ইংরেজি : চক্রান্ত ও শোষণের ভাষা
ইংরেজি এখন, বাঙলাদেশে ও এমন অনেক একদা-উপনিবেশে, চক্রান্ত ও শোষণের ভাষা। ভাষাটি ব্যবহার করেন তাঁরাই, যাঁদের অবস্থান বিভিন্ন শক্তিকেন্দ্রের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে, যেখান থেকে শাসন-শোষণ করা হয় ‘শক্তির উৎস’দের; এবং যেখানে প্রসবিত হয় নানামুখি চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। শক্তির পরিণতিদের সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্রের বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙিন মুখোশ প’রে থাকতে হয় ব’লে প্রকাশ্যে সাধারণ মানুষের সাথে বিরোধিতায় অবতীর্ণ হ’তে পারেন না; কিন্তু যখন তাঁরা ফিরে যান জনতা থেকে সুদূর শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে, তখনই শুরু হয় প্রিয় জনগণের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। ক্ষমতাশীল রাজনীতিক প্রকাশ্যে জনগণের নানা স্তব ক’রে, উন্নয়ন কল্পনা পরিকল্পনা শুনিয়ে, কয়েকটি ছদ্মজনহিতকর প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তরে মাটি লাগিয়ে যখন রাজধানির জনতা-থেকে-সুদূর সুরক্ষিত কক্ষটিতে ফেরেন, তখন নথিপত্রে শুরু হয় জনতার সাথে শত্রুতা ও চক্রান্ত। নথিপত্রে তিনি সাধারণত ইংরেজি লেখেন, সাধারণত পচা ও ভুল, আর ওই ইংরেজি লেখাই তাঁর প্রথম চক্রান্ত, এবং ওই ভাষায় যে-সমস্ত মত-মন্তব্য-সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেন, তার অধিকাংশই জনগণের বিপক্ষে যায়। বাঙলাদেশের কোনো মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিষ্ঠার সঙ্গে বাঙলা ব্যবহার করেন না; যতটুকু করেন তা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই।
পাকিস্তানকালে চক্রান্তের রূপটি স্পষ্ট ছিলো, এখন অস্পষ্ট। পাকিস্তানে সাধারণত ক্ষমতায় গেছেন স্বনির্বাচিতরা, ও মনোনীতরা, যাঁদের বিশেষ যোগ ছিলো না জনগণের সাথে। জনসভায়ও তাঁদের বিশেষ বক্তৃতা দিতে হতো না; থাকতেন তাঁরা সান্ত্রীসুরক্ষিত প্রাসাদে। ওই প্রাসাদগুলো ছিলো যতো প্রতিক্রিয়াশীল ক্রিয়াকলাপ ও ষড়যন্ত্রের মাতৃসদন; তাতে সব কিছুই সাধিত হতো ইংরেজিতে। একাত্তর উত্তরকালে রাজনীতিতে জনসাধারণের প্রভাব বৃদ্ধি পায়; ক্ষমতায় প্রবেশ করেন এমন ব্যক্তিগণ, ইংরেজিতে যাঁরা মোটামুটি অস্বস্তিতেই ভুগতেন। কিন্তু তাতেও ইংরেজি হটে নি, কেননা একাত্তর-উত্তর রাজনীতিকেরাও ইংরেজিচর্চা করেছেন। সত্তর দশকের দ্বিতীয়াংশে সারা দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার ব্যাপক বিস্তার ঘটে, ইংরেজিও পুনরায় ব্যাপক ও একচ্ছত্র হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে জনসাধারণের প্রভাব যতোই কমছে বাঙলাদেশে, বাঙলার প্রভাবও কমছে ততো; এবং শক্তিমান হয়ে উঠছে ইংরেজি। বাঙলাদেশে এখন শোষণ-চক্রান্তের অস্ত্ররূপেই বিরাজ করছে ইংরেজি।