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ অধিকারগুলি আক্রমণ করে কিংবা সেই সাগর দিয়ে চলাচলকারী ব্রিটিশ বাণিজ্যতরী আক্রমণ করে প্রতিশোধ নিতে পারে, কিন্তু ভূমধ্যসাগর এলাকার বাইরে অবস্থিত ব্রিটেনকে সে আক্রমণ করতে পারে না কিংবা ব্রিটেনের কাঁচামাল ও খাদ্যের উৎসগুলিকেও স্পর্শ করতে পারে না। এইভাবে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইতালি কার্যত অসহায় এবং মূলত সে রক্ষণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

আর যতদিন স্পেন ব্রিটেনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন কিংবা এমনকি নিরপেক্ষ থাকবে ততদিন ইতালির অসহায়তা ঘুচবে না। একমাত্র স্পেনের সাহায্যে ইতালি তার দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির আশা করতে পারে। স্পেনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে পেলে ইতালি ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আক্রমণের চেষ্টা করতে পারে। সে জিব্রাল্টার ধ্বংস করতে পারে এবং ব্রিটেনের দু’টি বাণিজ্যপথকে—ভূমধ্যসাগরীয় পথ ও উত্তমাশার পথ—বিপন্ন করতে পারে। অধিকন্তু, আটলান্টিক সমুদ্রের দিক থেকে তার আমদানি দ্রব্যগুলি স্থলপথে স্পেনের ওপর দিয়ে আসার ব্যবস্থা করে সে সম্ভাব্য অর্থনৈতির্ক অবরোধ কাটিয়ে উঠতে পারে। আবিসিনিয়ার যুদ্ধের সময় যেমন ব্রিটেনের সঙ্গে তুলনায় ইতালিয় নৌ—বাহিনীর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে তার বিমানবাহিনী সাহায্য করেছিল, তেমনই স্পেনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কিংবা স্পেনের ভূখণ্ডে পা রাখতে পারলে, ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সময় তার বর্তমান মারাত্মক রকমের দুর্বল ও আত্মরক্ষামূলক অবস্থাকে সে প্রবল ও আক্রমণাত্মক অবস্থায় পরিণত করতে পারে।

এইভাবে ইতালি স্পেনে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সে স্পেনের ভূখণ্ডে পা রাখবার মতো জায়গা পাবার জন্যে ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করছে।

এইসব রণকৌশলের দিক বিবেচনা করলে ইতালি যে ফ্রাঙ্কোর সাফল্যে এতটা আগ্রহী তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। বরং এটাই বিস্ময়কর যে, ফ্রাঙ্কো ও বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি জানাবার মতো মানুষ ব্রিটেনে আছেন। এ-বিষয়ে সুপরিচিত ব্রিটিশ সমরকুশলী ক্যাপ্টেন লিডেল হার্ট তাঁর ‘ইউরোপ ইন-আর্মস’ গ্রন্থে লিখেছেন:

“সমর-কৌশলের দিক থেকে বিপদ (ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষে) এত স্পষ্ট যে, ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে সর্বাধিক স্বীকৃত দেশপ্রেমিক মানুষের কিছু অংশ কীভাবে এত আগ্রহের সঙ্গে বিদ্রোহীদের সাফল্য কামনা করেন তা বোঝা কঠিন।”

এটা হয়তো স্বার্থের ওপর রাজনৈতিক কুসংস্কারের (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রবাদী ও কমিউনিস্টদের প্রতি ঘৃণা) বিজয়ী হবার একটি উদাহরণ।

আমি যা-কিছু বলেছি তা সত্ত্বেও এটা বলতে হবে যে ইতালি আজ মোটামুটি একটা সন্তুষ্ট শক্তি। ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ প্রভুত্বের হ্রাস তার কাম্য এবং সে মনে করে যে প্রাচীন কালের মতো ভূমধ্যসাগর একটা রোমান হ্রদ হয়ে থাকা উচিত। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে তার বিরোধে সে চরম কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ তার দিক থেকে ভাল মনে করে কেননা সে এটা ভালভাবে জানে যে কোনও বড় শক্তিই এখনও আন্তর্জাতিক যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত নয়। মুসোলিনি এত সচতুর রাজনীতিবিদ যে তিনি অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে কোনও বিপজ্জনক অভিযানে নিজেকে কিংবা তার দেশকে জড়িয়ে ফেলবেন না। অতএব আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্যে ইতালি আক্রমণাত্মক কিছু করবে না কিংবা সে জয়লাভ সম্বন্ধে সুনিশ্চিত না হলে কোনও যুদ্ধে যোগ দেবে না।

কিন্তু জার্মান সেনাবাহিনীর ধীর ও সাবধানী নীতি সত্ত্বেও হিটলারের অধীন জার্মানী কী করবে বলা কঠিন। নাৎসী জার্মানী এমন স্বপ্ন দেখছে যা কেবল যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ণ হতে পারে। তাছাড়া জার্মানীর ভেতরে অর্থনৈতিক সঙ্কট এমন তীব্র রূপ ধারণ করেছে যে, অনেক পর্যবেক্ষক এই অভিমত পোষণ করেন, এমন দিন সুদূর নয় যখন দেশের অসন্তোষ চাপা দেবার জন্যে তাকে স্বদেশের বাইরে যুদ্ধ করতে হতে পারে। জার্মানীর ভবিষ্যৎ বুঝতে হলে আমাদের আর-একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

মহাযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপীয় মহাদেশে ফরাসী প্রভুত্ব চলেছে। জার্মানীকে পরাজিত করেও সন্তুষ্ট না হয়ে ফ্রান্স পোল্যান্ড ও ক্ষুদ্র আঁতাত নামে (Little Entent) পরিচিত উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রগুলি চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া ও রুমানিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর মাধ্যমে জার্মানীর চারদিকে কূটনৈতিক প্রকার তৈরি করেছে। পরে এই নীতি অনুসরণ করে যে তুরস্ক আগে জার্মান প্রভাব-বৃত্তের মধ্যে ছিল তার সঙ্গে ফ্রান্স হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করেছে। জার্মানী যখন এইভাবে কূটনৈতিক বিচারে সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল তখন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার উপায় ছিল না। সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে র‍্যাপাল্লো চুক্তি (Treaty of Rapallo) করে এই ঘেরাও-নীতির একমাত্র জবাব সে দিয়েছিল।

১৮৭০ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশীয় যুদ্ধে ফ্রান্সের হীন পরাজয়ের পর থেকে ইউরোপীয় মহাদেশে যে জার্মানীর প্রভাব ছিল সর্বাধিক তার কাছে যুদ্ধোত্তর ইউরোপে ফরাসী প্রভুত্ব বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। তখন থেকে জার্মানী কয়েকটি দিকে আত্মসম্প্রসারণ করছিল। ইউরোপের বাইরে সে ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের প্রয়াসী হয়েছিল। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। সে শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিল এবং ব্রিটেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। সে অস্ট্রিয়া, বুলগেরিয়া ও তুরস্ককে নিজের ক্ষমতায় এনেছিল এবং বার্লিন-বাগদাদ রেলওয়ের পরিকল্পনা করেছিল। প্রাচ্যে ব্রিটেনের অধিকারগুলির দিকে তার লক্ষ্য ছিল এরূপ মনে করা হত। কিন্তু যুদ্ধ এইসব কৃতিত্ব ও আকাঙক্ষাকে ধূলিসাৎ করেছিল এবং দশ বছর ধরে হতাশায় ডুবেছিল আর এই সময় তার চিন্তাবিদগণ পাশ্চাত্যের অবক্ষয় সম্বন্ধে দার্শনিক তত্ত্ব প্রচার করছিলেন এবং স্পেঙ্গলার তাঁর ‘Untergand des Abend-Landes’ লিখেছিলেন। তারপর ন্যাশন্যাল-সোস্যালিস্ট কিংবা নাৎসী দলের উদ্ভবের মধ্যে দিয়ে নতুন জাগরণ এসেছিল।

নাৎসী দলের রাজনৈতিক মতবাদ একটি শব্দসমষ্টির মধ্যে সংক্ষেপে বলা যায় “Drang Nach 0sten” অর্থাৎ ‘পূর্ব দিকে এগিয়ে চলো’। এই মতবাদ প্রথম প্রচার করেছিলেন Muller van den Bruck তাঁর বই ‘Das dritte Reich’-এ যার অর্থ ‘তৃতীয় সাম্রাজ্য’। তিনি ১৯৩৩ সালে হিটলারের অধীনে তৃতীয় রাইখ-এর প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি, কারণ তিনি হঠাৎ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ১৯২৫ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন। যা হোক, তাঁর মতবাদ হিটলার গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯২৩ সালে তিনি (হিটলার) কারাগারে বসে ‘মেইন ক্যাম্প’ অথবা ‘আমার সংগ্রাম’ নামে যে বই লিখেছিলেন, তাতে তিনি এই মতবাদটি আরও বিস্তৃত করেছিলেন। এই মতবাদের মূল কথা হল জার্মানীকে নৌশক্তি কিংবা ঔপনিবেশিক শক্তি হওয়ার ধারণা ছাড়তে হবে। তাকে ইউরোপীয় মহাদেশের শক্তি হয়েই থাকতে হবে এবং এই মহাদেশের পূর্বদিকে তার সম্প্রসারণ হওয়া উচিত। যুদ্ধ-পূর্ব জার্মানীর ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের চেষ্টা করতে গিয়ে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া বড় ভুল হয়েছিল।

হিটলার যেভাবে নাৎসীদের নতুন সামাজিক দর্শনের ব্যাখ্যা করেছেন তাতে ইহুদি-প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে জার্মান জাতির বিশুদ্ধিকরণ ও তাকে শক্তিশালী করে তোলার কথা বলা হয় এবং তাদের স্বদেশে ফিরে আসার কথা বলা হয়। জার্মানীর জনগণের নতুন ধ্বনি হল ‘Blunt und Booden’ কিংবা ‘রক্ত এবং মাটি’। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নাৎসীরা সমস্ত জার্মানভাষী মানুষের একীকরণ এবং প্রজননশীল জার্মান জাতির জন্য পূর্বদিকে বাসস্থানে জোগাড়ের কথা বলেন। বাস্তব রাজনীতিতে উল্লিখিত লক্ষ্যগুলির অর্থ হল: (১) অস্ট্রিয়া অধিকার; (২) যে মেমেল সে লিথুয়ানিয়ার কাছে হারিয়েছে তার পুনঃসংযোজন; (৩) জাতিসংঘের আওতায় যে ডানজিগকে স্বাধীন নগর করা হয়েছে তার পুনঃসংযোজন; (৪) ৩৫ লক্ষ জনসংখ্যা-সহ চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মানভাষী অংশের সংযোজন; (৫) যে পোলিশ করিডর ও সাইলেসীয় কয়লাখনি অঞ্চল সে পোল্যান্ডের কাছে হারিয়েছিল তার পুনঃসংযোজন; (৬) সোভিয়েট ইউক্রেনের শস্য উৎপাদনকারী সমৃদ্ধ জমিগুলির সংযোজন এবং (৭) সম্ভবত সুইজারল্যান্ড, ইতালিয় টাইরল এবং অন্যান্য সন্নিহিত দেশগুলির জার্মানভাষী অংশগুলির সংযোজন।

জার্মানী ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে ভাসাই সন্ধির সামরিক ধারাগুলি মানতে অসম্মত হয়েছিল, ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে রাইনল্যান্ড দখল করেছিল এবং সে একটি গুলি না ছুঁড়েও ‘অ্যানসক্লাস্’ অর্থাৎ অস্ট্রিয়ার সঙ্গে একীকরণ সম্পন্ন করে ইউরোপীয় কুটনীতিবিদগণের সকল হিসাব-নিকাশ ব্যর্থ করে দিয়েছিল। এইরকম অবস্থার মধ্যে তার অব্যাহত অস্ত্রসজ্জার অর্থ একটিই অথাৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। তার পুনরস্ত্রসজ্জা আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণের দেহে শেষ মৃত্যুবাণ হেনেছে এবং নিছক সন্ত্রাসের বশবর্তী হয়ে সমগ্র ইউরোপ আজ পূনরস্ত্রসজ্জায় নিয়োজিত। যখন চারিদিকে এইরকম তাড়াতাড়ি যুদ্ধ-প্রস্তুতি চলেছে তখন একদিন সামান্যতম ঘটনায় আন্তর্জাতিক অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। জার্মানী তার লক্ষ্য পূরণের জন্যে কতদূর পর্যন্ত যাবে তা এখন আমাদের বিবেচ্য। কোন পর্যায়ে এবং কার বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করবে?

রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী সর্বদাই কঠিন কাজ—তবে একটি বিষয় নিশ্চিত। জার্মানী তার অতীত পরাজয়ের শিক্ষা ভোলেনি। তার সামরিক পরাজয় ঘটেনি, ঘটেছিল অর্থনৈতিক পরাজয়। আর ব্রিটিশ নৌবাহিনীই তাকে অনশনের দ্বারা নতি স্বীকার করাবার জন্যে প্রাথমিকভাবে দায়ী। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে জার্মানী যদি জানে যে ব্রিটেন তার বিরুদ্ধে আছে তবে যুদ্ধে সে যোগ দেবে না। ১৯১৪ সালে জার্মানী বোকার মতো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিশ্বাস করেনি যে, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের পক্ষ নিয়ে ব্রিটেন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। ঐতিহাসিকগণ এটা এখন সাধারণভাবে স্বীকার করেন যে, ব্রিটেন যদি আগে থেকে জার্মানীকে তার অভিপ্রায় জানাতো তাহলে সম্ভবত অস্ট্রো-সার্বীয় বিরোধ থেকে দূরে সরে থাকত এবং এইভাবে সে বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ রাখত কিংবা নিদেনপক্ষে মুলতুবি রাখতো।

যদিও তাঁর বই ‘মেইন ক্যাম্পে’ হিটলার ফ্রান্সের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়ার কথা বলেছেন, তবু নাৎসীরা ক্ষমতায় আসার পর জার্মানীর পররাষ্ট্রনীতি সংশোধিত হয়েছে। জার্মানী এখন আর ফ্রান্সের কাছ থেকে আলসাস-লোরেন কিংবা বেলজিয়ামের কাছ থেকে ইউপেন-ম্যালমাড়ি ফেরত পেতে চায় না। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে জার্মানী পশ্চিম ইউরোপে তার সীমান্ত সংশোধন দাবি করে না। এর কারণ খুঁজতে দূরে যেতে হবে না। জার্মানী এটা ভালভাবে জানে যে ফ্রান্স কিংবা হল্যান্ডের ওপর আক্রমণ সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনকে যুদ্ধে টেনে আনবে এবং হয়তো তার ফলে বিগত যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। জার্মানী সেজন্যে প্রতিনিয়ত পশ্চিমী চুক্তি সম্পাদন করে পশ্চিম ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রস্তাব করছে। অনেক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের কাছে এ প্রস্তাব লোভনীয় কারণ এর ফলে চিরদিনের মতো ব্রিটিশ স্বার্থের সম্ভাব্য বিপদ কেটে যাবে। এই প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানী আন্তর্জাতিক বাজারে দর কষা-কষির জন্যে কঠিন প্রয়াস করছে। তার দাবি এই যে, এই শান্তির বিনিময়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ব্যাপারে আগ্রহ দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে জার্মানী পৃথিবীর এই অংশের মানচিত্র নিজের খুশিমতো পুনর্বিন্যাসের সুযোগ পায়।

জার্মানী বর্তমানে এইসব লক্ষ্যের দিকে প্রস্তুত হচ্ছে। প্রথমত, সে সর্বাঙ্গীণ পুনরস্ত্রসজ্জার ব্যবস্থা করেছে। দ্বিতীয়ত, সে খাদ্য ও প্রধান কাঁচামাল সরবরাহে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করছে। (এটা অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা)। জামানীর চতুর্থ বার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে গত বছর এ কাজ আরম্ভ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, মধ্য কিংবা পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বাধলে পশ্চিমী শক্তিগুলি যাতে নিরপেক্ষ থাকে সেজন্যে সে এই শক্তিগুলিকে বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করছে। এইসব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ না হলে জার্মানী স্বেচ্ছায় যুদ্ধ আরম্ভ করবে—সে বিষয়ে রীতিমতো সন্দেহের কারণ আছে।

ব্রিটেনকে নিরপেক্ষ মনোভাবে আনবার জন্যে জার্মানী সে দেশে ব্যাপকভাবে প্রচারাভিযান চালিয়েছে এবং এতে সে এরমধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সফল হয়েছে। এই কাজে ব্রিটেনে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে কমিউনিজম সম্বন্ধে যে সাধারণ ঘৃণা আছে জার্মানী তা কাজে লাগিয়েছে। ফ্রান্স-সোভিয়েট চুক্তি এই কাজে সহায়ক হয়েছে এবং নাৎসীরা অনবরত জোর দিয়ে এটা বলেন যে ফ্রান্সের সঙ্গে ব্রিটেনের বন্ধন থাকার মানে হল এই যে, পূর্ব ইউরোপে ব্রিটেনের কোনও স্বার্থ না থাকলে ব্রিটেনকে সে অঞ্চলে সোভিয়েট রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে লড়াই করতে হবে। এইসঙ্গে নাৎসীরা এই দৃঢ় প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন যে তাঁরা বিশ্বের কোথাও ব্রিটিশ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করবেন না। এই উদ্যোগের ফলে ব্রিটেনে একটা প্রভাবশালী নাৎসী সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে—লর্ডস সভায়, লন্ডন মহানগরীতে এবং সাধারণভাবে শাসক শ্রেণী ও সামরিক বাহিনীতে এই সমর্থকগণ আছেন। ভিন্ন কারণে হলেও, এমনকি শ্রমিকদলের মধ্যেও সমর্থকরা রয়েছেন। এটা সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের গভর্নর মন্টেগু নমান, প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের ভূতপূর্ব ক্ষমতাশালী মানুষ স্যার রবার্ট ভ্যাক্সিটার্ট—এঁরা সকলেই নাৎসী সমর্থক।

ব্রিটেনের পররাষ্ট্রনীতি সোজা পথ ধরে চলবে কিংবা অতীতে প্রায়ই যেরকম হয়েছে সেরকম দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠবে তা বলার সময় এখনও আসেনি। এই মুহূর্তে ব্রিটিশ জনমত ভীষণভাবে বিভ্রান্ত। প্রথমত, পূর্বোল্লিখিত একটি নাৎসী সমর্থক গোষ্ঠী আছেন যাঁরা পশ্চিমী চুক্তি (Western Pact) চান এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে যাঁরা নারাজ। দ্বিতীয়ত, উইনস্টন চার্চিল যার প্রতিনিধি সেই নাৎসী-বিরোধী রক্ষণশীল দলে আছেন যাঁরা নাৎসীদের সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ এবং যাঁরা ভয় করেন যে, জামনিী যখন ইউরোপে একবার প্রভুত্বশালী হয়ে উঠবে তখন সে বিদেশে ব্রিটিশ স্বার্থে আঘাত হানবে। এঁরা এই প্রসঙ্গে বলেন যে ব্রিটেনের ফ্রান্সের দিক থেকে ভয়ের কিছু নেই এবং ইউরোপের বাইরে ব্রিটিশ ও ফরাসী ঔপনিবেশিক স্বার্থ সর্বত্র পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। তৃতীয়ত আছেন সমাজতন্ত্রবাদী ও কমিউনিস্টগণ যাঁরা আদর্শগত কারণে সাধারণ মনোভাবের দিক থেকে জার্মান-বিরোধী ও ফরাসী-সমর্থক।

এই বিভ্রান্তির মধ্যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র-দপ্তর একটা নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে চলেছে অথাৎ ফ্রান্সকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে তারা স্বার্থত্যাগ করার জন্যে প্ররোচিত করার চেষ্টা করছে। ভ্যান্সিটার্টের যে কর্মনীতি এখন লর্ড হ্যালিফ্যাক্স অনুসরণ করছেন তার লক্ষ্য হল জার্মানীকে একটি ইউরোপ মহাদেশীয় শক্তিরূপে সীমাবদ্ধ করে রাখা। এজন্যেই ব্রিটেন জার্মান পুনরস্ত্রসজ্জায় সম্মতি দিয়েছে, জার্মানীর সঙ্গে ১৯৩৫ সালের জুন মাসে নৌ-চুক্তি সম্পাদন করেছে, ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে জার্মানীর রাইনল্যান্ড অধিকার উপেক্ষা করার পরামর্শ ফ্রান্সকে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণে যদিও স্পেনের সরকারকে সাহায্যদানের স্পষ্ট অধিকার ফ্রান্সের আছে, তবু ব্রিটেন তাকে সে সাহায্যদানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। যাদের কূটনৈতিক গোপন তথ্য জানার সুযোগ আছে তাঁরা অভিযোগ করেন যে ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র-দপ্তর নাৎসী সরকারের সঙ্গে আপস রফা করার জন্যে পোল্যান্ডকে উৎসাহিত করেছিল। (পরের বছরে জার্মানী-পোল্যান্ড অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল)। এটা বেলজিয়ামকেও ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন করে নিরপেক্ষতায় ফিরে আসার জন্যে এবং ফ্রান্সের উপদেশের বিরুদ্ধে যুগোস্লাভিয়াকে ইতালি ও জার্মানীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে উৎসাহিত করেছিল। অধিকন্তু এটা চেকোস্লোভাকিয়ায় নাৎসী-সমর্থক হেনলিন দলকে উৎসাহিত করেছিল এবং ক্ষুদ্র আঁতাতের (চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া) ও বল্‌কান আঁতাতের (যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস ও তুরস্ক) বৃন্ধন ছিন্ন করার জন্যে কিংবা অন্ততপক্ষে শিথিল করার জন্যে ষড়যন্ত্র করেছিল। উল্লেখ থাকে যে এই আঁতাত দুটি ফরাসী প্রভাবাধীন।

উল্লিখিত তথ্যগুলি থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা অসঙ্গত হবে না যে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র-দপ্তর অন্তত ইউরোপের ক্ষেত্রে গোপনে ফরাসী স্বার্থবিরোধী কাজ করে চলেছে। এবং ইউরোপ মহাদেশে ফরাসী প্রভুত্ব হোয়াইটহলের পক্ষে সুখবর নয়। হয়তো এইজন্যেই দক্ষিণপন্থী ফরাসী রাজনীতিবিদগণ ব্রিটেনের ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং ব্রিটেনকে না জানিয়ে ইতালি ও সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনে লাভাল অগ্রসর হয়েছিলেন। বস্তুত একদিক থেকে বিচার করলে লাভালের পররাষ্ট্রনীতিকে ব্রিটিশ-বিরোধী বলা যেতে পারে। কিন্তু সুদিনে দুর্দিনে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের একসঙ্গে থাকা উচিত এটা বিশ্বাস করে বামপন্থী ফরাসী রাজনীতিবিদগণ অন্ধভাবে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র-দপ্তরের নীতি অনুসরণ করে চলেন।

বর্তমানে জার্মান পররাষ্ট্র-দপ্তর আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেছে আর ফ্রান্স ব্যস্ত আছে তার চাল ও কাজের মোকাবিলা করায়। ব্রিটেনের বাইরে নাৎসীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে বেলজিয়ামে। বেলজিয়ামে একটি নাৎসী সমর্থক দল (The Rexists) গঠিত হয়েছে ও বেলজিয়ামে ফ্লোমিসভাষী জনগণের মধ্যে নাৎসী প্রচার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বেলজিয়ামের সরকার ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী ছিন্ন করেছেন এবং মধ্য কিবা পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ ঘটলে ভবিষ্যতে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করবেন। ১৯৩৩ সালে নাৎসীদের ক্ষমতায় আসার পর থেকে সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাপোল্লোর চুক্তি কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে জার্মানীর ক্ষতিপূরণের জন্যে যেন নাৎসী সরকার পোল্যান্ডের সঙ্গে একটি অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই চুক্তি পোল্যান্ডে বহু অংশে ফরাসী প্রভাবের ক্ষতি করেছে। গত বছর পোল্যান্ডে তার প্রভাব ফিরে পাবার জন্যে ফ্রান্স বিশেষ চেষ্টা করেছিল এবং উভয় পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল দু’টি দেশের মধ্যে ঘন ঘন যাতায়াত করেছিলেন। কিন্তু মনে হয় যে ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের মৈত্রী আর কখনও জীবন্ত শক্তি হয়ে উঠবে না এবং ভবিষ্যতে পোল্যান্ড স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলবে অথাৎ ফ্রান্স-জার্মানী কিংবা রুশ-জার্মান বিরোধের ক্ষেত্রে পোল্যান্ড নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করবে।

উল্লিখিত কাজ ছাড়াও জামনিী এখন ক্ষুদ্র আঁতাত ও বল্‌কান আঁতাতের বন্ধন শিথিল করে এবং স্পেনের ভূখণ্ডে দাঁড়াবার স্থান জোগাড় করে ফ্রান্সকে দুর্বল করে তোলার চেষ্টায় ভীষণ রকমে ব্যস্ত। বর্তমানে কয়েকটি মৈত্রী চুক্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সংযোগের ফলে ফ্রান্সের অবস্থা রীতিমতো সুদৃঢ় এবং যতদিন এ অবস্থা থাকবে ততদিন সে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে নিজের স্বার্থত্যাগ করতে সম্মত হবে না। সে সোভিয়েট পররাষ্ট্র মন্ত্রী লিটভিনোভের মতো জোর দিয়ে বলতে থাকবে যে, শান্তি অবিভাজ্য এবং সমস্ত রাষ্ট্রকে সামগ্রিক নিরাপত্তা দানের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের আওতায় একটি ইউরোপীয় চুক্তি থাকা উচিত। এতে জার্মানী সম্মত নয় এবং সম্মত হবে না।

চেকোস্লোভাকিয়া ও সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে ফ্রান্স নিজেকে সুরক্ষিত করেছে। এই শেষোক্ত শক্তি দু’টির আবার নিজেদের মধ্যেও সামরিক চুক্তি আছে। সুতরাং আন্তর্জাতিক কোনও বিপদের সময় এই তিনটি শক্তিকে সবসময় একসঙ্গে দেখা যাবে। ক্ষুদ্র আঁতাতের অন্যান্য শক্তি যুগোস্লাভিয়া ও রুমানিয়ার সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়ার বোঝাপড়া আছে। আবার বল্‌কান আঁতাতের মাধ্যমে যুগোস্লাভিয়া ও রুমানিয়ার বোঝাপড়া আছে গ্রীস ও তুরস্কের সঙ্গে। জার্মানী আশা করে যে, সে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যুগোস্লাভিয়া ও রুমানিয়াকে দলে টেনে মধ্য ইউরোপে চেকোস্লোভাকিয়াকে বিচ্ছিন্ন করবে—কেননা চেকোস্লোভাকিয়ায় রুশ সাহায্য কেবলমাত্র রুমানিয়া কিংবা পোল্যান্ডের মধ্য দিয়ে আসা সম্ভব। অনাক্রমণ চুক্তির ফলে পোল্যান্ড এখন আর জার্মানীর কাছে কোনও সমস্যা নয়। ব্রিটেনের মাধ্যমে সে ফ্রান্সকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, সামরিক শক্তি হিসেবে সোভিয়েট রাশিয়ার মূল্য নেই এবং ফ্রান্স-সোভিয়েট চুক্তির সামরিক ধারাগুলিকে ফ্রান্সের বিদায় দেওয়া উচিত। রাশিয়ায় আটজন সামরিক জেনারেলের সাম্প্রতিক মৃত্যুদণ্ড ধনতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে প্রচারের একটা সুযোগ দিয়েছে এবং তারা এই মর্মে ভীষণ প্রচার করছে যে সোভিয়েট সামরিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা বেড়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে তার ওপর আর নির্ভর করা চলে না। সবশেষে হলেও যা নগণ্য নয় তা হল এই যে, যুদ্ধ হলে সে যাতে ফ্রান্সকে পিছন দিক থেকে ছুরি মারতে পারে সেই উদ্দেশ্যে জার্মানী আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্পেনের ভূখণ্ডে পা রাখবার মতো জায়গা পেতে। এটা সম্ভব হলে ইউরোপে যুদ্ধের সময় যে উত্তর আফ্রিকা থেকে ফ্রান্স সর্বদা তার সৈন্য ও যুদ্ধের উপকরণের বিরাট সরবরাহ পেয়ে থাকে তার সঙ্গে ফ্রান্সের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে। জার্মানী আশা করে যে ফ্রান্সকে সব দিক থেকে দুর্বল করে তুলে এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র-দপ্তরের মারফত তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে সে শেষপর্যন্ত তাকে পশ্চিমী চুক্তিতে রাজি করাতে পারবে। তাহলে জার্মানী মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে যা খুশি করতে পারবে। ফ্রান্স যদি এতে রাজি না হয় এবং শেষপর্যন্ত সে যদি সোভিয়েট রাশিয়ার পক্ষে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে সে ১৯১৪ সালের তুলনায় নিজেকে অনেক বেশি দুর্বল দেখতে পাবে।

কিন্তু ফ্রান্স কি জার্মানীর পরিকল্পনা অনুসারে চলবে? স্পষ্টতই না। ব্রিটেনের কাছে ইউরোপ মহাদেশে কে প্রভুত্ব করবে—ফ্রান্স কিংবা জার্মানী—তাতে কিছু যায় আসে না, কেননা ব্রিটেনের স্বার্থ ইউরোপের বাইরে। কিন্তু ফ্রান্স এত সহজে ইউরোপের প্রভুত্ব ছেড়ে দিতে পারে না, কারণ তার অবস্থা ব্রিটেনের মতো নয়; সে নিজে ঔপনিবেশিক শক্তি ছাড়াও মহাদেশীয় একটি শক্তি। অধিকন্তু, ফ্রান্স শুধু শক্তি ও মর্যাদার জন্যে লড়ছে না, সে লড়ছে তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে। সে ১৮৭০ সালের শোচনীয় পরাজয়ের কথা ভোলেনি। তার জনসংখ্যা স্থিতিশীল এবং এটা জার্মানীর জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। জার্মানীর জনসংখ্যা এখনও বেড়ে চলেছে। সুতরাং ফ্রান্সের জার্মান আক্রমণ সম্বন্ধে প্রকৃত ভয় আছে আর সেখানে ব্রিটেনের সে ভয় নেই—অন্তত যতদিন অ্যাংলো-জার্মান নৌ-চুক্তি অনুসারে জার্মান নৌবাহিনী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। সর্বোপরি ফ্রান্সে মানুষের মনে আছে জার্মান লক্ষ্য ও আকাঙক্ষা সম্বন্ধে গভীর অবিশ্বাস। হিটলারের বই ‘মেইন ক্যাম্প’-এ ফ্রান্সের ভয়ানক নিন্দা থাকায় এটা আরও বেড়ে গেছে। একজন লেখক সংক্ষেপে এ অবস্থা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা হল এইরকম: ফ্রান্সে দক্ষিণপন্থীরা জামানীকে ঘৃণা করেন, বামপন্থীরা ঘৃণা করেন হিটলারকে। এইরকম অবস্থায় যতদিন ভীষণ রকমে জাতীয়তাবাদী নাৎসী দল ক্ষমতায় থাকে ততদিন ফ্রান্স কখনও মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে তার মিত্রদের ও মৈত্রীবন্ধনগুলি ছাড়বে কি না খুবই সন্দেহের বিষয়।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ ঝুলে রয়েছে এবং জার্মান কূটনীতি সেখানে সফল হবে কি না তা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে এটা যথেষ্ট সফল হয়েছে। রুমানিয়ায় রাজা ও মন্ত্রিমণ্ডলী মোটামুটি জার্মান সমর্থক এবং ফরাসী প্রেমিক ভূতপূর্ব পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিটুলেস্কুর প্রভাব অনেক কমে গেছে। সেখানে সরকারের সমর্থনে রয়েছে। কাড্রেনুর নেতৃত্বাধীন ইহুদি-বিরোধী ও নাৎসীদলের সমর্থক আয়রন গার্ড দল। যুগোস্লাভিয়ায় প্রধানমন্ত্রী স্টায়াভিনোভিচ ও তাঁর সরকার নাৎসী সমর্থক আর রাজপরিবার ব্রিটিশ প্রভাবাধীন। গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মেটাক্সাস, যিনি নিজেকে ডিক্টেটর করে তুলেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে জার্মান প্রভাবাধীন। আর গ্রীস জার্মানীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কৃষ্ণসাগরের রুশ নৌবহর যদি দার্দানেলেস দিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে তাহলে গ্রীক দ্বীপপুঞ্জের ঘাঁটি থেকে তার ওপর আক্রমণ চালানো যাবে। এরপরে আছে হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়া। এরা ‘সর্বহারা’ দলভূক্ত শক্তি বলে যদি বোঝে যে তাদের জাতীয় অভিযোগগুলির প্রতিকারের কোনও সম্ভাবনা আছে, তাহলে প্রত্যাশা করা যায় যে তারা জার্মানীর সঙ্গে যোগ দেবে। এইভাবে দেখা যায় যে সমগ্র বল্‌কান উপদ্বীপ এলাকায় জার্মানী কূটনীতিতে ফ্রান্সকে পেছনে ফেলেছে এবং সে যেখানে সেখানে বাণিজ্যিক টোপও ফেলছে।

কিন্তু আন্তর্জিতিক রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ফ্রান্স সর্বত্র জাৰ্মনীর পশ্চাদনুসরণ করে চলেছে। কতদিন গ্রীসে মেটাক্সাস সরকার কিংবা যুগোস্লাভিয়া স্টায়াভিনোভিচ সরকার টিকে থাকবে সে সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। রুমানিয়ায় ফরাসী সমর্থকদল আপাতত ক্ষমতাচ্যুত হলেও নগণ্য নয় এবং প্রবাদ অনুসারে বল্‌কান মেজাজ পরিবর্তনশীল। অধিকন্তু জার্মানীর অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আছেন আধুনিক ইউরোপের একজন শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ চেকোস্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট এডোয়ার্ড বেনেস।

প্রতিদিন দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী আর যাই হোক সহজ নয়। একটা বিষয় নিশ্চিত, যদি যুদ্ধ আসে তবে তা আসবে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের স্থিতাবস্থাকে জার্মানীর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করার ফলে। কিন্তু যুদ্ধ কি আসবে? উত্তর প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে ব্রিটেনের ওপর জার্মানীর ১৯১৪ সালের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং যদি সে জানে যে ব্রিটেন তার বিরুদ্ধে যাবে তবে সে যুদ্ধ বাধাবে না। ১৯১৪ সালে যেরকম হয়েছিল সেরকম অবশ্য হতে পারে। ব্রিটেন যুদ্ধ থেকে দূরে থাকবে এই চিন্তা করে সে যুদ্ধের ফাঁদে পা দিতে পারে। যদি ফ্রান্স এবং ব্রিটেন মধ্য কিংবা পূর্ব ইউরোপের বিরোধে নিরপেক্ষ থাকতে রাজি হয় তাহলে যে মুহূর্তে জার্মানী তৈরি হবে সেই মুহূর্তে পূর্বদিকে সূর্যোদয় যেমন নিশ্চিত তেমনই নিশ্চিতরূপে ইউরোপে যুদ্ধ বাধবে। এমনকি ফ্রান্স যদি সোভিয়েট রাশিয়ার পক্ষ নেয় এবং ব্রিটেন যদি নিরপেক্ষ থাকে তা হলেও যুদ্ধ বাধতে পারে যদিও সে যুদ্ধের ফলাফল হবে অনিশ্চিত।

ফ্রাঙ্কো যদি জয়ী হন তবে সে বিজয় হবে ইতালির ও জার্মানীর এবং তার অর্থ হবে ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ও ফ্রান্সের সামনে অন্ধকার সময়। কিন্তু রুশ দানব প্রায়শই ধাঁধা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তা ইউরোপ বিজয়ী নেপোলিয়নকে ব্যর্থ করেছিল। তা কি হিটলারকেও ব্যর্থ করবে?

ডালহৌসি

২১আগস্ট, ১৯৩৭

মডার্ন রিভিয়্যু, সেপ্টেম্বর ১৯৩৭-এ প্রকাশিত। সুভাষচন্দ্র বসুর Through Congress Eyes (কিতাবিস্তান, এলাহাবাদ ও লন্ডন, ১৯৩৮) গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *