ইংরেজ ডাকাত (প্রথম অংশ) (হিলি ও ওয়ার্নার নামক দুইজন দস্যুর অদ্ভুত বৃত্তান্ত)
প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রত্যূষে ছয়টার সময় শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম। এ শয্যা আমার বাড়ীর শয্যা নহে, থানার শয্যা। কতকগুলি কার্য্যের ঝঞ্ঝাটে রাত্রিতে বাড়ী না গিয়া থানাতেই শুইয়াছিলাম। শয্যা হইতে উঠিয়াই দেখিলাম, নিকটেই ‘স্টেটসম্যান’ কাগজখানি রহিয়াছে। পিয়ন যে কখন কাগজখানি রাখিয়া গিয়াছে, তাহা জানিতে পারি নাই। বিছানার উপর বলিয়াই কাগজখানি খুলিলাম। দেখিলাম, উহাতে একটি সংবাদ বাহির হইয়াছে, তাহার মর্ম্ম এইরূপ :—
“গত রাত্রিতে হরিণ বাড়ীর জেল ভাঙিয়া সেই প্রসিদ্ধ ডাকাইত ‘হিলি’ ওয়ার্নারের সহিত পলায়ন করিয়াছে। যদি তাহারা শীঘ্র ধৃত না হয়, তাহা হইলে কত লোকের যে সর্ব্বনাশ সাধিত হইবে, তাহার আর স্থিরতা নাই। পুলিসের কর্তব্য যাহাতে উহারা শীঘ্র ধৃত হয়, তাহারা বিশেষরূপে চেষ্টা করা।”
ভাবিলাম, “এরূপ অবস্থায় আর বসিয়া কাগজ পড়া উচিত নহে, প্রাতঃকৃত্যাদি যত শীঘ্র হয়, সমাপন করিয়া লওয়াই কর্তব্য, বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এখনই এখানে উক্ত বিষয়ের সংবাদ আসিবে।” এই ভাবিয়া যত শীঘ্র পারি, প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করিয়া যেমন আমার গৃহে প্রবেশ করিতেছি, অমনই দেখিলাম, একজন প্রহরী একখানি পত্রহস্তে দৌড়িয়া আসিতেছে। পত্রখানি পড়িলাম, লালবাজার পুলিস হইতে আমাদিগের বড়সাহেব এই পত্রখানি লিখিয়াছেন। উহাতে লেখা আছে,—“এই পত্র পাঠমাত্র, ডিটেকটিভের কর্ম্মচারীমাত্রই আমার নিকট আগমন করিবেন, যেন কিছুমাত্র বিলম্ব না হয়।”
কাহার সাধ্য, এই পত্র পাঠ করিয়া গমনে বিলম্ব করে? সেই সময়ে কোন কর্মচারী গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত। কেহ বা নিদ্রিত নহেন। অথচ শয়ন করিয়া আছেন, কেহ বা উঠিয়াছেন মাত্র। কেহ বা স্নান করিতেছেন, কেহ বা স্নান করিয়া বসিয়াছেন, কেহ বা স্নান করিবার অভিলাষে তৈল মর্দন করিতেছেন। কেহ সেই সময়েই বাহির হইতে আগমন করিয়াছেন, কেহ বা বাহিরে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছেন। এইরূপ সময়ে বড় সাহেবের আদেশলিপি আসিয়া উপস্থিত হইল। যিনি নিদ্রিত ছিলেন, তাঁহার নিদ্রভঙ্গ হইল; যিনি শুইয়াছিলেন; তিনি উঠিলেন। যিনি স্নান করিতেছিলেন, তাঁহার সে দিবস পুরা স্নান হইল না। যিনি তৈল মৰ্দ্দন করিতেছিলেন, তাঁহার তৈল মুছিতে হইল। এইরূপ যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেই অবস্থাতেই আপন আপন পরিধেয় প্রভৃতি লইয়া বহির্গত হইলেন। আমরা সকলে একত্রিত হইয়া পুলিস অফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। গমনকালে মনে করিলাম,—‘আমরা যত লোক গমন করিতেছি এত লোকের আবশ্যক কি? দশ কুড়িজন হইলেই যথেষ্ট। কিন্তু পুলিসে গিয়া কি দেখিলাম? যাহা আমরা একবারও মনে ভাবি নাই তাহাই দেখিলাম। দেখিলাম, ইংরাজ পুলিস কর্ম্মচারী যত আছেন, সকলেই সেইখানে উপস্থিত; দেখিলাম আদেশ প্রার্থী হইয়া সকলেই সেই প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান। পুলিসের পোশাক কাহারও পরিধানে নাই, সকলেই আপন আপন ইচ্ছানুযায়ী পরিচ্ছদে শোভিত হইয়াছেন। ইঁহাদের সংখ্যা প্রায় একশত হইবেক। আমরাও সেই প্রাঙ্গণের একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলাম। সেই সময় আমাদের বড় সাহেব তাঁহার গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের নিকট আসিলেন। তাঁহার হস্তে একখানি কাগজ ও একটি পেন্সিল। সেইস্থানে যতগুলি কর্ম্মচারী ছিলেন, তিনি সকলের নাম লিখিয়া লইয়া, জেলের পলাতক কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত প্রত্যেককেই এক একদিকে যাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। যিনি যেমন আদেশ পাইতে লাগিলেন, তিনি তখনই আদেশ অনুযায়ী স্থানাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। কাহারও উপর আদেশ হইল, হাবড়া হইতে গাড়ীতে উঠিয়া বৰ্দ্ধমান গিয়া থাকিবে। এবং সেইস্থানে যত গাড়ী থামিবে, প্রত্যেক গাড়ীতেই উহাদিগের অনুসন্ধান করিবেন। কেহ বৰ্দ্ধমানে নামিয়া পদব্রজে হাবড়া পর্যন্ত আগমন করিলেন, কেহ হাবড়া হইতে পদব্রজে বৰ্দ্ধমান গমন করিবেন। কেহ ইষ্টারণ বেঙ্গল রেলওয়ে গমন করিয়া নৈহাটী ষ্টেশনে থাকিবেন, কেহ নৈহাটী হইতে হাঁটিয়া আসিবেন, কেহ নৈহাটীতে হাঁটিয়া গমন করিবেন। কেহ দমদম, কেহ বারাকপুর, কেহ বারাসত অভিমুখে গমন করিবেন। কেহ ডায়মণ্ডহারবার গমন করিয়া জাহাজ সকল দেখিবেন, কেহ সেই স্থান হইতে স্থলপথে কলিকাতায় আসিবেন, কেহ বা কলিকাতা হইতে স্থলপথে সেইস্থানে যাইবেন। কেহ নৌকা, কেহ ‘ষ্টীমলঞ্চ’ লইয়া ভাগীরথী বাহিয়া উত্তরে, কেহ বা দক্ষিণে গমন করিবেন। কেহ বা কিনারায় কিনারায় গমন, কেহ বা প্রত্যাগমন করিবেন। কেহ বা কলিকাতায় ষ্টীমার সকল, কেহ বা পান্সি সকল দেখিবেন, কেহ বা উলুবেড়িয়ায়, কেহ গেঁয়োখালিতে অবস্থান করিবেন। কেহ বা হাবড়ার গৃহে গৃহে, কেহ বা কলিকাতার বাড়ীতে বাড়ীতে অনুসন্ধান করিবেন, আর কেহ কেহ বা কলিকাতার চতুঃপার্শ্বের প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে খুঁজিবেন। এই আদেশ পাইয়া সকলেই চলিয়া গেলেন। কেবল বাকি থাকিলাম ‘আমি’। আমার উপর কোন আদেশ হইল না দেখিয়া ভাবিলাম, হয়ত অন্য কোন কৰ্ম্ম আছে, এই নিমিত্ত আমিই অবশিষ্ট থাকিলাম :– আমাকে বোধ হয়, এই অনুসন্ধানে গমন করিতে হইবে না। ক্ষণকালের জন্য আমি এরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় সাহেব আমাকে কহিলেন, “আমিও এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইতেছি। যদি তুমি ইচ্ছা কর, তাহা হইলে আমার সহিত যাইতে পার, কিম্বা যদি তুমি একাকী তোমার ইচ্ছানুযায়ী অন্য কোন স্থানে গমন করিতে ইচ্ছা কর, সেখানেও যাইতে পার। স্থূল কথা পলাতকদিগের সন্ধান করা চাই।” এই কথা শুনিয়া আমি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম,—“কয়েদীদ্বয় যে স্থান হইতে, এবং যে প্রকারে পলায়ন করিয়াছে, সেইস্থান আপনি দেখিয়াছেন কি?” উত্তরে সাহেব কহিলেন, “না, কিন্তু আমি এখনই সেইস্থানে গমন করিতেছি।” সাহেবের এই কথা শুনিয়া আমিও তাঁহার সহিত গমন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম; তিনিও সম্মত হইলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কয়েদীদ্বয় কিরূপে এবং কোথায় ধৃত হইলেন, সেই বিষয় পূর্ব্বে বলা অপেক্ষা তাঁহারা কে এবং কেনই বা তাঁহাদের জেল হইয়াছিল, তাহা বোধ হয়, পূর্ব্বে পাঠকগণের জানা আবশ্যক!
কলিকাতা লালদীঘির ধারে ডেলহৌসি স্কোয়ার ইষ্ট রাস্তায় ‘সিঙ্গার কোম্পানির’ সেলাইয়ের কলের একটি দোকান আছে, ওয়ার্নার এই দোকানের বড় সাহেব ছিলেন। তিনি অবিবাহিত—তাঁহার চরিত্র-দোষ যথেষ্ট ছিল। সন্ধার সময় একবার কলিঙ্গা-বাজার ষ্ট্রীটে তাঁহাকে গমন করিতেই হইত, ও সেই স্থান হইতে তিনি কোনদিবস রাত্রি ১২টার পূর্ব্বে প্রত্যাগমন করিতেন না। শনিবার, রবিবার বাগানেই কাটিয়া যাইত।
একদিন সোমবার বেলা এগারটার সময়, ওয়ার্নার সাহেব থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। থানায় প্রায় সকলেই তাঁহাকে চিনিত। সেই সময় থানায় যে দেশীয় কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তিনি বিশেষ সম্মানের সহিত ওয়ার্নারকে বসিতে দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই অসময়ে আপনি কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন?” উত্তরে ওয়ার্নার কহিল, আমার অফিসে ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে; সেই চুরির সংবাদ প্রদানের নিমিত্তই আমার এখানে আগমন। তোমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজ কর্মচারী যদি উপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে তাঁহাকে সংবাদ প্রদান কর, তিনি আগমন করিলেই চুরির সমস্ত অবস্থা আমি তাহার নিকট বলিব।”
সাহেবের কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারী দ্রুতপদে গমন করিয়া আপনার ঊর্দ্ধতন ইংরেজ কর্মচারীকে সংবাদ প্রদান করিল। সংবাদ পাইবামাত্র ইংরাজ কর্মচারী অফিসে আগমন করিলেন, “ইনিও ওয়ার্নারের পরিচিত। ওয়ার্নারকে দেখিয়া কর্ম্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার আফিস হইতে কিরূপে চুরি হইয়া গিয়াছে? “উত্তরে ওয়ার্নার কহিল, “গত শনিবার আফিস বন্ধ করিয়া আমি বাসায় গমন করি। আফিসের জানলা দরজা প্রভৃতি সমস্তই আমার সম্মুখে বন্ধ করা হয়, এবং আমিই আফিসের চাবি লইয়া বাসায় গমন করি। সেই দিবস আমার টেবিলের দেরাজের ভিতর নগদ টাকা, নোট এবং সোণা ও রূপার কতকগুলি গহনা ছিল; সৰ্ব্বসমেত উহার মূল্য ছয় শত সহস্র মুদ্রার কম নহে, অদ্য সর্বাগ্রে আমি আফিসে গমন করিয়া সদর দরজা খুলিবার সময় দেখিতে পাই, যে চ তালা সদর দরজায় দেওয়া ছিল, তাহা খোলা। পরিশেষে আফিসের ভিতর গমন করিয়া দেখিতে পাই আমার টেবিলের দেরাজও খোলা এবং তাহার ভিতর যাহা কিছু ছিল, তাহার কিছুই নাই সমস্তই চুরি হইয়া গিয়াছে।”
থানায় এই সংবাদ প্রদান করিলে থানার কর্ম্মচারীগণ এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিলেন। আমাদিগের নিকটও সংবাদ আসিল—আমরাও গমন করিলাম। সদর দরজার সেই ‘চ’ তালা দেখিলাম, তাহা যেমন তেমনই আছে; টেবিলের দেরাজের তালারও কোন প্রকার ব্যতিক্রম ঘটে নাই। আমরা যেরূপভাবে অনুসন্ধান আরম্ভ করি, প্রথমে এই অনুসন্ধানও সেইরূপভাবে আরম্ভ করিলাম। আফিসের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া এমন কোন চিহ্ন বা দ্রব্যাদি পাইলাম না, যাহাতে এই চুরি বাহিরের কোন লোক দ্বারা হইয়াছে, এরূপ সন্দেহ হইতে পারে। সদর দরজায় যে ‘চব্স’ তালা বন্ধ ছিল, তাহা দেখিয়াও কোনরূপে অনুমান করিতে পারিলাম না যে, কোন প্রকার অস্ত্র প্রয়োগে অথবা অপর কোন চাবির দ্বারা এই তালা খোলা হইয়াছে। আমাদিগের বিশ্বাস ছিল, চব্স তালা অপর চাবির দ্বারা খোলা যায় না। এই নিমিত্ত ওয়ার্নার সাহেবের অগোচরে সেই তালা আমরা টি. টমসন কোম্পানির বাড়ীতে পরীক্ষার নিমিত্ত পাঠাইয়া দিলাম। তাঁহারা সেই তালা খুলিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষাপূর্ব্বক কহিলেন, সেই তালার চাবি দ্বারাই সেই তালা খোলা হইয়াছে। আর কোন চাবি ব্যবহৃত হয় নাই। টি. টমসন কোম্পানির নিকট হইতে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, আমাদিগের আরও একটু অনুসন্ধান প্রয়োজন হইল। সেই তালার যদি দুইটি চাবি থাকে, তাহা হইলে অপর চাবিটি কোথায়? ওয়ার্নারকে জিজ্ঞাসা করায় সে সন্দেহও মিটিয়া গেল। তিনি কহিলেন, সেই তালার চাবি দুইটি আছে। একটি সর্বদা ব্যবহৃত হয়। অপরটি যে স্থানে তিনি থাকেন, সেইস্থানে একটি বাক্সের ভিতর আছে। এই কথা শুনিয়া ওয়ার্নারের বাসায় গমন করিলাম। তিনি একটি বাক্সের ভিতর হইতে সেই চাবিটি বাহির করিয়া আমাদিগকে দেখাইলেন। বহুদিন ব্যবহৃত না হওয়ায় উহার অঙ্গ ময়লায় পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। দেখিবামাত্রই বোধ হইল, এই চাবির দ্বারা এই তালা খোলা হয় নাই। এইসকল অবস্থা দেখিয়া মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। রাত্রিকালে সেই বাটীতে যে পাহারাওয়ালাদ্বয়ের পাহারা পড়ে, তাহাদিগের উভয়কেই গোপনে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করায় তাহাদিগের মধ্যস্থিত একজনের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, রবিবার রাত্রি চারিটার সময় যে সদর দরজায় সেই তালা দেখিয়াছে, তখন উহা খোলা ছিল না। সে আরও কহিল, সেই সময় যে জমাদারের রাউণ্ড ছিল, সেও সেই তালা তাহার সম্মুখে টানিয়া দেখিয়াছে। তখন সেই তালা খোলা ছিল না, বন্ধ ছিল। পাহারাওয়ালার কথা শুনিয়া রবিবারে যে জমাদার সেই তালা টানিয়া দেখিয়াছিল, তাহাকে তখন ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম। দেখিলাম, সেও সেই পাহারাওয়ালার কথার পোষকতা করিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
উহাদিগের কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে স্পষ্টই বিশ্বাস হইল যে, যদি প্রকৃতই এই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে আফিস বন্ধ হইবার পর শনিবারের রাত্রিতে এই চুরি হয় নাই। বা তাহার পরদিবসও এই চুরি হইতে পারে না। রাত্রি চারিটার সময় ও যখন তালা ঠিক বন্ধ আছে, এরূপ দেখা গিয়াছে, তখন চারিটার পর হইতে আফিস খুলিবার মধ্যে যে কয়েকঘন্টা সময় পাওয়া যায়, তাহার মধ্যেই এই চুরি হওয়ার সম্ভাবনা। এরূপ অবস্থায় সোমবার প্রাতঃকালে সেইস্থানে যাহারা পাহারা ছিল, তাহাকে একবার জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য; এই ভাবিয়া, যাহার পাহারা ছিল তাহাকে ডাকাইলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিতে পারিলাম, যে, যে ফরিয়াদী ওয়ার্নার সাহেবকে চেনে সে কহিল, সোমবার আন্দাজ সাতটার সময়, ওয়ার্নার সাহেবকে তাঁহার দোকানের তালা খুলিতে দেখিয়াছে। কিন্তু ওয়ার্নার সাহেবকে সে বিষয় জিজ্ঞাসা করায় তিনি তাহা অস্বীকার করিলেন। এইরূপ নানা কারণে ওয়ার্নার সাহেবের উপরই আমাদিগের সন্দেহ হইল; কিন্তু স্পষ্ট করিয়া কাহারও কিছু বলিতে সাহস হইল না। গোপনে কিন্তু আমরা তাঁহারই বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। যে সকল ইংরাজ বা জার্মান ‘মিসার’ গৃহে তাঁহার যাতায়াত ছিল, তাঁহাদিগের উপরই তখন আমাদের সেই অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। তাহাতে একটু ফলও ফলিল।
যে মিসের নিকট তাঁহার সর্বদা যাতায়াত ছিল, এক দিবস দেখিলাম, সন্ধ্যার সময় সেই মিস্ আপনার স্থান পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক একখানি ঠিকাগাড়িতে উঠিল। আমিও অপর একখানি ঠিকাগাড়ি করিয়া তাহার অনুগমন করিলাম। তাহার গাড়ি ইডেন গার্ডেনের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল, আমিও সেইস্থানে গিয়া অবতরণ করিলাম। মিল বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া তাহার নিকটে নিকটেই বেড়াইতে লাগিলাম। সেই সময়ে তাহার হস্তস্থিত অলঙ্কারের মধ্যে একগাছি সোনার বালার উপর আমার নয়ন পড়িল। উক্ত বালা দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল, যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে বলিয়া, ওয়ার্নার চুরির নালিশ করিয়াছিল, তাহার মধ্যে এইরূপ গড়নের দুইগাছি বালার কথাও উল্লিখিত আছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আর কোন কথা না বলিয়া, সেইস্থান হইতে আপনার থানায় আগমন করিলাম। সেইস্থানের আমার ঊর্দ্ধর্তন ইংরাজ কর্মচারীর নিকট আমার মনের সন্দেহের কথা বলিলে, সেই দিবস রাত্রিতেই তিনি সেই মিসের বাড়িতে গমন করিয়া সেই বালার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। আমিও তাঁহার সঙ্গেই ছিলাম। উত্তরে মিস কহিল যে, সে সেই বালা ওয়ার্নার সাহেবের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। তাহার নিকট ইহাও অবগত হওয়া গেল যে, ওয়ার্নার সাহেব বোম্বাই শহরে আপনার মাতার নিকট একটি পারসেল পাঠাইয়া দিয়াছেন। মিস্ বিবেচনা করেন যে, সেই পারসেলের ভিতর করিয়া ওয়ার্নার সাহেব কতকগুলি সোনার গহনা পাঠাইয়া দিয়াছেন। এই ব্যাপার প্রকাশ হওয়াতে কালবিলম্ব ব্যতিরেকে বোম্বাই পুলিস কমিশনারের নিকট এক টেলিগ্রাফ পাঠান হইল। তিনি সেই পারসেল আটক করিয়া এইস্থানে পাঠাইয়া দিলেন। উহাতে কয়েকখানি সোনার গহনা ছিল, সেগুলিও চুরির মালের তালিকাভুক্ত।
এখন আর ওয়ার্নার সাহেব যান কোথায়? তাঁহার উপর বিশ্বাসঘাতকতার নালিশ চালান সাব্যস্ত করিয়া, ‘সিঙ্গার কোম্পানীর’ প্রধান দোকানে বোম্বাই শহরে স্বত্ত্বাধিকারীর নিকট এক টেলিগ্রাফ পাঠান হইল। তাহাতে সমস্ত কথা স্পষ্ট করিয়া লেখা হইল। আরও লেখা হইল, যেন সেইস্থান হইতে একজন কলিকাতায় আসিয়া এই মোকদ্দমায় ফরিয়াদী হন। তাহার স্বপক্ষে যে এইসকল ষড়যন্ত্র হইতেছে, প্রথমে ওয়ার্নার তাহার কিছুই জানিতে পারিয়াছিল না। বোম্বাই হইতে যখন দোকানের একজন স্বত্ত্বাধিকারী আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাহার কিছু পূর্ব্বেই ওয়ার্নার এই সকল বিষয় জানিতে পারিয়া পলায়ন করিল।
ওয়ার্নারকে ধরিবার জন্য অনেক উপায় অনুসন্ধান ও বিশেষ চেষ্টা হইল; কিন্তু কিছুই ফল হইল না। সেই সময়ে আমিও উহার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাহাতে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, ওয়ার্নার হাবড়ার রেলে আরোহণ করিয়া পশ্চিমাভিমুখে গমন করিয়াছে। ক্রমে সন্ধানে সন্ধানে আমিও সেইদিকে গমন করিয়া, সর্ব্বশেষে মোকামা ষ্টেশনে উহার অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম; কিন্তু সে স্থান হইতে যে কোনদিকে চলিয়া গিয়াছিল, তাহা ঠিক করিতে না পারিয়া, আমি প্রত্যাগমন করি। ওয়ার্নারের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছিল, কিন্তু অনেক দিবস পর্য্যন্ত সে ধৃত হয় নাই।
এই ঘটনার প্রায় বৎসরাধিক পরে একটি কয়েদী লইয়া একজন ইংরাজ কর্মচারীকে রেঙ্গুনে গমন করিতে হয়। তিনি ওয়ার্নারকে চিনিতেন, সেইস্থানে তিনি উহাকে দেখিতে পান। ওয়ার্নার একটি চাকরী যোগাড় করিয়া লইয়া এতদিন সেইস্থানেই ছিলেন। ইংরাজ পুলিস কর্মচারী কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়া আপন ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীকে সেই সংবাদ প্রদান করেন। এই সংবাদের উপর নির্ভর করিয়া ওয়ারেন্টসহ একজন ইংরাজ কর্মচারীকে সেইস্থানে পাঠান হয়। তিনি সেইস্থানে গমনপূর্ব্বক উহাকে ধৃত করিয়া কলিকাতায় আনয়ন করেন। কলিকাতার সেসন কোর্টে সেই মোকদ্দমার বিচার হয়। বিচারে ওয়ার্নার অপরাধী সাব্যস্ত হয়, ও কঠিন পরিশ্রমের সহিত তাহার চারি বৎসরের মেয়াদ হয়। ওয়ার্নার তদবধি হরিণ বাড়ির জেলেই আবদ্ধ থাকে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
যে হরিণ বাড়ীর জেলে ওয়ার্নার ছিল, হিলি ও সেই জেলে ছিলেন। হিলি প্রথমে সৈনিক পদ গ্রহণ করিয়া ইংল হইতে এ প্রদেশে আগমন করেন। তিনি দলের মধ্যে একজন অতিকায় বলশালী সৈনিক পুরুষ। যতদিন তিনি এদেশে সৈনিক বিভাগে কৰ্ম্ম করেন, তাহার মধ্যে দুই তিনটি সম্মুখ সংগ্রামে নিযুক্ত হন, যুদ্ধ কয়েকটিতেই ইংরাজের জয় লাভ হয়। যে সকল যুদ্ধে এবং যে যে কৰ্ম্মচারীর অধীনে তিনি নিযুক্ত হন তাহার পরিচয় এখানে অনাবশ্যক। হিলি একজন প্রকৃত যোদ্ধা, তাঁহার শরীরে এখনও অনেক ‘গুলির’ চিহ্ন বিদ্যমান আছে। কয়েক বৎসর তিনি সৈনিক বিভাগে কর্ম্ম করিলে, পরিশেষে তাঁহার রেজিমেন্ট (Her Majesty’s own Scottish Border’s Regiment) যখন মিরাটে ছিল, সেই সময়ে তিনি বিনা অনুমতিতে নিরুদ্দেশ হন, এবং কোন সুযোগে ইংলণ্ড যাত্রা করেন। সেস্থানে গমন করিয়া কি জানি, কি কারণে তিনি সৎপথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক অসৎ পথ অবলম্বন করেন; একজন প্রসিদ্ধ ডাকাতের সহিত সম্মিলিত হইয়া ডাকাইতি ব্যবসায় আরম্ভ করেন। ক্রমে তিনি একটি প্রধান ডাকাইত দলের সর্ব্বপ্ৰধান নেতা হয়েন। ইংলণ্ডে তিনি যে কতশত ভয়ানক ভয়ানক ডাকাতিতে নিযুক্ত ছিলেন, উহার সম্পূর্ণ ইতিহাস এ দেশে প্রাপ্ত না হওয়া গেলেও, যাহা কিছু জানিতে পারা গিয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ এইস্থানে লিপিবদ্ধ করিতে হইলে, পুস্তকের কলেবর নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িবে বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। এক কথায় ইংলণ্ডে তিনি অনেক ভয়ানক চুরি ও ডাকাইতি করিয়া সেইস্থানের সুযোগ্য পুলিস ও ডিটেকটিভের চক্ষে ধূলি প্রদান করেন; পুলিস তাঁহার জ্বালায় নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া, অন্য কৰ্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক কেবল তাঁহারই উপর দৃষ্টি রাখেন, ভালভাল খ্যাতনামা বিলাতি ডিটেকটিভগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিতে থাকেন। এইরূপ নানাকারণে বাধ্য হইয়া ইংলণ্ড পরিত্যাগ পূর্ব্বক হিলি পুনরায় এদেশে পদার্পণ করেন। প্রথমে বোম্বাইতে আগমন করেন, ও সেইস্থান হইতে কলিকাতায় আসিয়া কোন এক হোটেলের একটি ত্রিতল গৃহে অবস্থান করিতে থাকেন।
এই সময়ে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্ট্রীটের নিকটবর্ত্তী স্থান সকলে ভয়ানক চুরি আরম্ভ হইল। প্রত্যহ প্রাতঃকালে সংবাদ আসিতে লাগিল, আজ তিনজন ইংরাজের গৃহ হইতে চেন ও ঘড়ী প্রভৃতি চুরি হইয়া গিয়াছে; কল্য আর পাঁচস্থানের পাঁচজন ইংরাজের চেন, ঘড়ী ও আংটী প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্যাদি পাওয়া যাইতেছে না; ইত্যাদি সংবাদের উপর সংবাদ আসিতে আরম্ভ করিল। অনুসন্ধান চলিতে লাগিল; প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ ইংরাজ ও দেশীয় কর্ম্মচারীগণের মধ্যে প্রায় সকলেই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। আমাকেও তাঁহাদিগের সহিত যোগ দিতে হইল। যিনি যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা করিলেন, তিনি সেইরূপেই আপনার বুদ্ধির চালনা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কাহারও দ্বারা যে কোনরূপ সুফল ফলিবে, তাহা বোধ হইল না। যিনি দর্প করিয়া এই অনুসন্ধানে যোগ দিলেন, ভগবান্ তাঁহার দর্প চূর্ণ করিলেন। যাহার মনে মনে অভিমান ছিল যে, তাহার মত সুনিপুণ অনুসন্ধানকারী আর কেহই না; এই চুরিতে তাহার সেই অভিমান দূরে পলায়ন করিল। স্থূল কথায়, কাহারই দ্বারা এই সকল চুরির অনুসন্ধানের ফল ফলিল না, অপহৃত দ্রব্যগুলির কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না। সাহেবদিগের খানসামা বাবুর্চিদিগকে বিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করায় কেহ কহিল, ‘রাত্রিতে আমাদের কুঠিতে একজন মুসলমান বেশী লোককে দেখিয়াছিলাম।’ কেহ বলিল ‘আমি চোরকে পলাইতে দেখিয়াছি, সেই ইহুদি।’ কেহ বলিল, ‘চোর আমার হস্ত ছাড়াইয়া পলাইয়া গিয়াছে—সে ফিরিঙ্গি।’ এইরূপ নানাকথা শুনা যাইতে লাগিল; সুতরাং চোর কে, বা কোন্ জাতীয় লোক, তাহা কিছুই স্থির হইল না। এইরূপে চারি পাঁচদিবসের মধ্যে উক্ত স্থানটি একরূপ অরাজক হইয়া উঠিল। পুলিসের যিনি মস্তক, তাঁহারও মস্তক ঘুরিয়া গেল—হস্তপদের ত কথাই নাই! কি প্রকার বন্দোবস্ত করিলে, এই চুরি বন্ধ হয়, এবং চোর ধরা পড়ে, তাহার নানাপ্রকার যুক্তি ও পরামর্শ হইতে লাগিল। পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে, যে স্থানে চুরি হইতেছে, সেইস্থানে রীতিমত পুলিস পাহারার বন্দোবস্ত করা হইবে।
পরামর্শ-অনুযায়ী সেইস্থানে পাহারা পড়িল। পাহারার নিমিত্ত সেইস্থানে এত পরিমাণে পুলিসের আমদানী হইল যে, দশহস্ত অন্তর একজন করিয়া পাহারায় নিযুক্ত হইল। ইহা ব্যতীত প্রত্যেক বাড়ীর দরজায় পুলিস রহিল পাহারাওয়ালা ব্যতীত ঊর্দ্ধতন কৰ্ম্মচারীমাত্রই অর্থাৎ ইনস্পেক্টার পর্য্যন্ত পাহারায় নিযুক্ত হইলেন। ইহার উপর তাঁহাদের ঊর্দ্ধর্তন কর্মচারীগণও ঘুরিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য যে, আমরাও সে পাহারা হইতে পরিত্রাণ পাইলাম না।
তথাপি চুরি বন্ধ হইল না। এইরূপে ক্রমে সাতদিবস গত হইয়া গেল, তথাপি চুরি বন্ধ হইল না। এই ভয়ানক সতর্ক অভেদ্য পাহারার ভিতরও সকলের চক্ষে ধুলি দিয়া চোরে চুরি করিতে লাগিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অষ্টমদিবস যখন আমরা সকলে পাহারায় নিযুক্ত, সেই সময়-রাত্রি আন্দাজ তিনটার সময়, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান ষ্টীটের একটি বাড়ীতে গোল উঠিল—“চোর চোর”। বাড়ীর বাহিরেই পুলিস, সদর দরজা বন্ধ। সেইস্থান হইতে পুলিসও বলিতে লাগিল –“ধর ধর”। বাড়ীতে একটি মুসলমানী আয়া ছিল, চোর আসিয়া তাহারই সম্মুখে পড়িল। আয়াও কম সাহসী নহে—সে চোরকে জাপ্টাইয়া ধরিল; কিন্তু চোর তাহার অপেক্ষা অধিক বলবান। সুতরাং সে আর চোরকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না; চোর সে বাড়ীর পশ্চিমদিগের প্রাচীর এক লম্ফে লঙ্ঘন করিয়া, পার্শ্ববর্তী বাড়ীর ভিতর গিয়া পড়িল। দ্বারের নিকট হইতে পুলিস তাহা দেখিতে পাইল। যে বাড়ীতে চোর গমন করিল, সেই বাড়ীর সম্মুখেও পুলিস ছিল। তখন সকলে একত্র “চোর চোর” বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে, কেহ বা সেই বাড়ীর ভিতর প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া প্রবেশ করিল, কেহ বা সেই বাড়ীর পার্শ্বস্থিত একটি খালি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। যে বাড়ীতে চোর আসিয়াছে, সেই বাড়ীতে দুইজন দ্বারবান্ জাগিয়াছিল; বাড়ীর ভিতর পুলিস প্রবেশ করিবার পূর্ব্বেই দ্বারবানদ্বয় চোরের পশ্চাৎ ধাবমান হইয়াছিল। চোর সেই সময়, সেই বাড়ীর ভিতর হইতে লম্ফপ্রদান করিয়া, সেই খালি বাড়ীর প্রাচীরের উপর যেমন উঠিবে, অমনই একজন দ্বারবান উহার একখানি পা চাপিয়া ধরিল। চোর অতিশয় বলশালী; সে অপর পদের দ্বারা আঘাত করিয়া ধৃতপদ ছাড়াইয়া লইল, খালি লম্ফপ্রদান করিয়া সেই খালি বাড়ীর ভিতর পতিত হইল। সেই বাড়ীর ভিতর অগ্রেই পুলিস প্রবেশ করিয়াছিল, কিন্তু উহাকে ধরিবার পূর্ব্বেই, সে দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া ছাদের উপর উঠিল। পুলিসও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছাদের উপর গমন করিলে, সে সেই ছাদের উপর হইতে একলম্ফে অন্য আর একটি বাড়ীর ছাদের উপর গিয়া পতিত হইল। পুলিসের সাধ্য নাই যে, সেইরূপ লম্ফপ্রদানে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে পারে। তখন আর কি করা যায়, স্থির করিতে না পারিয়া, সকলে মিলিয়া কেবল “চোর চোর” বলিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। আর সেই চোরও লম্ফে লম্ফে দুই তিনটি বাড়ী অতিক্রম—পূর্ব্বক অন্য আর একটি বাড়ীতে গমন করিল। সেই বাড়ী হইতে অন্য বাড়ীতে গমন করিতে, আর কেহই দেখিতে পাইল না। শেষোক্ত বাড়ীটি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রীটের হোটেল। এই সকল কথা বলিতে যত সময় লাগিল, তাহার সহস্রাংশের একাংশ সময়ের মধ্যে চোর প্রথম বাড়ী হইতে শেষ বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল।
সে যাহা হউক, তখন আমরা সকলে এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, চোর এই কয়েকটী বাড়ীর ভিতর নিশ্চয়ই আছে। অবশেষে স্থির হইল, এই বাড়ী কয়েকটিতে এরূপভাবে পাহারা দিতে হইবে যে, সে আর কোনদিক দিয়া পলায়ন করিতে সমর্থ না হয়; বন্দোবস্তও সেইরূপ হইল। পাহারার বন্দোবস্ত শেষ হইলে, আমাদের প্রথম কাৰ্য্য—সেই হোটেলের ভিতর অনুসন্ধান করা। সেইস্থানের সাহেবমাত্রই চোরের জ্বালায় পূর্ব্বেই জ্বালাতন হইয়াছিলেন; সুতরাং সকলে আসিয়া আমাদিগের সহিত যোগ দিলেন। হোটেলের দ্বারে গমন করিয়া দেখিলাম, সেইস্থানেও দুইজন সাহেব আসিয়া দাঁড়াইয়া আছেন; ইঁহারা সেই হোটেলেই থাকেন। ইঁহারাও আমাদের সাহায্যে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই দুইজন সাহেবের মধ্যে একজনের নাম “হিলি।”
হোটেলের নীচের গৃহ হইতে আমরা অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম। এ অনুসন্ধান, নামে অনুসন্ধান নহে—প্রত্যেক ঘরই দস্তুরমত খানা-তল্লাসি করিতে লাগিলাম। সেই সকল গৃহে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা সকলেই ভদ্রলোক; বিশেষতঃ পূর্ব্বোক্ত ভয়ানক ভয়ানক চুরির কথা সমস্ত তাঁহারা শুনিয়াছেন। তাঁহাদিগকে বলিবামাত্রই তাঁহারা গৃহের সমস্ত দ্রব্যাদি আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন; কিন্তু কাহারও গৃহে কোন চোরাই দ্রব্য পাওয়া গেল না। নীচের গৃহ ও দ্বিতলের গৃহ অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে ত্রিতলে উঠিলাম। এইস্থানে আমাদিগের সাহায্যকারী “হিলি” সাহেব অবস্থিতি করেন। জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম, দশ এগার দিবস হইতে তিনি সেই গৃহে আছেন। গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াই একজোড়া জুতা দেখিতে পাওয়া গেল; ঠিক্ এইরূপ একজোড়া জুতা একটি সাহেবের গৃহ হইতে পূর্ব্বে চুরি গিয়াছিল। সেই গৃহের ভিতর একগাছি ছড়ি ছিল, তাহাতে সুবর্ণ ও রৌপ্যের কাজ করা; এইরূপ একগাছি ছড়িও অন্য আর একজনের গৃহ হইতে চুরি যায়। তখন দুইজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী দুইখানি গাড়ি লইয়া, যাঁহাদের জুতা ও ছড়ি চুরি গিয়াছিল, সেই দুইজন সাহেবের নিকট গমন করিলেন। সেই সাহেবদ্বয় সেই কথা শুনিবামাত্র তখনই আগমন করিলেন। জুতা ও ছড়ি দেখিয়াই তাঁহারা বলিলেন, “ইহাই আমাদিগের গৃহ হইতে চুরি গিয়াছিল।” তখন আর হিলি সাহেব কোথায় যাইবেন?—তখনই তাঁহার হস্ত লৌহ-অলঙ্কারে শোভিত হইল, এবং সেই গোলযোগের সময় কে একজন আসিয়া, তাঁহার গালে সবলে এক চপেটাঘাত করিল। যখন হিলি দেখিল যে, তাহার আর বাঁচিবার উপায় নাই—সে মালসমেত ধরা পড়িয়াছে, তখন সে সমস্ত স্বীকার করিল। এইটি ইংরাজ চোরের মহৎ গুণ। ইংরাজ চোর যে পর্য্যন্ত মালসমেত ধরা না পড়ে, সে পর্যন্ত কাহার সাধ্য—উহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির করে। কিন্তু যদি দেখিল, মালসমেত ধরা পড়িয়াছে—-বাঁচিবার কোন উপায় নাই, তখন সে কোন কথা গোপন করিবে না—-সকল কথা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিবে।
হিলি যে সকল চুরি করিয়াছিল, তাহা সমস্ত স্বীকার করিল, এবং সেই বাড়ীর নানাস্থান হইতে দ্রব্যাদি বাহির করিয়া দিল। এ পর্য্যন্ত যত চুরি হইয়াছিল, তাহার সমস্ত দ্রব্যই প্রায় পাওয়া গেল; কেবল বাকি থাকিল—চেনগুলি। চেনের কথা জিজ্ঞাসা করায়, পরিশেষে হিলি তাহাও স্বীকার করিল, এবং একটী বাজার বাক্সের (পিয়োনোর) ভিতর হইতে ৩২ ছড়া সোণার চেন বাহির করিয়া দিল।
হিলির নামে অনেক চুরির নালিস হইল। মাজিষ্ট্রেটের কোর্টেও হিলি কোন কথা অস্বীকার করিল না, মাজিষ্ট্রেট সাহেব উহাকে দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেখানেও হিলি সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়া লওয়ায়, জজ ও জুরির দয়া হইল। ১৮৮৮ সালের আগষ্ট মাসে হিলি তিন বৎসরের নিমিত্ত কঠিন পরিশ্রমের সহিত কারাগারে প্রেরিত হইল। হিলিও হরিণ-বাড়ীর জেলে আবদ্ধ রহিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
লালবাজার পুলিসে বড় সাহেবের আফিসের সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময়ে তাঁহার ‘টম্ টম্’আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি ও সাহেব উভয়েই সেই ‘টম্ টম্’ আরোহণ করিয়া প্রেসিডেন্সী জেলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গমন করিয়া যাহা দেখিলাম, ও যাহা শুনিলাম, তাহাতে অবগত হইলাম যে, ওয়ার্নার ও হিলি দুইজনেই এক সময়ে জেল-হাসপাতালে ছিল; সেই সময় হইতেই উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া উহারা যখন জেলের ভিতর থাকে, সেই সময়ে একজন কয়েদী সংবাদ দেয় যে, ওয়ার্নার ও হিলি জেল হইতে পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। সেই সংবাদ পাইয়া জেলের কর্তৃপক্ষীয়গণকর্তৃক উহাদিগের থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করা হয়। সেই সময় হিলি যে স্থানে থাকিত, সেইস্থানে একখানি লৌহ-নির্ম্মিত অস্ত্র পাওয়া যায়। সেই সময় হইতে উহাদিগের উপরে বিশেষ পীড়াপীড়ি আরম্ভ হয়, এবং বিশেষ সতর্কতার সহিত উহাদিগকে জেলের ভিতর কয়েদ করিয়া রাখা হয়; উভয়কেই বৃহৎ লৌহ-শৃঙ্খল বা বেড়ির দ্বারা আবদ্ধ করা হয়। ইহা ব্যতীত রাত্রিকালে উভয়কেই স্বতন্ত্র দ্বারা বন্ধ করিয়া রাখা হয়, এবং গৃহের দ্বার ‘চবস্’ তালা কক্ষে আবদ্ধ থাকে। এই গৃহকে “শেল” কহে।
হিলি ও ওয়ার্নার কয়েদী। কিন্তু কয়েদী হইলেও উহারা ইংরাজ; সুতরাং দেশীয় কয়েদীর সহিত তাহাদের তুলনা হইতে পারে না। দেশীয় কয়েদীর পোষাক, এক প্রকার কাল ডোরাযুক্ত মোটা কাপড়ের জাঙ্গিয়া ও পিরাণ, এবং গলায় লোহার হাঁসুলি। আর ইংরাজ কয়েদীর পোষাক, কিছু অল্পমূল্যের কাপড়ের কোট, পেনটুলান; পায়ে মোজা ও বুট জুতা, মস্তকে সাদা সোলার হ্যাট। এই ত গেল পরিধেয়ের তারতম্য। ইহা ভিন্ন দেশীয় কয়েদী লোহার থালায় অন্ন আহার করে, ও মৃত্তিকা-নির্ম্মিত এক প্রকার শয্যার উপর শয়ন করে। আর, ইংরাজ কয়েদীর থাকিবার গৃহে প্রত্যেকেরই একটি টেবিল, একখানি চেয়ার ও একখানি খাট থাকে; আর তাহাদিগকে প্লেটে করিয়া রুটি, মাখম, এবং মাংসাদি ভোজন করিতে দেওয়া হয়।
হিলি ও ওয়ার্নার যে যে ‘শেলে’ বদ্ধ থাকিত, সেই সেই ‘শেলে’ এক একটি টেবিল, চেয়ার ও খাট ছিল।
যে সময়ে জেলের প্রহরী ‘কয়েদী পলাইল’ বলিয়া চীৎকার করিল, তাহার পর জেলের ভিতর দেখা গেল, উভয় ‘শেলের’ চ তালা ভাঙ্গা, উভয় কয়েদীর বেড়ি সেইস্থানে গড়াগড়ি যাইতেছে। সেইস্থানে একটি লোহার পুরাতন গাতি পড়িয়া রহিয়াছে, ‘শেলের’ ভিতর টেবিল চেয়ার প্রভৃতি কিছুই নাই। যে স্থান দিয়া কয়েদীকে পলাইতে একজন প্রহরী দেখিয়াছিল, সেইস্থানে জেলের ভিতর সেই সকল টেবিল, চেয়ার, খাট প্রভৃতি উপর্যুপরি করিয়া রাখা আছে। এই অবস্থায় দেখিয়া বোধ হইল, উহারা এই সকল দ্রব্যের সাহায্যে সেই উচ্চ প্রাচীরে উঠিয়া সেইস্থান হইতে লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে।
যে প্রহরীর পাহারার সময় কয়েদীদ্বয় পলায়ন করে, সেই প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, সে উহাদিগকে প্রথমে প্রাচীরের উপর দেখিতে পাইয়া “কয়েদী পলাইল, কয়েদী পলাইল” বলিয়া যেমন চীৎকার করে, অমনি তাহারা এক এক লম্ফে জেলের বাহিরে গিয়া উপস্থিত হয়। সেই সময় সে তাহার হস্তের রুল ফেলিয়া, প্রহার করায়, উহাদের একজনের টুপি সেইস্থানে পড়িয়া যায়। উহারা সেই টুপি ফেলিয়াই প্রস্থান করে। প্রহরী বন্দুক লইয়া পাহারায় নিযুক্ত ছিল, কিন্তু সে সময়ে সেই বন্দুক কোন কাজেই লাগে নাই; কারণ উহাতে গুলি, বারুদ প্রভৃতি কিছুই ছিল না; কেবল ফাকা বন্দুকই ছিলমাত্র।
আরও জানিতে পারিলাম যে, সেই প্রহরীর নিকট সংবাদ পাইয়া জেলের প্রধান প্রধান কর্ম্মচারীমাত্রই সেইস্থানে আগমন করেন। যেরূপভাবে কয়েদীদ্বয় পলায়ন করিয়াছে, তাহা শ্রবণ করিয়া, এবং জেলের ভিতরস্থিত অবস্থা সকল দেখিয়া তাঁহারা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া পড়েন; তথাপি সময়োচিত অনুসন্ধান করিতে তাহারা কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই। তাঁহাদিগের সাধ্যমত সেই জেলের চতুঃপার্শ্ববর্তী প্রকাণ্ড ময়দানের ভিতর সেই রাত্রিতেই কয়েদিদিগের অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; এবং অপরাপর বিশ্বাসী কর্ম্মচারীবর্গের দ্বারাও নিকটবর্ত্তী স্থান সকল অনুসন্ধান করিতে কিছুমাত্র ত্রুটী করেন নাই; কিন্তু তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ না হইয়া পরদিবস প্রাতঃকালে পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন।
এই সকল দেখিয়া শুনিয়া সাহেব ও আমি সেই জেল হইতে বহির্গত হইয়া, পলাতক কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। কিন্তু কোনস্থানে গমন করিব, কোন পথ অবলম্বন করিলে তাহাদিগের সন্ধান পাইতে পারিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কারণ, এমন কোনস্থান বাকি ছিল না, যে দিকে অপরাপর কর্ম্মচারীগণকে প্রেরণ করা না হইয়াছে। পরিশেষে উভয়ে যুক্তি করিয়া প্রথমে হাবড়া রেলে দেখাই স্থির করিলাম! কারণ, সেই পথ দিয়া ওয়ার্নার আর একবার পলায়ন করিয়াছিল। হাবড়ায় গিয়া দেখিলাম, সম্মুখে গাড়ি সুসজ্জিত। তখন তাহাতে উঠিয়াই চলিলাম—-বৰ্দ্ধমান। প্রথমে বর্দ্ধমানে অনুসন্ধান করিলাম, কোন সন্ধান পাইলাম না। সেইস্থান হইতে চন্দননগরে ও পরিশেষে সেওড়াফুলিতে আসিলাম; সেস্থানেও কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। এইরূপে দুই একটি ষ্টেশন অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু সে দিবস কোন সন্ধান না পাইয়া, রাত্রি বারটার সময় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম। রাত্রি দুইটা পর্যন্ত উভয়ে পরামর্শ পূর্ব্বক স্থির করিলাম যে, এরূপভাবে অনুসন্ধান করিলে চলিবে না। হাবড়া হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেক ষ্টেশনে গমন করিব, ও সেই সেইস্থানে থাকিয়া রীতি-মত অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত গমন করিতে থাকিব, এবং আবশ্যক বিবেচনা করিলে ক্রমে আরও অধিক দূর গমন করিব।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরদিবস, অর্থাৎ ইংরাজী ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের ৭ই মার্চ তারিখের প্রাতঃকালে প্রথমে বালি, পরে কোন্নগর ষ্টেশনে গিয়া পলায়িত কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া শ্রীরামপুর ষ্টেশনে গমন করিলাম। এ স্থানের ষ্টেশনমাষ্টার একজন ইংরাজ। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় জানিলাম যে, ৬ই মার্চ তারিখের প্রাতঃকালে দুইজন ইংরাজ (যাহাদের আকৃতি-প্রকৃতি, হিলি ও ওয়ার্নারের সহিত কতক মিলিল) আসানসোলের দুইখানি টিকিট লইয়া হাবড়া হইতে প্রথম যে গাড়ি ছাড়ে, সেই গাড়িতে গমন করিয়াছেন। এই সংবাদ মনে লাগিল; কারণ, তাহার পূর্ব্ব অর্থাৎ ৫ই মার্চের রাত্রিতেই উহারা পলায়ন করিয়াছে।
এই সংবাদ পাইয়া প্রথমে যে ট্রেণ পাইলাম, সেই ট্রেণে আসানসোল গমন করিলাম। সেইস্থানের অনুসন্ধানে অবগত হইলাম যে, ৬ই মার্চ তারিখে কোন ব্যক্তি শ্রীরামপুরের টিকিট লইয়া তথায় অবতরণ করে নাই। সেইস্থানে অন্যান্য লোকের নিকট অনুসন্ধান করিয়া, কোন সংবাদ না পাওয়াতে বর্দ্ধমানে ফিরিয়া আসিলাম। বর্দ্ধমানে যে সকল ব্যক্তি গাড়ির ভিতর টিকিট পরীক্ষা করে, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াও কোন সংবাদ পাইলাম না। পরিশেষে অনন্যোপায় হইয়া রাত্রি বারটার সময় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম।
১৮ই মার্চ প্রত্যূষে পাঁচটার সময় কলিকাতা হইতে বহির্গত হইলাম। মনে করিলাম, প্রথমে বৰ্দ্ধমানে গিয়া ট্রেন হইতে অবতরণ করিব, ও সেইস্থান হইতে প্রত্যেক ষ্টেশনে আগমন পূর্ব্বক ক্রমে হাবড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইব। এই কার্য্যে যে কয়েকদিবস অতিবাহিত হইবেক, তাহার মধ্যে আর কলিকাতায় ফিরিব না।
প্রত্যূষে ছয়টার গাড়িতে আরোহণ করিয়া দশটার সময় বর্দ্ধমান ষ্টেশনে অবতরণ করিলাম। দেখিলাম, প্লাটফরমের উপর আমাদিগের এইস্থানের একজন ইংরাজ ইনস্পেক্টার “হাবিৎ” সাহেব ও একজন ইংরাজ কনষ্টেবল “ডালসুরি” সাহেব দণ্ডায়মান। আমাকে দেখিয়াই হাবিৎ সাহেব কহিলেন, “তোম্ কাঁহা যাতা হ্যায়”।
আমি। তোমরাও যে কাৰ্য্যে যাইতেছ, আমিও সেই কার্য্যের নিমিত্ত যাইতেছি।
হাবিৎ। এ কালা বাঙ্গালি আছে না, যে তুই ধরবি; ও ইংরাজ আছে, ও গোরা আছে, উস্কো পাস্ পিস্তল আছে। উস্কো পাকড়না তোমার কাম নেহি হ্যায়, উস্কা পাকড়না হাম্ লোককা কাম—সাহেব লোককা কাম।
আমি। আচ্ছা সাহেব তুমিই পাক্ড়িও।
হাবিৎ। হাম্ জরুর পাড়েগা। হামারা পেট তোম মাফিক মোটা নেহি হ্যায়। আর হাম্ তোমারা মাফিক উস্কো নজদিক জাতে ডরতা নেই।
আমি। আমরা বাঙ্গালি, সকল কাজেই আমাদিগের ভয়, তাতে আবার উহাদিগের নিকট পিস্তল আছে, বলিতেছ। এরূপ অবস্থায় আমি না হয়, উহাদিগকে না ধরিতেই পারিব; কিন্তু তোমরা সাহসী ইংরাজ, তোমরা ত ধরিতে পারিবে। আমি না হয়, তোমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ থাকিব।
হাবিৎ। হাঁ, হাম্ তোম্কা বহুত রোজসে জান্তা হ্যায়, তোম্ আচ্ছা আমি হ্যায়। তোম্ হামারা সাৎ সাৎ রহ, হাম্ যাঁহা যায়েগা, হামারা সাৎ চল। যর্ হাম্ উস্কো পাড়েগা, তোমকে হাম্ জরুর সাকরকে লে যায়েগা। ইমে বহু রূপেয়া এনাম হ্যায়। ঐ রূপেয়া সে হ্যাম তোমকো কুছ দেগা। হাম্ রূপেয়া নেই মাংতা হ্যায়, হাম্ নাম মাংতা, ক্রেডিট (Credit) মাংতা।
আমি। আচ্ছা সাহেব তাই হবে, আমি তোমার সঙ্গেই থাকব। এ ইংলণ্ড নয়, এ বাঙ্গালা দেশ, এইস্থানে কিরূপ উপায়ে তোমরা পলাতক কয়েদীদিগের অনুসন্ধান কর, তাহা দেখিতে আমার বড়ই ইচ্ছা হইয়াছে। তোমরা বীরপুরুষ, তাহা আমি জানি; কিন্তু তোমার বুদ্ধির জোর কতদূর, তাহা এইবার দেখা যাইবে।
এই বলিয়া আমি সেইস্থানে দাঁড়াইলাম। প্রথমে হাবিৎ সাহেব এইরূপ দুই চারি কথা আমাকে কহিলেন। ডালপুরি নূতন লোক, তিনি চুপ্ করিয়াই আমাদিগের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন। আমি যে ট্রেণে গমন করিয়াছিলাম, সেই ট্রেণ বর্দ্ধমান ষ্টেশন ছাড়িয়া পশ্চিমাভিমুখে চলিয়া গেল। সেই সময় কলিকাতাভিমুখ হইতে একখানি মাল—গাড়ি আসিয়া, বৰ্দ্ধমান ষ্টেশনে উপস্থিত হইল। সেই সময় হাবিৎ সাহেব বাঙ্গালা মিশ্রিত হিন্দিকথা পরিত্যাগপূর্ব্বক, ইংরাজী কথাতেই আমাদিগের সহিত সেই পলাতক কয়েদী সম্বন্ধে গল্প করিতেছিলেন। হিলি কিরূপ বলশালী, কিরূপ চতুর, এবং কিরূপ দুর্বৃত্ত, তাহাই আমাদিগকে বুঝাইতেছিলেন। আরও বুঝাইতেছিলেন যে, তিনি বিশেষরূপে অবগত হইয়াছেন যে, হিলি ও ওয়ার্নার পিস্তল সঙ্গে লইয়া জেল হইতে বহির্গত হইয়াছে।
দিবা এগারটার সময় উক্তমাল-গাড়ির গার্ড পামর সাহেব আসিয়া আমাদিগের সহিত যোগ দিলেন; তিনি আগমন করায় আমাদিগের গল্প ভঙ্গ হইল। পামর সাহেব কহিলেন, “আমি যখন মাল-গাড়ি লইয়া আসিতেছিলাম, সেই সময়ে বৈঁচি ও দেবিপুর ষ্টেশনের মধ্যে দুইজন ইংরাজকে পদব্রজে আসিতে দেখিয়াছি। আমার বোধ হয়, আপনারা সেই দুই ব্যক্তিরই অনুসন্ধান করিতেছেন।”
পামরের কথা শুনিয়া আমরা আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; তিনজনেই তখন এক পরামর্শ করিলাম যে, আমরা মেমারি ষ্টেশনে অবতরণ পূর্ব্বক পদব্রজে পূৰ্ব্বকথিত ষ্টেশনদ্বয় অভিমুখে গমন করিব। তাহা হইলে সেই দুই ব্যক্তিকে নিশ্চয় পথের উপরেই পাইব।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
এই সময়ে একখানি ট্রেণ পশ্চিম হইতে আগমন করিল। আমরা তিনজনেই সেই ট্রেণে উঠিয়া, দিবা বারটার সময় মেমারি ষ্টেশনে পৌঁছিলাম। মেমারি ষ্টেশনে কয়েকখানি ঘোড়ার গাড়ি দেখিয়া, হাবিৎ সাহেব পূৰ্ব্ব প্রস্তাব আর ঠিক রাখিতে পারিলেন না; পদব্রজে যাওয়ার পরিবর্তে গাড়ি করিয়া যাওয়াই তখন স্থির হইল। ষ্টেশন হইতে একজন পিয়নকে একখানি গাড়ি আনিতে পাঠাইয়া দিলেন। পিয়ন গাড়ি আনিতে গেল, সাহেবদ্বয় ওয়েটিং রুমে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। আমি ভাবিলাম, যখন এইস্থানে আসিলাম, তখন এই অবকাশে যতদূর পারি, এখানে একটু অনুসন্ধান করিয়া লই। এই ভাবিয়া আমি বুকিং আফিসের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাবুদিগকে জিজ্ঞাসা করায় কেহ কিছু বলিতে পারিলেন না। সেইস্থানে সিগনালারবাবু রজনীনাথ রায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি কহিলেন, “৬ই মার্চ তারিখে কলিকাতার প্রথম ট্রেণ দশটার কিছু পূর্ব্বে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়। সেই ট্রেণ হইতে যে সকল লোক সেইস্থানে অবতরণ করে, তাহাদিগের টিকিট আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। উহাদিগের মধ্যে দুইজন সাহেব ছিলেন। তাহাদের টিকিট ছিল—-শ্রীরামপুর হইতে আসানসোল পর্যন্ত। আমি টিকিট দেখিয়া সাহেবদ্বয়কে বলিয়াছিলাম, আপনারা ভুল করিয়াছেন এ আসানসোল ষ্টেশন নহে, এ মেমারি। সাহেবদ্বয় আমার কথায় কর্ণপাত না করিয়া, বাজারের দিকে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু তাহার পর যে কোথায় গমন করিল, তাহা বলিতে পারি না। ইহাদের মধ্যে একজনের টুপি ছিল না।”
রজনীনাথের কথা, শ্রীরামপুর ষ্টেশন মাষ্টারের কথার সহিত মিলিল দেখিয়া, আমি বাজারের দিকে গমন করিলাম।
বাজারের দোকানদারদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া ক্রমে জানিতে পারিলাম যে, সাহেবদ্বয় সেইস্থানের সরাবের দোকান অভিমুখে গমন করিয়াছিল। সরাবের দোকানে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, ৬ই তারিখে দুইজন সাহেব তাহাদের দোকানে গমন করিয়া অতি সামান্য পরিমাণে মদ্যপান করে, এবং তাহার মূল্যের দরুণ একখানি দশ টাকার নিতান্ত জীর্ণ ও মলিন নোট প্রদানপূর্ব্বক অবশিষ্ট টাকা লইয়া প্রস্থান করে। কিন্তু কোথায় যে গমন করে, তাহা তাহারা বলিতে পারিল না। সেই দোকান হইতে তখন পুনরায় বাজারে প্রত্যাগমন করিলাম। সেইস্থানে কতকগুলি মুটিয়া বসিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে একজন কহিল, “আজ তিনদিবস হইল, বেলা এগারটার সময় আমি দুইজন সাহেবকে সিউচরণ বাগ্দীর গরুর গাড়িতে চদীঘির পথে গমন করিতে দেখিয়াছি।” অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, সিউচরণের বাসস্থান মেমারি হইতে প্রায় দুই মাইল ব্যবহিত। এই সকল সংবাদ সংগ্রহ করিতে প্রায় দিবা একটা বাজিয়া গেল, সেই সময় আমার অতিশয় ক্ষুধাবোধ হইতে লাগিল। স্নান আহ্নিক করিবার অবকাশ আর হইল না। মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া সেই বাজারের একখানি মেঠায়ের দোকান হইতে কিছু আহারীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া ভক্ষণপূর্ব্বক ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
আসিয়া দেখিলাম, একখানি ঘোড়ার গাড়ি আনা হইয়াছে ও সেই গাড়ির ভিতর দুইজন সাহেবই বসিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছেন। আমার বিলম্ব হইয়াছে, আর ‘কালা বাঙ্গালীর” অপেক্ষায় যখন তাঁহারা অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন, তখন কাজেই ইংরাজের রাগ হইতে পারে। কিন্তু তাঁহারা রাগ করিয়া আমার কি করিবেন, আমি তাঁহাদিগের অধীনস্থ কৰ্ম্মচারী নহে।
হাবিৎ সাহেবের মেজাজ স্বভাবতই একটু গরম। তিনি আমাকে দেখিয়াই ইংরাজীতে কহিলেন, (এই সময় সাহেব আবার ইংরাজীতেই কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু আমরা সে সকল কথা বাঙ্গালায় লিখিব) “তোমার নিমিত্ত বসিয়া বসিয়া এত বিলম্ব হইল, নির্দ্দিষ্ট কর্ম্মে গমন করিব কখন? বাঙ্গালী অকৰ্ম্মণ্য, জাতি, কেবল গাল-গল্পেই মজবুত। দেখ দেখি, কত সময় মিথ্যা নষ্ট করিলে?”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমার মনে মনে একটু রাগ হইল। তাঁহাকে কহিলাম, “আমি আপনাদিগের সহিত এ কৰ্ম্মে নিযুক্ত হই নাই, আপনারা অক্লেশে গমন করিতেই পারিতেন; আমার নিমিত্ত অপেক্ষা করিয়া থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। এখন আপনারা গমন করুন, আমি আপনার সহিত যাইব না।” এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে ষ্টেশনের ভিতর গমন করিলাম।
ডালসুরি সাহেব নিতান্ত ভদ্রলোক। তিনি গাড়ি হইতে অবতরণপূর্ব্বক আমার নিকট আগমন করিয়া, আমাকে মিষ্টকথায় অনেক বুঝাইলেন, ও পরিশেষে আমাকে ধরিয়া গাড়ির নিকট লইয়া গেলেন। তখন হাবিং সাহেব কহিলেন, “আমি রাগ করিয়া তোমাকে কিছু বলি নাই। এখন যে কার্য্যে গমন করিতেছি, মিথ্যা সময় নষ্ট না করিয়া আইস সেই কার্য্য সমাপন করি।”
হাবিৎ সাহেব বা ডালপুরি সাহেব তখন পর্যন্ত বুঝিতে পারেন নাই যে, আমি কেন তাহাদিগের সহিত গমন করিতে অসম্মত। সেই সময় আমি কহিলাম, “সাহেব! আমি মিথ্যা সময় নষ্ট করি নাই, তোমরাই বসিয়া বসিয়া কেবল সময়ের বৃথা অপব্যয় করিয়াছ।” এই বলিয়া আমি যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক উহাদিগকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তাঁহারা কহিলেন, “আমরাই অনর্থক সময় নষ্ট করিতে গমন করিতেছিলাম। এখন তুমি যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ, সেই সংবাদ মত তাহাদের অনুসরণ করিতে পারিলে, নিশ্চয়ই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। এখন চল, চকদীঘি,গমন করি; তাহা হইলে বোধ হয়, তাহাদিগকে পাইলে পাইতে পারিব।”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “সাহেব! এ ব্যস্ততার কার্য্য নহে। আমরা জানিতে পারিতেছি যে, তাহারা চকদীঘির পথে গমন করিয়াছে; কিন্তু একথা কেমন করিয়া বলিতে পারি যে, তাহারা অন্যস্থানে না গিয়া চদীঘিতেই গিয়াছে? যদি আমার পরামর্শ শুন সাহেব, তবে এক কাজ কর; প্রথমে সেই গাড়োয়ান সিউচরণের অনুসন্ধান কর, দেখ সে কি বলে।” আমার কথা শুনিয়া হাবিৎ সাহেব আমার সহিত সিউচরণের গ্রামে গমন করিতে চাহিলেন। হাবিতের কথা শুনিয়া আমার একটু রাগ হইল। ভাবিলাম, কোথাকার এক হাবাতে সাহেবের সহিত পড়িয়াছি; সে না বুঝে কথা, না বুঝে কাৰ্য্য। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “সাহেব! তুমি অমন কর্ম্ম করিও না। এ নিতান্ত পল্লীগ্রাম, এইস্থানের অনেক লোক আজও পৰ্য্যন্ত সাহেব দেখিয়াছে কি না, সন্দেহ; এরূপ অবস্থায় তুমি আমার সহিত গমন করিলে, কোন কার্য্যই হইবে না। তোমরা এইস্থানে অপেক্ষা কর, আমি গমন করিয়া সিউচরণের অনুসন্ধান করি। যদি তাহাকে পাই, তাহা হইলে তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিব।” ডালপুরি আমার কথা বুঝিল,। এবং হারিৎকে সে বুঝাইল। আমি সিউচরণের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত দুই মাইল পথ হাঁটিয়া, সেই গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সিউচরণ তাহার বাড়ীতেই ছিল, সে আমার সহিত আসিতে প্রথমে অস্বীকার করিল; পরিশেষে তাহাকে অনেক প্রকার বুঝাইয়া, দিবা আড়াইটার সময় সাহেবদিগের নিকট উহাকে আনয়ন করিলাম। সিউচরণ যাহা বলিল, তাহা শুনিয়া আমরা সকলেই সাহেবের সেই ভাড়াটিয়া গাড়িতে চদীঘি—অভিমুখে যাত্রা করিলাম। বলা বাহুল্য, সিউচরণ আমাদের সঙ্গেই চলিল।
নবম পরিচ্ছেদ
৮ই মার্চ তারিখের সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার সময় জামালপুর অতিক্রম করিয়া ছয়টার সময় কালনা গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। জানিতে পারিলাম যে, এইস্থানে পলায়িত সাহেবদ্বয় ৬ই মার্চ সন্ধ্যার পর আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সমস্ত রাত্রি সিউচরণ বাগ্দীর গরুর গাড়ির ভিতর শয়ন করিয়াই রাত্রিযাপন করে। ৭ই মার্চ প্রাতঃকালে এইস্থানে উহাদিগকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক সিউচরণ আপন গ্রামে প্রত্যাগমন করেন। মেমারি হইতে এইস্থান বাইস চব্বিশ মাইলের কম নহে। সেইস্থানে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইলাম যে, পলায়িত ইংরাজদ্বয় সেইস্থানে অবস্থিতি করিবার উপযুক্ত স্থান প্রাপ্ত না হইয়া সবিশেষরূপে বিপদগ্রস্থ হইয়াছিল। একে থাকিবার স্থান পাইল না, তাহার উপর জেল হইতে পলায়ন করিবার পর, আর উপযুক্তরূপ আহার পায় নাই। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আশ্রয় অনুসন্ধান করিতে লাগিল; কিন্তু সেইস্থানের কোন ব্যক্তিই তাহাদিগের কষ্টের দিকে লক্ষ্যও করিল না। আহারের সংস্থান করিয়া দেওয়া ত পরের কথা, থাকিবার নিমিত্তও কেহ স্থান প্রদান করিল না। কিন্তু জানি না, উহাদিগের কষ্ট দেখিয়া পরিশেষে জনৈক রজকের অন্তঃকরণে কেন দয়ার উদয় হইল? সে আপনার গৃহ হইতে কিছু অন্নব্যঞ্জন আনিয়া উহাদিগকে প্রদান করিল। ক্ষুধার্ত সাহেবদ্বয় সেই অন্নব্যঞ্জন আহার করিয়া আপন আপন জঠরানল নির্ব্বাপিত পূৰ্ব্বক পুনঃ পুনঃ সেই রজককে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিল। নিতান্ত দয়া-পরবশ হইয়া এই রজক সাহেবদ্বয়কে আহারের সংস্থান করিয়া দিল সত্য; কিন্তু থাকিবার কোন বন্দোবস্তই করিল না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া নিকটবর্তী একটি পুষ্করিণীর ধারে ধরাশয্যায় শয়ন করিয়া, উহাদিগকে ৭ই মার্চ তারিখের সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিতে হইল। উহারা যখন দেখিল, সূৰ্য্যদেব অস্তাচলাবলম্বী হইতেছেন, তখন সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিকটবর্ত্তী দামোদর নদীর অভিমুখে গমন করিল।
এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিয়া, আমরাও সেই দামোদর তীরে গমন করিয়া তাহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু প্রথমে কোনই সংবাদ পাওয়া গেল না। সেই সময় একজন লোক দামোদর পার হইতেছিল; তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, দুইজন সাহেবকে ৭ই সন্ধ্যার পর নদীর অপর পার্শ্বে বালির উপর বসিয়া থাকিতে সে দেখিয়াছে।
বর্দ্ধমান জেলার মধ্যে দামোদর একটি প্রসিদ্ধ নদ; কিন্তু, উহার জল সকল সময় সমান থাকে না। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ঐ নদীতে জল অধিক ছিল না। কোনস্থানে হাঁটু জল, কোনস্থানে তাহারও কম; কোনস্থানে কোমর-জল, কোনস্থানে বা এক বুক। সকলকেই হাঁটিয়া নদী পার হইতে হয়; সেইস্থানে নৌকা নাই, বা কোনরূপে পার হইবার উপায়ও নাই। এই নদী হাঁটিয়া পার হইতে হইবে দেখিয়া, আমার সঙ্গী সাহেবদিগের বিশেষ ভাবনা হইল। আমার সম্বলের মধ্যে ছিল—পরিধানে একখানি ধুতি, গায়ে একটি পিরাণ, একখানি চাদর এবং পায়ে একজোড়া জুতা। আমি জুতা খুলিলাম, পিরাণ খুলিলাম, চাদর পরিধান করিলাম; এবং কাপড় প্রভৃতি হস্তে লইয়া, অক্লেশে নদী পার হইলাম। অপর পারে গমন করিয়া কাপড়, জুতা প্রভৃতি পরিলাম। একটু অসুবিধার ভিতর হইল—কেবল ভিজা চাদর।
সাহেবদিগের দুঃখের কথা আর কি বলিব? তাঁহারা প্রথমে নৌকার চেষ্টা করিলেন—পাইলেন না। পরে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অনন্যোপায় হইয়া আপন আপন বুট-মোজা পা হইতে খসাইলেন, কামিজ কোট খুলিলেন। পরিশেষে অবশিষ্ট পেনটুলান খুলিয়া দিগম্বর-মূর্তি ধারণপূর্ব্বক জলে পড়িলেন। অনেকদূর হাঁটু ও তাহার কম জল ভাঙ্গিয়া যাইতে হইল। সাহেবদিগের অবস্থা দেখিয়া ঘাটে লোক জমিয়া গেল। পুরুষগণ হাসিতে লাগিল; স্ত্রীলোকগণ মুখে কাপড় দিয়া গালি দিতে দিতে পলাইল। সাহেবদিগের পরিধেয় সকল পূৰ্ব্বতীরে বালুকার উপরই পড়িয়া রহিল, আমি দেখিয়াও দেখিলাম না। সাহেবগণ নদী পার হইয়া অপর পারে গমন করিয়া, পোষাক পরিধান করিতে গিয়া দেখেন, উহা অন্য পারে পড়িয়া রহিয়াছে,—কেহ তাঁহাদিগের কাপড় প্রভৃতি আনয়ন করে নাই। এই তাবস্থায় ইংরাজের মেজাজ চটিয়া গেল। হাবিৎ সাহেব আমাকে কহিলেন, “কেহই আমাদিগের কাপড় আনে নাই-আমরা কি পরিব?” হাবিতের কথা শুনিয়া আমি একটু হাসিলাম; হাসিয়া কহিলাম,—“সাহেব! এ কি তোমার কলিকাতা যে, তোমার চাকর তোমার কাপড় লইয়া সঙ্গে সঙ্গে আসিবে? এখন পুনরায় নদী পার হও, কাপড় প্রভৃতি লইয়া আইস।”
আমার কথা শুনিয়া হাবিৎ অসন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু, ডালসুরি সাহেব বিশেষ নম্র ও লজ্জিতভাবে আমাকে কহিলেন, “বাবু! কোন প্রকারে আমাদিগের কাপড়গুলি এইস্থানে আনাইয়া দেও।” ডালসুরির কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আচ্ছা, তোমরা এইস্থানে দাঁড়াইয়া থাক; আমি তোমাদিগের কাপড় আনাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া সেইস্থানে যেসকল লোক দাঁড়াইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে একটি দরিদ্র লোককে চারি আনা প্রদান করিলাম। সে নদী-পারে গমন করিয়া সাহেবদিগের পেনটুলান জুতা প্রভৃতি আনিয়া দিলে উঁহারা আপন আপন লজ্জা নিবারণ করিলেন।
যে সময়ে সাহেবগণ সেইস্থানে উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়াইয়াছিলেন, সেই সময় সেইস্থানের অনেক লোক তাহাদিগকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। দুইজন সাহেবকে তাহারা গত কল্য সন্ধ্যার সময় এইস্থান দিয়া গমন করিতে দেখিয়াছে, কি না; এই কথা আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় সকলেই কহিল, তাহারা কোন সাহেবকে গত কল্য এইস্থানে দেখে নাই। কিন্তু একজন লোক কহিল, “দুইজন নূতন লোক শ্রীকৃষ্ণপুরের একজন গোয়ালার বাড়িতে রহিয়াছে।” এই কথা শুনিয়া হাবিৎ সাহেব সেই অবস্থাতেই সেইস্থানে গমন করিতে উদ্যত! সাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, সাহেব! ওরূপ কার্য্য করিও না। আমি উহার বন্দোবস্ত করিতেছি।” এই বলিয়া আমি সেই লোকটিকে সেই গোয়ালার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। তাহাকে কহিলাম, “তুমি গিয়া সেই লোক দুইটিকে দেখিয়া আইস—তাহারা সাহেব কি না?” আমার কথা শুনিয়া সে দেখিতে গমন করিল। কিন্তু তাহার আসিতে বিলম্ব হওয়ায় হাবিৎ আমাকে কহিলেন, “বাবু! তুমি সব নষ্ট করিলে! আমি গমন করিতে চাহিলাম, তুমি আমাকে গমন করিতে দিলে না; এখন নিশ্চয়ই তাহারা আমাদের কথা জানিতে পারিয়া পলায়ন করিয়াছে।” সাহেবের কথা শুনিয়া আমার রাগ হইল। কিন্তু মনের রাগ মনে রাখিয়া কহিলাম, “চল সাহেব, আমার সঙ্গে, আমি তোমাকে সেইস্থানে লইয়া যাইতেছি।” এই বলিয়া সেইস্থানে লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া সেই গোয়ালার বাড়ীতে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে দুইজন অতিথি রন্ধন করিতেছে। তাহাদিগকে দেখিয়া সাহেবকে কহিলাম, “হাবিৎ! এখনও উহারা তোমার আসিবার সংবাদ পায় নাই বা পলায় নাই; তুমি অনায়াসে উহাদিগকে এখনই গ্রেপ্তার করিতে পার।” সাহেব আমার কথা শুনিয়া দ্রুতপদে তাহাদিগের নিকট গমন করিল। দেখিল, দুইজন পশ্চিম-দেশীয় সন্ন্যাসী, সেই গোয়ালার গোয়ালঘরে বসিয়া রন্ধন করিতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া সাহেবদ্বয় বিশেষ লজ্জিত হইলেন, ও উহাদিগকে গালি দিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ
যখন আমরা সেইস্থান হইতে প্রত্যাগমন করি, সেই সময় রাজারামপুর-নিবাসী বাবু হরনাথ মিত্রের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইল। আমরা কে, কোথা হইতে আসিতেছি, এবং কি নিমিত্তই বা আগমন করিয়াছি, এই সমস্ত বিষয় তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে আমিও তাঁহাকে সংক্ষেপে সমস্ত কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন “আমি বোধ হয়, আপনাদিগকে কিছু সাহায্য করিতে পারিব। আপনারা আমাদিগের বাড়ীতে আসুন, সেইস্থানেই সমস্ত কথা শুনিতে পাইবেন।” হরবাবুর কথা শুনিয়া আমাদের মনে অনেক ভরসা হইল। তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাঁহাদের গ্রামাভিমুখে চলিলাম। যখন তাঁহাদের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি নয়টা।
সাহেবদ্বয় আসিয়াছেন—বিলাত হইতে; থাকেন—কলিকাতায়। এদেশে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ভিতর যে কিরূপ সম্বন্ধ, তাহা তাঁহারা অবগত নহেন। আমি ব্ৰাহ্মণ, আর হরনাথ বাবু শূদ্র; সুতরাং, হরনাথ বাবুর বাড়ীর সমস্ত লোকেরা আমাকে যেরূপ মান্য করিলেন, যেরূপে আমার সেবা করিলেন, তাহা দেখিয়া সাহেবদ্বয় অবাক হইলেন, এবং কহিলেন, “তোমাদের দেশের লোক তোমাদিগকে (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদিগকে যে এরূপভাবে দেখিয়া থাকেন, তাহা আমরা কখন স্বপ্নেও ভাবি না। আমাদিগের প্রধান পাদরিও কোন খৃষ্টানের নিকট বোধ হয়, এরূপ সম্মান প্রাপ্ত হয়েন না।”)
আমি বিশেষরূপ যত্ন প্রাপ্ত হইলাম বলিয়াই যে, হরনাথ বাবু সাহেবদ্বয়ের অযত্ন করিলেন, তাহা নহে। তিনি তাঁহার বাহিরের ঘর সাহেবদিগের জন্য ছাড়িয়া দিলেন, এবং সমস্ত দিবস উহাদিগের আহার হয় নাই শুনিয়া, প্রথমেই দুগ্ধ ও কদলী আনাইলেন। সাহেবদ্বয় ইচ্ছামত দুধ ও কলা খাইয়া কতক সুস্থ হইলেন; আমিও উদর পুরিয়া জলযোগ করিলাম।
আমরা সকলে সুস্থ হইয়া উপবেশন করিলে পর, হরনাথ বাবু কহিলেন, “গত কল্য (অর্থাৎ ৭ই মার্চ) সন্ধ্যার সময় আমরা দামোদর তীরে সান্ধ্য সমীরণ সেবন করিতেছিলাম। সেই সময় দেখিতে পাইলাম, শ্রীকৃষ্ণপুরের নিকট দামোদর তীরে বালুকার উপর দুইজন ইংরাজ বসিয়া রহিয়াছেন। যে স্থানে ইংরাজের কখনও পদার্পণ হয় না, সেইস্থানে দুই দুইজন ইংরাজকে দেখিয়া আমাদের অতিশয় কৌতূহল উপস্থিত হইল। এক পা দুই পা করিয়া, আমরা ক্রমে সাহেবদিগের নিকট গমন করিলাম। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, উঁহারা সরকারী কর্ম্মচারী। দামোদর নদীর কোন কোনস্থানে বাঁধ বাঁধিবার প্রয়োজন, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত তাঁহারা এ প্রদেশে আগমন করিয়াছেন, এবং থাকিবার উপযুক্তরূপ স্থান প্রাপ্ত না হওয়ায়, সেইস্থানেই অবস্থিতি করিতেছেন। আসিবার সময় আপনারা বোধ হয়, দেখিয়া থাকিবেন, দামোদর নদীর ধারে ধারে বাঁধ বাঁধা আছে। সরকার বাহাদুর কর্তৃক উক্ত বাঁধ বাঁধা হইয়াছে, এবং বৎসর বৎসর উহা মেরামতও করিয়া থাকে। এই বাঁধের দ্বারা আমাদিগের কি উপকার হইয়াছে, তাহা আমরাই জানি। উক্ত বাঁধের নিমিত্ত তাঁহারা এ প্রদেশে আগমন করিয়াছেন, সাহেবদিগের মুখে এই কথা শুনিয়া আমাদিগের মনে তাঁহাদিগের প্রতি অতিশয় দয়ার উদ্রেক হইল। আমরা তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের এই বাড়ীতে আনয়ন করিলাম, এবং আমাদিগের বাঙ্গালীর যে খাদ্য (লুচি, তরকারী প্রভৃতি) তাহাদিগকে খাইতে দিলাম। আহারাদি করিয়া সমস্ত রাত্রিই তাঁহারা আমাদিগের বাড়ীতে শুইয়াছিলেন।
“উক্ত সাহেবদ্বয়ের মধ্যে একজনকে অতিশয় বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোক বলিয়া, আমাদিগের বোধ হয়। কথার প্রসঙ্গে যখন যে কথা উপস্থিত হয়, তাহাতেই বুঝিতে পারি যে, উহার সর্ব্বদিকে বিশেষ দৃষ্টি আছে। সাহিত্যের কথা পাড়িয়া বুঝিলাম, তিনি একজন সাহিত্য-সেবী। সমর-সংক্রান্ত কথায় জানিতে পারিলাম, তিনি একজন সৈনিকপুরুষ; নিজে অনেক রণক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া, অনেক যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বিজ্ঞানে উহার বেশ দখল আছে, রাজনৈতিক সমস্ত কাৰ্য্যেই উনি বিশেষরূপে বুঝিতে পারেন। ডাক্তারি বিদ্যাতেও কতক পরিমাণে অভিজ্ঞ। এক কথায় সৰ্ব্বগুণে বিভূষিত এরূপ একটি লোক পাওয়া নিতান্ত সহজ নহে। তাঁহাদিগের সহিত একত্রে উপবেশন করিয়া নানাকথা প্রসঙ্গে প্রায় রাত্রি দুইটা পর্য্যন্ত আমরা বসিয়াছিলাম। অদ্য প্রাতঃকালে পাঁচটার সময় তাঁহারা এইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক, দামোদরের ধারে ধারে বাঁধ সকল দেখিতে দেখিতে চণ্ডীপুরের অভিমুখে গমন করিয়াছেন।”
আমার সাহেবদ্বয় তাঁহাদিগের জুতা ও কোট খুলিয়া সেই গৃহের বিছানার উপর শয়নপূর্ব্বক হরনাথবাবুর কথাগুলি শুনিতেছিলেন। যখন তাঁহার কথা শেষ হইল, অমনিই হাবিৎ সাহেব উঠিয়া তাঁহার কোর্ট পরিলেন, এবং জুতা পায়ে দিয়াই কহিলেন, “চল চণ্ডীপুর গমন করি—আর বিলম্ব করা উচিত নহে।”
হাবিতের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “সাহেব! এই রাত্রি দশটার সময় অজানিত পথে এরূপভাবে তুমি যাইতে চাহ, অক্লেশেই যাইতে পার; আমি কিন্তু এভাবে যাইব না। আমি প্রথমে যাওয়ার বন্দোবস্ত করিব, তারপর যদি যাওয়া বিবেচনা-সিদ্ধ হয়, যাইব। নতুবা এই রাত্রি এইস্থানে অতিবাহিত করিয়া পরদিবস প্রাতঃকালে উহাদিগের অনুসন্ধানে বহির্গত হইব।” এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে উঠিয়া অন্য গৃহে গমন করিলাম; ভাবিলাম, “ দেখি, উহারা কি করে?”
রাজারামপুর বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত জামালপুর থানার অধীন। জামালপুর এইস্থান হইতে অধিক দূর নহে, দামোদর নদীর অপর পারে। আমি রাজারামপুরের একজন চৌকীদারকে ডাকাইয়া তাহার হস্তে একখানি পত্ৰ দিয়া কহিয়াদিলাম, “যত শীঘ্র পার, এই পত্রখানি জামালপুর থানায় লইয়া যাও। সেইস্থান হইতে যদি কেহ আগমন করেন, তাঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া এইস্থানে আনয়ন করিবে।” চৌকীদারকে আমি যে পত্র প্রদান করিলাম, তাহার মৰ্ম্ম এই—
“জামালপুর থানার ইন্চার্য্য অফিসার মহাশয়! আমরা কলিকাতা পুলিসের কর্ম্মচারী, বিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্য্যের অনুরোধে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। কিন্তু এখন দেখিতেছি, আপনাদিগের সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন হইতেছে; কারণ, এ প্রদেশের রাস্তা, ঘাট এবং গ্রামাদি আমরা অবগত নহি। এই নিমিত্ত আপনাকে লেখা যাইতেছে যে, আপনি পত্র পাঠমাত্র যে পুরাতন কৰ্ম্মচারী, এই প্রদেশের সমস্ত উত্তমরূপে অবগত আছেন, তাঁহাকে আমাদিগের সাহায্যের নিমিত্ত পাঠাইয়া দিবেন। সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্য্য—–কোনরূপে বিলম্ব না হয় জানিবেন।
ইতি ৮ই মার্চ ১৮৮৯।”
চৌকিদার আমার পত্র লইয়া প্রস্থান করিলে, হাবিৎ সাহেব আমার নিকট আসিলেন, এবং কহিলেন, “তুমি এখন কি করিতে চাও? তোমার কি ইচ্ছা যে, এইস্থানে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়াই রাত্রি অতিবাহিত করিবে?” উত্তরে আমি কহিলাম, “সাহেব! আমি যাহা করিতে চাই, তাহা পরে দেখিবে। তোমরা যাহা করিতে চাহ, তাহা করিতে পার। আমি তোমাদিগের সহিত এইরূপ কলহ করিতে করিতে গমনের প্রার্থনা করি না। আমি এ প্রদেশে একে চিনি না, তাহাতে রাত্রিকাল, কোথায় যাইতে কোথা যাইব, তাহা ঠিক করিতে পারিতেছি না। আমি সেইজন্য নিকটবর্ত্তী থানায় পত্র লিখিয়াছি। সেইস্থান হইতে কোন লোক আসিলে, তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি বহির্গত হইব। ইহাতে তোমাদের ইচ্ছা হয়, আমার অপেক্ষায় থাকিতে পার, ইচ্ছা না হয়, গমন করিতে পার। আমার কোনও আপত্তি নাই।” এই বলিয়া আমি চুপ করিলাম। বুঝিলাম, আমার কথা সাহেবদিগের ভাল লাগিল না। হাবিৎ সাহেব নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার সঙ্গীকে কহিলেন, “আমি জানি বাঙ্গালী নিতান্ত অকৰ্ম্মণ্য জাতি। এই বহুমূল্য সময় নষ্ট করিতে ইহারা যেমন মজবুত, তেমন আর কেহই নহে। সাহসেও পৃথিবীর মধ্যে ইহারা অদ্বিতীয়! ঐ বাবু যে সকল কথা বলিয়া আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, আমার বোধ হয়, উহার একটি কথাও প্রকৃত নহে। স্থূল কথা—ও নিতান্ত ভীত হইয়াছে; রাত্রিকালে গৃহের বাহির হইতে উহার সাহস হইতেছে না। আর ও যদি নিতান্তই এখন আমাদিগের সঙ্গে গমন না করে, তাহা হইলেই বা আমরা কি করিব? কোথায় বা আমরা গমন করিব এবং কাহাকেই বা আমরা জিজ্ঞাসা করিব? এরূপ অবস্থার দায়ে পড়িয়া এখন উহার মতেই মত দিতে হইবে। যাহা হউক, কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া আমি ইহার প্রতিশোধ লইতে সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব।” এই বলিয়া সাহেবদ্বয় পুনরায় শয়ন করিলেন।
[পৌষ, ১৩০১]