ইউরোপিয়ান্‌স্ ওন্‌লি

ইউরোপিয়ান্‌স্ ওন্‌লি

বহুকাল আগে অনেক ট্রেনে দুটো করে বিশেষ থার্ড ক্লাস গাড়ি থাকত। একটা হল পুরুষদের জন্য। তার দরজার ওপরে লেখা থাকত— ‘ইউরোপিয়ান্‌স্ ওন্‌লি।’ অন্যটার দরজার ওপরে থাকত, ‘ইউরোপিয়ান লেডিজ ওনলি।’ বলাবাহুল্য এগুলো সায়েব-মেমদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। দিশি মহিলাদের জন্যেও বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা ছিল, তার দরজার ওপর লেখা ফিমেলস আর একপাশে একটা ছবি বাঁধানো থাকত। হাফ-ঘোমটা দেওয়া একজন দিশি মহিলা। তাই দেখেই বোঝা যেত এতে করে কারা যাবে।

এখন মুশকিল হল গিয়ে সায়েব-মেম চেনা যাবে কী দিয়ে? পোশাক ছাড়া আবার কী দিয়ে? রং তো সক্কলের মিশ্‌-কালো! কাজেই নিয়ম হল প্যান্ট পরে গেলেই সায়েব, গাউন পরে গেলেই মেম। একদিন হয়েছে কী, চাটগাঁ মেল ছাড়ব-ছাড়ব করছে, তিলধারণের জায়গা নেই। এমন সময় ধুতি পরা এক ছোকরা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে সামনের গাড়িটার হাতল ধরেছে। অমনি ভেতর থেকে কুচকুচে কালো সায়েব গর্জে উঠেছে, ‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ম্যান? কান্ট ইউ রিড! দিস ইজ ফর ইউরোপিয়ান্স ওনলি!’ ছোকরা এক গাল হেসে বলল, ‘রোসো রোসো সায়েব, বিকামিং ইউরোপিয়ান ইমিডিয়েটলি!’ অর্থাৎ, ‘দাঁড়াও সায়েব, এক্ষুনি ইউরোপিয়ান বনে যাচ্ছি!’ এই বলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই সুটকেস থেকে পেন্টেলুন বের করে, ধুতির ওপর পরে নিয়ে, সায়েব বনে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল।

আরেকবার কবি ও নাট্যকার ডি এল রায়ের ছোট শালী, সুরসিক গিরীশ শর্মার স্ত্রী এবং আমার ননদ তাঁর পেয়ারের আদিবাসী দাসী লক্ষ্মীকে নিয়ে রাঁচি থেকে আসছেন। ভদ্রমহিলার রং মেমদের মতো— বলতে মনে হল বক্রেশ্বরে দেখলাম একটা স্মৃতিফলকে লেখা— ‘মেমবরণী দেবী’— সে যাক গে, মোট কথা মহিলা ছিলেন পরমাসুন্দরী আর লক্ষ্মী ছিল মিশ্‌কালো, ঝকঝকে সাদা দাঁত, তেল-চুকচুকে চুলে জবাফুল গোঁজা, গালভরা হাসি।

দুজনে গুছিয়ে বসেছেন, এমন সময় এক কালো মেম তার দুই কালো কন্যে নিয়ে ওই গাড়িতে উঠতে গেছে। হঠাৎ মেজদিদির ওপর চোখ পড়াতে, নাক সিঁটকে, দু’হাত পেছিয়ে গিয়ে বলে উঠল, ‘উঃফ! নেটিভস! অন্য গাড়িতে চল!’

সঙ্গে সঙ্গে মেজদিদিও জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে— সেকালে জানলায় শিক থাকত না— ডাকতে লাগলেন, ‘ও মেম! ও মেম! চলে যেয়ো না! এখানেই এসো! এই দেখো, তোমার মতো মেম আমারও আছে!’

মেম ফিরে দেখে জানলায় মেজদিদির ফরসা সুন্দর মুখের পাশে, লক্ষ্মীর কালো মুখের বত্রিশ পাটি দাঁতের বাহার! প্ল্যাটফর্মের লোকরা হো-হো করে হাসতে লাগল আর মেম রাগের চোটে বেগনি হয়ে, দাপাতে দাপাতে অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠল।

তবে এসব হল গিয়ে আমার জন্মের আগের ঘটনা। এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, হালচাল পালটে গেছে। কয়েক বছর আগে বালিগঞ্জের এক ফ্যাশানেবল পাড়ায়, মিসেস বনামি বলে একজন কালো মেম একটা নার্সারি স্কুল খুলে বসলেন।

বাড়ির দেওয়ালে নীল গোলাপি রং হল। কাঠের দোলনা, দোলা-ঘোড়া, লোহার পিছলে-পড়া জিনিস, খুদে নাগরদোলা ইত্যাদি বারান্দায়, উঠোনে সাজানো হল। ঘরে ঘরে ছোট্ট ছোট্ট নানা রঙের চেয়ার-টেবিল বসল। মস্ত মস্ত গোল, তিন-কোনা, চার-কোনা কী সব এল। দু’জন আয়া রাখা হল। গেটের ওপর সাইনবোর্ড টাঙানো হল— বনামি বেবিজ!

ব্যস! আর কী চাই! শুধু ওই পাড়ারই নয়, আশপাশের তিন পাড়ার মা-বাবারা লাইন দিয়ে ছেলেমেয়ে ভরতি করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। নাকি মেমদের শিক্ষাই অন্য ব্যাপার, তার সঙ্গে গায়ের রঙের কোনও সম্পর্ক নেই। হপ্তা ঘুরতে না ঘুরতে বনামি বেবিজের একটা সিটও খালি রইল না। লম্বা এক ওয়েটিং লিস্ট হল। পঁচিশ টাকা জমা দিয়ে অনেকেই তাঁদের কোলোট-পরা বেবিদেরও নাম লিখিয়ে রাখলেন। ইস্কুল গমগম করতে লাগল।

সবাই মিসেস বনামির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেমন প্লিজ থ্যাংকু বলতে শেখায়। দিদিমণির বদলে ম্যাম্‌ বলতে হয়। নীল সাদা পোশাক জুতো মোজা পরতে হয়। ইংরেজিতে টুইংকেল টুইংকেল গান করতে হয়। বাড়ি থেকে আনা দুধ বিস্কুট খাবার আগে হাত ধুয়ে কোলে রুমাল পেতে বসতে হয়। মেম না হলে এসব হত? এর জন্যে মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে কিচ্ছু বেশি নয়।

তিনটে বছর চমৎকার চলল ইস্কুল। মিসেস বনামির কী সুনাম। শেষটা এমন দাঁড়াল যে তাঁর পরামর্শ না নিয়ে কেউ কোনও কাজে হাত দিত না, ছেলেমেয়ের বিয়ে পর্যন্ত হত না। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর মেমের মনটাও ছিল বড় ভাল। ঠিক এই সময় পাড়ার মাতব্বর বঙ্কুবাবুর নাতনি এসে সব ভেস্তে দিয়ে গেল।

সেদিন স্কুলের জন্মদিন। বঙ্কুবাবু নাতনি মঞ্জুকে সুদ্ধ ধরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘তোরা ছাই এমএ পাশ করেছিস। আমাদের মিসেস বনামিকে দেখলেও তার চেয়ে বেশি শিক্ষা হয়!’ নাতনি একটু হাঁড়িমুখ করেই গেছিল, কিন্তু সেখানে মিসেস বনামিকে দেখেই, দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে, তাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘ও কী রে, পুঁটি, তুই আবার মেম হলি কবে? ও দাদু, পুঁটি যে আমাদের দাশবাবুর মেয়ে, মনে নেই সেই যে আমার সঙ্গে পড়ত?’

ব্যস, হয়ে গেল। অমন আদর্শ মিসেস বনামি অমনি মন্দ হয়ে গেল! চল্লিশ টাকা মাইনে দিয়ে তো আর দাশবাবুর মেয়ের ইস্কুলে ছেলেপুলে পাঠানো যায় না। ইস্কুল উঠে গেল! মঞ্জুর মহা দুঃখ। তার জন্যেই এই সর্বনাশটি হল! পুঁটি হেসে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? হাজার পঞ্চাশেক জমে গেছে। তাই দিয়ে ওইখানেই মাদার্স ওন খুলব।’ নাকি খুব ভাল চলছে সেটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *