ইংরেজি ও বাঙলা : শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-উত্তরণ
এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় উত্তরণের সময় সংঘর্ষ বাঁধে। প্রতিক্রিয়া- ও রক্ষণ-শীলেরা একটি তথাকথিত মহিমামণ্ডিত ভাষাকে, আত্মস্বার্থে, আঁকড়ে থাকতে চান; আর প্রগতিশীলেরা সমস্ত স্তরে চালাতে চান ব্যাপক জনগোষ্ঠির ভাষা। এ-সংঘর্ষ দশক, এমনকি শতাব্দী, ধ’রে চলতে পারে; অবশেষে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো জয় হয় প্রগতিশীলদেরই। লাতিন থেকে ইংরেজিতে উত্তরণের সময় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে এমন ঘটেছিলো; বাঙলাদেশে এখন সে-সংঘর্ষ চলছে। ইংরেজি আমাদের দেশে শ্রেণীস্বার্থের ভাষা; একটি ছোটো কিন্তু শক্তিমান শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ইংরেজি। বাঙলাও একটি শ্রেণীর স্বার্থের ভাষা; সে-শ্রেণীটি বড়ো, কিন্তু প্রত্যক্ষ শক্তিহীন। এ-শ্রেণী দুটি এখন সংঘর্ষের মুখোমুখি; এবং বড়ো শ্রেণীটির বিজয় অবধারিত, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিরোধে তার জয় বিলম্বিত হচ্ছে। বাঙলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষের স্বাস্থ্য খুব ভালো, ত্বক উজ্জ্বল, চতুর্দিকে লাবণ্য, পোশাক বর্ণাঢ্য;- এ-শ্রেণীর কণ্ঠ থেকেই অবাধে উচ্চারিত হয় ইংরেজি- সাধারণত ভুল ইংরেজি। এঁদের বিপরীত মানুষেরা বাঙলা বলেন। এ-দু-শ্রেণীর মধ্যে এক সংগোপন সংগ্রাম চলছে; সময় মতো তা প্রকাশ্য সংগ্রামে পরিণত হবে। অধিকারহীনদের মধ্যেও একটি গোত্র আছেন, যাঁরা সংঘর্ষের বদলে উত্তরণে বিশ্বাসী। তাঁরা দেখেন ইংরেজি শিখলে সুবিধা অনেক, তাই ওই ভাষাটি তাঁরা আয়ত্ত করেন, নিজে না পারলে সন্তানকে দিয়ে আয়ত্ত করান। একটি উদাহরণ দেয়া যাক : জনাব ক মেধাবী ছিলেন না; পঞ্চাশের দশকে নিম্নতম বিভাগে মাধ্যমিক ও কলা পাশ করেছিলেন। অমন যোগ্যতা নিয়ে উন্নাসিক ইংরেজি বিভাগে প্রবেশে তাঁর অধিকার ছিলো না। যেহেতু মা ও বাঙলা বিভাগই সমস্ত অক্ষম সন্তানের শেষ আশ্রয়, তাই তিনি বাঙলা বিভাগে ঢুকেছিলেন। পরে তিনি নানা সুবিধাজনক সরণীতে ঘুরে ঘুরে এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সন্তানেরা স্বাস্থ্যবান, মেধাবী; তাদের ওঠা দরকার আরো উচ্চে; তাই জনাব ক মেধাবী সন্তানদের বাঙলা বিভাগে পাঠাবার কথা ভাববেনই না, পাঠাবেন ইংরেজি বিভাগে। সুবিধাবাদীদের শ্রেণীউত্তরণ এখন; বাঙলাদেশে এ-প্রক্রিয়ায়ই ঘটছে।